- Onu kothaশুকতারা
- Posts : 56
স্বর্ণমুদ্রা : 1526
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-05-26
Re: বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ
২১.
কারোর হাতের আবদ্ধে বন্ধ হওয়া চোখদুটোর সামনে তখন গভীর অন্ধকার। আগুন্তকঃ মানুষটার হাতের উপর হাত রাখলো টিকলি। বুঝার চেষ্টা চালালো, কে? এরপর খানিক নিচু স্বরে বলল,
'ভাইয়া?'
ওপাশ থেকে মিটিমিটি চাপা হাসির শব্দ পাওয়া গেলো। টিকলি রাগার অভিনয় করে বলল, 'ছাড়ো রাহুল ভাইয়া। আমি বোকা না যে চিনতে পারবো না।'
রাহুল ছেড়ে দাড়ালো এবং তার প্রথম কথাই ছিলো,
'তুই এতো রোমান্টিক কবে হলি রে ভেবলি?'
টিকলি নাক ফুলিয়ে তাকালো। আবার এই জঘন্যতম ডাক! রাহুল বলল,
'বাব্বাহ! কি সুন্দর গানও শিখেছিস আবার।'
টায়রা ভেটকিয়ে বলল, 'আমার বোন গান আগে থেকেই পারে নতুন করে শিখতে হয় না।'
'আরে...ময়নার মা যে। ইশশ..কত্তদিন পর তোর এই চাঁদ বদনখানি দেখলুম। বলি ময়নার বাপ ভালো আছে তো?'
টায়রা চিল্লিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা বাবার কাছে নালিশ ঠুকলো, 'বাবা....কি বলছে দেখো?'
শায়লা আক্তার এগিয়ে এলেন। রাহুলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, 'আহারে...আমার বাচ্চাটা। কতদূর থেকে এলো আর তোরা কি শুরু করলি হ্যাঁ? '
টায়রা বিরবির করে বলল, 'এখন আমরা শুরু করলাম? মানে ভাতিজার কোনো দোষ কোনোকালেই তার চোখে পরবে না।'
ফুফুকে এক হাতে জড়িয়ে নিয়ে রাহুল বলল, 'ঠিক বলেছো ফুফু। দেখো তো কেমন শুরু করেছে। তোমার মেয়ে তার ফাটাবাঁশের গলায় চিল্লিয়ে তোমার এই ভোলা ভালা বাচ্চাটার কান স্তব্ধ করে দিচ্ছে।'
টায়রা অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, 'আমি?'
টিকলি বিরক্ত নিয়ে উঠে পরলো বেতের চেয়ারটা থেকে। নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বলল,
'আমার ঘর থেকে ভিড় কমাও।'
টিকলি ঘরে গিয়ে গিটার রেখে আবার বারান্দায় আসলো। সবাই চলে গেছে। শুধু রয়েছে টায়রা, নিভা আর রাহুল রয়ে গেছে। নিভা এক কোণায় দাঁড়িয়ে ছিলো। টায়রা হাসছিলো রাহুলের কোনো মজামাখানো কথায়। টিকলি কিছুক্ষণ ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকলো।
এই মেয়ের কারোর সাথে উচ্চ গলায় ঝগড়া করতেও সময় লাগে না আবার হেসে খেলে কথা বলতেও সময় লাগে না। টিকলি নিভার কাধ ধরে বলল,
'রাহুল ভাইয়া এদিকে তাকাও তো।'
রাহুল হাসতে হাসতেই তাকালো। বলল, 'কি তাকাবো তোর দিকে? তোর দিকে ওতো তাকানোর কি আছে?'
টিকলি তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকলো মিনিটখানিক। এরপর বলল,
'এখানে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর তুমি একটু কুশল বিনিময় করবে না? মেয়েটা একা একা বোর হচ্ছিলো আর তোমরা দুজন হে হে করে একা একা হেসে যাচ্ছো?'
এক পলক অবহেলায় নিভার দিকে তাকিয়েই চোখ সরালো রাহুল। বলল, 'আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন?'
নিভা ইতস্তত বোধ করে জবাব দিলো, 'ওয়ালাইকুম আসসালাম। ভালো আছি। আপনি?'
'ভালো।' রাহুল একবার টিকলির দিকে তাকিয়ে আবার টায়রার দিকে তাকালো। টায়রা নিভার কাছে এগিয়ে এসে বলল,
'কিরে মুখটা এতো শুকনো লাগছে কেনো? আর ভাইয়া এগুলো কুশল বিনিময় হলো। আমি ইন্ট্রডিউস করিয়ে দিচ্ছি। ও হলো নিভা। আমাদের খুব ক্লোজ ফ্রেন্ড। আর নিভা উনি হলেন আমাদের মামাতো ভাই।'
নিভা এক পলক চাইলো। চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। হঠাৎ রাহুলও তাকালো। নিভা চোখ সরিয়ে নিলো নিভৃতে।
_____________________________
প্রচুর পড়াশোনা করছে আর্দ্র। নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে সে পড়াশোনায় মজে রয়েছে দিন-রাত। সামনে BJS পরীক্ষা। অথচ আর্দ্রর মনে হচ্ছে তার কিছুই পড়া হয়নি। রীতিমতো শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হওয়ার জোগাড়। আদর ঘরে ঢুকলো। রাত দশটা বাজে। আর্দ্র অবাক হওয়া গলায় বলল,
'এতো তাড়াতাড়ি? সূর্য কোনদিকে উঠলো?'
'আগে দেখে আয় চাঁদ কোনদিকে উঠেছে। আর তোর আমার ঘরে কিরে? খাস ও আমার ঘরে পড়িস ও আমার ঘরে ফোনও টিপিস আমার ঘরে শুধু গোসল টা নিজের ওয়াশরুম আর ঘুমানোর সময় নিজের বেডে ঘুমাস। আশ্চর্য!'
ভাইয়ের এই ঘরটা আর্দ্রর ভীষণ প্রিয় এবং ভাইকে নিরব ভাবে ভীষণ মিস করে বলে আর্দ্র প্রায় সবসময় ভাইয়ের ঘরে থাকে। এই ঘরে আদর আদর সুবাদ। আর্দ্রর ভালো লাগে। তার ইচ্ছে করে সবসময় ভাইয়ের কাছাকাছি থাকতে। ভাই সাথে থাকলে দুনিয়ায় কোনোকিছু তার কঠিন মনে হয়না বিরক্ত লাগে না নিষ্প্রয়োজন কিংবা নিষ্প্রভ মনে হয়না। ভাইয়ের কাছে সব সমস্যার সমাধান থাকে। ভাইয়ের এই ঘরটাতে পড়তেও ভালো লাগে৷ যদি ভাইয়ের মতো ব্রিলিয়ান্ট হওয়া যায় আর কি! বইয়ে চোখ বুলাতে বুলাতে আর্দ্র গলা খাকারি দিয়ে বলল,
'এই ঘরটা বাবা আমায় দিতে চেয়েছিলো। তুমি জোর করে নিছো। তাই সেই শোধ তুলতে আমি সবসময় এখানে থাকি।'
'থাপ্পড় দিয়ে দাঁত কপাটি সব ফেলে দিবো। মিথ্যাবাদী একটা। এতো চাপা কই থেকে শিখছস? চাপাবাজ।'
আদরের কথা কানে যেতেই পড়া বন্ধ হলো আর্দ্রর। মিনিট দুয়েক গলায় বেজে রইল চাপাবাজ শব্দটি। চোখের পলক পড়তেই সামনে ভেসে উঠলো টায়রার ঝগড়াটে মুখখানা আবার কখনো গাল ফুলিয়ে থাকার মুখ তো আবার উচ্চ হাসিতে মাতোয়ারা প্রাণবন্ত সেই নারীর মুখচ্ছবি। আর্দ্র টপাস করে চোখ খুলল। জোর গলায় বলল,
'একদম চাপাবাজ বলবে না। আমি চাপাবাজ না। আমি অতি শান্ত শিষ্ট ভদ্র নিরীহ একটা বাচ্চা।'
আদর আড়চোখে তাকিয়ে বিরবির করতে করতে ওয়াশরুমে ঢুকলো, 'নিজের ঢোল নিজেই পিটায়।'
ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই দেখলো আর্দ্র ফোন নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে। চোখ পাকিয়ে আদর বলল, 'আমার ফোনে তোর কি? আর লক জানোস?'
আর্দ্র হে হে করে হেসে বলল, 'সেদিন খুলার সময় দেখছিলাম।'
'কি খুঁজোস ফোনে?'
খুঁজায় ব্যস্ত হয়ে আর্দ্র জবাব দিলো,
'ওই যে টিকলির নাম্বার। কোথায়? ডিলিট করে দিয়েছো নাকি?'
'হুম। রেখে কি লাভ?'
আর্দ্র ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলল, 'কেনো ডিলিট করেছো?'
আর্দ্রর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে উল্টে আদর প্রশ্ন করলো,
'তুই কি কাউকে কখনো ভালোবেসেছিলি আর্দ্র?'
ঠোঁট উল্টিয়ে আর্দ্র জবাব দেয়, 'ভালোবাসা আবার কি ভাইয়া? এসব আমার আসে না। আমি অতি ভদ্র একটা পোলা। তুমি আমাকে পাকায় ফেলতাছো। এসব ভালোবাসা টালোবাসা আবার কি হ্যাঁ? আমি ছোট মানুষ না?'
আদর বিরক্তিতে বলল, 'দূর ড্রামাবাজ, তুই বাইর হ তো আমার রুম থেকে।'
'নাহ যাবো না। আমি এখন পড়বো।'
'যা। তাড়াতাড়ি যা। আর গিয়ে মাকে বল খাবার দিতে।'
______________________________
আদরকে না দেখার আজ ত্রিশ দিন। ক্যালেন্ডারের পাতায় মার্ক করে রাখলো টিকলি। লাল সাইনপেন দিয়ে মার্ক করা বৃত্ত টা জ্বলজ্বল করে টিকলির দুঃখ জানান দিচ্ছিলো। টিকলির ফোনের দিকে তাকালো। ফোনের লক স্ক্রিন খোলার পর ই হোম ওয়ালপেপারে আদর আর তার ছবি ভেসে উঠলো। ছবিটা অপ্রত্যাশিত ভাবে তুলে ফেলা হয়েছিলো চোয়াখালী বনে হরিণ দেখতে গিয়ে। একপাশে আদরের মুখ আরেকপাশে টিকলি মাঝখান দিয়ে দেখা যাচ্ছে হরিণরা ঘাটে জল খাচ্ছে।
টিকলি ফোনের উপর ছবিটায় হাত বুলালো। একবার দুইবার বারংবার। কিছু স্মৃতি তাজা করে রাখছে আদরকে। হঠাৎ টিকলির মাথায় টোকা পরলো। টিকলি তৎক্ষণাৎ ফোন অফ করে দিলো। পেছনে তাকাতেই দেখলো রাহুল দাঁত কেলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। টিকলি ভয় পেয়ে তাকালো। রাহুল ভাইয়া কি কিছু দেখে ফেলল?
'কিরে ভেবলি? ফোনে কি দেখিস? বয়ফ্রেন্ডের ছবি?'
টিকলি ফুস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। বুকে হাত দিয়ে দম নিয়ে রাগান্বিত ভাবে বলল,
'ভেবলি ডাকবা না আমাকে।'
'ভেবলি ভেবলি ভেবলি। তুই তো ভেবলি ই।'
রাহুল চোখ উল্টে বলল। এ বাড়িতে রাহুল আছে দুইদিন ধরে। টিকলি থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে থাকলো। মাথা ব্যথা করে উঠলো হঠাৎ। রাহুল জিজ্ঞাসা করলো,
'তোর না মাথা ব্যথা? কমেছে?'
মাথায় এক হাত রেখে টিকলি জবাব দিলো, 'নাহ ভাইয়া।'
'একটা ডাক্তার দেখানো দরকার।'
প্রায় পাঁচ সাতদিন থেকে টিকলির জোরালো মাথা ব্যথা। ব্যথা আগেও হতো তবে অল্প। কিন্তু ইদানীং প্রচুর মাথা ব্যথা করছে। থাকতে না পেরে দুদিন আগে মাকে বলেছে। শায়লা আক্তার বলেছেন,
'আর দুটো দিন দেখ। যদি মাথা ব্যথা না কমে তাহলে ডাক্তার দেখাবো।'
টিকলি রাহুলের কথার উত্তরে বলল, 'দেখি। আর আমার ঠান্ডার সমস্যা প্লাস চোখের সমস্যা না? এর জন্য হয়তো মাথা ব্যথা করে।'
'হুম। তবুও ডাক্তার দেখা। মাথার ব্যপার হেলাফেলা করতে নেই।'
রাহুল চলে যেতে ধরলো। টিকলি নিচু গলায় বলল,
'রাহুল ভাইয়া, আজকে মনে হয় মামা আসবে।'
রাহুল পেছন ঘুরে ভ্রু কুচকে তাকালো। গম্ভীর গলায় বলল, 'আমি যখনি আসি তখনি তার আসতে হয়?'
টিকলি মাথা নিচু করে রাখলো। গমগমে মুখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো রাহুল। টিকলি জানে মামা যতদিন এই বাড়িতে থাকবে রাহুল একবারের জন্যেও ঘর থেকে বের হবে না। বেচারা মামা টা কত কষ্ট করে আসে শুধু একমাত্র ছেলেকে দেখার জন্য। আর ছেলে তার......। টিকলি আর ভাবলো না। জোরালো দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারো ক্যালেন্ডারে দৃষ্টি স্থাপন করলো।
,
রুহুল হক চা খাচ্ছিলেন। কাপে চুমুক দেওয়ার আগেই এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু খুঁজলেন কিন্তু পেলেন না। টিকলি টায়রা সামনে বসে মামাকে দেখছিলো। মায়ের এই একটা মাত্র বড় ভাই টিকলি টায়রাকে ভীষণ আদর করে। মজা করে। তবে বেশ গুরুগম্ভীর। মায়ের আর ভাই বোন না থাকায় এই একমাত্র ভাইয়ের প্রতি তার দরদের শেষ নেই। আদরের কোনো কমতি নেই। চায়ের কাপ টা শব্দ তুলে টেবিলের উপর রেখে রুহুল হক বললেন,
'টিকলি নাকি অসুস্থ? '
টিকলি ইতস্তত করে বলল, 'কই মামাজান নাতো।'
রুহুল হক কপালে ভাজ ফেলে বলেন, 'তোমার মা বলল যে, মাথা ব্যথা নাকি?'
'হ্যা মামাজান তা করে।'
'চলো তবে ডাক্তার দেখিয়ে আনি৷ আমি এজন্যই আরো এসেছি।' এদিক ওদিক আড়চোখে তাকাতে তাকাতেই রুহুল হক জবাব দিলেন।
টায়রা শয়তানি করে ভাবুক গলায় বলল, 'তাই মামাজান? কিন্তু বাবাও তো টিকলিকে ডাক্তার দেখাতে পারতো।'
রুহুল হক হকচকিয়ে বললেন, 'আরে তোমার বাবা পারবে না। আমার কাছে একটা ভালো নিউরোলজিস্ট আছে। ইয়াং ডাক্তার। বেশ ভালো সম্পর্ক আমার তার সাথে। কাল নিয়ে যাবো। আজ বলে রাখছি।'
টিকলি মাথা নাড়ালো। কিছু বলল না। মাথা ব্যথা এতোটাই তীব্র যে একটু পর পর ই ঝিলিক মেরে উঠে। চুল টুল সব টেনে ছিড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। চিপের দু'পাশে অসহনীয় জ্বালা পোড়া। রুহুল হক দু'তলার বাম কোণার ঘরের দিকে তাকিয়ে বললেন,
'বাড়িতে আর কেউ নেই?'
টায়রার আবারো ফাইজলামি জবাব, 'আমাদের ছাড়া আর কাকে লাগবে আপনার মামাজান?'
রুহুল হক মনে মনে বিরক্ত হলেন। টিকলি টায়রাকে ইশারায় চুপ করতে বলে মামার দিকে তাকিয়ে বললেন,
'রাহুল ভাইয়া আছে মামাজান। আপনি যেই ঘরটায় তাকিয়ে আছেন সেই ঘরটাতেই আছে।'
রুহুল হক টিকলির দিকে একবার তাকিয়ে উঠে চলে যেতে লাগলেন নিজের ঘরের দিকে। আর যাওয়ার আগে বলে গেলেন,
'রাগ মানুষের ধ্বংসের কারণ। রাগ মানুষের দূরত্বের কারণ। রাগ মানুষের সম্পর্ক ভাঙার কারণ। রাগ ভুল বুঝাবুঝির কারণ। আর ভুল বুঝাবুঝি ভীষণ মারাত্মক, ধারালো এবং হিংস্র।'
চলবে
sandipchandradas, Emran sumon, Sheikh shohid, Md manik, Sadman alom, Nazim khan, Faria oishy and লেখাটি পছন্দ করেছে
- Onu kothaশুকতারা
- Posts : 56
স্বর্ণমুদ্রা : 1526
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-05-26
Re: বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ
২২.
'আসবো ইয়াং ম্যান?' পুলকিত হাসি দিয়ে বলল রুহুল হক।
মাথা উঠিয়ে সামনের পানে দৃষ্টি আবদ্ধ করে আদর ব্যস্ত কণ্ঠে বলল, 'আসুন আসুন। শরীর স্বাস্থ্য ভালো তো?'
চেয়ার টেনে বসতে বসতে রুহুল হক জবাব দেন,
'একদম দারুন! তা তোমাকে কাল রাতে ফোন করেছিলাম আমার ভাগ্নি...'
'জি মনে আছে। তা পেসেন্ট কোথায়?'
'পেসেন্ট ওইতো একটা ফোন এলো, বলল মামাজান আপনি যান আমি আসছি। আমার খুব আদরের বড় ভাগ্নি বুঝলে? খুব বুজুর্গ, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নারী, বিচক্ষণীয়। ভালো করে মাথার চিকিৎসাটা করে দিও তো ওর ইয়াং ম্যান।'
আদর হাসলো। চেম্বারের দরজায় খটখট শব্দ হলো। দু'একবার শব্দ হওয়ার পর দরজাটা টেনে খুলে ঢুকলো কেউ। চেম্বারের এক কোণায় থাকা জানালা মাড়িয়ে ঘরে ঢুকে পরলো ঠান্ডা হাওয়া। আগুন্তক নারীটির চুল উড়ে অবলীলায় গন্ধ মিশে গেলো হাওয়ায়। কালো টেবিলটার উপর থেকে কয়েকটা পাতা উড়ে চলে গেলো দূরে কোথাও। চারিপাশ স্তব্ধ অনুত্তর নিঃশব্দ। পেশিতে টান টান উত্তেজনা। দীর্ঘ একমাস পর চেনা মুখটির দর্শন। অনুভূতি স্থিত হয়ে রইল রক্তে। আদর নিজের জন্য বরাদ্দকৃত চেয়ারটা থেকে উঠে দাড়িয়ে পরেছিলো অনেক আগে।
টিকলি এলোমেলো চোখে ক্লান্ত, তৃষ্ণার্ত, চমকানো হৃদয়ে তাকিয়ে দেখছিলো। আদর বিহীন অনুর্বর বুক-জমিনে বন্যার পানিতে পলি মাটি জমলো। উর্বর হলো ভূ-খণ্ড। এরপর শুধুই চলল নিস্তব্ধতা। চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকা। এতোদিন দেখা না হওয়ার অপরাধে দিনগুলোর প্রতি অভিমানের ছোঁয়া। চাপা নিঃসৃত নিঃশ্বাসের ভারে বুক উত্তাপ। রুহুল হকের কথায় ঘোর ভাঙলো দুজনার। আদর ছিটকে বসে পরলো। এরপর উদভ্রান্তের মতো তাকিয়ে রইল টিকলির ওই ফুলের পাপড়ির ন্যায় বদনখানার দিকে। টিকলি দুরুদুরু বুকে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এসে বসলো। রুহুল হক বললেন,
'তোমার এই রোগী প্রচুর মাত্রায় বিজি বুঝলে? সারাক্ষণ সে ফোনের উপরই থাকে।'
টিকলি তার এতো দিনের... এতো বছরের ব্যক্তিত্ব ভুলে বেহায়ার মতো তাকিয়ে ছিলো আদরের দিকে। টিকলিকে দেখে আদরের সন্তুষ্ট শীতল চোখ জোড়া আবার অসন্তুষ্ট হয়ে উঠলো। ভ্রু কুচকে তাকালো। প্রশ্ন করতে গিয়েও করলো না। যতই হোক পেসেন্টের সাথে তো কেউ আর গালগল্প করবে না। যথাযথ গাম্ভীর্যপূর্ণ গলায় বলল,
'কি সমস্যা?'
কোনো উত্তর পাওয়া গেলো না। রুহুল হক এবার জিজ্ঞেস করলেন, 'টিকলি বলো তোমার কি কি সমস্যা?' তবুও নো রেসপন্স। টিকলির অমনোযোগীতায় টিকলির দিকে চোখ তুলে আবারো তাকালো আদর। এখনো টিকলির দৃষ্টি তার উপর সীমাবদ্ধ। সেই হৃদয় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, আচ্ছন্ন দৃষ্টির দিকে তাকাতেই আদর দিশেহারা হয়ে গেলো। মনেতে বাজতে থাকল একটাই প্রশ্ন,
'এতো সুন্দর মেয়েটা কেনো সারাদিন ফোন কলে বিজি থাকে?'
মনের প্রশ্নে আদর হেসে জবাব দিলো, 'আরে সুন্দর দেখেই তো ফোন কলে বিজি থাকে।'
আদর চোখ সরিয়ে নিয়ে নিজে নিজেই জিজ্ঞেস করলো, 'কি? মাথা ব্যথা?'
টিকলি সম্ভিত ফিরলো। ঘোরমাতাল রাজ্য থেকে বেরিয়ে এসে মাথা নিচু করে মৃদু নাড়ালো। আদর কাগজে কিছু লিখতে লিখতে বলল,
'কোথায় কোথায় ব্যথা?'
'হৃদয়ে, মনে, বুকে।'
আদর থতমত খেয়ে তাকালো। রুহুল হক অবাক চোখে বললেন,
'কি বলছো এসব?'
দাঁত দিয়ে জিব কামড়ে ধরে চোখ খিচিয়ে বন্ধ করলো টিকলি। কেশে উঠলো কয়েকবার। মিথ্যা কথা সাজিয়েও বলতে পারলো না। তবুও অনেক কষ্টে কাঁপাকাঁপি করে বলল,
'মুভির ডায়লগ। সকালে মুভি দেখেছিলাম তো। সেটাই মাথায় ঘুরছে।'
'এমন মুভি আছে?' নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলো রুহুল হক। তৎক্ষণাৎ আদর বলল,
'মাথার কোন সাইডে ব্যথা হয়? কখন হয়? সারাক্ষণ?'
বেশ চিন্তিত শোনা গেলো আদরের গলা। টিকলি বলল,
'নাহ সারাক্ষণ না। যখন ঠান্ডা লাগে তখন বেশি ব্যথা হয়। কপালের দিকটা। নাকের আশেপাশের জায়গাগুলো আর চিপের জায়গাগুলোতে জ্বালাপোড়া।'
আদর লিখতে লিখতেই জবাব দিলো, 'কয়েকটা টেস্ট করিয়ে আনুন। ব্লাড টেস্ট, ইউরিন টেস্ট, সিটি স্ক্যান আর এক্স-রে। সিটি স্ক্যান এবং এক্স-রে এর মধ্যে একটা করালেও চলবে।'
রুহুল হক দাড়াতে দাড়াতে বললেন, 'নাহ, দুটোই করাই।'
'আচ্ছা।'
ঘড়ি দেখে নিয়ে রুহুল হক বললেন, 'এখন তো লাঞ্চ টাইম হয়েগেছে। অলমোস্ট দুটো বাজে। লাঞ্চ করবে না?'
'জি করবো।'
'তাহলে চলো আজ লাঞ্চটা একসাথেই করি। টেস্ট গুলো করিয়ে পাশের রেসটুরেন্টে বসছি। আমি তোমাকে ফোন দিবো।'
আদর হালকা হেসে বলল,
'আচ্ছা।'
,
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত জাকজমকপূর্ণ রেসটুরেন্টের বড় সোফাটায় বসে ছিলো টিকলি এবং রুহুল হক। অপরপাশে বসেছে আদর। ওয়েটারকে অর্ডার দেওয়া শেষ হতেই রুহুল হক কপালে কিছু ভাঁজ ফেলে বললেন,
'রিপোর্ট পেতে তো অনেক সময় লাগবে তাই না? একটু আগে করা যায়না। মানে টাকা-পয়সা যাই লাগুক রিপোর্টগুলো আর্জেন্ট পেলে ভালো হতো।'
আদর সৌজন্যে হেসে বলল, 'আমি আসার সময় কল করে এসেছি। ওরা তাড়াতাড়ি করে দিবে। এক ঘণ্টার সময় চেয়েছে।'
'ওহ অনেক ধন্যবাদ ইয়াং ম্যান।'
আদর মাথা ঝাঁকিয়ে মৃদু হাসলো। রুহুল হক আবারো কিছু বলতে চাইলেন। পকেটে ফোন বাজার বাজখাঁই শব্দে ভ্রু কুচকে থেমে গেলেন। এক্সকিউজ মি বলে সে উঠে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে ফোন রিসিভ করলেন।
এদিকে জড়তা-সংকোচে কাটা হয়ে বসে রইল টিকলি। এদিক ওদিক তাকিয়ে আড়চোখে একবার টিকলির দিকে তাকিয়ে সোফায় হেলান দিয়ে বসলো আদর। চোখ ঘুরতে লাগলো অপরূপ মহারানীর সারামুখ জুড়ে।
আদরের চোখের নিশানা যে তার উপর টিকলি তা ঠিক বুঝতে পেরেছে। অস্বস্থিতে জড়োসড়ো হয়ে বসতেই তার মনে হলো কথা বলা দরকার। যেই আদরের সাথে কথা বলার জন্য মুখ খুলল ওমনি খেয়াল করলো তার গলা দিয়ে আওয়াজ আসছে না। চোখ মেলে তাকানো যাচ্ছে না সামনের মানুষটার দিকে। দীর্ঘ আকাঙ্ক্ষার পর অপ্রত্যাশিত ভাবে মানুষটাকে পাওয়ার পর গলার স্বর বন্ধ হয়ে গেছে। টিকলির ভারী অসহায় লাগলো নিজেকে। অনেক কথা বলার বাকি। অনেক কিছু বুঝানো বাকি। কত কিছুই না ভেবে রেখেছিলো! যেদিন আদরের সাথে দেখা হবে সেদিন এই করবে সেই করবে। অথচ আজ গলার স্বরটাই তার সাথে বেঈমানী করছে।
আদর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলো টিকলিকে। অক্ষিপট ঘুরছিলো টিকলির টিকলো নাকে, চশমায় ঘেরা চোখে, ছোট ছোট গর্তের অধিকারী গালের খাঁজে, গোলাপের পাপড়ির ন্যায় মসৃণ ঠোঁটের ভাঁজে। স্কাপে ঢেকে যাওয়া টিকলির অর্ধাংশ ঘন কালো রেশমি কেশগুলো দেখতে আদরের অযথাই ভালো লাগে। আদরের দেখার মাঝেই হঠাৎ টিকলি অপ্রকাশিত চোখে তাকালো। আদর সেখানেই স্থবির হয়ে রইল। কথা বলার ভাষা খুঁজে পেলো না। এতোক্ষণ মনে মনে কথা সাজালেও এই মুহুর্তে এসে সব এলোমেলো হয়ে গেলো। ইশশ...কি অসহায় দুটি চোখ! স্বপ্নমুখী সমুদ্রবিলাশী চোখ গুলো খালি দেখার আদরের ভারী ইচ্ছা। চশমার আড়ালে চোখ দুটো পড়তে পারেনা আদর। কবে এই মেয়েটার খালি চোখ দেখবে? কবে পড়তে পারবে?
আদরের ভাবনার ঘোর কাটলো রুহুল হকের কথায়, 'সরি ইয়াং ম্যান।'
আদর হকচকিয়ে গিয়েও সামলে নিলো নিজেকে। ভদ্রতার সহিত বলল,
'ইটস ওকে মি.রুহুল হক।'
'আচ্ছা এবার তো আমাকে আংকেল চাচা মামা কিছু ডাকতে পারো নাকি? আমাদের মধ্যে তো শুধু ডাক্তার পেসেন্ট সম্পর্ক না। ডাক্তার পেসেন্টের ফর্মালিটিপূর্ণ সম্পর্ক হলে কি আর এই রেসটুরেন্টে বসে একসাথে লাঞ্চ করতাম?'
লোকটা বড্ড ঠোঁটকাটা। আদর বড্ড লজ্জিত এবং অপমানিত বোধ করলো। সত্যি দোষটা তার। এতো বড় মানুষটার নাম ধরে ডাকা একদম উচিত হয়নি। আস্তে করে আদর বলল,
'সরি মামা।'
আদরের কথায় টিকলি অবাক হয়ে তাকালো। আদরও থতমত খেয়ে গেলো। চোরাচোখে তাকালো রুহুল হকের দিকে। খাবার এসে গেছে। প্লেট এগিয়ে দিতে দিতে হাসি হাসি মুখ করে রুহুল হক বললেন,
'মামাই ডেকো। মামা ডাকটা আমার ভীষণ পছন্দ। আমি ভাবতাম একমাত্র আমার ভাগ্নিদের মুখেই মামা ডাকটা অতুলনীয় লাগে। কি সুন্দর করে ওরা ডাকে মামাজান! কিন্তু তোমার মুখে ডাকটা শুনে ভুল ভাঙলো। বেশ ভালো লাগলো।'
_____________________________
রিপোর্টগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখছিলো আদর। কিছুক্ষণ দেখার পর ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করলো,
'আপনার ঠান্ডার সমস্যা আছে? এলার্জি?'
মাথা নিচু করেই টিকলি জবাব দেয়, 'জি।'
'অনেক সমস্যা? হঠাৎ সর্দি লাগে নাকি মাঝে মাঝেই?'
'জি। প্রায় প্রতিদিনই আমার ঠান্ডা লাগে। ঠান্ডা জাতীয় কিছু খেলে কিংবা অসময়ে গোসল করলে ধুলোবালিতে, এলার্জি জাতীয় কিছু খেলে। ঠান্ডার সাথে অসহ্য মাথা ব্যথা। আগে খুব কম হতো। ইদানীং মাথা ব্যথা বেড়েছে।'
'কিন্তু নিঝুম..... ' আদর থেমে গেলো। টিকলি সন্তুষ্ট চোখে তাকালো আদরের দিকে। যাক, মানুষটা তবে তাকে ভুলেনি। মনে আছে সব।
রুহুল হক বললেন, 'সিরিয়াস কিছু?'
চেয়ারে শরীর ঠেসে দিয়ে হাতের দু'আঙ্গুলে কলম ঘোরাতে ঘোরাতে আদর জবাব দিলো,
'নাহ বেশি সমস্যা হয়নি। আসলে উনার সাইনোসাইটিস এর প্রবলেম ধরা পরেছে।'
রুহুল হক একটু ভীত গলায় বললেন, 'ঠান্ডা থেকেই?'
'নাহ দীর্ঘমেয়াদি হাঁচি কাশি কিংবা নাক বন্ধ থাকলেই যে সাইনোসাইটিস হয় এমন কোনো কারণ নেই। তবে ঠান্ডার কারণে মাথা ব্যথা করবেই এবং নাকের আশেপাশে ব্যথা করবে। মুখের হাড়ের ভেতরে চারজোড়া যে ফাঁপা বায়ুপূর্ণ জায়গা থাকে সেগুলোকে সাইনাস বলে। আর এই সাইনাসের মধ্যে জ্বালা পোড়া শুরু হলে তাকে সাইনোসাইটিস বলে। সাইনাস প্রদাহ হলেই মাথা ব্যথা এবং ঘন ঘন সর্দি লাগে।'
'ভালো হবার উপায়?'
'বলতে গেলে মাইগ্রেন এর ম্যথা সাইনোসাইটিস এর ব্যথা যাদের আছে তাদের নিজ থেকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। নিয়মিত ওষুধ খেলে আস্তে আস্তে কমে যাবে। তবে অনেকের একবারে উপশম নাও হতে পারে তবে কমে যায়।'
আদর প্রেসক্রিপশন লিখতে বসলো। রুহুল হকের আবার ফোন এলো। রুহুল হক বললেন,
'সরি ইয়াং ম্যান। আসলে আমার মেয়ে রুমকি পরে গিয়ে ব্যথা পেয়েছে তাই বারবার ওর মা ফোন করছে। এক্সকিউজ মি। প্রেসক্রিপশন টা নিয়ে এসো টিকলি।'
টিকলি অবাক হয়ে কিছুক্ষণ মামাজানের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। রুমকি পরে গেছে। ব্যথা পেয়েছে। অথচ মামার কোনো হেলদোল নেই। কিন্তু এখানে রাহুল ভাইয়া থাকলে মামা নিশ্চয়ই পুরো হসপিটাল মাথায় তুলে ফেলতেন।
প্রেসক্রিপশন লিখে আদর টিকলির দিকে এগিয়ে দিলো। টিকলি চমকে ফিরে তাকিয়ে প্রেসক্রিপশন টা হাতে তুলে নিলো। আদর কথা বলতে চাইলো৷ কিন্তু বারংবার কথারা দলা পাকিয়ে গলায় আটকে গেলো। হঠাৎ আদরের কিছু মনে পরলো। প্রেসক্রিপশন টা ছিনিয়ে নিয়ে সে একটা আনস্মার্ট কাজ করে বসলো। টিকলি অবাকের উপর অবাক হলো। আদর প্রেসক্রিপশন টা ভাঁজ করে আবার ফেরত দিলো। টিকলি নিদারুণ বিস্ময়তায় দুনিয়াদারী ভুলে গেলো। মিনিট দুয়েক থম মেরে বসে থেকে ঘোরের মাঝেই উঠে দাড়ালো। টলমল পায়ে দরজা পর্যন্ত যেতেই আদর দাঁড়িয়ে ছোট করে বলল,
'প্রেসক্রিপশন কারোর হাতে দিবেন না।'
বিস্ময়তা আকাশ ছুঁলো। চারিপাশ নিস্তব্ধ পাতালপুরীতে পূর্ণ হল। শূন্যে ভেসে উঠলো আশেপাশের সব। কেবল অস্তিত্ব বিরাজমান আদর টিকলি দুটি প্রাণহৃদয়ের। হাতের প্রেসক্রিপশনের দিকে একবার তাকিয়ে ঢোক গিলল টিকলি। সে কথা বলতে পারছে না। আদরের সাথে একান্ত সময়টুকুতেই তার গলার স্বর আসছে না। বেঈমানী করছে। আহ! কষ্ট! প্রচুর কষ্ট! টিকলির কান্না পেয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ আদরকে অবাক করে দিয়েই এক দৌড়ে সে বেরিয়ে গেলো।
আদর স্বাভাবিক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর টেবিলে জোরে বাড়ি মারলো। শূন্যে দীর্ঘশ্বাস ফেলে দাঁড়ানো থেকে চেয়ারে বসে পরলো। হেলান দিলো। চোখ বন্ধ করলো। এরপর মৃদুমন্দ কাঁপন কণ্ঠস্বরে হতাশ নিঃশ্বাসে বলে উঠলো,
"আজও সরি বলা হয়ে উঠলো না। দেখা হয়েও যেনো দেখা হলো না। কথা হয়েও যেনো কথা হলো না। দুজন দুজনার দিকে তাকিয়েও যেনো তৃষ্ণা মিটলো না। চোখের আঁশ মিটলো না। হৃদয় পূর্ণ হলো না। বুকে ঢেউ বইলো না। আজ যেনো চোখে চোখ রেখেও রাখা হলো না।"
চলবে
sandipchandradas, Emran sumon, Sheikh shohid, Md mamun, Md sourav, Khalid sheikh, Mannat tasrin and লেখাটি পছন্দ করেছে
- Onu kothaশুকতারা
- Posts : 56
স্বর্ণমুদ্রা : 1526
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-05-26
Re: বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ
২৩.
স্কুটি নিয়ে বের হয়েছিলো টায়রা। টিয়া রঙের স্কুটিটা অনবরত ঘুরে চলেছিলো ঢাকা শহরের এ গলি ও গলি। একটা এদোঁ সরু গলির মুখে যেতেই অনাকাঙ্ক্ষিত বশত অন্য কোনো এক মোটরসাইকেলের সাথে বেজে গেলো টায়রার স্বাদের স্কুটি। নাও এবার কেল্লাফতে! উলটে পরলো স্কুটিসহ দু পাশের দুজনেই। টায়রা সামনের দিকে না তাকিয়েই তার বাজখাঁই গলায় চিতকার করে উঠলো,
'এই কোন শালা? চোখে দেখিস না?'
বলতে বলতেই সামনে তাকালো। বাইক নিয়ে পরে যাওয়া ছেলেটাকে দেখে মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলল। আকস্মিক বোবায় ধরলো তাকে। নিদারুণ কিছু অবাকতা, নিস্তব্ধতা, চমকানি দু'জোড়া প্রগাঢ় আঁখি নিয়ে তাকিয়ে থাকলো দুজন দুজনার দিকে।
আর্দ্র এই এতো বড় দামড়া বাইকের নিচে পরে গিয়েও ব্যথা ভুলে গেলো। সম্মুখের এই বিরক্তিকর নারীটির দিকে তাকিয়ে থাকলো নিমিত্তে। ফেলল না একবারো চোখের পাতা। শুধু তাকিয়েই রইল। এর মাঝে বিরবির করে বলল,
'আমি কি স্বপ্ন দেখছি?'
আর্দ্র বিরবির করা সম্পন্ন করতে পারলো না। তার আগেই অসম্পন্ন গলায় চেঁচিয়ে উঠলো টায়রা,
'আপনি? তাই তো বলি দিন-দুপুরে অন্ধ মানুষকে রাস্তা-ঘাটে কে বাইক চালাতে দেয়? কতটুকু ব্যথা দিলেন আপনি আমায়।'
চিল্লিয়ে যেনো গলা ছিড়ে ফেলবে টায়রা। আর্দ্র ব্যথায় অনেক কষ্টে বলল,
'আমি নাহয় অন্ধ কিন্তু আপনার চোখ তো ভালো। স্কুটি চালাতে পারেন না আবার চালাতে এসেছেন কেনো? আমি তো হর্ণ দিচ্ছিলাম। আপনি যে বধির সেটা তো আগে বলেননি।'
'এই আপনি আবার আমাকে অপমান করছেন?'
আর্দ্র চোখ মুখ খিচে বলল, 'মিস. ফুটা টায়ার আপনি যদি আমাকে এখান থেকে রক্ষা করেন তবে আমি আপনার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকবো। এই অধমকে সাহায্য করুন দয়া করে।'
টায়রা মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, 'অ্যাহ আসছে! আমাকে ফুটা টায়ার বলছেন আবার হেল্প চান কোন মুখে?'
'প্লিজ টায়রা আমি ব্যথা পাচ্ছি। তুলুন আমাকে।'
আর্দ্র গলা বেশ সিরিয়াস শোনা গেলো। টায়রার মায়া হলো। এগিয়ে এলো আর্দ্রর দিকে। তখন শেষ বিকালের মাথায় আকাশে দুটো লাল দাগ রঙিন হয়ে উঠেছিলো। প্রকৃতি ছেয়ে গেছিলো বৃষ্টি হওয়ার আগ মুহুর্তের এক অনাবিল সুখে। চারিপাশে বাতাস সাথে ছিলো প্রকৃতির বৃষ্টি রং। হালকা নীলচে কালো মেঘের রঙে পরিবেশ হয়ে উঠেছিলো সুনীল। দূর আকাশে মেঘের ভেলায় দেখা গেলো রংধনুর সাত রং। খেলে গেলো এক তরুণের অসহায়ত্ব সুর আরেক তরুণীর মায়া মাখানো হৃদয়।
টায়রা তেমন ব্যথা পায়নি। স্কুটির সামনের ফাঁকা অংশ দিয়ে পরে গিয়েছিলো। সে কোনোরকমে উঠে দাঁড়িয়ে স্কুটিটাকে টেনে তুলল। আর্দ্রর দিকে যেতেই দেখলো আর্দ্রর এক পা বাইকের নিচে পরেছে। মনটা ছলাৎ করে ভয়ে ছেয়ে গেলো। আর্দ্রর দিকে ঝুকলো। সাথে সাথে যেনো ব্যথা ট্যথা সব ভুলে হাওয়ায় উড়ানো টায়রার কোমড় অবধি চুলের গন্ধে মুখ ভাসালো আর্দ্র। নিজের এই কান্ডে চমকায়িত হলেও মনকে দমন করতে পারলো না কোনোমতেই। টায়রার এতোদিকে খেয়াল নেই। সে আর্দ্রর উপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে বাইকের হ্যান্ডেল ধরে গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে উঠানোর চেষ্টা করলো। একটু উঠাতেই ভেতর থেকে পা বের করলো আর্দ্র। উঠে দাড়াতেই খেয়াল করলো ডান পা অবশ হয়ে গেছে। পা নাড়ানো যাচ্ছে না। এদিকে টায়রা এতো ভারী বাইকটাকে সামলাতেও পারছে না। দাঁতে দাঁত খিচে আর্দ্র উঠে দাঁড়িয়ে বাইক সোজা করে রাখলো।
টায়রা হাফ ছেড়ে বাঁচলো যেনো। ভয় কেটে গেলো। তবুও খোটা দিতে ছাড়লো না।
'দেখেছেন? আমি কত দয়ালু নারী? আপনি আমাকে কত কটু কথা শোনান কত অপমান করেন তবুও বিপদের সময় এই টায়ার থুক্কু টায়রাকেই কাজে লাগলো। এখন আপনার উচিত আমাকে একটা বড় করে থ্যাংকস দেওয়া। রীতিমতো ধন্যবাদের বন্যা বইয়ে দেওয়া। কত্তো বড় হেল্প করলাম আপনার....।'
টায়রা ভীষণরকম এক্সপ্রেশন দিলো। আর্দ্রর দিক থেকে কোনো রেসপন্স না পেয়ে সে ভ্রু কুচকে তাকালো। আর্দ্র মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখতেই চোখ থেমে গেলো। মাথা ঝিমঝিম করে উঠলো। বাতাস ভারী লাগলো৷ চারিপাশ স্তব্ধ হলো। হাওয়ার সাথে মিলে গেলো সব৷ টায়রার চোখ দুটো জলে উপচে পরলো৷ ঘোলা দেখা গেলো চারপাশ৷ অস্ফুটস্বরে শুধু বলল,
'আল্লাহ! রক্ত!'
টায়রার কথা শুনে আর্দ্র নিজেও নিজের পায়ের দিকে তাকালো। তাকাতেই অবাক হলো। এর জন্যই তবে পা নাড়াতে এতো কষ্ট হচ্ছিলো। পায়ের হাটুর বেশ খানিকটা নিচের জায়গাটুকু থেকে লাল মাংস উঠে সাদা অংশ দেখা যাচ্ছে। টায়রা আরেকবার দেখার আগেই চোখ খিচে বন্ধ করলো। আর্দ্র বলল,
'লে হালুয়া! কাটলো, ছিড়লো আমার, আপনি এরম করেন ক্যা?'
থরথর করে কাঁপা ঠোঁট নিয়ে টায়রা জবাব দিলো, 'হেমোফোবিয়া। '
'আপনার ব্লাড ফোবি আছে?' আর্দ্র আতংকিত গলায় বলল। টায়রা মাথা ঝাকালো।
এই মুহুর্তে অসহায় কণ্ঠে অদ্ভুত এক কথা বলল আর্দ্র,
'তবে কি এখন আপনি অজ্ঞান হয়ে যাবেন?'
টায়রা কথা উত্তর না দিয়ে দাঁতে দাঁত পিষলো। ঝুলানো ব্যাগটা থেকে পানির বোতল বের করে পানি খেয়ে স্কুটিতে উঠে বসলো। আর্দ্র এগিয়ে এসে বলল,
'আমাকে একটু...'
আর্দ্রের কথা সম্পন্ন হওয়ার আগেই টায়রা জিজ্ঞেস করলো, 'এখানে থেকে আপনার বাড়ি কাছে নাকি হসপিটাল? '
না বুঝেই উত্তর দিলো আর্দ্র, 'বাড়ি।'
'তবে কাউকে ফোন করে বলুন আপনার বাইক টা এসে নিয়ে যেতে আর আমার স্কুটিতে উঠে বসুন। এবং ডান পা টা একটু আমার চোখের আড়ালে রাখবেন। বলা যায় না আবার রক্ত দেখলে আপনাকে নিয়ে এক্সিডেন্ট করে মরে টরে যেতে পারি। আর রাস্তা চিনিয়ে দিবেন।'
নাক ছিটকিয়ে আর্দ্র বলল, 'মেয়েদের পেছনে বসে যাবো?'
টিকলি চোখ পাকিয়ে আর্দ্রর দিকে তাকিয়ে আবার চোখ সরালো। চোখ বন্ধ করে রাগ নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে দাঁত কিড়িমিড়ি করে বলল,
'আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার আমার কি ঠেকা? নেহাৎ হাত পায়ের গোস্ত-মাংস ছুলে বসে আছেন তাই মানবতার খাতিরে নিয়ে যেতে চাইছি। তারউপর আবার এতো বড় বড় কথা বলেন? আমার মাথা ঘুরাচ্ছে। উঠে বসুন বলছি তাড়াতাড়ি।'
টায়রার ধমকে আর্দ্র উঠে বসতে চেয়েও বলল, 'হায়! আল্লাহ! আপনার মাথা ঘুরাচ্ছে? আপনার সাথে যাওয়া তো রিস্ক। এখন তো পা ছুলে বসে আছি। একটু পর উপরে যাওয়ার টিকিট কনফার্ম হয়ে যাবে।'
'কিচ্ছু হবেনা। উঠে বসুন। নাহলে আমি চলে গেলাম।'
'এই না। পরে আমি যাবো কিভাবে? ব্যথা সহ্য করা যাচ্ছে না। কি যন্ত্রনার জীবন!'
আর্দ্র উঠে বসলো টায়রার পেছনে। পকেট থেকে ফোন বের করে বাড়ির ড্রাইভারকে বলল বাইকটা এসে নিয়ে যেতে। আদর এখন নিশ্চয়ই বিজি। তবুও আর্দ্র আদরকে ফোন লাগালো। কিন্তু অপরপাশে ফোন ধরা হলো না। অবচেতন মনেই অন্য হাত টায়রার কোমড়ে রেখে আর্দ্র আবারো ফোন দিলো আদরের পারসোনাল নাম্বারে।
শরীর কেঁপে উঠল বৈদ্যুতিক তারের সাথে শক লাগার মতোন। ঠকঠক করে কেঁপে গেলো কিছুক্ষন অবলীলায়। মেদহীন টায়রার কোমড়টাতে আর্দ্রর হৃদপুষ্ট হাতের পাঁচ আঙ্গুল ঘুরে বেড়ালো নির্বিশেষে। টায়রা কথা হারিয়ে ফেলল। শুধু লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে দেখলো কাউকে ফোন দেওয়ায় ব্যস্ত আর্দ্রকে। হঠাৎ মনে হলো, বেহালা বাজছে। টায়রার চোখ বন্ধ হয়ে এলো। বেহালার সুরে মনের করিডোরে দুটো পাখি কিচিরমিচির করে তাদের অস্তিত্ব জানান দিলো। আর্দ্রের হাত কি জানান দিলো কে জানে? শুধু দেখা গেলো, কিছু মুহুর্ত পর আর্দ্র যখন ঠোঁট উল্টে বলল,
'ভাইয়া তো ফোন ধরলো না।'
টায়রা তখন হুশে ফিরলো। ঝটকানা দিয়ে আর্দ্রের হাত সরিয়ে দিলো। আর্দ্র বুঝে উঠার সাথে সাথে বিস্মিত চমকপ্রদ নিজের এই কাণ্ডে হতবাক হয়ে গেলো। মস্তিষ্ক ফাঁপা নালির মতোন শূন্য হয়ে পরে রইল। নিউরন গুলো কাজ করা বন্ধ করে দিলো। রক্ত চলাচল থেমে এলো। কি হয়েছে তার? একটু আগে চুলের গন্ধ এখন আবার কোমড়ে হাত? মাথা টাথা খারাপ হয়ে গেলো নাকি?
আর্দ্র আচ্ছন্ন দৃষ্টিতে তাকালো টায়রার ওই মেদহীন কোমড়ের বাঁকে। কিছুক্ষণ তাকিয়েই রইল। গলা খাকারি দিয়ে টায়রা বলল,
'নজর হেফাজতে রাখুন। গুলি করে চোখের খুলি উড়ায় দেওয়ার আগেই ভালো পথে ফিরে আসুন।'
আর্দ্র তৎক্ষণাৎ চোখ সরালো। অপমানে লজ্জায় কানকাটা হয়ে বলল,
'কি হইছে?'
বিস্ময় নিয়ে মুখ ঘুরালো টায়রা। এরপর আবার সামনে ঘুরে থমথমে মুখে বলল, 'একদম এডভান্টেজ নিবেন না আর ইনোসেন্ট সাজার চেষ্টা করবেন না। আমার গায়ে যাতে আপনার টাচ না লাগে। সরে বসুন।'
,
বাড়ির মাথায় আসতেই দেখা গেলো তিনতলার বাড়ির সামনে খয়েরী রঙের গেট৷ একপাশে নেইম-প্লেটে লিখা 'খান ভিলা'। গেট ছাড়িয়ে মাথা উঁচু করে বিল্ডিং এর গা বেয়ে জেগে উঠেছে বাগানবিলাস। এক পাশে আট কি দশটার মতোন শিমূল তুলোর গাছ। গেটে দারোয়ান দাঁড়ানো। দারোয়ান এগিয়ে এসে ব্যস্ত গলায় বললেন,
'ছোট সাহেব কি হইছে? প্যান্ট ছিড়লো কেমনে? আল্লাহ! আবার দেহি পাও ছিলছে।'
আর্দ্র রহমত চাচার কাধে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
'আমাকে ধরে একটু ভেতরে নিয়ে যাও চাচা।'
ভেতরে পা বাড়াতেই আবার উল্টো ঘুরলো আর্দ্র। খুড়িয়ে খুড়িয়ে টায়রার দিকে এগিয়ে এসে বলল,
'ভেতরে আসুন।'
মুখ বাকিয়ে টায়রার জবাব, 'নো থ্যাংকস।'
চোখের পলকেই স্কুটি নিয়ে উড়াল দিলো উড়নচণ্ডী টায়রা। আর্দ্র তাকিয়ে রইল রাস্তার আকেঁবাঁকে ততক্ষণ, যতক্ষণ দেখা যায় এই বিরক্ত মেয়েটাকে।
_________________________________
দুইদিন হয়েগেছে টিকলি এখনো প্রেসক্রিপশন টা খুলে দেখেনি। এক্সাইটমেন্ট কাজ করছে প্রচুর আবার ভয়ও হচ্ছে। মামাজান সেদিন বিকালেই চলে গিয়েছেন। বাবা আর রাহুল ভাই প্রেসক্রিপশনটা অনেকবার দেখতে চাইলে টিকলি কথা কাটিয়েছে এমনভাবে,
'তেমন কোনো প্রেসক্রিপশন না।'
রাহুলের উত্তর তখন, 'প্রেসক্রিপশন আবার কেমন হয়?'
'সাইনোসাইটিস এর সমস্যা। ওতো আহামরি কোনো ওষুধ দেয়নি।'
'আমার তো এবার সন্দেহ হচ্ছে। দেখি প্রেসক্রিপশন টা কোথায় রেখেছিস? আহামরি ওষুধ দিয়েছে কিনা দেয়নি দেখি।'
টিকলির ব্যাগ টেনে নিয়ে তন্নতন্ন করে খুঁজেও প্রেসক্রিপশন পেলো না রাহুল। টিকলি তুতলিয়ে বলল, 'বোধ হয় হারিয়ে ফেলেছি।'
রাহুল হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে চলে গেলো। যাওয়ার আগে বলে গেলো, 'তুই তো এমন ছিলি না টিকলি।'
রাহুলের কথাটা কেনো যেনো মিনিট খানিকের মতো টিকলির মাথায় বসে রাজত্ব করতে লাগলো। আসলেই তো, টিকলি তোএমন ছিলো না। রাহুল সারা ব্যাগ তন্নতন্ন করে খুঁজেছে প্রেসক্রিপশনটা অথচ কাগজটা ছিলো টিকলির হাতের মুঠোয় দুমড়ে মুচড়ে ভাঁজ করা।
নিজের গোপন ডয়ার থেকে প্রেসক্রিপশনটা নিয়ে বারান্দায় এলো টিকলি। টায়রা বসার ঘরে টিভি দেখছিলো। ঘরে শুধু একা টিকলি। কাগজটা চোখের সামনে মেলে ধরতেই দেখা গেলো ওষুধের নাম লিখা, দিনে কতবার খাবে তা লিখা। একদম উপরে আদরের অফিসিয়াল নাম এবং নাম্বার। সারা পৃষ্ঠা জুড়ে আর অন্যকিছু পাওয়া গেলোনা। কাগজটা উল্টাতেই অপরপাশের নিচে গুটিগুটি অক্ষর গুলো চোখে ধরা দিলো। টিকলি মুগ্ধ মন বলল,
'বাহ! ডাক্তারদের লেখা এতো সুন্দর! ইম্প্রেসিভ।'
চোখে চশমাটা ঠিকমতো এঁটে দিয়ে মনোযোগ সহকারে পড়তে শুরু করলো টিকলি,
"শূন্য জীবনে ভাসে এক আকাশের সাত রং। ছয় ঋতুতে আসছে বারো মাস আর এক ফাল্গুন। হঠাৎ জীবন পথ খুঁজে তিন গলির মুখে, পাঁচ রাস্তার মোড়ে। সারা মাসে অক্লান্ত পরিশ্রমে ফুরোয় দিন শুধুমাত্র তোমার কফি মগে।"
লেখাগুলো পড়ে ভ্রু কুচকালো টিকলি। মানে কি এই লেখাগুলোর? এই লেখা দিয়ে কি করবে সে? লেখার মাঝে কি আদরের কোনো অনুভূতি ব্যক্ত করলো নাকি? টিকলি আরো দু তিনবার পড়লো। তবুও বুঝে আসলো না। বিরক্তিতে মুখ তেতো হয়ে রইলো। ধ্যাত, ভেবেছিলাম হয়তো নাম্বার টাম্বার দিয়েছে, যে তাড়াতাড়ি লিখলো। বিরক্ত মনে দাঁড়িয়ে থাকার কিছুক্ষণ পর টিকলি আরো একবার চোখ বুলালো। চিঠিটা মেলে ধরে আনমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই হঠাৎ চিল্লিয়ে উঠলো, 'ইয়েস ইয়েস। পেয়েছি পেয়েছি।' বলেই ঘরে ছুট লাগালো নতুন কাগজের উদ্দেশ্যে। কলমের নিপ কিছুক্ষন বিরামহীন চলল সাদা কাগজের জমিনজুড়ে।
চলবে
Emran sumon, Sadman alom, Nazim khan, Faria oishy, Md mamun, Md sourav, Md akash shak and লেখাটি পছন্দ করেছে
- Onu kothaশুকতারা
- Posts : 56
স্বর্ণমুদ্রা : 1526
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-05-26
Re: বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ
২৪.
রাত তখন একটা বেজে পাঁচ মিনিট। ফোনের ওপাশে প্রগাঢ় নিস্তব্ধতা। কারোর ভারী নিঃশ্বাসের স্পন্দনে উত্তাল ঢেউয়ের গভীর নিরবতা। আদর কথা বলল প্রথম,
'বাহ! এতো তাড়াতাড়ি ফোনকল? আমি তো ভেবেছি আরো দু-চারদিন লাগবে।'
টিকলি জোরালো শ্বাস ফেলল। যাক, শেষ পর্যন্ত ঠিক ঠাক নাম্বারে কল করতে পেরেছে। ক্লান্ত গলা ঠেলে দিয়ে বলে উঠলো,
'আপনি এমন কেনো ডাক্তার?'
আদরকে জড়ীভূত ধরলো। মিনিট খানিক নিরব থেকে বিরবির করলো, 'আহ! ডাক্তার! কি মধুর!'
'কিছু বললেন?'
'নাহ।'
'এতো রাতে ফোন করলাম বিরক্ত হননি?'
'আমি এখনো হসপিটালে।'
'এতো রাতেও?'
'হুম।'
'বাড়ি ফিরবেন কখন?'
'এইতো দেখি। কখন ফেরা যায়।'
এরপর ওপাশে পিনপিনে নিরবতা। আদর চেয়ারে হেলান দিয়ে মুচকি হেসে প্রশ্ন করলো, 'তো নাম্বার পেলেন কীভাবে?'
টিকলি ভ্রু কুচকে বলল,
'ঢং করেন? আপনি নিজেই তো লিখে দিয়েছেন।'
'হ্যাঁ দিয়েছি। কিন্তু সেটা অতিমাত্রায় বুদ্ধিমান ব্যক্তি ছাড়া তো কারোর বুঝার কথা না।'
'আপনার কি আমাকে বোকা মনে হয় ডাক্তার?'
টিকলি গলায় তেজের রেশ টেনে বলল। আদর হেসে বলল, 'নাহ। আপনি তো ভীষণ বুদ্ধিমতী। এবার বলুন তো দেখি কীভাবে কীভাবে পেলেন?'
'আপনি আর কথা বলবেন না তো।'
'ওমা, কেনো?'
'আপনি জানেন আমি সাড়ে দশটায় প্রেসক্রিপশন টা খুলেছিলাম। আর এখন একটা পনেরো বাজে। এ পর্যন্ত আমি একেকজনকে ফোন ই দিয়েছি। যাকেই বলি আদর সাহেব বলছেন সেই বলে এতো রাতে মশকরা করছেন। পাগল ফাগল উপাধিও পেয়েছি। কোন কোন নাম্বারে ফোন দেইনি বলুন, ০১৭৬১২১৩৫৩০, ০১৭৬১২১৩৫৩১, ০১৭৬১২১৩৫২৮,০১৭৬১২১৩৫২৯, ০১৭৬১২১৩৫২৪। একটা নাম্বারও কাজে লাগেনি।'
আদর মনোযোগ দিয়ে শুনলো টিকলির সব কথা। খানিক বাদে বলল, 'কিছু পেতে হলে তো কিছু হারাতেই হবে টিকলি। সব কিছু কি এতো সহজেই হাতের মুঠোয় পাওয়া যায়? আপনার কি মনে হয় আমি এতো সহজে আপনাকে ধরা দিবো?'
'কিন্তু আমি তো ধরে ফেলেছি ডাক্তার।' টিকলির গলা নরম হলো। আদর চেয়ারে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করলো। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বলল, 'এক্সপ্লেইন করুন তো দেখি কীভাবে নাম্বারটা বুঝলেন?'
'আপনি যে প্যাচানো লোক সেটা তো ভালো করেই জানি। যখন দেখলাম কোনো নাম্বার ই কাজে লাগলো না। তখন খাতা নিয়ে বসে বিভিন্ন ভাবে মিলানো চেষ্টা করলাম এরপর আবার ফোন লাগাতে শুরু করলাম। এরপর মাত্র কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে পেলাম। শূন্য জীবনে ভাসে এক আকাশের সাত রং, ০১৭। ছয় ঋতুতে আসছে বারো মাস আর এক ফাল্গুন, ৬১২১।
হঠাৎ জীবন পথ খুঁজে তিন গলির মুখে, পাঁচ রাস্তার মোড়ে। দুটোই রাস্তার সাথে সংযোগ। আর পাঁচ রাস্তার মোড়ে তিন গলি আছে। এটুকু মিলে হবে আট। তাই না ডাক্তার?'
আদর হাসলো, 'হুম। তারপর?'
'সারা মাসে অক্লান্ত পরিশ্রমে ফুরোয় দিন তোমার কফি মগে। এখানে ৩০ এর সাথে ২৪ গুন করে হবে ৭২০। ০১৭৬১২১৮৭২০ এই হলো আপনার নাম্বার।'
আদর বাহ্বা দিয়ে বলল, 'বাহ! ইম্প্রেসিভ! আপনার আই-কিউ তো দারুন টিকলি। বোকা ভাবতাম কিন্তু প্রচুর বুদ্ধিমতী আপনি। দু দিনে বের করে ফেলেছেন।'
আনমনে টিকলি ধীর গলায় বলল, 'ভালোবাসলে এসব একটু আকটু আই-কিউ বের করা যায় বাদর সাহেব।'
আদর পুরো কথা শুনেনি তবে শেষে বাদর কথাটা ঠিক শুনেছে। রাগী কণ্ঠে বলল, 'এই কি বললেন আপনি?'
থতমত খেয়ে টিকলি জবাব দিলো, 'বলছিলাম যে আমি দুদিনে বের করিনি। আজকেই প্রেসক্রিপশন টা খুলেছি।'
'তাহলে তো আরো দারুন। ব্রিলিয়ান্ট এর উপর ব্রিলিয়ান্ট। তবে নিশ্চয়ই এখনো ওষুধ গুলো কিনেন নি? তাড়াতাড়ি কিনে ফেলবেন। মাথা ব্যথা বাড়বে নাহয়। এই দুদিনে আরো মাথা ব্যথা করেছিলো কি?'
'আপনাকে দেখে সব দৌড়ে পালিয়েছে ডাক্তার।'
'আহা! কি বিরবির করছেন মিস. টিকটিকি? জোরে বলুন না।'
টিকলি চোখ রাঙিয়ে বলল, 'এই...'
আদর হাসলো। হঠাৎ কিছু মনে পরেছে এমনভাবে বলল, 'আচ্ছা আপনার যে ঠান্ডার সমস্যা বলেননি তো। যে দুই তিনদিন নিঝুম দ্বীপে একসাথে থাকলাম সে কয়দিন তো তেমন....'
আদরের কথা সমাপ্ত করতে না দিয়েই টিকলি বলল,
'আপনি বোধ হয় ভুলে গেছেন। যেদিন আমরা নিঝুম দ্বীপে গেলাম সেদিন আমার ডাস্ট অ্যালার্জির কারণে সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়েছিলো বলে আপনি কি বকাটাই না দিলেন। ধুলোবালিতে ছিলাম এবং রাতে আরেকবার গোসল করেছিলাম বলে ঠান্ডা লেগে গিয়েছিলো।'
'ওহ হ্যাঁ মনে পরেছে।'
'আচ্ছা ডাক্তার, আপনি আমাকে আপনার ফোন নাম্বার কেনো দিলেন? তাও এভাবে?'
টিকলি ভ্রু কুচকে ঠোঁট টিপে প্রশ্ন করলো। আদর বিহ্বল হয়ে গেলো। চেহারা হয়ে উঠলো বিবর্ণ। এই প্রশ্নের কি জবাব দিবে? সে নিজেও তো জানে না কেনো সে নাম্বার দিয়েছে। আদর কথা ঘুরাতে বলল,
'আপনি এতো কার সাথে কথা বলেন টিকলি? আপনি এতো ফোন কলে বিজি থাকেন কেনো?'
আদরের কণ্ঠ কেমন জানি একটু অভিমানের ছোঁয়া। টিকলি বলতে চাইলো আমার ফোন কল বিজি থাকলেই আপনার কি ডাক্তার? কিন্তু আদরের ওই কোমল ললিত নরম কণ্ঠে সে অভিভূত হয়ে গেলো। বলল,
'কোথায়? আমার ফোন কল তো বিজি থাকেনা ডাক্তার। আপনাকে এ কথা কে বলেছে?'
'আপনার মামা। চেম্বারে ঢোকার আগে আপনি কারোর সাথে কথা বলছিলেন যার কারণে আপনার দেরি হয়েছে।'
টিকলি হেসে দিলো। বলল, 'আমার এক ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছিলাম।'
আদরের ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করলো, 'ফ্রেন্ড?'
'জি বান্ধবী।'
আদরের বুক কেনো যেনো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বড্ড ক্লান্ত গলায় বলল, 'ঘুমোবেন না?'
'হুম। আপনি বাড়ি যাবেন কখন?'
'দেখি। বাড়ি যাওয়া খুব প্রয়োজন। ওদিকে আর্দ্র এক্সিডেন্ট করেছে।'
'আল্লাহ! কীভাবে?'
'বাইক এক্সিডেন্ট। দেখেন না কেমন তিড়িং বিড়িং করে সবসময়। পায়ে অনেকটা ইনজুরি হয়েছে। হাটতে পারছে না।'
'ইশশ...একটু দেখে চলবে না? আজকে টায়রাও অসুস্থ হয়ে পরেছে।'
'কীভাবে?'
'ওর তো হেমোফোবিয়া আছে। রাস্তায় কে যেনো এক্সিডেন্ট করেছিলো। রক্ত দেখে বাসায় এসে বমি করেছে।'
আদর ভ্রু কুচকে কিছুক্ষণ ভাবলো। ছোট করে বলল, 'ওহ। খেয়াল রাখবেন। কি করছে টায়রা এখন?'
'ঘুমোচ্ছে। আচ্ছা ডাক্তার হেমোফোবিয়াকে ডাক্তারি ভাষায় কি বলে?'
'ভ্যাসোভ্যাগাল সিনকোপ বা নিউরোকার্ডিও জেনিক সিনকোপ।'
'উফফ..কত্ত কঠিন নাম। এতোকিছু মনে রাখেন কীভাবে?'
'ডাক্তারদের মনে রাখতে হয়। এর জন্যই তো আমরা ডাক্তার।'
টিকলি চোখ সরু করে বলল, 'ভাব ধরছেন?'
আয়েশী ভঙ্গিতে আদরের জবাব, 'হুম।'
টিকলি আর কথার উত্তর দিলোনা। বারান্দা গলিয়ে আসমানে তাকালো। আকাশে অনেক তাঁরার মেলা। তাঁরাদের মিলনায়তনে যোগ দিয়েছে চাঁদ। রুপালি আলো। চারিপাশে চমক আর চমক। শুধু ভালোলাগা। টিকলি চোখ বন্ধ করে বলল,
'আপনার কাছ থেকে আকাশ দেখা শিখেছি। আকাশ দেখা যে এতো সুন্দর হতে পারে জানা ছিলোনা।'
আদর ঠোঁটের কোণায় সন্তুষ্টির হাসি ঝুলিয়ে বলল,
'তবে এবার ঘুমিয়ে পড়ুন। অনেক রাত হলো।'
'আচ্ছা। শুভ রাত্রি।'
টিকলি ফোন রেখে দিতেই আদরের মনে পরলো তার সরি বলা হয়নি। তড়িঘড়ি করে সে বলল, 'হ্যালো হ্যালো কেটে দিয়েছেন? '
'নাহ বলুন শুনছি।'
আদর বড় করে শ্বাস নিলো। হঠাৎ কি যেনো হলো বুকের ভেতর তবলা বাজলো। ধামাধাম। আদর এলোমেলো হলো। সেই এলোমেলো থেকে অগোছালো কণ্ঠে বলল,
'চিরকুট টাতে কিন্তু শুধু আমার নাম্বার লিখা ছিলোনা কিছু অজানা অনুভূতিকে প্রহরী হিসেবে সাজিয়ে নিয়োজিত রেখেছিলাম।'
টিকলির ঠোঁট প্রসারিত হলো। কান থেকে আস্তে করে ফোন রেখে বুকের মাঝে চেপে ধরলো। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে নিঃশব্দে হেসে দিলো। ভালোবাসার একেকটা ছন্দ, স্বপ্ন, দৃশ্যকাব্য মনের ক্যানভাসে রঙিন হয়ে ধরা দিলো। টিকলি স্বপ্ন বুনলো। কল্পনা করলো আগামী দিনের তার ভালোবাসার দিনগুলি।
চোখের সামনে ফোন ধরে আদর কিছুক্ষন থ হয়ে বসে থাকলো। বলতে চাইলো কি? আর বলে ফেলল কি? নিজের এই অকর্মায় নিজেই লজ্জিত হয়ে পরলো। এই সরি টাই শনি। যতবার সরি বলতে গেছে কিছু না কিছু ভুল হয়ে যায়। আদর ভেবে পায়না, সে কেনো টিকলিকে সরি বলতে পারেনা? শুধুমাত্র টিকলিকেই কেনো?
_________________________________
ভোরের সূর্যের কোমল আলো ঘর ছুতেই আর্দ্রর বুঝে আসলো সকাল হয়ে গেছে এবং সারারাত তার ঘুম হয়নি অজানা কোনো বুককাঁপা উত্তেজনার কারণে। নরম কমলা সূর্যের আলোতে আর্দ্র নিজের বাম হাতের দিকে তাকালো। কেনো তাকালো কে জানে। কাল বিকালের পর থেকে এই হাত দিয়ে সে কিছুই ধরেনি। এমন কি বাথরুমের চাপ এলেও বাথরুমে যায়নি। কি যন্ত্রণা! শেষমেষ পায়ের সাথে সাথে কি মাথাটাও গেলো?
হাতের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই আর্দ্রর চোখে খেলে গেলো উড়নচণ্ডী, চাপাবাজ, পকপক করা টায়রার মুখচ্ছবি। এই হাতটাই টায়রার কোমড়ে রাখা হয়েছিলো। সেকেন্ড মিনিট গড়িয়ে অনেক্ষণ ওই কোমড়ের অধিকার পেয়েছিল। আর্দ্রর দিশেহারা লাগলো। অগোছালো জীবনটা আরো বেশি অগোছালো হয়ে উঠলো।
তখন বাজে সাড়ে পাঁচটা। আদর ঘুমু ঘুমু ক্লান্ত চোখে ঘরে ঢুকতেই দেখলো বিছানা জুড়ে অন্য কারোর বিচরণ। আর্দ্রকে দেখে আজ কোনো কড়া কথা কিংবা বকা দিলো না। নিঃশব্দে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে আর্দ্রর সামনে বসলো। আর্দ্র একাচ্ছন্ন নয়নে তখনো তাকিয়ে দেখছিলো বাম হাত। আদর বলল,
'এখন পায়ের অবস্থা কি?'
আর্দ্রের দিক থেকে কোনো ফিরতি উত্তর এলো না। আদর ভ্রু কুচকে তাকিয়ে নাক ছিটকে বলল,
'কিরে? বামহাতের রেখা গুনছিস নাকি? ছি ছি ছি! শেষমেষ বাম হাত? এমন ভাবে দেখছিস মনে হচ্ছে এখনি খেয়ে ফেলবি। ইয়াক! এক কাজ কর এভাবে দেখা বাদ দিয়ে একটু চেটে টেস্ট নিয়ে নে।'
আর্দ্র হুশে ফিরে তাড়াতাড়ি হাত নিচে নামিয়ে উঠে বসতে গেলেই পায়ে চাপ পরলো। সাথে সাথে কুকরিয়ে উঠলো। আদর বিরক্ত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ফার্স্ট-এইড বক্স নিয়ে আসলো। ড্রেসিং করতে করতে বলল,
'অসুস্থ বলে আজকে কিছু বললাম না। যে কয়দিন অসুস্থ আছিস সে কয়দিন আমার সাথে থাক। কিন্তু এরপর থেকে নিজের রুমে যাবি।'
আর্দ্র খুশি হয়ে বলল, 'হোয়াট আ বড় অফার....'
,
সকাল দশটা বাজতেই বাড়িতে আগমন ঘটলো নিভার। আদর সকালে নাস্তা করছিলো। আর্দ্র রিমোট চেপে চ্যানেল পাল্টাচ্ছিলো এবং মনোয়ারা বেগম ছোট ছেলেকে পরম যত্নে খাইয়ে দিচ্ছিলেন। নিভা ডুকতেই মনোয়ারা বেগম চিল্লানো সুরে বললেন,
'নিভা...তুই?'
নিভা আস্তে করে ভেতরে ডুকে আর্দ্রের পাশে সোফায় বসলো।
চলবে
sandipchandradas, Emran sumon, Sadman alom, Faria oishy, Md mamun, Md akash shak, Mannat tasrin and লেখাটি পছন্দ করেছে
- Onu kothaশুকতারা
- Posts : 56
স্বর্ণমুদ্রা : 1526
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-05-26
Re: বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ
নিভা গিয়ে আর্দ্রর পাশে সোফায় বসে বলল, 'তুমি অসুস্থ খালামনি কাল আম্মুকে ফোন দিয়ে বলল তাই আসলাম।'
মনোয়ারা খান খুশিতে গদগদ হয়ে বললেন, 'বাহ! বেশ ভালো করেছিস। আয় দেখি খেতে বস তোর আদর ভাইয়ার সাথে।'
সোফা ছেড়ে উঠে গিয়ে টেবিলে বসতে বসতে আদরের দিকে প্রশ্ন ছুড়লো নিভা, 'কেমন আছো বস?'
হালকা হেসে আদর উত্তর দিলো, 'এইতো যাচ্ছে। তোমার কি খবর? পড়াশোনা কেমন চলছে?'
'বেদনাদায়ক!'
'ফাঁকিবাজ।'
নিভা হেসে দিলো। আদর টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
'তবে থাকো। আমি যাই। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। মা গেলাম। খোদা হাফেজ। '
রান্নাঘর থেকে মনোয়ারা খান জবাব দিলেন, 'সাবধানে যাস বাবা। গিয়ে মাকে ফোন করতে ভুলিস না।'
খাবারের প্লেট নিয়ে নিভা আর্দ্রর পাশে এসে আবার বসলো। টিভি দেখতে দেখতে একসময় খাওয়া শেষ হলো। নিভা বলল, 'ছাদে যাই ভাইয়া?'
'একা?' আর্দ্র প্রশ্ন করলো ভ্রু কুচকে।
'হুম। তা নয়তো কে যাবে? তুমি তো পা ভেঙে বসে আছো।'
'দরকার নেই। তিনতলায় ব্যাচেলর ভাড়া দেওয়া হয়েছে।'
'এমা! কবে?'
'এইতো তিনমাস আগে। তুই তো প্রায় ছয় মাস থেকে আমাদের বাসায় আসিস না।'
'তোমরা যাও?'
সোফায় হেলান দিয়ে বসে আর্দ্র হাই তুলে বলল, 'না। আলসেমি লাগে।'
মুখ ভেঙিয়ে নিভা জবাব দিলো, 'হুম সেটাই। গেলাম আমি। ব্যাচেলররা এতো সকালে ঘুম থেকে উঠে না। আর উঠলেও কি? একটু চান্স ফান্স পাওয়া যাবে। সিংগেল থেকে মিংগেল হওয়ার একটা সুযোগ অন্তত পাবো।'
অবহেলার গলায় আর্দ্র বলল,
'লাভ নেই। দুজন বিবাহিত। একজন গেছে ফুফুর বাসায় আরেকজন বোধ হয় এখন টিউশনিতে আছে।'
'ওহ....মাই বেড লাক।'
হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে নিভা ছাদের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। সেন্টার টেবিলে নিভার ফোন পরে থাকতে দেখে আর্দ্র গলা উঁচিয়ে চিৎকার করে বলল,
'এই ফোন নিয়ে গেলি না?'
'রেখে দেও ভাইয়া। ফোন দেওয়ার মতো কেউ নেই। কষ্টে জীবন ত্যানাত্যানা।'
'মেয়েটা ভারী দুষ্টু হয়ে গেছে।'
বিড়বিড় করে আর্দ্র ফোনটা যথাস্থানে রাখলো। রাখার খানিক বাদেই বাজঁখাই গলায় ফোন চিল্লিয়ে উঠলো। আর্দ্র ভ্রু কুচকে তাকাতেই অবাক হয়ে গেলো। বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মুখের কথা হারিয়ে ফেলল। কপালে কিছু সূক্ষ্ম ভাঁজ, মুখে অপ্রত্যাশিত ছায়া, চোখ জোড়া কুচকিত। আর্দ্র ফোন হাতে তুলে নিলো। ফোনের পুরো স্ক্রিন জুড়ে ভেসে উঠেছে টায়রার ঠোঁট চেপে অল্প জিব বের করা বাম চোখ টিপা দুষ্ট মুখচ্ছবি। নাম্বার সেভ করা 'ময়নাপাখি ২' দিয়ে। পাজি সেই ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ফোন কেটে গেলো। আর্দ্র হুশে ফিরে নিজের বাম হাতটার দিকে তাকালো। এইতো...কাল এই মেয়েটার সাথে দেখা হয়েছিলো। বেশি বুঝা মস্তিষ্ক ভেবেছিলো আর কোনোদিন হয়তো দেখা হবে না। ভাগ্যের ফেরে আজ আবার....?
বোকা মস্তিষ্কের কথা ভাবতে ভাবতেই ফোন তার নিজস্ব ক্ষমতায় আবারো আন্দোলন করে উঠলো। এবারো ফোন কেটে গেলো। আকস্মিক এই ব্যক্তির ফোনকলে বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়েছে আর্দ্র। তৃতীয় বার ফোন বাজতে বাজতে কেটে যাওয়ার আগ মুহুর্তে আর্দ্র রিসিভ করলে ও পাশ থেকে কেউ চড়া গলায় বলল,
'ওই শালী, ফোন দিয়ে আমি শহিদ হয়ে যাইতাছি আর তুই কি করতাছোস হ্যাঁ? ঘুম পারতাছোস এখনো? এদিকে আমি তোমারে ফোন দিয়ে মরি ওদিকে তুমি অবলীলায় ঘুমাও?'
টায়রার ভাষা দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে পরলো আর্দ্র। ভীষণমাত্রায় অবাক হয়ে মাত্রাতিরিক্ত গম্ভীর গলায় বলে উঠলো,
'হ্যালো।'
টায়রার ভ্রু জোড়া কুচকে গেলো। এক মুহুর্ত চুপ থেকে আবারো তার ডাইনির ন্যায় গলায় চিল্লিয়ে বলে উঠলো,
'এই... আপনি কে? আমার বান্ধবীর ফোন আপনার কাছে কেনো? কি করছেন আমার বান্ধবীর সাথে? আমি যতদূর জানি ওর তো কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই। অবিয়াত্তা। তাহলে আপনি কে? কিডনাপ করছেন....? আমি তাহলে এই মুহুর্তে একজন কিডনাপার এর সাথে কথা বলছি?'
শেষের লাইন টায়রা বিস্ফোরিত গলায় বলল। আর্দ্র হতবিহ্বল, হতবাক চোখে শূন্যে চেয়ে রইল। এই মেয়েটা এতো বেশি বুঝে যে কিডনাপার এর উপাধিটাও লাভ করে ফেলল আর্দ্র। এই মুহুর্তে তার কেদে বুক ভাসাতে ইচ্ছে করলো হঠাৎ। ভাঙাচোরা হৃদয় নিয়ে বলে উঠলো,
'টায়রা....'
আর্দ্রের কথার মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে টায়রা টেনে টেনে বলল,
'ওহ...মাই...গড, আমার নামও জানেন? কে আপনি তাড়াতাড়ি বলুন। তা নাহলে পিছে এমন ডান্ডা দেবোনা দাড়ালে বসতে পারবেন না আর বসলে শুতে পারবেন না।'
আর্দ্র ধমকে বলল এবার,
'কি আবোলতাবোল বকছেন? বলছি তো আমি...'
টায়রা বিরবির করে বলল, 'কণ্ঠটা কেমন চেনা চেনা লাগলো।' পরমুহূর্তেই আবারো গগনবিদারী গলায় বলল,
'কে আপনি? পরিচিত? পরিচিত হয়ে এভাবে বাঁশ দিলেন? আমার বান্ধবীকে কিডনাপ করলেন? এখন নিশ্চয়ই মুক্তিপণ চাইবেন। দেখুন ভাই, ওতোসব টাকা-পয়সার মালিক আমি না। আর আমার বান্ধবীর বাবা হার্টের পেসেন্ট মা হাই-প্রেসার এর পেসেন্ট। তাই ওদের তো কোনোমতেই বলা যাবে না। যদি বাই চান্স মেয়ের শোকে মরে টরে যায় তাহলে ফোন দেওয়ার অপরাধে আমার দোষ হবে। তার চেয়ে এক কাজ করুন, আমার বান্ধবীকে বিয়ে করে ফেলুন। এখন যা টাকা মুক্তিপণ হিসেবে চাইতেন বিয়ের যৌতুক হিসেবে তা সুদে-আসলে তুলে নিবেন। যদিও যৌতুক হারাম। তবুও কিডনাপার রা তো মায়া-দয়াহীন হয়। খুন টুন ও করে ফেলে নাকি। থাক ভাই আমার বান্ধবীকে বাচিঁয়ে রেখে বিয়ে করে ফেলেন। আমাকে দাওয়াত দিয়েন। এত্তোবড় গিফট নিয়ে যাবোনি। আইডিয়া টা কেমন দিলাম বলুন...? রাজ্যের মহর সাথে রাজকন্যা ফ্রি। ভাবতেই ভিষণ অবাক লাগছে জানেন, যে আমি একজন কিডনাপারের সাথে কথা বলছি। হাউ ব্রেভ আই এম! আই এম প্রাউড অফ মি।'
টায়রার অনবরত বিরামহীন কথা শুনতে শুনতেই যেনো আর্দ্রর পায়ে ব্যথা বেড়ে গেলো। টায়রার কথার ইতি ঘটতেই ক্লান্ত গলা ঠেসে দিয়ে আর্দ্র বলল,
'শেষ মিস. ফুটা টায়ার? মানে সিরিয়াসলি? একটা মানুষ এতোটা বিরক্তিকর বাঁচাল কীভাবে হতে পারে? বুদ্ধিহীনতারও তো একটা সীমা আছে নাকি?'
'আপনি আমাকে ইনসাল্ট করছেন? কে আপনি? নাম বলুন। থানায় ফোন দিবো। কেস করবো। মামলা ঠুকবো। আপনাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবো। জেলে ডুকাবো। আপনাকে ফাসিতে...'
টায়রার কথা শেষ করতে না দিয়েই আর্দ্র উচ্চস্বরে চিল্লিয়ে উঠলো,
'সাট আপ। আমি আর্দ্র। '
আর্দ্রের উচ্চবাক্যে কেঁপে গেলো ফোন, ফোনের ওপাশের টায়রা। কান থেকে ফোন সরিয়ে চোখের সামনে ধরে নাম্বার দেখে ভ্রু কুচকে সচেতন দৃষ্টিতে তাকালো। এরপর বিস্ময়তা নিয়ে বলল,
'আপনি কেনো? আমার বান্ধবীর ফোনে আপনি কি করছেন? ও কোথায়...'
'চুপ করবেন?' আর্দ্র ধমকে উঠলো আবারো।
টায়রা ঠোঁট উল্টে বলল, 'আপনি আমাকে ধমক দিলেন?'
আর্দ্র চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই মেয়ের পকপকানিতে রীতিমতো মাথা ব্যথা ধরে গেছে। শান্ত গলায় আর্দ্র জবাব দিলো,
'আমি ওর খালাতো ভাই। ও আমার খালাতো বোন।'
টায়রা একদম কিছুই হয়নি এমন স্বাভাবিক গলায় বলল, 'ওহ। নিভা কই?'
'ছাদে গেছে। বাই দা ওয়ে আপনি ওর কি হন? ফ্রেন্ড?'
'নট জাস্ট আ ফ্রেন্ড উই আর বেস্ট ফ্রেন্ড।'
'মাশাল্লাহ! আমার বোন ভাগ্য করে একটা বেস্ট ফ্রেন্ড জুটাইছিলো। এমন বাঁশমার্কা বান্ধবী পাওয়ার সৌভাগ্য আর কতজনের হতে পারে?'
'কি বললেন আপনি?'
ছোট করে আর্দ্র বলল, 'কিছুনা। টিকলি কেমন আছে?'
'আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছে।'
এরপর কিছুক্ষণ নিরবতা। কথা আদান-প্রদান করার জড়তা, এতোক্ষন আজেবাজে কথা বলার জন্য লজ্জা, এই প্রথম ফোনে কথা বলায় অস্বস্থি। নিরব থাকতে থাকতে প্রথম প্রশ্ন টায়রা করলো,
'পায়ের অবস্থা কেমন এখন?'
'যেমন দেখেছিলেন তেমনি।'
'যত্ন নিবেন। হেলাফেলা করবেন না। রাখছি। নিভা এলে ফোন দিতে বলবেন।'
'আচ্ছা।'
'আল্লাহ হাফেজ।'
'আল্লাহ হাফেজ।'
,
ফুফু বাড়ির আমেজ শেষ করে নিজের ব্যাচেলর বাসাটায় ফিরে আসলো রাহুল। তখন শেষ অপরাহ্ন। রোদ মাথায় নিয়ে বাসায় ঢুকতে গেলেই পাশাপাশি পার হলো আরেক রমণী অথচ কেউ কাউকে তাকিয়ে দেখলো না। চিনলো না। যার যার নিজস্ব গতিতে নিজ নিজ জায়গার উদ্দেশ্যে ছুটলো। রাহুল ছুটলো গরম থেকে একটু রেহাই পেতে ঘরের ফ্যানের উদ্দেশ্যে। নিভা ছুটলো তাড়াতাড়ি বান্ধবী নামক শাকচুন্নির সাথে দেখা করতে। এতোটাই ব্যস্ত পথ পার হলো যে আড়াআড়ি চলে গেলো দুজন অথচ কেউ কাউকে বুঝলো না, খুঁজলো না, অনুভব করলো না, চোখের চাহনিতে আবদ্ধ করলো না। দুটো পরিচিত ব্যক্তি একই সময় একই কালে একই স্থান পার করলো অথচ কেউ কাউকে দেখেও দেখলো না। নিজস্ব উল্লাসের তল্লাসে চলে গেলো ফুরুৎ করে।
______________________________
সেদিনের পর আজ কেটে গেছে তিন দিন। এর মাঝে আদরের কোনো ফোন বা মেসেজ আসেনি। অভিমানে টিকলিও আর ফোন দেইনি। ফোন হাতে নিয়ে কৃত্রিম সবুজ গাসের বারান্দাটাতে বসে টিকলি উদাস চোখে বাইরে তাকিয়ে ছিলো। সন্ধ্যা হওয়ার পূর্বসূচি। পাখিদের নীড়ে ফিরে যাওয়ার তাড়না। দিনের আলো মিলে গিয়ে রাতের অন্ধকারে রূপান্তরিত হওয়ার সূচনা। আদরের নাম্বারটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই অবচেতন মনে ফোন লাগালো। এক দুবার রিং হওয়ার পরই ওপাশে ফোন ধরে গম্ভীর গলায় বলা হলো, 'হ্যালো।'
টিকলি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে রইল ফোনের পানে। মিনিট দুয়েক গড়ালো। আদর বার দশের মতো হ্যালো হ্যালো করে চুপ করে গেলো। টিকলি ফোন কানে ধরলো। বুকের মাঝে উথলে উঠা কান্নারা ঘাপটি মেরে বসে থাকলো সময়ের অপেক্ষায়। ভারী নিঃশ্বাসের সুগভীর কষ্ট প্রকাশযোগ্য হলেই আদর ছন্নছাড়া গলায় বলল,
'এতো দেরি করে ফেললেন টিকলি? তিনটে দিন..।'
টিকলি তখন ভাবছিলো সে বুঝি বেশি দুর্বল। আদর বোধ হয় এমনি কথা বলে তার সাথে। আদর বোধহয় বিরক্ত। আদরের থেকে তো কোনো রেসপন্স আসেনি এখনো। তারপরও কেনো এই লোকের মুখের বুলিগুলো এতোটা গভীর? টিকলির ভাবনার সুতো ছিড়লো আদরের বাণীতে। সব ভুলে গিয়ে মেয়েলী অহং, দর্প, দম্ভ, বড়াই সব একপাশে ফেলে রেখে সে মোহবিষ্ট গলায় বলল,
'আপনিও তো ফোন দেননি ডাক্তার। প্রতিবার কেনো আমিই প্রথম?'
আদর চুপ থাকলো। ক্ষণসময় চুপ থেকে বলল, 'যদি বিরক্ত হন।'
'তার মানে আমি যে ফোন দিলাম আপনি বিরক্তবোধ করছেন?'
আদর তড়িঘড়ি করে ব্যস্ত কণ্ঠে বলল, 'না না না টিকলি৷ একদমি না। আপনি ভুল ভাবছেন।'
'তাহলে সঠিকটা কি ডাক্তার?'
'সঠিকটা এই যে অসীম ব্যস্ততার মাঝেও বারংবার ফোন হাতে নিয়ে আপনার নাম্বার ডায়াল করেও ফিরে আসা।'
টিকলি চোখ বন্ধ করলো। বন্ধ চোখের কোলে খুশির জোয়ার চিকচিক করলো। টিকলি প্রফুল্লতার হাসি হাসলো। কিছুক্ষণ দু'পক্ষের মাঝে নিবিড় নিস্তব্ধতা চলার পর আদর বলল প্রথম হঠাৎ,
'দেখা করবেন টিকলি?'
টিকলি চমকে উঠলো। এতোটাই চমকালো যে আকস্মিক কোনো কথা খুঁজে পেলো না। আদর আবার বলল, 'আপনাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।'
মন্ত্রমুগ্ধ গলায় টিকলি বলল, 'কবে?'
'ইদানীং তো ব্যস্ত থাকি। সময় হবেনা। ব্যস্ততা কাটুক তারপর সময় নিয়ে নাহয়....।'
আদরের কথার মাঝেই প্রফুল্লচিত্তে টিকলি বলল,
'সত্যি?'
'তিন সত্যি।'
চলবে
sandipchandradas, Emran sumon, Md manik, Nazim khan, Md sourav, Md akash shak, Khalid sheikh and লেখাটি পছন্দ করেছে
- Onu kothaশুকতারা
- Posts : 56
স্বর্ণমুদ্রা : 1526
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-05-26
Re: বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ
২৬.
কেটে গেছে দিন পনেরো। ছোট ছোট অনুভূতিতে মত্ত টিকলি-আদরের ফোনালাপ। সপ্তাহে একদিন দুইদিন বিরামহীন আলাপকালে ক্রমেই দূর্বল হয়ে উঠলো আকর্ষণরা। আষাঢ়ে বৃষ্টির পদাচরণ শহর জুড়ে। জল বর্ষণে মুখরিত এবং আরামদায়ক পরিবেশ। বাড়ির পাশে বড় গাছটাতে কদম ফুলে ছেয়ে গেছে। ছাদের একপাশের মাঝারি সাইজের টপে বেলি, জুই, জিনিয়া ফুটেছে। সুন্দর দীপ্তিযুক্ত এই ফুলের সুভাসে বর্ষাকালের আগমন। সাথে অভ্যর্থনা জানায় মেঘলা আকাশকে। আষাঢ় বাদল এমন এক দুপুরে হঠাৎ আদরের ফোন আসবে ভাবতে পারেনি টিকলি। পরিবারের সাথে খেতে বসার সময়টাতেই ফোন এসেছিলো। ফোন কেটে দিলো। সবাই ভ্রু কুচকে তাকালো টিকলির দিকে। খানিকটা ইতস্তত বোধ করে টিকলি জবাব দিলো,
'নিভা ফোন করেছে।'
টায়রা মুখে খাবার পুড়ে জিজ্ঞেস করলো, 'তা ধরলি না কেনো?'
'খেয়ে তারপর কল ব্যাক করবো।' টিকলি খাওয়ায় মনোযোগ দিলো।
চটপট সবার আগে খাওয়া শেষ করে ঘরের দিকে দৌড়ে এগোলো টিকলি। ঝটপট আদরকে ফোন দিয়েই বলল,
'সরি সরি। খাচ্ছিলাম। সবাই সামনে ছিলো।'
আদর ব্যস্ত কণ্ঠে বলল, 'আমি কথা বলার জন্য ফোন দেইনি টিকলি। কথা বলার মতো সময় এখন হাতে নেই। এক্ষুনি অপারেশনে যেতে হবে আমায়। তবে একটা ইনফরমেশন দিতে ফোন করেছি। এক্ষুনি ফোন না দিলে কোনোমতেই শান্তি হচ্ছিলো না।'
'কি ইনফরমেশন ডাক্তার?'
'কাল আমি ফ্রি থাকবো বিকালে। চারটায় দেখা করা চাই ই চাই। কোথায় দেখা করবেন এড্রেস টা মেসেজ করে দিয়েন। রাখছি। বায়।'
টিকলিকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কাটা হলো। উৎফুল্লে মুখের বুলি কপচিয়ে গেলো। এতোটা খুশি হলো যে, বাইরে প্রকাশ পেয়েও পেলো না। অত্যন্ত চাপা আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠলো সদ্য ফুটা প্রেমিক মন। পেছন থেকে তখন কারোর গোয়েন্দার গলা শুনা গেলো,
'কে ব্যাপার রে তোর? কে ফোন করেছিলো?'
টিকলি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। টায়রাকে দেখে নিয়েই জড়োসড়ো হয়ে গেলো। তবুও বাইরে ডাট বজায় রেখে বলল,
'বললাম না নিভা ফোন দিয়েছিলো।'
টায়রা ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করলো, 'সত্যি? কই দেখি?'
টিকলির ফোন নিতে গেলেই টিকলি দু কদম সরে দাঁড়িয়ে অদ্ভুত ভাবে বলল, 'ফোন নিতে হবে কেনো? আমি বলছি তো।'
টায়রা অবাক কণ্ঠে বলল, 'বেশ কিছুদিন যাবত থেকে দেখছি তোর ফোন আসছে বারবার। জিজ্ঞেস করলেই বলিস নিভা ফোন করেছে। নিভার এতো কীসের দরকার তোর কাছে?'
'এমনি। দরকার থাকতে পারেনা?'
টায়রা মৃদু হেসে বলল, 'ওহ তাই? দাড়া এক মিনিট।'
টায়রা আকস্মিক ফোন লাগালো নিভাকে। ওপাশ থেকে নিভা ফোন ধরতেই বলল, 'তুই একটু আগে টিকলিকে ফোন দিছস?'
বৃষ্টিভেজা দিনে ঘুমিয়ে আরাম। দুপুরে খেয়ে নেয়েই কাঁথা মুড়ি দিয়ে ভাত ঘুম দিয়েছে নিভা। টায়রার কথা শুনে ঘুমুঘুমু কন্ঠেই শাসালো সে,
'থাপ্পড় চিনস? এই কথার জন্য ফোন দেওয়া লাগে আবার? টিকলির সাথে গত সাতদিনে আমার ফোনে কথা হয়নাই। মেসেজ হইছে শুধু।'
টায়রা ভার কণ্ঠে বলল, 'আচ্ছা তুই ঘুমা। ডিস্টার্ব করার জন্য সরি।'
ফোন কাটতেই টিকলির দিকে তাকালো টায়রা। টিকলি উদাস চোখে আকাশ ফেটে গড়িয়ে পড়া জল-বর্ষন দেখছিলো। ধরা খাওয়া মুখটা লুকিয়ে চুরিয়ে রাখতে চাইলো ওই আকাশের বুকে। টায়রা বলল খানিকটা ধরা গলায়,
'আমাদের মধ্যে তো কখনো কিছু লুকানো থাকতো না টিকলি। আমাদের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করে ফেললি আপু?'
শেষ শব্দটা বলেই চোখ মুছে ঘর ছেড়ে দৌড়ে পালালো টায়রা। কিছুটা নিরবে অশ্রু গলিয়ে পরলো টিকলির কোমল ফুলা গালবেয়ে। আচ্ছা, টিকলি কি টায়রার সাথে প্রতারণা করে ফেলল? মিথ্যে কেনো বলল? কেনো কষ্ট দিয়ে ফেলল? টিকলি তো চেয়েছিলো আদরের সাথে আগে ওর দেখা হোক। এরপর বুঝুক ব্যপারটা আসলে কোন পর্যায়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো সে। তারপর পুরো ঘটনা টায়রাকে বলবে। হয় টায়রা সারপ্রাইজড হতো নয়তো হতাশ হতো। কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেলো?
________________________________
আর্দ্রর পা ভালো হয়েছে। চলতে ফিরতে অল্প একটু সমস্যা হলেও মানিয়ে নেওয়া যাচ্ছে। দুপুরে খেয়ে ক্লান্ত বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিতেই তার উপর আদেশ এলো ভারসিটি গিয়ে নিভাকে টিফিন বক্সে করে খাবার দিয়ে আসতে। নিভার মা নামক একমাত্র খালামনিটি নাকি নানুবাড়ি গিয়েছে। আর্দ্র বিরক্ত হয়ে বলল,
'মাত্র খাইলাম আম্মু। এখন পারবো না, যাও। তোমার বোনের এতো বাপের বাড়ি যাওয়া লাগে কেনো?'
মনোয়ারা খানের তেজস্বী কণ্ঠ,
'তোদের বাপ-বেটার মতো তো আর কেউ এতো খারাপ না। দু বছর হলো বাপের বাড়ি গিয়ে একটা রাত থাকতে পারি না। সকালে যেতে না যেতেই সন্ধ্যায় ফিরে আসতে হয়। ভালো লাগে না আর বাপু? কিসের ঘানি টানছি? মাঝে মাঝে মনে হয় এসব সংসার টংসার সব চুলোয় যাক। যত জ্বালা আমার। আল্লাহ আমার মরণ নেয় না কেনো? কবরে বসে তোদের বাপ-বেটাদের কার্যকলাপ দেখতাম। দেখি মা ছাড়া কেমনে চলিস? এখন তো কথা শুনছিস না। '
আর্দ্র চোখ মুখ কুচকে খিচ মেরে বিছনায় শুয়ে মায়ের বিলাপ শুনতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর মনোয়ারা খানের নরম কণ্ঠ ভেসে এলো,
'যা না বাবা। তোর বাবা কি আর এখন ওতো পারে এই শরীরে? আদর ও নেই। হাসপাতালে সারাক্ষণ পরিশ্রম করে যাচ্ছে। মেয়েটা কি না খেয়ে থাকবে? ওর মা কতো করে ফোন দিয়ে বলল, মেয়েটাকে একটু দেখে রাখতে। একটু গিয়ে খাবারটা দিয়ে আয়। মেয়েটাকে বাড়ি আসতে বললাম আসবে না। দুপুরের পরে নাকি স্পেশাল দুটো ক্লাস আছে। ক্যান্টিনের খাবারও খায় না। এই খালিপেটে থাকলে তো মেয়েটার অসুখ করবে। একবেলার খাবারটাই তো। রাতে ওর মা এসে পরবে। যা একটু।'
বিরক্ত নিয়ে উঠে বসে আর্দ্র চিল্লিয়ে বলল, 'সবসময় ব্ল্যাকমেইল কেনো করো মা? অসহ্য।'
,
সকাল দিক দিয়ে আজ রোদ উঠলেও দুপুর থেকে আকাশের মন খারাপময় মেঘলা। ভারী বর্ষন হবে বোধ হয়। আর্দ্র বাইকে বসে ভারসিটির গেটে দাঁড়িয়ে ছিলো। মিনিট পাঁচেক পর নিভার আগমন। পেছন পেছন গুটিগুটি পায়ে আরেক রমণীর আগমন বার্তা। আর্দ্রর চোখ পরলো নিভা পার করে সেই রমণীর উপর। আর্দ্র তাকালো ভালো মতোন। হেসে খিলখিল করে কথা বলে এগিয়ে আসছিলো ধীরে ধীরে। কি অদ্ভুত তার চুল খেলানোর দৃশ্য, চোখ বড় করার অভ্যাস, মুচকি হেসে হেসে শাসিয়ে কথা বলার ধরন। আর্দ্র নিমিত্তে তাকিয়ে থাকলো। তাকিয়ে থাকতে থাকতেই কেউ সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলল,
'এই আর্দ্র ভাইয়া? কই তাকায় আছো? খাবার দেও। খিদা লাগছে।'
চমকে নিভার দিকে তাকিয়ে আর্দ্র আবারো একই স্থানে দৃষ্টি আবদ্ধ করলো। দৃষ্টিতে কেউ ধরা না দিতেই দেখা গেলো নিভার ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে আছে দৃষ্টি খোঁজা সেই রমণী।
আর্দ্র খাবার দিচ্ছে না দেখে আর্দ্রর হাত থেকে খাবারটা কেড়ে নিলো নিভা। এরপর বলল,
'মিট মাই ফ্রেন্ড টায়রা...।'
অবচেতনে আর্দ্র বলল, 'জানি।'
অবাক কণ্ঠে নিভা বলে, 'জানো?'
সম্ভিত ফিরে আর্দ্র পকেটে হাত গুজে দাড়ালো। একান্ত নিজস্ব ভঙ্গিতে বলল,
'অবশ্যই চিনি তো ইনাকে। এমন মাথামোটা পাগল বাচাঁল মানুষকে কে চিনবে না বল তো? ঢাকা শহরে এমন মহিলা আর একটাও খুঁজে পাওয়া যাবে বলে তো আমার মনে হয় না।'
টায়রা তেড়ে এসে বলল, 'ইউ ভাদ্র।'
টায়রার স্টাইলেই আর্দ্র বলল, 'ইউ ফুটা টায়ার... জাস্ট সাট আপ।'
'ইউ সাট আপ।'
নিভা বিস্ফোরণ চোখে ওদের দেখতে দেখতে বলল,
'তোমরা একে অপরকে চিনো কীভাবে?'
আর্দ্র চুপ হয়ে মিনিট খানিক ভাবতে লাগলো এখন কি বলা যায়। তারপর বলল,
'তুই যে আমাদের বাসায় এসে ছাদে গেলি। তোর ফোনে ময়নাপাখি ২ নামে সেভ করা নাম্বার থেকে ফোন এলো। তখন তোর ফোন আমি রিসিভ করেছিলাম। এই মহিলা তো রীতিমতো আমাকে কিডনাপার বানিয়ে দিয়েছিলো সেইদিন।'
নিভা তবুও বোকার মতোন বলল,
'আমি তাও বুঝলাম না। ও ফোন দিয়েছে কিন্তু তুমি ওকে চিনলে কীভাবে?'
আর্দ্রকে থামিয়ে দিয়ে টায়রা বলল,
'আমি বলছি শোন, তোকে বলেছিলাম না নিঝুম দ্বীপে আমাদের সাথে দুজন ছেলে ছিলো। আমাদের অনেক হেল্প করেছে। ইনারাই তারা। আদর এবং এই ভাদ্র।'
নিভা তাকিয়ে থাকলো মিনিট খানিক হা করে। আর্দ্র নখ কামড়ে ভাবতে লাগলো,
'নিভা না বাসায় গিয়ে আবার আব্বুর সামনে বলে দেয়। আব্বুর সামনে বললেই আব্বু আবার ভাইয়ার বিয়ে নিয়ে লাফাবে। তারউপর এক পা বাড়িয়ে উল্টো পাল্টা ভেবে নিজ দায়িত্বে সবার অজান্তে বিয়ে ঠিকও করে ফেলতে পারে। পরে ভাইয়া আমার গর্দান নিবে।'
টায়রার কথায় আর্দ্রের ভাবনায় ভাটা পরলো,
'তোর মতো এতো ভালো একটা মেয়ের আর আদর ভাইয়ার মতো এতো সুইট একটা ছেলের এমন বলদ বেয়াদব মার্কা ভাই কীভাবে থাকতে পারে? আমি তো ভেবেই পাগল হয়ে যাই।'
আর্দ্র মুখ থেকে হাত সরিয়ে ঠোঁট বিকৃত করে জবাব দিলো,
'এ্যাহ... নিজে খুব ভালো মনে হয়। টিকলির মতো এতো ভদ্র একটা মেয়ের এমন একটা অভদ্র ফুটা টায়ার মার্কা বোন কীভাবে থাকতে পারে আমিও ভেবে পাই না। এই তুই কি খায়ে এরে বান্ধুবী বানাইছোস? আবার ফোনে নাম্বার সেভ কইরে রাখছোস ময়নাপাখি ২। বাই দ্যা ওয়ে, ময়নাপাখি ১ কে ?'
আর্দ্র ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করলো। নিভা চোখ মুখ কুচকে জবাব দিলো, 'টিকলি।'
'ওহ ভালো কথা। আমার বোন আসে নাই? আমার বোনরে তো দেখি না।'
'আমি তো চোখের সামনেই দাঁড়িয়ে আছি ভাইয়া। কাকে খুঁজো তুমি?'
'তোরে কে খুজঁছে? টিকলি কই?'
'আসে নাই মাথা ব্যথা।'
টায়রা অন্যদিকে তাকিয়ে মুখ ভার করে জবাব দিলো। মনটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেলো। টিকলি আজ কেনো আসলো না কে জানে? এমন কখনো হয়নি টিকলিকে ছাড়া টায়রা একা ভারসিটি এসেছে। আজ প্রথম। আর্দ্র আড়চোখে তাকিয়ে থাকলো টায়রার ওই দুঃখী ভারাক্রান্ত মুখটার দিকে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে বাইক স্টার্ট দিয়ে শা... করে চলে গেলো ঠিক সেদিন টায়রা যেভাবে চলে গিয়েছিলো।
________________________________
ঝুম ঝুম বৃষ্টি মাথায় নিয়ে তড়িঘড়ি করে রেসটুরেন্ট ঢুকলো টিকলি। জামা ভিজে একাকার। আধভেজা শরীরে রেসটুরেন্টে পা রাখতেই খিদখিদ লাগতে শুরু করলো। দেখা করার কথা ছিলো খোলা আকাশের নিচে মাঠের তেপান্তরে অবাধ্য নদীর ঢেউয়ের পাড়ে কিন্তু এই বৃষ্টিটাই বাধ সাজলো। সবসময় বৃষ্টি ভালোকিছু বয়ে আনে না কিংবা সুখেরও হয়না। ভেজা জামা ঝাড়তে ঝাড়তেই টিকলি ফোন লাগালো আদরকে।
'এসেছেন আপনি?'
'জি। বাম পাশের তিন নম্বর টেবিলটা।'
ফোন কানে ধরেই হালকা উঁকিঝুঁকি দিতেই টিকলি পেয়ে গেলো। এখান থেকে লোকটার পেছনের অর্ধঅংশ এবং বাম হাতের বাদামী রঙের ঘড়িটা দেখা যাচ্ছে। দেখা পাওয়া মাত্র এক অনাবিল সুখে, আনন্দে, শান্তিতে টিকলির আত্মা ঠান্ডা হয়ে গেলো। হঠাৎই মনে হলো, স্বার্থক আজকে নার্ভাসনেস এ ভারসিটি না যাওয়া, এই বৃষ্টি, এই কর্দমাক্ত দিন, এই আধ ভেজা শরীর।
কান থেকে ফোন সরিয়ে অনেক আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এগিয়ে সামনে যেতেই দেখা হয়ে গেলো খুব অনাকাঙ্ক্ষিত একটা মানুষের সাথে। মানুষটিকে চিনতে মিনিট দুই সময় লাগলো। মাস্কের সেই ফালতু লোকটার কথা মনে পরতেই টিকলি আঙ্গুল তুলে চেঁচিয়ে উঠলো,
'আপনি....'
আদর বসে অপেক্ষা করছিলো কাঙ্ক্ষিত মানুষটার জন্য। হঠাৎ কারোর বাজখাঁই গলার কন্ঠস্বরে আদর ঘুরে তাকাতেই দেখা গেলো, একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাথায় স্কাপ, মুখে মাস্ক, জামা কাপড় ভিজে একাকার। মেয়েটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে আদর বুঝার চেষ্টা করলো তার এমন অভদ্র আচরণের কারণ। ভালো ভাবে পরখ করতেই দেখলো, এটা সেই বোকা পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট মেয়ে। বুঝা মাত্রই আদর চট করে উঠে দাড়ালো। নিজ তেজি গলায় বলল,
'আপনি??'
টিকলি চোখ বড় বড় করে বলল, 'আপনি এই টেবিলে কেনো?'
আদর পকেটে হাত ডুকিয়ে তারস্বরে বলল,
'কেনো টেবিলটা কি আপনার সো কল্ড পনেরো দিনের বাচ্চার বাবা কিনে নিয়েছে?'
'ফালতু কথা বলবেন না।'
'ওহ আচ্ছা এটা তবে ফালতু কথা? তাহলে ভালো কথা বলি। আপনার বাচ্চার এখন কত মাস চলছে জানি? উমমম...ঠিক মনে করতে পারছি না। তবে পাঁচ-ছয় মাস তো হওয়ার ই কথা ছিলো। কিন্তু আপনার পেটের তো কোনো ইম্প্রুভমেন্ট নাই। হায় আল্লাহ! বাপের মতো ধোকাবাজ হলো বুঝি? ইশশ আমার এখন আপসোস হচ্ছে নিউরোলজিস্ট না হয়ে গাইনোকোলজিস্ট কেনো হলাম না?'
'এই দেখুন, বেশি বাড়াবাড়ি করবেন না।'
'এই দেখাদেখির অভ্যাস টা আর আপনার গেলো না। নিন কি দেখাবেন দেখান?'
'ইডিয়েট। অত্যাধিক মাত্রায় বাড়াবাড়ি করছেন এবার।'
'বাড়াবাড়ি আপনি করছেন। সুন্দর দিনের সুন্দর একটা মুহুর্ত সুন্দর একটা মুড আপনাকে দেখেই নষ্ট হয়ে গেলো।'
আদরের এহেন কথায় হঠাৎ একটা আকস্মিক কাজ করে বসলো টিকলি। মুখ থেকে মাস্ক সরিয়ে ঝগড়ায় তাল দিলো,
'আর আপনাকে দেখে মনে হয় আমার মুড একদম রেললাইনের গতিতে চলছে? আপনাকে আমার বিন্দুপরিমাণ দেখতে ইচ্ছে করে না। আই উইশ আর কখনো আপনার এর ফাটাবাঁশের মতো চেহারার সাথে আমার দেখা না হতো।'
আদর স্তব্ধ, নিস্তব্ধ, নিরব দর্শকের মতো শুনে গেলো। শুধু তাকিয়ে থাকলো ওই মুখখানার দিকে যে মুখটার দিকে তাকালেই হৃদয়-বুক জমিন কেঁপে যায়। ভূমিকম্প শুরু হয় মন-আসমান জুড়ে। ওই চশমার আড়ালে যে দুটো চোখ দেখার আদরের খুব ইচ্ছে ছিলো তা আজও আড়াল হয়ে আছে লেন্সের পেছনে। ইশশ...এই কপাল! এই কপাল থেকে শুরু হওয়া দু গাছি চুল তো আদরের খুব প্রিয়। তবুও আদর বুঝতে পারলো না। ধরতে পারলো না। কণ্ঠ শুনেও বুঝতে পারলো না? কীভাবে সম্ভব?
টিকলি তখনো বলছিলো,
'কথা বলছেন না কেনো?'
আদর আস্তে করে নিজের মুখ থেকে মাস্ক খুলল। টিকলি চোখ বড় বড় করে তাকালো। আস্তে আস্তে চোখ শীতল হলো। দগ্ধ হলো। পুড়লো। টিকলি হঠাৎ বসে পরলো একটা চেয়ারের উপর। চোখ মুখ ঢেকে রাখলো হাতের দশ আঙ্গুল দিয়ে। মাথার চুল খিচে ধরলো। অনুভব করতে পারলো না কিচ্ছু। হাহাকার বিভীষিকাময় কষ্টে হঠাৎই বুকটা ছেয়ে উঠলো। নতুন নতুন অনুভূতি গুলো কি তবে এখানেই শেষ হয়ে যাবে? এখানেই কি তবে ইতি ঘটে যাবে হয়েও হলো না ভালোবাসার? প্রেম প্রেম গন্ধ কি তবে দুর্গন্ধ ছড়াবে?মরে যাবে কি অনুভব পাখিরা? খুব অজান্তেই... খুব বেশি অজান্তেই ভুল হয়ে গেলো। মস্ত বড় ভুল। কলি বের হওয়া গাছটাতে ফুল প্রস্ফুটিত হওয়ার আগেই মরে গেলো। আর হবে কি কখনো এক হওয়া?
আদর খুব গোপন নিরবে বেরিয়ে গেলো রেসটুরেন্ট থেকে। টিকলি আরো বেশি ভেঙে পরলো। উপরে তাকিয়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করতেই দেখা গেলো আজও সেই রেস্টুরেন্টে। প্রথম যেদিন এই ফালতু লোকটার সাথে দেখা হয়েছিলো। প্রথম যেদিন টিকলি পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট সেজেছিলো। প্রথম যেদিন নিজের অহেতুক বোকামির পরিচয় দিয়ে আদরের কাছে অপমানিত হয়েছিলো। মজার কারণ হয়েছিলো। আদর নামক এই বেয়াদব ব্যক্তি বিরক্তির কারণ হয়ে উঠেছিলো টিকলির মনের কাছে।
চলবে
আগের পর্বের লিংক- [Only admins are allowed to see this link]ৃষ্টিশেষে_প্রেমছন্দ
[Only admins are allowed to see this link]ুমুর্ষিরা_শাহরীন
২৫.
নিভা গিয়ে আর্দ্রর পাশে সোফায় বসে বলল, 'তুমি অসুস্থ খালামনি কাল আম্মুকে ফোন দিয়ে বলল তাই আসলাম।'
মনোয়ারা খান খুশিতে গদগদ হয়ে বললেন, 'বাহ! বেশ ভালো করেছিস। আয় দেখি খেতে বস তোর আদর ভাইয়ার সাথে।'
সোফা ছেড়ে উঠে গিয়ে টেবিলে বসতে বসতে আদরের দিকে প্রশ্ন ছুড়লো নিভা, 'কেমন আছো বস?'
হালকা হেসে আদর উত্তর দিলো, 'এইতো যাচ্ছে। তোমার কি খবর? পড়াশোনা কেমন চলছে?'
'বেদনাদায়ক!'
'ফাঁকিবাজ।'
নিভা হেসে দিলো। আদর টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
'তবে থাকো। আমি যাই। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। মা গেলাম। খোদা হাফেজ। '
রান্নাঘর থেকে মনোয়ারা খান জবাব দিলেন, 'সাবধানে যাস বাবা। গিয়ে মাকে ফোন করতে ভুলিস না।'
খাবারের প্লেট নিয়ে নিভা আর্দ্রর পাশে এসে আবার বসলো। টিভি দেখতে দেখতে একসময় খাওয়া শেষ হলো। নিভা বলল, 'ছাদে যাই ভাইয়া?'
'একা?' আর্দ্র প্রশ্ন করলো ভ্রু কুচকে।
'হুম। তা নয়তো কে যাবে? তুমি তো পা ভেঙে বসে আছো।'
'দরকার নেই। তিনতলায় ব্যাচেলর ভাড়া দেওয়া হয়েছে।'
'এমা! কবে?'
'এইতো তিনমাস আগে। তুই তো প্রায় ছয় মাস থেকে আমাদের বাসায় আসিস না।'
'তোমরা যাও?'
সোফায় হেলান দিয়ে বসে আর্দ্র হাই তুলে বলল, 'না। আলসেমি লাগে।'
মুখ ভেঙিয়ে নিভা জবাব দিলো, 'হুম সেটাই। গেলাম আমি। ব্যাচেলররা এতো সকালে ঘুম থেকে উঠে না। আর উঠলেও কি? একটু চান্স ফান্স পাওয়া যাবে। সিংগেল থেকে মিংগেল হওয়ার একটা সুযোগ অন্তত পাবো।'
অবহেলার গলায় আর্দ্র বলল,
'লাভ নেই। দুজন বিবাহিত। একজন গেছে ফুফুর বাসায় আরেকজন বোধ হয় এখন টিউশনিতে আছে।'
'ওহ....মাই বেড লাক।'
হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে নিভা ছাদের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। সেন্টার টেবিলে নিভার ফোন পরে থাকতে দেখে আর্দ্র গলা উঁচিয়ে চিৎকার করে বলল,
'এই ফোন নিয়ে গেলি না?'
'রেখে দেও ভাইয়া। ফোন দেওয়ার মতো কেউ নেই। কষ্টে জীবন ত্যানাত্যানা।'
'মেয়েটা ভারী দুষ্টু হয়ে গেছে।'
বিড়বিড় করে আর্দ্র ফোনটা যথাস্থানে রাখলো। রাখার খানিক বাদেই বাজঁখাই গলায় ফোন চিল্লিয়ে উঠলো। আর্দ্র ভ্রু কুচকে তাকাতেই অবাক হয়ে গেলো। বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মুখের কথা হারিয়ে ফেলল। কপালে কিছু সূক্ষ্ম ভাঁজ, মুখে অপ্রত্যাশিত ছায়া, চোখ জোড়া কুচকিত। আর্দ্র ফোন হাতে তুলে নিলো। ফোনের পুরো স্ক্রিন জুড়ে ভেসে উঠেছে টায়রার ঠোঁট চেপে অল্প জিব বের করা বাম চোখ টিপা দুষ্ট মুখচ্ছবি। নাম্বার সেভ করা 'ময়নাপাখি ২' দিয়ে। পাজি সেই ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ফোন কেটে গেলো। আর্দ্র হুশে ফিরে নিজের বাম হাতটার দিকে তাকালো। এইতো...কাল এই মেয়েটার সাথে দেখা হয়েছিলো। বেশি বুঝা মস্তিষ্ক ভেবেছিলো আর কোনোদিন হয়তো দেখা হবে না। ভাগ্যের ফেরে আজ আবার....?
বোকা মস্তিষ্কের কথা ভাবতে ভাবতেই ফোন তার নিজস্ব ক্ষমতায় আবারো আন্দোলন করে উঠলো। এবারো ফোন কেটে গেলো। আকস্মিক এই ব্যক্তির ফোনকলে বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়েছে আর্দ্র। তৃতীয় বার ফোন বাজতে বাজতে কেটে যাওয়ার আগ মুহুর্তে আর্দ্র রিসিভ করলে ও পাশ থেকে কেউ চড়া গলায় বলল,
'ওই শালী, ফোন দিয়ে আমি শহিদ হয়ে যাইতাছি আর তুই কি করতাছোস হ্যাঁ? ঘুম পারতাছোস এখনো? এদিকে আমি তোমারে ফোন দিয়ে মরি ওদিকে তুমি অবলীলায় ঘুমাও?'
টায়রার ভাষা দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে পরলো আর্দ্র। ভীষণমাত্রায় অবাক হয়ে মাত্রাতিরিক্ত গম্ভীর গলায় বলে উঠলো,
'হ্যালো।'
টায়রার ভ্রু জোড়া কুচকে গেলো। এক মুহুর্ত চুপ থেকে আবারো তার ডাইনির ন্যায় গলায় চিল্লিয়ে বলে উঠলো,
'এই... আপনি কে? আমার বান্ধবীর ফোন আপনার কাছে কেনো? কি করছেন আমার বান্ধবীর সাথে? আমি যতদূর জানি ওর তো কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই। অবিয়াত্তা। তাহলে আপনি কে? কিডনাপ করছেন....? আমি তাহলে এই মুহুর্তে একজন কিডনাপার এর সাথে কথা বলছি?'
শেষের লাইন টায়রা বিস্ফোরিত গলায় বলল। আর্দ্র হতবিহ্বল, হতবাক চোখে শূন্যে চেয়ে রইল। এই মেয়েটা এতো বেশি বুঝে যে কিডনাপার এর উপাধিটাও লাভ করে ফেলল আর্দ্র। এই মুহুর্তে তার কেদে বুক ভাসাতে ইচ্ছে করলো হঠাৎ। ভাঙাচোরা হৃদয় নিয়ে বলে উঠলো,
'টায়রা....'
আর্দ্রের কথার মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে টায়রা টেনে টেনে বলল,
'ওহ...মাই...গড, আমার নামও জানেন? কে আপনি তাড়াতাড়ি বলুন। তা নাহলে পিছে এমন ডান্ডা দেবোনা দাড়ালে বসতে পারবেন না আর বসলে শুতে পারবেন না।'
আর্দ্র ধমকে বলল এবার,
'কি আবোলতাবোল বকছেন? বলছি তো আমি...'
টায়রা বিরবির করে বলল, 'কণ্ঠটা কেমন চেনা চেনা লাগলো।' পরমুহূর্তেই আবারো গগনবিদারী গলায় বলল,
'কে আপনি? পরিচিত? পরিচিত হয়ে এভাবে বাঁশ দিলেন? আমার বান্ধবীকে কিডনাপ করলেন? এখন নিশ্চয়ই মুক্তিপণ চাইবেন। দেখুন ভাই, ওতোসব টাকা-পয়সার মালিক আমি না। আর আমার বান্ধবীর বাবা হার্টের পেসেন্ট মা হাই-প্রেসার এর পেসেন্ট। তাই ওদের তো কোনোমতেই বলা যাবে না। যদি বাই চান্স মেয়ের শোকে মরে টরে যায় তাহলে ফোন দেওয়ার অপরাধে আমার দোষ হবে। তার চেয়ে এক কাজ করুন, আমার বান্ধবীকে বিয়ে করে ফেলুন। এখন যা টাকা মুক্তিপণ হিসেবে চাইতেন বিয়ের যৌতুক হিসেবে তা সুদে-আসলে তুলে নিবেন। যদিও যৌতুক হারাম। তবুও কিডনাপার রা তো মায়া-দয়াহীন হয়। খুন টুন ও করে ফেলে নাকি। থাক ভাই আমার বান্ধবীকে বাচিঁয়ে রেখে বিয়ে করে ফেলেন। আমাকে দাওয়াত দিয়েন। এত্তোবড় গিফট নিয়ে যাবোনি। আইডিয়া টা কেমন দিলাম বলুন...? রাজ্যের মহর সাথে রাজকন্যা ফ্রি। ভাবতেই ভিষণ অবাক লাগছে জানেন, যে আমি একজন কিডনাপারের সাথে কথা বলছি। হাউ ব্রেভ আই এম! আই এম প্রাউড অফ মি।'
টায়রার অনবরত বিরামহীন কথা শুনতে শুনতেই যেনো আর্দ্রর পায়ে ব্যথা বেড়ে গেলো। টায়রার কথার ইতি ঘটতেই ক্লান্ত গলা ঠেসে দিয়ে আর্দ্র বলল,
'শেষ মিস. ফুটা টায়ার? মানে সিরিয়াসলি? একটা মানুষ এতোটা বিরক্তিকর বাঁচাল কীভাবে হতে পারে? বুদ্ধিহীনতারও তো একটা সীমা আছে নাকি?'
'আপনি আমাকে ইনসাল্ট করছেন? কে আপনি? নাম বলুন। থানায় ফোন দিবো। কেস করবো। মামলা ঠুকবো। আপনাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবো। জেলে ডুকাবো। আপনাকে ফাসিতে...'
টায়রার কথা শেষ করতে না দিয়েই আর্দ্র উচ্চস্বরে চিল্লিয়ে উঠলো,
'সাট আপ। আমি আর্দ্র। '
আর্দ্রের উচ্চবাক্যে কেঁপে গেলো ফোন, ফোনের ওপাশের টায়রা। কান থেকে ফোন সরিয়ে চোখের সামনে ধরে নাম্বার দেখে ভ্রু কুচকে সচেতন দৃষ্টিতে তাকালো। এরপর বিস্ময়তা নিয়ে বলল,
'আপনি কেনো? আমার বান্ধবীর ফোনে আপনি কি করছেন? ও কোথায়...'
'চুপ করবেন?' আর্দ্র ধমকে উঠলো আবারো।
টায়রা ঠোঁট উল্টে বলল, 'আপনি আমাকে ধমক দিলেন?'
আর্দ্র চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই মেয়ের পকপকানিতে রীতিমতো মাথা ব্যথা ধরে গেছে। শান্ত গলায় আর্দ্র জবাব দিলো,
'আমি ওর খালাতো ভাই। ও আমার খালাতো বোন।'
টায়রা একদম কিছুই হয়নি এমন স্বাভাবিক গলায় বলল, 'ওহ। নিভা কই?'
'ছাদে গেছে। বাই দা ওয়ে আপনি ওর কি হন? ফ্রেন্ড?'
'নট জাস্ট আ ফ্রেন্ড উই আর বেস্ট ফ্রেন্ড।'
'মাশাল্লাহ! আমার বোন ভাগ্য করে একটা বেস্ট ফ্রেন্ড জুটাইছিলো। এমন বাঁশমার্কা বান্ধবী পাওয়ার সৌভাগ্য আর কতজনের হতে পারে?'
'কি বললেন আপনি?'
ছোট করে আর্দ্র বলল, 'কিছুনা। টিকলি কেমন আছে?'
'আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছে।'
এরপর কিছুক্ষণ নিরবতা। কথা আদান-প্রদান করার জড়তা, এতোক্ষন আজেবাজে কথা বলার জন্য লজ্জা, এই প্রথম ফোনে কথা বলায় অস্বস্থি। নিরব থাকতে থাকতে প্রথম প্রশ্ন টায়রা করলো,
'পায়ের অবস্থা কেমন এখন?'
'যেমন দেখেছিলেন তেমনি।'
'যত্ন নিবেন। হেলাফেলা করবেন না। রাখছি। নিভা এলে ফোন দিতে বলবেন।'
'আচ্ছা।'
'আল্লাহ হাফেজ।'
'আল্লাহ হাফেজ।'
,
ফুফু বাড়ির আমেজ শেষ করে নিজের ব্যাচেলর বাসাটায় ফিরে আসলো রাহুল। তখন শেষ অপরাহ্ন। রোদ মাথায় নিয়ে বাসায় ঢুকতে গেলেই পাশাপাশি পার হলো আরেক রমণী অথচ কেউ কাউকে তাকিয়ে দেখলো না। চিনলো না। যার যার নিজস্ব গতিতে নিজ নিজ জায়গার উদ্দেশ্যে ছুটলো। রাহুল ছুটলো গরম থেকে একটু রেহাই পেতে ঘরের ফ্যানের উদ্দেশ্যে। নিভা ছুটলো তাড়াতাড়ি বান্ধবী নামক শাকচুন্নির সাথে দেখা করতে। এতোটাই ব্যস্ত পথ পার হলো যে আড়াআড়ি চলে গেলো দুজন অথচ কেউ কাউকে বুঝলো না, খুঁজলো না, অনুভব করলো না, চোখের চাহনিতে আবদ্ধ করলো না। দুটো পরিচিত ব্যক্তি একই সময় একই কালে একই স্থান পার করলো অথচ কেউ কাউকে দেখেও দেখলো না। নিজস্ব উল্লাসের তল্লাসে চলে গেলো ফুরুৎ করে।
______________________________
সেদিনের পর আজ কেটে গেছে তিন দিন। এর মাঝে আদরের কোনো ফোন বা মেসেজ আসেনি। অভিমানে টিকলিও আর ফোন দেইনি। ফোন হাতে নিয়ে কৃত্রিম সবুজ গাসের বারান্দাটাতে বসে টিকলি উদাস চোখে বাইরে তাকিয়ে ছিলো। সন্ধ্যা হওয়ার পূর্বসূচি। পাখিদের নীড়ে ফিরে যাওয়ার তাড়না। দিনের আলো মিলে গিয়ে রাতের অন্ধকারে রূপান্তরিত হওয়ার সূচনা। আদরের নাম্বারটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই অবচেতন মনে ফোন লাগালো। এক দুবার রিং হওয়ার পরই ওপাশে ফোন ধরে গম্ভীর গলায় বলা হলো, 'হ্যালো।'
টিকলি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে রইল ফোনের পানে। মিনিট দুয়েক গড়ালো। আদর বার দশের মতো হ্যালো হ্যালো করে চুপ করে গেলো। টিকলি ফোন কানে ধরলো। বুকের মাঝে উথলে উঠা কান্নারা ঘাপটি মেরে বসে থাকলো সময়ের অপেক্ষায়। ভারী নিঃশ্বাসের সুগভীর কষ্ট প্রকাশযোগ্য হলেই আদর ছন্নছাড়া গলায় বলল,
'এতো দেরি করে ফেললেন টিকলি? তিনটে দিন..।'
টিকলি তখন ভাবছিলো সে বুঝি বেশি দুর্বল। আদর বোধ হয় এমনি কথা বলে তার সাথে। আদর বোধহয় বিরক্ত। আদরের থেকে তো কোনো রেসপন্স আসেনি এখনো। তারপরও কেনো এই লোকের মুখের বুলিগুলো এতোটা গভীর? টিকলির ভাবনার সুতো ছিড়লো আদরের বাণীতে। সব ভুলে গিয়ে মেয়েলী অহং, দর্প, দম্ভ, বড়াই সব একপাশে ফেলে রেখে সে মোহবিষ্ট গলায় বলল,
'আপনিও তো ফোন দেননি ডাক্তার। প্রতিবার কেনো আমিই প্রথম?'
আদর চুপ থাকলো। ক্ষণসময় চুপ থেকে বলল, 'যদি বিরক্ত হন।'
'তার মানে আমি যে ফোন দিলাম আপনি বিরক্তবোধ করছেন?'
আদর তড়িঘড়ি করে ব্যস্ত কণ্ঠে বলল, 'না না না টিকলি৷ একদমি না। আপনি ভুল ভাবছেন।'
'তাহলে সঠিকটা কি ডাক্তার?'
'সঠিকটা এই যে অসীম ব্যস্ততার মাঝেও বারংবার ফোন হাতে নিয়ে আপনার নাম্বার ডায়াল করেও ফিরে আসা।'
টিকলি চোখ বন্ধ করলো। বন্ধ চোখের কোলে খুশির জোয়ার চিকচিক করলো। টিকলি প্রফুল্লতার হাসি হাসলো। কিছুক্ষণ দু'পক্ষের মাঝে নিবিড় নিস্তব্ধতা চলার পর আদর বলল প্রথম হঠাৎ,
'দেখা করবেন টিকলি?'
টিকলি চমকে উঠলো। এতোটাই চমকালো যে আকস্মিক কোনো কথা খুঁজে পেলো না। আদর আবার বলল, 'আপনাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।'
মন্ত্রমুগ্ধ গলায় টিকলি বলল, 'কবে?'
'ইদানীং তো ব্যস্ত থাকি। সময় হবেনা। ব্যস্ততা কাটুক তারপর সময় নিয়ে নাহয়....।'
আদরের কথার মাঝেই প্রফুল্লচিত্তে টিকলি বলল,
'সত্যি?'
'তিন সত্যি।'
চলবে
Sadman alom, Faria oishy, Md akash shak, Khalid sheikh, Abu talha, Nazrul islam, Md Abdullah and লেখাটি পছন্দ করেছে
- Onu kothaশুকতারা
- Posts : 56
স্বর্ণমুদ্রা : 1526
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-05-26
Re: বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ
২৭.
কাকভেজা শরীরেই বিছানায় বসে পরলো টিকলি। বিছানার এক কোণায় আধশোয়া অবস্থায় ফোন চালাচ্ছিলো টায়রা। বিছানা কেপে উঠতেই সে তাকালো। ভেজা শরীর নিয়ে বিছানায় বসতে দেখে টায়রা বিরক্ত হলো। গম্ভীর গলায় বলল,
'বিছানা ভিজে যাচ্ছে।'
টিকলির কোনো হেলদোল পাওয়া গেলো না। টায়রা ভ্রু কুচকে তাকালো। এবার খানিক উঁচু গলায় বলল,
'বিছানা ভিজে যাচ্ছে তো।'
তখন হঠাৎ টিকলির চোখ থেকে টপ করে পানি পরলো তার মসৃণ হাতের উপর। টায়রা থেমে গেলো। রাগ-ক্ষোভ অভিমান ভুলে তড়িঘড়ি করে এগিয়ে এসে টিকলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নরম গলায় বলল,
'কি হয়েছে?'
টিকলি অতর্কিতভাবে ঝাপটে ধরলো টায়রাকে। বাধন ছাড়া কান্নায় মত্ত হতে হতেই হেচকি উঠে গেলো। ঘরময় কেঁপে উঠলো টিকলি আর্তনাদময় বেদনার অভিসারে। টায়রার বুকে অঘটন ঘটার পূর্বাভাস। টিকলিকে বুক থেকে সরিয়ে টায়রা তাড়াতাড়ি ঘরের কাঠের দরজাটা ঠেলে বন্ধ করে দিয়ে এলো। এরপর আবার টিকলিকে জড়িয়ে ধরে বসলো। টিকলির কান্নার বেগ বাড়লো। টায়রা দিশেহারা পথভ্রষ্ট পথিকের মতো এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো।
টিকলি কাদে না। খুব বেশি যখন কষ্ট পায় তখন এভাবে চিতকার করে কাদে। বোনকে কাদতে দেখে টায়রার চোখ বেয়েও পানি পরলো। ওই যে বলেছিলাম, টায়রা প্রচুর কাদতে পারে। কিছুক্ষণ পর টিকলির কান্নার মাত্রা কমলো। টায়রা তখন শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো,
'কি হয়েছে আমাকে বল? কে বকেছে তোকে? আমি দেখে নিবো তাকে।'
টিকলির থেকে উত্তর পাওয়া গেলো না। টায়রা উৎকন্ঠা নিয়ে টিকলির হাত পা ভালো করে দেখে নিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো,
'কোথায় গিয়েছিলি এই বৃষ্টির মাঝে? বল না বল। কেউ কিছু করেছে? খারাপ কিছু হয়েছে তোর সাথে? শরীরের কোথাও কেউ হাত দিয়েছে? কাদছিস কেনো? একবার নামটা বল দেখ আমি কি করি....'
'আমি আদরকে ভালোবাসি।' টিকলি কাদার মাঝেই আস্তে করে বলল। টায়রা শুনলো না টিকলির কথা নিজের মতো কথা বলতে যাওয়ার মাঝেই টিকলি আরেকবার জোরে বলল, 'টায়রা, আমি আদরকে ভালোবাসি।'
টায়রা থেমে স্তব্ধ হয়ে গেলো। নিষ্প্রাণ চোখে তাকিয়ে থাকলো টিকলির দিকে। টর্নেডোর মতো আশেপাশে সব ঘুরপাক খেলো। মুখের বাক শক্তি হারিয়ে শুধু এক নিমিত্তে তাকিয়েই থাকলো। টিকলি আবার বলল,
'আমি আজ উনার সাথেই দেখা করতে গিয়েছিলাম।'
'তুই আমাকে একবারও বললি না টিকলি?' টায়রার করুণ গলা। চোখের পাতা বন্ধ করে ঠোঁট চেপে টিকলি বলল,
'আমি ভেবেছিলাম উনার সাথে দেখা করার পর তোকে সব বলবো।'
'তো কানতাছোস কেন? ভালোবাসছোস দেখা করছোস এখন দেখমু প্রেমও হয়ে যাবো। এখন আইসে কান্নাকাটি করতাছোস কেন? আমি তো আর তোর কেউ না।'
টায়রা তেজস্বী গলায় বলল। টিকলি কোনো উত্তর না দিলে টায়রা আবার জিজ্ঞেস করলো, ' আদর ভাই তোরে ভালোবাসে না? কথা বলোস তোরা ফোনে? নাম্বার কেমনে পাইছোস? যোগাযোগ কেমনে?'
টিকলি উদাস চোখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে উত্তর দিলো, 'উনি ভালোবাসে কিনা আমি জানিনা।'
'যোগাযোগ কেমনে হইলো? নাম্বার পাইছস কেমনে?' টায়রা ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করলো।
'মামাজান আমাকে যে নিউরোলজিস্ট এর কাছে নিয়ে গেছিলেন সেই ডাক্তারই উনি ছিলেন।'
'ওহ! এরপরই সব হয়ে গেলো? এরজন্যই তোমার এতো ঘন ঘন ফোন আসে? আর বারবার উনি উনি করোস কেন? জামাই লাগে তোর?' টায়রা ধমক দিয়ে বলল।
'তুই আমার সাথে মজা করতাছোস? ফাইযলামি লাগতাছে এসব তোর কাছে?'
টিকলির রাগী গলা। হাই তুলে টায়রা উত্তর দেয়,
'বিরক্ত লাগতাছে। প্রথমে ভাবলাম না জানি কি হইছে? আর এখন শুনি লাভ কেস। ধ্যাত আমার ইমোশন গুলার বারোটা বাজায় দিলি।'
টিকলি বৈরাগী চোখে তাকিয়ে থাকলো বারান্দা গলিয়ে আকাশের দিকে। খুব ধীর গলায় বলল, 'তুই বুঝতে পারছিস না টায়রা।'
'কি বুঝতে পারছি না?'
টায়রার দিকে একাচ্ছন্ন নয়নে তাকিয়ে টিকলি জবাব দিলো, 'এই সেই পাত্র যার সামনে আমি পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট সেজেছিলাম।'
অবাক বিষয়তৃষ্ণা শূন্য দৃষ্টিতে টায়রা তাকিয়ে থাকলো। স্বগতোক্তি করে বলল, 'কি বলস?'
'হুম।'
'সত্যি?'
'হুম। আজ যখন রেসটুরেন্টে গেলাম দেখা করার উদ্দেশ্যে তখন দেখি মাস্ক পরা অবস্থায় সেই লোক। পরে মাস্ক খুলতেই দেখলাম উনি।'
'কিন্তু তাতেই বা কি হয়েছে? এতে এতো কাদা-কাদির কি আছে?'
'উনি আমাকে চিনার পর বিনাবাক্যে রেসটুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেছেন। সমস্যা টা এইখানেই। চলে কেনো গেলো সে?'
'দেখ, তুই যেমন তাকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে কেদে ফেলেছিস। ঠিক তেমনি সেও হয়তো তোকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পরেছিলো। পুরুষ মানুষতো আর যখন তখন কাদতে পারে না? তাই হয়তো নির্বাকে চলে গিয়েছে।'
'সত্যি কি তাই?'
'হতেই পারে?'
'যদি এমন না হয়। আমাকে চেনার পর যদি সে আর আমার সাথে কথা না বলে? ওই মিথ্যা বানোয়াট প্রেগন্যান্সি এবং বয়ফ্রেন্ডের কথা সত্যি ভাবে তখন?'
টিকলি রুদ্ধ গলায় বলল। বলতে গেলেই চাপা হয়ে এলো গলা। মন খারাপেরা আবারো বাধ ভাঙলো।টায়রা হতাশ চোখে তাকিয়ে উত্তর দিলো,
'হ, সবাই তো তোমার মতো বলদ।'
টায়রা আবার বলল, 'আর শোনো মেয়ে, তুমি একদম আমার সাথে কথা বলবা না। তুমি আমার থেকে লুকায়ছো এত্তোবড় ঘটনাটা। বিশ্বাসঘাতকতা করছো।'
'এমন করিস না বোন। আমি অনেক সরি। আপু ভেরি ভেরি সরি।'
________________________________
ঝুম বৃষ্টিতে আদর রেসটুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলো। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে নির্লিপ্ত পায়ে কাদা মাড়িয়ে হেটে হেটে বাড়ি ফিরতে ফিরতে লেগে গেলো প্রায় দু-ঘন্টা। কাকভেজা হয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে আসতেই মনোয়ারা খানের মুখোমুখি হলো। মায়ের অবাক চোখের কৌতুহল ভরা দুটি মনি। আদর এক পলক তাকিয়েই আবারো অনুরাগহীন পায়ে চলে গেলো নিজের ঘরে।
ভাই এসেছে খবরটা পেয়েই ভাইয়ের খোঁজে আদরের ঘরে চলে এলো আর্দ্র। আদর নিরবচ্ছিন্ন নিরবতায় বসে ছিলো একান্ত ব্যক্তিগত পছন্দের নিজের কালো চেয়ারটাতে। আর্দ্র ভাইয়ের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
'কি করো ভাইয়া? কি হইছে?'
ক্লান্ত গলায় আদর বলল, 'কি হবে? হওয়ার মতো তো কিছু নেই।'
'কোথা থেকে আসলে?'
'কাজে গিয়েছিলাম একটা।'
'ওহ। আচ্ছা, তুমি কি প্রেমে পরলা নাকি?'
কপালে হাত দিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছিল আদর। আর্দ্রের কথায় কপাল থেকে হাত নামিয়ে ভ্রু কুচকে বলল, 'হঠাৎ এই প্রশ্ন?'
আমতা আমতা করে আর্দ্র উত্তর দিলো, 'না মানে। তোমার ফোনে দেখলাম আরকি।'
'কি দেখলি?'
'কাল যখন তুমি ওয়াশরুমে ছিলে তখন দেখলাম মনতাঁরা নামে সেভ করা একটা নাম্বার থেকে কল আসলো।'
আদর কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবারো এলোমেলো হয়ে গেলো। নিরস দেহটা নিছকই প্রাণহীন বনে গেলো। চেয়ারের হাতলে এলিয়ে দিলো মাথা। প্রথম দিনই মনতাঁরা নামে টিকলির নাম্বার সেভ করে রেখেছিলো। কেনো রেখেছিলো কে জানে! কিন্তু মন শুধু এটাই জানে এই তাঁরা ফোন করলেই আদরের বুকপাটাতন জ্যোৎস্নানাথ পাওয়ার উদ্দেশ্যে মেতে উঠতো। গোলাপে গোলাপে ছেয়ে যেতো দ্বিজরাজের বাগান। সৌন্দর্যে ভরে উঠতো যেই পয়োনিধি কুৎসিত।
আর্দ্র চলে যেতে নিলেই আদর অনুভবশূন্য গলায় ডাকলো,
'আর্দ্র।'
পেছন ফিরে তাকিয়ে আর্দ্র জবাব দিল, 'জি ভাইয়া।'
'সেই পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট মেয়েটা টিকলি। তোর তো জানার খুব ইচ্ছে ছিলো তাই জানিয়ে দিলাম।'
আর্দ্র বিস্ফোরিত নয়নে তাকালো। যেনো এই দর্শনেন্দ্রিয় দিয়ে এক্ষুনি অবাকতারা একে একে জড়ে পরবে। টালমাতালা গলায় আর্দ্র বলল, 'কি? টিকলি...'
আর্দ্রকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আদর কঠোর গলায় বলল, 'এই নিয়ে আর কোনো কথা হবে না। নিজের ঘরে যা।'
,
টিকলি ফ্রেস হয়ে আসার কিছুক্ষণ পরই আগমন ঘটলো শায়লা আক্তারের। মায়ের দিকে গোয়েন্দা নজরে তাকিয়ে থাকলো টায়রা। শায়লা আক্তার ধমকে বললেন,
'এমনে চ্যারা চোখে তাকায় থাকোস কেন? মনে হয় চুরি করতে ঢুকছি।'
'নাহ তুমি তো সচরাচর আসো না আমাদের ঘরে।'
'আমাদের ঘর? ঘর লেইখে দিছি নাকি তোদের? কত টাকায় বিক্রি করলাম?'
টিকলি বিরক্ত গলায় বলল, 'মা, কিছু বলবা? বললে বলো তা নাহলে এক কাপ কফি দাও। মাথা ব্যথা করতাছে।'
শায়লা আক্তার মেয়ের পাশে বসলেন। মেয়ের চুলে হাত বুলাতে বুলাতে মধুমিশ্রিত গলায় বললেন,
'কান্না করছস নাকি? চোখ মুখ ফোলা কেনো? তখন মনে হলো কারোর কান্নার আওয়াজ শুনলাম।'
'না মা। কান্না করবো কেনো? এমনি সাইনাসের ব্যথা বেড়েছে। তুমি কি বলতে এসেছো বলো না।'
'হুম। শোন মা, তোর বাবা একটা পাত্র দেখেছে...'
শায়লা আক্তার কথা শেষ করার আগেই টায়রা চেঁচিয়ে বলল, 'কি? বাবা আবার পাত্র দেখেছে?'
কটমট করে শায়লা আক্তার বললেন, 'নাহ, ছেলেবাড়ি থেকে সম্বন্ধ এসেছে। আর তুই এতো লাফায় উঠোস কেন? বিয়ে কি তুই করবি?'
'অবশ্যই আমার লাফায় উঠতে হবে কারণ টিকলির থেকে আমি মাত্র এক বছরের ছোট। সে হিসেবে টিকলির বিয়ের এক বছরের মাথায় আমার বিয়ে দেওয়া তোমাদের নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু এই দায়িত্ব আমি মেনে নিতে পারিনা। কারণ আমি এতো তাড়াতাড়ি আমার বিন্দাস লাইফ শেষ করে দিতে পারিনা বোন ছাড়াও থাকতে পারিনা আবার জামাই ছাড়াও থাকতে পারিনা। ইশশ..কি যন্ত্রণা! কি করলে এই সব একবারে পাওয়া যাবে আইডিয়া দাও তো আম্মু।'
'ঠাটায় একটা চর মারার পর আইডিয়ারা হাটি হাটি পা পা করে এমনেই চলে আসবে আম্মাজান।' দাঁত কিড়িমিড়ি করে বলল শায়লা আক্তার।
'আমি এখন বিয়ে নিয়ে ভাবছি না মা। প্লিজ এসব বিয়ে বিয়ে খেলা বন্ধ করো। একটু শান্তি দাও। তা নাহলে দু'চোখ যেইদিকে যাবে আমি সেদিকে চলে যাবো।' টিকলির অকপটে জবাব।
'সাথে আমারেও নিস। এই মাসুম বোনটারে ফেলায়ে এক একা যাইস না। ভয় পাবি। সাথে আমার অভিশাপও লাগবো।' টায়রা কাদো কাদো হয়ে বলল।
টিকলি বিরক্ত হয়ে বলল,
'সবসময় ফাইযলামি করলে কানের তিন আঙ্গুল নিচে খাবি একটা।'
,
সেদিন রাত থেকেই ধুমিয়ে জ্বর এলো আদরের। জ্বরে পাগল প্রায় আদরের সেবা যত্নে নিয়োজিত সর্বকাছের মা মনোয়ারা খান। কেদে বুক ভাসাচ্ছেন তিনি ক্ষনে ক্ষনে। ছেলের জ্বর হয়না প্রায় দু'বছর যাবৎ। হঠাৎ করে এই মাত্রাতিরিক্ত জ্বর হওয়ার কারণ কেউ ধরতে না পারলেও মনোয়ারা খান কান্নাভেজা গলায় বললেন,
'আরো বেশি করে বৃষ্টিতে ভিজ। জ্বর তোর আসবে না তো কার আসবে।'
মায়ের কথা আদরের কানে গেলো না। দেয়ালে দেখা গেলো একটা টিকটিকি ঘুরে চলেছে অবিরাম। আদর আধো চোখ দিয়ে তা দেখে মৃদু হেসে জ্বরের ঘোরে নিচুগলায় বলল,
'মা দেখো টিকটিকি। মিস. টিকটিকি।'
মনোয়ারা খান কিছুক্ষণ হাবুলের মতোন তাকিয়ে থেকে বিলাপ পেরে কেদে উঠলেন। শেষ পর্যন্ত জ্বরের কবলে পরে তার ছেলেটা পাগল হয়ে গেলো? টিকটিকি দেখিয়ে বলছে মিস. টিকটিকি। হায় আল্লাহ! এই দিন দেখানোর আগে আমার মরণ কেনো হলো না? আমাকে তো কোনোদিন কেউ বলেনি মিস. মনোয়ারা খান আর একটা টিকটিকিকে মিস? এতো সম্মান??
চলবে
Nazim khan, Md mamun, Md akash shak, Mannat tasrin, Nazrul islam, Imrose nabila, Md babul and লেখাটি পছন্দ করেছে
- Onu kothaশুকতারা
- Posts : 56
স্বর্ণমুদ্রা : 1526
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-05-26
Re: বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ
২৮.
ফোনটা এলো প্রায় সপ্তাহ খানিক পর। তখন মাঝরাত। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ছন্দপতন। তুমুল বেগে বৃষ্টি থেমেছে এই একটু আগে। ধীরে ধীরে টুপটাপ একটা দুটা ফোটা বৃষ্টির সাথে মিলিয়ে যাচ্ছে টিকলির মন খারাপ অনুভূতিরা। আকাশে অজস্র মেঘের ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মাঝে উঁকি দেয় রুপালি আলোর অধিকারী সুধাংশু। বাড়ির পাশের হিজল গাছের লাল ফুল চুইয়ে পানি পরছে। দু 'তলার বাড়ির দেয়াল ঘেঁষে জেগে উঠেছে জারুল গাছ। পাতার ফাঁক-ফোঁকর গলে পানি ক্রমাগত নিগড়ে পরছে টিকলির ঘরের বারান্দায়। টিকলি হাত বাড়িয়ে গোলাপি ফুলগুলো ছিড়লো। ফুলের কলি ফোটাতে ফোটাতে আনমনা চোখে জনমানবহীন ভিজা রাস্তার বাকলে তাকিয়ে রইল।
টায়রা ঘুমিয়ে গেছে। রাত প্রায় দেড়টা এখন। টিকলির হাতের মুঠোয় থাকা মুঠোফোন টা কেঁপে উঠলো। এতোরাতে কে ফোন দিতে পারে ভাবতেই টিকলি ভ্রু কুচকে ফোনের স্কিনে তাকালো। প্রায় সাথে সাথেই যেনো নিশ্চল হয়ে এলো বা'পাশের হৃদপিন্ডের ধুকধুকানি। অভাবনীয় বিস্ময় সূচক চোখে তাকিয়েই থাকলো।
ফোনটা এসেছেলো অতর্কিতভাবে। ঠিক তেমনে কেটেও গেলো আকস্মিক। কেটে যেতেই ওপাশ থেকে আর ফোন করা হলো না। সেকেন্ড গড়ালো মিনিট গড়ালো টিকলি চেয়ে থাকলো আরেকবার ফোনের আশায়। মিনিট দশেক পর আশা গুলোকে সত্যি প্রমাণিত করে ফোনটা আবার এলো। টিকলি দেরি করলো না। ইশশ..সাতটা দিন অপেক্ষা করেছে কখন একটা বার লোকটা ফোন দিয়ে কথা বলবে। চটজলদি ফোনটা রিসিভ করে টিকলি শ্বাস আটকে বসে রইল। পিনপিনে নিরবতায় কেটে গেলো প্রায় তিন মিনিট পনেরো সেকেন্ড। টিকলি রুদ্ধশ্বাসে এবার বলল,
'হ্যালো।'
ওপাশ থেকে তখন কেউ খুব ক্লান্ত নরম অনেক দিনের অপেক্ষার গলায় বলল,
"In the end of rain, The love is beginning."
টিকলির শরীর কেঁপে উঠলো অপ্রত্যাশিত মোহনায়। অপ্রতিরোধ্য গলায় কিছু বলতে গেলেই দেখলো গলা দিয়ে আওয়াজ আসছে না। কোনো এক অশরীরী তার গলা চেপে ধরেছে। বিদ্রোহ জানাচ্ছে আদর টিকলির প্রেমছন্দে। টিকলি ভয়ে আরো একবার কেঁপে উঠলো। মনে মনে খুব করে বলল, 'এবার যেনো প্রেমের ছন্দপতন না হয়।'
অনেক কষ্টে টিকলি বলতে পারলো, 'কি বললেন ডাক্তার?'
'বৃষ্টিশেষে প্রেমের শুরু।'
আদর আবার বলল খুব করুণ গলায়,
'আপনার মনে আছে টিকলি! প্রথম যেদিন আমাদের গল্পটা শুরু হলো? প্রথম যেদিন আপনার সাথে আমার দেখা রেসটুরেন্টে, ঠিক সেদিনও কিছুক্ষন আগেই বৃষ্টিশেষ হয়েছিলো। আপনার মনে আছে! সদরঘাটে কাদায় পড়া থেকে আপনাকে বাচিঁয়েছিলাম! সেদিনও কিছুক্ষন আগেই বৃষ্টিশেষ হয়েছিলো। আপনার মনে আছে প্রথম যখন লঞ্চে আপনার মুখ দেখলাম আপনি আমার বুকে এসে পরলেন ঠিক তার কিছুক্ষণ আগেই বৃষ্টিশেষ হয়েছিলো। মাতাল হাওয়ায় উন্মাদ ছিলো চারিপাশ। আপনার মনে আছে নিঝুম দ্বীপ ঘুরে এসে ঢাকা ফিরতেই যখন আমরা আলাদা হয়ে নিজেদের পথ ধরলাম তখনও বৃষ্টিশেষ হয়েছিলো।'
টিকলি ঠোঁট চেপে ধরে থাকলো। বুকের সান্নিপাতিক মনের আওয়াজ কান পর্যন্ত পৌছালো না। একাগ্রভাবে আদরের কথায় মনন করলো। শরীর জুড়ে বয়ে গেলো যুদ্ধে জয়লাভ করার তকমা। সত্যি কি জীবনটা এতো সুন্দর! আদর ডাকলো,
'টিকল.....'
টিকলি চোখ বন্ধ করে মুগ্ধস্বরে বলল, 'হুম।'
'আপনি কিছু বলবেন না?'
টিকলি চুপ হয়ে গেলো। কি বলবে! সারাক্ষণ মনের মাঝে, টায়রার সামনে, বুকের ভাঁজে লুকিয়ে চুরিয়ে বলছে এই একটা কথা। 'আমি আদরকে ভালোবাসি।' অথচ এখন এ কোন বোবায় ধরলো তাকে? কেনোকিছুই বলতে ইচ্ছে করছে না। কেনো শুধু শুনতে ইচ্ছে করছে? আদরের ওই ভালোবাসাময় বাণী? এতো মধুর লাগে কেনো কানে?
'আপনি কি আমার উপর অভিমান করে আছেন?'
আদরের প্রশ্নে টিকলির গলা ফাটিয়ে বলতে ইচ্ছে করলো,
'হুম বাদর ডাক্তার। আমি খুব অভিমান করেছি। অতি অভিমানে আমি পাথর হয়ে গিয়েছি। কেনো আপনি ফোন করতে এতোটা সময় নিলেন? কেনো? আপনার সেই প্যাচমোচড় নাম্বার বের করে ফোন লাগাতেও তো আমি এতোটা সময় নেইনি।'
আদর মুচকি হেসে বলল,
"অভিমান যেখানে সিক্ত হয় মনমাতানো অনুভূতি সেখানেই সৃষ্টি হয়।"
টিকলির চোখের দুয়ার বন্ধ হলো বিহ্বল এই বাক্যে। বশীভূত হয়ে উঠলো সরল অন্তঃকরণ। অবচেতন মনে শুধু একটা শব্দই বলতে পারলো,
'তাই?'
'আমি বিশ্বাস করি।'
'এতোটা দেরি কেনো করে ফেললেন ডাক্তার?'
টিকলির অসহায় গলায় আদর দ্বিগুন অসহায়ত্ব নিয়ে বলল,
'জানেন সেইদিন রেসটুরেন্ট থেকে ফিরে আসার পর আমার মাত্রাতিরিক্ত জ্বর হয়েছিলো। দুদিন বিছানায় পরে থাকার পর যখন নিজের কাজে ফিরে আসলাম। তখন দেখি আমার কোনো কিছুতেই মন বসছে না। অপারেশন করতে গিয়ে দেখি রোগীর পাশের জায়গায় আপনি দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে আশ্বস্থ করছেন। আমার মনে বল জোগাচ্ছেন। পেসেন্ট দেখতে গেলে বিরক্ত লাগা শুরু করে। ক্লাস করাতে গিয়ে লেকচার দিতে পারিনা। সব ভুলে যাই। শুধুমনে হয় ক্লাসের কোথাও না কোথাও আপনি বসে আছেন। আমাকে দেখছেন, শুনছেন। এই যে এখন, এখন আমি হাসপাতালে। আমার রাউন্ডে যাওয়ার সময় অথচ আমি যেতে পারলাম না। নিশ্চল পা গুলো হাত দুটোকে সচল বানিয়ে আপনাকে ফোন দেওয়ালো এবং অবাধ্য মুখ এতোগুলা কথা বলিয়ে দিলো। আমাকে কি কোনোভাবে বেহায়া লাগছে না?'
টিকলি হেসে উঠলো জোরে। আদর মুগ্ধ হয়ে শুনলো হাসির ধ্বনি। এরপর বলল, 'কবে আসবেন?'
'কোথায়?'
'আমার কাছে?'
'আপনার কাছে কেনো যাবো?'
'ওমা, আসবেন না?'
'না, একদম না।' টিকলি ঠোঁট চেপে হাসি থামিয়ে উত্তর দিলো।
'আচ্ছা, তুলে নিয়ে আসবোনি।'
টিকলি চোখ বড় বড় করে বলল, 'মারাত্মক! সাতদিনে মারাত্মক পরিবর্তন এসে গেছে।'
'এমন অবস্থায় ওরকম একটু একটু হয় মিস টিকটিকি।'
'কীরকম কীরকম ?'
'বলে বুঝানো যাচ্ছে না। যাই হোক, আচ্ছা আপনার কি বয়ফ্রেন্ড ছিলো বা আছে কিংবা কখনো... ছিলো?'
আদর ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করলো। টিকলি রেগে উত্তর দিলো,
'আপনি আসলেই একটা গর্দভ।'
আদর হাসলো। বলল,
'আর আপনি বোকা, বুদ্ধিহীন নারী। নাহ, বুদ্ধিহীন না। দুইটা রোল প্লে করেছেন তো তাই দুরকম মনে হয়েছে। পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট মহিলা হিসেবে যতটা মানসিক বিকারগস্ত, বুদ্ধিহীন, চঞ্চল, ঝগড়াটে মনে হয়েছে টিকলি হিসেবে ঠিক ততোটাই সুন্দর, বুদ্ধিমতী, নরম এবং শান্ত মনে হয়েছে।'
'তাই?'
'হুম।'
'আর আপনাকে ফালতু বেয়াদব লোক হিসেবে অহংকারী, দাম্ভিক, অভদ্র এবং ঝগড়ুটে মনে হয়েছে কিন্তু বাদর ডাক্তার হিসেবে ঠিক ততোটাই শান্ত, কোমল, ভদ্র, গাম্ভীর্যপূর্ণ মনে হয়েছে।'
আদর কিছুক্ষন নিঃশব্দে হেসে ধীর কণ্ঠে বলল,
'আপনি তো কিছু বললেন না টিকলি? উত্তর দিলে কি খুব দোষের হবে?'
টিকলি ঢোক গিলল। এবারও বলতে পারলো না। উলটে বলল, 'খেয়েছেন?'
হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে আদর বলল, 'নাহ।'
'সেকি! এখনো খাননি কেনো? রাত দুটো পার হয়ে গেছে। খেয়ে নিন এক্ষুনি।'
'বাড়ি ফিরে খাবো।'
'কখন ফিরবেন?'
'এইতো এক্ষুনি।'
'তাহলে যান। কথা বলে খিদে বাড়াবেন না। পরে অসুস্থ হয়ে যাবেন।'
আদর গম্ভীর গলায় উত্তর দিলো, 'হুম।'
'তবে রাখি?'
'আচ্ছা রাখুন।'
আদর ফোন রাখতে গেলেই টিকলি ব্যস্ত স্বরে বলে উঠলো,
'ডাক্তার শুনুন, আমি না আপনার শুকতারা হতে চাই! শুকতারা কি আমার কাছে বিক্রি করা যাবে?'
আদরের মনগভীর শীতল হলো। মন খারাপের মেঘ কেটে গিয়ে ঝরঝরা হাসিখুশি নতুন সূর্য উঁকি দিলো। ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে আদর বলল,
'শুকতারা যে বেঁচা যায় না টিকলি। শুধু জমানো যায় আর কেনা যায়।'
'তবে আমি কিনে নিতে চাই ডাক্তার। আর কেউ যেনো না পায়।' টিকলি আচ্ছন্ন ভরপুর কণ্ঠে বলল।
'শুকতারা গুলো আমি আপনার নামেই লিখে দিয়েছি টিকলি। আপনি যে আমার সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষ মহারানী। আর আমি আপনার রাজ্যের সামান্য এক কুঠিয়াল প্রজা।'
টিকলির চোখ ছলছল করে উঠলো। ভেজা গলায় বলল,
'এতো সুখ কি আমার কপালে সইবে? নাকি রাত পোহালেই শেষ হয়ে যাবে ডাক্তার?'
'আপনি কি কাদছেন টিকলি?'
'নাহ, আমি ফ্যাচফ্যাচ করে কাদি না। একটু চোখ ভিজে উঠেছিলো।'
'ওহ। একদম কাদবেন না। কক্ষনো না। আর সুখ আপনার কপালে সইবে না মানে? সুখকে ধরে বেধে আপনার কাছে নিয়ে আসবো।'
টিকলি হাসলো। এরপরও অসহায় গলায় বলল,
'সমস্যা তো আরেক জায়গায় আছে ডাক্তার।'
'কোন জায়গা?' আদর ভ্রু কুচকালো।
'আপনার আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিলো। নিজেদের পায়ে নিজেরা কুড়াল মেরে বিয়ে ভেঙেছি। এরপর তো আপনার বাবা আমার বাবাকে অনেক কথা শুনিয়ে দিয়েছিলো। আপনাদের ফ্যামিলিরও আমাদের সম্পর্কে খারাপ ধারণা এবং আমাদের ফ্যামিলিরও।'
কথাগুলো বলেই টিকলি হতাশ নিঃশ্বাস ফেলল। আদর কপালে কিছু ভাঁজ ফেলে বলল,
'এ কয়দিন আপনাতে এতো বিভোর ছিলাম যে এসব মাথায়ই আসেনি। আপনি চিন্তা করবেন না। আমি আছি তো। আমি সামলে নিবো।'
এতো করুণ মুহুর্তেও আদরের কথা শুনে টিকলি হাসলো। এরপর বলল, 'যদি আপনি না পারেন?'
'তবে তো আপনি আছেন আমার শুকতাঁরা আমার মনতাঁরা।'
তখন রাস্তার ধারে ধারে ভেজা পাতার হাট বসেছিলো। গাছের ডালে ডালে মুক্তোর মতো জ্বলজ্বল করা পানি। একফোঁটা টিপটিপ করে পরা বৃষ্টি। হিজল লাল ফুল আর জারুল গোলাপি ফুল মিলেমিশে প্রকৃতি মনোমোহর। টিকলি চোখ বন্ধ করে উপভোগ করলো। বলল,
"আপনি আমার অভিমান রাজা আমার গম্ভীর রাজা। সারাক্ষণ যার একমাত্র কাজ অকারণে মহারানীর উপর অভিমান করা।"
চলবে
Md manik, Sadman alom, Faria oishy, Md sourav, Khalid sheikh, Abu talha, Shamima zakia and লেখাটি পছন্দ করেছে
- Onu kothaশুকতারা
- Posts : 56
স্বর্ণমুদ্রা : 1526
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-05-26
Re: বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ
২৯.
তখনও বহমান ছিলো আষাঢ় মাস। শ্রাবণী পরিবেশের আকাশটাতে উড়ে চলে যেতো রাশি রাশি মেঘের কুন্ডলী। দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামার পথে। রুহুল হক নিজের বিলাশ বহুল বাড়িটার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ধীর পায়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই বুক চিরে বেরিয়ে এলো আবারো দীর্ঘশ্বাস। এই এতো বড় বাড়ি অথচ কি ভীষণ ফাঁকা! বাবা হিসেবে এই বয়সে ছেলের কাধে ভর দেওয়ার নিয়ম ছিলো। ছেলে বউ নাতি নাতনি নিয়ে সুখে সংসার করার রীতি ছিলো। রঙিন জীবন্ত জীবন। অথচ তার বেলায় যেনো সব ফিকে সব উল্টো। ভাবনার ঘোরে থেকে নিজের ব্যক্তিগত ঘরে পা ফেলতেই স্ত্রী আকিদা হক বলে উঠলেন,
'এতো তাড়াতাড়ি ফিরলে যে আজ?'
রুহুল হক স্ত্রীর দিকে বিরক্ত নিয়ে তাকালেন। তাকাতেই দেখলেন, স্ত্রীর চোখ কুচকিত। সূক্ষ্ম কুটনি চোখে সে কথা বলছে। চাল-চলনে গোয়েন্দা গোয়েন্দা ভাব। জর্জেট শাড়ির পাতলা আঁচল মাটি স্পর্শ করছে। ঠোঁটে কড়া লিপস্টিক। মুখে সাজঁগোজের বহর। বরাবরই সে এরকম। গ্রাম থেকে বিয়ে করে নিয়ে আসা মেয়েটা শহরের চলন ফেরন বুঝতেই হয়ে গেলো অতিমাত্রায় আধুনিক। কিন্তু তবুও ছোটোলোকি ছোক-ছোক স্বভাব তার। মনের থলি বিষহিংসায় পূর্ণ । রুহুল হক টাই খুলতে খুলতে রুক্ষ স্বরে জবাব দিলেন,
'কেনো তোমার সমস্যা হচ্ছে?'
'প্রতিদিন তো আগে আসো না। আমি হাজারবার বলার পরও আসো না। আজকে এতো আগে আসার কারণ কি সেটাই জানতে চাইছি।'
'বারবার এভাবে কথা বলছো কেনো? আগে এসে কি দোষ করে ফেললাম? আমার বাড়ি আমি যখন তখন আসবো। আমার ব্যাপারে একদম মাতব্বরি করবে না।'
রুহুল হক চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন। আকিদা হক গরম চোখে তাকিয়ে থাকতেই রুহুল হক আবার দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
'চোখ ঘুরাও। কোন সাহসে এভাবে তাকাও আমার দিকে? আর সারাক্ষণ এসব কি সেজেগুজে বসে থাকো? এতো পাতলা শাড়ি পড়ো কেনো? বয়স হচ্ছে তো নাকি? এখন তো আর ষোলো বছরের কিশোরী নও। দিনে তো একবারও আল্লাহর নাম নিতে দেখি না। ঘরের কাজ কর্ম কিছু করলেও তো পারো? তবুও তো কাজের লোক রাখতে হয়না৷ তিনটা মানুষের জন্য বাড়িতে এতো কাজের লোক? এসব হিংসা-বিদ্বেষ মনোভাব বাদ দিয়ে স্বামীর টাকা বাঁচানোর চেষ্টা করো না একটু!'
'আমি এসব পারবো না৷ আমার স্কিন নষ্ট হয়ে যাবে।'
'অথচ বাবার বাড়িতে ঠিকই পারতে। রোজ পারতে। তখন স্কিনের চিন্তা মাথায় থাকতো না বেদরাম মার খাওয়ার ভয়ে। ছোটলোক বিয়ে করলে এই এক সমস্যা। অতি বিলাশবহুলে তারা পাগল হয়ে যায়।'
রুহুল হক তাচ্ছিল্য গলায় কথা গুলো বলতেই আকিদা হক কাট কাট করে বললেন, 'তুমি আমাকে কথা শুনাচ্ছো? আমি কি তোমার হাতে পায়ে ধরে বিয়ে করেছি?'
'বিয়ের কথা মুখে এনো না। তোমার শেয়ানা বাবা যে কি কান্না কাটি করে বিয়ে দিয়েছে তা নিশ্চয়ই মনে আছে?'
আকিদা হক দাঁত কটমটালেন। তবুও নিজেকে সংবরন করার চেষ্টা করলেন। এখন বেশি কথা বললে নিজের মান সম্মানই খোয়া যাবে। তার চেয়ে চুপ থেকে কথা এড়িয়ে যাওয়াই শ্রেয়।
'তোমার ছেলে এসেছে।'
রুহুল হক বাথরুমে ঢুকছিলেন। কান পর্যন্ত কথাটা পৌছানো মাত্র পা জোড়া আটকে গেলো মেজের সাথে। নিষ্পাদন দৃষ্টিতে চেয়ে বললেন, 'কিহ?'
আকিদা হোক উত্তর দিলেন না। বিরবির করে শুধু বললেন, 'দরদ!'
রুহুল হক আর বাথরুমে ঢুকলেন না। ব্যস্ত পায়ে ঘর থেকে বের হতে নিলেই পেছন থেকে আকিদা হক হাত টেনে ধরলেন।
'আকিদা আমার হাত ছাড়ো।' রুহুল হক তড়িঘড়ি করে অসহায় গলায় বললেন।
আকিদা হক ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে বলল, 'কখনো আমার মেয়ের জন্য কিংবা আমার জন্য এতো অস্থির হয়েছো? যেই শুনলে ছেলে এসেছে ওমনি দরদ উথলায় পড়ে?'
রুহুল হক আর পারলেন না। ধাক্কা দিয়ে আকিদা হক কে সরিয়ে দিয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেলেন। আকিদা হক মরতে মরতে বাঁচলেন। সাপের মতো ফুসফুস শব্দ করে উঠে চললেন স্বামীর পিছুপিছু।
রাহুল তখন রুমকিকে খাইয়ে দিচ্ছিলো। আট বছরের রুমকি মাথা দুলিয়ে বলল, 'উমম..ভাইয়া মজা।'
রাহুল হেসে রুমকিকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে ধীর কণ্ঠে বলে,
'তুই এতো ভালো কেনো রুমকি? তোর জন্য বারবার এই আস্তানায় আসতে হয় আমার। এতো ভাইয়া পাগল কেনো রে তুই?'
রাহুলের চোখ ভিজে উঠলেই রুমকি ওর ছোট ছোট দু'হাত দিয়ে মুছিয়ে দিয়ে বলল,
'তুমি কি বোনপাগল না? আমার তোমাকে অনেক ভালোলাগে ভাইয়া। তোমার আমাকে ভালো লাগে না?'
ঠোঁট উল্টে দিলো রুমকি। রাহুল হেসে রুমকিকে আবার জড়িয়ে ধরতেই কারোর গম্ভীর কিন্তু উচ্ছ্বসিত গলা টের পাওয়া গেলো,
'কখন এসেছো?'
রাহুল আস্তে করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। রুমকি কে খাইয়ে দিতে দিতেই উত্তর দিলো,
'ঘণ্টা খানিক।'
তখনি আকিদা হক পেছনে এসে দাঁড়িয়ে চাপা গলায় বললেন, 'ও এসেছে তুমি জানতে তাই না? তাই আজ এতো তাড়াতাড়ি এসেছো?'
'আর একটা কথা বললে মুখ টেনে ছিড়ে ফেলবো।'
রুহুল হক বললেন ফিসফিস করে। আকিদা হক ক্রুর চোখে তাকিয়ে রইলেন। রাহুল মুচকি হেসে বলল,
'আপনার স্বামী জানতেন না আমি আসবো। রুমকি অসুস্থ। আমাকে ফোন করেছিলো কারো মোবাইল দিয়ে। কান্নাকাটি করছিলো তাই আসা।'
আকিদা হক গর্জন করে বললেন, 'কার ফোন দিয়ে ফোন করেছো?'
ভাইয়া আর বাবা পাশে থাকলে রুমকি একটুও ভয় পায় না। তেমনি আজও ভাইয়াকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে ভীতিহীন গলায় বলল,
'রহিমা নানুর ফোন থেকে।'
রহিমা টেবিলের কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলো। আকিদা হক টেবিলে থাবা বসিয়ে বললেন, 'খালা তুমি ওকে ফোন দিয়েছো কেনো? কাজের লোক কাজের লোকের মতো থাকতে পারোনা?'
রহিমা ভয়ে তটস্থ হয়ে দাড়ালেন। রাহুল চোখ তুলে আকিদা হক কে দেখতেই আবারো চোখ ফিরিয়ে নিলো। এই মহিলার দিকে তাকাতেও লজ্জা লাগে। ছিঃ কি পোশাক পরে সারা বাড়ি ঘুরছে। এতোগুলা কাজের লোক বাড়িতে। রুহুল হক এবার রেগে বললেন,
'থাপড়ে গাল লাল করে ফেলবো ছোটলোকের বাচ্চা। রহিমা খালাকে কাজের লোক বলস কোন সাহসে? তোর এক যুগ আগে থেকে রহিমা খালা এই বাসায় আছেন।'
আকিদা হক চুপসে গেলেন। তবুও দমলেন না। স্বামীর দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে নিজের রাগ জানান দিলেন। এতোগুলা মানুষের সামনে অপমান করার জন্য সাজা দেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয়ে গেলো। রুমকির খাওয়া শেষ। ওর ঠোঁট মুছে দিতে দিতে রাহুল বলল,
'শরীরে অনেক জ্বর ছিলো। ফোন দিয়ে ঠিকমতো কথাও বলতে পারছিলো না। তাই এসেছিলাম নয়তো আসতাম না।'
আকিদা হক গর্জে বললেন, 'তুমি আর কথা বলো না। এতো দরদ দেখাতে হবে না। এতোই যদি দরদ থাকতো তাহলে আমার মেয়ে যখন সিড়ি থেকে পরে গেলো তখন আসোনি কেনো?'
'তখন তো আমাকে ফোন করা হয়নি। কাজেই, আমি জানতাম না। এনিওয়ে আমি চলে যাচ্ছি। অশান্তি করবেন না।'
রুমকি কাদো কাদো খুব আদুরে কন্ঠে বলল,
'ভাইয়া তুমি যেও না প্লিজ।'
রাহুল হাটু মুড়ে রুমকির সামনে বসে আস্তে করে জড়িয়ে ধরে বলল,
'তুই যদি আমার নিজের বোন হতিস আমি কক্ষনো তোকে এখানে রাখতাম না। আপসোস.. খুব করে চাওয়া জিনিসগুলো বোধহয় কখনো নিজের হয়না রে। ইশশ...যদি আমি পারতাম তোকে আমার কাছে নিয়ে যেতে।'
কি নিরব আর্তনাদ! গোপন আর্তচিৎকারে ছেয়ে গেলো সারা শরীর। রাহুল উঠে দাঁড়িয়ে চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালেই রুহুল হক বললেন,
'দুপুরের খাবারটা অন্তত খেয়ে যাও।'
আকিদা হক বিরবির করে করলেন, ' আদিক্ষেতা।'
রাহুল স্পষ্ট শুনতে পেলো। পেছনে ঘুরে মেকি হাসি দিয়ে বলল,
'বলেছেন এই অনেক। ভালো থাকবেন আপনার স্ত্রীকে নিয়ে। আর পারলে মাঝে মাঝে রুমকিকে একটু আমার কাছে পাঠাবেন।'
নাক ছিটকে আকিদা হক বললেন, 'তোমার ওই ব্যাচেলর বাসায় আমার মেয়েকে পাঠাবো?'
মুচকি হেসে রাহুল বলল, 'ওখানে সবাই ভালো। ব্যাচেলর বাসা মনেই হয়না। তবে তা নাহলে একটু ফুফির বাসায় পাঠাবেন ও যখন ফুফির বাসায় যাবে তখন আমি এসে দেখে যাবো।'
রাহুল চলে গেলো। রুহুল হক অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই খেয়াল করলেন ছেলে তার শার্টের হাতায় চোখ মুছে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। অনেকদিন বাদে খুব করে কাদতে ইচ্ছে করলো। বুকের মাঝে কষ্টের পাহাড় ধসে পরলো চোখ বেয়ে।
______________________________
দেড় ঘন্টা অতিবাহিত করে আদর টিকলি এসে পৌছালো সাভারের বিরুলিয়ার গোলাপ গ্রামে। খুব যত্নে টিকলির মাথায় একটা গোলাপের ক্রাউন পড়িয়ে দিলো আদর। মোমের পুতুলের মতো দেখতে মিষ্টি মেয়েটার চোখ মুখ জুড়ে উল্লাস। ভালোবাসার মানুষটার হাত ধরে গোলাপ বাগানেই পার্মানেন্ট থাকার প্রয়াস।
'এই ডাক্তার, আমরা এখানকার মালী হয়ে যাই চলেন। আপনি আমি সারাদিন এই ফুলের মাঝে মাঝে ভ্রমর হয়ে ঘুর ঘুর করবো। এসব ডাক্তারি ফাক্তারি করে কি হবে?'
আদর টিকলির কথায় হেসে দিয়ে এই প্রথম টিকলির গাল টিপে দিলো। টিকলি বিরক্ত নিয়ে বলল,
'আমার গাল টিপলে রাগ হয়। '
আদর আরেকবার টিপে দিলো। টিকলি দু হাত সরে দাঁড়িয়ে বলল, 'আচ্ছা ডাক্তার? আমরা কি ডেট করছি? ফার্স্ট ডেট?'
'নাহ। আমরা জীবনের অগ্রভাগ ভালোবাসাময় সময় অতিবাহিত করছি।'
'আমি কি বলেছি আমি আপনাকে ভালোবাসি?' টিকলি ভ্রু কুচকে বলল।
'আমি কি বলেছি আমি আপনাকে ভালোবাসি?' আদরও ভ্রু কুচকে বলল।
টিকলি মিষ্টি করে হেসে দিতেই গালের গর্ত গাঢ় হলো। আদর বলল,
'ভালোবাসি না বলেও ভালোবাসার মুহুর্ত উপভোগ করছি। কি নিদারুন তৃপ্তিময় প্রশান্তি তাই না টিকলি!'
মুগ্ধকণ্ঠে টিকলি বলল, 'হুম।'
টিকলির মাথায় গোলাপের ক্রাউন। গোলাপের মতোই স্নিগ্ধ তার মুখ। লাল পাপড়ির মতো ঠোঁট। সবুজ পাতার দুটি চোখ। গায়ে লাল গাউন। টিকলির চোখে আজও চশমা। আদর তা দেখে করুণ গলায় বলল,
'চশমা টা খুলুন না। চশমার আড়ালে আমি আপনার চোখ দুটো পড়তে পারিনা।'
টিকলি অবাক চোখে তাকিয়ে দুষ্টুমি করে বলল,
'পড়া লাগবে না। যতো পড়বেন ততো গভীরে চলে যাবেন। এতো গভীরে যাওয়া ভালো না ডাক্তার। তারচেয়ে আজ থাক, অন্য একদিন নাহয়।'
আদর হালকা হাসলো। ঠোঁটের কোণে গর্ত হলো। ভাঁজ পরলো। টিকলি নয়নাভিরাম মঞ্জুলী চোখে তাকিয়ে রইল পলক না ফেলে। টিকলির ওই গালের একটু নিচে ঠোঁট বরাবর ফর্সা দুটো গর্ত আদরের চোখে সুচারুভাবে লাগলো। লাল জামার সাথে লাল নোসপিন টিকলির উজ্জ্বলতা এবং কান্তিমান লাবন্যতা জানান দিলো। হঠাৎ মনে হলো, মাথার লাল ফুলের ক্রাউন টার সাথে কিছু একটা অসমাপ্ত। অনেক দিন আগে মনের অবচেতনে পোষা কথা আদর আজ বিহ্বল, বিমুগ্ধ, বিবশ গলায় হুট করে বলে ফেলল,
''আপনি কি জানেন আপনার ওই কপালের দু'পাশ থেকে শুরু হওয়া দু' গাছি চুলের ভাঁজে টিকলি পরলে কতো সুন্দর লাগবে! বলতে নেই, তবে আমি কল্পনা করি তখন আমার আপনাকে খুব আদর করতে ইচ্ছে করবে।''
টিকলির মুখ রাঙা হলো। লজ্জায় মুখ লুকালো অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে। ঠোঁট টিপে হেসে ফিসফিস করে বলল,
'লাগামছাড়া হয়ে যাচ্ছেন ডাক্তার।'
'উহু একটুও না। আমি সত্যি কথা বলতে পছন্দ করি।'
আদর আবার বলল ফিসফিস করে ,
'আদর করা বলতে কিন্তু শুধু ঘনিষ্ঠতাই বুঝায় না টিকলি। এই যে একটু আগে আমি আপনার তুলতুলে গাল দুটো টিপে দিলাম এটাও কিন্তু আদর। আদরের ভয়ংকর আদর। বুঝলেন মিস. টিকটিকি?'
টিকলি চোখ বন্ধ করলো। শরীরে শিহরণ জাগলো। কম্পন টের পাওয়া গেলো। দুজন দুজকে ভালোবাসি না বলেও ভালোবাসার বাক্য বিনিময় হলো! দুজন দুজনকে স্পর্শ না করেও দৈবাৎক্রমে এতোটা ভালোবাসার উদয় হলো! দুজন খুব করে মনে মনে বলল, কখনো যেনো অস্ত না যায় এই ভালোবাসা। কারোর নজর না পড়ুক। টিকলি বন্ধ চোখে স্তব্ধ কানেই শুনছিলো। আদর বলছিলো,
"বন্ধ চোখের পাতায় লিখে রাখবেন আমার নাম
মনের গহীনে রেখে দিলাম আমার চিঠির খাম।"
টিকলি উপভোগ করলো। খুব করে উপভোগ করে ছলছল নয়নে তাকালো খানিক বাদে। ধীর নেশাক্ত গলায় বলল,
'চিঠি কোথায়, ডাক্তার?'
'এই যে, আমার বুক পকেটে।'
'কোথায়? দেখি?'
'খুঁজে পাবেন নাতো। খুব লুকিয়ে চুরিয়ে রাখি। শুধু আমার হয়েই থাকে। আমাকেই ধরা দেয়। একমাত্র আমি অনুভব করি। আর কারোর সামনে নিজ অস্তিত্বে বিরাজ করেনা।'
'এটা কেমন হলো ডাক্তার? চিঠিটা আমার জন্য না? বুক পকেট কি আমার জন্য না?' টিকলি ঠোঁট উল্টে প্রশ্ন করলো।
'আপনার জন্যই তো। এরজন্যই তো লুকিয়ে রাখি। কাউকে দেখানো সম্পূর্ণ নিষেধ। এমনকি আপনাকেও। খুব আত্মগোপনে থাকে সে। একটু উনিশ-বিশ হলেই রেগে বোম।'
'সাংঘাতিক তো! আমার সম্পদ অথচ আমাকেই দেখাতে চাচ্ছে না?'
চলবে
Md mamun, Mannat tasrin, Md jakir jomaddar, Nazrul islam, Md Abdullah, Ohi islam, Md babul and লেখাটি পছন্দ করেছে
- Onu kothaশুকতারা
- Posts : 56
স্বর্ণমুদ্রা : 1526
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-05-26
Re: বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ
৩০.
রাহুল যখন ও বাড়ি থেকে বের হলো তখন প্রায় বিকেল। বর্ষনমন্দ্রিত অন্ধকারেও যেনো চারিপাশে ফুটে উঠেছে অন্যরকম রওশন। মেঘমাখানো অন্ধকার থাকতে থাকতেই চোখ মুখ বন্ধ করে ঝুম বৃষ্টি নেমে পরলো। এদিক ওদিক একটা রিক্সাও খুঁজে পাওয়া গেলো না। অশনি ক্ষণপ্রভা বৃষ্টি থেকে বাঁচতে রাহুল একটা দোকানের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিলো। বন্ধ দোকান। সামনে দুটি খালি বেঞ্চ। বাঁশ দিয়ে ঠেকিয়ে রাখা উপরে টিন।
প্রায় আধ ঘন্টা যাবত দাঁড়িয়ে থেকেও যখন কোনো রিক্সার দেখা পাওয়া গেলো না রাহুল তখন ঝুম বৃষ্টি মাথায় নিয়েই নেমে পরলো রাস্তায়। ঘন ঘন বিকট আওয়াজে তড়িৎ তখন। রাস্তার এক ধার দিয়ে কাক ভেজা হয়ে ফিরছিলো রাহুল। দু ঘন্টা পর তার একটা টিউশনি আছে। এখান থেকে বাসায় পৌছুতেই লেগে যাবে এক ঘন্টা। তারউপর নিঝুম বৃষ্টি। রাহুল ধীর পায়ে হেটে চলল। টিউশনিতে যাওয়ার নিয়ম টা হঠাৎ আজকে একটু অনিয়মিত তে পরিণত করতে ইচ্ছে হলো। বৃষ্টির পানির সাথে দূর্লভ চোখের পানি ভাসিয়ে যেতে লাগলো নিজের গন্তব্যে। কি জোরে জোরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে! আচ্ছা এই ব্জ্রপাতে তো সে মরেও যেতে পারে আজ? হতে পারেনা? হতেই পারে? নাথিং ইজ ইম্পসিবল ফর এনভায়রনমেন্ট।
সুদূরপ্রসারী অবাঞ্ছিত ভবিষ্যৎ ভাবার কালেই কারোর ডাক পরলো। বৃষ্টির আওয়াজে স্পষ্ট শুনা গেলো না। রাহুল ঝাপসা চোখে তাকালো। ভেজা চুলগুলো লেপ্টে ছিলো কপালের সাথে৷ হাত দিয়ে মুখের পানি মুছার ব্যর্থ চেষ্টা করে রাহুল ভালোভাবে তাকালো। ওমনি তার সামনে এসে দাড়ালো একটা রিক্সা। নীল পলিথিনের নিচে ভেজা ঝপঝপে একটা মিস্টি মেয়ে। মুখে শীতল হাসি। রাহুল ঠিক ঠাহর করতে পারলো না মেয়েটাকে। সচেতন চোখে তাকিয়ে থাকতেই মেয়েটা হাত নাড়িয়ে হাই দিয়ে চিতকার করে বলল,
'এই বৃষ্টিতে ভিজে কোথায় যাচ্ছেন?'
বৃষ্টির প্রকট শব্দ ভেদ করে রাহুলও চিতকার করে বলল, ' আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না।'
'আমি নিভা। ভুলে গেছেন?'
'কোন নিভা?'
'টিকলি টায়রার ফ্রেন্ড। ওই যে দেখা হলো।'
রাহুল চিনতে পেরেও পারেনি এমন অবহেলার সুরে বলল, 'ওহ।'
'বৃষ্টিতে ভিজছেন কেনো? ঠান্ডা লাগবে না?'
'না। আমার ওতো অসুখ বেসুখ হয় না।'
'কি বললেন? জোরে বলুন। আচ্ছা, উঠে আসুন রিক্সায়। এই পথে এখন আর রিক্সা পাবেন না।'
রাহুল অবাক হলো। মেয়েটার দিকে সতর্ক দৃষ্টিতে পুরোদমে তাকাতেই মেয়েটাকে পুরোদস্তুর মনে পরলো। হ্যাঁ, এই মেয়েটাকে ফুফিদের বাসায় দেখেছিলো। রাহুল বলল,
'আপনি যান, আমি রিক্সা পেয়ে যাবো।'
'উঠে আসুন। পাবেন না রিক্সা। আমি জানি। এই রাস্তা দিয়ে আমার চলাফেরা আছে। আর আগামী দু-তিন ঘন্টার মধ্যে এই বৃষ্টি থামবে না।'
'আপনি কীভাবে জানলেন?'
'এতোবছর হলো বৃষ্টি দেখছি একটু আকটু অভিজ্ঞতা তো আমারও হয়েছে তাইনা?'
রাহুল হাসলো। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে ভাবলো রিক্সায় উঠা ঠিক হবে কিনা। মেয়েটার কথা যদি সত্যি হয় তবে রাহুলের দুটো টিউশনি মিস যাবে। আর এই রাস্তার যে অবস্থা রিক্সা না পেলে সর্বনাশ। তাছাড়া শিক্ষার্থীর গার্ডিয়ান ভীষণ কড়া। তাদের কথা হলো, মরে যাও তবুও আমার ছেলে মেয়েকে পড়াতে আসবে। এমনও হতে পারে মাস শেষে বেতনও কম দিয়ে দিয়েছে। হাতে মাত্র এই পরপর দুটো টিউশনি অবশিষ্ট আছে। এ দুটো খোয়া গেলে রাহুল চলবে কেমন করে। সব চিন্তা শেষে রাহুল রিক্সায় উঠার সিদ্ধান্ত নিলো। রিক্সার জায়গা খুব বেশি চাপা হওয়ায় রাহুল হুট ফেলে দিলো। নিভা ব্যস্ত গলায় বলল,
'আরে করেন কি? ভিজে যাবো তো? এভাবে ভিজেই যদি যাই তবে তো হাটাই ভালো ছিলো।'
রাহুল এক পলক তাকিয়ে উপর থেকে নীল পলিথিনটাও সরিয়ে রিক্সাওয়ালা মামার হাতে ধরিয়ে দিলো। নিভা পুরোদস্তুর ভিজে যেতেই রাহুল বলল,
'রিক্সার জায়গা চাপা।'
'রিক্সার জায়গা চাপাই থাকে।'
'আপনার কি খুব অসুবিধা হবে? অসুস্থ হয়ে পরবেন?'
'না।' মুখে না বললেও নিভা জানে আজ রাতেই তার হালকা পাতলা জ্বর উঠবে।
'আপনি এখানে কোনো কাজে এসেছিলেন?' নিভার প্রশ্ন।
'হুম। খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আপনি?'
'আরে আমার বাসা তো এই রোডেই। কিন্তু আপনাকে কখনোই খেয়াল করিনি।'
রাহুল অন্যদিকে তাকালো। অন্যমনস্ক হলো। এই রোডে বাড়িটা কেনা হয়েছে চার বছর ধরে। তার আগে থাকা হতো অন্য বাড়িতে। আর প্রায় সাত বছর থেকে রাহুল পরিবার ছাড়া থাকে। হুটহাট পূর্ণিমা চাঁদের মতো এই এলাকায় উঁকি দেয়। ভাবনার দড়ি ছিড়লো কোনো যত্নের সুরে,
'আপনার কি মন খারাপ? চোখ-মুখ ও ফোলা। বৃষ্টিতে ভিজে হলো বুঝি?'
রাহুল মাথা নাড়িয়ে না করলো। প্রাণহীন দৃষ্টি দুটি আবারো অন্যদিকে রাখলো। নিভার আড়ালেই নিষ্প্রাণ দুটি চোখ কাদতে বসলো নিঃশব্দে। নিভা রাহুলের মাথার পেছনের সাইডটার দিকে তাকিয়ে থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলো। খুব স্বল্প পরিচিত মানুষের সাথে এতোটা কথা বলা যায়না।
অর্ধ রাস্তায় আসতেই বৃষ্টি কমে এলো। রাহুল আকস্মিক বলল, 'মামা দাড়ান।'
রাহুল নেমে পরতেই নিভা বিস্ময়সূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। রাহুল সুন্দর একটা হাসি দিয়ে বলল,
'বৃষ্টি কমে এসেছে। এবার এখান থেকে রিক্সা পেয়ে যাবো। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে এতোটা উপকার করার জন্য। ভাড়া দিয়ে অপমান করলাম না।'
বিস্ময়ে থেকেই নিভা মাথা নাড়ালো। হঠাৎই বোধ হলো লোকটা ঠোঁটকাটা সাথে স্ট্রং পারসোনালিটি।
'মামা উনাকে উনার স্থানে নিয়ে যান।'
রিক্সা চলতে শুরু করলো। রাহুল আরেকটা রিক্সা পেলো। ভাড়া করেই এক নজর তাকালো সেই রিক্সা বরাবর দূর-দূরান্তে। তাকাতেই দেখতে পেলো এক মোহান্ত অতল দর্শনেন্দ্রিয় পেছনে ঘুরে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। সে তাকাতেই সরিয়ে নিলো অভিলাষী সেই নয়ন।
_________________________________
মাঝে কেটে গেলো দু-তিন দিনের মতো। খাবার পর ফোন হাতে ঘরে বসে ছিলো টিকলি। আদরের নাম্বারটাতে ডায়াল করতেই পাশ থেকে দেখতে পেলো টায়রা। ছু মেরে ফোনটা নিয়ে এক দৌড়ে বারান্দায় যেতে যেতে তারস্বরে চেঁচিয়ে বলল,
'আমি কথা বলবো। আজকে আমি কথা বলবো।'
টিকলিও বোনের পেছন পেছন ছুটলো। ফোন নিয়ে কাড়াকাড়ি করতেই ওপাশ থেকে ফোন ধরে বসা হলো। টায়রা ফিসফিস করে বলল,
'হুশশ...চুপ থাক।'
ফোন কানে নিতে নিতেই টায়রা টেনে বলল,
'হ্যাললো... দুলাভাই। কি খবর হুম? গোপনে গোপনে পিরিত করে ফেললেন? এখন আবার গোপনে গোপনে কথাও আদান-প্রদান হচ্ছে? বলি সারাদিন কি শুধু বউয়ের খবর নিলেই চলবে? শালির দিকে একটু নজর দিতে হবে না? এতো সুন্দর শালি আপনার!'
টিকলি টায়রার হাতে চিমটি কাটলো। টায়রা হাত ঝাড়া মেরে দূরে সরে দাঁড়িয়ে আবারো বলল,
'কি? শালির কণ্ঠ শুনতে না শুনতেই মুখের বুলি হাওয়া? ভয় পেলেন নাকি? আরে ভয় পাচ্ছেন কেনো আমি সব জানি। আমি আপনাদের সিকিউরিটি গার্ড বুঝলেন? এই যেমন ধরেন, টিকলি আপনার সাথে কথা বলছে কিন্তু ঘরে কখন আব্বু আম্মু আসে তার দেখার দায়িত্ব আমার। বিভিন্ন ভাবে কথা কাটিয়ে টিকলিকে বিয়ের জোর-ঝামেলা থেকে বাঁচিয়ে দেওয়ার দায়িত্বও আমার। এক কথায় আমি আপনাদের হ্যাল্পিং হ্যান্ড। তো, এতো পরিশ্রম করি আপনাদের জন্য তার বিনিময়ে শালীকা কে তো কিছু দেওয়া উচিত। ফাউ ফাউ দুলাভাই একদম গ্রহণযোগ্য নয়।'
ওপাশ থেকে তখন বিস্ময়ে দুর্বাক গলায় বলা হলো,
'দুলাভাই?? ভাইয়া বিয়ে করেছে? আমাকে না জানিয়েই?'
টায়রা হতবাক হয়ে গেলো। তাড়াতাড়ি ফোনটাকে সামনে এনে হাত দিয়ে চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল,
'এই তুই কার নাম্বারে দিছস?'
'কেনো? তোর ভাইয়ার নাম্বারে।'
'সত্যি?'
'ওমা! মিথ্যে হতে যাবে কেনো? পাগল হলি নাকি? প্রতিদিন তো এই নাম্বারেই ফোন দিয়ে কথা বলি।'
ওপাশ থেকে শতবার হ্যালো হ্যালো শুনা গেলো। আদর গেছে ওয়াশরুমে। ভাইয়ের ঘরে আসতেই আর্দ্র দেখলো ফোনটা বাজছে। ফোনের উপরে নাম ভেসে উঠেছে 'শুকতাঁরায় মনতাঁরা'। আগে ছিলো শুধু মনতাঁরা। কিন্তু এখন আবার শুকতাঁরাও লাগানো হয়েছে। কৌতুহল বশত ফোনটা রিসিভ করতেই অজানা সব তথ্য পাওয়া গেলো। অবাকতায় বশীকরণও হয়ে যাওয়া হলো যখন টিকলির নামটা কর্ণগোচর হলো। আর্দ্র আবারও বলল,
'ভাইয়া টিকলিকে বিয়ে করেছে, টায়রা?'
টায়রা চমকালো। আয়হায়! এ বেটা তো টায়রাকে চিনে ফেলেছে এবার কি হবে? কথাবার্তা শুনে তো মনে হচ্ছে আদর ভাইয়া আর টিকলিদের সম্পর্কে কিছুই জানে না। নিশ্চয়ই আদর ভাইয়া ইচ্ছে করে ভেবেচিন্তেই ব্যাপারগুলো জানায়নি। এখন টায়রা বলে দিলে যদি আবার বিপদ হয়। যদি উনার বাবা-মাকে বলে দেয়। নানা চিন্তাভাবনার কবলে পরে টায়রা বাইরে ডাট বজায় রেখে বলল,
'এই, আপনি ফোন ধরেছেন কেনো হ্যাঁ?'
আর্দ্র রাগান্বিত গলায় বলল, 'একদম ঝগড়া করার তাল তুলবেন না। আমার ভাইয়ের ফোন আমি যখন ইচ্ছা তখন ধরবো।'
'নাহ ধরবেন না। ফোন যে একটা পারসোনাল জিনিস আপনি জানেন না?'
আর্দ্র মুখ ভেঙিয়ে বলল, 'নাহ জানি না। আর এতো জ্ঞান দিচ্ছেন অথচ নিজেই তো অন্যের ফোন থেকে ফোন দিয়েছেন।'
টায়রা চোখ বড় বড় করে থেমে থেমে বলল, 'আপনি বেশি জানেন? আমি কার ফোন থেকে ফোন দিয়েছি? '
'ভাইয়ার ফোনে নাম্বার সেভ করা শুকতাঁরার মনতাঁরা দিয়ে। এদিকে আপনিও ফোন দিয়ে দুলাভাই ডাকছেন। কাজেই নিশ্চয়ই ফোনের মালিক আপনি নন।'
'আপনার সাথে তর্ক করে কে?'
'গাধাকে যত পেটাও গাধা কি ঘোড়া হয়।'
'আপনি কি আমাকে গাধা বলার চেষ্টা করলেন?'
'চেষ্টা করিনি সেটাই বলেছি।'
'আপনার সাথে কথা বললেই আমার মুড নষ্ট হয়ে যায়। যখনি কথা বলি তখনি ঝগড়া হয়। এতো অসহ্য কেনো আপনি?'
'কারণ আপনার সহ্যশক্তি কম। বকবক কিন্তু আপনি করা শুরু করলেন তর্কও আপনি করলেন অথচ দোষ সব এই নিষ্পাপ আমার।'
রাগের ঠেলায় টায়রা ফোন কেটে দিয়ে ফুসফুস শব্দ করে টিকলির দিকে তাকালো। টিকলি বিস্মিত হয়ে বলল,
'কি হয়েছে? কে ফোন ধরেছিলো?'
'এই শোন, তোর প্রেম ক্যান্সেল বুঝছস? কোনোমতেই এটা হবে না। আমি হতে দিবো না। তোর দেবর এতো খারাপ কেনো? আমি তোর শ্বশুর বাড়ি গেলেই এই ভাদ্রর মুখোমুখি হতে হবে। ব্যস, ওমনেই লেগে যাবে। এতোটা ঝগড়ুটে মানুষ কি করে হতে পারে?'
'তুই ই তো বেশি করলি দেখলাম।' টিকলি চোখ ঘুরিয়ে বলল।
দাঁতে দাঁত চেপে টায়রা উত্তর দিলো,
'তুই সব জানোস? ওপাশ থেকে কি বলছে না বলছে তা কি শুনছোস? এখনি শ্বশুড় বাড়ির মেম্বারদের পক্ষে সাপোর্ট নেস? দেখিস, কালকে যখন মা আরেকটা পাত্র নিয়ে এসে বলবে, 'তোর বাবা একটা পাত্র দেখেছে। এবার অন্তত না করিস না।' তখন আমি মাকে আরো উস্কানী দিবো। এবার আর তোর রেহাই নাই।'
টায়রা চলে যেতে নিয়েও আবার বলল,
'এই ভাদ্র যদি আবারো আমার সাথে এমন করে তাহলে মনে রাখিস তোর প্রেমে সবচেয়ে বড় কাটা হমু আমি।'
টিকলি হতাশ অবুঝ চোখে তাকিয়ে থাকলো। বিরবির করে বলল,
'এই মেয়েটা কি আসলেই পাগল হয়ে গেলো? একে কি জরুরি ভিত্তিতে একটা ডাক্তার দেখানো উচিত?'
,
ফোন হাতে নিয়ে ব্যাহত নিষ্পাদন চোখে শূন্যে তাকিয়ে ছিলো আর্দ্র। আজও ঝগড়া দিয়েই কথা শুরু হলো।শেষও হলো। এই মেয়েটা এতো অসভ্য কেনো? মেয়েদের কি এতোটা বেপরোয়া মানায়? তখনি আর্দ্রর হাত থেকে ছু মেরে ফোন নিয়ে আদর ভ্রু কুচকে বলল,
'আমার ফোন দিয়ে কি করস?'
আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আর্দ্র বলল, 'টিকলির সাথে যে তোমার ইটিশ-পিটিশ চলতাছে এটা একবার বললে না আমায় ভাইয়া?'
'ইটিশ-পিটিশ আবার কি? মারবো কানের নিচে এক চর। বড় ভাইয়ের সাথে ঠিকমতো কথাও বলতে জানিস না।'
'এখন তো মারবাই। এখন তো ভাই পর শালী আপন।'
আদর ভ্রু কুচকে বলল, 'মাথা কি একবারে গেলো নাকি? আর মাত্র চারদিন হয়েছে সম্পর্কের। এর মাঝে তোকে বলার সুযোগ পাইনি।'
'শালীকে বলার সুযোগ তো ঠিকই পাইছো।'
'বারবার শালী শালী করতাছোস কেন? শালী আসতাছে কই থেকে? আমি কি বিয়ে করছি?'
আদর দাঁত কিড়িমিড়ি করে বলল। পা এগুলো ছাদের দিকে। আর্দ্র জোরে জোরে বলল, 'আবার তোমাকে দুলাভাই তো ঠিকই ডাকে।'
চলবে
Md manik, Sadman alom, Nazim khan, Faria oishy, Md mamun, Md sourav, Md akash shak and লেখাটি পছন্দ করেছে