- Md Dadonনবাগত
- Posts : 1
স্বর্ণমুদ্রা : 1113
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-05-30
ভুতের লাঠি
Sun May 30, 2021 3:44 pm
আমার নিজের গ্রামের নাম আলীপুর সম্ভবত ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা) নাম অনুসারে নামকরণ করা হয়েছে। এর পার্শ্ববর্তী গ্রামের নাম রামচন্দ্রপুর যা হয়তো হিন্দু ধর্মের অবতার রামচন্দ্রের নামানুসারে নামকরণ করা হয়েছে। গ্রামের নাম রামচন্দ্রপুর হলেও রামের অনুসারী আর কেউ এখানে নেই।
যে এক ঘর হিন্দু এখনো বসবাস করছেন তারা প্রকৃতপক্ষে কার অনুসারী সেটা ঐতিহাসিক গবেষণার বিষয়!
আড়িয়াল খাঁ নদী খসেরহাট ছেড়ে সমিতির হাট যাওয়ার পথে বক্ররেখা বাদ দিয়ে বাঁশগাড়ি যাওয়ার যে সোজা পথ অনুসরণ করেছে -সেই ট্রায়াংগেলের কাছেই এক বিশাল চর রেখে গিয়েছে। যা বর্তমানে 'হোগলা বন' হিসেবেই পরিচিত। এই হোগলা বনের খাস জমিতে উপজেলা পরিষদ থেকে একটি বিনোদন পার্ক করার উদ্যোগ নিয়েছিল। নাম ঠিক করা হয়েছিল 'শেখ রাসেল ডিজিটাল পার্ক'। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান সম্ভাব্যতা যাচাই শেষে সীমানা নির্ধারণ করে সিমেন্টের খুটি (পিলার)গেড়ে বাউন্ডারির কাজ শুরুও করেছিল। এই কাজ করার জন্য যে সকল যন্ত্রপাতি নেয়া হয়েছিল যেমন হ্যামার, ভেকু ইত্যাদির কোনটিই সঠিকভাবে কাজ করছিল না। বন্ধ অবস্থায়ও মেশিন গুলো নিজে নিজেই নদীতে নেমে যাচ্ছিল।
এই প্রস্তাবিত পার্ক থেকে মাত্র পাঁচশ গজ দূরে আমার পুকুরের পাড়ের আড্ডা ঘর (টঙ) এ বসে এই চিত্র নিজের চোখে দেখা। প্রায়ই দেখতাম সকালে কাজ শুরু হয়ে ড্রাইভার এস্কেভেটরে কেবল উঠে স্টার্ট দেবেন এমন সময় চিতকার করে তিনি নেমে আসলেন। আবার দেখা যায় বিকেলে কাজ শেষে সবকিছু স্বাভাবিক রেখে গিয়েছে কিন্তু পরেরদিন ভেকু হয়তো নদীতে নেমে গোসলে নেমেছে।
এটা আমার চোখের সামনেই ঘটতে দেখেছি। তাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস -এখানে নিশ্চয়ই অতিপ্রাকৃত কোনো শক্তি কার্যকর। যে শক্তি চায় না সেখানে কোনো অবকাঠামো গড়ে উঠুক। অবশেষে কর্তৃপক্ষ বুঝতে পেরে কাজ ফেলে পালিয়ে যায়। যন্ত্রপাতি নিয়ে গেলেও খাম্বাগুলো(পিলার) প্রমাণ হিসেবে রয়েগেছে। একদিন অপ্রত্যাশিত ভাবেই আমার কাছে পার্ক করতে না পারার ঘটনা চলে আসে।
আমার পুকুর পাড়ের টঙ ঘরে বসে কথা হয় এই রামচন্দ্রপুর গ্রামের একমাত্র হিন্দু পরিবারের কর্তা বিমলের বাপের পুর্বপুরুষ পরিমলের সাথে। এই লোকটার নাম 'বিমলের বাপ' কেন তাও এক কাহিনি। সাধারণত বাপের নামেই ছেলের পরিচয় হয় যেমন -আলালের ঘরের দুলাল টাইপ। এই ক্ষেত্রে ঘটনা ভিন্ন। আমার মনে হয় বিমলের NID তেও বিমলের পিতার নাম হিসেবে বিমলের বাপ লেখা আছে।
যাইহোক রাত এগোরাটায় কথা হয় ৭৭ বছর বয়সী পরিমলের সাথে।
শুয়ে শুয়ে ফেসবুকিং করছি এমন সময়ে বাইরে কাশির শব্দ শুনে জিজ্ঞেস করলাম কে ওখানে?
কাঁপা কাঁপা গলায় উত্তর পেলাম -আমি পরিমল।
কোন পরিমল?
ওইযে স্কুলের সামনে বাওরের ওপারে বাড়ি -বিমলের বাপেরে চিননা? ঐ বাড়ি।
বিমলের বাপের নাম শুনেছি। চোখে দেখিনি।
বাইরে শুক্লপক্ষের দ্বাদশীর চাঁদ। পৃথিবী চাদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে। সে এক অপার্থিব দৃশ্য।
করোনায় কলেজ বন্ধ আছে। হাতে তেমন কাজ নেই। প্রতিদিনই এখানে সব বন্ধুরা মিলে আড্ডা দেই। কোনো কোনো দিন রাত শেষে ভোর হয়ে যায়। আজ আমি এই মুহুর্তে একা আছি। বন্ধু সাজিদ খাসের হাট বাজারে গিয়েছে এখনি চলে আসবে। আজ দুজনে এখানে থাকব। সারা রাত জোৎস্না দেখব। দক্ষিণে বিস্তীর্ণ এলাকা ফাঁকা। বর্ষার পানিতে চারিদিক থৈথৈ করছে। এমন সময় এই বৃদ্ধকে দেখে কিছুটা আশ্চর্য হলেও মনে মনে খুশিই হলাম। সাজিদ আসা পর্যন্ত গল্প করা যাবে।
আমি তাকে ভেতরে আসতে বললাম। বৃদ্ধ ফোকলা দাঁতের অমায়িক হাসি দিয়ে ভেতরে এসে বসলেন। কথা প্রসঙ্গে সামনের আড়িয়াল খাঁ নদীর চরের হোগলা বনের পার্ক করতে না পারার প্রসঙ্গ উঠালে বৃদ্ধ অনেকটা ক্ষেপে গেল মনে হল। আমার কাছে মুড়ি চানাচুর ছিল বৃদ্ধকে খেতে দিলাম। খাচ্ছি আর গল্প করছি। আবারও জানতে চাইলাম। এইবার বৃদ্ধ শুরু করলেন তার আসল গল্প।
বর্তমান রামচন্দ্রপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশেই তার বাড়ি ছিল। তখন বৃটিশরা কেবল এদেশে এসেছে। কোম্পানির শাসন চলমান সেই সময়ের কথা।
কথা বলে বুঝতে পারলাম বৃদ্ধ অশিক্ষিত নন। মনেমনে ভাবলাম গল্পটা তাহলে খারপ হবেনা।
যাইহোক, তিনি বলেই চলছেন,আমার বয়স তখন কত হবে? ২২ -২৩ বছরের যুবক। তখনকার কথা।
এই পুরো এলাকা তখন হিন্দু অধ্যুষিত। আড়িয়াল খাঁ নদী তখন অনেক বড় ছিল। আমরা এখন যেখানে বসে আছি এর দক্ষিণ-পূর্বে ছিল নদী আর তার পাশেই ছিল বিশাল জঙ্গল। নদীর পাড় ঘেঁষেই ছিল শ্মশান ও কালী মন্দির। মন্দিরের উপরে ছিল বিশাল অশ্বত্থের গাছ। যেন অশ্বত্থ গাছের কোলের ভেতর নিয়ে বসে আছে মা-কালীর মন্দির।
একদিন সন্ধ্যায় কোথা থেকে এসে এক জটা-জুটা ধারি সাধু এসে আস্তানা গাড়েন এই মন্দিরের ঠিক পাশেই অশ্বত্থ গাছের নিচে। পরের দিন সকালে সাধুর কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন জন সাধুর সাথে সাক্ষাৎ করে তাদের আবেদন নিবেদন করতে থাকেন। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার সাধু কারো কাছ থেকেই কিছু নিচ্ছেন। এমনকি খাবারগুলো না। ঐদিন রাতে আমাদের গ্রামে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার ঘটে তা হলো -আমাদের পাশের বাড়ির প্রিতমদের দুধের গাইটি হাড়িয়ে যায়। অনেক খোঁজ করেও পাওয়া যায় নি।
ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি রাত সাড়ে বারোটা বেজে গেছে।
তিনি গল্প বলে যাচ্ছেন।
হঠাৎ দূরে কোথাও রাত জাগা পাখি ডেকে উঠলো 'কুপ,কুপ কুপ'। নিস্তব্ধতায় এতে কোনো পরিবর্তন হলো না। আমি আবারও গল্পে ডুবে গেলাম।
তিনি বলে যাচ্ছেন।
পরের দিন সকালে প্রিতমদের গরুটি তাদেরই ঘরের পেছনে খুজে পাওয়া যায়। কিন্তু গরুটির দেহের আর কিছু বাকি ছিলা না। সম্পুর্ন শরীরটাকে কেউ প্রচণ্ড শক্তিতে টেনে ঘাড় থেকে দুই খন্ড করে রেখেছে। ভেতর থেকে নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে এসেছে।
সবার ভেতরে একটি অজানা আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এবার গ্রামের সবাই সাধুর কাছে প্রার্থনা জানায়। সাধু বরাবরের মতো নির্বিকার ভঙ্গিতে ধ্যান করে যাচ্ছেন। এর পর দিন আরও ভয়ংকর কিছু যে ঘটতে যাচ্ছে তা কারো কল্পনায়ও ছিলনা। গ্রামেরই একটি ছেলে নাম বিজয় ওর বীভৎস মৃত দেহ খুঁজে পাওয়া যায় তাদেরই ঘরের পেছনে। এবারে সবাই সাধুকে অপরাধী ভাবতে শুরু করে। গ্রামের সবাই মিলে সাধুর আস্তানায় ছুটে যায়। হামলে পড়ে সাধুর উপরে। জ্যান্ত পুড়িয়ে দেওয়া হয় তাকে। মৃত্যুর পূর্বে সাধু সবাইকে অভিশাপ দিয়ে যায়। তোরা সবাই ধ্বংস হয়ে যাবি। এরপর সবকিছু শেষ। এর কিছুদিন পরেই গ্রামে কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। অনেকেই গ্রাম ছেড়ে পালায়। বেশিরভাগ শেষ হয়ে যায়। এরপর নদী এসে সবকিছু গ্রাস করে। প্রায় দুইশো বছর নদী এক যায়গায় স্থিতিশীল থাকে। বর্তমান যে স্থানে পার্ক তৈরির জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে সেই স্থান জুড়েই ছিল শ্মশান। বলতে বলতে বৃদ্ধ বাইরে বেরিয়ে যায়।
আমি এতক্ষণ তন্ময় হয়ে তার কথা শুনছিলাম। বাইরে তাকিয়ে দেখি কখন যে ভোর হয়ে গেছে টেরই পাইনি। অজু করে ফজরের নামাজ আদায় করে সাজিদ কে ফোন দিলাম।
সাজিদ বললো সে মনে করেছে আমি চলে গিয়েছি। তাই ও আর আসেনি। ওকে আসতে বললাম।
কিছুক্ষণের মধ্যে সাজিদ এসে হাজির।
সাজিদ কে সবই বললাম। সাজিদ প্রথমে হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। যখন ঘরে গিয়ে বললাম যে আমি এখানে বসেছিলাম আর বৃদ্ধ এখানে বলে যেই যায়গাটায় তাকালাম দেখি সেখানে একটি বেতের লাঠি পরে আছে। দেখে আমাদের দুজনেরই মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। দু'জন তখনই পরিমলের খোঁজে বের হলাম। বিমলের বাপের বাড়ি বলতেই দেখিয়ে দিল। বাড়িতে গিয়ে দেখি ৬০-৬৫ বছরের এক বৃদ্ধ উঠোনে বসে আছে। জিজ্ঞেস করতেই জবাব দিলেন সেই বিমলের বাপ। শুনেই একটা ধাক্কা খেলাম।
সামলে নিয়ে বৃদ্ধের (বিমলের বাপ) আলাপ চারিতায় জানতে পারলাম পরিমল তার ঠাকুর্দার নাম ছিল। তার ঠাকুর্দা কম করে হলেও দেড়শো বছর আগে মারা গিয়েছেন। তার ঠাকুর্দারা ছিলেন পাঁচ ভাই। পরিমল ছিলেন সবার বড়। কিন্তু আমি কেন তার কথা জানতে চাই ইত্যাদি। কোনো ভাবে তাকে বুঝিয়ে বিদায় নিলাম।
সাজিদ কে বললাম, নিশ্চয়ই আমি স্বপ্ন দেখেছি। সাজিদ তার হাতের বহু পুরাতন বেতের লাঠি দেখিয়ে বললো তবে এটা কি?
আমার মাথা ঝিমঝিম করছে!তবে কি সারারাত ভুতের সাথে গল্প করেছি!নাকি হ্যালুসিনেশন!
তবে লাঠি?
মাথা ঠিক কাজ করছেনা।
(সমাপ্ত)
যে এক ঘর হিন্দু এখনো বসবাস করছেন তারা প্রকৃতপক্ষে কার অনুসারী সেটা ঐতিহাসিক গবেষণার বিষয়!
আড়িয়াল খাঁ নদী খসেরহাট ছেড়ে সমিতির হাট যাওয়ার পথে বক্ররেখা বাদ দিয়ে বাঁশগাড়ি যাওয়ার যে সোজা পথ অনুসরণ করেছে -সেই ট্রায়াংগেলের কাছেই এক বিশাল চর রেখে গিয়েছে। যা বর্তমানে 'হোগলা বন' হিসেবেই পরিচিত। এই হোগলা বনের খাস জমিতে উপজেলা পরিষদ থেকে একটি বিনোদন পার্ক করার উদ্যোগ নিয়েছিল। নাম ঠিক করা হয়েছিল 'শেখ রাসেল ডিজিটাল পার্ক'। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান সম্ভাব্যতা যাচাই শেষে সীমানা নির্ধারণ করে সিমেন্টের খুটি (পিলার)গেড়ে বাউন্ডারির কাজ শুরুও করেছিল। এই কাজ করার জন্য যে সকল যন্ত্রপাতি নেয়া হয়েছিল যেমন হ্যামার, ভেকু ইত্যাদির কোনটিই সঠিকভাবে কাজ করছিল না। বন্ধ অবস্থায়ও মেশিন গুলো নিজে নিজেই নদীতে নেমে যাচ্ছিল।
এই প্রস্তাবিত পার্ক থেকে মাত্র পাঁচশ গজ দূরে আমার পুকুরের পাড়ের আড্ডা ঘর (টঙ) এ বসে এই চিত্র নিজের চোখে দেখা। প্রায়ই দেখতাম সকালে কাজ শুরু হয়ে ড্রাইভার এস্কেভেটরে কেবল উঠে স্টার্ট দেবেন এমন সময় চিতকার করে তিনি নেমে আসলেন। আবার দেখা যায় বিকেলে কাজ শেষে সবকিছু স্বাভাবিক রেখে গিয়েছে কিন্তু পরেরদিন ভেকু হয়তো নদীতে নেমে গোসলে নেমেছে।
এটা আমার চোখের সামনেই ঘটতে দেখেছি। তাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস -এখানে নিশ্চয়ই অতিপ্রাকৃত কোনো শক্তি কার্যকর। যে শক্তি চায় না সেখানে কোনো অবকাঠামো গড়ে উঠুক। অবশেষে কর্তৃপক্ষ বুঝতে পেরে কাজ ফেলে পালিয়ে যায়। যন্ত্রপাতি নিয়ে গেলেও খাম্বাগুলো(পিলার) প্রমাণ হিসেবে রয়েগেছে। একদিন অপ্রত্যাশিত ভাবেই আমার কাছে পার্ক করতে না পারার ঘটনা চলে আসে।
আমার পুকুর পাড়ের টঙ ঘরে বসে কথা হয় এই রামচন্দ্রপুর গ্রামের একমাত্র হিন্দু পরিবারের কর্তা বিমলের বাপের পুর্বপুরুষ পরিমলের সাথে। এই লোকটার নাম 'বিমলের বাপ' কেন তাও এক কাহিনি। সাধারণত বাপের নামেই ছেলের পরিচয় হয় যেমন -আলালের ঘরের দুলাল টাইপ। এই ক্ষেত্রে ঘটনা ভিন্ন। আমার মনে হয় বিমলের NID তেও বিমলের পিতার নাম হিসেবে বিমলের বাপ লেখা আছে।
যাইহোক রাত এগোরাটায় কথা হয় ৭৭ বছর বয়সী পরিমলের সাথে।
শুয়ে শুয়ে ফেসবুকিং করছি এমন সময়ে বাইরে কাশির শব্দ শুনে জিজ্ঞেস করলাম কে ওখানে?
কাঁপা কাঁপা গলায় উত্তর পেলাম -আমি পরিমল।
কোন পরিমল?
ওইযে স্কুলের সামনে বাওরের ওপারে বাড়ি -বিমলের বাপেরে চিননা? ঐ বাড়ি।
বিমলের বাপের নাম শুনেছি। চোখে দেখিনি।
বাইরে শুক্লপক্ষের দ্বাদশীর চাঁদ। পৃথিবী চাদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে। সে এক অপার্থিব দৃশ্য।
করোনায় কলেজ বন্ধ আছে। হাতে তেমন কাজ নেই। প্রতিদিনই এখানে সব বন্ধুরা মিলে আড্ডা দেই। কোনো কোনো দিন রাত শেষে ভোর হয়ে যায়। আজ আমি এই মুহুর্তে একা আছি। বন্ধু সাজিদ খাসের হাট বাজারে গিয়েছে এখনি চলে আসবে। আজ দুজনে এখানে থাকব। সারা রাত জোৎস্না দেখব। দক্ষিণে বিস্তীর্ণ এলাকা ফাঁকা। বর্ষার পানিতে চারিদিক থৈথৈ করছে। এমন সময় এই বৃদ্ধকে দেখে কিছুটা আশ্চর্য হলেও মনে মনে খুশিই হলাম। সাজিদ আসা পর্যন্ত গল্প করা যাবে।
আমি তাকে ভেতরে আসতে বললাম। বৃদ্ধ ফোকলা দাঁতের অমায়িক হাসি দিয়ে ভেতরে এসে বসলেন। কথা প্রসঙ্গে সামনের আড়িয়াল খাঁ নদীর চরের হোগলা বনের পার্ক করতে না পারার প্রসঙ্গ উঠালে বৃদ্ধ অনেকটা ক্ষেপে গেল মনে হল। আমার কাছে মুড়ি চানাচুর ছিল বৃদ্ধকে খেতে দিলাম। খাচ্ছি আর গল্প করছি। আবারও জানতে চাইলাম। এইবার বৃদ্ধ শুরু করলেন তার আসল গল্প।
বর্তমান রামচন্দ্রপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশেই তার বাড়ি ছিল। তখন বৃটিশরা কেবল এদেশে এসেছে। কোম্পানির শাসন চলমান সেই সময়ের কথা।
কথা বলে বুঝতে পারলাম বৃদ্ধ অশিক্ষিত নন। মনেমনে ভাবলাম গল্পটা তাহলে খারপ হবেনা।
যাইহোক, তিনি বলেই চলছেন,আমার বয়স তখন কত হবে? ২২ -২৩ বছরের যুবক। তখনকার কথা।
এই পুরো এলাকা তখন হিন্দু অধ্যুষিত। আড়িয়াল খাঁ নদী তখন অনেক বড় ছিল। আমরা এখন যেখানে বসে আছি এর দক্ষিণ-পূর্বে ছিল নদী আর তার পাশেই ছিল বিশাল জঙ্গল। নদীর পাড় ঘেঁষেই ছিল শ্মশান ও কালী মন্দির। মন্দিরের উপরে ছিল বিশাল অশ্বত্থের গাছ। যেন অশ্বত্থ গাছের কোলের ভেতর নিয়ে বসে আছে মা-কালীর মন্দির।
একদিন সন্ধ্যায় কোথা থেকে এসে এক জটা-জুটা ধারি সাধু এসে আস্তানা গাড়েন এই মন্দিরের ঠিক পাশেই অশ্বত্থ গাছের নিচে। পরের দিন সকালে সাধুর কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন জন সাধুর সাথে সাক্ষাৎ করে তাদের আবেদন নিবেদন করতে থাকেন। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার সাধু কারো কাছ থেকেই কিছু নিচ্ছেন। এমনকি খাবারগুলো না। ঐদিন রাতে আমাদের গ্রামে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার ঘটে তা হলো -আমাদের পাশের বাড়ির প্রিতমদের দুধের গাইটি হাড়িয়ে যায়। অনেক খোঁজ করেও পাওয়া যায় নি।
ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি রাত সাড়ে বারোটা বেজে গেছে।
তিনি গল্প বলে যাচ্ছেন।
হঠাৎ দূরে কোথাও রাত জাগা পাখি ডেকে উঠলো 'কুপ,কুপ কুপ'। নিস্তব্ধতায় এতে কোনো পরিবর্তন হলো না। আমি আবারও গল্পে ডুবে গেলাম।
তিনি বলে যাচ্ছেন।
পরের দিন সকালে প্রিতমদের গরুটি তাদেরই ঘরের পেছনে খুজে পাওয়া যায়। কিন্তু গরুটির দেহের আর কিছু বাকি ছিলা না। সম্পুর্ন শরীরটাকে কেউ প্রচণ্ড শক্তিতে টেনে ঘাড় থেকে দুই খন্ড করে রেখেছে। ভেতর থেকে নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে এসেছে।
সবার ভেতরে একটি অজানা আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এবার গ্রামের সবাই সাধুর কাছে প্রার্থনা জানায়। সাধু বরাবরের মতো নির্বিকার ভঙ্গিতে ধ্যান করে যাচ্ছেন। এর পর দিন আরও ভয়ংকর কিছু যে ঘটতে যাচ্ছে তা কারো কল্পনায়ও ছিলনা। গ্রামেরই একটি ছেলে নাম বিজয় ওর বীভৎস মৃত দেহ খুঁজে পাওয়া যায় তাদেরই ঘরের পেছনে। এবারে সবাই সাধুকে অপরাধী ভাবতে শুরু করে। গ্রামের সবাই মিলে সাধুর আস্তানায় ছুটে যায়। হামলে পড়ে সাধুর উপরে। জ্যান্ত পুড়িয়ে দেওয়া হয় তাকে। মৃত্যুর পূর্বে সাধু সবাইকে অভিশাপ দিয়ে যায়। তোরা সবাই ধ্বংস হয়ে যাবি। এরপর সবকিছু শেষ। এর কিছুদিন পরেই গ্রামে কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। অনেকেই গ্রাম ছেড়ে পালায়। বেশিরভাগ শেষ হয়ে যায়। এরপর নদী এসে সবকিছু গ্রাস করে। প্রায় দুইশো বছর নদী এক যায়গায় স্থিতিশীল থাকে। বর্তমান যে স্থানে পার্ক তৈরির জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে সেই স্থান জুড়েই ছিল শ্মশান। বলতে বলতে বৃদ্ধ বাইরে বেরিয়ে যায়।
আমি এতক্ষণ তন্ময় হয়ে তার কথা শুনছিলাম। বাইরে তাকিয়ে দেখি কখন যে ভোর হয়ে গেছে টেরই পাইনি। অজু করে ফজরের নামাজ আদায় করে সাজিদ কে ফোন দিলাম।
সাজিদ বললো সে মনে করেছে আমি চলে গিয়েছি। তাই ও আর আসেনি। ওকে আসতে বললাম।
কিছুক্ষণের মধ্যে সাজিদ এসে হাজির।
সাজিদ কে সবই বললাম। সাজিদ প্রথমে হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। যখন ঘরে গিয়ে বললাম যে আমি এখানে বসেছিলাম আর বৃদ্ধ এখানে বলে যেই যায়গাটায় তাকালাম দেখি সেখানে একটি বেতের লাঠি পরে আছে। দেখে আমাদের দুজনেরই মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। দু'জন তখনই পরিমলের খোঁজে বের হলাম। বিমলের বাপের বাড়ি বলতেই দেখিয়ে দিল। বাড়িতে গিয়ে দেখি ৬০-৬৫ বছরের এক বৃদ্ধ উঠোনে বসে আছে। জিজ্ঞেস করতেই জবাব দিলেন সেই বিমলের বাপ। শুনেই একটা ধাক্কা খেলাম।
সামলে নিয়ে বৃদ্ধের (বিমলের বাপ) আলাপ চারিতায় জানতে পারলাম পরিমল তার ঠাকুর্দার নাম ছিল। তার ঠাকুর্দা কম করে হলেও দেড়শো বছর আগে মারা গিয়েছেন। তার ঠাকুর্দারা ছিলেন পাঁচ ভাই। পরিমল ছিলেন সবার বড়। কিন্তু আমি কেন তার কথা জানতে চাই ইত্যাদি। কোনো ভাবে তাকে বুঝিয়ে বিদায় নিলাম।
সাজিদ কে বললাম, নিশ্চয়ই আমি স্বপ্ন দেখেছি। সাজিদ তার হাতের বহু পুরাতন বেতের লাঠি দেখিয়ে বললো তবে এটা কি?
আমার মাথা ঝিমঝিম করছে!তবে কি সারারাত ভুতের সাথে গল্প করেছি!নাকি হ্যালুসিনেশন!
তবে লাঠি?
মাথা ঠিক কাজ করছেনা।
(সমাপ্ত)
Shuvo, Hasibul hasan, Nasim, Mr.twist, Mr kiddo, Mahmud, Akash and লেখাটি পছন্দ করেছে
Permissions in this forum:
You cannot reply to topics in this forum
|
|