- Anikaধুমকেতু
- Posts : 20
স্বর্ণমুদ্রা : 1324
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-06-01
মিশন ফেয়ার প্লে
Fri Jun 04, 2021 10:02 pm
(পর্ব : এক)
রহিমের বোনটাকে কারা যেন খুন করেছে। সবাইকে জানানো হয়েছে, সে পানিতে ডুবে মরেছে। রহিমও তাই জানত। কিন্তু একদিন রাতে রহিম কান্নার আওয়াজ শুনে জেগে উঠল। তার মা কেঁদে কেঁদে বাবাকে কীসব বলছেন। সব কথা স্পষ্ট শুনতে না পারলেও ধর্ষণ শব্দটা ঠিকই কানে এল।
ধর্ষণ শব্দটা আজকাল সহজ হয়ে গেছে। প্রতিদিনই খবরের কাগজে দেখা যায়। এ-নিয়ে রহিমের মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু নিজের বোনের সাথেই এমন...
বাবা সান্ত্বনা দিয়ে মা'কে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। ও-ঘরের আলো নিভে গেল। রহিমের ঘরটাও অন্ধকার। সে অন্ধকারে বসে একটা সিদ্ধান্ত নিলো। তার বোনের খুনি যে-ই হোক, তাকে সে ছেড়ে দেবে না। শাস্তি দেবে। কঠোর শাস্তি।
পরদিন সে আনোয়ারের কাছে গেল। আনোয়ার ক্লাস টেনে পড়ে। তবে এলাকায় তার এতটাই দাপট, কলেজের ছাত্ররাও তাকে ভয় পায়। তার মাথায় স্থানীয় লিডারদের হাত আছে। রহিম আনোয়ারের কাছে গিয়েছিল একটি ধারালো অস্ত্রের জন্য। ভেবেছিল, দা কিংবা চাপাতি নিয়ে আসবে। কিন্তু মাটির ব্যাঙ্কে জমানো টাকায় সেসব জোগাড় করা যায়নি। আনোয়ার টাকা গুণে একটি ছুরি দিয়েছে। বলেছে, 'রক্ত খাওয়া জিনিস। সামলাতে পারবি তো? এসব জিনিস একবার রক্ত খেলে বারবার খেতে চায়।'
রহিম কথার জবাব না দিয়ে চলে এসেছে। রক্তখেকো জিনিসই তো তার চাই!
বাড়িতে এসে বালিশের তলায় ছুরিটা লুকিয়ে রেখেছে। বিকেলে সবাই যখন খেলতে এসেছে, রহিম সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলেছে, 'আমার একটি মিশন আছে। কে কে আছিস আমার সঙ্গে?'
প্রথমে কয়েকজন হাত তুলেছিল। তাদের দেখাদেখি সবাই হাত তুলল। শুধু রনি বাদে। সে নির্লিপ্তভাবে একটু দূরে বসে আছে। কারোর দিকে খেয়াল নেই। তার দিকেও কেউ তাকাল না। একজন বলল, 'কী মিশন রে তোর?'
রহিম গলা ভার করে বলল, 'মিশন ফেয়ার প্লে।'
সবাই অবাক হয়ে গেল। একজন বলল, 'মিশন লিচু শুনেছি। মিশন আম শুনেছি। কিন্তু এই ফেয়ার প্লে কী? দেখ ভাই, ফলটা মিষ্টি হলে যেতে পারি। না হলে আমি চুরি ছেড়ে দিয়েছি।'
রহিম চেঁচিয়ে বলল, 'এই শালা, চুরি ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারিস না, না?'
ছেলেটা তেড়ে এল, 'শালা বললি কেন? শালা বললি কেন রে?'
'একশো বার বলব। হাজার বার বলব। কী করবি তুই?'
অনেক্ষণ হাতাহাতির পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলো। সবাই আবার মিশন ফেয়ার প্লে'তে মনোযোগী হলো। রহিম বলল, 'এই মিশনে আমরা কারোর গাছের ফল চুরি করব না। সরাসরি মার্ডার করব।'
মার্ডার শুনেই সবার মাথায় হাত পড়ল। নতুন মিশনের কথা শুনে যেভাবে উচ্ছসিত হয়েছিল ঠিক সেভাবেই নেতিয়ে পড়ল সবাই। রহিম চিৎকার করল, 'কেউ নেই আমার সাথে?'
একজন বিরক্তির স্বরে বলল, 'মাথা খারাপ? এরচে' আমাদের পুরনো মিশনগুলো ভালো। মিশন লিচু। মিশন আম। আঃ, কী মিষ্টি। মুখে স্বাদ এসে গেল!'
মন খারাপ করে জলাশয়ে ঢিল ছুঁড়ছিল। কে যেন পাশে এসে বসল। রহিম ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। রনি এসেছে। সে-ও একটি ঢিল পানিতে ছুঁড়ল। পানির দিকে তাকিয়েই বলল, 'কী মিশন রে তোর?'
'মিশন ফেয়ার প্লে।'
'মার্ডার করবি বলেছিলি?'
'হ্যাঁ, করব।'
'কিন্তু কেন?'
রহিম সব কথা খুলে বলল। বলতে বলতে কেঁদে ফেলল। রনি সব শুনে বলল, 'আমি তোকে সাহায্য করতে পারি। যদি তুই আমার সাথে এক জায়গায় যাস।'
'কোথায় যেতে হবে?'
'আরু মহলে।'
রহিম লাফিয়ে দু'হাত দূরে গিয়ে বলল, 'কী! ওই ভূতুড়ে জায়গায়! আমি পারব না।'
'তাহলে তোর মিশনের কথা ভুলে যা।'
'আচ্ছা, যাব। কবে যেতে হবে?'
'আজ।'
'আজই!
'রাত দশটায় রেডি থাকিস।'
'রাত দশটায়! আমি পারব না। ওখানে দিনের আলোতেই কেউ যায় না। আর রাতে! না বাবা!'
'না গেলে আমি তোকে হেল্প করব না। এবার ভেবে দেখ।'
রহিম শেষমেশ রাজি হলো। রনির উপর তার পূর্ণ আস্থা আছে। রনি যা বলে তাই করে। তার বাবা ছিলেন আর্মিতে। জায়গা-সম্পত্তি ভাগাভাগি নিয়ে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে রনির বাবাকে তারই আপন চাচা কুপিয়ে হত্যা করেন। রনির মা নিজের স্বামীর প্রাণ ভিক্ষা চাইতে গেলে তাকেও ওরা মেরে ফেলে। রনির তখন দু'বছর বয়স ছিল। এখন ষোলো বছর। সে নিজেকে তার বাবার মতোই মনে করে।
রাতে ঘুমের ভান করে শুয়ে রইল। রনি বলেছে দশটায় আসবে। এগারোটা বাজল, তখনও রনি এল না। একসময় রহিম ঘুমিয়েই পড়ল।
টুকটুক শব্দ শুনে চোখ খুলল। টেবিলের উপর থেকে হাতঘড়ি নিল। ঘড়ির ডান পাশের বোতামে চাপ দিলে লাল-নীল বাতি জ্বলে। সময় দেখা যায়। রহিম বাতি চেপে দেখল, বারোটা সাত মিনিট।
বাতাসের শো শো শব্দের মতো আওয়াজ এল, 'রহিম, এই রহিম!' আবারও টুকটুক শব্দ। শব্দটা টিনের বেড়ার ওপাশ থেকে আসছে। রনি তাহলে ঘরের পেছনের দিকে চলে এসেছে। কিন্তু এত রাতে!
রহিম নিঃশব্দে জানালা খুলে বলল, 'এখন কীরে?'
রনি ফিসফিস করে বলল, 'এখনই যাব।'
'এত রাতে! তুই বলেছিলি দশটায়।'
'দশটায় বলার পরেও রাজি হচ্ছিলি না। বারোটায় বললে রাজি হতি?'
'এত রাতে আমি যাব না।'
'তোর ইচ্ছে। তোর বোনের খুনিকেও শাস্তি দেওয়া হবে না।'
রনির মাথায় জেদ চেপে গেল। সে কাঠের জানালা পুরোপুরি মেলে টেবিলের উপর বসে জানালার বাইরে মাথা বের করল। তারপর বুক। পেট। একসময় পুরো শরীর ঘরের বাইরে চলে এল। মাটিতে দাঁড়িয়েই বলল, 'এখনই যাব। চল।'
অনেক্ষণ হাঁটার পর থমকে দাঁড়াল। বলল, 'এইরে! জুতো আনিনি তো!'
'দরকার নেই। জুতো দিয়ে কী করবি? খালি পায়ে হাঁট। ছুরিটা এদিকে দে।'
ছুরির কথা শুনতেই রহিম যেন আকাশ থেকে পড়ল। বলল, 'ছুরি আনিনি!'
'আনিসনি? তাহলে কী এনেছিস? তোর মাথা? যা নিয়ে আয়।'
রহিম দেয় ছুট। দৌড়ে আর পিছন ফিরে ফিরে তাকায়। চেঁচিয়ে বলে, 'তুইও আয়। আমার ভয় লাগে।'
রনি ফুঁসতে ফুঁসতে পা চালায়।
ঘরের পেছন দিকে জানালার কাছে গিয়ে নতুন বিপদ দেখা দেয়। রহিম তার বাবার কণ্ঠ স্পষ্ট শুনতে পায়। তিনি দরজায় দাঁড়িয়ে ডাকছেন। কিন্তু বাবা তো বলেছিলেন, ঢাকা থেকে কাল রওনা হবেন। আজ এত রাতেই ফিরে এলেন যে!
মা দরজা খুলে দিয়েছেন। বাবা এবার সোজা রহিমের ঘরে আসবেন। নিশ্চিত আসবেন। এসে যদি তাকে না পান? রহিম ভয়ে কুঁকড়ে যায়। একদিন রাত দশটায় বাসা থেকে বেরিয়ে বেল্টের বারি খেয়ে পিঠের মাংস ফেটে গিয়েছিল। আজ তো বারোটা বাজে। আজ কী হবে!
রহিম জানালা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করার আগেই বাবা এলেন। পুরো ঘর খুঁজেও রহিমকে না পেয়ে, 'রহিমা, এই রহিমা!' বলে ও-ঘরে চলে গেলেন। রহিম জানালার ফাঁক দিয়ে স্পষ্ট দেখল।
দ্বিতীয় বার যখন মা-বাবা তার ঘরে এলেন, তখন সে গুটিসুটি মেরে বিছানায় শুয়ে আছে। বাবা অনেকবার মা'কে বলেছেন, রহিম বিছানায় না থাকার ব্যাপারটা৷ মা বরাবরই হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন। একসময় বাবা হাত-মুখ ধুতে গেলেন। ভাত খেতে বসলেন। বাতি নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়তেই রহিম নিঃশব্দে বিছানা ছেড়ে নামল। জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে চলে এল।
'এক ঘন্টা লাগে একটা ছুরি আনতে?' রনি দাঁত কটমট করে বলল।
'কী বিপদে পড়েছিলাম জানিস না। একটুর জন্য ধরা খেয়ে যেতাম।'
'তুই ভীতু। ভীতু হয়েই মরবি। ছুরিটা দে।'
রহিম ছুরি দিয়ে বলল, 'এটা দিয়ে কী হবে?'
'কাজে আসবে।'
'কী কাজ?'
'খুন করা।'
রহিম অবাক হয়ে রনির দিকে তাকায়। আরু মহলে তো ভূত থাকে। তাহলে কি ভূত খুন...
আরু মহলে পৌঁছে যাবার আগে রহিম পথ আটকে দাঁড়ায়। বলে, 'রনি, আজকে যদি আমি মারা যাই তাহলে তো জাহান্নামে যেতে হবে।'
'কেন, জাহান্নামে যেতে হবে কেন?'
'কারণ আমি নাপাক। খেলার মাঠে পস্রাব করেছিলাম। পানি নেইনি।'
রনি মুখ ভার করে বলে, 'আমিও।'
'তাহলে চল ফিরে যাই।'
'না না। আজকেই যাব ওখানে। এবং পাক অবস্থায় যাব।'
'কীভাবে?' রহিম কৌতূহলী ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে।
'গোসল করব এখন।'
'কী বলিস!'
'আয়।' বলে রহিমের হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় বিলের ধারে। বলে, 'তুই দাঁড়া। আমি আগে ডুব দিয়ে আসি।'
রহিম কাঁপা গলায় বলে, 'সত্যি গোসল করবি? এত রাতে!'
'চুপ করে দাঁড়া।' বলে কাপড় ছেড়ে পানিতে নেমে যায় রনি। রহিম ভয়ে ভয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। চাঁদের আবছা আলোয় রনিকে ডুবে যেতে দেখলেও উঠতে দেখা যায় না।
এদিকে রহিম প্রবল আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে জলের দিকে। অন্ধকারে বিলের জল কালো কুচকুচে দেখাচ্ছে। এবার মনে হচ্ছে পানিটুকু বিষাক্ত। না না পুরো বিলটাই মানুষখেকো। যদি সত্যি তাই হয়! পানিটুকু রনিকে গিলে খেয়েছে কি?
রহিমের ভয় বেড়ে যায়। সে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আরো মনোযোগ দিকে তাকায়।
দশ সেকেন্ড যায়। পনেরো সেকেন্ড। তারপর বিশ। একসময় এক মিনিট পেরিয়ে যায়। রনির দেখা মিলে না। রহিম ভয়ে ভয়ে বলে, 'রনি, ও রনি!'
বিলের পানি স্থির থাকে। রহিম আবারও বলে, 'রনি! কোথায় গেলি?'
রনি উঠে আসে না। তাহলে কি রাতের অন্ধকারে বিলের জলে হারিয়ে গেল সে?
(চলবে)
মো. ইয়াছিন
রহিমের বোনটাকে কারা যেন খুন করেছে। সবাইকে জানানো হয়েছে, সে পানিতে ডুবে মরেছে। রহিমও তাই জানত। কিন্তু একদিন রাতে রহিম কান্নার আওয়াজ শুনে জেগে উঠল। তার মা কেঁদে কেঁদে বাবাকে কীসব বলছেন। সব কথা স্পষ্ট শুনতে না পারলেও ধর্ষণ শব্দটা ঠিকই কানে এল।
ধর্ষণ শব্দটা আজকাল সহজ হয়ে গেছে। প্রতিদিনই খবরের কাগজে দেখা যায়। এ-নিয়ে রহিমের মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু নিজের বোনের সাথেই এমন...
বাবা সান্ত্বনা দিয়ে মা'কে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। ও-ঘরের আলো নিভে গেল। রহিমের ঘরটাও অন্ধকার। সে অন্ধকারে বসে একটা সিদ্ধান্ত নিলো। তার বোনের খুনি যে-ই হোক, তাকে সে ছেড়ে দেবে না। শাস্তি দেবে। কঠোর শাস্তি।
পরদিন সে আনোয়ারের কাছে গেল। আনোয়ার ক্লাস টেনে পড়ে। তবে এলাকায় তার এতটাই দাপট, কলেজের ছাত্ররাও তাকে ভয় পায়। তার মাথায় স্থানীয় লিডারদের হাত আছে। রহিম আনোয়ারের কাছে গিয়েছিল একটি ধারালো অস্ত্রের জন্য। ভেবেছিল, দা কিংবা চাপাতি নিয়ে আসবে। কিন্তু মাটির ব্যাঙ্কে জমানো টাকায় সেসব জোগাড় করা যায়নি। আনোয়ার টাকা গুণে একটি ছুরি দিয়েছে। বলেছে, 'রক্ত খাওয়া জিনিস। সামলাতে পারবি তো? এসব জিনিস একবার রক্ত খেলে বারবার খেতে চায়।'
রহিম কথার জবাব না দিয়ে চলে এসেছে। রক্তখেকো জিনিসই তো তার চাই!
বাড়িতে এসে বালিশের তলায় ছুরিটা লুকিয়ে রেখেছে। বিকেলে সবাই যখন খেলতে এসেছে, রহিম সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলেছে, 'আমার একটি মিশন আছে। কে কে আছিস আমার সঙ্গে?'
প্রথমে কয়েকজন হাত তুলেছিল। তাদের দেখাদেখি সবাই হাত তুলল। শুধু রনি বাদে। সে নির্লিপ্তভাবে একটু দূরে বসে আছে। কারোর দিকে খেয়াল নেই। তার দিকেও কেউ তাকাল না। একজন বলল, 'কী মিশন রে তোর?'
রহিম গলা ভার করে বলল, 'মিশন ফেয়ার প্লে।'
সবাই অবাক হয়ে গেল। একজন বলল, 'মিশন লিচু শুনেছি। মিশন আম শুনেছি। কিন্তু এই ফেয়ার প্লে কী? দেখ ভাই, ফলটা মিষ্টি হলে যেতে পারি। না হলে আমি চুরি ছেড়ে দিয়েছি।'
রহিম চেঁচিয়ে বলল, 'এই শালা, চুরি ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারিস না, না?'
ছেলেটা তেড়ে এল, 'শালা বললি কেন? শালা বললি কেন রে?'
'একশো বার বলব। হাজার বার বলব। কী করবি তুই?'
অনেক্ষণ হাতাহাতির পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলো। সবাই আবার মিশন ফেয়ার প্লে'তে মনোযোগী হলো। রহিম বলল, 'এই মিশনে আমরা কারোর গাছের ফল চুরি করব না। সরাসরি মার্ডার করব।'
মার্ডার শুনেই সবার মাথায় হাত পড়ল। নতুন মিশনের কথা শুনে যেভাবে উচ্ছসিত হয়েছিল ঠিক সেভাবেই নেতিয়ে পড়ল সবাই। রহিম চিৎকার করল, 'কেউ নেই আমার সাথে?'
একজন বিরক্তির স্বরে বলল, 'মাথা খারাপ? এরচে' আমাদের পুরনো মিশনগুলো ভালো। মিশন লিচু। মিশন আম। আঃ, কী মিষ্টি। মুখে স্বাদ এসে গেল!'
মন খারাপ করে জলাশয়ে ঢিল ছুঁড়ছিল। কে যেন পাশে এসে বসল। রহিম ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। রনি এসেছে। সে-ও একটি ঢিল পানিতে ছুঁড়ল। পানির দিকে তাকিয়েই বলল, 'কী মিশন রে তোর?'
'মিশন ফেয়ার প্লে।'
'মার্ডার করবি বলেছিলি?'
'হ্যাঁ, করব।'
'কিন্তু কেন?'
রহিম সব কথা খুলে বলল। বলতে বলতে কেঁদে ফেলল। রনি সব শুনে বলল, 'আমি তোকে সাহায্য করতে পারি। যদি তুই আমার সাথে এক জায়গায় যাস।'
'কোথায় যেতে হবে?'
'আরু মহলে।'
রহিম লাফিয়ে দু'হাত দূরে গিয়ে বলল, 'কী! ওই ভূতুড়ে জায়গায়! আমি পারব না।'
'তাহলে তোর মিশনের কথা ভুলে যা।'
'আচ্ছা, যাব। কবে যেতে হবে?'
'আজ।'
'আজই!
'রাত দশটায় রেডি থাকিস।'
'রাত দশটায়! আমি পারব না। ওখানে দিনের আলোতেই কেউ যায় না। আর রাতে! না বাবা!'
'না গেলে আমি তোকে হেল্প করব না। এবার ভেবে দেখ।'
রহিম শেষমেশ রাজি হলো। রনির উপর তার পূর্ণ আস্থা আছে। রনি যা বলে তাই করে। তার বাবা ছিলেন আর্মিতে। জায়গা-সম্পত্তি ভাগাভাগি নিয়ে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে রনির বাবাকে তারই আপন চাচা কুপিয়ে হত্যা করেন। রনির মা নিজের স্বামীর প্রাণ ভিক্ষা চাইতে গেলে তাকেও ওরা মেরে ফেলে। রনির তখন দু'বছর বয়স ছিল। এখন ষোলো বছর। সে নিজেকে তার বাবার মতোই মনে করে।
রাতে ঘুমের ভান করে শুয়ে রইল। রনি বলেছে দশটায় আসবে। এগারোটা বাজল, তখনও রনি এল না। একসময় রহিম ঘুমিয়েই পড়ল।
টুকটুক শব্দ শুনে চোখ খুলল। টেবিলের উপর থেকে হাতঘড়ি নিল। ঘড়ির ডান পাশের বোতামে চাপ দিলে লাল-নীল বাতি জ্বলে। সময় দেখা যায়। রহিম বাতি চেপে দেখল, বারোটা সাত মিনিট।
বাতাসের শো শো শব্দের মতো আওয়াজ এল, 'রহিম, এই রহিম!' আবারও টুকটুক শব্দ। শব্দটা টিনের বেড়ার ওপাশ থেকে আসছে। রনি তাহলে ঘরের পেছনের দিকে চলে এসেছে। কিন্তু এত রাতে!
রহিম নিঃশব্দে জানালা খুলে বলল, 'এখন কীরে?'
রনি ফিসফিস করে বলল, 'এখনই যাব।'
'এত রাতে! তুই বলেছিলি দশটায়।'
'দশটায় বলার পরেও রাজি হচ্ছিলি না। বারোটায় বললে রাজি হতি?'
'এত রাতে আমি যাব না।'
'তোর ইচ্ছে। তোর বোনের খুনিকেও শাস্তি দেওয়া হবে না।'
রনির মাথায় জেদ চেপে গেল। সে কাঠের জানালা পুরোপুরি মেলে টেবিলের উপর বসে জানালার বাইরে মাথা বের করল। তারপর বুক। পেট। একসময় পুরো শরীর ঘরের বাইরে চলে এল। মাটিতে দাঁড়িয়েই বলল, 'এখনই যাব। চল।'
অনেক্ষণ হাঁটার পর থমকে দাঁড়াল। বলল, 'এইরে! জুতো আনিনি তো!'
'দরকার নেই। জুতো দিয়ে কী করবি? খালি পায়ে হাঁট। ছুরিটা এদিকে দে।'
ছুরির কথা শুনতেই রহিম যেন আকাশ থেকে পড়ল। বলল, 'ছুরি আনিনি!'
'আনিসনি? তাহলে কী এনেছিস? তোর মাথা? যা নিয়ে আয়।'
রহিম দেয় ছুট। দৌড়ে আর পিছন ফিরে ফিরে তাকায়। চেঁচিয়ে বলে, 'তুইও আয়। আমার ভয় লাগে।'
রনি ফুঁসতে ফুঁসতে পা চালায়।
ঘরের পেছন দিকে জানালার কাছে গিয়ে নতুন বিপদ দেখা দেয়। রহিম তার বাবার কণ্ঠ স্পষ্ট শুনতে পায়। তিনি দরজায় দাঁড়িয়ে ডাকছেন। কিন্তু বাবা তো বলেছিলেন, ঢাকা থেকে কাল রওনা হবেন। আজ এত রাতেই ফিরে এলেন যে!
মা দরজা খুলে দিয়েছেন। বাবা এবার সোজা রহিমের ঘরে আসবেন। নিশ্চিত আসবেন। এসে যদি তাকে না পান? রহিম ভয়ে কুঁকড়ে যায়। একদিন রাত দশটায় বাসা থেকে বেরিয়ে বেল্টের বারি খেয়ে পিঠের মাংস ফেটে গিয়েছিল। আজ তো বারোটা বাজে। আজ কী হবে!
রহিম জানালা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করার আগেই বাবা এলেন। পুরো ঘর খুঁজেও রহিমকে না পেয়ে, 'রহিমা, এই রহিমা!' বলে ও-ঘরে চলে গেলেন। রহিম জানালার ফাঁক দিয়ে স্পষ্ট দেখল।
দ্বিতীয় বার যখন মা-বাবা তার ঘরে এলেন, তখন সে গুটিসুটি মেরে বিছানায় শুয়ে আছে। বাবা অনেকবার মা'কে বলেছেন, রহিম বিছানায় না থাকার ব্যাপারটা৷ মা বরাবরই হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন। একসময় বাবা হাত-মুখ ধুতে গেলেন। ভাত খেতে বসলেন। বাতি নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়তেই রহিম নিঃশব্দে বিছানা ছেড়ে নামল। জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে চলে এল।
'এক ঘন্টা লাগে একটা ছুরি আনতে?' রনি দাঁত কটমট করে বলল।
'কী বিপদে পড়েছিলাম জানিস না। একটুর জন্য ধরা খেয়ে যেতাম।'
'তুই ভীতু। ভীতু হয়েই মরবি। ছুরিটা দে।'
রহিম ছুরি দিয়ে বলল, 'এটা দিয়ে কী হবে?'
'কাজে আসবে।'
'কী কাজ?'
'খুন করা।'
রহিম অবাক হয়ে রনির দিকে তাকায়। আরু মহলে তো ভূত থাকে। তাহলে কি ভূত খুন...
আরু মহলে পৌঁছে যাবার আগে রহিম পথ আটকে দাঁড়ায়। বলে, 'রনি, আজকে যদি আমি মারা যাই তাহলে তো জাহান্নামে যেতে হবে।'
'কেন, জাহান্নামে যেতে হবে কেন?'
'কারণ আমি নাপাক। খেলার মাঠে পস্রাব করেছিলাম। পানি নেইনি।'
রনি মুখ ভার করে বলে, 'আমিও।'
'তাহলে চল ফিরে যাই।'
'না না। আজকেই যাব ওখানে। এবং পাক অবস্থায় যাব।'
'কীভাবে?' রহিম কৌতূহলী ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে।
'গোসল করব এখন।'
'কী বলিস!'
'আয়।' বলে রহিমের হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় বিলের ধারে। বলে, 'তুই দাঁড়া। আমি আগে ডুব দিয়ে আসি।'
রহিম কাঁপা গলায় বলে, 'সত্যি গোসল করবি? এত রাতে!'
'চুপ করে দাঁড়া।' বলে কাপড় ছেড়ে পানিতে নেমে যায় রনি। রহিম ভয়ে ভয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। চাঁদের আবছা আলোয় রনিকে ডুবে যেতে দেখলেও উঠতে দেখা যায় না।
এদিকে রহিম প্রবল আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে জলের দিকে। অন্ধকারে বিলের জল কালো কুচকুচে দেখাচ্ছে। এবার মনে হচ্ছে পানিটুকু বিষাক্ত। না না পুরো বিলটাই মানুষখেকো। যদি সত্যি তাই হয়! পানিটুকু রনিকে গিলে খেয়েছে কি?
রহিমের ভয় বেড়ে যায়। সে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আরো মনোযোগ দিকে তাকায়।
দশ সেকেন্ড যায়। পনেরো সেকেন্ড। তারপর বিশ। একসময় এক মিনিট পেরিয়ে যায়। রনির দেখা মিলে না। রহিম ভয়ে ভয়ে বলে, 'রনি, ও রনি!'
বিলের পানি স্থির থাকে। রহিম আবারও বলে, 'রনি! কোথায় গেলি?'
রনি উঠে আসে না। তাহলে কি রাতের অন্ধকারে বিলের জলে হারিয়ে গেল সে?
(চলবে)
মো. ইয়াছিন
Abid faraje, Ayrin kaTun, Masum, Tanusri roi, Za mahmud, Nafisa akter, Sk limon and লেখাটি পছন্দ করেছে
- Anikaধুমকেতু
- Posts : 20
স্বর্ণমুদ্রা : 1324
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-06-01
Re: মিশন ফেয়ার প্লে
Fri Jun 04, 2021 10:03 pm
(পর্ব : দুই)
রহিমের পায়ের কাছে রনি কাপড় রেখে গিয়েছিল। এখন কাপড়গুলো নেই। সে চোখ কচলে ভালো করে তাকাল। নাঃ, সত্যিই নেই। কাপড় গেল কোথায়?
রহিম ভাঙা গলায় চেঁচাল, 'রনি!'
শব্দটা বেশি দূর গেল না। রহিমের চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। দু'হাত দিয়ে চোখের জল মুছে শেষ করা যাচ্ছে না। রহিম শেষবার ঘোলাটে চেখে জলের দিকে তাকাল। এবার যদি রনি উঠে না আসে, তবে সে দৌড়ে পালাবে।
'ভয় পেয়েছিস?' রনির কণ্ঠ।
রহিম দ্রুত বাঁ দিকে তাকাল। রনি নিশ্চিন্ত মনে ঘাসের বুকে বসে আছে। যেন কিছুই হয়নি।
রহিম বলল, 'তুই এখানে এলি কীভাবে? তুই তো পানিতে ছিলি!'
'এক ডুবে ওপাড়ে গিয়েছিলাম। তারপর বিলের পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে এসেছি। এসে দেখলাম তুই কাঁদছিস। ভাবলাম, আরো একটু কাঁদ। ততক্ষণে আমি কাপড় পরে নেই।'
'তুই সত্যি তুই তো?' রহিম হাত কচলাতে কচলাতে বলল।
'নয়তো কি ভূত?'
'তাইতো মনে হচ্ছে।'
'ওদিকে তাকা, দেখ আমার ছায়া দেখা যাচ্ছে। ভূতের তো ছায়া থাকে না। তবুও যদি বিশ্বাস না হয়, তুই আমাকে ছুঁতে পারিস।'
ছোঁয়া তো দূর তার কাছে ঘেঁষল না। দূর থেকেই বলল, 'চল বাড়ি যাই।'
'আমরা কি বাড়ি যাবার জন্য এসেছি? যে কাজে এসেছি, সেটা করেই যাব। যা, ডুব দিয়ে আয়।'
'এখন কাপড় ভেজালে সারা রাতেও শুকাবে না। সকালে ধরা খেয়ে যাব। এরচে' আমরা কাল যাই। কাল পাক অবস্থায় থাকব।'
'না। আজকেই যাব। তুই এখনি পানিতে নাম। কাপড় এখানে রেখে যা।'
'যাঃ! কী যে বলিস! কাপড় রেখে যাব আমি? আমার কি লজ্জাশরম নেই নাকি?'
'এত রাতে তোকে কে দেখতে আসবে? ভূত?'
'কেন, তুই?'
'আমি? আমি দেখব না। এই দেখ, চোখে হাত রাখলাম। কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। কিচ্ছু না।' বলে ডান হাত দিয়ে চোখ আড়াল করল রনি।
এই ফাঁকে রহিম কাপড় ছেড়ে বিলের জলে নেমে গেল। গা হীম করে দেওয়া জল। মনে হচ্ছে পানিতে বরফকুঁচি দেওয়া হয়েছে। কাঁপতে কাঁপতে এগোতে এগোতে একসময় বুক সমান পানিতে নেমে গেল। পায়ের অনেকটা অংশ কাদার ভেতর চলে গেছে। সেদিকে খেয়াল না করে দ্রুত ডুব দিয়ে উঠে এল।
আরু মহল।
রহিম শুনেছিল মহলটা নাকি চারশো বছরেরও বেশি পুরনো। চোখের দেখা দেখেনি কখনো। ছোটোবেলা থেকেই এদিকে আসা সাফ মানা। এই প্রথমবার এসেছে। তা-ও আবার এত রাতে। প্রায় আট ফুট উঁচু দেয়াল ঘেষেঁ বিশাল গেট। অর্ধেকটা খোলা ছিল। রনি আগে আগে চলে গেল। রহিম ভয়ে ভয়ে তার পিছু করতে লাগল৷ এদিক ওদিক তাকিয়ে অন্ধকারে যতদূর বুঝা গেল, চারপাশে ঝোপঝাড় ভরতি। মাঝখান দিয়ে সরু রাস্তা বয়ে গেছে। সেই রাস্তা ধরে এগোতে এগোতে একসময় আরু মহলের মূল দরজার সামনে উপস্থিত হলো।
তবে এখানের দরজাটা বোধহয় কেউ খুলে নিয়ে গেছে। দরজার অংশটুকু ফাঁকা। সেই ফাঁকা অংশ দিয়ে সতর্ক পা ফেলে রনি এগিয়ে গেল। রহিমও গেল। মনে হয়েছিল, মহলের ভিতর একেবারে অন্ধকার হবে। কিন্তু না। ভেতরেও বাইরের মতো আবছা আলো আছে। রহিম মাথা উঁচু করে তাকাল। আকাশের চাঁদ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মাথার উপর ছাদ নেই। চারপাশের দেয়ালগুলো ভাঙা ভাঙা।
'এই রনি, দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আয়।' রহিম ফিসফিস করে বলল।
একটা ব্যাপার মাথায় ঢুকলো না। আশপাশে তো কেউ নেই। তাহলে রনি ফিসফিস করে বলছে কেন? জোরে বললেওতো পারে!
'কী হলো? আয়!'
একসময় রনি কিছু একটা এগিয়ে দিলো। রহিম সেটা হাতে না নিয়ে জিজ্ঞেস করল, 'কী এটা?'
'দেখ ভালো করে।'
'স্যান্ডেল?'
'হ্যাঁ, তোর বোনের স্যান্ডেল।'
'রিতার স্যান্ডেল! রিতার স্যান্ডেল এখানে এল কী করে?'
বলার পরপরই রনি তার মুখ চেপে ধরল। এত জোরে ধরল, কথা বলা তো দূর নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিল। হাত ছেড়ে ইশারা করে চুপ থাকতে বলে এদিক ওদিক দেখে নিল। তারপর বলল, 'রেখে দে।'
'কী রাখব?'
'স্যান্ডেলটা রাখ।'
'এটা আমার বোনের স্যান্ডেল। আমি বাড়ি নিয়ে যাব।'
'চেঁচাবি না। রাখ এখানে। চলে আয়।' বলে পা চালাল রনি।
রহিম পেছন থেকে নিচু গলায় আওয়াজ দিলো, 'চলে যাবি? তাহলে এখানে এসেছিলি কেন?'
'নেই।'
'নেই মানে? কী নেই? বুঝিয়ে বল।'
'এত কথা বলিস কেন? চলে আয়। তাড়াতাড়ি আয়।'
'না, আসব না। আগে বল, কী নেই? কী খুঁজতে এসেছিলি?'
রনি প্রশ্ন এড়িয়ে বলল, 'আসবি না? বেশ। বসে থাক। বসে বসে সাপের কামড় খা। আমি গেলাম।'
সাপের কথা শুনতেই রহিমের গা কেঁপে উঠল। বলল, 'এ বাড়িতে সাপ আছে?'
'আছে কী! ধরে নে এটা সাপের বাড়ি। বড়ো বড়ো বিষাক্ত সাপ আছে এখানে।'
'এই রনি দাঁড়া। আমিও যাব।' বলে দ্রুত এসে রনির পাশাপাশি হাঁটতে লাগল রহিম।
পরদিন রহিমের গা কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এল। বাবা রহিমের সামনে দাঁড়িয়ে মাওলানা সাহেবকে বললেন, 'মৌলানা সাব, রহিমকে কাল জ্বিন নিয়ে গেছিল। রাতে আমি নিজ চোখে দেখেছি, সে বিছানায় নাই। পুরো ঘর খুঁজলাম। কোত্থাও নাই। তারপর তার মা'রে ডাকলাম। আমরা দুইজন আইসা দেখি, সে ঘুমায়া আছে। আমি তখনই আন্দাজ করছি, বিপদ আছে।'
মাওলানা সাহেব মুখে কিছু বলেননি। শুধু সামনের দিকে মাথা ঝাঁকিয়েছেন কয়েকবার। সুরা পড়ে ফুঁ দিয়েছেন। পানি পড়া দিয়ে গেছেন। যাবার সময় বাবা মাওলানা সাহেবের রাস্তা আটকে বললেন, 'মৌলানা সাব, বিপদ কাইটা যাইব তো? আর কিছু লাগব না তো?'
'আর কিছু লাগবে না। আল্লাহর রহমতে এমনিতেই সুস্থ হয়ে উঠবে।' বলে প্রস্থান করলেন।
ঠিকই সুস্থ হয়ে উঠল। সেদিন বিকেলেই। দুপুরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিল। বিকেলে ঘুম থেকে উঠে দেখে শরীরে জ্বর নেই। মাথাব্যথাও নেই। এখন সে হাঁটতে পারছে। ইচ্ছেমতো দৌড়ঝাঁপ করতে পারছে। একটুও দুর্বলতা নেই। একটুও কষ্ট হচ্ছে না তার।
সুস্থ শরীর নিয়ে ঘরে বসে থাকা যায় না। শত ইচ্ছে করলেও না। রহিমও পারল না।
রনিকে দেখা গেল বটতলায়। মনমরা হয়ে বসে আছে। গালে হাত। মাথায় ব্যান্ডেজ। কনুইয়ে ব্যান্ডেজ। চোখের নিচে কিছুটা অংশ থেঁতলে গিয়ে নীল বর্ণ ধারণ করেছে।
রহিম বলল, 'আবার কার হাতের মার খেয়েছিস?'
রনি ক্রুদ্ধ হয়ে বলল, 'খেয়েছি কে বলেছে? দিয়েছি। ইচ্ছেমতো মেরেছি। এমন মার দিয়েছি না...'
'হ্যাঁ, তা তো দেখাই যাচ্ছে।'
'কী দেখছিস? এসব ব্যান্ডেজ দেখে লাভ নেই। ওরা তো উপরে উপরে মেরেছে। আমাকে তো চেনে না। কিলঘুসি সব জায়গামতো বসিয়েছি। রাতে যখন ব্যথা উঠবে তখন বুঝবে আমি কী জিনিস।'
'কয়জন মিলে মেরেছে তোকে?'
'পাঁচজন। একলা একজনকে মারার জন্য পাঁচজন একসাথে আসে। একা আসতে পারে না? ভীতুর দল।' বলেই রনি হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। রহিম তাকে সান্ত্বনা দেবার আগেই সে চোখ-মুখ মুছে চলে গেল।
সেদিন রাতে ওদের কিছু হোক বা না হোক রনির ঠিকই হলো। এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়ল যে তাকে শেষমেশ হাসপাতালে ভর্তি করতে হলো। খবর পেয়ে রহিম ছুঁটে গেল রনির খালার বাসায়। ওখানেই সে থাকে।
রনি বিছানায় শুয়ে আছে। কথা বলতে পারছে না। চোখ খুলতেও পারছে না। শক্ত হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। খালা চোখের জলে গাল ভাসাচ্ছেন। খালু গাড়ি আনতে গিয়েছেন। রনিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে।
খালু রনিকে কোলে করে গাড়ি পর্যন্ত নিয়ে গেলেন। তখন রনি এক মুহূর্তের জন্য চোখ খুলল। ভাঙা ভাঙা গলায় বলল, 'ভাবছিস আমি মরে যাব? তোকে অনেক কিছু বলার আছে। সেগুলো না বলে আমি মরব না।'
রাতের তখন সাড়ে এগারো। রহিম ঘুম থেকে কেঁপে উঠল। তখনই মনে হলো, সেদিন আরু মহলে কিছু একটা দেখেছে সে। হতে পারে বিষাক্ত কোনো সাপ। সাপটির গা থেকে আলো ছড়াচ্ছিল।
সব ভুলে বালিশে মুখ গুঁজল। ঘুম এল না। বারোটা বাজল। তারপর সারে বারো। একসময় সে স্থির করল, আরু মহলে যাবে। এক্ষুনি যাবে।
রহিম জানালার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এল। সঙ্গে ধারালো ছুরিটা নিলে ভালো হত। কিন্তু বালিশের নিচে সেটা নেই। কোথায় রেখেছে তা-ও মনে পড়ছে না। তবে হাতঘড়ি সঙ্গে এনেছে। ঘড়িতে বোতাম টিপলে লাল-নীল আলো জ্বলে। সেটা অন্ধকারে কাজে দেবে।
হঠাৎ রহিমের মনে হলো সামনে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছেন। এতক্ষণ সে মাথা নিচু করে হাঁটছিল। সামনে কারোর উপস্থিতি বুঝতে পেরে মাথা উঁচু করে তাকাল।
সামনে ভূত থাকলেও হয়তো অতোটা ভয় লাগত না, যতটা ভয় বাবাকে দেখে লাগছে। তিনি চোখ বড়ো বড়ো করে রহিমের দিকে তাকিয়ে আছেন। বাঁ হাতে লম্বা টর্চ। সেটা জ্বালাচ্ছেন নিভাচ্ছেন। জ্বালাচ্ছেন নিভাচ্ছেন।
'হারামজাদা কই যাচ্ছিলি?' বাবা বাজখাঁই কণ্ঠে বললেন।
রহিম জবাব দিলো না। মাথা নিচু করে চুপ করে রইল। বাবা এদিক ওদিক খুঁজে একটা কাঠের টুকরো নিয়ে এসে বললেন, 'বল, এত রাতে কই যাচ্ছিলি?'
রহিম বুঝতে পারল জবাব না দিলে মার খেতে হবে। তাই হাত পা শক্ত রেখে চুপ করে রইল। বাবা আরো একবার জিজ্ঞেস করেই কাঠের টুকরো দিয়ে পা বরাবর এক ঘা বসিয়ে দিলেন। রহিম উঁঃ পর্যন্ত করল না। দাঁতে দাঁত চেপে রেখে চুপ করে রইল। পায়ের ব্যথায় চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল।
বাবা আরো কয়েক দফা বসিয়ে দিলেন রহিমের পায়ে। রহিম এবার মাটিতে পড়ে গেল। বাবা তার কলার ধরে টেনে তুলে গাল বরাবর চড় বসিয়ে বললেন, 'বল কই যাচ্ছিলি?'
তখন বাবার হাতের টর্চ রহিমের গালে এত জোরে লাগল, গাল থেকে টকটকে লাল রক্ত বেরিয়ে এল।
একটা দাঁত ভেঙে পড়েছে কি?
রহিম কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, 'আর মের না, বাবা।'
বাবা তবুও মারলেন। কাটা গালে। সেই ভাঙা দাঁতের ওখানে। চড় খেয়েই রহিম চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
(চলবে)
মো. ইয়াছিন
রহিমের পায়ের কাছে রনি কাপড় রেখে গিয়েছিল। এখন কাপড়গুলো নেই। সে চোখ কচলে ভালো করে তাকাল। নাঃ, সত্যিই নেই। কাপড় গেল কোথায়?
রহিম ভাঙা গলায় চেঁচাল, 'রনি!'
শব্দটা বেশি দূর গেল না। রহিমের চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। দু'হাত দিয়ে চোখের জল মুছে শেষ করা যাচ্ছে না। রহিম শেষবার ঘোলাটে চেখে জলের দিকে তাকাল। এবার যদি রনি উঠে না আসে, তবে সে দৌড়ে পালাবে।
'ভয় পেয়েছিস?' রনির কণ্ঠ।
রহিম দ্রুত বাঁ দিকে তাকাল। রনি নিশ্চিন্ত মনে ঘাসের বুকে বসে আছে। যেন কিছুই হয়নি।
রহিম বলল, 'তুই এখানে এলি কীভাবে? তুই তো পানিতে ছিলি!'
'এক ডুবে ওপাড়ে গিয়েছিলাম। তারপর বিলের পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে এসেছি। এসে দেখলাম তুই কাঁদছিস। ভাবলাম, আরো একটু কাঁদ। ততক্ষণে আমি কাপড় পরে নেই।'
'তুই সত্যি তুই তো?' রহিম হাত কচলাতে কচলাতে বলল।
'নয়তো কি ভূত?'
'তাইতো মনে হচ্ছে।'
'ওদিকে তাকা, দেখ আমার ছায়া দেখা যাচ্ছে। ভূতের তো ছায়া থাকে না। তবুও যদি বিশ্বাস না হয়, তুই আমাকে ছুঁতে পারিস।'
ছোঁয়া তো দূর তার কাছে ঘেঁষল না। দূর থেকেই বলল, 'চল বাড়ি যাই।'
'আমরা কি বাড়ি যাবার জন্য এসেছি? যে কাজে এসেছি, সেটা করেই যাব। যা, ডুব দিয়ে আয়।'
'এখন কাপড় ভেজালে সারা রাতেও শুকাবে না। সকালে ধরা খেয়ে যাব। এরচে' আমরা কাল যাই। কাল পাক অবস্থায় থাকব।'
'না। আজকেই যাব। তুই এখনি পানিতে নাম। কাপড় এখানে রেখে যা।'
'যাঃ! কী যে বলিস! কাপড় রেখে যাব আমি? আমার কি লজ্জাশরম নেই নাকি?'
'এত রাতে তোকে কে দেখতে আসবে? ভূত?'
'কেন, তুই?'
'আমি? আমি দেখব না। এই দেখ, চোখে হাত রাখলাম। কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। কিচ্ছু না।' বলে ডান হাত দিয়ে চোখ আড়াল করল রনি।
এই ফাঁকে রহিম কাপড় ছেড়ে বিলের জলে নেমে গেল। গা হীম করে দেওয়া জল। মনে হচ্ছে পানিতে বরফকুঁচি দেওয়া হয়েছে। কাঁপতে কাঁপতে এগোতে এগোতে একসময় বুক সমান পানিতে নেমে গেল। পায়ের অনেকটা অংশ কাদার ভেতর চলে গেছে। সেদিকে খেয়াল না করে দ্রুত ডুব দিয়ে উঠে এল।
আরু মহল।
রহিম শুনেছিল মহলটা নাকি চারশো বছরেরও বেশি পুরনো। চোখের দেখা দেখেনি কখনো। ছোটোবেলা থেকেই এদিকে আসা সাফ মানা। এই প্রথমবার এসেছে। তা-ও আবার এত রাতে। প্রায় আট ফুট উঁচু দেয়াল ঘেষেঁ বিশাল গেট। অর্ধেকটা খোলা ছিল। রনি আগে আগে চলে গেল। রহিম ভয়ে ভয়ে তার পিছু করতে লাগল৷ এদিক ওদিক তাকিয়ে অন্ধকারে যতদূর বুঝা গেল, চারপাশে ঝোপঝাড় ভরতি। মাঝখান দিয়ে সরু রাস্তা বয়ে গেছে। সেই রাস্তা ধরে এগোতে এগোতে একসময় আরু মহলের মূল দরজার সামনে উপস্থিত হলো।
তবে এখানের দরজাটা বোধহয় কেউ খুলে নিয়ে গেছে। দরজার অংশটুকু ফাঁকা। সেই ফাঁকা অংশ দিয়ে সতর্ক পা ফেলে রনি এগিয়ে গেল। রহিমও গেল। মনে হয়েছিল, মহলের ভিতর একেবারে অন্ধকার হবে। কিন্তু না। ভেতরেও বাইরের মতো আবছা আলো আছে। রহিম মাথা উঁচু করে তাকাল। আকাশের চাঁদ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মাথার উপর ছাদ নেই। চারপাশের দেয়ালগুলো ভাঙা ভাঙা।
'এই রনি, দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আয়।' রহিম ফিসফিস করে বলল।
একটা ব্যাপার মাথায় ঢুকলো না। আশপাশে তো কেউ নেই। তাহলে রনি ফিসফিস করে বলছে কেন? জোরে বললেওতো পারে!
'কী হলো? আয়!'
একসময় রনি কিছু একটা এগিয়ে দিলো। রহিম সেটা হাতে না নিয়ে জিজ্ঞেস করল, 'কী এটা?'
'দেখ ভালো করে।'
'স্যান্ডেল?'
'হ্যাঁ, তোর বোনের স্যান্ডেল।'
'রিতার স্যান্ডেল! রিতার স্যান্ডেল এখানে এল কী করে?'
বলার পরপরই রনি তার মুখ চেপে ধরল। এত জোরে ধরল, কথা বলা তো দূর নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিল। হাত ছেড়ে ইশারা করে চুপ থাকতে বলে এদিক ওদিক দেখে নিল। তারপর বলল, 'রেখে দে।'
'কী রাখব?'
'স্যান্ডেলটা রাখ।'
'এটা আমার বোনের স্যান্ডেল। আমি বাড়ি নিয়ে যাব।'
'চেঁচাবি না। রাখ এখানে। চলে আয়।' বলে পা চালাল রনি।
রহিম পেছন থেকে নিচু গলায় আওয়াজ দিলো, 'চলে যাবি? তাহলে এখানে এসেছিলি কেন?'
'নেই।'
'নেই মানে? কী নেই? বুঝিয়ে বল।'
'এত কথা বলিস কেন? চলে আয়। তাড়াতাড়ি আয়।'
'না, আসব না। আগে বল, কী নেই? কী খুঁজতে এসেছিলি?'
রনি প্রশ্ন এড়িয়ে বলল, 'আসবি না? বেশ। বসে থাক। বসে বসে সাপের কামড় খা। আমি গেলাম।'
সাপের কথা শুনতেই রহিমের গা কেঁপে উঠল। বলল, 'এ বাড়িতে সাপ আছে?'
'আছে কী! ধরে নে এটা সাপের বাড়ি। বড়ো বড়ো বিষাক্ত সাপ আছে এখানে।'
'এই রনি দাঁড়া। আমিও যাব।' বলে দ্রুত এসে রনির পাশাপাশি হাঁটতে লাগল রহিম।
পরদিন রহিমের গা কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এল। বাবা রহিমের সামনে দাঁড়িয়ে মাওলানা সাহেবকে বললেন, 'মৌলানা সাব, রহিমকে কাল জ্বিন নিয়ে গেছিল। রাতে আমি নিজ চোখে দেখেছি, সে বিছানায় নাই। পুরো ঘর খুঁজলাম। কোত্থাও নাই। তারপর তার মা'রে ডাকলাম। আমরা দুইজন আইসা দেখি, সে ঘুমায়া আছে। আমি তখনই আন্দাজ করছি, বিপদ আছে।'
মাওলানা সাহেব মুখে কিছু বলেননি। শুধু সামনের দিকে মাথা ঝাঁকিয়েছেন কয়েকবার। সুরা পড়ে ফুঁ দিয়েছেন। পানি পড়া দিয়ে গেছেন। যাবার সময় বাবা মাওলানা সাহেবের রাস্তা আটকে বললেন, 'মৌলানা সাব, বিপদ কাইটা যাইব তো? আর কিছু লাগব না তো?'
'আর কিছু লাগবে না। আল্লাহর রহমতে এমনিতেই সুস্থ হয়ে উঠবে।' বলে প্রস্থান করলেন।
ঠিকই সুস্থ হয়ে উঠল। সেদিন বিকেলেই। দুপুরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিল। বিকেলে ঘুম থেকে উঠে দেখে শরীরে জ্বর নেই। মাথাব্যথাও নেই। এখন সে হাঁটতে পারছে। ইচ্ছেমতো দৌড়ঝাঁপ করতে পারছে। একটুও দুর্বলতা নেই। একটুও কষ্ট হচ্ছে না তার।
সুস্থ শরীর নিয়ে ঘরে বসে থাকা যায় না। শত ইচ্ছে করলেও না। রহিমও পারল না।
রনিকে দেখা গেল বটতলায়। মনমরা হয়ে বসে আছে। গালে হাত। মাথায় ব্যান্ডেজ। কনুইয়ে ব্যান্ডেজ। চোখের নিচে কিছুটা অংশ থেঁতলে গিয়ে নীল বর্ণ ধারণ করেছে।
রহিম বলল, 'আবার কার হাতের মার খেয়েছিস?'
রনি ক্রুদ্ধ হয়ে বলল, 'খেয়েছি কে বলেছে? দিয়েছি। ইচ্ছেমতো মেরেছি। এমন মার দিয়েছি না...'
'হ্যাঁ, তা তো দেখাই যাচ্ছে।'
'কী দেখছিস? এসব ব্যান্ডেজ দেখে লাভ নেই। ওরা তো উপরে উপরে মেরেছে। আমাকে তো চেনে না। কিলঘুসি সব জায়গামতো বসিয়েছি। রাতে যখন ব্যথা উঠবে তখন বুঝবে আমি কী জিনিস।'
'কয়জন মিলে মেরেছে তোকে?'
'পাঁচজন। একলা একজনকে মারার জন্য পাঁচজন একসাথে আসে। একা আসতে পারে না? ভীতুর দল।' বলেই রনি হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। রহিম তাকে সান্ত্বনা দেবার আগেই সে চোখ-মুখ মুছে চলে গেল।
সেদিন রাতে ওদের কিছু হোক বা না হোক রনির ঠিকই হলো। এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়ল যে তাকে শেষমেশ হাসপাতালে ভর্তি করতে হলো। খবর পেয়ে রহিম ছুঁটে গেল রনির খালার বাসায়। ওখানেই সে থাকে।
রনি বিছানায় শুয়ে আছে। কথা বলতে পারছে না। চোখ খুলতেও পারছে না। শক্ত হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। খালা চোখের জলে গাল ভাসাচ্ছেন। খালু গাড়ি আনতে গিয়েছেন। রনিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে।
খালু রনিকে কোলে করে গাড়ি পর্যন্ত নিয়ে গেলেন। তখন রনি এক মুহূর্তের জন্য চোখ খুলল। ভাঙা ভাঙা গলায় বলল, 'ভাবছিস আমি মরে যাব? তোকে অনেক কিছু বলার আছে। সেগুলো না বলে আমি মরব না।'
রাতের তখন সাড়ে এগারো। রহিম ঘুম থেকে কেঁপে উঠল। তখনই মনে হলো, সেদিন আরু মহলে কিছু একটা দেখেছে সে। হতে পারে বিষাক্ত কোনো সাপ। সাপটির গা থেকে আলো ছড়াচ্ছিল।
সব ভুলে বালিশে মুখ গুঁজল। ঘুম এল না। বারোটা বাজল। তারপর সারে বারো। একসময় সে স্থির করল, আরু মহলে যাবে। এক্ষুনি যাবে।
রহিম জানালার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এল। সঙ্গে ধারালো ছুরিটা নিলে ভালো হত। কিন্তু বালিশের নিচে সেটা নেই। কোথায় রেখেছে তা-ও মনে পড়ছে না। তবে হাতঘড়ি সঙ্গে এনেছে। ঘড়িতে বোতাম টিপলে লাল-নীল আলো জ্বলে। সেটা অন্ধকারে কাজে দেবে।
হঠাৎ রহিমের মনে হলো সামনে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছেন। এতক্ষণ সে মাথা নিচু করে হাঁটছিল। সামনে কারোর উপস্থিতি বুঝতে পেরে মাথা উঁচু করে তাকাল।
সামনে ভূত থাকলেও হয়তো অতোটা ভয় লাগত না, যতটা ভয় বাবাকে দেখে লাগছে। তিনি চোখ বড়ো বড়ো করে রহিমের দিকে তাকিয়ে আছেন। বাঁ হাতে লম্বা টর্চ। সেটা জ্বালাচ্ছেন নিভাচ্ছেন। জ্বালাচ্ছেন নিভাচ্ছেন।
'হারামজাদা কই যাচ্ছিলি?' বাবা বাজখাঁই কণ্ঠে বললেন।
রহিম জবাব দিলো না। মাথা নিচু করে চুপ করে রইল। বাবা এদিক ওদিক খুঁজে একটা কাঠের টুকরো নিয়ে এসে বললেন, 'বল, এত রাতে কই যাচ্ছিলি?'
রহিম বুঝতে পারল জবাব না দিলে মার খেতে হবে। তাই হাত পা শক্ত রেখে চুপ করে রইল। বাবা আরো একবার জিজ্ঞেস করেই কাঠের টুকরো দিয়ে পা বরাবর এক ঘা বসিয়ে দিলেন। রহিম উঁঃ পর্যন্ত করল না। দাঁতে দাঁত চেপে রেখে চুপ করে রইল। পায়ের ব্যথায় চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল।
বাবা আরো কয়েক দফা বসিয়ে দিলেন রহিমের পায়ে। রহিম এবার মাটিতে পড়ে গেল। বাবা তার কলার ধরে টেনে তুলে গাল বরাবর চড় বসিয়ে বললেন, 'বল কই যাচ্ছিলি?'
তখন বাবার হাতের টর্চ রহিমের গালে এত জোরে লাগল, গাল থেকে টকটকে লাল রক্ত বেরিয়ে এল।
একটা দাঁত ভেঙে পড়েছে কি?
রহিম কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, 'আর মের না, বাবা।'
বাবা তবুও মারলেন। কাটা গালে। সেই ভাঙা দাঁতের ওখানে। চড় খেয়েই রহিম চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
(চলবে)
মো. ইয়াছিন
Abid faraje, Ayrin kaTun, Masum, Sk nadim, Tanusri roi, Za mahmud, Nafisa akter and লেখাটি পছন্দ করেছে
- Anikaধুমকেতু
- Posts : 20
স্বর্ণমুদ্রা : 1324
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-06-01
Re: মিশন ফেয়ার প্লে
Fri Jun 04, 2021 10:03 pm
(পর্ব : তিন)
ঘরে এসে বাবা অনেক্ষণ কাঁদলেন। তার চোখের জল দেখে মা-ও কেঁদে ফেললেন। আব্দুর রহিমও।
একসময় বাবা আব্দুর রহিমের সারা গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, 'এই কয়টা দিন আগে রিতা মরল। এখন যদি তোর কিছু হয়ে যায়... তুই ছাড়া আমাদের আর কে আছে, বল? তোকেও হারিয়ে ফেললে আমাদের কী হবে?'
আব্দুর রহিম তখনও চুপ করে রইল। বাবা তার হাত-পায়ের আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে মলম লাগিয়ে দিলেন।
রাতে বাবা আব্দুর রহিমের বিছানায় ঘুমালেন। তার পাশেই। পরদিনও একই কাজ। বাবা নিজের ঘর ছেড়ে আব্দুর রহিমের ঘরে। কিন্তু তার যে দু'টো কাজ বাকি। আরু মহল থেকে একবার ঘুরে আসা। আর দ্বিতীয় কাজ হচ্ছে রিতার খুনিকে শাস্তি দেওয়া। যার নাম দিয়েছে মিশন ফেয়ার প্লে।
এই দু'টো কাজ করা হয়ে গেলেই সে বাবার কথামতো চলবে। ঠিকমতো পড়াশোনা করবে। খেলার মাঠ থেকে সন্ধ্যা নামার আগেই ঘরে ফিরবে। এ ছাড়াও বাবা যা করতে বলবেন তা-ই সে করবে। শুধু এই দু'টো কাজ করা হয়ে যাক।
এগারোটা বাজতেই বাবা নাক ডাকতে শুরু করেছেন। আব্দুর রহিম উঠে যাওয়ার সাহস পায়নি। কালকের মতো আজও যদি বাবা উঠে যান! না না, রিক্স নেওয়া যাবে না। এরচে' চুপচাপ শুয়ে থাকা ভালো।
রাত তিনটের সময় সে একটু ভরসা পেল। বাবা বেঘোরে ঘুমাচ্ছেন। এই সময়টা সবাই গভীর ঘুমে থাকে। বাবাও। একসময় নিঃশব্দে বেরিয়ে এল। তবে আজ আর জানালা দিয়ে নয়। সোজা দরজা দিয়ে। রাতের তিনটে। ভয় লাগার কথা। কিন্তু তার ভয় লাগছে না।
আরু মহলের গেটে একটা বুনো শেয়াল বসে ছিল। আব্দুর রহিমকে দেখে উঠে দাঁড়াল। কয়েকবার হুঁশ হুঁশ করার পরেও শেয়ালটা নড়ল না। যেন সে পুরো বাড়ি পাহারা দিচ্ছে। তবে কয়েক পা এগিয়ে যাবার পর শেয়ালটা আর সাহস দেখাতে পারেনি। মুখ ফিরিয়ে ওদিকের অন্ধকারে চলে গেছে।
সেদিন রাতে রিতার স্যান্ডেল যেখানে রেখে গিয়েছিল, আজও সেখানেই পড়ে আছে। আব্দুর রহিম সেটা চোখে দেখলেও হাতে তুলে নিল না। রনি বারবার বলেছিল, স্যান্ডেলটা এখানে রেখে দিতে। হয়তো কোনো বিশেষ কারণ আছে। না হলে তো...
সাপের মতো কিছু একটা আজও সেদিনের মতো ভাঙা দেয়ালে ঝুলছে। সেটার গায়ে আলো জ্বলছে। তবে যেহেতু নড়ছে না, ধরাই যায় সাপটা মৃত। কিংবা ঘুমন্ত। ঘুমন্ত বিষাক্ত সাপের গায়ে হাত দিয়ে সেটাকে হিংস্র করে তুললে খুব বড়ো ভুল হবে কি? হলে হোক। আব্দুর রহিম নির্ভয়ে সেটাকে স্পর্শ করল।
সাপ নয়; তসবি। একটি রেডিয়াম তসবি। সেটা থেকে আলো ছড়াচ্ছিল। হতাশ হয়ে পিছন ফিরতেই কিছু একটায় পা ঠেকল। পায়ের কাছে মাটিতেই কেউ একজন পড়ে আছে। কারোর লাশ কি?
লোকটার বুকের উঠানামা দেখে আন্দাজ করা গেল, সে জীবিত। তাছাড়া তার গায়ে কোনো রকম আঘাতের চিহ্নও দেখা যাচ্ছে না। শুধু কপাল থেকে গাল বরাবর একটি আঘাতের চিহ্ন। সেটাও বহু পুরনো। রনি তাহলে এই লোকটাকেই খুঁজছিল?
লোকটার মুখের বিবরণ শুনে পুলিশ অফিসার কিছুক্ষণ চুপ মেরে বসে রইলেন। তারপর একটা পুরনো ফাইল খুঁজে আনলেন। পাসপোর্ট সাইজের একটি ছবি দেখিয়ে বললেন, 'এই লোকটা?'
আব্দুর রহিম বিস্ময়ের স্বরে বলল, 'হ্যাঁ, এই লোকটা। এই লোকটাই তো...'
'দেখ, তুমি এখনো বাচ্চা মানুষ। এত রাতে বাসা থেকে বেরোনো ঠিক না। মন দিয়ে পড়াশোনা করো। বড়ো হয়ে আমার মতো পুলিশ হয়ো। আপাতত ঘরে যাও। আর যা দেখেছো, ভুলে যাও। ওসব তোমার মনের ভুল ছিল৷'
'আমি বাচ্চা? আমার বয়স কত জানেন? পনেরো। পনেরো বছর বয়সে কেউ বাচ্চা হয়?'
অফিসার হাসলেন, 'হা হা হা! পনেরো বছর? বাচ্চাই তো! যাও, বাড়ি যাও।'
'কিন্তু তদন্ত?'
'কীসের তদন্ত, এই লোকটার?'
'হ্যাঁ।'
'সে তো মরে ভূত হয়ে গেছে। এখন তার তদন্ত করতে হলে কবর খুুঁড়তে হবে। একটা বাচ্চা ছেলের কথায় আমরা তো আর একজনের কবর খুঁড়তে পারি না। কী বলো?'
'মরে গেছে! কখন মরল?'
'দু'বছর আগে।' বলে এক টুকরো পত্রিকার কাটা অংশ এগিয়ে দিলেন। বললেন, 'আস্ত একটা ক্রিমিন্যাল ছিল। রাতের অন্ধকারে তার বাড়িতেই কারা যেন পুড়িয়ে মেরেছে।'
'কিন্তু আমি তো গতকাল রাতেও তাকে দেখলাম!' আব্দুর রহিম বলল।
অফিসার কিছু না বলে চেয়ার ছেড়ে চলে গেলেন। তার এক হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। অন্য হাতে ফাইল।
এক সপ্তাহ পর রনি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছে। এখন সুস্থ। তবে নামমাত্র। হাঁটতে দেখলে মনে হয়, এখনি হোঁচট খেয়ে পড়ে যাবে। শরীর বেশ দুর্বল। চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে গেছে। দুর্বল শরীর নিয়ে লাঠিতে ভর করে খেলার মাঠে চলে এসেছে। ছেলেরা মাঠে ছোটাছু্টি করছে। রনি দূরে বসে এক মনে মাঠের উপর দৃষ্টি রেখেছে।
রনিকে দেখেই আব্দুর রহিম খেলার মাঠ ছেড়ে ছুঁটে এল। পাশে বসে নানা ভাবে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। রনি একটি বারের জন্য তাকিয়ে দেখেনি। আব্দুর রহিম বলল, 'কী অসুখ হয়েছিল তোর?'
রনি উদাসীন ভাবে বলল, 'জেনে কী করবি?'
'না এমনি। আচ্ছা, তুই এখন সুস্থ তো?'
'দেখতে পাচ্ছিস না?'
'তা তো পাচ্ছি। কিন্তু... লুৎফর লোকটাকে খুঁজতে আরু মহলে গিয়েছিলি, তাই না?'
কথাটা শুনতেই রনি শক খাওয়ার মতো দ্রুত ফিরে তাকাল। চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, 'তুই কীভাবে জানিস?'
আব্দুর রহিম প্রশ্ন এড়িয়ে বলল, 'ভেবেছিলি, আমার বোনের খুনিকে শাস্তি দেওয়ার কথা বলে আমাকে তোর কাজে ব্যবহার করবি। অথচ আমি জানব না?'
'তুই ভুল বুঝছিস, রহিম।'
'ভুল? ভাগ্যিস একা একা আরু মহলে গিয়েছিলাম। না হলে তো তুই আমাকে ব্যবহার করছিস সেটা জানতেই পারতাম না। ওখানে লুৎফর লোকটাকে দেখেই আমি বুঝতে পেরেছি, কিছু একটা গন্ডগোল আছে। থানায় গিয়ে বুঝলাম, সত্যিই গন্ডগোল। অফিসার বলে কিনা, লুৎফর দু'বছর আগে মারা গিয়েছে। যাকে আমি নিজ চোখে দেখেছি...'
রনি প্রায় চেঁচিয়ে বলল, 'থানায়ও গিয়েছিলি!'
'গিয়েছিলাম তো। আর যাব না। পুলিশ আমাকে সাহায্য করবে না, এটা আমার বোঝা হয়ে গেছে।'
'তুই কত বড়ো ভুল করেছিস, জানিস? চিনিস ওই লুৎফর কে?' বলেই রনি কলার চেপে ধরল।
আব্দুর রহিম নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, 'রাগ হচ্ছে? সত্যিটা জেনে গেছি বলে খুব রাগ হচ্ছে, তাই না?'
'কী জেনেছিস? কিছুই জানিসনি। শোন, ওই লুৎফর একটা লম্পট, ক্রিমিন্যাল। একটা সাইকো। একটা সিরিয়াল রেপিস্ট।' কথাটুকু বলে রনি একটু দম নিল। আব্দুর রহিম অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকল তার দিকে।
রনি আবার বলতে শুরু করল, 'লম্পটটার বিরুদ্ধে কয়টি কেস ফাইল হয়েছে, জানিস? নয়টি। নয়টি রেপ কেস। আরো অসংখ্য কুকর্ম করেছে সে। লোকলজ্জা আর সমাজের ভয়ে চাপা পড়ে গেছে সেসব। একটি মেয়েকেও সে বাঁচতে দেয়নি। প্রথমে শারীরিক অত্যাচার করেছে। তারপর খুন। যেমনটা তোর বোনের ক্ষেত্রে হয়েছে।'
আব্দুর রহিম ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলল, 'আমার বোনকেও...'
'ইয়েস, ইয়েস। ব্যাটা খুব ভালো প্ল্যান করেছিল। ভেবেছিল নিজ বাড়িতে অন্য একজনকে পুড়িয়ে সেটাকে নিজের ডেডবডি হিসেবে চালিয়ে দেবে। পেপার পত্রিকায় সেরকমই লেখা হলো, যেরকম সে চেয়েছিল। কিন্তু তার দুর্ভাগ্য, সে এই গ্রামে চলে এসেছে। প্রথমবার দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছিল। তারপর আমি তাকে ফলো করতে শুরু করি। যখন কনফার্ম হই সে-ই লুৎফর, তখন আমার টিমকে খবর দেই...'
'তোর টিম?'
'হুঁ। তুই কি ভেবেছিস, মিশন ফেয়ার প্লে নামক যে মিশনে যুক্ত হয়েছিস সেটা তোর? ওটা আমার মিশন। গত দু'বছর ধরে সেই মিশন সাকসেসফুল করার জন্য কাজ করছি আমি এবং আমার টিম। যদিও আমি সিক্রেট মিশনে আছি তবুও বলি, আমি গোয়েন্দা বিভাগে চাকরি করি।'
আব্দুর রহিম চমকে উঠে বলল, 'এই বয়সে গোয়েন্দা বিভাগে?'
'বয়স দিয়ে কী হবে? কাজটাই বড়ো। আজকাল বয়স লাগে না। লাগে কনফিডেন্স আর দক্ষতা।'
'এতকিছু জেনেও লুৎফরকে অ্যারেস্ট করা হলো না কেন? কেন আমার বোনটাকে খুন করার সুযোগ পেল সে?'
রনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, 'ওই যে, প্রমাণের অভাব। প্রমাণ ছাড়া আমরা তার কিছুই করতে পারব না।'
'কিন্তু আমি তো পারব! আমিই কুকুরটাকে খুন করব। আজকেই করব।'
'এত সহজ? উল্টো নিজের প্রাণ বাঁচা। তুই যে তার সম্পর্কে জেনে গিয়েছিস, সেটা বুঝতে পারলে এতক্ষণে একদল প্রফোশন্যাল কিলার পাঠিয়ে দেবে।'
'প্রফেশন্যাল কিলার? তা-ও একদল? মগের মুল্লুক নাকি?'
'রহিম, তুই তাকে চিনিস না। সে যখন যা খুশি তা-ই করতে পারে। আমি তাকে ফলো করছি, তার বিরুদ্ধে প্রমাণ যোগাড় করার চেষ্টা করছি, সেটা লুৎফর এখনও জানে না। তবুও সব সময় আমার সেইফটির জন্য অস্ত্রসহ দু'জন মজুদ থাকে। দেখবি?'
বলেই রনি হাত দিয়ে ইশারা করল। মুহূর্তের মধ্যে কোত্থেকে যেন বিশালদেহী দু'টো লোক ধীর পায়ে এগিয়ে এসে রনির পাশে দাঁড়াল। একজন ডান পাশে অপরজন বাঁ পাশে।
কিছু বুঝে উঠার আগেই একজন আব্দুর রহিমের পিঠ বরাবর পিস্তল ঠেকিয়ে বলল, 'চলো আমাদের সাথে।'
আব্দুর রহিম রনিকে উদ্দেশ্য করে বলল, 'এই ছিল তোমাদের প্ল্যান?'
রনি সাড়া দিলো না। নির্লিপ্ত ভাবে তাকিয়ে রইল খেলার মাঠের দিকে। যেন সে কিছুই শুনতে পায়নি। কী ঘটছে কিছুই জানে না।
[রহিমের নাম পরিবর্তন করে আব্দুর রহিম রাখা হয়েছে।]
(চলবে)
মো. ইয়াছিন
ঘরে এসে বাবা অনেক্ষণ কাঁদলেন। তার চোখের জল দেখে মা-ও কেঁদে ফেললেন। আব্দুর রহিমও।
একসময় বাবা আব্দুর রহিমের সারা গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, 'এই কয়টা দিন আগে রিতা মরল। এখন যদি তোর কিছু হয়ে যায়... তুই ছাড়া আমাদের আর কে আছে, বল? তোকেও হারিয়ে ফেললে আমাদের কী হবে?'
আব্দুর রহিম তখনও চুপ করে রইল। বাবা তার হাত-পায়ের আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে মলম লাগিয়ে দিলেন।
রাতে বাবা আব্দুর রহিমের বিছানায় ঘুমালেন। তার পাশেই। পরদিনও একই কাজ। বাবা নিজের ঘর ছেড়ে আব্দুর রহিমের ঘরে। কিন্তু তার যে দু'টো কাজ বাকি। আরু মহল থেকে একবার ঘুরে আসা। আর দ্বিতীয় কাজ হচ্ছে রিতার খুনিকে শাস্তি দেওয়া। যার নাম দিয়েছে মিশন ফেয়ার প্লে।
এই দু'টো কাজ করা হয়ে গেলেই সে বাবার কথামতো চলবে। ঠিকমতো পড়াশোনা করবে। খেলার মাঠ থেকে সন্ধ্যা নামার আগেই ঘরে ফিরবে। এ ছাড়াও বাবা যা করতে বলবেন তা-ই সে করবে। শুধু এই দু'টো কাজ করা হয়ে যাক।
এগারোটা বাজতেই বাবা নাক ডাকতে শুরু করেছেন। আব্দুর রহিম উঠে যাওয়ার সাহস পায়নি। কালকের মতো আজও যদি বাবা উঠে যান! না না, রিক্স নেওয়া যাবে না। এরচে' চুপচাপ শুয়ে থাকা ভালো।
রাত তিনটের সময় সে একটু ভরসা পেল। বাবা বেঘোরে ঘুমাচ্ছেন। এই সময়টা সবাই গভীর ঘুমে থাকে। বাবাও। একসময় নিঃশব্দে বেরিয়ে এল। তবে আজ আর জানালা দিয়ে নয়। সোজা দরজা দিয়ে। রাতের তিনটে। ভয় লাগার কথা। কিন্তু তার ভয় লাগছে না।
আরু মহলের গেটে একটা বুনো শেয়াল বসে ছিল। আব্দুর রহিমকে দেখে উঠে দাঁড়াল। কয়েকবার হুঁশ হুঁশ করার পরেও শেয়ালটা নড়ল না। যেন সে পুরো বাড়ি পাহারা দিচ্ছে। তবে কয়েক পা এগিয়ে যাবার পর শেয়ালটা আর সাহস দেখাতে পারেনি। মুখ ফিরিয়ে ওদিকের অন্ধকারে চলে গেছে।
সেদিন রাতে রিতার স্যান্ডেল যেখানে রেখে গিয়েছিল, আজও সেখানেই পড়ে আছে। আব্দুর রহিম সেটা চোখে দেখলেও হাতে তুলে নিল না। রনি বারবার বলেছিল, স্যান্ডেলটা এখানে রেখে দিতে। হয়তো কোনো বিশেষ কারণ আছে। না হলে তো...
সাপের মতো কিছু একটা আজও সেদিনের মতো ভাঙা দেয়ালে ঝুলছে। সেটার গায়ে আলো জ্বলছে। তবে যেহেতু নড়ছে না, ধরাই যায় সাপটা মৃত। কিংবা ঘুমন্ত। ঘুমন্ত বিষাক্ত সাপের গায়ে হাত দিয়ে সেটাকে হিংস্র করে তুললে খুব বড়ো ভুল হবে কি? হলে হোক। আব্দুর রহিম নির্ভয়ে সেটাকে স্পর্শ করল।
সাপ নয়; তসবি। একটি রেডিয়াম তসবি। সেটা থেকে আলো ছড়াচ্ছিল। হতাশ হয়ে পিছন ফিরতেই কিছু একটায় পা ঠেকল। পায়ের কাছে মাটিতেই কেউ একজন পড়ে আছে। কারোর লাশ কি?
লোকটার বুকের উঠানামা দেখে আন্দাজ করা গেল, সে জীবিত। তাছাড়া তার গায়ে কোনো রকম আঘাতের চিহ্নও দেখা যাচ্ছে না। শুধু কপাল থেকে গাল বরাবর একটি আঘাতের চিহ্ন। সেটাও বহু পুরনো। রনি তাহলে এই লোকটাকেই খুঁজছিল?
লোকটার মুখের বিবরণ শুনে পুলিশ অফিসার কিছুক্ষণ চুপ মেরে বসে রইলেন। তারপর একটা পুরনো ফাইল খুঁজে আনলেন। পাসপোর্ট সাইজের একটি ছবি দেখিয়ে বললেন, 'এই লোকটা?'
আব্দুর রহিম বিস্ময়ের স্বরে বলল, 'হ্যাঁ, এই লোকটা। এই লোকটাই তো...'
'দেখ, তুমি এখনো বাচ্চা মানুষ। এত রাতে বাসা থেকে বেরোনো ঠিক না। মন দিয়ে পড়াশোনা করো। বড়ো হয়ে আমার মতো পুলিশ হয়ো। আপাতত ঘরে যাও। আর যা দেখেছো, ভুলে যাও। ওসব তোমার মনের ভুল ছিল৷'
'আমি বাচ্চা? আমার বয়স কত জানেন? পনেরো। পনেরো বছর বয়সে কেউ বাচ্চা হয়?'
অফিসার হাসলেন, 'হা হা হা! পনেরো বছর? বাচ্চাই তো! যাও, বাড়ি যাও।'
'কিন্তু তদন্ত?'
'কীসের তদন্ত, এই লোকটার?'
'হ্যাঁ।'
'সে তো মরে ভূত হয়ে গেছে। এখন তার তদন্ত করতে হলে কবর খুুঁড়তে হবে। একটা বাচ্চা ছেলের কথায় আমরা তো আর একজনের কবর খুঁড়তে পারি না। কী বলো?'
'মরে গেছে! কখন মরল?'
'দু'বছর আগে।' বলে এক টুকরো পত্রিকার কাটা অংশ এগিয়ে দিলেন। বললেন, 'আস্ত একটা ক্রিমিন্যাল ছিল। রাতের অন্ধকারে তার বাড়িতেই কারা যেন পুড়িয়ে মেরেছে।'
'কিন্তু আমি তো গতকাল রাতেও তাকে দেখলাম!' আব্দুর রহিম বলল।
অফিসার কিছু না বলে চেয়ার ছেড়ে চলে গেলেন। তার এক হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। অন্য হাতে ফাইল।
এক সপ্তাহ পর রনি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছে। এখন সুস্থ। তবে নামমাত্র। হাঁটতে দেখলে মনে হয়, এখনি হোঁচট খেয়ে পড়ে যাবে। শরীর বেশ দুর্বল। চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে গেছে। দুর্বল শরীর নিয়ে লাঠিতে ভর করে খেলার মাঠে চলে এসেছে। ছেলেরা মাঠে ছোটাছু্টি করছে। রনি দূরে বসে এক মনে মাঠের উপর দৃষ্টি রেখেছে।
রনিকে দেখেই আব্দুর রহিম খেলার মাঠ ছেড়ে ছুঁটে এল। পাশে বসে নানা ভাবে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। রনি একটি বারের জন্য তাকিয়ে দেখেনি। আব্দুর রহিম বলল, 'কী অসুখ হয়েছিল তোর?'
রনি উদাসীন ভাবে বলল, 'জেনে কী করবি?'
'না এমনি। আচ্ছা, তুই এখন সুস্থ তো?'
'দেখতে পাচ্ছিস না?'
'তা তো পাচ্ছি। কিন্তু... লুৎফর লোকটাকে খুঁজতে আরু মহলে গিয়েছিলি, তাই না?'
কথাটা শুনতেই রনি শক খাওয়ার মতো দ্রুত ফিরে তাকাল। চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, 'তুই কীভাবে জানিস?'
আব্দুর রহিম প্রশ্ন এড়িয়ে বলল, 'ভেবেছিলি, আমার বোনের খুনিকে শাস্তি দেওয়ার কথা বলে আমাকে তোর কাজে ব্যবহার করবি। অথচ আমি জানব না?'
'তুই ভুল বুঝছিস, রহিম।'
'ভুল? ভাগ্যিস একা একা আরু মহলে গিয়েছিলাম। না হলে তো তুই আমাকে ব্যবহার করছিস সেটা জানতেই পারতাম না। ওখানে লুৎফর লোকটাকে দেখেই আমি বুঝতে পেরেছি, কিছু একটা গন্ডগোল আছে। থানায় গিয়ে বুঝলাম, সত্যিই গন্ডগোল। অফিসার বলে কিনা, লুৎফর দু'বছর আগে মারা গিয়েছে। যাকে আমি নিজ চোখে দেখেছি...'
রনি প্রায় চেঁচিয়ে বলল, 'থানায়ও গিয়েছিলি!'
'গিয়েছিলাম তো। আর যাব না। পুলিশ আমাকে সাহায্য করবে না, এটা আমার বোঝা হয়ে গেছে।'
'তুই কত বড়ো ভুল করেছিস, জানিস? চিনিস ওই লুৎফর কে?' বলেই রনি কলার চেপে ধরল।
আব্দুর রহিম নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, 'রাগ হচ্ছে? সত্যিটা জেনে গেছি বলে খুব রাগ হচ্ছে, তাই না?'
'কী জেনেছিস? কিছুই জানিসনি। শোন, ওই লুৎফর একটা লম্পট, ক্রিমিন্যাল। একটা সাইকো। একটা সিরিয়াল রেপিস্ট।' কথাটুকু বলে রনি একটু দম নিল। আব্দুর রহিম অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকল তার দিকে।
রনি আবার বলতে শুরু করল, 'লম্পটটার বিরুদ্ধে কয়টি কেস ফাইল হয়েছে, জানিস? নয়টি। নয়টি রেপ কেস। আরো অসংখ্য কুকর্ম করেছে সে। লোকলজ্জা আর সমাজের ভয়ে চাপা পড়ে গেছে সেসব। একটি মেয়েকেও সে বাঁচতে দেয়নি। প্রথমে শারীরিক অত্যাচার করেছে। তারপর খুন। যেমনটা তোর বোনের ক্ষেত্রে হয়েছে।'
আব্দুর রহিম ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলল, 'আমার বোনকেও...'
'ইয়েস, ইয়েস। ব্যাটা খুব ভালো প্ল্যান করেছিল। ভেবেছিল নিজ বাড়িতে অন্য একজনকে পুড়িয়ে সেটাকে নিজের ডেডবডি হিসেবে চালিয়ে দেবে। পেপার পত্রিকায় সেরকমই লেখা হলো, যেরকম সে চেয়েছিল। কিন্তু তার দুর্ভাগ্য, সে এই গ্রামে চলে এসেছে। প্রথমবার দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছিল। তারপর আমি তাকে ফলো করতে শুরু করি। যখন কনফার্ম হই সে-ই লুৎফর, তখন আমার টিমকে খবর দেই...'
'তোর টিম?'
'হুঁ। তুই কি ভেবেছিস, মিশন ফেয়ার প্লে নামক যে মিশনে যুক্ত হয়েছিস সেটা তোর? ওটা আমার মিশন। গত দু'বছর ধরে সেই মিশন সাকসেসফুল করার জন্য কাজ করছি আমি এবং আমার টিম। যদিও আমি সিক্রেট মিশনে আছি তবুও বলি, আমি গোয়েন্দা বিভাগে চাকরি করি।'
আব্দুর রহিম চমকে উঠে বলল, 'এই বয়সে গোয়েন্দা বিভাগে?'
'বয়স দিয়ে কী হবে? কাজটাই বড়ো। আজকাল বয়স লাগে না। লাগে কনফিডেন্স আর দক্ষতা।'
'এতকিছু জেনেও লুৎফরকে অ্যারেস্ট করা হলো না কেন? কেন আমার বোনটাকে খুন করার সুযোগ পেল সে?'
রনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, 'ওই যে, প্রমাণের অভাব। প্রমাণ ছাড়া আমরা তার কিছুই করতে পারব না।'
'কিন্তু আমি তো পারব! আমিই কুকুরটাকে খুন করব। আজকেই করব।'
'এত সহজ? উল্টো নিজের প্রাণ বাঁচা। তুই যে তার সম্পর্কে জেনে গিয়েছিস, সেটা বুঝতে পারলে এতক্ষণে একদল প্রফোশন্যাল কিলার পাঠিয়ে দেবে।'
'প্রফেশন্যাল কিলার? তা-ও একদল? মগের মুল্লুক নাকি?'
'রহিম, তুই তাকে চিনিস না। সে যখন যা খুশি তা-ই করতে পারে। আমি তাকে ফলো করছি, তার বিরুদ্ধে প্রমাণ যোগাড় করার চেষ্টা করছি, সেটা লুৎফর এখনও জানে না। তবুও সব সময় আমার সেইফটির জন্য অস্ত্রসহ দু'জন মজুদ থাকে। দেখবি?'
বলেই রনি হাত দিয়ে ইশারা করল। মুহূর্তের মধ্যে কোত্থেকে যেন বিশালদেহী দু'টো লোক ধীর পায়ে এগিয়ে এসে রনির পাশে দাঁড়াল। একজন ডান পাশে অপরজন বাঁ পাশে।
কিছু বুঝে উঠার আগেই একজন আব্দুর রহিমের পিঠ বরাবর পিস্তল ঠেকিয়ে বলল, 'চলো আমাদের সাথে।'
আব্দুর রহিম রনিকে উদ্দেশ্য করে বলল, 'এই ছিল তোমাদের প্ল্যান?'
রনি সাড়া দিলো না। নির্লিপ্ত ভাবে তাকিয়ে রইল খেলার মাঠের দিকে। যেন সে কিছুই শুনতে পায়নি। কী ঘটছে কিছুই জানে না।
[রহিমের নাম পরিবর্তন করে আব্দুর রহিম রাখা হয়েছে।]
(চলবে)
মো. ইয়াছিন
Abid faraje, Ayrin kaTun, Masum, Sk nadim, Tanusri roi, Za mahmud, Nafisa akter and লেখাটি পছন্দ করেছে
- Anikaধুমকেতু
- Posts : 20
স্বর্ণমুদ্রা : 1324
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-06-01
Re: মিশন ফেয়ার প্লে
Fri Jun 04, 2021 10:04 pm
( শেষ পর্ব)
'চলো আমাদের সাথে।' বিশালদেহী লোকটা আবারও বলল।
আব্দুর রহিম ঝাঁজালো কণ্ঠে বলল, 'যাব না। যা করার করো, আমি কোথাও যাব না। গুলি করবে? করো গুলি। এখনি করো। তবুও যাব না।'
রনি বলল, 'পাগলামো করিস না। আমরা যা করছি, তোর ভালোর জন্যই করছি। ভালো চাস তো আমাদের কথা শোন। তোকে আমরা একটি সেইফ জায়গায় রাখব। যাতে করে লুৎফরের ভাড়াটে খুনিরা তোকে খুঁজে না পায়।'
'পেয়ে গেলে পাক। আমিও দেখি তার কত শক্তি।'
বিশালদেহী লোকটা বলল, 'আমি কিন্তু তোমাকে আঘাত করতে বাধ্য হব।'
'আচ্ছা তাই? আমি কি তাহলে বসে থাকব? চিৎকার করব না? চিৎকার করলে তোমাদের এই সিক্রেট মিশন আর সিক্রেট থাকবে?'
আব্দুর রহিমের কথার জবাব কেউ দিলো না। সে সোজা হাঁটতে হাঁটতে চলে এল। রনি একবার পিছন থেকে ডাকল, 'রহিম, ফিরে আয়। বড়ো রকমের বিপদ হবে কিন্তু।'
সে কথা কানে নিল না। মাথা নিচু করে চলতে লাগল। বিকেল পড়ে এসেছে। কিছুক্ষণ পর সন্ধ্যা নামবে। রাতের নিঃস্তব্ধতায় সাড়া দিয়ে সবাই যখন ঘুমের রাজ্যে গা এলিয়ে দেবে, ঠিক তখনই আব্দুর রহিম বদলা নিতে বেরিয়ে পড়বে। সমস্ত ঘৃণা মিটিয়ে একসময় সে কাঁদতে বসবে। বহুদিন সে মন খুলে কাঁদে না। আজ চোখের জলে সব দুঃখ কষ্ট দূর করে দেওয়া যাবে।
বাবা জরুরী কাজে ঢাকা গিয়েছেন। দু'দিন বাদে ফিরবেন। আব্দুর রহিম তার ঘরে একা। অন্ধকারে বিছানার উপর বসে আছে। হাতে রিতার একটি ছবি।
আব্দুর রহিম দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। স্কুল টিচার তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'বড়ো হয়ে কী হতে চাও?'
সে স্বাভাবিক ভাবেই জবাব দিয়েছিল, 'একজন আদর্শ খুনি হতে চাই, স্যার।'
মুহূর্তেই শ্রেণীকক্ষ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। স্কুল টিচার সোজা হেড স্যারের নিকট নালিশ করে বসলেন। আব্দুর রহিম অনেক্ষণ ভেবেও বুঝতে পারল না, সে তো খারাপ কিছু বলেনি। একজন আদর্শ খুনি হতে চেয়েছে। যে খুনি পাপিষ্ঠদের বধ করবে। তা হলে স্যার তার বিরুদ্ধে নালিশ করলেন কেন?
রাতের এগারোটা। আঁধারে ঢাকা আরু মহলের নিস্তব্ধতায় আঁচড় কেটে কারা যেন ফিসফিস করে কথা বলছে। আব্দুর রহিম এক পা এক পা ফেলে এগিয়ে যেতে লাগল। ভাঙা দেয়ালের ওপাশে তিন জন লোক। একজনক লুৎফর। বাকি দু'জন অচেনা। তারা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে শুনছে। আর লুৎফর তাদেরকে উদ্দেশ্য করে কী যেন বলছে। কথাগুলো অস্পষ্ট। তবে হাত পা নাড়াচাড়া দেখে বোঝা যাচ্ছে, লুৎফর তাদের ধমকাচ্ছে।
রহিম ঠিক করল, সে আরো একটু এগিয়ে যাবে। যাতে ওদের কথা শোনা যায়। মহলের ভেতরেই বিশাল বড়ো গাছ। সেই গাছের আড়ালেই লুকাতে চাচ্ছিল। কিন্তু গাছের গোড়ায় একটা ব্রিফকেস রাখা ছিল, সেটা অন্ধকারে খেয়াল করেনি। যার ফলে ব্রিফকেসটা পায়ের আঘাতে দুম করে মাটিতে আছড়ে পড়ল। লুৎফর এবং বাকি লুকদু'টো তখনই আব্দুর রহিমকে দেখে ফেলল। একজন পকেট থেকে কী যেন একটা বের করল। সেটা হাতে তুলে নিতেই ঘটল আশ্চর্যজনক ঘটনা। চোখের পলকে ধারালো ছুরি বেরিয়ে এল। একজন লোক সেই ছুরি নিয়ে এগিয়ে আসতে লাগল। ঠিক সেই সময় রহিম দু'হাত দিয়ে শক্ত করে পিস্তল ধরে লোকটার বুক বরাবর গুলি চালিয়ে দিলো। লোকটা ধপাস করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। ভাগ্যিস, রনির দেহরক্ষীর পকেট থেকে পিস্তলটা চুরি করে এনেছে সে। না হলে তো এখনই লোকটার হাতে মারা পড়তে হত!
অন্য লোকটা বলল, 'এই ছোকরা, পিস্তল পেলি কই? দেখি এদিকে দে।' বলে এগিয়ে আসতে লাগল। আব্দুর রহিম জানে, কাছে এসেই সে পিস্তল ছিনিয়ে নেবে। তারপর সেই পিস্তল দিয়েই তাকে নির্দ্বিধায় হত্যা করবে।
লোকটা কাছে আসার আগেই আব্দুর রহিম দ্বিতীয় বার গুলি চালাল। এই লোকটার কপাল খারাপ। বুকে গুলি করতে চেয়েছিল। হাত কেঁপে গিয়ে মাথায় লেগেছে। এবার শুধু বাকি আছে লুৎফর। কিন্তু তাকে সহজ মৃত্যু দিলে চলবে না। তাকে নির্মম ভাবে মারতে হবে। যেন সে মরতে মরতে পস্তাতে পারে, নিজের কৃতকর্মের জন্য।
'এই ছেলে, কী চাস? কী চাস তুই, বল আমাকে।' লুৎফর বলল।
'আমি চাই তোর লাশ। তোর রক্তাক্ত লাশ চাই শয়তান।'
'আমার লাশ? আমি তোর কী ক্ষতি করেছি?'
'তুই আমার বোনকে মেরেছিস। এবার আমি তোকে মারব।'
'আমাকে মেরে ফেললে তোর বোন ফিরে পাবি? ফিরে পেলে মার। আমি বাধা দেব না।'
'সেটা কোনোভাবে সম্ভব?'
'সম্ভব না তো? এজন্যই বলছি, আমার কথা শোন। আমি তোকে অনেক টাকা দেব। অনেক। তুই শুধু আমার হয়ে কাজ করবি। পারবি না?' বলে লুৎফর দু'পা এগিয়ে এল।
'এগোবি না। এগোবি না বললাম। নাহলে কিন্তু এখনই গুলি করব।'
'আচ্ছা আচ্ছা। এগোব না। আমাকে শুধু এটা বল, তোর বোন কোনটা? আমি তো অসংখ্য মেয়েকে খুন করেছি।'
'কয়েক মাস আগে যাকে হত্যা করে পানিতে ফেলে দিয়েছিলি।'
'সেই বাচ্চা মেয়েটা?'
'মাত্র নয় বছর বয়স ছিল। কেন মারলি তাকে? সে তো কারোর ক্ষতি করেনি..'
'মারতে চাইনি। সত্যিই মারতে চাইনি। দড়ি দিয়ে শক্ত করে মুখ বেঁধে ফেলেছিলাম। যাতে চেঁচাতে না পারে। কিন্তু সে নাছোরবান্দা। মুখ বাঁধা অবস্থায় চিৎকার করতে লাগল। আমার মাথায় রাগ চেপে গেল তখনই। হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরলাম। বাচ্চা মানুষ। বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারেনি। আমার একটু মায়া হলো। ততক্ষণে সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। মৃত মানুষকে তো আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব না। প্রমাণ মিটিয়ে পুকুরের জলে ফেলে দিয়ে এলাম।'
'মায়া হয়েছিল? তোর মতো জানোয়ারের মায়া হয়?' আব্দুর রহিম লুৎফরের কপাল বরাবর পিস্তল তাক করল।
লুৎফর বুলেট গতিতে ছুটে এসে থাবা মেরে আব্দুর রহিমের হাত থেকে পিস্তল ফেলে দিলো। কিছু বুঝে উঠার আগেই হাতের ধারালো ছুরি গলা বরাবর চালিয়ে দিলো। আব্দুর রহিম তৎক্ষণাৎ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। দু'হাত দিয়ে গলা চেপে ধরেও রক্ত আটকানো গেল না। হাতের আঙুল বেয়ে টপটপ করে টলটলে রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগল।
লুৎফর রহিমের মাথার কাছে হাঁটু গেঁড়ে বসে বলল, 'আমাকে মারবি বলেছিলি? মার এবার। মার না। দেখি কতটা সাহস তোর। বড়ো বড়ো রাঘব বোয়াল আমার চুল ছিঁড়তে পারেনি। আর তুই পুঁচকে ছেলে আমাকে মারবি? এতই সোজা, অ্যা?'
আব্দুর রহিম কিছু বলতে পারল না। তার পুরো শরীর কাঁপছে। ধীরে ধীরে চোখদু'টো ঝাপসা হয়ে আসছে। তাকিয়ে থাকার মতো শক্তি তার নেই। তবুও গলার কেটে যাওয়া অংশে দু'হাত চেপে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করল।
লুৎফর তার হাত টেনে নিয়ে ধারালো ছুরি দিয়ে একটি আঙুল হাত থেকে আলাদা করে ফেলল। আব্দুর রহিম প্রতিবাদ করতে পারল না। চিৎকার করতেও পারল না। নীরবে চোখের দু'ফোঁটা জল ফেলল।
লুৎফর খিকখিক করে হেসে বলল, 'আমাকে মারবি বলেছিলি না? এবার আমি তোকে দেখাব, মৃত্যু কাকে বলে।'
আব্দুর রহিমের আরো একটি আঙুলে ছুরি চালাল। ঠিক তখনি একদল সশস্ত্র বাহিনী চারদিক থেকে ঘিরে ফেলল। একজন লুৎফরের হাত থেকে ছুরি কেড়ে নিল। তারপর তাকে টেনে দাঁড় করিয়েই পিস্তল দিয়ে মাথায় আঘাত করল। লুৎফর মাটিতে পড়ে গেল। কেউ একজন টর্চ লাইট নিয়ে এগিয়ে এসে আব্দুর রহিমের মুখোমুখি বসল। রহিম শেষবারের মতো চোখ খুলে দেখল, তার সামনে টর্চ হাতে রনি বসে আছে। তার চোখে জল টলোমলো করছে।
আনন্দপুর গ্রামে কিশোরী ধর্ষণ।
পত্রিকায় হেডলাইন পড়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল আব্দুর রহিম। রনির দিকে একবার ফিরে তাকাল। সে ঘাসের বুকে বসে আকাশের চাঁদে দৃষ্টি রেখেছে।
আব্দুর রহিম বলল, 'মেয়েটার কী অবস্থা?'
রনি উদাসীন ভাবে বলল, 'বেঁচে আছে। তবে ভালো নেই।'
'কোথায় আছে?'
'হাসপাতালে।'
'দেখতে যাবি?'
'হ্যাঁ, চল।'
'পরে যাব। মেয়েটির এই অবস্থার জন্য যারা দায়ী, তাদের সব ক'টাকে মেরে তারপর যাব।'
'তাদের অ্যারেস্ট করা পর্যন্তই আমাদের কাজ। বাকিটা আদালত দেখবে।'
'তুই আমাকে এসব শোনাচ্ছিস, রনি? লুৎফরের কথা মনে আছে? তুই নিজ হাতে তাকে গুলি করেছিলি। পরপর চারটা গুলি একদম বুক বরাবর বসিয়ে শান্ত হয়েছিলি, মনে নেই?'
'আছে। সব মনে আছে।'
'তা হলে?'
'চল।'
'কোথায়?'
'খুন করতে।'
'অ্যারেস্ট করবি না?'
'না।'
'সত্যি বলছিস? সত্যি খুন করবি তো?'
'হ্যাঁ, একটাকেও বাঁচতে দেব না।'
'কিন্তু কেন?'
'কারণ, ধর্ষকের একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।'
(সমাপ্ত)
মো. ইয়াছিন
'চলো আমাদের সাথে।' বিশালদেহী লোকটা আবারও বলল।
আব্দুর রহিম ঝাঁজালো কণ্ঠে বলল, 'যাব না। যা করার করো, আমি কোথাও যাব না। গুলি করবে? করো গুলি। এখনি করো। তবুও যাব না।'
রনি বলল, 'পাগলামো করিস না। আমরা যা করছি, তোর ভালোর জন্যই করছি। ভালো চাস তো আমাদের কথা শোন। তোকে আমরা একটি সেইফ জায়গায় রাখব। যাতে করে লুৎফরের ভাড়াটে খুনিরা তোকে খুঁজে না পায়।'
'পেয়ে গেলে পাক। আমিও দেখি তার কত শক্তি।'
বিশালদেহী লোকটা বলল, 'আমি কিন্তু তোমাকে আঘাত করতে বাধ্য হব।'
'আচ্ছা তাই? আমি কি তাহলে বসে থাকব? চিৎকার করব না? চিৎকার করলে তোমাদের এই সিক্রেট মিশন আর সিক্রেট থাকবে?'
আব্দুর রহিমের কথার জবাব কেউ দিলো না। সে সোজা হাঁটতে হাঁটতে চলে এল। রনি একবার পিছন থেকে ডাকল, 'রহিম, ফিরে আয়। বড়ো রকমের বিপদ হবে কিন্তু।'
সে কথা কানে নিল না। মাথা নিচু করে চলতে লাগল। বিকেল পড়ে এসেছে। কিছুক্ষণ পর সন্ধ্যা নামবে। রাতের নিঃস্তব্ধতায় সাড়া দিয়ে সবাই যখন ঘুমের রাজ্যে গা এলিয়ে দেবে, ঠিক তখনই আব্দুর রহিম বদলা নিতে বেরিয়ে পড়বে। সমস্ত ঘৃণা মিটিয়ে একসময় সে কাঁদতে বসবে। বহুদিন সে মন খুলে কাঁদে না। আজ চোখের জলে সব দুঃখ কষ্ট দূর করে দেওয়া যাবে।
বাবা জরুরী কাজে ঢাকা গিয়েছেন। দু'দিন বাদে ফিরবেন। আব্দুর রহিম তার ঘরে একা। অন্ধকারে বিছানার উপর বসে আছে। হাতে রিতার একটি ছবি।
আব্দুর রহিম দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। স্কুল টিচার তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'বড়ো হয়ে কী হতে চাও?'
সে স্বাভাবিক ভাবেই জবাব দিয়েছিল, 'একজন আদর্শ খুনি হতে চাই, স্যার।'
মুহূর্তেই শ্রেণীকক্ষ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। স্কুল টিচার সোজা হেড স্যারের নিকট নালিশ করে বসলেন। আব্দুর রহিম অনেক্ষণ ভেবেও বুঝতে পারল না, সে তো খারাপ কিছু বলেনি। একজন আদর্শ খুনি হতে চেয়েছে। যে খুনি পাপিষ্ঠদের বধ করবে। তা হলে স্যার তার বিরুদ্ধে নালিশ করলেন কেন?
রাতের এগারোটা। আঁধারে ঢাকা আরু মহলের নিস্তব্ধতায় আঁচড় কেটে কারা যেন ফিসফিস করে কথা বলছে। আব্দুর রহিম এক পা এক পা ফেলে এগিয়ে যেতে লাগল। ভাঙা দেয়ালের ওপাশে তিন জন লোক। একজনক লুৎফর। বাকি দু'জন অচেনা। তারা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে শুনছে। আর লুৎফর তাদেরকে উদ্দেশ্য করে কী যেন বলছে। কথাগুলো অস্পষ্ট। তবে হাত পা নাড়াচাড়া দেখে বোঝা যাচ্ছে, লুৎফর তাদের ধমকাচ্ছে।
রহিম ঠিক করল, সে আরো একটু এগিয়ে যাবে। যাতে ওদের কথা শোনা যায়। মহলের ভেতরেই বিশাল বড়ো গাছ। সেই গাছের আড়ালেই লুকাতে চাচ্ছিল। কিন্তু গাছের গোড়ায় একটা ব্রিফকেস রাখা ছিল, সেটা অন্ধকারে খেয়াল করেনি। যার ফলে ব্রিফকেসটা পায়ের আঘাতে দুম করে মাটিতে আছড়ে পড়ল। লুৎফর এবং বাকি লুকদু'টো তখনই আব্দুর রহিমকে দেখে ফেলল। একজন পকেট থেকে কী যেন একটা বের করল। সেটা হাতে তুলে নিতেই ঘটল আশ্চর্যজনক ঘটনা। চোখের পলকে ধারালো ছুরি বেরিয়ে এল। একজন লোক সেই ছুরি নিয়ে এগিয়ে আসতে লাগল। ঠিক সেই সময় রহিম দু'হাত দিয়ে শক্ত করে পিস্তল ধরে লোকটার বুক বরাবর গুলি চালিয়ে দিলো। লোকটা ধপাস করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। ভাগ্যিস, রনির দেহরক্ষীর পকেট থেকে পিস্তলটা চুরি করে এনেছে সে। না হলে তো এখনই লোকটার হাতে মারা পড়তে হত!
অন্য লোকটা বলল, 'এই ছোকরা, পিস্তল পেলি কই? দেখি এদিকে দে।' বলে এগিয়ে আসতে লাগল। আব্দুর রহিম জানে, কাছে এসেই সে পিস্তল ছিনিয়ে নেবে। তারপর সেই পিস্তল দিয়েই তাকে নির্দ্বিধায় হত্যা করবে।
লোকটা কাছে আসার আগেই আব্দুর রহিম দ্বিতীয় বার গুলি চালাল। এই লোকটার কপাল খারাপ। বুকে গুলি করতে চেয়েছিল। হাত কেঁপে গিয়ে মাথায় লেগেছে। এবার শুধু বাকি আছে লুৎফর। কিন্তু তাকে সহজ মৃত্যু দিলে চলবে না। তাকে নির্মম ভাবে মারতে হবে। যেন সে মরতে মরতে পস্তাতে পারে, নিজের কৃতকর্মের জন্য।
'এই ছেলে, কী চাস? কী চাস তুই, বল আমাকে।' লুৎফর বলল।
'আমি চাই তোর লাশ। তোর রক্তাক্ত লাশ চাই শয়তান।'
'আমার লাশ? আমি তোর কী ক্ষতি করেছি?'
'তুই আমার বোনকে মেরেছিস। এবার আমি তোকে মারব।'
'আমাকে মেরে ফেললে তোর বোন ফিরে পাবি? ফিরে পেলে মার। আমি বাধা দেব না।'
'সেটা কোনোভাবে সম্ভব?'
'সম্ভব না তো? এজন্যই বলছি, আমার কথা শোন। আমি তোকে অনেক টাকা দেব। অনেক। তুই শুধু আমার হয়ে কাজ করবি। পারবি না?' বলে লুৎফর দু'পা এগিয়ে এল।
'এগোবি না। এগোবি না বললাম। নাহলে কিন্তু এখনই গুলি করব।'
'আচ্ছা আচ্ছা। এগোব না। আমাকে শুধু এটা বল, তোর বোন কোনটা? আমি তো অসংখ্য মেয়েকে খুন করেছি।'
'কয়েক মাস আগে যাকে হত্যা করে পানিতে ফেলে দিয়েছিলি।'
'সেই বাচ্চা মেয়েটা?'
'মাত্র নয় বছর বয়স ছিল। কেন মারলি তাকে? সে তো কারোর ক্ষতি করেনি..'
'মারতে চাইনি। সত্যিই মারতে চাইনি। দড়ি দিয়ে শক্ত করে মুখ বেঁধে ফেলেছিলাম। যাতে চেঁচাতে না পারে। কিন্তু সে নাছোরবান্দা। মুখ বাঁধা অবস্থায় চিৎকার করতে লাগল। আমার মাথায় রাগ চেপে গেল তখনই। হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরলাম। বাচ্চা মানুষ। বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারেনি। আমার একটু মায়া হলো। ততক্ষণে সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। মৃত মানুষকে তো আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব না। প্রমাণ মিটিয়ে পুকুরের জলে ফেলে দিয়ে এলাম।'
'মায়া হয়েছিল? তোর মতো জানোয়ারের মায়া হয়?' আব্দুর রহিম লুৎফরের কপাল বরাবর পিস্তল তাক করল।
লুৎফর বুলেট গতিতে ছুটে এসে থাবা মেরে আব্দুর রহিমের হাত থেকে পিস্তল ফেলে দিলো। কিছু বুঝে উঠার আগেই হাতের ধারালো ছুরি গলা বরাবর চালিয়ে দিলো। আব্দুর রহিম তৎক্ষণাৎ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। দু'হাত দিয়ে গলা চেপে ধরেও রক্ত আটকানো গেল না। হাতের আঙুল বেয়ে টপটপ করে টলটলে রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগল।
লুৎফর রহিমের মাথার কাছে হাঁটু গেঁড়ে বসে বলল, 'আমাকে মারবি বলেছিলি? মার এবার। মার না। দেখি কতটা সাহস তোর। বড়ো বড়ো রাঘব বোয়াল আমার চুল ছিঁড়তে পারেনি। আর তুই পুঁচকে ছেলে আমাকে মারবি? এতই সোজা, অ্যা?'
আব্দুর রহিম কিছু বলতে পারল না। তার পুরো শরীর কাঁপছে। ধীরে ধীরে চোখদু'টো ঝাপসা হয়ে আসছে। তাকিয়ে থাকার মতো শক্তি তার নেই। তবুও গলার কেটে যাওয়া অংশে দু'হাত চেপে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করল।
লুৎফর তার হাত টেনে নিয়ে ধারালো ছুরি দিয়ে একটি আঙুল হাত থেকে আলাদা করে ফেলল। আব্দুর রহিম প্রতিবাদ করতে পারল না। চিৎকার করতেও পারল না। নীরবে চোখের দু'ফোঁটা জল ফেলল।
লুৎফর খিকখিক করে হেসে বলল, 'আমাকে মারবি বলেছিলি না? এবার আমি তোকে দেখাব, মৃত্যু কাকে বলে।'
আব্দুর রহিমের আরো একটি আঙুলে ছুরি চালাল। ঠিক তখনি একদল সশস্ত্র বাহিনী চারদিক থেকে ঘিরে ফেলল। একজন লুৎফরের হাত থেকে ছুরি কেড়ে নিল। তারপর তাকে টেনে দাঁড় করিয়েই পিস্তল দিয়ে মাথায় আঘাত করল। লুৎফর মাটিতে পড়ে গেল। কেউ একজন টর্চ লাইট নিয়ে এগিয়ে এসে আব্দুর রহিমের মুখোমুখি বসল। রহিম শেষবারের মতো চোখ খুলে দেখল, তার সামনে টর্চ হাতে রনি বসে আছে। তার চোখে জল টলোমলো করছে।
আনন্দপুর গ্রামে কিশোরী ধর্ষণ।
পত্রিকায় হেডলাইন পড়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল আব্দুর রহিম। রনির দিকে একবার ফিরে তাকাল। সে ঘাসের বুকে বসে আকাশের চাঁদে দৃষ্টি রেখেছে।
আব্দুর রহিম বলল, 'মেয়েটার কী অবস্থা?'
রনি উদাসীন ভাবে বলল, 'বেঁচে আছে। তবে ভালো নেই।'
'কোথায় আছে?'
'হাসপাতালে।'
'দেখতে যাবি?'
'হ্যাঁ, চল।'
'পরে যাব। মেয়েটির এই অবস্থার জন্য যারা দায়ী, তাদের সব ক'টাকে মেরে তারপর যাব।'
'তাদের অ্যারেস্ট করা পর্যন্তই আমাদের কাজ। বাকিটা আদালত দেখবে।'
'তুই আমাকে এসব শোনাচ্ছিস, রনি? লুৎফরের কথা মনে আছে? তুই নিজ হাতে তাকে গুলি করেছিলি। পরপর চারটা গুলি একদম বুক বরাবর বসিয়ে শান্ত হয়েছিলি, মনে নেই?'
'আছে। সব মনে আছে।'
'তা হলে?'
'চল।'
'কোথায়?'
'খুন করতে।'
'অ্যারেস্ট করবি না?'
'না।'
'সত্যি বলছিস? সত্যি খুন করবি তো?'
'হ্যাঁ, একটাকেও বাঁচতে দেব না।'
'কিন্তু কেন?'
'কারণ, ধর্ষকের একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।'
(সমাপ্ত)
মো. ইয়াছিন
Abid faraje, Ayrin kaTun, Masum, Sk nadim, Sume akter, Tanusri roi, Za mahmud and লেখাটি পছন্দ করেছে
Permissions in this forum:
You cannot reply to topics in this forum