- Israt Jahanনবাগত
- Posts : 4
স্বর্ণমুদ্রা : 1308
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-05-30
আলোয় ভুবন ভরা
Fri Jun 04, 2021 5:14 pm
১|
উঠানে ফেলে কাঁচা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে ফিরোজ মাস্টার বেধরক পেটায় স্বর্ণালীকে। কোনো বাপ তার মেয়েকে এইভাবে পেটাতে পারে ফিরোজ মাস্টারকে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। স্বর্ণালীর পিঠে অগণিত মার মারতে থাকে। রুপালী স্কুল থেকে ফিরে তার আপুকে এইভাবে মারতে দেখে জলদি দৌঁড়ে গিয়ে বাবাকে আটকে।
- আব্বা কী করতাছেন। বুবু তো মইরা যাইবো।
-যাক মইরা। এই ছেমড়ি মরলে আমি বাঁইচা যাই।
স্বর্ণালী শোয়া থেকে উঠে চুপচাপ কথাগুলো হজম করে নেয়। পুরো পিট ব্যাথায় টনটন করছে। ব্যাথা সহ্য করতে না পেরে চোখ দিয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু মুখ দিয়ে একটি শব্দও বের করছে না।
রুপালি স্বর্ণালীকে ধরে কোঠাঘরে নিয়ে যায়। কোঠা ঘরে পুরোনো চৌকির উপর স্বর্ণালীকে বসিয়ে দিয়ে নিজেও পাশে বসে। ওখানে নিয়ে গিয়ে পিঠের কামিজ তুলে দেখে কালো পিঠ কঞ্চির আঘাতে নীল বর্ণ ধারণ করেছে। বাঁকানো ভাবে একটির উপর দিয়ে আরেকটি দাগ দিয়ে সারা পিঠ ভরে গেছে। রুপালি স্বর্ণালীর পিঠে আলতো করে ছুঁয়ে দেয় এতে করে স্বর্ণালী ব্যাথায় কেঁপে ওঠে। রুপালি তার বড় আপুর এই অবস্থা দেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।
স্বর্ণালীর এতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। ভাবলেশহীন ভাবেই কোঠা ঘরের চৌকির উপর হাঁটু ভাজ করে দু'হাত হাঁটুর উপর বাম হাতের উপর ডান হাত দিয়ে অপলক দৃষ্টিতে বসে থাকে সে। রুপালি স্বর্ণালিকে বসিয়ে রেখে উনুনঘরে যায়। সেখানে গিয়ে সুন্দর করে পাটা ধুয়ে নিয়ে হলুদ বাটে। এরপর চলে যায় ক্ষেতের ধারে দুটো দুব্বো কুড়িয়ে আনে। দুব্বোগুলোও পাটায় ছেচে কোঠাঘরে নিয়ে আসে।
যতবার করে বুবুর পিঠের দিকে তাকাচ্ছে ততবারই কান্নায় চোখ ভেসে যাচ্ছে রুপালি। পিঠে খুব আলতো করে দুব্বো আর হলুদ বাটাটুকুন মেখে দেয়। রুপালির প্রতিটি স্পর্শে স্বর্ণালী কেঁপে কেঁপে ওঠে আর ঠিক ততটাই কুকড়ে যায়।
- এমনে করে আর কতো সইবি বুবু। তুই এ বাড়ি ছেড়ে চইলে যা।
রুপালির এমন কথা শুনে স্বর্ণালী রুপার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকায়।
-ওমন করে চেয়ে থাকলে হবে না বুবু। এ গেরামে কেউ তোমারে সইয্য করবার পারে না। আমি তোমার ভালো চাইছি। তোমার জেবনডা এমন কইরে শেষ হয়ে যাবে যে। তুমি কালা বইলে কি তুমি মানুষ নও বুবু?
স্বর্ণালী এবার রুপার কথা শুনে নিঃশব্দে কেঁদে দেয়। চোখ বেয়ে জল গড়ায়। রুপা ছাড়া কেউ যেন স্বর্ণালীকে মানুষ বলে গন্য করে না।
-বুবু...
স্বর্ণা রুপার দিকে জল ভরা চোখ নিয়ে তাকায়। স্বর্ণার তাকানো দেখে রুপা আবারও বলে উঠলো
- তুই চলে যা বুবু। তুই উচ্চমাধ্যমিক পাশ দিছিস। তুই শহরে গেলে পোলাপান পড়াবার পারবি। আর সেই সাথে তোর লেখা পড়াডাও চালাইবার পারবি। তোর ভালো হইবো দেখিস। তখন আর কেউ তোকে অপবাদ দিয়ে বেড়াবে না। আমার কথাখান শুন বুবু। এইখানে খালি তোর চোখ বেয়ে জল গড়াবে। তার দাম তুই পাবি না বুবু। কেউ তোর চোখের জলের দাম দিবে না। তুই তোর চোখের পানি মুছতে শেখ। শক্ত হো বুবু আমার।
স্বর্ণালী এবারও কিছু না বলে চুপচাপ বসেই রইলো। স্বর্ণালীর ভাবভঙ্গির কোনো পরিবর্তন না পেয়ে রুপালি রেগে গিয়ে বলে উঠলো
- আমার কথা শুনবি ক্যান। গেরামের মানুষের নানান কথা শুনতে ভালা লাগে তোর। পঁচে মর তুই। তুই মইরে গেলেও আমি তোর ধারে আসবো না এই আমি কইয়ে দিলুম।
কথাটুকু বলেই রুপালি চৌকি থেকে নেমে ঘর থেকে বের হয়ে যায়।
_________________________________________________
মা মরা দুই মেয়ে স্বর্ণালী আর রুপালী। বাবা প্রাইমারি স্কুলের রিটায়ার্ড হেড মাস্টার। বাবা এক সময় এই দুইমেয়েকে খুব আদর করতো। মা মারা যাবার পর ফিরোজ মাস্টারের রাগ অনেক বেড়ে গেছে। আর সেই রাগ সুযোগ পেলেই বড় মেয়ে স্বর্ণালীর উপর দিয়ে যায়। স্বর্ণালী রুপালীর মা যখন মারা যায় তখন স্বর্ণালীর আট বছর আর রুপালির পাঁচ বছর। আজ দশ বছর হয়ে গেলো ফিরোজ মাস্টারের বউ মাধবীলতা ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেছেন।
দুই মেয়ে বড়ই আদরের ছিলো। বড় মেয়ে যখন হয়েছে খুব শখ করে নাম রেখেছিলো স্বর্ণালী। আর ছোট মেয়ে হলো ঠিক তিন বছর পর। রুপার মতন চেহারা ঠিক যেন মায়ের গায়ের রঙ পেয়েছে ছোট মেয়ে তাই তার নাম রাখা হয়েছিলো রুপালি। আর স্বর্ণালী পেয়েছে বাবার গায়ের রঙ।
বাবা মাস্টার হওয়ায় দুই মেয়েকে অনেকদূর লেখাপড়া করাতে চায়। মাধবীলতারও একই স্বপ্ন ছিলো। দুই মেয়ে লেখাপড়া করে অনেক বড় হবে। গ্রামের মেয়েরা সাধারণত লেখাপড়ার সুযোগ পায় না। সে জায়গায় বাবা গ্রামের হেডমাস্টার হওয়ায় স্বর্ণালী আর রুপালির জন্য এটা অনেক ভালো সুযোগ। স্বর্ণালীর গায়ের রঙ কালো হলেও তার চোখ দুটোতে অদ্ভুত মায়া কাজ করে। কালো মেয়েদের এই একগুন থাকে চোখগুলো হয় নজরকাড়া। আর তার সাথে স্বর্ণালীর কোমড় পেড়িয়ে ঘন মেঘকালো লম্বা চুল। অবশ্য কেউ সে চুল আজ পর্যন্ত দেখেনি রুপালি বাদে।
গ্রামের মেয়েরা চৌদ্দ পেরোতেই বিয়ে হয়ে যায় সে যায়গায় দু-দুটো যুবতী মেয়ে ফিরোজ মাস্টারের ঘরে। লোকে নানান মন্দ কথা বলে বেড়ায়। ছোট মেয়ে রুপালিকে নিয়ে কেউ কিছু বললে রুপালি কড়া জবাব দিয়ে দেয়। স্বর্ণালী ঠিক বিপরীত স্বভাবের। কেউ কিছু বললে মুখে কোনো রা নেই। আর সেই সুত্র ধরেই ফিরোজ স্বর্ণালীকে বেধড়ক পেটায়।
____________
স্বর্ণালী মাধ্যমিক পাশ দেবার পর থেকে ঘরের সকল কাজই করে। আগে লেখাপড়ার জন্য হাসু কাকি রান্না বান্না করে দিয়ে যেতো এখন সেসব একা হাতে স্বর্ণালী সামলায়। আজ সকালে বাবা চিংড়ি মাছ এনেছে বাজার থেকে তা দেখে স্বর্ণালীর খুব ইচ্ছে জাগে শাপলা দিয়ে চিংড়ি খেতে। তাছাড়া রুপালির শাপলা দিয়ে চিংড়িমাছ খুব পছন্দ। তাই সকাল সকাল উঠানে বসে কলাপাতায় করে চিংড়ি গুলো বেছে নিলো। চিংড়ি বাছা শেষ করে কলপাড়ে গিয়ে খুব সুন্দর করে ধুয়ে নিলো। ধোয়ার পর চিংড়ি গুলো সাদা ঝকঝক করছে। উনুনঘরে একটি বাটিতে চিংড়ি রেখে আরেকটি বাটি দিয়ে তা ঢেকে দেয় যেন বিড়াল এসে চিংড়িতে মুখ দিতে না পারে। মাছ ঢেকে স্বর্ণালী চলে যায় শাপলা তোলার জন্য। বিলের পাড়ে গিয়ে নৌকায় উঠে নৌকা বেয়ে বিলের মাঝে চলে যায় শাপলা তুলতে।
আর তা দেখে পাশের বাড়ির শেফালি কাকিমা এসে স্বর্ণালীর বাবার কাছে নালিশ দেয়
-ও ফিরোজ মাস্টার বলি বাড়ি আছো নাকি?
-কেডা? ও শেফালি বু আসো বাড়িতে আসো। স্বর্ণালীরে ঘর থেকে চেয়ারডা লইয়া আয়।
শেফালি পান চিবুতে চিবুতে বলে
- স্বর্ণালী বাড়িতে থাকলে না চেয়ার দিবো।
- স্বর্ণালী মনে হয় রান্না ঘরে আছে। দাড়াও বু আমি তোমারে চেয়ার দেই।
ফিরোজ মাস্টার চলে যায় আর ঘরে থেকে দুটো প্লাস্টিকের চেয়ার নিয়ে আসে উঠানে রাখে। চেয়ারে বসে শেফালি পান চিবুতে চিবুতে চিরিক করে পানের পিক উঠানে ফেলে এরপর বলে ওঠে
- কত কইরা কইলাম ফিরোজ মাস্টার মাইয়া দুইডা বড় হইছে বিয়া দেও নইলে দেখবা মাইয়া নাগোর জুটাইবো। পরে এই মুখ কই লুকাইবা।
শেফালির কথা শুনে ফিরোজের চোখ মুখ শক্ত হয়ে যায়। রাগী রাগী কণ্ঠে বলে উঠে
-বু কি কইবার চাইতাছো তুমি?
শেফালির এতে কোনো ভাবভঙ্গি পরিবর্তন হয়না। বরং আরেকটু আয়েশী ভঙ্গিতে বসে বলে
- যা সইত্য তাই কইতাছি ফিরোজ মাস্টার। আমার কথা তো গায়ে লাগাও না। মাইয়া নাগোর আনলে বুঝবা।
শেফালির কথায় ফিরোজের চোখ রাগে লাল হয়ে যায়। এরপর বলে ওঠে
- বু কথা না পেঁচাইয়া যা কইবার আইছো হেইডা কইয়া ফালাও।
- একটু আগে দেখলাম তোমার কালা মাইয়াডা।
- কালা মাইয়া কী? হের একটা নাম আছে। স্বর্ণালী হের নাম। নাম ধইরা কইবার পারো না?
- হ হেইডাই। এই ভর দুপুরে বিলের মধ্যে গা গতর দেহাইয়া বেড়াইতাছে। হেই তো জানে হে কালা দেইখা সহজে বিয়া হইবো না। তাই বইলা লাজ লজ্জার মাথা খাইয়া এই ভর দুপুরে লোকেরে গতর দেহাইয়া বেড়ানোর লাগবো? সময় মতো বিয়া না দিলে তো মাইয়া এমন করবই। সময় থাকতে বিয়া দিয়া দেও ফিরোজ মাস্টার। নইলে দেখবা মাইয়া একদিন নাগোর নিয়া ভাগবো আর তোমার মুখ পুরাইবো এই আমি কইয়া দিলাম।
- মুখ সামলাইয়া কথা কও বু। আমার মাইয়াগো আমি চিনি।
- হ, আমারেই ধমকাইতেই পারবা তাও নিজের মাইয়াগো ঠিক করবার পারবা না। কয়জনের মুখ আটকাইবা তুমি? আইজ আমি সাবধান করতে আইছি। কাইল যহন পাঁচজনে পাঁচ কথা কইবো তহন কি করবা? মাইয়া মানুষ মুখ পোড়ানোর আগে সামলাও মাস্টার।
- বু তুমি এহন যাও। তোমার লগে পরে কথা কমু।
শেফালি রাগী রাগী ভাব নিয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো। এরপর মুখ থেকে আরও একবার চিরিক করে পানের পিক উঠানে ফেললো।আর বললো
- যাইতাছি, যাইতাছি, এই জন্যই কয় কারো ভালো করন লাগে না।
কথাটি বলেই বড় বড় কদম ফেলে শেফালি এ বাড়ি ত্যাগ করলো।
ফিরোজ উঠানে রাগের মাথায় পাইচারি করতে থাকে। স্বর্ণালি বাড়ি এলে ফিরোজ মাস্টার জিজ্ঞেস করলো
- এই ভরদুপুরে তুই বিলে গেছিলি।
- হ, আব্বা।আমি..
স্বর্ণালিকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ দিলো না ফিরোজ মাস্টার। উঠানে পড়ে থাকা বাঁশের কঞ্চি দিয়েই বেধড়ক পেটায়। আর কিছুক্ষন পর রুপালি স্কুল থেলে এসে বাঁচিয়ে নিলো স্বর্ণালীকে।
(চলবে)
ইশরাত জাহান
উঠানে ফেলে কাঁচা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে ফিরোজ মাস্টার বেধরক পেটায় স্বর্ণালীকে। কোনো বাপ তার মেয়েকে এইভাবে পেটাতে পারে ফিরোজ মাস্টারকে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। স্বর্ণালীর পিঠে অগণিত মার মারতে থাকে। রুপালী স্কুল থেকে ফিরে তার আপুকে এইভাবে মারতে দেখে জলদি দৌঁড়ে গিয়ে বাবাকে আটকে।
- আব্বা কী করতাছেন। বুবু তো মইরা যাইবো।
-যাক মইরা। এই ছেমড়ি মরলে আমি বাঁইচা যাই।
স্বর্ণালী শোয়া থেকে উঠে চুপচাপ কথাগুলো হজম করে নেয়। পুরো পিট ব্যাথায় টনটন করছে। ব্যাথা সহ্য করতে না পেরে চোখ দিয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু মুখ দিয়ে একটি শব্দও বের করছে না।
রুপালি স্বর্ণালীকে ধরে কোঠাঘরে নিয়ে যায়। কোঠা ঘরে পুরোনো চৌকির উপর স্বর্ণালীকে বসিয়ে দিয়ে নিজেও পাশে বসে। ওখানে নিয়ে গিয়ে পিঠের কামিজ তুলে দেখে কালো পিঠ কঞ্চির আঘাতে নীল বর্ণ ধারণ করেছে। বাঁকানো ভাবে একটির উপর দিয়ে আরেকটি দাগ দিয়ে সারা পিঠ ভরে গেছে। রুপালি স্বর্ণালীর পিঠে আলতো করে ছুঁয়ে দেয় এতে করে স্বর্ণালী ব্যাথায় কেঁপে ওঠে। রুপালি তার বড় আপুর এই অবস্থা দেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।
স্বর্ণালীর এতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। ভাবলেশহীন ভাবেই কোঠা ঘরের চৌকির উপর হাঁটু ভাজ করে দু'হাত হাঁটুর উপর বাম হাতের উপর ডান হাত দিয়ে অপলক দৃষ্টিতে বসে থাকে সে। রুপালি স্বর্ণালিকে বসিয়ে রেখে উনুনঘরে যায়। সেখানে গিয়ে সুন্দর করে পাটা ধুয়ে নিয়ে হলুদ বাটে। এরপর চলে যায় ক্ষেতের ধারে দুটো দুব্বো কুড়িয়ে আনে। দুব্বোগুলোও পাটায় ছেচে কোঠাঘরে নিয়ে আসে।
যতবার করে বুবুর পিঠের দিকে তাকাচ্ছে ততবারই কান্নায় চোখ ভেসে যাচ্ছে রুপালি। পিঠে খুব আলতো করে দুব্বো আর হলুদ বাটাটুকুন মেখে দেয়। রুপালির প্রতিটি স্পর্শে স্বর্ণালী কেঁপে কেঁপে ওঠে আর ঠিক ততটাই কুকড়ে যায়।
- এমনে করে আর কতো সইবি বুবু। তুই এ বাড়ি ছেড়ে চইলে যা।
রুপালির এমন কথা শুনে স্বর্ণালী রুপার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকায়।
-ওমন করে চেয়ে থাকলে হবে না বুবু। এ গেরামে কেউ তোমারে সইয্য করবার পারে না। আমি তোমার ভালো চাইছি। তোমার জেবনডা এমন কইরে শেষ হয়ে যাবে যে। তুমি কালা বইলে কি তুমি মানুষ নও বুবু?
স্বর্ণালী এবার রুপার কথা শুনে নিঃশব্দে কেঁদে দেয়। চোখ বেয়ে জল গড়ায়। রুপা ছাড়া কেউ যেন স্বর্ণালীকে মানুষ বলে গন্য করে না।
-বুবু...
স্বর্ণা রুপার দিকে জল ভরা চোখ নিয়ে তাকায়। স্বর্ণার তাকানো দেখে রুপা আবারও বলে উঠলো
- তুই চলে যা বুবু। তুই উচ্চমাধ্যমিক পাশ দিছিস। তুই শহরে গেলে পোলাপান পড়াবার পারবি। আর সেই সাথে তোর লেখা পড়াডাও চালাইবার পারবি। তোর ভালো হইবো দেখিস। তখন আর কেউ তোকে অপবাদ দিয়ে বেড়াবে না। আমার কথাখান শুন বুবু। এইখানে খালি তোর চোখ বেয়ে জল গড়াবে। তার দাম তুই পাবি না বুবু। কেউ তোর চোখের জলের দাম দিবে না। তুই তোর চোখের পানি মুছতে শেখ। শক্ত হো বুবু আমার।
স্বর্ণালী এবারও কিছু না বলে চুপচাপ বসেই রইলো। স্বর্ণালীর ভাবভঙ্গির কোনো পরিবর্তন না পেয়ে রুপালি রেগে গিয়ে বলে উঠলো
- আমার কথা শুনবি ক্যান। গেরামের মানুষের নানান কথা শুনতে ভালা লাগে তোর। পঁচে মর তুই। তুই মইরে গেলেও আমি তোর ধারে আসবো না এই আমি কইয়ে দিলুম।
কথাটুকু বলেই রুপালি চৌকি থেকে নেমে ঘর থেকে বের হয়ে যায়।
_________________________________________________
মা মরা দুই মেয়ে স্বর্ণালী আর রুপালী। বাবা প্রাইমারি স্কুলের রিটায়ার্ড হেড মাস্টার। বাবা এক সময় এই দুইমেয়েকে খুব আদর করতো। মা মারা যাবার পর ফিরোজ মাস্টারের রাগ অনেক বেড়ে গেছে। আর সেই রাগ সুযোগ পেলেই বড় মেয়ে স্বর্ণালীর উপর দিয়ে যায়। স্বর্ণালী রুপালীর মা যখন মারা যায় তখন স্বর্ণালীর আট বছর আর রুপালির পাঁচ বছর। আজ দশ বছর হয়ে গেলো ফিরোজ মাস্টারের বউ মাধবীলতা ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেছেন।
দুই মেয়ে বড়ই আদরের ছিলো। বড় মেয়ে যখন হয়েছে খুব শখ করে নাম রেখেছিলো স্বর্ণালী। আর ছোট মেয়ে হলো ঠিক তিন বছর পর। রুপার মতন চেহারা ঠিক যেন মায়ের গায়ের রঙ পেয়েছে ছোট মেয়ে তাই তার নাম রাখা হয়েছিলো রুপালি। আর স্বর্ণালী পেয়েছে বাবার গায়ের রঙ।
বাবা মাস্টার হওয়ায় দুই মেয়েকে অনেকদূর লেখাপড়া করাতে চায়। মাধবীলতারও একই স্বপ্ন ছিলো। দুই মেয়ে লেখাপড়া করে অনেক বড় হবে। গ্রামের মেয়েরা সাধারণত লেখাপড়ার সুযোগ পায় না। সে জায়গায় বাবা গ্রামের হেডমাস্টার হওয়ায় স্বর্ণালী আর রুপালির জন্য এটা অনেক ভালো সুযোগ। স্বর্ণালীর গায়ের রঙ কালো হলেও তার চোখ দুটোতে অদ্ভুত মায়া কাজ করে। কালো মেয়েদের এই একগুন থাকে চোখগুলো হয় নজরকাড়া। আর তার সাথে স্বর্ণালীর কোমড় পেড়িয়ে ঘন মেঘকালো লম্বা চুল। অবশ্য কেউ সে চুল আজ পর্যন্ত দেখেনি রুপালি বাদে।
গ্রামের মেয়েরা চৌদ্দ পেরোতেই বিয়ে হয়ে যায় সে যায়গায় দু-দুটো যুবতী মেয়ে ফিরোজ মাস্টারের ঘরে। লোকে নানান মন্দ কথা বলে বেড়ায়। ছোট মেয়ে রুপালিকে নিয়ে কেউ কিছু বললে রুপালি কড়া জবাব দিয়ে দেয়। স্বর্ণালী ঠিক বিপরীত স্বভাবের। কেউ কিছু বললে মুখে কোনো রা নেই। আর সেই সুত্র ধরেই ফিরোজ স্বর্ণালীকে বেধড়ক পেটায়।
____________
স্বর্ণালী মাধ্যমিক পাশ দেবার পর থেকে ঘরের সকল কাজই করে। আগে লেখাপড়ার জন্য হাসু কাকি রান্না বান্না করে দিয়ে যেতো এখন সেসব একা হাতে স্বর্ণালী সামলায়। আজ সকালে বাবা চিংড়ি মাছ এনেছে বাজার থেকে তা দেখে স্বর্ণালীর খুব ইচ্ছে জাগে শাপলা দিয়ে চিংড়ি খেতে। তাছাড়া রুপালির শাপলা দিয়ে চিংড়িমাছ খুব পছন্দ। তাই সকাল সকাল উঠানে বসে কলাপাতায় করে চিংড়ি গুলো বেছে নিলো। চিংড়ি বাছা শেষ করে কলপাড়ে গিয়ে খুব সুন্দর করে ধুয়ে নিলো। ধোয়ার পর চিংড়ি গুলো সাদা ঝকঝক করছে। উনুনঘরে একটি বাটিতে চিংড়ি রেখে আরেকটি বাটি দিয়ে তা ঢেকে দেয় যেন বিড়াল এসে চিংড়িতে মুখ দিতে না পারে। মাছ ঢেকে স্বর্ণালী চলে যায় শাপলা তোলার জন্য। বিলের পাড়ে গিয়ে নৌকায় উঠে নৌকা বেয়ে বিলের মাঝে চলে যায় শাপলা তুলতে।
আর তা দেখে পাশের বাড়ির শেফালি কাকিমা এসে স্বর্ণালীর বাবার কাছে নালিশ দেয়
-ও ফিরোজ মাস্টার বলি বাড়ি আছো নাকি?
-কেডা? ও শেফালি বু আসো বাড়িতে আসো। স্বর্ণালীরে ঘর থেকে চেয়ারডা লইয়া আয়।
শেফালি পান চিবুতে চিবুতে বলে
- স্বর্ণালী বাড়িতে থাকলে না চেয়ার দিবো।
- স্বর্ণালী মনে হয় রান্না ঘরে আছে। দাড়াও বু আমি তোমারে চেয়ার দেই।
ফিরোজ মাস্টার চলে যায় আর ঘরে থেকে দুটো প্লাস্টিকের চেয়ার নিয়ে আসে উঠানে রাখে। চেয়ারে বসে শেফালি পান চিবুতে চিবুতে চিরিক করে পানের পিক উঠানে ফেলে এরপর বলে ওঠে
- কত কইরা কইলাম ফিরোজ মাস্টার মাইয়া দুইডা বড় হইছে বিয়া দেও নইলে দেখবা মাইয়া নাগোর জুটাইবো। পরে এই মুখ কই লুকাইবা।
শেফালির কথা শুনে ফিরোজের চোখ মুখ শক্ত হয়ে যায়। রাগী রাগী কণ্ঠে বলে উঠে
-বু কি কইবার চাইতাছো তুমি?
শেফালির এতে কোনো ভাবভঙ্গি পরিবর্তন হয়না। বরং আরেকটু আয়েশী ভঙ্গিতে বসে বলে
- যা সইত্য তাই কইতাছি ফিরোজ মাস্টার। আমার কথা তো গায়ে লাগাও না। মাইয়া নাগোর আনলে বুঝবা।
শেফালির কথায় ফিরোজের চোখ রাগে লাল হয়ে যায়। এরপর বলে ওঠে
- বু কথা না পেঁচাইয়া যা কইবার আইছো হেইডা কইয়া ফালাও।
- একটু আগে দেখলাম তোমার কালা মাইয়াডা।
- কালা মাইয়া কী? হের একটা নাম আছে। স্বর্ণালী হের নাম। নাম ধইরা কইবার পারো না?
- হ হেইডাই। এই ভর দুপুরে বিলের মধ্যে গা গতর দেহাইয়া বেড়াইতাছে। হেই তো জানে হে কালা দেইখা সহজে বিয়া হইবো না। তাই বইলা লাজ লজ্জার মাথা খাইয়া এই ভর দুপুরে লোকেরে গতর দেহাইয়া বেড়ানোর লাগবো? সময় মতো বিয়া না দিলে তো মাইয়া এমন করবই। সময় থাকতে বিয়া দিয়া দেও ফিরোজ মাস্টার। নইলে দেখবা মাইয়া একদিন নাগোর নিয়া ভাগবো আর তোমার মুখ পুরাইবো এই আমি কইয়া দিলাম।
- মুখ সামলাইয়া কথা কও বু। আমার মাইয়াগো আমি চিনি।
- হ, আমারেই ধমকাইতেই পারবা তাও নিজের মাইয়াগো ঠিক করবার পারবা না। কয়জনের মুখ আটকাইবা তুমি? আইজ আমি সাবধান করতে আইছি। কাইল যহন পাঁচজনে পাঁচ কথা কইবো তহন কি করবা? মাইয়া মানুষ মুখ পোড়ানোর আগে সামলাও মাস্টার।
- বু তুমি এহন যাও। তোমার লগে পরে কথা কমু।
শেফালি রাগী রাগী ভাব নিয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো। এরপর মুখ থেকে আরও একবার চিরিক করে পানের পিক উঠানে ফেললো।আর বললো
- যাইতাছি, যাইতাছি, এই জন্যই কয় কারো ভালো করন লাগে না।
কথাটি বলেই বড় বড় কদম ফেলে শেফালি এ বাড়ি ত্যাগ করলো।
ফিরোজ উঠানে রাগের মাথায় পাইচারি করতে থাকে। স্বর্ণালি বাড়ি এলে ফিরোজ মাস্টার জিজ্ঞেস করলো
- এই ভরদুপুরে তুই বিলে গেছিলি।
- হ, আব্বা।আমি..
স্বর্ণালিকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ দিলো না ফিরোজ মাস্টার। উঠানে পড়ে থাকা বাঁশের কঞ্চি দিয়েই বেধড়ক পেটায়। আর কিছুক্ষন পর রুপালি স্কুল থেলে এসে বাঁচিয়ে নিলো স্বর্ণালীকে।
(চলবে)
ইশরাত জাহান
Ayrin kaTun, Masum, Sk nadim, Sume akter, Nera akter, Israyeel hossen, Arif howla and লেখাটি পছন্দ করেছে
- Israt Jahanনবাগত
- Posts : 4
স্বর্ণমুদ্রা : 1308
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-05-30
Re: আলোয় ভুবন ভরা
Fri Jun 04, 2021 5:14 pm
২|
কোঠা ঘর থেকে বেড়িয়ে উঠানে তাকালো। বিল থেকে আনা শাপলাগুলো ওইভাবেই মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। সেখানে গিয়ে খুব যত্ন করে সেগুলো তুলে পানি দিলে হালকা করে ধুয়ে উঠানের ধুলা ছাড়িয়ে নিলো। শাপলার ডাটাগুলো ছোট ছোট করে কেটে চিংড়িটুকু মশলা দিয়ে কষিয়ে নিয়ে বেশি করে পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে ঝাল ঝাল করে রান্না করলো।
চালের ড্রাম খুলে সেখান থেকে চাল নিয়ে উনুনে বসিয়ে দিলো। শুকনা খড়ি দাউ দাউ করে জ্বলছে। জ্বলন্ত আগুনে চোখ আটকে যায় স্বর্ণালীর।
রুপালি গোসল সেরে দেখে বুবু রান্না বসিয়ে এক ধ্যানে আগুনের দিকে তাকিয়ে আছে। এদিকে ভাত উথলে উঠে উনুনের উপর পরছে সেদিকে স্বর্ণালীর কোনো খেয়াল নেই।
- এই বুবু ভাত যে উতলে উঠছে।
রুপার কথায় স্বর্ণালীর ধ্যান ভাঙে। খড়ি টেনে দিয়ে জ্বাল কমিয়ে দেয়। রুপালি একটা পিড়ি নিয়ে বুবুর পাশেই বসে পড়ে। বুবুর দিকে তাকিয়ে দেখে খুব মন খারাপ করে বসে আছে সে। রুপা তার বুবুর মন খারাপের কারণগুলো বুঝতে পারে।
-বুবু মন খারাপ করিস না।
এবার স্বর্ণালি কথা বলে ওঠে
- তোর মনে আছে রুপা? মা থাকতে আমরা সারাদিন বনে বাদারে ছুটে বেড়াতাম কেউ কিচ্ছুটি বলতো না। তুই কত ছোট ছিলি তখন।
- পুরোনো দিনের কথা ভেবে কী হবে বল? আব্বা ঠিকই বলে মা মারা যাবার সময় কেন আমাদের নিয়ে গেলো না? এতে করে আব্বার কষ্ট কমতো আর আমাদেরও।
দুবোনের মাঝেই খুব নিরবতা। হঠাৎই চিৎকার এর আওয়াজ এলো। ঘটনা কেউ কিছু বুঝতে পা পেরে দুজনেই আওয়াজ যে দিক থেকে এলো সেদিকে দৌড়ে গেল। আওয়াজ আসছিলো কল পাড় থেকে দুজন কলপাড়ে গিয়ে দেখলো আব্বা কলপাড়ের শেওলার মধ্যে পিছলা খেয়ে পড়ে গেছে আর কপাল থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। একসাথে এতো রক্ত দেখে স্বর্ণালী মাথা ঘুরিয়ে বমি করে দিলো। অল্প সময়ের মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে দুবোন মিলে বাবাকে ধরাধরি করে ঘরে নিয়ে গেলো। স্বর্ণালী রুপালিকে বললো
- আমি আব্বার কাছে বইতাছি তুই এহনি বাজারে গিয়া হাশেম ডাক্তারকে খবর দে।
রুপালি দেরি না করে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো। স্বর্ণালীর সারা জামা হাত পা রক্তে মাখামাখি হয়ে রইলো। ফিরোজ মাস্টার অজ্ঞান হয়ে আছে। স্বর্ণালী তার আব্বার কপাল মুখের সব রক্ত মুছে দিলো কিন্তু রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে কপালের কাটা জায়গাটায় জমাট বেঁধে আছে। স্বর্ণালী সেটাও খুব সাবধানে মুছে দিলো।
রুপালি ডাক্তার নিয়ে বাড়ি চলে এলো। হাশেম ডাক্তার নেই তাই অন্য কাউকে নিয়ে এসেছে। ডাক্তারকে দেখে স্বর্ণালী মাথার কাপড় টেনে ঘরের এককোনে দাঁড়িয়ে রইলো রুপালি ডাক্তারকে নিয়ে তার আব্বার কাছে গেলে ডাক্তার কাটা জায়গাটা ক্লিন করে মাথা ব্যান্ডেজ করে দিলো। দুটো ইঞ্জেকশন দিলো আর কিছু ওষুধ লিখে দিলো নিয়ম করে খাবার জন্য আর যাবার আগে বলে গেলো যতো দ্রুতো সম্ভব শহরে ডাক্তার দেখানোর জন্য কারন ফিরোজ মাস্টার পায়ে গুরুতরভাবে আঘাত পেয়েছে।
ডাক্তার চলে গেলে স্বর্ণালীর মনে পড়লো উনুনে ভাত বসানো ছিলো দৌড়ে গিয়ে দেখলো সবটা পুরে ছাই। আব্বার জন্য আবারও উনুনে ভাত বসিয়ে দিলো। এবার নরম করে ভাত রান্না করলো। ভাত রান্না শেষে ঘরে গিয়ে দেখলো রুপালি এক নজরে আব্বার দিকে তাকিয়ে আছে।
- রুপা তুই গোসল সেরে খেয়ে নে আমি আব্বার পাশে বসি।
আব্বাকে দেখে বুকের ভুতরটা কেমন করে উঠলো। দশ বছর আগে মা'কে হারিয়েছে আজ আব্বার কিছু হয়ে গেলে...
আর ভাবতে পারলো না চোখে জল নেমে এলো। ওড়নার একপাশ দিয়ে চোখ মুছে দু'হাতের মাঝে আব্বার এর একটি হাত নিলো। অনেকক্ষন যাবৎ এভাবেই বসে রইলো। আব্বার হাত এভাবে নিজের দু'হাতের মাঝে রেখেই নিজের কুনই দুটো বিছানায় ঠেকিয়ে দুহাতের পিঠে নিজের কপাল রেখে বসে রইলো। এভাবে থাকতে থাকতে কখন চোখ লেগে এসেছে মনে নেই। আব্বার হাতের নড়াচড়া অনুভব করে চোখ খুললো। চোখ খুলে দেখে আব্বার জ্ঞান ফিরছে। জ্ঞান ফিরতেই স্বর্ণালী আব্বাকে কোনো কিছুর সুযোগ না করে আব্বাকে অনবরত জিজ্ঞেস করে চললো।
- আব্বার আপনার কেমন লাগতাছে? কোনো কষ্ট হইতাছে? কোথায় কষ্ট হইতাছে আমারে কন। এই রুপা আব্বার লাইগা পানি লইয়া আয়।
রুপা দৌড়ে গিয়ে পানি আনলো। এসে সেও বলতে লাগলো
-আব্বা আপনি ঠিকাছেন?
দুই মেয়েকে অস্থির হতে দেখে ফিরোজ উঠে বসলো
- হ রে মা আমি ঠিকাছি।
কথাটি বলে ফিরোজ তার পা দুটো নাড়াতে চাইলো কিন্তু কোনোভাবে নাড়াতে পারলো না।
ফিরোজ ফ্যালফ্যাল করে দুই মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। ফিরোজের এভাবে তাকিয়ে থাকা দেখে দুই মেয়ের মুখ শুকিয়ে এলো। রুপালি বলে উঠলো
-আব্বা কি হইছে? কোনো কষ্ট লাগতাছে? কিছু লাগবো? কি দিমু কন।
নিরবতা ভেঙে ফিরোজ বললো
- আমি পাও লাড়াইতে পারতাছি না রে মা।
কথাটা শুনে দুইবোনের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। স্বর্ণালী ব্যস্ত হয়ে উনুনঘরে গেল ওখান থেকে সরিষার তেল নিয়ে এলো। তেল এনে আব্বার পায়ে তেল মালিশ করতে লাগলো।
- আব্বা চিন্তা কইরেন না সব ঠিক হয়ে যাবে। রোদ পড়লেই আপনারে নিয়া শহরের ডাক্তারের কাছে যামু। ডাক্তার সব ভালা কইরা দিবো।
স্বর্ণালী রুপার আর তার আব্বার জন্য ভাত ভেরে দিলো। সব কাজ শেষ করে গেলো রশিদ চাচার বাড়িতে।
- রশিদ চাচা একটু পর আপনার ভ্যানটা দিয়ে একটু সড়কে দিয়া আসবার পারবেন?
- সড়কে যাইবা ক্যান?
- আব্বার পায়ে ব্যাথা হইছে। ডাক্তারের কাছে নিয়া যাওন লাগবো।
- আইচ্ছা তুমরা তৈয়ার হও আমি ভ্যান বাহির করি।
বাড়ি এসে স্বর্ণালী প্রয়োজনীয় সব জিনিস গুছিয়ে নিলো। হাসপাতালে যেতে অনেক সময় লাগবে। আর নতুন জায়গায় গিয়ে হাতের কাছে কিছুই পাবেনা তাই দরকারি জিনিস আব্বার ওষুধ সব গুছিয়ে নিলো।
বিকেলে রোদ পড়তেই ভ্যান নিয়ে রশিদ চাচা বাড়ির উঠানে হাজির। তিনজন মিলে ধরাধরি করে ফিরোজকে ভ্যানে তুলে সড়কে নিয়ে গেল। সেখান থেকে মাইক্রো ভাড়া করে সোজা হাসপাতালে। যেতে যেতে আট ঘন্টা সময় লাগলো।
হাসপাতালে দুদিন রাখা হলো। ফিরোজ মাস্টারের পা নিয়ে আর চলাফেরা করতে পারবে না বলে ডাক্তার জানিয়ে দিয়েছে।
দুদিন পর তারা আবার বাড়ি চলে এলো। আর ফিরোজ মাস্টারের সঙ্গী হলো হুইল চেয়ার। ফিরোজ এর এমন খবর পেয়ে দূরের গ্রাম থেকে ফিরোজ এর ফুফু খুশবু এলেন বাড়িতে।
বয়স প্রায় ৭০ এর উপরে। মোটাসোটা দেখতে।ভীষণ রাগী চেহারা হাঁটে গেলে মাটিও যেন ভয়ে কাঁপে। উনার কথার উপর টু শব্দটি করার সাহস কারো নেই। বাম হাতে মোটা একটা তাবিজ বাঁধা দেখতে সুন্দর। কম বয়সে খুব ফর্সা আর সুন্দরী ছিলেন বোঝা যায়। বাড়ির সকলে তাকে খুব মান্য করে।
ফিরোজ এর এমন দুর্দিনে ছুটে এলেন ফিরোজকে দেখতে। ফিরোজ মাস্টার অনেকদিন পর কাছের মানুষকে দেখতে পেয়ে খুব খুশি হলো। স্বর্ণালী রুপালিকে বলে দিলো তাদের দাদী মানে ফিরোজ মাস্টারের ফুফুর যত্নের যেন কোনো কমতি না হয়। দুই মেয়ে একদিক দিয়ে বাবার ভালো থাকার জন্য যেমন দিনরাত এক করে ফেলছে। অন্যদিক দিয়ে পাল্লা ধরে দাদীর যত্ন করে যাচ্ছে এতটুকুও যেন কমতি না থাকে সেদিকে খেয়াল রেখে যাচ্ছে।
দাদীকে আব্বার ঘরে থাকাএ ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে। আর আব্বা থাকে দুইবোনের কোঠা ঘরে। দুবোন দাদীর ঘরেই নিচে তোশক পেতে নিজেদের থাকার জায়গা করে নিয়েছে।
এক রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে খুশবু ফিরোজের ঘরে গেল আর দুবোনকে কড়া নিষেধ করে দিলো ওদিকে যেন কেউ বিরক্ত না করে।
ফিরোজের ঘরে ঢুকে ফিরোজকে বলতে লাগলো
- দ্যাখ তোর এখন এই অবস্থা যুবতী দুই মাইয়া ঘরে রাখা কি ঠিক হইতাছে? লেখাপড়া তো অনেক করাইলি এসব লেখাপড়া দিয়া মাইয়া মানুষ কি করবো? সব শেষে তো বিয়া কইরা সংসার করাই লাগবো। তার চেয়ে বড় কথা মাইয়া দুইডার বয়স পার হইয়া যাইতাছে। পরে যোগ্য পাত্র খুইজা পাবি না। তাছাড়া এহন তোর এই অবস্থা কেউ কোনো ক্ষতি কইরা দিলে কি কইরা গেরামে মুখ দেহাইবি?
- ফুফু মা মরা মাইয়া দুইডা লেখাপড়া কইরা নিজের পায়ে দাড়াইলে তাগোর আর কোনো চিন্তা থাকবো না।
ফিরোজ মাস্টারের এমন কথা খুশবু মোটেও খুশি হতে পারলো না। চোখ দুটো সরু করে ফিরোজের দিকে তাকিয়ে রাগী রাগী গলায় বললো
- আমি কাছে থাকি না বইলা তোর সাহস খুব বাড়ছে ফিরোজ? আমি কি কোনোকালে তোর খারাপ চাইছি? আমার পোলার বন্ধুর ছেলে বয়স একটু বেশি কিন্তু অনেক সম্পত্তি। আর তাছাড়া তোর কালা মাইয়ারে বিয়া করবো কেডা? একটা পোলা হইলে সব সম্পত্তি তোর সেই নাতীর হইবো এমন ভালা ঘর তোর কালা মাইয়ার লাইগা তিন কুলেও পাইবি না এই আমি কইয়া দিলাম। আমি তাগোর লগে কথা কইয়া সব ঠিক করতাছি এর মাঝে তুই আর কোনো কথা কইবি না।
ফুফুর এমন রাগ দেখে ফিরোজ মাস্টার চুপ হয়ে গেলো। ফুফুর উপর কথা বলার সাহস তার নেই। স্বর্ণালীএ ভাগ্যে মনে হয় এটাই লেখা ছিলো এই ভেবে সবটাই মেয়ে নিলো ফিরোজ মাস্টার।
(চলবে)
কোঠা ঘর থেকে বেড়িয়ে উঠানে তাকালো। বিল থেকে আনা শাপলাগুলো ওইভাবেই মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। সেখানে গিয়ে খুব যত্ন করে সেগুলো তুলে পানি দিলে হালকা করে ধুয়ে উঠানের ধুলা ছাড়িয়ে নিলো। শাপলার ডাটাগুলো ছোট ছোট করে কেটে চিংড়িটুকু মশলা দিয়ে কষিয়ে নিয়ে বেশি করে পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে ঝাল ঝাল করে রান্না করলো।
চালের ড্রাম খুলে সেখান থেকে চাল নিয়ে উনুনে বসিয়ে দিলো। শুকনা খড়ি দাউ দাউ করে জ্বলছে। জ্বলন্ত আগুনে চোখ আটকে যায় স্বর্ণালীর।
রুপালি গোসল সেরে দেখে বুবু রান্না বসিয়ে এক ধ্যানে আগুনের দিকে তাকিয়ে আছে। এদিকে ভাত উথলে উঠে উনুনের উপর পরছে সেদিকে স্বর্ণালীর কোনো খেয়াল নেই।
- এই বুবু ভাত যে উতলে উঠছে।
রুপার কথায় স্বর্ণালীর ধ্যান ভাঙে। খড়ি টেনে দিয়ে জ্বাল কমিয়ে দেয়। রুপালি একটা পিড়ি নিয়ে বুবুর পাশেই বসে পড়ে। বুবুর দিকে তাকিয়ে দেখে খুব মন খারাপ করে বসে আছে সে। রুপা তার বুবুর মন খারাপের কারণগুলো বুঝতে পারে।
-বুবু মন খারাপ করিস না।
এবার স্বর্ণালি কথা বলে ওঠে
- তোর মনে আছে রুপা? মা থাকতে আমরা সারাদিন বনে বাদারে ছুটে বেড়াতাম কেউ কিচ্ছুটি বলতো না। তুই কত ছোট ছিলি তখন।
- পুরোনো দিনের কথা ভেবে কী হবে বল? আব্বা ঠিকই বলে মা মারা যাবার সময় কেন আমাদের নিয়ে গেলো না? এতে করে আব্বার কষ্ট কমতো আর আমাদেরও।
দুবোনের মাঝেই খুব নিরবতা। হঠাৎই চিৎকার এর আওয়াজ এলো। ঘটনা কেউ কিছু বুঝতে পা পেরে দুজনেই আওয়াজ যে দিক থেকে এলো সেদিকে দৌড়ে গেল। আওয়াজ আসছিলো কল পাড় থেকে দুজন কলপাড়ে গিয়ে দেখলো আব্বা কলপাড়ের শেওলার মধ্যে পিছলা খেয়ে পড়ে গেছে আর কপাল থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। একসাথে এতো রক্ত দেখে স্বর্ণালী মাথা ঘুরিয়ে বমি করে দিলো। অল্প সময়ের মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে দুবোন মিলে বাবাকে ধরাধরি করে ঘরে নিয়ে গেলো। স্বর্ণালী রুপালিকে বললো
- আমি আব্বার কাছে বইতাছি তুই এহনি বাজারে গিয়া হাশেম ডাক্তারকে খবর দে।
রুপালি দেরি না করে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো। স্বর্ণালীর সারা জামা হাত পা রক্তে মাখামাখি হয়ে রইলো। ফিরোজ মাস্টার অজ্ঞান হয়ে আছে। স্বর্ণালী তার আব্বার কপাল মুখের সব রক্ত মুছে দিলো কিন্তু রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে কপালের কাটা জায়গাটায় জমাট বেঁধে আছে। স্বর্ণালী সেটাও খুব সাবধানে মুছে দিলো।
রুপালি ডাক্তার নিয়ে বাড়ি চলে এলো। হাশেম ডাক্তার নেই তাই অন্য কাউকে নিয়ে এসেছে। ডাক্তারকে দেখে স্বর্ণালী মাথার কাপড় টেনে ঘরের এককোনে দাঁড়িয়ে রইলো রুপালি ডাক্তারকে নিয়ে তার আব্বার কাছে গেলে ডাক্তার কাটা জায়গাটা ক্লিন করে মাথা ব্যান্ডেজ করে দিলো। দুটো ইঞ্জেকশন দিলো আর কিছু ওষুধ লিখে দিলো নিয়ম করে খাবার জন্য আর যাবার আগে বলে গেলো যতো দ্রুতো সম্ভব শহরে ডাক্তার দেখানোর জন্য কারন ফিরোজ মাস্টার পায়ে গুরুতরভাবে আঘাত পেয়েছে।
ডাক্তার চলে গেলে স্বর্ণালীর মনে পড়লো উনুনে ভাত বসানো ছিলো দৌড়ে গিয়ে দেখলো সবটা পুরে ছাই। আব্বার জন্য আবারও উনুনে ভাত বসিয়ে দিলো। এবার নরম করে ভাত রান্না করলো। ভাত রান্না শেষে ঘরে গিয়ে দেখলো রুপালি এক নজরে আব্বার দিকে তাকিয়ে আছে।
- রুপা তুই গোসল সেরে খেয়ে নে আমি আব্বার পাশে বসি।
আব্বাকে দেখে বুকের ভুতরটা কেমন করে উঠলো। দশ বছর আগে মা'কে হারিয়েছে আজ আব্বার কিছু হয়ে গেলে...
আর ভাবতে পারলো না চোখে জল নেমে এলো। ওড়নার একপাশ দিয়ে চোখ মুছে দু'হাতের মাঝে আব্বার এর একটি হাত নিলো। অনেকক্ষন যাবৎ এভাবেই বসে রইলো। আব্বার হাত এভাবে নিজের দু'হাতের মাঝে রেখেই নিজের কুনই দুটো বিছানায় ঠেকিয়ে দুহাতের পিঠে নিজের কপাল রেখে বসে রইলো। এভাবে থাকতে থাকতে কখন চোখ লেগে এসেছে মনে নেই। আব্বার হাতের নড়াচড়া অনুভব করে চোখ খুললো। চোখ খুলে দেখে আব্বার জ্ঞান ফিরছে। জ্ঞান ফিরতেই স্বর্ণালী আব্বাকে কোনো কিছুর সুযোগ না করে আব্বাকে অনবরত জিজ্ঞেস করে চললো।
- আব্বার আপনার কেমন লাগতাছে? কোনো কষ্ট হইতাছে? কোথায় কষ্ট হইতাছে আমারে কন। এই রুপা আব্বার লাইগা পানি লইয়া আয়।
রুপা দৌড়ে গিয়ে পানি আনলো। এসে সেও বলতে লাগলো
-আব্বা আপনি ঠিকাছেন?
দুই মেয়েকে অস্থির হতে দেখে ফিরোজ উঠে বসলো
- হ রে মা আমি ঠিকাছি।
কথাটি বলে ফিরোজ তার পা দুটো নাড়াতে চাইলো কিন্তু কোনোভাবে নাড়াতে পারলো না।
ফিরোজ ফ্যালফ্যাল করে দুই মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। ফিরোজের এভাবে তাকিয়ে থাকা দেখে দুই মেয়ের মুখ শুকিয়ে এলো। রুপালি বলে উঠলো
-আব্বা কি হইছে? কোনো কষ্ট লাগতাছে? কিছু লাগবো? কি দিমু কন।
নিরবতা ভেঙে ফিরোজ বললো
- আমি পাও লাড়াইতে পারতাছি না রে মা।
কথাটা শুনে দুইবোনের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। স্বর্ণালী ব্যস্ত হয়ে উনুনঘরে গেল ওখান থেকে সরিষার তেল নিয়ে এলো। তেল এনে আব্বার পায়ে তেল মালিশ করতে লাগলো।
- আব্বা চিন্তা কইরেন না সব ঠিক হয়ে যাবে। রোদ পড়লেই আপনারে নিয়া শহরের ডাক্তারের কাছে যামু। ডাক্তার সব ভালা কইরা দিবো।
স্বর্ণালী রুপার আর তার আব্বার জন্য ভাত ভেরে দিলো। সব কাজ শেষ করে গেলো রশিদ চাচার বাড়িতে।
- রশিদ চাচা একটু পর আপনার ভ্যানটা দিয়ে একটু সড়কে দিয়া আসবার পারবেন?
- সড়কে যাইবা ক্যান?
- আব্বার পায়ে ব্যাথা হইছে। ডাক্তারের কাছে নিয়া যাওন লাগবো।
- আইচ্ছা তুমরা তৈয়ার হও আমি ভ্যান বাহির করি।
বাড়ি এসে স্বর্ণালী প্রয়োজনীয় সব জিনিস গুছিয়ে নিলো। হাসপাতালে যেতে অনেক সময় লাগবে। আর নতুন জায়গায় গিয়ে হাতের কাছে কিছুই পাবেনা তাই দরকারি জিনিস আব্বার ওষুধ সব গুছিয়ে নিলো।
বিকেলে রোদ পড়তেই ভ্যান নিয়ে রশিদ চাচা বাড়ির উঠানে হাজির। তিনজন মিলে ধরাধরি করে ফিরোজকে ভ্যানে তুলে সড়কে নিয়ে গেল। সেখান থেকে মাইক্রো ভাড়া করে সোজা হাসপাতালে। যেতে যেতে আট ঘন্টা সময় লাগলো।
হাসপাতালে দুদিন রাখা হলো। ফিরোজ মাস্টারের পা নিয়ে আর চলাফেরা করতে পারবে না বলে ডাক্তার জানিয়ে দিয়েছে।
দুদিন পর তারা আবার বাড়ি চলে এলো। আর ফিরোজ মাস্টারের সঙ্গী হলো হুইল চেয়ার। ফিরোজ এর এমন খবর পেয়ে দূরের গ্রাম থেকে ফিরোজ এর ফুফু খুশবু এলেন বাড়িতে।
বয়স প্রায় ৭০ এর উপরে। মোটাসোটা দেখতে।ভীষণ রাগী চেহারা হাঁটে গেলে মাটিও যেন ভয়ে কাঁপে। উনার কথার উপর টু শব্দটি করার সাহস কারো নেই। বাম হাতে মোটা একটা তাবিজ বাঁধা দেখতে সুন্দর। কম বয়সে খুব ফর্সা আর সুন্দরী ছিলেন বোঝা যায়। বাড়ির সকলে তাকে খুব মান্য করে।
ফিরোজ এর এমন দুর্দিনে ছুটে এলেন ফিরোজকে দেখতে। ফিরোজ মাস্টার অনেকদিন পর কাছের মানুষকে দেখতে পেয়ে খুব খুশি হলো। স্বর্ণালী রুপালিকে বলে দিলো তাদের দাদী মানে ফিরোজ মাস্টারের ফুফুর যত্নের যেন কোনো কমতি না হয়। দুই মেয়ে একদিক দিয়ে বাবার ভালো থাকার জন্য যেমন দিনরাত এক করে ফেলছে। অন্যদিক দিয়ে পাল্লা ধরে দাদীর যত্ন করে যাচ্ছে এতটুকুও যেন কমতি না থাকে সেদিকে খেয়াল রেখে যাচ্ছে।
দাদীকে আব্বার ঘরে থাকাএ ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে। আর আব্বা থাকে দুইবোনের কোঠা ঘরে। দুবোন দাদীর ঘরেই নিচে তোশক পেতে নিজেদের থাকার জায়গা করে নিয়েছে।
এক রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে খুশবু ফিরোজের ঘরে গেল আর দুবোনকে কড়া নিষেধ করে দিলো ওদিকে যেন কেউ বিরক্ত না করে।
ফিরোজের ঘরে ঢুকে ফিরোজকে বলতে লাগলো
- দ্যাখ তোর এখন এই অবস্থা যুবতী দুই মাইয়া ঘরে রাখা কি ঠিক হইতাছে? লেখাপড়া তো অনেক করাইলি এসব লেখাপড়া দিয়া মাইয়া মানুষ কি করবো? সব শেষে তো বিয়া কইরা সংসার করাই লাগবো। তার চেয়ে বড় কথা মাইয়া দুইডার বয়স পার হইয়া যাইতাছে। পরে যোগ্য পাত্র খুইজা পাবি না। তাছাড়া এহন তোর এই অবস্থা কেউ কোনো ক্ষতি কইরা দিলে কি কইরা গেরামে মুখ দেহাইবি?
- ফুফু মা মরা মাইয়া দুইডা লেখাপড়া কইরা নিজের পায়ে দাড়াইলে তাগোর আর কোনো চিন্তা থাকবো না।
ফিরোজ মাস্টারের এমন কথা খুশবু মোটেও খুশি হতে পারলো না। চোখ দুটো সরু করে ফিরোজের দিকে তাকিয়ে রাগী রাগী গলায় বললো
- আমি কাছে থাকি না বইলা তোর সাহস খুব বাড়ছে ফিরোজ? আমি কি কোনোকালে তোর খারাপ চাইছি? আমার পোলার বন্ধুর ছেলে বয়স একটু বেশি কিন্তু অনেক সম্পত্তি। আর তাছাড়া তোর কালা মাইয়ারে বিয়া করবো কেডা? একটা পোলা হইলে সব সম্পত্তি তোর সেই নাতীর হইবো এমন ভালা ঘর তোর কালা মাইয়ার লাইগা তিন কুলেও পাইবি না এই আমি কইয়া দিলাম। আমি তাগোর লগে কথা কইয়া সব ঠিক করতাছি এর মাঝে তুই আর কোনো কথা কইবি না।
ফুফুর এমন রাগ দেখে ফিরোজ মাস্টার চুপ হয়ে গেলো। ফুফুর উপর কথা বলার সাহস তার নেই। স্বর্ণালীএ ভাগ্যে মনে হয় এটাই লেখা ছিলো এই ভেবে সবটাই মেয়ে নিলো ফিরোজ মাস্টার।
(চলবে)
Ayrin kaTun, Masum, Sk nadim, Nera akter, Israyeel hossen, Arif howla, Sk limon and লেখাটি পছন্দ করেছে
- Israt Jahanনবাগত
- Posts : 4
স্বর্ণমুদ্রা : 1308
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-05-30
Re: আলোয় ভুবন ভরা
Fri Jun 04, 2021 5:15 pm
তৃতীয় পর্ব
খুশবুর জোরাজোরির লাইগা একসপ্তার মইধ্যেই স্বর্ণালীরে দেখোনের লাইগা ছেলের বাড়ি থাইকা লোক আইলো। স্বর্ণালীর লাইগা একটা গোলাপী শাড়ি হইছে চুমকি লাগানো পুরা শাড়ির মইধ্যে। পাত্রপক্ষের সব রান্নাবান্না স্বর্ণালীই করছে। স্বর্ণালীকে আইজ দেখতে আইবো তার লাইগা খুশবু তার পোলারে ডাইকা আনছে। খুশবুর পোলা খোরশেদ মিয়ার বয়স স্বর্ণালীর বাপের বয়সের সমান পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই করে। খোরশেদ বাজার থাইকা রুই মাছ, দেশি মুরগ,গরুর গোশত, ফল-ফলান্তি স্বর্ণালীর লাইগা শাড়ি,চুরি, কাজল সব আনছে। লোক আসার আগে স্বর্ণালীর পিছে পিছে রুপালিও উনুনঘরে বইসা সাহায্য করছে। স্বর্ণালী রুপালি কারোরই ইচ্ছা নাই স্বর্ণালীর এই ঘরে বিয়া হোক। ফিরোজ মাস্টার চোখ বন্ধ কইরা ফুফুর হুকুম মাইনা চলতাছে। স্বর্ণালী রান্না অনেক ভালো পারে তাই আইজকের রান্নাও স্বর্ণালীর দ্বায়িত্ব। মাঝে মইধ্যে রুপালিরে এইডা হেইডা আগাইয়া দিতে কইতাছে। রুপালি মুখ গোমড়া কইরা সব কইরা যাইতাছে। রুপালি চায় না তার বুবু তারে ছাইড়া চইলা যাক তার চেয়েও বড় কথা কোনো বুইড়া বেডার লগে তার বুবুর বিয়া হোক এইটা রুপালি মানতে চায়না। তার বুবুর ভালা একটা সংসার হইলে তা দেইখা রুপালির চোখ জুড়াইতো।
কাজের ফাঁকে ফাঁকে রুপালি তার বুবুরে এইডা ওইডা জিজ্ঞাস করতাছে।
-বুবু
- হু
- তোর খারাপ লাগতাছে না?
-হু
-আমার তো অনেক কষ্ট হইতাছে তোর লাইগা।
-হু
- বুবু তুই আমারে ছাইড়া চইলা যাবি?
-হু
- তোর কি অনেক কষ্ট হইতাছে বুবু?
-হু
-তুই আমারে ছাড়া থাকতে পারবি বুবু?
-হু
- আমি কারে জড়াইয়া ধইরা ঘুমামু? রাইতের বেলা বাথরুমে যাইবার হইলে কারে লইয়া যামু? আমার চুলে কেডা তেল দিয়া দিবো বুবু? তুই যাইস না বুবু। এই বিয়া ভাইঙ্গা দে সোনা বুবু আমার।
- হু
- কি তখন থাইকা হু হু করতাছস।
রুপালি স্বর্ণালীর দিকে চাইয়া দেখলো স্বর্ণালীর কপাল বাইয়া ঘাম পড়তাছে, ঠোঁট কাঁপতাছে আর চোখ ভর্তি পানি। মনে হইতাছে এখনই বৃষ্টির ঢাল নাইমা আসবো। রুপালি বুঝতাছে স্বর্ণালী ভিতরে ভিতরে অনেক কষ্ট পাইতাছে। আইজ কালা মাইয়া না হইলে ভালা একটা ঘর আইতো। লোকে নানান কথা কওয়ার সুযোগ পাইতো না। আরও অনেক ভালা ভাগ্য থাকতো তার। ছোড থাইকাই তার বুবু অনেক কষ্ট করছে। লোকের নানান কথা শুনছে। যে যা খুশি তা বইলা আব্বার কান ভরছে আর বিনিময়ে আব্বা বুবুরে অনেক মারছে। রুপালির বুক ফাইটা কান্না আসতাছে এতসব মনে কইরা।
রুপালি হঠাৎ কইরা বুবুরে শক্ত কইরা জড়াইয়া ধরলো।বোনের হঠাৎ জড়াইয়া ধরার লাইগা স্বর্ণালী চমকাইয়া গেলো। স্বর্ণালী আর কান্না আটকাইতে পারলো না। দুই বোন এক সাথে জড়াইয়া ধইরা কানতে লাগলো। মনে হইতাছে যেনো জীবনেও আর কেউ কাউরে দেখবার পারবো না এইটাই শেষ দেখা আর তার লাইগা দুইজন এমন কইরা কানতাছে।
দুই বোনের কান্নার শব্দ শুইনা খুশবু ধুমধাম শব্দে মাটি পাড়াইয়া উনুনঘরের দিকে ছুইটা আইলো। উনুনঘরে আসতে আসতেই হাঁপাইয়া উঠলো। উনুনঘরের সামনে দাড়াইয়া বড় কইরা কতগুলা দম নিয়া বইলা উঠলা
- রঙ্গ তামাশা দেখলে বাঁচি না। ওই ছেড়ি, ওই ছাড় কইতাছি; ছাড় তোর বইনেরে।
হঠাৎ কইরা দাদীর এমন গলা শুইনা দুই বোনই ভয় পাইয়া গেল। তাড়াতাড়ি ছাইড়া দিলো একে অন্যরে। ভয় ভয় চোখে দাদীর দিকে তাকাইয়া থাকলো দুইজনই।
- ওই ছেড়ি এমন কইরা কি দেহোস?এই কয়ডা রান্না করতে কত সময় লাগে?
স্বর্ণালী ভয়ে ভয়ে জবাব দিয়া উঠলো
- প্রায় শেষ দাদী। এহন শুধু গরুর গোশতোডা বাকি হইয়া উঠলেই সব শেষ হইয়া যাইবো।
- আইচ্ছা আইচ্ছা, আর শুন, রান্না শেষ কইরা গোসল কইরা কাপড় পালডাইলা খোরশেদ যে শাড়িডা আনছে হেইডা পইড়া লো। কথা কানে গেছে?
- হ দাদী।
- হ যা কইছি তাড়াতাড়ি তা কর।
স্বর্ণালীকে এইগুলা বইলা খুশবু রুপালির দিকে তাকাইলো। রুপালি ভয়ে স্বর্ণালীর পিছনে চুপচাপ গুটিসুটি মাইরা পিড়ির উপর বইসা আছে। রুপালির দিকে তাকাইয়া খুশবো বইলা উঠলো
- এই যে ছোড নবাবজাদী। বড় বইনরে দেখতে আইলে তুই আবার সামনে যাইস না। এমনেই তোর বড় বইনের যে ছিড়ি আল্লাহ জানে ফিরাইয়া দিবো কিনা।
রুপালি আস্তে কইরা জবাব দিলো
- ফিরাইলেই ভালা, অমন বুইড়া জামাইয়ের কাছে বুবুরে দিমু না।
খুশবু ভালা কইরা শুনতে পাইলো না। তাই রাগ দেখাইয়া আবার জিগাইলো
- কি কইলি ছেড়ি?
স্বর্ণালী বোনরে বাঁচানোর লাইগা কথা কাটাইয়া দিলো
- কিছু কয়নাই দাদী। আমি কাজ কাম শেষ কইরা আইতাছি।
- হ আয়, আর ছোড নবাবজাদী তুই কইলাম উনুনঘরেই থাকনি। মেহমানের সামনে যাইবি না।
রুপালি একদিকে ঘাড় কাৎ কইরা সায় জানাইলো। আবার মনে মনে বইলা উঠলো
- অমন জামাই দেহোনের ইচ্ছা আমার নাই।
স্বর্ণালী সব কাজ কাম শেষ কইরা গোসল দেওনের পর খোরশেদ চাচার আনা গোলাপি চুমকি ওয়ালা শাড়ি সুন্দর কইরা কুচি দিয়া পইড়া নিলো। দুইহাতে দুই মুঠ কাচের চুড়ি, চোখে কাজল মাইখা চুলগুলা শুকানোর পর মাথা আচরাইয়া খোঁপা কইরা নিলো।
স্বর্ণালীর এই বিয়া করোনের ইচ্ছা না থাকলেও দাদীরে ভীষণ ভয় পায় তাই সাজগোজ কইরা নিলো। দুপুর আড়াইটার দিকে জামাইয়ের বাড়ি থাইকা লোকজন আইলো। তিনডা মহিলা, আর দুইডা পুরুষ সাথে দুইডা বাচ্চা আসলো। আসার সময় অনেক ফল-ফলান্তি, মিষ্টি হাতে কইরা নিয়া আসলো।
সবাইরে ফিরোজের ঘরে বসার লাইগা সুন্দর কইরা ঘর সাজাইয়া রাখা হইছিলো। সবাই বাড়িতে আসার পরে হেই ঘরেই বইতে দেওয়া হইলো। খুশবু তাদের হাত থাইকা ফল মিষ্টি গুলা নিয়া কোঠা ঘরে গেল। ওইখানে গিয়া মিষ্টি গুলা একটা প্লেটে সাজাইলো আর খোরশেদ এর আনা ফলগুলা অন্য প্লেটে সাজাইলো। ফলগুলো একবার গিয়া খোরশেদ ফিরোজের ঘরে রাইখা আসলো আর স্বর্ণালীর হাতে মিষ্টির প্লেট ধরাইয়া দিলো।
স্বর্ণালীর সাথে খুশবুও ফিরোজের ঘরে ঢুকতে লাগলো। ফিরোজের ঘর কিছুটা উঁচা কইরা তৈরি করা হইছে। মাটির একরুমের ঘর। ঘরে ঢুকতে ছোট ছোট মাটির তিনডা সিড়ি। আর ঘরের ভেতর অল্প কয়ডা আসবাবপত্র। একটা চৌকি, একটা স্টিলের ট্রাঙ্ক, আর কাপড় রাখার একটা আলনা আর পুরান দুই তিনডা চেয়ার এই কয়ডাই জিনিস। স্বর্ণালীর বিয়ার লাইগা খোরশেদ কতগুলা নতুন প্লাস্টিকের চেয়ার কিন্না আনছিলো বাজার থাইকা।
স্বর্ণালী ঘরে ঢুকার সময় সিড়িতে পাড়া দিতে গিয়া উষ্টা খাইলো।পড়তে পড়তেও নিজেকে সামলাইয়া নিলো। এইসব দেইখা জামাইয়ের বাড়ির থাইকা আসা এক মহিলা বইলা উঠলো
- মেয়েরে কি খাওয়ান না নাকি? হাঁটতে গেলে পড়ে কেমনে? খায় দায় না? ঘর বাড়ির অবস্থাও তো ভালা না। মনে হয় না খাইয়াই থাকা লাগে।
কথা বলা শেষ কইরা খিকখিক কইরা হাসতে লাগলো আর সাথে তাল মিলাইয়া সাথের মহিলা হাসতে লাগলো।
এই কথা শুইনা স্বর্ণালীর চোখ পানিতে ভরে গেলো। ভেতরে গিয়া মিষ্টির প্লেট তাদের সামনে নিয়া রাখলো। প্লেট রাখার পর খোরশেদ জামাইয়ের বাড়ির লোকজনের মুখোমুখি একটা চেয়ার রাইখা স্বর্ণালীকে ইশারা দিয়া বসতে কইলো। সেও বাধ্য মাইয়ার মতো চুপচাপ বসে গেলো।
______________________________________________________
রুপালি উনুনঘরে পিড়ির উপর বইসা বইসা ডান হাতের আঙুলের নখ কামড়ায় আর দুই বোনের ছোটবেলার কথা মনে করতে থাকে। একসাথে বিলে ঝাপানোর কথা, সাঁতার দিয়া কেডায় আগে ওইপাড়ে যাইতে পারে, মকবুলদের বাড়ির বড়ই চুরির কথা। দুপুর হইলেই মকবুলরা ঘুমাইতো আর দুইবোন চুপচাপ গিয়া বড়ই পারতো গাছে থাইকা, স্বর্ণালী এইগুলান করতে অনেক ভয় পাইতো রুপালি জোর কইরা বুবুরে নিয়া যাইতো। না যাইতে চাইলে কইতো "তুই না গেলে তোর সাথে আড়ি নিমু আর কোনোদিনও কথা কমু না।" রুপালি জানতো বুবু কোনোদিন তার সাথে কথা না বইলা থাকতে পারবো না। আর রুপালি সেই দুর্বলতাকে কাজে লাগাইয়া বুবুরে লইয়া এইসব করতো।জমিদারদের বাগানের ডাসা পেয়ারা প্রতিদিন ওড়নায় ভরে নিয়ে আসার পর দুইবোন লবন দিয়া মাখাইয়া খুব মজা কইরা খাইতো।খুড়ি বুড়ির বাড়ির আম গাছের চুরি করতে যাইতো। বুড়ি খুড়িয়ে হাঁটতো দেইখা রুপালি নাম দিছে খুড়ি বুড়ি। চুরি করতে অনেক মজা হইতো তখন বুড়ি খুড়িয়ে খুড়িয়ে তাদের ধরতে পারতো না এই নিয়া দুই বোন হাসতে হাসতে একজন অন্যজনের গায়ে ঢলে পড়তো। একবার খুড়ি বুড়ি আব্বার কাছে নালিশ দিলো তারপর আব্বার কাছে কি মাইরটাই না খাইলো দুইবোন। ঠিক পরেরদিনই গ্রামের পোলাপান লইয়া পুরা আমগাছ খালি করে দিছিলো খুব মজা হইছিলো ওইদিন। এতোকিছু মনে করে নিজে নিজেই হাইসা দেয় রুপালি।
এমন সময় আব্বার ঘরে থাইকা হাসির শব্দ পায়। মুহুর্তেই রুপালির মন অনেক খারাপ হইয়া যায়। রুপালি বুঝে তার বুবুরে লইয়া সবাই হাসাহাসি করতাছে। রূপালির চোখে পানি চইলা আসে। তার বুবুরে একটু সুখী দেখার লাইগা রুপার ভিতরটা ফাইটা যায়। কবে তার এই স্বপ্ন পুরন হইবো। আল্লাহ কি কোনোদিন তার বুবুর দিকে ফিরা চাইবো না। মন খারাপ কইরা উনুনঘরে বইসা থাকে রুপা।
(চলবে)
খুশবুর জোরাজোরির লাইগা একসপ্তার মইধ্যেই স্বর্ণালীরে দেখোনের লাইগা ছেলের বাড়ি থাইকা লোক আইলো। স্বর্ণালীর লাইগা একটা গোলাপী শাড়ি হইছে চুমকি লাগানো পুরা শাড়ির মইধ্যে। পাত্রপক্ষের সব রান্নাবান্না স্বর্ণালীই করছে। স্বর্ণালীকে আইজ দেখতে আইবো তার লাইগা খুশবু তার পোলারে ডাইকা আনছে। খুশবুর পোলা খোরশেদ মিয়ার বয়স স্বর্ণালীর বাপের বয়সের সমান পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই করে। খোরশেদ বাজার থাইকা রুই মাছ, দেশি মুরগ,গরুর গোশত, ফল-ফলান্তি স্বর্ণালীর লাইগা শাড়ি,চুরি, কাজল সব আনছে। লোক আসার আগে স্বর্ণালীর পিছে পিছে রুপালিও উনুনঘরে বইসা সাহায্য করছে। স্বর্ণালী রুপালি কারোরই ইচ্ছা নাই স্বর্ণালীর এই ঘরে বিয়া হোক। ফিরোজ মাস্টার চোখ বন্ধ কইরা ফুফুর হুকুম মাইনা চলতাছে। স্বর্ণালী রান্না অনেক ভালো পারে তাই আইজকের রান্নাও স্বর্ণালীর দ্বায়িত্ব। মাঝে মইধ্যে রুপালিরে এইডা হেইডা আগাইয়া দিতে কইতাছে। রুপালি মুখ গোমড়া কইরা সব কইরা যাইতাছে। রুপালি চায় না তার বুবু তারে ছাইড়া চইলা যাক তার চেয়েও বড় কথা কোনো বুইড়া বেডার লগে তার বুবুর বিয়া হোক এইটা রুপালি মানতে চায়না। তার বুবুর ভালা একটা সংসার হইলে তা দেইখা রুপালির চোখ জুড়াইতো।
কাজের ফাঁকে ফাঁকে রুপালি তার বুবুরে এইডা ওইডা জিজ্ঞাস করতাছে।
-বুবু
- হু
- তোর খারাপ লাগতাছে না?
-হু
-আমার তো অনেক কষ্ট হইতাছে তোর লাইগা।
-হু
- বুবু তুই আমারে ছাইড়া চইলা যাবি?
-হু
- তোর কি অনেক কষ্ট হইতাছে বুবু?
-হু
-তুই আমারে ছাড়া থাকতে পারবি বুবু?
-হু
- আমি কারে জড়াইয়া ধইরা ঘুমামু? রাইতের বেলা বাথরুমে যাইবার হইলে কারে লইয়া যামু? আমার চুলে কেডা তেল দিয়া দিবো বুবু? তুই যাইস না বুবু। এই বিয়া ভাইঙ্গা দে সোনা বুবু আমার।
- হু
- কি তখন থাইকা হু হু করতাছস।
রুপালি স্বর্ণালীর দিকে চাইয়া দেখলো স্বর্ণালীর কপাল বাইয়া ঘাম পড়তাছে, ঠোঁট কাঁপতাছে আর চোখ ভর্তি পানি। মনে হইতাছে এখনই বৃষ্টির ঢাল নাইমা আসবো। রুপালি বুঝতাছে স্বর্ণালী ভিতরে ভিতরে অনেক কষ্ট পাইতাছে। আইজ কালা মাইয়া না হইলে ভালা একটা ঘর আইতো। লোকে নানান কথা কওয়ার সুযোগ পাইতো না। আরও অনেক ভালা ভাগ্য থাকতো তার। ছোড থাইকাই তার বুবু অনেক কষ্ট করছে। লোকের নানান কথা শুনছে। যে যা খুশি তা বইলা আব্বার কান ভরছে আর বিনিময়ে আব্বা বুবুরে অনেক মারছে। রুপালির বুক ফাইটা কান্না আসতাছে এতসব মনে কইরা।
রুপালি হঠাৎ কইরা বুবুরে শক্ত কইরা জড়াইয়া ধরলো।বোনের হঠাৎ জড়াইয়া ধরার লাইগা স্বর্ণালী চমকাইয়া গেলো। স্বর্ণালী আর কান্না আটকাইতে পারলো না। দুই বোন এক সাথে জড়াইয়া ধইরা কানতে লাগলো। মনে হইতাছে যেনো জীবনেও আর কেউ কাউরে দেখবার পারবো না এইটাই শেষ দেখা আর তার লাইগা দুইজন এমন কইরা কানতাছে।
দুই বোনের কান্নার শব্দ শুইনা খুশবু ধুমধাম শব্দে মাটি পাড়াইয়া উনুনঘরের দিকে ছুইটা আইলো। উনুনঘরে আসতে আসতেই হাঁপাইয়া উঠলো। উনুনঘরের সামনে দাড়াইয়া বড় কইরা কতগুলা দম নিয়া বইলা উঠলা
- রঙ্গ তামাশা দেখলে বাঁচি না। ওই ছেড়ি, ওই ছাড় কইতাছি; ছাড় তোর বইনেরে।
হঠাৎ কইরা দাদীর এমন গলা শুইনা দুই বোনই ভয় পাইয়া গেল। তাড়াতাড়ি ছাইড়া দিলো একে অন্যরে। ভয় ভয় চোখে দাদীর দিকে তাকাইয়া থাকলো দুইজনই।
- ওই ছেড়ি এমন কইরা কি দেহোস?এই কয়ডা রান্না করতে কত সময় লাগে?
স্বর্ণালী ভয়ে ভয়ে জবাব দিয়া উঠলো
- প্রায় শেষ দাদী। এহন শুধু গরুর গোশতোডা বাকি হইয়া উঠলেই সব শেষ হইয়া যাইবো।
- আইচ্ছা আইচ্ছা, আর শুন, রান্না শেষ কইরা গোসল কইরা কাপড় পালডাইলা খোরশেদ যে শাড়িডা আনছে হেইডা পইড়া লো। কথা কানে গেছে?
- হ দাদী।
- হ যা কইছি তাড়াতাড়ি তা কর।
স্বর্ণালীকে এইগুলা বইলা খুশবু রুপালির দিকে তাকাইলো। রুপালি ভয়ে স্বর্ণালীর পিছনে চুপচাপ গুটিসুটি মাইরা পিড়ির উপর বইসা আছে। রুপালির দিকে তাকাইয়া খুশবো বইলা উঠলো
- এই যে ছোড নবাবজাদী। বড় বইনরে দেখতে আইলে তুই আবার সামনে যাইস না। এমনেই তোর বড় বইনের যে ছিড়ি আল্লাহ জানে ফিরাইয়া দিবো কিনা।
রুপালি আস্তে কইরা জবাব দিলো
- ফিরাইলেই ভালা, অমন বুইড়া জামাইয়ের কাছে বুবুরে দিমু না।
খুশবু ভালা কইরা শুনতে পাইলো না। তাই রাগ দেখাইয়া আবার জিগাইলো
- কি কইলি ছেড়ি?
স্বর্ণালী বোনরে বাঁচানোর লাইগা কথা কাটাইয়া দিলো
- কিছু কয়নাই দাদী। আমি কাজ কাম শেষ কইরা আইতাছি।
- হ আয়, আর ছোড নবাবজাদী তুই কইলাম উনুনঘরেই থাকনি। মেহমানের সামনে যাইবি না।
রুপালি একদিকে ঘাড় কাৎ কইরা সায় জানাইলো। আবার মনে মনে বইলা উঠলো
- অমন জামাই দেহোনের ইচ্ছা আমার নাই।
স্বর্ণালী সব কাজ কাম শেষ কইরা গোসল দেওনের পর খোরশেদ চাচার আনা গোলাপি চুমকি ওয়ালা শাড়ি সুন্দর কইরা কুচি দিয়া পইড়া নিলো। দুইহাতে দুই মুঠ কাচের চুড়ি, চোখে কাজল মাইখা চুলগুলা শুকানোর পর মাথা আচরাইয়া খোঁপা কইরা নিলো।
স্বর্ণালীর এই বিয়া করোনের ইচ্ছা না থাকলেও দাদীরে ভীষণ ভয় পায় তাই সাজগোজ কইরা নিলো। দুপুর আড়াইটার দিকে জামাইয়ের বাড়ি থাইকা লোকজন আইলো। তিনডা মহিলা, আর দুইডা পুরুষ সাথে দুইডা বাচ্চা আসলো। আসার সময় অনেক ফল-ফলান্তি, মিষ্টি হাতে কইরা নিয়া আসলো।
সবাইরে ফিরোজের ঘরে বসার লাইগা সুন্দর কইরা ঘর সাজাইয়া রাখা হইছিলো। সবাই বাড়িতে আসার পরে হেই ঘরেই বইতে দেওয়া হইলো। খুশবু তাদের হাত থাইকা ফল মিষ্টি গুলা নিয়া কোঠা ঘরে গেল। ওইখানে গিয়া মিষ্টি গুলা একটা প্লেটে সাজাইলো আর খোরশেদ এর আনা ফলগুলা অন্য প্লেটে সাজাইলো। ফলগুলো একবার গিয়া খোরশেদ ফিরোজের ঘরে রাইখা আসলো আর স্বর্ণালীর হাতে মিষ্টির প্লেট ধরাইয়া দিলো।
স্বর্ণালীর সাথে খুশবুও ফিরোজের ঘরে ঢুকতে লাগলো। ফিরোজের ঘর কিছুটা উঁচা কইরা তৈরি করা হইছে। মাটির একরুমের ঘর। ঘরে ঢুকতে ছোট ছোট মাটির তিনডা সিড়ি। আর ঘরের ভেতর অল্প কয়ডা আসবাবপত্র। একটা চৌকি, একটা স্টিলের ট্রাঙ্ক, আর কাপড় রাখার একটা আলনা আর পুরান দুই তিনডা চেয়ার এই কয়ডাই জিনিস। স্বর্ণালীর বিয়ার লাইগা খোরশেদ কতগুলা নতুন প্লাস্টিকের চেয়ার কিন্না আনছিলো বাজার থাইকা।
স্বর্ণালী ঘরে ঢুকার সময় সিড়িতে পাড়া দিতে গিয়া উষ্টা খাইলো।পড়তে পড়তেও নিজেকে সামলাইয়া নিলো। এইসব দেইখা জামাইয়ের বাড়ির থাইকা আসা এক মহিলা বইলা উঠলো
- মেয়েরে কি খাওয়ান না নাকি? হাঁটতে গেলে পড়ে কেমনে? খায় দায় না? ঘর বাড়ির অবস্থাও তো ভালা না। মনে হয় না খাইয়াই থাকা লাগে।
কথা বলা শেষ কইরা খিকখিক কইরা হাসতে লাগলো আর সাথে তাল মিলাইয়া সাথের মহিলা হাসতে লাগলো।
এই কথা শুইনা স্বর্ণালীর চোখ পানিতে ভরে গেলো। ভেতরে গিয়া মিষ্টির প্লেট তাদের সামনে নিয়া রাখলো। প্লেট রাখার পর খোরশেদ জামাইয়ের বাড়ির লোকজনের মুখোমুখি একটা চেয়ার রাইখা স্বর্ণালীকে ইশারা দিয়া বসতে কইলো। সেও বাধ্য মাইয়ার মতো চুপচাপ বসে গেলো।
______________________________________________________
রুপালি উনুনঘরে পিড়ির উপর বইসা বইসা ডান হাতের আঙুলের নখ কামড়ায় আর দুই বোনের ছোটবেলার কথা মনে করতে থাকে। একসাথে বিলে ঝাপানোর কথা, সাঁতার দিয়া কেডায় আগে ওইপাড়ে যাইতে পারে, মকবুলদের বাড়ির বড়ই চুরির কথা। দুপুর হইলেই মকবুলরা ঘুমাইতো আর দুইবোন চুপচাপ গিয়া বড়ই পারতো গাছে থাইকা, স্বর্ণালী এইগুলান করতে অনেক ভয় পাইতো রুপালি জোর কইরা বুবুরে নিয়া যাইতো। না যাইতে চাইলে কইতো "তুই না গেলে তোর সাথে আড়ি নিমু আর কোনোদিনও কথা কমু না।" রুপালি জানতো বুবু কোনোদিন তার সাথে কথা না বইলা থাকতে পারবো না। আর রুপালি সেই দুর্বলতাকে কাজে লাগাইয়া বুবুরে লইয়া এইসব করতো।জমিদারদের বাগানের ডাসা পেয়ারা প্রতিদিন ওড়নায় ভরে নিয়ে আসার পর দুইবোন লবন দিয়া মাখাইয়া খুব মজা কইরা খাইতো।খুড়ি বুড়ির বাড়ির আম গাছের চুরি করতে যাইতো। বুড়ি খুড়িয়ে হাঁটতো দেইখা রুপালি নাম দিছে খুড়ি বুড়ি। চুরি করতে অনেক মজা হইতো তখন বুড়ি খুড়িয়ে খুড়িয়ে তাদের ধরতে পারতো না এই নিয়া দুই বোন হাসতে হাসতে একজন অন্যজনের গায়ে ঢলে পড়তো। একবার খুড়ি বুড়ি আব্বার কাছে নালিশ দিলো তারপর আব্বার কাছে কি মাইরটাই না খাইলো দুইবোন। ঠিক পরেরদিনই গ্রামের পোলাপান লইয়া পুরা আমগাছ খালি করে দিছিলো খুব মজা হইছিলো ওইদিন। এতোকিছু মনে করে নিজে নিজেই হাইসা দেয় রুপালি।
এমন সময় আব্বার ঘরে থাইকা হাসির শব্দ পায়। মুহুর্তেই রুপালির মন অনেক খারাপ হইয়া যায়। রুপালি বুঝে তার বুবুরে লইয়া সবাই হাসাহাসি করতাছে। রূপালির চোখে পানি চইলা আসে। তার বুবুরে একটু সুখী দেখার লাইগা রুপার ভিতরটা ফাইটা যায়। কবে তার এই স্বপ্ন পুরন হইবো। আল্লাহ কি কোনোদিন তার বুবুর দিকে ফিরা চাইবো না। মন খারাপ কইরা উনুনঘরে বইসা থাকে রুপা।
(চলবে)
Ayrin kaTun, Masum, Sk nadim, Nera akter, Arif howla, Sk limon, Sm rana and লেখাটি পছন্দ করেছে
- Israt Jahanনবাগত
- Posts : 4
স্বর্ণমুদ্রা : 1308
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-05-30
Re: আলোয় ভুবন ভরা
Fri Jun 04, 2021 5:15 pm
চতুর্থ পর্ব
খুশবু আজ ভীষণ খুশি। অবশেষে স্বর্ণালীর বিয়ে ঠিক হয়ে গেলো।সামনের মাসের প্রথম সপ্তাহের শুক্রবার স্বর্ণালীর বিয়ে। স্বর্ণালীর যেখানে বিয়ে ঠিক হলো তারা বড় ঘরের লোক। স্বর্ণালীর হবু স্বামী
মাস গেলে পঞ্চাশ হাজার এর উপরে রোজগার করে। এ নিয়ে খুশবুর খুশির বাঁধ যেন ভেঙে যায়। এবার তাদেরকে আর কষ্ট করতে হবে না। এতো খরচ করলো একবার স্বর্ণালীর বিয়ে হলে সব সুদে আসলে শোধ করে নিবে। এখন শুধু বিয়ের দিন গুনছে খুশবু। স্বর্ণালীকে দেখার পর তার হাতে পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছিলো তার শ্বশুর বাড়ি থেকে। স্বর্ণালীর শ্বশুর বাড়ির লোকজন বাড়ি থেকে বের হতেই খুশবু সবটা হামলে পড়ে নিয়ে নেয়। এই টাকা দিয়ে তার অনেকদিন কাটবে। স্বর্ণালী এখন খুশবুর কাছে সোনার ডিম পাড়া হাঁস।
লোকজন সব চলে যাবার পর স্বর্ণালী তার বাবার ঘর থেকে দৌড়ে এসে কোঠাঘরের চারপায়ার উপর বসে পড়লো। স্বর্ণালীকে এভাবে দৌড়ে যেতে দেখে রুপালিও রান্নাঘর থেকে কোঠাঘরে গেল। রুপালি ঘরে ঢুকে দেখলো স্বর্ণালী ফুপিয়ে কেঁদে চলছে। রুপালির উপস্থিতি টের পেয়ে তাকে বললো
- ঘরের দোর লাগাইয়া দে রুপা।
রুপালি স্বর্ণালীর মনের অবস্থা বুঝে দরজা লাগিয়ে দিলো। স্বর্ণালীর ফুপিয়ে কাঁদার কারণে তার শরীর বারবার কেঁপে উঠছে। কিছুক্ষন পরপর দু'হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে বেখাপ্পা ভাবে চোখ মুছে চলছে। এভাবে চোখ মোছার জন্য চোখের আশেপাশের সবটা জায়গা কাজলের কালিতে মাখামাখি হয়ে আছে। চোখ মোছার সময় চুড়িগুলো বারবার বিরক্ত করছে। কাচের চুড়িগুলো রাগের বশে খুলে ফেলতে চাইছে। কিন্তু নাছোড়বান্দা চুড়িগুলো হাতে শক্ত হয়ে এটে আছে যেন তার হাত ছাড়তে চায় না। চুড়ি খুলতে না পেরে স্বর্ণালী নিজের দু'হাত চৌকির পাশে থাকা কাঠের টেবিলের উপর অনবরত আঘাত করে যাচ্ছে। এভাবে আঘাত করার জন্য সব চুড়ি ভেঙে দু'হাত গড়িয়ে রক্ত পড়ছে। স্বর্ণালীকে দৌড়ে এসে রুপালি থামিয়ে দিলো। রুপালি স্বর্ণালীর কাছে আসতেই স্বর্ণালী তাকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো
-রুপা রে আমি কি পাপ করছিলাম। আল্লাহ আমারে এই শাস্তি ক্যান দেয়? আমি কালা দেইখা কি আমি মানুষ না? মা'য়ে যহন জন্ম দিছিলো আমারে গলা টিপ দিয়া মাইরা ফালাইলো না ক্যান? আর যদি না মারলো যহন মা মইরা গেছিলো আমারে লইয়া মরলো না ক্যান কইতে পারোস?আমি কি নিজে আমার রঙ বানাইছি? তাও সবাই আমারে ক্যান কথা শুনায়? আইজ কালা না হইলে কি ওই ঘরে আমার বিয়া ঠিক করতো? একটা ৪০ বছরের ব্যাডারে আমার বিয়া করা লাগবো ক্যান রুপা?
কাঁদতে কাঁদতে স্বর্ণালী কথাগুলো বলে চললো। রুপালির কাছে এর কোনো জবাব নেই। রুপালিও তার বুবু কান্না দেখে কেঁদে চললো। সত্যিই তো তার বুবুর তো কোনো দোষ নেই তাও কেন তাকেই শাস্তি পেতে হচ্ছে। মানুষ এতো নির্মম কেন? এরকম শত প্রশ্ন উঁকি দেয় রুপালির মনে। রুপালি নিজের কোমড়ের পিছন দিকটা ভেজা অনুভব করলো। স্বর্ণালীর হাত কোমড় থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দেখলো স্বর্ণালীর হাতের রক্তে কোমড় ভিজে আছে আর এখনও স্বর্ণালীর হাত থেকে প্রচুর রক্ত পড়ে যাচ্ছে। রুপালির খেয়াল হলো স্বর্ণালী আর নড়াচড়া করছে না। স্বর্ণালীর হাত ছেড়ে দিতেই স্বর্ণালী পিছন দিক হয়ে চৌকির উপর বসা থেকে ধড়াম করে শুয়ে পড়লো। স্বর্ণালীর এভাবে শুয়ে পড়া দেখে রুপালি ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। দ্রুত কোনোরকম চৌকির উপর হামাগুড়ি দিয়ে তার বুবুর মাথার কাছে গিয়ে বসলো। গালের দুপাশে দু'হাতে ধরে ডাকতে লাগলো
- এই বুবু, বুবুরে। কি হইছে তোর। বুবু...
বুবু কথা কস না ক্যান। ও বুবু..
রুপালির বুকের ভেতর কেউ যেন ঢোল বাজাচ্ছে এতো জোরে আওয়াজ হচ্ছে। ভয়ে কলিজা শুকিয়ে যাচ্ছে তার। কোনোদিনও বুবুর এমন হতে দেখেনি। স্বর্ণালীর হাতের মধ্যে ভাঙা কাচ ঢুকে আছে অনেক জায়গায়। রুপালি তাড়াতাড়ি ঘরের দরজা খুলে দৌড়ে উনুনঘরে চিনি খুঁজতে লাগলো। কাটা জায়গায় চিনি দিয়ে দেয়ার জন্য। ছোট বেলায় দু'বোনের হাত পা কেটে গেলে মা চিনি দিয়ে দিতো আর রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে যেতো। রুপালি একমুঠো চিনি হাতে নিয়ে এক মুহূর্তে দেরি না করে আবার কোঠাঘরে ফিরে এলো। স্বর্ণালী আগের মতই নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। কাচগুলো যতটা সম্ভব সরিয়ে চিনি মাখিয়ে দিলো। রক্তপড়া তবুও বন্ধ হচ্ছে না। কাঠের টেবিলের উপর থাকা জগ থেকে পানি নিয়ে স্বর্ণালীর মুখে ছিটিয়ে দিলো তাও কোনো রকম কোনো সাড়া পেলো না। ভয়ে রুপালির প্রাণ যায় যায় অবস্থা। আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে চিৎকার করে সবাইকে ডাকতে লাগলো
-আব্বা! তাড়াতাড়ি এইঘরে আসেন দেইখা যান বুবুর জানি কি হইছে। ও আব্বা, জলদি করেন।
রুপালির এমন চিৎকার শুনে খুশবু,খোরশেদ তাড়াতাড়ি দৌড়ে কোঠাঘরে চলে এলো আর ফিরোজ মাস্টার ক্র্যাচে ভর করে যতদ্রুত সম্ভব কোঠাঘরে আসার চেষ্টা করলো। কোঠা ঘরে খুশবু পা রেখেই বলতে শুরু করলো
- হায় আল্লাহ! কি হইছে তোর বইনের। ওই ছেমড়ি কি করছস তুই? তোর বইনের অমন বড়লোক ঘরে বিয়া হইবো এইডা তুই মানতে পারোস নাই তার লাইগা মাইরা দিছোস।
রুপালি এমন কথায় দাদীর দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো
- যা মনে আসে তাই কইবেন না দাদী। বুবুরে আমি আমার চেয়েও বেশি ভালোবাসি। আর অমন বড়লোক ঘরে আমি মইরা গেলেও যামুনা। যা হইছে সব আপনের লাইগাই হইছে।
- ওই ছেড়ি কি কইলি তুই? এতো বড় সাহস তোর তুই আমার মুখে মুখে কথা কস?
কথাটি বলেই খুশবু রুপালির দিকে ধেয়ে আসতে লাগলো এমন সময় ফিরোজ মাস্টার বলে উঠলো
- আহ ফুফু এহন ঝগড়া না কইরা আমার মাইয়াডারে বাঁচানোর চেষ্টা করো। খোরশেদ ভাই তুমি বাজার থাইকা তাড়াতাড়ি ডাক্তার লইয়া আসো।
ফিরোজ মাস্টারের কথা শুনে খোরশেদ বাজারের দিকে চলে গেলো। এদিকে সকলে মিলে স্বর্ণালীকে ডেকে চলছে কিন্তু স্বর্ণালীর কোনো সাড়াশব্দ নেই।আর এদিক দিয়ে খুশবু নানান ভাবে রুপালিকে দোষারোপ করে চলছে।
- শুইনা রাখ ছেড়ি মনে করিস না তুই পার পাইয়া যাইবি। তোর বইনের কিছু হইলে আমি কিন্তু তোরে ছাড়ুম না। যারা তোর বইনের মতো কালা মাইয়ারে ওইঘরের বউ করতে পারে তারা তোরে হাসতে হাসতে নিয়া যাইবো। তোর পার নাই কইয়া দিলাম।
বুবুর এই অবস্থাতেও দাদীর এরকম কথা শুনে রুপালির সারা শরীর রাগে জ্বলে যাচ্ছে। তাদের আত্মীয় না হলে এতোক্ষণে রুপালিও দু'চার কথা শুনিয়ে দিতো৷ শুধুমাত্র তাদের বাবার আত্মীয় তাই বাবার সম্মানের কথা ভেবে এমন বাজে কথাগুলো রুপালি মুখ বুজে সহ্য করে যাচ্ছে।
খোরশেদ ডাক্তার নিয়ে কোঠাঘরে ঢুকলো। হাশেম ডাক্তার স্বর্ণালীর পালস চেক করলো। জানালো পালস খুবই দুর্বল। দু'হাতে ব্যান্ডেজ করে দিলো আর বাম হাতে ক্যানোলা লাগিয়ে স্যালাইন দেয়ার ব্যবস্থা করলো। ক্যানোলা লাগানোর সময় রুপালি চোখ বন্ধ করে রইলো তার বুবুর হাতে এতোবড় সুচ ঢোকানো হচ্ছে সে কারনে। ডাক্তার জানিয়ে দিলো শরীর দুর্বল আর অনেক রক্তক্ষরণ হবার জন্যই স্বর্ণালী অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। পুরো স্যালাইন শেষ হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। আর কয়েকদিন বেশি করে স্বর্ণালীর খাওয়া দাওয়ার দিকে খেয়াল রাখতে বললো। কতগুলো ওষুধ দিয়ে গেলো স্বর্ণালীকে নিয়মমতো খাওয়ানোর জন্য। দুশ্চিন্তার কোনো কারন নেই জানিয়ে ডাক্তার চলে গেলো।ডাক্তার চলে যাবার পর সবাই কোঠাঘর থেকে চলে গেলেও রুপালি স্বর্ণালীর পাশেই চুপচাপ বসে রইলো।
__________________________________________________
সন্ধ্যার দিকে স্বর্ণালীর জ্ঞান ফিরলো। স্বর্ণালীর পাশেই বসে ছিলো রুপালি। জ্ঞান ফিরতেই রুপালি জিজ্ঞেস করলো
- বুবু এহন কেমন লাগতাছে। তুমি ঠিকাছো বুবু?
স্বর্ণালী চোখের ইশারায় বুঝালো সে ঠিকাছে। একদুপুরের মাঝে স্বর্ণালীর মুখ কেমন রক্তহীন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। এখনও স্বর্ণালীর শরীর দুর্বল।
বাম হাত সামান্য নাড়াতেই ব্যাথায় চোখমুখ সব ভাজ করে ফেললো।রুপালি বুঝতে পেরে বললো
- বুবু হাত নাড়াইও না, ব্যথা লাগবো। ক্যান অমন করতে গেলা বুবু। তুমি জানো আমি কত্ত ভয় পাইয়া গেছিলাম। তোমার কিছু হইলে আমি কি করমু কওতো।
স্বর্ণালী রুপার এইসব কথা চুপচাপ শুনে যেতে লাগলো। একসময় রুপাকে চোখের ইশারায় কাছে ডাকলো। রুপার নিজের কান স্বর্ণালীর মুখের কাছে নিতেই স্বর্ণালী মাথা হালকা উঁচু করে রুপার গালে চুমু দিলো এরপর বললো
- ধুর পাগলী এমন করতাছা ক্যান। আমার তো কিছু হয়নাই। আর আল্লাহ আমারে অত সহজে মরন দিবো না।
রুপালি কান্না কান্না মুখ করে অভিমানী স্বরে বলে উঠলো
- এমন কথা কইবানা বুবু। আর কিছু হয়নাই কইলেই হইলো? কত্তগুলা রক্ত পড়ছে তুমি তো দেহো নাই আমি দেখছি আমি জানি। আমি কত ভয় পাইছিলাম তোমারে কইয়া বুঝাইতে পারুম না। আমার কলিজা শুকাইয়া গেছিলো বুবু। মনে হইতাছিলো আমার জান খতম হইয়া যাইতাছে।
স্বর্ণালী ছোট বোনের এমন পাগলামি দেখে মুচকি হেসে দিলো। রুপালি অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলো
- তুমি দেইখা নিও বুবু আমি তোমার বিয়া হইবার দিমু না।
(চলবে)
খুশবু আজ ভীষণ খুশি। অবশেষে স্বর্ণালীর বিয়ে ঠিক হয়ে গেলো।সামনের মাসের প্রথম সপ্তাহের শুক্রবার স্বর্ণালীর বিয়ে। স্বর্ণালীর যেখানে বিয়ে ঠিক হলো তারা বড় ঘরের লোক। স্বর্ণালীর হবু স্বামী
মাস গেলে পঞ্চাশ হাজার এর উপরে রোজগার করে। এ নিয়ে খুশবুর খুশির বাঁধ যেন ভেঙে যায়। এবার তাদেরকে আর কষ্ট করতে হবে না। এতো খরচ করলো একবার স্বর্ণালীর বিয়ে হলে সব সুদে আসলে শোধ করে নিবে। এখন শুধু বিয়ের দিন গুনছে খুশবু। স্বর্ণালীকে দেখার পর তার হাতে পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছিলো তার শ্বশুর বাড়ি থেকে। স্বর্ণালীর শ্বশুর বাড়ির লোকজন বাড়ি থেকে বের হতেই খুশবু সবটা হামলে পড়ে নিয়ে নেয়। এই টাকা দিয়ে তার অনেকদিন কাটবে। স্বর্ণালী এখন খুশবুর কাছে সোনার ডিম পাড়া হাঁস।
লোকজন সব চলে যাবার পর স্বর্ণালী তার বাবার ঘর থেকে দৌড়ে এসে কোঠাঘরের চারপায়ার উপর বসে পড়লো। স্বর্ণালীকে এভাবে দৌড়ে যেতে দেখে রুপালিও রান্নাঘর থেকে কোঠাঘরে গেল। রুপালি ঘরে ঢুকে দেখলো স্বর্ণালী ফুপিয়ে কেঁদে চলছে। রুপালির উপস্থিতি টের পেয়ে তাকে বললো
- ঘরের দোর লাগাইয়া দে রুপা।
রুপালি স্বর্ণালীর মনের অবস্থা বুঝে দরজা লাগিয়ে দিলো। স্বর্ণালীর ফুপিয়ে কাঁদার কারণে তার শরীর বারবার কেঁপে উঠছে। কিছুক্ষন পরপর দু'হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে বেখাপ্পা ভাবে চোখ মুছে চলছে। এভাবে চোখ মোছার জন্য চোখের আশেপাশের সবটা জায়গা কাজলের কালিতে মাখামাখি হয়ে আছে। চোখ মোছার সময় চুড়িগুলো বারবার বিরক্ত করছে। কাচের চুড়িগুলো রাগের বশে খুলে ফেলতে চাইছে। কিন্তু নাছোড়বান্দা চুড়িগুলো হাতে শক্ত হয়ে এটে আছে যেন তার হাত ছাড়তে চায় না। চুড়ি খুলতে না পেরে স্বর্ণালী নিজের দু'হাত চৌকির পাশে থাকা কাঠের টেবিলের উপর অনবরত আঘাত করে যাচ্ছে। এভাবে আঘাত করার জন্য সব চুড়ি ভেঙে দু'হাত গড়িয়ে রক্ত পড়ছে। স্বর্ণালীকে দৌড়ে এসে রুপালি থামিয়ে দিলো। রুপালি স্বর্ণালীর কাছে আসতেই স্বর্ণালী তাকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো
-রুপা রে আমি কি পাপ করছিলাম। আল্লাহ আমারে এই শাস্তি ক্যান দেয়? আমি কালা দেইখা কি আমি মানুষ না? মা'য়ে যহন জন্ম দিছিলো আমারে গলা টিপ দিয়া মাইরা ফালাইলো না ক্যান? আর যদি না মারলো যহন মা মইরা গেছিলো আমারে লইয়া মরলো না ক্যান কইতে পারোস?আমি কি নিজে আমার রঙ বানাইছি? তাও সবাই আমারে ক্যান কথা শুনায়? আইজ কালা না হইলে কি ওই ঘরে আমার বিয়া ঠিক করতো? একটা ৪০ বছরের ব্যাডারে আমার বিয়া করা লাগবো ক্যান রুপা?
কাঁদতে কাঁদতে স্বর্ণালী কথাগুলো বলে চললো। রুপালির কাছে এর কোনো জবাব নেই। রুপালিও তার বুবু কান্না দেখে কেঁদে চললো। সত্যিই তো তার বুবুর তো কোনো দোষ নেই তাও কেন তাকেই শাস্তি পেতে হচ্ছে। মানুষ এতো নির্মম কেন? এরকম শত প্রশ্ন উঁকি দেয় রুপালির মনে। রুপালি নিজের কোমড়ের পিছন দিকটা ভেজা অনুভব করলো। স্বর্ণালীর হাত কোমড় থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দেখলো স্বর্ণালীর হাতের রক্তে কোমড় ভিজে আছে আর এখনও স্বর্ণালীর হাত থেকে প্রচুর রক্ত পড়ে যাচ্ছে। রুপালির খেয়াল হলো স্বর্ণালী আর নড়াচড়া করছে না। স্বর্ণালীর হাত ছেড়ে দিতেই স্বর্ণালী পিছন দিক হয়ে চৌকির উপর বসা থেকে ধড়াম করে শুয়ে পড়লো। স্বর্ণালীর এভাবে শুয়ে পড়া দেখে রুপালি ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। দ্রুত কোনোরকম চৌকির উপর হামাগুড়ি দিয়ে তার বুবুর মাথার কাছে গিয়ে বসলো। গালের দুপাশে দু'হাতে ধরে ডাকতে লাগলো
- এই বুবু, বুবুরে। কি হইছে তোর। বুবু...
বুবু কথা কস না ক্যান। ও বুবু..
রুপালির বুকের ভেতর কেউ যেন ঢোল বাজাচ্ছে এতো জোরে আওয়াজ হচ্ছে। ভয়ে কলিজা শুকিয়ে যাচ্ছে তার। কোনোদিনও বুবুর এমন হতে দেখেনি। স্বর্ণালীর হাতের মধ্যে ভাঙা কাচ ঢুকে আছে অনেক জায়গায়। রুপালি তাড়াতাড়ি ঘরের দরজা খুলে দৌড়ে উনুনঘরে চিনি খুঁজতে লাগলো। কাটা জায়গায় চিনি দিয়ে দেয়ার জন্য। ছোট বেলায় দু'বোনের হাত পা কেটে গেলে মা চিনি দিয়ে দিতো আর রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে যেতো। রুপালি একমুঠো চিনি হাতে নিয়ে এক মুহূর্তে দেরি না করে আবার কোঠাঘরে ফিরে এলো। স্বর্ণালী আগের মতই নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। কাচগুলো যতটা সম্ভব সরিয়ে চিনি মাখিয়ে দিলো। রক্তপড়া তবুও বন্ধ হচ্ছে না। কাঠের টেবিলের উপর থাকা জগ থেকে পানি নিয়ে স্বর্ণালীর মুখে ছিটিয়ে দিলো তাও কোনো রকম কোনো সাড়া পেলো না। ভয়ে রুপালির প্রাণ যায় যায় অবস্থা। আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে চিৎকার করে সবাইকে ডাকতে লাগলো
-আব্বা! তাড়াতাড়ি এইঘরে আসেন দেইখা যান বুবুর জানি কি হইছে। ও আব্বা, জলদি করেন।
রুপালির এমন চিৎকার শুনে খুশবু,খোরশেদ তাড়াতাড়ি দৌড়ে কোঠাঘরে চলে এলো আর ফিরোজ মাস্টার ক্র্যাচে ভর করে যতদ্রুত সম্ভব কোঠাঘরে আসার চেষ্টা করলো। কোঠা ঘরে খুশবু পা রেখেই বলতে শুরু করলো
- হায় আল্লাহ! কি হইছে তোর বইনের। ওই ছেমড়ি কি করছস তুই? তোর বইনের অমন বড়লোক ঘরে বিয়া হইবো এইডা তুই মানতে পারোস নাই তার লাইগা মাইরা দিছোস।
রুপালি এমন কথায় দাদীর দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো
- যা মনে আসে তাই কইবেন না দাদী। বুবুরে আমি আমার চেয়েও বেশি ভালোবাসি। আর অমন বড়লোক ঘরে আমি মইরা গেলেও যামুনা। যা হইছে সব আপনের লাইগাই হইছে।
- ওই ছেড়ি কি কইলি তুই? এতো বড় সাহস তোর তুই আমার মুখে মুখে কথা কস?
কথাটি বলেই খুশবু রুপালির দিকে ধেয়ে আসতে লাগলো এমন সময় ফিরোজ মাস্টার বলে উঠলো
- আহ ফুফু এহন ঝগড়া না কইরা আমার মাইয়াডারে বাঁচানোর চেষ্টা করো। খোরশেদ ভাই তুমি বাজার থাইকা তাড়াতাড়ি ডাক্তার লইয়া আসো।
ফিরোজ মাস্টারের কথা শুনে খোরশেদ বাজারের দিকে চলে গেলো। এদিকে সকলে মিলে স্বর্ণালীকে ডেকে চলছে কিন্তু স্বর্ণালীর কোনো সাড়াশব্দ নেই।আর এদিক দিয়ে খুশবু নানান ভাবে রুপালিকে দোষারোপ করে চলছে।
- শুইনা রাখ ছেড়ি মনে করিস না তুই পার পাইয়া যাইবি। তোর বইনের কিছু হইলে আমি কিন্তু তোরে ছাড়ুম না। যারা তোর বইনের মতো কালা মাইয়ারে ওইঘরের বউ করতে পারে তারা তোরে হাসতে হাসতে নিয়া যাইবো। তোর পার নাই কইয়া দিলাম।
বুবুর এই অবস্থাতেও দাদীর এরকম কথা শুনে রুপালির সারা শরীর রাগে জ্বলে যাচ্ছে। তাদের আত্মীয় না হলে এতোক্ষণে রুপালিও দু'চার কথা শুনিয়ে দিতো৷ শুধুমাত্র তাদের বাবার আত্মীয় তাই বাবার সম্মানের কথা ভেবে এমন বাজে কথাগুলো রুপালি মুখ বুজে সহ্য করে যাচ্ছে।
খোরশেদ ডাক্তার নিয়ে কোঠাঘরে ঢুকলো। হাশেম ডাক্তার স্বর্ণালীর পালস চেক করলো। জানালো পালস খুবই দুর্বল। দু'হাতে ব্যান্ডেজ করে দিলো আর বাম হাতে ক্যানোলা লাগিয়ে স্যালাইন দেয়ার ব্যবস্থা করলো। ক্যানোলা লাগানোর সময় রুপালি চোখ বন্ধ করে রইলো তার বুবুর হাতে এতোবড় সুচ ঢোকানো হচ্ছে সে কারনে। ডাক্তার জানিয়ে দিলো শরীর দুর্বল আর অনেক রক্তক্ষরণ হবার জন্যই স্বর্ণালী অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। পুরো স্যালাইন শেষ হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। আর কয়েকদিন বেশি করে স্বর্ণালীর খাওয়া দাওয়ার দিকে খেয়াল রাখতে বললো। কতগুলো ওষুধ দিয়ে গেলো স্বর্ণালীকে নিয়মমতো খাওয়ানোর জন্য। দুশ্চিন্তার কোনো কারন নেই জানিয়ে ডাক্তার চলে গেলো।ডাক্তার চলে যাবার পর সবাই কোঠাঘর থেকে চলে গেলেও রুপালি স্বর্ণালীর পাশেই চুপচাপ বসে রইলো।
__________________________________________________
সন্ধ্যার দিকে স্বর্ণালীর জ্ঞান ফিরলো। স্বর্ণালীর পাশেই বসে ছিলো রুপালি। জ্ঞান ফিরতেই রুপালি জিজ্ঞেস করলো
- বুবু এহন কেমন লাগতাছে। তুমি ঠিকাছো বুবু?
স্বর্ণালী চোখের ইশারায় বুঝালো সে ঠিকাছে। একদুপুরের মাঝে স্বর্ণালীর মুখ কেমন রক্তহীন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। এখনও স্বর্ণালীর শরীর দুর্বল।
বাম হাত সামান্য নাড়াতেই ব্যাথায় চোখমুখ সব ভাজ করে ফেললো।রুপালি বুঝতে পেরে বললো
- বুবু হাত নাড়াইও না, ব্যথা লাগবো। ক্যান অমন করতে গেলা বুবু। তুমি জানো আমি কত্ত ভয় পাইয়া গেছিলাম। তোমার কিছু হইলে আমি কি করমু কওতো।
স্বর্ণালী রুপার এইসব কথা চুপচাপ শুনে যেতে লাগলো। একসময় রুপাকে চোখের ইশারায় কাছে ডাকলো। রুপার নিজের কান স্বর্ণালীর মুখের কাছে নিতেই স্বর্ণালী মাথা হালকা উঁচু করে রুপার গালে চুমু দিলো এরপর বললো
- ধুর পাগলী এমন করতাছা ক্যান। আমার তো কিছু হয়নাই। আর আল্লাহ আমারে অত সহজে মরন দিবো না।
রুপালি কান্না কান্না মুখ করে অভিমানী স্বরে বলে উঠলো
- এমন কথা কইবানা বুবু। আর কিছু হয়নাই কইলেই হইলো? কত্তগুলা রক্ত পড়ছে তুমি তো দেহো নাই আমি দেখছি আমি জানি। আমি কত ভয় পাইছিলাম তোমারে কইয়া বুঝাইতে পারুম না। আমার কলিজা শুকাইয়া গেছিলো বুবু। মনে হইতাছিলো আমার জান খতম হইয়া যাইতাছে।
স্বর্ণালী ছোট বোনের এমন পাগলামি দেখে মুচকি হেসে দিলো। রুপালি অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলো
- তুমি দেইখা নিও বুবু আমি তোমার বিয়া হইবার দিমু না।
(চলবে)
Ayrin kaTun, Masum, Sk nadim, Sume akter, Nera akter, Israyeel hossen, Arif howla and লেখাটি পছন্দ করেছে
Permissions in this forum:
You cannot reply to topics in this forum