- শমির সাদিকনবাগত
- Posts : 3
স্বর্ণমুদ্রা : 1081
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-06-08
প্রেমনীতি
Sat Jun 12, 2021 2:23 am
১|
টানা তিন বছর ধরে ফেল করে চলছে ছেলেটা। তাও একটু লজ্জা হায়া যদি হতো। ক্লাসরুমে এমনভাবে প্রবেশ করছে দেখে মনে হচ্ছে এই কলেজের ফার্স্ট বয় সে। ছেলেটিকে একরকম দুই চোখে দেখতে পারে না তিতলি। তার নিজের অজান্তেই ভ্রু জোড়া কুঁচকে ওঠে। ঈর্ষায় গাটা জ্বলে পুড়ে যায়। মাথা ভর্তি কাল ঝাঁকড়া চুল, ঈষৎ গোলাপি ঠোঁটের প্রায় ছয় ফুট লম্বা, উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের ছেলেটিকে দেখলে ভালোলাগার পরিবর্তে গা রি রি করে ওঠে তার। ট্রিম করা গালের দাড়ি, মাথার দুপাশে ছাঁটানোর চুল আর সামনে জেল করা স্পাইক দেখে মনে হয় সৌন্দর্যচর্চাই তার সারাদিনের কাজ। তাছাড়া ক্লাসে এতো ভালো ভালো ছাত্র থাকতে সব মেয়েগুলি কেন যেন এর জন্যই লাট্টু। সম্ভবত হাসিটা মিষ্টি তাই। চোখগুলি গাড়ো গভীর। একবার তো তিতলির দিকে এমনভাবে তাকিয়ে ছিল, মনে হচ্ছিল তার মনের ভাষা সব পড়ে ফেলছে। এরপর থেকে চোখে চোখ পড়লেই টিটলির বুক ধক করে ওঠে। ছেলেটার দিকে বেশীক্ষণ তাঁকিয়ে থাকতে পারে না সে। আর ছেলেটাও কম নয় চোখ পড়লে কখনো চোখ সরায় না। বেহায়া একটা!
হঠাৎ তিতলির ভাবনায় ছেদ পড়ল ক্লাস টিচার তার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলার পর,
"এই মেয়ে, তোমাকে বলছি।" ফর্সা গায়ের রঙের লম্বা, সুদর্শন এই লোকটাকে মনের গভীর থেকে পছন্দ করে তিতলি। যদিও লোকটা তাকে খুব একটা পাত্তা দেয় বলে মনে হয় না। ইংরেজির শিক্ষক লোকটি। সবই ঠিক আছে। দেখতে সুন্দর, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। ইংলিশও ভালো বলে। শুধু নামটাতেই যা একটু সমস্যা। পুরনো সেকেলে আর কি। সবাই শহীদ স্যার শহীদ স্যার বলে ডাকে। অবশ্য তার আর কোন নাম আছে কিনা সেটাও জানা নেই তিতলির। হতে পারে তার ভালো কোন ডাকনাম রয়েছে।
এই শহীদ স্যার দ্বিতীয়বার কিছু বলার আগেই ঝট করে উঠে দাঁড়ালো তিতলি। তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল লোকটি, "কালকের এসাইনমেন্টটা কি এনেছো?" কোন একটা কারণে তাকে কখনোই নাম ধরে ডাকে না এই লোকটি। প্রতিবারই এই, ওই বলে সম্মোধন করে। এই ব্যাপারটিই যা একটু অস্বস্থি লাগে, তাছাড়া বাকি সব ঠিক আছে।
তার মতো লম্বা কালো চুল, ডাগর কালো চোখ আর দুধে আলতা গায়ের রঙের এরকম একটি মেয়ে কলেজে কমই আছে। যেখানে তার সমবয়সীরা তাকে দেখলে চোখ নামাতে পারে না, কথা বলার সময় জড়তা ভর করে গলায়, সেখানে এই লোকটি যেন নির্বিকার। মনে হয় তার ভেতরে কোন অনুভূতি নাড়া দেয় না। একটি লোক কিভাবে এত নিরামিষ হয়। যেখানে তার পশ্চাদ্দেশে নজর গেলে মানুষ হায় হায় করে। সেখানে এই লোকটি একদমই রিএকশন হীন। তিতলির মাথায় ব্যাপারটা ঢোকে না। এত ভাবে ওকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেও সে ব্যর্থ।
এমন কেন লোকটি? নাকি দেখতে যা তার থেকে বেশি বয়স তার। ভেতরে ভেতরে যৌবনের জৌলুস হারিয়ে গেছে। লৌহ দন্ড দুর্বল।
"দেখি অ্যাসাইনমেন্টা নিয়ে এসো এখানে।" তিতলির উদ্দেশ্যে নির্বিকারে কথাটি বলল শহীদ স্যার। তিতলি তড়িঘড়ি করে ব্যাগ থেকে খাতাটা বের করল। এক দৌড়ে শফিক স্যারের টেবিলের উপর নিয়ে রাখল। সে এই কলেজের ভালো ছাত্রী। সবার কাছে সুনাম আছে। তার অ্যাসাইনমেন্টে কখনোই কোনো গন্ডগোল পাওয়া যায় না। তবুও কেন যেন এই লোকটি সব সময় কিছু না কিছু খুঁজে বের করে ফেলে। আজও ঠিক তাই করল সে। বেশ কয়েকটি লাইনে লাল কালি দিয়ে দাগ দিতে দিতে বলল, "প্রচুর গ্রামাটিক্যাল মিস্টেক। এতো ভুল হলে চলে বলতো, মেয়ে? কদিন পরেই তো পরীক্ষা। ওই আদিত্যর মত ফেল করে বসে থাকতে হবে তবে। তুমিও কি সেটা চাও?
এবার যেন কেরোসিন ঢেলে কেউ আগুন লাগিয়ে দিয়েছে টিটলির গায়ে। ইংরেজি ক্লাসে তাকে এই ভাবে অপমান! তাই বলে ওই আদিত্য ছোকরাটার সাথে তুলনা! এটা তো মেনে নেয়ার মতো নয়। টের পাচ্ছে তিতলির শরীর ঘামতে শুরু করেছে এর মধ্যে। এবার সে নিজেও কিছুটা দ্বিধা দ্বন্দ্বে পড়ে গেছে। তাহলে কি সে সত্যি সত্যি ইংরেজীতে দুর্বল? নিজেকে কয়েকবার প্রবোধ দিল সে। মোটেও না। সব এই লোকটির বাড়াবাড়ি। এই মুহূর্তে ইচ্ছে করছে শহীদ স্যার নামক লোকটির মাথায় ডাস্টার দিয়ে একটা বাড়ি দিতে।
সামনে ক্লাসে চোখ যেতেই বুঝতে পারল সবাই তাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে। হঠাৎ অনিচ্ছাকৃতভাবেই সাদিয়ার দিকে চোখ পড়ল তিতলির। খুশিতে আটখানা ডাইনীটা। মনের ভেতর বাগডুম বাগডুম খেলা করছে। সাদিয়াকে বলা চলে নাম্বার ওয়ান অপনেন্ট তিতলির। শুধু পড়াশোনা নয় সব জায়গায় তাকে টেক্কা দেওয়ার চেষ্টা করে মেয়েটি।
শহীদ স্যারের এই টিপ্পনীর পরে সাদিয়া যেন আরো হারিয়ে গেল তার প্রেমে। লাজুক চোখে নিস্পলক স্যারের দিকে তাকিয়ে আছে সে। তিতলিকে করা টিপ্পনীগুলি হা করে গিলছে। এবার বুঝুক তিতলি তার দুর্বলতা। স্যার তো চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিল। নিজেকে যে কি মনে করে টিকলি। সাদিয়া সবসময় এটা বিশ্বাস করে তিতলির সব অতি রঞ্জিত। সে নিজেকে গুনোবতি মনে আসলে সে তা নয়।
মূল পরিক্ষায় স্যাররা তো তাকে সামনে বসিয়ে একবার তার চেহারা আরেকবার তার খাতা দেখে নাম্বার বসাবে না। ওখানে ঠিকই ধরাশায়ী হবে টিটলি। সাদিয়া সবসময় এটা বিশ্বাস করে এসেছে। সেই বিশ্বাসের পূর্বাভাস যে আসতে শুরু করেছে।
সাদিয়ার গায়ের রং কিছুটা চাপা হলেও চেহারা তার মিষ্টি। কিন্তু আমাদের দেশে চাপা মানেই কালো মেয়ে। তাই সৌন্দর্যের দৌড়ে বরাবরই তিতলির পেছনে থাকে সাদিয়া। এটা নিয়ে কিছুটা হীনমন্যতা হয় তার।
"এই যে ছেলে হাসাহাসি করছ কেন?" আদিত্যর দিকে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে কথাটি বলল শহীদ স্যার। কদিন পরেই তো তোমার ক্লাসমেট তোমার শিক্ষক হয়ে এই চেয়ারে বসবে। তখন কিন্তু তোমার এই গর্ব মাটিতে দলা পেকে পড়ে যাবে।" তিতলি ভাবল স্যারের মুখটাও একটা। যেন মুখ নয় ইস্পাত। একদম ছেচে দিয়েছে। কথাটি শুনে তিতলি লজ্জা লাগলেও আদিত্য যেন একটুও লজ্জা পায়নি। তার যেন হাসি চেপে রাখতে বড় কষ্ট হচ্ছে। তবে ভেতরে গিয়ে কিছুটা হলেও লেগেছে তার। কয়েক মুহুর্ত পর সেটা বোঝা গেল। কিছুটা জোর করে হাসার চেষ্টাটা এখন কাজে লাগছে না। একটু মেকি মেকি লাগছে। আদিত্যের বাবা জনতা লীগের বড় নেতা। সামনে ইলেকশন। আদিত্য তার হয়ে প্রচার-প্রচারণায় চালাতে ব্যস্ত। রাজনীতিবিদদের ছেলেপেলে গুলো বল মনে হয় বেহায়া ধরনের হয়।
কথাটি ভাবতেই একটু পর নিজে থেকে মাথা ঝাঁকিয়ে উঠল তিতলি। তার বাবাও যে রাজনীতিবিদ!
তবে সে তো কখনো এরকম বেহায়ার অপদার্থ ছিল না। সে তো ঠিকই দায়িত্ব নিয়ে পড়াশোনা করে। ভালো রেজাল্ট করে। হয়তোবা ছেলেরা একটু অন্যরকম হয়।
বকাঝকা শুনে মুখটা মলিন করে ছোট ছোট পায়ে নিজের চেয়ারে এসে বসলো তিতলি। কয়েক মুহূর্ত পর ক্লাসের ঘণ্টা বাজতেই সবাই ব্যাগ নিয়ে ছুটোছুটি করতে শুরু করল? টিতলি ব্যাগ গোছাচ্ছে। গোছাতে গোছাতে ডানে তাকিয়ে দেখল হামিদা তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। হামিদা তার ছোটবেলার বান্ধবী। দেখতে খুব একটা সুন্দর না হলেও, অসুন্দর বলা চলে না। তার থেকে কিঞ্চিৎ খাটো মোটাসোটা গড়নের। শ্যাম বর্ণের হামিদা আসলেই তার খুব আপন। বিপদে-আপদে সবসময় তাকে পাশে পাওয়া যায়।
"ইস কি একটা নাম রাখছে? আদিত্য! বাপ মা তো রাখে নাই, নিজে নিজে না রাখা নাম মনে হয়!" মুখ ভেংচি কেটে কথাটি বলল হামিদা। তিতলির কানে কোন কথা ঢুকলো না। এই মুহূর্তে তার কোন মুড ভালো নেই। মনের ভেতরটায় কেমন যেন একটা বিশ্রী অনুভূতি হচ্ছে। শহীদ স্যার নামক লোকটির উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে। নিজের কাছে ভাবতেই অবাক লাগছে এই লোকটাকে সে মনেপ্রাণে পছন্দ করত। এক নিমিষে যেন তার উপর থেকে পুরো মনটাই উঠে গেছে তিতলির। নিজের উপর ধিক্কার হচ্ছে।
বারান্দা দিয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ানোর সময় হঠাৎ নিচে মাঠের উপর চোখ গেল তিতলির। নিজের ছাদখোলা জিপের উপর এক লাফে উঠে বসেছে আদিত্য। পিছ পিছ তার আরো কয়েকটা সাগরেদ।
"এই আদি। তাড়াতাড়ি চল। অনেক কাজ আছে হাতে।" তারে এক সাগরেদ চিৎকার করে বলে উঠলো।
হঠাৎই ঘাড় ঘুরিয়ে চট করে পেছনে তাকালো আদিত্য। টিটলি কে দেখে হো হো শব্দ করে একটা হাসি দিল। এক বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বলল, "ওই দেখ, টিকটিকি।" তারপর সশব্দে গাড়িটি চালু করে ধুলো উড়তে উড়তে সামনের গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল। নিজের অজান্তেই মেঝের উপর ধুপ করে পা দিয়ে একটা শব্দ করলো তিতলি। আজকে যে কারো চেহারা দেখে উঠেছে সে। পুরো দিনটাই মাটি হয়ে গেল। রাস্তায় বের হতেই সাগরেদ দুটির মুখে দূর থেকে শ্লোগান শোনা গেল, আকবর ভাই, জিন্দাবাদ! আকবর ভাই জিন্দাবাদ!
এই আকবর হলো আদিত্যের গুণধর পিতা। সামনের ইলেকশনে মেয়র প্রার্থী। পিতা গুণধর হলেও পুত্রের এমন দশা কেন মাথায় ঢোকেনা তিতলির। অন্যদিকে তার বাবা কৃষক কল্যাণ পার্টির নেতা। এটা আবার পুরোপুরি বিপরীত একটি দল। আকবরের দল হ্যাঁ বললে এরা বলে না। এদের মধ্যকার বিরোধ এতটাই প্রবল যে এলাকা, মহল্লায় প্রায় সময়ই দুইদলের সমর্থকদের মধ্যে মারামারি শুরু হয়ে যায়।
যাহ! দিনটাই খারাপ গেল আজ! ভাবতে ভাবতে একটা রিকশা ডকলো তিতলি, এই খালি! যাবে?
চলবে।
টানা তিন বছর ধরে ফেল করে চলছে ছেলেটা। তাও একটু লজ্জা হায়া যদি হতো। ক্লাসরুমে এমনভাবে প্রবেশ করছে দেখে মনে হচ্ছে এই কলেজের ফার্স্ট বয় সে। ছেলেটিকে একরকম দুই চোখে দেখতে পারে না তিতলি। তার নিজের অজান্তেই ভ্রু জোড়া কুঁচকে ওঠে। ঈর্ষায় গাটা জ্বলে পুড়ে যায়। মাথা ভর্তি কাল ঝাঁকড়া চুল, ঈষৎ গোলাপি ঠোঁটের প্রায় ছয় ফুট লম্বা, উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের ছেলেটিকে দেখলে ভালোলাগার পরিবর্তে গা রি রি করে ওঠে তার। ট্রিম করা গালের দাড়ি, মাথার দুপাশে ছাঁটানোর চুল আর সামনে জেল করা স্পাইক দেখে মনে হয় সৌন্দর্যচর্চাই তার সারাদিনের কাজ। তাছাড়া ক্লাসে এতো ভালো ভালো ছাত্র থাকতে সব মেয়েগুলি কেন যেন এর জন্যই লাট্টু। সম্ভবত হাসিটা মিষ্টি তাই। চোখগুলি গাড়ো গভীর। একবার তো তিতলির দিকে এমনভাবে তাকিয়ে ছিল, মনে হচ্ছিল তার মনের ভাষা সব পড়ে ফেলছে। এরপর থেকে চোখে চোখ পড়লেই টিটলির বুক ধক করে ওঠে। ছেলেটার দিকে বেশীক্ষণ তাঁকিয়ে থাকতে পারে না সে। আর ছেলেটাও কম নয় চোখ পড়লে কখনো চোখ সরায় না। বেহায়া একটা!
হঠাৎ তিতলির ভাবনায় ছেদ পড়ল ক্লাস টিচার তার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলার পর,
"এই মেয়ে, তোমাকে বলছি।" ফর্সা গায়ের রঙের লম্বা, সুদর্শন এই লোকটাকে মনের গভীর থেকে পছন্দ করে তিতলি। যদিও লোকটা তাকে খুব একটা পাত্তা দেয় বলে মনে হয় না। ইংরেজির শিক্ষক লোকটি। সবই ঠিক আছে। দেখতে সুন্দর, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। ইংলিশও ভালো বলে। শুধু নামটাতেই যা একটু সমস্যা। পুরনো সেকেলে আর কি। সবাই শহীদ স্যার শহীদ স্যার বলে ডাকে। অবশ্য তার আর কোন নাম আছে কিনা সেটাও জানা নেই তিতলির। হতে পারে তার ভালো কোন ডাকনাম রয়েছে।
এই শহীদ স্যার দ্বিতীয়বার কিছু বলার আগেই ঝট করে উঠে দাঁড়ালো তিতলি। তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল লোকটি, "কালকের এসাইনমেন্টটা কি এনেছো?" কোন একটা কারণে তাকে কখনোই নাম ধরে ডাকে না এই লোকটি। প্রতিবারই এই, ওই বলে সম্মোধন করে। এই ব্যাপারটিই যা একটু অস্বস্থি লাগে, তাছাড়া বাকি সব ঠিক আছে।
তার মতো লম্বা কালো চুল, ডাগর কালো চোখ আর দুধে আলতা গায়ের রঙের এরকম একটি মেয়ে কলেজে কমই আছে। যেখানে তার সমবয়সীরা তাকে দেখলে চোখ নামাতে পারে না, কথা বলার সময় জড়তা ভর করে গলায়, সেখানে এই লোকটি যেন নির্বিকার। মনে হয় তার ভেতরে কোন অনুভূতি নাড়া দেয় না। একটি লোক কিভাবে এত নিরামিষ হয়। যেখানে তার পশ্চাদ্দেশে নজর গেলে মানুষ হায় হায় করে। সেখানে এই লোকটি একদমই রিএকশন হীন। তিতলির মাথায় ব্যাপারটা ঢোকে না। এত ভাবে ওকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেও সে ব্যর্থ।
এমন কেন লোকটি? নাকি দেখতে যা তার থেকে বেশি বয়স তার। ভেতরে ভেতরে যৌবনের জৌলুস হারিয়ে গেছে। লৌহ দন্ড দুর্বল।
"দেখি অ্যাসাইনমেন্টা নিয়ে এসো এখানে।" তিতলির উদ্দেশ্যে নির্বিকারে কথাটি বলল শহীদ স্যার। তিতলি তড়িঘড়ি করে ব্যাগ থেকে খাতাটা বের করল। এক দৌড়ে শফিক স্যারের টেবিলের উপর নিয়ে রাখল। সে এই কলেজের ভালো ছাত্রী। সবার কাছে সুনাম আছে। তার অ্যাসাইনমেন্টে কখনোই কোনো গন্ডগোল পাওয়া যায় না। তবুও কেন যেন এই লোকটি সব সময় কিছু না কিছু খুঁজে বের করে ফেলে। আজও ঠিক তাই করল সে। বেশ কয়েকটি লাইনে লাল কালি দিয়ে দাগ দিতে দিতে বলল, "প্রচুর গ্রামাটিক্যাল মিস্টেক। এতো ভুল হলে চলে বলতো, মেয়ে? কদিন পরেই তো পরীক্ষা। ওই আদিত্যর মত ফেল করে বসে থাকতে হবে তবে। তুমিও কি সেটা চাও?
এবার যেন কেরোসিন ঢেলে কেউ আগুন লাগিয়ে দিয়েছে টিটলির গায়ে। ইংরেজি ক্লাসে তাকে এই ভাবে অপমান! তাই বলে ওই আদিত্য ছোকরাটার সাথে তুলনা! এটা তো মেনে নেয়ার মতো নয়। টের পাচ্ছে তিতলির শরীর ঘামতে শুরু করেছে এর মধ্যে। এবার সে নিজেও কিছুটা দ্বিধা দ্বন্দ্বে পড়ে গেছে। তাহলে কি সে সত্যি সত্যি ইংরেজীতে দুর্বল? নিজেকে কয়েকবার প্রবোধ দিল সে। মোটেও না। সব এই লোকটির বাড়াবাড়ি। এই মুহূর্তে ইচ্ছে করছে শহীদ স্যার নামক লোকটির মাথায় ডাস্টার দিয়ে একটা বাড়ি দিতে।
সামনে ক্লাসে চোখ যেতেই বুঝতে পারল সবাই তাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে। হঠাৎ অনিচ্ছাকৃতভাবেই সাদিয়ার দিকে চোখ পড়ল তিতলির। খুশিতে আটখানা ডাইনীটা। মনের ভেতর বাগডুম বাগডুম খেলা করছে। সাদিয়াকে বলা চলে নাম্বার ওয়ান অপনেন্ট তিতলির। শুধু পড়াশোনা নয় সব জায়গায় তাকে টেক্কা দেওয়ার চেষ্টা করে মেয়েটি।
শহীদ স্যারের এই টিপ্পনীর পরে সাদিয়া যেন আরো হারিয়ে গেল তার প্রেমে। লাজুক চোখে নিস্পলক স্যারের দিকে তাকিয়ে আছে সে। তিতলিকে করা টিপ্পনীগুলি হা করে গিলছে। এবার বুঝুক তিতলি তার দুর্বলতা। স্যার তো চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিল। নিজেকে যে কি মনে করে টিকলি। সাদিয়া সবসময় এটা বিশ্বাস করে তিতলির সব অতি রঞ্জিত। সে নিজেকে গুনোবতি মনে আসলে সে তা নয়।
মূল পরিক্ষায় স্যাররা তো তাকে সামনে বসিয়ে একবার তার চেহারা আরেকবার তার খাতা দেখে নাম্বার বসাবে না। ওখানে ঠিকই ধরাশায়ী হবে টিটলি। সাদিয়া সবসময় এটা বিশ্বাস করে এসেছে। সেই বিশ্বাসের পূর্বাভাস যে আসতে শুরু করেছে।
সাদিয়ার গায়ের রং কিছুটা চাপা হলেও চেহারা তার মিষ্টি। কিন্তু আমাদের দেশে চাপা মানেই কালো মেয়ে। তাই সৌন্দর্যের দৌড়ে বরাবরই তিতলির পেছনে থাকে সাদিয়া। এটা নিয়ে কিছুটা হীনমন্যতা হয় তার।
"এই যে ছেলে হাসাহাসি করছ কেন?" আদিত্যর দিকে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে কথাটি বলল শহীদ স্যার। কদিন পরেই তো তোমার ক্লাসমেট তোমার শিক্ষক হয়ে এই চেয়ারে বসবে। তখন কিন্তু তোমার এই গর্ব মাটিতে দলা পেকে পড়ে যাবে।" তিতলি ভাবল স্যারের মুখটাও একটা। যেন মুখ নয় ইস্পাত। একদম ছেচে দিয়েছে। কথাটি শুনে তিতলি লজ্জা লাগলেও আদিত্য যেন একটুও লজ্জা পায়নি। তার যেন হাসি চেপে রাখতে বড় কষ্ট হচ্ছে। তবে ভেতরে গিয়ে কিছুটা হলেও লেগেছে তার। কয়েক মুহুর্ত পর সেটা বোঝা গেল। কিছুটা জোর করে হাসার চেষ্টাটা এখন কাজে লাগছে না। একটু মেকি মেকি লাগছে। আদিত্যের বাবা জনতা লীগের বড় নেতা। সামনে ইলেকশন। আদিত্য তার হয়ে প্রচার-প্রচারণায় চালাতে ব্যস্ত। রাজনীতিবিদদের ছেলেপেলে গুলো বল মনে হয় বেহায়া ধরনের হয়।
কথাটি ভাবতেই একটু পর নিজে থেকে মাথা ঝাঁকিয়ে উঠল তিতলি। তার বাবাও যে রাজনীতিবিদ!
তবে সে তো কখনো এরকম বেহায়ার অপদার্থ ছিল না। সে তো ঠিকই দায়িত্ব নিয়ে পড়াশোনা করে। ভালো রেজাল্ট করে। হয়তোবা ছেলেরা একটু অন্যরকম হয়।
বকাঝকা শুনে মুখটা মলিন করে ছোট ছোট পায়ে নিজের চেয়ারে এসে বসলো তিতলি। কয়েক মুহূর্ত পর ক্লাসের ঘণ্টা বাজতেই সবাই ব্যাগ নিয়ে ছুটোছুটি করতে শুরু করল? টিতলি ব্যাগ গোছাচ্ছে। গোছাতে গোছাতে ডানে তাকিয়ে দেখল হামিদা তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। হামিদা তার ছোটবেলার বান্ধবী। দেখতে খুব একটা সুন্দর না হলেও, অসুন্দর বলা চলে না। তার থেকে কিঞ্চিৎ খাটো মোটাসোটা গড়নের। শ্যাম বর্ণের হামিদা আসলেই তার খুব আপন। বিপদে-আপদে সবসময় তাকে পাশে পাওয়া যায়।
"ইস কি একটা নাম রাখছে? আদিত্য! বাপ মা তো রাখে নাই, নিজে নিজে না রাখা নাম মনে হয়!" মুখ ভেংচি কেটে কথাটি বলল হামিদা। তিতলির কানে কোন কথা ঢুকলো না। এই মুহূর্তে তার কোন মুড ভালো নেই। মনের ভেতরটায় কেমন যেন একটা বিশ্রী অনুভূতি হচ্ছে। শহীদ স্যার নামক লোকটির উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে। নিজের কাছে ভাবতেই অবাক লাগছে এই লোকটাকে সে মনেপ্রাণে পছন্দ করত। এক নিমিষে যেন তার উপর থেকে পুরো মনটাই উঠে গেছে তিতলির। নিজের উপর ধিক্কার হচ্ছে।
বারান্দা দিয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ানোর সময় হঠাৎ নিচে মাঠের উপর চোখ গেল তিতলির। নিজের ছাদখোলা জিপের উপর এক লাফে উঠে বসেছে আদিত্য। পিছ পিছ তার আরো কয়েকটা সাগরেদ।
"এই আদি। তাড়াতাড়ি চল। অনেক কাজ আছে হাতে।" তারে এক সাগরেদ চিৎকার করে বলে উঠলো।
হঠাৎই ঘাড় ঘুরিয়ে চট করে পেছনে তাকালো আদিত্য। টিটলি কে দেখে হো হো শব্দ করে একটা হাসি দিল। এক বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বলল, "ওই দেখ, টিকটিকি।" তারপর সশব্দে গাড়িটি চালু করে ধুলো উড়তে উড়তে সামনের গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল। নিজের অজান্তেই মেঝের উপর ধুপ করে পা দিয়ে একটা শব্দ করলো তিতলি। আজকে যে কারো চেহারা দেখে উঠেছে সে। পুরো দিনটাই মাটি হয়ে গেল। রাস্তায় বের হতেই সাগরেদ দুটির মুখে দূর থেকে শ্লোগান শোনা গেল, আকবর ভাই, জিন্দাবাদ! আকবর ভাই জিন্দাবাদ!
এই আকবর হলো আদিত্যের গুণধর পিতা। সামনের ইলেকশনে মেয়র প্রার্থী। পিতা গুণধর হলেও পুত্রের এমন দশা কেন মাথায় ঢোকেনা তিতলির। অন্যদিকে তার বাবা কৃষক কল্যাণ পার্টির নেতা। এটা আবার পুরোপুরি বিপরীত একটি দল। আকবরের দল হ্যাঁ বললে এরা বলে না। এদের মধ্যকার বিরোধ এতটাই প্রবল যে এলাকা, মহল্লায় প্রায় সময়ই দুইদলের সমর্থকদের মধ্যে মারামারি শুরু হয়ে যায়।
যাহ! দিনটাই খারাপ গেল আজ! ভাবতে ভাবতে একটা রিকশা ডকলো তিতলি, এই খালি! যাবে?
চলবে।
Sagor mondol, Preonte catarge, Choyon khan, RejWan Ahmed, Foijullah siddiki, Tapos ghos, Tawhid sikdar and লেখাটি পছন্দ করেছে
Permissions in this forum:
You cannot reply to topics in this forum
|
|