- Jamshedনবাগত
- Posts : 8
স্বর্ণমুদ্রা : 1122
মর্যাদা : 20
Join date : 2021-05-30
অলীক ভুবন
Sat Jun 05, 2021 9:54 pm
১|
আয়নায় নিজেকে দেখে সামিয়ার সারা শরীর রাগে থরথর করে কাঁপছে, ওর ইচ্ছা করছে এই মুহুর্তে আয়নাটা ভেঙে ফেলতে।
এদিক সেদিক তাকাতে তাকাতে টেবিলের উপরে কাঁচের একটা পানির গ্লাস সামিয়ার চোখে পড়ল। কালক্ষেপণ না করে ও গ্লাসটা হাতে নিয়ে সজোরে ছুড়ে মারল ড্রেসিংটেবিলের আয়নায়, মুহূর্তের মধ্যে আয়না ভেঙে চৌচির হয়ে গেল।
আজাদ বসার ঘরে বসে টেলিভিশন দেখছিল, কাঁচ ভাঙ্গার শব্দ শুনে ও ছুটে এসে ঘরে ঢুকল। ড্রেসিং টেবিলের আয়নার অবস্থা দেখে সামিয়ার দিকে তাকিয়ে আজাদ জিজ্ঞাসা করল, "সমস্যা কী তোমার? কী শুরু করলে?"
সামিয়া চেঁচিয়ে বলল, "তুমি ঘর থেকে বের হও, আমাকে একটু একা থাকতে দাও, প্লীজ।"
আজাদ রাগভরা চোখে কিছুক্ষণ সামিয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে ঘর থেকে বের হয়ে বাড়ির বাইরে চলে গেল। সামিয়া দরজা বন্ধ করে দিয়ে বিছানায় শুয়ে কাঁদতে শুরু করল।
আজ রান্নাঘরে নাস্তা বানানোর সময় সাদা শাড়ি পরিহিত এক বৃদ্ধাকে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সামিয়া ভয় পেয়েছে। আজাদকে এই কথা বলার পরও ও বিশ্বাস করেনি উল্টো হাসতে হাসতে বলেছে, "চারতলার সানসেডে বৃদ্ধা মহিলা এসে দাঁড়িয়ে ছিল এই কথা তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে বলো?" বেশকিছুদিন থেকে সামিয়া এই মহিলাকে দেখছে কিন্তু আজাদকে বলবার পরও ও বিশ্বাস করছে না, কখনো হেসে উড়িয়ে দিচ্ছে, কখনো রেগে যাচ্ছে। আজাদের উপরে সামিয়ার একই সাথে খুব রাগ হচ্ছে আবার খুব মন খারাপ হচ্ছে, বিছানায় শুয়ে কাঁদতে কাঁদতে ও ঘুমিয়ে গেল।
আজাদ বাড়ি থেকে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে যাত্রী ছাউনিতে গিয়ে বসল। আজকে ওর অফিসে যেতে ইচ্ছা করছে না।
উচ্চ-মাধ্যমিকে পড়াকালীন সময় আজাদের মা মারা গিয়েছে। স্নাতক-স্নাতোকোত্তর শেষ হবার পর আজাদের বাবা মোকসেদ মিয়া নিজে পছন্দ করে বছর দুয়েক আগে সামিয়ার সাথে ওর বিয়ে দিয়েছেন। বিয়ের পর দেড় বছর পর্যন্ত কোনো সমস্যা ছিল না, সমস্যার শুরু হয়েছে মাস পাঁচেক আগে। মাঝেমধ্যেই সামিয়া ভূত ভূত বলে বিকট চিৎকার দিতে শুরু করে। সামিয়ার চেঁচামেচি শুনতে শুনতে একদিন মোকসেদ মিয়া আজাদকে ডেকে বললেন, "বাবা বৌমা এরকম ভূত ভূত বলে চিৎকার দেয় কেন? সে কী খারাপ কিছু দেখে?"
আজাদ বলল,
"সাদা শাড়ি পরা কাকে নাকি দেখে।"
--"বুঝতে পারছি, বদজ্বীন ভয় দেখাইতেছে।"
আজাদের মনে হয়েছিল, বদজ্বীন জাতীয় কিছু নয় বরং সামিয়ার মাথায় গন্ডগোল হয়েছে।
মোকসেদ মিয়া একদিন কোন এক হুজুরের কাছ থেকে এক বোতল পানি পড়া নিয়ে এসে আজাদকে দিয়ে বললেন,
"বাবা প্রতি রাত্রে ঘুমানোর আগে বৌমাকে একগ্লাস করে তিনদিন খেতে বলবা।"
সামিয়া পরপর তিনদিন ঘুমানোর আগে বোতলের পানি খেল কিন্তু এতে বিশেষ কোনো লাভ হলো না। কিছুদিন পরেই বাথরুমে গোসল করার সময় সেই একই পৌঢ়াকে দেখে ভয় পেয়ে সামিয়া হুড়মুড় করে বাথরুম থেকে বের হয়ে দৌড় দিল, ওর গায়ে কোনো জামাকাপড় ছিল না। ভাগ্যিস আজাদ ঘরেই ছিল, ওকে এই অবস্থায় দৌড়াতে দেখে ও কোনোরকম ওকে আটকেছে।
মোকসেদ মিয়া কিছুদিন পর নামকরা এক কবিরাজের কাছ থেকে তাবিজ নিয়ে এসে আজাদকে দিয়ে বললেন, "তাবিজটা বৌমাকে পরিয়ে দাও। দেখবা খারাপ কিছু বউমার ধারের কাছে আসতে পারবে না।"
আজাদ সামিয়াকে তাবিজ পরিয়ে দিল কিন্তু এতেও কোনো লাভ হলো না।
শেষমেষ এক রাতে, বিখ্যাত ওঝা লাল চান ফকিরকে সাথে করে নিয়ে আসলেন মোকসেদ মিয়া। সে পুরো বাড়ির দরজা-জানালা বন্ধ করে দিয়ে ধুপ জ্বালল, বাড়ির সব ঘরে ঘরে ঢুকে মন্ত্র-তন্ত্র পড়ে জ্বীন-ভূত আসার পথ বন্ধ করে দিয়ে পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে চলে গেল। সামিয়া এর কিছুদিন পর আবারও এক রাতে ভূত ভূত বলে চিৎকার দিয়ে উঠল এবং এর মাসখানেক পরেই মোকসেদ মিয়া হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন।
মোকসেদ মিয়ার মৃত্যুর পর আজাদের মনে হয়েছিল বাড়িটাতেই কোনো সমস্যা আছে। আজাদ বাড়ি বদলে সামিয়াকে নিয়ে নতুন একটা বাড়িতে উঠেছে মাসদুয়েক আগে কিন্তু সামিয়ার সমস্যা এখনো কাটেনি। সামিয়ার মা'র সাথে আজাদ এই ব্যাপারে কথা বলেছে কিন্তু তিনি এই ব্যাপারে তেমন কিছু ওকে বলতে পারেননি।
সামিয়াকে বাসায় একা রেখে আজাদের কোথাও যেতে ইচ্ছা করে না। ওকে নিয়ে আজাদ সবসময় খুব চিন্তার মধ্যে থাকে, ও কখন কী করে বসে তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। যদি গোসল করতে ঢুকে ভয় পেয়ে জামাকাপড় ছাড়া দৌড়ে বাসার বাইরে চলে যায়! যদি সুইসাইড করে বসে! আজাদের চিন্তার কী আর শেষ আছে? বেসরকারি একটা ব্যাংকে ও চাকরি করে। সপ্তাহে পাঁচটা দিন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত ওকে অফিসে থাকতে হয়, বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা পেরিয়ে যায়, ছুটির দিনগুলোতে ওকে ওদের জুতার কারখানায় সময় দিতে হয়, সামিয়া বাসায় থাকে একদম একা। কিছুক্ষণ পরপর আজাদ ওকে ফোন করে খোঁজ-খবর যদিও নেয় তবুও মনের মধ্যে এক প্রকার সন্দেহ ওকে তাড়া করে বেড়ায়, কোনো সমস্যা হবে না তো! মাস তিনেক হলো সামিয়া কনসিভ করেছে। কনসিভ করার পর থেকে ওর ভয়-ভীতি আগের চেয়ে কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। আগে ও মাঝে মধ্যে ভূত ভূত বলে চিৎকার করত, ইদানীং পাগলের মতো সব আচরণ করছে, ঘরের জিনিসপত্র ভাংচুর করছে, দরজা বন্ধ করে দিয়ে কান্না করছে। আজাদ একটা বিষয় লক্ষ্য করেছে, সামিয়া যেদিন কিছু ভাংচুর করে সেদিন ওর আচরণ থাকে একদম বাচ্চাদের মতো।
ইতোমধ্যে আজাদ সামিয়াকে নিয়ে দুইজন ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়েছে। তারা প্রত্যেকে সামিয়াকে ভালো কোনো সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতে বলেছেন। গতমাসে ওকে নিয়ে একজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে আজাদ গিয়েছিল। তিনি সব শুনে কিছু ঔষধ আর বেশকিছু উপদেশ দিয়েছিলেন কিন্তু সবকিছু মেনে চলার পরও কোনো লাভ হচ্ছে না।
যাত্রী ছাউনিতে বেশকিছুক্ষণ বসে থেকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও আজাদ অফিসে চলে গেল।
সকাল এগারোটার দিকে সামিয়ার ঘুম ভাঙল। ঘুম ভাঙতেই আজাদের উপর ওর রাগ পড়ে গেল, মন ভালো হয়ে গেল। আয়নাটা ভাঙার কারণে মনে মনে ও খুব অপরাধবোধে ভুগছে। বিছানা ছেড়ে উঠে আজাদকে ফোন করে ও জিজ্ঞাসা করল, "কোথায় তুমি?"
আজাদ বলল, "আমি অফিসে, কেন?"
--"আমি এত কষ্ট করে নাস্তা বানালাম। তুমি নাস্তা না করে চলে গেলে কেন?"
সামিয়া বাচ্চাদের মতো আচরণ শুরু করেছে, আজাদ বলল, "আমার তাড়া ছিল যে, নাস্তা করে আসলে দেরি হয়ে যেত।"
--"আমি কিন্তু তোমার উপরে খুব রাগ করেছি।"
--"কেন কেন, রাগ করলে কেন?"
--"এই যে তুমি আমাকে না বলে অফিসে চলে গেলে, তাহলে রাগ করব না?"
--"আমি স্যরি।"
--"স্যরি বললে হবে না।"
--"তাহলে কী করতে হবে?"
--"আমাকে জলপাই আর বরইয়ের আচার এনে দিতে হবে।"
--"ঠিকআছে এনে দেবো। আচ্ছা, ঘরের মেঝেটা কী পরিস্কার করেছ?"
--"এখনো করিনি, একটু পরে করব।"
--"তোমাকে ওসব পরিষ্কার করতে হবে না। আমি অফিস থেকে এসে পরিষ্কার করব, কেমন?"
--"আচ্ছা।"
--"এই শোনো না।"
--"হুম বলো।"
--"আমি স্যরি, কেন যে আয়নাটা ভাঙলাম! আয়নাটা তো সবচেয়ে বেশি আমারই দরকার। কী যে হয়েছে আমার! রাগ উঠলে কিছু মাথায় থাকে না। এখন আমি চুল চিরুনি করব কীভাবে? টিপ পরব কীভাবে?"
--"দুইটা দিন তোমাকে একটু কষ্ট করতে হবে, পরশুদিন শুক্রবার না? আমি মিস্ত্রী এনে নতুন আয়না লাগিয়ে দেবো।"
--"থ্যাংক ইউ।"
এমন সময় ব্যাংকের ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজার আজাদকে ডেকে পাঠালেন। আজাদ ফোন রেখে ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজারের ঘরে ঢুকল। ম্যানেজার সাহেব আজাদকে দেখে বলে উঠলেন, "আজাদ আমি অনেকদিন থেকে লক্ষ্য করছি তুমি অফিসের কাজ-কর্ম বাদ দিয়ে ডেস্কে বসে মোবাইল ফোনে কথা বলো।"
আজাদ বলল,
"স্যার আমার স্ত্রী অসুস্থ। বাসায় একা একা সারাদিন থাকে, সেজন্য সময় পেলে কথা বলি।"
ম্যানেজার সাহেব বিরক্তমুখে আজাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, "দেখো আজাদ এইটা অফিস। এখানে ফোনে কথা বলা চলবে না। নেক্সট টাইম, যেন এমন না দেখি।"
--"জি স্যার।"
--"যাও কাজ করো।"
আজাদ চুপচাপ নিজের ডেস্কে এসে বসল। ম্যানেজারের উপরে ওর মেজাজ খারাপ হয়ে আছে, ও কী অফিসের কাজকর্ম বাদ দিয়ে কথা বলছে! অন্যান্যদের তুলনায় ও কাজ বেশি বৈ কম করে না। এইমুহূর্তে ওর ইচ্ছা করছে মাথার উপরের সিসি ক্যামেরাটা খুলে এক আছাড় মেরে ভেঙে ফেলতে। নিজেকে সংযত করে ও পিয়নকে ডেকে এক কাপ কফি দিতে বলে কাজে মন দিল।
দুপুরে খাবারের বিরতির সময় সামিয়াকে ফোন করল আজাদ। সামিয়া ফোন ধরার পর আজাদ জিজ্ঞাসা করল, "দুপুরের খাবার খেয়েছ?"
সামিয়া বলল, "না এখনো করিনি। তুমি করেছ?"
--"এইতো এখন করব। তুমি কী করছিলে?"
--"কাঁথা সেলাচ্ছি।"
--"বাবা! কাঁথাও সেলাতে শুরু করে দিয়েছ!"
--"তো সেলাবো না! বাচ্চার কী কাঁথা লাগবে না?"
--"হুম, তা তো লাগবেই।
--"ঠিক আছে, খাওয়া-দাওয়া করে নাও। আমি তাহলে এখন রাখি। সমস্যা হলে ফোন দিয়ো।"
ফোন রেখে খাওয়া-দাওয়া করে আজাদ আবারও নিজের ডেস্কে গিয়ে বসলো।
আজাদ সামিয়াকে কাঁচ পরিস্কার করতে বারণ করলেও আজাদকে ওর কষ্ট দিতে ইচ্ছা করছে না, আয়নাটা তো ও নিজেই ভেঙেছে, ওর ভুলের জন্য আজাদ কেন কষ্ট করবে? এইসব ভেবে সামিয়া কাঁথা রেখে ঘরে ঝাড়ু নিয়ে এলো। হালকা সাউণ্ডে রবীন্দ্র সংগীত ছেড়ে ও গুনগুন করে গানের সাথে গলা মেলাতে মেলাতে ঘরের কাঁচ পরিস্কার করতে শুরু করল। কাঁচের বড় বড় টুকরা হাত দিয়ে সরাতে গিয়ে আচমকা ওর হাতের আঙুল কেটে গিয়ে রক্ত পড়তে শুরু করল। খানিক সময় আঙুল থেকে রক্ত ঝরার দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে থেকে ও বলে উঠল, "ভালো হয়েছে, খুব ভালো হয়েছে, রাগের উত্তম শাস্তি হয়েছে।"
...
চলবে
নাহিদ হাসান নিবিড়
আয়নায় নিজেকে দেখে সামিয়ার সারা শরীর রাগে থরথর করে কাঁপছে, ওর ইচ্ছা করছে এই মুহুর্তে আয়নাটা ভেঙে ফেলতে।
এদিক সেদিক তাকাতে তাকাতে টেবিলের উপরে কাঁচের একটা পানির গ্লাস সামিয়ার চোখে পড়ল। কালক্ষেপণ না করে ও গ্লাসটা হাতে নিয়ে সজোরে ছুড়ে মারল ড্রেসিংটেবিলের আয়নায়, মুহূর্তের মধ্যে আয়না ভেঙে চৌচির হয়ে গেল।
আজাদ বসার ঘরে বসে টেলিভিশন দেখছিল, কাঁচ ভাঙ্গার শব্দ শুনে ও ছুটে এসে ঘরে ঢুকল। ড্রেসিং টেবিলের আয়নার অবস্থা দেখে সামিয়ার দিকে তাকিয়ে আজাদ জিজ্ঞাসা করল, "সমস্যা কী তোমার? কী শুরু করলে?"
সামিয়া চেঁচিয়ে বলল, "তুমি ঘর থেকে বের হও, আমাকে একটু একা থাকতে দাও, প্লীজ।"
আজাদ রাগভরা চোখে কিছুক্ষণ সামিয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে ঘর থেকে বের হয়ে বাড়ির বাইরে চলে গেল। সামিয়া দরজা বন্ধ করে দিয়ে বিছানায় শুয়ে কাঁদতে শুরু করল।
আজ রান্নাঘরে নাস্তা বানানোর সময় সাদা শাড়ি পরিহিত এক বৃদ্ধাকে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সামিয়া ভয় পেয়েছে। আজাদকে এই কথা বলার পরও ও বিশ্বাস করেনি উল্টো হাসতে হাসতে বলেছে, "চারতলার সানসেডে বৃদ্ধা মহিলা এসে দাঁড়িয়ে ছিল এই কথা তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে বলো?" বেশকিছুদিন থেকে সামিয়া এই মহিলাকে দেখছে কিন্তু আজাদকে বলবার পরও ও বিশ্বাস করছে না, কখনো হেসে উড়িয়ে দিচ্ছে, কখনো রেগে যাচ্ছে। আজাদের উপরে সামিয়ার একই সাথে খুব রাগ হচ্ছে আবার খুব মন খারাপ হচ্ছে, বিছানায় শুয়ে কাঁদতে কাঁদতে ও ঘুমিয়ে গেল।
আজাদ বাড়ি থেকে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে যাত্রী ছাউনিতে গিয়ে বসল। আজকে ওর অফিসে যেতে ইচ্ছা করছে না।
উচ্চ-মাধ্যমিকে পড়াকালীন সময় আজাদের মা মারা গিয়েছে। স্নাতক-স্নাতোকোত্তর শেষ হবার পর আজাদের বাবা মোকসেদ মিয়া নিজে পছন্দ করে বছর দুয়েক আগে সামিয়ার সাথে ওর বিয়ে দিয়েছেন। বিয়ের পর দেড় বছর পর্যন্ত কোনো সমস্যা ছিল না, সমস্যার শুরু হয়েছে মাস পাঁচেক আগে। মাঝেমধ্যেই সামিয়া ভূত ভূত বলে বিকট চিৎকার দিতে শুরু করে। সামিয়ার চেঁচামেচি শুনতে শুনতে একদিন মোকসেদ মিয়া আজাদকে ডেকে বললেন, "বাবা বৌমা এরকম ভূত ভূত বলে চিৎকার দেয় কেন? সে কী খারাপ কিছু দেখে?"
আজাদ বলল,
"সাদা শাড়ি পরা কাকে নাকি দেখে।"
--"বুঝতে পারছি, বদজ্বীন ভয় দেখাইতেছে।"
আজাদের মনে হয়েছিল, বদজ্বীন জাতীয় কিছু নয় বরং সামিয়ার মাথায় গন্ডগোল হয়েছে।
মোকসেদ মিয়া একদিন কোন এক হুজুরের কাছ থেকে এক বোতল পানি পড়া নিয়ে এসে আজাদকে দিয়ে বললেন,
"বাবা প্রতি রাত্রে ঘুমানোর আগে বৌমাকে একগ্লাস করে তিনদিন খেতে বলবা।"
সামিয়া পরপর তিনদিন ঘুমানোর আগে বোতলের পানি খেল কিন্তু এতে বিশেষ কোনো লাভ হলো না। কিছুদিন পরেই বাথরুমে গোসল করার সময় সেই একই পৌঢ়াকে দেখে ভয় পেয়ে সামিয়া হুড়মুড় করে বাথরুম থেকে বের হয়ে দৌড় দিল, ওর গায়ে কোনো জামাকাপড় ছিল না। ভাগ্যিস আজাদ ঘরেই ছিল, ওকে এই অবস্থায় দৌড়াতে দেখে ও কোনোরকম ওকে আটকেছে।
মোকসেদ মিয়া কিছুদিন পর নামকরা এক কবিরাজের কাছ থেকে তাবিজ নিয়ে এসে আজাদকে দিয়ে বললেন, "তাবিজটা বৌমাকে পরিয়ে দাও। দেখবা খারাপ কিছু বউমার ধারের কাছে আসতে পারবে না।"
আজাদ সামিয়াকে তাবিজ পরিয়ে দিল কিন্তু এতেও কোনো লাভ হলো না।
শেষমেষ এক রাতে, বিখ্যাত ওঝা লাল চান ফকিরকে সাথে করে নিয়ে আসলেন মোকসেদ মিয়া। সে পুরো বাড়ির দরজা-জানালা বন্ধ করে দিয়ে ধুপ জ্বালল, বাড়ির সব ঘরে ঘরে ঢুকে মন্ত্র-তন্ত্র পড়ে জ্বীন-ভূত আসার পথ বন্ধ করে দিয়ে পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে চলে গেল। সামিয়া এর কিছুদিন পর আবারও এক রাতে ভূত ভূত বলে চিৎকার দিয়ে উঠল এবং এর মাসখানেক পরেই মোকসেদ মিয়া হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন।
মোকসেদ মিয়ার মৃত্যুর পর আজাদের মনে হয়েছিল বাড়িটাতেই কোনো সমস্যা আছে। আজাদ বাড়ি বদলে সামিয়াকে নিয়ে নতুন একটা বাড়িতে উঠেছে মাসদুয়েক আগে কিন্তু সামিয়ার সমস্যা এখনো কাটেনি। সামিয়ার মা'র সাথে আজাদ এই ব্যাপারে কথা বলেছে কিন্তু তিনি এই ব্যাপারে তেমন কিছু ওকে বলতে পারেননি।
সামিয়াকে বাসায় একা রেখে আজাদের কোথাও যেতে ইচ্ছা করে না। ওকে নিয়ে আজাদ সবসময় খুব চিন্তার মধ্যে থাকে, ও কখন কী করে বসে তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। যদি গোসল করতে ঢুকে ভয় পেয়ে জামাকাপড় ছাড়া দৌড়ে বাসার বাইরে চলে যায়! যদি সুইসাইড করে বসে! আজাদের চিন্তার কী আর শেষ আছে? বেসরকারি একটা ব্যাংকে ও চাকরি করে। সপ্তাহে পাঁচটা দিন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত ওকে অফিসে থাকতে হয়, বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা পেরিয়ে যায়, ছুটির দিনগুলোতে ওকে ওদের জুতার কারখানায় সময় দিতে হয়, সামিয়া বাসায় থাকে একদম একা। কিছুক্ষণ পরপর আজাদ ওকে ফোন করে খোঁজ-খবর যদিও নেয় তবুও মনের মধ্যে এক প্রকার সন্দেহ ওকে তাড়া করে বেড়ায়, কোনো সমস্যা হবে না তো! মাস তিনেক হলো সামিয়া কনসিভ করেছে। কনসিভ করার পর থেকে ওর ভয়-ভীতি আগের চেয়ে কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। আগে ও মাঝে মধ্যে ভূত ভূত বলে চিৎকার করত, ইদানীং পাগলের মতো সব আচরণ করছে, ঘরের জিনিসপত্র ভাংচুর করছে, দরজা বন্ধ করে দিয়ে কান্না করছে। আজাদ একটা বিষয় লক্ষ্য করেছে, সামিয়া যেদিন কিছু ভাংচুর করে সেদিন ওর আচরণ থাকে একদম বাচ্চাদের মতো।
ইতোমধ্যে আজাদ সামিয়াকে নিয়ে দুইজন ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়েছে। তারা প্রত্যেকে সামিয়াকে ভালো কোনো সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতে বলেছেন। গতমাসে ওকে নিয়ে একজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে আজাদ গিয়েছিল। তিনি সব শুনে কিছু ঔষধ আর বেশকিছু উপদেশ দিয়েছিলেন কিন্তু সবকিছু মেনে চলার পরও কোনো লাভ হচ্ছে না।
যাত্রী ছাউনিতে বেশকিছুক্ষণ বসে থেকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও আজাদ অফিসে চলে গেল।
সকাল এগারোটার দিকে সামিয়ার ঘুম ভাঙল। ঘুম ভাঙতেই আজাদের উপর ওর রাগ পড়ে গেল, মন ভালো হয়ে গেল। আয়নাটা ভাঙার কারণে মনে মনে ও খুব অপরাধবোধে ভুগছে। বিছানা ছেড়ে উঠে আজাদকে ফোন করে ও জিজ্ঞাসা করল, "কোথায় তুমি?"
আজাদ বলল, "আমি অফিসে, কেন?"
--"আমি এত কষ্ট করে নাস্তা বানালাম। তুমি নাস্তা না করে চলে গেলে কেন?"
সামিয়া বাচ্চাদের মতো আচরণ শুরু করেছে, আজাদ বলল, "আমার তাড়া ছিল যে, নাস্তা করে আসলে দেরি হয়ে যেত।"
--"আমি কিন্তু তোমার উপরে খুব রাগ করেছি।"
--"কেন কেন, রাগ করলে কেন?"
--"এই যে তুমি আমাকে না বলে অফিসে চলে গেলে, তাহলে রাগ করব না?"
--"আমি স্যরি।"
--"স্যরি বললে হবে না।"
--"তাহলে কী করতে হবে?"
--"আমাকে জলপাই আর বরইয়ের আচার এনে দিতে হবে।"
--"ঠিকআছে এনে দেবো। আচ্ছা, ঘরের মেঝেটা কী পরিস্কার করেছ?"
--"এখনো করিনি, একটু পরে করব।"
--"তোমাকে ওসব পরিষ্কার করতে হবে না। আমি অফিস থেকে এসে পরিষ্কার করব, কেমন?"
--"আচ্ছা।"
--"এই শোনো না।"
--"হুম বলো।"
--"আমি স্যরি, কেন যে আয়নাটা ভাঙলাম! আয়নাটা তো সবচেয়ে বেশি আমারই দরকার। কী যে হয়েছে আমার! রাগ উঠলে কিছু মাথায় থাকে না। এখন আমি চুল চিরুনি করব কীভাবে? টিপ পরব কীভাবে?"
--"দুইটা দিন তোমাকে একটু কষ্ট করতে হবে, পরশুদিন শুক্রবার না? আমি মিস্ত্রী এনে নতুন আয়না লাগিয়ে দেবো।"
--"থ্যাংক ইউ।"
এমন সময় ব্যাংকের ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজার আজাদকে ডেকে পাঠালেন। আজাদ ফোন রেখে ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজারের ঘরে ঢুকল। ম্যানেজার সাহেব আজাদকে দেখে বলে উঠলেন, "আজাদ আমি অনেকদিন থেকে লক্ষ্য করছি তুমি অফিসের কাজ-কর্ম বাদ দিয়ে ডেস্কে বসে মোবাইল ফোনে কথা বলো।"
আজাদ বলল,
"স্যার আমার স্ত্রী অসুস্থ। বাসায় একা একা সারাদিন থাকে, সেজন্য সময় পেলে কথা বলি।"
ম্যানেজার সাহেব বিরক্তমুখে আজাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, "দেখো আজাদ এইটা অফিস। এখানে ফোনে কথা বলা চলবে না। নেক্সট টাইম, যেন এমন না দেখি।"
--"জি স্যার।"
--"যাও কাজ করো।"
আজাদ চুপচাপ নিজের ডেস্কে এসে বসল। ম্যানেজারের উপরে ওর মেজাজ খারাপ হয়ে আছে, ও কী অফিসের কাজকর্ম বাদ দিয়ে কথা বলছে! অন্যান্যদের তুলনায় ও কাজ বেশি বৈ কম করে না। এইমুহূর্তে ওর ইচ্ছা করছে মাথার উপরের সিসি ক্যামেরাটা খুলে এক আছাড় মেরে ভেঙে ফেলতে। নিজেকে সংযত করে ও পিয়নকে ডেকে এক কাপ কফি দিতে বলে কাজে মন দিল।
দুপুরে খাবারের বিরতির সময় সামিয়াকে ফোন করল আজাদ। সামিয়া ফোন ধরার পর আজাদ জিজ্ঞাসা করল, "দুপুরের খাবার খেয়েছ?"
সামিয়া বলল, "না এখনো করিনি। তুমি করেছ?"
--"এইতো এখন করব। তুমি কী করছিলে?"
--"কাঁথা সেলাচ্ছি।"
--"বাবা! কাঁথাও সেলাতে শুরু করে দিয়েছ!"
--"তো সেলাবো না! বাচ্চার কী কাঁথা লাগবে না?"
--"হুম, তা তো লাগবেই।
--"ঠিক আছে, খাওয়া-দাওয়া করে নাও। আমি তাহলে এখন রাখি। সমস্যা হলে ফোন দিয়ো।"
ফোন রেখে খাওয়া-দাওয়া করে আজাদ আবারও নিজের ডেস্কে গিয়ে বসলো।
আজাদ সামিয়াকে কাঁচ পরিস্কার করতে বারণ করলেও আজাদকে ওর কষ্ট দিতে ইচ্ছা করছে না, আয়নাটা তো ও নিজেই ভেঙেছে, ওর ভুলের জন্য আজাদ কেন কষ্ট করবে? এইসব ভেবে সামিয়া কাঁথা রেখে ঘরে ঝাড়ু নিয়ে এলো। হালকা সাউণ্ডে রবীন্দ্র সংগীত ছেড়ে ও গুনগুন করে গানের সাথে গলা মেলাতে মেলাতে ঘরের কাঁচ পরিস্কার করতে শুরু করল। কাঁচের বড় বড় টুকরা হাত দিয়ে সরাতে গিয়ে আচমকা ওর হাতের আঙুল কেটে গিয়ে রক্ত পড়তে শুরু করল। খানিক সময় আঙুল থেকে রক্ত ঝরার দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে থেকে ও বলে উঠল, "ভালো হয়েছে, খুব ভালো হয়েছে, রাগের উত্তম শাস্তি হয়েছে।"
...
চলবে
নাহিদ হাসান নিবিড়
Hasibul hasan santo, Sk sagor, Sk imran, Rasel islam, Mr faruk, Sumaiya akter, Sumon khan and লেখাটি পছন্দ করেছে
- Jamshedনবাগত
- Posts : 8
স্বর্ণমুদ্রা : 1122
মর্যাদা : 20
Join date : 2021-05-30
Re: অলীক ভুবন
Sat Jun 05, 2021 9:55 pm
পর্ব- ০২
অফিস থেকে বাড়ি ফিরে এসে আজাদ দেখল সামিয়া কাঁচ পরিস্কার করে ফেলেছে। ও কিছু বলার আগেই সামিয়া বলল, "তাড়াতাড়ি হাত-মুখ ধুয়ে টেবিলে এসো। খুব ক্ষুধা পেয়েছে।"
আজাদ জামাকাপড় বদলে হাত-মুখ ধুয়ে খাবার টেবিলে এসে বসল। সামিয়া প্লেটে খাবার বাড়ার সময় ওর হাতের দিকে দৃষ্টি পড়তেই আজাদ দেখল, ওর ডান হাতের আঙুলে ব্যাণ্ডেজ লাগানো। আজাদ জিজ্ঞাসা করল, "হাতে কী হয়েছে? কাঁচ পরিস্কার করতে গিয়ে হাত কেটে নিয়েছ, তাই না?"
সামিয়া কিছু বলল না।
আজাদ আবারও জিজ্ঞাসা করল, "কতখানি কেটেছে?"
--"বেশি না, অল্প একটু।"
--"তোমাকে বলেছিলাম না কাঁচ পরিস্কার করতে যেয়ো না, আমি অফিস থেকে ফিরে করব?"
--"তুমি যা বলবে তাই কী আমাকে শুনতে হবে?"
--"তুমি কথা শোনো না। হাতটা যে কেটে নিলে এখন খাবে কী করে?"
সামিয়া মুচকি হেসে বলল, "আমার জামাইটা আছে কেন?"
--"কাজটা তুমি ঠিক করোনি, আমি খুব কষ্ট পেয়েছি।"
--"স্যরি, ভুল হয়ে গেছে আর কখনো এমন করব না। এখন আমাকে খাইয়ে দাও।"
--"আর কখনো আমি যা করতে না করব তা করবে না।"
--"ঠিক আছে।"
খাওয়া-দাওয়া শেষে আজাদ থালা-বাসন ধুয়ে রেখে সোফায় গিয়ে বসে টেলিভিশন ছাড়ল। সামিয়া এসে ওর পাশে বসে বলল, "এই, আমার আচার কোথায়?"
--"এই যা, একদম ভুলে গেছি। আমি গিয়ে নিয়ে আসছি।"
--"থাক, এত রাত করে আর যেতে হবে না। কাল এনে দিয়ো।"
--"কত রাত হয়েছে?"
--"সাড়ে দশটা বেজে গেছে।"
--"এটা কোনো রাত হলো? চলো তো, তুমিও চলো।"
--"আমি গিয়ে কী করব?"
--"আহ চলো তো।"
আজাদ নাছোড়বান্দা, সামিয়াকে ও জোর করে দোকানে নিয়ে গিয়ে দুই বয়াম জলপাই আর তিন বয়াম বরইয়ের আচার কিনে জিজ্ঞাসা করল, "আইসক্রিম খাবে?"
সামিয়া বলল, "না না, এখন আইসক্রিম খাব না।"
--"আমার খুব ইচ্ছা করছে।"
--"তাহলে তুমি খাও।"
--"আমি একা একা আইসক্রিম খাব?"
--"হ্যাঁ, খাও।"
--"তোমাকেও খেতে হবে।"
--"না গো এখন খাব না।"
--"আচ্ছা চলো।"
--"কেন তুমি আইসক্রিম খাবে না?"
--"তুমি তো খেতে চাইছো না, তুমি না খেলে আমিও খাব না।"
সামিয়া হেসে বলল, "নাও আইসক্রিম নাও।"
--"কয়টা নেব?"
--"দুইটা।"
আজাদ দুইটা আইসক্রিম কিনে সামিয়াকে নিয়ে আইসক্রিম খেতে খেতে বাসায় ফিরে এলো।
বাসায় এসে আজাদ সামিয়াকে জিজ্ঞাসা করল,
"তুমি কী চা খাবে?"
সামিয়া ভুরু কুঁচকে আজাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
"পাগল হয়েছ? মাত্রই না আইসক্রিম খেলাম। আইসক্রিম খেয়ে কেউ কী চা খায়?"
--"আমি খাই।"
--"তুমি তো একটা পাগল।"
--"খাবে কী না তাই বলো।"
--"না খাবো না। আমার ঘুম পাচ্ছে, আমি ঘুমাতে যাই?"
--"আচ্ছা যাও।"
সামিয়া হাত-মুখ ধুয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। আজাদ রান্নাঘরে ঢুকে চা বানিয়ে চায়ের কাপ হাতে বসার ঘরে গিয়ে টেলিভিশনে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল জুড়ে দিল। নাটক, সিনেমা, সংবাদ দেখতে ওর ভালো লাগে না। টেলিভিশনে দেখার মধ্যে ও কেবলমাত্র যে সকল চ্যানেলে পশু-পাখি, বন-জঙ্গলের ভিডিও প্রচারিত হয় সেসব চ্যানেল দেখে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলে এখন একদল হাতির ভিডিও দেখানো হচ্ছে। হাতিগুলো দলবদ্ধভাবে হেঁটে যাচ্ছে, এদের মধ্যে কয়েকটা শাবক হাতিও আছে, এরা তিড়িং বিড়িং করছে, একবার সামনের দিকে ছুটে যাচ্ছে আবার আগের জায়গাতে ফিরে আসছে।
বেশকিছুক্ষণ মুগ্ধ নয়নে হাতিদের কর্মকাণ্ড দেখে আজাদ টেলিভিশন বন্ধ করে ঘরে গিয়ে সামিয়ার পাশে শুয়ে ওর মুখের দিকে তাকাল। ডিম লাইটের হালকা আলোয় ওর মুখমণ্ডল আবছামতন দেখা যাচ্ছে। কী নিশ্চিন্তে ও ঘুমাচ্ছে! কী নিষ্পাপ মুখ! আজাদের বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয় না, সামিয়া প্রায়শই নানান কাণ্ড করে বসে। ওর কপালে আলতো একটা চুমু দিয়ে চোখ বন্ধ করল আজাদ। খানিকসময় পরেই সামিয়া কাত হয়ে শুয়ে একটা হাত আজাদের বুকের উপর দিয়ে তুলে দিল।
অফিসে দুইটা সপ্তাহ খুব কাজের চাপ গেল আজাদের। কাজের চাপ আজ সকাল থেকে কমেছে। আজাদ চুপচাপ ওর ডেস্কে বসে আছে। হঠাৎ সামিয়া ফোন করল, আজাদ ফোন কেটে দিল।
ম্যানেজার সাহেব চারদিন আগেও আজাদকে ফোনে কথা বলার জন্য বকাবকি করেছেন। এরপর থেকে ও দুপুরের খাবার বিরতির সময় ব্যতীত সামিয়ার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। সামিয়া আবারও ফোন করল। আজাদের মনে হলো কোনো সমস্যা হয়েছে। ফোন ধরে ও জিজ্ঞাসা করল, "কী ব্যাপার? কোনো সমস্যা?"
সামিয়া বলল,
"তুমি কী খুব ব্যস্ত?"
আজাদের মনে হলো সামিয়া আবারও ভয় পেয়েছে নয়তো ওর মন খারাপ। আজাদ বলল, "তেমন ব্যস্ত না, বলো।"
--"একটা সমস্যা হয়েছে।"
--"কী সমস্যা?"
--"ঐ যে আমাদের দুই তলায় একটা ভাড়াটে আছে না?"
--"ফারুক সাহেব?"
--"হ্যাঁ, উনি কী করেছে জানো?"
আচমকা লাইনটা কেটে গেল। আজাদের ভীষণ চিন্তা হচ্ছে, লাইন কেটে যাওয়ার সাথে সাথে ও সামিয়াকে ফোন করল। সামিয়া ফোন ধরে বলল, "কেটে গেল কেন?"
--"বলতে পারছি না, ফারুক ভাই কী করেছে?"
--"আমি হাঁটাহাঁটি করতে বাড়ির নিচে গিয়েছিলাম। আধঘন্টার মতো হেঁটেছি, হাঁটা শেষে উপরে আসার সময় সিঁড়ি দিয়ে দুইতলাতে উঠে শুনলাম, একটা বাচ্চা ছেলে চিৎকার করে কান্না করছে।"
--"এরপর?"
--"আমি দরজা ধাক্কালাম, ফারুক ভাই যাকে বলো, সে এসে দরজা খুলল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কে কাঁদছে? উনি বলল, কাজের ছেলে।"
--"মেরেছে নাকি?"
এমন সময় ম্যানেজার সাহেব আজাদকে ডেকে পাঠালেন। আজাদ সামিয়াকে বলল,
"আমি কিছুক্ষণ পর তোমাকে ফোন করছি। স্যার ডাকছেন।"
আজাদ শার্ট-প্যান্টের ইন ঠিক করে ম্যানেজার সাহেবের ঘরে ঢুকল। ম্যানেজার সাহেব কার সাথে যেন হাসিমুখে কথা বলছিলেন, আজাদের মনে হলো তিনি খোশগল্প করছিলেন। আজাদকে দেখে তিনি ফোন রেখে বিরক্তমুখে বললেন, "বোসো।"
আজাদ বসল।
ম্যানেজার সাহেব বললেন, "তোমাকে কী আমি বলেছিলাম ফোনে কথা না বলতে?"
--"জি স্যার।"
--"তুমি আমার কথা শুনছো না কেন?"
--"স্যার আমার হাতে তো কোনো কাজ ছিল না। আপনাকে আমি বলেছিলাম আমার স্ত্রী অসুস্থ।"
ম্যানেজার সাহেব রেগে গিয়ে বললেন, "কাজ থাকুক আর নাই থাকুক, আই সেইড, অফিসে বসে ফোনে কথা বলা যাবে না, তো যাবেই না, কাজ থাকুক অথবা নাই থাকুক।"
আজাদ কোনো কথা বলল না।
--"দিস ইজ ইয়োর লাস্ট ওয়ার্নিং।"
ম্যানেজের সাহেবের ফোন আবারও বেজে উঠল, তিনি ফোন ধরে বললেন, "রিচি আমি তোমাকে কিছুক্ষণ পরে ফোন করছি।"
ম্যানেজার সাহেব ফোন রেখে দিলেন। আজাদ জিজ্ঞাসা করল, "স্যার যাব?"
--"যাও, মন দিয়ে কাজ করো। ফোনে কথা বলবে না।"
আজাদ ম্যানেজার সাহেবের ঘর থেকে বের হয়ে ডেস্কে এসে বসল। ওর মেজাজ ম্যানেজারের উপরে চরম মাত্রায় খারাপ হয়ে আছে। তিনি সারাটাদিন ফোনে কথা বলেন অথচ ও দুই-চার, দশমিনিট কথা বললেই তার সমস্যা হয়ে যায়। ইতোমধ্যে সামিয়া আবারও ফোন করতে শুরু করেছে। আজাদ ডেস্ক থেকে উঠে অনুমতি বিহীন ম্যানেজারের ঘরে গিয়ে ঢুকল। ম্যানেজার সাহেব এখনো হাসিমুখে ফোনে কথা বলছেন। আজাদকে দেখে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, "কিছু বলবে?"
আজাদ রক্তচোখে ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে হুংকার দিয়ে বলল, "তোর চাকরি আমি করব না। কাঁথা পুড়ি তোর চাকরির, বেটা ফাজিল।"
ম্যানেজার সাহেব ফোন রেখে দিয়ে ভোতামুখে বললেন, "আজাদ ব্যবহার ঠিক করো।"
--"ধুর বেটা ফাজিল, তোর সাথে ভালো ব্যবহার করব কীরে? তুই বেটা সারাদিন ফোনে কথা বলিস সেইটা কিছু হয় না? আমি আমার অসুস্থ স্ত্রীর সাথে একটু কথা বললেই তোর দুনিয়ার সমস্যা হয়ে যায়, করলাম না তোর চাকরি।"
ম্যানেজার সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। আজাদ আর কিছু না বলে গোমড়া মুখে অফিস থেকে বের হয়ে সামিয়াকে ফোন করল।
সামিয়া ফোন ধরে বলল,
"এই শোনো তুমি ফারুক সাহেবকে ফোন করে বলে দাও, সে যেন চিৎকার চেঁচামেচি না করে।"
--"কী হয়েছে? সে চেঁচাচ্ছে কেন?"
--"তোমাকে বললাম না, উনার ফ্ল্যাটে একটা ছেলে কাঁদছিল, ওর নাম সুজন। সুজনকে উনি মেরে কিছু রাখেনি। ওর নাক দিয়ে রক্ত পড়ছিল, গায়ে মারের দাগ পড়ে গেছে, তুমি আসলে দেখো।"
--"উনি চেঁচামেচি করছে কেন?"
--"আমি তো সুজনকে নিয়ে এসেছি। উনি বার বার বলছেন ওকে যেন দিয়ে দেই কিন্তু আমি দেবো না। উনারা এই ছেলেকে মেরেই ফেলবে। আমি বলে দিয়েছি, ওর বাবা-মা আসার পর তাদের সাথে কথা বলে তারা যদি ওকে উনাদের বাসায় রাখতে রাজি হয় তাহলেই কেবল দেবো।"
--"ফোন রাখো, আমি উনাকে ফোন করছি"
ফোন রেখে আজাদ হাঁটতে হাঁটতে রমনা পার্কের সামনে এসে ফারুক সাহেবকে ফোন করল। মেজাজ ওর এমনিতেই খারাপ, এরমধ্যে সামিয়ার সাথে তার চেঁচামেচির কথা শুনে মেজাজ আরও খারাপ হয়ে গেছে। ফারুক সাহেব ফোন ধরতেই ও চেঁচিয়ে বলল,
"সমস্যা কী আপনার, বাচ্চাটাকে এইভাবে মেরেছেন কেন?"
ফারুক সাহেব বললেন,
"সেটা কী আপনাকে বলতে হবে?"
আজাদ বিশ্রী একটা গালি দিয়ে বলল, "আমাকে বলবি না তো কাকে বলবি? তোর বাপকে বলবি? তুই বাসায় থাক আমি তোর বাপকে নিয়ে আসতেছি।"
আজাদ ফোন রেখে আবারও হাঁটা শুরু করল।
হাঁটতে হাঁটতে গুলিস্থান এসে একটা ভীড় দেখে আজাদ ভীড় ঠেলে সামনে গিয়ে দেখল, এক ভন্ড জ্যোতিষী মানুষের হাত দেখে ভবিষ্যদ্বাণী করছে। হাত দেখে সে যা বলছে, তাতে সবার ভবিষ্যত উজ্জ্বল। তার পাশের সাইনবোর্ডে লেখা,
"আল্লাহ..............সর্বশক্তিমান"
"জ্যোতিষী ঘুঘু মিয়া।"
(রসুলপুর, ঘাটাইল, টাঙ্গাইল)
দীর্ঘদিন হইতে হাত দেখিয়া নির্ভুলভাবে আস্থার সহিত ভবিষ্যদ্বাণী করিয়া আসিতেছি।
লোকজন ঘুঘু মিয়ার কথা আনন্দের সাথে শুনছে। সে আসর জমানোর জন্য কথার ফাঁকে ফাঁকে হাসির গল্পও বলছে। আজাদ তার সামনে গিয়ে বলল, "ভাই আমার হাতটা দেখুন তো।"
সে আজাদের হাত দেখে হাসিমুখে বলল, "আপনার তো ভাই চান কপাল।"
--"কেন কী হয়েছে?"
--"আপনার খুব শীঘ্রই বিবাহ হইবে।"
--"সত্যি? তার মানে আমার দ্বিতীয় বিয়ে হবে?"
--"হইতেই পারে, একজন পুরুষ লোক ইসলামি শরীয়াহ মোতাবেক চারটা পর্যন্ত বিবাহ করিতে পারে জনাব।"
--"আমিও যে একজন জ্যোতিষী, এই কথা জানেন আপনি?"
--"জি না ভাই সাহেব।"
--"দেখি আপনার হাতটা দেখি।"
ঘুঘু মিয়া উৎসাহের সহিত হাত বাড়িয়ে দিল। আজাদ হাত দেখে বসা অবস্থাতেই তার গালে কষে একটা থাপ্পড় লাগালো। সে গালে হাত দিয়ে বলল, "কী হলো ভাই সাহেব? আপনি আমাকে থাপ্পড় মারলেন কেন?"
আজাদ বলল,
"কেন আপনি আজকে আপনার হাত দেখেন নাই? আপনার হাতের রেখায় তো স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে, আজ আসরের মধ্যে থেকে একজন জ্যোতিষী আপনাকে হাত দেখাতে এসে আপনার হাত দেখে গালে কষে একটা থাপ্পড় লাগাবে।"
আজাদ জ্যোতিষী ঘুঘু মিয়ার আসর ভেঙে বের হয়ে একটা রিকশা নিয়ে ওয়ারী থানায় চলে গেল।
ওয়ারী থানার এস.আই কিবরিয়া আজাদের স্কুল জীবনের বন্ধু। কিবরিয়াকে সাবকিছু খুলে বলে ওকে সাথে নিয়ে আজাদ বাড়িতে ফিরল।
ফারুক সাহেব আজাদদের ফ্ল্যাটের সামনে সিঁড়িতে বসে আছেন। কিবরিয়ার পরনে খাঁকি পোষাক দেখে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তিনি ভাবেননি, আজাদ তার বাবার কথা বলে সাথে করে পুলিশ নিয়ে আসবে। তিনি সিঁড়ি থেকে উঠে নিচে চলে যেতে চেষ্টা করলেন। আজাদ তার হাত ধরে ফেলে বলল, "আরে যাচ্ছিস কোথায়? তোর বাপকে নিয়ে এসেছি তোর বিচার করার জন্যে।"
আজাদের কণ্ঠস্বর শুনে সামিয়া এসে দরজা খুলল।
কিবরিয়া আর ফারুক সাহেবকে নিয়ে আজাদ ঘরে ঢুকল।
সুজনের মুখমণ্ডল ফুলে আছে। সুজনকে দেখিয়ে আজাদ কিবরিয়াকে বলল, "তোকে বলেছিলাম না প্রায়ই বাচ্চাটাকে মারে? দেখ আজকে মেরে কী অবস্থা করেছে।"
সামিয়া বলল, "ভাইয়া, এখন তো খুব একটা বোঝা যাচ্ছে না। আমি যখন ওকে নিয়ে এসেছি তখন ওর নাক থেকে রক্ত বের হচ্ছিল।"
ফারুক সাহেব কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আসামীর মতো মাথা নত করে রেখেছেন। কিবরিয়া তার দিকে তাকিয়ে বলল, "ওকে মেরেছেন কেন?"
--"এ আমার শার্টের পকেট থেকে টাকা চুরি করেছে।"
কিবরিয়া সুজনকে জিজ্ঞাসা করল, "এই টাকা চুরি করেছ তুমি?"
সুজন ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে বলল, "আমি নেই নাই।"
ফারুক সাহেব অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে বলল,
"এ মিথ্যা কথা বলছে, ছেলে মহা ত্যাদড়।"
কিবরিয়া বলল, "ওর বাবা-মার ফোন নম্বর দিন।"
--"একে আমি এতিমখানা থেকে নিয়ে আসছিলাম। এর বাবা-মা নাই।"
--"ও আচ্ছা এজন্যেই এভাবে মারতে পেরেছেন। আপনার ছেলে-মেয়ে কয়জন?"
--"দুই ছেলে-মেয়ে।"
--"ওদেরকে কখনো এভাবে মারতে পারবেন?"
ফারুক সাহেব কোনো কথা বললেন না।
ফারুক সাহেবকে রাতের মধ্যে থানায় গিয়ে দেখা করতে বলে কিবরিয়া সুজনের দায়-দায়িত্ব আজাদদেরকে দিয়ে চলে গেল।
চলবে
নাহিদ হাসান নিবিড়
অফিস থেকে বাড়ি ফিরে এসে আজাদ দেখল সামিয়া কাঁচ পরিস্কার করে ফেলেছে। ও কিছু বলার আগেই সামিয়া বলল, "তাড়াতাড়ি হাত-মুখ ধুয়ে টেবিলে এসো। খুব ক্ষুধা পেয়েছে।"
আজাদ জামাকাপড় বদলে হাত-মুখ ধুয়ে খাবার টেবিলে এসে বসল। সামিয়া প্লেটে খাবার বাড়ার সময় ওর হাতের দিকে দৃষ্টি পড়তেই আজাদ দেখল, ওর ডান হাতের আঙুলে ব্যাণ্ডেজ লাগানো। আজাদ জিজ্ঞাসা করল, "হাতে কী হয়েছে? কাঁচ পরিস্কার করতে গিয়ে হাত কেটে নিয়েছ, তাই না?"
সামিয়া কিছু বলল না।
আজাদ আবারও জিজ্ঞাসা করল, "কতখানি কেটেছে?"
--"বেশি না, অল্প একটু।"
--"তোমাকে বলেছিলাম না কাঁচ পরিস্কার করতে যেয়ো না, আমি অফিস থেকে ফিরে করব?"
--"তুমি যা বলবে তাই কী আমাকে শুনতে হবে?"
--"তুমি কথা শোনো না। হাতটা যে কেটে নিলে এখন খাবে কী করে?"
সামিয়া মুচকি হেসে বলল, "আমার জামাইটা আছে কেন?"
--"কাজটা তুমি ঠিক করোনি, আমি খুব কষ্ট পেয়েছি।"
--"স্যরি, ভুল হয়ে গেছে আর কখনো এমন করব না। এখন আমাকে খাইয়ে দাও।"
--"আর কখনো আমি যা করতে না করব তা করবে না।"
--"ঠিক আছে।"
খাওয়া-দাওয়া শেষে আজাদ থালা-বাসন ধুয়ে রেখে সোফায় গিয়ে বসে টেলিভিশন ছাড়ল। সামিয়া এসে ওর পাশে বসে বলল, "এই, আমার আচার কোথায়?"
--"এই যা, একদম ভুলে গেছি। আমি গিয়ে নিয়ে আসছি।"
--"থাক, এত রাত করে আর যেতে হবে না। কাল এনে দিয়ো।"
--"কত রাত হয়েছে?"
--"সাড়ে দশটা বেজে গেছে।"
--"এটা কোনো রাত হলো? চলো তো, তুমিও চলো।"
--"আমি গিয়ে কী করব?"
--"আহ চলো তো।"
আজাদ নাছোড়বান্দা, সামিয়াকে ও জোর করে দোকানে নিয়ে গিয়ে দুই বয়াম জলপাই আর তিন বয়াম বরইয়ের আচার কিনে জিজ্ঞাসা করল, "আইসক্রিম খাবে?"
সামিয়া বলল, "না না, এখন আইসক্রিম খাব না।"
--"আমার খুব ইচ্ছা করছে।"
--"তাহলে তুমি খাও।"
--"আমি একা একা আইসক্রিম খাব?"
--"হ্যাঁ, খাও।"
--"তোমাকেও খেতে হবে।"
--"না গো এখন খাব না।"
--"আচ্ছা চলো।"
--"কেন তুমি আইসক্রিম খাবে না?"
--"তুমি তো খেতে চাইছো না, তুমি না খেলে আমিও খাব না।"
সামিয়া হেসে বলল, "নাও আইসক্রিম নাও।"
--"কয়টা নেব?"
--"দুইটা।"
আজাদ দুইটা আইসক্রিম কিনে সামিয়াকে নিয়ে আইসক্রিম খেতে খেতে বাসায় ফিরে এলো।
বাসায় এসে আজাদ সামিয়াকে জিজ্ঞাসা করল,
"তুমি কী চা খাবে?"
সামিয়া ভুরু কুঁচকে আজাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
"পাগল হয়েছ? মাত্রই না আইসক্রিম খেলাম। আইসক্রিম খেয়ে কেউ কী চা খায়?"
--"আমি খাই।"
--"তুমি তো একটা পাগল।"
--"খাবে কী না তাই বলো।"
--"না খাবো না। আমার ঘুম পাচ্ছে, আমি ঘুমাতে যাই?"
--"আচ্ছা যাও।"
সামিয়া হাত-মুখ ধুয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। আজাদ রান্নাঘরে ঢুকে চা বানিয়ে চায়ের কাপ হাতে বসার ঘরে গিয়ে টেলিভিশনে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল জুড়ে দিল। নাটক, সিনেমা, সংবাদ দেখতে ওর ভালো লাগে না। টেলিভিশনে দেখার মধ্যে ও কেবলমাত্র যে সকল চ্যানেলে পশু-পাখি, বন-জঙ্গলের ভিডিও প্রচারিত হয় সেসব চ্যানেল দেখে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলে এখন একদল হাতির ভিডিও দেখানো হচ্ছে। হাতিগুলো দলবদ্ধভাবে হেঁটে যাচ্ছে, এদের মধ্যে কয়েকটা শাবক হাতিও আছে, এরা তিড়িং বিড়িং করছে, একবার সামনের দিকে ছুটে যাচ্ছে আবার আগের জায়গাতে ফিরে আসছে।
বেশকিছুক্ষণ মুগ্ধ নয়নে হাতিদের কর্মকাণ্ড দেখে আজাদ টেলিভিশন বন্ধ করে ঘরে গিয়ে সামিয়ার পাশে শুয়ে ওর মুখের দিকে তাকাল। ডিম লাইটের হালকা আলোয় ওর মুখমণ্ডল আবছামতন দেখা যাচ্ছে। কী নিশ্চিন্তে ও ঘুমাচ্ছে! কী নিষ্পাপ মুখ! আজাদের বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয় না, সামিয়া প্রায়শই নানান কাণ্ড করে বসে। ওর কপালে আলতো একটা চুমু দিয়ে চোখ বন্ধ করল আজাদ। খানিকসময় পরেই সামিয়া কাত হয়ে শুয়ে একটা হাত আজাদের বুকের উপর দিয়ে তুলে দিল।
অফিসে দুইটা সপ্তাহ খুব কাজের চাপ গেল আজাদের। কাজের চাপ আজ সকাল থেকে কমেছে। আজাদ চুপচাপ ওর ডেস্কে বসে আছে। হঠাৎ সামিয়া ফোন করল, আজাদ ফোন কেটে দিল।
ম্যানেজার সাহেব চারদিন আগেও আজাদকে ফোনে কথা বলার জন্য বকাবকি করেছেন। এরপর থেকে ও দুপুরের খাবার বিরতির সময় ব্যতীত সামিয়ার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। সামিয়া আবারও ফোন করল। আজাদের মনে হলো কোনো সমস্যা হয়েছে। ফোন ধরে ও জিজ্ঞাসা করল, "কী ব্যাপার? কোনো সমস্যা?"
সামিয়া বলল,
"তুমি কী খুব ব্যস্ত?"
আজাদের মনে হলো সামিয়া আবারও ভয় পেয়েছে নয়তো ওর মন খারাপ। আজাদ বলল, "তেমন ব্যস্ত না, বলো।"
--"একটা সমস্যা হয়েছে।"
--"কী সমস্যা?"
--"ঐ যে আমাদের দুই তলায় একটা ভাড়াটে আছে না?"
--"ফারুক সাহেব?"
--"হ্যাঁ, উনি কী করেছে জানো?"
আচমকা লাইনটা কেটে গেল। আজাদের ভীষণ চিন্তা হচ্ছে, লাইন কেটে যাওয়ার সাথে সাথে ও সামিয়াকে ফোন করল। সামিয়া ফোন ধরে বলল, "কেটে গেল কেন?"
--"বলতে পারছি না, ফারুক ভাই কী করেছে?"
--"আমি হাঁটাহাঁটি করতে বাড়ির নিচে গিয়েছিলাম। আধঘন্টার মতো হেঁটেছি, হাঁটা শেষে উপরে আসার সময় সিঁড়ি দিয়ে দুইতলাতে উঠে শুনলাম, একটা বাচ্চা ছেলে চিৎকার করে কান্না করছে।"
--"এরপর?"
--"আমি দরজা ধাক্কালাম, ফারুক ভাই যাকে বলো, সে এসে দরজা খুলল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কে কাঁদছে? উনি বলল, কাজের ছেলে।"
--"মেরেছে নাকি?"
এমন সময় ম্যানেজার সাহেব আজাদকে ডেকে পাঠালেন। আজাদ সামিয়াকে বলল,
"আমি কিছুক্ষণ পর তোমাকে ফোন করছি। স্যার ডাকছেন।"
আজাদ শার্ট-প্যান্টের ইন ঠিক করে ম্যানেজার সাহেবের ঘরে ঢুকল। ম্যানেজার সাহেব কার সাথে যেন হাসিমুখে কথা বলছিলেন, আজাদের মনে হলো তিনি খোশগল্প করছিলেন। আজাদকে দেখে তিনি ফোন রেখে বিরক্তমুখে বললেন, "বোসো।"
আজাদ বসল।
ম্যানেজার সাহেব বললেন, "তোমাকে কী আমি বলেছিলাম ফোনে কথা না বলতে?"
--"জি স্যার।"
--"তুমি আমার কথা শুনছো না কেন?"
--"স্যার আমার হাতে তো কোনো কাজ ছিল না। আপনাকে আমি বলেছিলাম আমার স্ত্রী অসুস্থ।"
ম্যানেজার সাহেব রেগে গিয়ে বললেন, "কাজ থাকুক আর নাই থাকুক, আই সেইড, অফিসে বসে ফোনে কথা বলা যাবে না, তো যাবেই না, কাজ থাকুক অথবা নাই থাকুক।"
আজাদ কোনো কথা বলল না।
--"দিস ইজ ইয়োর লাস্ট ওয়ার্নিং।"
ম্যানেজের সাহেবের ফোন আবারও বেজে উঠল, তিনি ফোন ধরে বললেন, "রিচি আমি তোমাকে কিছুক্ষণ পরে ফোন করছি।"
ম্যানেজার সাহেব ফোন রেখে দিলেন। আজাদ জিজ্ঞাসা করল, "স্যার যাব?"
--"যাও, মন দিয়ে কাজ করো। ফোনে কথা বলবে না।"
আজাদ ম্যানেজার সাহেবের ঘর থেকে বের হয়ে ডেস্কে এসে বসল। ওর মেজাজ ম্যানেজারের উপরে চরম মাত্রায় খারাপ হয়ে আছে। তিনি সারাটাদিন ফোনে কথা বলেন অথচ ও দুই-চার, দশমিনিট কথা বললেই তার সমস্যা হয়ে যায়। ইতোমধ্যে সামিয়া আবারও ফোন করতে শুরু করেছে। আজাদ ডেস্ক থেকে উঠে অনুমতি বিহীন ম্যানেজারের ঘরে গিয়ে ঢুকল। ম্যানেজার সাহেব এখনো হাসিমুখে ফোনে কথা বলছেন। আজাদকে দেখে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, "কিছু বলবে?"
আজাদ রক্তচোখে ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে হুংকার দিয়ে বলল, "তোর চাকরি আমি করব না। কাঁথা পুড়ি তোর চাকরির, বেটা ফাজিল।"
ম্যানেজার সাহেব ফোন রেখে দিয়ে ভোতামুখে বললেন, "আজাদ ব্যবহার ঠিক করো।"
--"ধুর বেটা ফাজিল, তোর সাথে ভালো ব্যবহার করব কীরে? তুই বেটা সারাদিন ফোনে কথা বলিস সেইটা কিছু হয় না? আমি আমার অসুস্থ স্ত্রীর সাথে একটু কথা বললেই তোর দুনিয়ার সমস্যা হয়ে যায়, করলাম না তোর চাকরি।"
ম্যানেজার সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। আজাদ আর কিছু না বলে গোমড়া মুখে অফিস থেকে বের হয়ে সামিয়াকে ফোন করল।
সামিয়া ফোন ধরে বলল,
"এই শোনো তুমি ফারুক সাহেবকে ফোন করে বলে দাও, সে যেন চিৎকার চেঁচামেচি না করে।"
--"কী হয়েছে? সে চেঁচাচ্ছে কেন?"
--"তোমাকে বললাম না, উনার ফ্ল্যাটে একটা ছেলে কাঁদছিল, ওর নাম সুজন। সুজনকে উনি মেরে কিছু রাখেনি। ওর নাক দিয়ে রক্ত পড়ছিল, গায়ে মারের দাগ পড়ে গেছে, তুমি আসলে দেখো।"
--"উনি চেঁচামেচি করছে কেন?"
--"আমি তো সুজনকে নিয়ে এসেছি। উনি বার বার বলছেন ওকে যেন দিয়ে দেই কিন্তু আমি দেবো না। উনারা এই ছেলেকে মেরেই ফেলবে। আমি বলে দিয়েছি, ওর বাবা-মা আসার পর তাদের সাথে কথা বলে তারা যদি ওকে উনাদের বাসায় রাখতে রাজি হয় তাহলেই কেবল দেবো।"
--"ফোন রাখো, আমি উনাকে ফোন করছি"
ফোন রেখে আজাদ হাঁটতে হাঁটতে রমনা পার্কের সামনে এসে ফারুক সাহেবকে ফোন করল। মেজাজ ওর এমনিতেই খারাপ, এরমধ্যে সামিয়ার সাথে তার চেঁচামেচির কথা শুনে মেজাজ আরও খারাপ হয়ে গেছে। ফারুক সাহেব ফোন ধরতেই ও চেঁচিয়ে বলল,
"সমস্যা কী আপনার, বাচ্চাটাকে এইভাবে মেরেছেন কেন?"
ফারুক সাহেব বললেন,
"সেটা কী আপনাকে বলতে হবে?"
আজাদ বিশ্রী একটা গালি দিয়ে বলল, "আমাকে বলবি না তো কাকে বলবি? তোর বাপকে বলবি? তুই বাসায় থাক আমি তোর বাপকে নিয়ে আসতেছি।"
আজাদ ফোন রেখে আবারও হাঁটা শুরু করল।
হাঁটতে হাঁটতে গুলিস্থান এসে একটা ভীড় দেখে আজাদ ভীড় ঠেলে সামনে গিয়ে দেখল, এক ভন্ড জ্যোতিষী মানুষের হাত দেখে ভবিষ্যদ্বাণী করছে। হাত দেখে সে যা বলছে, তাতে সবার ভবিষ্যত উজ্জ্বল। তার পাশের সাইনবোর্ডে লেখা,
"আল্লাহ..............সর্বশক্তিমান"
"জ্যোতিষী ঘুঘু মিয়া।"
(রসুলপুর, ঘাটাইল, টাঙ্গাইল)
দীর্ঘদিন হইতে হাত দেখিয়া নির্ভুলভাবে আস্থার সহিত ভবিষ্যদ্বাণী করিয়া আসিতেছি।
লোকজন ঘুঘু মিয়ার কথা আনন্দের সাথে শুনছে। সে আসর জমানোর জন্য কথার ফাঁকে ফাঁকে হাসির গল্পও বলছে। আজাদ তার সামনে গিয়ে বলল, "ভাই আমার হাতটা দেখুন তো।"
সে আজাদের হাত দেখে হাসিমুখে বলল, "আপনার তো ভাই চান কপাল।"
--"কেন কী হয়েছে?"
--"আপনার খুব শীঘ্রই বিবাহ হইবে।"
--"সত্যি? তার মানে আমার দ্বিতীয় বিয়ে হবে?"
--"হইতেই পারে, একজন পুরুষ লোক ইসলামি শরীয়াহ মোতাবেক চারটা পর্যন্ত বিবাহ করিতে পারে জনাব।"
--"আমিও যে একজন জ্যোতিষী, এই কথা জানেন আপনি?"
--"জি না ভাই সাহেব।"
--"দেখি আপনার হাতটা দেখি।"
ঘুঘু মিয়া উৎসাহের সহিত হাত বাড়িয়ে দিল। আজাদ হাত দেখে বসা অবস্থাতেই তার গালে কষে একটা থাপ্পড় লাগালো। সে গালে হাত দিয়ে বলল, "কী হলো ভাই সাহেব? আপনি আমাকে থাপ্পড় মারলেন কেন?"
আজাদ বলল,
"কেন আপনি আজকে আপনার হাত দেখেন নাই? আপনার হাতের রেখায় তো স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে, আজ আসরের মধ্যে থেকে একজন জ্যোতিষী আপনাকে হাত দেখাতে এসে আপনার হাত দেখে গালে কষে একটা থাপ্পড় লাগাবে।"
আজাদ জ্যোতিষী ঘুঘু মিয়ার আসর ভেঙে বের হয়ে একটা রিকশা নিয়ে ওয়ারী থানায় চলে গেল।
ওয়ারী থানার এস.আই কিবরিয়া আজাদের স্কুল জীবনের বন্ধু। কিবরিয়াকে সাবকিছু খুলে বলে ওকে সাথে নিয়ে আজাদ বাড়িতে ফিরল।
ফারুক সাহেব আজাদদের ফ্ল্যাটের সামনে সিঁড়িতে বসে আছেন। কিবরিয়ার পরনে খাঁকি পোষাক দেখে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তিনি ভাবেননি, আজাদ তার বাবার কথা বলে সাথে করে পুলিশ নিয়ে আসবে। তিনি সিঁড়ি থেকে উঠে নিচে চলে যেতে চেষ্টা করলেন। আজাদ তার হাত ধরে ফেলে বলল, "আরে যাচ্ছিস কোথায়? তোর বাপকে নিয়ে এসেছি তোর বিচার করার জন্যে।"
আজাদের কণ্ঠস্বর শুনে সামিয়া এসে দরজা খুলল।
কিবরিয়া আর ফারুক সাহেবকে নিয়ে আজাদ ঘরে ঢুকল।
সুজনের মুখমণ্ডল ফুলে আছে। সুজনকে দেখিয়ে আজাদ কিবরিয়াকে বলল, "তোকে বলেছিলাম না প্রায়ই বাচ্চাটাকে মারে? দেখ আজকে মেরে কী অবস্থা করেছে।"
সামিয়া বলল, "ভাইয়া, এখন তো খুব একটা বোঝা যাচ্ছে না। আমি যখন ওকে নিয়ে এসেছি তখন ওর নাক থেকে রক্ত বের হচ্ছিল।"
ফারুক সাহেব কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আসামীর মতো মাথা নত করে রেখেছেন। কিবরিয়া তার দিকে তাকিয়ে বলল, "ওকে মেরেছেন কেন?"
--"এ আমার শার্টের পকেট থেকে টাকা চুরি করেছে।"
কিবরিয়া সুজনকে জিজ্ঞাসা করল, "এই টাকা চুরি করেছ তুমি?"
সুজন ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে বলল, "আমি নেই নাই।"
ফারুক সাহেব অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে বলল,
"এ মিথ্যা কথা বলছে, ছেলে মহা ত্যাদড়।"
কিবরিয়া বলল, "ওর বাবা-মার ফোন নম্বর দিন।"
--"একে আমি এতিমখানা থেকে নিয়ে আসছিলাম। এর বাবা-মা নাই।"
--"ও আচ্ছা এজন্যেই এভাবে মারতে পেরেছেন। আপনার ছেলে-মেয়ে কয়জন?"
--"দুই ছেলে-মেয়ে।"
--"ওদেরকে কখনো এভাবে মারতে পারবেন?"
ফারুক সাহেব কোনো কথা বললেন না।
ফারুক সাহেবকে রাতের মধ্যে থানায় গিয়ে দেখা করতে বলে কিবরিয়া সুজনের দায়-দায়িত্ব আজাদদেরকে দিয়ে চলে গেল।
চলবে
নাহিদ হাসান নিবিড়
Hasibul hasan santo, Sk sagor, Sk imran, Rasel islam, Mr faruk, Sumaiya akter, Rokeya hoq and লেখাটি পছন্দ করেছে
- Jamshedনবাগত
- Posts : 8
স্বর্ণমুদ্রা : 1122
মর্যাদা : 20
Join date : 2021-05-30
Re: অলীক ভুবন
Sat Jun 05, 2021 9:56 pm
পর্ব- ০৩
সুজনের বয়স ছয় থেকে সাত বছর হবে, সঠিক বয়স সামিয়া জানে না, সুজন নিজেও জানে না। আজাদকে সামিয়া বলেছে সুজনকে স্কুলে ভর্তি করে দেবে। আজাদ খুশি হয়ে বলেছে, "দ্রুত ভর্তি করে দাও।"
আজাদ অফিসে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। পরপর তিনদিন অফিসে যেতে না দেখে সামিয়া ওকে জিজ্ঞাসা করল, "তোমার কী শরীর খারাপ করেছে? অফিসে যাচ্ছ না কেন?"
আজাদ হেসে বলল, "আমি তো চাকরি ছেড়ে দিয়েছি।"
সামিয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, "মানে? চাকরি ছেড়েছ কেন?"
--"আর বোলো না। ম্যানেজারটা এত বদমাইশ, নিজে সারাদিন ফোনে কথা বলে তাতে কোনো সমস্যা নেই কিন্তু আমাকে তোমার সাথে ফোনে কথা বলতে দেখলেই ডেকে বকাবকি করতে শুরু করে।"
--"এখন তাহলে কী করবে?"
--"তোমার সাথে কয়দিন গল্প-গুজব করে কাটাই, এরপর আমাদের জুতার কারখানাটায় পুরোদমে সময় দেবো। চাকরিটা ছেড়ে ভালো করেছি না?"
সামিয়া হাসিমুখে বলল, "খুব ভালো করেছ, একা একা বাসায় থাকতে আমার ভালো লাগে না। আচ্ছা একটা কাজ করো, সুজনকে নিয়ে মার্কেটে যাও। ওর জন্যে সুন্দর দেখে জামাকাপড় কিনে নিয়ে আসো।"
আজাদ বলল, "তুমিও চলো।"
--"আমি গিয়ে কী করব?"
--"জামাকাপড় পছন্দ করে কিনবে।"
--"আচ্ছা তাহলে একটু অপেক্ষা করো, আমি কাপড় বদলে আসি।"
সামিয়া কিছুক্ষণের মধ্যে জামাকাপড় বদলে এলো।
সামিয়া আর সুজনকে নিয়ে আজাদ মার্কেটে চলে গেল।
সামিয়া মার্কেটের দোকানে দোকানে ঘুরে ঘুরে সুজনের জন্য জামাকাপড় কিনল।
আজাদ মার্কেট থেকে সামিয়াদেরকে চাইনিজ রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে খাওয়া দাওয়া করে বিকালবেলা বাসায় ফিরে এলো।
সামিয়া মার্কেট থেকে ফিরে এসে সুজনকে নেংটু করে গা ডলে গোসল করিয়ে দিয়েছে। এতদিন ওর কেবলমাত্র দুইটা লুঙ্গি আর একটা পায়জামা ছিল, তাতে কোনো জিপার ছিল না। প্যান্ট পরার সাথে ও অভ্যস্ত না। আজ গোসলের পর প্যান্ট পরতে গিয়ে ওর লজ্জাস্থান প্যান্টের জিপারে আটকে গিয়েছিল। ব্যাথায় ও আর্তনাদ করতে শুরু করেছিল, পরে সামিয়া ওকে এই বিপদের হাত থেকে রক্ষা করে জিপার লাগানোর কৌশল শিখিয়ে দিয়েছে। সুজন বুঝতে পারছে এই মহিলা ওকে খুব আদর করে কিন্তু তাকে ও কী বলে সম্মোধন করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। তাকে কী ও খালাম্মা বলে ডাকবে? ফারুক সাহেবের স্ত্রীকে ও খালাম্মা বলে ডাকত। সুজনকে সম্মোধন সমস্যা থেকে সামিয়াই উদ্ধার করল। রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর সামিয়া সুজনকে বলল, "আমাকে মা বলে ডাকবি ঠিক আছে?"
সুজন 'হ্যাঁ' সূচক মাথা নাড়ল।
আজাদকে ইশারায় দেখিয়ে সামিয়া বলল, "ওকে বাবা বকে ডাকবি ঠিক আছে?"
সুজন আবারও 'হ্যাঁ' সূচক মাথা নাড়ল।
সামিয়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সুজনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, "আমাকে কী বলে ডাকবি?"
সুজন বলল, "মা।"
সামিয়া আজাদকে দেখিয়ে বলল, "ওকে কী ডাকবি?"
সুজন বলল, "বাবা।"
সামিয়া হাসিমুখে সুজনের গাল টেনে আদর করে বলল, "গুড বয়।"
বর্তমানে সুজন আছে একটা ঘোরের মধ্যে, মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে এত এত পরিবর্তন ও ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না, ও চুপচাপ সময় কাটাচ্ছে। ওকে কিছু জিজ্ঞাসা করলে ও মাথা নেড়ে উত্তর দেবার চেষ্টা করছে। যেসব কথা একদমই মাথা নেড়ে উত্তর দেওয়া যাচ্ছে না কেবল সেসবের উত্তর ও মুখে বলছে।
ফারুক সাহেবদের বাসায় থাকাকালীন চেয়ার অথবা সোফায় বসা সুজনের জন্য নিষেধ ছিল। মেঝেতে বসতে বসতে ওর অভ্যাস হয়ে গেছে মেঝেতে বসা। সামিয়া ওকে গত কয়েকদিনে অসংখ্যবার মেঝেতে বসতে বারণ করেছে তারপরও ও ভুল করে বার বার মেঝেতে বসে পড়ছে।
সুজন এতদিন ঘুমিয়েছে মেঝেতে, ওর কোনো ঘর ছিল না। সামিয়া ওদের দুইটা ঘরের একটা ঘরে ওকে থাকতে দিয়েছে। ঘরে খাট আছে, একটা কাঠের আলমিরা আছে, সুন্দর একটা আলনা আছে, ছোট একটা টেবিলও আছে। ঘরে এটাচড বাথরুমও আছে, বাথরুমে হাইকমোড আছে। সামিয়া ওকে হাই কমোড ব্যবহার করা শিখিয়ে দিয়েছে। এখানে ওকে কোনো কাজ করতে হচ্ছে না, কেউ বকাঝকা করে না, মারে না, টেলিভিশন দেখতে দেয়, অনেক আদর-যত্ন করে, ভালো ভালো খাবার দেয়। সবকিছু ওর কাছে স্বপ্নের মতো লাগছে।
কয়েকদিনের মধ্যে আজাদ পুরোদমে জুতোর কারখানায় সময় দিতে শুরু করল। সুজন বাসায় আসার পর থেকে এখনো পর্যন্ত সামিয়া কোনো অস্বাভাবিক আচরণ করেনি। সুজনের জন্য আজাদ খানিকটা চিন্তামুক্ত থাকতে পারছে কিন্তু পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছে না যে সামিয়ার ভয় পাবার বাতিক কেটে গেছে। বাসার বাইরে যাবার সময় এখনো সামিয়ার জন্য ওর খুব চিন্তা হয়, যদি ও বাসার বাইরে যাবার পর সামিয়া আগের মতো ভয় পেয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি করতে শুরু করে! ঘরের জিনিসপত্র ভাংচুর করতে শুরু করে! তখন সুজনের কী অবস্থা হবে? ও সুজনকে ওর একটা ফোন দিয়ে দিয়েছে, কীভাবে ফোন করতে হয় শিখিয়ে দিয়ে ওকে বলেছে, বাসায় কখনো কোনো সমস্যা হলে সাথে সাথে ওকে ফোন করে জানাতে।
সামিয়া সুজনকে বাড়ির কাছের একটা স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে। বর্তমানে সারাক্ষণ ও সুজনকে নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। সুজনকে ও স্কুলে দিয়ে আসছে আবার নিয়ে আসছে, গোসল করাচ্ছে, একসাথে বসে টেলিভিশন দেখছে, গল্প করছে, রান্নাঘরে ওকে বসিয়ে রেখে রান্না-বান্না করছে, পড়তে বসাচ্ছে।
সপ্তাহদুয়েক কেটে গেল। আজাদ ইদানীং সকাল থেকে রাত অবধি কারখানায় সময় দিচ্ছে। আজ সকাল থেকে আকাশটা মেঘলা হয়ে আছে, কিছু সময় পরপর মেঘ ডাকাডাকি করলেও বৃষ্টি নামছে না, চারিদিকে শীতল বাতাস বইছে। দুপুরের রান্নাবান্না শেষ করে সুজনকে গোসল করিয়ে দিয়ে সামিয়া বলল, "তুই গিয়ে টেলিভিশনে কার্টুন দেখ৷ আমি গোসল করে এসে একসাথে খাব।"
সুজন সামিয়ার কথামতো বসার ঘরের সোফায় গিয়ে বসে টেলিভিশন জুড়ে দিল। সামিয়া গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে ঝর্ণা ছেড়ে ঝর্ণার নিচে দাঁড়ালো।
খানিক সময় পর সামিয়ার মনে হলো কেউ একজন ঠিক ওর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। ও দ্রুত পেছনের দিকে তাকাল, পেছনে তাকাতেই ও দেখল সেই সাদা শাড়ি পরিহিত বৃদ্ধা ঠিক ওর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। তার মাথায় কোনো চুল নেই, গালের চামড়া ঝুলে গেছে। নীলাভ চোখে সামিয়ার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে সে বলল, "আয় লো সখী তোরে গোসল করাই দেই।"
সামিয়া ভয়ে চিৎকার করতে শুরু করল, ছুটে বাথরুমের দরজার কাছে যেতে নিয়ে পা পিছলে ও মেঝেতে পড়ে গেল। পায়ে ও প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছে, ভয়ে ভয়ে মেঝেতে বসেই ও চারিদিকে তাকিয়ে দেখল, বাথরুমে ও ব্যতীত আর কেউ নেই। সামিয়ার চিৎকার শুনে ইতোমধ্যে সুজন বাথরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মা মা বলে ডাকতে শুরু করেছে। সামিয়া পায়ের ব্যথায় নড়তে পারছে না। দরজার বাইরে থেকে সামিয়ার গোঙানির শব্দ শুনে সুজন জোরে জোরে দরজা ধাক্কাতে শুরু করল। এই কয়দিনেই সামিয়ার প্রতি ওর হৃদয়ে তীব্র মায়ার সঞ্চার হয়েছে, চিন্তায় ভয়ে ওর কান্না চলে আসছে।
মিনিট পাঁচেক পর বহুকষ্টে সামিয়া দরজা খুলল। সুজন দেখল সামিয়া মেঝেতে বসে কাঁদছে। ও সামনে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, "কী হয়েছে মা?"
সামিয়া কিছু না বলে মেঝে থেকে উঠতে গিয়ে ককিয়ে উঠল। সুজন কী করবে বুঝতে না পেরে আবারও জিজ্ঞাসা করল, "মা এমন করছেন কেন?"
সামিয়া প্রত্যুত্তরে কিছু না বলে ওর গায়ে ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কোনোরকম ঘরে এসে ভেজা কাপড়েই বিছানায় শুয়ে পড়ল।
সুজন কয়েকবার জিজ্ঞাসা করল, "মা কী হয়েছে?" কিন্তু সামিয়া কোনো উত্তর দিল না। সুজন কি করবে ভাবতে ভাবতে আজাদকে ফোন করল। আজাদ ফোন ধরতেই সুজন বলল, "বাবা মা যেন কেমন করতেছে।"
সুজনকে কিছু জিজ্ঞাসা না করে আজাদ ফোন রেখে দ্রুত বাসায় চলে এলো।
বাসায় এসে আজাদ দেখল সামিয়া ভেজা কাপড় পরিহিত অবস্থায় বিছানায় শুয়ে আছে। আজাদ ওর পাশে বসে জিজ্ঞাসা করল, "কী হয়েছে তোমার?"
সামিয়া কিছু বলল না। আজাদ আবারও জিজ্ঞাসা করল, "কিছু দেখে ভয় পেয়েছ?"
সামিয়া ভয় পাবার কথা লুকিয়ে বলল, "বাথরুমে পড়ে গিয়েছিলাম।"
--"কীভাবে?"
--"পা পিছলে।"
--"কোথাও ব্যথা পেয়েছ?"
--"ডান পা নাড়তে পারছি না, খুব ব্যথা।"
আজাদের সন্দেহ হলো বাচ্চার কোনো ক্ষতি হয়নি তো! দেরি না করে ও সামিয়ার জামাকাপড় বদলে দিয়ে ওকে আর সুজনকে নিয়ে হাসপাতালে চলে গেল।
হাসপাতালে ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়ে আজাদ সবকিছু খুলে বলার পর ডাক্তার সামিয়াকে পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে জানিয়েছেন, "বাচ্চার কোনো ক্ষয়-ক্ষতি হয়নি কিন্তু সামিয়া ডানপায়ের হাঁটুতে ভীষণ চোট পেয়েছে।" ডাক্তার সামিয়াকে কোনো ব্যান্ডেজ না দিলেও দুই সপ্তাহ বিশ্রামে থাকতে বলেছেন, সাথে কিছু ঔষধও দিয়েছেন।
হাসপাতাল থেকে রাত নয়টার দিকে সামিয়াদেরকে নিয়ে বাসায় ফিরল আজাদ।
সামিয়ার পায়ে চোট পাবার সংবাদ শুনে রাতেই সামিয়ার মা রোকেয়া বেগম বাসায় চলে এলেন। মেয়েকে দেখে তিনি কেঁদে ফেললেন। আজাদ তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, "মা কাঁদবেন না, ওর যে পায়ের হাঁড় ভাঙেনি এই তো বেশি।"
রোকেয়া বেগম জিজ্ঞাসা করলেন, "বাবা বাচ্চাটার কী অবস্থা? ওর কোনো ক্ষতি হয়নি তো?"
আজাদ তাকে আশ্বস্ত করে বলল, "না মা বাচ্চা ভালো আছে।"
রোকেয়া বেগম স্বস্থির শ্বাস ফেলে বললেন, "আলহামদুলিল্লাহ।"
সামিয়াকে তিনি কিছুটা রাগ হয়ে বললেন, "এমন সময় একটু সাবধানে থাকবি না, আজকে বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারত। খুব ব্যথা করছে?"
সামিয়া বলল, "ব্যাথা তো করছেই।"
--"ঠিক হয়ে যাবে মা, তুই চিন্তা করিস না।"
--"মা আমি তো বিছানা থেকে উঠতে পারব না। দুপুরে রান্না করেছিলাম, একটু দেখো না সব ঠিক আছে কী না।"
আজাদ বলল, "মা আপনি বসুন, ওসব আমি দেখছি।"
আজাদ রান্নাঘরে গিয়ে দেখল, দুপুরে সামিয়া ভাতের সাথে মুরগির মাংস রান্না করেছে, সবকিছু ঠিকঠাকই আছে। আজাদ প্লেটে প্লেটে খাবার বেড়ে ঘরে নিয়ে গেল।
রোকেয়া বেগম নিজ হাতে মেয়েকে খাইয়ে দিয়ে নিজেও খেলেন।
খাওয়া-দাওয়ার পর আজাদ রোকেয়া বেগমকে বলল, "মা ও সুস্থ হবার আগ পর্যন্ত আপনি থেকে যান। আপনি থাকলে আমি একটু নিশ্চিন্তে থাকতে পারব।"
রোকেয়া বেগম বললেন, "থাকব বাবা, তুমি চিন্তা করো না।"
--"মা রাজিবের কী অবস্থা? ওকে নিয়ে আসতেন। একা একা ও বাসায় কী করবে?"
--"ছেলেটার জন্যই তো কোথাও যেতে পারি না, ওর পরীক্ষা চলছে।"
--"কয়টা আছে আর?"
--"আরও দুইটা, পরশুদিন শেষ হবে।"
--"তাহলে পরীক্ষার পর ওকেও চলে আসতে বলুন। অনেকদিন হলো ও আসে না। ওর একা একা বাসায় থাকার দরকার নেই।"
--"আচ্ছা বাবা বলব।"
রাত একটা অবধি আজাদের সাথে কথাবার্তা বলে রোকেয়া বেগম মেয়ের সাথে ঘুমালেন। আজাদ বেশকিছুক্ষণ টেলিভিশন দেখে গিয়ে ঘুমালো সুজনের ঘরে।
চলবে
নাহিদ হাসান নিবিড়
সুজনের বয়স ছয় থেকে সাত বছর হবে, সঠিক বয়স সামিয়া জানে না, সুজন নিজেও জানে না। আজাদকে সামিয়া বলেছে সুজনকে স্কুলে ভর্তি করে দেবে। আজাদ খুশি হয়ে বলেছে, "দ্রুত ভর্তি করে দাও।"
আজাদ অফিসে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। পরপর তিনদিন অফিসে যেতে না দেখে সামিয়া ওকে জিজ্ঞাসা করল, "তোমার কী শরীর খারাপ করেছে? অফিসে যাচ্ছ না কেন?"
আজাদ হেসে বলল, "আমি তো চাকরি ছেড়ে দিয়েছি।"
সামিয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, "মানে? চাকরি ছেড়েছ কেন?"
--"আর বোলো না। ম্যানেজারটা এত বদমাইশ, নিজে সারাদিন ফোনে কথা বলে তাতে কোনো সমস্যা নেই কিন্তু আমাকে তোমার সাথে ফোনে কথা বলতে দেখলেই ডেকে বকাবকি করতে শুরু করে।"
--"এখন তাহলে কী করবে?"
--"তোমার সাথে কয়দিন গল্প-গুজব করে কাটাই, এরপর আমাদের জুতার কারখানাটায় পুরোদমে সময় দেবো। চাকরিটা ছেড়ে ভালো করেছি না?"
সামিয়া হাসিমুখে বলল, "খুব ভালো করেছ, একা একা বাসায় থাকতে আমার ভালো লাগে না। আচ্ছা একটা কাজ করো, সুজনকে নিয়ে মার্কেটে যাও। ওর জন্যে সুন্দর দেখে জামাকাপড় কিনে নিয়ে আসো।"
আজাদ বলল, "তুমিও চলো।"
--"আমি গিয়ে কী করব?"
--"জামাকাপড় পছন্দ করে কিনবে।"
--"আচ্ছা তাহলে একটু অপেক্ষা করো, আমি কাপড় বদলে আসি।"
সামিয়া কিছুক্ষণের মধ্যে জামাকাপড় বদলে এলো।
সামিয়া আর সুজনকে নিয়ে আজাদ মার্কেটে চলে গেল।
সামিয়া মার্কেটের দোকানে দোকানে ঘুরে ঘুরে সুজনের জন্য জামাকাপড় কিনল।
আজাদ মার্কেট থেকে সামিয়াদেরকে চাইনিজ রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে খাওয়া দাওয়া করে বিকালবেলা বাসায় ফিরে এলো।
সামিয়া মার্কেট থেকে ফিরে এসে সুজনকে নেংটু করে গা ডলে গোসল করিয়ে দিয়েছে। এতদিন ওর কেবলমাত্র দুইটা লুঙ্গি আর একটা পায়জামা ছিল, তাতে কোনো জিপার ছিল না। প্যান্ট পরার সাথে ও অভ্যস্ত না। আজ গোসলের পর প্যান্ট পরতে গিয়ে ওর লজ্জাস্থান প্যান্টের জিপারে আটকে গিয়েছিল। ব্যাথায় ও আর্তনাদ করতে শুরু করেছিল, পরে সামিয়া ওকে এই বিপদের হাত থেকে রক্ষা করে জিপার লাগানোর কৌশল শিখিয়ে দিয়েছে। সুজন বুঝতে পারছে এই মহিলা ওকে খুব আদর করে কিন্তু তাকে ও কী বলে সম্মোধন করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। তাকে কী ও খালাম্মা বলে ডাকবে? ফারুক সাহেবের স্ত্রীকে ও খালাম্মা বলে ডাকত। সুজনকে সম্মোধন সমস্যা থেকে সামিয়াই উদ্ধার করল। রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর সামিয়া সুজনকে বলল, "আমাকে মা বলে ডাকবি ঠিক আছে?"
সুজন 'হ্যাঁ' সূচক মাথা নাড়ল।
আজাদকে ইশারায় দেখিয়ে সামিয়া বলল, "ওকে বাবা বকে ডাকবি ঠিক আছে?"
সুজন আবারও 'হ্যাঁ' সূচক মাথা নাড়ল।
সামিয়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সুজনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, "আমাকে কী বলে ডাকবি?"
সুজন বলল, "মা।"
সামিয়া আজাদকে দেখিয়ে বলল, "ওকে কী ডাকবি?"
সুজন বলল, "বাবা।"
সামিয়া হাসিমুখে সুজনের গাল টেনে আদর করে বলল, "গুড বয়।"
বর্তমানে সুজন আছে একটা ঘোরের মধ্যে, মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে এত এত পরিবর্তন ও ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না, ও চুপচাপ সময় কাটাচ্ছে। ওকে কিছু জিজ্ঞাসা করলে ও মাথা নেড়ে উত্তর দেবার চেষ্টা করছে। যেসব কথা একদমই মাথা নেড়ে উত্তর দেওয়া যাচ্ছে না কেবল সেসবের উত্তর ও মুখে বলছে।
ফারুক সাহেবদের বাসায় থাকাকালীন চেয়ার অথবা সোফায় বসা সুজনের জন্য নিষেধ ছিল। মেঝেতে বসতে বসতে ওর অভ্যাস হয়ে গেছে মেঝেতে বসা। সামিয়া ওকে গত কয়েকদিনে অসংখ্যবার মেঝেতে বসতে বারণ করেছে তারপরও ও ভুল করে বার বার মেঝেতে বসে পড়ছে।
সুজন এতদিন ঘুমিয়েছে মেঝেতে, ওর কোনো ঘর ছিল না। সামিয়া ওদের দুইটা ঘরের একটা ঘরে ওকে থাকতে দিয়েছে। ঘরে খাট আছে, একটা কাঠের আলমিরা আছে, সুন্দর একটা আলনা আছে, ছোট একটা টেবিলও আছে। ঘরে এটাচড বাথরুমও আছে, বাথরুমে হাইকমোড আছে। সামিয়া ওকে হাই কমোড ব্যবহার করা শিখিয়ে দিয়েছে। এখানে ওকে কোনো কাজ করতে হচ্ছে না, কেউ বকাঝকা করে না, মারে না, টেলিভিশন দেখতে দেয়, অনেক আদর-যত্ন করে, ভালো ভালো খাবার দেয়। সবকিছু ওর কাছে স্বপ্নের মতো লাগছে।
কয়েকদিনের মধ্যে আজাদ পুরোদমে জুতোর কারখানায় সময় দিতে শুরু করল। সুজন বাসায় আসার পর থেকে এখনো পর্যন্ত সামিয়া কোনো অস্বাভাবিক আচরণ করেনি। সুজনের জন্য আজাদ খানিকটা চিন্তামুক্ত থাকতে পারছে কিন্তু পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছে না যে সামিয়ার ভয় পাবার বাতিক কেটে গেছে। বাসার বাইরে যাবার সময় এখনো সামিয়ার জন্য ওর খুব চিন্তা হয়, যদি ও বাসার বাইরে যাবার পর সামিয়া আগের মতো ভয় পেয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি করতে শুরু করে! ঘরের জিনিসপত্র ভাংচুর করতে শুরু করে! তখন সুজনের কী অবস্থা হবে? ও সুজনকে ওর একটা ফোন দিয়ে দিয়েছে, কীভাবে ফোন করতে হয় শিখিয়ে দিয়ে ওকে বলেছে, বাসায় কখনো কোনো সমস্যা হলে সাথে সাথে ওকে ফোন করে জানাতে।
সামিয়া সুজনকে বাড়ির কাছের একটা স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে। বর্তমানে সারাক্ষণ ও সুজনকে নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। সুজনকে ও স্কুলে দিয়ে আসছে আবার নিয়ে আসছে, গোসল করাচ্ছে, একসাথে বসে টেলিভিশন দেখছে, গল্প করছে, রান্নাঘরে ওকে বসিয়ে রেখে রান্না-বান্না করছে, পড়তে বসাচ্ছে।
সপ্তাহদুয়েক কেটে গেল। আজাদ ইদানীং সকাল থেকে রাত অবধি কারখানায় সময় দিচ্ছে। আজ সকাল থেকে আকাশটা মেঘলা হয়ে আছে, কিছু সময় পরপর মেঘ ডাকাডাকি করলেও বৃষ্টি নামছে না, চারিদিকে শীতল বাতাস বইছে। দুপুরের রান্নাবান্না শেষ করে সুজনকে গোসল করিয়ে দিয়ে সামিয়া বলল, "তুই গিয়ে টেলিভিশনে কার্টুন দেখ৷ আমি গোসল করে এসে একসাথে খাব।"
সুজন সামিয়ার কথামতো বসার ঘরের সোফায় গিয়ে বসে টেলিভিশন জুড়ে দিল। সামিয়া গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে ঝর্ণা ছেড়ে ঝর্ণার নিচে দাঁড়ালো।
খানিক সময় পর সামিয়ার মনে হলো কেউ একজন ঠিক ওর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। ও দ্রুত পেছনের দিকে তাকাল, পেছনে তাকাতেই ও দেখল সেই সাদা শাড়ি পরিহিত বৃদ্ধা ঠিক ওর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। তার মাথায় কোনো চুল নেই, গালের চামড়া ঝুলে গেছে। নীলাভ চোখে সামিয়ার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে সে বলল, "আয় লো সখী তোরে গোসল করাই দেই।"
সামিয়া ভয়ে চিৎকার করতে শুরু করল, ছুটে বাথরুমের দরজার কাছে যেতে নিয়ে পা পিছলে ও মেঝেতে পড়ে গেল। পায়ে ও প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছে, ভয়ে ভয়ে মেঝেতে বসেই ও চারিদিকে তাকিয়ে দেখল, বাথরুমে ও ব্যতীত আর কেউ নেই। সামিয়ার চিৎকার শুনে ইতোমধ্যে সুজন বাথরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মা মা বলে ডাকতে শুরু করেছে। সামিয়া পায়ের ব্যথায় নড়তে পারছে না। দরজার বাইরে থেকে সামিয়ার গোঙানির শব্দ শুনে সুজন জোরে জোরে দরজা ধাক্কাতে শুরু করল। এই কয়দিনেই সামিয়ার প্রতি ওর হৃদয়ে তীব্র মায়ার সঞ্চার হয়েছে, চিন্তায় ভয়ে ওর কান্না চলে আসছে।
মিনিট পাঁচেক পর বহুকষ্টে সামিয়া দরজা খুলল। সুজন দেখল সামিয়া মেঝেতে বসে কাঁদছে। ও সামনে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, "কী হয়েছে মা?"
সামিয়া কিছু না বলে মেঝে থেকে উঠতে গিয়ে ককিয়ে উঠল। সুজন কী করবে বুঝতে না পেরে আবারও জিজ্ঞাসা করল, "মা এমন করছেন কেন?"
সামিয়া প্রত্যুত্তরে কিছু না বলে ওর গায়ে ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কোনোরকম ঘরে এসে ভেজা কাপড়েই বিছানায় শুয়ে পড়ল।
সুজন কয়েকবার জিজ্ঞাসা করল, "মা কী হয়েছে?" কিন্তু সামিয়া কোনো উত্তর দিল না। সুজন কি করবে ভাবতে ভাবতে আজাদকে ফোন করল। আজাদ ফোন ধরতেই সুজন বলল, "বাবা মা যেন কেমন করতেছে।"
সুজনকে কিছু জিজ্ঞাসা না করে আজাদ ফোন রেখে দ্রুত বাসায় চলে এলো।
বাসায় এসে আজাদ দেখল সামিয়া ভেজা কাপড় পরিহিত অবস্থায় বিছানায় শুয়ে আছে। আজাদ ওর পাশে বসে জিজ্ঞাসা করল, "কী হয়েছে তোমার?"
সামিয়া কিছু বলল না। আজাদ আবারও জিজ্ঞাসা করল, "কিছু দেখে ভয় পেয়েছ?"
সামিয়া ভয় পাবার কথা লুকিয়ে বলল, "বাথরুমে পড়ে গিয়েছিলাম।"
--"কীভাবে?"
--"পা পিছলে।"
--"কোথাও ব্যথা পেয়েছ?"
--"ডান পা নাড়তে পারছি না, খুব ব্যথা।"
আজাদের সন্দেহ হলো বাচ্চার কোনো ক্ষতি হয়নি তো! দেরি না করে ও সামিয়ার জামাকাপড় বদলে দিয়ে ওকে আর সুজনকে নিয়ে হাসপাতালে চলে গেল।
হাসপাতালে ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়ে আজাদ সবকিছু খুলে বলার পর ডাক্তার সামিয়াকে পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে জানিয়েছেন, "বাচ্চার কোনো ক্ষয়-ক্ষতি হয়নি কিন্তু সামিয়া ডানপায়ের হাঁটুতে ভীষণ চোট পেয়েছে।" ডাক্তার সামিয়াকে কোনো ব্যান্ডেজ না দিলেও দুই সপ্তাহ বিশ্রামে থাকতে বলেছেন, সাথে কিছু ঔষধও দিয়েছেন।
হাসপাতাল থেকে রাত নয়টার দিকে সামিয়াদেরকে নিয়ে বাসায় ফিরল আজাদ।
সামিয়ার পায়ে চোট পাবার সংবাদ শুনে রাতেই সামিয়ার মা রোকেয়া বেগম বাসায় চলে এলেন। মেয়েকে দেখে তিনি কেঁদে ফেললেন। আজাদ তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, "মা কাঁদবেন না, ওর যে পায়ের হাঁড় ভাঙেনি এই তো বেশি।"
রোকেয়া বেগম জিজ্ঞাসা করলেন, "বাবা বাচ্চাটার কী অবস্থা? ওর কোনো ক্ষতি হয়নি তো?"
আজাদ তাকে আশ্বস্ত করে বলল, "না মা বাচ্চা ভালো আছে।"
রোকেয়া বেগম স্বস্থির শ্বাস ফেলে বললেন, "আলহামদুলিল্লাহ।"
সামিয়াকে তিনি কিছুটা রাগ হয়ে বললেন, "এমন সময় একটু সাবধানে থাকবি না, আজকে বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারত। খুব ব্যথা করছে?"
সামিয়া বলল, "ব্যাথা তো করছেই।"
--"ঠিক হয়ে যাবে মা, তুই চিন্তা করিস না।"
--"মা আমি তো বিছানা থেকে উঠতে পারব না। দুপুরে রান্না করেছিলাম, একটু দেখো না সব ঠিক আছে কী না।"
আজাদ বলল, "মা আপনি বসুন, ওসব আমি দেখছি।"
আজাদ রান্নাঘরে গিয়ে দেখল, দুপুরে সামিয়া ভাতের সাথে মুরগির মাংস রান্না করেছে, সবকিছু ঠিকঠাকই আছে। আজাদ প্লেটে প্লেটে খাবার বেড়ে ঘরে নিয়ে গেল।
রোকেয়া বেগম নিজ হাতে মেয়েকে খাইয়ে দিয়ে নিজেও খেলেন।
খাওয়া-দাওয়ার পর আজাদ রোকেয়া বেগমকে বলল, "মা ও সুস্থ হবার আগ পর্যন্ত আপনি থেকে যান। আপনি থাকলে আমি একটু নিশ্চিন্তে থাকতে পারব।"
রোকেয়া বেগম বললেন, "থাকব বাবা, তুমি চিন্তা করো না।"
--"মা রাজিবের কী অবস্থা? ওকে নিয়ে আসতেন। একা একা ও বাসায় কী করবে?"
--"ছেলেটার জন্যই তো কোথাও যেতে পারি না, ওর পরীক্ষা চলছে।"
--"কয়টা আছে আর?"
--"আরও দুইটা, পরশুদিন শেষ হবে।"
--"তাহলে পরীক্ষার পর ওকেও চলে আসতে বলুন। অনেকদিন হলো ও আসে না। ওর একা একা বাসায় থাকার দরকার নেই।"
--"আচ্ছা বাবা বলব।"
রাত একটা অবধি আজাদের সাথে কথাবার্তা বলে রোকেয়া বেগম মেয়ের সাথে ঘুমালেন। আজাদ বেশকিছুক্ষণ টেলিভিশন দেখে গিয়ে ঘুমালো সুজনের ঘরে।
চলবে
নাহিদ হাসান নিবিড়
Hasibul hasan santo, Sk sagor, Sk imran, Rasel islam, Mr faruk, Sumaiya akter, Rokeya hoq and লেখাটি পছন্দ করেছে
- Jamshedনবাগত
- Posts : 8
স্বর্ণমুদ্রা : 1122
মর্যাদা : 20
Join date : 2021-05-30
Re: অলীক ভুবন
Sat Jun 05, 2021 9:57 pm
পর্ব- ০৪
শ্বাশুড়ি মা বাসায় আসার পর আজাদের চিন্তা বেশ কমেছে। ইতোমধ্যে ওর একমাত্র শ্যালক রাজিবও পরীক্ষা শেষ করে চলে এসেছে। বেশকিছুদিন থেকেই আজাদ ভাবছিল সামিয়ার জন্য কিছু পাখি কিনবে। বিকালবেলা কারখানা থেকে সরাসরি ও কাটাবনে চলে এসেছে।
কাটাবনে পাখির দোকানে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ আজাদের সাইকিয়াট্রিস্ট নিজাম আহমেদের কথা মনে পড়ে গেল। কিছুদিন আগে ও এক ব্যবসায়ীর সাথে গল্প করতে করতে তাঁর সন্ধান পেয়েছে। তিনি আজিমপুরে থাকেন। তাঁর ঠিকানা ওর মানিব্যাগে ছোট একটা কাগজে লেখা আছে। পাখি দেখা বাদ দিয়ে ও মানিব্যাগ থেকে ঠিকানা লেখা কাগজটা বের করে রিকশা নিয়ে আজিমপুরে চলে গেল।
আজিমপুর গোরস্তান থেকে খানিকটা ভেতরে নিজাম আহমেদের বাড়ি। আজাদ রিকশায় করে অলিতে-গলিতে খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে কাঙ্খিত বাড়ির সামনে এসে রিকশা থেকে নামল, বাড়ির নাম 'নক্ষত্র ভবন।' আজাদ রিকশার ভাড়া পরিশোধ করে বাড়ির ফটকে কড়া নেড়ে দেখল, ফটক খোলা। ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই ওকে দেখে সাদা এবং ঘিয়া রঙের পশমের সুন্দর একটা কুকুর ঘেউঘেউ করতে শুরু করল। আজাদ ভালোভাবে তাকিয়ে দেখল, কুকুরটা বাঁধা আছে কীনা। কুকুরটা বাঁধা আছে কিন্তু কুকুরটা হাকডাক থামাচ্ছে না। ফটক থেকে বাড়ি খানিকটা দূরে। আজাদ অস্বস্থিবোধে ভুগছে ও দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি চলে যাবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। এমন সময় সুদর্শন এক ভদ্রলোক এসে কুকুরকে কিছু একটা বলতেই কুকুরটা শান্ত হয়ে গেল। আজাদের দিকে এগিয়ে এসে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, "আপনি কী কাউকে খুঁজছেন?"
আজাদ বলল,
"হ্যাঁ, আমি এসেছিলাম সাইকিয়াট্রিস্ট নিজাম আহমেদের সাথে দেখা করতে। তিনি কী এখানে থাকেন?"
--"জি, আমিই নিজাম আহমেদ। আসুন, দোতলায় গিয়ে বসি।"
আজাদ নিজাম আহমেদের পেছন পেছন যেতে যেতে বলল, "কুকুরটা খুব সুন্দর। আপনার পোষা কুকুর?"
--"হ্যাঁ, এটা এ্যালাস্কান মালামিউট প্রজাতির কুকুর। খুব কষ্টে একে পেয়েছি।"
নিজাম আহমেদ আজাদকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে তাঁর গ্রন্থাগারে ঢুকলেন। আজাদ গ্রন্থাগারের পরিবেশ দেখে বেশ অবাক হলো, চারিদিকে কাঠের উঁচু উঁচু সোকেজে অসংখ্য বই সাজিয়ে রাখা হয়েছে। বেশ বড় একটা চতুর্ভুজ আকৃতির টেবিলের উপর টেবিলল্যাম্প জ্বলছে, ঘরে কয়েক রঙের বাতি জ্বেলে রাখা হয়েছে, এয়ার কন্ডিশন চলছে। আজাদকে বসতে বলে নিজাম আহমেদ গ্রন্থাগার থেকে বের হয়ে গেলেন। আজাদ ঘুরে ঘুরে বই দেখতে শুরু করল।
মিনিট পাঁচেক পর নিজাম আহমেদ একটা ফ্ল্যাক্স আর দুইটা কাপ হাতে গ্রন্থাগারে ঢুকলেন। কাপ দুটোতে চা ঢেলে একটা কাপ আজাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে অন্যটা নিজে নিয়ে চুমুক দিলেন। আজাদ কৌতূহলবশত জিজ্ঞাসা করল, "এখানে কতগুলো বই আছে?"
নিজাম আহমেদ বললেন, "সাত হাজারের মতো।"
--"আপনি কী সব পড়েছেন?"
--"সব পড়া হয়নি তবে মাঝে মাঝে মনে হয় সবই পড়ে ফেলেছি। আমার সমস্যা হচ্ছে, একটা বই পড়ে আরেকটা পড়তে গেলে আগেরটা ভুলে যাই। তারপর বলুন, কী সমস্যা?"
"সমস্যাটা মূলত আমার স্ত্রী সামিয়ার।"
--"কী সমস্যা উনার?"
--"ও মাঝে মাঝেই কিছু একটা দেখে ভয় পায়। ভূত ভূত বলে চিৎকার দিয়ে ওঠে।"
--"কী দেখে, বলেছে কিছু?"
--"এক বৃদ্ধ মহিলাকে নাকি দেখে।"
--"দেখতে কেমন? এই ব্যাপারে কিছু বলেছে?"
--"হ্যাঁ, তাঁর মাথায় কোনো চুল নেই, সাদা শাড়ি পরা থাকে, নীলবর্ণের চোখ।"
--"নির্দিষ্ট কোনো সময়ে দেখে নাকি যখন-তখন?"
--"না নির্দিষ্ট কোনো সময়ে দেখে না, কিছুদিন পরপর দেখে। কখনো রান্নাঘরে, কখনো গোসল করতে গিয়ে।"
--"সমস্যা কী শুধু এটাই, নাকি আরও কোনো সমস্যা আছে?"
--"মাঝে মাঝে ও দরজা বন্ধ করে দিয়ে কান্নাকাটি করে। কেন কান্না করল জিজ্ঞাসা করলে কিছু বলে না। আরেকটা সমস্যা হচ্ছে, মাঝে মধ্যেই ও জিনিসপত্র ভাংচুর করে।"
--"আপনাদের বিয়ে হয়েছে কত বছর হলো?"
--"দুই বছর গিয়ে তিনবছরে পড়ল।"
--"ছেলে-মেয়ে আছে?"
--"এখনো হয়নি, ও মাসচারেক হলো কনসিভ করেছে।"
--"আচ্ছা, আর কোনো সমস্যা?"
--"ও এপর্যন্ত দুবার ঘুমের মধ্যে আমার গলা টিপে ধরেছে। ওকে নিয়ে খুবই সমস্যার মধ্যে আছি।"
--"সমস্যাটা গুরুতর বলে মনে হচ্ছে না। আপনার বাবা- মা কী বেঁচে আছেন?"
--"না, তারা মারা গেছে।"
--"আপনারা ভাই-বোন কয়জন?"
--"আমি একাই।"
--"আপনার স্ত্রীর বাবা-মা কী বেঁচে আছেন?"
--"আমার শ্বাশুড়ি বেঁচে আছেন।"
--"তিনি এখন কোথায়?"
--"কিছুদিন থেকে আমাদের বাসায়। আমি আসলে সামিয়াকে সাথে নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম কিন্তু সপ্তাহখানেক থেকে ও খুব অসুস্থ।"
--"কী হয়েছে?"
--"বাথরুমে গোসল করতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গেছে।"
--"আপনি কী এই বিষয়টা নিয়ে সন্দেহে আছেন?"
--"কী করে বুঝলেন?"
--"বুঝিনি, আপনার গলার স্বরের ওঠানামা, মুখের ভাব-ভঙ্গি দেখে মনে হলো প্রশ্নটা করা উচিৎ তাই করেছি। আপনি কী তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন বাথরুমে সে কিছু দেখেছে কী না?"
--"জি, জিজ্ঞাসা করেছিলাম কিন্তু ও এই ব্যাপারটা এড়িয়ে গিয়েছে।"
--"আপনাদের সম্পর্ক কেমন?"
--"খুব ভালো।"
--"বর্তমানে আপনার স্ত্রী কেমন আছেন?"
--"ভালো কিন্তু ডাক্তার ওকে দুই সপ্তাহ বিশ্রামে থাকতে বলেছে। ও সুস্থ হলে আমি ওকে আপনার এখানে নিয়ে আসব।"
--"না না উনাকে আপনার নিয়ে আসতে হবে না, আপনি বরং আপনাদের বাড়ির ঠিকানা, ফোন নম্বর লিখে দিয়ে যান, আমিই যাব। আপনার শ্বাশুড়ির সাথেও কথা বলা প্রয়োজন।"
আজাদ একটা কাগজে বাড়ির ঠিকানা, ফোন নম্বর লিখে দিয়ে বাইরে বের হয়ে এলো। বাড়ির নিচে বেঁধে রাখা কুকুরটা আবারও ঘেউঘেউ করে উঠল।
রোকেয়া বেগমের সাথে কয়েকদিনের মধ্যেই সুজনের ভালো খাতির হয়ে গেছে। তিনি সুজনের সাথে সারাক্ষণ গল্প-গুজব করছেন। তাঁর সাথে গল্প করতে সুজনের খুব ভালো লাগে, ও সারাক্ষণ তাঁর পেছন পেছন ঘুরঘুর করছে। তাকে রান্নাবান্নার ক্ষেত্রেও ও সাহায্য-সহযোগিতা করছে।
সামিয়ার পায়ের ব্যাথা ভালো হয়ে গেছে। দুদিন থেকে ও স্বাভাবিক ভাবে হাঁটছে। আজাদ আজকে কারখানায় যায়নি, সারাটাদিন বাসায় কাটিয়েছে। সন্ধ্যার দিকে সামিয়া ওর কাছে ছাদে যাবার বায়না ধরল। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হবে জন্য আজাদ ওকে নিষেধ করল। সামিয়া বলল, "চলো না, অনেকদিন থেকে ছাদে যাই না, ভালো লাগছে না। আমার ব্যাথা ভালো হয়ে গেছে, কিছু হবে না।"
আজাদ বলল, "যদি হয়?"
--"হবে না, চলো।"
আজাদ আর নিষেধ করতে পারল না। সামিয়াকে নিয়ে ও ছাদে চলে গেল।
ছাদে হাঁটতে হাঁটতে সামিয়া বলল, "ছাদে তো একটুকুও বাতাস নেই।"
--"কিছুদিন থেকে ভ্যাপসা গরম পড়ছে।"
--"কতদিন যে বৃষ্টিতে ভিজি না!"
--"বৃষ্টিই তো নেই, ভিজবে কী করে?"
--"আজকে চাঁদও ওঠেনি। চলো নিচে ফিরে যাই।"
--"কেবলই না এলাম।"
--"ভালো লাগছে না তো।"
--"ঠিকআছে চলো।"
ছাদ থেকে বাসায় ফিরে এসে আজাদরা দেখল রোকেয়া বেগম সুজন আর রাজিবের সাথে বসার ঘরে বসে গল্প করছেন। আজাদ আর সামিয়াও গল্পে যোগ দিল।
আজ অনেকদিন পর সামিয়া নিজ হাতে রাতের রান্না করলো। এতদিন রোকেয়া বেগম রান্না-বান্না করেছেন।
রাতে খাওয়া-দাওয়া করতে বসে রোকেয়া বেগম আজাদকে বললেন, "বাবা অনেকদিন হলো এসেছি। সামিয়ার পা তো ভালো হয়ে গেছে, রাজিবেরও স্কুল খুলে গেছে। আমাদের তো ফেরা দরকার।"
আজাদ বলল, "মা আর কিছুদিন থাকুন।"
--"রাজিবের তো স্কুল কামাই যাচ্ছে।"
--"কিছুদিন স্কুল কামাই গেলে কিছু হবে না মা।"
খাওয়া-দাওয়ার পর রোকেয়া বেগম আজাদকে বললেন, "বাবা আজ তুমি সামিয়ার সাথে থাকো।"
আজাদ বেশ লজ্জা পেল, ও বুঝতে পারছে শ্বাশুড়ি মা কেন ওকে সামিয়ার সাথে ঘুমাতে বলছেন। তিনি তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন, সামিয়ার পা ভালো হয়ে গিয়েছে, দুইটা সপ্তাহ থেকে স্বামী-স্ত্রী ভিন্ন ঘরে ঘুমাচ্ছে, উভয়ই উভয়ের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত। আজাদ জিজ্ঞাসা করল, "আপনি কোথায় ঘুমাবেন মা?"
--"আমি রাজিবকে নিয়ে সুজনের ঘরে ঘুমাচ্ছি।"
আজাদকে আর কিছু বলবার সুযোগ না দিয়ে তিনি সুজনের ঘরে চলে গেলেন।
সামিয়া ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছে। আজাদ ধীর পায়ে ঘরে প্রবেশ করল। বিছানার কাছে গিয়ে ও দেখল সামিয়া ইতোমধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে। সামিয়াকে ঘুমাতে দেখে ওর মনটা খারাপ হয়ে গেল। ও গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে এসে সামিয়ার পাশে শুয়ে পড়ল।
কিছুক্ষণ পর সামিয়া আচমকা বলে উঠল, "এই।"
আজাদ সাথে সাথে সামিয়ার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, "এখনো ঘুমাওনি তুমি! আমি তো ভেবেছিলাম ঘুমিয়ে পড়েছ।"
--"কতদিন তোমার সাথে ঘুমাই না!"
--"এক যুগ, দুই যুগ নাকি আরও বেশি?"
--"আরও কত বেশি!"
--"সত্যি করে বলো তো, পায়ের ব্যথাটা পুরোপুরি কমেছে?"
--"হ্যাঁ, এখন আর একটুকুও ব্যথা নেই।"
সামিয়া ওর মাথাটা আজাদের বুকে রেখে বলল, "আমি তোমাকে খুব কষ্ট দেই, তাই না?"
--"কই না তো।"
--"তুমি না বললেও আমি জানি।"
--"ভুল জানো।"
--"তুমি যত যাই বলো আমি জানি, আমাকে নিয়ে তুমি সবসময় খুব চিন্তায় থাকো।"
--"চিন্তা তো তোমাকে নিয়েই করব, আমার আর কে আছে?"
সামিয়া আজাদের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, "এখন তুমি ঘুমিয়ে যাও।"
--"তুমি ঘুমাবে না?"
--"হ্যাঁ, ঘুমাবো তো, কতদিন পর তোমাকে কাছে পেলাম, তোমাকে একটু দেখি তারপর ঘুমাবো।"
আজাদ সামিয়ার কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল, "তোমাকেও তো কতদিন পর কাছে পেলাম। আমিও তোমাকে একটু দেখি।"
সামিয়া লজ্জা পেয়ে হেসে বলল, "এত দেখতে হবে না, এখন ঘুমাও।"
আজাদ সামিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই আচমকা ঘুমিয়ে গেল। সামিয়া বেশকিছুক্ষণ আজাদের দিকে তাকিয়ে থেকে বিছানা থেকে নেমে বসার ঘরে চলে গেল।
চলবে
নাহিদ হাসান নিবিড়
শ্বাশুড়ি মা বাসায় আসার পর আজাদের চিন্তা বেশ কমেছে। ইতোমধ্যে ওর একমাত্র শ্যালক রাজিবও পরীক্ষা শেষ করে চলে এসেছে। বেশকিছুদিন থেকেই আজাদ ভাবছিল সামিয়ার জন্য কিছু পাখি কিনবে। বিকালবেলা কারখানা থেকে সরাসরি ও কাটাবনে চলে এসেছে।
কাটাবনে পাখির দোকানে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ আজাদের সাইকিয়াট্রিস্ট নিজাম আহমেদের কথা মনে পড়ে গেল। কিছুদিন আগে ও এক ব্যবসায়ীর সাথে গল্প করতে করতে তাঁর সন্ধান পেয়েছে। তিনি আজিমপুরে থাকেন। তাঁর ঠিকানা ওর মানিব্যাগে ছোট একটা কাগজে লেখা আছে। পাখি দেখা বাদ দিয়ে ও মানিব্যাগ থেকে ঠিকানা লেখা কাগজটা বের করে রিকশা নিয়ে আজিমপুরে চলে গেল।
আজিমপুর গোরস্তান থেকে খানিকটা ভেতরে নিজাম আহমেদের বাড়ি। আজাদ রিকশায় করে অলিতে-গলিতে খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে কাঙ্খিত বাড়ির সামনে এসে রিকশা থেকে নামল, বাড়ির নাম 'নক্ষত্র ভবন।' আজাদ রিকশার ভাড়া পরিশোধ করে বাড়ির ফটকে কড়া নেড়ে দেখল, ফটক খোলা। ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই ওকে দেখে সাদা এবং ঘিয়া রঙের পশমের সুন্দর একটা কুকুর ঘেউঘেউ করতে শুরু করল। আজাদ ভালোভাবে তাকিয়ে দেখল, কুকুরটা বাঁধা আছে কীনা। কুকুরটা বাঁধা আছে কিন্তু কুকুরটা হাকডাক থামাচ্ছে না। ফটক থেকে বাড়ি খানিকটা দূরে। আজাদ অস্বস্থিবোধে ভুগছে ও দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি চলে যাবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। এমন সময় সুদর্শন এক ভদ্রলোক এসে কুকুরকে কিছু একটা বলতেই কুকুরটা শান্ত হয়ে গেল। আজাদের দিকে এগিয়ে এসে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, "আপনি কী কাউকে খুঁজছেন?"
আজাদ বলল,
"হ্যাঁ, আমি এসেছিলাম সাইকিয়াট্রিস্ট নিজাম আহমেদের সাথে দেখা করতে। তিনি কী এখানে থাকেন?"
--"জি, আমিই নিজাম আহমেদ। আসুন, দোতলায় গিয়ে বসি।"
আজাদ নিজাম আহমেদের পেছন পেছন যেতে যেতে বলল, "কুকুরটা খুব সুন্দর। আপনার পোষা কুকুর?"
--"হ্যাঁ, এটা এ্যালাস্কান মালামিউট প্রজাতির কুকুর। খুব কষ্টে একে পেয়েছি।"
নিজাম আহমেদ আজাদকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে তাঁর গ্রন্থাগারে ঢুকলেন। আজাদ গ্রন্থাগারের পরিবেশ দেখে বেশ অবাক হলো, চারিদিকে কাঠের উঁচু উঁচু সোকেজে অসংখ্য বই সাজিয়ে রাখা হয়েছে। বেশ বড় একটা চতুর্ভুজ আকৃতির টেবিলের উপর টেবিলল্যাম্প জ্বলছে, ঘরে কয়েক রঙের বাতি জ্বেলে রাখা হয়েছে, এয়ার কন্ডিশন চলছে। আজাদকে বসতে বলে নিজাম আহমেদ গ্রন্থাগার থেকে বের হয়ে গেলেন। আজাদ ঘুরে ঘুরে বই দেখতে শুরু করল।
মিনিট পাঁচেক পর নিজাম আহমেদ একটা ফ্ল্যাক্স আর দুইটা কাপ হাতে গ্রন্থাগারে ঢুকলেন। কাপ দুটোতে চা ঢেলে একটা কাপ আজাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে অন্যটা নিজে নিয়ে চুমুক দিলেন। আজাদ কৌতূহলবশত জিজ্ঞাসা করল, "এখানে কতগুলো বই আছে?"
নিজাম আহমেদ বললেন, "সাত হাজারের মতো।"
--"আপনি কী সব পড়েছেন?"
--"সব পড়া হয়নি তবে মাঝে মাঝে মনে হয় সবই পড়ে ফেলেছি। আমার সমস্যা হচ্ছে, একটা বই পড়ে আরেকটা পড়তে গেলে আগেরটা ভুলে যাই। তারপর বলুন, কী সমস্যা?"
"সমস্যাটা মূলত আমার স্ত্রী সামিয়ার।"
--"কী সমস্যা উনার?"
--"ও মাঝে মাঝেই কিছু একটা দেখে ভয় পায়। ভূত ভূত বলে চিৎকার দিয়ে ওঠে।"
--"কী দেখে, বলেছে কিছু?"
--"এক বৃদ্ধ মহিলাকে নাকি দেখে।"
--"দেখতে কেমন? এই ব্যাপারে কিছু বলেছে?"
--"হ্যাঁ, তাঁর মাথায় কোনো চুল নেই, সাদা শাড়ি পরা থাকে, নীলবর্ণের চোখ।"
--"নির্দিষ্ট কোনো সময়ে দেখে নাকি যখন-তখন?"
--"না নির্দিষ্ট কোনো সময়ে দেখে না, কিছুদিন পরপর দেখে। কখনো রান্নাঘরে, কখনো গোসল করতে গিয়ে।"
--"সমস্যা কী শুধু এটাই, নাকি আরও কোনো সমস্যা আছে?"
--"মাঝে মাঝে ও দরজা বন্ধ করে দিয়ে কান্নাকাটি করে। কেন কান্না করল জিজ্ঞাসা করলে কিছু বলে না। আরেকটা সমস্যা হচ্ছে, মাঝে মধ্যেই ও জিনিসপত্র ভাংচুর করে।"
--"আপনাদের বিয়ে হয়েছে কত বছর হলো?"
--"দুই বছর গিয়ে তিনবছরে পড়ল।"
--"ছেলে-মেয়ে আছে?"
--"এখনো হয়নি, ও মাসচারেক হলো কনসিভ করেছে।"
--"আচ্ছা, আর কোনো সমস্যা?"
--"ও এপর্যন্ত দুবার ঘুমের মধ্যে আমার গলা টিপে ধরেছে। ওকে নিয়ে খুবই সমস্যার মধ্যে আছি।"
--"সমস্যাটা গুরুতর বলে মনে হচ্ছে না। আপনার বাবা- মা কী বেঁচে আছেন?"
--"না, তারা মারা গেছে।"
--"আপনারা ভাই-বোন কয়জন?"
--"আমি একাই।"
--"আপনার স্ত্রীর বাবা-মা কী বেঁচে আছেন?"
--"আমার শ্বাশুড়ি বেঁচে আছেন।"
--"তিনি এখন কোথায়?"
--"কিছুদিন থেকে আমাদের বাসায়। আমি আসলে সামিয়াকে সাথে নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম কিন্তু সপ্তাহখানেক থেকে ও খুব অসুস্থ।"
--"কী হয়েছে?"
--"বাথরুমে গোসল করতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গেছে।"
--"আপনি কী এই বিষয়টা নিয়ে সন্দেহে আছেন?"
--"কী করে বুঝলেন?"
--"বুঝিনি, আপনার গলার স্বরের ওঠানামা, মুখের ভাব-ভঙ্গি দেখে মনে হলো প্রশ্নটা করা উচিৎ তাই করেছি। আপনি কী তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন বাথরুমে সে কিছু দেখেছে কী না?"
--"জি, জিজ্ঞাসা করেছিলাম কিন্তু ও এই ব্যাপারটা এড়িয়ে গিয়েছে।"
--"আপনাদের সম্পর্ক কেমন?"
--"খুব ভালো।"
--"বর্তমানে আপনার স্ত্রী কেমন আছেন?"
--"ভালো কিন্তু ডাক্তার ওকে দুই সপ্তাহ বিশ্রামে থাকতে বলেছে। ও সুস্থ হলে আমি ওকে আপনার এখানে নিয়ে আসব।"
--"না না উনাকে আপনার নিয়ে আসতে হবে না, আপনি বরং আপনাদের বাড়ির ঠিকানা, ফোন নম্বর লিখে দিয়ে যান, আমিই যাব। আপনার শ্বাশুড়ির সাথেও কথা বলা প্রয়োজন।"
আজাদ একটা কাগজে বাড়ির ঠিকানা, ফোন নম্বর লিখে দিয়ে বাইরে বের হয়ে এলো। বাড়ির নিচে বেঁধে রাখা কুকুরটা আবারও ঘেউঘেউ করে উঠল।
রোকেয়া বেগমের সাথে কয়েকদিনের মধ্যেই সুজনের ভালো খাতির হয়ে গেছে। তিনি সুজনের সাথে সারাক্ষণ গল্প-গুজব করছেন। তাঁর সাথে গল্প করতে সুজনের খুব ভালো লাগে, ও সারাক্ষণ তাঁর পেছন পেছন ঘুরঘুর করছে। তাকে রান্নাবান্নার ক্ষেত্রেও ও সাহায্য-সহযোগিতা করছে।
সামিয়ার পায়ের ব্যাথা ভালো হয়ে গেছে। দুদিন থেকে ও স্বাভাবিক ভাবে হাঁটছে। আজাদ আজকে কারখানায় যায়নি, সারাটাদিন বাসায় কাটিয়েছে। সন্ধ্যার দিকে সামিয়া ওর কাছে ছাদে যাবার বায়না ধরল। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হবে জন্য আজাদ ওকে নিষেধ করল। সামিয়া বলল, "চলো না, অনেকদিন থেকে ছাদে যাই না, ভালো লাগছে না। আমার ব্যাথা ভালো হয়ে গেছে, কিছু হবে না।"
আজাদ বলল, "যদি হয়?"
--"হবে না, চলো।"
আজাদ আর নিষেধ করতে পারল না। সামিয়াকে নিয়ে ও ছাদে চলে গেল।
ছাদে হাঁটতে হাঁটতে সামিয়া বলল, "ছাদে তো একটুকুও বাতাস নেই।"
--"কিছুদিন থেকে ভ্যাপসা গরম পড়ছে।"
--"কতদিন যে বৃষ্টিতে ভিজি না!"
--"বৃষ্টিই তো নেই, ভিজবে কী করে?"
--"আজকে চাঁদও ওঠেনি। চলো নিচে ফিরে যাই।"
--"কেবলই না এলাম।"
--"ভালো লাগছে না তো।"
--"ঠিকআছে চলো।"
ছাদ থেকে বাসায় ফিরে এসে আজাদরা দেখল রোকেয়া বেগম সুজন আর রাজিবের সাথে বসার ঘরে বসে গল্প করছেন। আজাদ আর সামিয়াও গল্পে যোগ দিল।
আজ অনেকদিন পর সামিয়া নিজ হাতে রাতের রান্না করলো। এতদিন রোকেয়া বেগম রান্না-বান্না করেছেন।
রাতে খাওয়া-দাওয়া করতে বসে রোকেয়া বেগম আজাদকে বললেন, "বাবা অনেকদিন হলো এসেছি। সামিয়ার পা তো ভালো হয়ে গেছে, রাজিবেরও স্কুল খুলে গেছে। আমাদের তো ফেরা দরকার।"
আজাদ বলল, "মা আর কিছুদিন থাকুন।"
--"রাজিবের তো স্কুল কামাই যাচ্ছে।"
--"কিছুদিন স্কুল কামাই গেলে কিছু হবে না মা।"
খাওয়া-দাওয়ার পর রোকেয়া বেগম আজাদকে বললেন, "বাবা আজ তুমি সামিয়ার সাথে থাকো।"
আজাদ বেশ লজ্জা পেল, ও বুঝতে পারছে শ্বাশুড়ি মা কেন ওকে সামিয়ার সাথে ঘুমাতে বলছেন। তিনি তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন, সামিয়ার পা ভালো হয়ে গিয়েছে, দুইটা সপ্তাহ থেকে স্বামী-স্ত্রী ভিন্ন ঘরে ঘুমাচ্ছে, উভয়ই উভয়ের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত। আজাদ জিজ্ঞাসা করল, "আপনি কোথায় ঘুমাবেন মা?"
--"আমি রাজিবকে নিয়ে সুজনের ঘরে ঘুমাচ্ছি।"
আজাদকে আর কিছু বলবার সুযোগ না দিয়ে তিনি সুজনের ঘরে চলে গেলেন।
সামিয়া ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছে। আজাদ ধীর পায়ে ঘরে প্রবেশ করল। বিছানার কাছে গিয়ে ও দেখল সামিয়া ইতোমধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে। সামিয়াকে ঘুমাতে দেখে ওর মনটা খারাপ হয়ে গেল। ও গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে এসে সামিয়ার পাশে শুয়ে পড়ল।
কিছুক্ষণ পর সামিয়া আচমকা বলে উঠল, "এই।"
আজাদ সাথে সাথে সামিয়ার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, "এখনো ঘুমাওনি তুমি! আমি তো ভেবেছিলাম ঘুমিয়ে পড়েছ।"
--"কতদিন তোমার সাথে ঘুমাই না!"
--"এক যুগ, দুই যুগ নাকি আরও বেশি?"
--"আরও কত বেশি!"
--"সত্যি করে বলো তো, পায়ের ব্যথাটা পুরোপুরি কমেছে?"
--"হ্যাঁ, এখন আর একটুকুও ব্যথা নেই।"
সামিয়া ওর মাথাটা আজাদের বুকে রেখে বলল, "আমি তোমাকে খুব কষ্ট দেই, তাই না?"
--"কই না তো।"
--"তুমি না বললেও আমি জানি।"
--"ভুল জানো।"
--"তুমি যত যাই বলো আমি জানি, আমাকে নিয়ে তুমি সবসময় খুব চিন্তায় থাকো।"
--"চিন্তা তো তোমাকে নিয়েই করব, আমার আর কে আছে?"
সামিয়া আজাদের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, "এখন তুমি ঘুমিয়ে যাও।"
--"তুমি ঘুমাবে না?"
--"হ্যাঁ, ঘুমাবো তো, কতদিন পর তোমাকে কাছে পেলাম, তোমাকে একটু দেখি তারপর ঘুমাবো।"
আজাদ সামিয়ার কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল, "তোমাকেও তো কতদিন পর কাছে পেলাম। আমিও তোমাকে একটু দেখি।"
সামিয়া লজ্জা পেয়ে হেসে বলল, "এত দেখতে হবে না, এখন ঘুমাও।"
আজাদ সামিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই আচমকা ঘুমিয়ে গেল। সামিয়া বেশকিছুক্ষণ আজাদের দিকে তাকিয়ে থেকে বিছানা থেকে নেমে বসার ঘরে চলে গেল।
চলবে
নাহিদ হাসান নিবিড়
Hasibul hasan santo, Sk sagor, Sk imran, Rasel islam, Mr faruk, Sumaiya akter, Rokeya hoq and লেখাটি পছন্দ করেছে
- Jamshedনবাগত
- Posts : 8
স্বর্ণমুদ্রা : 1122
মর্যাদা : 20
Join date : 2021-05-30
Re: অলীক ভুবন
Sat Jun 05, 2021 9:57 pm
পর্ব- ০৫
বসার ঘরের সোফায় বেশকিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে সামিয়া ঘরে ফিরে এলো। কোনোকিছুই ওর ভালো লাগছে না। ঘরে খানিক সময় পায়চারি করে ও বারান্দায় গিয়ে বসল কিন্তু বারান্দাতে বসে থাকতেও ওর ইচ্ছা করছে না। ওর ইচ্ছা করছে আজাদকে নিয়ে ছাদে যেতে কিন্তু ও ঘুমিয়ে আছে, ওকে ডাকতে ইচ্ছা করছে না। সামিয়া বারান্দা থেকে উঠে এসে আরও কিছু সময় ঘরে পায়চারি করে অবশেষে আজাদের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল।
রাত দুইটা বাজে, নিজাম আহমেদ গ্রন্থাগারে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সামিয়ার কথা ভাবছেন। আজাদের কথার উপর নির্ভর করে কিছু সন্দেহ তাঁর মনে জাগ্রত হয়েছে। চা শেষ করে তিনি নোটবুকে লিখলেন, "সামিয়া।" সামিয়ার নাম লেখার পরেই তাঁর মনে হলো তিনি ওর বয়স জানেন না। এই সাধারণ কিন্তু অতি প্রয়োজনীয় প্রশ্নটা তিনি আজাদকে কেন করেননি তার কোনো কারণ তিনি খুঁজে পেলেন না। সামিয়ার বয়স নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে করতে তাঁর মনে হলো ওর বয়স বাইশের উপরে হবে না। এর কারণ হচ্ছে, সামিয়া যেসব আচরণ করছে সেসব পরিপক্ক কারও করবার কথা না কিন্তু পরক্ষণেই তাঁর মনে হলো, বাইশ বছর কী একজন নারীর পরিপক্কতা লাভের জন্য যথেষ্ট নয়! বাংলাদেশের নারীরা নানারকম প্রতিকূল পরিবেশের মধ্য দিয়ে বড় হয় তাই গড় বয়স দিয়ে নারীদের পরিপক্কতা নির্ণয় করা সম্ভব নয়। নিজাম আহমেদ বয়স নিয়ে ভাবা বন্ধ করে সমস্যা নিয়ে ভাবতে শুরু করলেন। আজাদ তাকে বলেছে, সামিয়া বৃদ্ধা এক মহিলাকে মাঝে মধ্যেই দেখে, যার কোনো অস্তিত্ব নেই, মহিলার মাথায় চুল নেই এবং সে সাদা শাড়ি পরিধান করে অর্থাৎ মহিলা হিন্দু কোনো বিধবা। সামিয়া এরকম একজন মহিলাকেই দেখছে কেন? সে তো গাছ-পালা অথবা হিংস্র কোনো পশুকেও দেখতে পারত! সামিয়ার সাথে কী এরকম কারও পরিচয় ছিল? যদি থেকে থাকে তাহলে সেই মহিলার সাথে তার সম্পর্ক কেমন ছিল? তিনি কী এখনো বেঁচে আছেন? নিজাম আহমেদের মনে হলো, মহিলা মারা গেছেন, খুব সম্ভবত কোনো দূর্ঘটনায় মারা গেছেন এবং তার সাথে সামিয়ার অসংখ্য স্মৃতি রয়েছে যার কারণে সে তাকে হ্যালুসিনেট করছে কিন্তু শুধুমাত্র স্মৃতির কারণে এরকমটা হবে কেন? তবে কী সামিয়াকে ছোটবেলায় কেউ ভূতুরে গল্প শোনাতো? যদি মহিলা মারা গিয়েই থাকে তাহলে তখন সামিয়ার বয়স কত ছিল? তিনি নোটবুকে বোল্ড অক্ষরে লিখলেন, "বিধবা মহিলা।" এর নিচে লিখলেন, "সামিয়ার সাথে তার সম্পর্ক কেমন ছিল?"
"তিনি কী বেঁচে আছেন? নাকি মারা গেছেন? মারা গিয়ে থাকলে কীভাবে মারা গেছেন? তখন সামিয়ার বয়স কত ছিল? কেউ কী সামিয়াকে ভূতের গল্প শোনাতো?"
নিজাম আহমেদ একটা সিগারেট জ্বেলে ভাবতে শুরু করলেন, সামিয়া ঘরের দরজা বন্ধ করে কাঁদে কেন? জিনিসপত্র ভাংচুর করে কেন? দুই দুইবার আজাদের গলা সে চেপে ধরেছে কেন? গর্ভধারণের পর নারীদের নানারকম মানসিক পরিবর্তন আসতে পারে, এসব কী শুধুমাত্র সামিয়ার গর্ভাবস্থায় মানসিক পরিবর্তন নাকি আরও কোনো কারণ আছে? দরজা বন্ধ করে কান্না করা এবং জিনিসপত্র ভাংচুর করা স্বাভাবিক ঘটনা হলেও ঘুমের মধ্যে স্বামীর গলা টিপে ধরা নিশ্চয়ই কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। গলা টিপে ধরার কারণ কী হতে পারে? মনে মনে আজাদের প্রতি সে কী কোনো রাগ পুষে রেখেছে? আজাদ কী তাকে কষ্ট দিয়ে কিছু বলে? খুব সম্ভবত সামিয়া বৃদ্ধা মহিলার কথা আজাদকে বললে আজাদ তার সাথে এসব নিয়ে হাসিঠাট্টা করে অথবা রেগে যায় যেহেতু আজাদ বলেছে, তার সন্দেহ সামিয়া তার কাছে কিছু গোপন করছে, তারমানে বাথরুমে পা পিছলে যাবার ঘটনার পেছনেও বৃদ্ধা মহিলার ভূমিকা থাকতে পারে, আজাদ হাসিঠাট্টা করবে অথবা রাগ হবে জন্য সামিয়া ওর কাছে এটা লুকিয়েছে। আর কী কারণ থাকতে পারে? একাকিত্ব? আজাদকে জিজ্ঞাসা করা হয়নি বাসায় সামিয়া একা থাকে নাকি আরও কেউ থাকে? যদি কেউ থেকে থাকে তাহলে তাদের সাথে সামিয়ার সম্পর্ক কেমন? নিজাম আহমেদ নোটবুকে নীল বোল্ড অক্ষরে লিখলেন, "একাকিত্ব।"
ভোর চারটা বেজে গেছে। নিজাম আহমেদ নোটবুক বন্ধ করে গ্রন্থাগার থেকে বের হয়ে তিনতলায় হামিদুলের ঘরে চলে গেলেন।
হামিদুল মশারী না টানিয়ে ফ্যান ছেড়ে অঘোরে ঘুমিয়ে আছে। নিজাম আহমেদ ওকে বলেছেন সবসময় মশারী টানিয়ে ঘুমাতে কিন্তু ও বেশিরভাগ রাতেই মশারী না টানিয়েই ঘুমায়। তাঁর নিজেরও মশারী টানাতে ভালো লাগে না কিন্তু এইবছর মশার অত্যাচার মারাত্মক বেড়েছে। সন্ধ্যার পর থেকে ঘরে বাইরে কোথাও মশার অত্যাচারে থাকা যাচ্ছে না। মশা নিরোধে সিটি কর্পোরেশনের বিশেষ কোনো ভূমিকা নেই। বর্তমানে ভুয়া কয়েলে বাজার সয়লাব, এসব কয়েল জ্বাললে চোখ এবং মুখমণ্ডল ভীষণ জ্বালাপোড়া করে, শ্বাস-প্রশ্বাসে খুব সমস্যা হয়। নিজাম আহমেদ হামিদুলের বিছানায় মশারী টানিয়ে দিয়ে নিজের ঘরের বারান্দায় গিয়ে বসে একটা সিগারেট ধরালেন। দীর্ঘদিন থেকে তিনি নিঃসঙ্গতায় ভুগছেন। এত বছরেও তিনি তাঁর স্ত্রী-সন্তানের কথা বিন্দু পরিমাণও ভুলতে পারেননি। এখনো মাঝে মধ্যে রাতে তিনি ভুলে যান তাঁর স্ত্রী-সন্তান সড়ক দূর্ঘটনায় মারা গেছে, তাঁর মনে হয় তাঁরা সকালেই বাড়ি ফিরে আসবে কিন্তু তাঁরা আর আসে না। সেজন্যই তিনি হামিদুলকে নিয়ে এসেছেন। হামিদুলও তার মতো একা ছিল, ছেলেটার জন্য তাঁর খুব মায়া।
বেশকিছুক্ষণ বারান্দায় বসে থেকে নিজাম আহমেদ ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। হামিদুলের মতো তিনিও মশারী না টানিয়েই ঘুমিয়ে গেলেন, পার্থক্য কেবল হামিদুলকে মশারী টানিয়ে দেবার জন্য তিনি আছেন কিন্তু তাকে মশারী টানিয়ে দেবার মতো কেউ নেই।
নিজাম আহমেদের ঘুম ভাঙল সকাল সাড়ে দশটায়। বিছানা থেকে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে তিনি ঘর থেকে বের হয়ে দেখলেন বিউটি হামিদুলের সাথে ডাইনিংয়ে বসে গল্প করছে। তাকে দেখে বিউটি জিজ্ঞাসা করল, "ভাইজান নাস্তা করবেন না?"
--"হ্যাঁ, করব।"
--"রুটিতে জেলি লাগিয়ে দেবো?"
--"আমি লাগিয়ে নিচ্ছি। তুমি নাস্তা করেছ?"
--"জি ভাইজান, ছোট সাহেবের সাথে করেছি। দুপুরে কী খাবেন ভাইজান?"
নিজাম আহমেদ হামিদুলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, "ছোটসাহেব আজ দুপুরে কী খাবেন?"
হামিদুল লজ্জা পেয়ে বলল, "আমি কী জানি?"
নিজাম আহমেদ বিউটিকে বললেন, "ছোটসাহেব জানেন না, আজ তুমি করল্লা ভাজি করো। তোমার ছোটসাহেব করল্লা ভাজি খুব পছন্দ করেন।"
হামিদুলের মুখমণ্ডল কালো হয়ে গেল, করল্লা ও একদম পছন্দ করে না।
সন্ধ্যার দিকে আজাদকে ফোন করে নিজাম আহমেদ গাড়ি নিয়ে ওদের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।
মিনিট বিশেকের মধ্যে নিজাম আহমেদ আজাদদের বাড়িতে পৌঁছে গেলেন। তিনি আজাদদের বাড়ির নিচে গাড়ি পার্ক করে আজাদকে ফোন করে বললেন, "আমি চলে এসেছি, আপনি কী একটু নিচে আসবেন?"
আজাদ বলল, "জি, আমি এক্ষুণি আসছি।"
আজাদ কিছুক্ষণের মধ্যে নিচে এসে নিজাম আহমেদকে বাসায় নিয়ে গিয়ে বসার ঘরে বসল।
সামিয়ার জ্বর এসেছে, ও ঘরে শুয়ে আছে। রোকেয়া বেগম রান্নাঘরে রাতের রান্নার আয়োজন করছিলেন। আজাদ তাকে নিয়ে এসে নিজাম আহমেদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, "সামিয়াকে কী ডাকব?"
নিজাম আহমেদ বললেন, "না, আমি আপনাদের সাথে কথা বলব।"
--"জি আচ্ছা।"
--"আপনি বসুন।"
আজাদ বসল।
নিজাম আহমেদ রোকেয়া বেগমকে জিজ্ঞাসা করলেন, "মিসেস সামিয়ার ছোটবেলা কোথায় কেটেছে?"
রোকেয়া বেগম বললেন, "কিশোরগঞ্জে।"
--"সে কী ছোট থাকতে খুব গল্প শুনতে পছন্দ করত?"
--"হ্যাঁ, গল্পের পোকা ছিল।"
--"কী ধরনের গল্প শুনতে পছন্দ করত?"
--"ভূতের গল্প।"
--"আচ্ছা এমনকি কখনো হয়েছে, মিসেস সামিয়া প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে?"
--"একবার খুব ভয় পেয়েছিল৷"
--কীভাবে?"
--"আমাদের পাশের বাড়িতে সুস্মিতা রায় নামের একজন বিধবা হিন্দু মহিলা ছিল। আমরা তাকে মাসি বলে ডাকতাম। সামিয়া সারাদিন তাঁর কাছে পড়ে থাকত। কোনো কোনোদিন রাতেও ওকে উনার কাছ থেকে নিয়ে আসা যেতো না।"
--"তিনি সম্ভবত মিসেস সামিয়াকে খুব গল্প শোনাতেন। উনি ভয় পেয়েছিলেন কেন?"
--"এক রাতে, সামিয়া সুস্মিতা মাসির বাড়িতে গেছে। রাতে ওকে আর আনা যায়নি। সেই রাতেই সুস্মিতা মাসি মারা গেছেন।"
--"কীভাবে মারা গেছেন?"
--"রাতে মাসি বাইরে বের হয়েছিলেন, ঐদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। বাইরে বের হবার পর তাঁর উপরে বিজলী পড়ে তিনি মারা গেছেন। সামিয়া সেই রাতে খুব ভয় পেয়েছিল, কয়েকদিন ও কারও সাথে কথা বলেনি।"
--"সর্বপ্রথম তাঁর মরদেহ কী মিসেস সামিয়াই দেখেছিলেন?"
--"হ্যাঁ।"
--"তাঁর মাথায় কোনো চুল ছিল না, তাই না?"
--"স্বামী মারা যাবার পর থেকে তিনি চুল রাখতেন না।"
--"তিনি নিশ্চয়ই সাদা শাড়িও পরতেন?"
--"হ্যাঁ।"
--"মিসেস সামিয়ার তখন বয়স কত ছিল?"
--"সাত।"
--"সুস্মিতা রায় মারা যাবার পর মিসেস সামিয়া সবচেয়ে বেশি কার সাথে সময় কাটাতে পছন্দ করতেন?"
--"আমার মার সাথে।"
--"তিনিও নিশ্চয়ই তাকে বেশ গল্প শোনাতেন?"
--"হ্যাঁ।"
--"আচ্ছা সুস্মিতা রায়কে নিয়ে মিসেস সামিয়াকে কী কেউ ভয় দেখাতো?"
--"আমরা তো কখনো তাঁর কথা মনেও করতাম না কিন্তু ওর চাচা ওকে ভয় দেখানোর জন্য মাঝেমধ্যেই বলত।"
--"বর্তমানে মিসেস সামিয়ার বয়স কত?"
--"তেইশ বছর।"
--"মিসেস সামিয়ার বিয়ের আগেও কী এরকম সমস্যা হতো?"
--"না।"
--"আচ্ছা আজাদ সাহেব আপনাকে যখন মিসেস সামিয়া ভূত দেখার কথা বলতেন তখন কী আপনি তার কথা শুনে হাসতেন বা রাগ হতেন?"
আজাদ বলল, "মাঝে মাঝে হয়েছি।"
--"সেজন্যেই তিনি আপনাকে পরবর্তীতে ভয় পেয়ে কখনো বলেছেন কখনো হাসিঠাট্টা করবেন অথবা রাগ হবেন জন্য এড়িয়ে গেছেন। আচ্ছা আপনি কী করেন?"
--"আগে ব্যাংকে চাকরি করতাম, চাকরি ছেড়ে দিয়েছি বর্তমানে আমার একটা জুতার কারখানা আছে, সেখানে সময় দিচ্ছি।"
--"আপনাদের বাসায় আর কে কে থাকেন?"
--"বাবা মারা যাবার পর থেকে আমি আর সামিয়াই থাকি। কিছুদিন আগে সামিয়া একটা এতিম ছেলেকে নিয়ে এসেছে। বর্তমানে সেও আমাদের সাথে থাকে।"
--"তারমানে তিনি দীর্ঘদিন একা ছিলেন?"
--"হ্যাঁ, আমি অফিসে যাবার পর ও একাই থাকত।"
--"খুব সম্ভবত একাকীত্বতার কারণেই সমস্যাটা বেড়ে গিয়েছে। যখন একজন মানুষের কথা বলবার মতো কেউ থাকে না তখন সে এমনিতেই নানারাকম মানসিক সমস্যায় ভুগতে শুরু করে। মিসেস সামিয়ার ভয়ংকর একটা শৈশব আছে। এতবছর শৈশবের ভয়-ভীতিগুলো মনে সুপ্ত অবস্থায় ছিল। তিনি যখন একা হয়ে গেলেন তখন আবারও তিনি শৈশবের বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে শুরু করলেন। সেখান থেকেই তিনি সুস্মিতা রায়কে দেখতে শুরু করলেন। আপনাকে বলার পরও আপনি তার কথা বিশ্বাস করেননি, যার কারণে আপনার প্রতিও তার হৃদয়ে এক ধরনের ক্ষোভ জন্ম নিয়েছে। ঘুমের মধ্যে আপনার গলা টিপে ধরার এটা একটা কারণ হতে পারে, বাজে কোনো স্বপ্ন দেখে গলা টিপে ধরেছেন। ঘরের দরজা বন্ধ করে কান্না করা, জিনিসপত্র ভাংচুর করা এইসব একাকীত্বতা এবং আপনার অবিশ্বাস করার সাথে সম্পৃক্ত বলেই আমার মনে হচ্ছে। আমি কী ব্যাপারটা আপনাদেরকে বুঝাতে পেরেছি?"
আজাদ বলল, "জি।"
--"আমি আজ উঠি কয়েকদিনের মধ্যে আরেকবার আসব।"
আজাদ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, "সে কী এই প্রথম আমাদের বাসায় এলেন কিছু না খেয়ে যাবেন নাকি! আপনি বসুন, আমি এক্ষুণি আসছি।"
নিজাম আহমেদ সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, "আজকে কিছু করতে হবে না, এরপর যেদিন আসব সেদিন রাতের খাবার খেয়ে যাব, চলি।"
নিজাম আহমেদ আজাদদের বাসা থেকে বের হয়ে নিচে এসে গাড়িতে উঠে বসলেন। এমন সময় গাড়ির সামনে দিয়ে এক দম্পতি তাদের সন্তানকে কোলে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল। তিনি গাড়ি স্টার্ট করে খানিকসময় চুপচাপ বসে থেকে মনে মনে বললেন, "নিঃসঙ্গতা বড্ড খারাপ।"
চলবে
নাহিদ হাসান নিবিড়
Hasibul hasan santo, Sk sagor, Sk imran, Rasel islam, Mr faruk, Sumaiya akter, Rokeya hoq and লেখাটি পছন্দ করেছে
- Jamshedনবাগত
- Posts : 8
স্বর্ণমুদ্রা : 1122
মর্যাদা : 20
Join date : 2021-05-30
Re: অলীক ভুবন
Sat Jun 05, 2021 10:11 pm
শেষ পর্ব
রাত আটটা বাজে নিজাম আহমেদ হকার্স মার্কেটে চলে গেলেন। তিনি ভেবেছিলেন মার্কেটে এসে দেখবেন সব দোকান বন্ধ হয়ে গেছে কিন্তু এখনো বেশকিছু দোকান খোলা আছে। তিনি মার্কেটে ঘুরতে ঘুরতে একটা সাদা শাড়ি কিনে বাড়িতে ফিরে এলেন। হামিদুল তাঁর অপেক্ষাতেই বসে ছিল, তিনি দরজা দিয়ে ঢুকতেই ও বলল, "তাড়াতাড়ি হাত-মুখ ধুয়ে খেতে আসো, ক্ষুধা লেগেছে।" হামিদুলের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, "আসছি ছোটসাহেব।"
তিনি হাত-মুখ ধুয়ে এসে হামিদুলের সাথে খেতে বসলেন। খেতে খেতে তিনি বললেন, "আজকে মশারী টানিয়ে ঘুমাবি।"
--"গরম লাগে।"
--"গরমের দিন গরম তো লাগবেই। এইভাবে মশারী ছাড়া ঘুমালে তোর তো ম্যালেরিয়া হয়ে যাবে। এত মশা কামড়ায় তুই বুঝিস না?"
--"স্টেশনে মশার কামড় খেতে খেতে এখন আর মশার কামড় গায়ে লাগে না।"
হামিদুলের কথা শুনে নিজাম আহমেদের মন খারাপ হয়ে গেল। স্টেশনে ওর মতো আরও কত মা-বাবাহীন বাচ্চারা ঘুমায়! প্রতিরাতে যেন সাক্ষাৎ জাহান্নাম ওদের জীবনে নেমে আসে অথচ ওরা নিঃসংকোচে স্টেশনের মেঝেকে জান্নাত বানিয়ে ঘুমিয়ে থাকে। কী নিদারুণ কষ্টের ওদের জীবন! না আছে বাসস্থান, না আছে খাবার, আছে কেবল যুদ্ধ, সেই যুদ্ধে ওরা কেউ হয় টোকাই, কেউ হয় পকেটমার—বয়স বাড়ার সাথে সাথে সন্ত্রাস। জন্মই যেন ওদের আমরন পাপ অথচ ওরা একটু যত্ন পেলে কী ফুটফুটে হয়! তিনি হামিদুলকে জিজ্ঞাসা করলেন, "গ্রন্থাগারের মতো ঘরেও এসি লাগাবো?"
--"লাগালে তো ভালো হয়, কী যে গরম!"
--"আচ্ছা আর কিছুদিন যাক।"
খাওয়া-দাওয়ার পর নিজাম আহমেদ বারান্দায় চলে গেলেন, হামিদুল ঘরে গিয়ে ফ্যানের গতি পুরোপুরি বাড়িয়ে দিয়ে মশারী না টানিয়েই বিছানায় শুয়ে পড়ল।
নিজাম আহমেদ সাদা শাড়িটা কিনেছেন কারও মাঝে সুস্মিতা রায়ের প্রতিচ্ছবি সামিয়ার সামনে ফুটিয়ে তোলার জন্য, কিন্তু এরজন্য একজন নারীর প্রয়োজন। শাড়ি পরে সামিয়ার সামনে তাকে কিছুটা অভিনয়ও করতে হবে—এমন একজনকে তিনি কোথায় পাবেন? তার পরিচিত নারীদের কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎই বিউটির কথা তাঁর মনে পড়ল। বিউটি তাঁর প্রস্তাবে আনন্দের সাথেই রাজি হয়ে যাবার কথা। স্বস্থির শ্বাস ফেলে তিনি বারান্দা থেকে হামিদুলের ঘরে ঢুকে দেখলেন, ও আজও মশারী না টানিয়েই ঘুমিয়ে গেছে। তিনি আজকেও ওর মশারী টানিয়ে দিয়ে ঠিক করলেন ও যদি আবারও মশারী না টানিয়ে ঘুমায় তাহলে ওকে তিনি একটা উচিৎ শিক্ষা দেবেন, যাতে ভবিষ্যতে ও নিজে থেকেই মশারী টানিয়ে ঘুমায়।
হামিদুলের ঘর থেকে নিজের ঘরে এসে নিজাম আহমেদ বিছানায় শুয়ে পড়লেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে গেলেন।
সকাল আটটার দিকে নিজাম আহমেদের ঘুম ভেঙে গেল। তিনি হাতমুখ ধুয়ে ঘন্টাখানেক বাইরে হাঁটাহাঁটি করে বাসায় ফিরে এসে দেখলেন বিউটি চলে এসেছে। ঘর থেকে সাদা শাড়িটা নিয়ে এসে ওকে দিয়ে তিনি বললেন, "বিউটি এই শাড়িটা তোমার।"
শাড়ি দেখে বিউটির মন খারাপ হয়ে গেল। ও বছর দুয়েক থেকে এই বাসায় কাজ করে। মাঝে মাঝেই নিজাম আহমেদ ওকে সুন্দর সুন্দর শাড়ি উপহার দেন কিন্তু এইরকম সাদা শাড়ি কেন দিলেন! এইরকম সাদা শাড়ি তো বিধবা মহিলারা পরে। কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে ও জিজ্ঞাসা করল, "ভাইজান এইরকম সাদা শাড়ি দিলেন কেন?"
--"কাজ আছে তোমার। আজ বিকাল থেকে রাত দশটা-এগারোটা পর্যন্ত তুমি কী আমাকে সময় দিতে পারবে?"
--"জি ভাইজান পারব।"
--"তোমার স্বামী কোনো ঝামেলা করবে না তো?"
--"না ভাইজান, আমি ওকে ফোন করে বলে দেবো, বাসায় ফিরতে দেরি হবে।"
--"আচ্ছা, তোমাকে কিন্তু অভিনয় করতে হবে।"
বিউটি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, "কীসের অভিনয় ভাইজান?"
--"ভূতের অভিনয়, ঠিক ভূতের না পেত্নীর অভিনয় করতে হবে।"
--"ঘটনা কী ভাইজান?"
--"আমি সামিয়া নামের এমন একজন মহিলাকে পেয়েছি যিনি সাদা শাড়ি পরিহিত এক বৃদ্ধা মহিলাকে দেখে ভয় পায়, যার আসলে পৃথিবীতে কোনো অস্তিত্ব নেই। অনেক আগেই মারা গিয়েছেন। আমি তার ভুল ভেঙে দিতে চাই।"
--"ও আচ্ছা, এইজন্যেই তো বলি এইরকম সাদা শাড়ি দিলেন কেন। আমাকে আর কী করতে হবে ভাইজান?"
--"আমি যখন সামিয়া এবং তার স্বজনদের সাথে কথা বলতে থাকব তখন তুমি হঠাৎ ঘরে প্রবেশ করবে।"
--"এরপর?"
--"ঘরে হাঁটবে আর কিছুক্ষণ পরপর সামিয়ার দিকে তাকিয়ে হাসবে। আর কিছু করতে হবে না।"
--"এইসব তো কঠিন কিছু না, পারব ভাইজান। কিন্তু সামিয়াকে চিনব কী করে?"
--"চিনতে পারবে, ঐ বাসায় বর্তমানে সামিয়া আর তার মা ব্যতীত অন্য কোনো মহিলা নেই।"
--"আচ্ছা।"
--"তাহলে তৈরি থেকো, বিকালবেলা বের হবো।"
বিউটির সাথে কথা বলার পর নিজাম আহমেদ ভাবলেন, এরমধ্যে আজাদদের বাসায় তাদের কোনো আত্মীয় আসেনি তো! তাছাড়া সন্ধ্যায় তিনি যাবেন এই ব্যাপারটাও আজাদকে জানানো দরকার। তিনি আজাদকে ফোন করলেন। আজাদ ফোন ধরার পর তিনি বললেন, "আমি নিজাম আহমেদ বলছি, চিনতে পারছেন?"
আজাদ বলল, "জি, চিনব না কেন?"
--"আমি আজ সন্ধ্যার দিকে আপনাদের বাসায় আসতে চাইছি।"
--"জি আসুন।"
--"আমার সাথে একটা বাচ্চা ছেলে আর একজন মহিলা থাকবে।"
--"আচ্ছা।"
--"আপনাদের বাসায় বর্তমানে কে কে আছে?"
--"সামিয়া, আমি, আমার শ্বাশুড়ি, শ্যালক আর কিছুদিন আগে সামিয়া সুজন নামের যেই ছেলেটাকে নিয়ে এসেছে ও আছে।"
--"আজ আর কারও আপনাদের আসার সম্ভাবনা আছে?"
--"না।"
--"আপনার শ্যালক আর সুজনকে আমি আসার আগে কোথাও পাঠিয়ে দিতে পারবেন?"
--"জি পারব।"
--"আমি চাচ্ছি, বাসায় আপনি, আপনার স্ত্রী আর শ্বাশুড়ি ব্যতীত আর কেউ না থাকুক।"
--"ঠিক আছে আমরা তিনজন ব্যতীত আর কেউ থাকবে না।"
--"আমার সাথে যেই মহিলা আসবে সে মূলত সুস্মিতা রায় হয়ে অভিনয় করবে। আমরা কথা বলার সময় সে হঠাৎ ঘরে প্রবেশ করবে। তাকে দেখেও আপনি এবং আপনার শ্বাশুড়ি না দেখার ভান করবেন। মিসেস সামিয়া যদি জিজ্ঞাসা করেন সাদা শাড়ি পরিহিত কাউকে সে দেখতে পাচ্ছে তাহলে আপনারা বলবেন, আপনারা কাউকে দেখতে পাচ্ছেন না।"
--"জি আচ্ছা।"
--"ব্যাপারটা এক্ষুণি আপনার শ্বাশুড়িকে বলে রাখুন।"
--"জি এক্ষুণি বলব।"
--"ঠিক আছে সন্ধ্যায় দেখা হবে।"
বিকাল চারটার দিকে নিজাম আহমেদ সাজ পার্লারের মালিক সজীব পাটোয়ারীকে ফোন করলেন। সজীব পাটোয়ারী আগে নাটক এবং ছায়াছবির মেকাপ ম্যান ছিলেন। তার সাথে কথা বলে তিনি হামিদুল আর বিউটিকে নিয়ে সাজ পার্লারে চলে গেলেন।
নিজাম আহমেদের নির্দেশনা অনুযায়ী সজীব পাটোয়ারী বিউটিকে বৃদ্ধারূপে সাজিয়ে দিলেন।
সাজ পার্লার থেকে সন্ধ্যার দিকে নিজাম আহমেদ বিউটি আর হামিদুলকে নিয়ে আজাদদের বাড়ির নিচে গিয়ে আজাদকে ফোন করে নিচে নামতে বললেন।
কিছুক্ষণের মধ্যে আজাদ নিচে নেমে এলো। নিজাম আহমেদ আজাদকে জিজ্ঞাসা করলেন, "আপনার স্ত্রী কী করছেন?"
--"শ্বাশুড়ির সাথে কথা বলছে।"
--"বিউটিকে দেখুন, ওকে এমনভাবে বাসায় নিয়ে যেতে হবে যাতে আপনার স্ত্রী কোনোভাবেই বুঝতে না পারে।"
--"সেই ব্যবস্থা আমি করছি।"
--"ঠিক আছে চলুন।"
সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় নিজাম আহমেদ আজাদকে বললেন, "আমি মিসেস সামিয়ার সাথে প্রথমে একা কথা বলব। আমি আপনাকে ফোনে বার্তা পাঠানোর পর আপনি আপনার শ্বাশুড়িকে নিয়ে ঘরে আসবেন।"
আজাদ বলল, "ঠিক আছে।"
আজাদ বিউটিকে আড়াল করে সুজনের ঘরে রেখে নিজাম আহমেদ আর হামিদুলকে নিয়ে বসার ঘরে চলে গেল।
সামিয়া রোকেয়া বেগমের সাথে বসার ঘরে বসে ছিল। আজাদ সামিয়ার সাথে নিজাম আহমেদকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে শ্বাশুড়িকে নিয়ে বসার ঘর থেকে বের হয়ে গেল। নিজাম আহমেদ সোফায় বসে সামিয়াকে জিজ্ঞাসা করলেন, "কেমন আছেন?"
সামিয়া বলল, "ভালো। আপনি?"
--"আমিও ভালো আছি। আপনি নাকি এক বৃদ্ধা মহিলাকে দেখে ভয় পান?"
সামিয়া কিছু বলল না।
--"মিসেস সামিয়া আমি আপনাকে এই সমস্যা থেকে মুক্ত করতে চাই, আশা করছি আপনি আমাকে সহযোগিতা করবেন।"
সামিয়া এবারও কোনো কথা বলল না।
--"আপনার ছোটবেলা কেটেছে কোথায়?"
--"কিশোরগঞ্জে।"
--"আপনার একজন দিদা ছিল, তাঁর নাম সুস্মিতা রায়। তিনি বজ্রপাতে মারা গিয়েছিলেন। আপনাকে তিনি খুব গল্প শোনাতেন, তাই না?"
সামিয়া হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।
--"যেই রাতে উনি মারা গেলেন, সেই রাতে আপনাকে কী তিনি কোনো গল্প শুনিয়েছিলেন?"
সামিয়া আবারও হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।
--"কী ধরনের গল্প শুনিয়েছিলেন, মনে আছে?"
সামিয়া বলল, "ভূতের গল্প বলেছিল।"
--"আপনি যাকে দেখে ভয় পান তিনি কী সুস্মিতা রায়?"
--"না।"
--"আপনি কেন এত ভয় পান?"
সামিয়া কিছু বলল না।
--"ভয় পাবার সম্ভাব্য কারণ কী আমি আপনাকে বলব?"
সামিয়া হ্যাঁ না কিছুই বলল না।
নিজাম আহমেদ বললেন, "সুস্মিতা রায় যেই রাতে মারা গিয়েছে সেই রাতে খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। আপনি তাঁর সাথে থাকার জন্য বাসায় ফিরে যাননি। তাঁর কাছে গল্প শুনতে শুনতে সম্ভবত আপনি ঘুমিয়ে গিয়েছিলেন অথবা তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় ছিলেন। হঠাৎ আপনি আবিস্কার করলেন তিনি আপনার পাশে নেই। তাকে না পেয়ে আপনার ভয় লাগছিল। আপনি তাকে ঘরে খুঁজে না পেয়ে ঘর থেকে বাইরে বের হয়ে দেখলেন, তিনি বাড়ির উঠানে পড়ে আছেন।"
--"পড়ে ছিল না, দাঁড়িয়ে ছিল। আমি গিয়ে দিদাকে ডাকার পর দিদা কিছু বলছিল না। আমি তখন দিদার হাত ধরে টান দিলাম আর দিদা পড়ে গেল।"
--"এই ব্যাপারটা আমি জানতাম না।"
--"আমি এটা কাউকে বলিনি, আপনাকেই প্রথম বললাম।"
--"খুব ভয় পেয়েছিলেন, তাই না? ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক ব্যাপার, আপনার বয়স তখন ছিল মাত্র সাত বছর। সুস্মিতা রায় মারা যাবার পর কয়েকদিন আপনি কারও সাথেই কোনো কথা বলেননি, তাই না?"
--"হুম।"
--"আপনার চাচা মাঝে মধ্যেই সুস্মিতা রায়কে নিয়ে আপনাকে ভয় দেখাতেন। বর্তমানে আপনি যাকে দেখে ভয় পাচ্ছেন তার সাথে সুস্মিতা রায়ের বেশ মিল আছে। তাঁর মাথাতেও কোনো চুল ছিল না, আপনি যাকে দেখছেন তার মাথাতেও চুল নেই। তিনি সাদা শাড়ি পরতেন, আপনি যাকে দেখছেন সেও সাদা শাড়ি পরে। আমার ধারণা, ছোট থাকতে আপনি যে সকল ভূতের গল্প সুস্মিতা রায়ের কাছ থেকে শুনেছেন সেসবের কোনো চরিত্র অথবা তাঁর মৃত্যুর পর তিনি নিজেই একটা চরিত্র হয়ে আপনার হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। আপনি কী বিয়ের আগেও যাকে দেখে ভয় পাচ্ছেন তাকে দেখতেন?"
--"নাহ।"
--"আমার ধারণা এত বছর থেকে এসব ঘটনা আপনার হৃদয়ে সুপ্ত অবস্থায় ছিল। বিয়ের পর তীব্র নিঃস্বঙ্গতাবোধ আপনাকে পেয়ে বসেছে। আজাদ সাহেব অফিসে চলে গেলে আপনি সারাটাদিন একা একা বাসায় থাকতেন, আপনার কথা বলার মতো কেউ ছিল না, সারাদিন আপনার ছোটবেলার কথা মনে পড়ত। একা থাকতে থাকতে ছোটবেলার সেই ভয় আবারও ফিরে এসেছে।"
এমন সময় বিউটি ঘরে প্রবেশ করল। সামিয়া মাথা নিচু করে নিজাম আহমেদের কথা শুনছিল সেজন্য ও বিউটিকে দেখতে পেল না। বিউটি ঘরে হাঁটতে শুরু করল।
নিজাম আহমেদ আবারও বললেন, "যাকে দেখে আপনি ভয় পাচ্ছেন সে আপনার নিজেরই বানানো একটা ভৌতিক চরিত্র।"
সামিয়া মুখ তুলে কিছু একটা বলতে গিয়ে বিউটিকে দেখে আঁতকে উঠল। বিউটি ওর দিকে তাকিয়ে হাসতে শুরু করল। সামিয়া ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে নিজাম আহমেদকে জিজ্ঞাসা করল, "আপনি কী কিছু দেখতে পাচ্ছেন?"
নিজাম আহমেদ উল্টো জিজ্ঞাসা করলেন, "কী দেখার কথা বলছেন?"
সামিয়া হাতের আঙ্গুল বিউটির দিকে ইশারা করে বলল, "ঐ তো, হাঁটছে।"
--"কে হাঁটছে?"
--"আপনি সত্যি কিছু দেখতে পাচ্ছেন না?"
--"না তো, আপনি কী দেখছেন?"
নিজাম আহমেদ দ্রুত আজাদকে মুঠোবার্তায় রোকেয়া বেগমকে নিয়ে বসার ঘরে আসতে লিখে পাঠালেন।
সামিয়া বলল, "সাদা শাড়ি পরা।"
--"আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না।"
আজাদ শ্বাশুড়ি সমেত বসার ঘরে ঢুকতেই সামিয়া আজাদকে জিজ্ঞাসা করল, "তুমি কী কিছু দেখতে পাচ্ছো?"
আজাদ অবাক হয়ে বলল, "কী দেখার কথা বলছো?"
সামিয়া রোকেয়া বেগমকে জিজ্ঞাসা করল, "মা তুমিও কী কিছু দেখতে পাচ্ছো না?"
রোকেয়া বেগমও আজাদের মতো অবাক হয়ে বললেন, "কী দেখার বলছিস?"
নিজাম আহমেদ সামিয়াকে বললেন, "আপনি শান্ত হোন। আপনি যাকে দেখছেন তাকে গিয়ে ধরে দেখুন তো তাকে ধরা যায় কী না।"
সামিয়া কিছুক্ষণ ভীতু চোখে বিউটির গতিবিধির দিকে তাকিয়ে থেকে উঠে গিয়ে ওর হাত ধরে ফেলল।
নিজাম আহমেদ হাসতে হাসতে বললেন, "উনি কী ভূত নাকি মানুষ?"
সামিয়া রাগ হয়ে নিজাম আহমেদের দিকে তাকিয়ে বলল, "এটা নাটক ছিল?"
নিজাম আহেমদ বললেন, "নাটক বলা যায়।"
সামিয়া বসার ঘর থেকে বের হতে উদ্ধত হলো। নিজাম আহমেদ বললেন, "আপনি বসুন, আপনার সাথে আমার আরও কিছু কথা বলার আছে।"
নিজাম আহেমদ সামিয়া ব্যতীত বাকি সবাইকে ঘরের বাইরে চলে যেতে বললেন। সবাই ঘর থেকে বাইরে যাবার পর তিনি সামিয়াকে বললেন, "আপনি রাগ করছেন কেন? এসব শুধুমাত্র আপনাকে দেখানোর জন্য করা হয়েছে যে ভূত-প্রেতের কোনো অস্তিত্ব নেই, তাদেরকে স্পর্শ যায় না। যদি স্পর্শ করা যায় তবে সে মানুষ, ভূত-প্রেত না। আপনি যাকে দেখে ভয় পান তাকে কী কখনো স্পর্শ করেছেন, অথবা সে কী আপনাকে কখনো স্পর্শ করেছে?"
সামিয়া কিছু বলল না।
--"মিসেস সামিয়া আপনি সন্তান সম্ভাবা। কিছুদিন আগে আপনি বাথরুমে পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলেন, আমার ধারণা আপনি সেই বৃদ্ধাকে দেখে ভয় পেয়ে দ্রুত বাথরুম থেকে বের হতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। ভাগ্যিস আপনার বাচ্চার কোনো ক্ষতি হয়নি কিন্তু আপনি যদি এরকমভাবে ভয় পেতে থাকেন তাহলে যে কোনো সময় বড় ধরনের কোনো দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। আপনি কী আমার কথা বুঝতে পারছেন?"
সামিয়া এবারও নিশ্চুপ রইল।
নিজাম আহমেদ পুনরায় বললেন, "আপনি যাকে দেখে ভয় পাচ্ছেন বাস্তবে তার কোনো অস্তিত্ব নেই সুতরাং তাকে দেখে ভয় পাবারও কোনো কারণ নেই। আপনি নাকি মাঝে মধ্যে দরজা বন্ধ করে কাঁদেন? ঘরের জিনিসপত্র ভাংচুর করেন? আমি জানি এসব আপনি রাগের বশে করেন। আপনি যখন ভয় পান তখন আজাদ সাহেব আপনার কথা বিশ্বাস না করলে আপনার খুব কষ্ট হয়, খুব রাগ উঠে যায়, তাই না?"
সামিয়া এবারও কিছু বলল না।
কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে নিজাম আহেমদ বললেন, "আপনি এই পর্যন্ত আজাদ সাহেবের গলা দুই দুইবার টিপে ধরেছেন তিনি কিন্তু মরেও যেতে পারতেন। আচ্ছা আজাদ সাহেব কেমন মানুষ?"
--"খুব ভালো।"
--"আজাদ সাহেবকে স্বামী হিসেবে দশ নম্বরের মধ্যে আপনি কত নম্বর দেবেন?"
--"দশ।"
নিজাম আহমেদ তাঁর ব্যাগ থেকে বাচ্চাদের নাম রাখার একটা বই বের করে সামিয়াকে দিয়ে বললেন, "এখানে বাচ্চাদের অর্থসহ সুন্দর সুন্দর অনেক নাম আছে। বইটা আমি আপনাকে উপহার দিলাম।"
সামিয়া বলল, "ধন্যবাদ।"
নিজাম আহমেদ বললেন, "আমার মনে হয় না আপনি আর কখনো ভূত-প্রেত দেখবেন এরপরও যদি কখনো দেখে ফেলেন তাহলে তাকে বলবেন, সে যেন একটা টুনটুনি পাখি ধরে এনে আপনাকে দিয়ে যায়।"
সামিয়া হেসে ফেলল।
নিজাম আহমেদ বললেন, "এইবার একটু খাবার-দাবার দিন, ভীষণ ক্ষুধা পেয়েছে।"
সামিয়া লজ্জা পেয়ে বলল, "দুঃখিত একটু বসুন।"
সামিয়া বসার ঘর থেকে বের হয়ে গেল। নিজাম আহমেদ বিউটি আর হামিদুলকে বসার ঘরে আসতে বললেন। আজাদকে ডেকে তিনি বললেন, "এইবার আপনি আপনার শ্যালক আর সুজনকে নিয়ে আসতে পারেন।"
আজাদ রাজিব আর সুজনকে পাশের ফ্ল্যাটে রেখে এসেছিল, ও গিয়ে ওদেরকে নিয়ে এলো। ইতোমধ্যে সামিয়া টেবিলে খাবার দিয়েছে। আজাদ বসার ঘরে গিয়ে নিজাম আহমেদদেরকে খাবার টেবিলে নিয়ে এলো।
খাওয়া-দাওয়ার পর নিজাম আহমেদ হামিদুল আর বিউটিকে নিয়ে সামিয়া এবং রোকেয়া বেগমের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আজাদদের বাসা থেকে বের হলেন। আজাদও তাদের সাথে বের হলো।
বাড়ির নিচে এসে নিজাম আহমেদ বিউটি আর হামিদুলকে গাড়িতে উঠতে বলে আজাদকে বললেন, "আমার বিশ্বাস ভূত-প্রেত নিয়ে আপনার স্ত্রীর আর কোনো সমস্যা হবে না। আপনি চেষ্টা করুন তাকে একটু বেশি সময় দেবার। সবসময়ের জন্য তার একজন একজন সঙ্গীর প্রয়োজন।
--" সুজন আছে তো।"
--"তা আছে। আপনি চেষ্টা করে দেখুন, আপনাদের বাচ্চাটা হবার আগ পর্যন্ত আপনার শ্বাশুড়িকে বাসায় রেখে দিতে পারেন কী না।"
--"জি আচ্ছা, আপনার ভিজিটটা?"
নিজাম সাহেব হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, "আপনি সুজনের বাবা হয়ে উঠতে পেরেছেন কী?"
--"চেষ্টা করছি।"
--"বেশি বেশি চেষ্টা করুন।"
--"আপনার ভিজিটটা?"
নিজাম আহমেদ হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করলেন, "ভিজিট দেবেন?"
--"অবশ্যই দেবো।"
--"তাহলে ভিজিটটা চেয়ে ফেলি। স্ত্রীকে বেশি বেশি ভালোবাসবেন, বেশি বেশি সময় দেবেন আর সুজনের প্রকৃত বাবা হবার চেষ্টা অব্যাহত রাখবেন।"
নিজাম আহমেদ গাড়িতে উঠে বসলেন। আজাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তিনি আজিমপুরের দিকে গাড়ি ছোঁটালেন।
বিউটিকে ওদের বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে নিজাম আহমেদ রেনেসাঁ ব্যাণ্ডের "আজকের শিশু" গানটা ছেড়ে বাড়ির দিকে রওনা হলেন।
বৈশাখ মাস চলছে কিন্তু বৃষ্টির ছিটেফোঁটাটিও নেই। ভীষণ গরম পড়ছে। গরমে অতিষ্ঠ হয়ে নিজাম আহমেদ কয়েকদিনের মধ্যে হামিদুলের এবং তাঁর ঘরে এসি লাগিয়ে ফেললেন।
বর্তমানে হামিদুলের অন্যতম কাজ হচ্ছে সারাক্ষণ এসির ঠাণ্ডা হাওয়ায় বসে গল্পের বই পড়া। বই পড়তে ওর বিরক্ত লাগে, ও একটু ভিডিও গেমস খেলতে চায় কিন্তু নিজাম আহমেদ ওর ফোনে কী যেন করে দিয়েছেন, ও ভিডিও গেমস নামাতে পারছে না। নিরুপায় হয়ে ও গল্পের বই পড়ছে।
সপ্তাহ দুয়েকের ভ্যাপসা গরমের পর আজ সন্ধ্যা থেকে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। রাত এগারোটার দিকে মুষলধারে বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। সামিয়া আজাদকে বলল, "চলো না বৃষ্টিতে ভিজি।"
আজাদ বলল, "এতরাতে বৃষ্টিতে ভিজলে ঠাণ্ডা লেগে যাবে তো।"
--"লাগুক, একটু ঠাণ্ডা লাগলে কিছু হবে না।"
--"ঠিক আছে কিন্তু বেশি সময়ের জন্য না।"
সামিয়া খুশি হয়ে বলল, "আচ্ছা।"
আজাদ আর সামিয়া ছাদে চলে গেল।
বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সামিয়া আজাদকে বলল, "আমি স্যরি।"
আজাদ জিজ্ঞাসা করল, "কেন?"
--"আমি তোমাকে এতদিনে না জানি কত কষ্ট দিয়েছি। সেজন্যে স্যরি। আমি আর কখনো তোমাকে কষ্ট দেবো না।"
--"আমি কোনো কষ্ট পাইনি সামিয়া।"
--"তুমি বললেই হলো? আমি তো জানি আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। আমার নিজেরই লজ্জা লাগছে, এতদিন কী সব ভেবে ভয় পেয়েছি, কী সব কাণ্ড করেছি! ছি ছি।"
--"যা হয়েছে তা হয়ে গেছে, ওসব নিয়ে ভেবো না। চলো ঘরে ফিরে যাই।"
--"আরেকটু থাকি?"
আজাদ সামিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলল, "আচ্ছা।"
ঘন্টাখানেক বৃষ্টিতে ভিজে আজাদরা ঘরে ফিরে এলো।
রাত একটা বাজতে চলল, এখনো বৃষ্টি পড়ছে। নিজাম আহমেদ ছাদের রেলিং ঘেঁষে বসে আছেন। স্ত্রী-সন্তানের কথা তাঁর খুব মনে পড়ছে। এমনই বৃষ্টিস্নাত এক রাতে তিনি তাঁর স্ত্রী-সন্তানকে হারিয়েছেন। এতগুলো বৃষ্টিভেজা রাত তাঁর জীবন থেকে চলে গেল কিন্তু তারা আর ফিরে এলো না, তাঁরা আর কখনো ফিরে আসবে না।
সমাপ্ত
নাহিদ হাসান নিবিড়
রাত আটটা বাজে নিজাম আহমেদ হকার্স মার্কেটে চলে গেলেন। তিনি ভেবেছিলেন মার্কেটে এসে দেখবেন সব দোকান বন্ধ হয়ে গেছে কিন্তু এখনো বেশকিছু দোকান খোলা আছে। তিনি মার্কেটে ঘুরতে ঘুরতে একটা সাদা শাড়ি কিনে বাড়িতে ফিরে এলেন। হামিদুল তাঁর অপেক্ষাতেই বসে ছিল, তিনি দরজা দিয়ে ঢুকতেই ও বলল, "তাড়াতাড়ি হাত-মুখ ধুয়ে খেতে আসো, ক্ষুধা লেগেছে।" হামিদুলের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, "আসছি ছোটসাহেব।"
তিনি হাত-মুখ ধুয়ে এসে হামিদুলের সাথে খেতে বসলেন। খেতে খেতে তিনি বললেন, "আজকে মশারী টানিয়ে ঘুমাবি।"
--"গরম লাগে।"
--"গরমের দিন গরম তো লাগবেই। এইভাবে মশারী ছাড়া ঘুমালে তোর তো ম্যালেরিয়া হয়ে যাবে। এত মশা কামড়ায় তুই বুঝিস না?"
--"স্টেশনে মশার কামড় খেতে খেতে এখন আর মশার কামড় গায়ে লাগে না।"
হামিদুলের কথা শুনে নিজাম আহমেদের মন খারাপ হয়ে গেল। স্টেশনে ওর মতো আরও কত মা-বাবাহীন বাচ্চারা ঘুমায়! প্রতিরাতে যেন সাক্ষাৎ জাহান্নাম ওদের জীবনে নেমে আসে অথচ ওরা নিঃসংকোচে স্টেশনের মেঝেকে জান্নাত বানিয়ে ঘুমিয়ে থাকে। কী নিদারুণ কষ্টের ওদের জীবন! না আছে বাসস্থান, না আছে খাবার, আছে কেবল যুদ্ধ, সেই যুদ্ধে ওরা কেউ হয় টোকাই, কেউ হয় পকেটমার—বয়স বাড়ার সাথে সাথে সন্ত্রাস। জন্মই যেন ওদের আমরন পাপ অথচ ওরা একটু যত্ন পেলে কী ফুটফুটে হয়! তিনি হামিদুলকে জিজ্ঞাসা করলেন, "গ্রন্থাগারের মতো ঘরেও এসি লাগাবো?"
--"লাগালে তো ভালো হয়, কী যে গরম!"
--"আচ্ছা আর কিছুদিন যাক।"
খাওয়া-দাওয়ার পর নিজাম আহমেদ বারান্দায় চলে গেলেন, হামিদুল ঘরে গিয়ে ফ্যানের গতি পুরোপুরি বাড়িয়ে দিয়ে মশারী না টানিয়েই বিছানায় শুয়ে পড়ল।
নিজাম আহমেদ সাদা শাড়িটা কিনেছেন কারও মাঝে সুস্মিতা রায়ের প্রতিচ্ছবি সামিয়ার সামনে ফুটিয়ে তোলার জন্য, কিন্তু এরজন্য একজন নারীর প্রয়োজন। শাড়ি পরে সামিয়ার সামনে তাকে কিছুটা অভিনয়ও করতে হবে—এমন একজনকে তিনি কোথায় পাবেন? তার পরিচিত নারীদের কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎই বিউটির কথা তাঁর মনে পড়ল। বিউটি তাঁর প্রস্তাবে আনন্দের সাথেই রাজি হয়ে যাবার কথা। স্বস্থির শ্বাস ফেলে তিনি বারান্দা থেকে হামিদুলের ঘরে ঢুকে দেখলেন, ও আজও মশারী না টানিয়েই ঘুমিয়ে গেছে। তিনি আজকেও ওর মশারী টানিয়ে দিয়ে ঠিক করলেন ও যদি আবারও মশারী না টানিয়ে ঘুমায় তাহলে ওকে তিনি একটা উচিৎ শিক্ষা দেবেন, যাতে ভবিষ্যতে ও নিজে থেকেই মশারী টানিয়ে ঘুমায়।
হামিদুলের ঘর থেকে নিজের ঘরে এসে নিজাম আহমেদ বিছানায় শুয়ে পড়লেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে গেলেন।
সকাল আটটার দিকে নিজাম আহমেদের ঘুম ভেঙে গেল। তিনি হাতমুখ ধুয়ে ঘন্টাখানেক বাইরে হাঁটাহাঁটি করে বাসায় ফিরে এসে দেখলেন বিউটি চলে এসেছে। ঘর থেকে সাদা শাড়িটা নিয়ে এসে ওকে দিয়ে তিনি বললেন, "বিউটি এই শাড়িটা তোমার।"
শাড়ি দেখে বিউটির মন খারাপ হয়ে গেল। ও বছর দুয়েক থেকে এই বাসায় কাজ করে। মাঝে মাঝেই নিজাম আহমেদ ওকে সুন্দর সুন্দর শাড়ি উপহার দেন কিন্তু এইরকম সাদা শাড়ি কেন দিলেন! এইরকম সাদা শাড়ি তো বিধবা মহিলারা পরে। কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে ও জিজ্ঞাসা করল, "ভাইজান এইরকম সাদা শাড়ি দিলেন কেন?"
--"কাজ আছে তোমার। আজ বিকাল থেকে রাত দশটা-এগারোটা পর্যন্ত তুমি কী আমাকে সময় দিতে পারবে?"
--"জি ভাইজান পারব।"
--"তোমার স্বামী কোনো ঝামেলা করবে না তো?"
--"না ভাইজান, আমি ওকে ফোন করে বলে দেবো, বাসায় ফিরতে দেরি হবে।"
--"আচ্ছা, তোমাকে কিন্তু অভিনয় করতে হবে।"
বিউটি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, "কীসের অভিনয় ভাইজান?"
--"ভূতের অভিনয়, ঠিক ভূতের না পেত্নীর অভিনয় করতে হবে।"
--"ঘটনা কী ভাইজান?"
--"আমি সামিয়া নামের এমন একজন মহিলাকে পেয়েছি যিনি সাদা শাড়ি পরিহিত এক বৃদ্ধা মহিলাকে দেখে ভয় পায়, যার আসলে পৃথিবীতে কোনো অস্তিত্ব নেই। অনেক আগেই মারা গিয়েছেন। আমি তার ভুল ভেঙে দিতে চাই।"
--"ও আচ্ছা, এইজন্যেই তো বলি এইরকম সাদা শাড়ি দিলেন কেন। আমাকে আর কী করতে হবে ভাইজান?"
--"আমি যখন সামিয়া এবং তার স্বজনদের সাথে কথা বলতে থাকব তখন তুমি হঠাৎ ঘরে প্রবেশ করবে।"
--"এরপর?"
--"ঘরে হাঁটবে আর কিছুক্ষণ পরপর সামিয়ার দিকে তাকিয়ে হাসবে। আর কিছু করতে হবে না।"
--"এইসব তো কঠিন কিছু না, পারব ভাইজান। কিন্তু সামিয়াকে চিনব কী করে?"
--"চিনতে পারবে, ঐ বাসায় বর্তমানে সামিয়া আর তার মা ব্যতীত অন্য কোনো মহিলা নেই।"
--"আচ্ছা।"
--"তাহলে তৈরি থেকো, বিকালবেলা বের হবো।"
বিউটির সাথে কথা বলার পর নিজাম আহমেদ ভাবলেন, এরমধ্যে আজাদদের বাসায় তাদের কোনো আত্মীয় আসেনি তো! তাছাড়া সন্ধ্যায় তিনি যাবেন এই ব্যাপারটাও আজাদকে জানানো দরকার। তিনি আজাদকে ফোন করলেন। আজাদ ফোন ধরার পর তিনি বললেন, "আমি নিজাম আহমেদ বলছি, চিনতে পারছেন?"
আজাদ বলল, "জি, চিনব না কেন?"
--"আমি আজ সন্ধ্যার দিকে আপনাদের বাসায় আসতে চাইছি।"
--"জি আসুন।"
--"আমার সাথে একটা বাচ্চা ছেলে আর একজন মহিলা থাকবে।"
--"আচ্ছা।"
--"আপনাদের বাসায় বর্তমানে কে কে আছে?"
--"সামিয়া, আমি, আমার শ্বাশুড়ি, শ্যালক আর কিছুদিন আগে সামিয়া সুজন নামের যেই ছেলেটাকে নিয়ে এসেছে ও আছে।"
--"আজ আর কারও আপনাদের আসার সম্ভাবনা আছে?"
--"না।"
--"আপনার শ্যালক আর সুজনকে আমি আসার আগে কোথাও পাঠিয়ে দিতে পারবেন?"
--"জি পারব।"
--"আমি চাচ্ছি, বাসায় আপনি, আপনার স্ত্রী আর শ্বাশুড়ি ব্যতীত আর কেউ না থাকুক।"
--"ঠিক আছে আমরা তিনজন ব্যতীত আর কেউ থাকবে না।"
--"আমার সাথে যেই মহিলা আসবে সে মূলত সুস্মিতা রায় হয়ে অভিনয় করবে। আমরা কথা বলার সময় সে হঠাৎ ঘরে প্রবেশ করবে। তাকে দেখেও আপনি এবং আপনার শ্বাশুড়ি না দেখার ভান করবেন। মিসেস সামিয়া যদি জিজ্ঞাসা করেন সাদা শাড়ি পরিহিত কাউকে সে দেখতে পাচ্ছে তাহলে আপনারা বলবেন, আপনারা কাউকে দেখতে পাচ্ছেন না।"
--"জি আচ্ছা।"
--"ব্যাপারটা এক্ষুণি আপনার শ্বাশুড়িকে বলে রাখুন।"
--"জি এক্ষুণি বলব।"
--"ঠিক আছে সন্ধ্যায় দেখা হবে।"
বিকাল চারটার দিকে নিজাম আহমেদ সাজ পার্লারের মালিক সজীব পাটোয়ারীকে ফোন করলেন। সজীব পাটোয়ারী আগে নাটক এবং ছায়াছবির মেকাপ ম্যান ছিলেন। তার সাথে কথা বলে তিনি হামিদুল আর বিউটিকে নিয়ে সাজ পার্লারে চলে গেলেন।
নিজাম আহমেদের নির্দেশনা অনুযায়ী সজীব পাটোয়ারী বিউটিকে বৃদ্ধারূপে সাজিয়ে দিলেন।
সাজ পার্লার থেকে সন্ধ্যার দিকে নিজাম আহমেদ বিউটি আর হামিদুলকে নিয়ে আজাদদের বাড়ির নিচে গিয়ে আজাদকে ফোন করে নিচে নামতে বললেন।
কিছুক্ষণের মধ্যে আজাদ নিচে নেমে এলো। নিজাম আহমেদ আজাদকে জিজ্ঞাসা করলেন, "আপনার স্ত্রী কী করছেন?"
--"শ্বাশুড়ির সাথে কথা বলছে।"
--"বিউটিকে দেখুন, ওকে এমনভাবে বাসায় নিয়ে যেতে হবে যাতে আপনার স্ত্রী কোনোভাবেই বুঝতে না পারে।"
--"সেই ব্যবস্থা আমি করছি।"
--"ঠিক আছে চলুন।"
সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় নিজাম আহমেদ আজাদকে বললেন, "আমি মিসেস সামিয়ার সাথে প্রথমে একা কথা বলব। আমি আপনাকে ফোনে বার্তা পাঠানোর পর আপনি আপনার শ্বাশুড়িকে নিয়ে ঘরে আসবেন।"
আজাদ বলল, "ঠিক আছে।"
আজাদ বিউটিকে আড়াল করে সুজনের ঘরে রেখে নিজাম আহমেদ আর হামিদুলকে নিয়ে বসার ঘরে চলে গেল।
সামিয়া রোকেয়া বেগমের সাথে বসার ঘরে বসে ছিল। আজাদ সামিয়ার সাথে নিজাম আহমেদকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে শ্বাশুড়িকে নিয়ে বসার ঘর থেকে বের হয়ে গেল। নিজাম আহমেদ সোফায় বসে সামিয়াকে জিজ্ঞাসা করলেন, "কেমন আছেন?"
সামিয়া বলল, "ভালো। আপনি?"
--"আমিও ভালো আছি। আপনি নাকি এক বৃদ্ধা মহিলাকে দেখে ভয় পান?"
সামিয়া কিছু বলল না।
--"মিসেস সামিয়া আমি আপনাকে এই সমস্যা থেকে মুক্ত করতে চাই, আশা করছি আপনি আমাকে সহযোগিতা করবেন।"
সামিয়া এবারও কোনো কথা বলল না।
--"আপনার ছোটবেলা কেটেছে কোথায়?"
--"কিশোরগঞ্জে।"
--"আপনার একজন দিদা ছিল, তাঁর নাম সুস্মিতা রায়। তিনি বজ্রপাতে মারা গিয়েছিলেন। আপনাকে তিনি খুব গল্প শোনাতেন, তাই না?"
সামিয়া হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।
--"যেই রাতে উনি মারা গেলেন, সেই রাতে আপনাকে কী তিনি কোনো গল্প শুনিয়েছিলেন?"
সামিয়া আবারও হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।
--"কী ধরনের গল্প শুনিয়েছিলেন, মনে আছে?"
সামিয়া বলল, "ভূতের গল্প বলেছিল।"
--"আপনি যাকে দেখে ভয় পান তিনি কী সুস্মিতা রায়?"
--"না।"
--"আপনি কেন এত ভয় পান?"
সামিয়া কিছু বলল না।
--"ভয় পাবার সম্ভাব্য কারণ কী আমি আপনাকে বলব?"
সামিয়া হ্যাঁ না কিছুই বলল না।
নিজাম আহমেদ বললেন, "সুস্মিতা রায় যেই রাতে মারা গিয়েছে সেই রাতে খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। আপনি তাঁর সাথে থাকার জন্য বাসায় ফিরে যাননি। তাঁর কাছে গল্প শুনতে শুনতে সম্ভবত আপনি ঘুমিয়ে গিয়েছিলেন অথবা তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় ছিলেন। হঠাৎ আপনি আবিস্কার করলেন তিনি আপনার পাশে নেই। তাকে না পেয়ে আপনার ভয় লাগছিল। আপনি তাকে ঘরে খুঁজে না পেয়ে ঘর থেকে বাইরে বের হয়ে দেখলেন, তিনি বাড়ির উঠানে পড়ে আছেন।"
--"পড়ে ছিল না, দাঁড়িয়ে ছিল। আমি গিয়ে দিদাকে ডাকার পর দিদা কিছু বলছিল না। আমি তখন দিদার হাত ধরে টান দিলাম আর দিদা পড়ে গেল।"
--"এই ব্যাপারটা আমি জানতাম না।"
--"আমি এটা কাউকে বলিনি, আপনাকেই প্রথম বললাম।"
--"খুব ভয় পেয়েছিলেন, তাই না? ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক ব্যাপার, আপনার বয়স তখন ছিল মাত্র সাত বছর। সুস্মিতা রায় মারা যাবার পর কয়েকদিন আপনি কারও সাথেই কোনো কথা বলেননি, তাই না?"
--"হুম।"
--"আপনার চাচা মাঝে মধ্যেই সুস্মিতা রায়কে নিয়ে আপনাকে ভয় দেখাতেন। বর্তমানে আপনি যাকে দেখে ভয় পাচ্ছেন তার সাথে সুস্মিতা রায়ের বেশ মিল আছে। তাঁর মাথাতেও কোনো চুল ছিল না, আপনি যাকে দেখছেন তার মাথাতেও চুল নেই। তিনি সাদা শাড়ি পরতেন, আপনি যাকে দেখছেন সেও সাদা শাড়ি পরে। আমার ধারণা, ছোট থাকতে আপনি যে সকল ভূতের গল্প সুস্মিতা রায়ের কাছ থেকে শুনেছেন সেসবের কোনো চরিত্র অথবা তাঁর মৃত্যুর পর তিনি নিজেই একটা চরিত্র হয়ে আপনার হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। আপনি কী বিয়ের আগেও যাকে দেখে ভয় পাচ্ছেন তাকে দেখতেন?"
--"নাহ।"
--"আমার ধারণা এত বছর থেকে এসব ঘটনা আপনার হৃদয়ে সুপ্ত অবস্থায় ছিল। বিয়ের পর তীব্র নিঃস্বঙ্গতাবোধ আপনাকে পেয়ে বসেছে। আজাদ সাহেব অফিসে চলে গেলে আপনি সারাটাদিন একা একা বাসায় থাকতেন, আপনার কথা বলার মতো কেউ ছিল না, সারাদিন আপনার ছোটবেলার কথা মনে পড়ত। একা থাকতে থাকতে ছোটবেলার সেই ভয় আবারও ফিরে এসেছে।"
এমন সময় বিউটি ঘরে প্রবেশ করল। সামিয়া মাথা নিচু করে নিজাম আহমেদের কথা শুনছিল সেজন্য ও বিউটিকে দেখতে পেল না। বিউটি ঘরে হাঁটতে শুরু করল।
নিজাম আহমেদ আবারও বললেন, "যাকে দেখে আপনি ভয় পাচ্ছেন সে আপনার নিজেরই বানানো একটা ভৌতিক চরিত্র।"
সামিয়া মুখ তুলে কিছু একটা বলতে গিয়ে বিউটিকে দেখে আঁতকে উঠল। বিউটি ওর দিকে তাকিয়ে হাসতে শুরু করল। সামিয়া ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে নিজাম আহমেদকে জিজ্ঞাসা করল, "আপনি কী কিছু দেখতে পাচ্ছেন?"
নিজাম আহমেদ উল্টো জিজ্ঞাসা করলেন, "কী দেখার কথা বলছেন?"
সামিয়া হাতের আঙ্গুল বিউটির দিকে ইশারা করে বলল, "ঐ তো, হাঁটছে।"
--"কে হাঁটছে?"
--"আপনি সত্যি কিছু দেখতে পাচ্ছেন না?"
--"না তো, আপনি কী দেখছেন?"
নিজাম আহমেদ দ্রুত আজাদকে মুঠোবার্তায় রোকেয়া বেগমকে নিয়ে বসার ঘরে আসতে লিখে পাঠালেন।
সামিয়া বলল, "সাদা শাড়ি পরা।"
--"আমি কিছু দেখতে পাচ্ছি না।"
আজাদ শ্বাশুড়ি সমেত বসার ঘরে ঢুকতেই সামিয়া আজাদকে জিজ্ঞাসা করল, "তুমি কী কিছু দেখতে পাচ্ছো?"
আজাদ অবাক হয়ে বলল, "কী দেখার কথা বলছো?"
সামিয়া রোকেয়া বেগমকে জিজ্ঞাসা করল, "মা তুমিও কী কিছু দেখতে পাচ্ছো না?"
রোকেয়া বেগমও আজাদের মতো অবাক হয়ে বললেন, "কী দেখার বলছিস?"
নিজাম আহমেদ সামিয়াকে বললেন, "আপনি শান্ত হোন। আপনি যাকে দেখছেন তাকে গিয়ে ধরে দেখুন তো তাকে ধরা যায় কী না।"
সামিয়া কিছুক্ষণ ভীতু চোখে বিউটির গতিবিধির দিকে তাকিয়ে থেকে উঠে গিয়ে ওর হাত ধরে ফেলল।
নিজাম আহমেদ হাসতে হাসতে বললেন, "উনি কী ভূত নাকি মানুষ?"
সামিয়া রাগ হয়ে নিজাম আহমেদের দিকে তাকিয়ে বলল, "এটা নাটক ছিল?"
নিজাম আহেমদ বললেন, "নাটক বলা যায়।"
সামিয়া বসার ঘর থেকে বের হতে উদ্ধত হলো। নিজাম আহমেদ বললেন, "আপনি বসুন, আপনার সাথে আমার আরও কিছু কথা বলার আছে।"
নিজাম আহেমদ সামিয়া ব্যতীত বাকি সবাইকে ঘরের বাইরে চলে যেতে বললেন। সবাই ঘর থেকে বাইরে যাবার পর তিনি সামিয়াকে বললেন, "আপনি রাগ করছেন কেন? এসব শুধুমাত্র আপনাকে দেখানোর জন্য করা হয়েছে যে ভূত-প্রেতের কোনো অস্তিত্ব নেই, তাদেরকে স্পর্শ যায় না। যদি স্পর্শ করা যায় তবে সে মানুষ, ভূত-প্রেত না। আপনি যাকে দেখে ভয় পান তাকে কী কখনো স্পর্শ করেছেন, অথবা সে কী আপনাকে কখনো স্পর্শ করেছে?"
সামিয়া কিছু বলল না।
--"মিসেস সামিয়া আপনি সন্তান সম্ভাবা। কিছুদিন আগে আপনি বাথরুমে পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলেন, আমার ধারণা আপনি সেই বৃদ্ধাকে দেখে ভয় পেয়ে দ্রুত বাথরুম থেকে বের হতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। ভাগ্যিস আপনার বাচ্চার কোনো ক্ষতি হয়নি কিন্তু আপনি যদি এরকমভাবে ভয় পেতে থাকেন তাহলে যে কোনো সময় বড় ধরনের কোনো দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। আপনি কী আমার কথা বুঝতে পারছেন?"
সামিয়া এবারও নিশ্চুপ রইল।
নিজাম আহমেদ পুনরায় বললেন, "আপনি যাকে দেখে ভয় পাচ্ছেন বাস্তবে তার কোনো অস্তিত্ব নেই সুতরাং তাকে দেখে ভয় পাবারও কোনো কারণ নেই। আপনি নাকি মাঝে মধ্যে দরজা বন্ধ করে কাঁদেন? ঘরের জিনিসপত্র ভাংচুর করেন? আমি জানি এসব আপনি রাগের বশে করেন। আপনি যখন ভয় পান তখন আজাদ সাহেব আপনার কথা বিশ্বাস না করলে আপনার খুব কষ্ট হয়, খুব রাগ উঠে যায়, তাই না?"
সামিয়া এবারও কিছু বলল না।
কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে নিজাম আহেমদ বললেন, "আপনি এই পর্যন্ত আজাদ সাহেবের গলা দুই দুইবার টিপে ধরেছেন তিনি কিন্তু মরেও যেতে পারতেন। আচ্ছা আজাদ সাহেব কেমন মানুষ?"
--"খুব ভালো।"
--"আজাদ সাহেবকে স্বামী হিসেবে দশ নম্বরের মধ্যে আপনি কত নম্বর দেবেন?"
--"দশ।"
নিজাম আহমেদ তাঁর ব্যাগ থেকে বাচ্চাদের নাম রাখার একটা বই বের করে সামিয়াকে দিয়ে বললেন, "এখানে বাচ্চাদের অর্থসহ সুন্দর সুন্দর অনেক নাম আছে। বইটা আমি আপনাকে উপহার দিলাম।"
সামিয়া বলল, "ধন্যবাদ।"
নিজাম আহমেদ বললেন, "আমার মনে হয় না আপনি আর কখনো ভূত-প্রেত দেখবেন এরপরও যদি কখনো দেখে ফেলেন তাহলে তাকে বলবেন, সে যেন একটা টুনটুনি পাখি ধরে এনে আপনাকে দিয়ে যায়।"
সামিয়া হেসে ফেলল।
নিজাম আহমেদ বললেন, "এইবার একটু খাবার-দাবার দিন, ভীষণ ক্ষুধা পেয়েছে।"
সামিয়া লজ্জা পেয়ে বলল, "দুঃখিত একটু বসুন।"
সামিয়া বসার ঘর থেকে বের হয়ে গেল। নিজাম আহমেদ বিউটি আর হামিদুলকে বসার ঘরে আসতে বললেন। আজাদকে ডেকে তিনি বললেন, "এইবার আপনি আপনার শ্যালক আর সুজনকে নিয়ে আসতে পারেন।"
আজাদ রাজিব আর সুজনকে পাশের ফ্ল্যাটে রেখে এসেছিল, ও গিয়ে ওদেরকে নিয়ে এলো। ইতোমধ্যে সামিয়া টেবিলে খাবার দিয়েছে। আজাদ বসার ঘরে গিয়ে নিজাম আহমেদদেরকে খাবার টেবিলে নিয়ে এলো।
খাওয়া-দাওয়ার পর নিজাম আহমেদ হামিদুল আর বিউটিকে নিয়ে সামিয়া এবং রোকেয়া বেগমের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আজাদদের বাসা থেকে বের হলেন। আজাদও তাদের সাথে বের হলো।
বাড়ির নিচে এসে নিজাম আহমেদ বিউটি আর হামিদুলকে গাড়িতে উঠতে বলে আজাদকে বললেন, "আমার বিশ্বাস ভূত-প্রেত নিয়ে আপনার স্ত্রীর আর কোনো সমস্যা হবে না। আপনি চেষ্টা করুন তাকে একটু বেশি সময় দেবার। সবসময়ের জন্য তার একজন একজন সঙ্গীর প্রয়োজন।
--" সুজন আছে তো।"
--"তা আছে। আপনি চেষ্টা করে দেখুন, আপনাদের বাচ্চাটা হবার আগ পর্যন্ত আপনার শ্বাশুড়িকে বাসায় রেখে দিতে পারেন কী না।"
--"জি আচ্ছা, আপনার ভিজিটটা?"
নিজাম সাহেব হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, "আপনি সুজনের বাবা হয়ে উঠতে পেরেছেন কী?"
--"চেষ্টা করছি।"
--"বেশি বেশি চেষ্টা করুন।"
--"আপনার ভিজিটটা?"
নিজাম আহমেদ হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করলেন, "ভিজিট দেবেন?"
--"অবশ্যই দেবো।"
--"তাহলে ভিজিটটা চেয়ে ফেলি। স্ত্রীকে বেশি বেশি ভালোবাসবেন, বেশি বেশি সময় দেবেন আর সুজনের প্রকৃত বাবা হবার চেষ্টা অব্যাহত রাখবেন।"
নিজাম আহমেদ গাড়িতে উঠে বসলেন। আজাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তিনি আজিমপুরের দিকে গাড়ি ছোঁটালেন।
বিউটিকে ওদের বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে নিজাম আহমেদ রেনেসাঁ ব্যাণ্ডের "আজকের শিশু" গানটা ছেড়ে বাড়ির দিকে রওনা হলেন।
বৈশাখ মাস চলছে কিন্তু বৃষ্টির ছিটেফোঁটাটিও নেই। ভীষণ গরম পড়ছে। গরমে অতিষ্ঠ হয়ে নিজাম আহমেদ কয়েকদিনের মধ্যে হামিদুলের এবং তাঁর ঘরে এসি লাগিয়ে ফেললেন।
বর্তমানে হামিদুলের অন্যতম কাজ হচ্ছে সারাক্ষণ এসির ঠাণ্ডা হাওয়ায় বসে গল্পের বই পড়া। বই পড়তে ওর বিরক্ত লাগে, ও একটু ভিডিও গেমস খেলতে চায় কিন্তু নিজাম আহমেদ ওর ফোনে কী যেন করে দিয়েছেন, ও ভিডিও গেমস নামাতে পারছে না। নিরুপায় হয়ে ও গল্পের বই পড়ছে।
সপ্তাহ দুয়েকের ভ্যাপসা গরমের পর আজ সন্ধ্যা থেকে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। রাত এগারোটার দিকে মুষলধারে বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। সামিয়া আজাদকে বলল, "চলো না বৃষ্টিতে ভিজি।"
আজাদ বলল, "এতরাতে বৃষ্টিতে ভিজলে ঠাণ্ডা লেগে যাবে তো।"
--"লাগুক, একটু ঠাণ্ডা লাগলে কিছু হবে না।"
--"ঠিক আছে কিন্তু বেশি সময়ের জন্য না।"
সামিয়া খুশি হয়ে বলল, "আচ্ছা।"
আজাদ আর সামিয়া ছাদে চলে গেল।
বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সামিয়া আজাদকে বলল, "আমি স্যরি।"
আজাদ জিজ্ঞাসা করল, "কেন?"
--"আমি তোমাকে এতদিনে না জানি কত কষ্ট দিয়েছি। সেজন্যে স্যরি। আমি আর কখনো তোমাকে কষ্ট দেবো না।"
--"আমি কোনো কষ্ট পাইনি সামিয়া।"
--"তুমি বললেই হলো? আমি তো জানি আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। আমার নিজেরই লজ্জা লাগছে, এতদিন কী সব ভেবে ভয় পেয়েছি, কী সব কাণ্ড করেছি! ছি ছি।"
--"যা হয়েছে তা হয়ে গেছে, ওসব নিয়ে ভেবো না। চলো ঘরে ফিরে যাই।"
--"আরেকটু থাকি?"
আজাদ সামিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলল, "আচ্ছা।"
ঘন্টাখানেক বৃষ্টিতে ভিজে আজাদরা ঘরে ফিরে এলো।
রাত একটা বাজতে চলল, এখনো বৃষ্টি পড়ছে। নিজাম আহমেদ ছাদের রেলিং ঘেঁষে বসে আছেন। স্ত্রী-সন্তানের কথা তাঁর খুব মনে পড়ছে। এমনই বৃষ্টিস্নাত এক রাতে তিনি তাঁর স্ত্রী-সন্তানকে হারিয়েছেন। এতগুলো বৃষ্টিভেজা রাত তাঁর জীবন থেকে চলে গেল কিন্তু তারা আর ফিরে এলো না, তাঁরা আর কখনো ফিরে আসবে না।
সমাপ্ত
নাহিদ হাসান নিবিড়
Hasibul hasan santo, Sk sagor, Sk imran, Rasel islam, Mr faruk, Sumaiya akter, Rokeya hoq and লেখাটি পছন্দ করেছে
Permissions in this forum:
You cannot reply to topics in this forum
|
|