- M A Nayeemশুকতারা
- Posts : 68
স্বর্ণমুদ্রা : 1282
মর্যাদা : 20
Join date : 2021-05-22
তিন চন্দ্রদিন
Fri Jun 04, 2021 4:48 pm
- প্রথম অধ্যায় -
১| ভয়াবহ গভীর অন্ধকারে আচ্ছন্ন চারিদিক। আকাশের অগণিত তারার উপস্থিতি ছাড়া চোখে পড়ার মত কিছুই যেন নেই এখানে। অন্ধকার তার বিশাল কালো চাদর দিয়ে ঢেকে রেখেছে পুরো তৃণভূমি।
আরকান রাজ্যের গহীন এক জঙ্গলের ধার ঘেষে বেড়ে ওঠা এই তৃণভূমিতে তাবু খাটিয়েছি আমরা। রাজ্যের চরম সংকটাপূর্ণ মুহুর্তে গঠিত এই অভিযাত্রী দলে আমার সাথে রয়েছে আমার ঘনিষ্ট বন্ধু ও সহযোগী যোদ্ধা খাজা, রাজ্যের প্রধান উপদেষ্টা আয়াজ এবং সেনাপতি রাজন। তাছাড়াও রয়েছে অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন তিনজন প্রহরী।
আমাদের শিবিরে মাঝখানের একটি জায়গায় হালকা নীল আগুন জ্বলছিল। আগুনের চারপাশ ঘিরে বসে সবাই তাপ নিচ্ছিল, সাথে চলছিল একটু আড্ডা ও পানীয়। সারাদিনের দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর যাত্রার পর এই বিরতিটুকু খুবই প্রয়োজন হয়ে পড়েছিলো। তাছাড়া রাত্রি প্রহরে গভীর এই জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যাত্রা বেশ বিপদজনকও মনে হচ্ছিলো। তাই রাতটা এখানেই কাটিয়ে দিতে চায় সবাই।
একটু সামনের দিকে ঝুঁকে অত্যন্ত গম্ভীর ভঙ্গিতে ভয়ানক এক কাহিনী শোনাচ্ছিলেন উপদেষ্ঠা আয়াজ। “আমি শুনেছিলাম এখনো এই জঙ্গলেই গা ঢাকা দিয়ে আছে সেই ভয়াবহ দানব ডাকসা। যদিও আশেপাশের গ্রামবাসীরা আর কখনো তাকে দেখতে পেয়েছে বলে অভিযোগ করেনি।” কথাটি শেষ করেই একবার আমার দিকে তাকালেন উপদেষ্টা। “মহামান্য রাজকুমার, কিছুটা ভীত দেখাচ্ছে আপনাকে। আমি দুঃখিত, যদি আমার কাহিনী তার জন্য দায়ী হয়ে থাকে।”
“না, না। মোটেও তা নয়। আমি ঠিক আছি।” প্রায় সাথে সাথেই আমি মাথা নেড়ে জবাব দিলাম। “তা … তারপর কি ঘটেছিলো?” যদিও ইতস্তত ভাবটা লুকোতে পারলাম না।
“তারপর আর কিছুই ঘটেনি, রাজকুমার।” একটু থামলেন উপদেষ্টা। “আর কখনো দেখা যায়নি ডাকসাকে।”
“পালানোর সময় গুরুতর আহত হয়েছিলো সে।” কথাটি যোগ করলেন সেনাপতি রাজন। “এতদিনে নিশ্চয়ই কঙ্কালে পরিনত হয়েছে ডাকসা।” একটু থামলেন সেনাপতি। তারপর বললেন, “আজকের জন্য অনেক হয়েছে। এবার তাবুতে ফিরে যাওয়া উচিত। কাল চাঁদ ওঠার আগেই রওনা দিতে হবে আমাদের। অনেক লম্বা পথ রয়েছে সামনে।” আমার চোখে চোখ রাখলেন রাজন। আমি সম্মতি জানালাম।
তাবুতে ফিরেই দেরী না করে শোবার জন্য প্রস্তুতি নিলাম। সারাদিনের যাত্রায় প্রচুর ধকল গেছে, তাই ভেবেছিলাম বিছানায় গেলেই ঘুম চলে আসবে। কিন্তু আদতে এমনটা ঘটলো না।
নানান দুশ্চিন্তা ভর করলো আমার মাথায়। দুশ্চিন্তা এই রাজ্য নিয়ে, রাজ্যের রাজাকে নিয়ে। কারন আরকান রাজ্যের রাজা মনসুর তথা আমার পিতা এখন যে কেবলই এক নিশ্চল, নিথর মূর্তি। ছলনাময়ী ডাইনী মালিকা তাকে প্রেমের মায়াজালে ফাঁসিয়ে মূর্তিতে পরিণত করেছে, চুরি করে নিয়েছে তাঁর হাতের আংটি তথা রাজ্যের অমর রত্ন। এই রত্নের অনুপস্থিতিতে শুকিয়ে যাবে রাজ্যের সকল পানির উৎস নদী-নালা, খালবিল। বন্ধ হয়ে যাবে কৃষিকাজ, বিলীন হয়ে যাবে সশ্যক্ষেত্র। দেখা দেবে দুর্ভিক্ষ।
কিন্তু এটাই সবচেয়ে বড় বিপদ নয়। রাজা মনসুরকে পূর্বের মনুষ্য অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে আমাদের হাতে যে আর মাত্র তিন চন্দ্রদিনই অবশিষ্ট আছে! এই সময় অতিবাহিত হয়ে গেলে চিরস্থায়ী রুপ নেবে রাজার এই পরিনতি।
তাই কোন রকম কালক্ষেপন না করে জরুরী এক সভা ডেকে গঠন করা হয়েছে এই অভিযাত্রী দল।
আমাদের এই অতিগুরুত্বপূর্ণ ও গোপনীয় অভিযাত্রা উত্তর গোলার্ধ অভিমুখে, যেখানে সন্ধান মিলবে জ্ঞানী বৃক্ষের। হয়তো সে-ই এখন আমাদের একমাত্র সাহায্যকর্তা।
এই জ্ঞানী বৃক্ষের কথা উল্লেখ আছে রাজ্য গ্রন্থে। আরকান রাজ্যের পূর্বপুরুষেরা তাদের লিখিত বানীতে বলে গেছেন, “যদি তোমরা কখনো এমন কোন বিপদের সম্মুখীন হও, যা থেকে পরিত্রাণের উপায় তোমাদের জানা নেই, তবে মনে রেখো তার সমাধান আছে জ্ঞানী বৃক্ষের কাছে।”
তাই এই অভিযানই আমাদের শেষ ভরসা। রাজার অনুপস্থিতিতে আমার বড় ভ্রাতা রাজপুত্র জাকির এখন রাজ্য দেখাশুনা করছে।
এতসব চিন্তার মাঝে এখন নতুন করে যুক্ত হল ডাকসার ব্যপারটি। কেননা উত্তর গোলার্ধে যাত্রাপথে আমাদের অতিক্রম করতে হবে ডাকসার এই গভীর জঙ্গল। তাছাড়া সেনাপতি যতই দাবী করুক, ডাকসার মত নরপশু এতো সহজে শেষ হয়ে যাবে, আমার তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
হটাতই জঙ্গল ভেদ করে ক্ষীণ একটা শব্দ কানে ভেসে এলো আমার। অনেকটা শুকনো পাতার মর্মর শব্দ, যেন অদুরেই জঙ্গলের ভেতর দিয়ে কেউ একজন হেঁটে বেড়াচ্ছে।
আমি কান খাড়া করে শব্দটা শোনার চেষ্টা করলাম। লক্ষ্য করলাম ধীরে ধীরে আরও স্পষ্টতর হয়ে উঠছে সেটা, যেন জঙ্গল ছেড়ে এবার খোলা তৃণভূমির দিকেই এগিয়ে আসছে। আসছে ঠিক আমারই দিকে, ভারী পদক্ষেপ ফেলে!
জানি না কতগুলি মুহূর্ত কেটেছে এভাবে, হটাতই মনে হলো তাবুর ঠিক ওপারে এসে থেমেছে জিনিসটা। ওটার ভারী জান্তব নিঃশাস এসে পড়ছিল আমার তাবুর উপর। ঠিক যেন অস্থিরভাবে তাবুর চারিদিকে পায়চারী করে বেড়াচ্ছে আর ঘন ঘন নিঃশাস ফেলছে। আমার পা দুটি অবশ হয়ে এলো এবার। প্রচন্ড ইচ্ছা সত্তেও এক চুল নাড়াতে পারলাম না। এই সেই ভয়াবহ নরপশু ডাকসা নয়তো!
(২)
আমি খুব সন্তর্পণে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। আমার ডানে তাবুর এক কোনে আমার তরবারি ও ঢালটি রাখা ছিল। খুব সাবধানে সেদিকে এগিয়ে গেলাম। এক হাতে তরবারি ও অন্য হাতে ঢালটি তুলে নিলাম। তখনো স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম পশুটি আমার তাবুর আশেপাশে পায়চারী করে বেড়াচ্ছে। সেটার ভারী পদক্ষেপ আর ঘন নিঃশ্বাসে আমার গাঁয়ে কাঁটা দিয়ে উঠছিল। মনে হচ্ছিলো বড় কোন বিপদের সম্মুখীন হতে চলেছি।
এভাবে কেটে গেছে পরের বেশ কয়েকটি মুহূর্ত। কিন্তু যেমনটা আশংকা করেছিলাম, তেমন কিছু ঘটল না।
হটাত এক আর্তচিৎকারে সতবিত ফিরে এল আমার। চিৎকারটা আমাদেরই কোন এক তাবু থেকে এসেছে। আমি তড়িঘড়ি করে বাইরে বেরিয়ে এলাম। দেখতে পেলাম অদূরে একটি তাবুতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে! ইতিমধ্যেই শোরগোল পড়ে গেছে পুরো শিবিরে। আকাশে তাকাতেই চোখে পড়লো কয়েকটা ডাইনী জাদুর লাঠিতে ভর করে উড়ে বেড়াচ্ছে। তাদের বীভৎস খিল খিল হাসির শব্দ আমার কানে ভেসে এল। ডাইনিগুলি আমাদের তাবু লক্ষ্য করে আগুনের গোলা নিক্ষেপ করছে।
এর কিছুক্ষনের মধ্যেই হন্তদন্ত করে এদিকে ছুটে আসলেন সেনাপতি। তার পিছনে উপদেষ্টা আয়াজ ও আমার বন্ধু খাজাও ছিল। সবার চোখে মুখে স্পষ্ট আতংকের ছাপ। সেনাপতিকে সবচেয়ে বেশি বিচলিত দেখাচ্ছিল। আমি আগে কখনো তাকে এত বিচলিত হতে দেখিনি।
“রাজকুমার, আমি আমার সৈন্যদের নিয়ে ডাইনিদের ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছি, আপনারা সুযোগ পেলেই জঙ্গলের দিকে ছুটে পালাবেন।” কথাটি খুব দ্রুতই শেষ করলেন সেনাপতি। তারপর তাকালেন অন্যদের দিকে। “খাজা, রাজকুমারের দিকে খেয়াল রাখবেন। আর আয়াজ, আশা করি আমাদের আবার দেখা হবে।” কথাটি শেষ করেই মুখ ঘুরিয়ে নিলেন সেনাপতি। আর দ্রুতই মিলিয়ে গেলেন অন্ধকারে। যেন এটাই শেষবারের মত তার সাথে আমাদের দেখা।
খাজা আমাদের দুজনের হাত ধরল, আমাদের টেনে নিচু করে একটি তাবুর আড়ালে নিয়ে গেল। সেখানে চুপচাপ অপেক্ষা করতে লাগলাম আমরা।
“একজন সৈন্য ইতিমধ্যেই মারা পড়েছে।” ফিসফিস করে কথাটি বলল খাজা।
“ডাইনিরা সংখায় অনেক বেশি, সেনাপতির তাদের সাথে পেরে ওঠার সম্ভাবনা খুবই ক্ষিন।” ভীষণ দুশ্চিন্তাগ্রস্থ দেখাচ্ছিল আয়াজকে। “ডাইনিদের উদ্দেশ্য খুবই স্পষ্ট, আমাদের শেষ করতে এখানে এসেছে তারা। মালিকা পাঠিয়েছে তাদের।” তিনি বললেন।
“কিন্তু আমি ভেবে পাচ্ছি না, মালিকা আমাদের খোঁজ পেল কি করে?” আমি প্রশ্ন করলাম। কেউ কোন উত্তর দিল না। সম্ভবত এর উত্তর কারো জানা নেই।
হটাৎ লক্ষ্য করলাম শিবিরের অন্য দিকটায় ছুটে যাচ্ছে ডাইনিরা। তাদের দিকে তীর নিক্ষেপ করা হচ্ছে। বুঝতে পারলাম, আমাদের পালানোর সময় হয়েছে এবার। খুব দ্রুত সবাই জঙ্গলের দিকে ছুটতে শুরু করলাম।
পালানোর সময় আমি বার বার পেছনে ফিরে তাকাচ্ছিলাম। ডাইনিগুলি অবিরত আগুনের গোলা নিক্ষেপ করে চলছিলো আর বীভৎসভাবে খিল খিল করে হেসে চলছিলো। তাদের ঐ শক্তিশালী অস্ত্রের বিরুদ্ধে আমাদের ওই তীর বড়ই ঠুনকো মনে হচ্ছিলো।
সবগুলি তাবুতে আগুন লেগে গিয়েছিল। আগুনের লেলিহান শিখা দাউ দাউ করে উপরে উঠে চলছিলো। হটাতই সেনাপতিকে নিয়ে আমার ভীষণ চিন্তা হল। পিতৃতুল্য এই সেনাপতি আমার পিতার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুও বটে। জানি না তাঁর সাথে আর কখনো দেখা হবে কিনা?
আমরা ছুটে চলেছি। জানা নেই কতক্ষন এভাবে ছুটেছি। এক সময় জঙ্গলের গহীনে প্রবেশ করলাম। বেশ খানিকটা দূরে এসে থামলাম সবাই। চিৎকার আর কোলাহলের শব্দ এখানে অনেকটাই কমে এসেছে। এক মুহূর্তের জন্য মাটিতে বসে পড়লাম সবাই। টানা দৌড়ে হাঁপিয়ে গেছি। একটু জিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলাম।
“আমাদের হাতে বেশি সময় নেই। এই জায়গা বেশিক্ষনের জন্য নিরাপদ নয়।” একটি মশাল জ্বালিয়ে মাটিতে গাড়ল খাজা। তারপর থলে থেকে আরকান রাজ্যের মানচিত্রটি বের করলো। সেটি মাটিতে রেখে তার তর্জনী রাখল সেটার উপর।
“জঙ্গলের উত্তর-পূর্ব দিকে যেতে হবে আমাদের। সামনে একটি নালা পড়বে, তারপর মোড় নিতে হবে ডানে।”
“আমরা সরাসরি উত্তর দিক দিয়ে যাচ্ছি না কেন?” প্রশ্ন করলেন আয়াজ।
“কেননা উত্তর দিকটা ডাকসার অঞ্চল ছিল। আর তাছাড়া উত্তর-পূর্ব দিয়ে আমি আগেও যাত্রা করেছি।” বলল খাজা।
আয়াজ কোন কথা বাড়ালেন না। আমার দিকে তাকালেন। থলে থেকে অদ্ভুত আকৃতির একটি পাথর বের করলেন। আমার হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন, “এটা রাখুন, রাজকুমার।”
“কি এটা?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
জবাবে তিনি শুধু বললেন, “সময় হলেই জানতে পারবেন।”
মশালটি হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো খাজা, তারপর এগিয়ে চলল উত্তর-পূর্ব দিকে। আমি ও আয়াজ তাঁকে অনুসরন করলাম।
খাজা একজন অত্যন্ত দক্ষ ও সাহসী যোদ্ধা। সেনাপতির সাথে অনেক অভিযান পরিচালনা করেছে সে। এই রাজ্যের অনেক দুর্গম অঞ্চলে যাত্রার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। তাই এই মুহূর্তে তার উপর ভরসা রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে হল আমার।
(৩)
আকাশে বিশাল থালার মত করে দিনের চাঁদ উঠেছে। চাঁদের রুপালী আলোয় সামনের পথটা এখন অনেকটাই পরিষ্কার দেখাচ্ছে। ছেলেবেলায় রুপকথার বইতে পড়েছিলাম, কোন এক পৃথিবীতে চাঁদ ছাড়াও অন্য একটি নক্ষত্র রয়েছে, যা চাঁদের চেয়েও হাজারগুণ বেশি আলো দেয়। এই মুহূর্তে তাই ভীষণ আফসোস হচ্ছিলো ভেবে, যদি আমাদের পৃথিবীতেও ওরকম কিছু থাকতো।
বেশ দীর্ঘ একটা সময় এভাবে নিদ্রাহীন, বিরতিহীনভাবে যাত্রার পর ক্লান্তি যেন ভর করে বসলো আমার উপর। যদিও হ্রদ থেকে খুব বেশি দূরে নেই আমরা, কিন্তু বিশ্রাম নেয়াটা এবার যেন বড্ড বেশি প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। তাই একটু ফাঁকা জায়গা পেতেই আমি একটি টিবির উপর বসে পড়লাম। “বড্ড হাঁপিয়ে গিয়েছি।” বললাম আমি।
আমার অবস্থা দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল খাজা। তার হাতের মশালটি মাটিতে গেড়ে রাখল। বলল, “আমরা তো প্রায় হ্রদের কাছাকাছি চলে এসেছি।” খাজার চেহারাতেও ছিল ক্লান্তির ছাপ।
আয়াজ কিন্তু কোন রকম কথা বললেন না। চুপচাপ আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। বিষণ্ণ দৃষ্টিতে একবার এদিক ওদিক তাকালেন। চেহারায় তাঁর ভীত সন্ত্রস্ত ভাব।
“উপদেষ্টা, কোন সমস্যা?” আমি স্থির দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকালাম।
“না, তেমন কিছু নয়, রাজকুমার।” অন্যমনস্ক হয়ে উত্তর দিলেন তিনি।
“কিছু মনে করবেন না, আপনাকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে। কিছু একটা নিয়ে ভাবছেন আপনি।” সরাসরি বললাম কথাটা।
“আমার মনে হচ্ছে কিছু একটা আমাদের উপর নজর রাখছে।” এবার মুখ খুললেন আয়াজ। তাঁর কণ্ঠ শান্ত। “আমরা কোথাও একটা ভুল করছি।”
আয়াজের কথা শুনে নিচু করে মাথা নাড়তে লাগলো খাজা। ভীষণ হতাশ দেখাচ্ছিল তাকে। উপদেষ্টার কথা যেন মেনেই নিতে পারছিল না সে।
“আপনি কী ভাবছেন …” আমি কথাটি সম্পূর্ণ করতে পারলাম না। আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে আয়াজ বললেন, “না, এটা ডাকসা নয়।” বরফ শীতল তাঁর কণ্ঠ।
“কি বলছেন এসব? এখানে ঐ নরপশুর কথা আসলো কেন?” এবার সত্যি সত্যি বিরক্ত খাজা। হয়তো কিছুটা ভীতও। “দেখুন আয়াজ, এভাবে নষ্ট করার মত সময় আমাদের হাতে নেই।” খাজা উঠে দাঁড়ালো। এক হাতে মশালটি তুলে নিল।
হটাতই লক্ষ্য করলাম ব্যাপারটা। জঙ্গলের গভীর থেকে কয়েক জোড়া চোখ জ্বলজ্বল করে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি সাথে সাথে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম আয়াজের দিকে, সে নিজেও লক্ষ্য করেছে। কারো মুখ থেকে কোন রা বেরুল না। আয়াজের কথাই তাহলে ঠিক, কেউ আমাদের উপর নজর রাখছে।
কিছুক্ষনের মধ্যে আরও স্পষ্ট হল ব্যাপারটা। অন্তত ডজন খানেক চোখ আমাদের চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে। আমি ধীরে ধীরে আমার তরবারির হাতলের উপর হাত রাখলাম। সাবধানে তরবারিটি খোলসছাড়া করলাম। চোখগুলি যেন কিছু একটা আঁচ করতে পারলো। ধীরে ধীরে জঙ্গলের গভীর থেকে আমাদের দিকে আরও এগিয়ে আসতে লাগলো।
একসময় চারিদিক থেকে সেগুলি আমাদের ঘিরে ফেলল। চাঁদের আলোয় এবার স্পষ্ট দেখতে পেলাম সবকিছু। ওদের মুখগুলি অর্ধেক হা হয়ে ছিল, অনবরত লালা ঝরছিল সেখান থেকে। ভয়ানক তীক্ষ্ণ দাঁতগুলি চকচক করছিলো। চাহুনিতে ছিল অস্বাভাবিক হিংস্রতা। এগুলো হায়েনা। একটা নয়, দুটো নয়। অনেকগুলি!
তাদের আচরণ মোটেও স্বাভাবিক মনে হচ্ছিলো না। কেন যেন মনে হল, কোন সাধারণ হায়েনা এরা নয়। আমাদের চোখের ভাষা যেন পড়ছিল তারা। সবকিছু বুঝতে পারছিল, আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ, চিন্তা, পরিকল্পনা, সবকিছু।
হটাত কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটি হায়েনা অতর্কিতভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ল আয়াজের উপর। মুহূর্তের এই হামলায় নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারালেন আয়াজ। পড়ে গেলেন মাটিতে। আর সেখানেই ঘটলো বিপত্তি। অন্য একটি হায়েনা তাঁর ঘাড়ে কামড় বসিয়ে দিল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই, তাকে টেনে হিঁচড়ে জঙ্গলের দিকে নিয়ে যেতে শুরু করলো। মুখ দিয়ে শুধু অস্ফুট একটি শব্দ করতে পারলেন আয়াজ।
আমি চিৎকার করে উঠলাম, “খাজা, কিছু একটা করো।”
তরবারি হাতে নিয়ে তখনো স্থির দাঁড়িয়ে ছিল কিংকর্তব্যবিমুঢ় খাজা। যেন কি করতে হবে সেটাই ভুলে গেছে সে। আমি তরবারি নিয়ে দৌড়ে এগিয়ে গেলাম আয়াজের দিকে। কিন্তু ততক্ষনে অনেক বেশি দেরি হয়ে গেছে। হায়েনাগুলি আয়াজকে টেনে জঙ্গলের গভীরে অন্ধকারে নিয়ে গেছে।
“আয়াজ!” আমি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলাম। “ধরে থাকুন, আমি আসছি।” আর কোন সাড়া মিলল না তাঁর কাছ থেকে। অন্য একটি হায়েনা আমার পথ রোধ করে দাঁড়ালো।
আমি তরবারিটি দু-হাতে শক্ত করে ধরলাম। হায়েনাটির দিকে সেটা তাক করলাম। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম কোন রকম ভ্রুক্ষেপ হল না হায়েনাটির। পুরোপুরি অগ্রাহ্য করলো আমাকে। তাকিয়ে রইল এক দৃষ্টিতে, যেন আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।
“খাজা! মশাল দিয়ে ভয় দেখানোর চেষ্টা করো!” আমি চেঁচিয়ে উঠলাম। এবারও কোন উত্তর এল না।
আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না এখন কি করবো। হিংস্র এই অস্বাভাবিক জানোয়ারগুলির হাত থেকে কীভাবে রক্ষা পাবো। আমি মানুষের বিরুদ্ধে লড়াই করতে শিখেছি, এরকম অতিপ্রাকৃত ভয়ঙ্কর জন্তুর বিরুদ্ধে নয়। অগত্যা বিধাতার হাতেই নিজের ভাগ্য সঁপে দেয়া শ্রেয় মনে হল।
(৪)
হায়েনাগুলি চারিদিক থেকে আমাদের কোণঠাসা করে ফেলেছিল। আমরা পরস্পরের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে ওগুলির দিকে তরবারি তাক করে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
রাগে ক্ষোভে আমি যেন রীতিমতো কাঁপছিলাম। আমি দাঁতে দাঁত চেপে এক দৃষ্টিতে সেগুলির তাকিয়ে রইলাম। টের পেলাম আমার কপালের ঘাম গড়িয়ে চোয়ালে এসে ঠেকেছে।
ঠিক তখনই জঙ্গলের গভীর থেকে ভয়ংকর এক গর্জনের শব্দ ভেসে এল। পুরো জঙ্গলটি যেন কেঁপে উঠলো তাতে। ধক করে উঠলো আমার বুকের ভেতরটা। টের পেলাম গায়ের রোমগুলি খাড়া হয়ে গেছে। ভয়ে, বিস্ময়ে যেন হতবম্ব হয়ে পড়লাম।
এ কোন সাধারণ প্রাণী নয়। ভয়ঙ্কর, অতিপ্রাকৃতিক কিছু একটা।
“ডাকসা!” অস্ফুট স্বরে নামটি উচ্চারন করলো খাজা, যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না সে। “ডাকসা জীবিত!”
কেন জানি মনে হল, হায়েনাগুলি পেছনে সরে পড়েছে। যেন আমাদের মত সেগুলিও ভীত, সন্ত্রস্ত।
ভীত আমি নিজেও। কারন ভয়ঙ্কর গর্জনের মালিক ‘ডাকসা’ যে এদিকেই এগিয়ে আসছে। আসছে সবকিছু ছাপিয়ে, ভেঙ্গে চুড়ে। ওটার ভারী পদক্ষেপে কেঁপে উঠছিল পায়ের তলার মাটি।
হায়েনাগুলি ইতিমধ্যেই অদৃশ্য হয়ে গেছে। আমরা নিজেরাও পালানোর তাগিদ অনুভব করলাম। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। দানবটি লম্বা পদক্ষেপে খুব দ্রুতই আমাদের কাছে চলে এসেছে। জঙ্গল ছাড়িয়ে আমাদের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। রোধ করেছে সামনের পথটি।
এই প্রথমবারের মত ডাকসাকে দেখলাম আমি। লোমশ গায়ের বিশাল আকৃতির একটি নরপশু। হাতের থাবায় ধারালো নখর। মুখে সারি সারি ধারালো দাঁত। উজ্জ্বল চাঁদের আলোয় সেগুলি চকচক করছিলো।
জ্বলজ্বল চোখে এক দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল ডাকসা। চাহুনিতে ছিল নরকের হিংস্রতা।
ওটার ভারী জান্তব নিঃশ্বাস যেন চারিদিকের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে খান খান করে দিচ্ছিল।
আমি বুঝতে পারছিলাম কিছু একটা করার জন্য তৈরি হচ্ছে খাজা। হটাতই সে তার তরবারিটি খোলসছাড়া করলো। এক মুহূর্ত দেরি না করে ঝাঁপিয়ে পড়ল ডাকসার উপর।
কিন্তু খাজার ওই আক্রমণ নেহাতই ঠুনকো মনে হল, যেন এর কোন প্রভাবই পড়ল না ডাকসার উপর। ডাকসার এক থাবায় পরক্ষনেই খড়কুটোর মতো উড়ে গেল খাজা। ছিটকে পড়ল দূরে।
আমি চিৎকার করে উঠলাম কিন্তু কোন সাড়া মিলল না। এবার খাজার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে আমার দিকে তাকালো ডাকসা। এগিয়ে আসতে লাগলো সামনে। আমি ভয়ে, আতঙ্কে পিছিয়ে গেলাম কয়েক পা। কিন্তু হটাত কিছু একটার সাথে আটকে গেল আমার পা। সাথে সাথেই মাটিতে পড়ে গেলাম। তরবারিটি খসে পড়ল হাত থেকে।
আর কোন উপায় অন্তর না দেখে আমি আমার ঢালটি উঁচিয়ে ধরলাম। আত্মরক্ষার শেষ বৃথা চেষ্টা করলাম। কিন্তু পরক্ষনেই নাটকীয় কিছু একটা ঘটলো। হটাতই ডাকসা থমকে গেল। এক চুলও এগলো না আর। কিছু একটা ঘটেছে তার ভেতরে। স্থির দাঁড়িয়ে গেছে সে। তাকিয়ে আছে আমার ঢালের দিকে। যেন মূর্তি বনে গেছে।
হটাত আমি একটু নড়ে উঠতেই যেন ঘোর ভাঙল তার। সভয়ে পেছনে সরে গেল। কিছু একটা দেখেছে সে। এমন কিছু যার জন্য তৈরি ছিল না সে। তার মুখ দিয়ে আর্তনাদের মতো শুধু গরগর একটা আওয়াজ বেরোল। ঠিক পরক্ষনেই পেছনে ঘুরে ছুটে পালালো ডাকসা। মুহূর্তেই হারিয়ে গেল জঙ্গলের গভীরে।
ঘটনার আকস্মিকতায় আমি নিজেও হতবম্ব হয়ে পড়লাম। ঢালটির দিকে একবার তাকালাম। সেটার মুখ আমার দিকে ঘোরালাম। চাঁদের উজ্জ্বল আলোয় চকচক করছিলো ধাতব পাতটি। ঢালের মুখের উপর কিছু দেখেছে ডাকসা! নিজের চেহারা!
পরক্ষনেই আমি উঠে দাঁড়ালাম, ছুটে গেলাম অন্য দিকটায়। সেখানে খাজার নিশ্চল, নিথর দেহটা মাটিতে পড়ে ছিল। আমি হাঁটু গেড়ে বসে দু হাতে তার মাথাটা তুললাম। তার গালে কয়েকটা চড় লাগালাম। কিন্তু কোন সাড়া মিলল না। তার গলার ধমনির উপর হাত রাখতেই বুঝতে পারলাম অনেক দেরি হয়ে গেছে। সব শেষ হয়ে গেছে। খাজা নেই। চলে গেছে আমাকে ছেড়ে।
আমার চোখ দিয়ে যেন এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। আর যেন পারছিলাম না। সবাইকে হারাতে হারাতে যেন ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম।
একটা ডাইনী শেষ করে দিয়েছে সব। রাজ্য, রাজা, সেনাপতি, বন্ধু! সব। একা করে দিয়েছে আমাকে।
নিজের অজান্তেই কখন যেন মুষ্টি বদ্ধ হয়ে এল আমার হাত। দুঃখ পরিনত হল রাগে, ক্ষোভে, প্রতিহিংসায়। আমি যে মালিকাকে ছাড়ছি না।
১| ভয়াবহ গভীর অন্ধকারে আচ্ছন্ন চারিদিক। আকাশের অগণিত তারার উপস্থিতি ছাড়া চোখে পড়ার মত কিছুই যেন নেই এখানে। অন্ধকার তার বিশাল কালো চাদর দিয়ে ঢেকে রেখেছে পুরো তৃণভূমি।
আরকান রাজ্যের গহীন এক জঙ্গলের ধার ঘেষে বেড়ে ওঠা এই তৃণভূমিতে তাবু খাটিয়েছি আমরা। রাজ্যের চরম সংকটাপূর্ণ মুহুর্তে গঠিত এই অভিযাত্রী দলে আমার সাথে রয়েছে আমার ঘনিষ্ট বন্ধু ও সহযোগী যোদ্ধা খাজা, রাজ্যের প্রধান উপদেষ্টা আয়াজ এবং সেনাপতি রাজন। তাছাড়াও রয়েছে অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন তিনজন প্রহরী।
আমাদের শিবিরে মাঝখানের একটি জায়গায় হালকা নীল আগুন জ্বলছিল। আগুনের চারপাশ ঘিরে বসে সবাই তাপ নিচ্ছিল, সাথে চলছিল একটু আড্ডা ও পানীয়। সারাদিনের দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর যাত্রার পর এই বিরতিটুকু খুবই প্রয়োজন হয়ে পড়েছিলো। তাছাড়া রাত্রি প্রহরে গভীর এই জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যাত্রা বেশ বিপদজনকও মনে হচ্ছিলো। তাই রাতটা এখানেই কাটিয়ে দিতে চায় সবাই।
একটু সামনের দিকে ঝুঁকে অত্যন্ত গম্ভীর ভঙ্গিতে ভয়ানক এক কাহিনী শোনাচ্ছিলেন উপদেষ্ঠা আয়াজ। “আমি শুনেছিলাম এখনো এই জঙ্গলেই গা ঢাকা দিয়ে আছে সেই ভয়াবহ দানব ডাকসা। যদিও আশেপাশের গ্রামবাসীরা আর কখনো তাকে দেখতে পেয়েছে বলে অভিযোগ করেনি।” কথাটি শেষ করেই একবার আমার দিকে তাকালেন উপদেষ্টা। “মহামান্য রাজকুমার, কিছুটা ভীত দেখাচ্ছে আপনাকে। আমি দুঃখিত, যদি আমার কাহিনী তার জন্য দায়ী হয়ে থাকে।”
“না, না। মোটেও তা নয়। আমি ঠিক আছি।” প্রায় সাথে সাথেই আমি মাথা নেড়ে জবাব দিলাম। “তা … তারপর কি ঘটেছিলো?” যদিও ইতস্তত ভাবটা লুকোতে পারলাম না।
“তারপর আর কিছুই ঘটেনি, রাজকুমার।” একটু থামলেন উপদেষ্টা। “আর কখনো দেখা যায়নি ডাকসাকে।”
“পালানোর সময় গুরুতর আহত হয়েছিলো সে।” কথাটি যোগ করলেন সেনাপতি রাজন। “এতদিনে নিশ্চয়ই কঙ্কালে পরিনত হয়েছে ডাকসা।” একটু থামলেন সেনাপতি। তারপর বললেন, “আজকের জন্য অনেক হয়েছে। এবার তাবুতে ফিরে যাওয়া উচিত। কাল চাঁদ ওঠার আগেই রওনা দিতে হবে আমাদের। অনেক লম্বা পথ রয়েছে সামনে।” আমার চোখে চোখ রাখলেন রাজন। আমি সম্মতি জানালাম।
তাবুতে ফিরেই দেরী না করে শোবার জন্য প্রস্তুতি নিলাম। সারাদিনের যাত্রায় প্রচুর ধকল গেছে, তাই ভেবেছিলাম বিছানায় গেলেই ঘুম চলে আসবে। কিন্তু আদতে এমনটা ঘটলো না।
নানান দুশ্চিন্তা ভর করলো আমার মাথায়। দুশ্চিন্তা এই রাজ্য নিয়ে, রাজ্যের রাজাকে নিয়ে। কারন আরকান রাজ্যের রাজা মনসুর তথা আমার পিতা এখন যে কেবলই এক নিশ্চল, নিথর মূর্তি। ছলনাময়ী ডাইনী মালিকা তাকে প্রেমের মায়াজালে ফাঁসিয়ে মূর্তিতে পরিণত করেছে, চুরি করে নিয়েছে তাঁর হাতের আংটি তথা রাজ্যের অমর রত্ন। এই রত্নের অনুপস্থিতিতে শুকিয়ে যাবে রাজ্যের সকল পানির উৎস নদী-নালা, খালবিল। বন্ধ হয়ে যাবে কৃষিকাজ, বিলীন হয়ে যাবে সশ্যক্ষেত্র। দেখা দেবে দুর্ভিক্ষ।
কিন্তু এটাই সবচেয়ে বড় বিপদ নয়। রাজা মনসুরকে পূর্বের মনুষ্য অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে আমাদের হাতে যে আর মাত্র তিন চন্দ্রদিনই অবশিষ্ট আছে! এই সময় অতিবাহিত হয়ে গেলে চিরস্থায়ী রুপ নেবে রাজার এই পরিনতি।
তাই কোন রকম কালক্ষেপন না করে জরুরী এক সভা ডেকে গঠন করা হয়েছে এই অভিযাত্রী দল।
আমাদের এই অতিগুরুত্বপূর্ণ ও গোপনীয় অভিযাত্রা উত্তর গোলার্ধ অভিমুখে, যেখানে সন্ধান মিলবে জ্ঞানী বৃক্ষের। হয়তো সে-ই এখন আমাদের একমাত্র সাহায্যকর্তা।
এই জ্ঞানী বৃক্ষের কথা উল্লেখ আছে রাজ্য গ্রন্থে। আরকান রাজ্যের পূর্বপুরুষেরা তাদের লিখিত বানীতে বলে গেছেন, “যদি তোমরা কখনো এমন কোন বিপদের সম্মুখীন হও, যা থেকে পরিত্রাণের উপায় তোমাদের জানা নেই, তবে মনে রেখো তার সমাধান আছে জ্ঞানী বৃক্ষের কাছে।”
তাই এই অভিযানই আমাদের শেষ ভরসা। রাজার অনুপস্থিতিতে আমার বড় ভ্রাতা রাজপুত্র জাকির এখন রাজ্য দেখাশুনা করছে।
এতসব চিন্তার মাঝে এখন নতুন করে যুক্ত হল ডাকসার ব্যপারটি। কেননা উত্তর গোলার্ধে যাত্রাপথে আমাদের অতিক্রম করতে হবে ডাকসার এই গভীর জঙ্গল। তাছাড়া সেনাপতি যতই দাবী করুক, ডাকসার মত নরপশু এতো সহজে শেষ হয়ে যাবে, আমার তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
হটাতই জঙ্গল ভেদ করে ক্ষীণ একটা শব্দ কানে ভেসে এলো আমার। অনেকটা শুকনো পাতার মর্মর শব্দ, যেন অদুরেই জঙ্গলের ভেতর দিয়ে কেউ একজন হেঁটে বেড়াচ্ছে।
আমি কান খাড়া করে শব্দটা শোনার চেষ্টা করলাম। লক্ষ্য করলাম ধীরে ধীরে আরও স্পষ্টতর হয়ে উঠছে সেটা, যেন জঙ্গল ছেড়ে এবার খোলা তৃণভূমির দিকেই এগিয়ে আসছে। আসছে ঠিক আমারই দিকে, ভারী পদক্ষেপ ফেলে!
জানি না কতগুলি মুহূর্ত কেটেছে এভাবে, হটাতই মনে হলো তাবুর ঠিক ওপারে এসে থেমেছে জিনিসটা। ওটার ভারী জান্তব নিঃশাস এসে পড়ছিল আমার তাবুর উপর। ঠিক যেন অস্থিরভাবে তাবুর চারিদিকে পায়চারী করে বেড়াচ্ছে আর ঘন ঘন নিঃশাস ফেলছে। আমার পা দুটি অবশ হয়ে এলো এবার। প্রচন্ড ইচ্ছা সত্তেও এক চুল নাড়াতে পারলাম না। এই সেই ভয়াবহ নরপশু ডাকসা নয়তো!
(২)
আমি খুব সন্তর্পণে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। আমার ডানে তাবুর এক কোনে আমার তরবারি ও ঢালটি রাখা ছিল। খুব সাবধানে সেদিকে এগিয়ে গেলাম। এক হাতে তরবারি ও অন্য হাতে ঢালটি তুলে নিলাম। তখনো স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম পশুটি আমার তাবুর আশেপাশে পায়চারী করে বেড়াচ্ছে। সেটার ভারী পদক্ষেপ আর ঘন নিঃশ্বাসে আমার গাঁয়ে কাঁটা দিয়ে উঠছিল। মনে হচ্ছিলো বড় কোন বিপদের সম্মুখীন হতে চলেছি।
এভাবে কেটে গেছে পরের বেশ কয়েকটি মুহূর্ত। কিন্তু যেমনটা আশংকা করেছিলাম, তেমন কিছু ঘটল না।
হটাত এক আর্তচিৎকারে সতবিত ফিরে এল আমার। চিৎকারটা আমাদেরই কোন এক তাবু থেকে এসেছে। আমি তড়িঘড়ি করে বাইরে বেরিয়ে এলাম। দেখতে পেলাম অদূরে একটি তাবুতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে! ইতিমধ্যেই শোরগোল পড়ে গেছে পুরো শিবিরে। আকাশে তাকাতেই চোখে পড়লো কয়েকটা ডাইনী জাদুর লাঠিতে ভর করে উড়ে বেড়াচ্ছে। তাদের বীভৎস খিল খিল হাসির শব্দ আমার কানে ভেসে এল। ডাইনিগুলি আমাদের তাবু লক্ষ্য করে আগুনের গোলা নিক্ষেপ করছে।
এর কিছুক্ষনের মধ্যেই হন্তদন্ত করে এদিকে ছুটে আসলেন সেনাপতি। তার পিছনে উপদেষ্টা আয়াজ ও আমার বন্ধু খাজাও ছিল। সবার চোখে মুখে স্পষ্ট আতংকের ছাপ। সেনাপতিকে সবচেয়ে বেশি বিচলিত দেখাচ্ছিল। আমি আগে কখনো তাকে এত বিচলিত হতে দেখিনি।
“রাজকুমার, আমি আমার সৈন্যদের নিয়ে ডাইনিদের ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছি, আপনারা সুযোগ পেলেই জঙ্গলের দিকে ছুটে পালাবেন।” কথাটি খুব দ্রুতই শেষ করলেন সেনাপতি। তারপর তাকালেন অন্যদের দিকে। “খাজা, রাজকুমারের দিকে খেয়াল রাখবেন। আর আয়াজ, আশা করি আমাদের আবার দেখা হবে।” কথাটি শেষ করেই মুখ ঘুরিয়ে নিলেন সেনাপতি। আর দ্রুতই মিলিয়ে গেলেন অন্ধকারে। যেন এটাই শেষবারের মত তার সাথে আমাদের দেখা।
খাজা আমাদের দুজনের হাত ধরল, আমাদের টেনে নিচু করে একটি তাবুর আড়ালে নিয়ে গেল। সেখানে চুপচাপ অপেক্ষা করতে লাগলাম আমরা।
“একজন সৈন্য ইতিমধ্যেই মারা পড়েছে।” ফিসফিস করে কথাটি বলল খাজা।
“ডাইনিরা সংখায় অনেক বেশি, সেনাপতির তাদের সাথে পেরে ওঠার সম্ভাবনা খুবই ক্ষিন।” ভীষণ দুশ্চিন্তাগ্রস্থ দেখাচ্ছিল আয়াজকে। “ডাইনিদের উদ্দেশ্য খুবই স্পষ্ট, আমাদের শেষ করতে এখানে এসেছে তারা। মালিকা পাঠিয়েছে তাদের।” তিনি বললেন।
“কিন্তু আমি ভেবে পাচ্ছি না, মালিকা আমাদের খোঁজ পেল কি করে?” আমি প্রশ্ন করলাম। কেউ কোন উত্তর দিল না। সম্ভবত এর উত্তর কারো জানা নেই।
হটাৎ লক্ষ্য করলাম শিবিরের অন্য দিকটায় ছুটে যাচ্ছে ডাইনিরা। তাদের দিকে তীর নিক্ষেপ করা হচ্ছে। বুঝতে পারলাম, আমাদের পালানোর সময় হয়েছে এবার। খুব দ্রুত সবাই জঙ্গলের দিকে ছুটতে শুরু করলাম।
পালানোর সময় আমি বার বার পেছনে ফিরে তাকাচ্ছিলাম। ডাইনিগুলি অবিরত আগুনের গোলা নিক্ষেপ করে চলছিলো আর বীভৎসভাবে খিল খিল করে হেসে চলছিলো। তাদের ঐ শক্তিশালী অস্ত্রের বিরুদ্ধে আমাদের ওই তীর বড়ই ঠুনকো মনে হচ্ছিলো।
সবগুলি তাবুতে আগুন লেগে গিয়েছিল। আগুনের লেলিহান শিখা দাউ দাউ করে উপরে উঠে চলছিলো। হটাতই সেনাপতিকে নিয়ে আমার ভীষণ চিন্তা হল। পিতৃতুল্য এই সেনাপতি আমার পিতার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুও বটে। জানি না তাঁর সাথে আর কখনো দেখা হবে কিনা?
আমরা ছুটে চলেছি। জানা নেই কতক্ষন এভাবে ছুটেছি। এক সময় জঙ্গলের গহীনে প্রবেশ করলাম। বেশ খানিকটা দূরে এসে থামলাম সবাই। চিৎকার আর কোলাহলের শব্দ এখানে অনেকটাই কমে এসেছে। এক মুহূর্তের জন্য মাটিতে বসে পড়লাম সবাই। টানা দৌড়ে হাঁপিয়ে গেছি। একটু জিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলাম।
“আমাদের হাতে বেশি সময় নেই। এই জায়গা বেশিক্ষনের জন্য নিরাপদ নয়।” একটি মশাল জ্বালিয়ে মাটিতে গাড়ল খাজা। তারপর থলে থেকে আরকান রাজ্যের মানচিত্রটি বের করলো। সেটি মাটিতে রেখে তার তর্জনী রাখল সেটার উপর।
“জঙ্গলের উত্তর-পূর্ব দিকে যেতে হবে আমাদের। সামনে একটি নালা পড়বে, তারপর মোড় নিতে হবে ডানে।”
“আমরা সরাসরি উত্তর দিক দিয়ে যাচ্ছি না কেন?” প্রশ্ন করলেন আয়াজ।
“কেননা উত্তর দিকটা ডাকসার অঞ্চল ছিল। আর তাছাড়া উত্তর-পূর্ব দিয়ে আমি আগেও যাত্রা করেছি।” বলল খাজা।
আয়াজ কোন কথা বাড়ালেন না। আমার দিকে তাকালেন। থলে থেকে অদ্ভুত আকৃতির একটি পাথর বের করলেন। আমার হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন, “এটা রাখুন, রাজকুমার।”
“কি এটা?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
জবাবে তিনি শুধু বললেন, “সময় হলেই জানতে পারবেন।”
মশালটি হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো খাজা, তারপর এগিয়ে চলল উত্তর-পূর্ব দিকে। আমি ও আয়াজ তাঁকে অনুসরন করলাম।
খাজা একজন অত্যন্ত দক্ষ ও সাহসী যোদ্ধা। সেনাপতির সাথে অনেক অভিযান পরিচালনা করেছে সে। এই রাজ্যের অনেক দুর্গম অঞ্চলে যাত্রার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। তাই এই মুহূর্তে তার উপর ভরসা রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে হল আমার।
(৩)
আকাশে বিশাল থালার মত করে দিনের চাঁদ উঠেছে। চাঁদের রুপালী আলোয় সামনের পথটা এখন অনেকটাই পরিষ্কার দেখাচ্ছে। ছেলেবেলায় রুপকথার বইতে পড়েছিলাম, কোন এক পৃথিবীতে চাঁদ ছাড়াও অন্য একটি নক্ষত্র রয়েছে, যা চাঁদের চেয়েও হাজারগুণ বেশি আলো দেয়। এই মুহূর্তে তাই ভীষণ আফসোস হচ্ছিলো ভেবে, যদি আমাদের পৃথিবীতেও ওরকম কিছু থাকতো।
বেশ দীর্ঘ একটা সময় এভাবে নিদ্রাহীন, বিরতিহীনভাবে যাত্রার পর ক্লান্তি যেন ভর করে বসলো আমার উপর। যদিও হ্রদ থেকে খুব বেশি দূরে নেই আমরা, কিন্তু বিশ্রাম নেয়াটা এবার যেন বড্ড বেশি প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। তাই একটু ফাঁকা জায়গা পেতেই আমি একটি টিবির উপর বসে পড়লাম। “বড্ড হাঁপিয়ে গিয়েছি।” বললাম আমি।
আমার অবস্থা দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল খাজা। তার হাতের মশালটি মাটিতে গেড়ে রাখল। বলল, “আমরা তো প্রায় হ্রদের কাছাকাছি চলে এসেছি।” খাজার চেহারাতেও ছিল ক্লান্তির ছাপ।
আয়াজ কিন্তু কোন রকম কথা বললেন না। চুপচাপ আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। বিষণ্ণ দৃষ্টিতে একবার এদিক ওদিক তাকালেন। চেহারায় তাঁর ভীত সন্ত্রস্ত ভাব।
“উপদেষ্টা, কোন সমস্যা?” আমি স্থির দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকালাম।
“না, তেমন কিছু নয়, রাজকুমার।” অন্যমনস্ক হয়ে উত্তর দিলেন তিনি।
“কিছু মনে করবেন না, আপনাকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে। কিছু একটা নিয়ে ভাবছেন আপনি।” সরাসরি বললাম কথাটা।
“আমার মনে হচ্ছে কিছু একটা আমাদের উপর নজর রাখছে।” এবার মুখ খুললেন আয়াজ। তাঁর কণ্ঠ শান্ত। “আমরা কোথাও একটা ভুল করছি।”
আয়াজের কথা শুনে নিচু করে মাথা নাড়তে লাগলো খাজা। ভীষণ হতাশ দেখাচ্ছিল তাকে। উপদেষ্টার কথা যেন মেনেই নিতে পারছিল না সে।
“আপনি কী ভাবছেন …” আমি কথাটি সম্পূর্ণ করতে পারলাম না। আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে আয়াজ বললেন, “না, এটা ডাকসা নয়।” বরফ শীতল তাঁর কণ্ঠ।
“কি বলছেন এসব? এখানে ঐ নরপশুর কথা আসলো কেন?” এবার সত্যি সত্যি বিরক্ত খাজা। হয়তো কিছুটা ভীতও। “দেখুন আয়াজ, এভাবে নষ্ট করার মত সময় আমাদের হাতে নেই।” খাজা উঠে দাঁড়ালো। এক হাতে মশালটি তুলে নিল।
হটাতই লক্ষ্য করলাম ব্যাপারটা। জঙ্গলের গভীর থেকে কয়েক জোড়া চোখ জ্বলজ্বল করে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি সাথে সাথে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম আয়াজের দিকে, সে নিজেও লক্ষ্য করেছে। কারো মুখ থেকে কোন রা বেরুল না। আয়াজের কথাই তাহলে ঠিক, কেউ আমাদের উপর নজর রাখছে।
কিছুক্ষনের মধ্যে আরও স্পষ্ট হল ব্যাপারটা। অন্তত ডজন খানেক চোখ আমাদের চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে। আমি ধীরে ধীরে আমার তরবারির হাতলের উপর হাত রাখলাম। সাবধানে তরবারিটি খোলসছাড়া করলাম। চোখগুলি যেন কিছু একটা আঁচ করতে পারলো। ধীরে ধীরে জঙ্গলের গভীর থেকে আমাদের দিকে আরও এগিয়ে আসতে লাগলো।
একসময় চারিদিক থেকে সেগুলি আমাদের ঘিরে ফেলল। চাঁদের আলোয় এবার স্পষ্ট দেখতে পেলাম সবকিছু। ওদের মুখগুলি অর্ধেক হা হয়ে ছিল, অনবরত লালা ঝরছিল সেখান থেকে। ভয়ানক তীক্ষ্ণ দাঁতগুলি চকচক করছিলো। চাহুনিতে ছিল অস্বাভাবিক হিংস্রতা। এগুলো হায়েনা। একটা নয়, দুটো নয়। অনেকগুলি!
তাদের আচরণ মোটেও স্বাভাবিক মনে হচ্ছিলো না। কেন যেন মনে হল, কোন সাধারণ হায়েনা এরা নয়। আমাদের চোখের ভাষা যেন পড়ছিল তারা। সবকিছু বুঝতে পারছিল, আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ, চিন্তা, পরিকল্পনা, সবকিছু।
হটাত কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটি হায়েনা অতর্কিতভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ল আয়াজের উপর। মুহূর্তের এই হামলায় নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারালেন আয়াজ। পড়ে গেলেন মাটিতে। আর সেখানেই ঘটলো বিপত্তি। অন্য একটি হায়েনা তাঁর ঘাড়ে কামড় বসিয়ে দিল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই, তাকে টেনে হিঁচড়ে জঙ্গলের দিকে নিয়ে যেতে শুরু করলো। মুখ দিয়ে শুধু অস্ফুট একটি শব্দ করতে পারলেন আয়াজ।
আমি চিৎকার করে উঠলাম, “খাজা, কিছু একটা করো।”
তরবারি হাতে নিয়ে তখনো স্থির দাঁড়িয়ে ছিল কিংকর্তব্যবিমুঢ় খাজা। যেন কি করতে হবে সেটাই ভুলে গেছে সে। আমি তরবারি নিয়ে দৌড়ে এগিয়ে গেলাম আয়াজের দিকে। কিন্তু ততক্ষনে অনেক বেশি দেরি হয়ে গেছে। হায়েনাগুলি আয়াজকে টেনে জঙ্গলের গভীরে অন্ধকারে নিয়ে গেছে।
“আয়াজ!” আমি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলাম। “ধরে থাকুন, আমি আসছি।” আর কোন সাড়া মিলল না তাঁর কাছ থেকে। অন্য একটি হায়েনা আমার পথ রোধ করে দাঁড়ালো।
আমি তরবারিটি দু-হাতে শক্ত করে ধরলাম। হায়েনাটির দিকে সেটা তাক করলাম। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম কোন রকম ভ্রুক্ষেপ হল না হায়েনাটির। পুরোপুরি অগ্রাহ্য করলো আমাকে। তাকিয়ে রইল এক দৃষ্টিতে, যেন আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।
“খাজা! মশাল দিয়ে ভয় দেখানোর চেষ্টা করো!” আমি চেঁচিয়ে উঠলাম। এবারও কোন উত্তর এল না।
আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না এখন কি করবো। হিংস্র এই অস্বাভাবিক জানোয়ারগুলির হাত থেকে কীভাবে রক্ষা পাবো। আমি মানুষের বিরুদ্ধে লড়াই করতে শিখেছি, এরকম অতিপ্রাকৃত ভয়ঙ্কর জন্তুর বিরুদ্ধে নয়। অগত্যা বিধাতার হাতেই নিজের ভাগ্য সঁপে দেয়া শ্রেয় মনে হল।
(৪)
হায়েনাগুলি চারিদিক থেকে আমাদের কোণঠাসা করে ফেলেছিল। আমরা পরস্পরের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে ওগুলির দিকে তরবারি তাক করে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
রাগে ক্ষোভে আমি যেন রীতিমতো কাঁপছিলাম। আমি দাঁতে দাঁত চেপে এক দৃষ্টিতে সেগুলির তাকিয়ে রইলাম। টের পেলাম আমার কপালের ঘাম গড়িয়ে চোয়ালে এসে ঠেকেছে।
ঠিক তখনই জঙ্গলের গভীর থেকে ভয়ংকর এক গর্জনের শব্দ ভেসে এল। পুরো জঙ্গলটি যেন কেঁপে উঠলো তাতে। ধক করে উঠলো আমার বুকের ভেতরটা। টের পেলাম গায়ের রোমগুলি খাড়া হয়ে গেছে। ভয়ে, বিস্ময়ে যেন হতবম্ব হয়ে পড়লাম।
এ কোন সাধারণ প্রাণী নয়। ভয়ঙ্কর, অতিপ্রাকৃতিক কিছু একটা।
“ডাকসা!” অস্ফুট স্বরে নামটি উচ্চারন করলো খাজা, যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না সে। “ডাকসা জীবিত!”
কেন জানি মনে হল, হায়েনাগুলি পেছনে সরে পড়েছে। যেন আমাদের মত সেগুলিও ভীত, সন্ত্রস্ত।
ভীত আমি নিজেও। কারন ভয়ঙ্কর গর্জনের মালিক ‘ডাকসা’ যে এদিকেই এগিয়ে আসছে। আসছে সবকিছু ছাপিয়ে, ভেঙ্গে চুড়ে। ওটার ভারী পদক্ষেপে কেঁপে উঠছিল পায়ের তলার মাটি।
হায়েনাগুলি ইতিমধ্যেই অদৃশ্য হয়ে গেছে। আমরা নিজেরাও পালানোর তাগিদ অনুভব করলাম। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। দানবটি লম্বা পদক্ষেপে খুব দ্রুতই আমাদের কাছে চলে এসেছে। জঙ্গল ছাড়িয়ে আমাদের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। রোধ করেছে সামনের পথটি।
এই প্রথমবারের মত ডাকসাকে দেখলাম আমি। লোমশ গায়ের বিশাল আকৃতির একটি নরপশু। হাতের থাবায় ধারালো নখর। মুখে সারি সারি ধারালো দাঁত। উজ্জ্বল চাঁদের আলোয় সেগুলি চকচক করছিলো।
জ্বলজ্বল চোখে এক দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল ডাকসা। চাহুনিতে ছিল নরকের হিংস্রতা।
ওটার ভারী জান্তব নিঃশ্বাস যেন চারিদিকের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে খান খান করে দিচ্ছিল।
আমি বুঝতে পারছিলাম কিছু একটা করার জন্য তৈরি হচ্ছে খাজা। হটাতই সে তার তরবারিটি খোলসছাড়া করলো। এক মুহূর্ত দেরি না করে ঝাঁপিয়ে পড়ল ডাকসার উপর।
কিন্তু খাজার ওই আক্রমণ নেহাতই ঠুনকো মনে হল, যেন এর কোন প্রভাবই পড়ল না ডাকসার উপর। ডাকসার এক থাবায় পরক্ষনেই খড়কুটোর মতো উড়ে গেল খাজা। ছিটকে পড়ল দূরে।
আমি চিৎকার করে উঠলাম কিন্তু কোন সাড়া মিলল না। এবার খাজার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে আমার দিকে তাকালো ডাকসা। এগিয়ে আসতে লাগলো সামনে। আমি ভয়ে, আতঙ্কে পিছিয়ে গেলাম কয়েক পা। কিন্তু হটাত কিছু একটার সাথে আটকে গেল আমার পা। সাথে সাথেই মাটিতে পড়ে গেলাম। তরবারিটি খসে পড়ল হাত থেকে।
আর কোন উপায় অন্তর না দেখে আমি আমার ঢালটি উঁচিয়ে ধরলাম। আত্মরক্ষার শেষ বৃথা চেষ্টা করলাম। কিন্তু পরক্ষনেই নাটকীয় কিছু একটা ঘটলো। হটাতই ডাকসা থমকে গেল। এক চুলও এগলো না আর। কিছু একটা ঘটেছে তার ভেতরে। স্থির দাঁড়িয়ে গেছে সে। তাকিয়ে আছে আমার ঢালের দিকে। যেন মূর্তি বনে গেছে।
হটাত আমি একটু নড়ে উঠতেই যেন ঘোর ভাঙল তার। সভয়ে পেছনে সরে গেল। কিছু একটা দেখেছে সে। এমন কিছু যার জন্য তৈরি ছিল না সে। তার মুখ দিয়ে আর্তনাদের মতো শুধু গরগর একটা আওয়াজ বেরোল। ঠিক পরক্ষনেই পেছনে ঘুরে ছুটে পালালো ডাকসা। মুহূর্তেই হারিয়ে গেল জঙ্গলের গভীরে।
ঘটনার আকস্মিকতায় আমি নিজেও হতবম্ব হয়ে পড়লাম। ঢালটির দিকে একবার তাকালাম। সেটার মুখ আমার দিকে ঘোরালাম। চাঁদের উজ্জ্বল আলোয় চকচক করছিলো ধাতব পাতটি। ঢালের মুখের উপর কিছু দেখেছে ডাকসা! নিজের চেহারা!
পরক্ষনেই আমি উঠে দাঁড়ালাম, ছুটে গেলাম অন্য দিকটায়। সেখানে খাজার নিশ্চল, নিথর দেহটা মাটিতে পড়ে ছিল। আমি হাঁটু গেড়ে বসে দু হাতে তার মাথাটা তুললাম। তার গালে কয়েকটা চড় লাগালাম। কিন্তু কোন সাড়া মিলল না। তার গলার ধমনির উপর হাত রাখতেই বুঝতে পারলাম অনেক দেরি হয়ে গেছে। সব শেষ হয়ে গেছে। খাজা নেই। চলে গেছে আমাকে ছেড়ে।
আমার চোখ দিয়ে যেন এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। আর যেন পারছিলাম না। সবাইকে হারাতে হারাতে যেন ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম।
একটা ডাইনী শেষ করে দিয়েছে সব। রাজ্য, রাজা, সেনাপতি, বন্ধু! সব। একা করে দিয়েছে আমাকে।
নিজের অজান্তেই কখন যেন মুষ্টি বদ্ধ হয়ে এল আমার হাত। দুঃখ পরিনত হল রাগে, ক্ষোভে, প্রতিহিংসায়। আমি যে মালিকাকে ছাড়ছি না।
Ayrin kaTun, Sofikul alom, Liton vhos, Nowrin talukdar, Nera akter, Fahad islam, Israyeel hossen and লেখাটি পছন্দ করেছে
- M A Nayeemশুকতারা
- Posts : 68
স্বর্ণমুদ্রা : 1282
মর্যাদা : 20
Join date : 2021-05-22
Re: তিন চন্দ্রদিন
Fri Jun 04, 2021 4:49 pm
- দ্বিতীয় অধ্যায় -
আমি গহীন অরন্য পেছনে ফেলে হ্রদের অনেকটা কাছাকাছি চলে এসেছি। কিছুটা দুরেই হ্রদের টলমলে জল জ্বলজ্বল করছে। রুপালী থালার মতো বিশাল চাঁদ সেই জলে প্রতিফলিত হচ্ছে। হালকা স্রোতে সেই দৃশ্য দেখতে বড়ই অপরূপ লাগছে। চাঁদ যেন তার দিগুন শক্তিতে এই দিকটা আলোকিত করে তুলেছে।
আমি হ্রদের কিনারা ঘেঁষে চলা পথটি ধরে সামনে এগিয়ে চললাম। পথটি একটি গ্রামে গিয়ে মিলেছে। অল্প কিছুদুর হাঁটলেই আমি দেখা পাবো সেই গ্রামের। আজ রাতের জন্য আমাকে হয়তো সেখানেই আশ্রয় নিতে হবে।
দূরে গ্রামের ছোট ছোট ঘরগুলি আমার চোখে পড়ল। সেখানে দুই এক জায়গায় হালকা আলো জ্বলছিল। আমি গ্রামের অনেকটা কাছাকাছি চলে এসেছিলাম। এমন সময় আমার অদূরেই কিছু একটা চোখে পড়ল, হ্রদের কিনারা ঘেঁষে কেউ একজন বসে আছে। একটি মেয়ে!
হ্রদের দিকে মুখ করে তাকিয়ে আছে মেয়েটি। তাঁর চাপা কান্নায় আশপাশটা ভারী হয়ে উঠেছে।
কিছুটা সামনে এগোতেই আমার উপস্থিতি টের পেয়ে গেল মেয়েটি, সে তাৎক্ষনাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালো।
আমাকে দেখেই সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালো, সভয়ে পেছনে সরে গেল কয়েক পা। যেন এখুনি ছুটে পালাবে।
“আমি দুঃখিত, আমি কোনভাবে আপনাকে বিরক্ত করতে চাইনি।” কিছুটা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে ক্ষমা চাইলাম আমি।
মেয়েটি তখনো ধাতস্ত হতে পারেনি। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিলো, কোন একটি কারনে প্রচণ্ড ভীত সে।
আমি ধীরে ধীরে আমার কোমর থেকে তরবারিটি খুলে মাটিতে রাখলাম। তাঁর সাথে যথাসম্ভব বন্ধুসুলভ আচরণ করার চেষ্টা করলাম। “আমি কারো ক্ষতি করতে এখানে আসিনি। আরকান রাজ্যের একজন যোদ্ধা আমি, রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ একটি অভিযানে বেড়িয়েছি।”
মেয়েটির মুখ থেকে তখনো কোন রা বেরোল না। আবার ছুটেও পালাল না। শুধু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
“আপনাকে দেখে বিপদ্গ্রস্থ মনে হচ্ছে। আমি কী কোনভাবে আপনার সাহায্য করতে পারি?” আমি মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করলাম।
ছিপছিপে হালকা গড়নের মেয়েটিকে দেখতে বড়ই অসহায় লাগছিল। সে কিছু একটা বলতে চাইছিল কিন্তু বার বার ফুঁপিয়ে উঠছিল। অবশেষে মুখ খুলতে পারলো মেয়েটি, “আমার পরিবারের উপর হামলা হয়েছে। আমার পিতাকে হ…হত্যা করা হয়েছে।” কিছুটা জড়ানো কণ্ঠে কথাটি বলল সে।
আমি কিছুক্ষন চুপ করে রইলাম। তারপর বললাম, “আপনার এই ক্ষতির জন্য আমি দুঃখিত। কারা এটা করেছে?” আমার প্রশ্নের কোন তৎক্ষনিক জবাব দিতে পারলো না মেয়েটি। তাঁর ইতস্তত ভাব দেখে আমি বললাম, “আমাকে বলুন। এখানে সম্পূর্ণ নিরাপদ আপনি।” মেয়েটিকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলাম।
এবার মাথা তুলে তাকালো মেয়েটি। এক পলক তাকিয়েই সাথে সাথে চোখ নামিয়ে ফেলল। এই প্রথমবারের মতো তাঁকে দেখলাম আমি। অসাধারণ সুন্দরী একটি মেয়ে। তাঁর ডাগর কালো চোখগুলি যে কোন মানুষকে সম্মোহিত করার সামর্থ্য রাখে।
মেয়েটি ভীত সন্ত্রস্ত চোখে একবার তাকালো চারিদিকে। তারপর প্রায় ফিসফিস করে বলল, “ডাকসা!”
নামটি উচ্চারণ করেই কেমন এক অস্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করলো। যেন আর এক মুহূর্তও এখানে থাকতে রাজি নয় সে।
ব্যপারটি বুঝতে পেরে আমি আর কথা বাড়ালাম না। শুধু বললাম, “চলুন, আপনাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেই।” মেয়েটি কোন উত্তর দিল না।
আমি গ্রামটির দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললাম, “ওখানে আপনার বাড়ি?” মাথা নাড়ল মেয়েটি।
আমি চারিদিকে একবার তাকালাম। তারপর তরবারিটি হাতে নিয়ে সামনে এগিয়ে চললাম। মেয়েটি আমাকে অনুসরণ করতে শুরু করলো।
পথে কিছু টুকটাক কথা হল আমাদের মধ্যে। মেয়েটির নাম আলিয়া। তাঁর বাবা ছিলেন একজন কৃষক, এই গ্রামেরই বাসিন্দা তারা। গ্রামের সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল কিন্তু হটাত একদিন ডাকসার উপদ্রব শুরু হল। গ্রাম থেকে একের পর এক মানুষ হারিয়ে যেতে শুরু করলো। আতঙ্কিত মানুষজন একসময় গ্রামছাড়া হতে লাগলো। এখন অল্প কিছু সংখ্যক মানুষ ছাড়া অধিকাংশই গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে।
কিছুদূর হাঁটার পর গ্রামের পথে চলে এলাম আমরা। আশেপাশে কিছু কুটির চোখে পড়ল কিন্তু কোন মানুষজনের চিহ্ন দেখতে পেলাম না। কুটিরগুলির দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল।
আলিয়ার বাড়ি পৌঁছাতেই একজন বুড়িমত মহিলাকে দেখতে পেলাম, পানি তুলছিল কুয়ো থেকে। আমাকে দেখে এক মুহূর্তের জন্যে থমকে গেল বুড়ি, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইল আমার দিকে।
“ইনি আমার দাদীমা।” আমাকে উদ্দেশ্য করে কথাটি বলল আলিয়া।
আমি বুড়ির দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসি দেয়ার চেষ্টা করলাম কিন্তু তাতে তাঁর কোন ভাবাবেগ হল না, শুধু আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে রইলো।
“আমাকে এখন বিদায় নিতে হবে। আমি উত্তর গোলার্ধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করছি।” বললাম আমি।
মেয়েটি কিছুটা ইতস্তত করলো, তারপর শুধু বলল, “একটু অপেক্ষা করুন।” কথাটি বলেই এক দৌড়ে কুটিরের ভেতর ঢুকে গেল। কয়েক মুহূর্ত পর হাতে একটি শিশি নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “এটা সাথে রাখুন।”
“কি এটা?” আমি জানতে চাইলাম।
“ভ্রান্ত সুগন্ধি।” হটাত করেই কথাটি বলল বুড়ি। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাঁর দিকে তাকালাম। তখনো কুয়োর সামনে দাঁড়িয়ে ছিল সে। “ডাকসা তোমাকে অনুসরন করছে, তোমার গায়ের গন্ধ শুঁকে।” একটু থামল বুড়ি। তারপর বলল, “এটি সাথে রাখো, তাহলে তোমার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলবে সে।”
বুড়ির এই কথায় ভীষণ অবাক হলাম আমি। হাতের সুগন্ধিটির দিকে তাকালাম। শিশিটি নাকের সামনে ধরতেই বিকট ঝাঁজালো একটি গন্ধ ভেসে এল। আমি সাথে সাথে মুখ সরিয়ে নিলাম।
“তোমার পিছু পিছু এদিকটায় চলে এসেছে ডাকসা। শুরু করেছে মানুষ হত্যা।” কথা চালিয়ে গেল বুড়ি।
“কিন্তু …” আমি কথাটি শেষ করতে পারলাম না।
“বাইরে অনেক বিপদ। তোমার জন্য আজ রাতটা এই গ্রামেই কাটিয়ে দেয়া মঙ্গলজনক।” টেনে টেনে কথাগুলি বলছিল বুড়ি।
আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে উঠোনের অন্য দিকটায় হাঁটতে শুরু করলো সে। বলল, “আমার সাথে এসো।” ছোট একটি কুটিরের সামনে গিয়ে থামল বুড়ি। আমি আলিয়ার দিকে একবার তাকালাম। নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে ছিল আলিয়া।
ঘরটি ভালই। একটি খাট আছে ঘরে, একপাশে ছোট একটি টেবিল ও সাথে একটি কাঠের চেয়ার। টেবিলের উপর রাখা একটি টিমটিমে প্রদিপ ঘরটিকে আলোকিত করছিল। আমি মনে মনে বুড়িকে ধন্যবাদ জানালাম। এই আশ্রয়টুকু আমার বড্ড প্রয়োজন ছিল।
ইতিমধ্যেই চাঁদের আলো কমে গেছে, আঁধার নেমে গেছে চারিদিকে। আমি কোনরকম কালক্ষেপন না করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। সারাদিনের যাত্রায় প্রচণ্ড ক্লান্ত, মাথাটা ঝিমঝিম করছে।
ঘরের এক পাশে ছোট একটি জানালা ছিল, সেটি দিয়ে হু হু করে ভেতরে বাতাস ঢুকছিল। আমি ক্লান্তি ভরা চোখ নিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টের পাইনি, ঘুম ভাঙল একটি শব্দে।
(২)
জানালার কপাটদুটি প্রচণ্ড শব্দ করে পরস্পরের সাথে ধাক্কা খেল। টেবিলের উপর রাখা প্রদিপের আগুনের শিখা তাতে কিছুটা কেঁপে উঠলো। ওটার ঠিক পাশেই ভ্রান্ত সুগন্ধির শিশিটি রাখা ছিল। আমি ততোক্ষণে বিছানায় উঠে বসেছি, জানালার দিকে মুখ করে বাইরে তাকিয়ে আছি। ওপাশে নিকষ কালো অন্ধকার ছাড়া কিছুই চোখে পড়ছে না।
আমি আস্তে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। জানালার খিলটি আটকে দিলাম। তারপর টেবিলের পাশে রাখা পুরনো চেয়ারটিতে এসে বসলাম। ঝোলা থেকে আরকান রাজ্যের মানচিত্রটি বের করে টেবিলের উপর রাখলাম। সকাল হতে খুব বেশি দেরি নেই। তাই আর ঘুমোতে যাবো না।
মানচিত্রটির উপর চোখ বুলালাম। এই গ্রাম থেকে খুব বেশি দূরে নয় জ্ঞানী বৃক্ষের অঞ্চল। সামনে উষ্ণ পাহাড় পেরোলেই আমি দেখা পাবো তাঁর।
সকাল হতেই বুড়িকে ধন্যবাদ জানিয়ে তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিলাম। যাত্রা শুরু করলাম উত্তর গোলার্ধের উদ্দেশ্যে। আলিয়ার সাথে আর দেখা হল না। বুড়ি জানিয়েছিল, মেষ চড়াতে মাঠে গেছে সে।
অনেকখানি পথ চলার পর বুঝতে পারলাম উষ্ণ পাহাড়ের কাছাকাছি এসে পৌঁছেছি। চাঁদ ঠিক আমার মাথার উপর ছুই ছুই করছে। ইতোমধ্যেই গরম হাওয়ার ঝাঁপটা এসে লাগছে আমার মুখে।
আমি আমার হাতের দস্তানা থেকে শুরু করে আলখেল্লা পর্যন্ত সকল গরম কাপড় গাঁ থেকে খুলে ফেললাম। উষ্ণ পাহাড়ের দিকে যতোই এগোবো, এই বাতাস ততোই ভারী ও গরম হয়ে উঠবে।
আরও কিছুটা সামনে এগোতেই ছোটবড় কিছু গুহা আমার নজরে পড়ল। পাহাড়ের গাঁয়ে খোঁড়া গুহাগুলি দেখে মোটেও প্রাকৃতিক মনে হচ্ছিলো না। কিছুদূর যেতেই বুঝতে পারলাম অসংখ্য গুহা রয়েছে এখানটায়, পুরো এলাকাজুড়ে বিস্তৃত সেগুলি। আমি ভেবে অবাক হলাম কে বা কারা এই গুহাগুলি তৈরি করেছে! অবশ্য এর উত্তর পেতে খুব বেশি অপেক্ষা করতে হল না। একটু দূরেই কাদায় কিছু পায়ের ছাপ দেখতে পেলাম। কোন প্রাণী সদ্য তার থাবা বসিয়ে গেছে এখানটায়।
ছাপগুলি বেশ বড়, কোন সাধারণ প্রাণীর নয়। এবার আমি যেন কিছু একটা আঁচ করতে পারলাম! ভয়ে আতঙ্কে আমার ঘাড়ের চুলগুলি খাড়া হয়ে উঠলো। এগুলি আর কিছুই না! হায়েনা! সেই অতিপ্রাকৃত বিকট হায়েনা!
আমি সাথে সাথে আমার ঝোলা ঘেঁটে মানচিত্রটি বের করলাম। সাধারনত বিপদজনক এলাকাগুলি লাল কালি দিয়ে চিহ্নিত থাকে। কিন্তু এই অঞ্চলটি তেমন বিশেষভাবে চিহ্নিত নয়।
বুঝতে পারছিলাম বড় ধরনের বিপদে পড়ে গেছি। এখুনি এখান থেকে বের হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। আমি তরবারিটি খোলসছাড়া করলাম। ডানে বামে, আমার চারিদিকে একবার তাকালাম। হয়তোবা হায়েনাগুলি এই মুহূর্তে এখানে নেই, খাবারের সন্ধানে গেছে। আমাকে খুব দ্রুত এখান থেকে কেটে পড়তে হবে।
কিছুদূর এগোনোর পর বুঝতে পারলাম আমার ধারনা ভুল। কারন সামনে একটি হায়েনা আমার পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে। মুহূর্তের মধ্যেই আরও কয়েকটি হায়েনা চারিদিক থেকে আমাকে ঘিরে ফেলেছে। তাহলে শুরু থেকেই এরা আমার উপর নজর রাখছে। এটা একটা ফাঁদ বৈকি আর কিছুই নয়।
আমার জন্যই অপেক্ষা করছিলো এরা আর আমি এই ফাঁদে পা দিয়েছি।
হটাতই একটি হায়েনা প্রচণ্ড ক্ষিপ্র গতিতে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমি টালমাটাল হয়ে মাটিতে পড়ে গেলাম।
অন্য একটি হায়েনা আমার বুকের উপর উঠে দাঁড়ালো। এক মুহূর্তের জন্য আমার দম বন্ধ হয়ে এল। যেন কেউ একটা বিশাল আকৃতির পাথর আমার বুকের উপর চেপে দিয়েছে। আমি এক চুলও নড়তে পারলাম না। শরীরের সব শক্তি যেন মুহূর্তেই নিঃশেষ হয়ে গেল। হায়েনাটি আমার মুখের উপর ভারী নিঃশ্বাস ফেলছিল। কিছুক্ষনের মধ্যেই আমি জ্ঞান হারালাম।
যখন আমার জ্ঞান ফিরল, আমি নিজেকে একটি কালকুঠুরিতে আবিস্কার করলাম। শিকলে বাধা আমার হাত দুটি পেছনে প্রসারিত ছিল, আমি হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে ছিলাম। আমার কক্ষটি লোহার গারদ দিয়ে বদ্ধ ছিল।
হটাত একটি ভারী ধাতব শব্দ হল, যেন লোহার পুরনো ভারী দরজা টানার শব্দ। তারপরই ভেসে এল কিছু পায়ের আওয়াজ।
এর কিছুক্ষণের মধ্যে মহাডাইনী মালিকা আমার কুঠুরির সামনে এসে দাঁড়ালো। তাঁর পেছনে ছিল আরও দুইটি ডাইনী।
মালিকার পুরো শরীর একটি কালো আলখেল্লায় ঢাকা ছিল। হাতে ছিল একটি লম্বা ছড়ি। তাঁর পেছনের দীর্ঘ ঘন কালো চুলগুলি কোমর অবধি এসে ঠেকেছিল। চোখে ছিল গাড় কালি আর মুখে তৃপ্তির হাসি। হিংস্রতা আর ক্রোধে মিশ্রিত তাঁর সেই জঘন্য হাসি আমি আগে কখনো দেখিনি।
আমার পিতার সাথে অনেক সময় কাটিয়েছে সে কিন্তু তাঁর সেই সুশ্রী চেহারার পেছনে এমন একটি কদাকার রুপ আছে, আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।
“তোমার পিতার যোগ্য পুত্র তুমি, রাজকুমার। সত্যিই তোমাদের মন ভোলানো কত সহজ!” আমাকে উদ্দেশ্য করে কথাটি বলল মালিকা। লক্ষ্য করলাম তাঁর পাশে কেউ একজন এসে দাঁড়িয়েছে। তাঁর দিকে চোখ যেতেই আমার বুকটা ছেদ করে উঠলো। এ যে আলিয়া!
“তোমার পিতাকে বোকা বানিয়েছিলাম আমি আর তোমাকে বানিয়েছে আলিয়া।” তাচ্ছিল্যের সুরে কথাটি বলল মালিকা। মুখে মুচকি হাসি। “নিশ্চয়ই তোমার পিতা নির্জনে একাকী একটি মেয়েকে কাঁদতে দেখলে তাঁকে সাহায্য করতে বারন করেননি। তাই না, রাজকুমার?”
“কাউকে বিশ্বাস করা বা তাঁকে সাহায্য করা দোষের কিছু নয়।” আমি দাঁতে দাঁত চেপে কথাটি বললাম। “কিন্তু আমি ও আমার পিতার দুর্ভাগ্য যে তুমি বা আলিয়া কেউই সেই বিশ্বাসের যোগ্য ছিলে না।” আলিয়ার দিকে তাকালাম আমি। মাথা নিচু করে আছে সে, যেন ভয়ে জড়সড়।
“তা বটে।” ঠোঁট উল্টালো মালিকা। “কিন্তু এতো সহজে কারো প্রেমে পড়ে যাওয়াটা নিশ্চয়ই দোষের কিছু।” আলিয়ার দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসি দিল মহাডাইনী। তারপর বলল, “ডাকসা তোমাকে হত্যা করতে নয় বরং রক্ষা করতে তোমার পিছু নিয়েছিল।” মালিকার চোখ দিয়ে এবার আগুন ঠিকরে বেরচ্ছিল। “শুধু এই নির্বোধ পশুটির জন্য তোমাকে বন্দি করতে আমাকে এতোটা সময় ব্যয় করতে হয়েছে।”
মালিকার এই কথাটি শুনে আমি বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে পড়লাম। এটা কি করে সম্ভব! ডাকসা আমাকে রক্ষা করার জন্য আমার পিছু নিয়েছিল! তবে কি সেই প্রথম রাতের পশুটি ডাকসাই ছিল! তাবুর ওপারে আমার গন্ধ শুঁকছিল।
“এখন একে নিয়ে কি করবো, মহাডাইনী?” হটাতই মালিকার পাশে দাঁড়ানো ডাইনীটি কর্কশ কণ্ঠে বলে উঠলো।
“আরকান রাজ্য সম্পূর্ণ আমার না হওয়া পর্যন্ত একে জীবিত রাখতে হবে। একে আমার প্রয়োজন হতে পারে।” কথাটি বলেই ঘুরে দাঁড়ালো মালিকা। হাঁটা শুরু করলো উল্টো দিকে। “আর হ্যাঁ, ওকে আমার বিশেষ কারাগারে নিয়ে এসো। রাজকুমার বলে কথা! কিছুটা বাড়তি যত্ন আত্তি তো করতেই হয়।” যেতে যেতে কথাটি বলল সে। আলিয়া দ্রুত পায়ে তাঁকে অনুসরণ করলো। মেয়েটির আচরণ আমার কাছে বড়ই অদ্ভুত লাগছিল।
অপর ডাইনী দুটি আমার কক্ষের তালাটি খুলল। তারপর দেয়ালের শেকল থেকে আমার হাতদুটি আলগা করে আমাকে খাঁচা থেকে বের করলো।
“এই পুচকে রাজকুমার। সামনে এগিয়ে চলো।” একটি ডাইনী সজোরে আমার পিঠে ধাক্কা দিল।
(৩)
অদ্ভুত ধরনের একটি কক্ষে আমাকে নিয়ে এলো ডাইনীগুলি। কক্ষটিতে প্রবেশ করতেই একটি হলদে রঙের বড় আকারের মোমবাতি আমার দৃষ্টিগোচর হল। একটি টেবিলের উপর রাখা ছিল সেটি। আমি সেটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। কেননা এরকম আরও একটি মোমবাতি আমি আগেও দেখেছি, আমার পিতার শয়ন কক্ষে, যেদিন তিনি মূর্তিতে পরিণত হন।
আমাকে কক্ষের ঠিক মাঝামাঝি একটি স্থানে নিয়ে আসা হল। আমার মাথার উপর থেকে দুটি শেকল ঝুলছিল। আমার হাত দুটি শেকলগুলির সাথে আটকে দেয়া হল। এরপর একটি ডাইনী ঘরের এক কোনে একটি কলের কাছে গেল। কলটির লিভার ধরে টান দিল, সাথে সাথে শেকলগুলি আমাকে উপরের দিকে তুলতে শুরু করলো। ধীরে ধীরে আমার পুরো শরীর শুন্যে উঠে গেল। অন্য ডাইনিটি টেবিলের উপর থেকে মোমবাতিটি আমার কাছে নিয়ে এল। আমার পায়ের নিচে আঁকা একটি ছকের উপর সেটি বসিয়ে দিল, তারপর বাতিটি জ্বালিয়ে দিল। এই ছকটি আমি আগেও দেখেছি। আমার পিতার শয়ন কক্ষে!
আমি তখনো বুঝে উঠতে পারছিলাম না, ঠিক কি করতে যাচ্ছে মালিকা! মোম থেকে নির্গত আগুনের তাপ আমার পায়ের তলায় এসে ঠেকছিল। বলাই বাহুল্য, এতে খুব একটা কষ্ট হচ্ছিলো না আমার।
কিছুক্ষণ পর ডাইনীগুলি চুপচাপ কক্ষটি ছেড়ে চলে গেল। আমি শূন্যে স্থির ঝুলে রইলাম।
এভাবে কেটে গেছে বেশ কিছুক্ষণ। হটাত মনে হল আমার পা দুটি অসাড় হয়ে আসছে। আমি আগুনের তাপ টের পাচ্ছি না। ক্রমশ ভারী হয়ে আসেছে সেগুলি।
আমি আমার পায়ের আঙ্গুলগুলি নাড়ানোর শত চেষ্টা করলাম কিন্তু অবাক ব্যাপার আমি তা নাড়াতে পারলাম না। এবার প্রচণ্ড ভয় হল আমার। আমি ভয়ে ভয়ে নিচের দিকে তাকালাম। যা দেখলাম তাতে রক্ত হীম হয়ে যাওয়ার জোগাড় হল। আমার পায়ের পাতা থেকে শুরু করে গোড়ালি পর্যন্ত পুরোটাই পাথর হয়ে গেছে। আমি ধীরে ধীরে মূর্তিতে পরিণত হচ্ছি! এবার ভয়ে আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে পারলাম আমি। মুখ দিয়ে চিৎকার করতে লাগলাম। পা দুটি শূন্যে ছুড়তে শুরু করলাম। পাগলের মতো ছুড়তে লাগলাম।
জানি না কতক্ষন কেটে গেছে এভাবে। হটাৎ কক্ষের মূল দরজাটি খুলে যাওয়ার শব্দ পেলাম। সেদিকে মুখ ঘোরাতেই দেখতে পেলাম কেউ একজন সন্তর্পণে কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করছে।
অবয়বটির পুরো শরীর আলখেল্লায় ঢাকা ছিল। আবছা আলোয় আমি সেটার চেহারা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম না। অবয়বটি দ্রুত আমার কাছে চলে এল, মোমটি নিভিয়ে ঘরের অন্য প্রান্তে কলেটির কাছে চলে গেল। ওটার লিভার ধরে টানতেই আমি নিচে পড়ে গেলাম। আমার পা দুটি সজোরে মেঝেতে আঘাত করলো।
আমি উঠে বসতেই, আমার হাতের শেকলগুলি খুলতে লাগলো সে। আমি লক্ষ্য করলাম তাঁর হাত দুটি ক্ষনে ক্ষনে কেঁপে উঠছিল। আমি তাঁর দিকে মুখ তুলে তাকাতেই বুঝতে পারলাম, এটা আলিয়া।
“আমি আমার কৃতকর্মের জন্য অত্যন্ত দুঃখিত। আমার কাছে আর কোন উপায় ছিল না।” কাঁপা কাঁপা গলায় কথাটি বলল আলিয়া। “আমার দাদীমা আমাকে এসব করতে বাধ্য করেছে। সে নিজে মালিকার ডাইনী ছিল, আমাকেও ডাইনীতে পরিণত করতে চাইছে।” আমার একটি বাহু তাঁর কাঁধে তুলে নিল সে। আমি তাতে ভর করে উঠে দাঁড়ালাম। আমার পা দুটি তখনো অনেক ভারী লাগছিলো।
“আমি এভাবে বেশিদুর এগোতে পারবো না।” আমি বললাম।
“আমি জানি।” সাথে সাথেই উত্তর দিল আলিয়া। “আমি এর ব্যাবস্থা করে এসেছি।”
ভীত চোখে চারিদিকে একবার তাকালো আলিয়া। তারপর ধীরে ধীরে আমাকে কক্ষটি থেকে বের করে নিয়ে এল। কক্ষেটির বাইরে একটি সিঁড়ি ছিল, সেটি ধরে আমাকে উপরে নিয়ে যেতে শুরু করলো। কিছুক্ষনের মধ্যে আমরা সিঁড়ি বেয়ে মহলের ছাদ অবধি পৌঁছে গেলাম।
আলিয়া তাঁর ঝাড়ু লাঠিটি আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। বলল, “এতে ভর করেই আপনাকে পালাতে হবে।”
“কিন্তু তো … তোমার কি হবে?” আমি বললাম।
“আমাকে নিয়ে ভাববেন না।” বলল আলিয়া। “আপনার হতে খুব বেশি সময় নেই।”
আমি দেরি না করে লাঠিটির উপর উঠে বসলাম। সাথে সাথেই একটি ঝাঁকি দিয়ে উঠলো সেটি। আমাকে মেঝে থেকে কিছুটা উপরে তুলে নিল।
“এই থলেটি রাখুন।” আমার দিকে একটি থলে বাড়িয়ে দিল আলিয়া। “আর একটি কথা, এই লাঠিটি শুধু রাত্রিতেই কাজ করে, তাই আপনাকে চাঁদ ওঠার আগেই গন্তব্যে পৌছাতে হবে।” একটু থামল আলিয়া। আমার চোখে চোখ রেখে বলল, “বিদায়, রাজকুমার।”
তাঁর দিকে তাকিয়ে আমি মাথা নাড়লাম। বললাম, “আমি তোমাকে নিতে আসবো। আমার জন্য অপেক্ষা করো।”
কোন কথা বলল না আলিয়া। শুধু এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
জাদুর লাঠিটি মুহূর্তেই আমাকে উড়িয়ে নিয়ে চলল।
আমি গহীন অরন্য পেছনে ফেলে হ্রদের অনেকটা কাছাকাছি চলে এসেছি। কিছুটা দুরেই হ্রদের টলমলে জল জ্বলজ্বল করছে। রুপালী থালার মতো বিশাল চাঁদ সেই জলে প্রতিফলিত হচ্ছে। হালকা স্রোতে সেই দৃশ্য দেখতে বড়ই অপরূপ লাগছে। চাঁদ যেন তার দিগুন শক্তিতে এই দিকটা আলোকিত করে তুলেছে।
আমি হ্রদের কিনারা ঘেঁষে চলা পথটি ধরে সামনে এগিয়ে চললাম। পথটি একটি গ্রামে গিয়ে মিলেছে। অল্প কিছুদুর হাঁটলেই আমি দেখা পাবো সেই গ্রামের। আজ রাতের জন্য আমাকে হয়তো সেখানেই আশ্রয় নিতে হবে।
দূরে গ্রামের ছোট ছোট ঘরগুলি আমার চোখে পড়ল। সেখানে দুই এক জায়গায় হালকা আলো জ্বলছিল। আমি গ্রামের অনেকটা কাছাকাছি চলে এসেছিলাম। এমন সময় আমার অদূরেই কিছু একটা চোখে পড়ল, হ্রদের কিনারা ঘেঁষে কেউ একজন বসে আছে। একটি মেয়ে!
হ্রদের দিকে মুখ করে তাকিয়ে আছে মেয়েটি। তাঁর চাপা কান্নায় আশপাশটা ভারী হয়ে উঠেছে।
কিছুটা সামনে এগোতেই আমার উপস্থিতি টের পেয়ে গেল মেয়েটি, সে তাৎক্ষনাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালো।
আমাকে দেখেই সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালো, সভয়ে পেছনে সরে গেল কয়েক পা। যেন এখুনি ছুটে পালাবে।
“আমি দুঃখিত, আমি কোনভাবে আপনাকে বিরক্ত করতে চাইনি।” কিছুটা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে ক্ষমা চাইলাম আমি।
মেয়েটি তখনো ধাতস্ত হতে পারেনি। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিলো, কোন একটি কারনে প্রচণ্ড ভীত সে।
আমি ধীরে ধীরে আমার কোমর থেকে তরবারিটি খুলে মাটিতে রাখলাম। তাঁর সাথে যথাসম্ভব বন্ধুসুলভ আচরণ করার চেষ্টা করলাম। “আমি কারো ক্ষতি করতে এখানে আসিনি। আরকান রাজ্যের একজন যোদ্ধা আমি, রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ একটি অভিযানে বেড়িয়েছি।”
মেয়েটির মুখ থেকে তখনো কোন রা বেরোল না। আবার ছুটেও পালাল না। শুধু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
“আপনাকে দেখে বিপদ্গ্রস্থ মনে হচ্ছে। আমি কী কোনভাবে আপনার সাহায্য করতে পারি?” আমি মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করলাম।
ছিপছিপে হালকা গড়নের মেয়েটিকে দেখতে বড়ই অসহায় লাগছিল। সে কিছু একটা বলতে চাইছিল কিন্তু বার বার ফুঁপিয়ে উঠছিল। অবশেষে মুখ খুলতে পারলো মেয়েটি, “আমার পরিবারের উপর হামলা হয়েছে। আমার পিতাকে হ…হত্যা করা হয়েছে।” কিছুটা জড়ানো কণ্ঠে কথাটি বলল সে।
আমি কিছুক্ষন চুপ করে রইলাম। তারপর বললাম, “আপনার এই ক্ষতির জন্য আমি দুঃখিত। কারা এটা করেছে?” আমার প্রশ্নের কোন তৎক্ষনিক জবাব দিতে পারলো না মেয়েটি। তাঁর ইতস্তত ভাব দেখে আমি বললাম, “আমাকে বলুন। এখানে সম্পূর্ণ নিরাপদ আপনি।” মেয়েটিকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলাম।
এবার মাথা তুলে তাকালো মেয়েটি। এক পলক তাকিয়েই সাথে সাথে চোখ নামিয়ে ফেলল। এই প্রথমবারের মতো তাঁকে দেখলাম আমি। অসাধারণ সুন্দরী একটি মেয়ে। তাঁর ডাগর কালো চোখগুলি যে কোন মানুষকে সম্মোহিত করার সামর্থ্য রাখে।
মেয়েটি ভীত সন্ত্রস্ত চোখে একবার তাকালো চারিদিকে। তারপর প্রায় ফিসফিস করে বলল, “ডাকসা!”
নামটি উচ্চারণ করেই কেমন এক অস্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করলো। যেন আর এক মুহূর্তও এখানে থাকতে রাজি নয় সে।
ব্যপারটি বুঝতে পেরে আমি আর কথা বাড়ালাম না। শুধু বললাম, “চলুন, আপনাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেই।” মেয়েটি কোন উত্তর দিল না।
আমি গ্রামটির দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললাম, “ওখানে আপনার বাড়ি?” মাথা নাড়ল মেয়েটি।
আমি চারিদিকে একবার তাকালাম। তারপর তরবারিটি হাতে নিয়ে সামনে এগিয়ে চললাম। মেয়েটি আমাকে অনুসরণ করতে শুরু করলো।
পথে কিছু টুকটাক কথা হল আমাদের মধ্যে। মেয়েটির নাম আলিয়া। তাঁর বাবা ছিলেন একজন কৃষক, এই গ্রামেরই বাসিন্দা তারা। গ্রামের সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল কিন্তু হটাত একদিন ডাকসার উপদ্রব শুরু হল। গ্রাম থেকে একের পর এক মানুষ হারিয়ে যেতে শুরু করলো। আতঙ্কিত মানুষজন একসময় গ্রামছাড়া হতে লাগলো। এখন অল্প কিছু সংখ্যক মানুষ ছাড়া অধিকাংশই গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে।
কিছুদূর হাঁটার পর গ্রামের পথে চলে এলাম আমরা। আশেপাশে কিছু কুটির চোখে পড়ল কিন্তু কোন মানুষজনের চিহ্ন দেখতে পেলাম না। কুটিরগুলির দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল।
আলিয়ার বাড়ি পৌঁছাতেই একজন বুড়িমত মহিলাকে দেখতে পেলাম, পানি তুলছিল কুয়ো থেকে। আমাকে দেখে এক মুহূর্তের জন্যে থমকে গেল বুড়ি, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইল আমার দিকে।
“ইনি আমার দাদীমা।” আমাকে উদ্দেশ্য করে কথাটি বলল আলিয়া।
আমি বুড়ির দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসি দেয়ার চেষ্টা করলাম কিন্তু তাতে তাঁর কোন ভাবাবেগ হল না, শুধু আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে রইলো।
“আমাকে এখন বিদায় নিতে হবে। আমি উত্তর গোলার্ধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করছি।” বললাম আমি।
মেয়েটি কিছুটা ইতস্তত করলো, তারপর শুধু বলল, “একটু অপেক্ষা করুন।” কথাটি বলেই এক দৌড়ে কুটিরের ভেতর ঢুকে গেল। কয়েক মুহূর্ত পর হাতে একটি শিশি নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “এটা সাথে রাখুন।”
“কি এটা?” আমি জানতে চাইলাম।
“ভ্রান্ত সুগন্ধি।” হটাত করেই কথাটি বলল বুড়ি। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাঁর দিকে তাকালাম। তখনো কুয়োর সামনে দাঁড়িয়ে ছিল সে। “ডাকসা তোমাকে অনুসরন করছে, তোমার গায়ের গন্ধ শুঁকে।” একটু থামল বুড়ি। তারপর বলল, “এটি সাথে রাখো, তাহলে তোমার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলবে সে।”
বুড়ির এই কথায় ভীষণ অবাক হলাম আমি। হাতের সুগন্ধিটির দিকে তাকালাম। শিশিটি নাকের সামনে ধরতেই বিকট ঝাঁজালো একটি গন্ধ ভেসে এল। আমি সাথে সাথে মুখ সরিয়ে নিলাম।
“তোমার পিছু পিছু এদিকটায় চলে এসেছে ডাকসা। শুরু করেছে মানুষ হত্যা।” কথা চালিয়ে গেল বুড়ি।
“কিন্তু …” আমি কথাটি শেষ করতে পারলাম না।
“বাইরে অনেক বিপদ। তোমার জন্য আজ রাতটা এই গ্রামেই কাটিয়ে দেয়া মঙ্গলজনক।” টেনে টেনে কথাগুলি বলছিল বুড়ি।
আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে উঠোনের অন্য দিকটায় হাঁটতে শুরু করলো সে। বলল, “আমার সাথে এসো।” ছোট একটি কুটিরের সামনে গিয়ে থামল বুড়ি। আমি আলিয়ার দিকে একবার তাকালাম। নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে ছিল আলিয়া।
ঘরটি ভালই। একটি খাট আছে ঘরে, একপাশে ছোট একটি টেবিল ও সাথে একটি কাঠের চেয়ার। টেবিলের উপর রাখা একটি টিমটিমে প্রদিপ ঘরটিকে আলোকিত করছিল। আমি মনে মনে বুড়িকে ধন্যবাদ জানালাম। এই আশ্রয়টুকু আমার বড্ড প্রয়োজন ছিল।
ইতিমধ্যেই চাঁদের আলো কমে গেছে, আঁধার নেমে গেছে চারিদিকে। আমি কোনরকম কালক্ষেপন না করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। সারাদিনের যাত্রায় প্রচণ্ড ক্লান্ত, মাথাটা ঝিমঝিম করছে।
ঘরের এক পাশে ছোট একটি জানালা ছিল, সেটি দিয়ে হু হু করে ভেতরে বাতাস ঢুকছিল। আমি ক্লান্তি ভরা চোখ নিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টের পাইনি, ঘুম ভাঙল একটি শব্দে।
(২)
জানালার কপাটদুটি প্রচণ্ড শব্দ করে পরস্পরের সাথে ধাক্কা খেল। টেবিলের উপর রাখা প্রদিপের আগুনের শিখা তাতে কিছুটা কেঁপে উঠলো। ওটার ঠিক পাশেই ভ্রান্ত সুগন্ধির শিশিটি রাখা ছিল। আমি ততোক্ষণে বিছানায় উঠে বসেছি, জানালার দিকে মুখ করে বাইরে তাকিয়ে আছি। ওপাশে নিকষ কালো অন্ধকার ছাড়া কিছুই চোখে পড়ছে না।
আমি আস্তে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। জানালার খিলটি আটকে দিলাম। তারপর টেবিলের পাশে রাখা পুরনো চেয়ারটিতে এসে বসলাম। ঝোলা থেকে আরকান রাজ্যের মানচিত্রটি বের করে টেবিলের উপর রাখলাম। সকাল হতে খুব বেশি দেরি নেই। তাই আর ঘুমোতে যাবো না।
মানচিত্রটির উপর চোখ বুলালাম। এই গ্রাম থেকে খুব বেশি দূরে নয় জ্ঞানী বৃক্ষের অঞ্চল। সামনে উষ্ণ পাহাড় পেরোলেই আমি দেখা পাবো তাঁর।
সকাল হতেই বুড়িকে ধন্যবাদ জানিয়ে তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিলাম। যাত্রা শুরু করলাম উত্তর গোলার্ধের উদ্দেশ্যে। আলিয়ার সাথে আর দেখা হল না। বুড়ি জানিয়েছিল, মেষ চড়াতে মাঠে গেছে সে।
অনেকখানি পথ চলার পর বুঝতে পারলাম উষ্ণ পাহাড়ের কাছাকাছি এসে পৌঁছেছি। চাঁদ ঠিক আমার মাথার উপর ছুই ছুই করছে। ইতোমধ্যেই গরম হাওয়ার ঝাঁপটা এসে লাগছে আমার মুখে।
আমি আমার হাতের দস্তানা থেকে শুরু করে আলখেল্লা পর্যন্ত সকল গরম কাপড় গাঁ থেকে খুলে ফেললাম। উষ্ণ পাহাড়ের দিকে যতোই এগোবো, এই বাতাস ততোই ভারী ও গরম হয়ে উঠবে।
আরও কিছুটা সামনে এগোতেই ছোটবড় কিছু গুহা আমার নজরে পড়ল। পাহাড়ের গাঁয়ে খোঁড়া গুহাগুলি দেখে মোটেও প্রাকৃতিক মনে হচ্ছিলো না। কিছুদূর যেতেই বুঝতে পারলাম অসংখ্য গুহা রয়েছে এখানটায়, পুরো এলাকাজুড়ে বিস্তৃত সেগুলি। আমি ভেবে অবাক হলাম কে বা কারা এই গুহাগুলি তৈরি করেছে! অবশ্য এর উত্তর পেতে খুব বেশি অপেক্ষা করতে হল না। একটু দূরেই কাদায় কিছু পায়ের ছাপ দেখতে পেলাম। কোন প্রাণী সদ্য তার থাবা বসিয়ে গেছে এখানটায়।
ছাপগুলি বেশ বড়, কোন সাধারণ প্রাণীর নয়। এবার আমি যেন কিছু একটা আঁচ করতে পারলাম! ভয়ে আতঙ্কে আমার ঘাড়ের চুলগুলি খাড়া হয়ে উঠলো। এগুলি আর কিছুই না! হায়েনা! সেই অতিপ্রাকৃত বিকট হায়েনা!
আমি সাথে সাথে আমার ঝোলা ঘেঁটে মানচিত্রটি বের করলাম। সাধারনত বিপদজনক এলাকাগুলি লাল কালি দিয়ে চিহ্নিত থাকে। কিন্তু এই অঞ্চলটি তেমন বিশেষভাবে চিহ্নিত নয়।
বুঝতে পারছিলাম বড় ধরনের বিপদে পড়ে গেছি। এখুনি এখান থেকে বের হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। আমি তরবারিটি খোলসছাড়া করলাম। ডানে বামে, আমার চারিদিকে একবার তাকালাম। হয়তোবা হায়েনাগুলি এই মুহূর্তে এখানে নেই, খাবারের সন্ধানে গেছে। আমাকে খুব দ্রুত এখান থেকে কেটে পড়তে হবে।
কিছুদূর এগোনোর পর বুঝতে পারলাম আমার ধারনা ভুল। কারন সামনে একটি হায়েনা আমার পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে। মুহূর্তের মধ্যেই আরও কয়েকটি হায়েনা চারিদিক থেকে আমাকে ঘিরে ফেলেছে। তাহলে শুরু থেকেই এরা আমার উপর নজর রাখছে। এটা একটা ফাঁদ বৈকি আর কিছুই নয়।
আমার জন্যই অপেক্ষা করছিলো এরা আর আমি এই ফাঁদে পা দিয়েছি।
হটাতই একটি হায়েনা প্রচণ্ড ক্ষিপ্র গতিতে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমি টালমাটাল হয়ে মাটিতে পড়ে গেলাম।
অন্য একটি হায়েনা আমার বুকের উপর উঠে দাঁড়ালো। এক মুহূর্তের জন্য আমার দম বন্ধ হয়ে এল। যেন কেউ একটা বিশাল আকৃতির পাথর আমার বুকের উপর চেপে দিয়েছে। আমি এক চুলও নড়তে পারলাম না। শরীরের সব শক্তি যেন মুহূর্তেই নিঃশেষ হয়ে গেল। হায়েনাটি আমার মুখের উপর ভারী নিঃশ্বাস ফেলছিল। কিছুক্ষনের মধ্যেই আমি জ্ঞান হারালাম।
যখন আমার জ্ঞান ফিরল, আমি নিজেকে একটি কালকুঠুরিতে আবিস্কার করলাম। শিকলে বাধা আমার হাত দুটি পেছনে প্রসারিত ছিল, আমি হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে ছিলাম। আমার কক্ষটি লোহার গারদ দিয়ে বদ্ধ ছিল।
হটাত একটি ভারী ধাতব শব্দ হল, যেন লোহার পুরনো ভারী দরজা টানার শব্দ। তারপরই ভেসে এল কিছু পায়ের আওয়াজ।
এর কিছুক্ষণের মধ্যে মহাডাইনী মালিকা আমার কুঠুরির সামনে এসে দাঁড়ালো। তাঁর পেছনে ছিল আরও দুইটি ডাইনী।
মালিকার পুরো শরীর একটি কালো আলখেল্লায় ঢাকা ছিল। হাতে ছিল একটি লম্বা ছড়ি। তাঁর পেছনের দীর্ঘ ঘন কালো চুলগুলি কোমর অবধি এসে ঠেকেছিল। চোখে ছিল গাড় কালি আর মুখে তৃপ্তির হাসি। হিংস্রতা আর ক্রোধে মিশ্রিত তাঁর সেই জঘন্য হাসি আমি আগে কখনো দেখিনি।
আমার পিতার সাথে অনেক সময় কাটিয়েছে সে কিন্তু তাঁর সেই সুশ্রী চেহারার পেছনে এমন একটি কদাকার রুপ আছে, আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।
“তোমার পিতার যোগ্য পুত্র তুমি, রাজকুমার। সত্যিই তোমাদের মন ভোলানো কত সহজ!” আমাকে উদ্দেশ্য করে কথাটি বলল মালিকা। লক্ষ্য করলাম তাঁর পাশে কেউ একজন এসে দাঁড়িয়েছে। তাঁর দিকে চোখ যেতেই আমার বুকটা ছেদ করে উঠলো। এ যে আলিয়া!
“তোমার পিতাকে বোকা বানিয়েছিলাম আমি আর তোমাকে বানিয়েছে আলিয়া।” তাচ্ছিল্যের সুরে কথাটি বলল মালিকা। মুখে মুচকি হাসি। “নিশ্চয়ই তোমার পিতা নির্জনে একাকী একটি মেয়েকে কাঁদতে দেখলে তাঁকে সাহায্য করতে বারন করেননি। তাই না, রাজকুমার?”
“কাউকে বিশ্বাস করা বা তাঁকে সাহায্য করা দোষের কিছু নয়।” আমি দাঁতে দাঁত চেপে কথাটি বললাম। “কিন্তু আমি ও আমার পিতার দুর্ভাগ্য যে তুমি বা আলিয়া কেউই সেই বিশ্বাসের যোগ্য ছিলে না।” আলিয়ার দিকে তাকালাম আমি। মাথা নিচু করে আছে সে, যেন ভয়ে জড়সড়।
“তা বটে।” ঠোঁট উল্টালো মালিকা। “কিন্তু এতো সহজে কারো প্রেমে পড়ে যাওয়াটা নিশ্চয়ই দোষের কিছু।” আলিয়ার দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসি দিল মহাডাইনী। তারপর বলল, “ডাকসা তোমাকে হত্যা করতে নয় বরং রক্ষা করতে তোমার পিছু নিয়েছিল।” মালিকার চোখ দিয়ে এবার আগুন ঠিকরে বেরচ্ছিল। “শুধু এই নির্বোধ পশুটির জন্য তোমাকে বন্দি করতে আমাকে এতোটা সময় ব্যয় করতে হয়েছে।”
মালিকার এই কথাটি শুনে আমি বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে পড়লাম। এটা কি করে সম্ভব! ডাকসা আমাকে রক্ষা করার জন্য আমার পিছু নিয়েছিল! তবে কি সেই প্রথম রাতের পশুটি ডাকসাই ছিল! তাবুর ওপারে আমার গন্ধ শুঁকছিল।
“এখন একে নিয়ে কি করবো, মহাডাইনী?” হটাতই মালিকার পাশে দাঁড়ানো ডাইনীটি কর্কশ কণ্ঠে বলে উঠলো।
“আরকান রাজ্য সম্পূর্ণ আমার না হওয়া পর্যন্ত একে জীবিত রাখতে হবে। একে আমার প্রয়োজন হতে পারে।” কথাটি বলেই ঘুরে দাঁড়ালো মালিকা। হাঁটা শুরু করলো উল্টো দিকে। “আর হ্যাঁ, ওকে আমার বিশেষ কারাগারে নিয়ে এসো। রাজকুমার বলে কথা! কিছুটা বাড়তি যত্ন আত্তি তো করতেই হয়।” যেতে যেতে কথাটি বলল সে। আলিয়া দ্রুত পায়ে তাঁকে অনুসরণ করলো। মেয়েটির আচরণ আমার কাছে বড়ই অদ্ভুত লাগছিল।
অপর ডাইনী দুটি আমার কক্ষের তালাটি খুলল। তারপর দেয়ালের শেকল থেকে আমার হাতদুটি আলগা করে আমাকে খাঁচা থেকে বের করলো।
“এই পুচকে রাজকুমার। সামনে এগিয়ে চলো।” একটি ডাইনী সজোরে আমার পিঠে ধাক্কা দিল।
(৩)
অদ্ভুত ধরনের একটি কক্ষে আমাকে নিয়ে এলো ডাইনীগুলি। কক্ষটিতে প্রবেশ করতেই একটি হলদে রঙের বড় আকারের মোমবাতি আমার দৃষ্টিগোচর হল। একটি টেবিলের উপর রাখা ছিল সেটি। আমি সেটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। কেননা এরকম আরও একটি মোমবাতি আমি আগেও দেখেছি, আমার পিতার শয়ন কক্ষে, যেদিন তিনি মূর্তিতে পরিণত হন।
আমাকে কক্ষের ঠিক মাঝামাঝি একটি স্থানে নিয়ে আসা হল। আমার মাথার উপর থেকে দুটি শেকল ঝুলছিল। আমার হাত দুটি শেকলগুলির সাথে আটকে দেয়া হল। এরপর একটি ডাইনী ঘরের এক কোনে একটি কলের কাছে গেল। কলটির লিভার ধরে টান দিল, সাথে সাথে শেকলগুলি আমাকে উপরের দিকে তুলতে শুরু করলো। ধীরে ধীরে আমার পুরো শরীর শুন্যে উঠে গেল। অন্য ডাইনিটি টেবিলের উপর থেকে মোমবাতিটি আমার কাছে নিয়ে এল। আমার পায়ের নিচে আঁকা একটি ছকের উপর সেটি বসিয়ে দিল, তারপর বাতিটি জ্বালিয়ে দিল। এই ছকটি আমি আগেও দেখেছি। আমার পিতার শয়ন কক্ষে!
আমি তখনো বুঝে উঠতে পারছিলাম না, ঠিক কি করতে যাচ্ছে মালিকা! মোম থেকে নির্গত আগুনের তাপ আমার পায়ের তলায় এসে ঠেকছিল। বলাই বাহুল্য, এতে খুব একটা কষ্ট হচ্ছিলো না আমার।
কিছুক্ষণ পর ডাইনীগুলি চুপচাপ কক্ষটি ছেড়ে চলে গেল। আমি শূন্যে স্থির ঝুলে রইলাম।
এভাবে কেটে গেছে বেশ কিছুক্ষণ। হটাত মনে হল আমার পা দুটি অসাড় হয়ে আসছে। আমি আগুনের তাপ টের পাচ্ছি না। ক্রমশ ভারী হয়ে আসেছে সেগুলি।
আমি আমার পায়ের আঙ্গুলগুলি নাড়ানোর শত চেষ্টা করলাম কিন্তু অবাক ব্যাপার আমি তা নাড়াতে পারলাম না। এবার প্রচণ্ড ভয় হল আমার। আমি ভয়ে ভয়ে নিচের দিকে তাকালাম। যা দেখলাম তাতে রক্ত হীম হয়ে যাওয়ার জোগাড় হল। আমার পায়ের পাতা থেকে শুরু করে গোড়ালি পর্যন্ত পুরোটাই পাথর হয়ে গেছে। আমি ধীরে ধীরে মূর্তিতে পরিণত হচ্ছি! এবার ভয়ে আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে পারলাম আমি। মুখ দিয়ে চিৎকার করতে লাগলাম। পা দুটি শূন্যে ছুড়তে শুরু করলাম। পাগলের মতো ছুড়তে লাগলাম।
জানি না কতক্ষন কেটে গেছে এভাবে। হটাৎ কক্ষের মূল দরজাটি খুলে যাওয়ার শব্দ পেলাম। সেদিকে মুখ ঘোরাতেই দেখতে পেলাম কেউ একজন সন্তর্পণে কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করছে।
অবয়বটির পুরো শরীর আলখেল্লায় ঢাকা ছিল। আবছা আলোয় আমি সেটার চেহারা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম না। অবয়বটি দ্রুত আমার কাছে চলে এল, মোমটি নিভিয়ে ঘরের অন্য প্রান্তে কলেটির কাছে চলে গেল। ওটার লিভার ধরে টানতেই আমি নিচে পড়ে গেলাম। আমার পা দুটি সজোরে মেঝেতে আঘাত করলো।
আমি উঠে বসতেই, আমার হাতের শেকলগুলি খুলতে লাগলো সে। আমি লক্ষ্য করলাম তাঁর হাত দুটি ক্ষনে ক্ষনে কেঁপে উঠছিল। আমি তাঁর দিকে মুখ তুলে তাকাতেই বুঝতে পারলাম, এটা আলিয়া।
“আমি আমার কৃতকর্মের জন্য অত্যন্ত দুঃখিত। আমার কাছে আর কোন উপায় ছিল না।” কাঁপা কাঁপা গলায় কথাটি বলল আলিয়া। “আমার দাদীমা আমাকে এসব করতে বাধ্য করেছে। সে নিজে মালিকার ডাইনী ছিল, আমাকেও ডাইনীতে পরিণত করতে চাইছে।” আমার একটি বাহু তাঁর কাঁধে তুলে নিল সে। আমি তাতে ভর করে উঠে দাঁড়ালাম। আমার পা দুটি তখনো অনেক ভারী লাগছিলো।
“আমি এভাবে বেশিদুর এগোতে পারবো না।” আমি বললাম।
“আমি জানি।” সাথে সাথেই উত্তর দিল আলিয়া। “আমি এর ব্যাবস্থা করে এসেছি।”
ভীত চোখে চারিদিকে একবার তাকালো আলিয়া। তারপর ধীরে ধীরে আমাকে কক্ষটি থেকে বের করে নিয়ে এল। কক্ষেটির বাইরে একটি সিঁড়ি ছিল, সেটি ধরে আমাকে উপরে নিয়ে যেতে শুরু করলো। কিছুক্ষনের মধ্যে আমরা সিঁড়ি বেয়ে মহলের ছাদ অবধি পৌঁছে গেলাম।
আলিয়া তাঁর ঝাড়ু লাঠিটি আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। বলল, “এতে ভর করেই আপনাকে পালাতে হবে।”
“কিন্তু তো … তোমার কি হবে?” আমি বললাম।
“আমাকে নিয়ে ভাববেন না।” বলল আলিয়া। “আপনার হতে খুব বেশি সময় নেই।”
আমি দেরি না করে লাঠিটির উপর উঠে বসলাম। সাথে সাথেই একটি ঝাঁকি দিয়ে উঠলো সেটি। আমাকে মেঝে থেকে কিছুটা উপরে তুলে নিল।
“এই থলেটি রাখুন।” আমার দিকে একটি থলে বাড়িয়ে দিল আলিয়া। “আর একটি কথা, এই লাঠিটি শুধু রাত্রিতেই কাজ করে, তাই আপনাকে চাঁদ ওঠার আগেই গন্তব্যে পৌছাতে হবে।” একটু থামল আলিয়া। আমার চোখে চোখ রেখে বলল, “বিদায়, রাজকুমার।”
তাঁর দিকে তাকিয়ে আমি মাথা নাড়লাম। বললাম, “আমি তোমাকে নিতে আসবো। আমার জন্য অপেক্ষা করো।”
কোন কথা বলল না আলিয়া। শুধু এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
জাদুর লাঠিটি মুহূর্তেই আমাকে উড়িয়ে নিয়ে চলল।
Ayrin kaTun, Sofikul alom, Liton vhos, Nowrin talukdar, Nera akter, Fahad islam, Israyeel hossen and লেখাটি পছন্দ করেছে
- M A Nayeemশুকতারা
- Posts : 68
স্বর্ণমুদ্রা : 1282
মর্যাদা : 20
Join date : 2021-05-22
Re: তিন চন্দ্রদিন
Fri Jun 04, 2021 4:50 pm
তৃতীয় অধ্যায়
পর্ব-১
বড় বড় মেঘের পাহাড় কাটিয়ে বিদ্যুৎ গতিতে উড়ে চলছে আমার জাদুর লাঠি। আমি শুধু চলছি আর চলছি কিন্তু পথ শেষ হয় না। রাত শেষ হতে খুব বেশি দেরি নেই। জানি সকাল হবার আগেই এই লাঠি গন্তব্যে পৌঁছে দেবে আমাকে। তাই আমার দুশ্চিন্তা এখন অন্য জায়গায়। আমার কাছে আর মাত্র একটি চন্দ্রদিন অবশিষ্ট আছে। আর কালকের দিনটিই সেই শেষ চন্দ্রদিন।
এই লাঠি হয়তো যথাসময়ে পৌছে দেবে আমাকে কিন্তু এরপর কি হবে? আমি কী পাবো শেষ পর্যন্ত জ্ঞানী বৃক্ষের দেখা? আর জ্ঞানী বৃক্ষই কি পারবে আমাকে সাহায্য করতে? পারবো কী এতো কিছু ছাপিয়ে আমার পিতাকে মানব রূপে ফিরিয়ে আনতে? এরকম হাজারো চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল আমার মাথায়।
উড়তে উড়তে আমি যে কখন রাক্ষুসে জঙ্গলের উপর চলে এসেছি ঠিক জানি না। নিচ থেকে আসা চাপা গর্জনের শব্দে ঘোর ভাঙল হটাৎ। জঙ্গলের গভীর থেকে কিছু একটা লক্ষ্য করছে আমায়।
ছোট বেলায় এই জঙ্গলের কথা অনেক শুনেছি। এখানকার সব প্রাণী বিশাল আকৃতির আর রাক্ষুসে। এখানে রয়েছে মানুষখেকো গাছ আর দানবীয় পোকা। একবার এদের হাতে পরলে আর রক্ষা নেই।
তাই এর উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় ভয়ে গাটা ছমছম করে উঠছিল। তাছাড়া অন্ধকার এখন অনেকটাই কেটে গেছে, চাঁদ উঠতেও খুব বেশি দেরি নেই।
অবশেষে আমি জ্ঞানী বৃক্ষের গ্রামের খুব কাছাকাছি পৌছে গেলাম। অদূরেই অসংখ্য বৃক্ষে ঢাকা বিশাল গ্রামটি চোখে পড়ছিল। আমি আমার উড়ন্ত লাঠিটি কিছুটা নিচে নামিয়ে আনলাম।
গ্রামের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় দেখলাম গাছগুলি এক দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। প্রশস্থ গুড়ির উপর বসানো এদের চোখমুখগুলি যেন আমাকে দেখে বিস্ময়ে হতবাক।
এরপরই হটাৎ একটা ঝিম করে শব্দ তুলতে শুরু করলো গাছগুলি, যেন কোন সতর্কবানী জারি করছে। মুহূর্তের মধ্যেই শব্দের তীক্ষ্ণতা বেড়ে গেল বহুগুন। এক সময় মনে হল পুরো গ্রামটি ঝিম শব্দে স্থবির হয়ে গেছে।
আমি ঠিক সেদিকে মনোযোগ দিতে চাইলাম না। মানচিত্র অনুযায়ী গ্রামের ঠিক কেন্দ্রে জ্ঞানী বৃক্ষের অবস্থান। এখন আমি কেন্দ্রের অনেকটাই কাছাকাছি।
হটাত একটা আগুনের গোলা দেখতে পেলাম, ঠিক আমারই দিকে উড়ে আসছে। আমি তাৎক্ষণিক সেটার পাশ কাটানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ঝাড়ুর লেজের দিকটায় আঘাত করলো সেটি। সাথে সাথে আগুন ধরে গেল ঝাড়ুটিতে। আমি সেটিকে নিয়ন্ত্রন করতে চাইলাম, নিচে নামিয়ে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করলাম।
পরমুহূর্তেই ঝাড়ুসহ মাটিতে আছড়ে পড়লাম আমি। কয়েক মুহূর্ত পরে সতবিত ফিরে এল আমার। ভুমির অনেকটা কাছাকাছি থাকায় খুব একটা আঘাত লাগেনি, তবুও পাঁজরের ভেতরটায় সামান্য ব্যথা অনুভব করছিলাম।
কিছুটা দূরে আমার থলেটি পরে ছিল। আমি কোন রকমে উঠে সেটি তুলতে গেলাম। ঠিক তখনি বিকট এক গর্জনে আমি পেছন ফিরে তাকালাম। দেখতে পেলাম বিশাল একটি দানবীয় আকৃতির সিংহ ঠিক আমারই পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, যেন এখুনি ঝাঁপিয়ে পড়বে।
“ওকে আসতে দাও।” হটাৎই একটা ভারী কণ্ঠ কথাটি বলে উঠলো। “ওর কাছে বিষম পাথর রয়েছে।” কণ্ঠটি একটি বুড়োর।
প্রায় সাথে সাথেই বিশালকায় সিংহটি আমার পথ ছেড়ে দাঁড়ালো। আমি একটি শতবর্ষ পুরনো বৃদ্ধ গাছ দেখতে পেলাম। এটাই জ্ঞানী বৃক্ষ।
প্রথম প্রকাশঃ ১৮/০৫/১৬
(২)
ভারী ও গম্ভীর চেহারার শতবর্ষ পুরনো জ্ঞানী বৃক্ষ তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ধীরে ধীরে আমার পাথুরে পা দুটি টেনে তাঁর দিকে এগোতে লাগলাম।
কিছুটা ইতস্তত ভঙ্গিতে একবার সিংহটির দিকে তাকালাম। সুবোধ প্রাণীর মতো চুপচাপ বসে ছিল সেটি। সিংহটি জ্ঞানী বৃক্ষের পাহারাদার।
“আমি আরকান রাজ্যের কনিষ্ঠ রাজকুমার।” জ্ঞানী বৃক্ষের উদ্দেশ্যে বললাম কথাটি। “আমি আপনার সাহায্যপ্রার্থী।”
তখনো স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল বৃদ্ধ। কিছুক্ষণ পর মুখ খুলল সে। খুনখুনে মোটা গলায় বলল, “বহু বছর পূর্বে তোমার পূর্বপুরুষেরা আমার প্রাণ বাঁচিয়ে ছিল। আমি উপহারসরূপ এই বিষম পাথরটি তাদের দিয়েছিলাম।” একটু থামল বুড়ো। “এই পাথরটি তার চারপাশের ঘটনাবলি ধারণ করে রাখার সামর্থ্য রাখে।”
হটাতই মাটি ফুড়ে শেকড় সদৃশ কিছু একটা বেরিয়ে এল। সাথে সাথে একটু সরে দাঁড়ালাম আমি। বুড়োটি সেদিকে নির্দেশ করে বলল, “তোমার পাথরটি ওটার উপর রাখো।”
আমি থলে থেকে উপদেষ্টার দেয়া সেই অদ্ভুত আকৃতির পাথরটি বের করলাম। শেকড়ের শীর্ষে অঙ্গুলসদৃশ শাখাগুলির উপর সেটি রাখলাম।
পর মুহূর্তেই শাখাগুলি পেঁচিয়ে ধরল পাথরটি। লক্ষ্য করলাম ইতিমধ্যে জ্ঞানী বৃক্ষ তাঁর চোখজোড়া বন্ধ করে নিয়েছে। পাথরটি ধীরে ধীরে প্রজ্বলিত হয়ে উঠেছে।
পরের বেশ কয়েকটি মুহূর্ত এভাবে ধ্যানমগ্ন হয়ে থাকলেন বৃক্ষ। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল পাথরের সাথে জড়িত সমস্ত অতীত অনুভব করতে পারছিলেন তিনি।
কিছুক্ষণ পর চোখ মেলে তাকালেন জ্ঞানী বৃক্ষ। পাথরটিও ধীরে ধীরে নিভে এল।
“রাজা মনসুরকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে রক্তিম মোম সংগ্রহ করতে হবে তোমাকে।” এবার মুখ খুললেন বৃক্ষ। “কেবলমাত্র এই মোমের প্রজ্বলিত শিখাই তাঁকে পূর্বের মনুষ্য অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারে।” একটু থামলেন তিনি, তারপর বললেন, “কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হল শুধুমাত্র রাক্ষুসে জঙ্গলেই এই মোমের দেখা পাওয়া যায়। এবং অতিকায় মৌমাছিরা সংগ্রহ করে রাখে এটি।”
এবার যেন প্রচণ্ড হতাশা গ্রাস করে বসলো আমাকে। এখন আমি কি করবো! কীভাবে ঐ ভয়ানক জঙ্গল থেকে এই মোম সংগ্রহ করবো!
মনে হল আমার মনের অবস্থা কিছুটা হলেও বুঝতে পারলেন জ্ঞানী বৃক্ষ। বললেন, “আমার পাহারাদার সিংহ সেখানে পৌঁছে দেবে তোমাকে।”
তাঁর এই কথায় আমি ভীষণ অবাক হলাম। বললাম, “কিন্তু এতে করে তো আপনি অরক্ষিত হয়ে পরবেন।”
“আমাকে নিয়ে ভেব না।” উত্তর দিলেন বৃক্ষ। “এই গ্রামে সুরক্ষিত আমি। এখানে কেউ আমার ক্ষতি করতে পারবে না।”
সিংহটি কিছুটা নিচু হয়ে আমাকে তার পিঠে চড়ার জন্য আমন্ত্রন জানালো। আমি সেটার পিঠে চড়ে বসলাম। এরকম অতিকায় প্রাণীর পিঠে আমি আগে কখনো চড়িনি।
কিছুক্ষনের মধ্যে আমি জ্ঞানী বৃক্ষের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাক্ষুসে জঙ্গলের উদ্দেশ্যে রওনা করলাম।
৩
সুবিশাল, গহীন রাক্ষুসে জঙ্গল মূলত একদল অতিকায় মৌমাছি ও তাদের মহারানী কর্তৃক শাসিত। ছোটবেলায় এই জঙ্গল নিয়ে অনেক গল্প, কাহিনী পড়েছি কিন্তু কখনো সত্যি সত্যি এখানটায় আসতে হবে ভাবিনি।
ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ঘটনাচক্রে আজ এই জঙ্গলেই পা দিতে হচ্ছে আমাকে। আমি ও পাহারাদার সিংহ জঙ্গলের পথ অতিক্রম করছি।
পথিমধ্যে সিংহের সাথে ভীষণ ভাব জমে গেছে আমার। মনে হচ্ছিলো কতদিনের পুরনো বন্ধু আমরা।
জঙ্গলের দানবীয় পোকাদের মতো এখানকার গাছগুলিও সুবিশাল আর উচু, যেন উপরে আকাশের মেঘ ফুরে বেড়িয়ে গেছে সেগুলি। তাই দিনের আলো কখনো এই জঙ্গলের ভেতরটায় পৌছায় না।
আমি থলে থেকে মশালটি বের করে তাতে আগুন ধরালাম। মশালের আলোয় চারিদিকটা একবার দেখে নিলাম। গাছের ডালপালা, শাখা প্রশাখার আড়াল থেকে কোন কিছুর নড়াচড়ার ক্ষীণ একটা শব্দ আমার কানে ভেসে আসছিল। কিছু একটা আঁচ করতে পারছিলাম আমি। অন্ধকারে কেউ বা কারা আমাদের উপর নজর রাখছে।
দানবীয় পোকা! এরা আমাদের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে কিন্তু ঠিক আক্রমণ করার সাহস পাচ্ছে না। হয়তোবা বিশালকায় সিংহটির ভয়ে।
আমি মশালটি শক্ত করে ধরলাম। এই মশাল শুধু আমাকে পথই দেখাবে না, রক্ষা করবে এই পোকাদের হাত থেকেও।
বেশ কিছুদূর সামনে এগোনোর পর আমরা জঙ্গলের পূর্ব দিকটায় এসে পৌঁছালাম। এই অঞ্চলটিই অতিকায় মৌমাছিদের মূল ঘাটি। আমি পাহারাদার সিংহের পিঠ থেকে নেমে পড়লাম। আশেপাশ থেকে বড়সড় একটা গাছের ডাল খুঁজে বের করলাম। ডালটিতে ভর করে আমার থলে থেকে কিছু সুগন্ধি ফুল বের করলাম। জ্ঞানী বৃক্ষের গ্রাম থেকে এগুলি সংগ্রহ করেছি আমি। এই ফুলগুলি আমাকে মৌমাছিদের কাছে পৌঁছ দিতে সাহায্য করবে।
এবার অপেক্ষার পালা, বাকি কাজ করবে এই ফুল ও তার মিষ্টি ঘ্রাণ।
কিছুক্ষনের মধ্যেই আমি জঙ্গলের গভীর থেকে পাখার কম্পনের শব্দ শুনতে পেলাম। পরক্ষনেই কয়েকটা বিশাল আকৃতির মৌমাছি জঙ্গল ফুরে বেরিয়ে এল। চারপাশ দিয়ে আমাদের ঘিরে ধরল।
“আমি মৌ রানীর সাথে দেখা করতে চাই।” তাদের উদ্দেশ্য করে বললাম কথাটি। “তাঁর সাহায্য আমার খুবই প্রয়োজন।” মৌমাছিগুলি কোন রকম শব্দ করলো না।
হটাৎ একটি মৌমাছি আমার ঠিক কাছাকাছি নিচে নেমে এল। আমি কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়ে পেছনে সরে গেলাম। কিছুক্ষণ ইতস্তত করলাম। তারপর বুঝতে পারলাম আমাকে ওটার পিঠে চড়ে বসতে হবে।
আর এক মুহূর্ত দেরি না করে আমি মৌমাছিটির পিঠে চড়ে বসলাম। আমাকে পিঠে নিয়ে সাথে সাথেই উড়াল দিল অতিকায় প্রাণীটি। নিচে আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল আমার পাহারাদার সিংহ।
মৌমাছিটি বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে চলছিল। চলছিল ঘন জঙ্গল, গাছপালা সব কিছু ছাপিয়ে। কিছুক্ষণ এভাবে উড়ে চলার পর অদূরেই মহলসদৃশ বিশাল আকৃতির একটি মৌমাছির চাক আবিস্কার করলাম আমি। চাকটি একটি সুবিশাল গাছের মগডাল থেকে নিচের দিকে ঝুলছিল।
আমি এরকম দৃশ্য আগে কখনো দেখিনি। বিস্ময়ে মুখ হা হয়ে এল আমার। আমার বাকি সঙ্গীরা থাকলে নিশ্চয়ই এই দৃশ্যটি দেখে বিস্ময়ে হতবম্ব হয়ে পড়তো। ছোটবেলায় গল্পগুলির সাথে যেন এবার অনেকটাই মিল খুঁজে পেলাম।
ঝুলন্ত এই মহলের ভেতরে প্রবেশ করার জন্য একটি বিশাল গোলাকার দ্বার ছিল। মৌমাছিটি আমাকে সেই দ্বার দিয়ে মহলের অভ্যন্তরে নিয়ে গেল। স্বর্ণ দিয়ে মোড়ানো মহলের প্রতিটি দেয়াল অসংখ্য ছোট ছোট খোপ দিয়ে ভর্তি ছিল। জায়গাটি দেখতে অবিকল মৌমাছির চাকের মতো, শুধু পার্থক্য ছিল এটি অনেক বিশাল। উড়ে চলার সময় নিজের অজান্তেই আমার মুখ দিয়ে একটি ক্ষীণ চিৎকার বেরোল। মহলের দেয়ালগুলিতে সেটি যেন বারবার প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠলো।
কিছুক্ষণের মধ্যে একটি বিশাল হলঘরের মতো স্থানে আমাকে নিয়ে এল মাছিটি। অবশেষে এখানে এসে থামল সেটি। আমি ওটার পিঠ থেকে নেমে পড়লাম। কিছুটা দূরে একটি সিংহাসন দেখতে পেলাম। সেখানে মানবসদৃশ কেউ একজন বসে আছে। স্বর্ণের অলংকারে মোড়ানো তাঁর শরীরে ছিল রাজকীয় পোশাক। পেছনে দুটি সচ্ছ পাখা। একটি মেয়ে! একজন মধ্যবয়সী রমণী!
এটা ছিল আমার বিস্ময়ের সর্বশেষ ধাপ। আমি তখনো পুরোপুরি ধাতস্ত হতে পারিনি। তাহলে এটাই মৌমাছিদের মহারানী! মৌ রানী!
------------------------------------------------
৪
আমি শুরুতেই অতিকায় মৌমাছিদের মহারানীকে একবার কুর্নিশ করলাম। মহারানী মুখ তুলে তাকালেন আমার দিকে। তাঁর চোখদুটি ছিল গাড় কাজল দিয়ে আঁকানো। তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে আমাকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করলেন।
কিছুটা ইতস্তত হয়ে আমি প্রথমেই তাঁর কাছে ক্ষমা চাইলাম। “বিনা অনুমতিতে আপনার এলাকায় প্রবেশের জন্য আমি খুবই দুঃখিত, মহারানী।” আমি বললাম। তিনি কোন উত্তর করলেন না। “আমি আরকান রাজ্যের কনিষ্ঠ রাজপুত্র। আমার পিতা আরকান রাজ্যের রাজা মনসুর দুর্ভাগ্যক্রমে একটি পাথুরে মূর্তিতে পরিণত হয়েছেন।” আমি একটু থামলাম। লক্ষ্য করলাম, মহারানী এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি কথা চালিয়ে গেলাম, “তাঁকে পুনরায় মানবরুপে ফিরিয়ে আনতে আপনার সাহায্য খুবই প্রয়োজন। বস্তুত রক্তিম মোমের প্রয়োজন।”
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন মহারানী। আমার কথার কোন জবাব দিলেন না। শুধু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।
অবশেষে নীরবতা ভাঙলেন তিনি। বললেন, “তোমার চাচা আনসুরও তোমার মতো প্রচণ্ড সাহসী ও রোমাঞ্চপ্রিয় ছিল।” কথাটি শুনে আমি ভীষণ অবাক হলাম। আমার চাচার প্রশংসা মহারানীর মুখে! কিছুই ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
মনে হয় ব্যাপারটি কিছুটা আঁচ করতে পারলেন মহারানী। বললেন, “বহু বছর পূর্বে কোন বিশেষ অভিযানে তোমার চাচাও ঠিক তোমার মতো করেই এই জঙ্গলে এসেছিলেন।” একটু থামলেন তিনি। তারপর বললেন, “অসংখ্য বছর কোন মানুষ এই জঙ্গলে পা রাখেনি। তাই তাঁর বীরত্বে আমি তখন ভীষণ অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম।” একটু বিরতি নিলেন তিনি। “সেই থেকে তাঁর সাথে আমার পরিচয়। নিখোঁজ হবার ঠিক আগের দিনও আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল সে।” এবার থামলেন মহারানী। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কিছুটা বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল তাঁকে। “জাদুকর পারাগের বিষয়টি জেনে গিয়েছিল আনসুর। সম্ভবত জানতে পেরেছিল আরও বেশি কিছু।” মাথা নিচু করে ফেললেন মহারানী। তাঁকে ব্যথিত লাগছিল।
অসামান্য দুষ্টবুদ্ধি সম্পন্ন জাদুকর পারাগ অতিগোপনে কালো জাদুর চর্চা করতো। গ্রামের সাধাসিধে মানুষগুলিকে ভুলিয়ে ভালিয়ে তাঁর মহলে নিয়ে যেতো। তারপর জাদু দিয়ে মোহগ্রস্থ করে তাদের মূর্তিতে পরিণত করতো। শুধু এটুকুই নয়, তারপর সেই মূর্তিগুলিকে সে অন্য রাজ্যের হাটে নিয়ে চড়া দামে বিক্রি করতো।
একসময় ব্যাপারটি আমার পিতার দৃষ্টিগোচর হয়। তিনি আমার চাচাকে ঘটনাটি তদন্তের জন্য নিয়োজিত করেন। অনুসন্ধানের এক পর্যায়ে তিনি পারাগের মহলে যান। আর সেটাই তাঁর কাল হয়ে দাড়ায়।
তিনি আর কখনো ফেরত আসেননি।
আমার চাচার নিখোঁজ হয়ে যাবার ব্যাপারটি তখন গুরুতর আকার ধারণ করে পুরো রাজ্যে। আমার পিতা পারাগের মহল আক্রমণ করেন। পালাতে ব্যর্থ হয় পারাগ এবং ঘটনাস্থলেই নিহত হয়।
অতঃপর পারাগের মহল থেকে উদ্ধার করা হয় অসংখ্য মানুষের মূর্তি। যদিও আমার চাচার কোন মূর্তি সেখানে পাওয়া যায়নি।
এই ঘটনার পর থেকে আরকান রাজ্যে কালো জাদু চর্চা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
“নিশ্চয়ই মালিকা রাজা মনসুরের এই পরিণতির জন্য দায়ী।” হটাৎ করেই কথাটি বলে উঠলেন মহারানী।
আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে হয়ে পড়লাম। বললাম, “আজ্ঞে হ্যাঁ। কিন্তু আপনি তা জানতে পারলেন কি করে?”
“মালিকা পারাগের কন্যা।” ঠাণ্ডা কণ্ঠে জবাব দিলেন মহারানী। আমি তাঁর দিকে স্থির তাকিয়ে রইলাম।
এবার ধীরে ধীরে সবকিছু পরিষ্কার হতে লাগলো আমার কাছে। তাহলে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতেই আরকান রাজ্য আক্রমণ করেছে মালিকা! পিতার মতো সে নিজেও কালো জাদুতে পারদর্শী!
“আমি তোমাকে সাহায্য করবো, রাজকুমার। কিন্তু তার আগে তুমি তোমার পিতাকে সুস্থ করো।" একটি মৌমাছির দিকে তাকিয়ে তিনি কিছু একটা ইঙ্গিত করলেন। "এই মাছিটি খুব দ্রুত তোমাকে তোমার রাজ্যে পৌঁছে দেবে।”
এরপর আমি আর দেরি করিনি। খুব দ্রুতই রক্তিম মোম সংগ্রহ করে মহারানীর কাছ থেকে বিদায় নেই। নিচে পাহারাদার সিংহের সাথে দেখা করে তাঁকে গ্রামে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেই। তারপর অতিকায় মৌমাছির পিঠে করে রওনা করি আরকান রাজ্যের উদ্দেশ্যে।
পর্ব-১
বড় বড় মেঘের পাহাড় কাটিয়ে বিদ্যুৎ গতিতে উড়ে চলছে আমার জাদুর লাঠি। আমি শুধু চলছি আর চলছি কিন্তু পথ শেষ হয় না। রাত শেষ হতে খুব বেশি দেরি নেই। জানি সকাল হবার আগেই এই লাঠি গন্তব্যে পৌঁছে দেবে আমাকে। তাই আমার দুশ্চিন্তা এখন অন্য জায়গায়। আমার কাছে আর মাত্র একটি চন্দ্রদিন অবশিষ্ট আছে। আর কালকের দিনটিই সেই শেষ চন্দ্রদিন।
এই লাঠি হয়তো যথাসময়ে পৌছে দেবে আমাকে কিন্তু এরপর কি হবে? আমি কী পাবো শেষ পর্যন্ত জ্ঞানী বৃক্ষের দেখা? আর জ্ঞানী বৃক্ষই কি পারবে আমাকে সাহায্য করতে? পারবো কী এতো কিছু ছাপিয়ে আমার পিতাকে মানব রূপে ফিরিয়ে আনতে? এরকম হাজারো চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল আমার মাথায়।
উড়তে উড়তে আমি যে কখন রাক্ষুসে জঙ্গলের উপর চলে এসেছি ঠিক জানি না। নিচ থেকে আসা চাপা গর্জনের শব্দে ঘোর ভাঙল হটাৎ। জঙ্গলের গভীর থেকে কিছু একটা লক্ষ্য করছে আমায়।
ছোট বেলায় এই জঙ্গলের কথা অনেক শুনেছি। এখানকার সব প্রাণী বিশাল আকৃতির আর রাক্ষুসে। এখানে রয়েছে মানুষখেকো গাছ আর দানবীয় পোকা। একবার এদের হাতে পরলে আর রক্ষা নেই।
তাই এর উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় ভয়ে গাটা ছমছম করে উঠছিল। তাছাড়া অন্ধকার এখন অনেকটাই কেটে গেছে, চাঁদ উঠতেও খুব বেশি দেরি নেই।
অবশেষে আমি জ্ঞানী বৃক্ষের গ্রামের খুব কাছাকাছি পৌছে গেলাম। অদূরেই অসংখ্য বৃক্ষে ঢাকা বিশাল গ্রামটি চোখে পড়ছিল। আমি আমার উড়ন্ত লাঠিটি কিছুটা নিচে নামিয়ে আনলাম।
গ্রামের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় দেখলাম গাছগুলি এক দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। প্রশস্থ গুড়ির উপর বসানো এদের চোখমুখগুলি যেন আমাকে দেখে বিস্ময়ে হতবাক।
এরপরই হটাৎ একটা ঝিম করে শব্দ তুলতে শুরু করলো গাছগুলি, যেন কোন সতর্কবানী জারি করছে। মুহূর্তের মধ্যেই শব্দের তীক্ষ্ণতা বেড়ে গেল বহুগুন। এক সময় মনে হল পুরো গ্রামটি ঝিম শব্দে স্থবির হয়ে গেছে।
আমি ঠিক সেদিকে মনোযোগ দিতে চাইলাম না। মানচিত্র অনুযায়ী গ্রামের ঠিক কেন্দ্রে জ্ঞানী বৃক্ষের অবস্থান। এখন আমি কেন্দ্রের অনেকটাই কাছাকাছি।
হটাত একটা আগুনের গোলা দেখতে পেলাম, ঠিক আমারই দিকে উড়ে আসছে। আমি তাৎক্ষণিক সেটার পাশ কাটানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ঝাড়ুর লেজের দিকটায় আঘাত করলো সেটি। সাথে সাথে আগুন ধরে গেল ঝাড়ুটিতে। আমি সেটিকে নিয়ন্ত্রন করতে চাইলাম, নিচে নামিয়ে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করলাম।
পরমুহূর্তেই ঝাড়ুসহ মাটিতে আছড়ে পড়লাম আমি। কয়েক মুহূর্ত পরে সতবিত ফিরে এল আমার। ভুমির অনেকটা কাছাকাছি থাকায় খুব একটা আঘাত লাগেনি, তবুও পাঁজরের ভেতরটায় সামান্য ব্যথা অনুভব করছিলাম।
কিছুটা দূরে আমার থলেটি পরে ছিল। আমি কোন রকমে উঠে সেটি তুলতে গেলাম। ঠিক তখনি বিকট এক গর্জনে আমি পেছন ফিরে তাকালাম। দেখতে পেলাম বিশাল একটি দানবীয় আকৃতির সিংহ ঠিক আমারই পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, যেন এখুনি ঝাঁপিয়ে পড়বে।
“ওকে আসতে দাও।” হটাৎই একটা ভারী কণ্ঠ কথাটি বলে উঠলো। “ওর কাছে বিষম পাথর রয়েছে।” কণ্ঠটি একটি বুড়োর।
প্রায় সাথে সাথেই বিশালকায় সিংহটি আমার পথ ছেড়ে দাঁড়ালো। আমি একটি শতবর্ষ পুরনো বৃদ্ধ গাছ দেখতে পেলাম। এটাই জ্ঞানী বৃক্ষ।
প্রথম প্রকাশঃ ১৮/০৫/১৬
(২)
ভারী ও গম্ভীর চেহারার শতবর্ষ পুরনো জ্ঞানী বৃক্ষ তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ধীরে ধীরে আমার পাথুরে পা দুটি টেনে তাঁর দিকে এগোতে লাগলাম।
কিছুটা ইতস্তত ভঙ্গিতে একবার সিংহটির দিকে তাকালাম। সুবোধ প্রাণীর মতো চুপচাপ বসে ছিল সেটি। সিংহটি জ্ঞানী বৃক্ষের পাহারাদার।
“আমি আরকান রাজ্যের কনিষ্ঠ রাজকুমার।” জ্ঞানী বৃক্ষের উদ্দেশ্যে বললাম কথাটি। “আমি আপনার সাহায্যপ্রার্থী।”
তখনো স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল বৃদ্ধ। কিছুক্ষণ পর মুখ খুলল সে। খুনখুনে মোটা গলায় বলল, “বহু বছর পূর্বে তোমার পূর্বপুরুষেরা আমার প্রাণ বাঁচিয়ে ছিল। আমি উপহারসরূপ এই বিষম পাথরটি তাদের দিয়েছিলাম।” একটু থামল বুড়ো। “এই পাথরটি তার চারপাশের ঘটনাবলি ধারণ করে রাখার সামর্থ্য রাখে।”
হটাতই মাটি ফুড়ে শেকড় সদৃশ কিছু একটা বেরিয়ে এল। সাথে সাথে একটু সরে দাঁড়ালাম আমি। বুড়োটি সেদিকে নির্দেশ করে বলল, “তোমার পাথরটি ওটার উপর রাখো।”
আমি থলে থেকে উপদেষ্টার দেয়া সেই অদ্ভুত আকৃতির পাথরটি বের করলাম। শেকড়ের শীর্ষে অঙ্গুলসদৃশ শাখাগুলির উপর সেটি রাখলাম।
পর মুহূর্তেই শাখাগুলি পেঁচিয়ে ধরল পাথরটি। লক্ষ্য করলাম ইতিমধ্যে জ্ঞানী বৃক্ষ তাঁর চোখজোড়া বন্ধ করে নিয়েছে। পাথরটি ধীরে ধীরে প্রজ্বলিত হয়ে উঠেছে।
পরের বেশ কয়েকটি মুহূর্ত এভাবে ধ্যানমগ্ন হয়ে থাকলেন বৃক্ষ। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল পাথরের সাথে জড়িত সমস্ত অতীত অনুভব করতে পারছিলেন তিনি।
কিছুক্ষণ পর চোখ মেলে তাকালেন জ্ঞানী বৃক্ষ। পাথরটিও ধীরে ধীরে নিভে এল।
“রাজা মনসুরকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে রক্তিম মোম সংগ্রহ করতে হবে তোমাকে।” এবার মুখ খুললেন বৃক্ষ। “কেবলমাত্র এই মোমের প্রজ্বলিত শিখাই তাঁকে পূর্বের মনুষ্য অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারে।” একটু থামলেন তিনি, তারপর বললেন, “কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হল শুধুমাত্র রাক্ষুসে জঙ্গলেই এই মোমের দেখা পাওয়া যায়। এবং অতিকায় মৌমাছিরা সংগ্রহ করে রাখে এটি।”
এবার যেন প্রচণ্ড হতাশা গ্রাস করে বসলো আমাকে। এখন আমি কি করবো! কীভাবে ঐ ভয়ানক জঙ্গল থেকে এই মোম সংগ্রহ করবো!
মনে হল আমার মনের অবস্থা কিছুটা হলেও বুঝতে পারলেন জ্ঞানী বৃক্ষ। বললেন, “আমার পাহারাদার সিংহ সেখানে পৌঁছে দেবে তোমাকে।”
তাঁর এই কথায় আমি ভীষণ অবাক হলাম। বললাম, “কিন্তু এতে করে তো আপনি অরক্ষিত হয়ে পরবেন।”
“আমাকে নিয়ে ভেব না।” উত্তর দিলেন বৃক্ষ। “এই গ্রামে সুরক্ষিত আমি। এখানে কেউ আমার ক্ষতি করতে পারবে না।”
সিংহটি কিছুটা নিচু হয়ে আমাকে তার পিঠে চড়ার জন্য আমন্ত্রন জানালো। আমি সেটার পিঠে চড়ে বসলাম। এরকম অতিকায় প্রাণীর পিঠে আমি আগে কখনো চড়িনি।
কিছুক্ষনের মধ্যে আমি জ্ঞানী বৃক্ষের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাক্ষুসে জঙ্গলের উদ্দেশ্যে রওনা করলাম।
৩
সুবিশাল, গহীন রাক্ষুসে জঙ্গল মূলত একদল অতিকায় মৌমাছি ও তাদের মহারানী কর্তৃক শাসিত। ছোটবেলায় এই জঙ্গল নিয়ে অনেক গল্প, কাহিনী পড়েছি কিন্তু কখনো সত্যি সত্যি এখানটায় আসতে হবে ভাবিনি।
ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ঘটনাচক্রে আজ এই জঙ্গলেই পা দিতে হচ্ছে আমাকে। আমি ও পাহারাদার সিংহ জঙ্গলের পথ অতিক্রম করছি।
পথিমধ্যে সিংহের সাথে ভীষণ ভাব জমে গেছে আমার। মনে হচ্ছিলো কতদিনের পুরনো বন্ধু আমরা।
জঙ্গলের দানবীয় পোকাদের মতো এখানকার গাছগুলিও সুবিশাল আর উচু, যেন উপরে আকাশের মেঘ ফুরে বেড়িয়ে গেছে সেগুলি। তাই দিনের আলো কখনো এই জঙ্গলের ভেতরটায় পৌছায় না।
আমি থলে থেকে মশালটি বের করে তাতে আগুন ধরালাম। মশালের আলোয় চারিদিকটা একবার দেখে নিলাম। গাছের ডালপালা, শাখা প্রশাখার আড়াল থেকে কোন কিছুর নড়াচড়ার ক্ষীণ একটা শব্দ আমার কানে ভেসে আসছিল। কিছু একটা আঁচ করতে পারছিলাম আমি। অন্ধকারে কেউ বা কারা আমাদের উপর নজর রাখছে।
দানবীয় পোকা! এরা আমাদের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে কিন্তু ঠিক আক্রমণ করার সাহস পাচ্ছে না। হয়তোবা বিশালকায় সিংহটির ভয়ে।
আমি মশালটি শক্ত করে ধরলাম। এই মশাল শুধু আমাকে পথই দেখাবে না, রক্ষা করবে এই পোকাদের হাত থেকেও।
বেশ কিছুদূর সামনে এগোনোর পর আমরা জঙ্গলের পূর্ব দিকটায় এসে পৌঁছালাম। এই অঞ্চলটিই অতিকায় মৌমাছিদের মূল ঘাটি। আমি পাহারাদার সিংহের পিঠ থেকে নেমে পড়লাম। আশেপাশ থেকে বড়সড় একটা গাছের ডাল খুঁজে বের করলাম। ডালটিতে ভর করে আমার থলে থেকে কিছু সুগন্ধি ফুল বের করলাম। জ্ঞানী বৃক্ষের গ্রাম থেকে এগুলি সংগ্রহ করেছি আমি। এই ফুলগুলি আমাকে মৌমাছিদের কাছে পৌঁছ দিতে সাহায্য করবে।
এবার অপেক্ষার পালা, বাকি কাজ করবে এই ফুল ও তার মিষ্টি ঘ্রাণ।
কিছুক্ষনের মধ্যেই আমি জঙ্গলের গভীর থেকে পাখার কম্পনের শব্দ শুনতে পেলাম। পরক্ষনেই কয়েকটা বিশাল আকৃতির মৌমাছি জঙ্গল ফুরে বেরিয়ে এল। চারপাশ দিয়ে আমাদের ঘিরে ধরল।
“আমি মৌ রানীর সাথে দেখা করতে চাই।” তাদের উদ্দেশ্য করে বললাম কথাটি। “তাঁর সাহায্য আমার খুবই প্রয়োজন।” মৌমাছিগুলি কোন রকম শব্দ করলো না।
হটাৎ একটি মৌমাছি আমার ঠিক কাছাকাছি নিচে নেমে এল। আমি কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়ে পেছনে সরে গেলাম। কিছুক্ষণ ইতস্তত করলাম। তারপর বুঝতে পারলাম আমাকে ওটার পিঠে চড়ে বসতে হবে।
আর এক মুহূর্ত দেরি না করে আমি মৌমাছিটির পিঠে চড়ে বসলাম। আমাকে পিঠে নিয়ে সাথে সাথেই উড়াল দিল অতিকায় প্রাণীটি। নিচে আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল আমার পাহারাদার সিংহ।
মৌমাছিটি বিদ্যুৎ গতিতে ছুটে চলছিল। চলছিল ঘন জঙ্গল, গাছপালা সব কিছু ছাপিয়ে। কিছুক্ষণ এভাবে উড়ে চলার পর অদূরেই মহলসদৃশ বিশাল আকৃতির একটি মৌমাছির চাক আবিস্কার করলাম আমি। চাকটি একটি সুবিশাল গাছের মগডাল থেকে নিচের দিকে ঝুলছিল।
আমি এরকম দৃশ্য আগে কখনো দেখিনি। বিস্ময়ে মুখ হা হয়ে এল আমার। আমার বাকি সঙ্গীরা থাকলে নিশ্চয়ই এই দৃশ্যটি দেখে বিস্ময়ে হতবম্ব হয়ে পড়তো। ছোটবেলায় গল্পগুলির সাথে যেন এবার অনেকটাই মিল খুঁজে পেলাম।
ঝুলন্ত এই মহলের ভেতরে প্রবেশ করার জন্য একটি বিশাল গোলাকার দ্বার ছিল। মৌমাছিটি আমাকে সেই দ্বার দিয়ে মহলের অভ্যন্তরে নিয়ে গেল। স্বর্ণ দিয়ে মোড়ানো মহলের প্রতিটি দেয়াল অসংখ্য ছোট ছোট খোপ দিয়ে ভর্তি ছিল। জায়গাটি দেখতে অবিকল মৌমাছির চাকের মতো, শুধু পার্থক্য ছিল এটি অনেক বিশাল। উড়ে চলার সময় নিজের অজান্তেই আমার মুখ দিয়ে একটি ক্ষীণ চিৎকার বেরোল। মহলের দেয়ালগুলিতে সেটি যেন বারবার প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠলো।
কিছুক্ষণের মধ্যে একটি বিশাল হলঘরের মতো স্থানে আমাকে নিয়ে এল মাছিটি। অবশেষে এখানে এসে থামল সেটি। আমি ওটার পিঠ থেকে নেমে পড়লাম। কিছুটা দূরে একটি সিংহাসন দেখতে পেলাম। সেখানে মানবসদৃশ কেউ একজন বসে আছে। স্বর্ণের অলংকারে মোড়ানো তাঁর শরীরে ছিল রাজকীয় পোশাক। পেছনে দুটি সচ্ছ পাখা। একটি মেয়ে! একজন মধ্যবয়সী রমণী!
এটা ছিল আমার বিস্ময়ের সর্বশেষ ধাপ। আমি তখনো পুরোপুরি ধাতস্ত হতে পারিনি। তাহলে এটাই মৌমাছিদের মহারানী! মৌ রানী!
------------------------------------------------
৪
আমি শুরুতেই অতিকায় মৌমাছিদের মহারানীকে একবার কুর্নিশ করলাম। মহারানী মুখ তুলে তাকালেন আমার দিকে। তাঁর চোখদুটি ছিল গাড় কাজল দিয়ে আঁকানো। তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে আমাকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করলেন।
কিছুটা ইতস্তত হয়ে আমি প্রথমেই তাঁর কাছে ক্ষমা চাইলাম। “বিনা অনুমতিতে আপনার এলাকায় প্রবেশের জন্য আমি খুবই দুঃখিত, মহারানী।” আমি বললাম। তিনি কোন উত্তর করলেন না। “আমি আরকান রাজ্যের কনিষ্ঠ রাজপুত্র। আমার পিতা আরকান রাজ্যের রাজা মনসুর দুর্ভাগ্যক্রমে একটি পাথুরে মূর্তিতে পরিণত হয়েছেন।” আমি একটু থামলাম। লক্ষ্য করলাম, মহারানী এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি কথা চালিয়ে গেলাম, “তাঁকে পুনরায় মানবরুপে ফিরিয়ে আনতে আপনার সাহায্য খুবই প্রয়োজন। বস্তুত রক্তিম মোমের প্রয়োজন।”
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন মহারানী। আমার কথার কোন জবাব দিলেন না। শুধু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।
অবশেষে নীরবতা ভাঙলেন তিনি। বললেন, “তোমার চাচা আনসুরও তোমার মতো প্রচণ্ড সাহসী ও রোমাঞ্চপ্রিয় ছিল।” কথাটি শুনে আমি ভীষণ অবাক হলাম। আমার চাচার প্রশংসা মহারানীর মুখে! কিছুই ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
মনে হয় ব্যাপারটি কিছুটা আঁচ করতে পারলেন মহারানী। বললেন, “বহু বছর পূর্বে কোন বিশেষ অভিযানে তোমার চাচাও ঠিক তোমার মতো করেই এই জঙ্গলে এসেছিলেন।” একটু থামলেন তিনি। তারপর বললেন, “অসংখ্য বছর কোন মানুষ এই জঙ্গলে পা রাখেনি। তাই তাঁর বীরত্বে আমি তখন ভীষণ অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম।” একটু বিরতি নিলেন তিনি। “সেই থেকে তাঁর সাথে আমার পরিচয়। নিখোঁজ হবার ঠিক আগের দিনও আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল সে।” এবার থামলেন মহারানী। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কিছুটা বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল তাঁকে। “জাদুকর পারাগের বিষয়টি জেনে গিয়েছিল আনসুর। সম্ভবত জানতে পেরেছিল আরও বেশি কিছু।” মাথা নিচু করে ফেললেন মহারানী। তাঁকে ব্যথিত লাগছিল।
অসামান্য দুষ্টবুদ্ধি সম্পন্ন জাদুকর পারাগ অতিগোপনে কালো জাদুর চর্চা করতো। গ্রামের সাধাসিধে মানুষগুলিকে ভুলিয়ে ভালিয়ে তাঁর মহলে নিয়ে যেতো। তারপর জাদু দিয়ে মোহগ্রস্থ করে তাদের মূর্তিতে পরিণত করতো। শুধু এটুকুই নয়, তারপর সেই মূর্তিগুলিকে সে অন্য রাজ্যের হাটে নিয়ে চড়া দামে বিক্রি করতো।
একসময় ব্যাপারটি আমার পিতার দৃষ্টিগোচর হয়। তিনি আমার চাচাকে ঘটনাটি তদন্তের জন্য নিয়োজিত করেন। অনুসন্ধানের এক পর্যায়ে তিনি পারাগের মহলে যান। আর সেটাই তাঁর কাল হয়ে দাড়ায়।
তিনি আর কখনো ফেরত আসেননি।
আমার চাচার নিখোঁজ হয়ে যাবার ব্যাপারটি তখন গুরুতর আকার ধারণ করে পুরো রাজ্যে। আমার পিতা পারাগের মহল আক্রমণ করেন। পালাতে ব্যর্থ হয় পারাগ এবং ঘটনাস্থলেই নিহত হয়।
অতঃপর পারাগের মহল থেকে উদ্ধার করা হয় অসংখ্য মানুষের মূর্তি। যদিও আমার চাচার কোন মূর্তি সেখানে পাওয়া যায়নি।
এই ঘটনার পর থেকে আরকান রাজ্যে কালো জাদু চর্চা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
“নিশ্চয়ই মালিকা রাজা মনসুরের এই পরিণতির জন্য দায়ী।” হটাৎ করেই কথাটি বলে উঠলেন মহারানী।
আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে হয়ে পড়লাম। বললাম, “আজ্ঞে হ্যাঁ। কিন্তু আপনি তা জানতে পারলেন কি করে?”
“মালিকা পারাগের কন্যা।” ঠাণ্ডা কণ্ঠে জবাব দিলেন মহারানী। আমি তাঁর দিকে স্থির তাকিয়ে রইলাম।
এবার ধীরে ধীরে সবকিছু পরিষ্কার হতে লাগলো আমার কাছে। তাহলে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতেই আরকান রাজ্য আক্রমণ করেছে মালিকা! পিতার মতো সে নিজেও কালো জাদুতে পারদর্শী!
“আমি তোমাকে সাহায্য করবো, রাজকুমার। কিন্তু তার আগে তুমি তোমার পিতাকে সুস্থ করো।" একটি মৌমাছির দিকে তাকিয়ে তিনি কিছু একটা ইঙ্গিত করলেন। "এই মাছিটি খুব দ্রুত তোমাকে তোমার রাজ্যে পৌঁছে দেবে।”
এরপর আমি আর দেরি করিনি। খুব দ্রুতই রক্তিম মোম সংগ্রহ করে মহারানীর কাছ থেকে বিদায় নেই। নিচে পাহারাদার সিংহের সাথে দেখা করে তাঁকে গ্রামে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেই। তারপর অতিকায় মৌমাছির পিঠে করে রওনা করি আরকান রাজ্যের উদ্দেশ্যে।
Ayrin kaTun, Sofikul alom, Liton vhos, Nowrin talukdar, Nera akter, Fahad islam, Israyeel hossen and লেখাটি পছন্দ করেছে
- M A Nayeemশুকতারা
- Posts : 68
স্বর্ণমুদ্রা : 1282
মর্যাদা : 20
Join date : 2021-05-22
Re: তিন চন্দ্রদিন
Fri Jun 04, 2021 4:50 pm
অধ্যায় ৪
১।
মানবরূপে প্রত্যাবর্তনের পর মুহূর্তেই আমার পিতা সর্বপ্রথম যে প্রশ্নটি করলেন তা হল, “অমর রত্ন কোথায়?”
তিনি অস্থিরভাবে চারিদিকে পায়চারি করতে শুরু করলেন। কক্ষের বারান্দার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।
“মালিকা অমর রত্ন চুরি করে নিয়েছে, মহামান্য।” তাঁর প্রশ্নের জবাব দিলেন আমার ভ্রাতা রাজপুত্র জাকির।
জবাবটি যেন রাজা জানতেনই, প্রায় সাথে সাথেই বলে উঠলেন, “মালিকা আর কারো কোন ক্ষতি করেছে?” কেউ তাঁর এই প্রশ্নের কোন উত্তর দিল না।
রাজা জাকিরের দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকালেন। জাকির মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আমার দিকে ফিরলেন এরপর।
“আমি জানি না সেনাপতি কিংবা উপদেষ্টা কেউ বেঁচে আছেন কিনা কিন্তু আমরা খাজাকে হারিয়েছি।” আমি বললাম।
“কি?” কথাটি যেন ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না তিনি। “কি বলছ তুমি?” বিস্মিত রাজা।
“ডাকসা হত্যা করেছে খাজাকে।” আমি উত্তর দিলাম।
“ডাকসা!” অস্ফুট স্বরে নামটি উচ্চারণ করলেন তিনি। তারপর একদম চুপ হয়ে গেলেন।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, “কেবল রাজপুত্রদয় ব্যতিত বাকি সবাই এই কক্ষ ত্যাগ করো।” রাজার আদেশ শুনে প্রহরীরা সবাই প্রস্থান করলো।
এরপর তিনি আমার কাছে সব ঘটনার বিস্তারিত জানতে চাইলেন। আমি তাঁকে সবকিছু খুলে বললাম।
সব শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রাজা। তারপর দুজনের দিকে একবার করে তাকালেন। হিম শীতল গলায় বললেন, “খাজা জড়িত ছিল মালিকার সাথে।”
কথাটি শুনে আমি বিস্ময়ে হতবম্ব হয়ে পড়লাম। নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। “কিন্তু তা কি করে সম্ভব?” আমি বললাম।
“সম্ভব।” বললেন তিনি। “মূর্তিতে পরিণত হবার আগে আমি তা জানতে পেরেছিলাম।” একটু থামলেন রাজা। তারপর বললেন, “শুরু থেকেই জড়িত ছিল খাজা কিন্তু আমরা কখনোই তা ধরতে পারিনি।”
খাজা ছিল আমার বাল্যকালের বন্ধু। আমরা দুজন একসাথে বড় হয়েছি। অসাধারণ যোদ্ধা ছিল খাজা, তাই একসময় তাঁকে তীরন্দাজ বাহিনীর প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। আমার পিতার ভীষণ প্রিয়পাত্র ছিল সে। তাই ভাবতেই অবাক লাগছে এই মানুষটির ভেতরই এরকম দুরভিসন্ধি কাজ করছিল।
হতে পারে এই দোষ পুরোপুরি তাঁর নয়। হয়তোবা এর জন্য দায়ী এই বিলাসবহুল জীবনযাপন, যেটি তাঁর ভেতরে নতুন প্রলোভনের সৃষ্টি করেছিল।
তাছাড়া রাজ্যের দুর্গম অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করতো খাজা। হতে পারে সেখান থেকেই কোনভাবে মালিকার সাথে তাঁর পরিচয়। হয়তো মালিকার দুষ্ট প্রস্তাব নাখোজ করতে পানেনি সে।
আমি নানানভাবে নিজেকে বুঝ দেয়ার চেষ্টা করলাম কিন্তু রুর বাস্তবতা হল খাজা অপরাধী।
“আমাকে এক্ষুনি জ্ঞানী বৃক্ষের গ্রামে নিয়ে চল।” আমার উদ্দেশ্যে কথাটি বললেন রাজা। “আমার তাঁর সাথে দেখা করা খুবই জরুরী। এখন একমাত্র সে-ই আমার সব প্রশ্নের জবাব দিতে পারে।”
আমি দেরি না করে পিতাকে নিয়ে অতিকায় মৌমাছির পিঠে চড়ে বসলাম। খুব দ্রুতই জ্ঞানী বৃক্ষের গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা করলাম। আকাশের মেঘ কাটিয়ে আমাদের নিয়ে উড়ে চলল বিশাল পতঙ্গটি।
ইতিমধ্যেই দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে গোটা রাজ্যে, তাই যা কিছুই করার খুব দ্রুতই করতে হতো আমাদের। যদি খুব শীঘ্রয়ই আমরা কিছু একটা করতে না পারি তবে এই রাজ্য আর রাজ্য থাকবে না, পরিণত হবে শুকনো মরুভুমিতে।
আমার কানে বার বার পিতার কথাগুলি বাজছিল। ধীরে ধীরে আমার কাছে পুরো ব্যাপারটি পরিষ্কার হল। খাজাই আমাদের অভিযানের বিষয়টি গোপনে মালিকাকে জানিয়ে দিয়েছিল। সেজন্যই একজন দক্ষ তীরন্দাজ হওয়া সত্তেও সে সেনাপতির সাথে লড়াই করেনি। জঙ্গলের উত্তর পূর্ব দিক দিয়ে যাত্রা করাটাও তাঁরই পরিকল্পনার অংশ ছিল। আসলে আমরা সবাই তাঁর ও মালিকার পরিকল্পনারই অংশ ছিলাম।
হয়তো এই বিষয়টিই জানতো ডাকসা আর এজন্যই তাঁকে হত্যা করেছে সে। (চলবে)
২।
“বৃক্ষ মহাশয়, অনুগ্রহ করে আমার একটি প্রশ্নের জবাব দিন।” বৃদ্ধ বৃক্ষের উদ্দেশ্যে আমার পিতা বললেন। বৃদ্ধ এক দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। “আমি জানি আপনি বিষম পাথর প্রত্যক্ষ করেছেন। আপনি অনেক কিছুই জানতে পেরেছেন।” কথাটি বলে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন আমার পিতা। বৃক্ষের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর চোখে মিনতি।
“বলুন কি জানতে চান আপনি, মহামান্য।” অবশেষে মুখ খুললেন বৃক্ষ।
আমার পিতা প্রথমে একটি দীর্ঘশ্বাস নিলেন। তারপর বললেন, “ডাকসা আমার পুত্রকে রক্ষা করেছে। খাজাকেও হত্যা করেছে। আমি কিংবা আপনি আমরা দুজনেই জানি এটি কোন সাধারণ ঘটনা নয়। একটি বাক্শক্তিহীন হিংস্র পশু বিনা করনে কখনই এমন আচরণ করতে পারে না। আপনি কিছু একটা জানেন। দয়া করে আমাকে বলুন?”
বৃক্ষ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। শুধু স্থির দৃষ্টিতে রাজার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমার পিতাও তাঁর চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে ছিলেন। যেন কিছু একটা শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন।
“আপনি যা ভাবছেন সেটাই সঠিক, রাজা মনসুর।” এবার বললেন বৃক্ষ। “আপনার ভ্রাতা মারা যাননি। ডাকসাই আপনার হারিয়ে যাওয়া ভ্রাতা আনসুর।”
কথাটি শুনে টপ করে এক ফোঁটা পানি চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল রাজার। তিনি মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন। ভীষণ হতাশাগ্রস্থ দেখাচ্ছিল তাঁকে।
“আর এই আমিই তাঁকে হত্যা করার জন্য সৈন্যবাহিনী পাঠিয়েছিলাম।” তিনি বললেন। “শুধুমাত্র খাজার প্ররোচনায়।”
আমি আমার পিতার কাছে এগিয়ে গেলাম। তাঁকে ধরে তোলার চেষ্টা করলাম। এই মুহূর্তে মানসিকভাবে ভেঙ্গে ভীষণ পড়েছেন তিনি।
“আমাদের ভেঙ্গে পরলে চলবে না। এখনো সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি।” আমি তাঁকে সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করলাম।
ধীরে ধীরে ধাতস্ত হয়ে উঠলেন আমার পিতা। আমাকে ধরে উঠে দাঁড়ালেন। বৃক্ষের উদ্দেশ্যে বললেন, “আমরা কীভাবে তাঁকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারি?”
“তাঁকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা খুবই কঠিনসাধ্য ব্যাপার।” বললেন বৃক্ষ। “হয়তো জাদুকর পারাগ এর উপায় জানতেন।”
“মালিকা পারাগের কন্যা, সে নিশ্চয়ই কোন উপায় জানতে পারে।” আমি বললাম।
“আমি নিশ্চিত নই।” বৃক্ষ উত্তর দিলেন। “তাছাড়া মালিকা তোমাদের সাহায্য করবে না।”
“হুম, আমি তা জানি।” বললেন রাজা। “কিন্তু আমরা তাঁকে বাধ্য করবো।” এবার আমার দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন তিনি। তাঁর চোখে মুখে প্রতিশোধের আগুন। “আমরা মালিকাকে আক্রমণ করতে যাচ্ছি।”
দ্রুতই বৃক্ষের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা আরকান রাজ্যের উদ্দেশ্যে রওনা করলাম।
রাজ্যে পৌছাতেই আমার পিতা তাঁর সকল সৈন্যসামন্তকে প্রস্তুত হবার নির্দেশ দিলেন। কাল দিপ্রহরেই মালিকার মহল আক্রমণ করা হবে। কারন চাঁদের আলোয় ডাইনিদের জাদুর লাঠি নিষ্ক্রিয় হয়ে পরে।
আমি আমার পিতার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিলাম। অতিকায় মৌমাছির পিঠে চড়ে রাক্ষুসে জঙ্গলের উদ্দেশ্যে রওনা করলাম। মৌ রানী আমাকে সাহায্য করার কথা দিয়েছিলেন। নিশ্চয়ই তিনি তাঁর কথা রাখবেন।
আমি মৌ রানীর সাথে দেখা করে প্রথমেই তাঁকে সব ঘটনা খুলে বললাম। আমার চাচার বিষয়টি শুনে তিনি ভীষণ কষ্ট পেলেন। এবং তিনি সেটা লুকোতে পারলেন না, হয়তো লুকোনোর চেষ্টাও করলেন না।
“আমি ডাকসার সাথে একবার দেখা করতে চাই।” তিনি বললেন। বুঝতে পারছিলাম আবেগতাড়িত হয়ে পরেছেন তিনি।
“সেটা খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না, মহারানী।” আমি উত্তর দিলাম। “এটা সত্যি ডাকসা আমার জীবন বাঁচিয়েছে কিন্তু আদৌতে সে কেবলই একটি বাকশুন্য হিংস্র নরপশু, তাঁর মধ্যে মানুষের কোন বৈশিষ্ট্য নেই।” একটু থামলাম আমি। রানীকে দেখে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। বুঝতে পারছিলাম কথাগুলি মেনে নেয়া তাঁর জন্য এতোটা সহজ ছিল না। তিনি পুরোটা সময় মাথাটি নিচু করে ছিলেন। আমি তাঁকে একটু সময় দিলাম।
“আমি আমার মৌ প্রধানকে নির্দেশ দিয়ে দিচ্ছি।” কিছুক্ষণ পর বললেন মহারানী। “আমার মৌ বাহিনী তোমাদের সাহায্য করবে।”
“আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ, মহারানী।” আমি বললাম। (চলবে)
৩।
বড় বড় মেঘের চাই কাটিয়ে অতিকায় মৌমাছিটি আমাকে নিয়ে তীরের বেগে উড়ে চলছিল। নিচে গ্রাম, গ্রামের পর হ্রদ, তারপর কৃষিক্ষেত্র সবকিছুই পেছনে ছাপিয়ে চলছিলাম আমরা। উপরে আকাশের শত শত উজ্জ্বল তারা আমাদের দিকে ফিরে জ্বলজ্বল করছিল।
ইতিমধ্যেই আমরা রাক্ষুসে জঙ্গল পেছনে ফেলে এসেছি। মহারানীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আরকান রাজ্য অভিমুখে রওনা করেছি। তাছাড়া সকাল হতেও খুব বেশি দেরি নেই। তাই ভাবতে ভালই লাগছিল, অবশেষে আমরা এই লড়াইয়ের যবনিকা টানতে যাচ্ছি, মালিকার পতন হতে চলেছে।
আলিয়াকে নিয়ে আমার একটু দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। জানি না সে কীভাবে, কী অবস্থায় আছে।
হটাৎ পেছন থেকে একটা ক্ষীণ হাসির শব্দ আমার কানে ভেসে এল। যেন দূরে কেউ বা কারা খিল খিল করে হেসে চলছে। শব্দটি মোটেও স্বাভাবিক মনে হল না আমার কাছে। আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম, কান খাড়া করে সেটি শোনার চেষ্টা করলাম। আমাদেরই পেছন থেকে আসছে সেটি। কেউ আমাদের পিছু নিয়েছে।
“ছোটু, আরও দ্রুত চলতে হবে আমাদের।” আমি মৌমাছিটিকে উদ্দেশ্যে করে বললাম।
ধীরে ধীরে হাসির শব্দটি আরও জোরালো হতে লাগলো। হটাৎ তাচ্ছিল্যভরা কণ্ঠে কেউ একজন চেঁচিয়ে উঠলো, “ছোট্ট রাজকুমার, কোথায় যাওয়া হচ্ছে? আমরাও তোমার সঙ্গে যেতে চাই।” কথাটি বলেই বীভৎসভাবে খিল খিল করে হেসে চলল একটি ডাইনী।
এক মুহূর্তের জন্য মনে হল, ভয়াবহ রকমের বোকামি করে ফেলেছি আমি! এভাবে একা মৌ রানির সাথে দেখা করতে চলে এসেছি! বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছি আমাদের পুরো পরিকল্পনাটি।
নিশ্চয়ই হাত গুটিয়ে বসে ছিল না মালিকা। সুযোগের অপেক্ষায় ছিল সে আর আমিই তাঁকে সেই সুযোগটি তৈরি করে দিয়েছি! নিজের উপর বড্ড রাগ হচ্ছিল আমার।
যে কোন মুল্যেই হোক এখন আমাকে এদের হাত থেকে বেঁচে পালাতে হবে। যদি কোনভাবে এরা আমাকে ধরে ফেলতে সমর্থ হয় তবে সব পরিকল্পনাই ভেস্তে যাবে।
আমার পিতা নিশ্চয়ই আমার জীবন নিয়ে বাজি ধরবেন না। তাঁর এই দুর্বলতার কথাটি মালিকা খুব ভাল করেই জানে।
ইতিমধ্যেই ডাইনীগুলি আমাদের অনেকটা কাছাকাছি চলে এসেছে। আমাদের লক্ষ্য করে আগুনের গোলা নিক্ষেপ করছে। ছোটু কোনরকমে সেগুলি পাশ কাটিয়ে উড়ে চলছে। কিন্তু আমি জানি আমরা খুব বেশিদূর এভাবে এগোতে পারবো না। তাই যা কিছুই করার খুব দ্রুতই করতে হতো আমাকে।
হটাতই আমার মাথায় একটি বুদ্ধি খেলে গেল। আমি মুহূর্তেই মৌমাছিটিকে উত্তর দিকে ঘুরিয়ে নিলাম। ডাইনীরা আমার সঙ্গ কামনা করছে তো, আমি তাদের সঙ্গেই নিয়ে যাবো।
উত্তর দিকটা ডাকসার অঞ্চল। এখান থেকে খুব বেশি দূরেও নয় সেটি। আমি যদি কোনভাবে ডাকসার জঙ্গলে প্রবেশ করতে পারি, তবে হয়তো এদের হাত থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব। তাছাড়া আরকান রাজ্য এখনো অনেক দূরের পথ। তাই আমার কাছে অন্য কোন উপায় নেই।
আমরা ছুটে চলছি। এক মুহূর্তের জন্যেও পেছনে তাকানোর সময় নেই। ডাইনীগুলি তখনো আমাদের লক্ষ্য করে আগুনের গোলা নিক্ষেপ করে চলছিল। আর ছোটু সুচাতুরতার সাথে সেগুলি পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল।
কিন্তু হটাৎ একটি আগুনের গোলা ছোটুর ঠিক বামদিকের পাখাটায় এসে আঘাত করলো। মুহূর্তের মধ্যেই সে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করলো। আমি বুঝতে পারছিলাম খুব শীঘ্রয়ই মাটিতে আছড়ে পড়তে যাচ্ছি আমরা।
“আরেকটু পথ! আমরা প্রায় চলে এসেছি!” আমি চিৎকার করলাম। মনে মনে বিধাতার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলাম।
শেষ পর্যন্ত আমি আর মৌমাছিটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না। দুজনেই সজোরে মাটিতে আছড়ে পড়লাম। ছিটকে একটি গাছের সাথে ধাক্কা খেলাম আমি। মুহূর্তেই আমার চারপাশের সবকিছু ঝাপসা হয়ে এলো। আমি জ্ঞান হারাতে শুরু করলাম। দেখলাম উপরে আকাশে ডাইনীগুলি চক্কর কাটছে।
আমার যখন জ্ঞান ফিরল আমি নিজেকে একটি গুহার ভেতর আবিস্কার করলাম। আমার মাথার ভেতর প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছিল।
“এখানে সম্পূর্ণ নিরাপদ তুমি। কিছুটা বিশ্রামের প্রয়োজন তোমার।” একটা ভারী, গম্ভির কণ্ঠ কথাটি বলে উঠল। আমি এই কণ্ঠের মালিককে চিনি! আমি সাথে সাথেই ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিকে তাকালাম।
“সেনাপতি!” অস্ফুট স্বরে কথাটি বের হল আমার মুখ থেকে। “আপনি বেঁচে আছেন!”
বিস্ফোরিত চোখে আমি তখনো তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিলাম, যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
গুহার এক কোনায় সেনাপতি রাজন বসে আছেন। তাঁর একটি হাতের কুনুইয়ের নীচ থেকে বাকী অংশ নেই। হাতটি রক্তাক্ত কাপড় দিয়ে শক্ত করে পেঁচানো।
আমি তাঁর হাতের দিকে তাকালাম। বললাম, “কী হয়েছিল ঐ রাতে?” তিনি আমার কথার কোন জবাব দিলেন না। শুধু তাঁর কাটা হাতটির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “মনসুরের কি অবস্থা?”
আমি একটু সময় নিলাম। তারপর বললাম, “তিনি ভাল আছেন। আমরা তাঁকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পেরেছি।” কথাটি শুনে একদম চুপ হয়ে গেলেন সেনাপতি। মুখ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরোল তাঁর।
আমি ধীরে ধীরে তাঁকে সব ঘটনা খুলে বলতে শুরু করলাম। তিনি মনোযোগ দিয়ে আমার কথাগুলি শুনতে লাগলেন।
আয়াজের ব্যাপারটি শুনে ভীষণ কষ্ট পেলেন সেনাপতি। আয়াজ তাঁর অনেক পুরনো বন্ধু ছিলেন। তবে খাজার ব্যাপারটি তাঁর কাছে অনুমেয়ই ছিল। তিনি ঐ রাতেই কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছিলেন তবে বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছিল সেটা।
অন্য দিকে ডাকসা তাঁর জীবন বাঁচিয়েছিল। তাঁকে গুরুতর আহত অবস্থায় রক্ষা করেছিল। সেই রাতে তিনি ডাইনিদের হাত থেকে বাঁচার জন্য প্রাণপণে ছুটছিলেন, জঙ্গলের ভেতরে এসে জ্ঞান হারিয়েছিলেন, ডাকসাই তখন তাকে উদ্ধার করে। তাই ডাকসা আমার চাচা কথাটি শুনে আমি না যতটা ভেবেছিলাম তিনি ততটা অবাক হলেন না।
“ডাকসা এখন কোথায়?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“আমি ঠিক জানি না, রাজকুমার। আমি নিজেও তাঁর দেখা খুব একটা পাইনি।” সেনাপতি উত্তর দিলেন। “জানি না ঠিক কি কারনে সে আর কখনো আমার সামনে আসেনি। যদিও প্রতিদিনই আমার জন্য ফলমূল সংগ্রহ করে বাইরে রেখে যায়।” একটু থামলেন তিনি। তারপর আবার বললেন, “হয়তো সে ভয় পায়, যদি তাঁর দ্বারা আমার কোন ক্ষতি হয়ে যায়।”
আমি কিছুক্ষন চুপ করে রইলাম। হয়তোবা এটাই তার কারন, হয়তোবা নয়।
কিছুক্ষণ পর আমরা গুহা থেকে বাইরে বেরিয়ে এলাম। ইতিমধ্যে অন্ধকার অনেকটা কমে এসেছে, দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে। মৌমাছিটি বাইরেই অপেক্ষা করছিল। তাঁর পাখার অর্ধেকটাই পুড়ে গিয়েছিল। এই অবস্থায় সে হয়তো নিজে উড়ে যেতে পারবে কিন্তু আমাদের নিয়ে যেতে পারবে না।
আমাদের সৌভাগ্য ছিল আমরা জঙ্গল অবধি পৌছাতে পেরেছিলাম। তাই ডাইনীগুলিও আর নিচে নামার সাহস করেনি।
আমি মৌমাছিটির পিঠে হাত রাখলাম। সাথে সাথেই একটু নড়ে চড়ে উঠল পতঙ্গটি। “ছোটু, তুমি মৌ রানীর কাছে ফিরে যাও।” আমি বললাম। “তাঁকে এই বার্তা পৌঁছে দাও আমরা নিরাপদে আছি। আমাদের জন্য যেন কোন কিছু বিলম্বিত না হয়।” মৌমাছিটি কিছু বুঝে উঠতে পারলো কিনা জানি না। তবে সে উড়াল দেয়ার চেষ্টা করলো। কয়েকবার চেষ্টার পর অবশেষে উড়তে পারলো। তাকে আবার উড়তে দেখে আমি ভীষণ খুশি হলাম। যদিও পর মুহুরতে একটু ভয় হল সে নিরাপদে পৌছাতে পারবে কিনা।
এবার অপেক্ষার পালা। অপেক্ষা যেন সবকিছু ঠিকঠাক মতো হয়।
৪।
পুরোটা দিন জঙ্গলেই কাটাতে হল আমাদের। আমরা দুজনেই প্রার্থনা করছিলাম আর অপেক্ষার প্রহর গুনছিলাম যেন সবকিছুই পরিকল্পনা মতো হয়।
সারাদিনে ডাকসার দেখা মেলেনি। যদিও আমি তাঁর উপস্থিতি অনুভব করতে পারছিলাম। হয়তো সে আমাদের আশে পাশেই কোথাও রয়েছে , আড়াল থেকে আমাদের লক্ষ্য করছে।
সন্ধার দিকে দূর আকাশে আমি কিছু একটা দেখতে পেলাম। যেন কেউ বা কারা ঠিক এদিকেই উড়ে আসছে। হটাত করেই ছোটুকে আবিস্কার করলাম আমি, তার পেছনে রয়েছে আরও অনেকগুলি অতিকায় মৌমাছি। তাদের পাখার ফরফর শব্দ ধীরে ধীরে আরও জোরালো হয়ে উঠছিল।
মৌমাছিদের একটিতে আমার পিতা বসে ছিলেন, তাঁর চেহারায় ছিল যুদ্ধ জয়ের হাসি। নিজের অজান্তেই আমার ভেতরে একটি আনন্দ স্রোত বয়ে গেল। এক দৌড়ে আমি সেদিকে এগিয়ে গেলাম।
মৌমাছির পিঠ থেকে নেমে প্রথমেই আমাকে জরিয়ে ধরলেন পিতা। তারপর আলতো করে আমার কপালে একটি চুমু খেলেন।
সেনাপতির দিকে ফিরলেন তারপর, কিছুক্ষণ তাঁর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। চোখ ছলছল করছিল তাঁর। “তোমাকে নিয়ে আমি গর্বিত।” তিনি বললেন। তারপর তাঁকে জরিয়ে ধরলেন।
“আমরা মালিকাকে হারিয়ে দিয়েছি, অমর রত্ন রক্ষা করতে পেরেছি।” পাশ থেকে কথাটি বললেন আমার ভ্রাতা জাকির। “যদিও শেষ পর্যন্ত ডাইনীটা পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়।” একটু থামলেন তিনি। “কিন্তু সুসংবাদ হল আয়াজ বেঁচে আছেন। তিনি মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন কিন্তু এখন বিপদমুক্ত।” কথাটি শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরোল আমার মুখ থেকে। সেনাপতি যেন কেঁদেই ফেললেন।
এবার আমার দিকে ফিরলেন জাকির। একটু মুচকি হাসি দিলেন। সে জানে আমি কিছু একটা শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছি। “আর হ্যাঁ, আলিয়াও ঠিক আছে। আমরা তাকেও উদ্ধার করতে পেরেছি।” কথাটি বলেই হেসে দিলেন জাকির। আমি কিছুটা লজ্জা পেলাম। যদিও মনে মনে ভীষণ আনন্দ হচ্ছিল।
কিছুক্ষণ পর সবাই লক্ষ্য করলাম আরও একটি অতিকায় মৌমাছি ঠিক এই দিকেই উড়ে আসছে। এই মাছিটি অন্যগুলির তুলনায় অনেক বিশাল, মহারানী মৌরানী সেটির উপর বসে ছিলেন।
ধীরে ধীরে পতঙ্গটি নিচে নেমে এল। সবাই মহারানীকে কুর্নিশ করল। তিনি আমার পিতার দিকে একবার তাকালেন, বললেন, “অসাধারণ এই যুদ্ধ জয়ে আমার পক্ষ থেকে আপনাকে অভিনন্দন, রাজা মনসুর। আমার মৌ বাহিনী এই যুদ্ধে আপনার সঙ্গে ছিল, আশা করছি ভবিষ্যতেও আমরা সাহায্য করতে পারবো।”
রাজা মাথা নাড়ালেন, বললেন, “আপনাকেও অশেষ ধন্যবাদ, মহারানী। আপনার সাহায্য ছাড়া আমরা এই যুদ্ধ এতো সহজে জয়লাভ করতে পারতাম না।”
এবার সেনাপতির দিকে ফিরলেন মহারানী। কিছুক্ষণ চুপ থেকে তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনার এই ক্ষতির জন্য আমি খুবই দুঃখিত, সেনাপতি রাজন।” সেনাপতি কোন উত্তর দিলেন না। কেবল একবার মাথা নাড়লেন।
এবার মহারানী তাঁর চারিদিকে জঙ্গলের গভীরে তাকালেন, যেন দুচোখ দিয়ে তিনি কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করলেন।
এরপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমি তোমাকে নিয়ে ততোটাই গর্বিত, ঠিক যতটা আমি তাঁকে নিয়ে।” জঙ্গলের দিকে কিছু একটা ইঙ্গিত করলেন। তারপর কিছুটা উঁচু গলায় বললেন, “আমি জানি আপনি আমাদের প্রত্যক্ষ করছেন। আমি আপনাকে অনুভব করতে পারছি, ঠিক যেমনটা আপনি পারছেন। হয়তো আপনার দেখা আমি পাবো না, আপনার এই রূপটি আমার জানা হবে না কিন্তু কথা দিচ্ছি আমি আমৃত্যু এর প্রতিকার খুঁজে বেড়াবো।” একটু থামলেন তিনি। কিছুক্ষন চুপ থেকে বললেন, “আপনি সবসময়ই আমার কাছে সুদর্শন ছিলেন, থাকবেন।” কথাটি বলেই মাথা নিচু করে ফেললেন মহা রানী।
“আমরা সবাই অনেক ভালবাসি তোমাকে, আনসুর।” এবার আমার পিতা বললেন। “আমি কতো খুঁজে ফিরেছি তোমাকে, স্মরণ করেছি তোমার সাথে কাটানো মুহূর্তগুলি।” একটু থামলেন তিনি। তাঁর চোখদুটি ছলছল করছিল। “মানুষের কোন দুরবস্থা বা পরিণতিই তাঁর আপনজনের কাছে মুখ্য বিষয় নয়, আনসুর।” এবার থামলেন তিনি। যেন কিছু একটা জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
অপেক্ষা করছিলাম আমরা সবাই। তাকিয়ে ছিলাম জঙ্গলের গভীরে, আঁধারে। কিন্তু কিছুই ঘটলো না, কেউ জঙ্গল থেকে বেরিয়েও এলো না।
অনেক্ষণ কেটে গেছে এরপর। এক সময় নিঃশব্দে জঙ্গল ত্যাগ করলেন মহারানী। বাকীরাও একে একে মৌমাছির পিঠে চড়ে বসলো। ধীরে ধীরে মৌমাছিগুলি উপরে উঠে যেতে লাগলো। গাছপালা, জঙ্গল সবকিছুই ছোট হয়ে আসতে লাগলো। বিশাল থালার মতো চাঁদটি এবার আরও বড় দেখাল।
সবাই রওনা করলাম আরকান রাজ্যের উদ্দেশ্যে।
হটাত ঐ নিচে আমি কী কিছু একটা দেখতে পেলাম! কিছু একটা যেটা জঙ্গলের গভীর থেকে ঐ ফাঁকা জায়গায়টিতে এসে দাঁড়িয়েছে! নাকি এই সবই স্রেফ আমার কল্পনা, দৃষ্টি বিভ্রম!
তবে এটা যা-ই হোক আমি জানতাম আমাকে আবার বের হতে হবে। খুঁজে বের করতে হবে আমার চাচাকে, বের করতে হবে তার প্রতিকার। তবে সেটি না হয় হবে অন্য কোন একটি গল্প, অন্য একটি অভিযান। (সমাপ্ত)
১।
মানবরূপে প্রত্যাবর্তনের পর মুহূর্তেই আমার পিতা সর্বপ্রথম যে প্রশ্নটি করলেন তা হল, “অমর রত্ন কোথায়?”
তিনি অস্থিরভাবে চারিদিকে পায়চারি করতে শুরু করলেন। কক্ষের বারান্দার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।
“মালিকা অমর রত্ন চুরি করে নিয়েছে, মহামান্য।” তাঁর প্রশ্নের জবাব দিলেন আমার ভ্রাতা রাজপুত্র জাকির।
জবাবটি যেন রাজা জানতেনই, প্রায় সাথে সাথেই বলে উঠলেন, “মালিকা আর কারো কোন ক্ষতি করেছে?” কেউ তাঁর এই প্রশ্নের কোন উত্তর দিল না।
রাজা জাকিরের দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকালেন। জাকির মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আমার দিকে ফিরলেন এরপর।
“আমি জানি না সেনাপতি কিংবা উপদেষ্টা কেউ বেঁচে আছেন কিনা কিন্তু আমরা খাজাকে হারিয়েছি।” আমি বললাম।
“কি?” কথাটি যেন ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না তিনি। “কি বলছ তুমি?” বিস্মিত রাজা।
“ডাকসা হত্যা করেছে খাজাকে।” আমি উত্তর দিলাম।
“ডাকসা!” অস্ফুট স্বরে নামটি উচ্চারণ করলেন তিনি। তারপর একদম চুপ হয়ে গেলেন।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, “কেবল রাজপুত্রদয় ব্যতিত বাকি সবাই এই কক্ষ ত্যাগ করো।” রাজার আদেশ শুনে প্রহরীরা সবাই প্রস্থান করলো।
এরপর তিনি আমার কাছে সব ঘটনার বিস্তারিত জানতে চাইলেন। আমি তাঁকে সবকিছু খুলে বললাম।
সব শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রাজা। তারপর দুজনের দিকে একবার করে তাকালেন। হিম শীতল গলায় বললেন, “খাজা জড়িত ছিল মালিকার সাথে।”
কথাটি শুনে আমি বিস্ময়ে হতবম্ব হয়ে পড়লাম। নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। “কিন্তু তা কি করে সম্ভব?” আমি বললাম।
“সম্ভব।” বললেন তিনি। “মূর্তিতে পরিণত হবার আগে আমি তা জানতে পেরেছিলাম।” একটু থামলেন রাজা। তারপর বললেন, “শুরু থেকেই জড়িত ছিল খাজা কিন্তু আমরা কখনোই তা ধরতে পারিনি।”
খাজা ছিল আমার বাল্যকালের বন্ধু। আমরা দুজন একসাথে বড় হয়েছি। অসাধারণ যোদ্ধা ছিল খাজা, তাই একসময় তাঁকে তীরন্দাজ বাহিনীর প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। আমার পিতার ভীষণ প্রিয়পাত্র ছিল সে। তাই ভাবতেই অবাক লাগছে এই মানুষটির ভেতরই এরকম দুরভিসন্ধি কাজ করছিল।
হতে পারে এই দোষ পুরোপুরি তাঁর নয়। হয়তোবা এর জন্য দায়ী এই বিলাসবহুল জীবনযাপন, যেটি তাঁর ভেতরে নতুন প্রলোভনের সৃষ্টি করেছিল।
তাছাড়া রাজ্যের দুর্গম অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করতো খাজা। হতে পারে সেখান থেকেই কোনভাবে মালিকার সাথে তাঁর পরিচয়। হয়তো মালিকার দুষ্ট প্রস্তাব নাখোজ করতে পানেনি সে।
আমি নানানভাবে নিজেকে বুঝ দেয়ার চেষ্টা করলাম কিন্তু রুর বাস্তবতা হল খাজা অপরাধী।
“আমাকে এক্ষুনি জ্ঞানী বৃক্ষের গ্রামে নিয়ে চল।” আমার উদ্দেশ্যে কথাটি বললেন রাজা। “আমার তাঁর সাথে দেখা করা খুবই জরুরী। এখন একমাত্র সে-ই আমার সব প্রশ্নের জবাব দিতে পারে।”
আমি দেরি না করে পিতাকে নিয়ে অতিকায় মৌমাছির পিঠে চড়ে বসলাম। খুব দ্রুতই জ্ঞানী বৃক্ষের গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা করলাম। আকাশের মেঘ কাটিয়ে আমাদের নিয়ে উড়ে চলল বিশাল পতঙ্গটি।
ইতিমধ্যেই দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে গোটা রাজ্যে, তাই যা কিছুই করার খুব দ্রুতই করতে হতো আমাদের। যদি খুব শীঘ্রয়ই আমরা কিছু একটা করতে না পারি তবে এই রাজ্য আর রাজ্য থাকবে না, পরিণত হবে শুকনো মরুভুমিতে।
আমার কানে বার বার পিতার কথাগুলি বাজছিল। ধীরে ধীরে আমার কাছে পুরো ব্যাপারটি পরিষ্কার হল। খাজাই আমাদের অভিযানের বিষয়টি গোপনে মালিকাকে জানিয়ে দিয়েছিল। সেজন্যই একজন দক্ষ তীরন্দাজ হওয়া সত্তেও সে সেনাপতির সাথে লড়াই করেনি। জঙ্গলের উত্তর পূর্ব দিক দিয়ে যাত্রা করাটাও তাঁরই পরিকল্পনার অংশ ছিল। আসলে আমরা সবাই তাঁর ও মালিকার পরিকল্পনারই অংশ ছিলাম।
হয়তো এই বিষয়টিই জানতো ডাকসা আর এজন্যই তাঁকে হত্যা করেছে সে। (চলবে)
২।
“বৃক্ষ মহাশয়, অনুগ্রহ করে আমার একটি প্রশ্নের জবাব দিন।” বৃদ্ধ বৃক্ষের উদ্দেশ্যে আমার পিতা বললেন। বৃদ্ধ এক দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। “আমি জানি আপনি বিষম পাথর প্রত্যক্ষ করেছেন। আপনি অনেক কিছুই জানতে পেরেছেন।” কথাটি বলে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন আমার পিতা। বৃক্ষের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর চোখে মিনতি।
“বলুন কি জানতে চান আপনি, মহামান্য।” অবশেষে মুখ খুললেন বৃক্ষ।
আমার পিতা প্রথমে একটি দীর্ঘশ্বাস নিলেন। তারপর বললেন, “ডাকসা আমার পুত্রকে রক্ষা করেছে। খাজাকেও হত্যা করেছে। আমি কিংবা আপনি আমরা দুজনেই জানি এটি কোন সাধারণ ঘটনা নয়। একটি বাক্শক্তিহীন হিংস্র পশু বিনা করনে কখনই এমন আচরণ করতে পারে না। আপনি কিছু একটা জানেন। দয়া করে আমাকে বলুন?”
বৃক্ষ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। শুধু স্থির দৃষ্টিতে রাজার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমার পিতাও তাঁর চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে ছিলেন। যেন কিছু একটা শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন।
“আপনি যা ভাবছেন সেটাই সঠিক, রাজা মনসুর।” এবার বললেন বৃক্ষ। “আপনার ভ্রাতা মারা যাননি। ডাকসাই আপনার হারিয়ে যাওয়া ভ্রাতা আনসুর।”
কথাটি শুনে টপ করে এক ফোঁটা পানি চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল রাজার। তিনি মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন। ভীষণ হতাশাগ্রস্থ দেখাচ্ছিল তাঁকে।
“আর এই আমিই তাঁকে হত্যা করার জন্য সৈন্যবাহিনী পাঠিয়েছিলাম।” তিনি বললেন। “শুধুমাত্র খাজার প্ররোচনায়।”
আমি আমার পিতার কাছে এগিয়ে গেলাম। তাঁকে ধরে তোলার চেষ্টা করলাম। এই মুহূর্তে মানসিকভাবে ভেঙ্গে ভীষণ পড়েছেন তিনি।
“আমাদের ভেঙ্গে পরলে চলবে না। এখনো সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি।” আমি তাঁকে সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করলাম।
ধীরে ধীরে ধাতস্ত হয়ে উঠলেন আমার পিতা। আমাকে ধরে উঠে দাঁড়ালেন। বৃক্ষের উদ্দেশ্যে বললেন, “আমরা কীভাবে তাঁকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারি?”
“তাঁকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা খুবই কঠিনসাধ্য ব্যাপার।” বললেন বৃক্ষ। “হয়তো জাদুকর পারাগ এর উপায় জানতেন।”
“মালিকা পারাগের কন্যা, সে নিশ্চয়ই কোন উপায় জানতে পারে।” আমি বললাম।
“আমি নিশ্চিত নই।” বৃক্ষ উত্তর দিলেন। “তাছাড়া মালিকা তোমাদের সাহায্য করবে না।”
“হুম, আমি তা জানি।” বললেন রাজা। “কিন্তু আমরা তাঁকে বাধ্য করবো।” এবার আমার দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন তিনি। তাঁর চোখে মুখে প্রতিশোধের আগুন। “আমরা মালিকাকে আক্রমণ করতে যাচ্ছি।”
দ্রুতই বৃক্ষের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা আরকান রাজ্যের উদ্দেশ্যে রওনা করলাম।
রাজ্যে পৌছাতেই আমার পিতা তাঁর সকল সৈন্যসামন্তকে প্রস্তুত হবার নির্দেশ দিলেন। কাল দিপ্রহরেই মালিকার মহল আক্রমণ করা হবে। কারন চাঁদের আলোয় ডাইনিদের জাদুর লাঠি নিষ্ক্রিয় হয়ে পরে।
আমি আমার পিতার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিলাম। অতিকায় মৌমাছির পিঠে চড়ে রাক্ষুসে জঙ্গলের উদ্দেশ্যে রওনা করলাম। মৌ রানী আমাকে সাহায্য করার কথা দিয়েছিলেন। নিশ্চয়ই তিনি তাঁর কথা রাখবেন।
আমি মৌ রানীর সাথে দেখা করে প্রথমেই তাঁকে সব ঘটনা খুলে বললাম। আমার চাচার বিষয়টি শুনে তিনি ভীষণ কষ্ট পেলেন। এবং তিনি সেটা লুকোতে পারলেন না, হয়তো লুকোনোর চেষ্টাও করলেন না।
“আমি ডাকসার সাথে একবার দেখা করতে চাই।” তিনি বললেন। বুঝতে পারছিলাম আবেগতাড়িত হয়ে পরেছেন তিনি।
“সেটা খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না, মহারানী।” আমি উত্তর দিলাম। “এটা সত্যি ডাকসা আমার জীবন বাঁচিয়েছে কিন্তু আদৌতে সে কেবলই একটি বাকশুন্য হিংস্র নরপশু, তাঁর মধ্যে মানুষের কোন বৈশিষ্ট্য নেই।” একটু থামলাম আমি। রানীকে দেখে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। বুঝতে পারছিলাম কথাগুলি মেনে নেয়া তাঁর জন্য এতোটা সহজ ছিল না। তিনি পুরোটা সময় মাথাটি নিচু করে ছিলেন। আমি তাঁকে একটু সময় দিলাম।
“আমি আমার মৌ প্রধানকে নির্দেশ দিয়ে দিচ্ছি।” কিছুক্ষণ পর বললেন মহারানী। “আমার মৌ বাহিনী তোমাদের সাহায্য করবে।”
“আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ, মহারানী।” আমি বললাম। (চলবে)
৩।
বড় বড় মেঘের চাই কাটিয়ে অতিকায় মৌমাছিটি আমাকে নিয়ে তীরের বেগে উড়ে চলছিল। নিচে গ্রাম, গ্রামের পর হ্রদ, তারপর কৃষিক্ষেত্র সবকিছুই পেছনে ছাপিয়ে চলছিলাম আমরা। উপরে আকাশের শত শত উজ্জ্বল তারা আমাদের দিকে ফিরে জ্বলজ্বল করছিল।
ইতিমধ্যেই আমরা রাক্ষুসে জঙ্গল পেছনে ফেলে এসেছি। মহারানীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আরকান রাজ্য অভিমুখে রওনা করেছি। তাছাড়া সকাল হতেও খুব বেশি দেরি নেই। তাই ভাবতে ভালই লাগছিল, অবশেষে আমরা এই লড়াইয়ের যবনিকা টানতে যাচ্ছি, মালিকার পতন হতে চলেছে।
আলিয়াকে নিয়ে আমার একটু দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। জানি না সে কীভাবে, কী অবস্থায় আছে।
হটাৎ পেছন থেকে একটা ক্ষীণ হাসির শব্দ আমার কানে ভেসে এল। যেন দূরে কেউ বা কারা খিল খিল করে হেসে চলছে। শব্দটি মোটেও স্বাভাবিক মনে হল না আমার কাছে। আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম, কান খাড়া করে সেটি শোনার চেষ্টা করলাম। আমাদেরই পেছন থেকে আসছে সেটি। কেউ আমাদের পিছু নিয়েছে।
“ছোটু, আরও দ্রুত চলতে হবে আমাদের।” আমি মৌমাছিটিকে উদ্দেশ্যে করে বললাম।
ধীরে ধীরে হাসির শব্দটি আরও জোরালো হতে লাগলো। হটাৎ তাচ্ছিল্যভরা কণ্ঠে কেউ একজন চেঁচিয়ে উঠলো, “ছোট্ট রাজকুমার, কোথায় যাওয়া হচ্ছে? আমরাও তোমার সঙ্গে যেতে চাই।” কথাটি বলেই বীভৎসভাবে খিল খিল করে হেসে চলল একটি ডাইনী।
এক মুহূর্তের জন্য মনে হল, ভয়াবহ রকমের বোকামি করে ফেলেছি আমি! এভাবে একা মৌ রানির সাথে দেখা করতে চলে এসেছি! বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছি আমাদের পুরো পরিকল্পনাটি।
নিশ্চয়ই হাত গুটিয়ে বসে ছিল না মালিকা। সুযোগের অপেক্ষায় ছিল সে আর আমিই তাঁকে সেই সুযোগটি তৈরি করে দিয়েছি! নিজের উপর বড্ড রাগ হচ্ছিল আমার।
যে কোন মুল্যেই হোক এখন আমাকে এদের হাত থেকে বেঁচে পালাতে হবে। যদি কোনভাবে এরা আমাকে ধরে ফেলতে সমর্থ হয় তবে সব পরিকল্পনাই ভেস্তে যাবে।
আমার পিতা নিশ্চয়ই আমার জীবন নিয়ে বাজি ধরবেন না। তাঁর এই দুর্বলতার কথাটি মালিকা খুব ভাল করেই জানে।
ইতিমধ্যেই ডাইনীগুলি আমাদের অনেকটা কাছাকাছি চলে এসেছে। আমাদের লক্ষ্য করে আগুনের গোলা নিক্ষেপ করছে। ছোটু কোনরকমে সেগুলি পাশ কাটিয়ে উড়ে চলছে। কিন্তু আমি জানি আমরা খুব বেশিদূর এভাবে এগোতে পারবো না। তাই যা কিছুই করার খুব দ্রুতই করতে হতো আমাকে।
হটাতই আমার মাথায় একটি বুদ্ধি খেলে গেল। আমি মুহূর্তেই মৌমাছিটিকে উত্তর দিকে ঘুরিয়ে নিলাম। ডাইনীরা আমার সঙ্গ কামনা করছে তো, আমি তাদের সঙ্গেই নিয়ে যাবো।
উত্তর দিকটা ডাকসার অঞ্চল। এখান থেকে খুব বেশি দূরেও নয় সেটি। আমি যদি কোনভাবে ডাকসার জঙ্গলে প্রবেশ করতে পারি, তবে হয়তো এদের হাত থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব। তাছাড়া আরকান রাজ্য এখনো অনেক দূরের পথ। তাই আমার কাছে অন্য কোন উপায় নেই।
আমরা ছুটে চলছি। এক মুহূর্তের জন্যেও পেছনে তাকানোর সময় নেই। ডাইনীগুলি তখনো আমাদের লক্ষ্য করে আগুনের গোলা নিক্ষেপ করে চলছিল। আর ছোটু সুচাতুরতার সাথে সেগুলি পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল।
কিন্তু হটাৎ একটি আগুনের গোলা ছোটুর ঠিক বামদিকের পাখাটায় এসে আঘাত করলো। মুহূর্তের মধ্যেই সে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করলো। আমি বুঝতে পারছিলাম খুব শীঘ্রয়ই মাটিতে আছড়ে পড়তে যাচ্ছি আমরা।
“আরেকটু পথ! আমরা প্রায় চলে এসেছি!” আমি চিৎকার করলাম। মনে মনে বিধাতার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলাম।
শেষ পর্যন্ত আমি আর মৌমাছিটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না। দুজনেই সজোরে মাটিতে আছড়ে পড়লাম। ছিটকে একটি গাছের সাথে ধাক্কা খেলাম আমি। মুহূর্তেই আমার চারপাশের সবকিছু ঝাপসা হয়ে এলো। আমি জ্ঞান হারাতে শুরু করলাম। দেখলাম উপরে আকাশে ডাইনীগুলি চক্কর কাটছে।
আমার যখন জ্ঞান ফিরল আমি নিজেকে একটি গুহার ভেতর আবিস্কার করলাম। আমার মাথার ভেতর প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছিল।
“এখানে সম্পূর্ণ নিরাপদ তুমি। কিছুটা বিশ্রামের প্রয়োজন তোমার।” একটা ভারী, গম্ভির কণ্ঠ কথাটি বলে উঠল। আমি এই কণ্ঠের মালিককে চিনি! আমি সাথে সাথেই ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিকে তাকালাম।
“সেনাপতি!” অস্ফুট স্বরে কথাটি বের হল আমার মুখ থেকে। “আপনি বেঁচে আছেন!”
বিস্ফোরিত চোখে আমি তখনো তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিলাম, যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
গুহার এক কোনায় সেনাপতি রাজন বসে আছেন। তাঁর একটি হাতের কুনুইয়ের নীচ থেকে বাকী অংশ নেই। হাতটি রক্তাক্ত কাপড় দিয়ে শক্ত করে পেঁচানো।
আমি তাঁর হাতের দিকে তাকালাম। বললাম, “কী হয়েছিল ঐ রাতে?” তিনি আমার কথার কোন জবাব দিলেন না। শুধু তাঁর কাটা হাতটির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “মনসুরের কি অবস্থা?”
আমি একটু সময় নিলাম। তারপর বললাম, “তিনি ভাল আছেন। আমরা তাঁকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পেরেছি।” কথাটি শুনে একদম চুপ হয়ে গেলেন সেনাপতি। মুখ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরোল তাঁর।
আমি ধীরে ধীরে তাঁকে সব ঘটনা খুলে বলতে শুরু করলাম। তিনি মনোযোগ দিয়ে আমার কথাগুলি শুনতে লাগলেন।
আয়াজের ব্যাপারটি শুনে ভীষণ কষ্ট পেলেন সেনাপতি। আয়াজ তাঁর অনেক পুরনো বন্ধু ছিলেন। তবে খাজার ব্যাপারটি তাঁর কাছে অনুমেয়ই ছিল। তিনি ঐ রাতেই কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছিলেন তবে বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছিল সেটা।
অন্য দিকে ডাকসা তাঁর জীবন বাঁচিয়েছিল। তাঁকে গুরুতর আহত অবস্থায় রক্ষা করেছিল। সেই রাতে তিনি ডাইনিদের হাত থেকে বাঁচার জন্য প্রাণপণে ছুটছিলেন, জঙ্গলের ভেতরে এসে জ্ঞান হারিয়েছিলেন, ডাকসাই তখন তাকে উদ্ধার করে। তাই ডাকসা আমার চাচা কথাটি শুনে আমি না যতটা ভেবেছিলাম তিনি ততটা অবাক হলেন না।
“ডাকসা এখন কোথায়?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“আমি ঠিক জানি না, রাজকুমার। আমি নিজেও তাঁর দেখা খুব একটা পাইনি।” সেনাপতি উত্তর দিলেন। “জানি না ঠিক কি কারনে সে আর কখনো আমার সামনে আসেনি। যদিও প্রতিদিনই আমার জন্য ফলমূল সংগ্রহ করে বাইরে রেখে যায়।” একটু থামলেন তিনি। তারপর আবার বললেন, “হয়তো সে ভয় পায়, যদি তাঁর দ্বারা আমার কোন ক্ষতি হয়ে যায়।”
আমি কিছুক্ষন চুপ করে রইলাম। হয়তোবা এটাই তার কারন, হয়তোবা নয়।
কিছুক্ষণ পর আমরা গুহা থেকে বাইরে বেরিয়ে এলাম। ইতিমধ্যে অন্ধকার অনেকটা কমে এসেছে, দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে। মৌমাছিটি বাইরেই অপেক্ষা করছিল। তাঁর পাখার অর্ধেকটাই পুড়ে গিয়েছিল। এই অবস্থায় সে হয়তো নিজে উড়ে যেতে পারবে কিন্তু আমাদের নিয়ে যেতে পারবে না।
আমাদের সৌভাগ্য ছিল আমরা জঙ্গল অবধি পৌছাতে পেরেছিলাম। তাই ডাইনীগুলিও আর নিচে নামার সাহস করেনি।
আমি মৌমাছিটির পিঠে হাত রাখলাম। সাথে সাথেই একটু নড়ে চড়ে উঠল পতঙ্গটি। “ছোটু, তুমি মৌ রানীর কাছে ফিরে যাও।” আমি বললাম। “তাঁকে এই বার্তা পৌঁছে দাও আমরা নিরাপদে আছি। আমাদের জন্য যেন কোন কিছু বিলম্বিত না হয়।” মৌমাছিটি কিছু বুঝে উঠতে পারলো কিনা জানি না। তবে সে উড়াল দেয়ার চেষ্টা করলো। কয়েকবার চেষ্টার পর অবশেষে উড়তে পারলো। তাকে আবার উড়তে দেখে আমি ভীষণ খুশি হলাম। যদিও পর মুহুরতে একটু ভয় হল সে নিরাপদে পৌছাতে পারবে কিনা।
এবার অপেক্ষার পালা। অপেক্ষা যেন সবকিছু ঠিকঠাক মতো হয়।
৪।
পুরোটা দিন জঙ্গলেই কাটাতে হল আমাদের। আমরা দুজনেই প্রার্থনা করছিলাম আর অপেক্ষার প্রহর গুনছিলাম যেন সবকিছুই পরিকল্পনা মতো হয়।
সারাদিনে ডাকসার দেখা মেলেনি। যদিও আমি তাঁর উপস্থিতি অনুভব করতে পারছিলাম। হয়তো সে আমাদের আশে পাশেই কোথাও রয়েছে , আড়াল থেকে আমাদের লক্ষ্য করছে।
সন্ধার দিকে দূর আকাশে আমি কিছু একটা দেখতে পেলাম। যেন কেউ বা কারা ঠিক এদিকেই উড়ে আসছে। হটাত করেই ছোটুকে আবিস্কার করলাম আমি, তার পেছনে রয়েছে আরও অনেকগুলি অতিকায় মৌমাছি। তাদের পাখার ফরফর শব্দ ধীরে ধীরে আরও জোরালো হয়ে উঠছিল।
মৌমাছিদের একটিতে আমার পিতা বসে ছিলেন, তাঁর চেহারায় ছিল যুদ্ধ জয়ের হাসি। নিজের অজান্তেই আমার ভেতরে একটি আনন্দ স্রোত বয়ে গেল। এক দৌড়ে আমি সেদিকে এগিয়ে গেলাম।
মৌমাছির পিঠ থেকে নেমে প্রথমেই আমাকে জরিয়ে ধরলেন পিতা। তারপর আলতো করে আমার কপালে একটি চুমু খেলেন।
সেনাপতির দিকে ফিরলেন তারপর, কিছুক্ষণ তাঁর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। চোখ ছলছল করছিল তাঁর। “তোমাকে নিয়ে আমি গর্বিত।” তিনি বললেন। তারপর তাঁকে জরিয়ে ধরলেন।
“আমরা মালিকাকে হারিয়ে দিয়েছি, অমর রত্ন রক্ষা করতে পেরেছি।” পাশ থেকে কথাটি বললেন আমার ভ্রাতা জাকির। “যদিও শেষ পর্যন্ত ডাইনীটা পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়।” একটু থামলেন তিনি। “কিন্তু সুসংবাদ হল আয়াজ বেঁচে আছেন। তিনি মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন কিন্তু এখন বিপদমুক্ত।” কথাটি শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরোল আমার মুখ থেকে। সেনাপতি যেন কেঁদেই ফেললেন।
এবার আমার দিকে ফিরলেন জাকির। একটু মুচকি হাসি দিলেন। সে জানে আমি কিছু একটা শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছি। “আর হ্যাঁ, আলিয়াও ঠিক আছে। আমরা তাকেও উদ্ধার করতে পেরেছি।” কথাটি বলেই হেসে দিলেন জাকির। আমি কিছুটা লজ্জা পেলাম। যদিও মনে মনে ভীষণ আনন্দ হচ্ছিল।
কিছুক্ষণ পর সবাই লক্ষ্য করলাম আরও একটি অতিকায় মৌমাছি ঠিক এই দিকেই উড়ে আসছে। এই মাছিটি অন্যগুলির তুলনায় অনেক বিশাল, মহারানী মৌরানী সেটির উপর বসে ছিলেন।
ধীরে ধীরে পতঙ্গটি নিচে নেমে এল। সবাই মহারানীকে কুর্নিশ করল। তিনি আমার পিতার দিকে একবার তাকালেন, বললেন, “অসাধারণ এই যুদ্ধ জয়ে আমার পক্ষ থেকে আপনাকে অভিনন্দন, রাজা মনসুর। আমার মৌ বাহিনী এই যুদ্ধে আপনার সঙ্গে ছিল, আশা করছি ভবিষ্যতেও আমরা সাহায্য করতে পারবো।”
রাজা মাথা নাড়ালেন, বললেন, “আপনাকেও অশেষ ধন্যবাদ, মহারানী। আপনার সাহায্য ছাড়া আমরা এই যুদ্ধ এতো সহজে জয়লাভ করতে পারতাম না।”
এবার সেনাপতির দিকে ফিরলেন মহারানী। কিছুক্ষণ চুপ থেকে তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনার এই ক্ষতির জন্য আমি খুবই দুঃখিত, সেনাপতি রাজন।” সেনাপতি কোন উত্তর দিলেন না। কেবল একবার মাথা নাড়লেন।
এবার মহারানী তাঁর চারিদিকে জঙ্গলের গভীরে তাকালেন, যেন দুচোখ দিয়ে তিনি কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করলেন।
এরপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমি তোমাকে নিয়ে ততোটাই গর্বিত, ঠিক যতটা আমি তাঁকে নিয়ে।” জঙ্গলের দিকে কিছু একটা ইঙ্গিত করলেন। তারপর কিছুটা উঁচু গলায় বললেন, “আমি জানি আপনি আমাদের প্রত্যক্ষ করছেন। আমি আপনাকে অনুভব করতে পারছি, ঠিক যেমনটা আপনি পারছেন। হয়তো আপনার দেখা আমি পাবো না, আপনার এই রূপটি আমার জানা হবে না কিন্তু কথা দিচ্ছি আমি আমৃত্যু এর প্রতিকার খুঁজে বেড়াবো।” একটু থামলেন তিনি। কিছুক্ষন চুপ থেকে বললেন, “আপনি সবসময়ই আমার কাছে সুদর্শন ছিলেন, থাকবেন।” কথাটি বলেই মাথা নিচু করে ফেললেন মহা রানী।
“আমরা সবাই অনেক ভালবাসি তোমাকে, আনসুর।” এবার আমার পিতা বললেন। “আমি কতো খুঁজে ফিরেছি তোমাকে, স্মরণ করেছি তোমার সাথে কাটানো মুহূর্তগুলি।” একটু থামলেন তিনি। তাঁর চোখদুটি ছলছল করছিল। “মানুষের কোন দুরবস্থা বা পরিণতিই তাঁর আপনজনের কাছে মুখ্য বিষয় নয়, আনসুর।” এবার থামলেন তিনি। যেন কিছু একটা জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
অপেক্ষা করছিলাম আমরা সবাই। তাকিয়ে ছিলাম জঙ্গলের গভীরে, আঁধারে। কিন্তু কিছুই ঘটলো না, কেউ জঙ্গল থেকে বেরিয়েও এলো না।
অনেক্ষণ কেটে গেছে এরপর। এক সময় নিঃশব্দে জঙ্গল ত্যাগ করলেন মহারানী। বাকীরাও একে একে মৌমাছির পিঠে চড়ে বসলো। ধীরে ধীরে মৌমাছিগুলি উপরে উঠে যেতে লাগলো। গাছপালা, জঙ্গল সবকিছুই ছোট হয়ে আসতে লাগলো। বিশাল থালার মতো চাঁদটি এবার আরও বড় দেখাল।
সবাই রওনা করলাম আরকান রাজ্যের উদ্দেশ্যে।
হটাত ঐ নিচে আমি কী কিছু একটা দেখতে পেলাম! কিছু একটা যেটা জঙ্গলের গভীর থেকে ঐ ফাঁকা জায়গায়টিতে এসে দাঁড়িয়েছে! নাকি এই সবই স্রেফ আমার কল্পনা, দৃষ্টি বিভ্রম!
তবে এটা যা-ই হোক আমি জানতাম আমাকে আবার বের হতে হবে। খুঁজে বের করতে হবে আমার চাচাকে, বের করতে হবে তার প্রতিকার। তবে সেটি না হয় হবে অন্য কোন একটি গল্প, অন্য একটি অভিযান। (সমাপ্ত)
Ayrin kaTun, Sofikul alom, Liton vhos, Nowrin talukdar, Nera akter, Fahad islam, Israyeel hossen and লেখাটি পছন্দ করেছে
Permissions in this forum:
You cannot reply to topics in this forum
|
|