- Trimatraধুমকেতু
- Posts : 23
স্বর্ণমুদ্রা : 1434
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-06-05
যেখানে আঁধার নামে
Sat Jun 05, 2021 8:09 pm
১ম পর্ব
"আমার স্ত্রী মনে করে সে সন্তানসম্ভবা।"
"এমন সুসংবাদেও আপনার কণ্ঠ শুনে বেশ বিচলিত মনে হচ্ছে! কারণ?"
"গত সপ্তাহেই আমার স্ত্রীর ডেলিভারি হয়েছে। এরই মধ্যে কেউ পুনরায় সন্তানসম্ভবা কীভাবে হতে পারে?"
ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে আসা কণ্ঠস্বর পরিচিত কারো নয়। তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই, কিন্তু লোকটির বলা শেষ কথাটুকু তাকে হঠাৎ করেই ভাবনার জগতে আচমকা এক ধাক্কায় ফেলে দিয়েছে। তার নিরবতায় ওপাশ থেকে বারবার "হ্যালো, হ্যালো" ধ্বনি ভেসে আসছে।
সেদিকটাতে মনোনিবেশ করতে নিজেকে মৃদু ঝাঁকিয়ে নিলেন তিনি। ওপাশের লোকটার হ্যালো'র জবাবে পাল্টা 'হ্যালো' বললেন। লোকটা পুলকিত হয়েছে বোধহয়, এদিক থেকে সাড়া পেয়ে সাথে সাথে প্রশ্ন করে বসলেন, "হ্যালো ড. ইফতেখার জাওয়াদ, আমাকে শুনতে পাচ্ছেন?"
"জি শুনছি।"- উত্তর দিলেন ড. জাওয়াদ।
"আপনি কি কিছু নিয়ে চিন্তা করছিলেন?"- ওপাশের লোকটি প্রশ্ন করলেন।
"তেমন কিছু নয়। আপনি আপনার সমস্যার কথা বলছিলেন। সেটা বলুন।"
"মনে হচ্ছে বিরক্ত করছি।"
"আরে না না!"- লোকটির উদ্দেশ্যে মুখে হাসির ছাপ ফুটালেন ডক্টর। যদিও তার হাসিমুখটা সে ফোনের ওপাশ থেকে দেখতে পারবে না। অভ্যাসবশত, বলা চলে। রোগীদের সাথে হাসিমুখে কথা বলাকে অন্যতম একটা গুণ মনে করেন তিনি৷ কথায় প্রফুল্লতা বজায় রেখে তিনি বলতে থাকলেন, "আপনার বলা শেষ কথাটুকু শুনে একটুখানি অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম। বলতে পারেন কথাটি হঠাৎ করেই ভাবিয়ে তুলেছে।"
"আমি খুব চিন্তিত।"
"এটা কি শুধুমাত্র আপনার স্ত্রীর একটা ভুল ধারণা? নাকি অন্যকিছু?"
"আমি নিছক হাসিখেলা বলেই ধরে নিতাম। কিন্তু আমি দেখেছি মাঝেমাঝে সে এমন অসুস্থ হয়ে পড়ে যে, সারা শরীর থেকে দরদর করে ঘাম ঝরতে থাকে, গায়ে হাত দিলে বুঝা যায় জ্বর জ্বর ভাব এসেছে। ব্যথায় দু'হাতে পেট চেপে ধরে কাতরাতে থাকে ও। চোখের সামনে এভাবে তার যন্ত্রণাকে কীভাবে সহ্য করতে পারি বলুন?"
ড. জাওয়াদ নিজেও বেশ কিছুটা ভাবনায় পড়ে গেলেন। তবে একটা বিষয় তিনি বুঝতে পারছেন না- তিনি সাইকিয়াট্রিস্ট, মানসিক রোগের ডাক্তার; শরীরবৃত্তীয় রোগের নয়। লোকটি কি জানে সে ব্যাপারে? তিনি প্রশ্ন করলেন, "আচ্ছা জনাব..."
"মুশতাক মাসুদ।"
"জনাব মাসুদ, আপনি কি এটা জানেন যে আমি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট?"
"হ্যাঁ, অবশ্যই জানি৷ আপনার ব্যাপারে কে না জানে?"
"কিছু মনে করবেন না। আমার মনে হচ্ছে আপনার স্ত্রীর জন্য সাইকিয়াট্রিস্ট নয়, ডাক্তার প্রয়োজন।"- ইতস্তত করে বলে ফেললেন ড. জাওয়াদ।
"আপনিও তো একজন ডাক্তার।"- ওপাশ থেকে অবিচলিত উত্তর।
"কিন্তু আমি মানসিক রোগের ডাক্তার।"
"মানসিকভাবে দুর্বল হলে তবেই না শারীরিক রোগ দেখা দেয়।"
"আপনার কথা পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারলাম না।"- অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন ড. ইফতেখার জাওয়াদ।
"আমার স্ত্রী মানসিক আঘাতের কারণে এমনটা করছে। এটা আমার ধারণা নয়, প্রায় নিশ্চিত বললেও ভুল বলবো না।"
"আশা করি আপনার কথার ব্যাখ্যা পাবো।"
"আসলে.."- কিছু সময়ের নিরবতার ঢল বেয়ে আসে। ড. জাওয়াদ বেশ আগ্রহের সাথেই ফোন কানে ধরে আছেন। নিরবতা ঠেলে মুশতাক মাসুদ বললেন, "আসলে আমার স্ত্রী পরপর দু'বারই মৃত সন্তানের জন্ম দিয়েছে।"
ড. জাওয়াদ কিছুটা বিব্রতবোধ করলেন, সাথে অবাকও হলেন সীমিত। আচ্ছা ওপাশের লোকটিকে কি বিষণ্ণতায় ঘিরে ধরেছে? তাকে কি সান্ত্বনা দেওয়া উচিত? আর দিলেও কী বলে সান্ত্বনা দিবেন তিনি?- নিজেকে একের পর এজ প্রশ্ন করে যাচ্ছেন ডক্টর।
তার ধ্যান ভেঙ্গে দিতে লোকটি আবারও বেশ জোরেসোরে 'হ্যালো' বলে উঠলো। ড. জাওয়াদ প্রশ্ন করলেন, "আপনার স্ত্রীর এমন অবস্থা হলে তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাননি?"
"নিয়েছিলাম। আল্ট্রাসনোগ্রাম করার পরে একেবারেই স্বাভাবিক রিপোর্ট পেয়ছিলাম। কোনো ভ্রূণের অস্তিত্ব ছিল না।"
"কোথায় নিয়েছিলেন?"
"আমাদের এখানে একটিমাত্র প্রাইভেট হসপিটাল আছে, সেখানেই যাই। সরকারী হসপিটালটির অবস্থা নাজেহাল। বারান্দায় পা রাখতেও মন সায় দেয় না।"
"প্রাইভেট হাসপাতালটির নাম?"
"প্যারাডাইস গার্ডেন।"
_____
প্যারাডাইস গার্ডেনের করিডোর দিয়ে ধীরপায়ে এগোচ্ছে শাদাব। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে সে। মাঝেমাঝে তার বাদামী বর্ণের চোখদু'টোর উপরে অবস্থান নেওয়া ভ্রু কুঁচকে নিচ্ছে সে।
'ধুমপান নিষেধ'- লেখাটির থেকে চোখ সরিয়ে তারই নিচে থাকা ধুমপানরত লোকটির দিকে তাকায় ও। আবারও ভ্রু কুঁচকে যায় তার। এই ব্যাটা কী অন্ধ? নাকি মূর্খ? এতবড় করে 'ধুমপান নিষেধ' লেখাটিও কি তার চোখে পড়ছে না? মেজাজ বিগড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা তার। হাসপাতাল সিগারেট খাওয়ার জায়গা? বিদ্যুৎগতিতে লোকটির দিকে ছুটে গেল সে।
"কী ব্যাপার ভাই? লেখাপড়া জানেন না? নাকি ন্যূনতম জ্ঞানটুকুও নেই?"- চোখে হুংকারের চিহ্ন রেখে সূঁচালো দৃষ্টিতে তাকায় সে লোকটির দিকে। তার হঠাৎ এমন আচরণে লোকটি তার কপাল এমনভাবে কুঁচকায় মনে হয় যেন শাদাব ভুল কিছু বলে ফেলেছে। আরও বিরক্ত হয়ে ওঠে সে।
"এখনও সিগারেট ফুঁকছেন? এখানে যে 'ধুমপান নিষেধ' লেখা, এটি চোখে পড়েনি আপনার? তাছাড়া হাসপাতালের মধ্যে কোন আক্কেলে মনের আনন্দে সিগারেট খাচ্ছেন?"
লোকটি এবার তীক্ষ্ণ তীর্যক দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে৷ ঠোঁট থেকে সিগারেটটি বের করে হাত কিঞ্চিৎ উঁচু করে সিগারেটটির দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে বলে, "আমি এখানকার কম্পাউন্ডার।"
তার কথা শুনে শাদাবের মেজাজ আরও বিগড়ে যায়। কম্পাউন্ডার তো কী? স্বয়ং মন্ত্রীপরিষদের কেউও তো হাসপাতালে সিগারেট খাওয়ার ভ্রান্ত চিন্তা করবে না। ইচ্ছে করছে সজোরে নাক বরাবর ঘুষি ফেলতে। কিন্তু এখানে সে নতুন এসেছে। মফস্বল এলাকা, একেবারেই কাউকে চেনে না সে। সাবধানে চলাফেরা করতে হবে তার। চাপা ক্রোধ সামলে রেখে সে প্রশ্ন করলো, "মা ও শিশু স্বাস্থ্য ইউনিট কত ফ্লোরে?"
লোকটি এবার ইচ্ছা করে শাদাবের মুখের উপর ধোঁয়া ছেড়ে উত্তর দেয়, "চতুর্থ ফ্লোরে।"
বাচ্চাকণ্ঠের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসতে লাগে শাদাবের কানে। দেয়ালগুলোর ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় ভিন্ন ধরনের ছাপ লেগে আছে৷ ধুলোয় ভরা ফ্লোর। প্রাইভেট হাসপাতালেরও এমন বেহাল অবস্থা দেখতে তার মোটেও ভালো লাগছে না। কোন আক্কেলে যে এই হাসপাতালের নাম 'প্যারাডাইস গার্ডেন' রেখেছিল কে জানে! প্যারাডাইস না ছাঁই! নামকরণের দায়িত্ব তার উপর দেওয়া হলে নির্ঘাত নাম রাখতো 'গার্ডেন অব হেল' কিংবা 'হেল ইয়ার্ড'। মনেমনে বিড়বিড় করতে করতে পকেট থেকে ফোন বের করে ডায়াল করলো একটা নম্বরে। কয়েক সেকেন্ড রিং হতেই ওপাশ থেকে ফোনটা তুললো কেউ।
"হ্যালো, ড. জাওয়াদ?"
"হ্যাঁ বলো শাদাব। কতদূর কী ইনভেস্টিগেট করলে?"
"আমার এখানে একদমই স্বস্তি লাগছে না ডক্টর।"- ধীরপায়ে হাঁটতে হাঁটতে বললো সে।
"কেন?"- ওপাশ থেকে ড. জাওয়াদের মৃদু হাসির শব্দ ভেসে আসলো।
"জানি না কিন্তু এখানকার পরিবেশ মোটেও বন্ধুসুলভ নয়। কেমন একটা ভূতুড়ে ভাব আছে।"- বিচলিত কণ্ঠে উত্তর দেয় শাদাব।
"ওখানে কিন্তু তুমি সেচ্ছায় যেতে চেয়েছিলে।"
"আমি জানি ডক্টর। আপনার দরকার ছিল এখানে ছোটখাটো তদন্ত করার জন্য কাউকে পাঠানো, ভাবলাম এ সুযোগ হাতছাড়া করা উচিত নয় আমার। কিন্তু এসেই দেখছি মহা ঝামেলায় পড়ে গেলাম।"
ওপাশ থেকে ড. জাওয়াদের হাসির শব্দ ভেসে আসছে। বিষয়টা বেশ উপভোগ করছেন তিনি। বললেন, "নিজেকে প্রাইভেট ডিটেকটিভ দাবি করতে হলে আরও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে তোমাকে বাছা।"
"কিন্তু ডক্টর, এখানে পাঠানোর কারণ এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না।"
"মুশতাক মাসুদের ব্যাপারে কতটুকু তথ্য পেয়েছ?"
"রিশেপশন কাউন্টার থেকে তার স্ত্রীকে নিয়ে ভর্তির তারিখ ও সময় জানতে পেরেছি। তার স্ত্রী একটি মৃত সন্তানের জন্ম দেন এটাও সত্য। এর পরে তিনি তার স্ত্রীকে নিয়ে আবার চেক-আপ করাতে এসেছিলেন।"
"তবে মি. মাসুদের বলা কথাগুলো মিথ্যে ছিল না।"
"কিন্তু তার কথায় আপনার সন্দেহ হওয়ার কারণ বুঝলাম না ডক্টর।"- বিস্ময়ের সাথে প্রশ্ন করলো শাদাব।
"লোকটি বলেছিল সে আমার নম্বর নাকি ফোনবুক থেকে পেয়েছে। কিন্তু সেখানে আমার ব্যক্তিগত নম্বর দেওয়া নেই। অথচ লোকটি আমার ব্যক্তিগত নম্বরে কল করেছিল। ভাবলাম কেউ হয়তো ইচ্ছে করে বিরক্ত করতে চাইছে আমাকে। তাই মনে করলাম কথাটির সত্যতা যাচাই করা উচিত। আর তুমি নিজেই এটার তদন্ত করতে চাইলে।"
"আরেকটা বিষয় আমার চোখে পড়েছে ডক্টর।"
"কী সেটা?"
"একজন মহিলার তীব্র আর্তনাদ। মনে হচ্ছে তার বাচ্চা মারা গিয়েছে। কিন্তু এখানে দায়িত্বরত ডাক্তার বা নার্স কারো মধ্যেই কোনো ভ্রুক্ষেপ দেখলাম না।"
"স্ট্রেইঞ্জ!"- ওপাশ থেকে বললেন ড. জাওয়াদ, "তুমি যতদূর পারো আরও তথ্য যোগাড় করতে থাকো। হাসপাতাল, ডাক্তার, কর্মচারী সবার। আর মুশতাক মাসুদের ব্যাপারেও।"
শাদাব সম্মতি জানিয়ে ফোন রেখে দেয়।
_____
চোখ খুলে নিজেকে প্রায় অন্ধকার একটা কক্ষে আবিষ্কার করে শাদাব। সামনে একটা ছোটখাটো বেড পড়ে আছে। মৃদু আলোয় তার উপরে থাকা সবুজ বেডশিটের দিকে চোখ পড়ে তার৷ সবুজ বেডশিট! প্যারাডাইস গার্ডেনের বেডগুলোয় দেখেছিল সে৷ নিজের মধ্যে আতঙ্ক ছেয়ে আসে এবার। সে এখানে কেন? আর কীভাবে?
পায়ের আওয়াজ শুনতে পায় এবার সে। একজনের নয়, কমপক্ষে তিনজন আসছে এদিকটায়। নিজেদের মধ্যে বলা ফিসফিসিয়ে কথাগুলোও তার কান অব্দি পৌঁছাতে পারছে। সে কান খাড়া করে কথাগুলো শোনার চেষ্টা করলো। কিন্তু স্পষ্টভাবে তা মোটেও সম্ভব হচ্ছে না তার পক্ষে। শুধুমাত্র ফিসফিসানি-ই আসছে যা।
পায়ের আওয়াজগুলো জোরালো হতে লাগলো। সে বুঝতে পারে রুমের কাছাকাছি চলে এসেছে তারা৷ কিন্তু কারা আসছে এদিকে? আর সে-ই বা এখানে কীভাবে? "অদ্ভুত! আমি উঠে গিয়ে দেখছি না কেন?"- নিজেকে প্রশ্ন করলো সে। পায়ের উপর শক্তি দিয়ে উঠতে চেষ্টা করলো, কিন্তু কিছু একটা টেনে ধরছে তাকে। চেয়ারের হাতল থেকে হাত সরানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু অদৃশ্য কোনো শক্তি দিয়ে বাঁধা সেগুলোও। কোনোভাবেই নড়াচড়া করতে পারছে না ও।
পায়ের শব্দগুলো এদিকেই আসছে৷ হ্যাঁ, সে নিশ্চিত- শব্দগুলো তার সামনেই হচ্ছে। কিন্তু অবয়বগুলোকে দেখতে পারছে না সে। হঠাৎ বেডের উপর থাকা লাইটটি জ্বলে উঠলো, অপারেশন লাইট। মানে সে হাসপাতালেই আছে- পুরোপুরি নিশ্চিত হলো শাদাব। লাইটের আলোয় এবার বাকি অবয়বগুলোর দিকে খেয়াল করে সে। মোট চারজন, যদিও সে ধারণা করেছিল তিনজন হবে হয়তো। এবার বেডের উপর শুয়ে থাকা মহিলাটির দিকে চোখ পড়ে তার। কেঁপে উঠলো সে। এই মহিলা কোত্থেকে এলো? অথচ কিছুসময় আগেও বেড ফাঁকা পড়ে ছিল, মৃদু নীল আলোয় দেখেছে সে। আর বেডের দু'পাশে দাঁড়ানো চারজন কারা? নীল এপ্রোন, মুখে সার্জিক্যাল মাস্ক। "ডাক্তার?"- আবারও নিজেকে প্রশ্ন করে সে৷ এখানে এসেছে কেন? অপারেশন করতে? কিন্তু সে এখানে কী করছে? আর কেনই বা নড়তে পারছে না চেয়ার থেকে। আর ডাক্তারগুলোই বা তার দিকে কেন দেখছে না? একমাত্র মহিলাটিই তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।
এক ঝটকায় বেডটিকে ঘুরিয়ে দেয় তারা৷ এবার বেডে থাকা মহিলার পায়ের দিকটা তার সামনে। ভাঁজকরা দু'পায়ের উপরে থাকা নীল চাদরের নিচ দিয়ে মহিলার দেহের নিম্নভাগ স্পষ্ট তার চোখে পড়ছে৷ লজ্জায় ঘাড় ঘুরিয়ে নিতে চায় সে। কিন্তু মনে হচ্ছে কেউ তার মাথাকেও চেপে ধরে রেখেছে, ডানে-বায়ে ঘোরানোর কোনো শক্তি পাচ্ছে না সে। চোখ বন্ধ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। তার সামনেই কি এরা অপারেশন করবে? কিন্তু অপারেশন তো মনে হচ্ছে না। তবে কী? ডেলিভারি? ডেলিভারি করাতে চারজন ডাক্তার! যতটা না অবাক হচ্ছে তার থেকে বেশি ভয় পাচ্ছে সে।
মহিলার হাঁটুর উপরে থাকা চাদরের কারণে ওপাশে থাকা তার মুখটিকে দেখতে পাচ্ছে না শাদাব। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে মহিলাটি চাদরের উপর দিয়ে মাথা উঁচু করে তার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে তোলে ঠোঁটের কোণায়। শাদাব বুঝতে পারে সে ঘামছে। তার সামনেই মহিলাটির বাচ্চা প্রসব করানো হয়। কিন্তু বাচ্চাটি মোটেও কান্না করছে না। "মৃত?"- আবারও নিজেকে প্রশ্ন করলো সে।
বাচ্চাটির গায়ে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ৷ হঠাৎ শাদাবের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় সে। সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া বাচ্চাটি ছোটছোট পা ফেলে এগিয়ে আসছে তার দিকে।
চলবে...
Sayan
"আমার স্ত্রী মনে করে সে সন্তানসম্ভবা।"
"এমন সুসংবাদেও আপনার কণ্ঠ শুনে বেশ বিচলিত মনে হচ্ছে! কারণ?"
"গত সপ্তাহেই আমার স্ত্রীর ডেলিভারি হয়েছে। এরই মধ্যে কেউ পুনরায় সন্তানসম্ভবা কীভাবে হতে পারে?"
ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে আসা কণ্ঠস্বর পরিচিত কারো নয়। তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই, কিন্তু লোকটির বলা শেষ কথাটুকু তাকে হঠাৎ করেই ভাবনার জগতে আচমকা এক ধাক্কায় ফেলে দিয়েছে। তার নিরবতায় ওপাশ থেকে বারবার "হ্যালো, হ্যালো" ধ্বনি ভেসে আসছে।
সেদিকটাতে মনোনিবেশ করতে নিজেকে মৃদু ঝাঁকিয়ে নিলেন তিনি। ওপাশের লোকটার হ্যালো'র জবাবে পাল্টা 'হ্যালো' বললেন। লোকটা পুলকিত হয়েছে বোধহয়, এদিক থেকে সাড়া পেয়ে সাথে সাথে প্রশ্ন করে বসলেন, "হ্যালো ড. ইফতেখার জাওয়াদ, আমাকে শুনতে পাচ্ছেন?"
"জি শুনছি।"- উত্তর দিলেন ড. জাওয়াদ।
"আপনি কি কিছু নিয়ে চিন্তা করছিলেন?"- ওপাশের লোকটি প্রশ্ন করলেন।
"তেমন কিছু নয়। আপনি আপনার সমস্যার কথা বলছিলেন। সেটা বলুন।"
"মনে হচ্ছে বিরক্ত করছি।"
"আরে না না!"- লোকটির উদ্দেশ্যে মুখে হাসির ছাপ ফুটালেন ডক্টর। যদিও তার হাসিমুখটা সে ফোনের ওপাশ থেকে দেখতে পারবে না। অভ্যাসবশত, বলা চলে। রোগীদের সাথে হাসিমুখে কথা বলাকে অন্যতম একটা গুণ মনে করেন তিনি৷ কথায় প্রফুল্লতা বজায় রেখে তিনি বলতে থাকলেন, "আপনার বলা শেষ কথাটুকু শুনে একটুখানি অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম। বলতে পারেন কথাটি হঠাৎ করেই ভাবিয়ে তুলেছে।"
"আমি খুব চিন্তিত।"
"এটা কি শুধুমাত্র আপনার স্ত্রীর একটা ভুল ধারণা? নাকি অন্যকিছু?"
"আমি নিছক হাসিখেলা বলেই ধরে নিতাম। কিন্তু আমি দেখেছি মাঝেমাঝে সে এমন অসুস্থ হয়ে পড়ে যে, সারা শরীর থেকে দরদর করে ঘাম ঝরতে থাকে, গায়ে হাত দিলে বুঝা যায় জ্বর জ্বর ভাব এসেছে। ব্যথায় দু'হাতে পেট চেপে ধরে কাতরাতে থাকে ও। চোখের সামনে এভাবে তার যন্ত্রণাকে কীভাবে সহ্য করতে পারি বলুন?"
ড. জাওয়াদ নিজেও বেশ কিছুটা ভাবনায় পড়ে গেলেন। তবে একটা বিষয় তিনি বুঝতে পারছেন না- তিনি সাইকিয়াট্রিস্ট, মানসিক রোগের ডাক্তার; শরীরবৃত্তীয় রোগের নয়। লোকটি কি জানে সে ব্যাপারে? তিনি প্রশ্ন করলেন, "আচ্ছা জনাব..."
"মুশতাক মাসুদ।"
"জনাব মাসুদ, আপনি কি এটা জানেন যে আমি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট?"
"হ্যাঁ, অবশ্যই জানি৷ আপনার ব্যাপারে কে না জানে?"
"কিছু মনে করবেন না। আমার মনে হচ্ছে আপনার স্ত্রীর জন্য সাইকিয়াট্রিস্ট নয়, ডাক্তার প্রয়োজন।"- ইতস্তত করে বলে ফেললেন ড. জাওয়াদ।
"আপনিও তো একজন ডাক্তার।"- ওপাশ থেকে অবিচলিত উত্তর।
"কিন্তু আমি মানসিক রোগের ডাক্তার।"
"মানসিকভাবে দুর্বল হলে তবেই না শারীরিক রোগ দেখা দেয়।"
"আপনার কথা পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারলাম না।"- অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন ড. ইফতেখার জাওয়াদ।
"আমার স্ত্রী মানসিক আঘাতের কারণে এমনটা করছে। এটা আমার ধারণা নয়, প্রায় নিশ্চিত বললেও ভুল বলবো না।"
"আশা করি আপনার কথার ব্যাখ্যা পাবো।"
"আসলে.."- কিছু সময়ের নিরবতার ঢল বেয়ে আসে। ড. জাওয়াদ বেশ আগ্রহের সাথেই ফোন কানে ধরে আছেন। নিরবতা ঠেলে মুশতাক মাসুদ বললেন, "আসলে আমার স্ত্রী পরপর দু'বারই মৃত সন্তানের জন্ম দিয়েছে।"
ড. জাওয়াদ কিছুটা বিব্রতবোধ করলেন, সাথে অবাকও হলেন সীমিত। আচ্ছা ওপাশের লোকটিকে কি বিষণ্ণতায় ঘিরে ধরেছে? তাকে কি সান্ত্বনা দেওয়া উচিত? আর দিলেও কী বলে সান্ত্বনা দিবেন তিনি?- নিজেকে একের পর এজ প্রশ্ন করে যাচ্ছেন ডক্টর।
তার ধ্যান ভেঙ্গে দিতে লোকটি আবারও বেশ জোরেসোরে 'হ্যালো' বলে উঠলো। ড. জাওয়াদ প্রশ্ন করলেন, "আপনার স্ত্রীর এমন অবস্থা হলে তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাননি?"
"নিয়েছিলাম। আল্ট্রাসনোগ্রাম করার পরে একেবারেই স্বাভাবিক রিপোর্ট পেয়ছিলাম। কোনো ভ্রূণের অস্তিত্ব ছিল না।"
"কোথায় নিয়েছিলেন?"
"আমাদের এখানে একটিমাত্র প্রাইভেট হসপিটাল আছে, সেখানেই যাই। সরকারী হসপিটালটির অবস্থা নাজেহাল। বারান্দায় পা রাখতেও মন সায় দেয় না।"
"প্রাইভেট হাসপাতালটির নাম?"
"প্যারাডাইস গার্ডেন।"
_____
প্যারাডাইস গার্ডেনের করিডোর দিয়ে ধীরপায়ে এগোচ্ছে শাদাব। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে সে। মাঝেমাঝে তার বাদামী বর্ণের চোখদু'টোর উপরে অবস্থান নেওয়া ভ্রু কুঁচকে নিচ্ছে সে।
'ধুমপান নিষেধ'- লেখাটির থেকে চোখ সরিয়ে তারই নিচে থাকা ধুমপানরত লোকটির দিকে তাকায় ও। আবারও ভ্রু কুঁচকে যায় তার। এই ব্যাটা কী অন্ধ? নাকি মূর্খ? এতবড় করে 'ধুমপান নিষেধ' লেখাটিও কি তার চোখে পড়ছে না? মেজাজ বিগড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা তার। হাসপাতাল সিগারেট খাওয়ার জায়গা? বিদ্যুৎগতিতে লোকটির দিকে ছুটে গেল সে।
"কী ব্যাপার ভাই? লেখাপড়া জানেন না? নাকি ন্যূনতম জ্ঞানটুকুও নেই?"- চোখে হুংকারের চিহ্ন রেখে সূঁচালো দৃষ্টিতে তাকায় সে লোকটির দিকে। তার হঠাৎ এমন আচরণে লোকটি তার কপাল এমনভাবে কুঁচকায় মনে হয় যেন শাদাব ভুল কিছু বলে ফেলেছে। আরও বিরক্ত হয়ে ওঠে সে।
"এখনও সিগারেট ফুঁকছেন? এখানে যে 'ধুমপান নিষেধ' লেখা, এটি চোখে পড়েনি আপনার? তাছাড়া হাসপাতালের মধ্যে কোন আক্কেলে মনের আনন্দে সিগারেট খাচ্ছেন?"
লোকটি এবার তীক্ষ্ণ তীর্যক দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে৷ ঠোঁট থেকে সিগারেটটি বের করে হাত কিঞ্চিৎ উঁচু করে সিগারেটটির দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে বলে, "আমি এখানকার কম্পাউন্ডার।"
তার কথা শুনে শাদাবের মেজাজ আরও বিগড়ে যায়। কম্পাউন্ডার তো কী? স্বয়ং মন্ত্রীপরিষদের কেউও তো হাসপাতালে সিগারেট খাওয়ার ভ্রান্ত চিন্তা করবে না। ইচ্ছে করছে সজোরে নাক বরাবর ঘুষি ফেলতে। কিন্তু এখানে সে নতুন এসেছে। মফস্বল এলাকা, একেবারেই কাউকে চেনে না সে। সাবধানে চলাফেরা করতে হবে তার। চাপা ক্রোধ সামলে রেখে সে প্রশ্ন করলো, "মা ও শিশু স্বাস্থ্য ইউনিট কত ফ্লোরে?"
লোকটি এবার ইচ্ছা করে শাদাবের মুখের উপর ধোঁয়া ছেড়ে উত্তর দেয়, "চতুর্থ ফ্লোরে।"
বাচ্চাকণ্ঠের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসতে লাগে শাদাবের কানে। দেয়ালগুলোর ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় ভিন্ন ধরনের ছাপ লেগে আছে৷ ধুলোয় ভরা ফ্লোর। প্রাইভেট হাসপাতালেরও এমন বেহাল অবস্থা দেখতে তার মোটেও ভালো লাগছে না। কোন আক্কেলে যে এই হাসপাতালের নাম 'প্যারাডাইস গার্ডেন' রেখেছিল কে জানে! প্যারাডাইস না ছাঁই! নামকরণের দায়িত্ব তার উপর দেওয়া হলে নির্ঘাত নাম রাখতো 'গার্ডেন অব হেল' কিংবা 'হেল ইয়ার্ড'। মনেমনে বিড়বিড় করতে করতে পকেট থেকে ফোন বের করে ডায়াল করলো একটা নম্বরে। কয়েক সেকেন্ড রিং হতেই ওপাশ থেকে ফোনটা তুললো কেউ।
"হ্যালো, ড. জাওয়াদ?"
"হ্যাঁ বলো শাদাব। কতদূর কী ইনভেস্টিগেট করলে?"
"আমার এখানে একদমই স্বস্তি লাগছে না ডক্টর।"- ধীরপায়ে হাঁটতে হাঁটতে বললো সে।
"কেন?"- ওপাশ থেকে ড. জাওয়াদের মৃদু হাসির শব্দ ভেসে আসলো।
"জানি না কিন্তু এখানকার পরিবেশ মোটেও বন্ধুসুলভ নয়। কেমন একটা ভূতুড়ে ভাব আছে।"- বিচলিত কণ্ঠে উত্তর দেয় শাদাব।
"ওখানে কিন্তু তুমি সেচ্ছায় যেতে চেয়েছিলে।"
"আমি জানি ডক্টর। আপনার দরকার ছিল এখানে ছোটখাটো তদন্ত করার জন্য কাউকে পাঠানো, ভাবলাম এ সুযোগ হাতছাড়া করা উচিত নয় আমার। কিন্তু এসেই দেখছি মহা ঝামেলায় পড়ে গেলাম।"
ওপাশ থেকে ড. জাওয়াদের হাসির শব্দ ভেসে আসছে। বিষয়টা বেশ উপভোগ করছেন তিনি। বললেন, "নিজেকে প্রাইভেট ডিটেকটিভ দাবি করতে হলে আরও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে তোমাকে বাছা।"
"কিন্তু ডক্টর, এখানে পাঠানোর কারণ এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না।"
"মুশতাক মাসুদের ব্যাপারে কতটুকু তথ্য পেয়েছ?"
"রিশেপশন কাউন্টার থেকে তার স্ত্রীকে নিয়ে ভর্তির তারিখ ও সময় জানতে পেরেছি। তার স্ত্রী একটি মৃত সন্তানের জন্ম দেন এটাও সত্য। এর পরে তিনি তার স্ত্রীকে নিয়ে আবার চেক-আপ করাতে এসেছিলেন।"
"তবে মি. মাসুদের বলা কথাগুলো মিথ্যে ছিল না।"
"কিন্তু তার কথায় আপনার সন্দেহ হওয়ার কারণ বুঝলাম না ডক্টর।"- বিস্ময়ের সাথে প্রশ্ন করলো শাদাব।
"লোকটি বলেছিল সে আমার নম্বর নাকি ফোনবুক থেকে পেয়েছে। কিন্তু সেখানে আমার ব্যক্তিগত নম্বর দেওয়া নেই। অথচ লোকটি আমার ব্যক্তিগত নম্বরে কল করেছিল। ভাবলাম কেউ হয়তো ইচ্ছে করে বিরক্ত করতে চাইছে আমাকে। তাই মনে করলাম কথাটির সত্যতা যাচাই করা উচিত। আর তুমি নিজেই এটার তদন্ত করতে চাইলে।"
"আরেকটা বিষয় আমার চোখে পড়েছে ডক্টর।"
"কী সেটা?"
"একজন মহিলার তীব্র আর্তনাদ। মনে হচ্ছে তার বাচ্চা মারা গিয়েছে। কিন্তু এখানে দায়িত্বরত ডাক্তার বা নার্স কারো মধ্যেই কোনো ভ্রুক্ষেপ দেখলাম না।"
"স্ট্রেইঞ্জ!"- ওপাশ থেকে বললেন ড. জাওয়াদ, "তুমি যতদূর পারো আরও তথ্য যোগাড় করতে থাকো। হাসপাতাল, ডাক্তার, কর্মচারী সবার। আর মুশতাক মাসুদের ব্যাপারেও।"
শাদাব সম্মতি জানিয়ে ফোন রেখে দেয়।
_____
চোখ খুলে নিজেকে প্রায় অন্ধকার একটা কক্ষে আবিষ্কার করে শাদাব। সামনে একটা ছোটখাটো বেড পড়ে আছে। মৃদু আলোয় তার উপরে থাকা সবুজ বেডশিটের দিকে চোখ পড়ে তার৷ সবুজ বেডশিট! প্যারাডাইস গার্ডেনের বেডগুলোয় দেখেছিল সে৷ নিজের মধ্যে আতঙ্ক ছেয়ে আসে এবার। সে এখানে কেন? আর কীভাবে?
পায়ের আওয়াজ শুনতে পায় এবার সে। একজনের নয়, কমপক্ষে তিনজন আসছে এদিকটায়। নিজেদের মধ্যে বলা ফিসফিসিয়ে কথাগুলোও তার কান অব্দি পৌঁছাতে পারছে। সে কান খাড়া করে কথাগুলো শোনার চেষ্টা করলো। কিন্তু স্পষ্টভাবে তা মোটেও সম্ভব হচ্ছে না তার পক্ষে। শুধুমাত্র ফিসফিসানি-ই আসছে যা।
পায়ের আওয়াজগুলো জোরালো হতে লাগলো। সে বুঝতে পারে রুমের কাছাকাছি চলে এসেছে তারা৷ কিন্তু কারা আসছে এদিকে? আর সে-ই বা এখানে কীভাবে? "অদ্ভুত! আমি উঠে গিয়ে দেখছি না কেন?"- নিজেকে প্রশ্ন করলো সে। পায়ের উপর শক্তি দিয়ে উঠতে চেষ্টা করলো, কিন্তু কিছু একটা টেনে ধরছে তাকে। চেয়ারের হাতল থেকে হাত সরানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু অদৃশ্য কোনো শক্তি দিয়ে বাঁধা সেগুলোও। কোনোভাবেই নড়াচড়া করতে পারছে না ও।
পায়ের শব্দগুলো এদিকেই আসছে৷ হ্যাঁ, সে নিশ্চিত- শব্দগুলো তার সামনেই হচ্ছে। কিন্তু অবয়বগুলোকে দেখতে পারছে না সে। হঠাৎ বেডের উপর থাকা লাইটটি জ্বলে উঠলো, অপারেশন লাইট। মানে সে হাসপাতালেই আছে- পুরোপুরি নিশ্চিত হলো শাদাব। লাইটের আলোয় এবার বাকি অবয়বগুলোর দিকে খেয়াল করে সে। মোট চারজন, যদিও সে ধারণা করেছিল তিনজন হবে হয়তো। এবার বেডের উপর শুয়ে থাকা মহিলাটির দিকে চোখ পড়ে তার। কেঁপে উঠলো সে। এই মহিলা কোত্থেকে এলো? অথচ কিছুসময় আগেও বেড ফাঁকা পড়ে ছিল, মৃদু নীল আলোয় দেখেছে সে। আর বেডের দু'পাশে দাঁড়ানো চারজন কারা? নীল এপ্রোন, মুখে সার্জিক্যাল মাস্ক। "ডাক্তার?"- আবারও নিজেকে প্রশ্ন করে সে৷ এখানে এসেছে কেন? অপারেশন করতে? কিন্তু সে এখানে কী করছে? আর কেনই বা নড়তে পারছে না চেয়ার থেকে। আর ডাক্তারগুলোই বা তার দিকে কেন দেখছে না? একমাত্র মহিলাটিই তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।
এক ঝটকায় বেডটিকে ঘুরিয়ে দেয় তারা৷ এবার বেডে থাকা মহিলার পায়ের দিকটা তার সামনে। ভাঁজকরা দু'পায়ের উপরে থাকা নীল চাদরের নিচ দিয়ে মহিলার দেহের নিম্নভাগ স্পষ্ট তার চোখে পড়ছে৷ লজ্জায় ঘাড় ঘুরিয়ে নিতে চায় সে। কিন্তু মনে হচ্ছে কেউ তার মাথাকেও চেপে ধরে রেখেছে, ডানে-বায়ে ঘোরানোর কোনো শক্তি পাচ্ছে না সে। চোখ বন্ধ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। তার সামনেই কি এরা অপারেশন করবে? কিন্তু অপারেশন তো মনে হচ্ছে না। তবে কী? ডেলিভারি? ডেলিভারি করাতে চারজন ডাক্তার! যতটা না অবাক হচ্ছে তার থেকে বেশি ভয় পাচ্ছে সে।
মহিলার হাঁটুর উপরে থাকা চাদরের কারণে ওপাশে থাকা তার মুখটিকে দেখতে পাচ্ছে না শাদাব। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে মহিলাটি চাদরের উপর দিয়ে মাথা উঁচু করে তার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে তোলে ঠোঁটের কোণায়। শাদাব বুঝতে পারে সে ঘামছে। তার সামনেই মহিলাটির বাচ্চা প্রসব করানো হয়। কিন্তু বাচ্চাটি মোটেও কান্না করছে না। "মৃত?"- আবারও নিজেকে প্রশ্ন করলো সে।
বাচ্চাটির গায়ে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ৷ হঠাৎ শাদাবের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় সে। সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া বাচ্চাটি ছোটছোট পা ফেলে এগিয়ে আসছে তার দিকে।
চলবে...
Sayan
Abul basar, Santa akter, Raihan khan, Tanusri roi, Badol hasan, Saiful Osman, Sumon khan and লেখাটি পছন্দ করেছে
- Trimatraধুমকেতু
- Posts : 23
স্বর্ণমুদ্রা : 1434
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-06-05
Re: যেখানে আঁধার নামে
Sat Jun 05, 2021 8:11 pm
২য় পর্ব
"এখানে আর একদিন থাকলে আমি নিশ্চিত পাগল হয়ে যাব নাহয় মারা পড়বো।"
"কেন?"
"রোগটি আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।"- বিচলিত কণ্ঠে উত্তর দেয় শাদাব।
"তার মানে..."
"হ্যাঁ! আমি আবারও ভয়ংকর সব স্বপ্ন দেখছি। দুঃস্বপ্ন।"- ড. জাওয়াদের কথা শেষ হওয়ার আগেই ওপাশ থেকে বলতে থাকে শাদাব। "ঠিক যখনই কোনো দুঃশ্চিন্তা মাথায় ভর করে তখনই সেই বিষয় নিয়ে খুব বাজে রকম দুঃস্বপ্ন দেখি আমি।"
"আমি জানি সেটা। কাউন্সেলিংও করা হয়েছিল তোমার।"
"হ্যাঁ সুস্থও হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু গতকালের দৌঁড়াদৌঁড়িতে অবসাদগ্রস্ত দেহ আবারও আমার বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছে।"
"তোমার আর কষ্ট নিতে হবে না। শীঘ্রই সেখানে আমার পরিচিত একজন সাইকিয়াট্রিস্টকে পাঠাবো।"
"একজন নয়, দু'জন পাঠান।"
"কেন?"- হেসে ফেললেন ড. জাওয়াদ।
"একজন ঐ ডাইনি মহিলার জন্য আরেকজন আমার জন্য।"
"একজন সাইকিয়াট্রিস্ট কি দু'জনের চিকিৎসা করতে পারে না?"- শব্দ করে হেসে ফেললেন ড. জাওয়াদ। এক সেকেন্ড বাদেই হঠাৎ থমকে গেলেন। অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, "ডাইনি মহিলা মানে? কার কথা বলছো তুমি?"
"মারজিয়া মেহবুব, মুশতাক মাসুদের স্ত্রী। যার ব্যাপারে খোঁজ নিতে এসেছিলাম আমি।"- নিচুস্বরে জবাব দেয় শাদাব।
"ডাইনি বলছো কেন তাকে?"- আবারও অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন ড. জাওয়াদ।
"আমি না, এখানের এক পাগল অনেককিছু বলেছে আমাকে।"
"পাগল?"
"আমি দুঃখিত ডক্টর। সাইকিয়াট্রিস্টদের কাছে পাগল বলতে কিছু নেই, মানসিক রোগী আর কী।"- ইতস্তত করলো শাদাব।
"যাই হোক। তুমি একজন মানসিক বিকারগ্রস্ত মানুষের কথায় একজন মহিলাকে ডাইনি বলছো?"- ভ্রু কুঁচকে নিলেন ড. ইফতেখার জাওয়াদ।
"আসলে.."- শাদাব কীভাবে কথাগুলো বলবে বুঝে উঠতে না পেরে উসখুস করতে থাকে। ড. জাওয়াদ অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন শাদাবের কথাগুলো শোনার জন্য।
"আসলে এই লোকটিকে পাগল..আই মিন মানসিক বিকারগ্রস্ত বললে হয়তো ভুল হবে। লোকটির মধ্যে জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব আছে একটা। স্রেফ যাযাবরের মতো এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায় আর একা একা বিড়বিড়িয়ে বেড়ায় বলেই এখানকার লোকজন পাগল বলে তাকে৷"
কিছু সময় চুপ থাকলেন ড. জাওয়াদ। ফের প্রশ্ন করলেন, "তাকে কোথায় খুঁজে পেলে তুমি?"
"আমি খুঁজিনি, সে নিজেই এসেছিল আমার কাছে। আর আশ্চর্যজনকভাবে বুঝেও গিয়েছিল আমি মুশতাক মাসুদের ব্যাপারে খোঁজ নিতে এসেছি৷"
"আচ্ছা!"
নিরবতা ভেঙ্গে শাদাব আবার বলতে শুরু করে, "সম্ভবত আমি আজ রাতেও কোনো ভয়ংকর স্বপ্নের সম্মুখীন হতে চলেছি।"
"কেন বলো তো?"
"লোকটি বেশ কিছু বলেছিল মহিলাটির ব্যাপারে। সে নাকি কবর থেকে মৃত বাচ্চা তুলে এনে বলি দেয়।"
"মানে!?"- বেশ বড়সড় মাপের বিস্ময় নামে ড. জাওয়াদের মধ্যে।
"আমি কল্পনা করে নিয়েছি কী স্বপ্ন দেখতে পারি আজ রাতে- 'কোনো গোরস্তানের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি আমি। একজন মহিলাকে দেখবো কবর থেকে ছোট বাচ্চার লাশ টেনে তুলছে। সাদা কাপড়ের আড়াল থেকে বাচ্চাটি হঠাৎ মুখ বের করে আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকবে.."
"শাদাব.."- কিছুটা বিরক্তবোধ করলেন ড. জাওয়াদ।
"আমি দুঃখিত ডক্টর। কিন্তু এমন কিছুই হতে চলেছে আমার সাথে।"
_____
রকিং চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়েছেন ডক্টর ইফতেখার জাওয়াদ। বিকেলের সূর্য পশ্চিম দিকে রক্তিম আলো ছড়াচ্ছে। সপ্তাহের সবগুলো দিনেই কোনো না কোনো রোগীর সাথে এপয়েন্টমেন্ট থাকে তার৷ তবে একজন রোগীর জন্য সপ্তাহে একদিন৷ শাদাবকে সত্যতা যাচাই করতে পাঠালেও তার সেখানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেননি তিনি। চেয়েছিলেন মুশতাক মাসুদের কথার যদি সত্যতা পাওয়া যায় তবে অন্য কোনো ডক্টরকে পাঠাবেন তিনি। রোগীগুলোর সাথে এপয়েন্টমেন্ট বাতিল করে ছুটি নিয়ে সেখানে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই ড. জাওয়াদের। ফোন হাতে নিয়ে তার পরিচিত ও বেশ ঘনিষ্ঠ একজন সাইকিয়াট্রিস্টকে কল করতে যাওয়ার মূহুর্তে শাদাবের নাম ভেসে ওঠে স্ক্রিনে।
"হ্যাঁ বলো শাদাব।"
"গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্য আছে, আগেরগুলো থেকেও গুরুত্বপূর্ণ।"- হাঁপাতে হাঁপাতে বলে শাদাব।
"কী তথ্য? আর তুমি এভাবে হাপাচ্ছো কেন?"
"বলছি।"- শব্দ করে ঘনঘন নিশ্বাস নেয় সে৷ "প্যারাডাইস গার্ডেনে একটা মহিলার তীব্র আর্তনাদের কথা বলেছিলাম মনে আছে? বলেছিলাম, হয়তো তার সন্তান মারা গিয়েছে।"
"হ্যাঁ, কেন?"
"ঐ পাগলের থেকে মুশতাকের স্ত্রী মানে মারজিয়ার ব্যাপারে জানার পর আমার সন্দেহ হয়। হাসপাতালে আর্তনাদ করা মহিলার ব্যাপারে খোঁজ নেই৷ তার সন্তানকে যেখানে কবর দেওয়া হয়েছিল ওখান পর্যন্ত গিয়েছিলাম আমি।"- এটুকু বলেই হার্টবিট বেড়ে গেল তার৷ ছোট করে কাটা মাথার চুলগুলো খাড়া হয়ে যাচ্ছে। "কিন্তু..."- ঢোক গিললো সে। বললো, "কিন্তু বাচ্চাটির কবরে কোনো লাশ ছিল না।"
প্রচণ্ডরকম চমকে গেলেন ড. জাওয়াদ৷ বিস্ময় চেপে রাখতে না পেরে প্রশ্ন করলেন, "তুমি বাচ্চাটির কবর খুঁড়েছিলে?"
"হ্যাঁ!"- মুখের উপর থেকে গলা অব্দি হাত দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে বলে সে। "মানে ঐ পাগল লোকটি যেমনটা বলেছিল তা সত্যি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। ঐ মহিলা মৃত বাচ্চাদের কবর থেকে তুলে এনে বলি দেয় কিংবা অন্য কিছু করে।"
কানের কাছে ফোন চেপে রেখে চুপ করে আছেন ড. জাওয়াদ। ওপাশ থেকে শাদাব ফের বলে ওঠে, "আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ডক্টর। আমার মনে হয় কেউ আমাকে অনুসরণ করছে। অনুমান নয়, প্রায় নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি।"
ইফতেখার জাওয়াদ নিজেও বেশ বিপাকে পড়ে গেলেন। মনে হচ্ছে কোনো কানাগলির মাঝে আটকে গিয়েছেন। শাদাবের সাথে কথা শেষ করে ফোনটাও রেখে দিলেন। যদিও কিছুক্ষণ আগে ফোন হাতে নিয়েছিলেন তার বন্ধু ড. ফুয়াদকে কল করার জন্য। কিন্তু কিছু একটা ভেবে হাত থেকে ফোন নামিয়ে ফের রকিং চেয়ারে গা এলিয়ে দেন তিনি। স্ত্রীর ব্যাপারে মুশতাক মাসুদের বলা কথাগুলো সত্যি ছিল সেটা হাসপাতালে খোঁজ নিয়েই জেনেছিলেন তিনি, শাদাবের মাধ্যমে। এখন তার মাথায় ভর করেছে ঐ পাগলের বলা কথাগুলো আর কবর থেকে বাচ্চাটির লাশ গায়েব হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা। ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে। সন্ধ্যা হতে আর কিছুক্ষণ বাকি৷ এমন সময়ে ঘুমাতে চান না তিনি। চেয়ার ছেড়ে বেসিনে গিয়ে মুখে পানি ছিঁটালেন। আয়নায় নিজের চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছু সময়।
সন্ধ্যার পর শাদাবকে ফোনে না পেয়ে চিন্তায় পড়ে গেলেন ড. জাওয়াদ৷ এই ছেলেটা কখনও ফোন বন্ধ করে রাখে না। আর এই বিশেষ সময়ে তো না-ই৷ বেশি চিন্তা হচ্ছে তার বলা একটি কথা মনে করে, 'আমার মনে হয় কেউ আমাকে অনুসরণ করছে।'
"তবে কী...নাহ কিসব চিন্তা করছি আমি।"- বিড়বিড়িয়ে বললেন ড. জাওয়াদ। দুশ্চিন্তা যখন মাথায় খেলা করে তখন সবকিছু নিয়েই একটা নেতিবাচক ভাবনা চলে আসে। আর এখন তার মাথায় ঘুরপাক খাওয়া এই নেতিবাচক ভাবনাকে প্রশ্রয় দিতে চান না তিনি কোনোভাবেই।
"বি পজিটিভ, ড. ইফতেখার জাওয়াদ।"- আবারও বিড়বিড় করে নিজেকেই বললেন তিনি।
ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছেন শাদাবকে লাইনে পেতে। কিন্তু ফোন এখনও সুইচড অফ। ভোরে উঠে কোনোমতে ফ্রেশ হয়ে আবারও চেষ্টা করলেন, কিন্তু এখনও তার ফোন বন্ধ। আজকের দিনটাতে অপেক্ষা করার কোনো ইচ্ছা নেই তার। ভেবেছিলেন মুশতাককে ফোন করে বলবেন শাদাবের ব্যাপারে। কিন্তু কী বলবেন? তার কথাকে যাচাই করতে গোয়েন্দা লাগিয়েছিলেন তিনি আর তাকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না কাল থেকে? না মুশতাককে শাদাবের ব্যাপারে জানানো কোনোভাবেই ঠিক হবে না। ছেলেটা যদি বিপদে পড়ে তবে তার কারণেই পড়েছে- এমনটাই মনে করতে লাগলেন তিনি। অনিচ্ছা স্বত্তেও এক সপ্তাহের সকল এপয়েন্টমেন্ট বাতিল করে দিয়ে কোনোরকম নাস্তা সেরে ভোর থাকতেই নিজের গাড়ি নিয়ে রওনা হলেন ড. জাওয়াদ।
প্রায় সন্ধ্যার দিকে পৌঁছালেন তিনি৷ প্রথমবার মুশতাকের সাথে কথা বলার সময় নেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী। সম্ভবত আর একটুখানি সামনে এগোলেই মুশতাকের বাড়ি চোখে পড়বে। কিন্তু তিনি রাস্তার পাশে একটি টংএর দোকানের সামনে গাড়ি থামিয়ে নেমে আসলেন। তার প্রশ্নলোলুপ চোখদু'টো কাউকে খুঁজছে এখানে। কিন্তু আদতে তিনি এখানে নামলেন কেন নিজেও সন্দিহান।
একটু পরেই কাঁধে টোকা পড়লো তার। বেশ চমকে উঠে পিছনে ঘুরে তাকালেন তিনি। আধপাকা দাঁড়িতে ভর্তি লোকটির মুখ। তাকে তো পরিচিত কেউ বলে মনে হচ্ছে না! তাহলে সে এসে ড. জাওয়াদের ঘাড়ে টোকা মারবে কেন? লোকটির আচরণও স্বাভাবিক নয়। তবে এটা কি সেই পাগল ব্যক্তি যার কথা শাদাব বলেছিল? নিজের অজান্তেই মনেমনে পুলকিত হন তিনি। সম্ভবত তার অবচেতন মন এই লোকটিরই খোঁজ করছিল।
"মাসুদের বাড়িত যাইতে চান?"- লোকটি প্রশ্ন করলো। ড. জাওয়াদ বেশ অবাক হলেন, এই লোকটি কীভাবে বুঝলো? তার মাথার মধ্যে আপনাআপনিই প্রশ্নটা চলে আসে।
"কী? কথা কন না ক্যান?"- আবারও প্রশ্ন করলো সে।
"হ্যাঁ! কিন্তু আপনি বুঝলেন কীভাবে?"- বিস্মিত চোখে প্রশ্ন করলেন ড. জাওয়াদ।
লোকটি মুখে হাসি ফুটিয়ে মাথা ঝাঁকালো কয়েকবার। সম্ভবত ড. জাওয়াদের প্রশ্নের উত্তর দিতে ইচ্ছুক নয় সে।
"ক্যান আসছেন? ডাইনিটার ব্যাপারে খোঁজ নিবার লাইগা?"
"ডাইনি?"
চোখ বাকিয়ে ফেললো লোকটা। বেশ অসন্তুষ্ট মনে হলো তাকে৷ বললো, "মাসুদের বউ, সাক্ষাৎ ডাইনি। বেডি মরা বাচ্চাগুলারেও ছাড়ে না।"
শাদাবের বলা কথাগুলোকে মনে করতে লাগলেন তিনি৷ বুঝতে আর বাকি রইলো না এই সেই ব্যক্তি যার কথা শাদাব বলেছিল।
"মৃত বাচ্চা নিয়ে কী করবে সে?"
"বলি দেয়, শয়তানের লাইগা।"
"কেন?"- চোখেমুখে বিস্ময় তার।
"ক্যান আবার। বেডির নিজের হইছে দুইবার মরা বাচ্চা। অহন কোনো ফন্দি আটতাছে শয়তানরে খুশি কইরা জ্যান্ত বাচ্চা পয়দা দেওনের।"
কথাগুলোকে হজম করতে কষ্ট হচ্ছে ড. জাওয়াদের। এসবে মোটেও বিশ্বাস নেই তার। কিন্তু শয়তানকে খুশি করে বাচ্চা পাওয়াকে সম্ভব না হোক, তবে এমন বিশ্বাস নিয়ে কেউ বলিদান দিলে আশ্চর্যজনক কিছু হবে না। কারণ এখনও অগণিত মানুষ আছে যারা এসবে বিশ্বাস করে।
"কিন্তু শয়তান মৃত বাচ্চাগুলো নিয়ে কী করবে?"- প্রশ্ন করলেন তিনি।
"মৃত বাচ্চাগো শরীর গুলারে একটা আয়নার মধ্যে আটকাইয়া রাখে সে৷"
"কেন?"
"হেইয়া আমি ক্যামনে জানমু?"- লোকটির চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ। ড. জাওয়াদ বুঝতে পারেন এগুলো তাদের মনগড়া ভ্রান্ত ধারণা বাদে কিছুই না। আবারও প্রশ্ন করলেন, "আয়নার মাঝেই আটকাতে হবে কেন? বোতলেও তো বন্দি করতে পারে।"
লোকটি এবার ভীষণরকম রেগে গেল। এমন তর্ক তার মোটেও পছন্দ হচ্ছে না।
"আপনের এতো জানার দরকার হইলে শয়তানরে গিয়া জিগান মিয়া। আমারে জ্বালাইতে আইছেন ক্যান?"
তার আচরণ অদ্ভুত, তবে ড. জাওয়াদ তার আচরণে মোটেও অবাক হচ্ছেন না; অবাক হচ্ছেন তার বলা কথাগুলোয়। হতে পারে মারজিয়া নিজেও এমন ভ্রান্ত বিশ্বাসে বিশ্বাসী এবং সেজন্য শয়তানের উদ্দেশ্যে মৃত বাচ্চা বলি দিচ্ছে। কিন্তু মৃত বাচ্চা কেন?- প্রশ্নটিকে নিজের মাঝেই রাখলেন তিনি। এই লোকটিকে রাগানো উচিত হবে না আর। শাদাব নিজে বলেছে বাচ্চাটির কবরে নাকি তার লাশ পাওয়া যায়নি। তবে কি সত্যিই মারজিয়া...
শাদাব এমন দুঃসাহসিক বিদঘুটে কাজ কেন করতে গেল তার বুঝে আসে না। পাগলটি গান ধরেছে এবার। থামিয়ে দিয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, "আচ্ছা ভাই, এটা বলেন যে শয়তান মৃত বাচ্চাগুলোকে কোথায় বন্দী করে রাখে?"
লোকটি গান থামিয়ে দেয়। ড. জাওয়াদের দিকে মুখ বাড়িয়ে দিয়ে একটু আগে কথায় থাকা আঞ্চলিক টান ত্যাগ করে ফ্যাকাশে গলায় উত্তর দেয়, "যেখানে আঁধার নামে।"
চলবে...
Sayan
"এখানে আর একদিন থাকলে আমি নিশ্চিত পাগল হয়ে যাব নাহয় মারা পড়বো।"
"কেন?"
"রোগটি আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।"- বিচলিত কণ্ঠে উত্তর দেয় শাদাব।
"তার মানে..."
"হ্যাঁ! আমি আবারও ভয়ংকর সব স্বপ্ন দেখছি। দুঃস্বপ্ন।"- ড. জাওয়াদের কথা শেষ হওয়ার আগেই ওপাশ থেকে বলতে থাকে শাদাব। "ঠিক যখনই কোনো দুঃশ্চিন্তা মাথায় ভর করে তখনই সেই বিষয় নিয়ে খুব বাজে রকম দুঃস্বপ্ন দেখি আমি।"
"আমি জানি সেটা। কাউন্সেলিংও করা হয়েছিল তোমার।"
"হ্যাঁ সুস্থও হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু গতকালের দৌঁড়াদৌঁড়িতে অবসাদগ্রস্ত দেহ আবারও আমার বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছে।"
"তোমার আর কষ্ট নিতে হবে না। শীঘ্রই সেখানে আমার পরিচিত একজন সাইকিয়াট্রিস্টকে পাঠাবো।"
"একজন নয়, দু'জন পাঠান।"
"কেন?"- হেসে ফেললেন ড. জাওয়াদ।
"একজন ঐ ডাইনি মহিলার জন্য আরেকজন আমার জন্য।"
"একজন সাইকিয়াট্রিস্ট কি দু'জনের চিকিৎসা করতে পারে না?"- শব্দ করে হেসে ফেললেন ড. জাওয়াদ। এক সেকেন্ড বাদেই হঠাৎ থমকে গেলেন। অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, "ডাইনি মহিলা মানে? কার কথা বলছো তুমি?"
"মারজিয়া মেহবুব, মুশতাক মাসুদের স্ত্রী। যার ব্যাপারে খোঁজ নিতে এসেছিলাম আমি।"- নিচুস্বরে জবাব দেয় শাদাব।
"ডাইনি বলছো কেন তাকে?"- আবারও অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন ড. জাওয়াদ।
"আমি না, এখানের এক পাগল অনেককিছু বলেছে আমাকে।"
"পাগল?"
"আমি দুঃখিত ডক্টর। সাইকিয়াট্রিস্টদের কাছে পাগল বলতে কিছু নেই, মানসিক রোগী আর কী।"- ইতস্তত করলো শাদাব।
"যাই হোক। তুমি একজন মানসিক বিকারগ্রস্ত মানুষের কথায় একজন মহিলাকে ডাইনি বলছো?"- ভ্রু কুঁচকে নিলেন ড. ইফতেখার জাওয়াদ।
"আসলে.."- শাদাব কীভাবে কথাগুলো বলবে বুঝে উঠতে না পেরে উসখুস করতে থাকে। ড. জাওয়াদ অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন শাদাবের কথাগুলো শোনার জন্য।
"আসলে এই লোকটিকে পাগল..আই মিন মানসিক বিকারগ্রস্ত বললে হয়তো ভুল হবে। লোকটির মধ্যে জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব আছে একটা। স্রেফ যাযাবরের মতো এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায় আর একা একা বিড়বিড়িয়ে বেড়ায় বলেই এখানকার লোকজন পাগল বলে তাকে৷"
কিছু সময় চুপ থাকলেন ড. জাওয়াদ। ফের প্রশ্ন করলেন, "তাকে কোথায় খুঁজে পেলে তুমি?"
"আমি খুঁজিনি, সে নিজেই এসেছিল আমার কাছে। আর আশ্চর্যজনকভাবে বুঝেও গিয়েছিল আমি মুশতাক মাসুদের ব্যাপারে খোঁজ নিতে এসেছি৷"
"আচ্ছা!"
নিরবতা ভেঙ্গে শাদাব আবার বলতে শুরু করে, "সম্ভবত আমি আজ রাতেও কোনো ভয়ংকর স্বপ্নের সম্মুখীন হতে চলেছি।"
"কেন বলো তো?"
"লোকটি বেশ কিছু বলেছিল মহিলাটির ব্যাপারে। সে নাকি কবর থেকে মৃত বাচ্চা তুলে এনে বলি দেয়।"
"মানে!?"- বেশ বড়সড় মাপের বিস্ময় নামে ড. জাওয়াদের মধ্যে।
"আমি কল্পনা করে নিয়েছি কী স্বপ্ন দেখতে পারি আজ রাতে- 'কোনো গোরস্তানের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি আমি। একজন মহিলাকে দেখবো কবর থেকে ছোট বাচ্চার লাশ টেনে তুলছে। সাদা কাপড়ের আড়াল থেকে বাচ্চাটি হঠাৎ মুখ বের করে আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকবে.."
"শাদাব.."- কিছুটা বিরক্তবোধ করলেন ড. জাওয়াদ।
"আমি দুঃখিত ডক্টর। কিন্তু এমন কিছুই হতে চলেছে আমার সাথে।"
_____
রকিং চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়েছেন ডক্টর ইফতেখার জাওয়াদ। বিকেলের সূর্য পশ্চিম দিকে রক্তিম আলো ছড়াচ্ছে। সপ্তাহের সবগুলো দিনেই কোনো না কোনো রোগীর সাথে এপয়েন্টমেন্ট থাকে তার৷ তবে একজন রোগীর জন্য সপ্তাহে একদিন৷ শাদাবকে সত্যতা যাচাই করতে পাঠালেও তার সেখানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেননি তিনি। চেয়েছিলেন মুশতাক মাসুদের কথার যদি সত্যতা পাওয়া যায় তবে অন্য কোনো ডক্টরকে পাঠাবেন তিনি। রোগীগুলোর সাথে এপয়েন্টমেন্ট বাতিল করে ছুটি নিয়ে সেখানে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই ড. জাওয়াদের। ফোন হাতে নিয়ে তার পরিচিত ও বেশ ঘনিষ্ঠ একজন সাইকিয়াট্রিস্টকে কল করতে যাওয়ার মূহুর্তে শাদাবের নাম ভেসে ওঠে স্ক্রিনে।
"হ্যাঁ বলো শাদাব।"
"গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্য আছে, আগেরগুলো থেকেও গুরুত্বপূর্ণ।"- হাঁপাতে হাঁপাতে বলে শাদাব।
"কী তথ্য? আর তুমি এভাবে হাপাচ্ছো কেন?"
"বলছি।"- শব্দ করে ঘনঘন নিশ্বাস নেয় সে৷ "প্যারাডাইস গার্ডেনে একটা মহিলার তীব্র আর্তনাদের কথা বলেছিলাম মনে আছে? বলেছিলাম, হয়তো তার সন্তান মারা গিয়েছে।"
"হ্যাঁ, কেন?"
"ঐ পাগলের থেকে মুশতাকের স্ত্রী মানে মারজিয়ার ব্যাপারে জানার পর আমার সন্দেহ হয়। হাসপাতালে আর্তনাদ করা মহিলার ব্যাপারে খোঁজ নেই৷ তার সন্তানকে যেখানে কবর দেওয়া হয়েছিল ওখান পর্যন্ত গিয়েছিলাম আমি।"- এটুকু বলেই হার্টবিট বেড়ে গেল তার৷ ছোট করে কাটা মাথার চুলগুলো খাড়া হয়ে যাচ্ছে। "কিন্তু..."- ঢোক গিললো সে। বললো, "কিন্তু বাচ্চাটির কবরে কোনো লাশ ছিল না।"
প্রচণ্ডরকম চমকে গেলেন ড. জাওয়াদ৷ বিস্ময় চেপে রাখতে না পেরে প্রশ্ন করলেন, "তুমি বাচ্চাটির কবর খুঁড়েছিলে?"
"হ্যাঁ!"- মুখের উপর থেকে গলা অব্দি হাত দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে বলে সে। "মানে ঐ পাগল লোকটি যেমনটা বলেছিল তা সত্যি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। ঐ মহিলা মৃত বাচ্চাদের কবর থেকে তুলে এনে বলি দেয় কিংবা অন্য কিছু করে।"
কানের কাছে ফোন চেপে রেখে চুপ করে আছেন ড. জাওয়াদ। ওপাশ থেকে শাদাব ফের বলে ওঠে, "আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ডক্টর। আমার মনে হয় কেউ আমাকে অনুসরণ করছে। অনুমান নয়, প্রায় নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি।"
ইফতেখার জাওয়াদ নিজেও বেশ বিপাকে পড়ে গেলেন। মনে হচ্ছে কোনো কানাগলির মাঝে আটকে গিয়েছেন। শাদাবের সাথে কথা শেষ করে ফোনটাও রেখে দিলেন। যদিও কিছুক্ষণ আগে ফোন হাতে নিয়েছিলেন তার বন্ধু ড. ফুয়াদকে কল করার জন্য। কিন্তু কিছু একটা ভেবে হাত থেকে ফোন নামিয়ে ফের রকিং চেয়ারে গা এলিয়ে দেন তিনি। স্ত্রীর ব্যাপারে মুশতাক মাসুদের বলা কথাগুলো সত্যি ছিল সেটা হাসপাতালে খোঁজ নিয়েই জেনেছিলেন তিনি, শাদাবের মাধ্যমে। এখন তার মাথায় ভর করেছে ঐ পাগলের বলা কথাগুলো আর কবর থেকে বাচ্চাটির লাশ গায়েব হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা। ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে। সন্ধ্যা হতে আর কিছুক্ষণ বাকি৷ এমন সময়ে ঘুমাতে চান না তিনি। চেয়ার ছেড়ে বেসিনে গিয়ে মুখে পানি ছিঁটালেন। আয়নায় নিজের চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছু সময়।
সন্ধ্যার পর শাদাবকে ফোনে না পেয়ে চিন্তায় পড়ে গেলেন ড. জাওয়াদ৷ এই ছেলেটা কখনও ফোন বন্ধ করে রাখে না। আর এই বিশেষ সময়ে তো না-ই৷ বেশি চিন্তা হচ্ছে তার বলা একটি কথা মনে করে, 'আমার মনে হয় কেউ আমাকে অনুসরণ করছে।'
"তবে কী...নাহ কিসব চিন্তা করছি আমি।"- বিড়বিড়িয়ে বললেন ড. জাওয়াদ। দুশ্চিন্তা যখন মাথায় খেলা করে তখন সবকিছু নিয়েই একটা নেতিবাচক ভাবনা চলে আসে। আর এখন তার মাথায় ঘুরপাক খাওয়া এই নেতিবাচক ভাবনাকে প্রশ্রয় দিতে চান না তিনি কোনোভাবেই।
"বি পজিটিভ, ড. ইফতেখার জাওয়াদ।"- আবারও বিড়বিড় করে নিজেকেই বললেন তিনি।
ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছেন শাদাবকে লাইনে পেতে। কিন্তু ফোন এখনও সুইচড অফ। ভোরে উঠে কোনোমতে ফ্রেশ হয়ে আবারও চেষ্টা করলেন, কিন্তু এখনও তার ফোন বন্ধ। আজকের দিনটাতে অপেক্ষা করার কোনো ইচ্ছা নেই তার। ভেবেছিলেন মুশতাককে ফোন করে বলবেন শাদাবের ব্যাপারে। কিন্তু কী বলবেন? তার কথাকে যাচাই করতে গোয়েন্দা লাগিয়েছিলেন তিনি আর তাকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না কাল থেকে? না মুশতাককে শাদাবের ব্যাপারে জানানো কোনোভাবেই ঠিক হবে না। ছেলেটা যদি বিপদে পড়ে তবে তার কারণেই পড়েছে- এমনটাই মনে করতে লাগলেন তিনি। অনিচ্ছা স্বত্তেও এক সপ্তাহের সকল এপয়েন্টমেন্ট বাতিল করে দিয়ে কোনোরকম নাস্তা সেরে ভোর থাকতেই নিজের গাড়ি নিয়ে রওনা হলেন ড. জাওয়াদ।
প্রায় সন্ধ্যার দিকে পৌঁছালেন তিনি৷ প্রথমবার মুশতাকের সাথে কথা বলার সময় নেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী। সম্ভবত আর একটুখানি সামনে এগোলেই মুশতাকের বাড়ি চোখে পড়বে। কিন্তু তিনি রাস্তার পাশে একটি টংএর দোকানের সামনে গাড়ি থামিয়ে নেমে আসলেন। তার প্রশ্নলোলুপ চোখদু'টো কাউকে খুঁজছে এখানে। কিন্তু আদতে তিনি এখানে নামলেন কেন নিজেও সন্দিহান।
একটু পরেই কাঁধে টোকা পড়লো তার। বেশ চমকে উঠে পিছনে ঘুরে তাকালেন তিনি। আধপাকা দাঁড়িতে ভর্তি লোকটির মুখ। তাকে তো পরিচিত কেউ বলে মনে হচ্ছে না! তাহলে সে এসে ড. জাওয়াদের ঘাড়ে টোকা মারবে কেন? লোকটির আচরণও স্বাভাবিক নয়। তবে এটা কি সেই পাগল ব্যক্তি যার কথা শাদাব বলেছিল? নিজের অজান্তেই মনেমনে পুলকিত হন তিনি। সম্ভবত তার অবচেতন মন এই লোকটিরই খোঁজ করছিল।
"মাসুদের বাড়িত যাইতে চান?"- লোকটি প্রশ্ন করলো। ড. জাওয়াদ বেশ অবাক হলেন, এই লোকটি কীভাবে বুঝলো? তার মাথার মধ্যে আপনাআপনিই প্রশ্নটা চলে আসে।
"কী? কথা কন না ক্যান?"- আবারও প্রশ্ন করলো সে।
"হ্যাঁ! কিন্তু আপনি বুঝলেন কীভাবে?"- বিস্মিত চোখে প্রশ্ন করলেন ড. জাওয়াদ।
লোকটি মুখে হাসি ফুটিয়ে মাথা ঝাঁকালো কয়েকবার। সম্ভবত ড. জাওয়াদের প্রশ্নের উত্তর দিতে ইচ্ছুক নয় সে।
"ক্যান আসছেন? ডাইনিটার ব্যাপারে খোঁজ নিবার লাইগা?"
"ডাইনি?"
চোখ বাকিয়ে ফেললো লোকটা। বেশ অসন্তুষ্ট মনে হলো তাকে৷ বললো, "মাসুদের বউ, সাক্ষাৎ ডাইনি। বেডি মরা বাচ্চাগুলারেও ছাড়ে না।"
শাদাবের বলা কথাগুলোকে মনে করতে লাগলেন তিনি৷ বুঝতে আর বাকি রইলো না এই সেই ব্যক্তি যার কথা শাদাব বলেছিল।
"মৃত বাচ্চা নিয়ে কী করবে সে?"
"বলি দেয়, শয়তানের লাইগা।"
"কেন?"- চোখেমুখে বিস্ময় তার।
"ক্যান আবার। বেডির নিজের হইছে দুইবার মরা বাচ্চা। অহন কোনো ফন্দি আটতাছে শয়তানরে খুশি কইরা জ্যান্ত বাচ্চা পয়দা দেওনের।"
কথাগুলোকে হজম করতে কষ্ট হচ্ছে ড. জাওয়াদের। এসবে মোটেও বিশ্বাস নেই তার। কিন্তু শয়তানকে খুশি করে বাচ্চা পাওয়াকে সম্ভব না হোক, তবে এমন বিশ্বাস নিয়ে কেউ বলিদান দিলে আশ্চর্যজনক কিছু হবে না। কারণ এখনও অগণিত মানুষ আছে যারা এসবে বিশ্বাস করে।
"কিন্তু শয়তান মৃত বাচ্চাগুলো নিয়ে কী করবে?"- প্রশ্ন করলেন তিনি।
"মৃত বাচ্চাগো শরীর গুলারে একটা আয়নার মধ্যে আটকাইয়া রাখে সে৷"
"কেন?"
"হেইয়া আমি ক্যামনে জানমু?"- লোকটির চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ। ড. জাওয়াদ বুঝতে পারেন এগুলো তাদের মনগড়া ভ্রান্ত ধারণা বাদে কিছুই না। আবারও প্রশ্ন করলেন, "আয়নার মাঝেই আটকাতে হবে কেন? বোতলেও তো বন্দি করতে পারে।"
লোকটি এবার ভীষণরকম রেগে গেল। এমন তর্ক তার মোটেও পছন্দ হচ্ছে না।
"আপনের এতো জানার দরকার হইলে শয়তানরে গিয়া জিগান মিয়া। আমারে জ্বালাইতে আইছেন ক্যান?"
তার আচরণ অদ্ভুত, তবে ড. জাওয়াদ তার আচরণে মোটেও অবাক হচ্ছেন না; অবাক হচ্ছেন তার বলা কথাগুলোয়। হতে পারে মারজিয়া নিজেও এমন ভ্রান্ত বিশ্বাসে বিশ্বাসী এবং সেজন্য শয়তানের উদ্দেশ্যে মৃত বাচ্চা বলি দিচ্ছে। কিন্তু মৃত বাচ্চা কেন?- প্রশ্নটিকে নিজের মাঝেই রাখলেন তিনি। এই লোকটিকে রাগানো উচিত হবে না আর। শাদাব নিজে বলেছে বাচ্চাটির কবরে নাকি তার লাশ পাওয়া যায়নি। তবে কি সত্যিই মারজিয়া...
শাদাব এমন দুঃসাহসিক বিদঘুটে কাজ কেন করতে গেল তার বুঝে আসে না। পাগলটি গান ধরেছে এবার। থামিয়ে দিয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, "আচ্ছা ভাই, এটা বলেন যে শয়তান মৃত বাচ্চাগুলোকে কোথায় বন্দী করে রাখে?"
লোকটি গান থামিয়ে দেয়। ড. জাওয়াদের দিকে মুখ বাড়িয়ে দিয়ে একটু আগে কথায় থাকা আঞ্চলিক টান ত্যাগ করে ফ্যাকাশে গলায় উত্তর দেয়, "যেখানে আঁধার নামে।"
চলবে...
Sayan
Abul basar, Santa akter, Raihan khan, Tanusri roi, Badol hasan, Saiful Osman, Sumon khan and লেখাটি পছন্দ করেছে
- Trimatraধুমকেতু
- Posts : 23
স্বর্ণমুদ্রা : 1434
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-06-05
Re: যেখানে আঁধার নামে
Sat Jun 05, 2021 8:12 pm
৩য় পর্ব
উঠানের ডান কোণে থাকা তুলসি গাছটার দিকে নজর পড়তে বেশ অবাক হলেন ইফতেখার জাওয়াদ। আরও বেশি অবাক হলেন গাছটির গোঁড়ায় বেশ সুন্দর করে মাটি দিয়ে চারপাশে চার ইঞ্চির মতো উঁচু মাচা দেখে। সাধারণত হিন্দুয়ানী বাড়িতে তুলসি গাছগুলোকে এমন যত্ন করে রাখা হয়। ডুপ্লেক্স বাড়িটা তার সামনে যেন সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। ফর্সা মত একজন লোক এগিয়ে আসলেন তার দিকে। হাস্যোজ্জ্বল মুখ, চোখে স্টিলের রাউন্ড ফ্রেমের চশমা। মুখে খোঁচা দাঁড়ি। এগিয়ে এসে মুচকি হাসি দিয়ে ড. জাওয়াদের উদ্দেশ্যে হাত বাড়িয়ে দিলেন তিনি।
"এই লোকটা আমাকে আগে থেকেই চেনে?"- নিজেকে প্রশ্ন করলেন ড. জাওয়াদ।
এমন একটা অঞ্চলে ডুপ্লেক্স বাড়িটার উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। ভেতরে ঢুকতে মাথায় কাপড় দেওয়া একজন মহিলা স্বাগত জানালেন ড. জাওয়াদকে। তিনি বেশ আগ্রহী চোখে মহিলাটির দিকে তাকালেন। চেহারায় কোনো খুত না থাকলেও চোখের নিচে হালকা কালো দাগ লক্ষণীয়। তার হাসির মাঝেই ড. জাওয়াদ তার বাঁকা দাঁতটিকে খেয়াল করলেন। বাঁকা দাঁতের মেয়েরা হাসলে অন্যরকম সৌন্দর্য ফুটে ওঠে নাকি!- প্রথমবারের মতো সচক্ষে দেখলেন তিনি। কথাটা একেবারে ভুল নয়, বস্তুত পুরোপুরি সঠিকও বলা চলে।
"আপনাকে বিষন্ন দেখাচ্ছে ডক্টর।"- বললেন মুশতাক মাসুদ।
"দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়েছি। সম্ভবত এজন্য ক্লান্তি লাগছে।"
"আমি আপনার রুম দেখিয়ে দিচ্ছি। ফ্রেশ হয়ে নিবেন জলদি। ওয়াশরুমে গিজারও আছে, চাইলে পানি গরমও করে নিতে পারেন।"- মুশতাকের সৌজন্যবোধ।
"আসলে..আমি দুঃখিত আমি এখানে থাকতে পারবো না।"
"কেন?"- অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন মুশতাক।
"আমি অলরেডি একটা হোটেলে কয়েকদিনের জন্য বুকিং নিয়েছি। সেখানেই থাকবো।"
"কিন্তু.."
"আমাকে জোর করবেন না মি. মাসুদ। কিন্তু আমি ভীষণ দুঃখিত যে আপনাদের এখানে থাকতে পারবো না।"- তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন ড. জাওয়াদ। তার এখানে আসার মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে শাদাবকে খুঁজে বের করা। মুশতাকের বাড়িতে থাকলে এ ব্যাপারে নিশ্চয়ই কোনো বাধা থেকে থাকবে। তাই তিনি চাইছেন, বাইরে থেকে মূলত শাদাবাকে খুঁজতে। ছেলেটার সাথে এখনও কোনো যোগাযোগ করতে পারছেন না তিনি।
এখানে আসার আগে আলাপ হওয়া ঐ পাগলের বলা কথাগুলো কিছুটা হলেও ভাবাচ্ছে তাকে। মারজিয়াকে কোনো দিক থেকেও ডাইনি মনে হচ্ছে না। অবশ্য চেহারায় আর কী বুঝা যায়। ভেতরে কোন সত্তা আছে কে জানে!
ড. জাওয়াদ একটু হলেও পাগলটির কথায় বিশ্বাস করেছে- এটা ভেবে নিজেই অবাক হন। তার উপর আবার বাড়ির উঠানে চোখে পড়ার মতো স্থানে তুলসি গাছ, সেটাও আবার যত্ন করে রাখা। এগুলো ভাবিয়ে তুলছে তাকে। কিছুক্ষণের জন্য তার মাথায় একটা চিন্তা আসলো, মুশতাকের স্ত্রী মানে মারজিয়া কি ধর্মান্তরিত হয়েছে? আপাতত প্রশ্নগুলোকে নিজের মাঝেই রেখে দিয়ে তাদের সাথে আর কিছু সময় কথা বলে বেরিয়ে পড়লেন তিনি।
শাদাব যেখানে উঠেছিল সেই একই হোটেলে উঠেছেন ইফতেখার জাওয়াদ। রিশেপশন ডেস্কের গিয়ে প্রথমে শাদাবের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলেন। জানতে পারলেন, গতকাল সন্ধ্যায় বের হয়েছিল সে। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত ফেরেনি।
"শাদাব যে রুম নিয়েছিল আমার জন্য ঐ রুমটা দেওয়া যাবে?"- ড. জাওয়াদ প্রশ্ন করলেন।
"দুঃখিত স্যার। এমন কোনো নিয়ম নেই আমাদের। অন্তত দুই দিন অপেক্ষা করি আমরা। যদি ক্লায়েন্ট ফিরে না আসে তবে তার জিনিসপত্র আমাদের বড় স্টোররুমে আলাদা করে গুছিয়ে রাখি। এরপর ফিরে আসলে ব্যাক করে দেই।"
"শাদাবকে কাল থেকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। কোনো বিপদে পড়েছে হয়তো ছেলেটা।"
"কিন্তু স্যার, আমরা আপনাকে তার রুমটি দিতে পারছি না। ক্ষমা করবেন।"
কিঞ্চিৎ মন খারাপ করলেন তিনি। অন্য একটি রুম বুক করতে হবে, তবে সমস্যা নেই। রিশেপশন ডেস্কে থাকা লোকটি ফর্ম ফিল-আপের জন্য তার নাম জিজ্ঞাসা করলেন।
"ইফতেখার জাওয়াদ।"
লোকটি এবার একটু অবাক হয়ে তার দিকে তাকালো। বেশ কয়েক সেকেন্ড ভালো করে দেখার পর জিজ্ঞাসা করলো, "ড. ইফতেখার জাওয়াদ? সাইকিয়াট্রিস্ট?"
"জি।"
লোকটির মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। ড. জাওয়াদ অবাক হলেন না। দেশসেরা সাইকিয়াট্রিস্ট হিসেবে অনেকেই চেনে তাকে। আর তার চেহারার থেকে বেশি চেনে তার নামে। এটা গর্ব করার বিষয় অবশ্য, তবুও তার মধ্যে গম্ভীরতা নেই।
পরদিন সকালে সেই টংএর দোকানের সামনে থাকা বেঞ্চের উপরে গিয়ে বসলেন তিনি। মূলত তিনি চাইছেন পাগলটির সাথে কথা বলতে। কিছু সময় অপেক্ষার পর তাকে এদিকটায় আসতে দেখে আনন্দিত হলেন ড. জাওয়াদ। লোকটি তার দিকেই আসছে। তাকে অবাক করে দিয়ে সোজা তার পাশে এসেই বসলো সে। ড. জাওয়াদ নিজেই প্রথমে জিজ্ঞাসা করলেন, "আপনার নাম কী ভাই?"
"আপনার নাম কী ভাই?"- সেও প্রশ্ন করলো।
"জাওয়াদ, ইফতেখার জাওয়াদ।"
"জাওয়াদ, ইফতেখার জাওয়াদ।"
ড. জাওয়াদ এবার বাকা চোখে তাকালেন তার দিকে। লোকটি তার কথার কাউন্টার দিচ্ছে। বিরক্ত না হয়ে পকেট থেকে ফোন বের করে শাদাবের একটি ছবি বের করে তার মুখের সামনে ধরলেন। লোকটি মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে বেশ কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলো। এরপর মুখ তুলে ড. জাওয়াদের প্রশ্নলোলুপ চোখের দিকে তাকালো সে। বিশেষ ভঙ্গিমায় ডান হাতের বুড়ো আঙুল থুতনির নিচে ঘষতে লাগলো। ড. জাওয়াদ বুঝতে পারলেন কিছু একটা ভাবছে সে।
লোকটি এবার মোবাইলের দিকে আঙুলের ইশারা দিয়ে বললো, "এই পোলাটার লগে ঐদিন রাতে গেছিলাম।"
"কোথায়?"
"লাশ চুরি করতে।"
"লাশ চুরি করতে মানে?"
পান খাওয়া লাল দাঁতে হাসি দিয়ে সে বললো, "আসল কথা হইলো আমরা গেসিলাম গোয়েন্দাগিরি করতে, লাশ চুরি হইছে কি না এইডা দেখার লাইগা।"
ড. জাওয়াদ শাদাবের বলা কথার সাথে মিলাচ্ছেন। লোকটি আবারও বলে উঠলো, "মাইনষে পাগলা কাশেম কইয়া ডাকে আমারে। তয় আমি কইলাম মোটেও পাগল না মিয়া।"
"হ্যাঁ আমারও তাই মনে হয়।"- তার কথায় সায় দিয়ে বললেন তিনি। ফের প্রশ্ন করলেন, "আচ্ছা শেষ কখন দেখা হয়েছিল তার সাথে?"
"ঐ রাইতেই। হেরপর কইছিল সন্ধ্যার পর আবার বাইর হইবো। তয় আমার কাছে আর আসেনাই হেয়।"
সন্ধ্যা বলতে লোকটি গত সন্ধ্যা বুঝিয়েছে ড. জাওয়াদ বুঝতে পারেন। বিষয়টা এমন দাঁড়ায় যে, শাদাব সন্ধ্যার পর বের হয়েছিল, সম্ভবত কথা ছিল এই লোকটির সাথে দেখা করার৷ কিন্তু তার আগেই সে নিখোঁজ হয়। হতে পারে অপহৃত হয়েছে সে। কিন্তু এই এলাকায় তার পরিচিত কেউ-ই ছিল না। শত্রু বা কোত্থেকে আসবে?
সারাদিন বেশ কিছু জায়গা ঘোরাঘুরির পর হোটেলে ফিরে আসলেন তিনি। মুশতাক সাহেবের বাড়িতেও গিয়েছিলেন। বাড়িটা চোখে পড়ার মতো সুন্দর। পিছন দিকটায় বড়সড় বাগান আছে। তার ওপাশে স্রোতস্বিনী নদী।
মুশতাকের স্ত্রীর সাথে দেখা করেন। তিনি কিন্তু সে শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ। মুশতাকের বলা কথানুযায়ী সেও বলেছিল, "একজন গর্ভবতী মহিলা ঠিক যেমন অনুভব করে আমারও তেমনই অনুভূতি হয় মাঝে মাঝে। তবে অবাক হই এজন্য যে, কখনও কখনও অনেক বেশি ঘেমে যাই, শরীর গরম হতে থাকে, মনে হয় যেন জ্বর আসছে। পেটে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। এমনও মনে হয় যেন ভেতর থেকে কেউ লাথি মারছে।"
সাধারণ একটা সাক্ষাৎকার নিয়ে ফিরে আসেন তিনি।
যদি এমনটা হয় যে, সে শয়তানের উদ্দেশ্যে মৃত শিশুর বলি দিচ্ছে আর তাতে শয়তান খুশি হয়ে তাকে সন্তান উপহার দিয়েছে? আর এজন্যই মারজিয়ার এমন অনুভূতি হচ্ছে? পরক্ষণে নিজের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন তিনি। কিসব চিন্তা মাথায় আসছে তার! একজন আস্তিক হিসেবে শয়তানে বিশ্বাস করেন তিনি। কিন্তু শয়তানের কোনো ক্ষমতা নেই কারো গর্ভে সন্তান দেওয়ার। এ ক্ষমতা স্বয়ং স্রষ্টার, অন্য কারও নয়।
কিন্তু শয়তানের সন্তান দেওয়ার ক্ষমতা না থাকলেও হয়তো মারজিয়া এটাতে বিশ্বাস করে যে, তার উদ্দেশ্যে বলি দিলে হয়তোবা সে সন্তান উপহার দিতে পারবে। তবে আরেকটা বিষয়ও মাথায় আসলো তার, তুলসি গাছটির ব্যাপারে।
সম্ভাবনা থাকতেও পারে সে হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত হয়েছে। তবে তার মধ্যে এখনও নিজ ধর্মের টান রয়ে গেছে। হতে পারে তাদের ধর্মমতে সৃষ্টিদেবতার উৎসর্গে মৃত বাচ্চার বলি দিচ্ছে সে।
কিন্তু এতেও নিজের ভাবনার বিপক্ষে অবস্থান নিলেন তিনি। হিন্দুধর্মানুযায়ী কোথাও মৃত বাচ্চা উৎসর্গের কথা আছে বলে তার মনে হয় না। নরবলি বা নরহত্যার অনুমতি কোনো ধর্মেই নেই। কিন্তু তবুও ইতিহাস ঘাটলে নরবলির কিছু নজির পাওয়া যায়। হতে পারে মারজিয়া এমনই ভ্রান্ত মতবাদে বিশ্বাসীদের একজন।
ড. জাওয়াদ নিজের মধ্যে বেশ বিস্ময়বোধ করছেন। তিনি নিজেও জানেন না যে তার অবচেতন মন মারজিয়ার বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছে কেন। যে লোকটিকে সবাই পাগলা কাশেম বলে ডাকে শুধুমাত্র তার বলা কথাতেই নাকি অন্যকিছু?
শাদাবের বলা কথানুযায়ী একটি বাচ্চার কবর থেকে তার লাশ তুলে নেওয়া হয়েছে৷ এতটুকুই যথেষ্ট হতে পারে মারজিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার। কিন্তু আদতে মারজিয়ার বিপক্ষে প্রমাণস্বরূপ কোনো যুক্তি নেই। কিছু একটা ভেবে দ্রুত চাঁদের অবস্থান জেনে নিলেন। জানতে পারলেন আজ রাতেই আমাবস্যা। অর্থাৎ যদি কবর থেকে ঐ বাচ্চার লাশটি চুরি করে এনে কেউ গোপনে বলি দিয়েও থাকে তবে আজ রাতেই দিবে, আর যদি হয় তা শয়তানের উদ্দেশ্যে।
রাত দশটার দিকে মুশতাক সাহেবের কাছে ফোন করলেন ড. জাওয়াদ। জানতে চাইলেন তার স্ত্রীর ব্যাপারে। বললো, "খাওয়া শেষ করে ঘুমানোর জন্য বিছানা রেডি করছে সে।"
একটু পুলকিত হলেন তার স্ত্রী বাড়িতেই আছে জানতে পেরে। রিশেপশন ডেস্কে থাকা লোকটাকে বলে গেলেন আজ রাতে হোটেলে থাকবেন না তিনি। হোটেল থেকে বের হয়ে সোজা হাঁটা ধরলেন উত্তর দিকে, মুশতাক সাহেবের বাড়ির উদ্দেশ্যে। প্রায় আধঘন্টা হাঁটার পর সেখানে পৌঁছালেন তিনি৷ এগারোটা বাজতে আর কয়েক মিনিট বাকি আছে। তার বাড়ির সদর দরজার দিকে নজর রাখলেন তিনি, নিজেকে লুকিয়ে রেখে। আরও আধাঘন্টা পরে বাড়ি সম্মুখে এগুলেন তিনি। এতক্ষণে নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়বে তারা। ভাগ্য ভালো এদিকে কুকুরের উপদ্রব নেই। নয়তো এতক্ষণে ঘেউঘেউ করে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে নিতো। আর এতো রাতে কেউ এদিকে আসবেও না, মোটামুটি নিশ্চিত তিনি।
বাড়ির চারপাশটাতে ঘুরে ঘুরে পায়চারি করতে লাগলেন তিনি। বিশেষ করে দরজাগুলোর দিকে কড়া নজর তার। যদি মারজিয়া বাড়ির মধ্যেই কাজটি সম্পন্ন করতে চায় তবে মুশতাকের নজরে আসার কথা বিষয়টির। আর এমন কাজ অবশ্যই কেউ বাড়ির মধ্যে করবেও না। তবে কি নদীটির সামনে খোলা কোনো স্থানে? যা-ই হোক না কেন, আজ রাত তার নির্ঘুম কাটাতে হবে।
পরদিন বেশ খোঁজাখুঁজির পর পাগলা কাশেমকে পেলেন ড. জাওয়াদ। কাল রাতের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বললেন তিনি, বাড়ি থেকে কেউ-ই বের হয়নি। আমাবস্যার রাতে বলি দেওয়ার কথা ছিল, যদি বিষয়টি সত্য হয়ে থাকে তবেই।
"কাল রাইতেই বলি দিবে আপনারে কেডা কইছে?"- লোকটি প্রশ্ন করে।
"কেন? কাল না আমাবস্যার রাত ছিল? আর এমন ভয়াল রাতেই তো নরবলি দেওয়া হয়।"
"আমাবস্যার রাইত-ই ক্যান হইতে হইবে?"- সে আবারও প্রশ্ন করলো।
"তাহলে?"
লোকটি এবার ঝেড়ে কাশি দিল। সম্ভবত আঞ্চলিকতার টান ত্যাগ করে ভাষায় শুদ্ধতা নিয়ে কোনো বুলি আওড়াতে চলেছে। ড. জাওয়াদের ধারণাকে সঠিক প্রমাণ করেই সে বললো, "আমাবস্যার রাত ত্রাসের বটে! পূর্ণিমার দানবাকৃতির চাঁদ কি ভয়ানক নয়?"
চলবে...
Sayan
উঠানের ডান কোণে থাকা তুলসি গাছটার দিকে নজর পড়তে বেশ অবাক হলেন ইফতেখার জাওয়াদ। আরও বেশি অবাক হলেন গাছটির গোঁড়ায় বেশ সুন্দর করে মাটি দিয়ে চারপাশে চার ইঞ্চির মতো উঁচু মাচা দেখে। সাধারণত হিন্দুয়ানী বাড়িতে তুলসি গাছগুলোকে এমন যত্ন করে রাখা হয়। ডুপ্লেক্স বাড়িটা তার সামনে যেন সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। ফর্সা মত একজন লোক এগিয়ে আসলেন তার দিকে। হাস্যোজ্জ্বল মুখ, চোখে স্টিলের রাউন্ড ফ্রেমের চশমা। মুখে খোঁচা দাঁড়ি। এগিয়ে এসে মুচকি হাসি দিয়ে ড. জাওয়াদের উদ্দেশ্যে হাত বাড়িয়ে দিলেন তিনি।
"এই লোকটা আমাকে আগে থেকেই চেনে?"- নিজেকে প্রশ্ন করলেন ড. জাওয়াদ।
এমন একটা অঞ্চলে ডুপ্লেক্স বাড়িটার উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। ভেতরে ঢুকতে মাথায় কাপড় দেওয়া একজন মহিলা স্বাগত জানালেন ড. জাওয়াদকে। তিনি বেশ আগ্রহী চোখে মহিলাটির দিকে তাকালেন। চেহারায় কোনো খুত না থাকলেও চোখের নিচে হালকা কালো দাগ লক্ষণীয়। তার হাসির মাঝেই ড. জাওয়াদ তার বাঁকা দাঁতটিকে খেয়াল করলেন। বাঁকা দাঁতের মেয়েরা হাসলে অন্যরকম সৌন্দর্য ফুটে ওঠে নাকি!- প্রথমবারের মতো সচক্ষে দেখলেন তিনি। কথাটা একেবারে ভুল নয়, বস্তুত পুরোপুরি সঠিকও বলা চলে।
"আপনাকে বিষন্ন দেখাচ্ছে ডক্টর।"- বললেন মুশতাক মাসুদ।
"দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়েছি। সম্ভবত এজন্য ক্লান্তি লাগছে।"
"আমি আপনার রুম দেখিয়ে দিচ্ছি। ফ্রেশ হয়ে নিবেন জলদি। ওয়াশরুমে গিজারও আছে, চাইলে পানি গরমও করে নিতে পারেন।"- মুশতাকের সৌজন্যবোধ।
"আসলে..আমি দুঃখিত আমি এখানে থাকতে পারবো না।"
"কেন?"- অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন মুশতাক।
"আমি অলরেডি একটা হোটেলে কয়েকদিনের জন্য বুকিং নিয়েছি। সেখানেই থাকবো।"
"কিন্তু.."
"আমাকে জোর করবেন না মি. মাসুদ। কিন্তু আমি ভীষণ দুঃখিত যে আপনাদের এখানে থাকতে পারবো না।"- তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন ড. জাওয়াদ। তার এখানে আসার মুখ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে শাদাবকে খুঁজে বের করা। মুশতাকের বাড়িতে থাকলে এ ব্যাপারে নিশ্চয়ই কোনো বাধা থেকে থাকবে। তাই তিনি চাইছেন, বাইরে থেকে মূলত শাদাবাকে খুঁজতে। ছেলেটার সাথে এখনও কোনো যোগাযোগ করতে পারছেন না তিনি।
এখানে আসার আগে আলাপ হওয়া ঐ পাগলের বলা কথাগুলো কিছুটা হলেও ভাবাচ্ছে তাকে। মারজিয়াকে কোনো দিক থেকেও ডাইনি মনে হচ্ছে না। অবশ্য চেহারায় আর কী বুঝা যায়। ভেতরে কোন সত্তা আছে কে জানে!
ড. জাওয়াদ একটু হলেও পাগলটির কথায় বিশ্বাস করেছে- এটা ভেবে নিজেই অবাক হন। তার উপর আবার বাড়ির উঠানে চোখে পড়ার মতো স্থানে তুলসি গাছ, সেটাও আবার যত্ন করে রাখা। এগুলো ভাবিয়ে তুলছে তাকে। কিছুক্ষণের জন্য তার মাথায় একটা চিন্তা আসলো, মুশতাকের স্ত্রী মানে মারজিয়া কি ধর্মান্তরিত হয়েছে? আপাতত প্রশ্নগুলোকে নিজের মাঝেই রেখে দিয়ে তাদের সাথে আর কিছু সময় কথা বলে বেরিয়ে পড়লেন তিনি।
শাদাব যেখানে উঠেছিল সেই একই হোটেলে উঠেছেন ইফতেখার জাওয়াদ। রিশেপশন ডেস্কের গিয়ে প্রথমে শাদাবের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলেন। জানতে পারলেন, গতকাল সন্ধ্যায় বের হয়েছিল সে। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত ফেরেনি।
"শাদাব যে রুম নিয়েছিল আমার জন্য ঐ রুমটা দেওয়া যাবে?"- ড. জাওয়াদ প্রশ্ন করলেন।
"দুঃখিত স্যার। এমন কোনো নিয়ম নেই আমাদের। অন্তত দুই দিন অপেক্ষা করি আমরা। যদি ক্লায়েন্ট ফিরে না আসে তবে তার জিনিসপত্র আমাদের বড় স্টোররুমে আলাদা করে গুছিয়ে রাখি। এরপর ফিরে আসলে ব্যাক করে দেই।"
"শাদাবকে কাল থেকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। কোনো বিপদে পড়েছে হয়তো ছেলেটা।"
"কিন্তু স্যার, আমরা আপনাকে তার রুমটি দিতে পারছি না। ক্ষমা করবেন।"
কিঞ্চিৎ মন খারাপ করলেন তিনি। অন্য একটি রুম বুক করতে হবে, তবে সমস্যা নেই। রিশেপশন ডেস্কে থাকা লোকটি ফর্ম ফিল-আপের জন্য তার নাম জিজ্ঞাসা করলেন।
"ইফতেখার জাওয়াদ।"
লোকটি এবার একটু অবাক হয়ে তার দিকে তাকালো। বেশ কয়েক সেকেন্ড ভালো করে দেখার পর জিজ্ঞাসা করলো, "ড. ইফতেখার জাওয়াদ? সাইকিয়াট্রিস্ট?"
"জি।"
লোকটির মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। ড. জাওয়াদ অবাক হলেন না। দেশসেরা সাইকিয়াট্রিস্ট হিসেবে অনেকেই চেনে তাকে। আর তার চেহারার থেকে বেশি চেনে তার নামে। এটা গর্ব করার বিষয় অবশ্য, তবুও তার মধ্যে গম্ভীরতা নেই।
পরদিন সকালে সেই টংএর দোকানের সামনে থাকা বেঞ্চের উপরে গিয়ে বসলেন তিনি। মূলত তিনি চাইছেন পাগলটির সাথে কথা বলতে। কিছু সময় অপেক্ষার পর তাকে এদিকটায় আসতে দেখে আনন্দিত হলেন ড. জাওয়াদ। লোকটি তার দিকেই আসছে। তাকে অবাক করে দিয়ে সোজা তার পাশে এসেই বসলো সে। ড. জাওয়াদ নিজেই প্রথমে জিজ্ঞাসা করলেন, "আপনার নাম কী ভাই?"
"আপনার নাম কী ভাই?"- সেও প্রশ্ন করলো।
"জাওয়াদ, ইফতেখার জাওয়াদ।"
"জাওয়াদ, ইফতেখার জাওয়াদ।"
ড. জাওয়াদ এবার বাকা চোখে তাকালেন তার দিকে। লোকটি তার কথার কাউন্টার দিচ্ছে। বিরক্ত না হয়ে পকেট থেকে ফোন বের করে শাদাবের একটি ছবি বের করে তার মুখের সামনে ধরলেন। লোকটি মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে বেশ কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলো। এরপর মুখ তুলে ড. জাওয়াদের প্রশ্নলোলুপ চোখের দিকে তাকালো সে। বিশেষ ভঙ্গিমায় ডান হাতের বুড়ো আঙুল থুতনির নিচে ঘষতে লাগলো। ড. জাওয়াদ বুঝতে পারলেন কিছু একটা ভাবছে সে।
লোকটি এবার মোবাইলের দিকে আঙুলের ইশারা দিয়ে বললো, "এই পোলাটার লগে ঐদিন রাতে গেছিলাম।"
"কোথায়?"
"লাশ চুরি করতে।"
"লাশ চুরি করতে মানে?"
পান খাওয়া লাল দাঁতে হাসি দিয়ে সে বললো, "আসল কথা হইলো আমরা গেসিলাম গোয়েন্দাগিরি করতে, লাশ চুরি হইছে কি না এইডা দেখার লাইগা।"
ড. জাওয়াদ শাদাবের বলা কথার সাথে মিলাচ্ছেন। লোকটি আবারও বলে উঠলো, "মাইনষে পাগলা কাশেম কইয়া ডাকে আমারে। তয় আমি কইলাম মোটেও পাগল না মিয়া।"
"হ্যাঁ আমারও তাই মনে হয়।"- তার কথায় সায় দিয়ে বললেন তিনি। ফের প্রশ্ন করলেন, "আচ্ছা শেষ কখন দেখা হয়েছিল তার সাথে?"
"ঐ রাইতেই। হেরপর কইছিল সন্ধ্যার পর আবার বাইর হইবো। তয় আমার কাছে আর আসেনাই হেয়।"
সন্ধ্যা বলতে লোকটি গত সন্ধ্যা বুঝিয়েছে ড. জাওয়াদ বুঝতে পারেন। বিষয়টা এমন দাঁড়ায় যে, শাদাব সন্ধ্যার পর বের হয়েছিল, সম্ভবত কথা ছিল এই লোকটির সাথে দেখা করার৷ কিন্তু তার আগেই সে নিখোঁজ হয়। হতে পারে অপহৃত হয়েছে সে। কিন্তু এই এলাকায় তার পরিচিত কেউ-ই ছিল না। শত্রু বা কোত্থেকে আসবে?
সারাদিন বেশ কিছু জায়গা ঘোরাঘুরির পর হোটেলে ফিরে আসলেন তিনি। মুশতাক সাহেবের বাড়িতেও গিয়েছিলেন। বাড়িটা চোখে পড়ার মতো সুন্দর। পিছন দিকটায় বড়সড় বাগান আছে। তার ওপাশে স্রোতস্বিনী নদী।
মুশতাকের স্ত্রীর সাথে দেখা করেন। তিনি কিন্তু সে শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ। মুশতাকের বলা কথানুযায়ী সেও বলেছিল, "একজন গর্ভবতী মহিলা ঠিক যেমন অনুভব করে আমারও তেমনই অনুভূতি হয় মাঝে মাঝে। তবে অবাক হই এজন্য যে, কখনও কখনও অনেক বেশি ঘেমে যাই, শরীর গরম হতে থাকে, মনে হয় যেন জ্বর আসছে। পেটে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। এমনও মনে হয় যেন ভেতর থেকে কেউ লাথি মারছে।"
সাধারণ একটা সাক্ষাৎকার নিয়ে ফিরে আসেন তিনি।
যদি এমনটা হয় যে, সে শয়তানের উদ্দেশ্যে মৃত শিশুর বলি দিচ্ছে আর তাতে শয়তান খুশি হয়ে তাকে সন্তান উপহার দিয়েছে? আর এজন্যই মারজিয়ার এমন অনুভূতি হচ্ছে? পরক্ষণে নিজের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন তিনি। কিসব চিন্তা মাথায় আসছে তার! একজন আস্তিক হিসেবে শয়তানে বিশ্বাস করেন তিনি। কিন্তু শয়তানের কোনো ক্ষমতা নেই কারো গর্ভে সন্তান দেওয়ার। এ ক্ষমতা স্বয়ং স্রষ্টার, অন্য কারও নয়।
কিন্তু শয়তানের সন্তান দেওয়ার ক্ষমতা না থাকলেও হয়তো মারজিয়া এটাতে বিশ্বাস করে যে, তার উদ্দেশ্যে বলি দিলে হয়তোবা সে সন্তান উপহার দিতে পারবে। তবে আরেকটা বিষয়ও মাথায় আসলো তার, তুলসি গাছটির ব্যাপারে।
সম্ভাবনা থাকতেও পারে সে হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত হয়েছে। তবে তার মধ্যে এখনও নিজ ধর্মের টান রয়ে গেছে। হতে পারে তাদের ধর্মমতে সৃষ্টিদেবতার উৎসর্গে মৃত বাচ্চার বলি দিচ্ছে সে।
কিন্তু এতেও নিজের ভাবনার বিপক্ষে অবস্থান নিলেন তিনি। হিন্দুধর্মানুযায়ী কোথাও মৃত বাচ্চা উৎসর্গের কথা আছে বলে তার মনে হয় না। নরবলি বা নরহত্যার অনুমতি কোনো ধর্মেই নেই। কিন্তু তবুও ইতিহাস ঘাটলে নরবলির কিছু নজির পাওয়া যায়। হতে পারে মারজিয়া এমনই ভ্রান্ত মতবাদে বিশ্বাসীদের একজন।
ড. জাওয়াদ নিজের মধ্যে বেশ বিস্ময়বোধ করছেন। তিনি নিজেও জানেন না যে তার অবচেতন মন মারজিয়ার বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছে কেন। যে লোকটিকে সবাই পাগলা কাশেম বলে ডাকে শুধুমাত্র তার বলা কথাতেই নাকি অন্যকিছু?
শাদাবের বলা কথানুযায়ী একটি বাচ্চার কবর থেকে তার লাশ তুলে নেওয়া হয়েছে৷ এতটুকুই যথেষ্ট হতে পারে মারজিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার। কিন্তু আদতে মারজিয়ার বিপক্ষে প্রমাণস্বরূপ কোনো যুক্তি নেই। কিছু একটা ভেবে দ্রুত চাঁদের অবস্থান জেনে নিলেন। জানতে পারলেন আজ রাতেই আমাবস্যা। অর্থাৎ যদি কবর থেকে ঐ বাচ্চার লাশটি চুরি করে এনে কেউ গোপনে বলি দিয়েও থাকে তবে আজ রাতেই দিবে, আর যদি হয় তা শয়তানের উদ্দেশ্যে।
রাত দশটার দিকে মুশতাক সাহেবের কাছে ফোন করলেন ড. জাওয়াদ। জানতে চাইলেন তার স্ত্রীর ব্যাপারে। বললো, "খাওয়া শেষ করে ঘুমানোর জন্য বিছানা রেডি করছে সে।"
একটু পুলকিত হলেন তার স্ত্রী বাড়িতেই আছে জানতে পেরে। রিশেপশন ডেস্কে থাকা লোকটাকে বলে গেলেন আজ রাতে হোটেলে থাকবেন না তিনি। হোটেল থেকে বের হয়ে সোজা হাঁটা ধরলেন উত্তর দিকে, মুশতাক সাহেবের বাড়ির উদ্দেশ্যে। প্রায় আধঘন্টা হাঁটার পর সেখানে পৌঁছালেন তিনি৷ এগারোটা বাজতে আর কয়েক মিনিট বাকি আছে। তার বাড়ির সদর দরজার দিকে নজর রাখলেন তিনি, নিজেকে লুকিয়ে রেখে। আরও আধাঘন্টা পরে বাড়ি সম্মুখে এগুলেন তিনি। এতক্ষণে নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়বে তারা। ভাগ্য ভালো এদিকে কুকুরের উপদ্রব নেই। নয়তো এতক্ষণে ঘেউঘেউ করে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে নিতো। আর এতো রাতে কেউ এদিকে আসবেও না, মোটামুটি নিশ্চিত তিনি।
বাড়ির চারপাশটাতে ঘুরে ঘুরে পায়চারি করতে লাগলেন তিনি। বিশেষ করে দরজাগুলোর দিকে কড়া নজর তার। যদি মারজিয়া বাড়ির মধ্যেই কাজটি সম্পন্ন করতে চায় তবে মুশতাকের নজরে আসার কথা বিষয়টির। আর এমন কাজ অবশ্যই কেউ বাড়ির মধ্যে করবেও না। তবে কি নদীটির সামনে খোলা কোনো স্থানে? যা-ই হোক না কেন, আজ রাত তার নির্ঘুম কাটাতে হবে।
পরদিন বেশ খোঁজাখুঁজির পর পাগলা কাশেমকে পেলেন ড. জাওয়াদ। কাল রাতের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বললেন তিনি, বাড়ি থেকে কেউ-ই বের হয়নি। আমাবস্যার রাতে বলি দেওয়ার কথা ছিল, যদি বিষয়টি সত্য হয়ে থাকে তবেই।
"কাল রাইতেই বলি দিবে আপনারে কেডা কইছে?"- লোকটি প্রশ্ন করে।
"কেন? কাল না আমাবস্যার রাত ছিল? আর এমন ভয়াল রাতেই তো নরবলি দেওয়া হয়।"
"আমাবস্যার রাইত-ই ক্যান হইতে হইবে?"- সে আবারও প্রশ্ন করলো।
"তাহলে?"
লোকটি এবার ঝেড়ে কাশি দিল। সম্ভবত আঞ্চলিকতার টান ত্যাগ করে ভাষায় শুদ্ধতা নিয়ে কোনো বুলি আওড়াতে চলেছে। ড. জাওয়াদের ধারণাকে সঠিক প্রমাণ করেই সে বললো, "আমাবস্যার রাত ত্রাসের বটে! পূর্ণিমার দানবাকৃতির চাঁদ কি ভয়ানক নয়?"
চলবে...
Sayan
Abul basar, Santa akter, Raihan khan, Tanusri roi, Badol hasan, Saiful Osman, Sumon khan and লেখাটি পছন্দ করেছে
- Trimatraধুমকেতু
- Posts : 23
স্বর্ণমুদ্রা : 1434
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-06-05
Re: যেখানে আঁধার নামে
Sat Jun 05, 2021 8:12 pm
৪র্থ ও শেষ পর্ব
"শয়তানে বিশ্বাস করেন?"
"কেন বলুন তো?"
"বা আপনার স্ত্রী বিশ্বাস করে?"- তার প্রশ্নের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে পাল্টা প্রশ্ন করলেন ড. জাওয়াদ।
"কেমন ধরণের বিশ্বাসের কথা বলছেন আপনি?"
"গর্ভে বাচ্চা দেওয়ার ক্ষমতায় বিশ্বাস!"
"মানে?"- অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন মুশতাক মাসুদ।
"গতরাতে আপনার স্ত্রী কোথায় ছিল?"- ড. জাওয়াদ আবারও প্রশ্ন করলেন।
"আমার সাথেই তো ছিল, ঘুমাচ্ছিল। কেন?"
"আপনি নিশ্চিত?"
"নিশ্চিত না হওয়ার কী আছে?"
"না এমনিই প্রশ্ন করলাম আর কি! ছাড়ুন এসব। আপনার উঠানে একটা তুলসি গাছ বেশ যত্নের সাথে হাওয়ায় দুলছে যে?"
"গাছের যত্ন করা খারাপ নাকি?"
"একদম-ই না। কিন্তু সচরাচর এটা দেখা যায় না। একমাত্র হিন্দুয়ানী বাড়িতে ছাড়া।"
"আমার স্ত্রী মনে করে তুলসি গাছের বাতাস ঘরে যাওয়া অনেক কল্যাণ বয়ে আনে। আর তুলসি পাতার যে অনেক ঔষধি গুণ আছে এটাও জানেন নিশ্চয়ই?"
ড. জাওয়াদ তার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলেন না। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিলেন কয়েকবার।
"আমি আসার আগে কী করছিলেন আপনি?"
"তেমন কিছু না।"
"মনে হচ্ছে লিখছিলেন কিছু।"
একটু অবাক হলেন মুশতাক মাসুদ। প্রশ্ন করলেন, "হ্যাঁ, কিন্তু আপনি বুঝলেন কীভাবে?"
"না বুঝার কিছুই নেই। আপনার হাতের তালুর নিচের দিকে কলমের দাগ লেগে আছে। লেখার সময় কলম ঘুরাঘুরি করলে এমন দাগ লেগে যায়। সম্ভবত আপনি গভীরভাবে চিন্তা করে কোনোকিছু লিখছিলেন যে কারণে ভাবনার মাঝে মাঝে হাতের মধ্যে কলম নড়াচড়া করতে থাকেন, এজন্যই দাগগুলো পড়েছে।"
মুশতাক সাহেব এবার হাত উঁচু করে দাগগুলো দেখলেন। কিছু বলার আগে ড. জাওয়াদ আবার প্রশ্ন করলেন, "আপনার স্টাডি রুমটা দেখতে পারি একটু?"
মুশতাক সাহেব ইতস্তত করছেন একটু। চেহারায় আগের মতো হাসির ছাপ নেই। তার এ পরিবর্তন ড. জাওয়াদের চোখ এড়াতে পারলো না। মৃদু হেসে প্রশ্ন করলেন, "স্টাডি রুমকে তো আর আপনার মতো মানুষ পর্ণ ম্যাগাজিন কিংবা চটি বইয়ের আখড়া বানাবে না। তাহলে আপনাকে বিচলিত দেখাচ্ছে কেন?"
ড. জাওয়াদের কৌতুকপূর্ণ কথায় মুশতাকের ঠোঁট কোনোমতে বাকা হয়ে একটুখানি হাসি ফুটিয়ে তোলে। কিন্তু আদতে তিনি কথাটি উপভোগ করেননি। ড. জাওয়াদ একটু বোকাচোখে তাকালেন তার দিকে। এই মানুষটি কি রসিকতা পছন্দ করে না? নাকি কোনো কিছু গোপন করতে চেষ্টা করছে?- মনে মনে ভাবলেন তিনি।
নতুন কোনো বাক্য আদান-প্রদানের আগেই পাশের রুম থেকে মেয়েলি কণ্ঠের চাপা চিৎকার শুনতে পান তারা। মুশতাক সাহেব এবার নড়েচড়ে ওঠেন।
"এক্সকিউজ মি ডক্টর।"- বলেই তার পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন তিনি। ড. জাওয়াদ মনেমনে দৃশ্যটি কল্পনা করে নিচ্ছেন। 'মেঝেতে পেটে হাত রেখে গড়াগড়ি খাচ্ছে মারজিয়া। কপাল থেকে বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝরছে। মুশতাক সাহেব সেখানে গিয়েই তাকে টেনে তুলবেন। হয়তো রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে হাত দিয়ে দেখবেন শরীর গরম হয়েছে স্বাভাবিকের চেয়ে।'- এমনই একটা দৃশ্য কল্পনায় ধারণ করে তিনিও বেরিয়ে আসলেন।
গিয়ে দেখলেন খাটের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে আছে সে। পাশে তার স্বামী হাত দিয়ে ঘুরিয়ে সোজা করে তোলার চেষ্টা করছে। যদিও এটার দৃশ্য অন্যরকম কল্পনা করেছিলেন তিনি তবে প্রেক্ষাপট একই। ফোন বের করে কাউকে কল করলেন মুশতাক। এম্বুলেন্স হবে হয়তো। ড. জাওয়াদের দিকে তাকিয়ে বললেন, "দুঃখিত ডক্টর, আমি এখন আপনাকে সময় দিতে পারবো না৷ ওকে নিয়ে দ্রুত বের হতে হবে।"
ড. জাওয়াদ সৌজন্যবোধে মাথা নাড়ালেন। মুশতাক তার স্ত্রীর এক হাত নিজের কাঁধের উপর রেখে তাকে ধরে বাইরে বের করার চেষ্টা করছেন। কড়া পারফিউমের গন্ধ আসছে মারজিয়ার শরীর থেকে।
_____
"আপনার স্ত্রী সুস্থ এখন?"
"হুম। তবে আতঙ্কের মধ্যে আছে।"
"ভয় পাবেন না। আমার মনে হচ্ছে এগুলোর পুরোটাই তার অভিনয়।"
"কেন? আর জ্বর জ্বর আসা, ঘেমে যাওয়া এগুলোও অভিনয়?"- অবাক হলেন মুশতাক মাসুদ।
"হুম।"
"আপনার এমনটা মনে হচ্ছে কেন?"
"পারফিউম।"
"মানে?"
"আপনার স্ত্রীর এমন আচরণের আগে যখন সে সামনে আসে, কোনোরকম পারফিউমের ব্যবহার করেছিল না সে। কিন্তু এমনটা করার পর যখন তাকে বাইরে নিয়ে যাচ্ছিলেন, বেশ তীব্র ঘ্রাণের একটা পারফিউমের গন্ধ পাচ্ছিলাম তার থেকে।"
"তো এটার সাথে অভিনয়ের সম্পর্ক কী?"
"আমি ধারণা করছি সে অভিনয় করছে, নিশ্চিত নই। যদি প্রশ্ন করেন যে সে ঘাম আনছে কীভাবে, তবে এটার সহজ ব্যাখ্যার আগে ঘাম হওয়ার কারণ বলি। ঘামের তৈরি হয় ঘামগ্রন্থি থেকে। আমাদের দেহে দুই ধরনের ঘামগ্রন্থি আছে। একটি হল একক্রাইন(eccrine) ঘামগ্রন্থি ও অপরটি হল অ্যাপেক্রাইন (apocrine) ঘামগ্রন্থি। একক্রাইন এর সংখ্যা অসংখ্য এবং এরা
আমাদের সারা শরীর জুড়ে বিস্তৃত। আমাদের মস্তিষ্কে হাইপােথ্যালামাস (hypothalamus) নামে একটি অংশ আছে যেটি আমাদের দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ও সঞ্চালনের কাজ দেখাশোনা করে। যখন আমাদের দেহের তাপমাত্রা বেড়ে যায় তখন এই হাইপোথ্যালামাস একক্রাইন ঘামগ্রন্থিকে সংকেত পাঠায় এবং এর ফলে আমাদের ঘাম নির্গত হয়। এবার সহজ ব্যাখাটি আপনি নিজেই দিন।"
"মানে সে নিজের দেহের তাপমাত্রাকে বৃদ্ধি করে তুলেছিল?"
"এক্সাক্টলি এটাই। বাইরে তাজা রোদ, দু'মিনিট দাঁড়ালেই ঘাম ঝরতে শুরু করবে। ঘাম আসাকে অলৌকিকভাবে নিবেন না অন্তত।"
"আর জ্বরের ব্যাপারে?"
"আপনি নিজেই বলেছিলেন জ্বর জ্বর ভাব আসে, জ্বর আসে বলেননি। রসূন কেঁটে বগলের নিচে রেখে রোদে একটু দৌঁড়াদৌঁড়ি করলেই ব্যাস, শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায় আর মনে হয় জ্বর জ্বর এসেছে৷ সম্ভবত আপনার স্ত্রী এমন কিছুই করেছে আর রসূনের গন্ধ যেন আপনার কিংবা আমার নাকে না আসে এজন্য পারফিউম ছড়িয়েছে।"
"কিন্তু ডক্টর, সে এমনটা কেন করতে যাবে?"
ড. জাওয়াদের ইচ্ছে হয় ঐ পাগলটার বলা কথাগুলো বলে দিক। কিন্তু সেগুলো থেকে ডক্টর নিজেও কোনো কারণ খুঁজে পাননি এমনটা করার। একবার ভেবেছিলেন, তার এমনটা করার উদ্দেশ্য হলো হাসপাতালের চাইল্ড হেলথ ইউনিটে যাওয়ার। যেন সে জানতে পারে কোনো বাচ্চার মৃত্যু হয়েছে কি না। কিন্তু এটাকে নিজেই ভঙ্গুর যুক্তি ধরে নিয়েছেন। তাছাড়া ঐ পাগলের বলা কথাগুলোও যে শতভাগ সত্য তেমনটা বিশ্বাস করছেন না তিনি।
প্রসঙ্গ পালটে বললেন, "আপনার স্টাডি রুমটা দেখালেন না যে?" মূলত স্টাডি রুম দেখতে চাওয়ার পর মুশতাকের মোচড়ামুচড়ি দেখে ডক্টরের স্পৃহা আরো বেড়ে যায়। মুশতাক কোনো উত্তর না দিয়ে তাকে স্টাডি রুমে নিয়ে গেলেন। অবাক হলেন যে, এতো বড় স্টাডি রুম কিন্তু বইয়ের সংখ্যা নগন্য। আরেকটা নজর কাড়ার মতো বিষয় হলো বইগুলোর পঁচানব্বই ভাগ-ই হিউম্যান ব্রেইনের উপর লেখা। বেশ কয়েকটির দিকে ভালোকরে লক্ষ্য করে দেখতে পান সেগুলোএ অধিকাংশই নতুন একদম, মনে হচ্ছে মলাটটিও খোলা হয়নি। পাঁচ-দশ মিনিট এদিক সেদিক চোখ ঘুরিয়ে বেরিয়ে আসলেন তিনি।
_____
দুপুরবেলায় এই লোকটার চা খেতে কেমন লাগছে কে জানে! মাঝে কোনো বিরতি না নিয়ে একের পর এক চুমুক দিয়ে পুরো কাপটি খালি করতে বড়জোর চল্লিশ সেকেন্ড লেগেছে। ড. জাওয়াদ এই পাগলটিকে কারণ ছাড়াই পছন্দ করে ফেলেছেন। হোটেলে অলস সময় কাটানোর থেকে এর সাথে থাকাকেই বেশি গুরুত্ব দেন তিনি। অবশ্য অন্য একটি কারণও আছে, শাদাব এই লোকটির সাথেই তার সবথেকে বেশি সময় কাটিয়েছে এখানে এসে। কে জানে হয়তো এর থেকেই শাদাবের খোঁজ পেয়ে যাবেন তিনি।
"আপনে তো ডাক্তার, তাই না?"- প্রশ্ন করলো সে।
"হুম। কেন?"
"তাইলে একটা কথা কন তো, সাপের বিষ খাইলে মানুষ মরে না ক্যান?"
"মরে না এটা আপনি কীভাবে জানলেন?'
"আমি দেখছি।"
"ও আচ্ছা৷ সাপ হলো বিষধর (venomous), বিষাক্ত (poisonous) নয়৷ ধরুন আপনি কোনো প্রাণিকে কামড়ালেন আর আপনিই মারা গেলেন, তাহলে প্রাণিটি বিষাক্ত। আর যদি কোনো প্রাণি আপনাকে কামড়ায় আর আপনি মারা যান, তবে সেটা বিষধর। সেক্ষেত্রে ইঁদুর মারা বিষ হলো Poison আর সাপের বিষ হলো Venom তাই ইঁদুর মারা বিষ খেলে মৃত্যুর সম্ভাবনা থাকে কিন্তু সাপের বিষ খেলে পেপসিন বা ট্রিপসিন(প্রোটিন হজমে সাহায্যকারী উৎসেচক) এটিকে রাসায়নিক ভাবে ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। এই রাসায়নিকটি শুধুমাত্র রক্তের সাথে মিশে গিয়েই বিষক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে তাই পেটে গেলে মানুষ মারা যায় না। কিন্তু কোনোভাবে যদি পাকস্থলীতে যাওয়ার পথে তা রক্তে মিশতে পারে, তবে মৃত্যু ঘটবে।"
লোকটি একটু উপরের দিকে তাকিয়ে মুখের দাড়িগুলো চুলকাতে লাগলো। সে কি আসলেই কিছু বুঝেছে কি না এই নিয়ে ঘোর সন্দেহ হয় ড. জাওয়াদের।
"আমার কেমন জানি লাগতাছে।"- লোকটি বললো
"কেমন লাগছে?"
"হেইয়া আমি ক্যামনে জানমু? আপনে ডাক্তার, আপনে কন।"
"আপনার কেমন লাগছে সেটা তো আপনিই ভালো বলতে পারবেন। অস্বস্তি, ক্ষুদা, রাগ নাকি অস্থিরতা কোনটা?"
"আমি ক্যামনে কমু?"
বেশ ঝামেলায় পড়ে গেলেন ড. জাওয়াদ। এ মূহুর্তে ভাবছেন এর সাথে তর্কে যাওয়া উচিত হবে না। তাকে অবাক করে দিয়ে পাগলটি বললো, "বুঝলেন ডাক্তার, দুইজন বুদ্ধির মানুষের কোনো বিষয় লইয়া তর্ক করতে নাই। তাইলে বিষয়টার আরও ঘোল পাকাইয়া যায়।"
"বুদ্ধির মানুষ মানে, বুদ্ধিমান?"
"হ অইটাই।"
"কেন? কোন দুইজন বুদ্ধিমানে তর্ক করছে?"
"এই যে আমি।"- নিজের দিকে ইঙ্গিত করে খিলখিলিয়ে হাসলো সে। ড. জাওয়াদও হেসে প্রশ্ন করলেন, "আর অন্যজন কে?"
"আপনে!"
"আমি যে বুদ্ধিমান এটা কে বললো আপনাকে?"
"মুশতাকের বাড়িত আইছেন না? হের বাড়ি বুদ্ধিমান মাইনষে ছাড়া কেউ আসে না।"
এবার ড. জাওয়াদের মুখ থেকে হাসির চিহ্ন হারিয়ে যায়। দ্রুত সেখান থেকে চলে আসেন হোটেলে। পাগল লোকটা তার হঠাৎ এভাবে চলে যাওয়ার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
_____
"শাদাব কোথায়?"- জোরগলায় প্রশ্ন করলেন ড. জাওয়াদ।
অবাক হওয়ার ভঙ্গিমায় মুশতাক উত্তর দেয়, "কোন শাদাব? শাদাব নামের কাউকে চিনি না আমি।"
"ভং ধরবেন না একদমই। আমাকে এখানে আনার জন্য অনেক নাটক সাজিয়েছেন আপনি।"
"আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কী বলতে চাইছেন আপনি।"- কপালের চামড়া কুঁচকিয়ে বললো মুশতাক।
"আপনি প্রথমে আমার ব্যক্তিগত নম্বরে ফোন করে এখানে আসার জন্য বলেন। কিন্তু জেনেশুনে মিথ্যা বলেছিলেন যে আমার নম্বর ফোনবুক থেকে পেয়েছেন। আর আপনি জানতেন আমার রোগীদের সাথে রাখা এপয়েন্টমেন্ট বাদ দিয়ে আপনার কথার সত্যতা যাচাই করতে আসবো না। অন্য কাউকে পাঠাবো এ ব্যাপারে খোঁজ নিতে, আর আমি শাদাবকে পাঠালাম। আপনার স্ত্রীকে দিয়ে সাজানো নাটকের মূল পরিচালক আপনি। যাতে শাদাব এসে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, আপনি ফোনে আমাকে সত্যি কথা-ই বলেছিলেন। আর সেজন্য এই নাটক সাজালেন।
ঠিক তেমনটাই হলো। তবে আপনি খুব চতুর মানুষ। শাদাবকে প্রথম দিনেই ধরে ফেললেন। তবে আমিই যে এখানে আসবো সে ব্যাপারে আপনি নিশ্চিত ছিলেন না। এরই মধ্যে ঐ পাগলের বলা কথাকে বাস্তবায়ন করতে বাচ্চাটির কবরের লাশ চুরি করলেন আর সেখানে গিয়ে শাদাব দেখতে পায় কবরে কোনো লাশ নেই। ব্যাস, আপনার স্ত্রীর বিপক্ষে অনেক সুন্দর একটি গল্প সাজানো হয়ে গেল।
এ ব্যাপারে শাদাব আমাকে জানানো পরে শাদাবকে অপহরণ করেন আপনি। আর আমি যখন তার বিপদের সন্দেহ করি, তখনই চলে আসি এখানে। আপনি জানতেন, আপনার ফেলানো দু'টো টোপের একটিকে আমি গিলবোই। আর তেমনটাই হলো, আমি চলে এলাম এখানে।"
"কিন্তু আপনাকে এখানে এনে আমার কী লাভ?"
"এর আগেও এনেছিলেন না কাউকে? আমার মস্তিষ্ক কি খুব জরুরি আপনার কাছে? মিস্টার সাইকো।"
মুশতাক এবার মাথা নিচু করে বাকা একটি হাসি ফুটিয়ে তোলে ঠোঁটের কোণায়। বললো, "তবে জেনে গিয়েছেন?"
"আগের ব্যক্তিগুলো কারা ছিলেন?"
"শাহাবুদ্দিন রাব্বি ও আরিফ জব্বার। আপনি তৃতীয়।"
"মানে এক বছর আগে নিখোঁজ হওয়া হোমিসাইড গোয়েন্দা শাহাবুদ্দিন রাব্বি আর ছয়মাস আগে নিখোঁজ হওয়া মেডিকেল শিক্ষক আরিফ জব্বারের কথা বলছেন আপনি?"
"এক্সাক্টলি৷ মাঝখানে এমন সময়ের গ্যাপ রাখি যাতে নিখোঁজের কেইসগুলো ধামাচাপা পড়ে যায়। কিন্তু আপনি আমার উপর সন্দেহ কখন আনলেন?"
"যখন আপনার স্টাডিরুমে এতোগুলো নতুন বই দেখি হিউম্যান ব্রেইনের উপরে। যেগুলো খুলে দেখেননি আপনি। পরবর্তীতে জানতে পারলাম আগেও আপনার বাড়িতে বুদ্ধিমান কেউ পা রেখেছিলেন। ব্যাস, বুঝতে পারলাম আপনার মানুষের ব্রেইনের উপর ঝোঁক আছে। আর তাও বুদ্ধিমান কারো ব্রেইন। আপনি চাইলে আমাকে আরও আগেই নিজের কব্জা করতে পারতেন কিন্তু আপনি যাচাই করছিলেন আমাকে। আপনি এমনই একজন সাইকো, যার নেশা হলো মানুষের ব্রেইনকে শরীর থেকে আলাদা করা।"
"শতভাগ সত্য।"
"শাদাব কোথায়?"
"কেন বলবো?"
"আমার ধারণা, তাকে এখনও জীবিত রেখেছেন আপনি। দেখুন মি. মাসুদ, আপনি আমার মস্তিষ্ক খুলে নিতে চান, শাদাবের নয়। আমি জানি আপনি তাকে আপনার পরিচয় গোপন করেই অপহরণ করেছেন, আর আপনার পরিচয় গোপন করেই তাকে ছেড়ে দিন। আপনার বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য একমাত্র আমিই থাকবো যে স্বয়ং আপনার শিকার হতে যাচ্ছে।"
"তার মানে আপনি আত্মসমর্পণ করছেন?"- আবারও বাকা হাসি তার ঠোঁটে।
"যদি শাদাবকে কোথায় রেখেছেন এটা বলেন তবেই। নাহয় আমার বাহুর শক্তি দেখতে পাবেন আপনি।"
শাদাবকে লুকিয়ে রাখার জায়গা বলে দেন মুশতাক। ড. জাওয়াদ পকেট থেকে মোবাইল বেরিয়ে কল করলেন কাউকে। মুশতাক এবার আক্রমণাত্মকভাবে উঠে আসতে গেলে ড. জাওয়াদ হাতের ইশারায় থামিয়ে বলেন, "ভয় পাওয়ার কিছু নেই। শুধুমাত্র শাদাবের ব্যাপারটাই বলবো।"
ওপাশে কাউকে শাদাবকে লুকিয়ে রাখার ঠিকানা দিয়ে ফোন রেখে দেন তিনি। বললেন, "আমাকে আরেকটু সময় দিন। যদি ওরা আমাকে কনফার্ম করে যে তারা শাদাবকে পেয়েছে তবেই ধরা দিচ্ছি আমি। নয়তো হাতাহাতি হবে, আর আপনিও ফেঁসে যাবেন।
প্রায় আধঘন্টা ধরে চেয়ারে এক পায়ের উপর অন্য পা ভাঁজ করে বসে আছেন ড. জাওয়াদ। মুশতাক চেয়ার ছেড়ে উঠে পায়চারি করছে। বললো সে, "এতোক্ষণ লাগার কথা নয়।"
পরবর্তী দু'মিনিটের মাথায় বেশ কয়েকজন পোশাক পরা লোক হাজির হলেন সেখানে, পুলিশ। চমকে উঠলেন মুশতাক মাসুদ। ড. জাওয়াদ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে বললেন, "এতো সহজে আমি আত্মসমর্পণ করছি এটাকে কীভাবে বিশ্বাস করে নিলেন মি. মাসুদ, দ্য সাইকো? আপনার বুঝা উচিত ছিল শাদাবের ঠিকানা জানতেই এমনটা করেছি আমি। ব্যাক-আপ আগে থেকেই রেডি করে রেখেছিলাম যেন আমি ফোন করে শাদাবের ঠিকানা বলার সাথে সাথেই তারা বুঝতে পারে মেইন কালপ্রিট আপনি। আর সেখান থেকে দ্রুত তাকে উদ্ধার করেই এখানে পৌঁছে যায় তারা।"
পরাজয়ের সুরে এবার মুশতাক মাসুদ বললেন, "তোমার ঐ ব্রেইনটাই সবথেকে বেশি দরকার ছিল আমার।"
ড. জাওয়াদ হাসলেন।
_____
শেষবারের মতো পাগলটির সাথে দেখা করলেন ড. জাওয়াদ, সাথে শাদাবও আছে। এই লোকটির কারণেই সে মুশতাককে ধরতে পেরেছে। যাওয়ার আগে তাকে বলে গেলেন, "শোনো কাশেম ভাই, যেখানে শয়তান বাস করে সেখানে আঁধার নামে না, যেখানে অনিয়ম চলে সেখানেই আঁধার নামে আর শয়তান সেখানেই আখড়া গড়ে তোলে।"
পাগল লোকটি চুপ করে তাদের চলে যাওয়ার দৃশ্য দেখছে।
সমাপ্ত
Sayan
"শয়তানে বিশ্বাস করেন?"
"কেন বলুন তো?"
"বা আপনার স্ত্রী বিশ্বাস করে?"- তার প্রশ্নের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে পাল্টা প্রশ্ন করলেন ড. জাওয়াদ।
"কেমন ধরণের বিশ্বাসের কথা বলছেন আপনি?"
"গর্ভে বাচ্চা দেওয়ার ক্ষমতায় বিশ্বাস!"
"মানে?"- অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন মুশতাক মাসুদ।
"গতরাতে আপনার স্ত্রী কোথায় ছিল?"- ড. জাওয়াদ আবারও প্রশ্ন করলেন।
"আমার সাথেই তো ছিল, ঘুমাচ্ছিল। কেন?"
"আপনি নিশ্চিত?"
"নিশ্চিত না হওয়ার কী আছে?"
"না এমনিই প্রশ্ন করলাম আর কি! ছাড়ুন এসব। আপনার উঠানে একটা তুলসি গাছ বেশ যত্নের সাথে হাওয়ায় দুলছে যে?"
"গাছের যত্ন করা খারাপ নাকি?"
"একদম-ই না। কিন্তু সচরাচর এটা দেখা যায় না। একমাত্র হিন্দুয়ানী বাড়িতে ছাড়া।"
"আমার স্ত্রী মনে করে তুলসি গাছের বাতাস ঘরে যাওয়া অনেক কল্যাণ বয়ে আনে। আর তুলসি পাতার যে অনেক ঔষধি গুণ আছে এটাও জানেন নিশ্চয়ই?"
ড. জাওয়াদ তার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলেন না। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিলেন কয়েকবার।
"আমি আসার আগে কী করছিলেন আপনি?"
"তেমন কিছু না।"
"মনে হচ্ছে লিখছিলেন কিছু।"
একটু অবাক হলেন মুশতাক মাসুদ। প্রশ্ন করলেন, "হ্যাঁ, কিন্তু আপনি বুঝলেন কীভাবে?"
"না বুঝার কিছুই নেই। আপনার হাতের তালুর নিচের দিকে কলমের দাগ লেগে আছে। লেখার সময় কলম ঘুরাঘুরি করলে এমন দাগ লেগে যায়। সম্ভবত আপনি গভীরভাবে চিন্তা করে কোনোকিছু লিখছিলেন যে কারণে ভাবনার মাঝে মাঝে হাতের মধ্যে কলম নড়াচড়া করতে থাকেন, এজন্যই দাগগুলো পড়েছে।"
মুশতাক সাহেব এবার হাত উঁচু করে দাগগুলো দেখলেন। কিছু বলার আগে ড. জাওয়াদ আবার প্রশ্ন করলেন, "আপনার স্টাডি রুমটা দেখতে পারি একটু?"
মুশতাক সাহেব ইতস্তত করছেন একটু। চেহারায় আগের মতো হাসির ছাপ নেই। তার এ পরিবর্তন ড. জাওয়াদের চোখ এড়াতে পারলো না। মৃদু হেসে প্রশ্ন করলেন, "স্টাডি রুমকে তো আর আপনার মতো মানুষ পর্ণ ম্যাগাজিন কিংবা চটি বইয়ের আখড়া বানাবে না। তাহলে আপনাকে বিচলিত দেখাচ্ছে কেন?"
ড. জাওয়াদের কৌতুকপূর্ণ কথায় মুশতাকের ঠোঁট কোনোমতে বাকা হয়ে একটুখানি হাসি ফুটিয়ে তোলে। কিন্তু আদতে তিনি কথাটি উপভোগ করেননি। ড. জাওয়াদ একটু বোকাচোখে তাকালেন তার দিকে। এই মানুষটি কি রসিকতা পছন্দ করে না? নাকি কোনো কিছু গোপন করতে চেষ্টা করছে?- মনে মনে ভাবলেন তিনি।
নতুন কোনো বাক্য আদান-প্রদানের আগেই পাশের রুম থেকে মেয়েলি কণ্ঠের চাপা চিৎকার শুনতে পান তারা। মুশতাক সাহেব এবার নড়েচড়ে ওঠেন।
"এক্সকিউজ মি ডক্টর।"- বলেই তার পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন তিনি। ড. জাওয়াদ মনেমনে দৃশ্যটি কল্পনা করে নিচ্ছেন। 'মেঝেতে পেটে হাত রেখে গড়াগড়ি খাচ্ছে মারজিয়া। কপাল থেকে বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝরছে। মুশতাক সাহেব সেখানে গিয়েই তাকে টেনে তুলবেন। হয়তো রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে হাত দিয়ে দেখবেন শরীর গরম হয়েছে স্বাভাবিকের চেয়ে।'- এমনই একটা দৃশ্য কল্পনায় ধারণ করে তিনিও বেরিয়ে আসলেন।
গিয়ে দেখলেন খাটের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে আছে সে। পাশে তার স্বামী হাত দিয়ে ঘুরিয়ে সোজা করে তোলার চেষ্টা করছে। যদিও এটার দৃশ্য অন্যরকম কল্পনা করেছিলেন তিনি তবে প্রেক্ষাপট একই। ফোন বের করে কাউকে কল করলেন মুশতাক। এম্বুলেন্স হবে হয়তো। ড. জাওয়াদের দিকে তাকিয়ে বললেন, "দুঃখিত ডক্টর, আমি এখন আপনাকে সময় দিতে পারবো না৷ ওকে নিয়ে দ্রুত বের হতে হবে।"
ড. জাওয়াদ সৌজন্যবোধে মাথা নাড়ালেন। মুশতাক তার স্ত্রীর এক হাত নিজের কাঁধের উপর রেখে তাকে ধরে বাইরে বের করার চেষ্টা করছেন। কড়া পারফিউমের গন্ধ আসছে মারজিয়ার শরীর থেকে।
_____
"আপনার স্ত্রী সুস্থ এখন?"
"হুম। তবে আতঙ্কের মধ্যে আছে।"
"ভয় পাবেন না। আমার মনে হচ্ছে এগুলোর পুরোটাই তার অভিনয়।"
"কেন? আর জ্বর জ্বর আসা, ঘেমে যাওয়া এগুলোও অভিনয়?"- অবাক হলেন মুশতাক মাসুদ।
"হুম।"
"আপনার এমনটা মনে হচ্ছে কেন?"
"পারফিউম।"
"মানে?"
"আপনার স্ত্রীর এমন আচরণের আগে যখন সে সামনে আসে, কোনোরকম পারফিউমের ব্যবহার করেছিল না সে। কিন্তু এমনটা করার পর যখন তাকে বাইরে নিয়ে যাচ্ছিলেন, বেশ তীব্র ঘ্রাণের একটা পারফিউমের গন্ধ পাচ্ছিলাম তার থেকে।"
"তো এটার সাথে অভিনয়ের সম্পর্ক কী?"
"আমি ধারণা করছি সে অভিনয় করছে, নিশ্চিত নই। যদি প্রশ্ন করেন যে সে ঘাম আনছে কীভাবে, তবে এটার সহজ ব্যাখ্যার আগে ঘাম হওয়ার কারণ বলি। ঘামের তৈরি হয় ঘামগ্রন্থি থেকে। আমাদের দেহে দুই ধরনের ঘামগ্রন্থি আছে। একটি হল একক্রাইন(eccrine) ঘামগ্রন্থি ও অপরটি হল অ্যাপেক্রাইন (apocrine) ঘামগ্রন্থি। একক্রাইন এর সংখ্যা অসংখ্য এবং এরা
আমাদের সারা শরীর জুড়ে বিস্তৃত। আমাদের মস্তিষ্কে হাইপােথ্যালামাস (hypothalamus) নামে একটি অংশ আছে যেটি আমাদের দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ও সঞ্চালনের কাজ দেখাশোনা করে। যখন আমাদের দেহের তাপমাত্রা বেড়ে যায় তখন এই হাইপোথ্যালামাস একক্রাইন ঘামগ্রন্থিকে সংকেত পাঠায় এবং এর ফলে আমাদের ঘাম নির্গত হয়। এবার সহজ ব্যাখাটি আপনি নিজেই দিন।"
"মানে সে নিজের দেহের তাপমাত্রাকে বৃদ্ধি করে তুলেছিল?"
"এক্সাক্টলি এটাই। বাইরে তাজা রোদ, দু'মিনিট দাঁড়ালেই ঘাম ঝরতে শুরু করবে। ঘাম আসাকে অলৌকিকভাবে নিবেন না অন্তত।"
"আর জ্বরের ব্যাপারে?"
"আপনি নিজেই বলেছিলেন জ্বর জ্বর ভাব আসে, জ্বর আসে বলেননি। রসূন কেঁটে বগলের নিচে রেখে রোদে একটু দৌঁড়াদৌঁড়ি করলেই ব্যাস, শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায় আর মনে হয় জ্বর জ্বর এসেছে৷ সম্ভবত আপনার স্ত্রী এমন কিছুই করেছে আর রসূনের গন্ধ যেন আপনার কিংবা আমার নাকে না আসে এজন্য পারফিউম ছড়িয়েছে।"
"কিন্তু ডক্টর, সে এমনটা কেন করতে যাবে?"
ড. জাওয়াদের ইচ্ছে হয় ঐ পাগলটার বলা কথাগুলো বলে দিক। কিন্তু সেগুলো থেকে ডক্টর নিজেও কোনো কারণ খুঁজে পাননি এমনটা করার। একবার ভেবেছিলেন, তার এমনটা করার উদ্দেশ্য হলো হাসপাতালের চাইল্ড হেলথ ইউনিটে যাওয়ার। যেন সে জানতে পারে কোনো বাচ্চার মৃত্যু হয়েছে কি না। কিন্তু এটাকে নিজেই ভঙ্গুর যুক্তি ধরে নিয়েছেন। তাছাড়া ঐ পাগলের বলা কথাগুলোও যে শতভাগ সত্য তেমনটা বিশ্বাস করছেন না তিনি।
প্রসঙ্গ পালটে বললেন, "আপনার স্টাডি রুমটা দেখালেন না যে?" মূলত স্টাডি রুম দেখতে চাওয়ার পর মুশতাকের মোচড়ামুচড়ি দেখে ডক্টরের স্পৃহা আরো বেড়ে যায়। মুশতাক কোনো উত্তর না দিয়ে তাকে স্টাডি রুমে নিয়ে গেলেন। অবাক হলেন যে, এতো বড় স্টাডি রুম কিন্তু বইয়ের সংখ্যা নগন্য। আরেকটা নজর কাড়ার মতো বিষয় হলো বইগুলোর পঁচানব্বই ভাগ-ই হিউম্যান ব্রেইনের উপর লেখা। বেশ কয়েকটির দিকে ভালোকরে লক্ষ্য করে দেখতে পান সেগুলোএ অধিকাংশই নতুন একদম, মনে হচ্ছে মলাটটিও খোলা হয়নি। পাঁচ-দশ মিনিট এদিক সেদিক চোখ ঘুরিয়ে বেরিয়ে আসলেন তিনি।
_____
দুপুরবেলায় এই লোকটার চা খেতে কেমন লাগছে কে জানে! মাঝে কোনো বিরতি না নিয়ে একের পর এক চুমুক দিয়ে পুরো কাপটি খালি করতে বড়জোর চল্লিশ সেকেন্ড লেগেছে। ড. জাওয়াদ এই পাগলটিকে কারণ ছাড়াই পছন্দ করে ফেলেছেন। হোটেলে অলস সময় কাটানোর থেকে এর সাথে থাকাকেই বেশি গুরুত্ব দেন তিনি। অবশ্য অন্য একটি কারণও আছে, শাদাব এই লোকটির সাথেই তার সবথেকে বেশি সময় কাটিয়েছে এখানে এসে। কে জানে হয়তো এর থেকেই শাদাবের খোঁজ পেয়ে যাবেন তিনি।
"আপনে তো ডাক্তার, তাই না?"- প্রশ্ন করলো সে।
"হুম। কেন?"
"তাইলে একটা কথা কন তো, সাপের বিষ খাইলে মানুষ মরে না ক্যান?"
"মরে না এটা আপনি কীভাবে জানলেন?'
"আমি দেখছি।"
"ও আচ্ছা৷ সাপ হলো বিষধর (venomous), বিষাক্ত (poisonous) নয়৷ ধরুন আপনি কোনো প্রাণিকে কামড়ালেন আর আপনিই মারা গেলেন, তাহলে প্রাণিটি বিষাক্ত। আর যদি কোনো প্রাণি আপনাকে কামড়ায় আর আপনি মারা যান, তবে সেটা বিষধর। সেক্ষেত্রে ইঁদুর মারা বিষ হলো Poison আর সাপের বিষ হলো Venom তাই ইঁদুর মারা বিষ খেলে মৃত্যুর সম্ভাবনা থাকে কিন্তু সাপের বিষ খেলে পেপসিন বা ট্রিপসিন(প্রোটিন হজমে সাহায্যকারী উৎসেচক) এটিকে রাসায়নিক ভাবে ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। এই রাসায়নিকটি শুধুমাত্র রক্তের সাথে মিশে গিয়েই বিষক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে তাই পেটে গেলে মানুষ মারা যায় না। কিন্তু কোনোভাবে যদি পাকস্থলীতে যাওয়ার পথে তা রক্তে মিশতে পারে, তবে মৃত্যু ঘটবে।"
লোকটি একটু উপরের দিকে তাকিয়ে মুখের দাড়িগুলো চুলকাতে লাগলো। সে কি আসলেই কিছু বুঝেছে কি না এই নিয়ে ঘোর সন্দেহ হয় ড. জাওয়াদের।
"আমার কেমন জানি লাগতাছে।"- লোকটি বললো
"কেমন লাগছে?"
"হেইয়া আমি ক্যামনে জানমু? আপনে ডাক্তার, আপনে কন।"
"আপনার কেমন লাগছে সেটা তো আপনিই ভালো বলতে পারবেন। অস্বস্তি, ক্ষুদা, রাগ নাকি অস্থিরতা কোনটা?"
"আমি ক্যামনে কমু?"
বেশ ঝামেলায় পড়ে গেলেন ড. জাওয়াদ। এ মূহুর্তে ভাবছেন এর সাথে তর্কে যাওয়া উচিত হবে না। তাকে অবাক করে দিয়ে পাগলটি বললো, "বুঝলেন ডাক্তার, দুইজন বুদ্ধির মানুষের কোনো বিষয় লইয়া তর্ক করতে নাই। তাইলে বিষয়টার আরও ঘোল পাকাইয়া যায়।"
"বুদ্ধির মানুষ মানে, বুদ্ধিমান?"
"হ অইটাই।"
"কেন? কোন দুইজন বুদ্ধিমানে তর্ক করছে?"
"এই যে আমি।"- নিজের দিকে ইঙ্গিত করে খিলখিলিয়ে হাসলো সে। ড. জাওয়াদও হেসে প্রশ্ন করলেন, "আর অন্যজন কে?"
"আপনে!"
"আমি যে বুদ্ধিমান এটা কে বললো আপনাকে?"
"মুশতাকের বাড়িত আইছেন না? হের বাড়ি বুদ্ধিমান মাইনষে ছাড়া কেউ আসে না।"
এবার ড. জাওয়াদের মুখ থেকে হাসির চিহ্ন হারিয়ে যায়। দ্রুত সেখান থেকে চলে আসেন হোটেলে। পাগল লোকটা তার হঠাৎ এভাবে চলে যাওয়ার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
_____
"শাদাব কোথায়?"- জোরগলায় প্রশ্ন করলেন ড. জাওয়াদ।
অবাক হওয়ার ভঙ্গিমায় মুশতাক উত্তর দেয়, "কোন শাদাব? শাদাব নামের কাউকে চিনি না আমি।"
"ভং ধরবেন না একদমই। আমাকে এখানে আনার জন্য অনেক নাটক সাজিয়েছেন আপনি।"
"আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কী বলতে চাইছেন আপনি।"- কপালের চামড়া কুঁচকিয়ে বললো মুশতাক।
"আপনি প্রথমে আমার ব্যক্তিগত নম্বরে ফোন করে এখানে আসার জন্য বলেন। কিন্তু জেনেশুনে মিথ্যা বলেছিলেন যে আমার নম্বর ফোনবুক থেকে পেয়েছেন। আর আপনি জানতেন আমার রোগীদের সাথে রাখা এপয়েন্টমেন্ট বাদ দিয়ে আপনার কথার সত্যতা যাচাই করতে আসবো না। অন্য কাউকে পাঠাবো এ ব্যাপারে খোঁজ নিতে, আর আমি শাদাবকে পাঠালাম। আপনার স্ত্রীকে দিয়ে সাজানো নাটকের মূল পরিচালক আপনি। যাতে শাদাব এসে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, আপনি ফোনে আমাকে সত্যি কথা-ই বলেছিলেন। আর সেজন্য এই নাটক সাজালেন।
ঠিক তেমনটাই হলো। তবে আপনি খুব চতুর মানুষ। শাদাবকে প্রথম দিনেই ধরে ফেললেন। তবে আমিই যে এখানে আসবো সে ব্যাপারে আপনি নিশ্চিত ছিলেন না। এরই মধ্যে ঐ পাগলের বলা কথাকে বাস্তবায়ন করতে বাচ্চাটির কবরের লাশ চুরি করলেন আর সেখানে গিয়ে শাদাব দেখতে পায় কবরে কোনো লাশ নেই। ব্যাস, আপনার স্ত্রীর বিপক্ষে অনেক সুন্দর একটি গল্প সাজানো হয়ে গেল।
এ ব্যাপারে শাদাব আমাকে জানানো পরে শাদাবকে অপহরণ করেন আপনি। আর আমি যখন তার বিপদের সন্দেহ করি, তখনই চলে আসি এখানে। আপনি জানতেন, আপনার ফেলানো দু'টো টোপের একটিকে আমি গিলবোই। আর তেমনটাই হলো, আমি চলে এলাম এখানে।"
"কিন্তু আপনাকে এখানে এনে আমার কী লাভ?"
"এর আগেও এনেছিলেন না কাউকে? আমার মস্তিষ্ক কি খুব জরুরি আপনার কাছে? মিস্টার সাইকো।"
মুশতাক এবার মাথা নিচু করে বাকা একটি হাসি ফুটিয়ে তোলে ঠোঁটের কোণায়। বললো, "তবে জেনে গিয়েছেন?"
"আগের ব্যক্তিগুলো কারা ছিলেন?"
"শাহাবুদ্দিন রাব্বি ও আরিফ জব্বার। আপনি তৃতীয়।"
"মানে এক বছর আগে নিখোঁজ হওয়া হোমিসাইড গোয়েন্দা শাহাবুদ্দিন রাব্বি আর ছয়মাস আগে নিখোঁজ হওয়া মেডিকেল শিক্ষক আরিফ জব্বারের কথা বলছেন আপনি?"
"এক্সাক্টলি৷ মাঝখানে এমন সময়ের গ্যাপ রাখি যাতে নিখোঁজের কেইসগুলো ধামাচাপা পড়ে যায়। কিন্তু আপনি আমার উপর সন্দেহ কখন আনলেন?"
"যখন আপনার স্টাডিরুমে এতোগুলো নতুন বই দেখি হিউম্যান ব্রেইনের উপরে। যেগুলো খুলে দেখেননি আপনি। পরবর্তীতে জানতে পারলাম আগেও আপনার বাড়িতে বুদ্ধিমান কেউ পা রেখেছিলেন। ব্যাস, বুঝতে পারলাম আপনার মানুষের ব্রেইনের উপর ঝোঁক আছে। আর তাও বুদ্ধিমান কারো ব্রেইন। আপনি চাইলে আমাকে আরও আগেই নিজের কব্জা করতে পারতেন কিন্তু আপনি যাচাই করছিলেন আমাকে। আপনি এমনই একজন সাইকো, যার নেশা হলো মানুষের ব্রেইনকে শরীর থেকে আলাদা করা।"
"শতভাগ সত্য।"
"শাদাব কোথায়?"
"কেন বলবো?"
"আমার ধারণা, তাকে এখনও জীবিত রেখেছেন আপনি। দেখুন মি. মাসুদ, আপনি আমার মস্তিষ্ক খুলে নিতে চান, শাদাবের নয়। আমি জানি আপনি তাকে আপনার পরিচয় গোপন করেই অপহরণ করেছেন, আর আপনার পরিচয় গোপন করেই তাকে ছেড়ে দিন। আপনার বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য একমাত্র আমিই থাকবো যে স্বয়ং আপনার শিকার হতে যাচ্ছে।"
"তার মানে আপনি আত্মসমর্পণ করছেন?"- আবারও বাকা হাসি তার ঠোঁটে।
"যদি শাদাবকে কোথায় রেখেছেন এটা বলেন তবেই। নাহয় আমার বাহুর শক্তি দেখতে পাবেন আপনি।"
শাদাবকে লুকিয়ে রাখার জায়গা বলে দেন মুশতাক। ড. জাওয়াদ পকেট থেকে মোবাইল বেরিয়ে কল করলেন কাউকে। মুশতাক এবার আক্রমণাত্মকভাবে উঠে আসতে গেলে ড. জাওয়াদ হাতের ইশারায় থামিয়ে বলেন, "ভয় পাওয়ার কিছু নেই। শুধুমাত্র শাদাবের ব্যাপারটাই বলবো।"
ওপাশে কাউকে শাদাবকে লুকিয়ে রাখার ঠিকানা দিয়ে ফোন রেখে দেন তিনি। বললেন, "আমাকে আরেকটু সময় দিন। যদি ওরা আমাকে কনফার্ম করে যে তারা শাদাবকে পেয়েছে তবেই ধরা দিচ্ছি আমি। নয়তো হাতাহাতি হবে, আর আপনিও ফেঁসে যাবেন।
প্রায় আধঘন্টা ধরে চেয়ারে এক পায়ের উপর অন্য পা ভাঁজ করে বসে আছেন ড. জাওয়াদ। মুশতাক চেয়ার ছেড়ে উঠে পায়চারি করছে। বললো সে, "এতোক্ষণ লাগার কথা নয়।"
পরবর্তী দু'মিনিটের মাথায় বেশ কয়েকজন পোশাক পরা লোক হাজির হলেন সেখানে, পুলিশ। চমকে উঠলেন মুশতাক মাসুদ। ড. জাওয়াদ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে বললেন, "এতো সহজে আমি আত্মসমর্পণ করছি এটাকে কীভাবে বিশ্বাস করে নিলেন মি. মাসুদ, দ্য সাইকো? আপনার বুঝা উচিত ছিল শাদাবের ঠিকানা জানতেই এমনটা করেছি আমি। ব্যাক-আপ আগে থেকেই রেডি করে রেখেছিলাম যেন আমি ফোন করে শাদাবের ঠিকানা বলার সাথে সাথেই তারা বুঝতে পারে মেইন কালপ্রিট আপনি। আর সেখান থেকে দ্রুত তাকে উদ্ধার করেই এখানে পৌঁছে যায় তারা।"
পরাজয়ের সুরে এবার মুশতাক মাসুদ বললেন, "তোমার ঐ ব্রেইনটাই সবথেকে বেশি দরকার ছিল আমার।"
ড. জাওয়াদ হাসলেন।
_____
শেষবারের মতো পাগলটির সাথে দেখা করলেন ড. জাওয়াদ, সাথে শাদাবও আছে। এই লোকটির কারণেই সে মুশতাককে ধরতে পেরেছে। যাওয়ার আগে তাকে বলে গেলেন, "শোনো কাশেম ভাই, যেখানে শয়তান বাস করে সেখানে আঁধার নামে না, যেখানে অনিয়ম চলে সেখানেই আঁধার নামে আর শয়তান সেখানেই আখড়া গড়ে তোলে।"
পাগল লোকটি চুপ করে তাদের চলে যাওয়ার দৃশ্য দেখছে।
সমাপ্ত
Sayan
Abul basar, Santa akter, Raihan khan, Tanusri roi, Badol hasan, Saiful Osman, Sumon khan and লেখাটি পছন্দ করেছে
Permissions in this forum:
You cannot reply to topics in this forum