- Trimatraধুমকেতু
- Posts : 23
স্বর্ণমুদ্রা : 1246
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-06-05
স্যার ভাইয়া
Sat Jun 05, 2021 8:26 pm
মায়ের শরীর বেশ কিছুদিন ধরে খারাপ। তবুও এ মানুষটা কীভাবে যেন হাসিমুখে সংসার চালায়। মাটির ব্যাংকে জমানো টাকা আগেই ওষুধ কিনে শেষ হয়ে গিয়েছে। বাবা নেই, পরিবারটি সম্পূর্ণ আমার কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে। ছোটবোনের পড়ালেখার খরচ চালানোর পাশাপাশি ছোটখাটো বায়না তো রয়েছেই। এদিকে নিজের পড়াশোনা। সব মিলিয়ে নিষ্ঠুর এক পরিস্থিতি।
হাতে থাকা একটা টিউশনিও সেদিন ছুটে গেল। তারা নাকি অন্য কোথাও শিফট হয়েছে। পরিবারের আয়ের দ্বিতীয় কোনো রাস্তা খোলা নেই। এই মুহূর্তে একটা টিউশনি খুব দরকার। আল্লাহর কৃপায় কিছুদিন উত্তর-দক্ষিণ খোঁজ করে পেয়েও গেলাম। বেশ ভালো অংকের বেতন পাব। বিষণ্ণ চেহারায় আনন্দের হাসি ফুটে ওঠে। যাক! একটা পথ তো খুলে গেল।
ক্লাস টু এর পিচ্চি একটা মেয়ে, তবে নাকি খুব চালাক ও মেধাবী। পড়ার রুমে বসে অপেক্ষা করছি। খানিক সময় বাদ আন্টি কিছু নাস্তা নিয়ে এলেন। খেতে বলে উনি আবারও চলে গেলেন দরজার পাশে দেখলাম মেয়েটি উঁকি মারছে। ইশারায় ডাকলাম তাকে। প্রথমে ভেংচি মারলো৷ একটু ইতস্তত হয়ে নড়েচড়ে বসলাম। মেয়েটি আমার কাণ্ড দেখে ফিক করে হেসে দিলো, মায়াবী আর মিষ্টি বটে। আবারও ইশারা দিলে এগিয়ে আসলো। তার কাছে জুসের গ্লাসটি এগিয়ে দিলাম। খানিকক্ষণ চেয়ে রইলো আমার দিকে। এরপর বললো, "এগুলো আম্মু তোমাকে দিয়েছে, আমি কেন ভাগ বসাবো?"
থ হয়ে কিছু সময় চেয়ে রইলাম তার মুখের দিকে। এখনও মুচকি হাসছে। পাশে থাকা চেয়ারটায় বসে পা দুলাতে দুলাতে কয়েকবার ডানে-বামে মাথা বাকায়। তারপর জিজ্ঞাসা করে, "আচ্ছা তোমার নাম কী?"
প্রশ্নটা আমার করা উচিত ছিল কিন্তু তার আগেই সে করে বসে। অদ্ভুত, স্টুডেন্টের কাছে এমন প্রশ্ন কেউ আজ অব্দি শুনেছে কি না জানা নেই আমার।
"রাফসান..."- বলেই টেবিলের উপর দু'হাতের ভর রেখে জিজ্ঞাসা করলাম,"...আর তোমার নাম?"
আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই সে আবারও বললো, "শুধুই রাফসান? আগে পিছে কিছু নেই?"
আমি বারবার মেয়েটির প্রশ্নের কাছে আটকে যাচ্ছি। অন্য কেউ হলে কখনওই এমনটা হতো না। কিন্তু ও, সবে ক্লাস টু এর বাচ্চা।
আর কিছু বলার আগেই আন্টি এসে তার বইখাতা নিয়ে এসে মেয়েটিকে বলেন, "তিথী, আজ থেকে এই ভাইয়া তোমাকে পড়াবেন। কোনো বেয়াদবি করবে না। আপনি করে কথা বলবে। কেমন?"
জানতে পারলাম মেয়েটির নাম তিথী। আন্টির কথায় সায় দিয়ে মাথা নাড়ালো। চলে যেতেই ঠোঁটদু'টো আঙুলে চেপে প্রশ্ন করে, "আম্মু তোমাকে আপনি করে বলতে বললো। আমি কিন্তু তোমাকে তুমি করেই বলবো। ওকে?"
ছোট মানুষের উপর কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া কখনওই উচিত নয়। তারা যেটাতে স্বাচ্ছন্দবোধ করে সেটাই করতে দেওয়া উচিত। তবে নেতিবাচক আবদারের ক্ষেত্রে নয়। তিথীর কথায় মাথা নাড়ালাম। কিছু বলার আগেই সে আবারও বলে ওঠে, "আচ্ছা সবাই তো টিচারকে স্যার বলে ডাকে, কিন্তু আম্মু আবার বললো তোমাকে ভাইয়া ডাকতে। এখন কি বলে ডাকবো আমি?"
অবাক হওয়া প্রশ্ন বটে। পরে বললাম, "তোমার যেটা ভালো লাগে।"
"দূর, আমিও তোমাকে তুমি করে বলছি আর তুমিও আমাকে তুমি করে বলছো। তাহলে আমাদের ছাত্রি শিক্ষকের মধ্যে পার্থক্য থাকলো কিসে?"
তার চিকন স্বরে বলা প্রত্যেকটা কথাই অবাক করছে আমাকে। এমনটা কখনও হয়নি যে অন্য কেউ প্রশ্ন করছে আর আমি একেবারে চুপ করে আছি। উত্তর যেন জেনেও জানা নেই।
"আচ্ছা শোন, তুমি আমাকে তুই করে বলবা। আর আমি তোমাকে স্যার ভাইয়া বলে ডাকবো। কী? রাজি তো?"
রাজি হয়ে গেলাম। মনে মনে এটাই ভাবতে লাগলাম ক্লাস টু এর মেয়ে এতো ক্রিয়েটিভ!
রোজ রোজ তিথীকে পড়ানো, তার সাথে গল্প করা, অনেক ভালো লাগতো। নিজের ছোট বোনের মতোই ভালোবাসতাম তাকে। দিন যেতে যেতে কখন যে মাস হয়ে গেলো বুঝতে পারিনি। আজ তিথীর আম্মু টিউশনির বেতন দিয়ে চলে যান। মানিব্যাগ টা বের করে টাকা রাখতে যাবো তখন তিথী উঁকি মারে মানিব্যাগ টার দিকে..
"স্যার ভাইয়া, তোমার মানিব্যাগে ওটা কার ছবি?"
"পড়ায় মনোযোগ দে।"
"আগে বলো ওটা কার ছবি। জিএফ-এর?"-বলেই হিহি করে হেসে ওঠে ও, প্রচণ্ড মায়াবী হাসি ওর।তার কথার উত্তর না দিয়ে আবারও বললাম, "তোর এতো কিছু দিয়ে কাজ নেই। চুপচাপ পড়।"
"বলোনা প্লিজ কার ছবি। নাম কী আপুটার?"
"তানহা"
"তার ছবি রেখে দিয়েছো কেন?"
"এমনি।"
"বুঝেছি, সে তোমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। তাই না? এজন্য তার ছবি স্মৃতি হিসেবে রেখে দিয়েছো?"
মেয়েটির বুঝে ওঠার ক্ষমতাটা অদ্ভুত। এই একমাসে অনেকবারই তার কথা শুনে হা করে থাকা ছাড়া উপায় ছিল না।
"আচ্ছা ভাইয়া তোমাকে যদি আর কেউ ছেড়ে চলে যায় তাহলে কি তার ছবিটাও মানিব্যাগে রাখবে?"
"আর কে যাবে আবার?"
"আমি, হিহিহি।"
কথাটি বলে আবারও হিহি করে হাসতে থাকে তিথী। কিন্তু আমি স্তব্ধ হয়ে যাই একেবারেই৷ অজানা শূন্যতার ব্যথা টের পাচ্ছিলাম। সেদিন আর খুব বেশি পড়াই নি, পড়াতেও পারিনি।
যতই দিন যাচ্ছে মেয়েটার প্রতি ভালোবাসা আর স্নেহ আরো বেড়ে চলেছে। কিছুদিন আগেও একেবারেই অচেনা ছিল মেয়েটা। বড় অদ্ভুত এই পৃথিবীটা। হঠাৎই এমন কারো উপর ভালোবাসা সৃষ্টি হয়, প্রচণ্ড ভালোবাসা- যাকে কখনও চিনতাম না।
আজ মেয়েটা কেমন যেন চুপচাপ। মুখের সেই মায়াভরা হাসিটাও নেই। বইখাতাও নিয়ে আসেনি। একটু পর ওর আম্মু এসে জানান যে তারা বাইরে কোথাও যাচ্ছেন। হাতে অর্ধেক মাসের বেতনের টাকাটা তুলে দিয়ে বলেন যে তারা ফিরলে আমায় ফোন করে জানাবে। তিথীর মন খারাপের কারণটা বুঝতে পারলাম। চোখদুটো ছলছল করছে মেয়েটার। আমার কন্ঠটাও ভারি হয়ে এসেছে খুব। মেয়েটি চলে যাওয়ার সময় আবারও ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে, কান্না করে দেয় এবার, "স্যার ভাইয়া, খুব মিস করবো তোমাকে।"
ওর মাথায় কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে দিয়ে বিদায় জানিয়ে চলে আসলাম। ইতিমধ্যে আরেকটা টিউশনি পেয়েছি, ক্লাস টেনের। তবে অতোটা বেশি ভালোবাসা মনে হয় না অন্য কোনো স্টুডেন্টের উপর জন্ম হবে। প্রতিদিন ফোন করে দু'মিনিট কথা বলতে না পারলে মন শান্ত হয় না। ওরা ছুটি নেওয়ার দিন থেকে প্রতিদিনই ভাবি যে এই অপেক্ষার প্রহর কবে শেষ হবে। আজ ক'টা দিন হলো আন্টির ফোন অফ। ভেতরে অনেকটা ছটফট করতে লাগলাম। চিন্তাও হচ্ছিলো খুব। একদিন হঠাৎ আন্টি কল করে বাসায় যেতে বলে। খুশিতে কেঁদেই ফেলেছিলাম প্রায়। তিথীর স্যার ভাইয়া ডাকটিকে আবারও শুনতে পাবো আজ থেকে।
বাসায় গিয়ে আন্টিকে সালাম দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম তিথী কোথায়। আমাকে বসতে বলে কিছু সময় পর হাতে একটা খাম নিয়ে আসলেন। কিছু বলতে যাব এমন সময় কেঁদে ওঠেন তিনি।
অজানা একটা শূন্যতা অনুভব করতে লাগলাম। মনে হচ্ছিলো কিছু হারিয়ে ফেলেছি আমি, অনেক প্রিয় কিছু। খানিকক্ষণ বাদে নিজেকে সামলে তিনি বললেন যে তিথী আর এই দুনিয়াতে নেই। হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যাই আমি। বুঝতে পারছি চোখদুটো ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।
"তিথীর হার্টে একটা ছিদ্র ছিলো, ডক্টর ও বলেছিলেন যে বেশি হলে দু-তিন মাস বাঁচতে পারে। তিথীও এটা জানতো। কিন্তু কখনো মন খারাপ করেনিও। প্রত্যেকের জীবনের এই বাস্তব সত্যকে মেনে নিয়েছিল ও। তুমি এই ক'টা দিন তিথীকে অনেক আনন্দের মধ্যে রেখেছিলে। তোমার ঋণ হয়তো কোনোদিন শোধ করতে পারব না।"
চোখ দিয়ে নিঃশব্দে পানি গড়িয়ে পড়ছে আমার। বারবার মেয়েটির মায়াবী হাসিটা মুখের সামনে ভেসে উঠছে। তার স্যার ভাইয়া ডাকটি আরেকবার শুনতে খুব ইচ্ছা করছে, যেটা আর সম্ভব নয়।
"এই খামটি রাখো। তোমার বাকি অর্ধেক মাসের বেতন আর একটা চিঠি। তিথী রেখে গিয়েছে তোমার জন্য।"
আমি জানি আমার অনেক প্রয়োজন টাকাগুলোর, অনেক বেশি। কিন্তু প্রশ্ন যেখানে মনুষ্যত্বের প্রয়োজন সেখানে কিছুই নয়। টাকাগুলো নিতে পারিনি। চিঠিটা বের করে ঝাপসা হয়ে যাওয়া চোখদুটোর সামনে ধরলাম-
“প্রিয় স্যার ভাইয়া, দেখলে আমিও তানহা আপুর মতোই স্বার্থপরের মতোই তোমাকে ছেড়ে চলে গেলাম। তোমার মানিব্যাগে তানহা আপুর ছবির পাশে আমার ছবিটা রাখবে তো? আর তোমাকে স্যার ভাইয়া ডাকা হলো না। বেশি মিস করো না আমায়।
তোমার ভালোবাসার তিথী।"
চোখ মুছতে মুছতে চিঠিটা ভাজ করে পকেটে রাখলাম। হয়তো শেষবারের মতো তাদের বাসা থেকে বিদায় নিলাম।
তিথীর একটি ছবি তানহার ছবির পাশেই রেখে দিয়েছি। প্রায় প্রতিদিন যাই তার কবর যিয়ারত করতে। কবরের উপরে থাকা সবুজ ঘাসগুলো বাতাসে দোল খেতে থাকলে মনে হয় যেন তিথী এই বুঝি ডেকে উঠলো...“স্যার ভাইয়া”
09 July 2018
Sayhan Ahmed
হাতে থাকা একটা টিউশনিও সেদিন ছুটে গেল। তারা নাকি অন্য কোথাও শিফট হয়েছে। পরিবারের আয়ের দ্বিতীয় কোনো রাস্তা খোলা নেই। এই মুহূর্তে একটা টিউশনি খুব দরকার। আল্লাহর কৃপায় কিছুদিন উত্তর-দক্ষিণ খোঁজ করে পেয়েও গেলাম। বেশ ভালো অংকের বেতন পাব। বিষণ্ণ চেহারায় আনন্দের হাসি ফুটে ওঠে। যাক! একটা পথ তো খুলে গেল।
ক্লাস টু এর পিচ্চি একটা মেয়ে, তবে নাকি খুব চালাক ও মেধাবী। পড়ার রুমে বসে অপেক্ষা করছি। খানিক সময় বাদ আন্টি কিছু নাস্তা নিয়ে এলেন। খেতে বলে উনি আবারও চলে গেলেন দরজার পাশে দেখলাম মেয়েটি উঁকি মারছে। ইশারায় ডাকলাম তাকে। প্রথমে ভেংচি মারলো৷ একটু ইতস্তত হয়ে নড়েচড়ে বসলাম। মেয়েটি আমার কাণ্ড দেখে ফিক করে হেসে দিলো, মায়াবী আর মিষ্টি বটে। আবারও ইশারা দিলে এগিয়ে আসলো। তার কাছে জুসের গ্লাসটি এগিয়ে দিলাম। খানিকক্ষণ চেয়ে রইলো আমার দিকে। এরপর বললো, "এগুলো আম্মু তোমাকে দিয়েছে, আমি কেন ভাগ বসাবো?"
থ হয়ে কিছু সময় চেয়ে রইলাম তার মুখের দিকে। এখনও মুচকি হাসছে। পাশে থাকা চেয়ারটায় বসে পা দুলাতে দুলাতে কয়েকবার ডানে-বামে মাথা বাকায়। তারপর জিজ্ঞাসা করে, "আচ্ছা তোমার নাম কী?"
প্রশ্নটা আমার করা উচিত ছিল কিন্তু তার আগেই সে করে বসে। অদ্ভুত, স্টুডেন্টের কাছে এমন প্রশ্ন কেউ আজ অব্দি শুনেছে কি না জানা নেই আমার।
"রাফসান..."- বলেই টেবিলের উপর দু'হাতের ভর রেখে জিজ্ঞাসা করলাম,"...আর তোমার নাম?"
আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই সে আবারও বললো, "শুধুই রাফসান? আগে পিছে কিছু নেই?"
আমি বারবার মেয়েটির প্রশ্নের কাছে আটকে যাচ্ছি। অন্য কেউ হলে কখনওই এমনটা হতো না। কিন্তু ও, সবে ক্লাস টু এর বাচ্চা।
আর কিছু বলার আগেই আন্টি এসে তার বইখাতা নিয়ে এসে মেয়েটিকে বলেন, "তিথী, আজ থেকে এই ভাইয়া তোমাকে পড়াবেন। কোনো বেয়াদবি করবে না। আপনি করে কথা বলবে। কেমন?"
জানতে পারলাম মেয়েটির নাম তিথী। আন্টির কথায় সায় দিয়ে মাথা নাড়ালো। চলে যেতেই ঠোঁটদু'টো আঙুলে চেপে প্রশ্ন করে, "আম্মু তোমাকে আপনি করে বলতে বললো। আমি কিন্তু তোমাকে তুমি করেই বলবো। ওকে?"
ছোট মানুষের উপর কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া কখনওই উচিত নয়। তারা যেটাতে স্বাচ্ছন্দবোধ করে সেটাই করতে দেওয়া উচিত। তবে নেতিবাচক আবদারের ক্ষেত্রে নয়। তিথীর কথায় মাথা নাড়ালাম। কিছু বলার আগেই সে আবারও বলে ওঠে, "আচ্ছা সবাই তো টিচারকে স্যার বলে ডাকে, কিন্তু আম্মু আবার বললো তোমাকে ভাইয়া ডাকতে। এখন কি বলে ডাকবো আমি?"
অবাক হওয়া প্রশ্ন বটে। পরে বললাম, "তোমার যেটা ভালো লাগে।"
"দূর, আমিও তোমাকে তুমি করে বলছি আর তুমিও আমাকে তুমি করে বলছো। তাহলে আমাদের ছাত্রি শিক্ষকের মধ্যে পার্থক্য থাকলো কিসে?"
তার চিকন স্বরে বলা প্রত্যেকটা কথাই অবাক করছে আমাকে। এমনটা কখনও হয়নি যে অন্য কেউ প্রশ্ন করছে আর আমি একেবারে চুপ করে আছি। উত্তর যেন জেনেও জানা নেই।
"আচ্ছা শোন, তুমি আমাকে তুই করে বলবা। আর আমি তোমাকে স্যার ভাইয়া বলে ডাকবো। কী? রাজি তো?"
রাজি হয়ে গেলাম। মনে মনে এটাই ভাবতে লাগলাম ক্লাস টু এর মেয়ে এতো ক্রিয়েটিভ!
রোজ রোজ তিথীকে পড়ানো, তার সাথে গল্প করা, অনেক ভালো লাগতো। নিজের ছোট বোনের মতোই ভালোবাসতাম তাকে। দিন যেতে যেতে কখন যে মাস হয়ে গেলো বুঝতে পারিনি। আজ তিথীর আম্মু টিউশনির বেতন দিয়ে চলে যান। মানিব্যাগ টা বের করে টাকা রাখতে যাবো তখন তিথী উঁকি মারে মানিব্যাগ টার দিকে..
"স্যার ভাইয়া, তোমার মানিব্যাগে ওটা কার ছবি?"
"পড়ায় মনোযোগ দে।"
"আগে বলো ওটা কার ছবি। জিএফ-এর?"-বলেই হিহি করে হেসে ওঠে ও, প্রচণ্ড মায়াবী হাসি ওর।তার কথার উত্তর না দিয়ে আবারও বললাম, "তোর এতো কিছু দিয়ে কাজ নেই। চুপচাপ পড়।"
"বলোনা প্লিজ কার ছবি। নাম কী আপুটার?"
"তানহা"
"তার ছবি রেখে দিয়েছো কেন?"
"এমনি।"
"বুঝেছি, সে তোমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। তাই না? এজন্য তার ছবি স্মৃতি হিসেবে রেখে দিয়েছো?"
মেয়েটির বুঝে ওঠার ক্ষমতাটা অদ্ভুত। এই একমাসে অনেকবারই তার কথা শুনে হা করে থাকা ছাড়া উপায় ছিল না।
"আচ্ছা ভাইয়া তোমাকে যদি আর কেউ ছেড়ে চলে যায় তাহলে কি তার ছবিটাও মানিব্যাগে রাখবে?"
"আর কে যাবে আবার?"
"আমি, হিহিহি।"
কথাটি বলে আবারও হিহি করে হাসতে থাকে তিথী। কিন্তু আমি স্তব্ধ হয়ে যাই একেবারেই৷ অজানা শূন্যতার ব্যথা টের পাচ্ছিলাম। সেদিন আর খুব বেশি পড়াই নি, পড়াতেও পারিনি।
যতই দিন যাচ্ছে মেয়েটার প্রতি ভালোবাসা আর স্নেহ আরো বেড়ে চলেছে। কিছুদিন আগেও একেবারেই অচেনা ছিল মেয়েটা। বড় অদ্ভুত এই পৃথিবীটা। হঠাৎই এমন কারো উপর ভালোবাসা সৃষ্টি হয়, প্রচণ্ড ভালোবাসা- যাকে কখনও চিনতাম না।
আজ মেয়েটা কেমন যেন চুপচাপ। মুখের সেই মায়াভরা হাসিটাও নেই। বইখাতাও নিয়ে আসেনি। একটু পর ওর আম্মু এসে জানান যে তারা বাইরে কোথাও যাচ্ছেন। হাতে অর্ধেক মাসের বেতনের টাকাটা তুলে দিয়ে বলেন যে তারা ফিরলে আমায় ফোন করে জানাবে। তিথীর মন খারাপের কারণটা বুঝতে পারলাম। চোখদুটো ছলছল করছে মেয়েটার। আমার কন্ঠটাও ভারি হয়ে এসেছে খুব। মেয়েটি চলে যাওয়ার সময় আবারও ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে, কান্না করে দেয় এবার, "স্যার ভাইয়া, খুব মিস করবো তোমাকে।"
ওর মাথায় কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে দিয়ে বিদায় জানিয়ে চলে আসলাম। ইতিমধ্যে আরেকটা টিউশনি পেয়েছি, ক্লাস টেনের। তবে অতোটা বেশি ভালোবাসা মনে হয় না অন্য কোনো স্টুডেন্টের উপর জন্ম হবে। প্রতিদিন ফোন করে দু'মিনিট কথা বলতে না পারলে মন শান্ত হয় না। ওরা ছুটি নেওয়ার দিন থেকে প্রতিদিনই ভাবি যে এই অপেক্ষার প্রহর কবে শেষ হবে। আজ ক'টা দিন হলো আন্টির ফোন অফ। ভেতরে অনেকটা ছটফট করতে লাগলাম। চিন্তাও হচ্ছিলো খুব। একদিন হঠাৎ আন্টি কল করে বাসায় যেতে বলে। খুশিতে কেঁদেই ফেলেছিলাম প্রায়। তিথীর স্যার ভাইয়া ডাকটিকে আবারও শুনতে পাবো আজ থেকে।
বাসায় গিয়ে আন্টিকে সালাম দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম তিথী কোথায়। আমাকে বসতে বলে কিছু সময় পর হাতে একটা খাম নিয়ে আসলেন। কিছু বলতে যাব এমন সময় কেঁদে ওঠেন তিনি।
অজানা একটা শূন্যতা অনুভব করতে লাগলাম। মনে হচ্ছিলো কিছু হারিয়ে ফেলেছি আমি, অনেক প্রিয় কিছু। খানিকক্ষণ বাদে নিজেকে সামলে তিনি বললেন যে তিথী আর এই দুনিয়াতে নেই। হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যাই আমি। বুঝতে পারছি চোখদুটো ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।
"তিথীর হার্টে একটা ছিদ্র ছিলো, ডক্টর ও বলেছিলেন যে বেশি হলে দু-তিন মাস বাঁচতে পারে। তিথীও এটা জানতো। কিন্তু কখনো মন খারাপ করেনিও। প্রত্যেকের জীবনের এই বাস্তব সত্যকে মেনে নিয়েছিল ও। তুমি এই ক'টা দিন তিথীকে অনেক আনন্দের মধ্যে রেখেছিলে। তোমার ঋণ হয়তো কোনোদিন শোধ করতে পারব না।"
চোখ দিয়ে নিঃশব্দে পানি গড়িয়ে পড়ছে আমার। বারবার মেয়েটির মায়াবী হাসিটা মুখের সামনে ভেসে উঠছে। তার স্যার ভাইয়া ডাকটি আরেকবার শুনতে খুব ইচ্ছা করছে, যেটা আর সম্ভব নয়।
"এই খামটি রাখো। তোমার বাকি অর্ধেক মাসের বেতন আর একটা চিঠি। তিথী রেখে গিয়েছে তোমার জন্য।"
আমি জানি আমার অনেক প্রয়োজন টাকাগুলোর, অনেক বেশি। কিন্তু প্রশ্ন যেখানে মনুষ্যত্বের প্রয়োজন সেখানে কিছুই নয়। টাকাগুলো নিতে পারিনি। চিঠিটা বের করে ঝাপসা হয়ে যাওয়া চোখদুটোর সামনে ধরলাম-
“প্রিয় স্যার ভাইয়া, দেখলে আমিও তানহা আপুর মতোই স্বার্থপরের মতোই তোমাকে ছেড়ে চলে গেলাম। তোমার মানিব্যাগে তানহা আপুর ছবির পাশে আমার ছবিটা রাখবে তো? আর তোমাকে স্যার ভাইয়া ডাকা হলো না। বেশি মিস করো না আমায়।
তোমার ভালোবাসার তিথী।"
চোখ মুছতে মুছতে চিঠিটা ভাজ করে পকেটে রাখলাম। হয়তো শেষবারের মতো তাদের বাসা থেকে বিদায় নিলাম।
তিথীর একটি ছবি তানহার ছবির পাশেই রেখে দিয়েছি। প্রায় প্রতিদিন যাই তার কবর যিয়ারত করতে। কবরের উপরে থাকা সবুজ ঘাসগুলো বাতাসে দোল খেতে থাকলে মনে হয় যেন তিথী এই বুঝি ডেকে উঠলো...“স্যার ভাইয়া”
09 July 2018
Sayhan Ahmed
Abul basar, Tanusri roi, Saiful Osman, Sumaiya akter, Rokeya hoq, Asha islam, Abir nill and লেখাটি পছন্দ করেছে
Permissions in this forum:
You cannot reply to topics in this forum
|
|