- M A Nayeemশুকতারা
- Posts : 68
স্বর্ণমুদ্রা : 1470
মর্যাদা : 20
Join date : 2021-05-22
Re: ভাইরাস
পড়ন্ত বিকেল। আকবর মেম্বারের বাড়িতে বৈঠক বসেছে। বৈঠকে হারিস দেওয়ানও রয়েছে।
সগীর মুন্সি তার কাছে একটি আকুতি নিয়ে এসেছে। বেশ কিছুদিন যাবত সে তার বাবাকে খুঁজে পাচ্ছে না। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর বাড়ি খুঁজে তার কোন হদিস মেলেনি। যেদিন সে হারিয়ে যায়, তার আগের দিন রাতে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিল তার বাবা। সগীর মুন্সি তড়িঘড়ি করে ডাক্তার ডাকতে গেলে ফিরে এসে আর তার বাবাকে খুঁজে পায় নাই। এখন অবধি তার বাবার কোন হদিস পাওয়া যায়নি।
আকবর মেম্বার সগির মুন্সির কথাগুলি মনোযোগ দিয়ে শোনে। তারপর হুক্কাতে একটি টান দেয়। মুখ থেকে ধোঁয়া বের করতে বের করতে বলে, সগীর, তোমার বাপ তো মিন্টুর মায়ের দাফনে অংশগ্রহণ করছিল। তাই না?
ছগির হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে। আকবর মেম্বার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তার চেহারায় এক ধরনের চিন্তার ছাপ ফুটে ওঠে। বলে, তারপরে তোমার বাপ অসুস্থ হইয়া গেল আর এখন তারে খুঁজে পাইতেছ না।
আকবর মেম্বারের পাশেই দাড়িয়ে থাকা শফিক মস্তান সগির মুন্সির উদ্দেশ্যে হাক ছেড়ে বলে, খুইজা পাইতেছনা নাকি একমাস ঘরে বন্দী থাকতে হইবো তাই কোথাও পাঠায়ে দিসো, মিয়া।
সগির মুন্সি প্রায় সাথে সাথেই উত্তর দেয়, খোদার কসম মিয়া ভাই। কোথাও পাঠাই নাই। নিজের বাপেরে নিয়া এত বড় মিথ্যা কথা বলার সাহস আমার নাই।
আকবর মেম্বার গম্ভীরভাবে একবার মাথা নাড়লো। কথা ঠিক তার, চেহারায় অসহায়ত্ব, পিতৃবিরহের বেদনা। মিথ্যে বলছে না সে। ভাবল সে।
একবার হারিস দেওয়ানের মুখের দিকে তাকায় মেম্বার সাব। হারিস দেওয়ান নিজেও এই বিষয়টি নিয়ে ভীষণ চিন্তিত।
এবার মেম্বর সাব ভিড়ের দিকে তাকিয়ে বলে, আর কারো কোন সমস্যা আছে? থাকলে বল।
মাটিতে এক কোনায় মাখনলাল হাঁটু ভাঁজ করে কাচুমাচু ভঙ্গিতে বসে ছিল। চেহারায় তার গভীর আনুগত্য। ভয়ে আকুতি মিনতি করে আকবর মেম্বারের উদ্দেশ্যে বলল, হুজুর আমার ছেলে দিলিপরে তো আর খুঁইজা পাইলাম না!
আকবর মেম্বর এবার তার দিকে ঘুরে তাকায়। একটু বিরক্তি নিয়ে বলে, আরে মিয়া, লাশও তো পাও নাই। এখনো তো আশা আছে, তাই না। আর আমি তো পুলিশের সাথে যোগাযোগ করেই রাখছি। তারা জানতে পারলে আমারে জানাইবে। একটু ধৈর্য রাখো। মেম্বরের এরূপ বিরূপ আচরণে, মাখনলালের চোখদুটি ভিজে যায়। ডুকরে কেদে উঠে। প্রায় এক মাস হতে গেল যে!
হারিস দেওয়ান তার মনের অবস্থা বুঝতে পারে। বলে, তোমার কষ্ট আমি বুঝবার পারি। কিন্তু একটু ধৈর্য ধরো। এই গ্রামে অনেকেরই আপন লোক হারায় গেছে। আমরা কেউই কিছুর কোন সুরাহা করবার পারতেছি না। পুলিশও আসছে কয়েকবার। কোন কিছুর মীমাংসা হয় নাই।
ওইদিকে মিন্টুর বাড়িতে লাশ পড়ে আছে। কেউ সেটা ধরবারও সাহস পায় নাই। এখন সেটা থেকে দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে। পুলিশকে বলা হইছে। পুলিশেরও দেখা নাই। সবাই আমরা একটা বিপদের মধ্যে আছি। বোঝার চেষ্টা করো।
মাখনলাল মাথা নাড়তে নাড়তে ভীর থেকে এক পাশে নিজেকে সরিয়ে নিল।
শোন, আমরা সবাই খুব চিন্তার মধ্যে আছি। সন্ধ্যার পর কেউ বাড়ি থাইকা বাইর হইবা না। গেরামে কোন পাগলা কুত্তা বা নেকড়ে থাইকা থাকতে পারে। বুড়ো মানুষ, বাচ্চা-কাচ্চা সাবধানে রাখবা। একটু থামল আকবর মেম্বার। একবার মাথা নিচু করে কিছু একটা ভাবলো। তারপর বলল, রহমানরে আমি মন থাইকা ভালবাসতাম। তার এই রকম মৃত্যুতে আমার দিলেও খুব দুঃখ লাগছে!
.
রহমান চাচার দোকানে এখন তার ভাস্তে বসেছে। রহমান চাচার বউ বাচ্চা নেই। অনেক আগেই তাকে ছেড়ে চলে গেছে। কোথায় গেছে কেউ তাদের হদিস জানে না।
ভাস্তে এক হাতে চা বানাচ্ছিল, অন্য হাতে একটা একটা করে সবাইকে বিতরন করছিল। দোকানে আজ বেশ লোকজনের জমায়েত হয়েছে। সবাই ভাস্তের কাছে রহমান চাচার বিষয়ে জানতে চাচ্ছে। যদিও ভাস্তে তার কোনো সদুত্তর দিতে পারছে না। সে রহমান চাচার খুব একটা খোঁজখবর রাখে না। আর এখন তো সে একটা লাশ। লাশের এতো খোঁজ নিয়ে কি হবে!
বউ বাচ্চা না থাকায় রহমান চাচার দোকানটি তার কপালে জুটেছে। এটা যে তার জন্য এক ধরনের পরম সৌভাগ্য। তাই সে ফুরফুরে মেজাজে চা বানিয়ে চলছে। এই উছিলায় তার বেকারত্ব যে ঘুচল। বিনা পরিশ্রম, অর্থ ব্যয়ে এরকম একটি দোকানের মালিক হয়ে গেল। তার যে কপালটাই খুলে গেল!
সূর্য প্রায় ডুবি ডুবি করেছে, এরকম সময় শফিক তার সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে ভাস্তের দোকানের সামনে এসে দাড়ালো। তাকে দেখে কয়েকটা অল্প বয়সী ছেলে দ্রুত আসন ছেড়ে উঠে পড়ল।
শফিক মস্তান ওদের দিকে একবার তাকাল, বলল, দিনকাল ভালো যাইতেসে না। তোমরা এখনো বাইরে ঘোরাঘুরি করতাছো কেন?
জে, আমার বাসা একটু সামনেই। আমি চইলা যাইতেই ছিলাম। তার মধ্যে আপনি আসলেন। তাদের একজন বলল। অনেকটা কাচুমাচু করতে করতে দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করল ছোকরাগুলি।
শফিকের সাথে থাকা সাঙ্গ ভাস্তেকে উদ্দেশ্যে করে বলল, মিয়া ভাইরে মাস্ত এক কাপ চা বানায় দাও।
ভাস্তে মাথা ঝাকাতে ঝাকাতে বিদ্যুৎ গতিতে চায়ের কাপে চিনি ঢালতে শুরু করল। চা পানি ঢেলে নাড়তে শুরু করল। এটা যে ভাইকে খুশি করার মোক্ষম সুযোগ!
রহমান তোমার কেমন ধরনের চাচা ছিল? ভাস্তের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করল শফিক।
সে আমার বাবার চাচাতো ভাই। একটু ভেবে উত্তর দেয় ভাস্তে।
হুম সেইটাই ভাবতেছিলাম। শফিক মুখের খোঁচা খোঁচা দাড়ি হাতাতে হাতাতে বলে। রহমান মারা গেল দুইদিন হয় নাই, তুমি আইসা পড়ছো তার দোকান সামলাইতে।
ভাস্তে শফিকের কথার কিছু বুঝলো কিনা বোঝা গেল না। সে তাকে মুগ্ধ করণীয় চা বানাতে ব্যস্ত।
কিছুক্ষণ পরে চামচ দিয়ে কাপে ভালো একটা ঘুটা দিয়ে কাপটা ডান হাতে ধরে বাম হাত ডান হাতের নিচে রেখে আদবী কায়দায় শফিকের দিকে বাড়িয়ে দিল।
কাপটি হাতে নিয়ে শফিক মনে মনে একটু খুশি হলো। ভাবল আদব লেহাজ ভালোই জানা আছে রহমানের ভাস্তের।
তা তোমার চাচা কিভাবে মারা গেল তা তো জানা আছে? কাপটা হাতে নিতে নিতে শফিক লাঠিয়াল বলল। ছেলেটাকে একটু পরীক্ষা করছিল সে।
জে। জানা আছে। কোন এক জন্তু জানোয়ার দোকানে ঢুইকা তারে খাইয়া গেছে। অবলিলায় কথাটি বলে দিল সে। তার বলা তাও শেষ হয় নাই। বলতে লাগলো, বুড়া মানুষ বাড়িতে লোকজন নাই। তাই বইলা রাইত বিরাইতে দোকানে থাকতে হইবো। আর দোকানেরই বা কি হাল। এইখানে ভাঙ্গা, ওইখানে ভাঙ্গা। সামনের কপাটগুলোও ঠিকমতো লাগানোর ব্যবস্থা নাই। শফিক মস্তান শুনছিল আর চায়ের কাপে ফু দিচ্ছিলো। বলে চলল সে, বুড়া হইয়া গেছিল চাচায়। খেয়ালখুশি কইমা গেছিল তাই। আমি আইসা সবকিছু ঠিকঠাক করছি। একনাগাড়ে রহমান চাচার খুঁটিনাটি দোষ-ত্রুটির ব্যাপারে বলছিল সে।
ওয়াক থু ... শফিক চা-টা মুখে দিতেই শব্দ করে ফেলে দিল। কাপটা বেঞ্চের উপর রেখে উঠে দাঁড়ালো। মুখে অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গি করতে করতে বলল, ধুর মিয়া, দিলা তো মেজাজটা খারাপ কইরা। কি বানাইছ এইডা, চা না আর কিছু। কথাটি বলে রাস্তার দিকে পা বাড়ালো শফিক।
তার এক সাঙ্গ ভাস্তের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার দ্বারা দোকানদারি হইব না। বাড়িতে গিয়া বেকার বইসে থাকো। বলেই মুখ ভেংচি দিয়ে শফিকের পিছু হাঁটা দিল।
তারা দোকান ছেড়ে কিছু এগিয়ে যাওয়ার পরপরই মুখ বাঁকিয়ে ওদের কথা নকল করে আপন মনে ভাস্তে বলল, তোমারে দ্বারা দোকানদারি হইবো না! এহ .. নিজেরা এক একটা ভবঘুরে। কাজ পারে না। মস্তানি কইরে বেড়ায়। আবার মানুষরে উপদেশ দেয়!
.
সবুর দেওয়ান একটু রাত করেই বাইক চালিয়ে বাড়ি ফিরছিল। তার পানাহারের বদঅভ্যাস রয়েছে। এই দুর্যোগের সময়ও সেগুলি থেকে দূরে থাকতে পারছে না। আজ রাতে সে অবশ্য একটু বেশিই খেয়ে ফেলেছে। বাইক চালানোর সময় সেটা মাঝেমধ্যেই টের পাওয়া যাচ্ছে। একটু পর পর মাথা চক্কর দিয়ে উঠছে। পিচ্ছিল পথে ক্ষনে ক্ষনে বাইকের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে। একবার তো বাইকসহ খাদেই পড়ে যাচ্ছিল প্রায়!
কি একটা ভেবে রাস্তার এক পাশে বাইকটা থামাল সবুর দেওয়ান। মাথাটা একবার ঝাকি দিল। হাত দিয়ে চোখ দুটি কচলালো। শরীর বেশি কড়া হয়ে গেছে। মাথা ঝিমঝিম করছে। হেডলাইট জ্বালিয়ে গাড়ির উপরেই কিছুক্ষণ বসে রইলো সে। কিছু একটা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার বাইক থেকে অদূরে কেউ একজনকে দেখতে পেল। বাইকের হেড লাইটের আলোয় লোকটাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। পাশের নালা থেকে ধীরে ধীরে রাস্তায় উঠে এসেছে। সারা শরীর কাদাপানিতে সিক্ত।
সবুর লোকটাকে উদ্দেশ্য করে হাক দিল, কে ওই খানে?
লোকটা তার কথার কোন জবাব দিল না। রাস্তার ঠিক মাঝখানে এসে স্থির দাঁড়িয়ে পড়ল। এক মুহূর্তের জন্য সবুরের কাছে মনে হল যেন সামনে একটা মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক কয়েক মুহূর্ত পরেই সেটির শরীর এক ধরনের ঝাকি দিতে শুরু করলো। মনে হল অবয়বটি কেঁপে কেঁপে উঠছে। সবুরের চোখ দুটি ছোট হয়ে আসে। তার মাথা ঠিক কাজ করে না। এবার ছায়াটি একটু দুলতে শুরু করেছে। সেটির কাঁপুনি আরো বেড়ে গেছে।
আজকে বেশি খেয়ে ফেলেছে সে। মনে মনে ভাবল সবুর দেওয়ান। তাই উল্টাপাল্টা কি সব দেখছে।
একটা ঢোক গিলে আবার হাক ছেড়ে বলল, কে রে ওইখানে? এই রাত দুপুরে আমার সাথে মশকরা করস?
কাদায় সিক্ত অদ্ভুত সেই অবয়বটি তখনও সেখানে দাঁড়িয়ে। এবার মুখ থেকে এক ধরনের গোঙ্গানির শব্দ বেরিয়ে আসে সেটির। এক ঝটকায় মুখ তুলে তাকায় তার দিকে। যেন সবুরের কথায় চটে গেছে।
সেটির অশুভ চাহনির দিকে তাকিয়ে বুকটা ছ্যাৎ করে ওঠে সবুর দেওয়ানের। একটু ভয় ভয় লাগতে শুরু করে। ভুত-প্রেত জাতীয় কিছু নয় তো!
পরক্ষনেই নিজেকে আবার সামলে নিল সবুর। ভাবল সব অতিরিক্ত পানাহারের ফল।
হয়তোবা লোকটি কোন চোর ডাকাত। তার হাতে বা আশেপাশে কোন দা চাপাতি নেই তো! ভাবল সে।
আর বেশি কিছু ভাবার সুযোগ পেল না সবুর দেওয়ান। ঠিক পরমুহূর্তেই হাত-পা বাঁকিয়ে কাঁপা কাঁপা শরীর নিয়ে ক্ষিপ্রগতিতে তারই দিকে ছুটে আসতে শুরু করল অবয়বটি।
সবুর দেওয়ান কিছুটা বিভ্রান্তির দৃষ্টিতে কয়েক মুহূর্ত সেদিকে তাকিয়ে রইল। কাদায় সিক্ত বুড়ো মত কেউ অপার্থিব শারীরিক ভঙ্গিতে এক ধরনের আর্তচিৎকার করতে করতে তার দিকে ধেয়ে আসছে।
সেটিকে ঠিক চিৎকার বলবে নাকি কোন ধরনের হিংস্র গর্জন সবুর দেওয়ান ঠিক ভেবে পায় না। তার সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। কয়েক মুহূর্তের জন্য সে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। সৎবিৎ ফিরে পেতেই আর কিছু না ভেবে গাড়িটা স্টার্ট দেয়ার চেষ্টা করে। চাবিটি বারবার ঘুরাতে থাকে। জোরে জোরে ঘোরাতে থাকে। এখন এক মুহূর্ত যে তার কাছে অনন্তকালের সমান। একসময় গাড়িটা স্টার্ট নেয়। মাটিতে পা ভর করে বাইকটিকে উল্টো দিকে ঘোরানোর চেষ্টা করে সবুর। সপাত সপাত কাদা পানি ছিটিয়ে এক ঝটকায় ঘুরে যায় বাইকটি।
ইতিমধ্যে বুড়ো ছায়াটি অনেকটাই তার কাছাকাছি চলে এসেছে। এখন প্রায় ছুঁই ছুঁই। নিজের অজান্তেই সবুর দেওয়ান এর মুখ থেকে এক ধরনের আর্তনাদ বেরিয়ে আসে। চোখ বন্ধ করে বাইকের গতি বাড়িয়ে দেয় সে। বুড়োটি এখনো তার পেছন পেছন। মনে মনে পণ করে সবুর দেওয়ান, জীবনে আর কোনদিন এত বেশি মাল খাবে না। (চলবে)
RabbY khan, Debasis sorkar, Maruf khan, Sm samim, Alom khan, Salman reja, Foisal Hossain and লেখাটি পছন্দ করেছে
- M A Nayeemশুকতারা
- Posts : 68
স্বর্ণমুদ্রা : 1470
মর্যাদা : 20
Join date : 2021-05-22
Re: ভাইরাস
রহিম বক্স মিলিটারির প্রতিবেশীই শুধু নয় বরং তাদের বিপদ আপদের বন্ধু। রহিম বক্সের বিপদে যেমন মিলিটারি এগিয়ে আসে, মিলিটারির ক্ষেত্রেও তাই।
ভোর রাতের দিকে কালাম রহিম বক্সের বাড়িতে গেল। রহিম বক্সের শরীর খারাপ কালাম সেটা জানে। রহিম বক্সকে দেখতে বা বিরক্ত করতে সে যায়নি, গিয়েছে একটি সাহায্য চাইতে।
অনেকক্ষন দরজায় কড়া নেড়ে, ডাকাডাকি করার পর, ভেতর থেকে ছট্টু জিজ্ঞেস করে, কেডা বাইরে?
আমি তোর কালাম চাচা। উঠোনে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় উত্তর দেয় কালাম।
জবাব শুনে কিছুক্ষণ পর নিঃশব্দে ঘরের খিল খুলে উঠোনে বেরিয়ে আসে ছট্টু।
চাচা! এতো রাইতে! সব ঠিক আছেনি?
নারে কোন কিছুই ঠিক নাই। তর বাজানের শরীরটা কেমন আছে?
ভালা নাই, চাচা। জর আরো বাড়ছে। কিছু খাইবার পারতাসে না। কথাও উলটপালট বলতাছে। ছট্টু কালামের হাতের দিকে তাকায়। বলে, তোমার হাতে কি হইছে চাচা? কালামের হাত সাদা কাপরে মূড়ানো। সেখানে ছোপ ছোপ রক্ত লেগে আছে।
একটা দুঃঘটনা ঘটছিল।
কি দুঃঘটনা?
কালাম কোন উত্তর দেয় না। কিছুক্ষন চুপ করে থাকে তারপর বলে, আমার একটা সাহায্য লাগবো।
ছোট্ট একটু অবাক হয়, বলে, কি সাহায্য চাচা?
তর ভ্যান গাড়িটা লাগব।
ভ্যান গাড়ি। লইয়া যাও। এইডা আবার কবার কি আছে?
না। তোরও একটু সাথে আসা লাগবো।
কি হইছে চাচা খুইলা বল তো। এবার ছট্টু একটু অবাক হয়।
তুই আইতে পারবি কিনা বল। একটু জোর গলায় কালাম বলে।
বাজানের যেই অবস্থা। তারে রাইখা আসি কেমনে। ছোট্টু একটু চিন্তিত হয়ে বলে।
কালাম একটু নিরাশ হয়। বলে, আচ্ছা ঠিক আছে। বাড়ির দিকে পা বাড়ায় সে।
ছোট্টু পেছন থেকে ডাক দেয়, বলে, আইচ্ছা আমি মায়েরে বইলা দেখতাসি। তুমি একটু খাড়াও।
কিছুক্ষণ পরে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে ছট্টু। বলে, চলো, চাচা।
উঠনের এক কোনে পরে থাকা ভ্যানগাড়িটির তালা খুলে সামনে চালিয়ে নিয়ে আসে ছট্টু।
উঠ চাচা। কালামের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলে।
কালাম এক লাফ দিয়ে ভ্যানের পেছনে চড়ে বসে। পা দুটি বাইরে দুলিয়ে দেয়। ছট্টু ভ্যানের প্যাডেলে এক পা দিয়ে একটু দৌড়ে ভ্যানের গতি আসতেই, অন্য পা-টি ঘুরিয়ে চালকের আসনের উপর চড়ে বসে।
বাইরে এখনো পুরোপুরি ফর্সা হয়নি। কালাম ও ছোট্টু ভ্যান থেকে সাদা কাফনের কাপড়ে মোড়ানো দুটি লাশ এক এক করে ধরে নিচে নামায়।
এই মুহূর্তে ওরা টুটপাড়া কবরস্থানে রয়েছে। কালাম চায় গোপনে বেশি কিছু জানাজানি না করে লাশদুটি দাফন করতে।
হাতে কোদাল নিয়ে মাটি খুঁড়তে শুরু করে দুজনে।
প্রায় ঘন্টা খানেক পর দুজনে মিলে দুটো কবর খুঁড়ে ফেলে।
প্রথমে সাদা কাপড়ে মোড়ানো বুড়োর লাশটি দুজনে ধরে কবরের গর্তে রাখে। তারপর গর্তের উপর একটি বাশের চালা বসিয়ে দেয় কালাম। চোখ মুছতে মুছতে মাটি ছিটিয়ে দিতে শুরু করে।
ছোট্টু কুঁজো বুড়ির লাশটি টানতে টানতে পরের গর্তটির কাছে নিয়ে যায়। দুজনে মিলে লাশটি ধরে কবরের মাঝখানটা নামায়।
হঠাৎ করেই ছোট্টুর মনে হয় লাশটি যেন কাপড়ের ভেতরে একটু নড়ে উঠেছে। প্রথমে বিষয়টি ধরতে পারেনি সে। তার কাছে মনে হয়েছে, তার মনের ভুল কিংবা লাশটি নিয়ে নাড়াচাড়া করার সময় দেখতে এরকমটা লেগেছে।
কিন্তু তার প্রায় কয়েক মুহূর্ত পর লাশটি আবার নড়ে ওঠে। এবার ছোট্টু কিছুটা আঁতকে ওঠে। সে ভাবে সে যা দেখেছে ঠিক দেখেছে।
ছোট্টু কালামের দিকে তাকায়, বলে,
চাচা তুমি কি কিছু দেখছো?
কালাম ওর কথায় একটু অবাক হয়, বলে, কি দেখমু?
ছোট্ট কিছু না বলে মাথা নাড়ে।
কবরের উপর বাশের চালাটি বসাতে গিয়ে এবার তৃতীয়বারের মতো একই জিনিস লক্ষ্য করে ছোট্টু। লাশটির মাথার দিকটা খানিকটা নড়ে উঠেছে। ছোট্টু সাথে সাথে এক চিৎকার করে ওঠে। কালামকে উদ্দেশ্য করে বলে, চাচা তোমার মায় তো বাইচা আছে!
কালাম ছোট্টুর কথাটি শোনার জন্য ঠিক প্রস্তুত ছিল না। হতভম্ব হয়ে জবাব দেয়, কি? কি বলছ তুই?
ছোট্টু আবার বলে, হয় দাদি বাইচা আছে! এদিকে আহো, দেইখা যাও। এই মাত্রই নইড়া উঠছে!
কালাম বাশের চালাটি পাশে রেখে ছুটে ছোট্টুর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। তারপর স্থির কয়েক মুহূর্ত লাশটির দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছুক্ষণ পরে ছোট্টুর উদ্দেশ্যে বলে, তোর চোখের ভুল!
ছোট্টু কালামের কথাটি বিশ্বাস করে না। আরে আমি একবার না, কয়েকবার দেখছি। দাঁড়াও এইখানে। কথাটি বলে এক লাফে গর্তে নেমে পড়ে সে।
তারপর মাথার দিকের মোড়ানো কাপড়টি খোলার চেষ্টা করে। ঠিক ওই মুহূর্তেই লাশটি পাক খাওয়ার মত করে মোচড় দিতে শুরু করে। ছোট্টু সভয়ে কিছুটা পেছনে সরে যায়। কালামের ততক্ষণে মাথা চক্কর দিয়ে উঠেছে। সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই কুজোবুড়ির লাশটি এবার গলা কাটা মুরগীর মত লাফাতে শুরু করে দেয়।
তাই দেখে পড়িমড়ি করে গর্তটি থেকে উপরে উঠে আসে ছোট্টু। কি করবে সে কিছু বুঝে উঠতে পারে না।
কালাম নিজেও দিশেহারা হয়ে পড়ে। তবে কি তার মায় বাইচে আছে?
বাইচে থাকলেই বা কি? সেতো পাগল হয়ে গেছে। বিকালে সে তার যে রূপ দেখছে, তারপর থাইকা তারে আর স্বাভাবিক লাগে না কালামের কাছে। স্ট্রোক নামে নাকি কি এক রোগ আছে, সেইটা হলে মানুষ এরকম পাগলের মত আচরণ করে। তার মায়ের কি সেইরকম কিছু হইল?
কালাম চতুর্দিকে একবার তাকায়, বলে, মায়ের শরীরের দাফনের কাপড় খোলা যাইবো না।
ছোট্টু জিজ্ঞেস করে, কেন চাচা? তোমার মা তো বাইচে আছে। না খুলে দিলে তো শ্বাস আটকে যাইবে।
কালাম কোন কথা না বলে। দ্রুত গর্তের মধ্যে নেমে পড়ে। মাথার দিকের মোড়ানো কাপড়টুকু খুলে দেয়ার চেষ্টা করে।
তারপর দড়ি চায় ছোট্টুর কাছে। ছোট্টু এক দৌড়ে তার ভ্যান গাড়ি থেকে এক গোছা দড়ি নিয়ে আসে, বলে, দড়ি দিয়া কি করবা?
কালাম বলে, বাধবো। ছোট্টু অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে কালাম চাচার দিকে তাকিয়ে থাকে।
কালাম দাফনের কাপড়ের উপর থেকেই কুঁজো বুড়ি পা-দুটি বেঁধে ফেলে। তারপর দুই হাতের চারপাশ দিয়ে কোমর বরাবর আরেকটা বাঁধা দেয়।
এবার সে বুড়ির মাথা মোড়ানো কাপড়ের পুরোটুকু খুলে দেয়। কুজোবুড়ির ভয়ঙ্কর মুখখানা এক ঝটকায় বেরিয়ে আসে। তার চেহারার হিংস্রতা দেখে ছোট্টুর বুক ধক করে ওঠে। এবড়ো থেবড়ো মুখের চামড়ার উপর জমে যাওয়া ছোপ ছোপ রক্ত।
বুড়ির মুখ থেকে অনবরত লালা ঝড়ছে। দাঁতে দাঁত কামড় দিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে কিড়মিড় করছে। প্রচন্ড ক্ষুধায় কোন হিংস্র পশু যে রকম আচরণ করে কুজোবুড়িকে দেখে সেরকম কিছু একটা মনে পড়ে গেল ছোট্টর। সে বুঝে উঠতে পারছে না কালাম চাচার মায়ের আদতে কি রোগ হয়েছে।
চাচা তোমার মায় কি পাগল হইয়া গেছে?
আমি ঠিক জানিনা রে। কালাম সরাসরি উত্তর দেয়। মায়েরে বাড়ি নিয়া যাইতে হইবো। আমারে একটু সাহায্য কর। একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে কালাম আবার বলে, আমি তার মুখ দড়ি দিয়ে বাধমু।
ছোট্টু ভয়ে ভয়ে নিচে গর্তে নেমে আসে। কুঁজো বুড়ি তার মাথা এমনভাবে নেড়ে চলছিল সেটি ধরতে গেলে কামড় খাওয়ার প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। কালাম তার মাথাটি কোনভাবেই স্থির করে ধরে রাখতে পারছিল না। মাথায় হাত দিতেই সাপের মত ছো মেরে উঠছিল কুঁজো বুড়ি।
দুজনে মিলে এদিক ওদিক করে বুড়ির মুখটি বাঁধার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে।
.
হারিস দেওয়ান সগীর মুনসিকে ডেকে পাঠিয়েছে। হারিস দেওয়ানের ছেলে সবুর দেওয়ান তার ঠিক পাশেই মুখ ভার করে একটি কাঠের চেয়ারে বসে আছে।
সগির মুন্সি বাড়ির মূল ফটক পেরিয়ে আসতেই, সবুর দেওয়ান ইশারায় তাকে সামনের একটি টুলের উপর বসতে বলে। সগীর মুনসির কাছে সবুর দেওয়ানের হাবভাব ঠিক ভালো ঠেকে না। তার কাছে মনে হয়, কোন একটা গন্ডগোল আছে।
সগির মুন্সি ভয়ে ভয়ে সামনের কাঠের টুলটির উপর গিয়ে বসে। সবুর দেওয়ান সগির মুনসির দিকে এক ধরনের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকায়, তারপর একটু কড়া ভাষায় জিজ্ঞেস করে, তোমার বাপ কয়দিন আগে হারায় গেছিল?
সগির মুন্সি কাঁপা কাঁপা গলায় উত্তর দেয়, তিন চারদিন হইবো। তারপর জিজ্ঞেস করে, কেন সাব? বাজানরে কি পাওয়া গেছে?
সবুর দেওয়ান সাথে সাথে তাকে একটি ঝাড়ি দেয়, বলে যেটা জিজ্ঞেস করি শুধু সেইটার উত্তর দিবা।
সগির মুন্সি দ্রুত মাথা নাড়ে।
তোমার বাপ তো মাঝেমধ্যে রহমানের দোকানে আসতো। সবুর দেওয়ান বলতে থাকে। চা সিগারেট খাইতো। পথে ঘাটে দেখা হইলে সেলাম দিতো। তারে কখনো তো পাগল মনে হয় নাই। একটু কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে সবুর দেওয়ান। তারপর বলে, কাইল রাইতে আমি তারে দেখছি। উত্তর পাড়ার বড় রাস্তায় পাগলের মতো ঘুরতাছিল।
সবুর দেওয়ানের কথাটি যেন নিজ কানে বিশ্বাস করতে পারছিল না সগির মুন্সি।
কি বলেন, সাব? আমার বাজান তো পাগল ছিল না?
এবার সগিরের উপর বেশ চটে যায় সবুর দেওয়ান। অনেকটা খেঁকিয়ে ওঠে, তবে কি আমি মিথ্যা কথা কইতাছি?
সগির মুন্সি সাথে সাথে ডানে বামে মাথা নাড়ে।
সবুর দেওয়ান আবার বলে, তোমার বাপেরে আমি কাইল রাইতে দেখছি, ন্যাংটা পাগলের মতো ঘুরতাছিল। মানুষরে ধাওয়া কইরা বেড়াইতাছিল।
তারে কি আপনে ধরতে পারছেন? আবার মুখ ফসকে প্রশ্নটি করে ফেলে সগির মুন্সি। প্রশ্নটি করেই নিজের ভুল বুঝতে পারে সে। মাথা নাড়ে।
ওই মিয়া! সবুর আবার চেঁচিয়ে ওঠে। বলে, তারে ধরা কি আমার কাজ? তোমার বাপ তুমি গিয়া ধরো। সে বেশ রেগে গিয়ে এবার যেন ফুঁসতে থাকে, আমি যদি আবার শুনি তোমার বাপ গ্রামের আর কাউরে বিরক্ত করছে, তবে আমি তোমারে দেইখা নিমু। কথাটা মনে রাইখো মিয়া।
সগীর মুন্সী হারিস দেওয়ানের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকায়। হারিস দেওয়ান এক ধরনের বিরক্তি নিয়ে মুখ থেকে এক গোল্লা থুতু ফেলে। তারপর বলে, সবুর ঠিকই কইছে, তুমি তোমার বাপেরে ধরার ব্যবস্থা করো। এলাকার মানুষেরে সে যেন আর বিরক্ত না করে।
সগির নিঃশব্দে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
চলবে।
RabbY khan, Debasis sorkar, Maruf khan, Sm samim, Alom khan, Salman reja, Foisal Hossain and লেখাটি পছন্দ করেছে
- M A Nayeemশুকতারা
- Posts : 68
স্বর্ণমুদ্রা : 1470
মর্যাদা : 20
Join date : 2021-05-22
Re: ভাইরাস
বাড়িতে ঢুকতেই ঘরের ভেতর চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ পেয়ে ভ্যান গাড়িটি উঠোনে রেখে দৌড়াতে শুরু করে ছোট্টু।
ভেতরে ঢুকেই দেখতে পায় মিলিটারি আর তার মেজো ভাই তার বাজানের হাতদুটি খাটের দুই পাশ থেকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। নিজের স্বামীর পা দুটি বাঁধার চেষ্টা করছে তার মা।
তার ডান পায়ে যে আঘাতটি ছিল সেটির ব্যান্ডেজ খুলে ফেলা হয়েছে। আঘাতটি আরো বেশি ছড়িয়ে পড়েছে। সেটি এখন প্রায় পুরো পা জুড়ে। পূজে ভরে গেছে পুরো ক্ষত স্থানটি। বিভৎস সেই ক্ষত দেখে ছোট্টুর গা রি রি করে উঠলো। চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, কি হইছে বাজানের?
পাগলের মত হাত-পা ছুড়তে থাকা রহিম বক্স যেন এক মুহূর্তের জন্য ছোট্টুর দিকে তাকালো। ছেলের সাথে যেন তার শেষবারের মতো একবার চোখাচোখি হলো।
তার পরক্ষনেই আবার ভয়ঙ্করভাবে আর্তচিৎকার জুড়ে দিলো। পুরো শরীর বাঁকিয়ে মোচড় কাটতে শুরু করলো, যেন সারা শরীরে তার অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। ক্ষুদার্থ মুখে অঝোরে লালা ঝরছে।
রহিম বক্স এর চোখের মনি দুটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। তার উপরে এক ধরনের ঝাপসা আবরণ তৈরি হয়েছে। মুখের ভেতর দাঁতের সাথে দাঁত কিড়মিড় করছে সে। যেন প্রচণ্ড ক্ষুধায় ছটফট করছে, ঠিক যেন মিলিটারির মায়ের মতো, একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটছে। একটু আগে ছোট্টু কালামের সাথে তাকে বাড়ি ছেড়ে এসেছে।
হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছট্টুর দিকে তাকিয়ে হাঁক ছাড়ে মিলিটারি, আমারে একটু সাহায্য কর!
এবার যেন সৎবিৎ ফিরে পায় সে। দ্রুত পায়ে মিলিটারির কাছে এগিয়ে যায়। খাটের কলামের সাথে তার বাপের হাত বাঁধতে সাহায্য করে। অন্য পাশের হাতটি ইতিমধ্যে তারা বেঁধে ফেলেছে। নিচে তার মা পা দুটি খাটিয়ার সাথে বাধার চেষ্টা করছে।
খাঁচায় আটকানো জন্তুর মতো ছটফট করতে শুরু করে রহিম বক্স। ধীরে ধীরে তার আর্তনাদটি এক ধরনের গর্জনে রূপান্তরিত হয়। ছোট্টু ব্যাপারটা খেয়াল করে। ঠিক যেন মিলিটারির মায়ের মত, গলার স্বরে পরিবর্তন আসছে তার বাজানেরও।
মিলিটারি ছোট্টুর দিকে তাকিয়ে বলে, তোর বাপের মুখটা বাঁধতে হবে।
ছোট্টু মাথা নাড়ে, সে জানে এই মুখ বাধাটাই সবচেয়ে কঠিন কাজ।
.
কালাম তার বউ এর উদ্দেশ্য ঠান্ডা গলায় বলে, মায়েরে একটু খাওয়ানো দরকার।
তার বউ মুখ বাঁকা করে উত্তর দেয়, তোমার পাগল মায়েরে তুমি খাওয়াও। আমারে বলতাছো কেন? শাশুড়ির এরুপ প্রত্যাবর্তন ভালোভাবে নিতে পারেনি তার বউ।
কালাম কোন জবাব দেয় না। অগত্যা নিজের দুর্বল শরীরটাকে বিছানা থেকে টেনে তুলে। খাবারের হাড়িগুলির দিকে এগিয়ে যায়। শরীরটা প্রচন্ড ক্লান্ত লাগছিল তার।
একটি থালায় করে একটু ভাত, এক টুকরো মুরগির মাংস, ঝোল নিয়ে মাখাতে মাখাতে তার মায়ের খাটের উপর গিয়ে বসে সে। কুঁজোবুড়ি খাটের সাথে শক্ত করে বাঁধা রয়েছে। কালাম কুজোবুড়ির মুখের বাঁধনটি খুলে দেয়।
এখন যেন কিছুটা শান্ত রয়েছে কুঁজো বুড়ি। কালামকে কামড়ানোর কোন চেষ্টা করল না সে।
কালাম তার মুখে এক গাল ভাত তুলে দেয়ার চেষ্টা করে। কুজোবুরি একটু মুখটা তারদিকে বাড়ায়, সম্ভবত নাক দিয়ে গন্ধ শুঁকে। তারপর অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
কালাম অনেকক্ষণ তাকে ইনিয়ে-বিনিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু কুজোবুড়ি কোনভাবেই খাবার মুখে নেয় না। অগত্যা কালাম মুরগির মাংসের টুকরাটি হাতে নিয়ে মায়ের দিকে বাড়িয়ে দেয় কালাম, বলে, ভাত না খাও, মাংসটা নষ্ট কইরো না।
কুজোবুড়ি কিছুক্ষণ অন্যদিকে ফিরে থাকে। তারপর কালামের হাতের দিকে তাকিয়ে কি একটা মনে করে, সাথে সাথেই গপ করে মাংসের টুকরোটি মুখে পুরে নেয়।
কুজোবুড়ি আগে কখনো মাংস খেতে চাইত না। শাকসবজি ছিল তার পছন্দের খাবার। তবে তার মুখের রুচিতে সম্ভবত পরিবর্তন এসেছে।
কালাম ছুটে গিয়ে হাড়ি থেকে আরো কয়েক টুকরা মাংস তুলে আনে।
প্রায় সাথে সাথেই তার বউ খেঁকিয়ে ওঠে, বলে, সব মাংস কি তোমার মায়ের পেটে দিবা? আমারার জন্য রাখা লাগবো না।
কালাম আবার ফিরে যায় হাড়ির দিকে। এক টুকরো মাংস হাঁড়ির মধ্যে রেখে দেয়। বাকি কয়েক টুকরো কুজোবুড়ি গোগ্রাসে গিলে নেয়।
ইতিমধ্যেই কালামের বউ পাশের ঘরের বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে পড়েছে। কালাম ঘরে আসতেই তার বউ তাকে এক ধরনের ইঙ্গিত করে, ইশারায় খাটে ডাকে। কালাম বউয়ের এই ইশারা ভালো করেই জানে।
ইশারার ডাকে সাড়া দিতে ভাতের থালাটি মাটিতে রেখে দ্রুত কলসি থেকে পানি নিয়ে হাত ধুয়ে নেয়। তারপর এক লাফে বিছানায় চলে যায়। কালামের বউয়ের গায়ের রং একটু চাপা হলেও, আদতে খুবই সুন্দরী সে, আবেদনময়ীও বটে। যেন খর কুটের ঘরে একটি ঝকঝকে ঝাড়বাতি।
মূলত এই কারণে কালাম অনেকটাই তার বউয়ের বসে থাকে। তার কথা মতো উঠাবসা করে।
কালামের বউ তার দিকে তাকিয়ে দুষ্টু একটা হাসি দেয়, বলে, সব ইশারা কি আমারেই করতে হইব?
কালাম কোন কথা না বলে বউয়ের চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। তার গলায় ঘাড়ে আলতো কামড় দেয়, যেটি তার বউয়ের খুবই পছন্দের। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসতে থাকে মেয়েটির। চোখ দুটি বুজে ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলে, আরো দাও!
কালাম নিজেও খানিকটা উত্তেজিত হয়ে পড়ে, বউয়ের গলায় আরেকটা কামড় বসায়।
তৎক্ষণাৎ তার বউ চিৎকার করে লাফিয়ে ওঠে। এক ঝটকায় কালামকে সরিয়ে দেয়। বিছানা থেকে দ্রুত নেমে দৌড়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কালাম তার ঘাড়ে জোরে একটি কামড় বসিয়ে দিয়েছে। কিছুটা মাংস খুবলে তুলে ফেলেছে!
তোমার কি মাথা খারাপ হইয়া গেছে? মায়ের মত পাগল হইয়া গেছো? চিৎকার করে কালামের উদ্দেশ্যে বলে সে, আইসা দেইখা যাও, আমার ঘাড়ে কি করছো! ক্ষতটি দেখাতে দেখাতে বিস্মিত দৃষ্টিতে কালামের দিকে তাকায় সে। কালাম হতভম্ব হয়ে লক্ষ করে কামড়ে বেশ খানিকটা কেটে ফেলেছে সে। কিভাবে ব্যাপারটা ঘটলো সে নিজেও ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। সে তো কখনও এত জোরে কামড়ায় না। নিজের অজান্তেই সে এভাবে দাত বসিয়ে দিতে পারল!
কালাম অপরাধী ভঙ্গিতে তার বউয়ের একটু কাছে এগিয়ে যেতে চায়। ঠিক তখনই তার বউ চেঁচিয়ে ওঠে, বলে, খবরদার! আমার সামনে আসবা না। দূরে থাকো। আইজ থাইকা তুমি তোমার মায়ের সাথে পাশের ঘরে থাকবা। কথাটি বলে এক ধরনের আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা নিয়ে কালামের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে। (চলবে)
RabbY khan, Debasis sorkar, Sm samim, Alom khan, Salman reja, Foisal Hossain, Rajesh mondol and লেখাটি পছন্দ করেছে
- M A Nayeemশুকতারা
- Posts : 68
স্বর্ণমুদ্রা : 1470
মর্যাদা : 20
Join date : 2021-05-22
Re: ভাইরাস
হাসপাতালের মর্গে পড়ে রয়েছে রহমান চাচার লাশ। কর্তৃপক্ষ কারো কাছে তার লাশটি হস্তান্তর করার সুযোগ পায়নি। রহমান চাচার স্ত্রী-সন্তান নেই। অনেক আগেই তাকে পরিত্যাগ করেছে। কেন করেছে, তারা এখন কোথায় সেটিও কারো জানা নেই।
তার একমাত্র যে আপন ভাই, সেও তার লাশের খোঁজ খবর নেয়নি। সেটি সৎকারের জন্য কোন ধরনের ব্যবস্থাও গ্রহণ করেনি। যদিও তার ছেলে রহমান চাচার ভাস্তে তার দোকান দেখভালের দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে।
গ্রামে গ্রামে ভাইরাসের বিষয়টি রটিয়ে পড়েছে। মূলত সেই কারণেই মানুষ অনেকটা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। অজানা কারণে গ্রামের মানুষ মারা যাচ্ছে। কেউ ভাবছে অজ্ঞাত কোন জন্তু জানোয়ার মানুষ মেরে ফেলছে, কেউবা ভাবছে অতিপ্রকৃত কোন ঘটনা।
মানুষ অজানাকে বড্ড বেশি ভয় পায়। তাই এই বিষয়গুলি যতক্ষণ সুরাহা না হচ্ছে, সেগুলির ব্যাপারে বিশদ জানতে না পারছে, তাদের মধ্যে ভয়-ভীতি কমে আসার সম্ভাবনা নেই।
অন্ধকার রাত।
প্রহরী একটু আগে মর্গের ভেতর রহমান চাচার লাশটি অন্য একটি কেবিনেটে স্থানান্তর করেছে। লাশকাটা ঘরে কেবিনেট সংকট রয়েছে। হঠাৎ করেই অনেক বেশী বেওয়ারিশ লাশ আসতে শুরু করেছে। লাশগুলি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কারো কাছে হস্তান্তর করা সুযোগ পাচ্ছে না। তাই লাশকাটা ঘরে এক ধরনের সংকট দেখা দিয়েছে।
বুড়ো প্রহরীটি মর্গের মূল ফটকের পাশে, একটি চেয়ারে বসে বিড়ি টানছে।
ফটকের সামনে উঠোনের মত একটি জায়গা আছে। সেটির আশেপাশটা ঘিরে রয়েছে ঝোপঝাড়। বহু বছর ধরে কেউ সেগুলি পরিষ্কার করেনি। সরকারি সদর হাসপাতালগুলি যেমন হয় আর কি।
হটাত মাঝে মাঝেই দুই একটা রাত জাগা পাখি গাছগুলির মগডাল থেকে ক্ষণে ক্ষণে ডেকে উঠছে। চারিপাশ থেকে ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ কানে আসছে।
এগুলি অবশ্য প্রতিদিনকার ঘটনা। বুড়ো প্রহরী এসবে অভ্যস্ত। তবে আজকের রাতটা কেন জানি তার কাছে অন্যরকম মনে হল। মনে হল অলুক্ষনে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। অনেক বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা তার। খারাপ কিছু আগে থেকেই আঁচ করতে পারে সে।
হঠাৎ করেই লাশকাটা ঘর থেকে এক ধরনের শব্দ ভেসে আসে। বুড়ো প্রহরীর অভিজ্ঞ কান সাথে সাথে খাড়া হয়ে যায়।
রাত বিরাতে ইঁদুর-বিড়াল ঘুরে বেড়ায় চারিদিক। বিভিন্ন ধরনের শব্দ করে। কিন্তু এই শব্দটি সেরকম কিছুর সাথে মেলাতে পারছে না সে।
বুড়ো প্রহরী সিঁড়ি থেকে উঠে দাঁড়ায়। হাতের জ্বলন্ত বিড়িটি সামনের উঠোনে ছুঁড়ে ফেলে। তারপর লুঙ্গিটি ভাজ করে তুলে সিঁড়ি বেয়ে সামনে এগিয়ে যায়।
শব্দটি সম্ভবত লাশ কাটা ঘরের কোন কেবিনেট থেকে আসছে। কেবিনেট এর ভেতরে কোন ইদুর বিড়াল ঢুকে পড়ল কিনা। কিন্তু এত বছরের অভিজ্ঞতায় সেটি কখনো ঘটতে দেখেনি সে। তাছাড়া সম্ভবও না সেটা। কেবিনেটগুলি তালাবদ্ধ থাকে।
লাশকাটা ঘরের সামনে পৌঁছাতেই হাতের চাবি দিয়ে খট করে তালাটি খুলে ফেলে বুড়ো। ভেতরে ঢুকতেই টের পেল সামনের কেবিনেটগুলির কোন একটা থেকে আসছে শব্দটি।
বুড়ো সেটি বোঝার জন্য কান পেতে কিছু একটা শোনার চেষ্টা করে। উপরে কোনার একটি কেবিনেট থেকে শব্দটা আসছে। বুড়ো খুব সাবধানে সেই দিকটায় এগিয়ে যায়।
লাশ ঘরটির পরিবেশ স্বাভাবিকভাবেই খুব শীতল। ইঁদুর-বিড়াল এই দিকটায় কমই আসে। তাছাড়া প্রতিটি কেবিনেট তালাবদ্ধ। কোন প্রাণীর পক্ষে সেটির ভেতরে ঢোকা সম্ভব নয়। এত বছরের চাকুরি জীবনে সে এরকম ঘটনার সম্মুখীন হয়নি। শব্দটি এক ধরনের ভেতরকার দিক থেকেই আসছে বলে মনে হয় তার কাছে। হতে পারে সেটি দেয়ালের পেছন থেকে আসছে।
বুড়ো অতিপ্রাকৃত বিষয়ে বিশ্বাস যে করে না ঠিক তা নয়। আবার এত বছরের অভিজ্ঞতায় এরকম ঘটনা ঘটেনি সেটিও নয়।
হঠাৎ করেই কেউ যেন কেবিনেটের দেয়ালে জোরে একটি শব্দ করল। বুড়ো সভয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেল।
চোখ বড় বড় করে সেই দিকে তাকিয়ে রইল। তার হৃদস্পন্দন বহুগুন বেড়ে গেছে। অন্য কেউ হলে হয়তো কেবিনেটটি ধারার সাহস পেত না।
কিন্তু আধি-ভৌতিক বহু ঘটনার অভিজ্ঞতা যে রয়েছে তার।
বুড়ো সন্তর্পনে কোমরে গোজা চাবির ছড়া থেকে কেবিনেটের চাবিটি বের করল। কাঁপাকাঁপা হাতে চাবি ঘুরিয়ে কেবিনেট খুলে ফেলল। আস্তে আস্তে ট্রেটি টেনে লাশটির অর্ধেকটা বের করল।
বের করে যা দেখল তা এই জীবনে কখনো দেখেনি সে।
রহমানের লাশটি ক্ষণে ক্ষণে সাপের মত পাক খেয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। তারই প্রেক্ষিতে ভাঙ্গা হাড় বেরিয়ে থাকা তার অর্ধ খাওয়া হাতটি কেবিনেটের দেয়ালে বারি খাচ্ছে।
এরকম ভয়ানক একটি দৃশ্য দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা বুড়ো। আচমকা এই ধাক্কা সামলাতে না পেরে কেবিনেটটি খোলা রেখেই দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে।
তারপর উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটতে ছুটতে মুহূর্তেই কোথাও হারিয়ে গেল।
.
কালামের বউ স্টিলের ট্রাংকটিতে তার কাপড়-চোপড় গোছাতে শুরু করেছে। সে আর কালামের সাথে থাকবে না বলে মন স্থির করেছে। আজি বাপের বাড়ি চলে যাবে।
কালাম তার মায়ের মতো পাগল হয়ে যাচ্ছে। সারাদিন তাকে মাংস খাওয়ায়। প্রথমে রাধা মাংস খাওয়ালেও, এখন সে কাঁচা মাংসই কোথা থেকে জোগাড় করে নিয়ে আসে। মাকে খেতে দেয়, এমনকি নিজেও খায়।
তার আচরণ এতোটাই অস্বাভাবিক হয়ে পড়েছে যে, তার সাথে থাকাটা এখন এক ধরনের ভীতিকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কালাম তার মায়ের ঘরে বসে, তাকে মাংস খাওয়াচ্ছে। তার বউ স্টিলের ট্রাংকটি টানতে টানতে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছে। তারপর রওনা করেছে তার বাপের বাড়ির উদ্দেশ্যে।
কালাম ভেতরে বসে কিছু শুনতে বা বুঝতে পারল কি না তা নিয়ে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। চলবে
RabbY khan, Debasis sorkar, Maruf khan, Sm samim, Alom khan, Salman reja, Foisal Hossain and লেখাটি পছন্দ করেছে
- M A Nayeemশুকতারা
- Posts : 68
স্বর্ণমুদ্রা : 1470
মর্যাদা : 20
Join date : 2021-05-22
Re: ভাইরাস
হাসেম অস্থিরভাবে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। সামসুর ঘরে কয়েকবার কড়া নেড়ে একটু দুরে উঠোনে এসে দাঁড়ায়। শামসুর বউ দরজা খুলতেই সামসুকে সে ডেকে দিতে বলে।
সামসু ঘরে বসে হাত পাখা দিয়ে বাতাস করছিল। বউয়ের কথা শুনে সে তড়িঘড়ি করে পাখাটি বিছানায় রেখে বাইরে বেরিয়ে আসে। হাশেমের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, কিরে কি হইছে, হাসু?
বড় বড় নিঃশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে হাসেম বলে, আমার খুব শ্বাসকষ্ট হইতেসে। পায়খানা দিয়ে রক্ত যাচ্ছে। আমি মনে হয় ভাইরাসে আক্রান্ত, মিয়া ভাই!
কথাটি শুনে শামসু তার দিকে পা বাড়াতে যায়। উঠোনে নেমে আসতে গেলেই, হাসেম বাধা দেয়, বলে, আমার সামনে আইসো না। ওইখানেই থাকো।
হাসেমের চেহারায় গভীর চিন্তার ছাপ। মৃত্যুভয় তাকে পুরোপুরি কাবু করে ফেলেছে।
দরজায় দাঁড়িয়ে হতভম্ব সামসু হাসেমের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, কি উত্তর দিবে, কি করবে, কিছুই সে বুঝে উঠতে পারছে না!
.
বিকেল পেরিয়ে রাত গড়িয়েছে। রহিম বক্সকে কোনভাবেই শান্ত করতে পারছে না মিলিটারি। তার মুখে শক্ত করে এটে কাপড় বেঁধে দেয়া হয়েছে। তাতে করে তার আর্তচিৎকার কিছুটা কমে আসলেও অস্থিরতা একটুও কমেনি। সারাদিন খাটের উপর কুমিরের মতো উল্টানোর চেষ্টা করেছে সে। যেন তার শরীরের ভেতর অসহ্য যন্ত্রণা। সেই যন্ত্রণায় সে গলা কাটা মুরগীর মত কাতরাচ্ছে।
তার উপর এরকম ধস্তাধস্তিতে কয়েকবার তার হাতের বাধন ঢিলা হয়ে যায়। মিলিটারি ও ছোট্টু মিলে বাঁধনগুলি আবার শক্ত করে এটে দেয়।
সবাই তারা ঘরের ভেতর একপ্রকার বন্দী। তার ওপর সারাদিন সারাক্ষণ রহিম বক্স এর উপর নজর রাখাটাও বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে দাড়িয়েছে। কেউ তাকে না পারছে ছেড়ে দিতে, না পারছে ছেড়ে যেতে। শুধু রহিম বক্সের পরিবারই নয়, মিলিটারির নিজেরও যে তার উপর মায়া পড়ে গেছে। রহিম বক্স ছিল তার বড় ভাইয়ের মতো। এমনকি কালামের চেয়ে রহিম বক্স এর সাথে তার বেশি ওঠাবসা ছিল।
ইতিমধ্যে রহিম বক্স এর চোখ দুটি আরো ঘোলাটে হয়ে এসেছে। মুখ দিয়ে এক ধরনের আর্তনাদ বের হচ্ছে। যেন ক্ষুদায় অস্থির হয়ে উঠেছে সে।
হঠাৎ করেই বাইরে এক ধরনের জান্তব আর্তচিৎকারের শব্দ শুনতে পায় মিলিটারি। ছোট্টুর দিকে তাকিয়ে চোখ দুটি বিস্ময়ে ছানাবড়া হয়ে যায় তার। চিৎকারটি কোন সাধারণ মানুষের নয়। যেন অতিপ্রাকৃত কোন জন্তুর।
ছোট্ট একদম চুপ মেরে যায়। কান খাড়া করে শব্দটি শোনার চেষ্টা করে সে। চিৎকার থামে না, একনাগাড়ে হতেই থাকে।
রহিম বক্স এর বউ ব্যাপারটির ভয়াবহতা বুঝতে পেরে তার ছোট ছোট বাচ্চাদুটিকে নিয়ে ঘরের এক কোণে বসে পড়ে। চিৎকারটি অনেকটা তাদের উঠোন অবধি এসে পড়েছে।
মিলিটারি বিদ্যুৎবেগে ছুটে গিয়ে ভাল করে দরজার খিলটি আটকে দেয়। ছোটুকে জানালাগুলি পরীক্ষা করে দেখতে বলে। ছোট্টু একে একে প্রত্যেকটি জানালার খিলগুলি শক্ত করে আটকে দেয়।
মেজো ঘরের কোন থেকে একটি বাশ যোগাড় করে মিলিটারি হাতে এনে দেয়। মিলিটারি বাশটি শক্ত করে হাতে ধরে চুপচাপ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে।
আর্তচিৎকারটি এবার যেন এক ধরনের গোঙ্গানির মত গরগর শব্দে রূপ নেয়।
তারপর হঠাৎ করেই দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে কেউ একজন বলে ওঠে, মিয়া ভাই। ও মিয়া ভাই। কণ্ঠটি কালামের। মিলিটারি চিনতে পারে। কিন্তু খানিকটা বিকৃত। তার গলার স্বরে এক ধরনের পরিবর্তন এসেছে।
ছোট্টু তড়িৎ গতিতে দরজার খিলটি খুলতে গেলে, মিলিটারি তার হাতটি চেপে ধরে। ইশারায় তাকে থামতে বলে।
রহিম বক্স এর পায়ের দিকে একবার তাকায় মিলিটারি। রহিম বক্সের পায়ের ক্ষতটি ধীরে ধীরে আরো বিস্তৃতি লাভ করেছে। দকদক করছে চারিপাশ। পুজ দিয়ে ভরে উঠেছে। কালামের হাতেও রহিম বক্সের মতই একটি আঘাত আছে। কুঁজো বুড়ি তার হাতটি কামড়ে দিয়েছিল।
এবার যেন ঠিক দরজার ওপাশে এসে বসে কালাম। ডুকরে কেঁদে ওঠে, এক ধরনের ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে উঠে, সবাইইই আমারারেরেরে ছাইড়াড়াড়া চইলালালা গেছেছেছে!
তার স্থূল গলার স্বরটি ভিশন অস্বাভাবিক লাগে ছোটুর কাছে। সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে তার।
কালাম তার বিকট গলায় প্রলাপ বকতে থাকে। আর বলতে থাকে, দরজাটাটাটা খোলো...
তারপর হঠাৎ করেই যেন রেগে ফুঁসে ওঠে। আবার সেই হিংস্র আর্তনাদ করতে শুরু করে। তার চিৎকারে আশেপাশের নীরবতা ভেঙে খানখান হয়ে যায়।
মিলিটারি বুঝতে পারে কালাম ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে যাচ্ছে। কালামকে কোনোভাবেই ঘরের ভেতরে ঢুকতে দেয়া যাবে না।
.
এদিকে সদর হাসপাতালে সকাল থেকে সারাদিন রহমানের লাশটি খুঁজে চলছে পুলিশ। অবশেষে সেটি না পেয়ে তারা হাসপাতালে খোঁজ বন্ধ করে চলে গেছে।
পুলিশ প্রহরী বুড়োর কাছে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করেও, তেমন কোন তথ্য বের করতে পারেনি। বুড়ো রাত্রিতে ভয়ে আতঙ্কে কেবিনট খুলেই পালিয়ে গিয়েছিল। তারপরে কি হয়েছে তার আর কিছুই জানা নেই।
এদিকে হাসপাতাল থেকে রোগীরা একে একে চলে যেতে শুরু করেছে। এই ঘটনার পরে পুরো হাসপাতাল জুড়ে কানাঘুষা শুরু হয়ে গেছে। সারাদিনে হাসপাতালের প্রায় অর্ধেক রোগী ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে গেছে।
শুধুমাত্র পুরুষ ওয়ার্ডসহ অন্যান্য কিছু কেবিনে কয়েকজন মুমূর্ষু রোগী রয়ে গেছে।
পুরুষ ওয়ার্ডের একজন মুমূর্ষু রোগী অবিরত কাতরাচ্ছিল। তার সাথে শুধু তার ২০-২২ বছরের ছেলেটি হাত ধরে বসে ছিল।
অবস্থা আরো খারাপ হতে থাকলে, ছেলেটি দ্রুত পায়ে ডাক্তার ডাকতে বেরিয়ে যায়।
বাইরে চারপাশটা গাড় অন্ধকারে ঢেকে গেছে। এদিকে মুমূর্ষু রোগীটির প্রাণ বায়ু বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম।
পুরুষ ওয়ার্ডে দশটি বেড থাকলেও আজকের ঘটনার পরে বাকি যে কয়েকটি রোগী ছিল ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে গেছে।
হঠাৎ কিছু একটা যেন বাইরের সিঁড়ি ঘর দিয়ে ধীরে ধীরে উপরে উঠে আসতে শুরু করেছে। একটা অবয়ব, একটি হাত নেই।
খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে অবয়বটি পুরুষ ওয়ার্ডের ভেতরে ঢুকে পড়েছে। চারিপাশে একবার তাকিয়ে সেটির চোখ কাতরাতে থাকা মুমূর্ষ রোগীটির উপরে গিয়ে পড়ে। মুখ থেকে এক ধরনের বিকৃত শব্দ করে অবয়বটি। রোগীটি বিছানায় পড়ে শেষবারের মতো কাতরাচ্ছিল, এই যেন প্রাণ বায়ু বের হতে চলেছে।
.
কালাম সজোরে দরজায় আঘাত করে চলছিল। এবার যেন সে প্রায় পুরোপুরি তার ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। এদিকে হঠাৎ করেই মিলিটারির মনে হয় উঠোনে আরও কেউ একজন কালামের সাথে যোগ দিয়েছে। অস্ফূট একটা গলার স্বর শুনতে পাচ্ছিল সে, যেন বিড়বিড় করছে। দাঁত কিড়মিড় করছে।
কালাম রয়ে রয়ে হিংস্রভাবে চেঁচিয়ে উঠছিল। এদিকে রহিম বক্সের অস্থিরতাও যেন আরও বেড়ে গেছে। সে এক ধরনের ধস্তাধস্তি শুরু করে দিয়েছে। কুমিরের মতো উল্টে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কিছুক্ষণ অস্থিরতা করতেই তার একটি হাত খাটের কলামটি থেকে কিছুটা ঢিলা হয়ে আসে। দেখে মনে হয় কিছুক্ষণের মধ্যেই সে হাতটি ছাড়িয়ে নেবে।
ঘরে বাইরে দুই জায়গায়তেই যেন অবস্থা আরো সংকটপূর্ণ হয়ে পড়ছে।
মিলিটারি দৌড়ে রহিম বক্সের স্ত্রীর কাছে ছুটে যায়। বলে, ভাবী, তুমি ঘরের পেছনের দরজা দিয়ে ওদেরকে নিয়ে বেরিয়ে যাও। রহিম বক্সের স্ত্রী তার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, তোমার কি হবে মিলিটারি?
মিলিটারি কোন উত্তর করে না। বলে, আমরা এই ঘরের ভেতরে আর এক মুহুর্ত নিরাপদ না।
মিলিটারি পেছনে তাকিয়ে দেখে রহিম বক্স তার হাতটি খাটের কলাম থেকে ছাড়িয়ে নেয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করেই চলছে।
রহিম বক্স এর স্ত্রী তার ছোট ছোট বাচ্চাদুটির একটিকে কোলে তুলে নেয়, অন্যটির হাত ধরে পেছনের দরজার দিকে এগিয়ে যায়। তার পেছন পেছন মেজটা দরজার দিকে পা বাড়ায়।
মায়ের মমতা নিয়ে ছোট্টুর দিকে একবার তাকায় সে। দ্রুত চোখের পলক ফেলে কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা করে ছোট্ট। নিচের দিকে তাকিয়ে বলে, আমি মিলিটারি চাচার সাথে থাকমু।
ছেলের দিকে তাকিয়ে চোখ দুটি ছল ছল করে ওঠে তার। কিন্তু ছোট্টর দৃঢ় মানসিকতা, তাকে ফিরে যেতে বাধ্য করে।
আঁচলে চোখ দুটি মুছতে মুছতে পেছনে দরজা খুলে বাইরে পা দেয় রহিম বক্সের স্ত্রী। মেজ তার অন্য ভাইটিকে কোলে তুলে নেয়।
তারপর খুব দ্রুতই পেছনের ঝোপঝাড় গুলির ভেতর তারা হারিয়ে যায়। রওনা করে কোন এক অজানার উদ্দেশ্যে।
মিলিটারী দরজার দিকে ফিরে শক্ত হাতে বাশটি ধরে থাকে। ছোট্টু রহিম বক্সের হাতটি পুনরায় বেঁধে ফেলার চেষ্টা করে যেতে থাকে। (চলবে)
RabbY khan, Debasis sorkar, Maruf khan, Sm samim, Alom khan, Salman reja, Foisal Hossain and লেখাটি পছন্দ করেছে
- M A Nayeemশুকতারা
- Posts : 68
স্বর্ণমুদ্রা : 1470
মর্যাদা : 20
Join date : 2021-05-22
Re: ভাইরাস
পশুর মত হিংস্র কালাম এক সময় সজোরে এক ধাক্কা দিয়ে পুরো দরজাসহ ঘরের ভেতর উপুড় হয়ে পড়ে। মিলিটারি টাল সামাল দিতে না পেরে দরজার একপাশে উলটে পড়ে। হাতে ধরে থাকা বাশটি একটু দূরে ছিটকে পড়ে যায়।
এদিকে রহিম বক্স প্রচণ্ড রকমে ধস্তাধস্তি জুড়ে দিয়েছে। একটি হাত খাট থেকে ছাড়িয়ে নিয়েছে, অন্যটি প্রায় খুলে যাচ্ছে। তার হাতের এক ধাক্কায় ছোট্টু উল্টে ঘরের কাঠের আলমিরার সাথে সজোরে এক বাড়ি খেয়ে নিচে বসে পরে। তারপর আস্তে একপাশে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
এদিকে মিলিটারি কোনরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাড়ানোর চেষ্টা করে। তার কাছে মনে হয় কয়েক মুহূর্তের জন্য তার চারপাশটা অন্ধকার হয়ে আসছে। তার পা দুটি অসাড় হয়ে আসছে।
কোনরকমে কনুইতে ভর করে বাশটির দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে মিলিটারি। হঠাৎ তার পিছনে একটি ঘরঘর শব্দ হলে পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখতে পায়, কালাম মাটির উপর হাঁটু ভাঁজ করে উঠে বসেছে। মিলিটারির দিকে তাকিয়ে তার মাথাটি একদিকে একটু কাত করে বাঁকিয়ে ফেলেছে, যেন স্থির দৃষ্টিতে কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করেছে।
কয়েক মুহূর্ত পরেই বাদরের মত এক লাফ দিয়ে মিলিটারির উপর আছড়ে পড়ে কালাম। মিলিটারি কোনরকমে তার দিকে ফিরে দুই হাতে সজোরে তাকে ঠেকানোর চেষ্টা করে যায়।
কালাম মিলিটারির মুখের সামনে মাথাটি নিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে, কিছু একটা বলার চেষ্টা করে কিন্তু তার গলা দিয়ে অস্ফূট গরগর শব্দ ছাড়া আর কিছুই বের হয় না। যেন এক ধরনের গোংগানীর মত শব্দ সেটি। তার সেই ভাষা বোধগম্য হয় না মিলিটারির কাছে।
মিলিটারির মুখের উপর কামর বসানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে কালাম। মিলিটারি কোন রকমে তার বুকে, গলায় হাত দিয়ে তাকে প্রানপণে ঠেকানোর চেষ্টা করে।
এই দিকে ঘরের দরজায় অন্য আরেকটি অবয়ব আবছা দেখতে পায় মিলিটারি।
একটি বীভৎস চেহারার ছায়া দাড়িয়ে আছে দরজায়। মুখ দিয়ে লালা ঝরছে। চোখ দুটি ঘোলা, ছানির মত এক ধরনের সাদা পর্দা পড়েছে। চেহারাটি বিকৃত, বুড়ো। চামড়া এবড়ো থেবড়ো।
অন্যদিকে রহিম বক্স তার অন্য হাতটিও ইতিমধ্যে ছাড়িয়ে ফেলেছে। পর মুহুর্তেই খাট থেকে লাফিয়ে মাটিতে উপুড় হয়ে পড়েছে। গড়িয়ে গড়িয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্ত তার পা দুটি খাটের অন্য দুটি কলামের সাথে আটকে থাকায় অনবরত হাতের নখ দিয়ে মাটিতে আচড়ে যাচ্ছে।
এদিকে তাকিয়ে দাত কিড়মিড় করছে। মুখ দিয়ে কুকুরের ঘেউ ঘেউ এর মত এক ধরনের আর্তনাদ করে চলছে।
মিলিটারি ঘরের চারপাশটায় একবার তাকায়। ছোট্টু মাটিতে লুটিয়ে আছে। সম্ভবত জ্ঞান হারিয়েছে। একবার মুখ হা করে ছোট্টুকে ডাকার চেষ্টা করেও আবার চুপ হয়ে পড়ে সে।
কারন হিংস্র বিভৎস লাশগুলির দৃষ্টি এখন মিলিটারি দিকে। ছোট্টুর নিথর দেহের দিকে কারো খেয়াল নেই। কোনভাবে সেগুলির নজর তার দিকে চলে গেলে তাকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে বাচ্চা ছেলেটিকে।
কালাম তখনো কামড় বসিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। মিলিটারি প্রানপনে তার কামড় থেকে নিজেকে বাঁচানোর আপ্রান চেষ্টা করছিল। কারণ সে জানে এই জন্তুটি কামড় দিয়ে বসলে আর তার রক্ষে নেই।
এখনো বাশটি মিলিটারির হাত থেকে বেশ খানিকটা দূরে। বাশটি পেলেই মিলিটারি কালামকে কোনভাবে আঘাত করে সরিয়ে দিতে পারত। যদিও কালাম প্রচন্ড ক্ষিপ্রগতির, হিংস্র পশুর ন্যায়। তবে শক্তিতে কোন রাক্ষসের মত নয়, যে তাকে হারানো সম্ভব না! তবে এটাও ঠিক তার সাথে খালি হাতে পেরে ওঠা সম্ভব নয়।
অনেকক্ষণ চেষ্টার পরেও মিলিটারি কালামের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারল না। অনেকটা অসহায়ভাবেই আত্মসমর্পণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল সে। তার শরীরের সব শক্তি যে ফুরিয়ে আসছে।
জীবনে লড়াই করেছে সে। অন্য দেশের সৈনিকের সাথে। মানুষের সাথে। কিন্তু এরকম অতিপ্রাকৃত কিছুর সাথে লড়াইয়ের অভ্যাস যে তার নেই।
তবে জীবনে অনেক কিছুই প্রথমবারের মতো করতে হয়। অনাকাঙ্খিত ভাবেই সেটির মোকাবেলা করতে হয়।
তাই আজ বাঁচতে হলে তাকে এটির সাথে লড়াই করেই বাঁচতে হবে। শেষ নিঃশ্বাস অবধি এই লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।
সে যে কাপুরুষ নয়! যেটি এই গ্রামের অনেকেই মনে করে। সে যুদ্ধ ছেড়ে চলে এসেছে ঠিকই কিন্তু এই ভয়ংকর যুদ্ধে হারবার জন্য নয়। চোখ দুটি বন্ধ হয়ে আসে মিলিটারির। সৃষ্টিকর্তাকে একবার স্মরণ করে। কারন এই যুদ্ধে বাচতে যে ভাগ্যের সহায়তাও একটু প্রয়োজন!
হঠাৎ করেই রহিম বক্স পেছন থেকে কালামের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। রহিম বক্স কোনভাবে খাটের কলামগুলি থেকে নিজের পা ছাড়িয়ে নিয়েছে। খাটের কলামের একটি ভাঙ্গা কাঠের অংশ তার পায়ের সাথে দড়ি দিয়ে ঝুলছে।
রহিম বক্সের অতর্কিত হামলায় কালাম ভারসাম্য হারিয়ে এক পাশে পরে যায়।
কালাম উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই দুজনে জড়াজড়ি করে মাটিতে ছিটকে পড়ে। শুরু হয় তাদের মধ্যে ধস্তাধস্তি। সে এক ভয়ঙ্কর ব্যাপার। দেখে মনে হচ্ছিল বাঘে-সিংহের লড়াই লেগেছে। চিৎকার হুংকারে চারিদিকটা গমগম করে উঠছে।
কথায় আছে ভাগ্য সাহসীদের সঙ্গ দেয়। মিলিটারি এই সুযোগে কোন রকমে নিজেকে টেনে হিঁচড়ে বাশটির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এদিকে অন্য অবয়বটি তার নড়াচড়া দেখতে পেয়ে হিংস্র বেগে চিৎকার করতে করতে তার দিকে ছুটে আসতে থাকে। মিলিটারি বাশটি কোনরকমে হাতের নাগালে পেতেই সেটি ধরে বুড়ো লাশটির মুখে সজোরে একটি আঘাত করে বসে।
এক আঘাতে সেটি ছিটকে ঘরের বেড়ার সাথে গিয়ে আছড়ে পড়ে।
মুহূর্তেই মিলিটারির রক্তের ভেতর দিয়ে এক ধরনের উষ্ণ স্রোত বয়ে যায়। সে নিজের ভেতরে এক ধরনের সাহস ও শক্তি অনুভব করে। মাটি থেকে উঠে দাঁড়ায়।
দৌড়ে ছোট্টু কাছে এগিয়ে যায় মিলিটারি। তার গালে কষে কয়েকটা থাপ্পর দেয়। এতে কিছুটা যেন কাজ হয়। ছোট্টু অল্প করে তার চোখের পাতাগুলি মেলে তাকায়।
মিলিটারি তার হাত ধরে টেনে ঘরের পেছনের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। ছোট্ট কিছু একটা বুঝতে পেরে দুর্বল ভঙ্গিতে ভাঙ্গা ভাঙ্গা পায়ে মিলিটারির সাথে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।
মিলিটারি পিছনে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। অন্য অবয়বটিও ইতিমধ্যে রহিম বক্স এর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। যেন তিন ভয়ঙ্কর হিংস্র দানবের লড়াই চলছে। তাদের গর্জনে চারিদিকটা গমগম করে উঠছে। মিলিটারি এই অন্ধকার ঝোপের মধ্য দিয়ে কোনরকমে ছোট্টুকে টেনে হেচড়ে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলে। পেছনে তাকানোর সময় যে নেই তার।
RabbY khan, Debasis sorkar, Sm samim, Alom khan, Salman reja, Foisal Hossain, Rajesh mondol and লেখাটি পছন্দ করেছে
- M A Nayeemশুকতারা
- Posts : 68
স্বর্ণমুদ্রা : 1470
মর্যাদা : 20
Join date : 2021-05-22
Re: ভাইরাস
ছুটে চলছে মিলিটারি। দিগিত্তিক জ্ঞান হারিয়ে ছুটে চলছে যতদূর চোখ যায়। ছোট্টু মাঝেমধ্যেই থেমে যাচ্ছে। বসে পড়ে হাপাচ্ছে। মিলিটারি আবার তার হাত টেনে ধরে তুলছে। জোর করে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। জঙ্গল ঝোপঝাড় পেরিয়ে একটি ধান ক্ষেতের মধ্য দিয়ে ছুটে চলছে তারা। ছুটে চলছে কোন এক অজানা গন্তব্যে।
মিলিটারি জানে না এই যাত্রায় রহিম বক্সের রক্ষা হবে কিনা। হয়তো বাকিরা তাকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে। অথবা হতে পারে তার ভাই কালাম তাদের হাতে মারা পড়বে।
মিলিটারির চোখদুটি জলে ভিজে যায়। একে একে সবাইকে হারানোর বেদনা যেন তাকে গ্রাস করে ফেলছে।
এ যে যুদ্ধের চেয়েও ভয়ংকর, অবর্ণনীয় নিষ্ঠুর এক লড়াই। এখানে লড়তে হয় নিজের আপন মানুষের সাথে।
তকালই যে ভাইটির সাথে কথা হয়েছে, রাগারাগি খুনসুটি হয়েছে। আজই তার সাথে লড়তে হচ্ছে। তাও সেটি কি কারনে! ভাবতেই গা শিউরে উঠে যেন!
ভাই ভাইকে ভক্ষণ করতে চাচ্ছে। পিতা-পুত্রের মাংস খেতে চাইছে। এটি কি মানুষ কোনদিন কল্পনাও করতে পেরেছে!
দুই দিন আগেই যে ছোট্টু বাবা বাবা করেছে, বাবার হাতের খেলনার জন্য অপেক্ষা করেছে, আজ সেই ছোট্টু বাবার হাতে ভক্ষনের ভয়ে গ্রাম ছাড়া হচ্ছে।
এ যেন নরকের ভয়াবহতাকেও হার মানায়। রক্ষক যে ভক্ষকে পরিণত হয়েছে।
এই নিষ্ঠুরতার শেষ কোথায়? জানে না সে। নাকি এটি সবে শুরু? তাও জানে না।
মানবজাতি কি পারবে এই ভয়াবহতাকে পরাস্ত করতে?
অতীতে অনেক যুদ্ধ হয়েছে পৃথিবীতে কিন্তু এরকম কোন যুদ্ধ তো ঘটেনি।
মানুষ কি পারবে এই নতুন যুদ্ধে জয়ী হতে? নাকি হেরে যাবে! চলে যাবে বিলুপ্তির পথে।
মিলিটারির চোখদুটি ছল ছল করে ওঠে। বুকের ভেতর থেকে বোবা কান্না বেরিয়ে আসতে চায়। কিন্তু তাকে যে শক্ত হতে হবে। এখন যে হেরে গেলে চলবে না। যতক্ষণ প্রাণ আছে বেঁচে থাকার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
ছুটতে ছুটতে ছোট্টুর দিকে একবার তাকায় সে। এই দৌড়ঝাপে যতটা না সে ক্লান্ত তার চেয়ে বেশি ক্লান্ত মানসিকভাবে। ষোল কি সতের বয়স তার। এই বয়সে এরকম ভয়াবহতার সাক্ষী হতে হয়েছে তাকে। দুই দিনের ব্যবধানে পরিবার-পরিজনের সবাইকে হারাতে হয়েছে।
তাও তো সে বুকে একটি আশা বাধতে পারে, তার মা ভাইদের ফিরে পাওয়ার। কিন্তু মিলিটার?
সে তো সবাইকে হারিয়েছে। মাকে হারানোর ক্ষত না শুকাতেই ভাইকে হারাতে হয়েছে তাকে।
মিলিটারি জানে না কালামের উপর রহিম বক্স কেন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল? হতে পারে মিলিটারি কালামের নিচে ছিল, তাই রহিম বক্স এর কাছে কালামের গতিবিধি নজরে পড়েছে।
এই লাশগুলি কোন ধরনের গতিবিধি লক্ষ্য করলেই সেটির উপরে ঝাপিয়ে পড়ে। ছোট্টু নিথর হয়ে পড়েছিল, ছোট্টুর উপর কেউ আক্রমণ করেনি। মিলিটারি ছুটাছুটি করেছে তার ওপরই হামলা হয়েছে।
ভোরের আলো কিছুটা ফুটে উঠছে। মিলিটারির চোখের পাতা দুটি ভারী হয়ে আসছে। পা দুটি অসাড় হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে কতদিন ঘুমায় না সে! কত বছর ধরে না জানি দৌড়ে চলছে!
.
সকাল হতেই সামসু ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। ছুটতে থাকে গঞ্জের পথে। হাশেমের জন্য ওষুধ আনতে হবে যে।
হাসেমের শ্বাসকষ্ট এর রোগ আছে। তাছাড়া জ্বর পায়খানার ওষুধও তো লাগবে।
হাসেমকে সাহায্য করার কেউ নেই। স্ত্রী আর মাকে সপ্তাহখানেক আগেই সে চাচার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে।
নিজের অসুস্থতার জন্য তাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে দূরে সরিয়ে রেখেছে।
কিন্তু এখন সে যে নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সামসু ছাড়া তাকে সাহায্য করার আর কেউ যে নেই।
বেশ কয়েকদিন পর ঘর থেকে বেরিয়েছে সামসু। ইতিমধ্যে যেন গ্রামে অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে। অনেকেই গ্রাম ছাড়া হয়ে পড়েছে। ঘরগুলি শুন্য। গোয়াল ঘর শুন্য। পশুর বিচরণ নেই। মাঠে কৃষক নেই। রাস্তায় মানুষজন নেই।
রহমান চাচার দোকানটিও বন্ধ। যেন কোথাও যুদ্ধ লেগে গেছে। মানুষ গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে পালিয়ে গেছে।
কিছু কিছু ঘর বাড়িতে মানুষ থাকলেও ঘরের জানালা দরজা সব বন্ধ করে রেখেছে। যেন বাইরে বাঘ ভল্লুক ঘুরে বেড়াচ্ছে। বের হওয়া বারণ।
একটা সময় গঞ্জে এসে পৌঁছায় সামসু। কিন্তু এখানে এসে সে যেন আরো হতবাক হয়ে যায়। দোকানপাট কিছুই খোলা নেই। সব বন্ধ। দেখে মনে হয় দীর্ঘদিন যাবত এই দোকানগুলির কপাটটিও কেউ খোলেনি।
অনেক খোঁজাখুঁজির পর একটি ওষুধের দোকান খোলা পেল সামসু। এক দৌড়ে দোকানটির সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই, দোকানদার হকচকিয়ে তার দিকে মাথা তুলে তাকালো।
তাকে দেখেই আতঙ্কে এক ধরনের চিৎকার বেড়িয়ে এল তার গলা থেকে।
শামসু না তুই! সামসুর দিকে তাকিয়ে বলল লোকটি। সামসু লোকটিকে চিনতে পাড়ল৷ তার বাবা মা বেঁচে থাকতে অনেকবার বাড়িতে এসেছে। মায়ের হাতে রান্না খেয়েছে৷
ইসহাক চাচা! সামসু কিছুটা খুশিতে চেঁচিয়ে উঠলো।
তুই বাইরে কি করছ? তোর তো ঘরের ভিতর বন্দি থাকার কথা! তার ইসাক চাচা যেন তাকে দেখে খুব একটা খুশি হতে পারেনি।
সামসু হাত নেড়ে তাকে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করে। কিন্তু যেন অবুঝের মতো তার কোন কথাই শুনতে পায় না সে। দোকানের কপাটগুলি লাগিয়ে দিতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। সামসুকে দেখে দূর দূর করে।
সামসু দোকান থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে দাড়ায়। ইসহাক চাচার উদ্দেশ্যে বলে, আমরারে দুইপাতা ওষুধ দাও চাচা! আমি এখনই চইলে যাইতেছি!
ইসাক সামসুর মুখের উপর সজোরে দোকানের কপাটগুলি আটকে দেয়। ভেতর থেকে চেচিয়ে বলে ওঠে, দেখ সামসু! আমি ওষুধ বেচার জইন্য দোকান খুলি নাই! আমার মাইয়াটা খুব অসুস্থ, তাই ঔষধ নিতে দোকানে আইসি।
শামসু তার কাছে আর্তনাদ করে, বলে, আমারারে দুইটা ওষুধ দিয়া দাও, চাচা। একটু দয়া করো।
ইসহাক চাচা আর কোন উত্তর দেয় না। নিষ্ঠুরের মতো দোকানের ভেতর মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকে।
এবার শামসু দোকানের একটু কাছে এগিয়ে যায়। কপাটে নক করতেই খ্যাপা ষাঁড়ের মত চিৎকার করে ওঠে ইসাক চাচা। তারপর তাকে উদ্দেশ্য করে গালাগাল করতে করতে বদদোয়া দিতে থাকে।
অগত্যা সামসু সেখান থেকে সরে পড়ে। একটু রাগ হয় তার। ভাবে, বিপদে পড়লে মানুষ কত পরিবর্তন হয়ে যায়!এই ইসহাক চাচা তার বাবা মা বেচে থাকতে কতো তাদের বাড়িতে এসেছে। তার মা তাকে নিজ হাতে রান্না করে খাইয়েছে। আজ তার কাছ থেকে দুই পাতা ওষুধ পেল না সে! তাকে কুকুরের মত দুর দুর করে তাড়িয়ে দিল! (চলবে)
RabbY khan, Debasis sorkar, Maruf khan, Sm samim, Alom khan, Salman reja, Foisal Hossain and লেখাটি পছন্দ করেছে
- M A Nayeemশুকতারা
- Posts : 68
স্বর্ণমুদ্রা : 1470
মর্যাদা : 20
Join date : 2021-05-22
Re: ভাইরাস
মাথায় ঘোমটার মতো করে গামছা পেচিয়ে গঞ্জ থেকে বাড়ি ফিরছিল, সামসু। গামছা এক হাতে টেনে মুখ ঢাকা তার। এদিক সেদিক তাকাতে তাকাতে দ্রুত পায়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে চলছে সে।
পথিমধ্যে হারিস দেওয়ানের বাড়ি এক ধরনের ভিড়ভাট্টা হট্টগোল দেখে থেমে পড়ে সামসু। বাড়ির বেড়ার সাথে গা ঘেঁষে নিঃশব্দে দাঁড়ায়।
বাড়ির ভেতর থেকে এক ধরনের আহাজারীর শব্দ তার কানে ভেসে আসে। হারিস দেওয়ানের ইটের দালানের সামনের উঠোনে তার স্ত্রী মাটিতে বসে বুক চাপড়াচ্ছে।
সামনে একটি লাশ কাফনের কাপরে মুড়ানো। পাশেই সবুর দেওয়ান তার মায়ের কাঁধে হাত রেখে তাকে থামানোর চেষ্টা করে চলছে। হারিস দেওয়ানের স্ত্রী ছেলের হাত দুটি বার বার সরিয়ে দিচ্ছে। চিৎকার করে বলছে, কই ছিলি সারারাইত! আমানুষের বাচ্চা!
সবুর দেওয়ান সারারাত গঞ্জে ছিল। গোপন মদের আসরে তার প্রতিদিনকার আড্ডা। গ্রামে এত কিছুর ঘটে যাবার পরেও তাদের এই আড্ডা থামেনি।
সে বাড়িতে থাকলে হয়তোবা আজ তার বাপের এই করুন মৃত্যু দেখতে হতো না। মদের নেশার বুদ হয়ে শেষ পর্যন্ত চরম মূল্য দিতে হলো তাকে।
রাতে হারিস দেওয়ান বাইরে পায়খানায় গেলে, পাগলাটে কিছু মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে তার উপর। মুহূর্তেই তার দেহটি ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলে।
গ্রামের অনেকেই বলে বেড়াচ্ছে, জিন ভূতের আছর পড়েছে গ্রামে। কিন্তু সবুর সেটা বিশ্বাস করতে নারাজ। তার পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা শফিকের দিকে তাকিয়ে, চোখে মুখে একরাশ হতাশা নিয়ে বলে, সগির মুন্সিকে খুজে বের কর। ওর উম্মাদ বাপ এইসবের সাথে জড়িত।
শফিক তাঁর হাতে ধরা মোটা বাশটি দিয়ে সজোরে মাটিতে আঘাত করে। ঠক করে একটি শব্দ হয়। সামসুর বুকটি যেন কেঁপে ওঠে তাতে। মাথার ঘোমটাটা আরেকটু বাড়িয়ে বড় বড় পদক্ষেপে বাড়ির দিকে ছুটে চলে।
বাড়িতে পৌঁছেই দরজায় ঠকঠক আঘাত করলে, তড়িঘড়ি করে শামসুর বউ দরজা খুলে তাকে ভেতরে আসতে বলে।
ঘরে ঢুকেই সামসু দেখতে পায়, খাটের উপর মিলিটারি বসে আছে। পাশেই রহিম বক্সের বড় ছেলে এক কাত হয়ে শুয়ে ঘুমোচ্ছে।
মিলিটারির সামনে এক বোল গুড়-মুড়ি রাখা, পাশেই একটি পানি ভর্তি জগ। পানির গ্লাসে এক চুমুক দিয়ে মুখ ভর্তি মুড়ি নিয়ে চিবোতে চিবোতে সামসুর দিকে মুখ তুলে তাকায় সে। সামসুকে দেখে তার খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়, চোখদুটি ছল ছল করে ওঠে।
খারাপ কিছু একটা আঁচ করতে পেরে সামসু ভয়ার্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, কি হইছে মিয়া ভাই!
.
শফিক তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে ভরদুপুরে সগীর মুন্সির বাড়িতে আসে। সগির মুন্সি আতঙ্কে দরজা জানালা সব বন্ধ করে ঘরের ভেতর বসে আছে। শফিক দুই তিনবার হাক ছেড়ে তাকে ঘর থেকে বের হতে বলে। সগির ভেতর থেকে উত্তর দেয় না।
কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পর তার স্ত্রী জবাব দেয়, ভাইসাব, আপনেরা পরে আসেন।
কথাটি যেন শফিক সহ্য করতে পারে না। আতে ঘা লাগে তার। তেড়ে ফুঁড়ে বলে উঠে, ওই বান্দি! অরে ঘর থাইকা বাইর হইতে বল। নয়তো তোগোর সবাইরে পিটায়ে লাশ বানায় ফেলমু!
শফিকের হুংকার শুনে ভেতর থেকে কিছুক্ষন কেউ কোন সাড়া শব্দ করে না। একটু পরে সগীর মুন্সী তার স্ত্রী কন্যাকে ঘরে রেখে ধীরে দরজার কপাট খুলে বাইরে বেরিয়ে আসে।
কিছু হইসে, মিয়া ভাই? আমতা আমতা স্বরে জিজ্ঞেস করে। সগির মুন্সির শরীরটা ভালো নেই। কিন্তু সে সেটি কোনভাবেই প্রকাশ করে না।
শফিক তার দিকে তাকিয়ে হাক ছেড়ে বলে, আমাদের সাথে চল!
কই যামু, ভাইজান?
শফিক কোন জবাব দেয় না। এক রকম কঠিন দৃষ্টি নিয়ে সগির মুন্সির দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চোয়াল দুটি একটু যেন নড়ে ওঠে। ভেতরে দাঁত কিড়মিড় করে।
এক রকম জোর করেই সগির মুন্সির হাত টেনে তাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে সে। সগির মুন্সি প্রথমে একবার বাধা দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু বাকি দুজনও তাকে চেপে ধরলে একপর্যায়ে হাল ছেড়ে দেয় সে। প্রায় এক রকম জোর করেই তিনজনে মিলে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যেতে থাকে তাকে।
.
রফিক চাচা ও তার স্ত্রী বাড়ি থেকে বের হয় না অনেকদিন। গ্রামও ছাড়ার উপায় নেই তাদের। এই গ্রামের বাইরে তাদের জানাশোনা কেউ নেই। কিন্তু ওপাশে মিন্টুর লাশ পচে গলে এলাকায় গন্ধ ছড়িয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত কেউ লাশটি সৎকারের ব্যাবস্থা করেনি। তাদের পাশে আরেক যে প্রতিবেশী ছিল, তারাও অন্য গ্রামে চলে গেছে।
রফিক চাচার জন্য এখানে থাকাটা এখন প্রায় মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। না পাড়ছে বাড়ি থেকে বের হতে, না কিছু করতে।
এদিকে গ্রামের অনেকেই ঘর ছাড়া হয়ে গেছে। গ্রামে নাকি জিন ভুত ভর করেছে। অনেকেই নাকি রাত বিরাতে দেখেছে। তার ওপর রয়েছে ভাইরাসের উৎপাত। মানুষ এই রোগে মারা যাচ্ছে।
এদিকে আজ সকালে জানতে পারে হারিস দেওয়ান মারা গেছে। কে বা কারা তাকে মেরে ফেলে রেখে চলে গেছে।
তবে কী গ্রামে চোর ডাকাতও পড়তে শুরু করেছে। অন্যদিকে তার বাড়িতে খাদ্যভাব শুরু হয়ে গেছে। চাল ডাল প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। এভাবে আর কতদিন চলবে জানা নেই।
আবার বাড়ির বাইরে বের হতেও ভয় লাগে। একবার ভাবে আকবরের মেম্বারের কাছে যাবে অথবা থানা পুলিশ করবে কিন্তু পরক্ষনেই ভয়ে পিছিয়ে পড়ে। বাইরে গেলে না আবার ভাইরাস সাথে করে নিয়ে আসে। তাছাড়া চোর ডাকাত, জিন ভুতের বিষয়টির কথাও তো এখন আর অবহেলা করা যাচ্ছে না!
.
মিলিটারি ছোটুর মা আর ভাইদের খুঁজতে বেরিয়ে পড়েছে সেই সাত সকালে। সামসুকে বুঝিয়ে দিয়ে এসেছে, হাসেমের দিকে লক্ষ্য রাখতে। সে কোন উদ্ভট আচরণ করে কিনা খেয়াল রাখতে।
এদিকে মিলিটারির শরীরটাও ভালো নেই। বুকটা কেমন যেন ভারী হয়ে আসছে তার। শরীর অসার হয়ে আসছে। অনেকটা এই কারনেই সামসুর বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়েছে সে।
মিলিটারি নিজে একবার তার শরীর হাত পা ভালোভাবে পরীক্ষা করে।
নাহ, তার শরীরে কোন ক্ষত নেই! কিন্তু এই দুর্বলতা কেনো তাকে এতো পেয়ে বসেছে?
মাথার উপর খাড়া রৌদ্রে ধান ক্ষেতের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হটাতই তার খুব পানির তেষ্টা পায়।
তারপরেই যেন মিলিটারি আর কিছুই ভাবতে পারে না। তার চারপাশটা যেন ঘুরে যেতে শুরু করে। হঠাৎই করেই যেন শরীরের সব বল হারিয়ে ফেলে।
.
সগির মুন্সিকে টেনেহিঁচড়ে একটি মাঠে নিয়ে এসেছে শফিক ও তার দল। একটু পরেই রাস্তার পাশে একটি বাইক এসে থামল। সবুর দেওয়ান বাইকটি থেকে নেমে মাঠের দিকে হেটে আসতে লাগল।
সবুর দেওয়ান কিছু বলে ওঠার আগেই শফিক তার মোটা বাশটি দিয়ে সগির মুন্সির পায়ের উপর সজোরে একটি আঘাত করে বসে। সগির মুন্সি এক চিৎকার করে মাটিতে আছড়ে পড়ে যায়। ব্যথায় কষ্টে বুকে ফেটে আর্তনাদ করতে থাকে।
সবুর দেওয়ান চোখ মুখ বাঁকিয়ে হিংস্র ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে, বল, তোর বুড়া বাপকে কোথায় লুকায়ে রাখছোস! বল, হারামজাদা!
সগির মুন্সি মুখ দিয়ে এক ধরনের অস্ফুট শব্দ করতে থাকে আর দুই পায়ে হাত দিয়ে ব্যথায় কুকড়ে ওঠে।
এবার যেন সবুর দেওয়ানের ধৈর্যের বাধ ভেঙে যায়। শহর থেকে কিনে আনা গায়ে জড়ানো দামী প্যান্টটিসহ হাটুগেড়ে মাটিতে বসে পড়ে। তারপর সগির মুন্সির কলার টেনে তার মুখের সামনে মুখ নিয়ে বলে, তর বাপ কালকে একটা মানুষ মাইরা ফেলসে! বুঝছোস? তুই কি মনে করস আমি কিছুই জানি না! এখনো সময় আছে বল! নয়তো আজ তোর বউ বাচ্চার কাছে তরে না তর লাশ পাঠামু!
সগির মুন্সি এবার একটু কাকুতি মিনতি করতে থাকে। ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলে, বলতাসি, সব বলতাসি ভাই সাব!
সবুর দেওয়ান স্থির দৃষ্টিতে তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
RabbY khan, Debasis sorkar, Maruf khan, Sm samim, Alom khan, Salman reja, Foisal Hossain and লেখাটি পছন্দ করেছে
- M A Nayeemশুকতারা
- Posts : 68
স্বর্ণমুদ্রা : 1470
মর্যাদা : 20
Join date : 2021-05-22
Re: ভাইরাস
বাজানে মিন্টু ভাইয়ের বাড়ি গেছিল, তার মায়ের লাশ দাফন করবার জন্য। সগির মুন্সি গরগর করে বলতে থাকে। বাড়িতে আসার দুই দিন পর থাইকা বাজানের শরীরটা খারাপ হইতে শুরু করে। অস্থির হইয়া পড়ে সে। আমি কিছু ওষুধপত্র বহু কষ্টে গঞ্জ থাইকা আইনা দিলাম কিন্তু সেগুলি খাইয়াও কোন কাজ হইল না। বরং শরীর আরো খারাপ হইয়া পড়ল তার। জ্বর কাশির সাথে রক্ত আমাশা শুরু হইল। একটু থামলো সগির। পায়ে হাত দিতেই ব্যথায় একবার কুকড়ে উঠল। তারপর একটা বড় শ্বাস নিয়ে আবার বলতে শুরু করল। দিন দিন বাজানের শরীরের অবস্থা আরো খারাপ হইয়া যাইতে লাগলো। একটা সময় খাওন দাওন বন্ধ হইয়া গেল। মুখে তুইলা দিলেও কিছুই খাইবার চাইতো না। হঠাৎ কইরাই তার পাগলামি আরো বাড়তে লাগলো। একদিন রান্না করার জন্য হাড়িতে রাখা কাঁচা মাংসের উপর লাফ দিয়া পড়ল। আমার বউ আইসা দেখল সে সমানে কাচা মাংস গিলতাসে।
কি বললা মিয়া! সগির মুন্সিকে থামিয়ে দিল সবুর দেওয়ান। এই কথাটি হজম করতে পারছিল না সে। বিস্ময় নিয়ে শফিকের দিকে একবার তাকালো।
ওই! কথাবার্তা ঠিক কইরা ক! একটা ধমক দিল শফিক। হাতের বাশটা তুলতেই দুই হাত উঁচু করে নিজেকে বাচানোর চেষ্টা করে সগির মুন্সি। কেদো কেদো গলায় বলে, মিয়া ভাই, একটা কথাও বানাই বলি নাই। খোদার কসম!
শফিক তার পেটে বাশ দিয়ে একটা গুতো দিতে গেলে সবুর তাকে থামিয়ে দিল, বলল, দাড়া, বলতে দে ওরে।
শফিক থেমে গেলে সগির মুন্সি আবার বলতে শুরু করল। বাজানে দিনের বেলা বাইরে বাইর হইবার চাইতো না। নিস্তেজ হইয়া পড়তো। কিন্তু রাইত হইলে অস্থিরতা করতো। মুখ দিয়া লালা পড়তো আর দাত মুখ খিচাইতো। খাওন দাওন ছাইড়া দিলে আমরা এক সময় বাধ্য হইয়া তারে মুরগির কাচা মাংস খাওয়ানো শুরু করি।
ওই, শালার পো শালা! মশকরা করছ! এবার যেন মেজাজ আর ধরে রাখতে পারল না শফিক। বারি আরেক ঘা দিয়েই বসল। সঙ্গে সঙ্গে 'ও মাগো' বলে এক লাফ দিয়ে কাতরাতে শুরু করল সগির।
শফিককে এবার হাত দিয়ে বাধা দিল সবুর দেওয়ান। আরে রাখ! এক রকম কটমট করে তার দিকে তাকালো।
সগির এবার চুপ হয়ে গেল। কথা বলা বন্ধ করে দিল। সবুর ওর দিকে তাকিয়ে তাকে আশ্বস্ত করল। ঠান্ডা গলায় বলল, শফিক আর কিছু কইবো না তরে। বাকিটা বল।
সগির মুন্সি ডানে বামে মাথা নাড়তে থাকল। এবার হাটু গেড়ে বসল সবুর, সগিরের ভয়ার্ত চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, তোর বাপেরে কি কোন পাগলা কুত্তা বিলাই কামড়াইছিলো?
সগির দ্রুত মাথা নাড়ে। বলে, আমি তার পুরা শরীর পরিক্ষা কইরা দেখছি, মিয়া ভাই। তাছাড়া জলে তার কোন ভয়ও ছিল না। জল সে চাইতো। কিন্তু কোন খাবার মুখে নিতো না।
দিনের বেলা কি হইতো? বাইরে বাইর হইতে চাইতো না কেন?
কি জানি? তয় আমার কাছে মনে হইসে আলো সইতে পারতো না। চোখ বন্ধ কইরা ফালাইতো।
তারপর ... থেমে গেল সগির।
তারপর কি?
তারপর একদিন রাইতের বেলা এতো অস্থিরতা শুরু করল, আমরা তারে আর ধইরা রাখবার পারলাম না। একটু ইতস্তত করে বলল, আমরার সাথে প্রায় হাতাহাতি কইরা দরজার খিল ভাইঙ্গে বাইর হইয়া গেল।
তোগো কাউরে কামরায় টামরায় নাই তো? শফিক গলা বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল।
সাথে সাথে ডানে বামে মাথা নেড়ে উঠল সগির।
সবুর দেওয়ান তীক্ষ দৃষ্টি নিয়ে সগির মুন্সির দিকে তাকিয়ে বলল, কথা ঠিক তো রে, সগির?
হ, মিয়া ভাই। নিচের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল সগির।
.
সন্ধ্য নেমে আসার সাথে সাথে হাসেমের অস্থিরতা যেন আরও বেড়ে গেল। ঘরের জিনিস পত্র ছুড়তে শুরু করল। নিজে নিজে চিৎকার-চেচামেচি করতে লাগলো।
হইচই শুনে পাশের বাড়ি থেকে দৌড়ে সামসু আর ছোট্টু তার ঘরের সামনে এসে কড়া নাড়ল।
হাসেম কিছুক্ষন কোন কথা বলল না।
তারপর ভেতর থেকে একটু অস্থির গলায় উত্তর দিল, সামসু ভাই! তোমরা কেউ ভিতরে আইসো না! বাইরে দিয়া দরজা লাগায় দেও।
সামসু বিস্ময়ে ছোট্টর দিকে তকালো। ছোট্ট দ্রুত তার মাথা উপর নীচ করল। সামসুর বোঝা হয়ে গেল অনেক বেশি দেরী হয়ে গেছে। হাসেম আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।
দরজার কড়া বাধার জন্য দড়ি খুজে আনতে উঠনে গেল সামসু। ছোট্টু দরজার কড়া দুটি শক্ত করে ধরে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
এইদিকে ভেতরে হাশেমের চিৎকার-চেঁচামেচি আরো বেড়ে গেছে। ছোট্টুর কাছে মনে হল এবার কিছু একটার সাথে নিজের মাথা ঠুকছে সে। ঠিক যেন তার বাজানের মতো, সেই একই রকমের অস্থিরতা, আর্তচিৎকার! যেন কোন অসহ্য যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সে।
ছোট্ট উঠানের দিকে ফিরে ফিরে তাকাতে থাকলো।
সামসু ভাই এখনো দড়ি নিয়ে আসেনি!
.
সগির মুন্সি বাড়িতে ফিরতেই হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। তার স্ত্রী কন্যা বাড়িতে নেই! মুহুর্তেই সে ঘরের ভেতর ঢুকে চিৎকার করতে থাকে। স্ত্রীর নাম ধরে ডাকতে থাকে। এই ঘর, ওই ঘর হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে।
তারপর দৌড়ে উঠোনে চলে আসে সে। বাড়ির কাচা পায়খানাটির দিকে এগিয়ে যায়। কোথাও কিছু না পেয়ে বাড়ির পেছনে লাউ গাছের মাচার কাছে গিয়ে হাক ছাড়তে থাকে। মেয়ের নাম ধরে ডাকতে থাকে। কিন্তু পুরো বাড়ি জুড়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কারো হদিস পায় না।
তার বউয়ের এক হাতে বাজান একটা কামড় দিছিলো! কিছুদিন যাবৎ দিনের বেলা বেশি একটা বের হতে চাইতো না তার বউ। সূর্যের আলো মোটেই সহ্য করতে পারত না। চোখে গিয়ে লাগতো খুব। খাওয়া-দাওয়াও ছেড়ে দিয়েছিল একদম।
এবার এক ভয়ঙ্কর চিন্তায় পড়ে গেল সগির মুন্সি। তার মেয়েটা গেল কই?
.
সামসু কোথা থেকে এক গোছা দড়ি যোগাড় করে নিয়ে এল। একবার ছট্টুর দিকে তাকাল। ছট্টু ভয়ার্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
দেরী না করে দ্রুত দরজার কড়া বাধতে শুরু করল সামসু। কড়া বাধার সময় তার হাত দুটি কেপে কেপে উঠছিল। ঘরের ভেতর হাসেমের পাশবিক আর্তনাদ যে বেড়েই চলছে। ভেতর থেকে ভাংচুরের শব্দ ভেসে আসছে। যেন তার উপর জিন ভূতে আছড় করেছে। কড়াটি শক্ত করে বেধে দুজনেই পড়িমড়ি করে কোন রকমে ঘরের দিকে ছুটতে শুরু করে। চলবে।
RabbY khan, Debasis sorkar, Maruf khan, Sm samim, Alom khan, Salman reja, Foisal Hossain and লেখাটি পছন্দ করেছে
- M A Nayeemশুকতারা
- Posts : 68
স্বর্ণমুদ্রা : 1470
মর্যাদা : 20
Join date : 2021-05-22
Re: ভাইরাস
একটু আগে মিলিটারির জ্ঞান ফিরেছে। জ্ঞান ফিরতেই নিজেকে একটি ধান ক্ষেতের আইলের উপর পড়ে থাকা অবস্থায় আবিষ্কার করে সে। চারপাশটা অন্ধকার তার। আকাশে থালার ন্যায় চাঁদ উঠেছে। চারিদিকটা আলোকিত করে রেখেছে। কতক্ষন এভাবে অচেতন অবস্থায় পড়ে ছিল জানা নেই। তেমন একটা বলও পাচ্ছে না শরীরে। কোনরকমে নিজেকে উঠিয়ে টেনেটুনে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল মিলিটারি।
.
হাসেম পাশের বাড়িতে বসে এই রাত দুপুরে কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে। সামসু একবার ওপাশে তার সাথে দেখা করতে যেতে চাইলে ছোট্টু তার দুই হাত জোর করে তাকে যেতে বাধা দেয়।
কালাম চাচাও এই একই রকম আচরণ করছিল। তারপর হঠাৎ কইরেই সবকিছু পরিবর্তন হইয়ে গেছিল সেদিন। কিছু একটা ভেবে ছোটুর চোখদুটি ছল ছল করে উঠলো। কেঁদো কেঁদো কন্ঠে আবার বলে, আমরার সবারই একই অবস্থা হইবার যাইতেছে, তাই না চাচা!
শামসু কোন উত্তর দিল না। আসলে সামসুর কাছে এর কোন উত্তর নেই। ছোট্টর দিকে হাত বাড়িয়ে তাকে আগলে বুকের সাথে জড়িয়ে নিল।
.
সবুর দেওয়ান শফিক ও তার সাঙ্গোপাঙ্গদের সাথে নিয়ে তার পাকা দালানের ভেতরে একটি কক্ষের দরজা-জানালা সব বন্ধ করে বসে বৈঠক করছে।
শফিকের সাথে থাকা একটা চ্যালা সবুর দেওয়ানের উদ্দেশ্যে বলল, মিয়া ভাই, আমি মিলিটারির ভাই কালামরেও দেখসি পাগলা কুত্তার মতো সেই দিন রাইতে দৌড়াইতাছে। আমি বাইকে ছিলাম। জোরে টান দিয়া বাড়ি চইলা আইসি।
পেছন থেকে আরেকজন বলে উঠল, আমিও পুব পাড়ার এক জনরে রাইত বিরাইতে ছন্নছাড়ার মতো ঘুইরা বেড়াইবার দেখছি। আমার কাছে হের আচরণও সন্দেহজনক মনে হইছিল।
সবুর দেওয়ানের চোখে-মুখে চিন্তার ছাপ। কিছুক্ষণ চুপ থেকে দাত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়াতে কামড়াতে বলল, এই পাগলগুলি রাইতের বেলা বাইর হয়। সগির মুন্সির কথাই ঠিক। কিন্তু আমি বুঝবার পারতাসি না এগুলি মানুষের উপর ঝাপায় পড়ে কেন!
আরে বুঝলেন না, মিয়াভাই! কাঁচা মাংস খায় এগুলা! আপনার বাপেরে ছিন্নভিন্ন কইরা খাইছে না! হঠাৎই শফিক তাঁর বাজখাঁই গলায় খেঁকিয়ে উঠলো। মুহুর্তেই হুট করে মাথা তুলে তার দিকে তাকাল সাবুর। তার তাকানোর ভঙ্গি দেখে শফিক বুঝতে পারল মুখ ফসকে ভুল কথা বেরিয়ে গেছে তার।
শফিক কোন কথা বলতে পারল না। কাচুমাচু করে এপাশ ওপাশ তাকাতে থাকল।
কিছুক্ষনের জন্য একদম চুপ মেরে গেলো সবুর। তার মনটা হঠাৎ করেই খারাপ হয়ে গেছে। সে বুঝতে পারছে একইভাবে রহমান চাচার লাশও কেউ আধ খাওয়া করে খেয়ে ফেলে রেখে গেছে। সেগুলো কোন জংলি জানোয়ার, পাগলা কুত্তা নয়। বরং এই পাগল মানুষগুলি!
.
এদিকে হাশেমের চিৎকার-চেঁচামেচি হঠাৎ করেই থেমে গেছে। সর্বশেষ তার একটি আর্তচিৎকার শুনতে পেয়েছে ছোট্টু ও শামসু। আর্ত চিৎকার করেই যেন হঠাৎ সবকিছু নিশ্চুপ হয়ে গেছে। তারপর বেশ কিছুটা সময় পাশের ঘর থেকে কোন সাড়াশব্দ আসে না। সামসুর স্ত্রী ভয়ার্ত চোখে ছোট্টুর দিকে তাকিয়ে বলল, হাসু কি মইরা গেল!
.
মিলিটারি দৌড়াতে দৌড়াতে আইল পাড় হয়ে তার বাড়ির উঠোনের উপর এসে দাঁড়ালো। প্রচন্ড হাপিয়ে পড়েছে সে। দাড়িয়ে থাকতে না পেরে মাটিতে হাটু গেড়ে বসে পড়ল। তারপর বুক ভরে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগল।
পুরো বাড়িতে কোনো আলো নেই। ঘরের দরজাটি হা করে খোলা। চারপাশটা নিশ্চুপ নিরব। কোন জনমানবের সাড়াশব্দ নেই। কোন রকমে উঠে নিজেরই ঘরের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল আতঙ্কিত স্তব্ধ মিলিটারি।
.
সবুর দেওয়ান কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। শফিক নিরবতা ভেঙে তার দিকে তাকিয়ে বলল, মিয়া ভাই, কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি।
সবুর ধীরে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। শফিক বলে চলল, মিয়া ভাই, মিন্টু শহর থাইকে যে ভাইরাস নিয়ে আইসে, এইডে সেই ভাইরাস না।
সবুর দেওয়ান তার দিকে মাথা তুলে তাকাল, এক ধরনের অনিশ্চয়তার ভঙ্গিতে বলল, তুই এতো নিশ্চিত হইলি কেমনে?
শফিক কিছুক্ষন চুপ করে রইলো। তারপর বললো, মিন্টু বা তার মায় এই ভাইরাসে আক্রান্ত হইয়ে মারা গেছে। কিন্তু তাদের কেউ এই রকম পাগলা কুত্তা হইয়া যায় নাই। আমরা মিন্টুর মায়েরে দাফন করসি। মিন্টুর লাশ মইরে পইচা গইলা গেসে। পেছন থেকে শফিকের একটা সাঙ্গো একটু কেশে উঠলো।
শফিক একটু থেমে গেল। গলা ঝাড়ে আবার বলল, আপনে নিশ্চিত থাকেন এইগুলারে কোন পাগলা কুত্তা বা কোন জংলি জানোয়ারে কামরাইসে। কি একটা রোগ আছে না ... রা রা ...
র্যাবিস বা জলাতঙ্ক। শফিকের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল গ্রামের এক মাত্র শিক্ষিত লোক সবুর দেওয়ান।
হ, হ ওইটাই। রাবিশ না কি বলে জলাতঙ্ক। শফিক তার মোটা মাথা ঝাকাতে লাগলো।
কিন্তু সগীর মুন্সির বাপেরে তো কিছুতে কামড়ায় নাই। সবুর এখনো অনিশ্চিত।
আরে মিয়া ভাই, সগির মুন্সির সব কথা বিশ্বাস কইরেন না। শফিক মোটা গলায় বলে উঠলো।
তাও ঠিক। আপন মনে বিড়বিড় করল সবুর দেওয়ান। তারপর সামনে তাকিয়ে বলল, তবে আমরা এখন কি করতে পারি?
আমরা এই গুলারে একটা একটা করে ধইরে মাইরে ফেলামু। কথাটা এমনভাবে বললো শফিক, যেন কাজটি খুবই সহজ।
সবুর দেওয়ান একটু বিস্মিত হয়ে তার দিকে তাকাল।
শফিক বলে চলল, হ, মিয়া ভাই। রাইতের বেলায় কাজটা কঠিন হইলেও, দিনের বেলায় নিশ্চয়ই এর চেয়ে সোজা হইবো।
শফিককে যতটা মাথা মোটা ভাবতো সবুর, ততোটা মোটা মাথার লোক সে নয়। তার কথায় আজ সেটি প্রমান হল।
হুম। একটু আপন মনে বিড়বিড় করল সবুর। সগীরের কথায়ও সেই আচ পেয়েছে। দিনের বেলায় এগুলা একটু দুর্বল হয়ে পড়ে কিন্তু রাতের বেলায় অস্থিরতা বেড়ে যায়।
কিন্তু কথা হল এইগুলা দিনের বেলাতে থাকেটা কই? প্রশ্নটি যেন সবার উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিল সবুর।
.
ছোট্টু সামসুর দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বলল, চাচা আমার বাপেরে রাইতের বেলায় কিছু একটায় কামড়ায়ছিল। তারপর থাইকা সে অসুস্থ হইয়া পড়ে, তার রক্ত আমাশা শুরু হয়। একটু থেমে একটা দীর্ঘ একটা শ্বাস নেয় ছোট্ট। তারপর আবার বলে, মিলিটারির চাচার মায়েরেও কিছু একটা কামড় দিছিল।
হুম। বুঝবার পারসি। সামসু মাথা নাড়ে। গেরামে কোন পাগলা কুত্তা, শিয়াল টিয়াল আছে। সেটার কাছ থাইকেই এই রোগটা সবার মধ্যে ছড়ায়ে পড়ছে।
সেইটা হইলে তো এইটা মিন্টুর রোগ না। সামসুর স্ত্রী এবার বললো কথাটা।
হইতে পারে। শামসু উত্তর দিল। তবে হাশেমের গায়ে তো কোন কামড়ও নাই।
হুম, হেই কেন বাজানের মতো এমন পাগলামি করতে করতে মারা গেল, বুঝবার পারতেসি না। ছোট্ট আপন মনে বিড়বিড় করল।
হঠাৎ করেই হাসেমের ঘর থেকে আবার এক ধরনের শব্দ শুরু হয়। কেউ যেনো আবিরাম দরজা ভাঙার চেষ্টা করে চলছে। ব্যাপারটি বুঝতে পেরে পিলে চমকে ওঠে সবার। অবিশ্বাসের চোখ নিয়ে একজন আরেকজনের দিকে তাকাতে থাকে। এতক্ষণ পরে ভেতরে এটি আবার কিসের শব্দ! (চলবে)
RabbY khan, Debasis sorkar, Sm samim, Alom khan, Salman reja, Foisal Hossain, Rajesh mondol and লেখাটি পছন্দ করেছে