সাদা কাগজ
Would you like to react to this message? Create an account in a few clicks or log in to continue.

Go down
avatar
Shamim
ধুমকেতু
ধুমকেতু
Posts : 23
স্বর্ণমুদ্রা : 1110
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-06-01

মাতৃত্বের স্বাদ - Page 2 Empty Re: মাতৃত্বের স্বাদ

Wed Jul 28, 2021 6:14 pm
(১১)

মুক্তি ইচ্ছে করে হাসির কিছু কথা বললো, যা শুনে সুপ্তি না হেসে থাকতে পারলো না। আওয়াজ তুলে হাসছে। সাথে মুক্তিও খিলখিল করে হাসছে। সুপ্তির মা ওদের হঠাৎ এমন হাসির কারণ বুঝতে পারছেন না। তিনি অনেকটা বিব্রত বোধ করেন। কিচেন থেকে আবার হাসির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। এদিকে রশিদ সাহেব পাত্রের আদি অন্ত সব বিস্তারিত বলে যাচ্ছেন। সুপ্তির মায়ের সেইদিকে কোনো খেয়াল নেই। মেয়ে দুটোর এমন উদ্ভট আচরণে ওনি কিছুটা লজ্জা পাচ্ছেন। দুই বোন হেসে কথা বলতে বলতে মগভর্তি উষ্ণ ধূমায়িত চা নিয়ে বারান্দা দিয়ে অন্যঘরে চলে গেল।

ঘরে এসে সুপ্তি জিজ্ঞেস করলো,
বুবু, আজ হঠাৎ এমন করছিস কেন? ওনারা কি মনে করবে?
ঐ লোকটাকে এভাবেই ইগনোর করতে হবে। পাত্তাই দিবি না। ঠাণ্ডা মাথায় কথা দিয়ে,ব্যবহার দিয়ে অপমান করতে হবে। এখন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আমার উপকার
করতে চাইছে। বদ লোক একটা।

রশিদ সাহেব কথার ফাঁকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে সুপ্তিকে খোঁজ করছে। নানা রকম কথা বলে শুধু কথা টেনেই নিচ্ছেন। মিসেস করিম চুপ থেকে শুনে হ্যাঁ,হু করে যাচ্ছেন। রশিদ সাহেব সব কথার শেষে বললেন,

আপনি চাইলে কালই ছেলের ছবি এনে দেখাতে পারি।
আর দেখাদেখির প্রোগ্রাম করলে সেটা আগেই জানিয়ে দিতে হবে। যেহেতু ছেলের পোস্ট দূরে। ছুটি নিয়ে তাকে ভাইয়ের বাসায় আসতে হবে।

মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব তেমন পছন্দ হয়নি মিসেস করিমের। মুখের উপর সরাসরি না করেও দিতে পারছে না। এদিকে নামাজের ওয়াক্ত পেরিয়ে যাচ্ছে। কথা আর বাড়াতে চাইছেন না। শান্ত গলায় শুধু বললেন,

আমার একার মতামতে তো বিয়ে হবে না। মেয়ে বড় হয়েছে,লেখাপড়া শিখেছে। ভালো মন্দ বুঝতে শিখেছে। তার মতামত ছাড়া আমি কিছু বলবো না। ওর বাবা নেই
অভিভাবক বলতে আমি। অভিভাবক আমি হলেও মেয়েদের চাচারা আছেন। ওনাদের সাথে কথা বলে তারপর দেখাদেখির তারিখ ঠিক করলে মনে হয় ভালো হবে। তাছাড়া মুক্তির সামনে একটা নিয়োগ পরীক্ষা আছে। মেয়েটা এখন চাকরির পড়া নিয়েই ব্যস্ত। পরীক্ষা হয়ে যাক তারপর বিয়ের কথা বলবো।

ব্যাংকের পরীক্ষা?

না,শহরে একটা বেসরকারী কলেজে। কলেজের নামটা কি জানি বলল। ও মনে পড়েছে! আর্দশ বিদ্যানিকেতন মহাবিদ্যালয়।

খুব ভালো কলেজ। এই কলেজে চাকরি হলে তো খুবই ভালো হয়। মুক্তি স্টুডেন্ট ভালো। আশা রাখি হয়ে যাবে।

সুহানা সুপ্তির মায়ের কথার সাথে তাল মিলিয়ে বলল,

আপার সাথে আমি পুরোপুরি একমত। বিয়েতে মুক্তির মতামত জরুরী। বিয়ে ছেলে খেলা নয়। সারাজীবনের
ব্যাপার।

'তুমি থাকো। আমার কাজ আছে। আমি বের হচ্ছি।'
সুহানাকে কথাটা বলেই রশিদ সাহেব বের হয়ে গেলেন।

রিয়া অনেক আগেই সুপ্তির ঘরে চলে আসে। সুপ্তির মা ওযু করে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলে সুহানা মেয়েকে না নিয়ে কাজের কথা বলে ঘরে চলে আসলো।

রিয়ার আব্বু বিয়ের প্রস্তাব এনে আবার কাছাকাছি ভিড়তে চাইছে। ভালো মানুষ সাজার নাটক তৈরি করছে। সুপ্তিকে দেখতে,কথা বলার সুযোগ বের করার চেষ্টা করছে। সেটা মুক্তি খুব ভালো করে বুঝতে পারে।
রিয়ার কারণে লোকটা সম্পর্কে সুপ্তির কাছে কোনো কথা শেয়ার করতে পারছে না। মেয়েটা ঘর থেকে যাচ্ছেও না। মুক্তি জব সলিউশনের সহজ সমাধান বইটি হাতে নিয়ে শুয়ে শুয়ে দেখছে। রিয়া খাটে পুরোনো কিছু খেলনা ছড়িয়ে খেলছে। সুপ্তি ফিজিক্সের অংক করছে টুকটাক কথা বলছে। পিছন থেকে আশিক এসে সুপ্তির মাথায় টোকা দিয়ে বলল,

'পাগল হয়ে যাবি তো! এত পড়া লাগে? আমি আজ সারাদিন বই হাতে নিয়েও দেখি নাই।'

তুই পড়তে বসলে ঘুরে বেড়াবে কে? সারাদিন টই টই করে ঘুরে বেড়াস।

মুক্তি বই বন্ধ করে শোয়া থেকে উঠে বসলো।

সারাদিন কি করলি আশিক? পরীক্ষার আর ক'দিন আছে বল? এখনও সময় আছে। মন দিয়ে লেখাপড়া কর। বানরের মতো ঘুরে বেড়াস না!

তোমার মতো এত দরদ দিয়ে শাসন তো কেউ করে না
মুক্তি বু! লেখাপড়া না করলেও আম্মা কিছুই বলে না।
আব্বা সারাদিন ধমকায়। আম্মা এই নিয়ে আব্বার সাথে তুলকালাম। কেন তার ছেলেকে বকা দিল।

চাচী বেশি আদর দিয়েই তোদের মাথাটা খেয়েছে। চাচীর এই ন্যাকা আদরের জন্য সালমার পড়ালখাটা হলো না। অল্প বয়সে বিয়ে দিতে হলো। চাচার কত ইচ্ছে ছিল সালমা লেখাপড়া শিখবে। অন্তত গ্র্যাজুয়েশন করবে। এইচএসসি পাশটা করতে পারলো না। চাচি তোদের দিকে নজর না দিয়ে কোন বাড়িতে কি ঘটলো,
সেসব নিয়ে মাথা ঘামায়। মায়ের বিয়ের পর থেকে পিছনে লেগে থাকতো। দাদি মা'কে পছন্দ করতো ঐটা
তিনি সহ্য করতেন না। থাক সে সব পুরানো কথা। তুই বুঝিস না নিজের ভবিষ্যত? লেখাপড়া করে জীবনে
ভালো কিছু করতে হবে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে।

আশিক চুপ থেকে বলল,

আম্মার কথা কি বলবো বলো? নিজে যা বুঝে সেটাই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। ছোটখাটো বিষয় নিয়ে আব্বার সাথে এখনও এমন ঝগড়া করে। বুঝিয়ে কিছুতেই থামাতে পারি না। এইসব ঝগড়াঝাঁটি আমার ভালো লাগে না। এখন যাই মুক্তি 'বু'। তোমার কথাগুলো মেনে চলবো।

আচ্ছা যা! ঘুরে সময় নষ্ট করিস না।

আশিক যাওয়ার সময় সুপ্তির মাথায় আবার টোকা দিয়ে হাসলো। সুপ্তি ঘাড় ঘুরিয়ে বাঁকা চোখে তাকিয়ে রেগে বলল,

বাউন্ডুলের মতো সারাদিন না ঘুরে পরীক্ষার জন্য ভালো করে প্রস্তুতি নে।

দেখিস, সুপ্তি আমাকে আর দেখতে পাবি না। আজ থেকে মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করবো। একেবারে পরীক্ষার পর আসবো।
আচ্ছা,দেখবো নি। কথাটা কতভাগ সত্যি হয়। সুপ্তি
এই কথা বলে মুচকি হাসলো।

বিকেল ঘনিয়ে সন্ধ্যা নেমে আসলো। মুক্তি নামাজ পড়তে চলে গেল। সুপ্তি জানালা আটকিয়ে নিজেও নামাজের জন্য ওযু করতে গেল। উঠোনের বারান্দার বাইরে থেকে মায়ের ডাক শুনে রিয়া এক দৌড়ে ওদের ঘরে চলে গেল। মিসেস করিম তসবিহ হাতে সুপ্তির ঘরে আসলেন। মুক্তি নামাজের বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াতেই রাগে প্রশ্ন করলেন,

তখন দু'বোনের কি হয়েছিল শুনি? রান্নাঘরে উচ্চস্বরে হাসাহাসি করছিলি কেন? রিয়ার বাপ,মা কি মনে করবে? আমি ভাবছি চা বানাতে গিয়ে দু'জন কথা বলছিস। দু'কাপ চা দিয়ে গেলে কি হতো?

ঐ লোক যা খুশি মনে করুক কিছু যায় আসে না। তুমি রিয়ার বাবাকে যতটা ভালো মানুষ মনে করো সে কিন্তু লোক ভালো না। খুব ধুরন্ধর লোক। রিয়া,তার মায়ের জন্য বাসাটা ছেড়ে দেওয়ার কথা বলছি না। মেয়েটাকে আমরা খুবই ভালোবাসি। তাছাড়া রিয়ার আম্মু খুব ভালো মনের মানুষ। আমাদের সাথে বেশ মানিয়ে নিয়েছে। কোনো কারণ ছাড়াই হুটহাট তো একজনকে বাসা ছেড়ে দেওয়ার কথা বলা যায় না। ভদ্রতা বলতে তো কিছু আছে। এই মুহূর্তে আমারও চাকরি নেই। দুই এক মাস বাসা খালি থাকলে অনেক সমস্যা। তবুও তো বাসা ভাড়ার টাকা দিয়ে সুপ্তির প্রাইভেট,কলেজের টিউশন ফি,লেখাপড়ার যাবতীয় খরচ চালিয়ে নেওয়া যাচ্ছে। এইসব কিছু ভেবেই নামধারী ভদ্রলোক পুলিশ ইন্সপেক্টরকে বাসা ছেড়ে দেওয়ার কথা বলতে পারছি না।

মিসেস করিম মুক্তির মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। মুক্তির কথা শেষ হতেই বললেন,

কি বলছিস এইসব? আমাকে জানাস নাই কেন? আমি ওনার খারাপ কিছু দেখি না তো! আচার-ব্যবহার,কথাবার্তা বেশ সামাজিক,ভদ্র মানুষই
মনে হয়। কি ঘটেছে বল? কালকেই রিয়ার আব্বুকে বাসা ছেড়ে দিতে বলবো। বাসা খালি থাকবে। তবুও ভালো মানুষ ছাড়া বাসা ভাড়া দিব না। টাকার ব্যবস্থা আল্লাই করবে। আল্লাহর দুনিয়ায় কেউ না খেয়ে থাকে না। সব জীবের খাদ্যের ব্যবস্থা করেই তিনি দুনিয়ায় পাঠান। রিজিক,রুজির মালিক একমাত্র উপরওয়ালা।
তোদের নিয়ে এমনিতেই কতটা চিন্তায় থাকি সেটা একমাত্র আমি আর উপরওয়ালা জানেন। অনেক সময় রাতে ঘুমাতে পারি না। সুপ্তিও একদিন বলল রিয়ার আব্বুকে বাসা ছেড়ে দেওয়ার কথা বলতে। তখন বিষয়টি তেমন গুরুত্ব মনে করিনি। কিন্তু আজ তুই এইসব কি শোনাইলি?

সুপ্তি চুপ থেকে সব কথা শুনে মুক্তিকে ইশারায় আর কিছু বলতে নিষেধ করলো। খাটে মায়ের পাশে বসে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,

মা,তেমন কিছু ঘটে নি। অযথা চিন্তা করো না তো! বাদ দাও এইসব। রিয়ার আব্বু কথা বলার সময় হয়তো কোনো কথা বুবুর পছন্দ হয়নি। এখন বলো বুবুর বিয়ে নিয়ে কি সব কথা হলো?

মুক্তি বলল,

মা,এখন বিয়ের কথা বন্ধ রাখো। একটা ভালো চাকরি হোক। সুপ্তিকে একটা জায়গায় দাঁড় করাই। ঘরদোরের অবস্থা আর একটু ভালো করি। তোমাদের জন্য আরও কিছু করি তারপর চিন্তা ভাবনা করো।

মিসেস করিম একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। তারপর শান্ত গলায় বললেন,

মা রে সময় বসে থাকে না। বয়স তো বেড়ে যাচ্ছে! বেশি
বয়সে বিয়ে হলে কত ধরনের সমস্যা হয়।

মায়ের গালের সাথে গাল মিশিয়ে কিছুসময় চুপ থাকে
মুক্তি। নিঃশ্বাসের সাথে প্রাণভরে মায়ের গায়ের গন্ধ নিচ্ছে। দুই মেয়ের ভালোবাসার আলিঙ্গনে নীরবতায় কেটে যায় খানিকটা সময়। নড়েচড়ে মুক্তি আহ্লাদি গলায় বলল,

বিয়ে দিলে যখন তখন কি তোমার গাল ঘঁষে আদর খেতে পারবো? তোমার পাশে সব সময় থাকতে পারবো? আমার জন্য শুধু দোয়া করো। চাকরিটা যেন হয়ে যায়।

পনেরোদিন প্রস্তুতি নিয়ে শুক্রবার সকালে মায়ের কাছ থেকে দোয়া নিয়ে মুক্তি চাকরির পরীক্ষা দিতে গেল। গিয়ে জানতে পারে আজই লিখিত,মৌখিক পরীক্ষা হয়ে বিকেলেই যোগ্য প্রার্থীদের জয়েনিং লেটার দিয়ে দেওয়া হবে। লিখিত পরীক্ষার ফলাফল কলেজ গেইটে নোটিশ বোর্ডে টানিয়ে দিবে। বিকেল তিনটায় মৌখিক পরীক্ষা শুরু হবে। দেড় ঘন্টা লিখিত পরীক্ষা দিয়ে মুক্তি গেইটের বাইরে রাস্তার পাশে বসে অপেক্ষা করছে। নানা ভাবনায় সময় পার করছে। হঠাৎ দেখে বান্ধবী মনি তার হাজব্যান্ডসহ সামনে দাঁড়ানো। মনি তার হাজব্যান্ডকে পরিচয় করিয়ে দিল। পরিচয় পর্ব শেষ করে টুকটাক কথা বলে মনি একসাথে লাঞ্চ করার কথা বললে মুক্তি কিছুটা সংকোচ প্রকাশ করলো। মনি জোর করেই মুক্তিকে নিয়ে গেল। লাঞ্চ সেড়ে এসে দেখে নোটিশ বোর্ডে ভীড় লেগে গেছে। মুক্তি ভিতরে ভিতরে খুব টেনশন করছে। চাকরিটা তার খুব প্রয়োজন। যদি লিখিত পরীক্ষায় পাশ না করতে পারে ভাইভা না দিয়েই
মন খারাপ নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। মুক্তি মনে মনে আল্লাহকে ডাকছে। হে আল্লাহ তুমি আমাকে নিরাশ করো না। মনের আশা পূরণ করে দিও। আস্তে আস্তে
নোটিশ বোর্ডের দিকে এগিয়ে গেল।

বোটানি বিষয়ের দুই নং ক্রমিকে মুনতাহা করিম নামটি দেখেই মুক্তির চোখমুখ ঝলমল করে উঠে। খুশিতে চোখের কোণে এক ধলা পানি জমে উঠে। চোখ বুলিয়ে ভালো করে মনির নাম আছে কিনা খেয়াল করে। একটু পর মনি মুক্তির কাঁধে হাত রেখে মলিন মুখে হেসে বলল,

'অভিনন্দন বন্ধু,খুব খুশি হয়েছি! দোয়া করি তোর চাকরিটা হয়ে যাক।'

মুক্তি চোখের কোণায় জমে থাকা পানি মুছে বলল,

তোর জন্য খারাপ লাগছে মনি!

আমার জন্য ভাবতে হবে না। তাছাড়া আমার চাকরির ইচ্ছে খুব একটা নেই। বাবার জোরাজুরিতে লিখিত পরীক্ষা দিতে আসছি। বিয়ে হয়ে গেছে স্বামী,সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকতে চাই। বিয়ের প্রোগ্রামে তোকে আসতে হবে কিন্তু। ফোন করলে সুপ্তিকে নিয়ে চলে আসিস।

ওকে বন্ধু,দোয়া করি। সুখে সংসার কর। অনুষ্ঠানের তারিখ জানিয়ে ফোন দিস। ঠিক সময়ে চলে আসবো।

মনি তার হাজব্যান্ড নিয়ে চলে গেল। মুক্তি ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করছে। সিরিয়াল আসলে ভিতরে ভাইভা দিতে গেল। ভাইভা বোর্ডের সদস্যগণ যা যা প্রশ্ন করছে মুক্তি কম বেশি সবগুলোর উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছে। বেশিরভাগ প্রশ্নের উত্তর দিতে পেরেছে। সালাম দিয়ে রুম থেকে বের হবে এমন সময় মুক্তির ডানে বসা এক সদস্য হঠাৎ বললেন,

মনুতাহা করিম আপনার বাবা বেঁচে নেই? আপনারা দুইবোন। মা সরকারি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা। পুলিশ ইন্সপেক্টর আব্দুর রশিদ আপনাদের আত্মীয় হন? বেশ
ভালো মনের মানুষ উনি।
মুক্তি ব্যক্তিগত এমন কিছু প্রশ্ন শুনে হকচকিয়ে যায়।
টেনশন,উত্তেজনা দুটোই কাজ করছে। চুপ থেকে মুচকি হেসে বলল,

জ্বি স্যার,বাবা বেঁচে নেই। মা,ছোটবোন নিয়ে তিনজনের ছোট্ট সংসার। পুলিশ ইন্সপেক্টর আব্দুর রশিদ সাহেব উনি আমাদের বাসায় পরিপার নিয়ে ভাড়া থাকেন।

ঠিক আছে,আপনি এখন আসতে পারেন।

টেনশন,অপেক্ষার অবসান কাটিয়ে সন্ধ্যার ঠিক আগ মুহূর্ত মুক্তি প্রভাষক পদে জয়েনিং লেটার হাতে নিয়ে কলেজ গেইট ত্যাগ করে। একাকী দৃঢ় পায়ে হেঁটে যাচ্ছে স্টেশনের দিকে। ব্যাগে রাখা মোবাইল বের করে প্রথমে মা'কে খুশির খবরটা দিল। প্রত্যাশা যা করেছিল আজ উপরওয়ালা তার পুরোটাই দিয়েছেন। মনে মনে সৃষ্টিকর্তার প্রতি শুকরিয়া জানায়। হাঁটতে হাঁটতে প্রায় স্টেশনে চলে আসলো। স্টার্ট দেওয়া বাস দেখে ঝটপট উঠে গেলো। প্রথম সিট খালি পেয়ে বসে পড়লো জানালার পাশে। দৃষ্টি রাখলো জানালার বাইরে ঘুটঘুটে
অন্ধকারের দিকে। বাস চলে যাচ্ছে পে- পো শব্দে বাতাসের গতিতে। হিমেল হওয়া মুক্তির চোখ মুখ ছুঁয়ে যাচ্ছে। ছোট ছোট চুলগুলো বাতাসে বারবার দোল খাচ্ছে। আরামে চোখ দুটো তার বন্ধ হয়ে আসছে। এতদিনের পরিশ্রমের ফল আজ তার হাতের মুঠোয়। কি যে ভালো লাগছে মুক্তির! হঠাৎ তার বাবার মুখটি মনে করে মনটা খারাপ হয়ে।
------------চলবে

Sahin kondokar, Ruma islam, Md salim bapari, Jalsan khan, Naimul islam, Faima islam, Meher afroj and লেখাটি পছন্দ করেছে

avatar
Shamim
ধুমকেতু
ধুমকেতু
Posts : 23
স্বর্ণমুদ্রা : 1110
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-06-01

মাতৃত্বের স্বাদ - Page 2 Empty Re: মাতৃত্বের স্বাদ

Wed Jul 28, 2021 6:14 pm
(১২,১৩)

মুক্তি কলেজে যোগদান করে একমাস ধরে বাড়ি থেকেই ক্লাস করছে। বেশ আনন্দ,এবং যত্ন নিয়েই নিয়মিত
পেশাগত কাজের দায়িত্ব পালন করছে। কলেজ থেকে অনেক সময় বাসায় ফিরতে দেরি হয়ে যায়। ক্লান্ত দেহ নিয়ে ফিরতে কখনো বিকেল আবার কখনো সন্ধ্যা গড়ায়। দেহটা ক্লান্ত থাকলেও মনের দিক অনেকখানি প্রাণোচ্ছল,সতেজ থাকে। বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে খেতে বসে মা,বোনের কাছে হেসে হেসে সব কথা গড়গড় করে বলে। কলেজে কি ঘটলো, ক্লাস নিতে টেনশন হচ্ছিল কিনা,ক্লাসে কোন মেয়ে তার প্রশংসা করলো,পথে কি হলো,বাসে সিট পেলো কিনা, একে একে সব কথা বলে তারপর রেস্ট নিতে যাবে। মিসেস করিম মনোযোগ সহকারে মেয়ের কথা শুনেন। সঠিক দিকনির্দেশনা দেন।
মেয়ে নতুন চাকরিতে জয়েন করেছে তাঁর সুখের সীমা নেই। সুখের সাথে দুশ্চিন্তার রেশটাও কাটিয়ে উঠতে পারেন না। মনের ভিতর সব সময় একটা আতংক কাজ করে। এতদূর জার্নি করে যেতে হয়। পথে কত ধরনের সমস্যা হতে পারে। বাসে চেপে এভাবে প্রতিদিন আসা যাওয়া করলে মেয়ের শরীর,স্বাস্থ্য ঠিক থাকবে না।
শহরে একা বাসা ভাড়া করে থাকবে মনটা সাঁয় দেয় না।
চাকরি পাওয়ার পর আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরে এলেও চিন্তাটা দ্বিগুণ বেড়েছে মিসেস করিমের। আল্লাহর কাছে একটাই চাওয়া সৎপাত্রের হাতে মেয়েটাকে তুলে
দিয়ে চিন্তার পাল্লাটা হালকা করতে চান।

স্কুল থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে সুপ্তিকে নিয়ে দুপুরের খাওয়া শেষ করেন মিসেস করিম। সুপ্তি খাবার টেবিল গুছাচ্ছে, ফাঁকে মায়ের সাথে টুকটাক কথা বলছে। মিসেস করিম ফিল্টার থেকে জগে পানি ভরে টেবিলে রাখলেন। এরপর পানির মগটা নিয়ে এক মগ পানি খেলেন।

মুক্তি বাসে উঠেছে? ফোন দিয়েছিলি?

দিয়েছিলাম। কল রিসিভ করেনি। ফোন ব্যাগে রাখে। মনে হয় টের পায়নি। চাপ লেগে অনেক সময় সাইলেন্ট হয়ে যায়।

তোর চাচার বাসায় যাবো। রেডি হ। জমিজমা নিয়ে ভাইজানের সাথে কথা বলবো। অনেকদিন ধরে ভাবছি যাবো। আর সময় বের করতে পারি না।

তুমি যাও মা! আমি বরং বাসায় বসে পড়ি।

কথা বাড়াস না! যা বলছি তাই কর। বেশি সময় থাকবো না। এসে সন্ধ্যা থেকে পড়তে বসিস।

সুপ্তি ঘরের জামা চেঞ্জ করে মায়ের সাথে বের হলো। মিসেস করিম উঠোনের বারান্দার গ্রিলের গেইটে তালা দিয়ে চাবিটা সুপ্তির হাতে দিয়ে বললেন,

রিয়ার আম্মুর কাছে চাবিটা রেখে আয়! মুক্তি বাসায় এসে দাঁড়িয়ে থাকবে। চাবিটা থাকলে ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নিতে পারবে।

সুপ্তি চাবি নিয়ে রশিদ সাহেবের ঘরে আসলো। দেখে ওনি শুয়ে টিভি দেখছে। সুপ্তিকে দেখামাত্রই শোয়া থেকে উঠে বসলেন। রিয়া বাবার পাশে ঘুমাচ্ছে। সুপ্তি সুহানাকে দেখতে না পেয়ে কোনো কথা না বলে সরাসরি ভিতরে আসলো। সুহানা মোবাইলে কথা বলছিল। সুপ্তিকে দেখেই হেসে বলল,

কি মনে করে এলে? আমাদের ঘরে আসা তো ভুলেই গেছ। এখন আর আগের মতো চা খেতে খেতে জমিয়ে আড্ডা দেওয়া হয় না। সুপ্তি অনেকটা বদলে গেছো তুমি। মনে হচ্ছে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছো। কি হয়েছে তোমার?

কিছুই হয়নি। আসলে লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত সময় যাচ্ছে।
সামনে পরীক্ষা তাই সব কিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া। চাবিটা রাখেন। বুবু এসে খোঁজ করলে দিবেন।
মা'কে নিয়ে একটা বিশেষ কাজে চাচার বাসায় যাচ্ছি।

আশিকদের বাসায় যাচ্ছো?

হুমম।

সুপ্তি দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে আসলো। রশিদ সাহেব কথা না বলে সুপ্তির দিকে শুধু নিরব দৃষ্টি দিলেন।সুহানা পিছন পিছন দরজা পর্যন্ত আসলো। সুপ্তি একবারের জন্যও রশিদ সাহেবের মুখের দিকে তাকায়নি।

সুপ্তি মা'কে নিয়ে চাচার বাসায় পৌঁছে দেখে চাচা বারান্দায় দুইজন লোক নিয়ে কথা বলছেন। সুপ্তি সালাম দিয়ে ভেতরে গেলো। আশিকের বোন সালমা
খাটে ছোট বাচ্চাটাকে ফিডার খাওয়াচ্ছে। হাত মুছতে
মুছতে আশিকের মা ঘরে ঢুকলেন,

শুনলাম মুক্তির কলেজে মাস্টারি চাকরি হইছে। এখন
মেয়ের বিয়ার চিন্তা করো রেবেকা। মেয়ের বয়স তো মেলা হইছে। এখন দেখ বয়সের সাথে মিলাইয়া জামাই
পাও কিনা।

মিসেস করিম ভালো করেই জানেন খোঁচা দিয়ে কথা বলা ছাড়া ওনি কোনো কথা বলতে পারেন না। মানুষকে সব সময় তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কথা বলেন। সম্মান দিতে
জানেন না। সম্মান কি সেটাও বুঝেন না। এইজন্য কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলতে চান না। কিছু সময় চুপ থেকে তারপর বললেন,

মেয়ের বিয়ে দিব ভালো ছেলেই তো পাই না। আমার শিক্ষিত মেয়ে। ইচ্ছে করলেই যার তার কাছে বিয়ে দিতে পারি না। মেয়ে দুটোকে নিয়ে এত চিন্তা করি না। মেয়েরা
আমার আঁচলের নীচেই আছে। জন্ম,মৃত্যু,বিয়ে সবই উপরওয়ালার হাতে। আল্লাহর যখন হুকুম হবে তখনই
মেয়ের বিয়ে হবে। দোয়া করবেন মেয়ে দুটোর জন্য।

আশিকের মা কথাগুলো শুনে টেবিল থেকে পানের বাটা
নিয়ে খাটের উপর পা উঠিয়ে বসলেন। জর্দা দিয়ে পান বানিয়ে নিজের মুখে দিলেন। আয়েশ করে পান চিবুচ্ছেন। জর্দার সুঘ্রাণে সারা ঘর মৌ মৌ করছে। সুপ্তিকে পান দিয়ে বললেন,

বারান্দায় তোর চাচাকে দিয়ে আয়।

সুপ্তি পান দিয়ে আবার মায়ের পাশে বসলো। এক দৃষ্টিতে চাচির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। চাচির পান খাওয়া রাঙা মুখটা দেখতে সুপ্তির খুব ভালো লাগছে।
তারও মুখভর্তি করে জর্দা দিয়ে পান চিবুতে ইচ্ছে করছে। মায়ের ভয়ে সাহস করে বলতে পারছে না।
কি করবে এখন? তার যে খেতে খুব ইচ্ছে করছে। চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে খাটে বসলো। চুপ করে পানের বাটা থেকে একটু পান সুপারি নিয়ে মুখে দিয়ে মায়ের দিকে তাকালো। মিসেস করিম ভ্রু কুঁচকে বললেন,

সুপ্তি এইসব কি হচ্ছে?

থাক রেবেকা!মেয়ের পান খাইতে মন চাইছে তুমি কিছু
বলবা না। ছেলে-মেয়েদের এত শাসনে রাখা ভালা না।

আশিকের বাবা লোকজনের সাথে কথা শেষ করে ঘরের ভিতরে আসলেন। সুপ্তির মা সালাম দিয়ে কুশলাদি বিনিময় করে কথা শুরু করলেন,

ভাইজান,একটা বিষয়ে আপনার সাথে কথা বলতে আসছিলাম। অনেকদিন ধরে ভাবছি আসবো। আর সময় করে আসতে পারছি না।

আশিকের বাবা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললেন,

মুক্তির বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে আসছো? নাকি অন্য কিছু?

মুক্তির বিয়ে আপনাদের সাথে আলোচনা করা ছাড়া দিব না। যা কিছু করবো আপনাদের সাথে পরামর্শ করেই করবো। বাড়ির পিছনে পালানের জমি নিয়ে একটু কথা বলতে চাই ভাইজান।

আশিকের মা কথাটা শোনা মাত্রই তড়িৎ গতিতে বড় বড় চোখে বললো,

পালানের জমির আবার কি হইলো? ঐখানে তো তোমাদের ভাগ নাই। সুপ্তির বাপের অসুখের সময় সব বিক্রি করে দিয়ে টাকা নিয়া গেলা তোমার মনে নাই?

ভাবী ঐখানে সুপ্তির বাবার সাত শতাংশ জমি ছিল। তাঁর চিকিৎসার জন্য এবং অন্য একটা দরকারে পাঁচ শতাংশ বিক্রি করা হয়েছিল। দুই শতাংশ জমি এখনও আছে। ঐ দুই শতাংশ বিক্রি করার ব্যাপারে ভাইজানের সাথে কথা বলতে আসছি।

মুহূর্তের মধ্যে আশিকের মা অগ্নিমূর্তির ন্যায় রূপ ধারণ করে। রাগে গজগজ করতে করতে উচ্চস্বরে বলল,

রেবেকা তুমি এইসব কি কইতাছো? মাস্টারি কইরা তোমার মাথাডা গেছে। পালানের জমিতে তোমাদের আর কোনো ভাগ নাই। কথাটা ভালা কইরা শুইনা রাখো। তোমার ভাইজান জমিজমার কিছুই জানে না।

আশিকের বাবা চুপ থেকে মাথা নীচু করে বসে আছেন।
সব কথা শুনে শুধু বললেন,

রেবেকা তুমি মেয়েকে নিয়ে বাড়ি যাও। সন্ধ্যা হয়ে আসতেছে। ঐ দুই শতাংশ জমির কাস্টমার এখন পাওয়া যাবে না। আমার অংশ যখন বিক্রি করবো তখন তোমারটা বেচে টাকা দিয়ে দিব।

মিসেস করিম কিছু বলতে যাবে হঠাৎ মোবাইল বেজে উঠলো। দেখে মুক্তির কল। সুপ্তি রিসিভ করে বলল,

বাসায় আসছিস?

অনেক আগেই আসছি। রিয়ার আম্মু বলল তুই আর মা চাচার বাসায় গেছিস তাই ফোন করিনি। এখন দেরি দেখে কল দিলাম।

এখনি চলে আসবো। রাখছি।

মিসেস করিম ভাসুরের সিদ্ধান্তের উপর আস্থা রেখেই বললেন,

ভালো কথা বলেছেন। ভাইজান, টাকাটা আমার খুব প্রয়োজন। আপনি জমিটা রেখে টাকা দিয়ে দিলে খুবই ভালো হয়।

আশিকের মা এবার স্বামীর দিকে তেড়ে গেল। মুখের সামনে আঙুল উঁচিয়ে বললো,

এত মাতাব্বরি করতে তোমারে কে বলছে শুনি? তোমার বাপ,মা জমির দিক দিয়া তোমারে ঠকাইছে তুমি জানো না? তুমি ভুল হিসাব করতাছো। ঐ জমিতে সুপ্তিদের আর কোনো অংশ নাই। এটা নিয়া আর কোনো কথা বলবা না।

মিসেস করিমের দিকে তাকিয়ে বলল,

রেবেকা, যা বলছি কান খুইল্লা শুইনা রাইখো। আর কোনোদিন পালানের জমির ভাগ নিয়ে এ বাড়িতে আসবা না।
--------------------------
[Only admins are allowed to see this link]্ব-( ১৩)

আশিকের মা, এই সব কি বলছো? যা বুঝো না তা নিয়ে কথা বলবা না। জমির হিসাব আমার চেয়ে তুমি ভালো বুঝো তাই না? আফসারের এক হাত জমিও আমার অংশে থাকবে না। দুই শতাংশ জমিতে আফসারের দুই মেয়ের হক আছে।
আশিকের মা রাগে বিড়বিড় করতে করতে ঘর থেকে বের হয়ে উঠোনের দিকে গেল।

মিসেস করিম চুপ থেকে ভাসুরকে বললেন, ভাইজান
জমির কাস্টমার আপনিও দেখেন আমিও খোঁজে থাকি।যদি কেউ কিনতে রাজি হয় খুবই ভালো। যে দামে পাঁচ শতাংশ বিক্রি করেছিলেন। একই দামে দুই শতাংশ বিক্রি করে দিয়েন। জমির দাম বাড়লেও আগের রেটে টাকা দিলেই হবে। টাকাটা খুবই প্রয়োজন। অল্প জমি কেউ কিনতে রাজি না হলে আপনিই রেখে দেন। এই সময়ে টাকার সমস্যা হলে এক,দেড় মাস পরে দিলেও হবে। তখন টাকা দিয়ে জমি রেজিস্ট্রি করে নিয়েন।

দেখি কি করা যায়। বলেই ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন
আশিকের বাবা।

আশিকের বোন সালমা ছোট বাচ্চাটাকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে নিজের চোখ দুটো লেগে যায়। হঠাৎ চেতন পেয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো।

চাচি,কতদিন পর আপনাদের দেখলাম। আজ থাকেন আমাদের বাড়িতে। মুক্তি 'বু' কেমন আছে চাচি? সুপ্তি
তুই অনেক শুকাইছিস।

সুপ্তি হেসে বলল, আমি আবার মোটা ছিলাম কবে সালমা আপা? আমি তো বরাবর এমনই। তবে এখন
লেখাপড়ার চাপে শুকনো লাগছে। তোমার মুক্তি বু'র
নতুন চাকরি হইছে। সে এখন খুব ভালো আছে। একটা বিয়ে হলেই মোটামুটি মায়ের মাথা থেকে চিন্তাটা নেমে যেত। সালমা আপা,তুমি কতদিনের নাইওরে বাপের বাড়ি আসছো? কালকে সকালে বাবু দুইটাকে নিয়ে আমাদের বাসায় চলে আসো। সেই যে কবে গেলে আর গেলে না। মাঝে মাঝে আসো। চাচা,চাচিকে দেখে দৌড় দাও শ্বশুর বাড়ি।

সালমা ম্লান হাসি দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,বিয়ে হলে বুঝবি কত দায়িত্ব কাঁধে এসে যায়। গাধার মতো সারাদিন খাটলেও নাম নেই। কেন যে লেখাপড়া করলাম না। লেখাপড়া ছাড়া জীবনে কোনো দাম নেই।
এখন সবই বুঝি। বুঝলেও আগের জীবন তো ফিরে পাবো না। জানিস সুপ্তি, খুব আফসোস হয়।

আফসোস করে লাভ নেই সালমা আপা। যা হবার হয়ে গেছে। যা পেয়েছো,যেমন আছো তাই নিয়ে ভালো থাকার চেষ্টা করো। চলে যাচ্ছি সালমা আপা। সময় পেলে একবার বাসায় এসো।

সুপ্তি মায়ের হাত ধরে বলল,চলো মা,এবার বের হই।

জায়ের কথাগুলো শুনে মিসেস করিমের মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। মহিলাটা কখনো পাল্টাবে না। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় মলিনমুখে শুধু বলল,

সালমা,শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার আগে আমাদের বাসা হয়ে
যেও। আজই না হয় আমাদের সাথে চলো। কালকে চলে এসো।

আজ না চাচি। অন্য একদিন যাবো।

সুপ্তি মা'কে নিয়ে রিকশায় বসলো। সন্ধ্যা প্রায় হয়ে আসছে। কিছু সময় বাদেই মাগরিবের আযান দিবে। ফুরফুরে মোলায়েম হাওয়া বারবার দোলা দিয়ে যাচ্ছে। সুপ্তির ভীষণ ভালো লাগছে। আর কিছু সময় রিকশা নিয়ে সন্ধ্যার আঁধারে মিলমিলে হাওয়ায় ঘুরে বেড়ালে মন্দ হতো না। মা'কে বললে গালে চড় বসিয়ে দিবে। কারণ চাচির কথা শুনে মায়ের মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। মিসেস করিম চুপচাপ ভেবে যাচ্ছে। খানিক সময় বাদে সুপ্তিকে বলল,
দেখছিস? তোর চাচি কেমন নাটক করলো। রাগে আমার শরীরের সব রক্ত মাথায় উঠে গেছে। এই মহিলা কি করে এতগুলো ডাহা মিছে কথা জোর গলায় বলে গেলো চিন্তা করে পাই না। তোর চাচি জীবনেও পাল্টাবে না। বিয়ের পর থেকে শুনে আসছি শ্বশুর, শাশুড়ি তার জামাইকে ঠকিয়েছে। অথচ তোর দাদা তাঁর সব ছেলেকে জমিজমা সমানভাবে ভাগ করে দিয়ে গেছেন। আসলে কি জানিস? এই মহিলা অন্যের ভালো দেখতে পারে না। অন্যের সুখ দেখে চোখ টাটানোই তার স্বভাব। গায়ে পড়ে অযথাই ঝগড়া করবে। নিজের স্বার্থটা ষোল আনা বুঝে। পরেরটাও নিজের করে নিতে জীবন দিয়ে দিবে।

মা,তুমি পাল্টা কিছু বললে না কেন? তখন তোমার উপর খুব রাগ হচ্ছিল।

তোর দাদি থাকতে আগেও চুপ থেকেছি। আমার হয়ে তোর দাদি কথা বলতেন। মা শুধু বলতেন,তুমি শিক্ষিত মেয়ে। সে যা বলতে পারে তুমি তা পারবা না। ওর সাথে গলাবাজি করে তোমার সম্মান নষ্ট করবা না কোনোদিন। তারপর থেকে তাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। প্রয়োজনের তাগিদে যতটুকু কথা বলা প্রয়োজন বলি। তার অনেক কথাই শুধু শুনে যাই।

বাসায় ফিরে সুপ্তি চা বানিয়ে মায়ের ঘরে দিয়ে নিজের মগ নিয়ে পড়ার টেবিলে বসলো। মিসেস করিম নামাজ,কোরআন শেষ করে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে দেখেন চা ঠাণ্ডা হয়ে শরবত হয়ে গেছে। আবার চা গরম করে খেয়ে মেয়ের ঘরে গেলেন। দেখেন মুক্তি কোল বালিশ জড়িয়ে আরামে ঘুমুচ্ছে।

মুক্তি আবার ঘুমিয়ে পড়লো? ঘুম তো আসবেই। কতটা পথ জার্নি করে যেতে হয়। এভাবে জার্নি করলে শরীর ঠিক থাকবে?

মা,বুবুর জন্য শহরে বাসা ভাড়া করা দরকার। এক সপ্তাহ পর পর বাসায় এসে দু'দিন আমাদের সাথে থেকে চলে যাবে।

তোর পরীক্ষা শেষ হোক। দু'বোন একসাথেই শহরে থাকা শুরু করবি। তুই ভর্তি পরীক্ষার কোচিং করবি।
তোর বুবু কলেজ করবে। আমি মাঝে মাঝে তোদের এখানে চলে যাবো।

মুক্তি নড়েচড়ে ঐপাশ থেকে এপাশে ফিরলো। মিসেস
করিম খাটে বসে মুক্তির মাথায় হাত রাখলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে আস্তে করে ডাকলেন,

মুক্তি সজাগ আছিস? উঠ মা। এখন এত ঘুমালে রাতে ঘুম আসবে না। এখন আর ঘুমাস না! রাতের খাবার খেয়ে একটু আগেই ঘুমিয়ে পড়িস।

মুক্তি চোখ মেলে তাকালো।

সজাগই আছি। কিছু বলার থাকলে বলো। চাচার সাথে জমি নিয়ে কি কথা হলো?

জমি বিক্রির কথা বললে আশিকের মা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো। মনে হলো তার বাপের বাড়ির জমি বিক্রি করতে গেছি। তোর চাচির কথা এখন আর ধরি না।
তোর চাচা আশ্বাস দিলেন বিক্রি করে দিবেন।

চাচার উপর ভরসা করা যায়। উনি কখনো আমাদের ঠকাবেন না। জানো মা,আজ কলেজ থেকে ফেরার পথে কি হয়েছে?

মিসেস করিম কিছুটা ভয় নিয়ে বললেন,

কি হয়েছে? তাড়াতাড়ি বল। তুই যাওয়ার পর থেকে বাসায় ফেরা না পর্যন্ত কতটা অস্থির থাকি জানিস না।

তেমন কিছু না। সব কথা তোমাদের কাছে শেয়ার করে এমন হয়েছে যে কোনো কথাই পেটে জমিয়ে রাখতে পারি না। বলতেই হয়। তোমাকে বলেছিলাম না ভাইভা পরীক্ষা শেষ করে রুম থেকে বের হওয়ার সময় একজন সদস্য আমার পরিচয় বলে রিয়ার আব্বুকে চিনি কিনা জানতে চেয়েছিলেন। ঐ ভদ্রলোকের সাথে আবার দেখা। ক্লাসশেষে কলেজ প্রাঙ্গণ ছেড়ে গেইটে আসি তখন ওনার মুখোমুখি। হেসে নিজ থেকেই বললেন,
মুনতাহা করিম কেমন আছেন? চাকরি কেমন চলছে?
কোনো সমস্যা নেই তো? হঠাৎ ওনার মুখে এইসব শুনে আম তো অবাক। সালাম দিয়ে ভদ্রভাবে ওনার প্রশ্নের উত্তর দিলাম। ওনি হাস্য উজ্জ্বল ভঙ্গিতে দ্রুত ভেতরে চলে গেলেন। ওনি যাওয়ার পর গেইট দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলাম এই ভদ্রলোককে চিনে কিনা। পিয়ন জানালো ওনি শহরের বিশিষ্ট সমাজসেবক,ব্যবসায়ী
এবং কলেজ পরিচালনা পর্ষদের একজন দাতা সদস্য। পরিচয় জেনে আবারও চমকে গেলাম। ভাইভা পরীক্ষার দিন কিছুটা আন্দাজ করতে পারি হয়তো ম্যানেজিং কমিটির কোনো সদস্য হবেন। লোকটার ব্যবহার এত অমায়িক। চেহারা দেখলেই বুঝা যায় বেশ ভদ্রলোক।
মা,আমার মনে হয় ওনার সাথে রিয়ার আব্বুর একটা
ভালো সম্পর্ক আছে। আমার চাকরিটা হওয়ার ব্যাপারে রিয়ার আব্বু হয়তো সুপারিশ করেছেন। ওনি আমাকে মনে রেখেছেন এইজন্য এই চিন্তাটা মাথায় আসছে।

তুই তো রিয়ার আব্বুর ব্যাপারে কত খারাপ কথা বললি। আমার কিন্তু রিয়ার আব্বুকে বেশ সামাজিক,
ভদ্রলোকই মনে হয়। না জেনে কাউকে নিয়ে আজেবাজে চিন্তা করা মোটেও ঠিক না। রিয়ার আম্মুও বেশ আন্তরিক। পরিবারটিকে খুবই পছন্দ করি।

মায়ের কথা শুনে দুই বোন চোখাচোখি করে মুচকি হাসলো। মুক্তি বলল,

তোমার কথাই ঠিক মা। আমি বুঝতে ভুল করেছি। মানুষের ভালোটাই আশা করি।

সুপ্তিকে পড়তে দে। তুই উঠে ওযু করে এশার নামাজ পড়ে নে। আমি রান্নাঘরে যাই। সকালের জন্য কিছু একটা রেডি করে রাতের খাবার গরম করি গিয়ে।

রাতের খাবার খেয়ে মুক্তি লাইট অফ করে শুয়ে পড়লো। আলো জ্বললে ঘুম আসতে দেরি হয়। কিছুতেই ঘুম আসে না। সুপ্তি ছোট্ট টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে পড়তে বসলো। কিছু সময় পড়ার পর রশিদ সাহেবের দেওয়া বার্থডে আংটির কথা মনে হতেই চুপ করে আংটি বের করে আবার আস্তে করে টেবিলে বসলো। কিছু সময় মুক্তিকে নজর রাখলো ঘুমিয়েছে কিনা। দেখে মুক্তি ঘুমিয়ে আছে। আংটি বের করে বামহাতের আঙুলে পরে নিল। পড়া বাদ দিয়ে আংটিটার দিকে তাকিয়ে দিকে আছে। জীবনে প্রথম যার প্রতি দুর্বল হয়েছি, পছন্দ করেছি সে একজন বিবাহিত পুরুষ। এমন হলো কেন?
এটা কি আমার বয়সের দোষ? নাকি সত্যিকারের ভালোবাসা? সবার জীবনে প্রেম,ভালোবাসা বলে,কয়ে
সময় বেঁধে আসে না। আমার জীবনে তাই ঘটেছে। আমি যে মনের সাথে অনবরত যুদ্ধ করে যাচ্ছি। বুবুকে,মা'কে কথা দিয়েছি ঠিকমতো লেখাপড়া করবো। তারা যেমন চায় সেভাবেই চলবো। তাদের মনের আশা পূরণ করবো। বুবুর সাথে প্রমিজ করেছি রিয়ার আব্বুকে ভুলে যাবো। সত্যিই কি ভুলতে পেরেছি? জীবনে প্রথম যাকে ভালো লাগে তাকে সহজেই ভুলে থাকা যায়?

হঠাৎ মুক্তি শোয়া থেকে উঠে বসলো। সুপ্তি তাড়াহুড়ো করে বামহাত টেবিলের নীচে রাখলো।

বামহাতের আঙ্গুল থেকে আংটিটা খুলে দে! এতরাতে পড়া বাদ দিয়ে আংটি নিয়ে কি ভাবছিস? দশদিন আছে পরীক্ষার। এখনও ঘোরের মধ্যে আছিস? তোর এত সুন্দর জীবন রিয়ার আব্বুর জন্য নষ্ট করিস না। জেনেবুঝে আগুনে ঝাঁপ দিস না সুপ্তি। তোর সুন্দর ভবিষ্যত আছে। তুই কেন ঐ লোককে পছন্দ করবি? একটু বুঝিয়ে বল তো।
সুপ্তি চুপ থেকে কথা শুনে যাচ্ছে। মুক্তি আবার বলল,

আংটিটা দে বলছি। ঐটা তোর কাছে থাকলে একটু সময়ের জন্য হলেও লোকটাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করবি। সামনে জন্মদিনে তোকে এমন আংটি আমি কিনে দিব।
সুপ্তি নিঃশব্দে আংটি খুলে মুক্তির হাতে দিল। আংটি রেখে মুক্তি বলল,

এখন লক্ষী মেয়ের মতো পড়ায় মন দে। মনে রাখিস, যা কিছু বলবো,যা কিছু করবো সব তোর ভালোর জন্য।
তোর জীবনে অনেক ভালো কিছু অপেক্ষা করছে।
দেখিস একদিন তুই বলবি বুবু তোর জন্যই আমার সব কিছু ভালো হয়েছে।

দশদিন পর থেকে মুক্তির এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হলো। প্রথম দুই পরীক্ষাতে মিসেস করিম স্কুল থেকে ছুটি নিয়েছেন। মেয়েকে নিয়ে পরীক্ষা কেন্দ্রে আসা যাওয়া করছেন। পরের পরীক্ষাগুলো আশিকের সাথে পাঠিয়েছেন। মুক্তি পরীক্ষা ডিউটি করে কলেজ থেকে
বের হলো। আজ যেহেতু হাতে সময় আছে ফুটপাথ ধরে হেঁটে স্টেশনে যাবে। আস্তে আস্তে হাঁটছে। পিছন থেকে 'মুক্তি শুনন' ডাক শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে কলিগ শিহাব
পিছনে। কাছে এসে হাসতে হাসতে বলল,

আজ বাড়ি যাওয়ার খুব তাড়া আছে ? একটু সময় চাইতে পারি?
মুক্তি দাঁড়িয়ে মুচকি হাসলো। তারপর শান্ত গলায় বলল,

বাড়ি যাওয়ার তাড়া নেই। আস্তে আস্তেই যাচ্ছি। তবে বাড়িতেই তো ফিরতে হবে। অযথা দেরি করে লাভ কি বলুন?

তা অবশ্য ঠিক। আমরা আসলে কেউ করো সাথে তেমন পরিচিত না। কলিগ হিসাবে শুধু জানি দুজনেই এই কলেজে চাকরি করি। আপনি দুইমাস আগে জয়েন করেছেন। আপনার সাবজেক্ট বোটানি। আর আমি একবছর আগে গণিতের প্রভাষক হিসাবে জয়েন করেছি । এতটুকুই শুধু জানি। ফ্যামিলিতে কে কে আছেন। কে কোথায় জব করেন কিছুই জানা হয়নি।
আপনিও ছুটির পর দ্রুত বাস ধরার জন্য ছুটেন। ইচ্ছে থাকলেও আপনার তাড়াহুড়ো দেখে আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করিনি। আজ একটু সময় দিলে নিজেকে ধন্য মনে করবো।

এভাবে বলছেন কেন? এখানে দাঁড়িয়ে কথা হবে ?

রাজি হয়েছেন। অসংখ্য ধন্যবাদ। চলুন সামনে এগিয়ে যাই। পাশেই সুন্দর একটা পার্ক আছে। যেতে দশমিনিট
লাগবে। হেঁটেই যাওয়া যাবে।

শিহাবের পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছে মুক্তি।

----------চলবে

Umma Mejana khatun, Arbaj khan, Hikmatullah khan, Sahin kondokar, Md amanul, Akaram khan, Md salim bapari and লেখাটি পছন্দ করেছে

avatar
Shamim
ধুমকেতু
ধুমকেতু
Posts : 23
স্বর্ণমুদ্রা : 1110
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-06-01

মাতৃত্বের স্বাদ - Page 2 Empty Re: মাতৃত্বের স্বাদ

Wed Jul 28, 2021 6:15 pm
মাতৃত্বের-স্বাদ (১৪)

পার্কের প্রবেশ পথের কাছেই একটা বড় গাছের নীচে ছায়াযুক্ত স্থানে ওরা দু'জন বসলো। মুক্তি কিছুটা দূরত্ব
রেখেই বসেছে। সাইট ব্যাগ কোলের উপর রেখে হাতঘড়িটার দিকে তাকালো। দুপুর দুটো বেজে পনেরো মিনিট। গাছের উপর একটা কাক কা-কা করে যাচ্ছে। মুক্তি তাকিয়ে দেখলো তার মাথার উপর কিনা। কাকটিকে দেখতে পেলো না। ডাক শুনতে পাচ্ছে। ভিতরে টেনশন হচ্ছে। গায়ের উপর কিছু ফেললে শিহাবের সামনে লজ্জায় পড়ে যাবো। শিহাব মোবাইলে একটা নাম্বার খোঁজ করতে করতে বলল,
-এত কি ভাবছেন ম্যাডাম?
-কিছু না।
-আসলে সময়টা বাজে। এখন লাঞ্চ আওয়ার। ডিউটি শেষ করে আসছি। দু'জনেই ক্লান্ত এবং ক্ষুধার্ত। কোনো রেস্তরাঁয় বসা উচিত ছিল তাই না? চলুন লাঞ্চ করি একসাথে।
-পার্কে যেহেতু চলেই আসছি এখন আর রেস্টুরেন্টে ঢুকবো না। অন্যদিন খাওয়া যাবে। কি উদ্দেশ্যে নিয়ে এখানে আসছি। বরং তা নিয়ে কথা বলি। বেশি সময় এখানে থাকা যাবে না। দূরের পথ জ্যাম থাকলে বাসায়
ফিরতে দেরি হবে।
-তাহলে কথা দিন। একদিন একসাথে দু'জন লাঞ্চ করবো।
মুক্তি হেসে বলল,
- স্যার,আচ্ছা পাগল মানুষ তো আপনি! এটা কথা দেওয়ার কি আছে? প্রতিদিনই কলেজে দেখা হচ্ছে। ক্লাস শেষ করে একদিন চলে আসলেই হলো।

মুক্তির কথা শুনে শিহাব হাসলো। মুক্তি ডানে তাকিয়ে দেখে দূরে ঝালমুড়িওয়ালা। হাত দিয়ে ইশারায় লোকটাকে ডাকলো। লোকটা কাছে আসতেই মুক্তি বলল,
-মুড়ি ছাড়া শুধু চিকন মচমচে চানাচুর বেশি করে পেঁয়াজ,কাঁচামরিচ,ধনেপাতা কুঁচি দিয়ে মেখে দেন। আর একটাতে ঝাল একটু কম দিয়েন।
স্যার,আপনি ঝাল কেমন খান? আপনারটায় ঝাল কি বেশি দিবে?
শিহাব মোবাইল রেখে বলল,
-ম্যাম,কথা ছিল আমি আগে আপনাকে খাওয়াবো।

-না তো করিনি স্যার! সামনে পেলাম তাই ঝালমুড়ির লোভ সামলাতে পারলাম না। খু-উ-ব পছন্দ করি ঝালমুড়ি। এখন তাড়াতাড়ি বলুন কাঁচামরিচ বেশি দিবে? সাথে মুড়ি,ঘুগনি দিবে কিনা।

মুক্তির সাবলীল ব্যবহার দেখে শিহাবের খুব ভালো লাগে। মুখের দিকে তাকিয়ে প্রাণখোলা হাসি দিয়ে বলল,
-মুড়ি লাগবে না। মুড়ি খেলে গ্যাস হয়। চানাচুরই ঠিক আছে তবে ঝাল কম দিয়ে পেঁয়াজ কুঁচি একটু বেশি দিয়েন ভাই।

লোকটাও হেসে হেসে দু'জনের পছন্দের চানাচুর মাখা ঠোঙায় দিয়ে প্রথমে মুক্তির দিকে এগিয়ে দিল। তারপর শিহাবকে দিল। মুক্তি পঞ্চাশ টাকা দিয়ে ঝালমুড়িওয়ালাকে বিদায় করলো। মুক্তি টপাটপ সমানে খাচ্ছে। বেশি ঝাল হওয়াতে ব্যাগ থেকে পানি বের করে দুই ঢুক গিলে নিল। শিহাব মুক্তির খাওয়া দেখছে। নিজেও আস্তে আস্তে খাচ্ছে। মুক্তি বলল,
-কি যে মজা চানাচুর মাখা! বলে বুঝানো যাবে না। সারাদিন দিলে সারাদিনই খেতে পারবো। ছোট বোন সুপ্তির তো অনেক পছন্দ ঝালঝাল চানাচুর মাখা আর আইসক্রিম।
- ছোটবোন কোথায় লেখাপড়া করে? মা,বাবা বেঁচে আছেন?
-ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিচ্ছে। আজ কেমন পরীক্ষা দিল জানি না। ফোন করার সময়ও পাইনি। বাবা নেই।
স্ট্রোক করে বিছানায় পড়া ছিলেন চারবছরের মতো।
তারপর কোলন ক্যান্সার ধরা পড়লো। ক্যান্সার ধরা পড়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মারা গেলেন। বাবা অনেক কষ্ট ভোগ করে মারা গেছেন। মা আছেন। প্রাইমারি স্কুল টিচার। কলেজে চাকরি হওয়ার আগে
একটা স্কুলে জব করতাম। মূলত মা'কে সাহায্য করার জন্য,সংসার খরচের কিছু দায়িত্ব নেওয়ার জন্যই স্কুলের চাকরিটা করেছি। কলেজে জয়েন করার কয়েকমাস আগে ছেড়ে দেই। মা,ছোট বোনকে নিয়ে ছোট্ট সুখের সংসার। এত টাকা,পয়সা নেই কিন্তু মাকে নিয়ে আল্লাহর রহমতে খুব ভালো আছি। চাচারা থাকেন
আলাদা বাড়িতে। যার যার সংসার নিয়ে ওনারা ভালোই আছেন। শুধুমাত্র আমার বাবাটাই আমাদের রেখে অসময়ে চলে গেলেন। খুব আফসোস হয়। বাবার জন্য তেমন কিছু করতে পারিনি। বাবাকে সুস্থ করে তুলতে পারিনি। বাবাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারিনি।

মুক্তি কথাগুলো বলে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রাখে। বাবার প্রসঙ্গ আসলেই মনটা খারাপ হয়ে যায়। শিহাব খাওয়া শেষ করে মুক্তির কাছে পানি চাইলো। মুক্তি পানির বোতল এগিয়ে দিলে পানি খেয়ে বোতল ফেরত
দিয়ে বলল,
-বাবার কথা বলে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেছে তাই না? আপনার মুখ দেখেই বুঝতে পারছি। সবার বাবা কি চিরকাল বেঁচে থাকে? আগে পরে সবার মা,বাবাই সন্তানদের এতিম করে ওপারে চলে যান। মৃত্যুর উপর কারো হাত নেই ম্যাডাম। আপনার তো তবুও মা বেঁচে আছেন। দিনশেষে মায়ের শান্তির আঁচলে মুখটি লুকিয়ে শান্তির নিঃশ্বাস নিতে পারেন। আল্লাহর কাছে শতকোটি শুকরিয়া আদায় করবেন সব সময়। আমার তো মা,বাবা কেউ বেঁচে নেই। এতিম,একা মানুষ আমি। শূন্যতা আমার পিছু ছাড়ে না। নিঃসঙ্গতা কাটাতে সব সময় ব্যস্ত থাকি। কলেজ সময় বাদ দিয়ে স্টুডেন্ট পড়াই। বাসার পাশেই একটা কোচিং সেন্টারে ক্লাস নেই।
দিনের সময়টুকু কাজের মাঝে নিজেকে ডুবিয়ে বেশ ভালোই কাটছে। রাত আসলেই ভীষণ বিরক্ত লাগে। একা মানুষের জন্য ভালো কিছু রান্না করে খেতে ইচ্ছে করে না। সময় মতো ঘুমও আসে না।
শিহাব আর কোনো কথা না বলে চুপ করে থাকে।
মুক্তি মনোযোগ দিয়ে শিহাবের কথা শুনছিল। হঠাৎ থেমে যাওয়াতে জিজ্ঞেস করলো,

-কি হলো? থামলেন কেন? মা,বাবা কীভাবে মারা গেলেন? শুনতে চাই বলেন। বাসায় কে কে থাকেন?
- মা মারা যাওয়ার পর থেকে একাই থাকি। মা কতবার বলেছেন চাকরি হয়েছে। এবার বিয়ে করে বউ ঘরে আন। তোর বউ দেখে যেন মরতে পারি। বউ দেখার ভাগ্য মা'র হলো না। আটমাস আগে পরপারে পাড়ি জমান। বাবা মারা যান আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়ি তখন। তারপর থেকে সংসারের হাল ধরি। বাবা ব্যাংকে কিছু টাকা এফডিআর করে রেখেছিলেন। ঐ টাকার লাভের অংশ আর আমার টিউশনির টাকা দিয়ে মা সংসারের খরচ চালাতেন। মা গৃহিনী ছিলেন। এই শহরে মাথা গোঁজার ঠাঁই ছোট্ট এক চিলতে বাড়ি বাবা বেঁচে থাকতেই বানিয়েছিলেন। ঐ বাড়িতে মা,ছোটবোনকে নিয়ে থাকতাম। হিসেবের নির্দিষ্ট টাকায় খুব কষ্ট করে চলতে হতো আমাদের। বোনটা ছাত্রী হিসাবে আমার চেয়ে খুব ভালো ছিল। মাস্টার্স করার সাথে সাথে ব্যাংকে জব হয়ে যায়। বাবার ছোটবেলার বন্ধুর ছেলের সাথে বিয়ে হলো। বোনজামাইও ব্যাংকার। বোনের দুই বছরের মেয়ে আছে। দুই ভাইবোন কাছাকাছি বাসাতেই থাকি। বোনটা কাছেই ভাড়া বাসায় থাকে। একমাত্র ছোটবোনই তার ভাইয়ের জন্য কাঁদে। সুযোগ পেলেই ভালো কিছু রান্নাবান্না করে বক্স ভরে পাঠিয়ে দিবে। বন্ধ পেলে মাঝে মাঝে ওর বাসার কাজের মেয়েটাকে নিয়ে চলে আসে। মেয়েকে দিয়ে সব ময়লা কাপড়,বিছানার চাদর ধুয়ে ঘরদোর পরিস্কার করে ঝকঝকে করে তারপর যাবে। রান্না করে বক্সভরে উপরে নাম লিখে চলে যাওয়ার সময় বলবে,দাদাভাই একটা খাবারও নষ্ট করিস না। মনে করে খেয়ে আবার ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখিস। যা রেঁধেছি তোর এক সপ্তাহ চলে যাবে। তুই শুধু কষ্ট করে ভাতটা রেঁধে তরকারি গরম করে খেয়ে নিস। বোনরা মনে হয় ভাইদের জন্য বেশিই মায়া করে। ভাইরা
ততটা বোনদের ফিডব্যাক দিতে জানে না। আমার বোন না থাকলে বিষয়টি বুঝতাম না।
মুক্তি স্মিত হেসে হাতঘড়ি দেখতে দেখতে বলল,
-আমার ভাই নেই তাই ফিলিংস বলতে পারবো না। ছোটবোনটাকে খুব স্নেহ করি,ভালোবাসি। তবে চাচাতো
ভাই আছে তিনজন। ওদেরকে নিজের ভাইয়ের মতোই মনে হয়। আদর করি,শাসন করি। ওরাও আমাকে খুব মানে,শ্রদ্ধা করে। আমাকে 'বু' বলে ডাকে। স্যার,কিছু মনে করবেন না। অনেক বেজে গেছে। আজ উঠতে হচ্ছে।
-সরি,ম্যাডাম। আপনার অনেক সময় নষ্ট করে দিলাম।
এক মিনিট পর আমরা চলে যাচ্ছি। প্লিজ,আপনার নাম্বারটা একটু বলুন।
মুক্তি উঠতে উঠতে নিজের সেল নাম্বার বলে দিল। শিহাব সাথে সাথেই মুক্তির নাম্বারে কল দিয়ে বলল,
-রিং হচ্ছে। ওটা আমার মোবাইল নাম্বার। সেইভ করে রাখবেন।

দু'জনেই চুপচাপ পাশাপাশি হাঁটছে। শিহাব মুক্তির দিকে
ফিরে বলল,
-কিছু কথা বলার ছিল।
-আরো কথা?
-হুমম,আসল কথাই জানানো হয়নি।
-অন্যদিন বললে হয় না? ফোন করেও তো বলা যাবে।
- তা বলা যেত। আজ এখানে আসছি নিজের সব কথা জানাতে এবং জানতে। আমার সম্পর্কে যা যা বলেছি সবই সত্যি। আসলে প্রেম করে পার্কে ঘুরে ডেটিং করার বয়স আমাদের এখন আর নেই। দু'জনেরই বিয়ের যথেষ্ট বয়স হয়েছে। ছোটবোন বিয়ের জন্য পাগল বানায়ে ফেলল। ওকে আশ্বস্ত করেছি ছয়মাসের মধ্যে বিয়ে করবো। মুক্তি, আমি এমন কাউকে মনে মনে চাইছি যার জীবনের সাথে আমার জীবনের অনেককিছু মিল থাকবে। যে জীবনে কষ্ট দেখেনি,সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে শিখেনি। সে অন্যের দুঃখ,কষ্ট বুঝবে না। নিজে
অভাবে পড়লে অন্যের অভাব ঠিক বুঝতে পারে। সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম নেওয়া সন্তানদের সাথে
মধ্যবিত্ত ঘরের খেঁটে খাওয়া ছেলে-মেয়েদের মন মানসিকতায় রাতদিন তফাত। ধনি-গরিবে সংসার হলে সে সংসারে সুখ,শান্তি আসে না। অনেকসময় সংসার টিকেও না। মুক্তি, আমাকে আপনার কেমন লেগেছে জানি না। যদিও আমাকে বুঝতে ততটা সময় দেইনি। সরাসরি বলি, যদি আমাকে পছন্দ হয়ে থাকে। বিয়ে করতে আপত্তি না থাকে বাকি জীবনটা কি সুখে,দুখে আমরা একসাথে কাটাতে পারি না? বিয়ে করে সংসার শুরু করতে পারি না?
মুক্তি মাথা নীচু করে সব কথা শুনে যাচ্ছে।হাঁটতে হাঁটতে মেইন রাস্তায় চলে আসলো। স্টেশনে যাওয়ার জন্য রিকশাওয়ালাকে ডাকলো। শিহাব মুক্তির মুখ থেকে কিছু শোনার জন্য অপেক্ষা করছে। শিহাবের দিকে দৃষ্টি দিয়ে বলল,

-দুটো দিন সময় চেয়ে নিচ্ছি। আমার কোনো বিষয়ই মায়ের অজানা নয়। মায়ের কাছে সবকিছু শেয়ার করি। মা,ছোটবোনটা বন্ধুর মতো।
-জেনে আমি ভীষণ আপ্লুত! অপেক্ষায় রইলাম। স্টেশন পর্যন্ত সাথে যাই?
- অসংখ্য ধন্যবাদ। অযথা কষ্ট করে স্টেশন পর্যন্ত যাওয়ার প্রয়োজন নেই।
দু'জনে হাসিমুখে বিদায় নিল। মুক্তি রিকশা নিয়ে ছুটলো স্টেশনের দিকে। মুক্তি শিহাবের কথাগুলো নিয়ে ভাবতে
ভাবতে বাসায় পৌঁছালো। ক্ষুধায় পেটে যন্ত্রণা হচ্ছে।মিসেস করিম মেয়েকে দেখে খাবার গরম করতে গেলেন কিচেনে। তরকারি,ডাল গরম করে টেবিলে দিলেন। মুক্তি ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং এ আসতেই জিজ্ঞেস করলেন,
-আজ না শুধু ডিউটি ছিল? এত দেরি হলো কেন? রাস্তায় জ্যাম ছিল?

মুক্তি উত্তর না দিয়ে খেয়ে যাচ্ছে। মা,মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়েই আছে। প্লেটে তরকারি তুলে দিচ্ছে,ভাত দিচ্ছে। মুক্তি এক গ্লাস পানি গিলে দম ছেড়ে বলল,
-আর দিও না। সব খেতে পারবো না। খাওয়া শেষ করি।তারপর এক এক করে সব কথা বলছি। তোমাকে বলিনি এমন কিছু নেই। সবই তোমাদের কাছে শেয়ার করি।
-খারাপ কিছু হয়নি তো?
-তুমি না আমাদের নিয়ে অযথা চিন্তা করো মা!
-মা হলে বুঝবি চিন্তাটা কেন হয়? একটা বাচ্চা যখন কাঁদে কেউ না বুঝলেও মায়ের কানে সে কান্না পৌঁছবেই। মা বুঝতে পারে সে কান্নার কারণ।
- খুব বুঝতে পারি। তুমি এখন দয়া করে রেস্ট নিতে যাও। আমি টেবিল গুছিয়ে আসছি। সুপ্তি আজ পরীক্ষা কেমন দিল?
-বলল তো পরীক্ষা ভালো দিয়েছে। এসেই খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি বিছানায় গেলাম। দেখি চোখের পাতা এক হয় কিনা।

রাত দশটার দিকে শিহাব মুক্তিকে ফোন দিল। নাম্বার দেখে বুঝতে পারে এটা শিহাব ছাড়া অন্য কারোর নাম্বার না। তিনবার রিং হতেই মুক্তি রিসিভ করলো।
অপরপ্রান্ত থেকে কথা আসলো,
-ঠিকঠাক মতো পৌঁছেছেন?
-জ্বি হ্যাঁ
-অনেক আগেই ফোন দিতে ইচ্ছে করছিল। এমনিতে আপনি ক্লান্ত হয়ে ফিরেছেন। ফ্রেশ হয়ে খাওয়া শেষ করে হয়তো ঘুমাচ্ছেন। তাই বিরক্ত করিনি। তাহলে কালকে দেখা হচ্ছে। ভালো থাকুন। রাখছি।
-জ্বি, আপনিও ভালো থাকুন।

রাতে খেতে বসে মুক্তি শিহাবের ব্যাপারে সবকিছু মা,বোনের কাছে খুলে বলে। সুপ্তি খবরটা শুনে খুশিতে এক চিৎকার দিয়ে বোনকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-আমার তো খুবই পছন্দ হয়েছে। বুবু তোর কাছাকাছি বিয়েটা হোক। তোর শ্বশুরবাড়ি যেতে বড়জোর দেড় থেকে দুই ঘন্টা সময় লাগবে। আমি তো প্রায় সময় তোকে দেখে আসতে পারবো। শিহাব ভাইয়ের সাথে আমাদের পরিবারের অনেক কিছুতেই মিল। তোর সাথে ভালোই এডজাস্ট হবে। যেহেতু একই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছিস। উহ্ আমার যে কি ভালো লাগছে বুবু! তোকে বুঝাতে পারবো না। তোর বিয়ে হবে,বাচ্চা হবে। সেই বাচ্চাকে আমিই পালবো। আমাদের এখানে থাকবে। মা,আর আমিই যত্ন করে বড় করে তুলবো। তুই শহরে থেকে আরামে চাকরি করবি।
মিসেস করিম সুপ্তিকে ধমক দিয়ে বললেন,
- এবার থাম দেখি! সেই থেকে কথা শুরু করেছে আর থামার নাম নেই। মেয়েটা বেশি পেকে গেছে! তোর না কালকে পরীক্ষা আছে। যা গিয়ে পড়তে বোস।

সুপ্তি খাওয়া শেষ করে তার রুমে চলে গেল। সবই তো শুনলাম। ছেলেটার চরিত্র কেমন হবে?কেমন মনের মানুষ হবে? কিছুই জানি না। বাইরে থেকে একজন মানুষকে পুরোপুরি জানা সম্ভবও না। মায়ের মুখে একথা শুনে মুক্তি বলল,মা একসাথে অনেক বছর থেকেও অনেক হাজব্যান্ড,ওয়াইফ একে অপরকে বুঝতে পারে না,চিনতে পারে না। বহুরূপী মুখোশধারী স্বামীর আসল রূপ ধরতে পারে না। আবার অনেক নারী ও আছে স্বামী,বাচ্চা রেখে স্বামীর চোখকে ফাঁকি দিয়ে পরকীয়া করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যখন স্কুলে চাকরি করেছি
ঐশী নামক এক ছাত্রীর মা'কে আর এক ছাত্রীর বাবার সাথে প্রায়ই একসাথে দেখতাম। জানি না কি সম্পর্ক ছিল। তবে ভালো লাগে নি তাদের চলাফেরা। আসলে কি মা জানো? যখন মানুষের ভিতর নীতিনৈতিকতা থাকে না, ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাব ঘটে তখন সুস্থ চিন্তাভাবনা করতে পারে না। বিবেকে পচন ধরে। চরিত্রের স্খলন ঘটে। লোভ,মোহের কারণে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। শিহাবের বাহ্যিক চেহারা দেখে কথা বলে যতটুকু বুঝতে পেরেছি খুবই প্র্যাকটিক্যাল।
মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। জীবনকে খুব কাছ থেকে দেখেছে। অন্যের দুঃখ,কষ্টগুলো বুঝার ক্ষমতা তার আছে।
টাকার চেয়ে সৎ,চরিত্রবান,আত্মসম্মান,ব্যক্তিত্ব,মানবিক
ধার্মিক,বিবেকবান,মানুষগুলোকে সব সময় প্রাধান্য দেই। জানি না শিহাবের সাথে মিল পড়বে কিনা।
কথায় কোনো রকম জটিল,বা মিথ্যার আশ্রয় নেয়নি।
-তোর পছন্দ হলে আমার আপত্তি নেই মা। তোর কাছ থেকে যতটুকু শুনেছি। ভালোই তো মনে হলো।

পরদিন সুপ্তির পরীক্ষা আছে। রাত জেগে পড়বে। আলো জ্বালানো থাকলে ঘুম আসবে না তাই মায়ের ঘরে চলে এল। লাইট অফ করে শুয়ে আছে। মিসেস করিম সব গুছিয়ে সুপ্তির টেবিলে এক গ্লাস গরম দুধ রেখে আসার সময় বলল,
- দুধ খেয়ে ঘুমাস। বেশি রাত জাগিস না। ভোরে ডাক দিয়ে দিব নি।
রাতের ঔষধ খেয়ে নিঃশব্দে মুক্তির পাশে শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলেন মিসেস করিম। মেয়ের মাথায় পরম মমতার হাতটি রাখলেন। মুক্তি খানিকটা নড়েচড়ে মায়ের বুকের কাছে মুখ ঘেঁষে শুইলো।
-কি রে ঘুমাস নাই?
-ঘুম আসছে না মা।
-মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি ঘুমানোর চেষ্টা কর। কালকে
শিহাবের সাথে দেখা হলে জানিয়ে দিস ওদের বাড়ি থেকে যেন বোন,বোনজামাই, এক দুইজন মুরুব্বিকে
পাঠায়। তোকে দেখে আমার সাথে ফাইনাল কথা বলে
দিন,তারিখ ঠিক করে যাক। ছেলের বাড়ি থেকেই তো প্রথমে প্রস্তাব আসে। এদিকে তোর চাচাদের সাথে কথা বলে ওনাদের থাকতে বলি। শিহাবকে আমার পছন্দ হয়েছে। তাই দেরি করতে চাই না।
-এত তাড়াহুড়ো করছো কেন মা? দু'দিন সময় নিয়েছি।
সুপ্তির পরীক্ষা শেষ হোক। তারপর যা কিছু হবার হবে।
-দু'দিন ভাবা যে কথা দু'ঘন্টা ভাবা একি কথা। কথা ফাইনাল হয়ে এগিয়ে থাকুক। সুপ্তির পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর বিয়ের অনুষ্ঠান।
-ঠিক আছে । শিহাবকে বলবো। এখন ঘুমাও। চোখে ঘুম চলে আসছে।

মিসেস করিমের চোখে ঘুম নেই। এলোমেলো ভাবনা এসে চোখ জুড়ে বসলো। মেয়েকে একসেট গয়না বানিয়ে দিব। সেই চিন্তা থেকেই জমি বিক্রির সিদ্ধান্ত নেই।এখন যদি টাকাটা ঠিক সময়ে না পাই। বিয়ের সময় মেয়েকে কি দিব? জমানো যা টাকা আছে ছোট করে বিয়ের অনুষ্ঠানের খরচ চালানো যাবে। ভাইজান ইচ্ছে করলেই জমির টাকাটা দিয়ে দিতে পারে। ভাবীর
ভয়ে সাহস পাচ্ছে না। কালকে ফোন দিয়ে বাসায় আসতে বলি। তারপর বিয়ের কথা বলে জমির টাকার কথা আবার বলি।

মুক্তি খাতা জমা দিয়ে কলেজে থেকে বের হবে এমন সময় মোবাইল বাজছে। দেখে আশিকের নাম্বার। কল রিসিভ করতেই আশিক বলল,
-গেইটের বাইরে অপেক্ষা করছি।
-দু'মিনিটের মধ্যে আসছি।
মুক্তি গেইট পার হয়ে দেখে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে।
মুক্তিকে দেখতে পেয়ে হাত দিয়ে ইশারায় ডাকলো।
কাছে যেতেই মুচকি হাসি দিয়ে আশিক বলল,
-চলেন আজ লাঞ্চ করি।
-কালকেও দেরি করে বাসায় গিয়েছি। আজ শরীরটা ভালো লাগছে না।
-তাহলে থাক। অন্যদিন যাবো।
-মায়ের সাথে কথা হলো?
-হুমম,হয়েছে। রাতে মায়ের সাথেই ঘুমিয়েছি।
-ওনি সব শুনে কি বললেন?
-আপনাকে পছন্দ করেছেন। আপনাদের বাড়ি থেকে প্রস্তাব নিয়ে কাউকে যেতে বলেছেন মায়ের সাথে কথা বলতে।
-আলহামদুলিল্লাহ। যদি বলেন কালকেই পাঠাতে পারি।
ছোটবোন,বোনজামাই এবং শহরেই আমার খালা খালু থাকেন। তারা প্রস্তাব নিয়ে যাবেন। আপনি যদি চান সাথে আমিও যাবো। যদি ঐদিনই বিয়ে করার কথা কেউ বলে তাও আমি রাজি আছি।
মুক্তি শব্দ করে হেসে দিল। আশিকও হাসছে। দু'জন দু'জনের দিকে তাকিয়ে আছে। মুক্তির লজ্জা লাগছে তাই অন্যদিকে দৃষ্টি দিল। আশিক ঠোঁটে হাসি রেখেই বলল,
-হাসলে আপনাকে খুব সুন্দর লাগে! আমাকে মুক্তি ম্যামের পছন্দ হলো কিনা তা পুরোপুরি জানা হলো না।
এখন শুধু মায়ের মতামতটা জানতে পেরেছি। দু'দিনের আগে কি জানা যাবে না?
-জানা যাবে তবে আংশিক। পুরোটা জানাবো বিয়ের রাতে।
মুক্তির মুখ থেকে এমন কথা শুনে আশিকের চোখে,মুখে তৃপ্তির ছোঁয়া। ভালো লাগার আবেশ তার মুখটিতে ঘিরে থাকে। একগাল হেসে বলল,
-তবে তাই হোক। পুরোটা বিয়ের রাতেই শুনবো।
মুক্তি বলল,
-চলুন সামনে এগিয়ে যাই। হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি।
আজ আর কোথাও বসবো না।
-ঠিক আছে। সামনে রাস্তার পাশে ফাস্টফুডের দোকান আছে। ঐখানে কিছু খেয়ে তারপর স্টেশনের দিকে যাবেন। আর আজ আমি আপনার সাথে স্টেশনে যাবো
পৌঁছে দিতে। নিষেধ করতে পারবেন না।
-কোনো দরকার নেই কষ্ট করার। খামাখা এতটা পথ গিয়ে আবার ফেরত আসা।
-তাহলে সাথে নিয়ে চলেন মা'কে দেখে আসবো। মায়ের হাতের রান্না খেয়ে আসবো। মা'হীন হয়েছি আজ অনেকগুলো মাস চলে গেলো। মা থাকতে বাসায় ফিরেই আগে মায়ের মুখটা দেখতাম। কোথাও দেখতে না পেলে ডেকে সারা বাড়ি মাথায় তুলতাম। মা পাগলের মতো ছুটে আসতো। মা'কে এত ভালোবাসতাম বলেই মা আজ আমাকে একা করে চলে গেলেন।
-মন খারাপ করার কথা বলবেন না আশিক। আপনার কষ্টে সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। আমিও মাকে ভীষণ ভালোবাসি। মায়ের কষ্ট সহ্য করতে পারি না

হাঁটতে হাঁটতে ফাস্টফুডের দোকানে চলে আসলো। আশিক দুটো চিকেন শর্মা,ড্রিংকসের অর্ডার দিয়ে মুক্তিকে নিয়ে এক কর্ণারে বসলো। খাবার চলে আসলো। মুক্তি খেতে খেতে বলল,
-আশিক আমার কিছু সিদ্ধান্তের কথা আপনাকে বলি।
যার সাথেই আমার বিয়ে ঠিক হতো। ওনার কাছে আমি বিয়ের আগেই বলে ওনার মতামতটা জেনে নিতাম।
আসলে আমি মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। বেড়ে উঠা,লেখাপড়া করেছি থানা শহরেই। বাবা অসুস্থ থাকা অবস্থায় সংসার খরচের দায়িত্ব নিয়েছি। যতটুকু সম্ভব মা'কে সাহায্য করছি। ইচ্ছে ছিল সুপ্তিকে ভালো কোনো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করিয়ে তারপর নিজের জন্য কিছু ভাববো। সুপ্তির বয়সটা সেনসেটিভ। এই বয়সের মেয়েরা আবেগতাড়িত হয়ে জীবনে বেশি ভুল করে। হুটহাট সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। জীবনের বাস্তবতা বুঝে না।
দুই,তিনটে বছর পার হলে এই ভয়টা থাকবে না। তখন আপনাআপনি ম্যাচিওরিটি চলে আসবে। কিন্তু বর্তমানে মা আমার বিয়ে নিয়ে এত বেশি টেনশন করেন যা আমাকে রীতিমত ভাবিয়ে তোলে। মায়ের টেনশন দেখে মনে হয় আমার বয়স অনেক হয়ে যাচ্ছে। বিয়ে আর হবেই না। তাই ডিসিশন নিয়েছি মা যা চাইছেন তাই করবো।
-মুক্তি আমি আগেই বলেছি মানুষের দুঃখ,কষ্ট বুঝার ক্ষমতা আমার আছে। আপনি আগেও যেভাবে তাদের পাশে ছিলেন, সাপোর্ট দিয়েছেন। বিয়ের পরেও তা অব্যাহত থাকবে। সুপ্তি,মাকে আমার নিজের মা,বোনের চোখেই দেখবো। আপনি আমার উপর শতভাগ ভরসা রাখেন। বিয়ের পর সুপ্তি আমাদের বাসা থেকেই লেখাপড়া করতে পারবে।
-কথাগুলো বলে হালকা লাগছে। আপনার কাছ থেকে সুন্দর মতামত জেনে খুব ভালো লাগছে। আশিক এখন উঠা যাক।
-এখনি উঠবেন?
-হুমম।

দু'জনে খাবারের দোকান থেকে বের হলো।আশিক রিকশা ডাকলো। মুক্তি চট করে রিকশায় উঠে আশিকের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,'বাসায় গিয়ে লাঞ্চ করে বিশ্রাম নিন।' আশিক এক দৃষ্টিতে মুক্তির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছু বলছে না।
মুক্তি আবার বলল,'কি হলো? চলে যাচ্ছি। কিছু বলুন।' আশিক মলিন মুখে বলল,'কেন জানি আমার ভীষণ খারাপ লাগছে! কিছু বলতে পারছি না।'
মুক্তি ফিক করে হেসে দিল। আশিক হাসছে না। গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে আছে। হাসতে হাসতে মুক্তি বলল,
'বাসায় গিয়েই ফোন দিব। অনেক সময় ধরে কথা হবে। এখন স্যারের হাসিমুখটা দেখে যেতে চাচ্ছি।'

আশিক মলিনমুখে আওয়াজ করে হাসলো। মুক্তিও হাসি দিয়ে বাই বলে বিদায় নিল। রিকশাওয়ালাকে বলল,' দ্রুত টেনে স্টেশনে যান।'
--------চলবে
[Only admins are allowed to see this link]াকসুদা খাতুন দোলন

Arbaj khan, Ruma islam, Naimul islam, Feroz hassan, Risbi mahin, Arfin rony, Afrin kalam and লেখাটি পছন্দ করেছে

avatar
Shamim
ধুমকেতু
ধুমকেতু
Posts : 23
স্বর্ণমুদ্রা : 1110
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-06-01

মাতৃত্বের স্বাদ - Page 2 Empty Re: মাতৃত্বের স্বাদ

Wed Jul 28, 2021 6:15 pm
মাতৃত্বের-স্বাদ (১৫)

শেষ পরীক্ষার দিন সুপ্তি হল থেকে বের হয়ে দেখে আশিক দাঁড়িয়ে আছে। প্রশ্নপত্র নিয়ে দু'জনে কথা বলতে বলতে সামনের দিকে হাঁটছে। কলেজের সামনে কোনো বাহন নেই। প্রচণ্ড ভিড়। হাঁটা ছাড়া উপায় নেই। সব স্টুডেন্টরা এই পথ ধরেই হেঁটে যাচ্ছে। আশিক পাশের দোকান থেকে দুটো চকবার আইসক্রিম কিনে একটা সুপ্তির হাতে দিল।
-নে ধর, তোর পছন্দের আইসক্রিম। খেতে খেতে যেতে থাকি।
সুপ্তি হেসে বলল,
-তুই কি করে বুঝলি? এই মুহূর্তে আমার ভীষণ আইসক্রিম খেতে মন চাচ্ছে।
-খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। দু'জনে পরীক্ষা দিয়ে বের হয়েছি। এরপর যা গরম পড়েছে। দেহটা ক্লান্ত,জিভটা পিপাসার্ত। ঠাণ্ডা কিছু খেতে পারলে কলিজাটা জুড়িয়ে যাবে।
-আসলে ঠিক তাই! প্রাণটা একদম ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।
হাইয়ার ম্যাথ পরীক্ষা কেমন হলো?
-ফাটাফাটি হয়েছে! সব পরীক্ষাই ভালো হয়েছে। তুই একদিন বললি মন দিয়ে লেখাপড়া করতে। তোর কথাটা মনে রেখেছি। তাছাড়া মুক্তি 'বু'কে নিজের মায়ের পেটের বোন বলে মনে করি। মুক্তি 'বু'র মুখটা দেখলেই শান্তি লাগে। খুব শ্রদ্ধা করি,ভালোবাসি। বু যেইদিন বলল,বানরের মতো ঘুরে বেড়াস না। লেখাপড়ায় মন দে! তখন থেকে বাইরে ঘোরাফেরা কমিয়ে দিয়ে লেখাপড়ায় মন দিয়েছি।

আশিক চুপ থেকে আবার বলল,
-একটা কথা বলবো?
সুপ্তি হেসে বলল,
-বোকার মতো কথা বলছিস কেন? একটা কেন? তুই তো অনর্গল কথা বলে যাচ্ছিস।
আশিক ভারমুখে শান্ত গলায় বলল,
-বিষয়টা খুব সিরিয়াস! হালকাভাবে নিস না। আমাকে বুঝতে পারিস না? আমি তো ঠিকই তোকে বুঝে নিয়েছি। একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে আমাকে শুধু কাজিন,বন্ধুই মনে হবে না। তোর খুব কাছের একজন মনে হবে।
সুপ্তি আবার দুষ্টুমির হাসি হাসছে। তারপর বলল,
-তুই তো আমার কাছেরই একজন। পরিবারের একজন। ঐটা আবার এত ভাব নিয়ে বলার কি আছে?
-উহ্ সুপ্তি তোরে নিয়ে আর পারি না। উল্টো বুঝছিস কেন?
সুপ্তি হাসি থামিয়ে শান্ত গলায় বলল,
-উল্টো,সোজা যাই বুঝে থাকি না কেন? মন দিয়ে লেখাপড়া কর। এডমিশন কোচিং এ ভর্তি হয়ে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু কর। সামনে ভর্তি পরীক্ষা।
আমিও সর্বোচ্চ চেষ্টা করি দেখি মা,বুবুর আশা পূরণ করতে পারি কিনা। বুবুর ইচ্ছে ডাক্তারি পড়ি। চান্স পাবো কিনা জানি না। চান্স না পেলেও আফসোস করবো না। মনকে সান্ত্বনা দিতে পারবো চেষ্টা করেছি।
কপালে ছিল না।
কথা বলে হাঁটতে হাঁটতে দু'জন সুপ্তির বাসার সামনে চলে আসলো। সুপ্তি আশিককে দুপুরে খেয়ে যেতে বললে আশিক রাজি হলো না। সুপ্তি চলে আসলো বাসায়। আশিক ঐখান থেকে রিকশা নিয়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল।

মুক্তি কলেজ থেকে বের হয়ে সোজা চলে আসলো 'ভোজন-বিলাস'রেস্টুরেন্টে। শিহাব ছোট বোন রাত্রিকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে অপেক্ষা করছে। ফোন করে শিহাব জানিয়েছিল আজ একসাথে লাঞ্চ করবে। মুক্তিকে একমাত্র বোনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে,দেখার জন্য এই আয়োজন করে শিহাব। মুক্তির সাথে কথা বলে তার ব্যবহার, আন্তরিকতা দেখে রাত্রি মুগ্ধ হয়। খুশিতে বলেই ফেলল,'আমার আদরের একমাত্র ভাইটিকে দাদা বলে ডাকি। মা ছোটবেলায় শিখিয়েছেন। দাদার বউকে 'দাদি' নাকি 'ভাবী' বলে সম্বোধন করবো? অনুমতি পেলে আজই শুরু করতে পারি। রাত্রির কথা শুনে দু'জনেই হাসলো। মুক্তি বলল,যা সম্বোধন করলে তুমি শান্তি পাবে। তাই ডেকো। তবে একটা কথা না বলে তৃপ্তি পাচ্ছি না। রাত্রি, তুমি খুব সুন্দর এবং মায়াবী।
রাত্রি হেসে বলল,ভাবী তুমিও অনেক ভালো মনের মানুষ। দেখতে খুব খুব কিউট।

লাঞ্চ টাইমে বেশি সময় ওরা রেস্টুরেন্টে থাকলো না। বিদায় নিয়ে রাত্রি তার কর্মস্থলে চলে গেলো। মুক্তি শিহাবকে নিয়ে লাইব্রেরিতে আসলো। সুপ্তির পরীক্ষা আজ শেষ হয়েছে। মুক্তি আগেই ঠিক করে রাখে কলেজ থেকে ফেরার পথে গল্পের বই কিনে নিয়ে যাবে। সমরেশ মজুমদারের 'সাতকাহন'উপন্যাসের দুই খণ্ড নিয়ে সেলসম্যানকে বলল প্যাকেট করে দিতে। টাকা বের করতে ব্যাগে হাত দিতেই শিহাব আস্তে করে মুক্তির ডানহাতটা চেপে ধরে বলল, রাখো,আমি দিচ্ছি। হঠাৎ
শিহাবের হাতের স্পর্শ পেয়ে মুক্তি চুপ হয়ে যায়। মুখের দিকে চেয়ে ধরে থাকা হাতটার দিকে তাকিয়ে থাকে। পছন্দের মানুষটির হাতটিতে মায়া,নির্ভরতা,ভরসার নির্ভেজাল আশ্রয় খুঁজে পায়। মুহূর্তে ভালোবাসার এক গভীর অনুভূতি তার ভিতরটাকে শিহরিত করে তোলে। মুক্তি ইচ্ছে করেই হাতটা সরালো না। শিহাব অন্য হাতে টাকা দিয়ে বইয়ের প্যাকেট নিল। বের হওয়ার সময় আলতো চাপ দিয়ে হাতটা ছেড়ে দিল শিহাব। মুচকি হেসে বলল,চলো এবার যাওয়া যাক। মুক্তি বলল, আর একটু কাজ আছে। চলেন একটু এগিয়ে যাই। এই সামনের কোনো শো-পিচ অথবা টয়ের শপে যাবো। তবে একটা শর্ত আছে। কেন যাচ্ছি, কার জন্য কিনছি এইসব প্রশ্ন করা যাবে না। শিহাব বলল,
ঠিক আছে, ম্যাডাম। যা করতে চাইছেন তাই হবে।

মুক্তি পছন্দ করে খুব সুন্দর একটা খেলনা,আর ক্রিস্টালের শো-পিচ কিনে সেলসম্যানকে প্যাকেট করে দিতে বলল। তারপর শিহাবের হাতে দিয়ে বলল,
রাত্রির সাথে প্রথম দেখা হয়েছে। ওকে কিছু খাওয়াতে পারলাম না। মা,মেয়ের জন্য আমার কাছ থেকে ছোট্ট ভালোবাসা। প্যাকেটটা নিয়ে শিহাব বলল,
'এবার কিছু বলতে পারবো ম্যাডাম?' মুক্তি হাসলো।
বলা যাবে । গিফট সম্পর্কে কিছু শুনতে চাচ্ছি না।
শিহাব মুক্তির হাত ধরে রাস্তা পার হয়ে এপাশে এসে রিকশা ডাকলো। রিকশায় উঠুন। যেতে যেতে বলি।
সুপ্তি অবাক হয়ে বলল,এখন আবার কোথায় যাবো?
স্টেশনে যাবো দু'জনেই। আপনাকে স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দিতে যাবো। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আজ নিষেধ করবেন না প্লিজ। সুপ্তি চুপচাপ রিকশায় উঠে বসলো। শিহাব
পাশে বসে রিকশাওয়ালাকে বলল,চাচা স্টেশনের দিকে যান। দু'জনেই নীরবতায় আচ্ছন্ন। চারদিকে বিদায়ী বিকেলের ফুরফুরে বাতাসের আলিঙ্গন। এলোমেলো হাওয়ায় মুক্তির সামনের ছোট চুলগুলো ওড়ছে। ব্যস্ত শহরে সবাই ছুটছে নিজ নিজ গন্তব্যে। শিহাব নীরবতা ভেঙে মুক্তির ডানহাতটি নিজের হাতে রেখে বলল,

আজ সুপ্তির পরীক্ষা শেষ হলো। আসছে শুক্রবার
ঘরোয়াভাবে বিয়েটা হয়ে গেলে কেমন হয়? কালকে যেহেতু কলেজ বন্ধ। তাই খালাখালু,রাত্রিকে কথা বলতে
কালকে আপনাদের বাসায় পাঠাই। এত আয়োজনের দরকার নেই। লাঞ্চের পর বিকালে যাবে। কথা বলে চা,নাস্তা খেয়ে চলে আসলো। বিয়ের পর সুবিধা মতো তারিখ দেখে দুই পরিবার থেকে এক অনুষ্ঠান করে আত্মীয় স্বজন,কলিগদের দাওয়াত করে খাওয়াবো। বাড়িতে ঝামেলা না করে কমিউনিটি সেন্টারে প্রোগ্রাম হলে ভালো হয়।
মুক্তি সব শুনে বলল,
মায়ের সাথে কথা বলে রাতে ফোনে বিস্তারিত জানাবো।

পঁচিশ মিনিটের মধ্যে স্টেশনে চলে আসলো। মুক্তি বাস পেয়ে শিহাবকে বিদায় জানিয়ে ঝটপট উঠে পড়লো।
রাস্তা ফাঁকা থাকায় খুব তাড়াতাড়ি বাসায় এসে পৌঁছালো। ফ্রেশ হয়ে চা খেতে খেতে মায়ের সাথে শিহাবের সিদ্ধান্তের কথা জানায়। মিসেস করিম সব শুনে বললেন, খুব তাড়াহুড়ো হলেও শিহাবের সাথে আমি একমত। আমিও এমনটা চাইছি। বিয়েটা হয়ে যাক তারপর একটু দেরি করে অনুষ্ঠান করবো। কিন্তু অনুষ্ঠান একটা হবে এটা কেমন কথা? আমার কি বাড়ি-ঘর নাই? কলিগ,আত্মীয়-স্বজন সবাই শহরে যাবে? যেমন পারি বাড়িতে অনুষ্ঠান করে আত্মীয়-স্বজনদের খাওয়াবো। মান-সম্মান থাকবে না। লোকজন কি বলবে? শিহাব কমিউনিটি সেন্টারে বৌভাতের ছোটখাটো অনুষ্ঠান করলেই ভালো হবে।
তুই এখনি শিহাবকে জানিয়ে দে বিকেলে না এসে এখানে দুপুরে খাবে। প্রথমবার আসবে শুধু চা খেয়ে চলে যাবে তা হয় না।
'ঠিক বলছো মা! শিহাবকে ফোন করে সব জানাই। দুপুরে লাঞ্চ করবে। তুমি যেভাবে বলবে শিহাব অমত করবে না আশা রাখি।'

মুক্তি রাতে খাওয়ার পর শিহাবকে ফোনে জানিয়ে দিল।
মিসেস করিম মুক্তিকে নিয়ে রাতেই বাজারের লিস্ট করে রাখলেন। আশিককে ফোন করে সকালে বাসায় চলে আসতে বললেন। তিনি রাতেই ভাসুরকে ফোনে জানিয়ে দিলেন। মুক্তিকে দেখে কথা ফাইনাল করতে ছেলেপক্ষের আত্মীয়স্বজন বাসায় আসবে।

সুপ্তি বিয়ের কথায় কান না দিয়ে উপন্যাস পড়াতে ব্যস্ত।
সন্ধ্যা থেকে একটানা পড়ছে। মুক্তি ঘুমুতে এসে জিজ্ঞেস করলো,উপন্যাসটা কেমন রে? ডুবে আছিস দেখছি।
জীবন পাল্টানোর গল্প। দীপার সংগ্রামী জীবন কাহিনী পড়ে নিজের ভিতরে প্রবল আত্মশক্তি সঞ্চার হবে আশা করি। মেয়েদের জীবনে নানা প্রতিকূলতা আসবেই। নানা ঘটনার সম্মুখীন হবে। সকল কিছুকে উপেক্ষা করে
ভালোর দিকে এগিয়ে যাওয়াই মেয়েদের জীবনের ব্রত হওয়া উচিত। খুব ভালো উপন্যাস। সুপ্তি উপন্যাসের পাতায় চোখ রেখেই বলল,
এই রকম অনুপ্রেরণামূলক বই আরও কিনে দিস বুবু।
এই দুটো আগে শেষ কর। আস্তে আস্তে সব পাবি। আমার বিয়ে,ব্যবহারিক পরীক্ষার পর ভর্তি পরীক্ষার পড়া শুরু করে দিবি।
সুপ্তি মন খারাপ করে বলল,বুবু তোকে ছাড়া থাকা খুব কষ্টের হবে। একা বাসায় কি করে থাকবো?
তোকে খুব বেশিদিন একা থাকতে হবে না। ভালো জায়গায় চান্স হলে হোস্টেলে চলে যাবি। তবে মা ভীষণ একা হয়ে যাবে। মায়ের কথাটাই বেশি ভাবছি। আমি,
তুই ভালোই থাকবো। কিন্তু মা তো একা হয়ে যাবে। মায়ের বয়স বাড়ছে। মায়ের কাছে কে থাকবে?
মায়ের প্রসঙ্গ তুলে কথা বলে দু'জনেই চুপ থাকে।

সকালে নাস্তা খাওয়ার পর সুপ্তি বারান্দায় আসলো উপন্যাস হাতে নিয়ে। রশিদ সাহেব বারান্দা থেকে বাইক বের করার সময় ভাঁজ করা কাগজ গ্রিলের ফাঁক দিয়ে সুপ্তির সামনে রাখলেন। কথা না বলে বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে গেলেন। উপন্যাসের ভিতরে কাগজটা মেলে চুপ করে পড়তে শুরু করলো,'তোমার এড়িয়ে চলাটা সহ্য করতে পারছি না। এতটা বদলে গেলে কেন? আমাকে মানুষ মনে করো না? খুব তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে যাচ্ছি। ভালো থেকো।'

সুপ্তি কাগজটা ছিঁড়ে টুকরো করে বাইরে ফেলে দিল।
ভিতরে এসে দেখে রিয়ার আম্মু মায়ের সাথে কথা বলছে মুক্তির বিয়ে নিয়ে। চিঠিটা পড়ে মনটা খারাপ হয়ে যায় সুপ্তির। ঘরে এসে উপন্যাস টেবিলে রেখে শুয়ে থাকে বেশ কিছু সময়। রিয়া চলে যাবে ভাবতেই পারে না। ভিতরে কষ্ট হচ্ছে। মনটা অস্থির লাগছে। কেন এদের সাথে পরিচয় হলো? সবার মায়া কাটিয়ে ভুলে থাকা আমার জন্য খুব কষ্টের হবে। এদিকে বুবুর বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। বুবু চলে যাবে শহরে শ্বশুরবাড়ি। রিয়াও চলে যাবে। আমার যে ভীষণ একা লাগবে। কি করবো আমি? আমার এত কষ্ট হচ্ছে কেন? চোখের পাতা ভিজে যাচ্ছে কেন? ভেজা চোখে এলোমেলো ভাবনায় সুপ্তি ঘুমিয়ে পড়ে।আশিক বাজার থেকে এসে নাস্তা করে সুপ্তির ঘরে আসলো। বালিশ ওর পিঠে ছুঁড়ে দিয়ে বলল,বাসায় মেহমান আসবে। আর তুই এখানে আরামে ঘুমাচ্ছিস?
বাসায় কত কাজ আছে। উঠ তাড়াতাড়ি! চাচি তোরে ডাকে।
সুপ্তি উঠে হাতমুখে পানি দিতে বাথরুমে চলে গেল।
বের হয়ে কিচেনে গেল মা'কে সাহায্য করার জন্য। কারো সাথে তেমন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। মা'কে বলল,ভীষণ মাথা ধরেছে। চা থাকলে দাও। মিসেস করিম উনুনে তরকারি নাড়তে নাড়তে বললেন,
পরীক্ষা শেষ হতেই মোটা একটা বই নিয়ে পড়া শুরু করলি আর থামার নাম নেই। সেই সন্ধ্যা থেকে শুরু করছিস। ঐ যে দেখ পাতিলে চা আছে। গরম করে খেয়ে বিছানার চাদরগুলো পাল্টে বালিশের কভার লাগিয়ে রাখ। ঘরদোর গুছিয়ে গোসল করতে যা। এদিকটা জুলেখার মা'কে নিয়ে সামলাতে পারবো।

মুক্তি গোসল করে ব্লকের সুতি শাড়ি পরে নিল। হালকা সাজগোজ করে গেস্টদের জন্য অপেক্ষা করছে। দুপুর আড়াইটায় শিহাবের বোন,বোনজামাই,খালা খালু চলে আসলো। খাওয়া পর্ব শেষ করে মিসেস করিম,মুক্তির চাচার সাথে ফাইনাল কথা বলে সন্ধ্যার আগেই ওনারা চলে গেলেন।

শুক্রবার দিন বিয়ে। হাতে সময় নেই। মিসেস করিম মেয়েকে একসেট গয়না দিবে। জুয়েলারি দোকানে আগেই অর্ডার দিয়েছেন। অথচ টাকার কোনো ব্যবস্থা করতে পারেন নি। আশিকের বাবা বলেছেন দু'দিনের মধ্যে টাকাটা জোগাড় করে দিবেন। এখন ওনি ফোনে টাকা নিয়ে কোনো কথাই বলেন না। বাড়িতে কোনো ঝামেলা চলছে কিনা কে জানে? ভাবী নিশ্চয়ই জমির টাকা নিয়ে ঝগড়া করছে। হঠাৎ অপরিচিত এক লোক ফোন করে মিসেস করিমকে বললেন,
আপনি যে অল্প জমি বিক্রি করতে চাইছেন। ঐটা আমি কিনবো। আপনি চাইলে কালকে টাকা নিয়ে রেজিস্ট্রি করে দিতে পারেন।
টাকার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। মিসেস করিম খুশিতে আত্মহারা। মনে মনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেন। আল্লাহ একটা ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। পরদিন লোকের সাথে কথা বলে টাকা নিয়ে জমি রেজিস্ট্রি করে দিলেন। জমি বিক্রি হয়ে গেছে শুনে আশিকের মা মিসেস করিমকে রাগে ফোন করে জানালেন,তোমাদের
সাথে আর কোনো সম্পর্ক নেই। একা একা মেয়ে বিয়া দাও। কোনোদিন ঐ বাড়িতে পা রাখবো না।

কলেজ থেকে একদিনের ছুটি নিল শিহাব, মুক্তি। পছন্দ মতো বিয়ের শপিং নিজেরাই করলো। বিয়ের বাজার,
বাবুর্চি,খাওয়া-দাওয়া,প্যান্ডেলসহ বাড়ি সাজানোর সবকিছু রশিদ সাহেব,আশিকের উপর ছেড়ে দিয়েছেন
মিসেস করিম। তারাই তদারকি করছে। ওনি শুধু টাকা দিয়ে দিক,নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন।

আজ মুক্তির গায়ে হলুদ। সকালেই কাজিনরা চলে আসলো। বিকেলে হলুদের অনুষ্ঠান। সুপ্তি তার বুবুর সাথে ম্যাচিং করে শাড়ি পরলো। রিয়াকে শাড়ি পরিয়ে দিল । রিয়ার জন্য ম্যাচিং শাড়ি আগেই কিনে রেখেছিল সুপ্তি। সুহানাও বেশ সাজগোজ করে হলুদের অনুষ্ঠানে সবার সাথে গান গেয়ে বেশ আনন্দ করলো। আশিক কাজের ফাঁকে বারবার সুপ্তির দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসে। সুপ্তি খেয়াল করে বলল,'কিরে তুই কেবলা হাকিমের মতো আমার দিকে তাকিয়ে কি দেখিস? আশিক হেসে বলল, তুই বুঝবি না। তোর মাথা মোটা। লিপি আশিকের কথা টেনে নিয়ে হাসতে হাসতে বলল,সুপ্তির মাথা মোটা হলেও আমার মাথা মোটা না। চিকন মাথা আমার। তোর মনে এখন রঙিন প্রজাপতি উড়াউড়ি করছে। কাউকে নিয়ে স্বপ্নের জগতে ডুবে ডুবে পানি খাচ্ছিস। ঠিক কিনা বল?
সুপ্তি লিপিকে টানতে টানতে বলল, আশিকের মনের খবর পরে রাখিস। এখন চল্। বুবুকে মেহেদি লাগাতে হবে।
রাতে খাওয়ার পর সবাই চলে গেল। সুপ্তি,বান্ধবী লিপিকে নিয়ে মুক্তির হাতে মেহেদি লাগাচ্ছে। রিয়াও মেহেদি পরবে সুপ্তির কাছে বায়না ধরে বসে আছে।
রিয়ার চোখে ঘুম দেখে সুপ্তি আগেই রিয়ার হাতে মেহেদি লাগাচ্ছে। রশিদ সাহেব রিয়াকে নিতে এসে মনোযোগ দিয়ে সবার মেহেদি দেওয়া দেখে পিছনে চুপ করে দাঁড়িয়ে সুপ্তির দিকে তাকিয়ে থাকেন। কারো আসার আওয়াজ শুনে রিয়াকে ডাকলেন,চলো রিয়া। ঘরে যাবে। সকালে আবার এসো। সুপ্তি এবার অনেকদিন পর রশিদ সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
রিয়া আজ আমাদের কাছে থাকুক। রাতে কান্না করলে দিয়ে আসবো। রশিদ সাহেব সুপ্তির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলল,কান্না করলে দিয়ে এসো।

রাতে সবাই ঘুমিয়ে আছে। মুক্তির ঘুম আসছে না। কাল থেকে এ বাড়িটি ছেড়ে থাকতে হবে। ভাবতেই দু'চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। কত স্মৃতি ঘেরা বাবার হাতে গড়া এই 'রেবেকা মঞ্জিল'বাড়িটি। বাবার হাত ধরে সারা উঠোনজুড়ে সাইকেল নিয়ে দৌড়াদৌড়ি। উঠোনে সুপ্তিকে নিয়ে ঝোলাপাতি খেলা। মা,সুপ্তির সাথে কানামাছি খেলা। সব স্মৃতি মনে করে মুক্তি নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলে। হঠাৎ মাথার কাছে সাইলেন্ট করা মোবাইলে শিহাব নামটি দেখে চমকে উঠে। এত রাতে শিহাব কেন ফোন করেছে? কোনো সমস্যা হলো কিনা?
তাড়াতাড়ি রিসিভ করলো। খুব আস্তে করে শিহাব বলল,
-কি করো?
-এত রাতে ফোন কেন? কোন সমস্যা নেই তো?
-হুমম, সমস্যা হচ্ছে।
-কি হয়েছে?শরীর খারাপ করেছে?
-অসুখ করেছে।
-কি অসুখ?প্লিজ বলুন।
-অসুখটা তুমি। ঔষধও তুমি। কাছে এলেই সারবে। কিছুতেই ঘুম আসছে না। কাছে পেতে ইচ্ছে করছে।
-এতক্ষণে বুঝলাম। বিয়েটা দু'মাস পরে হলেই ভালো হতো। রাত জাগলে শরীর খারাপ করবে। এখন ঘুমান।
রাখছি।
-কাল থেকে তো রাত জাগতেই হবে। আজ থেকেই শুরু করি। আজ দু'জনে কথা বলেই রাত শেষ করে দেই।
কালকে কোনো কথা হবে না।
মুক্তি হেসে দুষ্টুমি করে বলল,
-কালকে রাতে কি হবে? কথা হবে না কেন?
-যা হবে সব ব্যবহারিক।
-মানে কি?
-বোটানির ম্যাডামকে এত ভেঙে বলতে হবে কেন?
হঠাৎ সুপ্তি ঘরের আলো জ্বালালো। মুক্তি তাড়াতাড়ি আশিককে বলল,
-রাখছি।
-অনেক আদর
-হুমম ।
সুপ্তি বলল,বুবু রিয়া তার মায়ের কাছে যাবে। ঘুম থেকে উঠে কাঁদছে। মা'কে ডাকিনি। সারাদিন পরিশ্রম করে
ঘুমিয়েছেন। তোকে ডাকতে তোর রুমে এলাম। দুইজন মিলে ওকে ওদের ঘরে দিয়ে আসি।

বিয়ের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলো সন্ধ্যার আগেই। মাগরিবের পর পরই শিহাব মুক্তিকে নিয়ে রওয়ানা দিবে। সুপ্তি সারাদিন তার বুবুর কাছাকাছি আসেনি। দূর থেকে তাকিয়ে দেখেছে। ভিতরটা কান্নায় ফেটে যাচ্ছে।
দিনে কতবার নিঃশব্দে কেঁদেছে। কাউকে বুঝতে দেয়নি। আজ থেকে বুবু পর হয়ে যাচ্ছে ভাবতেই দু'চোখ
জলে উপচে উঠে। পা ছুঁয়ে সালাম করতেই মিসেস করিম একটানে মেয়েকে বুকে মিশিয়ে অঝোরে কাঁদতে থাকেন। সবাই অশ্রুসিক্ত। শিহাবের চোখ দুটো চিকচিক করছে। মিসেস করিম মেয়ে,মেয়ের জামাইকে নিয়ে দেয়ালে টানানো স্বামীর ছবির দিকে তাকিয়ে বললেন,
মুক্তির বাবা তুমি যে দায়িত্ব আমার কাঁধে তুলে দিয়ে চলে গেলে। আমি সেই দায়িত্ব পালন করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। তোমার মেয়ে অনেক বড় চাকরি পেয়েছে। সে যোগ্য হতে পেরেছে। আজ স্বামীর ঘরে যাচ্ছে। তুমি কবর থেকে দোয়া করো। তোমার মুক্তি যেন স্বামী,সন্তান নিয়ে অনেক সুখে থাকে।

সুপ্তির গাল ছুঁয়ে চোখের পানি ফেলে মুক্তি বলল,মন দিয়ে লেখাপড়া করিস। মা'কে নিয়ে সব সময় ভালো থাকবি।
সিক্ত চোখে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শিহাবের সাথে গাড়ি উঠে মুক্তি।

------চলবে
মাকসুদা খাতুন দোলন

Umma Mejana khatun, Hikmatullah khan, Md amanul, Ruma islam, Md salim bapari, Ahmed ridoy akon, Faima islam and লেখাটি পছন্দ করেছে

avatar
Shamim
ধুমকেতু
ধুমকেতু
Posts : 23
স্বর্ণমুদ্রা : 1110
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-06-01

মাতৃত্বের স্বাদ - Page 2 Empty Re: মাতৃত্বের স্বাদ

Wed Jul 28, 2021 6:15 pm
মাতৃত্বের-স্বাদ (১৬)

'কারি কারি টাকা এনে তোমার হাতে তুলে দিতে না পারলেও সম্মান, ভালোবাসা,মায়া,সহযোগিতা,বিশ্বাস দিয়ে তোমায় সারাজীবন সুখে রাখতে পারবো। মা,বাবা ছাড়া এই এতিম মাস্টারকে তুমি শুধু একটু ভালোবাসা দিও।' শিহাব খাটের মশারি টানাতে টানাতে কথাগুলো বলল। মশারি গুঁজে খাট থেকে নেমে মুক্তির সামনে এসে ড্রেসিং টেবিলের কোণায় হেলান দিয়ে বলল,

-একটা মশাও পাবা না। আরামে ঘুমুতে পারবা। ফ্যানের
বাতাস পুরোটাই মশারির ভিতরে যাবে লোজ করে টানাইছি। কারণ টানটান করে মশারি টানালে বাতাস বেশি ঢুকে না। নিচু করে একটু লোজ করে টানাতে হয়। বাবা মারা যাওয়ার পর দুটো খাটের মশারি আমিই টানাতাম। মা একদিন দেখিয়ে দিয়েছিল। তারপর থেকে
মা'কে মশারি টানাতে দেইনি। এখন চলুন ম্যাডাম, দয়া করে খাটে চলুন!
মুক্তি ফ্রেশ হয়ে খোঁপার ক্লিপ খুলে চুলের জট ছাড়াতে চেষ্টা করছে। মন দিয়ে শিহাবের কথা শুনে মুচকি হেসে বলল,
- আমি ভাগ্যবতী এত গুণী মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসাবে পেয়েছি। চুল ছাড়াতে অনেক সময় লাগবে স্যার! দয়া করে আপনি বিশ্রাম নিন। আজ বিয়ে করেছেন। অনেক
খাটাখাটনি হয়েছে।
-ও তাই নাকি? আসল পরিশ্রম তো হয়নি ম্যাডাম!
দু'জনেই মুখের দিকে তাকিয়ে দুষ্টুমির হাসি হাসলো।
শিহাব হাতের কাছে রাখা চিরুনি নিয়ে মুক্তির পিছনে দাঁড়িয়ে বলল,
-দেখি,দেখি উঠে দাঁড়াও! পাঁচ মিনিটে চুলের জট ছাড়িয়ে আঁচড়ে সোজা করে দিচ্ছি। দেখো এমন ভাবে আস্তে আস্তে আঁচড়ে দিব। আরামে চোখ বুঁজে আসবে। চুলে একটা টানও খাবে না।
-জনাব, আপনাকে এত কষ্ট করতে হবে না। আপনি শুতে যান। পাঁচ মিনিটের মধ্যে চলে আসবো।

শিহাব চিরুনি রেখে মুক্তিকে বুকের খুব কাছে টেনে নিল। দু'হাত দিয়ে পিঠে আলতো করে চেপে ধরলো । কপালের মাঝ বরাবর অধর ছুঁয়ে দু'চোখের পাতায় আস্তে করে পবিত্র চুম্বন এঁকে দিল। ঠোঁটের স্পর্শ মুক্তির
ভিতরটাকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। হৃদস্পন্দন বেড়ে চলেছে। নিজেও দু' হাত দিয়ে শিহাবের পিঠে হাত বুলিয়ে গভীর আলিঙ্গনে চোখ বুঁজে রইলো কিছুক্ষণ।
শিহাব গালে গাল মিশিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
-অসুখটা আজ থেকে কমবে। এই পাগলের সাথে থেকে তুমিও অনেক পাগলামি করবে।
মুক্তি চোখ বুঁজেই আহ্লাদি গলায় বলল,
-জ্বি না,মোটেও পাগলামি করবো না। আমি আপনার মতো এত অস্থির নই।
-তাই নাকি? 'আপনি' সম্বোধন আর কতদিন চলবে শুনি?
-'আপনি' ডাকের মধ্যে যদি নিবিড় নিঁখাদ ভালোবাসা,
শ্রদ্ধা,থাকে তাহলে ক্ষতি কি তাতে? আমি আপনি ডেকে শান্তি পাই।
-ওকে ম্যাম।
শিহাব মুক্তিকে আরও শক্ত করে চেপে ধরলো নিজের বুকের লোশম জমিনে। আর্দ্র মোলায়েম অধর দিয়ে সারা মুখে,গলায় শুদ্ধ,পবিত্র ভালোবাসার চিহ্ন এঁকে দিল। দু'জনের তপ্ত শ্বাস মিশে একাকার। শিহাব মুক্তির নাকের ডগায় নাক চেপে আস্তে করে বলল,
-ম্যাম, আপনার ভিতরে এই মুহূর্তে কি চলছে ঠিক বুঝতে পারছি। মোমের মতো গলে যাচ্ছেন।
মুক্তি মুচকি হেসে বলল,
-মোটেও না। আমি ঠিক আছি।
- কিছুই ঠিক নেই। প্রচণ্ড ঝড় উঠেছে আপনার ভিতর। গরম শ্বাস আমাকে মাতাল করে দিচ্ছে। এক মুহূর্ত দেরি করতে চাই না।

শিহাব মুক্তিকে পাঁজাকোলে নিয়ে খাটের মাঝখানে শুইয়ে দিল। লাইটের সুইচ অফ করে ফিরে আসতেই মুক্তি বলল,
-একটা জরুরি কথা ছিল।
- উফ্ এখন আবার কি জরুরি কথা? যা কিছু কথা সব কালকে সকাল এগোটার পর হবে।
মুক্তি শোয়া থেকে উঠে বসলো। তারপর বলল,
-ঘরে প্রথম পা রেখেই কথাটা মনে হয়েছিল। ভাবছি তখনি বলব। ঘরে মানুষজন ছিল তাই বলা হয়নি।
যদি শ্বশুর,শাশুড়ি বেঁচে থাকতেন এই বাড়িতে এসেই প্রথমে ওনাদের পা ছুঁয়ে দোয়া চেয়ে নিতাম। সেই সৌভাগ্য যেহেতু হয়নি। ওনাদের ছবি দেখতে চাই। মনে মনে দোয়া চেয়ে কিছুটা ইচ্ছে পূরণ করতে চাই।

শিহাব শুনেই স্টিলের আলমারি থেকে পুরোনো এলবাম
নিয়ে খাটের উপর বসলো। মা,বাবা,বোনের পুরানো ছবি দেখাচ্ছে। ছবির সাথে জড়িয়ে থাকা নানা স্মৃতিকথা বলছে। হঠাৎ শিহাবের অনেক আগের ছবি সামনে আসলো। ছবিটা সাদাকালো। ছবিটা দেখিয়ে শিহাব বলল,
-জামাইকে চিনছো?
-হুমম,চিনেছি। গুণ্ডার মতো দেখতে,হিহিহি। গোঁফ,মাথার চুল দেখে মনে হচ্ছে মাস্তানি করে বেড়াইছো। আজকের ভদ্র,মার্জিত কলেজ মাস্টারের সাথে কোনো মিল নেই।
-কেমন গুণ্ডা ছিলাম আজ টের পাবে।
শিহাব হাসতে হাসতে এলবাম সরিয়ে লাইটের সুইচ অফ করে শুয়ে মুক্তিকে বুকে মিশিয়ে নিল।

সকাল সাড়ে দশটায় শিহাবের মোবাইল বেজে যাচ্ছে। মুক্তি সজাগ পেয়ে উঠে গেল খাটের সাইট টেবিলে। দেখে মোবাইলের স্কিনে রাত্রি নামটা ঝলঝল করছে। মুক্তি রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কথা ভেসে আসলো,

-দাদাভাই, তোরা নাস্তা করবি না? তাড়াতাড়ি আয়!
খাবার ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। দরজায় নক করলাম তোদের
আওয়াজ পেলাম না। তাই ফোন দিলাম। অপেক্ষা করছি আয় তাড়াতাড়ি। রাখছি।
- আরে ফোনটা রেখো না। আমি তোমার দাদাভাই না।
-ও ভাবী তুমি? আগে বলবে তো! তা কখন উঠলে? রাতে ঘুম কেমন হলো? নতুন বাড়ি,নতুন মানুষ ফিলিংস কেমন?
মুক্তি হাসতে হাসতে বলল,
-বলার সময় দিলে কখন? একদমে সব গড়গড় করে বলে গেলে। আমিও মনোযোগ দিয়ে আমার লক্ষী ননদিনীর কথা শুনছিলাম। ফিলিংস দেখা হলে শেয়ার করবো।
-ওকে ভাবী। তাড়াতাড়ি আসো।

মুক্তি ফোন রেখে শিহাবকে ধাক্কা দিয়ে সজাগ করে বলল,
-তাড়াতাড়ি উঠো! রাত্রি ফোন দিয়েছিল। খাবার নিয়ে বসে আছে। আমি ফ্রেশ হতে যাচ্ছি।
মুক্তি খাট থেকে নামতেই শিহাব ডান হাত ধরে টেনে আবার বুকের সাথে মিশিয়ে নিল। ঠোঁটে আলতো করে চুমু খেয়ে বলল,
-এখনও বললে না আমাকে কেমন পছন্দ হয়েছে? পার্কে কথা বলার সময় বলছিলে বিয়ের রাতে বলবে।
মুক্তিও শিহাবের গালে ঠোঁট ছুঁয়ে আদর দিল। মাথায় হাত বুলিয়ে চুলে বিলি কেটে দিয়ে বলল,
-সবকিছু মুখে বলা যায় না। কিছু বুঝে নিতে হয়।
শিহাব দুষ্টুমির হাসি দিয়ে কানে কানে বলল,
-তোমার ঠোঁটের ছোঁয়ায় কিন্তু শিহরিত হচ্ছি। ভিতরে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। এখন কিছু ঘটে গেলে তার জন্য আমাকে দায়ী করতে পারবে না।
-বুঝতে পেরেছি। এখন এসব হবে না। এমনিতে অনেক বেলা হয়ে গেছে। এখনি উঠতে হবে।
- প্লিজ আর একবার দু'জনে সুখের সাগরে হারিয়ে যাই।
-হুমম।
মুক্তি মুচকি হেসে শিহাবের আবদারে সামিল হয়ে গভীর আলিঙ্গনে জড়িয়ে থাকে বেশকিছু সময়। ভালোবাসার উষ্ণ ছোঁয়ায় একে অপরের মাঝে হারিয়ে যায়।

মুক্তি লাল রঙের সুতি শাড়ি পরে হালকা গয়না পরে নিল। এত বেলা হয়ে গেছে। অথচ বাড়ির বউ কত দেরি করে ঘুম থেকে উঠেছে। মুক্তির খুব লজ্জা লাগছে। শিহাবটা যে কি? বড্ড ছেলে মানুষ। সাদা মনের আর্দশ একজন মানুষ। শুধু ভালোবাসা চায়,ভালোবাসতে চায়।এই মানুষটাকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেবা করতে চাই।ভালোবাসতে চাই। শিহাবকে বাথরুমে রেখেই মুক্তি খাবার টেবিলে গেল। রাত্রি ছোট মেয়েটাকে ঘুরে ঘুরে নুডুলস খাওয়াচ্ছে। মুক্তিকে দেখেই হেসে বলল,

-সরি ভাবী, তোমাদের রেখে আমরা খেয়ে নিয়েছি।
কিছু মনে করো না। দাদাভাই কই? এখনও উঠে নি?
-উঠেছে। তোমরা খেয়ে ভালো করেছো।

শিহাব নীল গেঞ্জি, ট্রাউজার পরে ডাইনিং রুমে আসলো। মুক্তিকে নিয়ে খাওয়া শেষ করে চা খেতে খেতে উঠোনে গেল। শিহাব মা,বাবার হাতে লাগানো গাছ দেখিয়ে বলল,
-এই জামরুল গাছটা মায়ের হাতের। জানো, এত জামরুল হয়। পাতার চেয়ে জামরুলই বেশি দেখা যায়। জলপাই গাছটাও মায়ের হাতের। বাড়ির উঠোন এবং বাইরে যে ফলের,ফুলের গাছ দেখবে। সবগুলো গাছ খুব ভালো ফলন দেয়। মা বেঁচে থাকতে সব সময় আশেপাশের বাড়িতে ফল পাঠাতেন। অনেক সময় টাকার সমস্যায় ফল বিক্রি করতে হতো।

মুক্তি বাড়ির সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। সবুজ গাছপালা ঘেরা ছিমছাম পুরনো একতলা একটা বাড়ি।
উঠোনের একপাশে ছোট্ট টিনের ঘর। মুক্তি ঘরটার সামনে যেতেই শিহাব বলল,
-এই ঘরটা মা,বাবার প্রথম থাকার ঘর ছিল। তখন আমাদের জন্ম হয় নি। মা,বাবার অনেক সুখের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। মা বলতেন,এই ঘরটা কখনো ভাঙবি না। দেখলে শান্তি পাই।

দুপুরে মুক্তি রান্না করে সবাইকে নিজ হাতে বেড়ে খাওয়ালো। রাত্রির হাজব্যান্ড মুক্তির রান্নার খুব প্রশংসা করলো। রাত্রি,বাচ্চা,হাজব্যান্ড নিয়ে বাসায় যাওয়ার সময় বলল,
-ভাবী, তোমার স্বামী,সংসার বুঝে নিয়েছো এখন আমার দায়িত্ব শেষ। তোমার জামাইটা ছোট বাচ্চাদের মতো।
তবে খুব ভালো মনের মানুষ। একদম আলাদা। তোমাকে খুব সুখে রাখবে।
মা মারা যাওয়ার পর থেকে ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করতোই না। খুব অনিয়ম করে চলতো।
মুক্তি রাত্রির কাঁধে হাত রেখে বলল,
-ভাইয়ের প্রতি বোনের আদর,ভালোবাসা,শ্রদ্ধা কোনো সময় শেষ হয় না। সব বোনরা ভাইদের খুব খেয়াল রাখে। তুমি একটু বেশিই দেখভাল করেছো। মা,বাবা ছাড়া বেঁচে থাকা কতটা কষ্টের তা আমি ভালো করে জানি। একটা কথা, প্রতি শুক্রবার বন্ধের দিন জামাই,বাচ্চা নিয়ে সকালেই চলে আসবা এখানে। সকালে,দুপুরে খেয়ে রেস্ট নিয়ে বিকেলে চা,নাস্তা খেয়ে তারপর যাওয়া। মনে থাকে যেন। যেহেতু সবাই জব করি। শুক্রবার ছাড়া এই আয়োজন করা যাবে না।

রাত্রি মুক্তির গালের সাথে গাল মিশিয়ে হেসে বলল,
-আমার লক্ষী আদরের ভাবী। দাদাকে নিয়ে সব সময় ভালো থাকবে। আমাকে দেওয়াত দিতে হবে না। সময় পেলে সাতদিনই আসতে পারবো। পরে না তুমি বিরক্ত হয়ে যাও!
- আমি তো বিরক্ত হতেই চাই। চলে আসবা সাতদিনই।

রাত্রি যাওয়ার পর মুক্তি সব গুছিয়ে ফ্রেশ হয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে। শিহাব পিছন থেকে মুক্তির কোমড়ে ধরে আস্তে আস্তে পেটে হাত রাখলো। চোখ বন্ধ করে চুলের গন্ধ শুকছে। নেশা ধরা চোখে ফিসফিসিয়ে বলল,
-লাল চুড়ি পরলে না কেন? নতুন বিয়ে হয়েছে। প্রতিদিন শাড়ি পরবে,সাজগোজ করবে। শাড়িতে নারীর আসল সৌন্দর্য ফুটে উঠে। যে ক'দিন ছুটিতে থাকবে শাড়ি পরবে।মুক্তি দু'হাতে কাঁচের চুড়ি পরে নিল। শিহাব মুক্তির পায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,একটা কথা অনেক আগেই মনে হয়েছিল। যেইদিন পার্কে বসে প্রথম কথা বলি তখন চোখে পড়ে। তুমি কি ভাববে তাই বলিনি। সেইদিনই মনে মনে ঠিক করে রাখি।
-কি চোখে পড়ে? আর কি ঠিক করে রেখেছেন?
-তোমার পা খুব সুন্দর। ঠিক করে রাখি তোমার পায়ের আঙুলের নখে নেলপালিশ লাগিয়ে দিব। তারপর চেয়ে চেয়ে দেখবো।
মুক্তি শব্দ করে হাসলো। মাথায় আস্তে করে ধাক্কা দিয়ে বলল,
-আসলেই আপনি একটা পাগল! এটা কোনো শখ হলো? আমার পা ছুঁতে দিব না। আমার ভালো লাগবে না। আপনার সবকিছু আমার বুকে আর মাথায় রাখবো।
আপনার হাতদুটো আমার পা স্পর্শ করলে আমার ভালো লাগবে না। তাছাড়া নখে নেলপালিশ বেশি লাগাই না। মাঝে মাঝে সুপ্তি একটু আকটু দিয়ে দেয়।
পরশু যখন বাসায় যাবো তখন সুপ্তিকে বলবো দিয়ে দিতে।
-ঠিক আছে,মহারানির নিষেধাজ্ঞার প্রতি সম্মান জানিয়ে ইচ্ছেটা বকেয়া থাকলো। এখন তাহলে অন্য কিছু হয়ে যাক।
-অন্য কিছু কি হবে?
-পাগলামি হবে।
-আবার শুরু করলে?
-বিয়ের পর নতুন কাপলরা কি করে শুনি?
শিহাব হাসতে হাসতে মুক্তিকে টেনে লোমশ বুকে নিবিড় আলিঙ্গনে জড়িয়ে রাখে। মুক্তির এলোমেলো চুল
শিহাবের চোখ,মুখ ঢেকে ফেলে।

ছুটি শেষ হওয়ার দু'দিন আগে মুক্তি শিহাবকে নিয়ে
মায়ের কাছে গেল। শিহাব শ্বশুরবাড়ির জন্য বড় দুটো রুইমাছ,মিষ্টি,দই নিল। মুক্তিকে কাছে পেয়ে মা পরম মমতায় বুকে জড়িয়ে ধরে। মেয়ের শ্বশুর বাড়ির কথা জেনে খুব খুশি হন। শিহাব মুক্তির বাসায় এসে সবাইকে আপন করে নিয়েছে। শিহাবের কথা শুনে,ব্যবহার দেখে কেউ মনে করবে না এ বাড়িতে প্রথমবার এসেছে। সুপ্তিকে তুই করে ডাকা শুরু করলো। ড্রইং রুমে বসে শিহাব টিভি দেখছিল। সুপ্তিকে ডেকে বলল,

-দুপুরে খাওয়ার পর তোর বুবুকে পায়ের আঙুলের নখে নেলপালিশ লাগিয়ে দিবি।
সুপ্তি ফিক করে হেসে দিল। কৌতুহল চোখে বলল,
-পায়ের নখে কেন?
-তোর বুবুর পা সুন্দর। নেলপালিশ দিলে সুন্দর দেখাবে।
-বাব্বা,এই তিনদিনে এত প্রেম! জমে একদম ক্ষীর হয়ে গেছে। ওকে এখনি দিয়ে দিচ্ছি। প্রাণভরে দেখে নিয়েন।
সুপ্তি ঘর থেকে বের হবে এমন সময় আশিক এসে ড্রইং রুমে ঢুকলো। শিহাব বলল,
-আরে শালাবাবুর এতক্ষণে আসার সময় হয়েছে?
বোনটাকে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে আর খবর নেই।
আশিক হেসে বলল,
- বুবু,দুলাভাইয়ের খবর নিতেই তো এলাম।
-সুপ্তি যা তো আশিকের জন্য দই,মিষ্টি নিয়ে আয়!
আশিক ভিতরে যেতে যেতে বলল,
-আগে বুবুকে দেখে আসি। তারপর দই,মিষ্টি খাবো।
আশিক যাওয়ার পর শিহাব রিমোট চেপে টিভি চ্যানেল
ঘুরিয়ে খবরে চোখ রাখলো।

দুপুরে সবার সাথে খেতে বসে শিহাব বলল, দু'জনেই মন দিয়ে লেখাপড়া করবি। ভালো জায়গায় ভর্তি হওয়া চাই। দু'জনেই যদি ভালো জায়গায় ভর্তি হতে পারিস তোদের জন্য আমার তরফ থেকে গিফট আছে। আশিক তাড়াতাড়ি বলল,দুলাভাই প্লিজ, আমার গিফটটা বলে দিন। সেটার লোভে অনেক লেখাপড়া করবো। এমনিতে আমার পড়ায় মন নেই। কারোর উৎসাহ পেলে,উপহার পেলে খুব পড়তে ইচ্ছে করে। সুপ্তির গিফট লাগবে না। ও এমনিতেই খুব পড়ে। আমার এত ধৈর্য নেই।
শিহাব হেসে বলল,উপহার আগে বলে দিলে মজা থাকে না। এমনও হতে পারে তুই যা প্রত্যাশা করছিস তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু পেয়ে যাবি।

বিকেলে রশিদ সাহেব ঘর থেকে বেরোনোর সময় সুহানাকে বলল,রাতে জামাইসহ মুক্তি,সুপ্তি তার মা আমাদের এখানে খাবে। বাজার তো ফ্রিজে আছে।
থানার গেইটের দারোয়ান মফিজের বউ,মেয়েকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। ওরা এসে হাতে হাতে কাজ করে দিয়ে যাবে। তোমার রান্নাটা তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। আলমারিতে দশ হাজার টাকা রাখা আছে। ঐখান থেকে আট হাজার টাকা মুক্তির হাতে দিও। বিয়েতে কিছু দেইনি। আমার ফিরতে দেরি হতে পারে। বারোটার পর টহলে যাবো। এখন মুক্তি,শিহাবকে খাওয়ার কথা বলে যাচ্ছি।
রশিদ সাহেব কথাগুলো বলে দ্রুত ঘর থেকে বের হলেন।
------চলবে
মাকসুদা খাতুন দোলন

Arbaj khan, Sahin kondokar, Akaram khan, Jalsan khan, Naimul islam, Feroz hassan, Risbi mahin and লেখাটি পছন্দ করেছে

avatar
Shamim
ধুমকেতু
ধুমকেতু
Posts : 23
স্বর্ণমুদ্রা : 1110
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-06-01

মাতৃত্বের স্বাদ - Page 2 Empty Re: মাতৃত্বের স্বাদ

Wed Jul 28, 2021 6:16 pm
মাতৃত্বের- স্বাদ(১৭)

মুক্তি শিহাবকে নিয়ে মায়ের কাছে একদিন থেকে চলে আসলো। পাঁচদিনের ছুটি শেষ করে দু'জনে কলেজে জয়েন করলো। শিহাব স্টুডেন্ট পড়ালেও মুক্তি পড়ায় না। কলেজ সময় বাদে বাকি সময় সংসারের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। পুরানো ছোট্ট বাড়িটিকে পরিস্কার করে গুছিয়ে তকতক করে রাখে। শিহাব বাসায় থাকলে মুক্তি র কাজে সব সময় হেল্প করে। প্রায় দেড়মাস পর চাইনিজ রেস্টুরেন্টে বৌভাতের অনুষ্ঠান করে কলিগ,খুব কাছের লোকজনকে দাওয়াত করে খাওয়ালো। প্রোগ্রামে বিভিন্ন উপঢৌকনের সাথে যা টাকা পেয়েছে।
দু'জনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সেই টাকা মৃত মা,বাবার নামে এতিমখানায় দান করে দিল। মুক্তি প্রতিদিন সকালে আর না হলে সন্ধ্যার পর মা,বোনের সাথে ফোনে কথা বলে খবর নেয়। একদিন সন্ধ্যায় দু'জনে চা খেতে খেতে গল্প করছে। মুক্তি ভাবছে চা শেষ করেই ফোনে মায়ের সাথে কথা বলবে। তার আগেই মোবাইল বেজে উঠলো। মায়ের কল দেখে রিসিভ করলো। সুপ্তি কেঁদে কেঁদে বললো,'বুবু, মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে! হঠাৎ বুকে খুব ব্যথা হয়। হসপিটালে নিয়ে আসছি।' সাথে সাথেই মুক্তির হাত থেকে চায়ের কাপ পড়ে ভেঙে যায়।

শিহাবকে নিয়ে এক কাপড়ে ছুটে আসলো হসপিটালের
ইমার্জেন্সি বিভাগে। এসে দেখে রশিদ সাহেব ডাক্তারের সাথে কথা বলছেন। পাশেই সুপ্তি আশিককে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুক্তির ছায়া দেখামাত্রই সুপ্তি বোনকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কান্না শুরু করলো। মুক্তি নিঃশব্দে শুধু চোখের পানি ফেলছে। সুপ্তির মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করে বলল,
'মায়ের কিচ্ছু হবে না। দেখিস মা সুস্থ হয়ে উঠবেন। মা'কে সুস্থ করে তুলবোই।'

ডাক্তার সবকিছু দেখে দ্রুত শহরের হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হসপিটালে নিয়ে যেতে বললেন। রাতেই
হৃদরোগ হসপিটালে ভর্তি করানো হলো। ইসিজি,ইকো
আরও বিভিন্ন টেস্ট করানোর পর রিপোর্টে হার্টে তিনটি ব্লক ধরা পড়লো। ডাক্তার জানালেন দ্রুত অপরাশেন করে রিং পড়াতে হবে। অপারেশন,হসপিটালের চার্জসহ প্রায় দুই,আড়াই লাখ টাকা লাগবে। সব শুনে মুক্তির শরীর দুশ্চিন্তায় অবশ হয়ে যায়। চোখে চোখে,মুখে আঁধার দেখে। এতগুলো টাকা কোথায় পাবে? মায়ের একাউন্ট ফাঁকা। দু'জনের জমানো যা ছিল বৌভাতের প্রোগ্রামে খরচ হয়েছে। শিহাব সবকিছু বুঝতে পেরে টেনশন করছে। মুক্তির মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
'আল্লার উপর ভরসা রাখো। টেনশন করো না।' মুক্তি চুপ থেকে শুধু ভেবে যাচ্ছে। একটু সরে গিয়ে ফোন করলো পরিচিত জুয়েলার্সের মালিক মহাদেব কর্মকারকে,

'কাকা, মায়ের শরীর খুব খারাপ। হসপিটালে ভর্তি করেছি। আপনাকে ভীষণ প্রয়োজন। আমি এখনি আসছি।'
উনার কাছ থেকেই মুক্তির বিয়ের গয়না বানানো হয়। মুক্তিদের পরিবারের সাথে ভালো উঠা-বসা আছে। সুপ্তি
আশিককে মায়ের কাছে রেখে শিহাবকে নিয়ে বাসায় আসলো মুক্তি। আলমারি থেকে সব গয়না নিয়ে ছোট্ট ব্যাগে ঢুকিয়ে বলল,
চলো,গয়নাগুলো কাকার কাছে রেখে টাকা নিয়ে আসি। এই মূহুর্তে এছাড়া কোনো উপায় দেখছি না। কারো কাছে টাকা ধার চাইতে পারবো না।
শিহাব মুক্তির সিদ্ধান্ত শুনে অবাক চোখে বলল,

'শখের গয়না বন্ধক রাখবে? রাত্রি তার জামাইকে
জানিয়ে দেখতে পারি। একটা ব্যবস্থা হবে।'
ননদের কাছ থেকে ধার করেই তো আনতে হবে। সে ধার পরিশোধ করতে হবে। গয়না গুলো ঘরেই পড়ে আছে। কাকার কাছে রেখে টাকা এনে প্রতিমাসে বেতন থেকে একটা নির্দিষ্ট হারে পরিশোধ করলেই অনেক বেশি সম্মানজনক। কারো কাছে ধার চাইতে হলো না। সমস্যার কথা কেউ জানলো না। সুপ্তি, মা জিজ্ঞেস করলে বলবো আমরা দু'জন মিলেই দিয়েছি।'
শিহাব মুক্তিকে বুকে টেনে নিল। মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত গলায় বলল,
' এই মূহুর্তে আমার অনেক কিছু করার ছিল। আর্থিক দুর্বলতার কারণে কিছুই করতে পারলাম না। আমার অক্ষমতাকে ক্ষমা করো।'
'তোমার কোনো অক্ষমতা নেই। দু'জনের সংসার। সংসারের ভালো-মন্দ দু'জনেই বুঝবো। এখন চলো। দেরি হয়ে যাচ্ছে।'

মুক্তি মহাদেবের কাছে সব গয়না রেখে আড়াই লাখ টাকা নিয়ে রাতেই ফিরলো হসপিটালে। ডাক্তারকে বলল,' টাকার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। কালকেই মায়ের অপারেশন করতে চাই। যে করে হোক মা'কে সুস্থ করে তুলতে হবে।' ডাক্তার আশ্বস্ত করে বললেন, 'পরদিন সকাল দশটায় আপনার মায়ের ওপেন হার্ট সার্জারি করে রিং পড়ানো হবে। কোনো রকম টেনশন করবেন না। আমরা আপনার মা'কে সুস্থ করে তুলতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। আল্লাহকে ডাকুন। সব ঠিক হয়ে যাবে।'
পরদিন মিসেস করিমকে দশটায় ওটিতে নেওয়া হলো।
দীর্ঘ সময় পর ডাক্তার ওটি থেকে বের হয়ে বললেন,
অপারেশন ভালোভাবে সম্পূর্ণ হয়েছে। তবে জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত কিছুই বলা যাবে না। ওটির বাইরে সবাই অপেক্ষা করছে। রশিদ সাহেব কেবিন ঠিক করে শিহাবের সাথে কথা বলছেন। ঠিক তখনই ফোন আসলো। ফোনে কথা শেষ করে রশিদ সাহেব মুক্তিকে বললেন, জরুরি কাজে চলে যাচ্ছি। আশা করি তাড়াতাড়ি ওনার জ্ঞান ফিরবে। কোনো টেনশন করবে না। আবার আসবো।'

দুপুরের দিকে মিসেস করিমের জ্ঞান ফিরলে তাঁকে কেবিনে নেওয়া হলো। ডাক্তার জানালেন কিছুদিন তরল খাবার দিতে হবে। মুক্তি বাসা থেকে স্যুপ,তরল খাবার রান্না করে হসপিটালে চলে আসলো। মায়ের অসুস্থতার জন্য কলেজ থেকে চারদিনের ছুটি নিল। শিহাব কলেজ, স্টুডেন্ট পড়ানোর সময়টুকু বাদ দিয়ে শাশুড়ির কাছে থাকে,গল্প করে। দুই মেয়ের সেবায় মিসেস করিম ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠেন। হসপিটাল থেকে রিলিজ দিলে মুক্তি মাকে নিয়ে বাসায় চলে আসলো।

সুপ্তি ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। মায়ের অসুস্থতার জন্য শহরে কোচিং করা বাদ দিয়ে ঘরেই মন দিয়ে লেখাপড়া করছে। মুক্তি সুযোগ পেলেই ভালো ভালো খাবার রান্না করে,ফলফ্রুট নিয়ে শিহাবকে সাথে করে মায়ের কাছে চলে। নিজের হাতে মা'কে পছন্দের খাবার মুখে তুলে খাইয়ে দেয়। মা,বোনের সাথে গল্প করে কিছু সময় থেকে চলে আসে। ধীরে ধীরে মিসেস করিম অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেন। হাঁটাচলা করতে পারলেও পরিশ্রমের কোনো কাজ করতে পারেন না। আশিক গ্রাম থেকে পরিচিত একটা ছোট মেয়ে এনে দেয়। সেই মেয়ে আর সুপ্তি ঘরের সব কাজ,রান্নাবান্না করে।

একরাতে রিয়ার নানাবাড়ি থেকে ফোন আসলো। নানা খুব অসুস্থ। পরদিন খুব ভোরে রশিদ সাহেব মেয়েসহ সুহানাকে নিয়ে শ্বশুর বাড়ি চলে গেলেন। একদিন থাকার পর সুহানাকে বাপের বাড়ি রেখে চলে আসলেন।
সুহানা যাওয়ার আগে স্বামীর জন্য রান্না করে ফ্রিজে রেখে যান। রশিদ সাহেব ঐ খাবার গরম করে খান।
মাঝে মাঝে সুপ্তি কাজের মেয়েটাকে দিয়ে খাবার পাঠিয়ে দেয়।

একমাস মেডিকেল ছুটি কাটিয়ে মিসেস করিম স্কুলে জয়েন করেন। পনেরো দিন পর সুপ্তির রেজাল্ট হলো।
আশিক,সুপ্তি দু'জনেই খুব ভালো রেজাল্ট করে। মেয়ের রেজাল্ট শুনে মিসেস করিম রোগাটে শরীরটাতে যেন প্রাণশক্তি ফিরে পেয়েছে। দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে।
রেজাল্ট পেয়েই আশিক মিষ্টি নিয়ে সুপ্তিদের বাসায় আসলো। হাসতে হাসতে মিসেস করিমের পা ছুঁয়ে সালাম করে বলল,'চাচি তুমি আমার মাথায় আবার একটু ছুঁয়ে দোয়া করে দাও। সামনে যেন আরও ভালো করতে পারি। মিসেস করিম প্যাকেট থেকে মিষ্টি নিয়ে সুপ্তির মুখে একটা দিল আর একটা দিল আশিকের মুখে। আশিক মিষ্টি নিয়ে মিসেস করিমের মুখের সামনে ধরে বলল,'হা করো। তোমাকে খাইয়ে দিব। মিসেস করিম অল্প একটু মিষ্টি ভেঙে মুখে নিলেন। তারপর বললেন, তোর মা,বাবাকে মুখে তুলে খাইয়ে দিস। অনেক খুশি হবে।' আশিক বলল,'জানো চাচি, মা এই সব ফিলিংস বুঝে না। মা অন্য জগতের মানুষ। তুমি আর মা আমার কাছে সমান। মা'কে যেমন ভালোবাসি ঠিক তোমাকেও তেমন ভালোবাসি।' মিসেস করিম আছরের ওযু করতে চলে গেলেন। আশিক সুপ্তির খুব কাছে গিয়ে হেসে বলল,
-তোর কথাগুলো মেনে মন দিয়ে লেখাপড়া করছি।
মনে রাখিস। কোনো জায়গায় চান্স হলে তারপর কিন্তু ......
-তারপর কি?
সুপ্তির নাক টিপে বলল,
-তোর নাকের ঘি। বুঝিস না কিছু? থাক,এখন বুঝার দরকার নেই।
-আধা আধা কথা বললে কে বুঝবে? তোর মতো আমার মাথা এত ভালো না বুঝছোস? এখন বল চা খাবি কিনা?
-তোর হাতের চা আবার খাবো না? বড় মগে দিস।
আশিক চা খেয়ে বাসায় চলে গেলো।

সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে সুপ্তি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।
হিম পবনের মৃদ আলিঙ্গনে বাগান বিলাস গাছের পাতাগুলো দুলছে। সুপ্তির মনের আঙিনায় রঙিন এলোমেলো ভাবনাগুলো দোলা দিয়ে যাচ্ছে। গ্রিলের ফাঁক দিয়ে হাত বাড়িয়ে বাগান বিলাস গাছ থেকে কয়েক থোকা ফুল হাতে নিল। ফুলগুলো নড়াচড়া করছে আপনমনে বিড়বিড় করে বলছে,
"বসন্তের ফুল ফুটেছিল
মনের কাননে
অসময়ে ঝরে গেল
অশ্রু দু'নয়নে
কেন সে এসেছিল
খুব গোপনে
জায়গা করে নিয়েছিল
হৃদয় কোণে,,
রশিদ সাহেব গেইট খুলে ভিতরে ঢুকলো।সুপ্তিকে দেখেই হেসে বলল,
-অভিনন্দন। আমি জানতাম তুমি খুব ভালো ফলাফল করবে। আশিকের সাথে পথে দেখা হলো। ওর কাছ থেকে দু'জনের রেজাল্ট শুনলাম।
-দুপুরে কোথায় খেলেন? আজ বাসায় আসলেন না যে?
-বাইরে খেয়েছি। কাজ ছিল।
-চা করবো?
-করো,কাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে আসছি।

সুপ্তি ভিতরে এসে ওযু করে মাগরিবের নামাজ পড়ে চা বানাতে গেল কিচেনে। ফ্রিজে সেদ্ধ করা নুডুলস,সবজি ছিল। এক চুলায় চা করলো। অন্য চুলায় দ্রুত নুডুলস ভেজে নিল। রশিদ সাহেব এসে মিসেস করিমের সাথে
কথা বলছেন। সুপ্তির ভর্তির ব্যাপারে পরামর্শ দিচ্ছেন।
মিসেস করিম কথার মাঝে বললেন,রিয়া তার মা'কে নিয়ে আসেন। রিয়া ছাড়া বাসা একদম ফাঁকা লাগে। মুক্তিও শ্বশুরবাড়ি চলে গেলো। বাসাটা কেমন জনশূন্য মনে হয়। সুপ্তি চা,নাস্তা নিয়ে আসলো। চা খেতে খেতে সুপ্তিও ওনাদের কথা শুনেছ। চা খাওয়ার পর রশিদ সাহেব আরও কিছুক্ষণ কথা বললেন। চলে যাওয়ার সময় মিসেস করিম বললেন,রাতের খাবার পাঠিয়ে দিব? তিনি হেসে বললেন,আজ রাতে আর কিছু খাবো না। কথা শেষ করে ওনি চলে গেলেন।

সকালে মিসেস করিম স্কুলে চলে যাওয়ার পর রশিদ সাহেব একটা প্যাকেট সুপ্তির হাতে দিয়ে বলল,
-ভালো রেজাল্ট করেছো। এটা তোমার জন্য। এখনি পরে আসো। দেখে তারপর বের হবো।
সুপ্তি প্যাকেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কি বলবে বুঝতে পারছে না। চুপ থেকে বলল,
-এটা না নিলে হয় না? কেন এইসব করেন?
-না হয় না। যা বলছি করো। যেইদিন প্রথম এডমিশন পরীক্ষা দিতে যাবে। এই ড্রেসটা পরে যাবে।
সুপ্তি ড্রেস পরে সামনে আসলো। রশিদ সাহেব দেখে হাসলো। যাওয়ার সময় হেসে বলল,
-খুব সুন্দর! তোমাকে দারুণ মানিয়েছে। আয়নায় গিয়ে দেখো। আমি বের হচ্ছি। আমার জন্য খাবার করো না। ফিরতে দেরি হবে। খেয়ে আসবো।
সুপ্তি মুচকি হেসে বলল,
-ড্রেসটা খুব সুন্দর। পছন্দ হয়েছে।
ধন্যবাদ জানিয়ে রশিদ সাহেব চলে গেলেন।
মুক্তি ফোন করে সুপ্তির রেজাল্ট জেনে খুব খুশি হয়।
কোচিং এ ভর্তি হয়ে মন দিয়ে লেখাপড়া করতে বলল।
আশিক,সুপ্তি দু'জনেই এক কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়ে একসাথেই আসা যাওয়া করে। মাঝে মাঝে মুক্তির বাসায় দুপুরে খেয়ে রেস্ট নিয়ে বিকেলে আসে। মাকে একা থাকতে হবে তাই মুক্তির বাসায় থেকে ক্লাস করতে পারে না। যেয়ে যেয়ে ক্লাস করে,পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে।

এক সন্ধ্যায় রশিদ সাহেব মিসেস করিমকে জানালেন, '
-আমার একটা নিউজ আছে। বাসাটা ছেড়ে দিচ্ছি। আপনাদের ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে। বলতে খুব কষ্ট হচ্ছে আর্জেন্ট সিলেট থানায় জয়েন করতে হচ্ছে। আগামী
পরশু চলে যাচ্ছি।
কথাটা শেষ করেই রশিদ সাহেব গম্ভীর হয়ে মাথা নিচু করে রাখেন। মিসেস করিমের মনটা খারাপ হয়ে গেলেও
স্বাভাবিকভাবে বললেন,
-বদলির জব। এক জায়গায় বেশিদিন থাকা যায় না।
যদি পারেন এই থানায় আবার আসবেন। খবরটা শুনে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। আপনাদের নিজের পরিবারের সদস্যই ভেবেছি। রিয়া,তার মায়ের জন্য ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। শেষ দেখা হলো না।
খবরটা শোনার পর সুপ্তির দু'চোখ জলে ভিজে উঠে।
নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলে। সুপ্তির চোখে পানি দেখে রশিদ সাহেবের ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। মিসেস করিমের সামনে সুপ্তিকে কিছু বলতে পারছে না। চোখের পানি মুছে দিতে পারছে না। ভিতরে প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। থানার কাজের কথা বলে দ্রুত বের হয়ে গেলেন।

সকালে মিসেস করিম স্কুলে চলে যাওয়ার পর রশিদ সাহেব সুপ্তির কাছে আসলেন। সুপ্তি আজ কোচিং ক্লাসে যাইনি। টেবিলে বসে বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।
রশিদ সাহেব সুপ্তির সামনে ছোট্ট প্যাকেট ধরলো।
-এটা কি?
-মোবাইল। কোন চিন্তা করবে না। যেকোন সমস্যা হলে
ফোন করবে। যেখানেই থাকি চলে আসবো। মন দিয়ে লেখাপড়া করবে। আমার উপর বিশ্বাস রাখো। সিলেট মেডিকেলে চান্স হলে তো সবকিছু সেটআপ হয়ে গেলো।
সুপ্তি কেঁদেই যাচ্ছে। কোনো কথা বলছে না। রশিদ সাহেব চোখ মুছে বলল,
-কেনো কাঁদো বলো তো? কতবার বলেছি কাঁদবে না।
তুমি কাঁদলে আমার কষ্ট হয় বুঝো না? জীবনটা নিজের। তাই নিজের সিদ্ধান্তই আসল। সবকিছু পরিকল্পনা করে জীবন এগিয়ে চলে না। অপ্রত্যাশিত বা অনাকাঙিক্ষত কিছু ঘটে যায়। সব প্রতিকূলতাকে কাটিয়ে সামনে চলতে হয়,নিজেকে ভালো রাখতে হয়। এবার একটু হাসো লক্ষী মেয়ে!
সুপ্তি মলিনমুখে একটু হাসলো।

রশিদ সাহেব বদলি হয়ে চলে গেলেন। সুপ্তি মনোযোগ সহকারে লেখাপড়া করছে। মোবাইলটা গোপন রাখলো।
বাসার বাইরে থাকলে সুপ্তি যোগাযোগ করে। বাসায় মোবাইল বন্ধ করেই রাখে। মুক্তি এক রাতে ফোন করে মাকে জানালো,
-মা শরীর খুব খারাপ। কিছু খেতে পারি না। প্রচুর বমি হয়। নামাজ পড়ে দোয়া করো আমার জন্য।
মিসেস করিম মেয়ের সুখবর আছে বুঝতে পারে। হেসে
বললেন,
-মা ডাক শুনতে হলে এমন তো হবেই মা! মাতৃত্বের স্বাদ অমৃত। যে নারী মা হয়নি সে বুঝবে না কেমন অনুভূতি।
সাবধানে থাকিস মা! সকালে কলেজে যাওয়ার আগে আইতুল কুরসি পড়ে ফুঁ দিয়ে বের হবি। তিনমাস খুব সাবধানে থাকতে হবে। ভারি কিছু তুলবি না।
মুক্তি মায়ের কথা শুনে লজ্জা পেল। মায়ের কথাগুলো
খুব ভালো লাগে। মা তো ঠিকই ধরেছেন। আমি মা হতে চলেছি। মুক্তি আস্তে করে তার নিজের পেটে বামহাতটা রাখলো। তারপর হেসে বলল,
-মা,তুমি ঠিক ধরেছো। আমি কনসিভ করেছি। শিহাব
খুশিতে আত্মহারা। শুনেই আমাকে কোলে নিয়ে সারা ঘরে ঘুরলো। তোমার জামাই একটা পাগল। খুব ছেলে
মানুষ। তবে খুব ভালো মনের মানুষ।
-আমি জানি মা। শিহাবের মতো ছেলে হয় না। তোদের সুখ জেনে আমার শরীর থেকে সব রোগ ওধাও হয়ে যায়। এখন সুপ্তির সবকিছু ভালোয় ভালোয় হলেই আল্লার কাছে আমার আর কিছু চাওয়ার নেই। বিশ্রাম নে। এখন রাখছি।

পরদিন সুপ্তি কোচিং এ যাবে আশিককে সাথে নিয়ে । মিসেস করিম ঘরে বানানো কয়েক প্রকার আচার,শুটকির তরকারি টিফিন বক্স ভরে দিল মুক্তির জন্য। সুপ্তি কোচিং শেষ করে খাবার নিয়ে বাসায় পৌঁছেই মুক্তিকে জড়িয়ে ধরলো,
-বুবু দেখিস তোর টুইন বেবি হবে। আমি রাতে কাগজে লিখে পরীক্ষা করেছি তিনবার। তিনবারই তোর টুইন বেবি উঠেছে। আমার যে কি খুশি লাগছে! আমি এখন থেকেই নাম ঠিক করে রাখবো।
-আচ্ছা রাখিস। এখন হাতে, মুখে পানি দিয়ে আয়!
খাবার বাড়ছি।
আশিক ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে বলল,
-মুক্তি বু তুমি উঠবে না। এই সুপ্তি চল্ তুই আর আমি খাবার টেবিলে দেই। বু কলেজ করে আসছে।
মুক্তি আশিকের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
-এত মায়া করিস কেন? বল তো? মরে গেলে কি করে থাকবি?
আশিক মুক্তির মুখে হাত রেখে বলল,
-আর একবার মরার কথা বলবে না। এখন চলো খেতে বসি। পেটে খুব ক্ষুধা। সেই সকালে খেয়েছি।

খাওয়া শেষ করে আশিক সুপ্তিকে নিয়ে বিকেলেই মুক্তির বাসা থেকে বাড়িতে চলে আসলো।

------চলবে
মাকসুদা খাতুন দোলন

Umma Mejana khatun, Hikmatullah khan, Md amanul, Rahan balich, Nandita dev, Neet kundal, Shohag islam and লেখাটি পছন্দ করেছে

avatar
Shamim
ধুমকেতু
ধুমকেতু
Posts : 23
স্বর্ণমুদ্রা : 1110
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-06-01

মাতৃত্বের স্বাদ - Page 2 Empty Re: মাতৃত্বের স্বাদ

Wed Jul 28, 2021 6:16 pm
মাতৃত্বের-স্বাদ (১৮)

রাতে শিহাবকে খাবার বেড়ে দিয়ে পাশে বসে টুকটাক কথা বলছে মুক্তি। খেতে ইচ্ছে করছে না। শিহাব বারবার খেতে বলছে। মাছের তরকারি দিয়ে ভাত মেখে মুক্তির মুখের সামনে ধরে বলল, না খেলে শরীর আরও দুর্বল হবে। বমি হলেও জোর করেই খেতে হবে।' মুখে হাত চেপে মুক্তি বলল,' কেন জানি মাছের গন্ধটা সহ্য হচ্ছে না। দিও না। এখনি বমি চলে আসবে। তুমি খাওয়া শেষ করো। তরকারি দিয়ে না খেয়ে ডালের সাথে আচার মিশিয়ে একটু ভাত খাবো।' শিহাব খাওয়া শেষ করে মুক্তির জন্য ডাল,ভাত মেখে বলল,'এবার আচার মিশিয়ে খাও। মুখে রুচি হবে।' মুক্তি আচার মিশিয়ে অল্প একটু ডাল ভাত খেলো। শিহাব খাবার টেবিল গুছিয়ে খাটের মশারি টাঙিয়ে মুক্তিকে বলল,শরীর খারাপ লাগলে শুয়ে পড়ো। আমি টিভি নিউজ দেখে তারপর আসছি। শিহাব ড্রইং রুমে চলে আসলো। মুক্তি ওযু করে এশার নামাজ পড়ে কিছু সময় দোয়া দুরুদ পড়লো। চুল আঁচড়ে বিনুনি করে ড্রইংরুমে শিহাবের পাশে বসে বলল,চল্ এবার শুতে যাই। সকালে তোমার পড়ানো আছে। শিহাব মুক্তিকে জড়িয়ে নিজের কাঁধে মুক্তির মাথা রেখে আস্তে করে বলল,এই আর দশ মিনিট। তারপর শুতে যাবো। মুক্তি শান্তিতে চোখ বুঁজে রইলো। শিহাব আপনমনে টিভি নিউজ শুনছে। মুক্তি শান্ত গলায় বলল,একটা বিষয় তোমাকে শেয়ার করবো। কবে থেকেই ভেবে যাচ্ছি। শিহাব টিভির ভলিউম কমিয়ে বলল, কি শেয়ার করবে? মুক্তি কাঁধ থেকে মাথা তুলে সোজা হয়ে বসলো। তারপর বলল,

সুপ্তি আর আশিকের কথা। সুপ্তির আচরণ বুঝতে পারি না। সুপ্তি খুব চাপা স্বভাবের মেয়ে। তবে আশিক সুপ্তিকে খুব পছন্দ করে,ভালোবাসে। আশিককে ছোট ভাইয়ের চোখেই দেখি। আমি চাই ওদের লেখাপড়া শেষ হলে আশিক সুপ্তিকে বিয়ে করুক। চাচা রাজি থাকলেও চাচি মরে গেলেও রাজি হবেন না। মাও সব জেনেশুনে
নিজেদের মধ্যে আত্মীয়তা করবেন না মনে হয়। শিহাব
বলল,আমি আগেই বুঝতে পেরেছি আশিক সুপ্তিকে পছন্দ করে। দু'জনে আগে ভালো জায়গায় ভর্তি হোক। লেখাপড়া শেষ করে আশিক কিছু একটা করা শুরু করলে আমরাই বিয়ে দিয়ে দিব। সব সংসারে এই রকম ঝামেলা থাকে। পরে আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যায়।

সময় যেতে লাগলো। ফাইনাল মডেল টেস্ট শুরু হলে সুপ্তি দুটো পরীক্ষা দিয়ে পরের পরীক্ষা দিতে যাবে সকাল থেকে হালকা জ্বর। মাথা ঘুরে পড়ে যায়। অসুস্থ বোধ করলে মিসেস করিম পরীক্ষা দিতে মেয়েকে নিষেধ করেন। সারাদিন শুয়ে থাকে। স্কুল থেকে ফিরে মিসেস করিম গোসল,নামাজ শেষ করে মেয়ের রুমে আসেন। দেখেন সুপ্তি কাঁথা নিয়ে শুয়ে আছে। কপাল ছুঁয়ে বলল, জ্বর তেমন নেই । জ্বর মেপেছিলি? সুপ্তি চোখ মেলে বলল,না মাপিনি। কপালে হাত রেখেই মা বললেন,সকালে তেমন কিছু খেলি না। এখন উঠ। চল্ খেয়ে নাপা খেয়ে নে। সামনে পরীক্ষা। এখন অসুখ বাঁধিয়ে বিছানায় পড়ে থাকলে হবে? সুপ্তি মায়ের কথায় শুনে কিছু বলল না। সাথে সাথে উঠে খাবার টেবিলে গেল।
মায়ের সাথে টেবিলে খাবার আনার কাজে হাত লাগালো। অর্ধেক খাওয়ার পর দৌড়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। গলগল করে বমি করলো। মুখ ধুয়ে ক্লান্ত শরীর নিয়ে আবার খাবার টেবিলে বসলো। মিসেস করিম মেয়ের বমি হয়েছে বুঝতে পেরে বলল,
-বমি হলো?
সুপ্তি মাথা নিচু করে বলল,
-হুম।
-বাইরে কিছু হাবিজাবি খেয়েছিলি? ঝালমুড়ি দেখলে তোর তো আবার হুঁশ থাকে না। ছোলা,ঘুগনি ক'দিনের পুরনো ছিল কে জানে?
-কালকে ঐসব কিছু খাইনি মা!
-লেবু নিয়ে ভাত খাওয়া শেষ কর। সন্ধ্যায় ডাক্তারের কাছে যাবো।

সন্ধ্যায় মিসেস করিম সুপ্তিকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চাইলে সুপ্তি জানালো শরীর ঠিক হয়ে গেছে। ডাক্তারের কাছে যেতে হবে না। রাতে মা ঘুমিয়ে গেলে রশিদ সাহেবের মোবাইলে কয়েকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করে সুপ্তি। যতবার ফোনে ট্রাই করেছে। ততবার বন্ধ পেয়েছে। কয়েকটি পরীক্ষা দিয়ে আর দিতেই পারলো না। দিনে দিনে আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে।
মিসেস করিম সন্ধ্যায় মুক্তিকে ফোন করে বলল,

-হঠাৎ করে সুপ্তির যে কি হলো। বুঝতে পারছি না। কিছুই খেতে পারে না। শুকিয়ে রোগাটে হয়ে যাচ্ছে। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চাইলাম। বলল,আমি ভালো হয়ে যাচ্ছি। ডাক্তারের কাছে যেতে হবে না।
সামনে পরীক্ষা। লেখাপড়াও তেমন করে না। দেখতো কি করি?তোকে ফোন দেইনি কারণ, সারাদিন ব্যস্ত থাকিস কলেজ,সংসার নিয়ে। তোর নিজের শরীরও ভালো নেই। ঐদিন বললি শিহাবের স্টুডেন্টের পরীক্ষার খাতা দেখছিস। তাই তোকে বিরক্ত করিনি।

মুক্তি সব শুনে বলল, খাতা দেখা শেষ হয়ে গেছে। যদি পারি কালকে আর না হয় পরশুদিন আসবো। মা, তুমি সুপ্তিকে ফোনটা দাও।
মোবাইল সুপ্তির হাতে দিয়ে মিসেস করিম কিচেনে গেলেন। সুপ্তি শুয়ে মোবাইল কানে ধরে আছে। ঐপাশ থেকে মুক্তি বলল,
-কিরে, কি হয়েছে?
-শরীর ভালো নেই।
-আশিকের সাথে রাগারাগি হয়েছে?
-ওর সাথে রাগারাগি হবে কেন?
-তাহলে?
সুপ্তি চুপ থাকে। চোখের কোণে পানি জমে। কিছুই বলতে পারছে না। মুক্তি বলল,
-চুপ করে আছিস কেন? আচ্ছা রাখছি। কিছুই বলতে হবে না।
সুপ্তি কথা শেষ করে নিজের মোবাইল নিয়ে দরজা লাগিয়ে রশিদ সাহেবের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলো। এবারও মোবাইল বন্ধ পায়।

একদিন পর মুক্তি কলেজ থেকে বাসায় এসে শিহাবকে বলল,আজ বিকেলের দিকে একটু মা'কে দেখতে যাবো।
তোমার যেতে হবে না। রাতটা থেকে কালকে ভোরে চলে আসবো। শিহাব শার্টের বোতাম খুলছিল। মুক্তির কথায় অনেকটা আশ্চর্য হলো। মুক্তি কখনোই শিহাবকে ছাড়া একা কোথাও যায় না। আজ হঠাৎ বিকেলবেলা অসুস্থ শরীর নিয়ে একা যেতে চাইছে কেন? শার্টের অর্ধেক বোতাম খুলে মুক্তির কাছে এসে বলল, তোমার শরীর কি আগের মতো আছে? ইচ্ছে হলেই হুটহাট চলে যাবে। এখন তুমি একা নও। তোমার ভিতরে যে ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে তার কথা ভাববে না? তোমাকে একা যেতে দিব না। আমিও যাচ্ছি সাথে। মুক্তি কথা শুনতে শুনতে শার্টের বাকি বোতাম খুললো। গা থেকে শার্ট খুলে হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে বারান্দার রশিতে রাখলো। এরপর বলল, এত ভাবতে হবে না। আমি আল্লার রহমতে সুস্থ আছি। তোমার সকালে পড়ানো আছে। তাড়াহুড়ো করে এসে পড়িয়ে আবার কলেজে যাবে। এত কষ্ট করতে হবে না।

মুক্তি সন্ধ্যার একটু পরেই বাসায় চলে আসে। এসে দেখে
সুপ্তি টেবিলে বই খুলে বইয়ের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মুক্তি এসে সুপ্তির মাথায় হাত রাখলো। সুপ্তির দু'চোখের নোনাজল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে বইয়ের উপরে।
-খেয়েছিস কিছু?
সুপ্তি না সূচক মাথা নাড়লো। ওড়না দিয়ে গাল মুছে বলল,
-খেতে পারি না। সব বমি হয়ে বের হয়ে যায়।
মুক্তির ভিতরটা কেঁপে উঠে। অজানা ভয়,নানা প্রশ্ন মনের ভিতর তোলপাড় শুরু করে। গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলো,
-পিরিয়ড কবে?
-ডেট পার হয়েছে বিশ দিন।
-কি বলছিস??
সুপ্তি নিঃশব্দে কাঁদছে। মুক্তির হাতদুটো নিজের গলার কাছে এনে বলল,
-গলা চেপে আমাকে মেরে ফেল বুবু। তোর কথা রাখতে পারিনি। তোকে কথা দিয়েছিলাম ফিরে আসবো। কিছুই ধরে রাখতে পারিনি। সব শেষ হয়ে গেছে.....
মুক্তির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা। হঠাৎ
শরীরসহ মাথা চক্কর দিয়ে উঠে। দাঁড়ানো ছিল। সাথে সাথে খাটের কোণায় বসে পড়ে। কপালে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে জিজ্ঞেস করলো,
-কি হয়েছে খুলে বল।
সুপ্তি কেঁদে কেঁদে বলল,
-রিয়ার আব্বুকে বিয়ে করেছি।
মিসেস করিম তখনই ঘরে ঢুকেন। কোনো কথা বললেন না। বিয়ের কথা শুনেই সুপ্তির গালে জোরে চড় বসিয়ে দিলেন। চেয়ার থেকে ছিটকে ফ্লোরে পড়ে যায় সুপ্তি। মিসেস করিম রাগে মেয়ের দু'গালে সমানে চড়াতে থাকে। তাঁর অসুস্থ শরীরটা কাঁপছে। ফ্লোরে বসে পড়েন। চোখ থেকে অঝোরে পানি পড়ছে। কান্নাজড়িত গলায় বললেন,

-নিজের এতবড় সর্বনাশ কেন করলি? কেন তোরে পেটে ধরেছিলাম? তুই আমার সেই কষ্টের মেয়ে। যার চোখ দুটো ফোটার আগেই সিজার করতে হয়েছিল। দুশ্চিন্তায়
সারারাত ঘুমাতে পারিনি। বিড়ালছানার মতো এতটুকুন ছোট্ট মেয়েকে কি করে বড় করে তুলবো। সুস্থ হয়ে বেড়ে উঠবে তো! বড় হলে যদি কোনো সমস্যা থেকে যায়।
নানা কুচিন্তায় নিঃশব্দে শুধু কেঁদেছি। সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করেছি। প্রতিটা রাতদিন কতটা কষ্ট করেছি সেটা তোর বাবা ছাড়া কেউ জানে না। যে মেয়ের নাক টিপলে এখনও মায়ের দুধ বের হবে। মুখে মায়ের দুধের গন্ধ লেগে আছে সেই মেয়ে আজ এত বড় হয়ে গেছে! নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত একাই নিতে শিখে গেছে। কল্পনাও করতে পারিনি। এটা দেখার আগে আমার মরণ হলো না কেন? হে আল্লাহ্! আমাকে নিয়ে যাও।
আল্লাহ তুমি বুকে ব্যথার সময় কেন নিয়ে গেলে না?

মিসেস করিম বিলাপ করে নিজের মাথার চুল টানতে থাকেন। মুক্তি চোখ মুছে মাকে ধরে খাটে শুইয়ে দেয়।
-শান্ত হও মা! আরও অসুস্থ হয়ে যাবে তো! নিজের শরীরের কথাটা একবার ভাববে না? কিছুদিন আগে কত বড় একটা অপারেশন হলো।

সুপ্তি ফ্লোরে বসে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনে দেয়ালটার দিকে। অনেকটা ভাবলেশহীন,উন্মাদের মতো। লকলকে ছাড়া চুল ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। চোখ দুটো লাল হয়ে ফোলে আছে।

মুক্তি মাকে আস্তে আস্তে শোবার ঘরে নিয়ে যায়। টাওয়েল ভিজিয়ে মুখটা মুছে দিল। মাথার তালুতে তেল পানি দিয়ে আলতো করে চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। মিসেস করিম চোখ বন্ধ করে রাখেন। চোখ বন্ধ থাকলেও চোখের পাতা দুটো ভেজা। মুক্তি ওড়না চেপে চোখ দুটো মুছে দিল। মা তন্দ্রাচ্ছন্ন বুঝতে পেরে লাইট অফ করে চলে আসলো কিচেনে। ছোট্ট কাজের মেয়েটাকে বলল, চুলায় ভাত বসিয়ে দে! খাবার গরম করে টেবিলে রাখ। তোর নানিরে এখন ডাকতে যাবি না।
তার শরীর ভালো নেই। এক গ্লাস পানি খেয়ে মুক্তি চলে আসলো সুপ্তির ঘরে। হাত ধরে ফ্লোর থেকে সুপ্তিকে খাটে বসালো। তার পাশেই শুয়ে বলল,
- কি ঘটেছিল?
সুপ্তি কাঁদতে কাঁদতে বলল,
- যেইদিন তোর সাথে সব কিছু শেয়ার করলাম। তারপর থেকে তোর সব পরামর্শ,উপদেশ মেনে চলার চেষ্টা করি। নিজেকে অনেক কষ্টে কন্ট্রোল করে সরিয়ে এনেছিলাম। প্রতি মুহূর্তে তোর কথাগুলো মনে করে রিয়ার আব্বুকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। ইচ্ছে করে কখনোই তার সামনে যেতাম না। নিজেকে দেখাতাম না।প্রায়ই ছোট কাগজে চিঠি লিখে বারান্দায় রেখে যেতো।'সুপ্তি আমাকে মানুষ মনে করো না। এত অবহেলা কেন করো? তোমাকে না দেখলে ভালো লাগে না। প্লিজ,বাইকের আওয়াজ শুনলে বারান্দায় আর না হয় ছাদে একটিবার এসো। তোমাকে এক নজর দেখবো। তোমাকে দেখা ছাড়া থাকা খুব কষ্টের। আমার কষ্টের কথা তোমাকে জানাতে চাই।' আরও অনেক কিছু লিখতো। যতবার ছোট ছোট চিঠি পেয়েছি পড়ে ছিড়ে ফেলে দিয়েছি। চিঠির কথা অনুযায়ী ওনার সামনে যাইনি কখনো। চিঠির কোনো জবাব দেই নি।

-আমাকে জানাস নি কেন?

-ভয়ে জানাই নি। যদি উনাকে বাসা ছেড়ে দিতে বলিস।
কেন জানি চলে যাবার কথা শুনলেই ভীষণ কষ্ট লাগতো। একদিন চিঠিতে লিখলেন আমার অবহেলা সহ্য হচ্ছে না। ওনি পৃথিবী থেকে চলে যাবেন। ঐদিন সবার আড়ালে ভীষণ কেঁদেছিলাম। তখন থেকে আবার
আমার ভিতর আগের ভাবনাগুলো ফিরে আসে। নিজেকে কিছুতেই আটকাতে পারিনি। ওনাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করি। তোর বিয়ে, মায়ের অসুস্থতার সময় ওনি আমাদের পরিবারের একজন হয়ে কাজ করেন।
ওনার সহযোগিতা, উদারতা আমাকে মুগ্ধ করে।
তখন থেকে আমিও ওনাকে নিজের ভাবতে শুরু করি।

রিয়ার আম্মু বাড়ি চলে যাওয়ার পর মা মাঝে মাঝে ওনার খাবার পাঠাতেন। খাবার নিয়ে আমি কখনো ওনার ঘরে যাইনি। শেফালিকে দিয়ে পাঠাতাম। রেজাল্টের পরদিন মা স্কুলে চলে গেলে ওনি একটা ড্রেস নিয়ে বললেন,'এটা ভালো ফলাফলের উপহার। পরে আসো। তোমাকে দেখবো।'নিতে চাই নি। জোর করলেন। ড্রেসটা পরে ওনার সামনে আসলে খুব খুশি হন। ওনি বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। দেখেই তখনি চলে গেলেন। এর কিছুদিন পর মা সকালে স্কুলে চলে গেলেন। শেফালি বাড়ি গেল। বলল বিকালে চলে আসবে। আমি কোচিং এর পড়া পড়ছি। রিয়ার আব্বু
বাসায় আসলেন। জানালো ওনার শরীর ভালো লাগছে না। জ্বর আসছে। থার্মোমিটার চাইলো। থার্মোমিটার দিয়ে ওনার জন্য লেবু দিয়ে শরবত বানিয়ে দিলাম।
কথা বলার এক পর্যায়ে ওনি আমার খুব কাছে চলে আসলেন। জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো শুধু বললেন,
কেন বিশ্বাস করো না? প্রচণ্ড ভালোবাসি তোমায়। রিয়ার চোখের মনি তুমি। তোমাকে ছাড়া রিয়া ভালো থাকতে পারবে না। তুমিও ভালো থাকতে পারবে না। তুমি রিয়াকে,আমাকে ভীষণ ভালোবাসো। এই সম্পর্কে কোনো পাপ নেই। খাঁটি প্রেম সব সময় পবিত্র। আমি ওনাকে বারবার ছাড়াতে চেষ্টা করে পারিনি। আমার কান্না দেখে ওনি বললেন, চলো তুমি রাজি থাকলে আজ এখনি বিয়ে করবো। আর বাঁধা দিতে পারিনি। এরপর বেশ কিছু সময় দু'জনের একসাথে কেটে যায়। পরদিন আমাকে নিয়ে কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ের রেজিস্ট্রি করেন। ঐভাবে বিয়ে করতে মোটেও রাজী ছিলেন না। আমাকে বিশ্বাস করানোর জন্য রেজিস্ট্রি করেন। বিয়ের কয়েকদিন পর ওনার বদলির অর্ডার এল। মোবাইল কিনে একফাঁকে মাথায় হাত রেখে বললেন, কোনো বিশ্বাসঘাতকতা করবো না। প্লিজ,কাঁদবে না। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। কোনো টেনশন করবে না। সব সময় যোগাযোগ করবে। আমার উপর বিশ্বাস রাখো। যে কোন সমস্যা হলে জানাবে যেখানেই থাকি চলে আসবো।
সুপ্তি কথাগুলো বলে ঝরঝর করে চোখের পানি ফেলছে।
-মোবাইল কোথায়? যোগাযোগ করছিস?
-মোবাইল বন্ধ পাচ্ছি। অসুস্থ হওয়ার পর থেকে অসংখ্য
বার যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি। বারবার বন্ধ পাই।
মুক্তি সজোরে কষে সুপ্তির ডান গালে চড় বসিয়ে দিল।

-অসভ্য মেয়ে! তোর মুখ দেখাও পাপ। নিজের কপালে নিজে কুড়াল মারলি। এতবার বুঝিয়ে তোকে ফেরাতে পারিনি। সবকিছু গোপন করে নিজের জীবনটা ধ্বংস করে দিলি? জীবনটাকে খেলার পুতুল ভেবেছিস? যে যেভাবে বুঝিয়ে খেলে যাবে। যা, চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যা!সুপ্তি চোখে ওড়না চেপে মাথা নীচু করে কেঁদে যাচ্ছে। মুক্তির চোখ দুটো ভেজা। বালিশের কাছে সাইট ব্যাগ রাখা। সাইলেন্ট মুডে ফোন বেজে যাচ্ছে। টের পেয়ে মোবাইল বের করে দেখে শিহাবের কল। পৌঁছে শিহাবকে কল করার কথা ছিল। বাসার অবস্থা দেখার পর মনেই নেই। তাড়াতাড়ি কল রিসিভ করলো,

-তুমি কি বলতো? কতবার কল করেছি। কোথায় ছিলে?
কখন বাসায় গিয়েছো?
মুক্তি ভার গলায় বলল,

- মোবাইল ব্যাগে ছিল। বুঝতে পারিনি কল আসছে। সন্ধ্যায় এসে মায়ের সাথে কথা শুরু করেছি। ভুলে গেছি জানাতে।
-গলা এই রকম লাগছে কেন? শরীর ঠিক আছে?
-চোখে ঘুম তো তাই এই রকম লাগছে। আমি ভালো আছি। টেনশন করো না।
-ঘুম পেলে এশার নামাজ পড়ে খেয়ে ঘুম দাও।
-তাই করবো। তুমিও খেয়ে নিও। রাখছি।
-আদর।
-হুম।

মুক্তি পরদিন সকালে সুপ্তিকে নিয়ে বোরকা পরে দূরের ক্লিনিকে চলে আসলো। টেস্ট করিয়ে এমআর করানোর পর সুপ্তিকে বাসায় রেখে থানায় গেল। রশিদ সাহেবের
খোঁজ নিতে সিলেট থানায় যোগাযোগ করার চেষ্টা করে।
সিলেট থানা থেকে ল্যান্ড ফোনে যে অপারেটরের সাথে
কথা হয়েছে উনি তেমন কোন তথ্য দিতে পারেনি। সেই লোক জানালেন, সে থানায় চারদিন হয় জয়েন করেছে।
মুক্তি বাসায় ফিরে রশিদ সাহেবের দেওয়া মোবাইলে কয়েকবার কল করে ব্যর্থ হয়। বারবার ফোন বন্ধ পায়।

মিসেস করিম সুপ্তির সাথে কোনো কথাই বললেন না। খেতেও ডাকে না,পড়তেও বলেন না। স্কুল,নামাজ বাদে
প্রায়ই শুয়ে থাকেন। কোরআন তেলওয়াত করেন। মুক্তি
মায়ের একমাসের ঔষধ,ফল,বিস্কিট,হরলিকস কিনে একদিন থেকে শিহাবের কাছে চলে গেলো।সুপ্তির খবর নিতে আশিক বাসায় আসলো। এসে দেখে মিসেস করিম কোরআন শরীফ পড়ছেন। সুপ্তি কপালে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। আশিক আস্তে করে ডাকলো,
-সুপ্তি জেগে আছিস?
সুপ্তি হাত সরিয়ে চোখ মেলে তাকিয়ে বাম কাত হয়ে ঐপাশ ফিরলো। আশিক কপালে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-কি হয়েছে তোর? জ্বর টর করেনি তো? হঠাৎ এমন রোগা হয়ে চুপসে গেলি কেন? মডেল টেস্টগুলি শেষ করতে পারলি না। সামনে ভর্তি পরীক্ষা।
সুপ্তি কথার জবাব দিল না। আশিক কিছু সময় বসে চলে আসলো মিসেস করিমের রুমে। চাচির কোরআন পড়া ডিস্টার্ব হবে তাই কথা না বলে বাড়ি চলে আসলো।

'রেবেকা মঞ্জিল' এখন যেন একটা ভুতুরে বাড়ি। কোনো কোলাহল নেই,আনন্দ নেই। সুনসান নীরবতা চারদিকে ঘিরে রেখেছে। পাশের ইউনিট থেকে রশিদ সাহেব চলে যাবার পর এখনও খালিই পড়ে আছে। বাড়িতে তিনটি প্রাণ থাকলেও সবকিছু যেন মৃত। কেউ কারো সাথে তেমন কথা নেই। কুমারি সুপ্তির সাথে এখনের সুপ্তির কোনো মিল নেই। ইচ্ছে হলেই যেই মেয়েটা মনের সুখে আপনমনে কবিতা আওড়াতো,গুনগুনিয়ে গান গাইতো
বৃষ্টি ছুঁয়ে দিত। বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করতো। বৃষ্টিস্নাত গাছের কচিপাতায় শিশির ফোঁটার মতো বিন্দু বিন্দু জলে হাত ভিজাতো। গাছদের সাথে মনের কথা বলতো। সুপ্তির সেই তারুণ্যের সজীবতা হারিয়ে গেছে।
এখন তার উচ্ছ্বাস, তারুণ্যের চপলতায় ধূসর মেঘেদের মেলা। এখন আর বর্ষার আগমন লাগে না। ক্ষণেক্ষণেই নামে ছন্দ ছাড়া নিঃশব্দে ভারি বৃষ্টি। কখনো দু'চোখে শ্রাবণের ঢল নামে। ভিতরে যতই কষ্ট আছে জমে। কেউ দেখে না, কাছে আসে না। কেউ খোঁজ রাখে না। তার গতিময় জীবন আঁধারে ঢেকে গেছে। এক অভিশপ্ত জীবন টেনে চলছে অবিরাম।

সময় ফুরিয়ে এক এক করে সব এডমিশন টেস্ট হয়ে গেল। সুপ্তি কিছু কিছু ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। মেডিকেলে,ভার্সিটিতে চান্স পেলো না। এদিকে আশিক খুলনা বিআইটিতে টিকে গেলো। ভর্তি হয়ে আবারও মিষ্টি নিয়ে রেবেকা মঞ্জিলে আসে। নীরবতায় আচ্ছন্ন বাড়িটির উঠোন লাগোয়া বারান্দার এক পাশে ছোট্ট টোলে বসে দূর আকাশের দিকে চেয়ে আছে সুপ্তি। কোনো নড়াচড়া নেই। কারো দিকে দৃষ্টি নেই। আকাশটার দিকে তাকালেই যেন তৃপ্তি পায়,শান্তি পায়। কারো ডাক শুনতে পায়। এই ডাক শুধুই তার কানে আসে। তখনই কেঁপে উঠে। ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠে। আশিক চাচিকে পা ছুঁয়ে সালাম করে মিষ্টি খাইয়ে দিতে চাইলে উনি বললেন,'বাবা,ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে। মিষ্টি খাওয়া নিষেধ। খুব খুশি হয়েছি। ভালো জায়গায় চান্স পেয়েছিস। দে তোকে খাইয়ে দেই।'প্যাকেট থেকে মিষ্টি নিয়ে নিজ হাতে আশিককে খাইয়ে দিলেন। আশিক দ্রুত একটা মিষ্টি হাতে নিয়ে সুপ্তির পিছনে দাঁড়ালো। বামহাতটা কাঁধে রাখতেই সুপ্তি ঘাড় ঘুরিয়ে বলল,
'কখন আসছিস? আশিক হেসে বলল,এই তো কিছুক্ষণ আগে। তাড়াতাড়ি হা কর। মিষ্টির রস হাত বেয়ে কনুই পর্যন্ত চলে আসছে। সুপ্তি শান্ত গলায় বলল,'অভিনন্দন।
আল্লাহ তোর মঙ্গল করুক। অর্ধেক ভেঙে দে। পুরোটা খেতে পারবো না।' সুপ্তি নিজেই অর্ধেক মিষ্টি ভেঙে খেলো।

আশিক বাকি অর্ধেক মিষ্টি খেয়ে হাত ধুয়ে সুপ্তির পাশে বসলো। সুপ্তি আবার আকাশপানে তাকিয়ে আছে।
আশিক বলল,এতদিন ভর্তি পরীক্ষার ঝামেলার জন্য তোর সাথে তেমন বেশি কথা বলতে পারিনি। তুই তো এমন ছিলি না সুপ্তি। লেখাপড়ায় খুব সিরিয়াস ছিলি।
আমিই বাউন্ডুলে ছিলাম। তোর কথা,মুক্তি বু'র কথা শুনে লেখাপড়ায় মন দিলাম। তোর চান্স হলো না কেন?
এটা কিছুতেই হিসেব মেলাতে পারছি না। দেখতেও রোগাটে হয়ে গেছিস। কি অসুখ করেছে তোর? আমাকে বলা যায় না? তোর এই রকম বদলে যাওয়া মানতে পারছি না। সুপ্তি কোনো কথার সঠিক জবাব না দিয়ে বলল,তোর ভর্তি কবে? কবে চলে যাচ্ছিস? আশিক মন খারাপ করে বলল,এই মাসেই। আমি যা জিজ্ঞেস করেছি এড়িয়ে যাচ্ছিস কেন? চুপ থেকে সব আড়াল করা যায় না। মনে রাখিস। আশিক চলে গেলো। সুপ্তি আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। নোনা অশ্রু গাল বেয়ে নিচে নামছে।

মুক্তির সাত মাস গিয়ে আটমাসে পড়েছে। ডাক্তার বেশি
মুভমেন্ট করতে নিষেধ করেছে। তাই মা'কে দেখতে আসে না। ফোনে সব খবরাখবর রাখে। মিসেস করিম মুক্তির পছন্দের খাবার,নতুন শাড়ি,পায়েস রেঁধে মেয়েকে দেখতে গেলেন। সুপ্তিকে সাথে নিতে চাইলে
বলল,'আমার ভালো লাগছে না। তুমি যাও। আমি বাসায় থাকি। তুমি বুবুকে দেখে আসো।'

মুক্তি রেগে থাকলেও ভর্তির ব্যাপারে সুপ্তিকে পরামর্শ দেয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজগুলিতে চেষ্টা করতে বলে। মুক্তির কথা অনুযায়ী পরীক্ষা দিয়ে শহরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে একটা কলেজে ইংরেজিতে চান্স পেলো। মুক্তি টাকা পাঠালে অনার্স প্রথম বর্ষে ভর্তি হলো। সামনের মাস থেকে ক্লাস শুরু হবে। সুপ্তি মোবাইল বের করে আবার রশিদ সাহেবের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে। ফোন সুইস অফ।
সুপ্তি রাগে মোবাইলটা ফ্লোরে ছুঁড়ে মারলো। সাথে সাথেই মোবাইল দুই খণ্ড হয়ে খাটের নীচে,টেবিলের কোণায় ছিটকে গেল। সুপ্তি দরজা বন্ধ করে চিৎকার কিছু সময় কাঁদলো।

আপোসহীন সময়ের পিছে ছুটে চলে প্রত্যেকের জীবন।
সময় সব সময় সামনে এগিয়ে চলে। পিছনে ফেরে না।
মানুষের জীবনও পিছনে ফেরে না। ক্ষত বহন করে জীবনকে টেনে নিতে হয়। জীবনে ঘটে যাওয়া পুরোনো
স্মৃতিগুলোই বারবার মনে পড়ে। কিন্তু সেই সময়ে ফেরা যায় না। ভিতরে বিশাল কষ্টের পাহাড় চেপে সুপ্তিও জীবনকে টেনে নিচ্ছে। অনার্সের ক্লাস শুরু হলো। বাড়ি থেকেই ক্লাস করছে। এখন আর আগের মতো হুটহাট মুক্তির কাছে ছুটে যায় না। অনেকখানি দূরত্ব চলে আসছে। প্রাণখুলে জড়িয়ে ধরে কথা বলা,হাসাহাসি,
চা ভাগাভাগি করে খাওয়া হয় না কতদিন ধরে। বাসে বসে সুপ্তি অতীত সুন্দর মুহূর্তে ফিরে যায়। বাস থেকে নেমে রিকশাযোগে রেবেকা মঞ্জিলের গেইটে আসতেই দেখলো পিয়ন চিঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। ভিতর থেকে কেউ খুলছে না। সুপ্তি ভাড়া মিটিয়ে তাড়াতাড়ি নামলো।
জানতে চাইলো,কার চিঠি আসছে? পিয়ন বলল,
'মানসুরা করিম সুপ্তির নামে সিলেট থেকে চিঠি আসছে।'

-------চলবে
মাকসুদা খাতুন দোলন

Ruma islam, Akaram khan, Md salim bapari, Jalsan khan, Ahmed ridoy akon, Feroz hassan, Arfin rony and লেখাটি পছন্দ করেছে

avatar
Shamim
ধুমকেতু
ধুমকেতু
Posts : 23
স্বর্ণমুদ্রা : 1110
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-06-01

মাতৃত্বের স্বাদ - Page 2 Empty Re: মাতৃত্বের স্বাদ

Wed Jul 28, 2021 6:17 pm
মাতৃত্বের-স্বাদ (১৯)

আজ সন্ধ্যায় মুক্তির ডাক্তারের কাছে এপয়েন্টমেন্ট আছে। তাই শিহাব বিকালের ব্যাচের স্টুডেন্টদের একটু আগেই ছেড়ে দেয়। প্রতিদিন ফেরার পথে মুক্তির পছন্দের কোনো একটা জিনিস নিয়ে বাসায় ফিরে শিহাব। আজ মুক্তির পছন্দের ঝাল ঝাল চটপটির পার্সেল হাতে বাসার কলিংবেল চাপতেই মুক্তি এসে গেইট খুলে দাঁড়ালো। পার্সেল সামনে ধরে হেসে বলল,

-এই যে সুকন্যার আম্মিজান,মা মেয়ে দু'জনের জন্য গরম,ঝালঝাল চটপটি। তাড়াতাড়ি খাও। তুমি খেলেই তো ঐ পুচকিটার খাওয়া হবে। ওর জন্য এখন থেকেই তার পাপার কত চিন্তা। আর কিছুদিন পরেই পৃথিবীর আলো দেখবে। ওর আগমনে পুরানো এই বাড়ি ঝলমলে হয়ে উঠবে। ধীরে ধীরে সে বড় হবে,হাঁটা শিখবে। সারা ঘরময় হেসে খেলে দৌঁড়াবে।
কথাগুলি বলে শিহাব মুক্তির পেটে ডানহাতটা আলতো করে ছুঁয়ে দিল।
মুক্তি মুচকি হাসলো,
- ধরেই নিয়েছো মেয়ে হবে? সুকন্যার পাপার ইচ্ছে আল্লাহ যেন পূরণ করেন। এখন চলো ভিতরে যাই। শরীরটা ভালো লাগছে না। বিকালে ঘুম হলো না।

শিহাব মুক্তিকে নিয়ে ভিতরে আসলো। কাপড় ছেড়ে মাগরিবের নামাজ পড়ে দু'জনের জন্য চা বানালো শিহাব। দু'জনে খাওয়া শেষ করে চলে আসলো বাসার কাছেই সুলতানা ক্লিনিকে। গাইনি ও প্রসূতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডাঃ সুলতানা জাহানের কাছেই নিয়মিত চেকআপে আসে। ডাক্তার আলট্রাসহ বেশকিছু টেস্ট করতে দিলেন। সব টেস্টের রিপোর্ট দেখে ডাক্তার জানালেন, সব রিপোর্ট ভালোই আসছে।
বেবির গ্রোথ, হার্টবিট সব ঠিক আছে। শেষের দিকে যেহেতু তাই বেবির মুভমেন্টটা খেয়াল করা জরুরি। বাচ্চার নড়াচড়ার নজর রাখতে হবে। প্রেসারটা একটু বেশি মনে হলো। কোনো রকম টেনশন করবেন না।
মুক্তি বলল, ঘুম হচ্ছে না ঠিকমতো। ডাক্তার প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে বললেন, প্রেসারের ঔষধ
সকালে,রাতে খাবেন। কোনোভাবেই প্রেসার বাড়তে দেওয়া যাবে না। এই সময়ে ঘুম একটু কমই হবে। দৈনিক আট ঘন্টা ঘুমাতে হবে। ঘুম না হলে রাতে শোবার আগে ক্লোনাজিপাম খেয়ে ঘুমাবেন। সব লিখে দিয়েছি। আর একটা কথা,ও পজিটিভ গ্রুপের ব্লাড ডোনার ঠিক করে রাখবেন। ব্লাড নাও লাগতে পারে।
ঔষধ নিয়মিত খেয়ে যাবেন।
মুক্তি ডাক্তারকে সালাম জানিয়ে শিহাবকে নিয়ে চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসলো।

শিহাব কাছের ফার্মেসি থেকে ঔষধ কিনে মুক্তিকে বলল,বাইরে কিছু খাবে? না,তাড়াতাড়ি বাসায় চলো।
শরীর ভালো লাগছে না। শিহাব রিকশা ডাকলো।
বাসায় আসার পথে মুক্তি রিকশায় ভাবছে শিহাবের কাছে সুপ্তির বিয়ের বিষয়টি গোপন রেখে খুব ভুল করছি। আমার ঘুম না হওয়ার একমাত্র কারণ হচ্ছে সুপ্তি। রশিদ সাহেব কালবৈশাখী ঝড়ের বেগে এসে সুপ্তির জীবনটাকে একেবারে লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে চলে গেল। সুপ্তির এই ঘটনা মা আমি ছাড়া আর কেউ জানে না। শিহাবকে কোন মুখে জানাবো এই কথাগুলো। না জানিয়ে আড়াল করে আর কতদিন রাখবো?
মা অসুস্থ, আশিক বাড়িতে নেই। সিলেট গিয়ে রশিদ সাহেবের খোঁজখবরটা আনবে কে? এতদিন সুপ্তির ভর্তি পরীক্ষার ঝামেলা ছিল। রাগে,কষ্টে ভর্তি পরীক্ষার জন্য এতদিন চুপ করে থেকেছি। ওর সাথে কথা বলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভালো লো-ইয়ার ধরে ডিভোর্স দিয়ে দিতে হবে। সুপ্তি রাজি হবে কিনা কে জানে। মেয়েটা জেনে বুঝে নিজের জীবনটাকে নষ্ট করে দিল।

মুক্তির চুপ দেখে শিহাব হাত নেড়ে বলল, আমি খেয়াল করেছি হঠাৎ তুমি মাঝে মাঝে অন্য মনস্ক হয়ে যাও।
কি নিয়ে এত ভাবো বলতো? মুক্তি শান্ত গলায় বলল,
কিছু ভাবছি না। শরীরটা দিনে দিনে ভারী হয়ে যাচ্ছে।
ভালো লাগে না কিছু। শিহাব একহাতে ফাইল,ঔষধ ধরে রাখলো। অন্যহাতে মুক্তিকে নিজের গায়ের সাথে জড়িয়ে শক্ত করে ধরে বসলো। কানের কাছে মুখ লাগিয়ে বলল,এই তো আর ক'টা দিন মাত্র। কষ্টের দিন শেষ হয়ে আসছে। কিছুদিন পরেই আমাদের সুকন্যা তার মায়ের কোলজুড়ে শুধু হাসবে। ভালো কথা, আলট্রা করার সময় ডক্টরকে জিজ্ঞেস করলে না ছেলে না মেয়ে? ডক্টরস তোমাকে কিছু বলল না?
মুক্তি আস্তে বলল,চলে আসছি। বাসায় গিয়ে সব বলবো।

মুক্তি রাতে অল্প ভাত খেয়ে প্রেসার,ঘুমের ঔষধ খেয়ে শুয়ে পড়ে। শিহাব এশার নামাজ শেষ করে খাটের মশারি টাঙিয়ে গুঁজে দিল। মোবাইলের রিংটোন শুনে মুক্তির ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে দেখে রাত্রির নাম্বার। রিসিভ করতেই রাত্রি বলল,
-ভাবী, ডাক্তারের কাছ থেকে আসছো? ডাক্তার কি বলল? ছেলে নাকি মেয়ে হবে?
-তোর ভাবীর শরীর ভালো নেই। শুয়ে পড়েছে। এখন কথা বলবি?
মুক্তি এপাশ ফিরে বলল,
-জেগে আছি। মোবাইলটা দাও। রাত্রির সাথে কথা বলি।
শিহাব মুক্তিকে মোবাইল দিয়ে ড্রইং রুমে টিভি দেখতে চলে গেল। মুক্তি শুয়ে থেকেই রাত্রির সাথে ফোনে কথা শুরু করলো।
- হ্যাঁ বলো রাত্রি। কেমন আছো সবাই?
-ভাবী, তোমার খবর আগে শুনতে চাই। ডাক্তার কি বললো ছেলে বাবু নাকি মেয়ে বাবু?
-বিশ্বাস করো রাত্রি, আমি না জিজ্ঞেস করিনি ছেলে না মেয়ে। ডাক্তারও বলেননি। আমি ভেবেছি ডাক্তার নিজ থেকেই বলবেন।
-কি বলো ভাবী? কেন জানলে না? তবে আমার মনে হয় তোমার মেয়েই হবে।
মুক্তি একটু হাসলো। এরপর বলল,
-তোমার দাদাভাইও মেয়ের কথা বলে। সব সময় বলে মেয়ে হবে। তোমার পাগল ভাইটা তার মেয়ের নামও ঠিক করে রেখেছে।
রাত্রি আওয়াজ করে হেসে বলল,
-তাই নাকি? কি নাম ঠিক করেছে?
-সুকন্যা
-বাহ্ সুন্দর নাম। দোয়া করি, তোমাদের মনের আশা পূরণ হোক।
-ভাবী, মা বেঁচে নেই। আমার বড় কোনো বোন নেই। তুমিই আমার মা,তুমিই বড় বোন তুমিই একমাত্র ভাইয়ের বউ। তোমাকে যেমন শ্রদ্ধা করি ঠিক তেমনি খুব ভালোবাসি। তোমার কাছে কিছু না বলে থাকতে পারি না।
-সে তো আমি জানি। তোমাকেও সুপ্তির চেয়ে কোনো অংশে কম দেখি না। হঠাৎ আজ এইসব বলছো কেন? কি হয়েছে রাত্রি?
রাত্রি গম্ভীর গলায় বলল,
-ভাবী,আবার কনসিভ করেছি। খুব টেনশনে আছি। এখন বেবি নেওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই কারণ, ইরার বয়স মাত্র আড়াই বছর। ব্যাংকের জব। বুঝোই তো সারাদিন চলে যায়। মা বেঁচে থাকলে এতটা টেনশন ছিল না। ইরাকে তো মা'ই পালছে। এখন কি করি বলতো?

- অভিনন্দন, এত সুন্দর খুশির খবরটা এভাবে
মুখ ভার করে বলছো কেন? যা হবার হবে। যে পৃথিবীতে আসতে চাচ্ছে তাকে আসতে দাও। তুমি, আমি বাঁধা দেওয়ার কে? আল্লাহ কাউকে নিরাশ করেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। ধৈর্য ধরো।
-তোমার সাথে কথা বললেই মনটা ভালো হয়ে যায় ভাবী। এত সুন্দর করে বুঝিয়ে কথা বলো যে শুনতেই ভালো লাগে। এখন রাখছি। কালকে সন্ধ্যায় ইরাকে নিয়ে তোমায় দেখতে আসবো। কি নিয়ে আসবো বলো?
কি খেতে মন চাইছে?
-কিছুই আনতে হবে না। তুমি আসলেই হবে। সাবধানে থেকো। রাখছি।
মুক্তি হাসতে হাসতে কথা শেষ করে কল কেটে দিল। মোবাইল হাতে রেখেই ভাবছে মা'কে ফোন করবে কিনা।
শিহাব এসে বলল,
-তোমাদের ননদ, ভাবীর কথা এখনও শেষ হয়নি?
-হয়েছে।
-মোবাইল দাও। চার্জে দিয়ে দেই।
-মা'কে সারাদিন ফোন দেইনি। আজ কথা বলতে পারিনি। ফোন করে একটু কথা বলে নেই।
-না,এখন নয়। সকালে ফোন করে কথা বলে নিও। তোমার এমনিতেই ঘুম হয় না।
শিহাব মোবাইল চার্জে দিয়ে লাইট অফ করে মুক্তির পাশে এসে শুয়ে পড়লো। কপালে আলতো করে অধর ছুঁয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
-এবার ঘুমানোর চেষ্টা করো। মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।
মুক্তি শিহাবের আরও কাছে এসে লোমশ বুকে মুখটি গুঁজে চোখ বন্ধ করে রাখলো। সুখ,শান্তির এই আশ্রয়স্থলে মুখটি রাখলেই সব কষ্টগুলো যেন এক নিমিষেই দূর হয়ে যায়। নিজেকে শতভাগ সুখী ভাবে। মানুষটি এমনভাবেই যেন সারাটা জীবন তাকে মায়া, ছায়া,ভালোবাসা, নির্ভরতা দিয়ে আগলে রাখে। শিহাবের বুকের ধপধপ আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে মুক্তি।
আস্তে করে ফিসফিসিয়ে বলল,একটা সুখবর আছে?
না বলে থাকতে পারছি না। শিহাব মুক্তির চোখের পাতায়,গালে ঠোঁট ছুঁয়ে বলল,বলুন ম্যাডাম। ডাক্তার ছেলে নাকি মেয়ের কথা জানালেন। মুক্তি হেসে দিল।
'আরে এই খবর না। আমি তো জানতে চাইনি ডাক্তারের কাছে। ডাক্তারও আগ বাড়িয়ে কিছু জানাননি আমাকে।
প্রথম বেবি আল্লাহ যাই দিবেন আমি তাতেই অনেক খুশি। আমার আদরের সন্তান যেন সুস্থ,শরীর নিয়ে পৃথিবীতে আসে। এটাই আল্লার কাছে চাওয়া। রাত্রি আবার কনসিভ করেছে। এই আনন্দের খবরটা দিতেই ফোন দিয়েছিল। শিহাব চমকে গিয়ে বলল, বল কি?
ইরা তো এখনও অনেক ছোটই। তাছাড়া ব্যাংকের চাকরি। এতকিছু কি করে সামলাবে মেয়েটা। সমস্যায় পড়ে যাবে। মা বেঁচে থাকলে কোনো সমস্যা ছিল না।
মুক্তি বলল, এত ভাবছো কেন? রাত্রির শাশুড়ি এখনও বেঁচে আছেন। ওনি রাত্রিকে সহযোগিতা করলেই তো সমস্যা সমাধান হয়ে যায়। নাতি,নাতনিরা দাদি,নানির কাছে অনেক ভালো থাকে। শিহাব কিছুটা গম্ভীর হয়ে বলল,রাত্রির শাশুড়ি আমার তোমার মায়ের মতো না।
ওনি অনেক মর্ডান। তিনি এইসব ঝামেলা এড়িয়ে চলেন। থাক এইসব কথা। বলতে গেলে রাত ফুরিয়ে যাবে। শুধু জেনে রাখো, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আত্মীয়তা করলে সেখানে মূল্যায়ন পাওয়া যায়। সবাই মানুষকে সম্মান দিতে জানে না। মানুষকে মানুষ ভাবতে পারে না।
রাত্রির শ্বশুর,হাজব্যান্ড খুবই ভালো মানুষ। সব সময় মুক্তিকে সাপোর্ট করে। দু'জন মানুষ ছাড়া বাকিরা অর্থের দাম্ভিকতায় নিজেদের আকাশচুম্বি কল্পনা করে।
মুক্তি শান্ত গলায় বলল, থাক আর বলতে হবে না। সব বুঝতে পেরেছি।
কিছু সময় টুকটাক কথা বলতে বলতে দু'জনেই ঘুমিয়ে পড়ে।

সুপ্তি পিয়নের কাছ থেকে চিঠিটা নিয়েই দ্রুত ঘরে আসলো। খুশিতে তার চোখ দুটো টলমল। সাইট ব্যাগ খাটে ছুঁড়ে ফ্যান ছেড়ে ফ্লোরে দু' পা মেলে বসে ব্যাকুলতা নিয়ে তিনপৃষ্ঠার চিঠিটা পড়তে শুরু করলো,

সুপ্তি,আমি জানি একেকটা দিন কতটা যন্ত্রণা,কষ্ট নিয়ে
তুমি পার করছো। কতবার ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছো। লুকিয়ে লুকিয়ে কত কেঁদে যাচ্ছো। কতগুলো নির্ঘুম রাত তুমি চোখের জলে পার করছো। ঘৃণা,ক্ষোপে ফেটে যাচ্ছো। ভেজা চোখ নিয়ে অসহায়ের মতো দিন গুনছো কবে ফিরবে আমার কাছে। তুমি জীবিত থেকেও আজ আমার কারণে অনেকটা প্রাণহীন। । আমি দূর থেকে অশ্রুসজল চোখে ফুলের মতো সুন্দর,পবিত্র আমার আদরের সুপ্তির সিক্ত চোখ দুটো দেখতে পাচ্ছি। বিশ্বাস করো তোমাকে ঠকাইনি।
কোনো প্রতরণা করিনি। তোমাকে ভালোবেসে সারাজীবন কাছে পাবার জন্যই বিয়ে করেছি। তোমাদের পরিবারের একজন হতে চেয়েছিলাম। আমি বিবাহিত পুরুষ। এক কন্যা সন্তানের জনক। কোনো পুরুষের ঘরে স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও অন্য মেয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্ক ধর্ম,সমাজ,পরিবার কেউ মেনে নেয় না। কেউ স্বীকৃতি দেয় না। অবৈধ বা অনৈতিক সম্পর্ক বলেই জানে। আমাদের সম্পর্ক কখনোই অবৈধ ছিল না। খাঁটি,পবিত্র প্রেম ছিল। আমি তোমাকে ভালোবেসে ধর্মীয় মতে বিয়ে করেছি। তোমাকে নিয়েই সুখে থাকতে চেয়েছি। ভিতটায় শূন্যতায় ভরা। কাউকে কিছু বলতে পারি না। সুপ্তি, বিশ্বাস একবার ভেঙে গেলে তা জুড়া লাগানো খুব কষ্টের। আগের অবস্থানটা আর ফিরে না। সুহানার উপর বিশ্বাস হারিয়েছি রিয়া পেটে আসার তিনমাস বয়সে। যখন জানতে পারলাম সুহানা ক্লাস নাইনে স্কুল থেকে কলেজ পড়ুয়া বখাটে একছেলের সাথে পালিয়ে যায়। ঐদিনই তার বাবা,মা সুহানাকে খুঁজে এনে বাড়িতে আটকে রাখে। ছেলেটাকে তার বাবা
তিন মাসের মধ্যে চাচার কাছে বিদেশ পাঠিয়ে দিল। সুহানার সাথে যোগাযোগ ছিল কিনা জানি না। এতবড় সত্যিটা চেপে রেখে আমাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে।
আমিও সুহানাকে প্রচণ্ড ভালোবাসতাম। দু'জনের দেখা কম হতো। মনের কথাগুলো চিঠিতে লিখে জানাতাম।
সুহানাকে খুব বিশ্বাস করেছিলাম। অথচ সে আমাকে না জানিয়ে প্রতারণা করেছে। বিশ্বাস ভেঙে দিয়েছে।

সুহানার মা,বাবাও বিষয়টি চেপে রেখে মেয়েকে আমার কাছে বিয়ে দেন। সুহানার প্রাক্তন দীর্ঘদিন পর দেশে এসে আমার সাথে যোগাযোগ করে তাদের সম্পর্কের
কথা জানায়। সুহানার কাছে জানতে চাইলে কেঁদে পায়ে পড়লো। ক্ষমা চাইলো। জানালো সে ভুল করেছে। তাকে যেন ক্ষমা করে দেই। সুহানার মা আমার ফুপু আমাকে ছোট থেকেই তুই সম্বোধন করতেন। সুহানার বাবার সরকারি জবের কারণে বিভিন্ন জায়গায় থাকতেন।
ওদের সাথে নিয়মিত সব সময় যোগাযোগ হতো না।
সুহানার অতীত শুনে তার মা'কে ফোন দিলে বললেন, জানতাম তোরা একে অপরকে খুব পছন্দ করিস,
ভালোবাসিস। ভেবেছি সুহানার সব কথা তুই জানিস।
সব জেনেই সুহানাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিস। ঐটা একটা দুর্ঘটনা ছিল বাবা। এতবছর আগের এইসব মনে রাখিস না। সুহানাকে ক্ষমা করে সুখে সংসার কর। সুহানার হয়ে আমি ক্ষমা চাইছি। এইসব নিয়ে সংসারে অশান্তি করিস না। আমরা তোর সাথে অন্যায় করেছি।
সবকিছু ভুলে ক্ষমা করে দিস বাবা।

ক্ষমা তো তাকে করতেই হবে। যেহেতু বিয়ে করেছি। তার পেটে আমার ঔরসজাত সন্তান। ক্ষমা তাকে করেছি ঠিক আগের জায়গা থেকে সরিয়ে দিয়েছি। এই বিশ্বাসঘাতকতা কিছুতেই মানতে পারছিলাম না। আমার বাচ্চার ক্ষতি হবে ভেবে তাকে শারীরিক এবং
মানসিকভাবে কখনো কষ্ট দেইনি। এরপর থেকে নিজেকে নিয়ে সব সময় ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করেছি। ভেতরে পাহাড়সম কষ্ট থাকলেও কাউকে বুঝতে দেইনি। মেয়ের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে সবকিছু মেনে নিয়েছি। মেনে নিলেও আগের মতো কিছুই ঠিক ছিল না।
তোমাদের বাসায় আসার পর জীবনটাতে নতুন প্রাণ
খুঁজে পেয়েছিলাম। বিশেষ করে রিয়ার সাথে তোমার যে মায়ার বন্ধন। সেটা কোটি টাকা দিলেও কেনা যাবে না।
তুমি রিয়াকে এতটা ভালোবাসতে কেন জানি না। রিয়াও
তোমার ভিতর কি খুঁজে পেয়েছিল জানি না। মেয়েটা সুহানার চেয়ে তোমার কাছে থাকতেই পছন্দ করতো।
স্বার্থপরের মতো সবকিছুকে উপেক্ষা করে তোমাকে আমার নিজের এবং রিয়ার জন্য জন্য ভাবতে শুরু করি।

সুপ্তি,তোমার মা,বোনের কাছে আমি যথেষ্ট ঘৃণার মানুষ। আমাদের বিয়েটা কোনোদিন মেনে নিবে না। আমাকে নিয়ে যাই ভাবুক আমার কোনো আক্ষেপ নেই। আমি সব সময় তোমাদের পরিবারের জন্য ভাল কিছু করতে চেয়েছি। আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি। তোমার বাবার অসুস্থতা নিয়ে সবাই খুবই টেনশন করতে। সংসার খরচের দায়িত্ব তোমার মা আর মুক্তির উপর ছিল। তোমাদের খুব কাছ থেকে দেখেছি অল্পতেই তোমরা কতটা খুশি থাকো। তোমাদের সবাইকে খুব আপন করে নিয়েছিলাম। যেইদিন শুনলাম মুক্তি শহরে কলেজের চাকরির পরীক্ষা দিতে যাবে। তখনই চেষ্টা করি মুক্তির জন্য কিছু করতে পারি কিনা। ঐ কলেজের ম্যানেজিং কমিটির দাতা সদস্য মোস্তাক আহমেদ আমার খুব কাছের মানুষ। ওনাকে তোমাদের সবকিছু খুলে বললাম। চাকরিটা কনফার্ম হওয়ার জন্য মোস্তাককে কিছু পে করতে চাইলাম কিন্তু ওনি খুব ভালো মানুষ তাই নিলেন না। শুধু আশ্বস্ত করলেন যদি লিখিত পরীক্ষায় পাশ করে তাহলে ভাইভা বোর্ডে সবাইকে ম্যানেজ করে ওকে সর্বোচ্চ নাম্বার পাইয়ে ওর জন্য কিছু করবো। মোস্তাক সাহেব তাঁর কথা রেখেছেন। মুক্তির
কলেজে চাকরি হলো। কলেজ থেকে বাসায় ফিরতে মুক্তির অনেক রাত হয়ে যায়। তোমার মা টেনশন করেন। মুক্তির বিয়ে নিয়ে দুশ্চিন্তা করেন। একদিন মোস্তাককে ফোন করে বললাম মুক্তির জন্য ভালো ছেলের খোঁজ দিতে। তখন মোস্তাক আহমেদ ঐ কলেজের আনম্যারেড শিক্ষক শিহাবকে ডেকে মজা করে হেসে বললেন, বিয়ে নিয়ে দেরি করছেন কেন? বিয়েটা করে ফেলুন। আমাদের কলেজেই অনেক স্মার্ট ম্যাডাম জয়েন করেছেন। এরপর থেকে দু'জনের পরিচয়, কথা জানাশোনা হলো। তোমার মায়ের সিদ্ধান্তে বিয়ের তারিখ চূড়ান্ত হলো। মোস্তাককে বলেছিলাম সবকিছু আড়ালে রাখতে। ও তাই করেছে। সবকিছু গোপন রেখেছিল।

তড়িঘড়ি করেই মুক্তির বিয়ের সব আয়োজন করতে হলো। এদিকে মুক্তির গয়না বানানো শেষ টাকার জন্য আনতে পারছে না। সুহানা তোমাদের ঘর থেকে জেনে আসলো জমি বিক্রি হয়নি তোমার মা খুব টেনশন করছেন। জেনে আমারও খুব খারাপ লাগছে। কি করতে পারি। গয়নার টাকা ধার দিতে চাইলে যদি তোমার মা নিতে রাজি না থাকেন। যতটুকু বুঝেছি ওনার আত্মসম্মানবোধ বেশি। জমিটা বিক্রির জন্য আমিও গোপনে খুব চেষ্টা করতে থাকি। পরিচিত এক ব্যবসায়ীকে খুব রিকোয়েস্ট করে রাজি করাই। ঐ লোককে তোমার মায়ের নাম্বার দিয়ে যোগাযোগ করে টাকা দিয়ে জমি রেজিস্ট্রি করে নিতে বললাম। যা করতে চেয়েছিলাম অবশেষে সবার ইচ্ছাই পূরণ হয়েছিল। তোমার মায়ের ওপেন হার্ট সার্জারি হবে। এতগুলো টাকার কথা জেনে মুক্তির চোখ,মুখ বিমর্ষ হয়ে যায়। নিজেও ভিতরে ভিতরে খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম। আমার কাছেও ঐ অবস্থায় কোনো টাকা ছিল না।
সশরীরে উপস্থিত থেকে যতটুকু পেরেছি সাধ্যমতো করেছি। তোমাদের পরিবারটিকে খুব পছন্দ করি বলে।

সুপ্তি,আমি মরে গিয়েও কোনো রকম বেঁচে আছি। জানিনা এই কষ্টের জীবন থেকে সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে আবার ফিরবো কিনা। আমি কারো সাথে কোনো অন্যায় করিনি। কাউকে ঠকাইনি। জানি না কোন পাপের ফল আজ ভোগ করছি। তোমার সুন্দর গুছানো জীবনটা এলোমেলো করে দিয়ে আসছি তাই হয়তো সৃষ্টিকর্তা আমার জীবনেও এক ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনা উপহার দিয়ে দুনিয়াতেই আমার সাজা দিয়েছেন। সিলেট থানায় জয়েন করার দু'দিন পরেই রিয়াকে আনতে যাই দেশের বাড়ি থেকে। যাওয়ার পথে এই দুর্ঘটনা ঘটে। দীর্ঘ কয়েকমাস অসহ্য যন্ত্রণায় পঙ্গু হসপিটালে চিকিৎসা নিয়েছি। হুইল চেয়ারটি পথ চলার একমাত্র অবলম্বন। জমানো যা টাকা ছিল সবই চিকিৎসায় খরচ হয়। অসাড় দেহটা নিয়ে কোনো রকম বেঁচে আছি। জানি,তুমি অসংখ্যবার ফোনে কথা বলার চেষ্টা করেছো। এক্সিডেন্টের পর অনেক কিছু ফেরত পাইনি। বাইরে গিয়ে দোকান থেকে ফোনে তোমার সাথে যোগাযোগ করবো সেই যোগ্যতাও আমার নেই। একজনকে দিয়ে সিম উঠিয়ে নতুন সেটে ভরলেও তোমার নাম্বারে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। সব নাম্বার আগের সেটে সেইভ করা ছিল। এই মুহূর্তে আর কিছু লিখতে পারছি না। সমাজ,পরিবার, তোমার চোখে নিকৃষ্ট,পাপী একজন মানুষ আমি। এই অধম মানুষটাকে যা শাস্তি দিবে তাই মেনে নিব.......

সুপ্তির চোখ থেকে বৃষ্টির ফোঁটার মতো পানি পড়ছে চিঠির শেষ পৃষ্ঠায়। তার হাতদুটো কাঁপছে। জোরে চিৎকার করে কাঁদছে। মিসেস করিম নামাজ শেষ করে দ্রুত ছুটে আসেন মেয়ের ঘরে। মেয়েকে কিছু বললেন না। সুপ্তির এই অবস্থা দেখে ওনিও হতবিহবল হয়ে পড়েন। হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে এক নিঃশ্বাসে পড়ে শেষ করেন। সব জেনে নিজের চোখের পানিও আটকাতে পারছেন না। শাড়ির আঁচলে চোখ দুটো মুছে নিলেন।
সুপ্তির মাথায় হাত রাখলেন। মায়ের হাতের স্পর্শে সুপ্তির কান্নার বেগ বেড়ে যায়। মিসেস করিম সুপ্তির মাথা নিজের বুকে নিয়ে চুপ করে থাকলেন কিছু সময়।
নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে বললেন,ঝড়ে বিধ্বস্ত
মানুষগুলো তাদের সহায় সম্বল হারিয়ে আবার উঠে দাঁড়ায়। জীবনসংগ্রামে টিকে থাকতে নতুনভাবে বাঁচতে
শিখে। দুমড়ে মুচড়ে নিজেদের শেষ করে দেয় না। তোকেও উঠে দাঁড়াতে হবে, ভালোভাবে বাঁচতে হবে।
ভেবে নে রশিদ সাহেবও তোর জীবনে একটা ঝড় হয়ে আসছিল। সুপ্তি কথাগুলো শুনে মুখটা মায়ের বুকেই গুঁজে মা'কে শক্ত করে ধরে থাকে বেশকিছু সময়।

মুক্তির শরীর ভালো ছিল না তাই কলেজে যায়নি।
শিহাব একমাস আগে থেকেই মুক্তিকে ছুটি নিতে বলেছে। মুক্তির এই সময়ে শিহাব আগের চেয়ে বেশি সময় বাসায় থাকে। একজন এসিসট্যান্ট রেখেছে সে
প্রশ্ন করা,খাতা দেখার কাজগুলো করে। মাঝেমাঝে ক্লাসগুলো নেয়। শিহাব শুধু সঠিক দিক নির্দেশনা দিয়ে আসে। দুপুরে খেতে বসে মুক্তি বলল,কেন জানি ইদানিং সবকিছু নিয়ে খুব ভয় করে। কিছুই ভালো লাগে না আমার। সুপ্তিটার সাথে অনেকদিন হয় কথা বলি না।
খেয়ে মা,সুপ্তির সাথে ফোনে কথা বলবো। শিহাব খাওয়া শেষ করে বেসিনে হাত ধুতে ধুতে বলল,আমিও
বিষয়টি খেয়াল করেছি। সুপ্তি আগের মতো বাসায় আসে না। ভাবলাম কোথাও চান্স হয়নি তাই লজ্জায় আসেনা। তুমি হয়তো অনেক বকা দিয়েছো। তাই অভিমান করে আসে না। তোমাদের দু'বোনের সম্পর্কটা তো অন্যরকম। মুক্তি কথা বলছে না। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে। শিহাব পানি খেতে এসে দেখে মুক্তি কাঁদছে। সে কি ভাত সামনে নিয়ে কাঁদছো কেন?
খাওয়া শেষ করো তাড়াতাড়ি! এই যে আমি বসলাম
তোমার পাশে। শিহাব মুক্তির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মুক্তি প্লেটের বাকি ভাত পানি দিয়ে কোনো রকম
ঠেলে গলার ভিতর দিয়ে হাত ধুয়ে আসলো। শিহাব সব
গুছিয়ে মুক্তিকে নিয়ে খাঁটে আসলো।

মুক্তি হঠাৎ বলল,তোমাকে একটা কথা জানাইনি শিহাব। শিহাব হেসে বলল,সিরিয়াস কিছু? মুক্তি শান্ত গলায় বলল, সুপ্তি রশিদ সাহেবকে বিয়ে করেছে।
শিহাবের চোখদুটো কপালে উঠে গেল। আশ্চর্য হয়ে বলল,কি বলছো এইসব? কবে,কখন এই কাজ করেছে? মুক্তি এক এক করে পুরো কাহিনি শিহাবের কাছে শেয়ার করে। শিহাব সবশুনে বলল,আমার খুঁজে
ভালো এডভোকেট আছে। আমি সব ব্যবস্থা করছি।
এই ব্যাপারে সুপ্তির আর কোনো বক্তব্য শুনবে না।
কোনোভাবেই এই সম্পর্ক মেনে নেওয়া যায় না। সুপ্তির
এই সস্তা আবেগকে প্রশ্রয় দেওয়া মস্তবড় ভুল হবে।
যখন বাস্তবতায় ফিরবে সে নিজে থেকেই সরে আসতে চাইবে। রশিদ সাহেবের বিরুদ্ধে থানায় মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ে করার লিখিত অভিযোগ দিলেও তেমন কার্যকর হবে না। সে নিজেও আইনের লোক। তাছাড়া সুপ্তি থানায় গিয়ে যদি নিজের স্টেইটম্যান্ট দেয় সে নিজেই পছন্দ করে ভালোবেসে রশিদ সাহেবকে বিয়ে করেছে। তখন সব কষ্ট, দৌড়াদৌড়ি জলে যাবে।

সুপ্তি মায়ের ফোন দিয়ে চিঠির কথা না জানিয়ে পরদিন
সকালে চিঠিটা নিয়ে মুক্তির কাছে চলে আসে। মুক্তি চিঠি পড়ে শুধু বলল,সময় সবচেয়ে ভালো বিচারক।
সময়ই তার উপযুক্ত বিচার করেছে। প্রকৃতির বিচার বলে একটা কথা থাকে। রশিদ সাহেবের অধ্যায় জীবন থেকে একেবারে মুছে ফেলে নতুন ভাবে বাঁচতে শিখবি।
শিহাবের সাথে সব কিছু নিয়ে কথা হয়েছে। তুই শুধু ওর সাথে কোর্টে যাবি যেভাবে যা বলবে তা করবি।

কিছুদিনের মধ্যে ডাকযোগে রশিদ সাহেবকে ডিভোর্স পেপারস পাঠিয়ে দিল শিহাব। শিহাব,মুক্তি দু'জনে মিলে সুপ্তিকে অনেক বুঝালো। দুপুরে খেতে বসে শিহাব সুপ্তিকে বলল, ধরে নাও এটা তোমার জীবনে একটা
দুর্ঘটনা। সামনে তোমার উজ্জ্বল ভবিষ্যত। অনেক ভালো কিছু অপেক্ষা করছে। ভালো কোথাও চান্স পাওনি তাতে কি? জীবনে হেরে যাওয়া মানে থেমে যাওয়া নয়। হারটাকে মনে রেখে জয়ের আশায় রাতদিন
পরিশ্রম করো। দেখবে সাফল্য তোমার হাতের মুঠোয় চলে আসছে। যেখানে ভর্তি হয়েছো। মন দিয়ে লেখাপড়া করো। অনার্স ফাইনাল দিয়েই বিসিএস এর
জন্য চেষ্টা করো। শিহাবের কথাগুলো শুনে সুপ্তির
মনোবল বেড়ে যায়। মনের মাঝে নতুনভাবে আশার আলো সঞ্চিত হতে থাকে। খাওয়া শেষ করে আরও কিছু সময় মুক্তির কাছে থেকে বিকালের দিকে বাড়ির
উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল।

ফুটপাথ ধরে হেঁটে যাচ্ছে স্টেশনের দিকে। আনমনে
জীবন নিয়ে কত ভাবনা ভেবে যাচ্ছে। হঠাৎ চোখে পড়লো রাস্তার পাশে একটা ফুটফুটে বাচ্চা মায়ের কোলে। মা হাত পেতে সাহায্য চাইছে। যে যেমন পারে
সামনে রাখা থালায় দিয়ে চলে যাচ্ছে। সুপ্তির বাচ্চাটার জন্য খুব মায়া হলো। দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
বাবুর বয়স কত? মহিলা বলল,তিন মাস বিশ দিন।
সুপ্তি আবার জিজ্ঞেস করলো,এত ছোট বাচ্চা নিয়ে
রাস্তায় কেন আসছেন? রোদের মধ্যে রাস্তায় ঘুরেন বাবুটার খুব কষ্ট হয় তো। মহিলা তার বাচ্চার দিকে
একবার তাকালো। কি করুম! ফেটের জ্বালায় বাইর
অইছি। খাওন দিব ক্যাডা? মাইয়ার বাপের কোনো খোঁজ নাই। সুপ্তি গাড়ি ভাড়া রেখে ব্যাগে যে অল্প টাকা ছিল মহিলার হাতে দিয়ে বলল, টাকাটা রাখেন।মেয়েটাকে একটা জামা কিনে দিবেন। সুপ্তি রিকশায় না উঠে দ্রুত হেঁটে চলে আসলো স্টেশনে।

বাচ্চা ডেলিভারি হওয়ার পনেরো দিন আগেই রাতে হঠাৎ মুক্তির ঘুম ভেঙে যায়। বাথরুম থেকে ফেরার সময় পা পিছলে মেঝেতে পড়ে বেসিনে তাড়াতাড়ি ধরে ফেলে। কোনো রকম উঠে বিছানায় আসে। কিছু সময় পর থেকেই পেটে অল্প ব্যথা শুরু হয়। শিহাব ঘুমাচ্ছে তাই সজাগ করেনি। আধ ঘন্টা পরেই ফজরের আযানের ধ্বনি মুক্তির কানে ভেসে আসে। ব্যথায় বিছানায় কাতরাচ্ছে। মুক্তির ছটফটে শিহাব সজাগ পেয়ে দেখে শোয়ার জায়গাটুকু রক্তে ভিজে গেছে।

-----চলবে
মাকসুদা খাতুন দোলন

Arbaj khan, Sahin kondokar, Md amanul, Akaram khan, Naimul islam, Risbi mahin, Faima islam and লেখাটি পছন্দ করেছে

avatar
Shamim
ধুমকেতু
ধুমকেতু
Posts : 23
স্বর্ণমুদ্রা : 1110
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-06-01

মাতৃত্বের স্বাদ - Page 2 Empty Re: মাতৃত্বের স্বাদ

Wed Jul 28, 2021 6:19 pm
মাতৃত্বের -স্বাদ(২০,২১)

ক্লিনিকে নেওয়ার আগে মুক্তি শিহাবের হাত ধরে শুধু বলল,'মেয়ে হলে তোমার ঠিক করা নামটাই রেখো। ছেলে হলে নাম রাখবে 'সূর্য' । সুপ্তি যদি কোনোদিন তোমার কাছে কিছু চায় তবে ফিরিয়ে দিও না।' শিহাব ভেজা চোখে মুক্তির হাতদুটো নিজের হাতে শক্ত করে ধরে আছে। মুক্তিকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। সব কথা যেন ধলা পাকিয়ে গলায় আটকে আছে। সে আজ মনের দিক থেকে মুক্তির চেয়েও অনেকটা ভেঙে পড়েছে। তার পুরো শরীরটা অবশ হয়ে আসছে।
নিজেকে এতটা অসহায় কেন মনে হচ্ছে?
মুক্তিকে ছাড়া সে একটা মুহূর্তও কল্পনা করতে পারে না।

ডাক্তার,নার্স সবাই প্রস্তুত মুক্তির সিজারের জন্য। ডাক্তার জানালেন খুব দ্রুত ওপজিটিভ গ্রুপের দুই ব্যাগ ব্লাড লাগবে। শিহাব তার পরিচিত যে ব্লাড ডোনার ঠিক করে রেখেছিল তাকে এত সকালে পাওয়া যাচ্ছে না। মোবাইল বন্ধ রেখেছে। শিহাবের অস্থিরতা বেড়ে যায়। পাগলের মতো ফোনে ট্রাই করতে থাকে। ডাক্তারকে জানালে ডাক্তার তাঁর পরিচিত এক নার্সকে ব্লাড দিতে বললেন। মুক্তিকে ওটিতে নেওয়ার পর পরই শিহাব আরও এক ব্যাগ ব্লাড জোগাড় করলো।

শিহাবের ফোন পেয়ে মিসেস করিম সুপ্তিকে নিয়ে ক্লিনিকে চলে আসলো। এসে মুক্তির মুখটি দেখতে পেলো না। এর আগেই মুক্তিকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হলো। ওটির সামনের করিডোরে চেয়ারে
সুপ্তি মা'কে নিয়ে বসে আছে। সুপ্তি ভেজা চোখে মনে
মনে সৃষ্টিকর্তাকে ডেকে যাচ্ছে। প্রভু,আমি জেনে,বুঝে
ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় কত পাপ করেছি। কত মিছে কথা
বলেছি। মা,বোনের অবাধ্য হয়েছি। তাঁদের কষ্ট দিয়েছি।
আমার কারণে তাঁদের চোখ থেকে অশ্রু ঝরেছে।
এই পাপীকে ক্ষমা করে দিও। আমি যদি কোনো ভালো
কাজ করে থাকি সেটার উসিলায় তুমি আমার বুবুকে
তার বাচ্চাকে সংসারে ফিরিয়ে দিও প্রভু। মায়ের মতো
প্রাণপ্রিয় বুবুকে হারাতে চাই না। যেকোনো উপায়ে সুস্থ করে আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দিও। মিসেস করিম
একটু পরপর আঁচলে চোখ মুছে নিঃশব্দে মেয়ের জন্য
দোয়া,দুরুদ পড়ছেন। শিহাব একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। ধীর পায়ে পায়চারি করছে। একটু পর পর ঘাড় ঘুরিয়ে ওটির দরজার দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকে। কেউ কারো সাথে কোনো কথা বলছে না। সবার চোখে,মুখে হতাশা,উৎকন্ঠা,অস্থিরতা।

অনেক সময় অপেক্ষার পর ডাক্তার অটি থেকে বের
হয়ে বললেন,শিহাব আপনি এক ফুটফুটে কন্যা সন্তানের বাবা হয়েছেন। বেবি সুস্থ এবং ভালো আছে।
ওজন প্রায় সাড়ে তিন কেজি। কিন্তু মুক্তির অবস্থা ভালো নেই। এখন ওকে পোস্ট অপারেটিভ রুমে নেওয়া
সম্ভব হচ্ছে না। মুক্তিকে আইসিইউতে ট্রান্সফার করা হয়েছে। সিজার করার সময় মুক্তির সেন্স ছিল না।
টেনশন করবে না। আশা করছি,দ্রুত জ্ঞান ফিরবে।
মুক্তিকে সুস্থ করে তুলতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।
ডাক্তারের কথা শুনে প্রথমে শিহাব আনন্দে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানালেও মুক্তির অবস্থা জেনে চোখ,মুখ শুকিয়ে যায়। টেনশনে ভিতরে ঘামতে শুরু করে।
ডাক্তারের হাতটি ধরে শুধু বলল,'যে কোন মূল্যে মুক্তির সুস্থ জীবন চাই। আর কিছু চাওয়ার নেই।'
'শান্ত হোন। চেষ্টার কোনো ত্রুটি থাকবে না' ডাক্তার শিহাবকে আশ্বস্ত করে ভিতরে চলে গেলেন।

বেশ কিছু সময় পরে নার্স বেবিকে মিসেস করিমের হাতে তুলে দিলেন। তিনি নাতনির ফুটফুটে মুখ দেখে সূরা পড়ে শরীরে ফুঁ দিলেন। শিহাবের চোখ থেকে দু'ফোঁটা আনন্দশ্রু গড়িয়ে পড়লো। সদ্য জন্ম নেওয়া তার আদরের মেয়েটা যেন মুক্তির এক কার্বন কপি।
বারবার তাকিয়ে মেয়েটাকে প্রাণভরে দেখছে। সুপ্তির
মুখজুড়ে আনন্দের ঝিলিক। মুঠিবদ্ধ গুটিগুটি ছোট্ট হাতদুটো তার গালে ছুঁয়ে চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে।
লালচে আভায় বেবির মুখটা যেন প্রস্ফুটিত ছোট্ট গোলাপ। খুশিতে মা'কে সুপ্তি বলল,মা দেখো ঠিক বুবুর মুখ পেয়েছে। তিনি নাতনির মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,হুমম। দেখতে মা,বাপ দু'জন মিলিয়ে হয়েছে।
আল্লাহ যেন ভালোয় ভালোয় তার মা'কে ফিরিয়ে আনেন। সুপ্তি মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে দ্রুত মার্কেটে এসে নিউব্রন বেবিদের যা যা লাগে সব কিনে
নিয়ে আসলো। উৎকন্ঠার প্রহর শেষে একদিন পর মুক্তির জ্ঞান ফিরলে কেবিনে দেওয়া হলো। মেয়ের মুখ দেখে মুক্তি আনন্দে কেঁদে ফেলে। নিজের কাছে সবকিছু অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। বেঁচে ফিরে আসবে,সন্তানের মুখ দেখতে পাবে। মা ডাক শুনবে সবকিছু যেন কল্পনার বাইরে ছিল। পরম মমতায় মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিজের গালের সাথে ছোট্ট তুলতুলে গাল ছুঁয়ে চোখ বন্ধ করে আছে মুক্তি। তার এতদিনের কষ্ট আজ নিমিষে উধাও হয়ে গেছে। মাতৃত্বের স্বাদ যে অমৃত।এ অনুভূতি কিছুর সাথে তুলনা নেই। অসুস্থ,দুর্বল দেহ,মনজুড়ে কেবলই তৃপ্তির আবেশ। শান্তির শীতল ছোঁয়ায় চোখ বন্ধ রেখেই বেশ কিছু সময় কেটে যায়।
পাঁচদিন কেবিনে থাকার পর মুক্তি একটু সুস্থ হলে ডাক্তার মা,মেয়েকে বাসায় নিয়ে যেতে বলেন।

সুকন্যার আগমনে শিহাব,মুক্তির সংসার আলোয় আলোকিত। সুকন্যা যেন এক ফালি চাঁদ। পুরানো বাড়িটিতে তার ঝলমলে আলো উপছে পড়ছে।
প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির মিলনে শিহাবের চোখে,মুখে আনন্দের ফোয়ারা। দু'জনের ঠোঁটের কোণে হাসি লেগেই থাকে। আকিকা দিয়ে মেয়ের নাম রাখে
তারান্নুমা শিহাব সুকন্যা। মিসেস করিম ছোট্ট সোনার
আংটি সুকন্যার ছোট্ট নরম আঙ্গুলে পরিয়ে বললেন,
আল্লাহ সবার মনের আশা পূরণ করেছেন,আলহামদুলিল্লাহ্। সুস্থভাবে বেড়ে উঠলেই
শান্তি। যতদিন ছুটিতে থাকবি। বুকের দুধ খাওয়াবি।
নিজের দিকে খেয়াল রাখিস। আমার ছুটি শেষ হয়ে আসতেছে। সুপ্তিকে নিয়ে বাড়ি যাবো। গিয়ে দেখি
কাউকে এখানে পাঠাতে পারি কিনা।

সুপ্তি বাসায় এসেই সেলাই মেশিনে সুকন্যার জন্য কয়েকটা জামা বানাতে বসে গেল। ঘুরেফিরে সুকন্যার
মুখটি তার চোখে ভাসে। ভাঁজ করা ছোট্ট হাত, তুলতুলে
গাল,চোখ মেলে টিপটিপে চাওয়া কিছুতেই ভুলে থাকতে পারে না। সব যেন চোখ মেললেই দেখতে পায়।
মিসেস করিম কাজের মেয়ে শেফালির মায়ের কাছে ছোট ছোট কাঁথা বানাতে দিলেন। দশদিন ছুটি কাটিয়ে স্কুলে জয়েন করলেন।কলিগদের মুক্তির সুখবর জানিয়ে মিষ্টি মুখ করালেন। নাতনির জন্য সবার কাছে দোয়া চাইলেন। সুপ্তি ক্লাস করতে যাবে। তাই সকালে উঠেই
নাস্তা করে গোসল করে নিল। আজ একটু আগেই বের হবে। মাকে ডেকে বলল,

'মা,তোমার সব গুছানো শেষ হয়েছে? আমি এখনি বের হবো। বুবুর বাসায় সব দিয়ে ক্লাসে যাবো।'

'এই তো শেষ! আসছি।'
কাপড়ের ছোট্ট ব্যাগ সাথে শেফালিকে নিয়ে সুপ্তির ঘরে
আসলেন মিসেস করিম।
'শেফালিকে নিয়ে যা! আমি বাসায় থাকি না। তুই ভার্সিটিতে চলে যাস। মেয়েটা একা একা থাকে। আর এখন মুক্তির কাছে একজন সাহায্যকারী দরকার।
ঠিকে বুয়া এসে দুই ঘন্টা কাজ করে দিলেই সব কাজ শেষ হয়ে যায় না। বাসায় যে কাজ আছে আমরা মা,মেয়ে করতে পারবো।
-তোমার শরীর তো ভালো নেই! তোমাকে কোনো কাজ করতে হবে না। পড়া শেষ করে রাতেই পরের দিনের রান্নার কাজ এগিয়ে রাখবো। সকালে ভার্সিটিতে যাওয়ার আগেই ঘর মুছে গোসলটা করে নিব। কাপড় ধোয়ার কাজ না হয় বন্ধের দিন করবো। তেমন অসুবিধা হবে না।

সুপ্তি শেফালিকে নিয়ে পনেরো মিনিটের মধ্যে রওয়ানা দিয়ে দিল। মিসেস করিম স্কুলের চলে গেলেন। সুপ্তি পৌঁছে দেখে সুকন্যা ঘুমাচ্ছে। কপালের কোণায় কাজলের ছোট্ট কালো টিপ। পরনে লাল টুকটুকে সুতির
নিমা। সুপ্তির কি যে ভালো লাগছে! আস্তে আস্তে কাছে গিয়ে কপালে আলতো করে চুমো খেলো। সাথে সাথে সুকন্যা চমকে উঠলো। নিঃশব্দে বুকের কাছে আগলে
ধরে। ঘুম পাড়িয়ে সুপ্তি কিছু সময় সুকন্যার দিকে তাকিয়ে থাকে। মুক্তি কিচেন থেকে সবকিছু দেখছে।
সুপ্তির জন্য তার মনটা কেঁদে উঠে। অনেক সময় গোপনে কাঁদে। কাউকে বুঝতে দেয় না কেন সুপ্তির জন্য তার এত কষ্ট হয়। বোনটাকে যে সে ভীষণ ভালোবাসে।
কে জানতো অল্প বয়সে তার জীবনটা এলোমেলো হয়ে
যাবে? হাত মুছতে মুছতে কাছে আসলো। সুপ্তির কাঁধে হাত রেখে বলল,

ক্লাস শেষ করে খেয়ে তারপর বাড়িতে যাবি। আর না হলে আজকের দিনটা এখানে থেকে যা!

'না বুবু, একা একা মায়ের কষ্ট হবে। শেফালিকে তোর কাছে পাঠিয়ে দিল মা। ক্লাস শেষে ঐদিক দিয়েই বাড়ি চলে যাবো। আজ আর আসবো না।'

' শোন,খেয়ে তারপর যাবি। এভাবে প্রতিদিন আসা যাওয়া করলে অসুস্থ হয়ে পড়বি তো! প্রতিদিন ক্লাস করার দরকার নেই।'

দেখি আজ আসতেও পারি আবার নাও পারি। এখন যাই বুবু! আর হ্যাঁ, ব্যাগে কাঁথা আছে। শেফালির মা
সুকন্যার জন্য বানিয়ে দিয়েছে। সাথে আমার বানানো কিছু ড্রেস আছে। আমার গুল্লো সোনাটার জন্য। এখন
যাই বুবু!

সুপ্তি ক্লাস শেষ করে স্টেশনের দিকে রওয়ানা দিয়েও
কেন জানি আবার ফিরে মুক্তির বাসার দিকে রওয়ানা দিল। ড্রেসগুলো কেমন মানিয়েছে তা দেখতে মনটা ছুটে গেছে সুকন্যার কাছে। এসে দেখে সুকন্যা আবারও ঘুমাচ্ছে। মুক্তির এক কলিগ ম্যাডাম সুকন্যার জন্য খেলনা,ড্রেস নিয়ে দেখতে আসছে। মুক্তি তাকে নিয়ে খেতে বসে টুকটাক কথা বলছে। সুপ্তিকে দেখে বলল,
মুক্তি ম্যাম, আপনার এত সুন্দর ছোট বোন আছে।
জানতাম না। একমাত্র ভাইটির জন্য কত জায়গায় মেয়ে দেখলাম। সবদিক মেলানো যায় না। বোনটি কিসে
লেখাপড়া করে? মুক্তি,সুপ্তি দু'জনে চোখাচোখি করে।
মুক্তি বলল,অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ে। সুপ্তির বিয়ের চিন্তা
আমাদের মাথায় নেই। লেখাপড়া আগে শেষ করুক তারপর বিয়ের কথা। আগে মেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে হয় তারপর বিয়ের চিন্তাভাবনা। নিজের পায়ের
তলার মাটি শক্ত না করে অন্যের সাহায্য দাঁড়াতে গেলে
হোঁচট খেতে হয়। মুখ থুবড়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে।
মুক্তির কথা শুনে ম্যাম বললেন,একদম ঠিক কথা বলেছেন। সুপ্তিও তাদের সাথে খাওয়া শেষ করে। সুকন্যার জন্য অপেক্ষা করছে। কখন ঘুম থেকে সজাগ হবে ময়না পাখিটা? সুকন্যা সজাগ হলে সবগুলো ড্রেস পরিয়ে মনভরে দেখলো। আদর করে আরও কিছু সময় থেকে বিকালে বাড়ির দিকে রওয়ানা দিল সুপ্তি.....
------------------------------------------------------------------
[Only admins are allowed to see this link]াতৃত্বের-স্বাদ (২১)

দেখতে দেখতে দিনগুলো কেটে যাচ্ছে। গ্রীষ্মের বন্ধ শুরু হলো। মিসেস করিমের স্কুল,সুপ্তির ভার্সিটি বন্ধ।
তিনি এই বন্ধে বাসার কিছু কাজে হাত দিলেন।
জমানো কিছু টাকা ছিল তা দিয়ে পাশের ইউনিটটায়
নতুন করে সব করে দিলেন। এখন দুই ইউনিট সম্পূর্ণ
আলাদা। ভাড়ার জন্য প্রতিদিন লোকজন দেখতে আসে। সবকিছু শুনে পছন্দ হয় না তাই ভাড়া দিতে রাজি হন না। কয়েকমাস ধরে খালি পড়ে আছে।
এক পড়ন্ত বিকেলে সুপ্তি ছাদে আসলো। আগের মতো এখন আর ছাদে অনেক সময় থাকতে পারে না। সময়,
পরিস্থিতি পাল্টে দিয়েছে সব। ছাদে আগের মতো তেমন বেশি গাছও নেই। যে কয়টা টব আছে সেইগুলোতে পানি দিচ্ছে। গাছের কচিপাতা ছুঁয়ে দিচ্ছে। গোলাপের নতুন কুঁড়িগুলিতে হাত বুলিয়ে আদর করে দিচ্ছে। একেকটা ফুলের কুঁড়ি তার কাছে সন্তানের মতো।
হঠাৎ কানের কাছে আওয়াজ আসলো। দূর থেকে তাকে কেউ 'মা' বলে ডেকে যাচ্ছে। আবারও শুনলো মা। সুপ্তির ভিতরটা হু হু করে উঠে। চোখদুটো স্যাঁতেস্যাঁতে হয়ে যায়। আকাশের দিকে তাকিয়ে একবুক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আশিক এসে কখন তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে টেরই পায়নি। আশিক সুপ্তিকে
কিছু সময় খেয়াল করলো। আনমনা হয়ে কিছু একটা
ভেবে যাচ্ছে। দু'হাতে কাঁধে ধরে তার দিক ফেরালো।
সুপ্তি চমকে উঠে। আশিক সুপ্তির চোখের কোণে পানি
দেখে শান্ত গলায় প্রশ্ন করলো,

কাঁদছিস কেন?
দ্রুত নিজেকে ছাড়িয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল সুপ্তি। ওড়না দিয়ে চোখ,মুখ মুছে নিল।

কই কাঁদছি? কাঁদছি না তো! একদিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে চোখে ঐরকম একটু আধটু পানি জমে। বাসায় কখন এলি?

এই তো কিছুক্ষণ হলো। সুকন্যার কথা শুনলাম চাচির মুখে। দেখতে অনেক সুন্দর হয়েছে। তোর কথা জানতে চাইলে বললেন, তুই ছাদে। এসে দেখি তুই অন্যমনস্ক
হয়ে কিছু ভাবছিস।

ময়না পাখিটাকে দেখতে যাই না কতদিন হলো। খুব
দেখতে ইচ্ছে করছে!
আশিক সুপ্তির সামনে আসলো। একদম মুখোমুখি।
সুপ্তি নিজেকে আড়াল করতে চাইছে। কেন জানি তার
খুব কান্না পাচ্ছে। জোরে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। আশিক সুপ্তির চিবুক ধরে বলল,

আমার চোখের দিকে তাকা একটু।
সুপ্তি তাকাতে পারছে না। অন্যদিকে তাকিয়ে আছে।
আশিক ধমক দিয়ে বলল,

কি হলো? তাকা বলছি। কষ্ট দিচ্ছিস কেন?

সুপ্তি তাকিয়ে দেখে আশিকের চোখদুটো টলমল।
জলে উপছে পড়া চোখ নিয়ে তার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। সুপ্তির সিক্ত চোখ আবারও সিক্ত হলো।
আশিক কাঁপা গলায় বলল,

তোর এই রকম বদলে যাওয়া আমাকে ভীষণ কষ্ট দিচ্ছে। তুই আমাকে এতটা কষ্টে রাখছিস কেন?
তুই কিছুই বুঝিস না? কার জন্য ভাবিস? সেই মানুষটি কে? আজ তোকে বলতেই হবে। আমাকে কষ্ট দেওয়ার কোনো অধিকার তোর নেই।

সুপ্তি দূরে সরে যায়। কিছু সময় চুপ থাকে। নীরবে কাঁদে। আশিকও নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলে। সুপ্তি
নীরবতা ভেঙে বলল,

তোকে আমি কিছুই বলতে পারবো না। আর একটিবার
জানতে চাইবি না কেন এমন হয়ে গেছি। আমি এমনই
থাকবো।
আশিক হঠাৎ রেগে গেল। চোখ মুছে দ্রুত সুপ্তির ডান গালে চড় বসিয়ে দিল।

তুই আরও মার। আমাকে মেরে ফেল। আমি মরতে চাই
আশিক। সুপ্তি কেঁদে পাগলের মতো আশিকের হাতদুটো
ওর গালে চেপে ধরে বলল,

নে আরও মেরে রক্তাক্ত করে দে! তোকে কষ্ট দেওয়ার বদলা তুই নিয়ে নে। তবুও জানতে চাস না আমার কি হয়েছে।
আশিক সুপ্তির ওড়নার নীচের অংশটুকু দিয়ে চোখ,মুখ মুছে দিল। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,

ভুলে গেছিস কেন? ছোট থেকে একসাথে বড় হয়েছি।
মাঠে একসাথে খেলেছি,দৌড়াদৌড়ি করেছি।একই স্কুল কলেজে লেখাপড়া করেছি। কত দুষ্টুমি, আইসক্রিম নিয়ে কত ভাগাভাগি করে খেয়েছি। আমি একটু বেশি
খেয়েছিলাম বলে তুই পিঠে সে কি জোরে জোরে কিল বসিয়ে দিলি। মনে নেই তোর? আমারও তো সব মনে পড়ে। একদিন দুপুরে দু'জনে বড় রাস্তার ঐ মাথায়
সিগারেটের উচ্ছিষ্ট অংশটুকু আগুনে ধরিয়ে ইচ্ছেমতো
ফুঁকলাম। আমি নাক দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে পারলেও তুই
পারিসনি। দুই টান দেওয়ার পর তোর সে কি কাশি।
কাশতে কাশতে চোখ লাল হয়ে পানি পড়া শুরু হলো।
হঠাৎ চাচা বাড়ি যাওয়ার সময় দু'জনকে দেখে ফেললো। বাড়িতে এনে শাস্তি হিসাবে দু'জনকে গামছা দিয়ে কিছু সময় বেঁধে রাখলো। মুক্তি বু আমাদের দুই
আসামিকে দেখে খিলখিল করে হাসলো।

আশিকের কথা শুনে সুপ্তিও এবার ফিক করে হেসে উঠলো। আশিকও হাসছে। কি যে ভালো লাগছে! কতদিন পর সুপ্তিকে এমন হাসতে দেখলো। আশিক চায় এমন করেই সুপ্তির ঠোঁটে সব সময় হাসি লেগে থাকুক। তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখুক। সুপ্তির মনের কথা,ইচ্ছের কথা,ভালো লাগার কথা অকপটে বলুক। সুপ্তিটা কেন দূরে দূরে থাকতে চায়?
সুপ্তি হাসতে হাসতে বলল,সব মনে আছে। শৈশবের স্মৃতি কেউ ভুলতে পারে না। শৈশব কেন? কোনো স্মৃতিই মানুষ ভুলতে পারে না। আজ যা ঘটবে কালকেই তা স্মৃতি হয়ে থাকবে। ক্ষণে ক্ষণে মনে পড়বে।

সন্ধ্যার আযান শুনে মিসেস করিম সুপ্তিকে ডাকলেন।নীচ থেকে মায়ের ডাক শুনে সুপ্তি আশিককে নিয়ে ঘরে আসলো। আশিক ওযু করে মাগরিবের নামাজ পড়ার জন্য অন্য ঘরে গেল। সুপ্তি ঘরের জানালা আটকিয়ে ওযু করে মাগরিবের নামাজ আদায় করে মোনাজাত শেষে উঠে দাঁড়াতেই চোখ গেল খাটের কোণায়।
বড় একটা প্যাকেট বালিশের উপরে রাখা। কিছুটা কৌতুহল হয়ে প্যাকেটটা ধরে বুঝার চেষ্টা করছে ভিতরে কি আছে। ঠিক তখনি আশিক এসে সামনে দাঁড়ালো।

----চলবে
মাকসুদা খাতুন দোলন

Hikmatullah khan, Ahmed ridoy akon, Meher afroj, Umme ayman, Rahan balich, Zahirul islam, Zoya khan and লেখাটি পছন্দ করেছে

avatar
Shamim
ধুমকেতু
ধুমকেতু
Posts : 23
স্বর্ণমুদ্রা : 1110
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-06-01

মাতৃত্বের স্বাদ - Page 2 Empty Re: মাতৃত্বের স্বাদ

Wed Jul 28, 2021 6:22 pm
মাতৃত্বের-স্বাদ (২২)

-খুলে দেখ! পছন্দ হয় কিনা! দুটো একই কালার। তোরটা বাসন্তী রংয়ের কিনেছি। এখানে শুধু তোর আর মুক্তি বু'রটা আছে।
সুপ্তি প্যাকেট খুলে দুটো শাড়ি বের করলো। আশিকের
মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
-কিছুই বুঝতে পারছি না। হঠাৎ শাড়ি কেন আনতে গেলি?
- টিউশনির প্রথম মাসের অনারিয়াম। তিনবোনের জন্য
কিনেছি।
-চাচা,চাচিকে রেখে আগে বোনদের জন্য কিনলি কেন?
এটা ঠিক হয়নি।
-পরের মাসে ওনাদের জন্য বরাদ্দ। মা,আব্বা আর চাচির জন্য পছন্দের কিছু কিনে আনবো। এটা আগেই
ঠিক করে রেখেছি।
সুপ্তি বাসন্তী রঙের শাড়িটা হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখছে। অসময়ে মনের ভিতর গোপনে বসন্ত এসেছিল।
এই বসন্ত জীবনটাকে এলোমেলো করে দিবে বুঝতে পারিনি। কাউকে বুঝাতে পারি না ভিতরে কতটা রক্ত ঝরে। অকারণেই চোখ দুটো ভিজে উঠে। দূর থেকে
মায়াবী ছোট্ট ডাক কানে ভেসে আসে। মা তুমি দূরে কেন? তোমাকে ছেড়ে থাকতে কষ্ট হয়। তুমি কাছে এসে বুকে জড়িয়ে নাও। তোমাকে ছাড়া আমি ভালো নেই।
আশিক সুপ্তির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মাথায় হাল্কা ধাক্কা দিয়ে বলল,
- এই সুপ্তি, কি ভাবছিস? শাড়ি তোর পছন্দ হয়নি ?
সুপ্তি থতমত খেয়ে যায়। ভাবনা থেকে ফিরে আসে।
-খুব পছন্দ হয়েছে! চল্ চা খাবি।

সুপ্তি রান্নাঘরে এসে চুলায় চায়ের পানি বসালো। আশিক ড্রইংরুমে টিভি ছেড়ে রিমোট হাতে সোফায় বসলো। সুপ্তি চা,বিস্কুট মায়ের ঘরে দিয়ে ট্রে হাতে আশিকের পাশের সোফায় বসে চায়ের মগ এগিয়ে বলল,
-তোর ঐখানে কোনো বেস্ট ফ্রেন্ড হয়নি?
--হয়েছে। তুই থাকলে খুব ভালো হতো। তোকে সব সময় মিস করি। জানিস, ন্যান্সি নামে এক বান্ধবী আছে এত মজা করে কথা বলতে পারে। ওর সামনে কেউ মন খারাপ করে থাকতেই পারে না। ওর কথা শুনে হাসতে বাধ্য। ও বাবা,মায়ের একমাত্র সন্তান। দেখতেও খুব সুন্দরী। গান গাইতে পারে। কবিতা আবৃত্তিও মনোমুগ্ধকর। বিকেলের আড্ডায় ন্যান্সির গান না হলে
জমেই না। সব ফ্রেন্ডরা তোকে নিয়ে যেতে বলেছে।
সুপ্তি চুপচাপ গরম চা গিলছে মনোযোগ দিয়ে আশিকের
কথা শুনছে। তোকে নিয়ে যেতে বলেছে শুনেই প্রশ্ন করলো,
-আমাকে নিয়ে যেতে বলেছে মানে কি? আমাকে চিনে?
-তোর কথা আলাপ করেছি। তোর আর আমার শৈশবে
কাটানো সময়। একই স্কুল,কলেজে লেখাপড়া। দু'জনের মাঝে খুনসুটি সবকিছু বলেছি। সবাই জানে তোর সাথে আমার......
-থামলি কেন?
-বুঝিস না?
-বুঝি। ভুল করছিস!

আশিক কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনি ফোন হাতে মিসেস করিম ড্রইং রুমে ঢুকে বললেন, এতক্ষণ মুক্তির সাথে কথা হলো। ওর মেটার্নিটি লিভ প্রায় শেষ হতে চলেছে। গ্রীষ্মের বন্ধের পনেরো দিন পরে জয়েন করবে।
ভাবছি এই ক'দিনের মধ্যে আমিও একবার সুকন্যাকে দেখে আসবো। পরে আমারও স্কুল থাকবে যেতে পারবো না।
আশিক বাড়ি যেতে চাইলে মিসেস করিম আশিককে রাতের খাবার খেয়ে যেতে বললে খেতে রাজি হলো। সুপ্তি খাবার গরম করে টেবিলে দিয়ে মা,আশিককে ডেকে আনলো। বাড়ির টুকটাক কথা বলতে বলতে আশিক বলল, চাচি আব্বার শরীরটা তেমন ভালো যাচ্ছে না। সুগার বেড়ে গেছে। প্রেসার তো আছেই। কোনো নিয়ম মানে না। মা সালমার বাড়ি গেছে প্রায় দেড়মাস হলো। মিসেস করিম বললেন,
সালমার আবার ছেলে হয়েছে শুনলাম। সালমা তার বাচ্চা কেমন আছে? ভাবী মেয়ে,নাতিকে বাড়ি নিয়ে আসলেই তো পারে। তাহলে ভাইজানের তেমন কষ্ট হয় না। আশিক বলল,সালমার শাশুড়ি আসতে দিচ্ছে না।
আমিও মাকে ফোন করে এটাই বললাম। বলল,
দু'চারদিনের মধ্যে চলে আসবে। আশিক তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে বিদায় নিয়ে বাড়ি চলে গেলো।

চার,পাঁচ দিন আশিক তার বাবাকে নিয়ে ব্যস্ত সময় পার
করে। ডাক্তার দেখিয়ে বিভিন্ন টেস্ট করিয়ে ঔষধ কিনে হলে যাওয়ার আগের দিন দুপুরে সুপ্তির সাথে দেখা করতে আসলো। মিসেস করিম পুরো শরীর কাঁথা দিয়ে ঢেকে শুয়ে আছে। আশিক রান্নাঘরে উঁকি দিল। সুপ্তি চুলায় ভাজি নাড়ছে।
-কি রে ঘেমেটেমে একাকার হয়ে গেছিস! কি এত রাঁধিস? পিছন দিক তোর জামা ভিজে গায়ের সাথে লেগে গেছে।
সুপ্তি হাতের কাছে রাখা ওড়না বুকে জড়িয়ে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে আসলো। ফ্যান ছেড়ে চেয়ার টেনে বসে
বলল,
-রাত থেকে মায়ের খুব জ্বর। কিছুই খেতে চাইছে না।
তাই আলু,করল্লা ভাজলাম যদি একটু ভাত খাওয়াতে পারি।
-আমিও ভাবছি চাচির শরীর ভালো নেই হয়তো। না হলে এত গরমে কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকবে কেন?
কোনো ঔষধ খেতে দিস নাই?
- প্যারাসিটামল রাতেও খেয়েছে। সকালে অল্প কিছু খেয়ে আবার খেলো। দেখি সন্ধ্যায় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো।
আশিক সুপ্তির মুখের দিকে বারবার তাকাচ্ছে। নাকের ডগায় শিশির বিন্দুর মতো খানিকটা ঘাম জমেছে।
এই মুহূর্তে সুপ্তির মুখটা তার কাছে বৃষ্টিস্নাত ফুটন্ত গোলাপের মতো মনে হচ্ছে। গ্রীষ্মের রৌদ্রজ্বল দুপুরে প্রচণ্ড গরমে তার গাল দুটো লালচে আভায় আরও ঝলমলে লাগছে। সুপ্তির গালদুটো ছুঁয়ে নাকের ঘাম মুছে দিতে ইচ্ছে করছে আশিকের। নিজের অভিব্যক্তি না জানিয়ে থাকতে পারলো না। মুচকি হেসে বলল,
-তোর নাকের ডগায় ঘাম জমে আছে। নাক ঘামলে কি হয় জানিস? কেন জানি তোকে আজ খুবই সুন্দর লাগছে!
সুপ্তি নাক,মুখ মুছতে যাবে ঠিক তখনি আশিক বলল,
-মুছিস না। আমি দেখবো।

সুপ্তির ভিতরটা শিহরিত হয়। ভালো লাগার আবেশ তার মনকে আলিঙ্গন করলেও কারো সুন্দর কমপ্লিমেন্ট এখন তার কাছে অসহ্য লাগে। নিজেকে আর গলাতে চায় না। পাথরের মতো শক্ত থেকেই জীবনের বাকিটা পথ পাড়ি দিবে। ভিতরে যে বিমূর্ত কষ্টের পাথর বসে আছে। সেখানটায় কোনো আবেগ,ভালোবাসাকে প্রশ্রয় দিবে না। সুপ্তি ম্লানমুখে স্মিত হেসে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
-সব সুন্দরের আড়ালে কিছু অসুন্দর,কালিমা লুকিয়ে থাকে। অসুন্দরগুলো আমরা নানা কৌশলে ঢেকে রাখি তাই চোখে পড়ে না। নিজের খারাপ দিকগুলো আমরা ক'জন বলতে জানি? অন্যের হতাশা,অপূর্ণতা,কষ্ট, ভুলের প্রায়শ্চিত্তের দায়ভার কি কেউ স্বেচ্ছায় কারোরটা নিতে জানে? কেউ নেয় না। দুনিয়ায় ভালোর সাথি সবাই। মন্দের সাথি কেবল চোখের জল,আঁধার রাত।
আশিক রাগে বলল,
-তোকে বারবার বুঝতে গিয়ে ব্যর্থ হচ্ছি। এত কঠিন হয়ে গেলি কেন? তোর জীবনে কি এমন ঘটেছে? কে এসে তোর জীবনে দুঃখ,কষ্ট,হতাশা ভরিয়ে দিল?
সুপ্তি ভার গলায় বলল,
-আমার একটা রিকোয়েস্ট থাকবে। তুই তোর সুন্দর জীবনে আমাকে জড়িয়ে নিজের মতো এতকিছু ভাবিস না। খুব কষ্ট পাবি। তুই আমাকে শুধু তোর কাজিন আর একজন ভালো বন্ধুই ভাবিস!
আশিক শান্ত গলায় বলল,
-এত সহজে হাল ছাড়ছি না। যাকে মনে বেঁধে নিয়েছি।
যে আমার রক্তের প্রতিটি শিরা উপশিরায় মিশে আছে
তাকেই চাই এবং আজীবন তাকেই চাইবো। তাকেই বিয়ে করবো। তুইও ভালো করে মাথায় রাখিস। যদি আমাকে পছন্দ নাই করতিস তবে কেন আমার ফিউচার নিয়ে ভাবতিস? বল্ কেন ভালো রেজাল্ট,ভালো জায়গায় ভর্তির জন্য উৎসাহ দিয়েছিলি? তোর আর বু'র কথায় লেখাপড়ায় মন দিয়েছি। তোদের অনুপ্রেরণায় নিজেকে একটা ভালো জায়গায় নিতে পেরেছি। তোর মনে নেই সেইদিনের কথা? তোকে বলেছিলাম, ভালো জায়গায় ভর্তি হয়ে তোকে মনের কথা জানাবো। তুই শুনে চুপ করে ছিলি। আমি জানি, তুই আমাকে ভালোবাসিস,খুব পছন্দ করিস।

সুপ্তি কোনো কথা না বলে রান্নাঘরে চলে আসলো। ভাজি নেড়ে ঢেকে দিল। অন্য চুলায় মায়ের জন্য গরম পানি বসিয়ে দিল।
আশিক চেয়ার ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য পা পাড়ালো।
-কাল ভোরে ভার্সিটিতে ফিরে যাচ্ছি। সন্ধ্যায় আবার আসবো। চাচির জ্বর না কমলে বিকালে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবি। আমিও থাকবো।
সুপ্তি বলল,
-দুপুরে ভাত খেয়ে যা!
- না,আজ খাবো না। কোনো বাজার করার থাকলে বল্
করে দেই।
সুপ্তি রান্নাঘর থেকেই হেসে উঠলো।
-এত ভাবিস না। সুপ্তি আস্তে আস্তে সব শিখে নিয়েছে।
একাই এখন অনেক কিছু করতে পারে।
-বুঝলাম। তুই অনেক বড় হয়ে গিয়েছিস। আমি যতদিন
কাছে থাকবো সবকিছু তোকে একা করতে দিচ্ছে কে শুনি?
সুপ্তি চুপ করে থাকে। তার মনটা খারাপ হয়ে যায়। আশিকের জন্য খুব কষ্ট হয়। আশিক তার সমস্ত সত্তায় আমাকে কেন এমনভাবে জড়িয়ে নিল। তার সুন্দর জীবনে কপাল পুড়া সুপ্তিকে নিয়ে সে কখনোই সুখী হতে পারবে না। সে কেন বুঝতে চাইছে না? আমিই কেন ওকে নিজের কথা জানিয়ে দিচ্ছি না? ওর সাথে কোনো অন্যায় করবো না। যে করে হোক আশিককে দূরে সরিয়ে রাখবোই। তার পবিত্র ভালোবাসার কাছে হার মেনে ওকে ঠকাতে পারবো না।
-সুপ্তি চলে গেলাম। তুই রান্নায় ডুবে আছিস। বিকালে তৈরি থাকিস। ঠিক পাঁচটায় চলে আসবো।
আশিক এই কথা বলে চলে গেল।

সুপ্তি হালকা গরম পানি দিয়ে মায়ের শরীর মুছে দিল।
মুখে তুলে অল্প একটু ভাত খাইয়ে প্যারাসিটামল খেতে দিল। মাথার তালুতে অল্প একটু তেল দিয়ে চুলে হালকা বিলি কেটে দিতে দিতে বলল,মা ঘুমানোর চেষ্টা করো।
জ্বর না কমলে বিকালে ডাক্তারের কাছে যাবো। আর দেরি করা ঠিক হবে না। মিসেস করিম চোখ বন্ধ করে আছে। মেয়ের হাতের স্পর্শ পেয়ে চোখের পাতায় ঘুম জুড়ে আসে। মিনিট দশেক পর মা ঘুমিয়ে পড়েছে দেখে
সুপ্তি ঘরদোর গুছানো,কাপড় ধোয়ার কাজ শেষ করে বাথরুমে ঢুকে। অনেকসময় নিয়ে গোসল করে বের হয়ে গেইটে নক করার আওয়াজ শুনে। চুল থেকে টাওয়েলের প্যাঁচ খুলে দ্রুত বাইরের বারান্দায় আসে।
খাঁকি পোশাকে পিয়ন চিঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সুপ্তিকে দেখেই পিয়ন বললেন,
সুপ্তি মা, তোমার চিঠি আছে। সুপ্তি গ্রিলের ফাঁক দিয়ে ডানহাত বের করে হলুদ খামের চিঠিটা নিল। ইতিমধ্যে তার বুকে থুকথুকানি শুরু হয়ে গেল।
নিজের ঘরে এসে ঠিকানাহীন চিঠির খাম খুলে পড়তে শুরু করলো,
প্রিয়া,
যেইদিন প্রথম তোমায় দেখি। সেইদিন তোমার ইনোসেন্ট মুখটায় বিস্বাদের কালো ছায়া ঢেকেছিল। পরনে ছিল হালকা পার্পেল কালার ড্রেস। চোখে কার্বন ফ্রেমের চশমা। মুখে ছিল না কোনো প্রসাধনী। অধর দুটোও ছিল না রঙিন। অজানা এক অদ্ভুত আর্কষণে বারবার লুকিয়ে দেখেছি তোমাকে। ঐদিনের পর থেকে প্রায় সময় তোমাকে একবার নয় শতবার চোখ দুটো ফিরে
গিয়েছিল তোমার কাজল কালো ঐ চোখের গভীরে।
যখন তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে হনহন পায়ে হেঁটে যেতে
ফুটপাথ ধরে। তখনও চুপটি করে তোমার পিছু নিতাম। পিছন পিছন অনেকটুকু পথ হেঁটে যেতাম। তোমার পিঠজুড়ে ছিল দীঘল কালো চুলের লকলকে বিনুনি।
ডানকাঁধে ঝুলানো ছিল সূতার কারুকাজে কাপড়ের ব্যাগ। তুমি কখনোই পিছনে তাকাতে না। সময়ের সাথে
দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে এক সময় চোখের আড়াল হয়ে যেতে। আমিও আমার পথে ফিরে আসতাম। আজ কতদিন হলো তোমার ঐ মায়াবী মুখটি দেখি না। বড্ড দেখতে ইচ্ছে করে! দেখে যাবো ঠিক ততদিন, যতদিন রবে এ দেহে প্রাণ।
ক্ষণিক জীবনে কত লোকের ভীড়ে,
কে কার জীবনে এসে যায় হঠাৎ করে।
কিছু স্বপ্ন,কিছু কল্পনা,কিছু ভালোবাসা থাকে ঘিরে, ক্ষণেক্ষণে প্রিয় সেই মুখটিই মনে পড়ে।
ভালো থেকো নিরন্তর,
হয়তোবা কিছু চাইবার,কিছু দেবার;
মুখোমুখি হবো অনেক বছর পর....

সুপ্তি বেশ উত্তেজনা নিয়ে চিঠিটা পড়ে শেষ করে। মনে মনে বিড়বিড় করে বলে, কি শুরু হলো জীবনে? আমাকে কেউ ভালো থাকতে দেবে না দেখছি। যত্তসব ফাইজলামি। ভালো করে বুঝতে পারছি ডিপার্টমেন্টের
কোনো রামছাগল ছাড়া আর কেউ না। সাহস নেই সামনে আসার। ঠিকানা ছাড়া চিঠি পাঠিয়েছে। কাপুরুষ একটা। সুপ্তি চিঠিটা টেবিলে রেখে দুপুরের খাবার খেয়ে ঘুম দিল। সারাদিনের পরিশ্রমে এখন ঘুম চোখে লেগেই থাকে। শুইলেই ঘুমে চোখের পাতা বুঁজে আসে।

বিকালে আশিক এলে মা'কে নিয়ে ডাক্তারের কাছে এল সুপ্তি। ডাক্তার প্রেসক্রিপশন লিখে দিলেন। ঔষধ,কিছু
ফল কিনে বাসায় আসলো। আশিক বলল,
সুপ্তি চা কর। তোর হাতের চা খেয়ে তারপর চলে যাবো।
রাতেই সব গুছিয়ে রাখতে হবে। খুব ভোরে ট্রেন।
মুক্তির ফোন আসলে মিসেস করিম কথা বলতে বলতে শোবার ঘরে শুয়ে কথা বলছেন। সুপ্তি গেল চা বানাতে।
আশিক টেবিল থেকে চিঠিটা নিয়ে পড়লো। রাগে তার চোখ,মুখ লাল হয়ে যায়। সুপ্তির সামনে গিয়ে চিঠিটা ধরলো,
-এটা কার চিঠি?
-জানি না।
-ওও এইজন্যই আমার সাথে এমন অভিনয় করে যাচ্ছিস? খুব ভালো।
-বাজে কথা বলিস না!
-সুপ্তি,আজই চাচির সাথে কথা বলবো তোর আমার বিয়ের ব্যাপারে।
-পাগল হয়ে গেলি? প্লিজ শান্ত হ আশিক।
-তোর একটা কথাও শুনবো না। দু'জনের বিয়ে আজই
ফাইনাল হবে। আব্বা আমার পছন্দ মেনে নিবে।
- অস্থির হওয়ার কিছু নেই। চিঠিটা ভালো করে পড়ে বুঝতে চেষ্টা কর। আমার সাথে কোনো রকম প্রেমের সর্ম্পক আছে কিনা। ঠিকানা বিহীন একটা উড়ো চিঠি নিয়ে এতটা রিএক্ট করছিস কেন? এটাই বুঝতে পারছি না।
-তোকে জীবনের চাইতে বেশি ভালোবাসি এটা বুঝিস
তো? তুই শুধুই আমার। তোকে কেউ পছন্দ করলে,
তোর জীবনে অন্য কেউ এলে তাকে গুলি করবো। মনে রাখিস!
সুপ্তির চোখ দুটো ভিজে উঠে। নিজেকে সংযত করে জোরে হেসে ভেতরের কষ্টটাকে ঢেকে দিল। চা ছেঁকে মগ ভর্তি করে তিনজনের চা ঢাললো। গরম চায়ের মগ আশিকের হাতে দিয়ে বলল,
নে ধর। চা খেয়ে আউলা মাথা ঠিক করে নে। খুব ক্ষেপে গেছিস! বিশ্বাস কর চিঠির মানুষটিকে আমি চিনি না, জানি না। কোনোদিন দেখি নাই। সুপ্তি দ্রুত তার ডানহাত
আশিকের মাথায় রাখলো। এই দেখ্ তোর মাথা ছুঁয়ে বলছি। সত্যিই আজই দুপুরে প্রথমবার এই চিঠিটা আসছে। তোর হাত দিয়ে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দে। এই চিঠির প্রতি বিন্দুমাত্র আমার আর্কষণ
নেই। আশিক চায়ের মগ রেখে সুপ্তির হাতটি শক্ত করে নিজের হাতে চেপে রাখলো কিছুসময়। দু'জন দু'জনের দিকে আছে। আশিক শান্ত গলায় বলল,
-তোকে আঁকড়ে ধরেই আমি ভালো থাকবো। আর কাউকে না। তুই ছাড়া কাউকে আমার জীবনে চাই না।
আমাকে কেউ ভালো রাখতে পারবে না। তুইও ভালো থাকবি না। আমরা দু'জন যে অনেক আগে থেকেই একই সূতোয় মায়ার বাঁধনে বাঁধা পড়ে আছি।

আশিক আবেগাপ্লুত হয়ে কেঁদে ফেলে। সুপ্তির চোখ দুটোও স্যাঁতেস্যাঁতে। সুপ্তি আশিকের চোখের পানি মুছে দিল। আশিক সুপ্তিকে কাছে টেনে বুকে জড়িয়ে অধরের
কাছে মুখ নিতেই সুপ্তি নিজেকে ছাড়িয়ে কিছুটা দূরে চলে আসে।
-কি হলো? লজ্জা পেলি কেন?
-না,এইসব খুব অন্যায়।
আশিক হেসে বলল,
-বুঝতে পেরেছি। আচ্ছা থাক। সবকিছু ভবিষ্যতের জন্য রেখে দিলাম।
সুপ্তি কোনো জবাব দিল না। অন্যদিকে ফিরে আছে।
আশিক চা শেষ করে চলে গেল।
------------চলবে
মাকসুদা খাতুন দোলন

Umma Mejana khatun, Arbaj khan, Hikmatullah khan, Ruma islam, Akaram khan, Jalsan khan, Feroz hassan and লেখাটি পছন্দ করেছে

Sponsored content

মাতৃত্বের স্বাদ - Page 2 Empty Re: মাতৃত্বের স্বাদ

Back to top
Permissions in this forum:
You cannot reply to topics in this forum