- Trimatraধুমকেতু
- Posts : 23
স্বর্ণমুদ্রা : 1434
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-06-05
মৃত্যুচক্র
Sat Jun 05, 2021 8:22 pm
১ম পর্ব
টলতে টলতে বাথরুমের দিকে এগোচ্ছে রাফি। কাল রাতে প্রথমবারের মতো মদ্যপান করেছে। প্রেমিকাকে অন্য কারো সাথে অন্তরঙ্গ মুহুর্তে দেখা ভালো লাগার মতো কোনো বিষয় নয়। আর মেয়েটাও কী বোকা! পার্কের মধ্যে সবার সম্মুখেই ছেলেটা তার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে ছিল আর সে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো৷ এখনকার যুগে এসব আর কেউ তোয়াক্কা করে না। বিশেষ করে শহুরে এলাকাতে। যে যার মতো কাজ করছে, কারো দিকে তাকাবে এই সময়টুকু নষ্ট করার মতো সময়ও তাদের নেই। গ্রামে আবার পাশাপাশি দু'জন ছেলেমেয়ে হাটতে দেখলেও বিশেষ লুক দেওয়া হয়। পিচঢালা শহরের উপর এসব আর কেউ গুণে দেখতে যায় না। কিন্তু তাই বলে নিজের প্রেমিকও যে দেখবে না তেমনটা তো নয়।
প্রত্যেক প্রেমিকেরই নিজের প্রেয়সীর মতো দ্বিতীয় কোনো মেয়ে রাস্তায় কারো সাথে দেখলেও মনের মধ্যে হাতুড়ির বাড়ি পড়তে শুরু করে৷ পরক্ষণে যখন বুঝতে পারে যে সে তার প্রেমিকা না, অন্য কোনো মেয়ে তখন একবুক তৃপ্তির নিঃশ্বাস নিয়ে মনে মনে বলে, "যাক! সে নয়।"
এইতো গতকাল বিকালের ঘটনা, পার্কের মাঝে অন্য একটা ছেলের সাথে আড্ডা দিচ্ছে রাফির প্রেমিকা, সায়মা। হয়তো তার দ্বিতীয় বয়ফ্রেন্ড হবে। রাফির প্রতিক্রিয়া এমন ছিল যে, হাতে বন্দুক থাকলে তখনই দু'জনকেই মার্ডার করে ফেলতে পারতো। তবে রগচটা স্বভাবের হলেও সে প্রচণ্ড ভালোবাসে সায়মাকে। উচিত ছিল তখনই তাদের সম্মুখে গিয়ে কিছু একটা করা। কিন্তু সে কিছুই করেনি তখন। ক্ষোভ মেটানোর জন্য কয়েক বোতল মদ যোগাড় করে তা নিঃসঙ্গতার সঙ্গী বানায়।
_____
এখনও টলছে রাফি। সকালে উঠেই বমি করেছে একবার। আবারও পাক দিয়ে উঠছে পেটের মধ্যে৷ ফুল স্পিডে ফ্যান চলছে। তবুও যেন সারা শরীরে উত্তাপের ঝড় বয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে সমস্ত জামাকাপড় খুলে বাথটাবে নিজেকে চুবিয়ে রাখতে। রাতে কী ঘটেছিল মনে নেই তার। মদের নেশায় বুদ হয়ে গেলে যা হয় আর কি। দ্বিতীয়বারের মতো সামান্য বমি করে সে। কলিংবেল বাজছে, ঘন ঘন। ওদিকে তাকানোর সময় কোথায়?
বেসিনের সামনে এসে নিজের মুখে পানি ছিটাতে ছিটাতে একবার আয়নাতে প্রতিবিম্বটা দেখে।
এলোমেলো চুলগুলো ভিজে গিয়ে কপালে অবিন্যস্ত হয়ে পড়ে আছে। নিজেকে দেখে একটা মন্তব্যই লাগসই লাগে রাফির।
‘গাঞ্জুট্টি !’ বিড় বিড় করে বলে এগোয় টাওয়েলের দিকে।
কলিং বেল আবারও দুইবার পড়ল। পুরোনো আমলের ‘টিং টং’ শব্দটাকেই ভালো লাগে তার। ওটাই রেখেছে বেলের শব্দ হিসেবে। সেটা ঘন ঘন পড়লে মেজাজ খারাপ হওয়ার কথা এমনিতেই। এখানে প্রথমবারের মত হ্যাংওভারে পড়া রাফির মেজাজোমিটারের কাঁটা দ্রুত চড়ে যায়।
আরে ব্যাটা ফোন দিয়েছিস? অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছিস? অযথা মানুষের দরজাতে এসে বেলের ঝংকার, না?
ধীরে ধীরে ব্রাশ করে রাফি। বাইরে যেই শালার ব্যাটাই এসে থাকুক – দাঁড়িয়ে থাক ।
সবচেয়ে ভালো হয় চলে গেলে। হারামজাদা; ভোর দশটাতে এসে মানুষের দরজাতে টোকাটুকি?
আরও কয়েকটা গালি মনে মনে দিতে দিতে ব্রাশ করে যায় রাফি একমনে। এটাই সম্ভবতঃ ওর ধ্যান জ্ঞান এবং লক্ষ্য – এমনটা মনে হওয়াটা স্বাভাবিক।
কলিং বেল এবার বৃষ্টির মত পড়ছে। মাথা ধরিয়ে দেওয়া শব্দটা এমনিতেই মাথা ধরে থাকা রাফির খুলির ভেতর বাড়ি মারতে থাকে। মুখ ধুয়ে একটা ড্যাগার তুলে নিয়ে দরজার দিকে আগায় সে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হলেও শালাকে এখন খুন করে ফেলতে হবে। যাতে অন্য কারও বাসাতে সকাল-সকাল বিনা নোটিশে এসে এভাবে আর জ্বালাতে না পারে। মানবজাতির উপকার হবে একটা।
দরজা খুলতে যাবে, তখনও চলছে নিয়মিত কলিং বেলের শব্দ। ওপাশের মানুষটা মনে হয় সুইচটাকে ভেঙ্গেই ফেলবে ! গ্লাস দিয়ে তাকানোর প্রয়োজনও অনুভব করে না রাফি। হুট করে দরজা খুলে ফেলে। বাইরে সায়মার বান্ধবী তানহা দাঁড়িয়ে। মেয়েটা যথেষ্ট সুন্দরী আর ভদ্রও বটে। তাকে দেখেই রাফি পেছনে কোনমতে দ্রুত ড্যাগারটা লুকিয়ে ফেলতে পারে সময়মত।
"এতক্ষণ কোথায় ছিলে?" রাগত চোখে প্রশ্নটা করে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা। তানহার সুন্দর মুখটাতে এখন উৎকন্ঠা, অনিশ্চয়তা, বেদনা, বিভ্রান্তি আর তীব্র ক্রোধ।
নিশ্চয় কিছু হয়েছে। সিরিয়াস কিছু?
নিজেকে কোনোমতে সামলিয়ে ড্রয়িং রুমে তানহাকে বসিয়ে ড্যাগারটা রেখে আসে। এসেই দেখতে পায় তানহার চোখ ছলছল করছে। পাশের সোফাটাতে বসেই জিজ্ঞাসা করে কী হয়েছে। "সায়মা খুন হয়েছে।"-উত্তর তানহার। রাফি নিশ্চুপ হয়ে যায় মুহূর্তেই, চোখের পলকও নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। তানহা কথাটি বলে আর সামলাতে পারেনি নিজেকে। লোনা পানির বন্যা ঝরঝর করে তার ফর্সা গাল বেয়ে পড়তে থাকে।
দুইজন সুন্দরীর মাঝে বন্ধুত্ব হতে পারে না- এই প্রচলিত বিশ্বাসকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে স্কুল জীবন থেকে এই পর্যন্ত টিকে এসেছে সায়মা-তানহার ফ্রেন্ডশীপ। ওরা বান্ধবী ছিল না শুধু, ছিল দুই বোনের মত। সায়মার সাথে তখনও রিলেশনটা হয় নি রাফির। ভার্সিটির জনা পঞ্চাশেক ছেলে ঘুর ঘুর করত সায়মা-তানহার আশে পাশে।
বন্ধু আসিফকে একবার তখন প্রশ্ন করেছিল রাফি, "এরা আসলে কে কার পেছনে ঘোরে? সায়মার ? না তানহার ?"
আসিফ হেসে উত্তর দিয়েছিল, "মনে হয় দুইজনেরই ।"
রাফি সায়মার পেছনে ঘোরেনি। আর সেজন্যই হয়তো প্রকৃতির অমোঘ সমীকরণ মেনে সায়মা ঘুরেছে রাফির পেছনে। ভালোবাসার মানুষটাকে বেশিদিন দ্বিধাতে না রেখে রাফিও মনের কথা জানিয়ে দিয়েছিল।
_____
মেয়েটা এখনও কাঁদছে। প্রিয় বান্ধবীর মৃত্যু কতটা শকিং হতে পারে জানে রাফি। এখনও সে বুঝতে পারছে না হ্যাংওভার কি কেটেছে ওর? নাকি আরেক দফা ঘুমাচ্ছে ও? আর সেখানে দেখছে এই ভয়ংকর স্বপ্নটা? কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না যে সায়মা খুন হয়েছে।
"তুমি..." নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে জ্বলন্ত চোখে তাকায় তানহা, "...খুঁজে বের করবে কে করেছে এই কাজটা? তাকে নিজের হাতে খুন করব আমি! বোঝা গেছে?"- তানহার চোখ দুটো প্রতিহিংসাতে ধ্বক ধ্বক করে জ্বলছে। প্রাইভেট ডিটেক্টিভ বলে নিজের পরিচয় দেয় রাফি। মাত্র দুটো কেসে কাজ করেছে। সাফল্য এসেছে দুটোতেই।
তানহা সেদিকেই ইঙ্গিত করছে- বুঝতে পারে।
শক্ত মুখে তাকায় রাফি, "সে ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারো, তানহা।" সায়মার খুনীকে আমি পার পেতে দেব না। তবে তার খুনিকে তুমি বা আমি খুন করতে পারি না। আইনের বিচারে শাস্তি আমি নিশ্চিত করবই ওর।"
তানহা চেঁচিয়ে ওঠে এবার, "আই উইল কিল দ্যাট বাস্টার্ড! কোন পুলিশ-আদালত দেখবে না সে! খুন করব ওকে আমি!"
কিছু বলে না রাফি। মেয়েটা অনেক বেশি শক খেয়েছে। সে নিজেও খেয়েছে বৈকি। যতই তার সাথে ধোকাবাজি করুক, রাফি ভালোবাসে তাকে। রগচটা আর কঠোর স্বভাবের রাফি নিজেকে সামলাতে পারলেও তানহাকে স্থির হতে সময় দেওয়া উচিত।
চোখের পানিতে ভিজে আছে গাল৷ তার মাঝেও কোথা থেকে জানি আগুন পাচ্ছে মেয়েটা। চোখ জ্বলছে এখনও। অক্ষম ক্রোধে ফুঁসতে থাকা মেয়েটার দিকে তাকায় রাফি, কোমল গলাতে জানতে চায়, "ওর লাশ কোথায়?"
"মর্গে।"- চোখ মুছতে মুছতে উত্তর দেয় তানহা।
_____
ছেলেমানুষী হাসিতে ভরে থাকে ওসি সাদেক সাহেবের মুখটা সবসময়৷ এই মুহূর্তে তা মুছে গেছে। রাফির আপন মামা সম্পর্কে মানুষটা। আর এটাই অন্যতম প্রধান কারণ যে এই অল্প বয়েসেও সে মার্ডার কেস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে পেরেছে আগের দুই কেসে।
অন্য কেউ হলে পুলিশে ঘাড় ধরে বাসায় বসিয়ে দিত। একে তো সিভিলিয়ান মানুষ, তার ওপর একটা ইউনিভার্সিটির থার্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট; পুলিশী কেসে নাক গলাতে দেওয়ার কথা না। সাদেক সাহেব ভাগনের মাঝে সম্ভাবনা দেখেই তাকে সুযোগ দিয়েছেন৷ বিশ্বাসের মর্যাদা রেখেছে বটে রাফি।
চমক দেখিয়েছে আলোচিত ব্যবসায়ির হত্যার কেসে।
এবারের কেস অবশ্য আলোচিত কাওকে নিয়ে না। মারা গেছে রাফির গার্লফ্রেন্ড। পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে পেরে সদাহাস্যময় সাদেক সাহেবও চুপ মেরে গেছেন। রাফি এমন কারো কেস হাতে নিতে যাচ্ছে যে তার সাথেই প্রতারণা করেছিল। তবুও ভালোবাসার খাতিরে সব ভুলে যায় সে।
"তুমি কি হোমিসাইডকে আরেকবার কনভিনস করতে পার? লাশটিকে ভালো করে দেখবো একবার।"- দ্বিতীয়বারের মত প্রশ্নটা করে রাফি।
সায়মার ব্যাপারে সব বলে রাফি প্রথমে যখন এই প্রশ্নটা করেছিল তখনই চিন্তাতে ডুবে গেছিলেন সাদেক সাহেব। এজন্য দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করাই লাগে ওর।
মাথা ঝাঁকান সাদেক সাহেব, "তা করে দেব । ডিরেক্টর আমার বন্ধু মানুষ । তবে রাফি-"
রাফি উৎসুক দৃষ্টিতে তাকায় সাদেক সাহেবের দিকে।
"-কাজটাতে নামার আগে ভেবে দেখ তুমি প্রস্তুত কি না?"
শক্ত চোয়াল আরও শক্ত হয়ে যায় রাফির।
"আমি সব জেনে বুঝেই নেমেছি। আমাকে জাস্ট পারমিশনটা ম্যানেজ করে দাও; বাকিটা দেখছি আমি। সায়মার খুনীকে পার পেতে দেব ভেবেছ?"
"হোমিসাইডও কাজ করছে এ নিয়ে। ওদের টপ প্রায়োরিটি কেস এখন সায়মার কেসটা। ওরা সলভ করবেই। তুমি বাসায় ফিরে যাও। তানহাকে স্বান্তনা দেওয়ার জন্য পাশে কারও থাকা উচিত। মেয়েটা নিশ্চয় প্রচন্ড একটা ধাক্কা খেয়েছে।"
মাথা নাড়ে রাফি, "তানহাকে স্বাভাবিক করার একটাই উপায় খুনী কে সেটা বের করা। আমাকে ফেরানোর চেষ্টা না করে হোমিসাইডের সাথে যোগাযোগ কর। জানাও আমি আসছি।"
মাথা নাড়েন সাদেক সাহেব, উঠে দাঁড়িয়েছেন, "এই কেসে শুধু ফোন যথেষ্ট না। তোমাকে স্রেফ ভাগিয়ে দেবে ওরা। সাথে আমিও যাচ্ছি, চল।"
মামার দিকে একটা কৃতজ্ঞ দৃষ্টি দেয় রাফি। তারপর উঠে দাঁড়ায় নিজেও।
_____
হোমিসাইডের মর্গটা সাজানো গুছানো। বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর মত বিশৃঙখল অবস্থা হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টের কখনই ছিল না। অনেক চিন্তাভাবনা করে ডিপার্টমেন্টটা খোলা হয়েছে। প্রতিটি হেডকোয়ার্টার থেকে প্রতিটি ছোট কাজের পেছনেও কাজ করেছে সুনিপুণ পরিকল্পনা। সেজন্যই এখানে আসলে মনে হয় বাংলাদেশ না- পাশ্চাত্য উন্নত কোন দেশের কোন ডিপার্টমেন্টে চলে এসেছে সে।
চারপাশে তাকিয়ে দেখে রাফি। অনেকগুলো ড্রয়ার আছে দেওয়ালের দিকে। প্রতিটা একটি করে মরদেহ সংরক্ষণ করতে পারে। সাদেক সাহেব আগেই পারমিশনিটা এনে দিয়েই চলে গিয়েছেন। রুমের একমাত্র অপারেটিং টেবিলের ওপর শুয়ে আছে একটি মাত্র লাশ। বুক থেকে পা পর্যন্ত একটা সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা আছে সেটা। ঠান্ডা চোখে সায়মার মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকে রাফি। গলা কিছুটা ভারি হয়ে আসে। যতই প্রতারক হোক, রাফি তো ভালোবাসতো তাকে।
একপাশ থেকে মেডিকেল এক্সামিনার তোফায়েলের দীর্ঘশ্বাস শোনা যায়। লোকটাকে নিশ্চয় প্রতিদিনই লাশ নিয়ে ঘাঁটতে হয় ? হোমিসাইড ডিপার্টমেন্ট মানেই মার্ডার কেস। আর মার্ডার কেস মানেই মার্ডার। আর মার্ডার মানেই যে লাশের সমাহার – তা তো জানা কথা। কিন্তু তারপরেও তোফায়েলের মুখ থেকে দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসছে, সেটা বিস্ময়কর । লাশ কম দেখেনি সে। কিন্তু এতটা সৌন্দর্য্য নিয়ে এত অল্প বয়েসে এতটা নির্মম মৃত্যু সে আগে দেখেনি।
এক পা এগিয়ে আসে রাফি। টান দিয়ে কাপড়টা সরিয়ে নেয় সায়মার শরীর থেকে।
তারপর...
চলবে...
Sayhan Ahmed
টলতে টলতে বাথরুমের দিকে এগোচ্ছে রাফি। কাল রাতে প্রথমবারের মতো মদ্যপান করেছে। প্রেমিকাকে অন্য কারো সাথে অন্তরঙ্গ মুহুর্তে দেখা ভালো লাগার মতো কোনো বিষয় নয়। আর মেয়েটাও কী বোকা! পার্কের মধ্যে সবার সম্মুখেই ছেলেটা তার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে ছিল আর সে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো৷ এখনকার যুগে এসব আর কেউ তোয়াক্কা করে না। বিশেষ করে শহুরে এলাকাতে। যে যার মতো কাজ করছে, কারো দিকে তাকাবে এই সময়টুকু নষ্ট করার মতো সময়ও তাদের নেই। গ্রামে আবার পাশাপাশি দু'জন ছেলেমেয়ে হাটতে দেখলেও বিশেষ লুক দেওয়া হয়। পিচঢালা শহরের উপর এসব আর কেউ গুণে দেখতে যায় না। কিন্তু তাই বলে নিজের প্রেমিকও যে দেখবে না তেমনটা তো নয়।
প্রত্যেক প্রেমিকেরই নিজের প্রেয়সীর মতো দ্বিতীয় কোনো মেয়ে রাস্তায় কারো সাথে দেখলেও মনের মধ্যে হাতুড়ির বাড়ি পড়তে শুরু করে৷ পরক্ষণে যখন বুঝতে পারে যে সে তার প্রেমিকা না, অন্য কোনো মেয়ে তখন একবুক তৃপ্তির নিঃশ্বাস নিয়ে মনে মনে বলে, "যাক! সে নয়।"
এইতো গতকাল বিকালের ঘটনা, পার্কের মাঝে অন্য একটা ছেলের সাথে আড্ডা দিচ্ছে রাফির প্রেমিকা, সায়মা। হয়তো তার দ্বিতীয় বয়ফ্রেন্ড হবে। রাফির প্রতিক্রিয়া এমন ছিল যে, হাতে বন্দুক থাকলে তখনই দু'জনকেই মার্ডার করে ফেলতে পারতো। তবে রগচটা স্বভাবের হলেও সে প্রচণ্ড ভালোবাসে সায়মাকে। উচিত ছিল তখনই তাদের সম্মুখে গিয়ে কিছু একটা করা। কিন্তু সে কিছুই করেনি তখন। ক্ষোভ মেটানোর জন্য কয়েক বোতল মদ যোগাড় করে তা নিঃসঙ্গতার সঙ্গী বানায়।
_____
এখনও টলছে রাফি। সকালে উঠেই বমি করেছে একবার। আবারও পাক দিয়ে উঠছে পেটের মধ্যে৷ ফুল স্পিডে ফ্যান চলছে। তবুও যেন সারা শরীরে উত্তাপের ঝড় বয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে সমস্ত জামাকাপড় খুলে বাথটাবে নিজেকে চুবিয়ে রাখতে। রাতে কী ঘটেছিল মনে নেই তার। মদের নেশায় বুদ হয়ে গেলে যা হয় আর কি। দ্বিতীয়বারের মতো সামান্য বমি করে সে। কলিংবেল বাজছে, ঘন ঘন। ওদিকে তাকানোর সময় কোথায়?
বেসিনের সামনে এসে নিজের মুখে পানি ছিটাতে ছিটাতে একবার আয়নাতে প্রতিবিম্বটা দেখে।
এলোমেলো চুলগুলো ভিজে গিয়ে কপালে অবিন্যস্ত হয়ে পড়ে আছে। নিজেকে দেখে একটা মন্তব্যই লাগসই লাগে রাফির।
‘গাঞ্জুট্টি !’ বিড় বিড় করে বলে এগোয় টাওয়েলের দিকে।
কলিং বেল আবারও দুইবার পড়ল। পুরোনো আমলের ‘টিং টং’ শব্দটাকেই ভালো লাগে তার। ওটাই রেখেছে বেলের শব্দ হিসেবে। সেটা ঘন ঘন পড়লে মেজাজ খারাপ হওয়ার কথা এমনিতেই। এখানে প্রথমবারের মত হ্যাংওভারে পড়া রাফির মেজাজোমিটারের কাঁটা দ্রুত চড়ে যায়।
আরে ব্যাটা ফোন দিয়েছিস? অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছিস? অযথা মানুষের দরজাতে এসে বেলের ঝংকার, না?
ধীরে ধীরে ব্রাশ করে রাফি। বাইরে যেই শালার ব্যাটাই এসে থাকুক – দাঁড়িয়ে থাক ।
সবচেয়ে ভালো হয় চলে গেলে। হারামজাদা; ভোর দশটাতে এসে মানুষের দরজাতে টোকাটুকি?
আরও কয়েকটা গালি মনে মনে দিতে দিতে ব্রাশ করে যায় রাফি একমনে। এটাই সম্ভবতঃ ওর ধ্যান জ্ঞান এবং লক্ষ্য – এমনটা মনে হওয়াটা স্বাভাবিক।
কলিং বেল এবার বৃষ্টির মত পড়ছে। মাথা ধরিয়ে দেওয়া শব্দটা এমনিতেই মাথা ধরে থাকা রাফির খুলির ভেতর বাড়ি মারতে থাকে। মুখ ধুয়ে একটা ড্যাগার তুলে নিয়ে দরজার দিকে আগায় সে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হলেও শালাকে এখন খুন করে ফেলতে হবে। যাতে অন্য কারও বাসাতে সকাল-সকাল বিনা নোটিশে এসে এভাবে আর জ্বালাতে না পারে। মানবজাতির উপকার হবে একটা।
দরজা খুলতে যাবে, তখনও চলছে নিয়মিত কলিং বেলের শব্দ। ওপাশের মানুষটা মনে হয় সুইচটাকে ভেঙ্গেই ফেলবে ! গ্লাস দিয়ে তাকানোর প্রয়োজনও অনুভব করে না রাফি। হুট করে দরজা খুলে ফেলে। বাইরে সায়মার বান্ধবী তানহা দাঁড়িয়ে। মেয়েটা যথেষ্ট সুন্দরী আর ভদ্রও বটে। তাকে দেখেই রাফি পেছনে কোনমতে দ্রুত ড্যাগারটা লুকিয়ে ফেলতে পারে সময়মত।
"এতক্ষণ কোথায় ছিলে?" রাগত চোখে প্রশ্নটা করে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা। তানহার সুন্দর মুখটাতে এখন উৎকন্ঠা, অনিশ্চয়তা, বেদনা, বিভ্রান্তি আর তীব্র ক্রোধ।
নিশ্চয় কিছু হয়েছে। সিরিয়াস কিছু?
নিজেকে কোনোমতে সামলিয়ে ড্রয়িং রুমে তানহাকে বসিয়ে ড্যাগারটা রেখে আসে। এসেই দেখতে পায় তানহার চোখ ছলছল করছে। পাশের সোফাটাতে বসেই জিজ্ঞাসা করে কী হয়েছে। "সায়মা খুন হয়েছে।"-উত্তর তানহার। রাফি নিশ্চুপ হয়ে যায় মুহূর্তেই, চোখের পলকও নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। তানহা কথাটি বলে আর সামলাতে পারেনি নিজেকে। লোনা পানির বন্যা ঝরঝর করে তার ফর্সা গাল বেয়ে পড়তে থাকে।
দুইজন সুন্দরীর মাঝে বন্ধুত্ব হতে পারে না- এই প্রচলিত বিশ্বাসকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে স্কুল জীবন থেকে এই পর্যন্ত টিকে এসেছে সায়মা-তানহার ফ্রেন্ডশীপ। ওরা বান্ধবী ছিল না শুধু, ছিল দুই বোনের মত। সায়মার সাথে তখনও রিলেশনটা হয় নি রাফির। ভার্সিটির জনা পঞ্চাশেক ছেলে ঘুর ঘুর করত সায়মা-তানহার আশে পাশে।
বন্ধু আসিফকে একবার তখন প্রশ্ন করেছিল রাফি, "এরা আসলে কে কার পেছনে ঘোরে? সায়মার ? না তানহার ?"
আসিফ হেসে উত্তর দিয়েছিল, "মনে হয় দুইজনেরই ।"
রাফি সায়মার পেছনে ঘোরেনি। আর সেজন্যই হয়তো প্রকৃতির অমোঘ সমীকরণ মেনে সায়মা ঘুরেছে রাফির পেছনে। ভালোবাসার মানুষটাকে বেশিদিন দ্বিধাতে না রেখে রাফিও মনের কথা জানিয়ে দিয়েছিল।
_____
মেয়েটা এখনও কাঁদছে। প্রিয় বান্ধবীর মৃত্যু কতটা শকিং হতে পারে জানে রাফি। এখনও সে বুঝতে পারছে না হ্যাংওভার কি কেটেছে ওর? নাকি আরেক দফা ঘুমাচ্ছে ও? আর সেখানে দেখছে এই ভয়ংকর স্বপ্নটা? কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না যে সায়মা খুন হয়েছে।
"তুমি..." নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে জ্বলন্ত চোখে তাকায় তানহা, "...খুঁজে বের করবে কে করেছে এই কাজটা? তাকে নিজের হাতে খুন করব আমি! বোঝা গেছে?"- তানহার চোখ দুটো প্রতিহিংসাতে ধ্বক ধ্বক করে জ্বলছে। প্রাইভেট ডিটেক্টিভ বলে নিজের পরিচয় দেয় রাফি। মাত্র দুটো কেসে কাজ করেছে। সাফল্য এসেছে দুটোতেই।
তানহা সেদিকেই ইঙ্গিত করছে- বুঝতে পারে।
শক্ত মুখে তাকায় রাফি, "সে ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারো, তানহা।" সায়মার খুনীকে আমি পার পেতে দেব না। তবে তার খুনিকে তুমি বা আমি খুন করতে পারি না। আইনের বিচারে শাস্তি আমি নিশ্চিত করবই ওর।"
তানহা চেঁচিয়ে ওঠে এবার, "আই উইল কিল দ্যাট বাস্টার্ড! কোন পুলিশ-আদালত দেখবে না সে! খুন করব ওকে আমি!"
কিছু বলে না রাফি। মেয়েটা অনেক বেশি শক খেয়েছে। সে নিজেও খেয়েছে বৈকি। যতই তার সাথে ধোকাবাজি করুক, রাফি ভালোবাসে তাকে। রগচটা আর কঠোর স্বভাবের রাফি নিজেকে সামলাতে পারলেও তানহাকে স্থির হতে সময় দেওয়া উচিত।
চোখের পানিতে ভিজে আছে গাল৷ তার মাঝেও কোথা থেকে জানি আগুন পাচ্ছে মেয়েটা। চোখ জ্বলছে এখনও। অক্ষম ক্রোধে ফুঁসতে থাকা মেয়েটার দিকে তাকায় রাফি, কোমল গলাতে জানতে চায়, "ওর লাশ কোথায়?"
"মর্গে।"- চোখ মুছতে মুছতে উত্তর দেয় তানহা।
_____
ছেলেমানুষী হাসিতে ভরে থাকে ওসি সাদেক সাহেবের মুখটা সবসময়৷ এই মুহূর্তে তা মুছে গেছে। রাফির আপন মামা সম্পর্কে মানুষটা। আর এটাই অন্যতম প্রধান কারণ যে এই অল্প বয়েসেও সে মার্ডার কেস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে পেরেছে আগের দুই কেসে।
অন্য কেউ হলে পুলিশে ঘাড় ধরে বাসায় বসিয়ে দিত। একে তো সিভিলিয়ান মানুষ, তার ওপর একটা ইউনিভার্সিটির থার্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট; পুলিশী কেসে নাক গলাতে দেওয়ার কথা না। সাদেক সাহেব ভাগনের মাঝে সম্ভাবনা দেখেই তাকে সুযোগ দিয়েছেন৷ বিশ্বাসের মর্যাদা রেখেছে বটে রাফি।
চমক দেখিয়েছে আলোচিত ব্যবসায়ির হত্যার কেসে।
এবারের কেস অবশ্য আলোচিত কাওকে নিয়ে না। মারা গেছে রাফির গার্লফ্রেন্ড। পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে পেরে সদাহাস্যময় সাদেক সাহেবও চুপ মেরে গেছেন। রাফি এমন কারো কেস হাতে নিতে যাচ্ছে যে তার সাথেই প্রতারণা করেছিল। তবুও ভালোবাসার খাতিরে সব ভুলে যায় সে।
"তুমি কি হোমিসাইডকে আরেকবার কনভিনস করতে পার? লাশটিকে ভালো করে দেখবো একবার।"- দ্বিতীয়বারের মত প্রশ্নটা করে রাফি।
সায়মার ব্যাপারে সব বলে রাফি প্রথমে যখন এই প্রশ্নটা করেছিল তখনই চিন্তাতে ডুবে গেছিলেন সাদেক সাহেব। এজন্য দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করাই লাগে ওর।
মাথা ঝাঁকান সাদেক সাহেব, "তা করে দেব । ডিরেক্টর আমার বন্ধু মানুষ । তবে রাফি-"
রাফি উৎসুক দৃষ্টিতে তাকায় সাদেক সাহেবের দিকে।
"-কাজটাতে নামার আগে ভেবে দেখ তুমি প্রস্তুত কি না?"
শক্ত চোয়াল আরও শক্ত হয়ে যায় রাফির।
"আমি সব জেনে বুঝেই নেমেছি। আমাকে জাস্ট পারমিশনটা ম্যানেজ করে দাও; বাকিটা দেখছি আমি। সায়মার খুনীকে পার পেতে দেব ভেবেছ?"
"হোমিসাইডও কাজ করছে এ নিয়ে। ওদের টপ প্রায়োরিটি কেস এখন সায়মার কেসটা। ওরা সলভ করবেই। তুমি বাসায় ফিরে যাও। তানহাকে স্বান্তনা দেওয়ার জন্য পাশে কারও থাকা উচিত। মেয়েটা নিশ্চয় প্রচন্ড একটা ধাক্কা খেয়েছে।"
মাথা নাড়ে রাফি, "তানহাকে স্বাভাবিক করার একটাই উপায় খুনী কে সেটা বের করা। আমাকে ফেরানোর চেষ্টা না করে হোমিসাইডের সাথে যোগাযোগ কর। জানাও আমি আসছি।"
মাথা নাড়েন সাদেক সাহেব, উঠে দাঁড়িয়েছেন, "এই কেসে শুধু ফোন যথেষ্ট না। তোমাকে স্রেফ ভাগিয়ে দেবে ওরা। সাথে আমিও যাচ্ছি, চল।"
মামার দিকে একটা কৃতজ্ঞ দৃষ্টি দেয় রাফি। তারপর উঠে দাঁড়ায় নিজেও।
_____
হোমিসাইডের মর্গটা সাজানো গুছানো। বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর মত বিশৃঙখল অবস্থা হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টের কখনই ছিল না। অনেক চিন্তাভাবনা করে ডিপার্টমেন্টটা খোলা হয়েছে। প্রতিটি হেডকোয়ার্টার থেকে প্রতিটি ছোট কাজের পেছনেও কাজ করেছে সুনিপুণ পরিকল্পনা। সেজন্যই এখানে আসলে মনে হয় বাংলাদেশ না- পাশ্চাত্য উন্নত কোন দেশের কোন ডিপার্টমেন্টে চলে এসেছে সে।
চারপাশে তাকিয়ে দেখে রাফি। অনেকগুলো ড্রয়ার আছে দেওয়ালের দিকে। প্রতিটা একটি করে মরদেহ সংরক্ষণ করতে পারে। সাদেক সাহেব আগেই পারমিশনিটা এনে দিয়েই চলে গিয়েছেন। রুমের একমাত্র অপারেটিং টেবিলের ওপর শুয়ে আছে একটি মাত্র লাশ। বুক থেকে পা পর্যন্ত একটা সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা আছে সেটা। ঠান্ডা চোখে সায়মার মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকে রাফি। গলা কিছুটা ভারি হয়ে আসে। যতই প্রতারক হোক, রাফি তো ভালোবাসতো তাকে।
একপাশ থেকে মেডিকেল এক্সামিনার তোফায়েলের দীর্ঘশ্বাস শোনা যায়। লোকটাকে নিশ্চয় প্রতিদিনই লাশ নিয়ে ঘাঁটতে হয় ? হোমিসাইড ডিপার্টমেন্ট মানেই মার্ডার কেস। আর মার্ডার কেস মানেই মার্ডার। আর মার্ডার মানেই যে লাশের সমাহার – তা তো জানা কথা। কিন্তু তারপরেও তোফায়েলের মুখ থেকে দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসছে, সেটা বিস্ময়কর । লাশ কম দেখেনি সে। কিন্তু এতটা সৌন্দর্য্য নিয়ে এত অল্প বয়েসে এতটা নির্মম মৃত্যু সে আগে দেখেনি।
এক পা এগিয়ে আসে রাফি। টান দিয়ে কাপড়টা সরিয়ে নেয় সায়মার শরীর থেকে।
তারপর...
চলবে...
Sayhan Ahmed
Hasibul hasan santo, Abul basar, Santa akter, Sk sagor, Sk imran, Raihan khan, Tanusri roi and লেখাটি পছন্দ করেছে
- Trimatraধুমকেতু
- Posts : 23
স্বর্ণমুদ্রা : 1434
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-06-05
Re: মৃত্যুচক্র
Sat Jun 05, 2021 8:22 pm
২য় পর্ব
এক পা এগিয়ে আসে রাফি। টান দিয়ে কাপড়টা সরিয়ে নেয় সায়মার শরীর থেকে। তারপর নিজের অজান্তেই পিছিয়ে আসে দুই পা। সায়মার সারা শরীরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চোখ বোলায় রাফি।
বাম কাঁধের কাছে গভীর একটা ক্ষত। ক্ষতের আকৃতি দেখে মনে হচ্ছে না কোন ধরনের ছুরি ব্যবহার করা হয়েছে। ভোঁতা একটা অস্ত্রের সাহায্যে কাঁটা হয়েছে কাঁধটা। নাভির ডানপাশ থেকে শুরু করে কোমর পর্যন্ত ক্ষতচিহ্ন। তবে এটাও কোনো ছুরির সাহায্যে নয়, মনে হচ্ছে টেনে ছিঁড়ে ফেলেছে খুনি।
রাফির হাত কাঁপছে খুব। ভালোবাসার মানুষটার লাশ স্বচক্ষে দেখার মতো সহ্যশক্তি সবার হয় না। সায়মার লাশের দিকে তাকাতেই শিরশির করে উঠছে পিঠের ভেতর। চোখ দিয়ে ঝর্ণা বয়ে যেতে চাচ্ছে। কঠোর হৃদয়ের অধিকারী হওয়ায় জোর করে সামলে নেয় নিজেকে। যত্ন করে সায়মার দেহটা ঢেকে দিচ্ছিল ও। মুহূর্তেই প্রচণ্ড রাগে কপালের রগগুলো ফুলে ওঠে রাফির। তখনই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে নেয় সে।
সায়মার খুনীকে পুলিশ পাবে না; আদালতের মুখ দেখবে না ও। তার বিচার নিজ হাতে করবে রাফি, নিজের আদালতে।
_____
"সারাদিন ছিলি কোথায়? ক্যাম্পাসে আসতে পারতি।" একটু হেসে মাথা নাড়ে তন্ময়, রাফির সবথেকে কাছের বন্ধু।
কিছু না বলে প্রথমে একটা সিগারেট ধরায় রাফি; তারপর মুখ তোলে-
"ব্যস্ত ছিলাম। আর কিছু কথা ছিল তোর সাথে।"
"তো ক্যাম্পাসেই ডাকতি। পার্কে কেন?"
"ওখানে এসব নিয়ে আলোচনা করা যাবে না । বিষয়টা স্পর্শকাতর।"
পার্কের আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে হাসে এবার তন্ময়, "ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্টদের নিয়ে হয়েছে এই সমস্যা তোদের। এটুকু বুঝিস না যে আমাদের জন্য স্পর্শকাতর বলে কিছুই নেই। আমরাই স্পর্শ করি, যখন কেউ কাতর হয়। বুঝলি?"
বাঁকা চোখে তাকায় রাফি বন্ধুর দিকে। ছেলেটা মনে হচ্ছে আরেক বোতল ভদকা মেরেছে। বাপের টাকা আছে বটে। বেশ কিছুদিন হলো তার ব্রেক-আপ হয়েছে৷ তন্ময় অনেক চেষ্টা করেও আটকাতে পারেনি তার প্রেমিকাকে৷ সেদিনের পর তার সাথে আর কথা হয়নি ওর।
যত কথা তার হয়েছে গত রাতে, একটা ভদকার বোতলের সাথে৷ বেচারা নাকি তাকে অন্য ছেলের সাথে রিকশায় ঘুরতে দেখেছিল। ভদকার বোতলকে মাঝরাতে যখন জীবনের কাহিনী শোনাচ্ছিল তন্ময়, তখনই হাজির হয় রাফি। এক বোতল ভোদকা নিয়ে সোজা বাসায় চলে আসে ও। মদের নেশায় বুদ হয়ে থাকা তন্ময় তখন বুঝতে পারেনি বিষয়টা কী হয়েছিল। এজন্য আজ তাকে পার্কে ডেকে আনে রাফি।
বেচারা তন্ময়ের ছয় বছরের পুরাতন প্রেম যখন ব্যর্থতাতে ডুবে গেছে; সেখানে রাফির কষ্টটা তার থেকে বেশি নয়।
এই ব্যর্থ প্রেম নিয়ে অদ্ভুত রকমের একটা কৌতুক অনুভব করতো ও সবার প্রতি। এখন তন্ময়েরও তাই করার কথা। সেজন্য হাসির দমকে আকাশ এবং বাতাস কাঁপিয়ে হেসে হেসে চোখের পানি বের করে দিচ্ছে মানুষটা। তাকে দোষ দেয় না রাফি। তবে এখন ওর একজন ডাক্তারের সাথে ফ্র্যাংকলি কথা বলে দরকার। পরবর্তীতে সম্ভব হলে একজন মনরোগ বিশেষজ্ঞের সাথেও।
"দোস্ত, তোকে তো পুরাই পেরেশান লাগছে। মনে হয় ছ্যাঁকটা আমি না, তুই খাইছিস।"- মুচকি হেসে বলে তন্ময়।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সায়মার কথা বলতে শুরু করে রাফি। ছেলেটা কে ছিল জানে না। তবে এসব মাতালটাকে শুনিয়ে লাভ আছে কি না কে জানে?
সব বলতে বলতে আবারও তীব্র ক্রোধ অনুভব করে সে।
শেষে যোগ করে দেয়, "তোর কাছে আমার দরকার এখানেই। এখন বল কী করবো আমি?"
তন্ময়ের মুখটা দেখার মত হয়েছে এবার। কিছুক্ষণ ধ্যানে মগ্ন থেকে তারপর মুখ খোলে, "লাশের পাশে কিছু পেয়েছে পুলিশ?"
আরেকটা সিগারেট বের করে রাফি। আগেরটা থেকেই আগুন নিয়ে আগের ফিল্টারটুকু ফেলে দেয় মাটিতে।
"লাশের চারপাশে পুলিশ কোন অংশই পায়নি৷ তবে একটা কাগজ পেয়েছিল, ওখানে শুধুমাত্রই সায়মার নাম লেখা। মেয়েটার নাভির ডানপাশ থেকে কোমর অব্দি টেনে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। এমন কাজ নিশ্চয় কোনো মানুষ করবে না?"
হাত পেতে বসে আছে তন্ময়। নির্ঘাত একটা সিগারেট চাচ্ছে। ওর হাতে পুরো প্যাকেট তুলে দিতে ধীরে সুস্থে সিগারেট বের করে তন্ময়। তারপর কয়েকবার এদিক ওদিক ধোঁয়া ছেড়ে নিজেকে সুস্থির করার চেষ্টা করে। মাথার ভেতর ব্রেইনের চেয়ে বেশি কাজ করছে ভদকা !
বন্ধুর দিকে তাকায় তন্ময়, "করতেও পারে! বলা তো যায় না মানুষের রূপ কখন কীভাবে পাল্টে। এই যেমন তুই গত পরশু অব্দি ছিলি মজনু কাল বিকাল থেকে হয়ে গেলি ছ্যাঁকাখোর!" বলেই আবারও হাসিতে পার্ক কাঁপিয়ে তোলে সে।
রাফি এবার বিরক্তির চোখে তাকায় তার দিকে। এমন নেশাখোর বন্ধুর সাথে কথা বলে লাভ পাবে কি না জানে না। আসলেই মানুষ বদলে যায় পরিস্থিতির শিকারে, হয়তো বড় কোনো ধাক্কায়।
"আমি এখানে তোকে ডেকেছি সাহায্যের জন্য। কতটা জোরে হাসতে পারিস এটা দেখার জন্য নয়।"
আবারও হাত পাতে তন্ময়৷
রাফি চেঁচিয়ে ওঠে, "সিগারেটের প্যাকেটটাই তো দিয়ে দিলাম তোর হাতে। আবার কী?"
"ও, সরি। ভুলে গিয়েছিলাম।"- হাতে থাকা সিগারেটের প্যাকেটটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে তন্ময়। "ছেলেটিকে চিনিস?"
"কোন ছেলে?"
"তোর প্রেয়সীর সাথে গতকাল যাকে দেখেছিলি।"- আবারও সিগারেট জ্বালায় তন্ময়। নিজেকে চেইন স্মোকার হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে কি না কে জানে। একটা শেষ হলেই আরেকটার শুরু।
"না, আগেও কোনোদিন দেখিনি ছেলেটাকে।"
"তো আগে খুঁজে বের কর যে ছেলেটা কে।"- হাতে থাকা অর্ধপোড়া সিগারেটটি এবার ফেলে দেয় তন্ময়। পার্কের বেঞ্চে হেলান দিয়ে শেষবারের মতো ধোঁয়া ছাড়ে ও।
"কিভাবে?"-জিজ্ঞাসা করে রাফি।
"আমি কী জানি? এর থেকে ভালো হতো প্রথমেই এটা জিজ্ঞাসা করতি যে খুন কে করেছে!"-তন্ময়ের কণ্ঠ মুহূর্তেই বজ্ররূপ ধারণ করে। রাফি চুপ হয়ে যায়। তন্ময় রেগে উঠেছে বুঝতে পারে। কিছুক্ষণ নিরব থেকে তন্ময় আবারও বলতে শুরু করে, "ভালো হয় বাদ দিয়ে দে এই তদন্ত। কেন করছিস? আর কার জন্যই বা? আমি হলেই তো নিজেই খুন..."- থেমে যায় তন্ময়।
"থামলি কেন? বল বল। তুই হলে তো কী? নিজেই খুন করতি ওকে তাইতো? তোর প্রেমিকাও তো তোকে ধোঁকা দিয়েছে। এখন তাই বলে খুন করতে পারবি তুই তার?"
মাথা নুইয়ে ফেলে তন্ময়। উত্তর নেই তার কাছে। রাফি আবারও বলতে শুরু করে, "জানি এর কোনো উত্তর হয় না। নিজেও বুঝতে পারছিস যে এই তদন্ত আমি হাতে কেন নিয়েছি। পারলে সাহায্য করিস নতুবা দরকার নেই।"
উঠে দাঁড়ায় রাফি। সায়মার খুনিকে তার বের করতেই হবে- আপাতত এটাই তার ধ্যান, জ্ঞান ও পণ।
_____
সূর্যটা এখনও পশ্চিম আকাশে রক্তিম আলো ছড়াচ্ছে। রাফি রুমের মধ্যে পায়চারী করছে। ডান হাতের শক্ত মুষ্টি বারবার আঘাত করছে তার বাম হাতের তালুকে। এদিকে সায়মার খুন আর ওদিকে ঐ ছেলেটা, যার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো সায়মা। মাথায় একবার চিন্তার উঁকি দেয় যে ছেলেটা কে ছিল আবার অন্য মুহূর্তে ভাবে খুনের সাথে ছেলেটার কোনো সম্পর্ক আছে কি না। দু'য়ের মাঝে সমন্বয় সৃষ্টি করতে পারলে তার জন্যই সুবিধা হবে। আর যদি না হয়?
রাফির চোখে এখনো সায়মার লাশের ছবি ভাসছে। কী নৃশংসভাবে মেরেছে তাকে। মানুষ এতোটা জঘন্যতম ভাবে কাউকে মারতে পারে বলে তার মনে হয় না। লাশের পাশেও কোনো সূত্র পায়নি পুলিশ। শুধুমাত্র একটা রক্তমাখা কাগজ, আর তার উপরে সায়মার নাম বড় হরফে লেখা, ইংরেজিতে। এই মুহূর্তে কাকে সন্দেহ করবে সেটাও বুঝে উঠতে পারে না ও৷
মাথা ঝিম ধরে গেছে। এবার মনে হচ্ছে যে নেশা না করেও ঘোরে ডুবে আছে সে। নাকি গতরাতের প্রভাব, নাকি সায়মার মৃতদেহকে দেখার পর থেকে এই ঘোরের সূচনা- কিছুই বুঝতে পারে না ও। এক কাপ কফি বানিয়ে সোফায় বসতেই কলিংবেলের সেই পুরোনো টুংটাং শব্দ। ঘড়ির কাঁটায় ছ'টা ছুই ছুই। এখনই আজান হবে মাগরিবের। এই অসময়ে আবার কে এলো? কফির মগটা টেবিলে রেখে দরজা খুলে দিতেই তানহাকে দেখতে পায়। নাক-চোখ লাল হয়ে আছে মেয়েটার। হয়তো সারাদিন কান্না করেছে। ওকে বসিয়ে রেখে আরেক কাপ কফি বানিয়ে নিয়ে আসে রাফি।
"এই অবেলায় কেন?"- কফির মগে চুমুক দিয়ে সে জিজ্ঞাসা করে।
"বিকালে এসেছিলাম একবার, পাইনি। তাই এখন আবার এলাম।"-ভাঙ্গা গলায় উত্তর দেয় তানহা।
"ফোন করলেই পারতে।"
"সমস্যা নেই। আর তোমার প্রোগ্রেস কতদূর?"
"লাশটা দেখেছি শুধু। অন্য কোনো ক্লু পাইনি। পোস্টমর্টেম রিপোর্টের অপেক্ষা করছি।"
"আর তোমার নতুন গার্লফ্রেন্ডের?"- চোখের ভ্রু উঁচিয়ে মাথা বাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে তানহা।
রাফি দাঁড়িয়ে ওঠে সোফা ছেড়ে,"আমার নতুন গার্লফ্রেন্ড মানে?"
"কেন? যে রাতেই সায়মা খুন হলো ঐদিন বিকালেই তো সায়মা আর আমি তোমাকে নীল রঙের বাইকে করে একটা মেয়েকে নিয়ে যেতে দেখলাম। একদম শরীরের সাথে লেপ্টে ছিল সে।"
"মানে? আমি কখন কাকে বাইকের পিছনে নিয়ে ঘুরলাম? আর আমার বাইকের রং নিল নয় বরং কালো। আর ঐ বিকালে তো আমি তোমার বান্ধবীকে দেখলাম পার্কে কোনো এক ছেলেকে কোলে শুইয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো।"-উত্তেজিত কণ্ঠে উত্তর দেয় রাফি।
"আজেবাজে বকো না। ও সারা বিকাল সেদিন আমার সাথে ছিল।"-তানহাও চেঁচিয়ে ওঠে এবার।
"আমি নিজের চোখে দেখেছি সায়মা অন্য কোনো ছেলের সাথে পার্কে ছিল। আর তারপর সেখান থেকে সোজা তন্ময়ের কাছে গিয়ে এক বোতল ভোদকা নিয়ে বাসায় চলে আসি। এখনো ঝুড়িতে বোতলটা পড়ে আছে। চাইল দেখে নিতে পারো।"- বলেই ঝুড়িটার দিকে আঙুলের ইশারা দেয় সে।
উঁকি দিয়ে একবার দেখে তানহা, "হয়তো বিকালে মেয়েটার সাথে ঘুরে এসে রাতে খেয়েছ ওটা। আর সায়মা সেদিন পার্কেই যায়নি। বললাম না আমার সাথে ছিল সে? আর আমরাও স্বচক্ষে তোমাকে মেয়েটার সাথে দেখেছি।"
"আমি কেন শুধু শুধু মদ্যপান করতে যাব? আবারও বলছি তোমার ভুল হচ্ছে কোথাও।"-রাফির কপালের রগ ফুলে উঠেছে।
"একই সাথে দু'জন মানুষ ভুল কী করে দেখবে রাফি? আমারতো তোমাকেই সন্দেহ হচ্ছে। তোমার নতুন প্রেয়সীকে পাওয়ার জন্য তুমি নিজেই সায়মাকে এমন নৃশংসভাবে খুন করেছ...
চলবে...
Sayhan Ahmed
এক পা এগিয়ে আসে রাফি। টান দিয়ে কাপড়টা সরিয়ে নেয় সায়মার শরীর থেকে। তারপর নিজের অজান্তেই পিছিয়ে আসে দুই পা। সায়মার সারা শরীরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চোখ বোলায় রাফি।
বাম কাঁধের কাছে গভীর একটা ক্ষত। ক্ষতের আকৃতি দেখে মনে হচ্ছে না কোন ধরনের ছুরি ব্যবহার করা হয়েছে। ভোঁতা একটা অস্ত্রের সাহায্যে কাঁটা হয়েছে কাঁধটা। নাভির ডানপাশ থেকে শুরু করে কোমর পর্যন্ত ক্ষতচিহ্ন। তবে এটাও কোনো ছুরির সাহায্যে নয়, মনে হচ্ছে টেনে ছিঁড়ে ফেলেছে খুনি।
রাফির হাত কাঁপছে খুব। ভালোবাসার মানুষটার লাশ স্বচক্ষে দেখার মতো সহ্যশক্তি সবার হয় না। সায়মার লাশের দিকে তাকাতেই শিরশির করে উঠছে পিঠের ভেতর। চোখ দিয়ে ঝর্ণা বয়ে যেতে চাচ্ছে। কঠোর হৃদয়ের অধিকারী হওয়ায় জোর করে সামলে নেয় নিজেকে। যত্ন করে সায়মার দেহটা ঢেকে দিচ্ছিল ও। মুহূর্তেই প্রচণ্ড রাগে কপালের রগগুলো ফুলে ওঠে রাফির। তখনই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে নেয় সে।
সায়মার খুনীকে পুলিশ পাবে না; আদালতের মুখ দেখবে না ও। তার বিচার নিজ হাতে করবে রাফি, নিজের আদালতে।
_____
"সারাদিন ছিলি কোথায়? ক্যাম্পাসে আসতে পারতি।" একটু হেসে মাথা নাড়ে তন্ময়, রাফির সবথেকে কাছের বন্ধু।
কিছু না বলে প্রথমে একটা সিগারেট ধরায় রাফি; তারপর মুখ তোলে-
"ব্যস্ত ছিলাম। আর কিছু কথা ছিল তোর সাথে।"
"তো ক্যাম্পাসেই ডাকতি। পার্কে কেন?"
"ওখানে এসব নিয়ে আলোচনা করা যাবে না । বিষয়টা স্পর্শকাতর।"
পার্কের আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে হাসে এবার তন্ময়, "ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্টদের নিয়ে হয়েছে এই সমস্যা তোদের। এটুকু বুঝিস না যে আমাদের জন্য স্পর্শকাতর বলে কিছুই নেই। আমরাই স্পর্শ করি, যখন কেউ কাতর হয়। বুঝলি?"
বাঁকা চোখে তাকায় রাফি বন্ধুর দিকে। ছেলেটা মনে হচ্ছে আরেক বোতল ভদকা মেরেছে। বাপের টাকা আছে বটে। বেশ কিছুদিন হলো তার ব্রেক-আপ হয়েছে৷ তন্ময় অনেক চেষ্টা করেও আটকাতে পারেনি তার প্রেমিকাকে৷ সেদিনের পর তার সাথে আর কথা হয়নি ওর।
যত কথা তার হয়েছে গত রাতে, একটা ভদকার বোতলের সাথে৷ বেচারা নাকি তাকে অন্য ছেলের সাথে রিকশায় ঘুরতে দেখেছিল। ভদকার বোতলকে মাঝরাতে যখন জীবনের কাহিনী শোনাচ্ছিল তন্ময়, তখনই হাজির হয় রাফি। এক বোতল ভোদকা নিয়ে সোজা বাসায় চলে আসে ও। মদের নেশায় বুদ হয়ে থাকা তন্ময় তখন বুঝতে পারেনি বিষয়টা কী হয়েছিল। এজন্য আজ তাকে পার্কে ডেকে আনে রাফি।
বেচারা তন্ময়ের ছয় বছরের পুরাতন প্রেম যখন ব্যর্থতাতে ডুবে গেছে; সেখানে রাফির কষ্টটা তার থেকে বেশি নয়।
এই ব্যর্থ প্রেম নিয়ে অদ্ভুত রকমের একটা কৌতুক অনুভব করতো ও সবার প্রতি। এখন তন্ময়েরও তাই করার কথা। সেজন্য হাসির দমকে আকাশ এবং বাতাস কাঁপিয়ে হেসে হেসে চোখের পানি বের করে দিচ্ছে মানুষটা। তাকে দোষ দেয় না রাফি। তবে এখন ওর একজন ডাক্তারের সাথে ফ্র্যাংকলি কথা বলে দরকার। পরবর্তীতে সম্ভব হলে একজন মনরোগ বিশেষজ্ঞের সাথেও।
"দোস্ত, তোকে তো পুরাই পেরেশান লাগছে। মনে হয় ছ্যাঁকটা আমি না, তুই খাইছিস।"- মুচকি হেসে বলে তন্ময়।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সায়মার কথা বলতে শুরু করে রাফি। ছেলেটা কে ছিল জানে না। তবে এসব মাতালটাকে শুনিয়ে লাভ আছে কি না কে জানে?
সব বলতে বলতে আবারও তীব্র ক্রোধ অনুভব করে সে।
শেষে যোগ করে দেয়, "তোর কাছে আমার দরকার এখানেই। এখন বল কী করবো আমি?"
তন্ময়ের মুখটা দেখার মত হয়েছে এবার। কিছুক্ষণ ধ্যানে মগ্ন থেকে তারপর মুখ খোলে, "লাশের পাশে কিছু পেয়েছে পুলিশ?"
আরেকটা সিগারেট বের করে রাফি। আগেরটা থেকেই আগুন নিয়ে আগের ফিল্টারটুকু ফেলে দেয় মাটিতে।
"লাশের চারপাশে পুলিশ কোন অংশই পায়নি৷ তবে একটা কাগজ পেয়েছিল, ওখানে শুধুমাত্রই সায়মার নাম লেখা। মেয়েটার নাভির ডানপাশ থেকে কোমর অব্দি টেনে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। এমন কাজ নিশ্চয় কোনো মানুষ করবে না?"
হাত পেতে বসে আছে তন্ময়। নির্ঘাত একটা সিগারেট চাচ্ছে। ওর হাতে পুরো প্যাকেট তুলে দিতে ধীরে সুস্থে সিগারেট বের করে তন্ময়। তারপর কয়েকবার এদিক ওদিক ধোঁয়া ছেড়ে নিজেকে সুস্থির করার চেষ্টা করে। মাথার ভেতর ব্রেইনের চেয়ে বেশি কাজ করছে ভদকা !
বন্ধুর দিকে তাকায় তন্ময়, "করতেও পারে! বলা তো যায় না মানুষের রূপ কখন কীভাবে পাল্টে। এই যেমন তুই গত পরশু অব্দি ছিলি মজনু কাল বিকাল থেকে হয়ে গেলি ছ্যাঁকাখোর!" বলেই আবারও হাসিতে পার্ক কাঁপিয়ে তোলে সে।
রাফি এবার বিরক্তির চোখে তাকায় তার দিকে। এমন নেশাখোর বন্ধুর সাথে কথা বলে লাভ পাবে কি না জানে না। আসলেই মানুষ বদলে যায় পরিস্থিতির শিকারে, হয়তো বড় কোনো ধাক্কায়।
"আমি এখানে তোকে ডেকেছি সাহায্যের জন্য। কতটা জোরে হাসতে পারিস এটা দেখার জন্য নয়।"
আবারও হাত পাতে তন্ময়৷
রাফি চেঁচিয়ে ওঠে, "সিগারেটের প্যাকেটটাই তো দিয়ে দিলাম তোর হাতে। আবার কী?"
"ও, সরি। ভুলে গিয়েছিলাম।"- হাতে থাকা সিগারেটের প্যাকেটটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে তন্ময়। "ছেলেটিকে চিনিস?"
"কোন ছেলে?"
"তোর প্রেয়সীর সাথে গতকাল যাকে দেখেছিলি।"- আবারও সিগারেট জ্বালায় তন্ময়। নিজেকে চেইন স্মোকার হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে কি না কে জানে। একটা শেষ হলেই আরেকটার শুরু।
"না, আগেও কোনোদিন দেখিনি ছেলেটাকে।"
"তো আগে খুঁজে বের কর যে ছেলেটা কে।"- হাতে থাকা অর্ধপোড়া সিগারেটটি এবার ফেলে দেয় তন্ময়। পার্কের বেঞ্চে হেলান দিয়ে শেষবারের মতো ধোঁয়া ছাড়ে ও।
"কিভাবে?"-জিজ্ঞাসা করে রাফি।
"আমি কী জানি? এর থেকে ভালো হতো প্রথমেই এটা জিজ্ঞাসা করতি যে খুন কে করেছে!"-তন্ময়ের কণ্ঠ মুহূর্তেই বজ্ররূপ ধারণ করে। রাফি চুপ হয়ে যায়। তন্ময় রেগে উঠেছে বুঝতে পারে। কিছুক্ষণ নিরব থেকে তন্ময় আবারও বলতে শুরু করে, "ভালো হয় বাদ দিয়ে দে এই তদন্ত। কেন করছিস? আর কার জন্যই বা? আমি হলেই তো নিজেই খুন..."- থেমে যায় তন্ময়।
"থামলি কেন? বল বল। তুই হলে তো কী? নিজেই খুন করতি ওকে তাইতো? তোর প্রেমিকাও তো তোকে ধোঁকা দিয়েছে। এখন তাই বলে খুন করতে পারবি তুই তার?"
মাথা নুইয়ে ফেলে তন্ময়। উত্তর নেই তার কাছে। রাফি আবারও বলতে শুরু করে, "জানি এর কোনো উত্তর হয় না। নিজেও বুঝতে পারছিস যে এই তদন্ত আমি হাতে কেন নিয়েছি। পারলে সাহায্য করিস নতুবা দরকার নেই।"
উঠে দাঁড়ায় রাফি। সায়মার খুনিকে তার বের করতেই হবে- আপাতত এটাই তার ধ্যান, জ্ঞান ও পণ।
_____
সূর্যটা এখনও পশ্চিম আকাশে রক্তিম আলো ছড়াচ্ছে। রাফি রুমের মধ্যে পায়চারী করছে। ডান হাতের শক্ত মুষ্টি বারবার আঘাত করছে তার বাম হাতের তালুকে। এদিকে সায়মার খুন আর ওদিকে ঐ ছেলেটা, যার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো সায়মা। মাথায় একবার চিন্তার উঁকি দেয় যে ছেলেটা কে ছিল আবার অন্য মুহূর্তে ভাবে খুনের সাথে ছেলেটার কোনো সম্পর্ক আছে কি না। দু'য়ের মাঝে সমন্বয় সৃষ্টি করতে পারলে তার জন্যই সুবিধা হবে। আর যদি না হয়?
রাফির চোখে এখনো সায়মার লাশের ছবি ভাসছে। কী নৃশংসভাবে মেরেছে তাকে। মানুষ এতোটা জঘন্যতম ভাবে কাউকে মারতে পারে বলে তার মনে হয় না। লাশের পাশেও কোনো সূত্র পায়নি পুলিশ। শুধুমাত্র একটা রক্তমাখা কাগজ, আর তার উপরে সায়মার নাম বড় হরফে লেখা, ইংরেজিতে। এই মুহূর্তে কাকে সন্দেহ করবে সেটাও বুঝে উঠতে পারে না ও৷
মাথা ঝিম ধরে গেছে। এবার মনে হচ্ছে যে নেশা না করেও ঘোরে ডুবে আছে সে। নাকি গতরাতের প্রভাব, নাকি সায়মার মৃতদেহকে দেখার পর থেকে এই ঘোরের সূচনা- কিছুই বুঝতে পারে না ও। এক কাপ কফি বানিয়ে সোফায় বসতেই কলিংবেলের সেই পুরোনো টুংটাং শব্দ। ঘড়ির কাঁটায় ছ'টা ছুই ছুই। এখনই আজান হবে মাগরিবের। এই অসময়ে আবার কে এলো? কফির মগটা টেবিলে রেখে দরজা খুলে দিতেই তানহাকে দেখতে পায়। নাক-চোখ লাল হয়ে আছে মেয়েটার। হয়তো সারাদিন কান্না করেছে। ওকে বসিয়ে রেখে আরেক কাপ কফি বানিয়ে নিয়ে আসে রাফি।
"এই অবেলায় কেন?"- কফির মগে চুমুক দিয়ে সে জিজ্ঞাসা করে।
"বিকালে এসেছিলাম একবার, পাইনি। তাই এখন আবার এলাম।"-ভাঙ্গা গলায় উত্তর দেয় তানহা।
"ফোন করলেই পারতে।"
"সমস্যা নেই। আর তোমার প্রোগ্রেস কতদূর?"
"লাশটা দেখেছি শুধু। অন্য কোনো ক্লু পাইনি। পোস্টমর্টেম রিপোর্টের অপেক্ষা করছি।"
"আর তোমার নতুন গার্লফ্রেন্ডের?"- চোখের ভ্রু উঁচিয়ে মাথা বাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে তানহা।
রাফি দাঁড়িয়ে ওঠে সোফা ছেড়ে,"আমার নতুন গার্লফ্রেন্ড মানে?"
"কেন? যে রাতেই সায়মা খুন হলো ঐদিন বিকালেই তো সায়মা আর আমি তোমাকে নীল রঙের বাইকে করে একটা মেয়েকে নিয়ে যেতে দেখলাম। একদম শরীরের সাথে লেপ্টে ছিল সে।"
"মানে? আমি কখন কাকে বাইকের পিছনে নিয়ে ঘুরলাম? আর আমার বাইকের রং নিল নয় বরং কালো। আর ঐ বিকালে তো আমি তোমার বান্ধবীকে দেখলাম পার্কে কোনো এক ছেলেকে কোলে শুইয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো।"-উত্তেজিত কণ্ঠে উত্তর দেয় রাফি।
"আজেবাজে বকো না। ও সারা বিকাল সেদিন আমার সাথে ছিল।"-তানহাও চেঁচিয়ে ওঠে এবার।
"আমি নিজের চোখে দেখেছি সায়মা অন্য কোনো ছেলের সাথে পার্কে ছিল। আর তারপর সেখান থেকে সোজা তন্ময়ের কাছে গিয়ে এক বোতল ভোদকা নিয়ে বাসায় চলে আসি। এখনো ঝুড়িতে বোতলটা পড়ে আছে। চাইল দেখে নিতে পারো।"- বলেই ঝুড়িটার দিকে আঙুলের ইশারা দেয় সে।
উঁকি দিয়ে একবার দেখে তানহা, "হয়তো বিকালে মেয়েটার সাথে ঘুরে এসে রাতে খেয়েছ ওটা। আর সায়মা সেদিন পার্কেই যায়নি। বললাম না আমার সাথে ছিল সে? আর আমরাও স্বচক্ষে তোমাকে মেয়েটার সাথে দেখেছি।"
"আমি কেন শুধু শুধু মদ্যপান করতে যাব? আবারও বলছি তোমার ভুল হচ্ছে কোথাও।"-রাফির কপালের রগ ফুলে উঠেছে।
"একই সাথে দু'জন মানুষ ভুল কী করে দেখবে রাফি? আমারতো তোমাকেই সন্দেহ হচ্ছে। তোমার নতুন প্রেয়সীকে পাওয়ার জন্য তুমি নিজেই সায়মাকে এমন নৃশংসভাবে খুন করেছ...
চলবে...
Sayhan Ahmed
Hasibul hasan santo, Abul basar, Santa akter, Sk sagor, Sk imran, Raihan khan, Tanusri roi and লেখাটি পছন্দ করেছে
- Trimatraধুমকেতু
- Posts : 23
স্বর্ণমুদ্রা : 1434
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-06-05
Re: মৃত্যুচক্র
Sat Jun 05, 2021 8:23 pm
৩য় পর্ব
রাফির ইচ্ছা হয় সজোরে তানহার গালে একটা থাপ্পড় কষতে। মাঝখানে দূরত্ব না থাকলে এতক্ষণে হয়তো দিয়েও বসতো। যেখানে সে অল্পতেই রেগে আগুন হয়ে যায় আর সেখানে তার উপরেই নিজের প্রেমিকাকে হত্যার অভিযোগ তোলা হচ্ছে! রাগে ফুসলাতে থাকে সে। রাগলে রাফির কান দুটো দেখার মতো হয়, রক্তবর্ণ ধারণ করে।
মনে মনে তানহাকে খানিকক্ষণ গালাগাল দিয়ে নিজের কক্ষে চলে যায়। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে ও। মেয়েটা আগুন ধরিয়ে দিয়েছে মাথায়। রাগের মাত্রা বেশি হলে একজায়গায় স্থির হয়ে বসে থাকা যায় না। বেসিনে গিয়ে চোখেমুখে পানি ছিটায় সে। এসে দেখে তানহা সেখানেই আগের মতো বসে আছে। "এই মেয়েটা কি রাতে এখানেই থেকে যেতে চায় নাকি?"- ভ্রু কুঁচকে মনে মনে বলে রাফি। কথাও বলতে ইচ্ছা করছে না ওর সাথে। গালি দিলেও তা সহ্য করা যায়, কিন্তু অপবাদ? অসম্ভব।
রাত বেড়ে চলেছে। রাফি একা থাকে বাসায়। আর এভাবে সে অন্য কোনো মেয়েকে রাতের বেলা নিজের বাসায় থাকার জন্য জায়গা করে দিতে পারবে না। আবদ্ধ ঘরে শুধুমাত্র একজন ছেলে আর একজন মেয়ে থাকলে নাকি রাত বাড়ার সাথে সাথে পুরুষত্বও জেগে ওঠে; না চাইতেও- সেকথা অনেক শুনেছে রাফি। কিন্তু সে কখনও চায় না যে এমনটা হোক। সে নিজেও জানে যে সে এমনটা করবে না কিংবা করতে চায়বেও না তবুও সে এ ব্যাপারে নিজের উপর শতভাগ বিশ্বাস রাখতে পারছে না।
"বাসায় কখন যাবে? ঘড়ির কাঁটা কিন্তু থেমে নেই।"- বাধ্য হয়ে মুখ খোলে রাফি।
"যাব না।"- গম্ভীরভাবে উত্তর দেয় তানহা।
মানে টা কী? মগের মুল্লুক পেয়েছে নাকি এটা? নাকি তার নিজের বাড়ি যে যাব না বললেই হলো। আসলে কী চায় এই মেয়ে? নাকি মাথায় সমস্যা কোনো?
"কী আশ্চর্য! একটা ছেলের সাথে একা একটা বাড়িতে থাকবে এটা কেমন কথা? পাগল হয়ে গিয়েছ তুমি?"
"তবুও আমি ঐ বাড়িতে যাব না। আর এতো রাতে তো না-ই।"-এখনও গম্ভীরতার ঢল তার কন্ঠে।
"তাই বলে আমি তোমার সাথে থাকতে পারবো না।"-গলায় দৃঢ়তা ঢেলে বলে রাফি।
"ওটা একটা মৃত্যুপুরী। সায়মা খুন হয়েছে গতরাতে। আজ যদি আমার কিছু হয়ে যায়?"- তানহা ভীত কন্ঠে রাফির চোখের দিকে তাকায়৷ মেয়েটার চোখে পানি জ্বলজ্বল করছে। তবুও কোনো মেয়ের সাথে একই বাড়িতে রাত কাটানো সম্ভব নয়।
"তুমি আর সায়মা তো একই বাসায় থাকতে। অথচ কাল তার খুন হলো আর তুমি বুঝতেই পারলে না?"-রাফি আড়চোখে তাকায় এবার।
"আমি সেরাতে বাসায় ছিলাম না। আমার দূরসম্পর্কের এক দাদি মারা যাওয়াতে আমি সেখানেই যাচ্ছিলাম। সায়মা এগিয়ে দিতে যাচ্ছিল আমায়। আর তার মধ্যেই তোমাকে অন্য মেয়ের সাথে বাইকে দেখতে পাই। প্রচণ্ড আঘাত পায় সায়মা। ওকে রেখে যেতেও মন চাইছিল না আবার দাদির মৃত্যুতে না গিয়েও উপায় ছিল না।"-থেমে গিয়ে এক দীর্ঘশ্বাস নেয় সে। এরপর আবার বলতে শুরু করে- "আমাদের অন্য রুমমেট অবন্তীকে ফোন করে আসতে বলি। তাকে বলে দেই সায়মাকে সামলে রাখতে। আমি সকালেই রওনা হবো আবার। এরপর বাসায় চলে যায় ওরা।"
কিছুক্ষণ চুপ থাকে রাফি। এরপর ধপাস করে সোফায় বসে পড়ে সে- "কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব? আমি সেদিন বিকালে ওকে পার্কে দেখেছি, অন্য ছেলের সাথে। আর ঐ বিকালে কোনো মেয়ের সাথে ছিলাম না আমি।"
"আমি জানি না। কিছুই জানি না আমি। ওই বাড়িতে আমি আর যাব না, ব্যাস।"-তানহার কন্ঠস্বর কেঁপে ওঠে এবার।
"তুমি একটু আগেই না আমাকে সন্দেহ করলে? তাহলে কিলারের সাথে থাকতে ভয় হচ্ছে না এখন তোমার?"
"আমার ওই বাড়িটাকেই ভয় হচ্ছে। যে বাড়িতে কারো খুন হয়েছে সেখানে থাকবো কীভাবে আমি?" মেয়েটা বোধহয় এবার কান্না শুরু করে দেবে। তার সমস্যা বুঝে উঠতে পারে না রাফি। একটু আগেই যাকে খুনি সাব্যস্ত করছিল এখন আবার তার সাথেই থাকতে চায় সে! আশ্চর্য!
"অবন্তিও তো থাকে ওখানে। তবে ভয় কিসের?"-রাফি আবারও উঠে দাঁড়ায়।
"অবন্তি তো সেদিনও ছিল যেদিন সায়মার খুন হয়।"-বাম হাতের তালু দিয়ে প্রায় ভিজে যাওয়া চোখ দুটো মুছে নেয় তানহা। রাফি ভাবে, কথাটা ভাবিয়ে তোলে তাকে। সায়মা যদি অবন্তীর সাথেই থেকে থাকে তাহলে অবন্তীর অবশ্যই জানার কথা কী হয়েছিল সে রাতে। রাফি মনে মনে পুলকিত হয়ে ওঠে- তদন্তের সর্বপ্রথম সূত্র পেয়েছে সে।
"অবন্তী একা বাসায় আছে, তোমার কি উচিত নয় তার সাথে থাকা?"- রাফি আবারও প্রশ্ন করে তাকে।
"ও একা নেই। তোমার বাসায় ফিরতে দেরি হওয়ায় আমি ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিলাম যে আমি নাও যেতে পারি বাসায়। সে বলেছিল যে তাহলে সে একরাতের জন্য ওর এক আন্টির বাসায় থেকে যাবে, খুব বেশি দূরে নয়। আধা কিলোমিটারের দূরত্ব মাত্র।"
তানহা কোথায় থাকবে এ চিন্তা রাফির মাথা থেকে বেরিয়ে যায়। এখন সে ভাবছে গতরাতের ব্যাপারে, আর অবন্তীর।
"অবন্তীর আচরণে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করেছ?"
"অনেকটা। এক ধ্যানে কী যেন ভাবে সারাক্ষণ। আশেপাশে ঘটে চলা অন্য কিছুর দিকেই খেয়াল থাকে না।"-অনেকটা শান্তভাবে তানহা উত্তর দেয়।
চিন্তার ঢল নেমে আসে রাফির মাথায়। আপাতত ব্রেইনটাকে একটু বিশ্রাম দেওয়া দরকার। সকাল হতেই অবন্তীর সাথে কথা বলা দরকার। আপাতত রাতের খাবারটা সেরে নিতে চায় তারা। বিকেলে বুয়া গরুর মাংস রান্না করে দিয়ে গেছে।
_____
ভোর হতেই রাফির ঘুম ভাঙ্গে। একটু বেলা করেই ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস তার। তবে মনে তাড়া থাকলে নিজে থেকে খুব ভোরেও ওঠা সম্ভব। তানহার জন্য নিজের বেডরুম ছেড়ে পাশের রুমে ঘুমিয়েছিল সে। দরজায় ঠকঠক আওয়াজ করার কয়েক সেকেন্ড পরেই দরজা খুলে বেরিয়ে আসে তানহা। রাফি লক্ষ্য করে মেয়েটার চোখ লাল আর সামান্য ফুলে আছে। মনে হয় সারারাত জেগেই ছিল। কিছু জিজ্ঞাসা করে না সে। হতে পারে ও এখনও রাফিকেই সন্দেহ করছে আর সে ভয়েই ঘুমায়নি রাতে, কিংবা ঘুমাতে পারেনি।
কোনোমতে ফ্রেশ হয়ে সকালের নাস্তাটা চা আর বিস্কুট দিয়ে সেরে নেয়। এরপর দু'জনেই বেরিয়ে পড়ে একসাথে। অবন্তীর কাছে যাওয়াটা এখন প্রথম উদ্দেশ্য।
_____
কলিং বেল বাজাতেই অবন্তী এসে দরজা খুলে দেয়। "তাহলে মেয়েটা সকাল সকাল ফিরে এসেছে আন্টির বাসা থেকে।" দু'জনেই ভাবে। রাফি মেয়েটির দিকে লক্ষ্য করে। চোখেমুখে অদ্ভুত আতঙ্কের ছাপ। খুব ঘাবড়ে আছে মনে হয়।
"তুই না মাত্র বের হলি? আবারও ফিরে এলি কেন?"-তানহার দিকে প্রশ্ন ছোঁড়ে অবন্তী। রাফি আর তানহা একে অন্যের মুখের দিকে তাকায়। অবাক হয় প্রচণ্ড। কী বলে মেয়েটা? রাতে তো রাফির সাথেই ছিল সে।
কিছুটা সামলে তানহা প্রশ্ন করে, "আমি মাত্র বেরিয়ে গেলাম মানে? এইমাত্রই তো বাসায় আসলাম আমি।"
ফ্যাকাশে হয়ে যায় অবন্তীর চেহারা। "মানে তুই বলতে চাচ্ছিস রাতে তুই বাইরে কোথাও ছিলি?..."-কাঁপা গলায় অবন্তী প্রশ্ন করে,"...তাহলে আমার সাথে কে ছিল?"
রাফি কিংবা তানহা কিছু বলার আগেই অবন্তী জ্ঞান হারায়। গলা শুকিয়ে এসেছে দু'জনেরই। অবন্তীর পাশে তানহাকে রেখে তন্ময়কে ফোন দিয়ে পার্কে আসতে বলে রাফি।
_____
"রাতে তানহা তোর সাথেই ছিল? বাহ! খুব এনজয় করেছিস বোধহয়। একটা যেতে না যেতেই অন্যটা। পারিসও বটে ভাই।"-খেকখেক করে হেসে ওঠে তন্ময়।
"দেখ, আজেবাজে বকিস না। ছুঁইয়েও দেখিনি আমি ওকে।"-কিছুটা রেগে ওঠে রাফি।
"কেন রে ভাই? পুরুষত্ব লোপ পেয়েছে নাকি?"-আবারও হেসে ওঠে তন্ময়। রাফি এবার সজোরে থাপ্পড় কষে দেয় ওর মুখে। কানদুটো প্রচণ্ড লাল হয়ে গিয়েছে। তন্ময় মুখে হাত দিয়ে চুপ হয়ে যায়।
"পুরুষত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠাস, তাই না? আরে কোনো মেয়ের একাকিত্ব আর দূর্বলতাকে যদি কোনো পুরুষ সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে নেয় তবে তো কিছুদিন পর নিজের ভাই আর বাপের উপর থেকেও বিশ্বাস হারাবে মেয়েরা।"-ফোসলাতে ফোসলাতে বলে রাফি। তন্ময় কোনো কথা বলে না। ছেলেটা আগে এমন ছিল না। ব্রেকাপের পর থেকে নেশা করতে করতে মাথাটাই বিগড়ে গিয়েছে তার৷
তন্ময় ভুল বুঝতে পারে নিজের। রাফি শান্ত হয়ে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে দেয় ওকে।
"মানে তুই বলছিস যে তুই সেদিন বিকাল সায়মাকে অন্য ছেলের সাথে দেখেছিলি? আবার তানহা বলছে ওরা তোকে একই দিনে একই সময়ে অন্য মেয়ের সাথে দেখেছে?"
"হুম..."-গম্ভীরভাবে রাফি উত্তর দেয়, "... এখানেই শেষ হলে কথা ছিল। তবে কাল রাতে তানহা আমার বাসাতেই ছিল কিন্তু অবন্তী বলছে ও নাকি তার সাথে ছিল রাতে।"
"সিগারেট এনেছিস?"-তন্ময় প্রশ্ন করে।
"না। তোকে সিগারেট খাওয়ানোর জন্য ডাকিনি। বিষয়টার জন্য সাহায্য চাচ্ছি ভাই।"-একটু বিরক্ত হয় রাফি।
"আচ্ছা ব্যাপার না। দু'টো আছে আমার কাছে। তা দিয়েই কাজ সেরে নেওয়া যাবে।"-বলেই প্যাকেট থেকে একটা বের করে ধরিয়ে নেয়।
"শালা গাঞ্জুট্টি।"-রাফি মনে মনে গালি দেয় ওকে।
"ওই বিকালে তুই সায়মাকে অন্য কারো সাথে দেখে আমার থেকে ভোদকার বোতল মেরে দিস একটা। সে বিষয়টা যাক। তবে সায়মা যখন তোকে অন্য মেয়ের সাথে দেখেছিল তাহলে তো তোকে ফোন করার কথা ছিল ওর।"- উপরের দিকে মুখ করে ধোঁয়া ছাড়ে তন্ময়।
রাফি দ্রুত পকেট থেকে ফোন বের করে কল হিস্ট্রি চেক করে। পরশু রাতে সায়মার নম্বর থেকে বায়ান্ন বার কল এসেছিল। অথচ সে এখন বুঝতে পারে সেটা! তার মানে তানহা সত্যিই বলছিল। ঐ রাতে ভোদকার নেশায় বুদ হয়ে ছিল রাফি। বুঝতে পারেনি তখন। সেরাতে তার নেশা করা উচিত হয়নি মোটেই। সায়মার খুনের জন্য এবার নিজেকে দায়ী করে তোলে ও।
"প্যারালাল ইউনিভার্স সম্পর্কে জানিস কিছু?"- বলেই আরেকবার সিগারেটে টান দেয় তন্ময়।
"খুব বেশি নয়। এক গ্রহের ন্যায় অন্য গ্রহের অস্তিত্ব-এমন কিছু?"
"জ্যোতির্বিদ্যা মনে করে থাকে একই বিশ্বের মতো দেখতে আরও বিশ্ব আছে যেগুলো সমান্তরালভাবে চলে। আর সে বিশ্বে আমাদের মতোই অন্য কারো অস্তিত্ব আছে।"
রাফি নড়েচড়ে বসে এবার-"মানে বলতে চাচ্ছিস যে হুবহু আমাদের মতো দেখতে অন্য কেউ?"
"হুম।"-শেষবারের মতো সিগারেটটি টান দিয়ে ফিল্টারটি ছুঁড়ে মারে।
"কিন্তু যদি এই ধারণা সত্যিও হয়ে থাকে তাহলে অন্য জগৎ থেকে আমাদের মত দেখতে দ্বিতীয় কেউ এ জগতে আসবে কীভাবে?"-উৎসুক চাহনিতে প্রশ্ন করে রাফি।
"কিছু বিজ্ঞানীরা মনে করতেন মাঝে মাঝে দু'টো জগৎ একে অপরকে ক্রস করে ফেলে। ধরে নেওয়া হয় এই ক্রসিং এর ফলে সময়ের চাদরে একটা ছিদ্র হয়। আর এর মাধ্যমেই কেউ অন্য সমান্তরাল জগতে চলে যেতে পারে।"-প্যাকেট থেকে দ্বিতীয় ও শেষ সিগারেটটি বের করে নেয়।
"এসব গাঁজাখুরি চিন্তাভাবনা। প্রমাণ আছে কোনো?"
"জোরালোভাবে তেমন কোনো প্রমাণ নেই। শুধুমাত্র একটি ধারণা। তবে এটাও বলা হয়, সমান্তরাল জগতদ্বয় একে অন্যকে ক্রস করার সময় অল্ট্রা ভার্স ঘটে।"
"অল্ট্রা ভার্স?"
"তোর কি কখনও এমনটা মনে হয়েছে যে, তুই কোনো কাজ করছিস বা দেখছিস কিন্তু এমনটা মনে হয় যে সেটা আগেও ঘটেছে কিংবা দৃশ্যটা তোর পরিচিত?"
"হুম। হয়েছে কয়েকবার। তবে এতে প্যারালাল ইউনিভার্সের অস্তিত্ব প্রমাণ হয় না।"
"আমিও বলছি না যে এটা শতভাগ বাস্তব। কিছু বিজ্ঞানীর ধারণা মাত্র।"
"মানে এখন তুই এটা বলতে চাচ্ছিস যে এই সামন্তরিক জগৎ থেকেই আমাদের মতো দেখতে কেউ পৃথিবীতে এসেছে?"
"হতেও পারে।"
রাফি থেমে যায়। মাথাটা আবারও ঝিম ধরে গেছে। এ রহস্য পরে উন্মোচন করা যাবে। আগে জানতে হবে সে রাতে কী হয়েছিল- যার উত্তর একমাত্র অবন্তীর কাছেই। মেয়েটা খুব বেশি শঙ্কিত হয়ে আছে। এতোটা আতঙ্কিত হতে সে কখনও দেখেনি কাউকে। একটা কল করার দরকার তানহাকে, অবন্তীর জ্ঞান ফিরেছে কি না জানাটা অতীব জরুরি..
চলবে...
Sayhan Ahmed
রাফির ইচ্ছা হয় সজোরে তানহার গালে একটা থাপ্পড় কষতে। মাঝখানে দূরত্ব না থাকলে এতক্ষণে হয়তো দিয়েও বসতো। যেখানে সে অল্পতেই রেগে আগুন হয়ে যায় আর সেখানে তার উপরেই নিজের প্রেমিকাকে হত্যার অভিযোগ তোলা হচ্ছে! রাগে ফুসলাতে থাকে সে। রাগলে রাফির কান দুটো দেখার মতো হয়, রক্তবর্ণ ধারণ করে।
মনে মনে তানহাকে খানিকক্ষণ গালাগাল দিয়ে নিজের কক্ষে চলে যায়। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে ও। মেয়েটা আগুন ধরিয়ে দিয়েছে মাথায়। রাগের মাত্রা বেশি হলে একজায়গায় স্থির হয়ে বসে থাকা যায় না। বেসিনে গিয়ে চোখেমুখে পানি ছিটায় সে। এসে দেখে তানহা সেখানেই আগের মতো বসে আছে। "এই মেয়েটা কি রাতে এখানেই থেকে যেতে চায় নাকি?"- ভ্রু কুঁচকে মনে মনে বলে রাফি। কথাও বলতে ইচ্ছা করছে না ওর সাথে। গালি দিলেও তা সহ্য করা যায়, কিন্তু অপবাদ? অসম্ভব।
রাত বেড়ে চলেছে। রাফি একা থাকে বাসায়। আর এভাবে সে অন্য কোনো মেয়েকে রাতের বেলা নিজের বাসায় থাকার জন্য জায়গা করে দিতে পারবে না। আবদ্ধ ঘরে শুধুমাত্র একজন ছেলে আর একজন মেয়ে থাকলে নাকি রাত বাড়ার সাথে সাথে পুরুষত্বও জেগে ওঠে; না চাইতেও- সেকথা অনেক শুনেছে রাফি। কিন্তু সে কখনও চায় না যে এমনটা হোক। সে নিজেও জানে যে সে এমনটা করবে না কিংবা করতে চায়বেও না তবুও সে এ ব্যাপারে নিজের উপর শতভাগ বিশ্বাস রাখতে পারছে না।
"বাসায় কখন যাবে? ঘড়ির কাঁটা কিন্তু থেমে নেই।"- বাধ্য হয়ে মুখ খোলে রাফি।
"যাব না।"- গম্ভীরভাবে উত্তর দেয় তানহা।
মানে টা কী? মগের মুল্লুক পেয়েছে নাকি এটা? নাকি তার নিজের বাড়ি যে যাব না বললেই হলো। আসলে কী চায় এই মেয়ে? নাকি মাথায় সমস্যা কোনো?
"কী আশ্চর্য! একটা ছেলের সাথে একা একটা বাড়িতে থাকবে এটা কেমন কথা? পাগল হয়ে গিয়েছ তুমি?"
"তবুও আমি ঐ বাড়িতে যাব না। আর এতো রাতে তো না-ই।"-এখনও গম্ভীরতার ঢল তার কন্ঠে।
"তাই বলে আমি তোমার সাথে থাকতে পারবো না।"-গলায় দৃঢ়তা ঢেলে বলে রাফি।
"ওটা একটা মৃত্যুপুরী। সায়মা খুন হয়েছে গতরাতে। আজ যদি আমার কিছু হয়ে যায়?"- তানহা ভীত কন্ঠে রাফির চোখের দিকে তাকায়৷ মেয়েটার চোখে পানি জ্বলজ্বল করছে। তবুও কোনো মেয়ের সাথে একই বাড়িতে রাত কাটানো সম্ভব নয়।
"তুমি আর সায়মা তো একই বাসায় থাকতে। অথচ কাল তার খুন হলো আর তুমি বুঝতেই পারলে না?"-রাফি আড়চোখে তাকায় এবার।
"আমি সেরাতে বাসায় ছিলাম না। আমার দূরসম্পর্কের এক দাদি মারা যাওয়াতে আমি সেখানেই যাচ্ছিলাম। সায়মা এগিয়ে দিতে যাচ্ছিল আমায়। আর তার মধ্যেই তোমাকে অন্য মেয়ের সাথে বাইকে দেখতে পাই। প্রচণ্ড আঘাত পায় সায়মা। ওকে রেখে যেতেও মন চাইছিল না আবার দাদির মৃত্যুতে না গিয়েও উপায় ছিল না।"-থেমে গিয়ে এক দীর্ঘশ্বাস নেয় সে। এরপর আবার বলতে শুরু করে- "আমাদের অন্য রুমমেট অবন্তীকে ফোন করে আসতে বলি। তাকে বলে দেই সায়মাকে সামলে রাখতে। আমি সকালেই রওনা হবো আবার। এরপর বাসায় চলে যায় ওরা।"
কিছুক্ষণ চুপ থাকে রাফি। এরপর ধপাস করে সোফায় বসে পড়ে সে- "কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব? আমি সেদিন বিকালে ওকে পার্কে দেখেছি, অন্য ছেলের সাথে। আর ঐ বিকালে কোনো মেয়ের সাথে ছিলাম না আমি।"
"আমি জানি না। কিছুই জানি না আমি। ওই বাড়িতে আমি আর যাব না, ব্যাস।"-তানহার কন্ঠস্বর কেঁপে ওঠে এবার।
"তুমি একটু আগেই না আমাকে সন্দেহ করলে? তাহলে কিলারের সাথে থাকতে ভয় হচ্ছে না এখন তোমার?"
"আমার ওই বাড়িটাকেই ভয় হচ্ছে। যে বাড়িতে কারো খুন হয়েছে সেখানে থাকবো কীভাবে আমি?" মেয়েটা বোধহয় এবার কান্না শুরু করে দেবে। তার সমস্যা বুঝে উঠতে পারে না রাফি। একটু আগেই যাকে খুনি সাব্যস্ত করছিল এখন আবার তার সাথেই থাকতে চায় সে! আশ্চর্য!
"অবন্তিও তো থাকে ওখানে। তবে ভয় কিসের?"-রাফি আবারও উঠে দাঁড়ায়।
"অবন্তি তো সেদিনও ছিল যেদিন সায়মার খুন হয়।"-বাম হাতের তালু দিয়ে প্রায় ভিজে যাওয়া চোখ দুটো মুছে নেয় তানহা। রাফি ভাবে, কথাটা ভাবিয়ে তোলে তাকে। সায়মা যদি অবন্তীর সাথেই থেকে থাকে তাহলে অবন্তীর অবশ্যই জানার কথা কী হয়েছিল সে রাতে। রাফি মনে মনে পুলকিত হয়ে ওঠে- তদন্তের সর্বপ্রথম সূত্র পেয়েছে সে।
"অবন্তী একা বাসায় আছে, তোমার কি উচিত নয় তার সাথে থাকা?"- রাফি আবারও প্রশ্ন করে তাকে।
"ও একা নেই। তোমার বাসায় ফিরতে দেরি হওয়ায় আমি ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিলাম যে আমি নাও যেতে পারি বাসায়। সে বলেছিল যে তাহলে সে একরাতের জন্য ওর এক আন্টির বাসায় থেকে যাবে, খুব বেশি দূরে নয়। আধা কিলোমিটারের দূরত্ব মাত্র।"
তানহা কোথায় থাকবে এ চিন্তা রাফির মাথা থেকে বেরিয়ে যায়। এখন সে ভাবছে গতরাতের ব্যাপারে, আর অবন্তীর।
"অবন্তীর আচরণে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করেছ?"
"অনেকটা। এক ধ্যানে কী যেন ভাবে সারাক্ষণ। আশেপাশে ঘটে চলা অন্য কিছুর দিকেই খেয়াল থাকে না।"-অনেকটা শান্তভাবে তানহা উত্তর দেয়।
চিন্তার ঢল নেমে আসে রাফির মাথায়। আপাতত ব্রেইনটাকে একটু বিশ্রাম দেওয়া দরকার। সকাল হতেই অবন্তীর সাথে কথা বলা দরকার। আপাতত রাতের খাবারটা সেরে নিতে চায় তারা। বিকেলে বুয়া গরুর মাংস রান্না করে দিয়ে গেছে।
_____
ভোর হতেই রাফির ঘুম ভাঙ্গে। একটু বেলা করেই ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস তার। তবে মনে তাড়া থাকলে নিজে থেকে খুব ভোরেও ওঠা সম্ভব। তানহার জন্য নিজের বেডরুম ছেড়ে পাশের রুমে ঘুমিয়েছিল সে। দরজায় ঠকঠক আওয়াজ করার কয়েক সেকেন্ড পরেই দরজা খুলে বেরিয়ে আসে তানহা। রাফি লক্ষ্য করে মেয়েটার চোখ লাল আর সামান্য ফুলে আছে। মনে হয় সারারাত জেগেই ছিল। কিছু জিজ্ঞাসা করে না সে। হতে পারে ও এখনও রাফিকেই সন্দেহ করছে আর সে ভয়েই ঘুমায়নি রাতে, কিংবা ঘুমাতে পারেনি।
কোনোমতে ফ্রেশ হয়ে সকালের নাস্তাটা চা আর বিস্কুট দিয়ে সেরে নেয়। এরপর দু'জনেই বেরিয়ে পড়ে একসাথে। অবন্তীর কাছে যাওয়াটা এখন প্রথম উদ্দেশ্য।
_____
কলিং বেল বাজাতেই অবন্তী এসে দরজা খুলে দেয়। "তাহলে মেয়েটা সকাল সকাল ফিরে এসেছে আন্টির বাসা থেকে।" দু'জনেই ভাবে। রাফি মেয়েটির দিকে লক্ষ্য করে। চোখেমুখে অদ্ভুত আতঙ্কের ছাপ। খুব ঘাবড়ে আছে মনে হয়।
"তুই না মাত্র বের হলি? আবারও ফিরে এলি কেন?"-তানহার দিকে প্রশ্ন ছোঁড়ে অবন্তী। রাফি আর তানহা একে অন্যের মুখের দিকে তাকায়। অবাক হয় প্রচণ্ড। কী বলে মেয়েটা? রাতে তো রাফির সাথেই ছিল সে।
কিছুটা সামলে তানহা প্রশ্ন করে, "আমি মাত্র বেরিয়ে গেলাম মানে? এইমাত্রই তো বাসায় আসলাম আমি।"
ফ্যাকাশে হয়ে যায় অবন্তীর চেহারা। "মানে তুই বলতে চাচ্ছিস রাতে তুই বাইরে কোথাও ছিলি?..."-কাঁপা গলায় অবন্তী প্রশ্ন করে,"...তাহলে আমার সাথে কে ছিল?"
রাফি কিংবা তানহা কিছু বলার আগেই অবন্তী জ্ঞান হারায়। গলা শুকিয়ে এসেছে দু'জনেরই। অবন্তীর পাশে তানহাকে রেখে তন্ময়কে ফোন দিয়ে পার্কে আসতে বলে রাফি।
_____
"রাতে তানহা তোর সাথেই ছিল? বাহ! খুব এনজয় করেছিস বোধহয়। একটা যেতে না যেতেই অন্যটা। পারিসও বটে ভাই।"-খেকখেক করে হেসে ওঠে তন্ময়।
"দেখ, আজেবাজে বকিস না। ছুঁইয়েও দেখিনি আমি ওকে।"-কিছুটা রেগে ওঠে রাফি।
"কেন রে ভাই? পুরুষত্ব লোপ পেয়েছে নাকি?"-আবারও হেসে ওঠে তন্ময়। রাফি এবার সজোরে থাপ্পড় কষে দেয় ওর মুখে। কানদুটো প্রচণ্ড লাল হয়ে গিয়েছে। তন্ময় মুখে হাত দিয়ে চুপ হয়ে যায়।
"পুরুষত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠাস, তাই না? আরে কোনো মেয়ের একাকিত্ব আর দূর্বলতাকে যদি কোনো পুরুষ সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে নেয় তবে তো কিছুদিন পর নিজের ভাই আর বাপের উপর থেকেও বিশ্বাস হারাবে মেয়েরা।"-ফোসলাতে ফোসলাতে বলে রাফি। তন্ময় কোনো কথা বলে না। ছেলেটা আগে এমন ছিল না। ব্রেকাপের পর থেকে নেশা করতে করতে মাথাটাই বিগড়ে গিয়েছে তার৷
তন্ময় ভুল বুঝতে পারে নিজের। রাফি শান্ত হয়ে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে দেয় ওকে।
"মানে তুই বলছিস যে তুই সেদিন বিকাল সায়মাকে অন্য ছেলের সাথে দেখেছিলি? আবার তানহা বলছে ওরা তোকে একই দিনে একই সময়ে অন্য মেয়ের সাথে দেখেছে?"
"হুম..."-গম্ভীরভাবে রাফি উত্তর দেয়, "... এখানেই শেষ হলে কথা ছিল। তবে কাল রাতে তানহা আমার বাসাতেই ছিল কিন্তু অবন্তী বলছে ও নাকি তার সাথে ছিল রাতে।"
"সিগারেট এনেছিস?"-তন্ময় প্রশ্ন করে।
"না। তোকে সিগারেট খাওয়ানোর জন্য ডাকিনি। বিষয়টার জন্য সাহায্য চাচ্ছি ভাই।"-একটু বিরক্ত হয় রাফি।
"আচ্ছা ব্যাপার না। দু'টো আছে আমার কাছে। তা দিয়েই কাজ সেরে নেওয়া যাবে।"-বলেই প্যাকেট থেকে একটা বের করে ধরিয়ে নেয়।
"শালা গাঞ্জুট্টি।"-রাফি মনে মনে গালি দেয় ওকে।
"ওই বিকালে তুই সায়মাকে অন্য কারো সাথে দেখে আমার থেকে ভোদকার বোতল মেরে দিস একটা। সে বিষয়টা যাক। তবে সায়মা যখন তোকে অন্য মেয়ের সাথে দেখেছিল তাহলে তো তোকে ফোন করার কথা ছিল ওর।"- উপরের দিকে মুখ করে ধোঁয়া ছাড়ে তন্ময়।
রাফি দ্রুত পকেট থেকে ফোন বের করে কল হিস্ট্রি চেক করে। পরশু রাতে সায়মার নম্বর থেকে বায়ান্ন বার কল এসেছিল। অথচ সে এখন বুঝতে পারে সেটা! তার মানে তানহা সত্যিই বলছিল। ঐ রাতে ভোদকার নেশায় বুদ হয়ে ছিল রাফি। বুঝতে পারেনি তখন। সেরাতে তার নেশা করা উচিত হয়নি মোটেই। সায়মার খুনের জন্য এবার নিজেকে দায়ী করে তোলে ও।
"প্যারালাল ইউনিভার্স সম্পর্কে জানিস কিছু?"- বলেই আরেকবার সিগারেটে টান দেয় তন্ময়।
"খুব বেশি নয়। এক গ্রহের ন্যায় অন্য গ্রহের অস্তিত্ব-এমন কিছু?"
"জ্যোতির্বিদ্যা মনে করে থাকে একই বিশ্বের মতো দেখতে আরও বিশ্ব আছে যেগুলো সমান্তরালভাবে চলে। আর সে বিশ্বে আমাদের মতোই অন্য কারো অস্তিত্ব আছে।"
রাফি নড়েচড়ে বসে এবার-"মানে বলতে চাচ্ছিস যে হুবহু আমাদের মতো দেখতে অন্য কেউ?"
"হুম।"-শেষবারের মতো সিগারেটটি টান দিয়ে ফিল্টারটি ছুঁড়ে মারে।
"কিন্তু যদি এই ধারণা সত্যিও হয়ে থাকে তাহলে অন্য জগৎ থেকে আমাদের মত দেখতে দ্বিতীয় কেউ এ জগতে আসবে কীভাবে?"-উৎসুক চাহনিতে প্রশ্ন করে রাফি।
"কিছু বিজ্ঞানীরা মনে করতেন মাঝে মাঝে দু'টো জগৎ একে অপরকে ক্রস করে ফেলে। ধরে নেওয়া হয় এই ক্রসিং এর ফলে সময়ের চাদরে একটা ছিদ্র হয়। আর এর মাধ্যমেই কেউ অন্য সমান্তরাল জগতে চলে যেতে পারে।"-প্যাকেট থেকে দ্বিতীয় ও শেষ সিগারেটটি বের করে নেয়।
"এসব গাঁজাখুরি চিন্তাভাবনা। প্রমাণ আছে কোনো?"
"জোরালোভাবে তেমন কোনো প্রমাণ নেই। শুধুমাত্র একটি ধারণা। তবে এটাও বলা হয়, সমান্তরাল জগতদ্বয় একে অন্যকে ক্রস করার সময় অল্ট্রা ভার্স ঘটে।"
"অল্ট্রা ভার্স?"
"তোর কি কখনও এমনটা মনে হয়েছে যে, তুই কোনো কাজ করছিস বা দেখছিস কিন্তু এমনটা মনে হয় যে সেটা আগেও ঘটেছে কিংবা দৃশ্যটা তোর পরিচিত?"
"হুম। হয়েছে কয়েকবার। তবে এতে প্যারালাল ইউনিভার্সের অস্তিত্ব প্রমাণ হয় না।"
"আমিও বলছি না যে এটা শতভাগ বাস্তব। কিছু বিজ্ঞানীর ধারণা মাত্র।"
"মানে এখন তুই এটা বলতে চাচ্ছিস যে এই সামন্তরিক জগৎ থেকেই আমাদের মতো দেখতে কেউ পৃথিবীতে এসেছে?"
"হতেও পারে।"
রাফি থেমে যায়। মাথাটা আবারও ঝিম ধরে গেছে। এ রহস্য পরে উন্মোচন করা যাবে। আগে জানতে হবে সে রাতে কী হয়েছিল- যার উত্তর একমাত্র অবন্তীর কাছেই। মেয়েটা খুব বেশি শঙ্কিত হয়ে আছে। এতোটা আতঙ্কিত হতে সে কখনও দেখেনি কাউকে। একটা কল করার দরকার তানহাকে, অবন্তীর জ্ঞান ফিরেছে কি না জানাটা অতীব জরুরি..
চলবে...
Sayhan Ahmed
Hasibul hasan santo, Abul basar, Santa akter, Sk sagor, Sk imran, Raihan khan, Tanusri roi and লেখাটি পছন্দ করেছে
- Trimatraধুমকেতু
- Posts : 23
স্বর্ণমুদ্রা : 1434
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-06-05
Re: মৃত্যুচক্র
Sat Jun 05, 2021 8:23 pm
৪র্থ ও শেষ পর্ব
ফোন হাতে উঠাতেই তানহার কল। মেয়েটার নাকি হুশ ফিরেছে৷ তন্ময়ের থেকে বিদায় নিয়ে সেখানে পোঁছায় রাফি।
কেউ ভয় পেয়ে কান্না করলে তার মুখ দিয়ে বেরুনো প্রতিটা কথা কেমন যেন আটকে যায়। অবন্তী শান্ত হতে পারছে না কিছুতেই। এখনও কাঁপছে, মনের ভেতর তীব্র ভয় কাজ করছে তার। আবার অজ্ঞান হয়ে পড়ে কি না কে জানে!
ধীরে ধীরে কিছুটা স্বাভাবিক হয় সে। এক হাতে চোখের পানি মুছতে মুছতে বলতে শুরু করে-
"সায়মা পুরোটা রাস্তা কাঁদতে কাঁদতে এসেছিল। বাসায় পোঁছে যেন কান্নার বেগ আরো বেড়ে ওঠে। কিছু সময় পর ও উঠে দাঁড়ায়, বলে রাফির বাসায় যাবে। এই রাতে বের হতে না করলাম, তবুও জোর করেই বেরিয়ে পড়ে সে। প্রায় দু'ঘন্টা বাদ সে ফিরে আসে, রাত বারোটা বাজতে আর কিছু সময় বাকি। জিজ্ঞাসা করলাম যে তোমার সাথে দেখা করেছে কি না। হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়িয়ে চুপচাপ নিজের রুমে চলে যায়..."
"কিন্তু ওই রাতে সে আমার কাছে আসেইনি..."-অবন্তীকে থামিয়ে দেয় রাফি। দু'জনেই অবাক হয় কিছুটা। "...এটা পরে ভাবা যাবে। অবন্তী আগে তার কথা শেষ করুক।"
"তার কাছে গিয়ে কথা বলতে চাইলাম। কিন্তু ওর আচরণ অন্যরকম ছিল। মুখ খুলতে চাইছিল না ও। পরে ও আমায় ঘুমিয়ে যেতে বলে, বলে যে সকাল হলে সব জানাবে। কিন্তু তার কণ্ঠস্বরে কেমন অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। মনে হচ্ছিল যেন সায়মা নয়, অন্য কেউ কথা বলছে। পরে আমি নিজের রুমে এসে ঘুমিয়ে পড়ি। আর সকালে উঠে দেখি সায়মার লাশ।"-বলেই কান্না শুরু করে দেয় অবন্তী।
রাফি কিছু না বলেই সায়মার রুমে চলে যায়। খানিক সময় বাদ ফিরে আসে, হাতে একটা মোমবাতি নিয়ে-
"ওর খাটের তলা থেকে পেয়েছি এটা। হয়তো পুলিশের নজরে পড়েনি।"
"কিন্তু মোমবাতির সাথে ওর খুনের কী সম্পর্ক?"-তানহা প্রশ্ন করে।
"মোমবাতিটা প্রথমে দেখলে মনে হবে যে এটার অর্ধেক জ্বালানো হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ভালো করে লক্ষ্য করো- যদি মোমবাতিটার অর্ধেক জ্বালানো হয়ে থাকে তবে গলে পড়া অনেকখানি মোম এটার গায়ে লেগে থাকার কথা। কিন্তু এটার শুধুমাত্র মাঝের সুতোটাই পোড়া দেখা যাচ্ছে। মানে এটাকে কেউ অর্ধেক কেটে জ্বালিয়ে আবার নিভিয়ে ফেলেছে।"
"আমি আবারও জিজ্ঞাসা করছি এটার সাথে ওর খুনের সম্পর্ক কীভাবে?"
"বিষয়টা স্বাভাবিক নয়। সম্পর্ক অবশ্যই আছে। তবে সেটা এখন আমরা কেউই জানি না। হয়তো জানতে পারবো খুব শীঘ্রই।"
রাফির ফোন বেজে ওঠে- ওর মামা ফোন করেছে, "রাফি তুমি সায়মার লাশের পাশে থাকা কাগজটার ফরেনসিক টেস্ট করাতে বলিয়েছিলে ওটার রিপোর্ট হাতে পেয়েছি। কাগজে লেগে থাকা রক্ত সায়মার-ই।
তবে এর সাথে সোডিয়াম ক্লোরাইডও পাওয়া গিয়েছে। মনে হয় কাগজের উপর লবণ ছিটানো হয়েছিল।"
ফোন কেটে দেয় রাফি। বিষয়টা বলে সে। তানহা শঙ্কিত হয়ে বলে ওঠে,"দ্য মিডনাইট গেইম।"
প্রত্যেকেই তার মুখের দিকে তাকায়। তানহা তার কথা চালিয়ে যেতে থাকে,"এর প্রতিটা লক্ষণ-ই মিডনাইট গেইমের সাথে মিলে যাচ্ছে। আত্মার সাথে সংযুক্ত হওয়ার এক ভয়ানক গেইম।"
"মানে তুমি বলতে চাচ্ছো সায়মা সে রাতে এই গেইম খেলেছিল?"-রাফির প্রশ্ন।
"আমি জানি না৷ হঠাৎ মাথায় এসেছে বিষয়টা।"
"তানহা আমি গেইমটার ব্যাপারে খুব ভালো করেই জানি। আর তুমিও জানো সায়মা প্রচণ্ড ভীতু ছিল; মাঝরাতে বিড়ালের ডাক শুনলেই চেচিয়ে উঠতো যে, সে কীভাবে বারোটা থেকে শুরু করে তিনটা তেত্রিশ অব্দি এ গেইম খেলবে?"
"কিন্তু দেখ, এই মোমবাতি, ওর লাশের পাশে থাকা কাগজে ওর নাম আর তার উপরে ওর রক্ত, কাগজে লবণের অস্তিত্ব- এগুলো এই গেইমকেই আঙুল দেখায়।"
"তুমি এখনও এইসব গেইমে বিশ্বাস করো? আর কী বলতে চাচ্ছো? ও এই গেইমে ফেইলড হয়ে গিয়েছিল বলে আত্মাটা মেরে ফেলে তাকে? হাও ফানি! দেখ তানহা, যদি গেইমটা সত্যিও হয়ে থাকে তবে এর রুলসগুলো আরেকবার মনে করিয়ে দেই তোমাকে.." রাফি মেইনগেটের দিকে এগিয়ে যায়।
"...এটা দেখ! এই দরজাটা লোহার, কাঠের নয়। আর মোমবাতির ব্যাপারে একটু আগেই বলেছি আমি। ওটা কেউ অর্ধেক কেটে জ্বালিয়ে আবার নিভিয়ে দেয়। আর এই গেইম খেললে নাম লেখা কাগজটা লাশের পাশে পড়ে থাকবে এ কথা কোথায় আছে? খুনি যে-ই হোক, সে এটাই প্রমাণ করতে চেয়েছিল যে সায়মা এই গেইম খেলতে গিয়েই মারা পড়েছে। যাতে তার দিকে আঙুল না ঘুরায় কেউ।"
প্রত্যেকেই চুপ করে আছে। রাফি ওর মামাকে আবারও ফোন করে। পোস্টমর্টেমের রিপোর্টটা জানা হয়নি,
"তোমার সরকারী বাহিনী এই কেইসে কতদূর অগ্রসর?"
"ওরা কেইসটার উপর থেকে সরে গিয়েছে। ডক্টর আলফাজ খুন হয়েছেন গতরাতে। আর সায়মার কেইসের তদন্ত তুমি করছো বলে ওরা আর এগোয়নি।"
"যাক গে, আমিই বের করবো খুনিকে। এখন সায়মার পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা বলো।"
"শ্বাসরোধ করে মারা হয়েছে। আর বাকি আঘাতগুলো মৃত্যুর পর। রাত দশটা কী এগারোটা নাগাদ খুন হয়েছে ও।"
রাফি চোখদুটো বড়বড় হয়ে ওঠে। সাদেক সাহেবকে ফোন রাখতে বলে। এরপর বাকিদের উদ্দেশ্যে বলে,"অবন্তীর কথাগুলো সত্যি হলে ওই রাতে সায়মা দশটার দিকে বাসা থেকে বের হয়, কিন্তু বারোটার দিকে যে ফিরে আসে সে সায়মা নয়। সায়মার খুন হয়েছে দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে।মানে যে ফিরে আসে সে অন্য কেউ ছিল।"
ওরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে রাফির মুখের দিকে। রুমভর্তি পিনপতন নীরবতা।
"খুনি যে-ই হোক, অনেক ঠান্ডা মাথায় প্লানিং করেছে.."- আবার বলতে শুরু করে রাফি। "...রাতে বাসা থেকে বের হওয়ার পর তাকে খুন করা হয়। এরপর মাঝরাতের দিকে যে ফিরে আসে ও সায়মা ছিল না, ছিল অন্য কেউ। অবন্তী ঘুমিয়ে গেলে সায়মার লাশটা রুমে এনে লাশের উপরে অমানবিক অত্যাচার করে। আর সাথে এমনভাবে নাটকটা সাজায় যেন মনে হয় ও এই গেইমে হেরে যাওয়ার কারণে মারা গিয়েছে। খুনি ধূর্ত বটে। কিন্তু বোকা, খুব বোকা।"
"কিন্তু রাফি, এই একজন ব্যক্তির একই সময়ে ভিন্ন জায়গায় উপস্থিত থাকা এটার ব্যাপারে কী বলবে?"-তানহা প্রশ্ন করে।
তানহার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে রাফি ওর মামার কাছে ফোন দেয়,"বাসায় তল্লাশি করে কী পেয়েছো।....দ্রুত তার ব্যাংক একাউন্টে ট্রানজিশন চেক করো, দ্রুত।"
তানহা আবারও প্রশ্ন করে,"কার বাসায় তল্লাশি করবে? কার ব্যাংক একাউন্ট চেক করবে? কাকে কী বলছো এগুলো?"
রাফি এখনও চুপ। বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়, রুমে কয়েকবার পায়চারি করে আবারও বসে পড়ে৷ দুহাতে মুখটা মোনাজাতের ন্যায় মুছে নিয়ে দু'হাতের আঙুল মিলিয়ে থুতনির ভর রাখে তার উপরে। চোখের পলক পড়ছে না। ভাবছে, নাকি অপেক্ষা করছে?
কিছুক্ষণ পর রাফির ফোন বেজে ওঠে। ওর মুখ দেখে মনে হচ্ছিল এটারই অপেক্ষা করছিল সে৷ রিসিভ করে কয়েক সেকেন্ড কানের কাছে রেখে ফোন কেটে দেয়।
"জানতাম এটাই হবে। ডক্টর আলফাজের বাসা তল্লাশি করে মাস্ক তৈরির মডেল পাওয়া গিয়েছে, চারটি। ব্যাংক একাউন্ট ট্রানজিশন চেক করে জানা যায় তার একাউন্টে একদিনে একসাথে পঞ্চাশ লাখ টাকা ট্রান্সফার করা হয়।"
"কিন্তু এর সাথে সায়মার খুনের সম্পর্ক কোথায়? আমি দুঃখিত, তবে বারবার আমাকে একই প্রশ্ন করতে হচ্ছে।"
"যে চারটি মডেল পাওয়া গিয়েছে ওগুলো আমার, তোমার, সায়মার আর আরেকটা তন্ময়ের। বিষয়টা এমনই দাঁড়ায় যে খুনি তাকে ঘুষ দিয়ে মুখোশগুলো বানিয়ে নেয়। যেগুলোর কারণে আমরা প্রত্যেকেই দ্বিধায় পড়ে যাই, সায়মা যে রাতে খুন হয় তার আগের বিকাল থেকেই। পরক্ষণে হয়তো ডক্টর তাকে ব্লাকমেইল করেছিল কিংবা পুলিশের কাছে বলে দিতে চেয়েছিল সব যার কারণে তাকেও খুন হতে হয়।"
"কিন্তু রাফি, তন্ময়ের চেহারার মুখোশ কেন বানানো হয়েছে?"
তানহার প্রশ্নটা রাফিকে কঠোরভাবে ভাবিয়ে তোলে। তাদের প্রত্যেকের ডাবল রোল প্লে হয়েছে। তন্ময়েরটা এখনও হয়নি। নাকি হয়েছে কিন্তু তারা জানে না। রাফির ফোন আবারও বেজে ওঠে। সাদেক সাহেবের ফোন। আবার কেন ফোন করেছে, কী দরকারে বুঝতে পারে না সে। কথা শেষ হতেই ধুপ করেই বসে পড়ে সে। নিশ্চুপ হয়ে যায় মুহূর্তেই। চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা পানি বের হয় তার।
তানহা কিছু জিজ্ঞাসা করতে যাবে এমন সময় রাফি নিজে থেকেই বলা শুরু করে,"তন্ময়কেও মেরে ফেলেছে। কিছুক্ষণ আগে ওর লাশ পেয়েছে পুলিশ।"
তানহাও চুপ হয়ে যায় এবার। অবন্তী শুরু থেকে চুপ করে আছে। এতো ভীতু মেয়ে ও আগে দেখেনি। তবে ওর কাছে যা জানার ছিল তা জানতে পেরেছে এটাই ঢের।
রাফি আবার বলতে শুরু করে,"বুঝেছি। ও আমার প্রিয় মানুষদের মারতে চায়। ওর শত্রু আমিই। সূক্ষ্ম পরিকল্পনা করেছিল ও। একই সাথে সায়মা ও আমাকে একে অন্যের উপর ক্ষোভ সৃষ্টি করিয়ে তোলে। আমার সাথে দেখা করার জন্য সেই রাতে বের হয় ও। আর তারপরেই..." আর বলতে পারে না সে। চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে। তানহা এখনও চুপ করে আছে।
চোখদুটো মুছে নেয় রাফি,"অবন্তীর অজ্ঞান হওয়ার পর তন্ময়ের কাছে গিয়েছিলাম। মিথ্যা তন্ময়, তাকেও মেরে দিয়েছে ও। আমাকে এটা বিশ্বাস করাতে চাচ্ছিল যে একসাথে এক ব্যক্তির দুই জায়গায় অবস্থান করা প্যারালাল ইউনিভার্সের কারণ। যাতে খুনির এ প্লানের দিকে আঙুল তুলতে না পারি আমি। বোকা, কেন বুঝতে পারলাম না যে ওটা তন্ময় নয়, অন্য কেউ ছিল?" রাফি দাঁড়িয়ে পড়ে। মুহূর্তেই বজ্রকঠিন হয়ে ওঠে-"এতক্ষণে ও নিজের প্লানে চলেছে। এখন আমার প্লান শুরু করবো আমি।"
তন্ময়ের সিমকার্ডটা ওর কাছেই আছে। রাফি ফোন করে ওকে, বলে যে ও আর তানহা বিয়ে করতে যাচ্ছে দু'দিন বাদেই। তানহা অবাক হয়। এটা কী বলছে রাফি।
"দেখ, ও আমার প্রিয় মানুষদের আমার থেকে দূরে করে নিচ্ছে। তোমাকে এ রিস্ক নিতে হবে তানহা। এটা শোনার পর ও নিশ্চয় তোমাকেও মেরে ফেলতে চাইবে৷ কাল, অথবা পরশু। ওকে ধরার এটাই একমাত্র সুযোগ।"
"কিন্তু তোমার সন্দেহ যদি ভুল হয়? ও যদি এই উদ্দেশ্য নয়, অন্য উদ্দেশ্যে খুন করে? তাহলে?
"এই ছাড়া দ্বিতীয় কোনো কারণ আমি দেখছি না। শুধু নিশ্চিত হওয়ার পালা। আর আমার এই ধারণা ভুল হলেও ওকে আমি বের করবো, অবশ্যই করবো।"
_____
রাত প্রায় বারোটা। রাস্তা একদমই ফাঁকা। সেই বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে রাফি আর তানহা। রাফি চলে যেতেই ও আসবে, তানহাকেও খুন করতে- যদি রাফির ধারণা সত্যি হয়। কিছুক্ষণ পর বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে যায় রাফি; ভান করে চলে যাওয়ার। তানহা আরেকটু সময় দাঁড়িয়ে থাকে গেটের বাইরে, ইচ্ছাকৃতভাবেই। যেমনটা ভেবেছিল রাফি, কেউ আসছে ওর দিকে। কিছুদূর গিয়ে বাইক অফ করে সেদিকে লক্ষ্য রেখেছে ও। তানহা দেখেও না দেখার ভান করে আছে। আর কয়েক মিটার দূরে থাকতেই তানহা বাসায় ঢোকার জন্য পা বাড়ায়।
ঠিক এমন সময়ই ওর পিছন দিয়ে কাপড় দিয়ে মুখ বেঁধে নেয় সেই এগিয়ে আসা লোকটা। রাফি এটারই অপেক্ষা করছিল। দ্রুত ফিরে আসে রাফি। বাম হাতে বাইকটাকে কন্ট্রোলে রেখে ডান হাত থাকা লাঠি দিয়ে সজোরে আঘাত করে ওর মাথায়। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে লোকটা। রাফি ওর মামাকে আগেই ফোন করে রেখেছিল। ওর সন্দেহ বাস্তবে রূপ নেওয়ায় আসতে বলে তাকে।
_____
পুলিশ কাস্টোডিতে বসে আছে ওরা- রাফি, তানহা, অবন্তী, সাদেক সাহেব, আর দু'জন কনস্টেবল। খুনি সামনের চেয়ারেই বাঁধা।
"তো মি. আকাশ, চেয়ারম্যান খুনের দায়ে তোমার ভাইকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে সাহায্য করেছিলাম বলেই আমার উপর এই প্রতিশোধ নিলে তুমি? প্রতিশোধ নেওয়ার ছিল তো আমাকে খুন করতে, ওরা কী ক্ষতি করেছিল তোমার?"-ওর চেয়ার পাশে ঘুরতে ঘুরতে জিজ্ঞাসা করে রাফি।
"আপনজন হারানোর কষ্ট কতটা কঠিন, সেটাই বুঝাতে চেয়েছিলাম তোমাকে। কেমন বোধ করছো এখন? মি. রাফি?"-সজোরে হেসে ওঠে আকাশ।
"তোমার ভাই অপরাধ করেছিল, তার শাস্তি পেয়েছে সে। কিন্তু তুমি বিনা অপরাধে খুন করলে সায়মা আর তন্ময়ের। শুধুমাত্র প্রতিশোধের জন্য? প্রতিশোধ, হাহ! মানুষকে পশুর স্তরে নামিয়ে আনে এই প্রতিশোধ...."-রাফি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে,"...সায়মার খুনির বিচার আমি নিজের হাতে করবো ভেবেছিলাম। কিন্তু প্রতিশোধের এই বিষাক্ত কবলে পড়ে আমি খুনি হতে চাই না। তোমার আর তোমার সহযোগীদের বিচার আইন নিজেই করবে।"
সমাপ্ত
Sayhan Ahmed
ফোন হাতে উঠাতেই তানহার কল। মেয়েটার নাকি হুশ ফিরেছে৷ তন্ময়ের থেকে বিদায় নিয়ে সেখানে পোঁছায় রাফি।
কেউ ভয় পেয়ে কান্না করলে তার মুখ দিয়ে বেরুনো প্রতিটা কথা কেমন যেন আটকে যায়। অবন্তী শান্ত হতে পারছে না কিছুতেই। এখনও কাঁপছে, মনের ভেতর তীব্র ভয় কাজ করছে তার। আবার অজ্ঞান হয়ে পড়ে কি না কে জানে!
ধীরে ধীরে কিছুটা স্বাভাবিক হয় সে। এক হাতে চোখের পানি মুছতে মুছতে বলতে শুরু করে-
"সায়মা পুরোটা রাস্তা কাঁদতে কাঁদতে এসেছিল। বাসায় পোঁছে যেন কান্নার বেগ আরো বেড়ে ওঠে। কিছু সময় পর ও উঠে দাঁড়ায়, বলে রাফির বাসায় যাবে। এই রাতে বের হতে না করলাম, তবুও জোর করেই বেরিয়ে পড়ে সে। প্রায় দু'ঘন্টা বাদ সে ফিরে আসে, রাত বারোটা বাজতে আর কিছু সময় বাকি। জিজ্ঞাসা করলাম যে তোমার সাথে দেখা করেছে কি না। হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়িয়ে চুপচাপ নিজের রুমে চলে যায়..."
"কিন্তু ওই রাতে সে আমার কাছে আসেইনি..."-অবন্তীকে থামিয়ে দেয় রাফি। দু'জনেই অবাক হয় কিছুটা। "...এটা পরে ভাবা যাবে। অবন্তী আগে তার কথা শেষ করুক।"
"তার কাছে গিয়ে কথা বলতে চাইলাম। কিন্তু ওর আচরণ অন্যরকম ছিল। মুখ খুলতে চাইছিল না ও। পরে ও আমায় ঘুমিয়ে যেতে বলে, বলে যে সকাল হলে সব জানাবে। কিন্তু তার কণ্ঠস্বরে কেমন অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। মনে হচ্ছিল যেন সায়মা নয়, অন্য কেউ কথা বলছে। পরে আমি নিজের রুমে এসে ঘুমিয়ে পড়ি। আর সকালে উঠে দেখি সায়মার লাশ।"-বলেই কান্না শুরু করে দেয় অবন্তী।
রাফি কিছু না বলেই সায়মার রুমে চলে যায়। খানিক সময় বাদ ফিরে আসে, হাতে একটা মোমবাতি নিয়ে-
"ওর খাটের তলা থেকে পেয়েছি এটা। হয়তো পুলিশের নজরে পড়েনি।"
"কিন্তু মোমবাতির সাথে ওর খুনের কী সম্পর্ক?"-তানহা প্রশ্ন করে।
"মোমবাতিটা প্রথমে দেখলে মনে হবে যে এটার অর্ধেক জ্বালানো হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ভালো করে লক্ষ্য করো- যদি মোমবাতিটার অর্ধেক জ্বালানো হয়ে থাকে তবে গলে পড়া অনেকখানি মোম এটার গায়ে লেগে থাকার কথা। কিন্তু এটার শুধুমাত্র মাঝের সুতোটাই পোড়া দেখা যাচ্ছে। মানে এটাকে কেউ অর্ধেক কেটে জ্বালিয়ে আবার নিভিয়ে ফেলেছে।"
"আমি আবারও জিজ্ঞাসা করছি এটার সাথে ওর খুনের সম্পর্ক কীভাবে?"
"বিষয়টা স্বাভাবিক নয়। সম্পর্ক অবশ্যই আছে। তবে সেটা এখন আমরা কেউই জানি না। হয়তো জানতে পারবো খুব শীঘ্রই।"
রাফির ফোন বেজে ওঠে- ওর মামা ফোন করেছে, "রাফি তুমি সায়মার লাশের পাশে থাকা কাগজটার ফরেনসিক টেস্ট করাতে বলিয়েছিলে ওটার রিপোর্ট হাতে পেয়েছি। কাগজে লেগে থাকা রক্ত সায়মার-ই।
তবে এর সাথে সোডিয়াম ক্লোরাইডও পাওয়া গিয়েছে। মনে হয় কাগজের উপর লবণ ছিটানো হয়েছিল।"
ফোন কেটে দেয় রাফি। বিষয়টা বলে সে। তানহা শঙ্কিত হয়ে বলে ওঠে,"দ্য মিডনাইট গেইম।"
প্রত্যেকেই তার মুখের দিকে তাকায়। তানহা তার কথা চালিয়ে যেতে থাকে,"এর প্রতিটা লক্ষণ-ই মিডনাইট গেইমের সাথে মিলে যাচ্ছে। আত্মার সাথে সংযুক্ত হওয়ার এক ভয়ানক গেইম।"
"মানে তুমি বলতে চাচ্ছো সায়মা সে রাতে এই গেইম খেলেছিল?"-রাফির প্রশ্ন।
"আমি জানি না৷ হঠাৎ মাথায় এসেছে বিষয়টা।"
"তানহা আমি গেইমটার ব্যাপারে খুব ভালো করেই জানি। আর তুমিও জানো সায়মা প্রচণ্ড ভীতু ছিল; মাঝরাতে বিড়ালের ডাক শুনলেই চেচিয়ে উঠতো যে, সে কীভাবে বারোটা থেকে শুরু করে তিনটা তেত্রিশ অব্দি এ গেইম খেলবে?"
"কিন্তু দেখ, এই মোমবাতি, ওর লাশের পাশে থাকা কাগজে ওর নাম আর তার উপরে ওর রক্ত, কাগজে লবণের অস্তিত্ব- এগুলো এই গেইমকেই আঙুল দেখায়।"
"তুমি এখনও এইসব গেইমে বিশ্বাস করো? আর কী বলতে চাচ্ছো? ও এই গেইমে ফেইলড হয়ে গিয়েছিল বলে আত্মাটা মেরে ফেলে তাকে? হাও ফানি! দেখ তানহা, যদি গেইমটা সত্যিও হয়ে থাকে তবে এর রুলসগুলো আরেকবার মনে করিয়ে দেই তোমাকে.." রাফি মেইনগেটের দিকে এগিয়ে যায়।
"...এটা দেখ! এই দরজাটা লোহার, কাঠের নয়। আর মোমবাতির ব্যাপারে একটু আগেই বলেছি আমি। ওটা কেউ অর্ধেক কেটে জ্বালিয়ে আবার নিভিয়ে দেয়। আর এই গেইম খেললে নাম লেখা কাগজটা লাশের পাশে পড়ে থাকবে এ কথা কোথায় আছে? খুনি যে-ই হোক, সে এটাই প্রমাণ করতে চেয়েছিল যে সায়মা এই গেইম খেলতে গিয়েই মারা পড়েছে। যাতে তার দিকে আঙুল না ঘুরায় কেউ।"
প্রত্যেকেই চুপ করে আছে। রাফি ওর মামাকে আবারও ফোন করে। পোস্টমর্টেমের রিপোর্টটা জানা হয়নি,
"তোমার সরকারী বাহিনী এই কেইসে কতদূর অগ্রসর?"
"ওরা কেইসটার উপর থেকে সরে গিয়েছে। ডক্টর আলফাজ খুন হয়েছেন গতরাতে। আর সায়মার কেইসের তদন্ত তুমি করছো বলে ওরা আর এগোয়নি।"
"যাক গে, আমিই বের করবো খুনিকে। এখন সায়মার পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা বলো।"
"শ্বাসরোধ করে মারা হয়েছে। আর বাকি আঘাতগুলো মৃত্যুর পর। রাত দশটা কী এগারোটা নাগাদ খুন হয়েছে ও।"
রাফি চোখদুটো বড়বড় হয়ে ওঠে। সাদেক সাহেবকে ফোন রাখতে বলে। এরপর বাকিদের উদ্দেশ্যে বলে,"অবন্তীর কথাগুলো সত্যি হলে ওই রাতে সায়মা দশটার দিকে বাসা থেকে বের হয়, কিন্তু বারোটার দিকে যে ফিরে আসে সে সায়মা নয়। সায়মার খুন হয়েছে দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে।মানে যে ফিরে আসে সে অন্য কেউ ছিল।"
ওরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে রাফির মুখের দিকে। রুমভর্তি পিনপতন নীরবতা।
"খুনি যে-ই হোক, অনেক ঠান্ডা মাথায় প্লানিং করেছে.."- আবার বলতে শুরু করে রাফি। "...রাতে বাসা থেকে বের হওয়ার পর তাকে খুন করা হয়। এরপর মাঝরাতের দিকে যে ফিরে আসে ও সায়মা ছিল না, ছিল অন্য কেউ। অবন্তী ঘুমিয়ে গেলে সায়মার লাশটা রুমে এনে লাশের উপরে অমানবিক অত্যাচার করে। আর সাথে এমনভাবে নাটকটা সাজায় যেন মনে হয় ও এই গেইমে হেরে যাওয়ার কারণে মারা গিয়েছে। খুনি ধূর্ত বটে। কিন্তু বোকা, খুব বোকা।"
"কিন্তু রাফি, এই একজন ব্যক্তির একই সময়ে ভিন্ন জায়গায় উপস্থিত থাকা এটার ব্যাপারে কী বলবে?"-তানহা প্রশ্ন করে।
তানহার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে রাফি ওর মামার কাছে ফোন দেয়,"বাসায় তল্লাশি করে কী পেয়েছো।....দ্রুত তার ব্যাংক একাউন্টে ট্রানজিশন চেক করো, দ্রুত।"
তানহা আবারও প্রশ্ন করে,"কার বাসায় তল্লাশি করবে? কার ব্যাংক একাউন্ট চেক করবে? কাকে কী বলছো এগুলো?"
রাফি এখনও চুপ। বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়, রুমে কয়েকবার পায়চারি করে আবারও বসে পড়ে৷ দুহাতে মুখটা মোনাজাতের ন্যায় মুছে নিয়ে দু'হাতের আঙুল মিলিয়ে থুতনির ভর রাখে তার উপরে। চোখের পলক পড়ছে না। ভাবছে, নাকি অপেক্ষা করছে?
কিছুক্ষণ পর রাফির ফোন বেজে ওঠে। ওর মুখ দেখে মনে হচ্ছিল এটারই অপেক্ষা করছিল সে৷ রিসিভ করে কয়েক সেকেন্ড কানের কাছে রেখে ফোন কেটে দেয়।
"জানতাম এটাই হবে। ডক্টর আলফাজের বাসা তল্লাশি করে মাস্ক তৈরির মডেল পাওয়া গিয়েছে, চারটি। ব্যাংক একাউন্ট ট্রানজিশন চেক করে জানা যায় তার একাউন্টে একদিনে একসাথে পঞ্চাশ লাখ টাকা ট্রান্সফার করা হয়।"
"কিন্তু এর সাথে সায়মার খুনের সম্পর্ক কোথায়? আমি দুঃখিত, তবে বারবার আমাকে একই প্রশ্ন করতে হচ্ছে।"
"যে চারটি মডেল পাওয়া গিয়েছে ওগুলো আমার, তোমার, সায়মার আর আরেকটা তন্ময়ের। বিষয়টা এমনই দাঁড়ায় যে খুনি তাকে ঘুষ দিয়ে মুখোশগুলো বানিয়ে নেয়। যেগুলোর কারণে আমরা প্রত্যেকেই দ্বিধায় পড়ে যাই, সায়মা যে রাতে খুন হয় তার আগের বিকাল থেকেই। পরক্ষণে হয়তো ডক্টর তাকে ব্লাকমেইল করেছিল কিংবা পুলিশের কাছে বলে দিতে চেয়েছিল সব যার কারণে তাকেও খুন হতে হয়।"
"কিন্তু রাফি, তন্ময়ের চেহারার মুখোশ কেন বানানো হয়েছে?"
তানহার প্রশ্নটা রাফিকে কঠোরভাবে ভাবিয়ে তোলে। তাদের প্রত্যেকের ডাবল রোল প্লে হয়েছে। তন্ময়েরটা এখনও হয়নি। নাকি হয়েছে কিন্তু তারা জানে না। রাফির ফোন আবারও বেজে ওঠে। সাদেক সাহেবের ফোন। আবার কেন ফোন করেছে, কী দরকারে বুঝতে পারে না সে। কথা শেষ হতেই ধুপ করেই বসে পড়ে সে। নিশ্চুপ হয়ে যায় মুহূর্তেই। চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা পানি বের হয় তার।
তানহা কিছু জিজ্ঞাসা করতে যাবে এমন সময় রাফি নিজে থেকেই বলা শুরু করে,"তন্ময়কেও মেরে ফেলেছে। কিছুক্ষণ আগে ওর লাশ পেয়েছে পুলিশ।"
তানহাও চুপ হয়ে যায় এবার। অবন্তী শুরু থেকে চুপ করে আছে। এতো ভীতু মেয়ে ও আগে দেখেনি। তবে ওর কাছে যা জানার ছিল তা জানতে পেরেছে এটাই ঢের।
রাফি আবার বলতে শুরু করে,"বুঝেছি। ও আমার প্রিয় মানুষদের মারতে চায়। ওর শত্রু আমিই। সূক্ষ্ম পরিকল্পনা করেছিল ও। একই সাথে সায়মা ও আমাকে একে অন্যের উপর ক্ষোভ সৃষ্টি করিয়ে তোলে। আমার সাথে দেখা করার জন্য সেই রাতে বের হয় ও। আর তারপরেই..." আর বলতে পারে না সে। চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছে। তানহা এখনও চুপ করে আছে।
চোখদুটো মুছে নেয় রাফি,"অবন্তীর অজ্ঞান হওয়ার পর তন্ময়ের কাছে গিয়েছিলাম। মিথ্যা তন্ময়, তাকেও মেরে দিয়েছে ও। আমাকে এটা বিশ্বাস করাতে চাচ্ছিল যে একসাথে এক ব্যক্তির দুই জায়গায় অবস্থান করা প্যারালাল ইউনিভার্সের কারণ। যাতে খুনির এ প্লানের দিকে আঙুল তুলতে না পারি আমি। বোকা, কেন বুঝতে পারলাম না যে ওটা তন্ময় নয়, অন্য কেউ ছিল?" রাফি দাঁড়িয়ে পড়ে। মুহূর্তেই বজ্রকঠিন হয়ে ওঠে-"এতক্ষণে ও নিজের প্লানে চলেছে। এখন আমার প্লান শুরু করবো আমি।"
তন্ময়ের সিমকার্ডটা ওর কাছেই আছে। রাফি ফোন করে ওকে, বলে যে ও আর তানহা বিয়ে করতে যাচ্ছে দু'দিন বাদেই। তানহা অবাক হয়। এটা কী বলছে রাফি।
"দেখ, ও আমার প্রিয় মানুষদের আমার থেকে দূরে করে নিচ্ছে। তোমাকে এ রিস্ক নিতে হবে তানহা। এটা শোনার পর ও নিশ্চয় তোমাকেও মেরে ফেলতে চাইবে৷ কাল, অথবা পরশু। ওকে ধরার এটাই একমাত্র সুযোগ।"
"কিন্তু তোমার সন্দেহ যদি ভুল হয়? ও যদি এই উদ্দেশ্য নয়, অন্য উদ্দেশ্যে খুন করে? তাহলে?
"এই ছাড়া দ্বিতীয় কোনো কারণ আমি দেখছি না। শুধু নিশ্চিত হওয়ার পালা। আর আমার এই ধারণা ভুল হলেও ওকে আমি বের করবো, অবশ্যই করবো।"
_____
রাত প্রায় বারোটা। রাস্তা একদমই ফাঁকা। সেই বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে রাফি আর তানহা। রাফি চলে যেতেই ও আসবে, তানহাকেও খুন করতে- যদি রাফির ধারণা সত্যি হয়। কিছুক্ষণ পর বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে যায় রাফি; ভান করে চলে যাওয়ার। তানহা আরেকটু সময় দাঁড়িয়ে থাকে গেটের বাইরে, ইচ্ছাকৃতভাবেই। যেমনটা ভেবেছিল রাফি, কেউ আসছে ওর দিকে। কিছুদূর গিয়ে বাইক অফ করে সেদিকে লক্ষ্য রেখেছে ও। তানহা দেখেও না দেখার ভান করে আছে। আর কয়েক মিটার দূরে থাকতেই তানহা বাসায় ঢোকার জন্য পা বাড়ায়।
ঠিক এমন সময়ই ওর পিছন দিয়ে কাপড় দিয়ে মুখ বেঁধে নেয় সেই এগিয়ে আসা লোকটা। রাফি এটারই অপেক্ষা করছিল। দ্রুত ফিরে আসে রাফি। বাম হাতে বাইকটাকে কন্ট্রোলে রেখে ডান হাত থাকা লাঠি দিয়ে সজোরে আঘাত করে ওর মাথায়। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে লোকটা। রাফি ওর মামাকে আগেই ফোন করে রেখেছিল। ওর সন্দেহ বাস্তবে রূপ নেওয়ায় আসতে বলে তাকে।
_____
পুলিশ কাস্টোডিতে বসে আছে ওরা- রাফি, তানহা, অবন্তী, সাদেক সাহেব, আর দু'জন কনস্টেবল। খুনি সামনের চেয়ারেই বাঁধা।
"তো মি. আকাশ, চেয়ারম্যান খুনের দায়ে তোমার ভাইকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে সাহায্য করেছিলাম বলেই আমার উপর এই প্রতিশোধ নিলে তুমি? প্রতিশোধ নেওয়ার ছিল তো আমাকে খুন করতে, ওরা কী ক্ষতি করেছিল তোমার?"-ওর চেয়ার পাশে ঘুরতে ঘুরতে জিজ্ঞাসা করে রাফি।
"আপনজন হারানোর কষ্ট কতটা কঠিন, সেটাই বুঝাতে চেয়েছিলাম তোমাকে। কেমন বোধ করছো এখন? মি. রাফি?"-সজোরে হেসে ওঠে আকাশ।
"তোমার ভাই অপরাধ করেছিল, তার শাস্তি পেয়েছে সে। কিন্তু তুমি বিনা অপরাধে খুন করলে সায়মা আর তন্ময়ের। শুধুমাত্র প্রতিশোধের জন্য? প্রতিশোধ, হাহ! মানুষকে পশুর স্তরে নামিয়ে আনে এই প্রতিশোধ...."-রাফি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে,"...সায়মার খুনির বিচার আমি নিজের হাতে করবো ভেবেছিলাম। কিন্তু প্রতিশোধের এই বিষাক্ত কবলে পড়ে আমি খুনি হতে চাই না। তোমার আর তোমার সহযোগীদের বিচার আইন নিজেই করবে।"
সমাপ্ত
Sayhan Ahmed
Hasibul hasan santo, Abul basar, Santa akter, Sk sagor, Sk imran, Raihan khan, Tanusri roi and লেখাটি পছন্দ করেছে
Permissions in this forum:
You cannot reply to topics in this forum