- Trimatraধুমকেতু
- Posts : 23
স্বর্ণমুদ্রা : 1434
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-06-05
সাইকোপ্যাথ কিলার
Sat Jun 05, 2021 8:27 pm
১ম পর্ব
"আপনার স্ত্রী গত তিনদিন ধরে নিখোঁজ আর আপনি আজ এসেছেন কমপ্লেইন করতে! কি ভাই, বউকে ভালোবাসেন না নাকি?"
"আমি এখানে এসেছি এফআইআর করতে, পারিবারিক বিষয়ে কাউকে নাক গলাতে দেওয়ার জন্য নয়।"-শাহাদাত আঙুল দিয়ে টেবিলের উপর আঘাত করতে করতে বলে শফিক।
"তাই নাকি? চটে আছেন খুব। এমনটা নয়তো যে আপনার স্ত্রীকে বকাঝকা করার পরেই সে রাগ করে চলে যায়?"
"দেখুন স্যার, আমি আবারও বলছি, পারিবারিক বিষয়ে কথা বলতে আসিনি এখানে আমি।"
"আচ্ছা? সেটা তো সময় বলে দিবে কখন কার মুখ থেকে কী বের করতে হবে।"-চেয়ারে হেলান দিয়ে হাতে থাকা লাঠিটা ৩৬০ ডিগ্রি এঙ্গেলে কয়েকবার ঘুরান ইনস্পেক্টর সাব্বির।
বেশ নামডাক আছে তার বলতে হয়৷ দুর্নীতির বেড়াজালে যেখানে কনস্টেবল থেকে শুরু করে মাথা পর্যন্ত প্রায় সকলেই ঘুষ ছাড়া কোনো কাজই করে দিতে চায় না সেখানে ক্লায়েন্টের থেকে এক পয়সাও না নিয়ে চৌকস ভাবে প্রতিটি কেইসের তদন্ত করে যাচ্ছেন তিনি। তাকে এ ব্যাপারে কখনও প্রশ্ন করা হলে একটাই উত্তর তার মুখ থেকে বের হয় যে, পুলিশে এসেছি মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য, বাপের বয়সী কারো পাছায় লাথি মেরে টাকা নেওয়ার জন্য নয়।
রীতিমতো ঘুষখোরদের অসুবিধা হচ্ছে বটে, তবে বেশ কয়েকজন বিশ্বস্ত সহযোগীও পেয়েছেন তিনি। পেয়েছেন বলতে, অনেকটা পাইয়ে নিয়েছেন। মানুষকে নিজের কথা দিয়ে আকৃষ্ট করে নেওয়ার ক্ষমতা তার প্রশংসার যোগ্য।
"তারপর শফিক সাহেব, শেষ কবে আপনার স্ত্রী আপনার সাথে ছিল?"
"বললাম না তিনদিন আগে?"-একটু জোরগলায় বলে ওঠে শফিক।
"আরে শান্ত হউন, বেশ রাগি মানুষ দেখছি আপনি। এরপর বলুন কী হয়েছিল? তিনি নিখোঁজ হলেন কীভাবে?"
"সামান্য কথা কাটাকাটি হয়েছিল, এরপর সে রাগ করে বাপের বাড়ি চলে যাবে বলে একটা ব্যাগে অল্প কিছু জামাকাপড় নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।"
"সামান্য কথা কাটাকাটির জন্য বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল? আপনার বউও আপনার মতই রাগি দেখছি।"-হেলান থেকে উঠে টেবিলে হাত রাখে সাব্বির। গলার রগগুলো টানটান হয়ে গিয়েছে শফিক সাহেবের। মনে হচ্ছে আবারও গর্জন ছুড়বে। তাকে কিছু বলার সুযোগ দেওয়ার আগেই সাব্বির আবারও বলে ওঠে, "আচ্ছা এরপর আটকালেন না আপনি তাকে?"
"না।"
"আচ্ছা..."- মাথা ঝাকাতে ঝাকাতে বলে সাব্বির, "... তো এরপর সে বেরিয়ে পড়ে আর আপনি তিনদিন ধরেই কোনো খোঁজ নিলেন না তার?"
"হ্যাঁ! জেদ এমনভাবে চেপে বসেছিল যে সে যাওয়ার পর একবারের জন্য ফোনও দেইনি৷ কিন্তু ও কীভাবে এমনটা করতে পারলো আমি বুঝলাম না।"
"এমনটা বলতে?"
"ও আমার সাথে কথা না বলে একটা দিনও থাকতে পারে না। কিন্তু সে কখনওই যোগাযোগ করেনি। এমনকি সে বাসায় পৌঁছিয়েছিল কি না সেটাও জানায় নি।"
"আর আপনিও জানতে চান নি।"-সাব্বির আবারও চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে।
"না। কিন্তু তিনদিন পার হয়ে যাওয়ার পরেও সে ফোন দিচ্ছে না দেখে অনেক চিন্তায় পড়ে যাই। ওকে ফোন দিলাম কিন্তু বন্ধ ছিল। তার বাবার কাছে ফোন দিলাম কিন্তু তিনি বলেন যে সে বাসায়-ই যায়নি।"
"হোয়াট?"-চোখের ভ্রু বাকিয়ে সাব্বির বিস্ময় প্রকাশ করে।
"আজ সকালেই এটা জানতে পারি। এরপর কতজনকে ফোন করেছি হিসাব নেই। নিজের প্রাইভেট কার নিয়ে খুঁজতে বেরিয়ে পড়ি। যদিও জানি যে রাস্তায় হয়তো কোথাও পাবো না, কিন্তু তবুও- যদি পেয়ে যাই। অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও কোথাও পাইনি।"
"এমনটা নয় তো যে আপনার শশুরবাড়ির লোকেরা মিথ্যা বলছে?"
"না, সেখানেও গিয়েছিলাম- নেই।"
দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট চেপে ধরে সাব্বির কয়েকবার উপর-নীচ মাথা ঝাকায়। এরপর জিজ্ঞাসা করে যে তার স্ত্রীর কোনো ছবি এনেছে কি না। পকেট থেকে একটা ছবি বের করে টেবিলের উপর রাখে শফিক সাহেব।
"আচ্ছা এই কেইসের জন্য কতো প্রোফিট পাচ্ছি আমি?"
সাব্বিরের মুখে এমন কথা শুনে অবাক হয়ে তার দিকে তাকায় সে। শফিক সাহেব ভালো করেই জানেন যে সাব্বির কখনওই ঘুষ খায় না। তবুও তাকে বলে যে, "ব্ল্যাংক চেক দিয়ে দিব আপনাকে, যত ইচ্ছা নিয়ে নিবেন।"
সাব্বির এবার চেয়ার থেকে উঠে আসে। মুচকি হেসে শফিক সাহেবের কাঁধ চাপড়িয়ে বলেন, "আরও ভালো হয় যদি আপনি সবসময় সত্যটাই বলবেন যেটা আমি জিজ্ঞাসা করবো।"
শফিক সাহেব মাথা ঝাকান।
_____
"স্যার, শফিক সাহেব দেখি বেজায় রগচটা মানুষ।"
"হুম সেটাই তো দেখছি আনোয়ার ভাই।"
"কিন্তু স্যার, মাত্র এইটুকু জিজ্ঞাসা করেই বিদায় দিলেন যে? কোনোরকম সূত্রই তো জানা হলো না।"- নিজের টাক পড়া মাথায় চুলকাতে চুলকাতে জিজ্ঞাসা করে কনস্টেবল আনোয়ার, সাব্বিরের অনেক বিশ্বস্ত লোক বটে।
"হুম। অনেক কিছুই জানতে হবে তার থেকে। তবে এখানে নয়, এটার জন্য তার বাড়িই উপযুক্ত জায়গা।"- টেবিলটাতে হেলান দিয়ে বুকের উপর হাত বেঁধে দাঁড়ায় সাব্বির।
"মাঝে মাঝে আপনার উদ্দেশ্য আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না স্যার।"
"বুঝবে, খুব দ্রুতই বুঝবে।"- সাব্বির মুচকি হেসে উত্তর দেয়। কিছু সময় চুপ থেকে আবার বলে ওঠে,
"আচ্ছা আনোয়ার ভাই, কয়েকদিন আগে যে বেওয়ারিশ লাশটা পাওয়া গিয়েছিল, পরিচয় পাওয়া যায়নি ওটা কে ছিল?"
"না স্যার, এখনও পর্যন্ত ওটার ব্যাপারে কোনো কমপ্লেইনও আসেনি। তোরো-চৌদ্দ দিন হয়ে গেল, অথচ পাত্তাই নেই কারো।"
সাব্বির আবারও নিজের চেয়ারে বসে পড়ে। ও লাশটিকে নিজের চোখে দেখেছিল। এত জঘন্যতমভাবে আর এত কষ্ট দিয়ে তাকে খুন করা হয়েছিল ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। মহিলার বয়স আনুমানিক ত্রিশ থেকে বত্রিশ, বিবাহিতা। মাথা থেকে পা অব্দি শরীরের প্রতিটা অঙ্গে আঘাতের চিহ্ন। দুই হাত এবং পায়ে একাধিক ছিদ্র, পেরেক দিয়ে পিটিয়ে করা হয়েছে। বুক থেকে নাভি পর্যন্ত চিরে ফেলা হয়েছে ধারালো কিছু দিয়ে। এমনটা নয় যে শরীর থেকে কেউ কিডনি বা লিভার চুরি করার জন্য এ খুন করেছে। শুধুমাত্র প্রচণ্ড কষ্ট দিয়ে খুন করা হয়েছে, এই ছাড়া শরীর থেকে কোনো অঙ্গ বিচ্ছেদ করেনি খুনি।
পোস্টমর্টেম করে জানা যায় প্রতিটা আঘাত তার মৃত্যুর আগে। অর্থাৎ খুন করে আঘাত নয়, বরং আঘাত করতে করতে খুন করা হয়েছিল৷ মানুষ এতো নৃশংস হতে পারে ভাবতেই গায়ে কাটা দেয়।
লাশটিকে বস্তাভর্তি অবস্থায় পাওয়া যায় শহরের কোনো এক ডাস্টবিনে। আর লাশের সাথে একটা ছবি ছিল, একটা পেইন্টিং। খুব নিঁখুতভাবে অঙ্কন করেছে কেউ।
চেয়ারে তারকাটা দিয়ে বাঁধা, হাতে পায়ে পেরেক দিয়ে চেয়ারের সাথে আটকানো ও উন্মুক্ত দেহের বুক থেকে নাভি অব্দি চিরে ফেলার ক্ষত আর মুখে তীব্র আর্তনাদ খুব সুক্ষ্মভাবে ফুটে উঠেছে এই পেইন্টিং এ।
মাথায়ও কম আঘাত নেই। তবে পেইন্টিং এর প্রতিটি আঘাতের সাথে লাশটিরও প্রতিটি আঘাতের কাকতালীয় মিল রয়েছে। ব্যাপারটা রহস্যজনক।
"আনোয়ার ভাই, দু'কাপ চায়ের অর্ডার দিন তো।"
"দু'কাপ কেন স্যার?"
"কেন? আমি একাই খাব আর তুমি চেয়ে চেয়ে দেখবে?"
"স্যার, এভাবে কোনো ইনস্পেক্টর সাধারণ কনস্টেবলের সাথে বসে চা খায় এমনটা আগে কোথাও দেখিনি।"
সাব্বির আবারও মুচকি হাসে, "এরকম অনেকেই আছে আনোয়ার ভাই, আমি একা নই।"
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কথা বলছে তারা। সাব্বির গল্পপ্রিয় মানুষ। মানুষের সাথে মিশতে, তাদের সুখ-দুঃখের অনুভূতির সঙ্গী হতে অনেক আগ্রহী সে৷ মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয় তার সারা দেশ ঘুরে বেড়াতে, নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হয়ে তাদের আবেগের ভাগীদার হতে।
বেওয়ারিশ লাশটি সম্পর্কে ভাবতেই মাথা ঝিম ধরে ওর। না চাইতেও বারবার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এখন ও বিশ্রাম নিতে চায়।
মাথাটা চেয়ারের সাথে দুলিয়ে চোখ বোজে কয়েক মিনিটের জন্য। কিছুক্ষণ পর টেবিলে থাকা টেলিফোনটি ক্রিংক্রিং করে বাজতে থাকে। চোখ বুজেই সে বলে, "আনোয়ার ভাই, দেখেন তো কে ফোন করলো।"
আনোয়ার ফোনটি রিসিভ করে৷ সর্বোচ্চ দশ সেকেন্ড কথা বলেই ফোন রেখে দেয় ও। কাঁপা গলায় বলে ওঠে, "স্যার! আরেকটা লাশ!"
ধড়ফড়িয়ে উঠে পড়ে সাব্বির- "লাশ? কোথায়?"
গাড়ি নিয়ে দু'জনেই বেরিয়ে পড়ে৷ অনেক মানুষের জটলা হয়ে আছে নদীতে ময়লা জমে সৃষ্ট চরটিতে। মানুষ এতোটাই সচেতন(!) যে ময়লা ফেলতে ফেলতে নদীতেই চর বানিয়ে মৃতপ্রায় করে ফেলেছে। বস্তাটির চারপাশে হাজারো মাছির মেলা বসেছে৷ দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে খুব। এম্বুলেন্সে করে মর্গে নিয়ে যাওয়া হয় লাশটিকে।
ঠিক একইভাবে লাশের সাথে একটা পেইন্টিং, সুক্ষ্ম শিল্পীর পোক্ত হস্তে আঁকা। পেইন্টিংটাও সম্পূর্ণ এক, সাথে লাশটির শরীরে থাকা প্রত্যেকটি আঘাতের চিহ্ন।
লাশটির মুখ থেতলে দেওয়া হয়েছে আগেরবারের মতোই। পেইন্টিং এ আঁকা মহিলার চেহারা পরিচিত মনে হচ্ছে সাব্বিরের, যেন দেখেছে কোথাও।
হ্যাঁ, মনে পড়েছে- কিছুক্ষণ আগে ওর টেবিলের উপরেই দেখেছে। শফিক সাহেবের স্ত্রী। নিখোঁজ হয়েছিল তিনদিন আগে। কেইসের তদন্ত শুরু করার আগেই পেয়ে গেল তার লাশ।
"একইভাবে খুন, দু'জনের বয়সও কাছাকাছি। একই নিশান- পেইন্টিং, যাতে ফুটে উঠেছে মৃত্যু-পথযাত্রীর তীব্র কষ্ট, মৃত্যুকষ্ট। ঠিক একই জায়গায় আঘাতের চিহ্ন দু'টো লাশের।"- পেইন্টিং টা হাতে নিয়ে পায়চারি করতে করতে বিড়বিড় করছে সাব্বির।
"স্যার, এতো নৃশংসভাবে মানুষ কীভাবে পারে কারো খুন করতে?"- ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে আনোয়ার।
"মানুষ নয় সে!"- সাব্বিরের চোখে তীব্রতার ছাপ।
"তাহলে?"
"সাইকো, হি মাস্ট বি আ সাইকো!"
চলবে..
Sayhan Ahmed
"আপনার স্ত্রী গত তিনদিন ধরে নিখোঁজ আর আপনি আজ এসেছেন কমপ্লেইন করতে! কি ভাই, বউকে ভালোবাসেন না নাকি?"
"আমি এখানে এসেছি এফআইআর করতে, পারিবারিক বিষয়ে কাউকে নাক গলাতে দেওয়ার জন্য নয়।"-শাহাদাত আঙুল দিয়ে টেবিলের উপর আঘাত করতে করতে বলে শফিক।
"তাই নাকি? চটে আছেন খুব। এমনটা নয়তো যে আপনার স্ত্রীকে বকাঝকা করার পরেই সে রাগ করে চলে যায়?"
"দেখুন স্যার, আমি আবারও বলছি, পারিবারিক বিষয়ে কথা বলতে আসিনি এখানে আমি।"
"আচ্ছা? সেটা তো সময় বলে দিবে কখন কার মুখ থেকে কী বের করতে হবে।"-চেয়ারে হেলান দিয়ে হাতে থাকা লাঠিটা ৩৬০ ডিগ্রি এঙ্গেলে কয়েকবার ঘুরান ইনস্পেক্টর সাব্বির।
বেশ নামডাক আছে তার বলতে হয়৷ দুর্নীতির বেড়াজালে যেখানে কনস্টেবল থেকে শুরু করে মাথা পর্যন্ত প্রায় সকলেই ঘুষ ছাড়া কোনো কাজই করে দিতে চায় না সেখানে ক্লায়েন্টের থেকে এক পয়সাও না নিয়ে চৌকস ভাবে প্রতিটি কেইসের তদন্ত করে যাচ্ছেন তিনি। তাকে এ ব্যাপারে কখনও প্রশ্ন করা হলে একটাই উত্তর তার মুখ থেকে বের হয় যে, পুলিশে এসেছি মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য, বাপের বয়সী কারো পাছায় লাথি মেরে টাকা নেওয়ার জন্য নয়।
রীতিমতো ঘুষখোরদের অসুবিধা হচ্ছে বটে, তবে বেশ কয়েকজন বিশ্বস্ত সহযোগীও পেয়েছেন তিনি। পেয়েছেন বলতে, অনেকটা পাইয়ে নিয়েছেন। মানুষকে নিজের কথা দিয়ে আকৃষ্ট করে নেওয়ার ক্ষমতা তার প্রশংসার যোগ্য।
"তারপর শফিক সাহেব, শেষ কবে আপনার স্ত্রী আপনার সাথে ছিল?"
"বললাম না তিনদিন আগে?"-একটু জোরগলায় বলে ওঠে শফিক।
"আরে শান্ত হউন, বেশ রাগি মানুষ দেখছি আপনি। এরপর বলুন কী হয়েছিল? তিনি নিখোঁজ হলেন কীভাবে?"
"সামান্য কথা কাটাকাটি হয়েছিল, এরপর সে রাগ করে বাপের বাড়ি চলে যাবে বলে একটা ব্যাগে অল্প কিছু জামাকাপড় নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।"
"সামান্য কথা কাটাকাটির জন্য বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল? আপনার বউও আপনার মতই রাগি দেখছি।"-হেলান থেকে উঠে টেবিলে হাত রাখে সাব্বির। গলার রগগুলো টানটান হয়ে গিয়েছে শফিক সাহেবের। মনে হচ্ছে আবারও গর্জন ছুড়বে। তাকে কিছু বলার সুযোগ দেওয়ার আগেই সাব্বির আবারও বলে ওঠে, "আচ্ছা এরপর আটকালেন না আপনি তাকে?"
"না।"
"আচ্ছা..."- মাথা ঝাকাতে ঝাকাতে বলে সাব্বির, "... তো এরপর সে বেরিয়ে পড়ে আর আপনি তিনদিন ধরেই কোনো খোঁজ নিলেন না তার?"
"হ্যাঁ! জেদ এমনভাবে চেপে বসেছিল যে সে যাওয়ার পর একবারের জন্য ফোনও দেইনি৷ কিন্তু ও কীভাবে এমনটা করতে পারলো আমি বুঝলাম না।"
"এমনটা বলতে?"
"ও আমার সাথে কথা না বলে একটা দিনও থাকতে পারে না। কিন্তু সে কখনওই যোগাযোগ করেনি। এমনকি সে বাসায় পৌঁছিয়েছিল কি না সেটাও জানায় নি।"
"আর আপনিও জানতে চান নি।"-সাব্বির আবারও চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে।
"না। কিন্তু তিনদিন পার হয়ে যাওয়ার পরেও সে ফোন দিচ্ছে না দেখে অনেক চিন্তায় পড়ে যাই। ওকে ফোন দিলাম কিন্তু বন্ধ ছিল। তার বাবার কাছে ফোন দিলাম কিন্তু তিনি বলেন যে সে বাসায়-ই যায়নি।"
"হোয়াট?"-চোখের ভ্রু বাকিয়ে সাব্বির বিস্ময় প্রকাশ করে।
"আজ সকালেই এটা জানতে পারি। এরপর কতজনকে ফোন করেছি হিসাব নেই। নিজের প্রাইভেট কার নিয়ে খুঁজতে বেরিয়ে পড়ি। যদিও জানি যে রাস্তায় হয়তো কোথাও পাবো না, কিন্তু তবুও- যদি পেয়ে যাই। অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও কোথাও পাইনি।"
"এমনটা নয় তো যে আপনার শশুরবাড়ির লোকেরা মিথ্যা বলছে?"
"না, সেখানেও গিয়েছিলাম- নেই।"
দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট চেপে ধরে সাব্বির কয়েকবার উপর-নীচ মাথা ঝাকায়। এরপর জিজ্ঞাসা করে যে তার স্ত্রীর কোনো ছবি এনেছে কি না। পকেট থেকে একটা ছবি বের করে টেবিলের উপর রাখে শফিক সাহেব।
"আচ্ছা এই কেইসের জন্য কতো প্রোফিট পাচ্ছি আমি?"
সাব্বিরের মুখে এমন কথা শুনে অবাক হয়ে তার দিকে তাকায় সে। শফিক সাহেব ভালো করেই জানেন যে সাব্বির কখনওই ঘুষ খায় না। তবুও তাকে বলে যে, "ব্ল্যাংক চেক দিয়ে দিব আপনাকে, যত ইচ্ছা নিয়ে নিবেন।"
সাব্বির এবার চেয়ার থেকে উঠে আসে। মুচকি হেসে শফিক সাহেবের কাঁধ চাপড়িয়ে বলেন, "আরও ভালো হয় যদি আপনি সবসময় সত্যটাই বলবেন যেটা আমি জিজ্ঞাসা করবো।"
শফিক সাহেব মাথা ঝাকান।
_____
"স্যার, শফিক সাহেব দেখি বেজায় রগচটা মানুষ।"
"হুম সেটাই তো দেখছি আনোয়ার ভাই।"
"কিন্তু স্যার, মাত্র এইটুকু জিজ্ঞাসা করেই বিদায় দিলেন যে? কোনোরকম সূত্রই তো জানা হলো না।"- নিজের টাক পড়া মাথায় চুলকাতে চুলকাতে জিজ্ঞাসা করে কনস্টেবল আনোয়ার, সাব্বিরের অনেক বিশ্বস্ত লোক বটে।
"হুম। অনেক কিছুই জানতে হবে তার থেকে। তবে এখানে নয়, এটার জন্য তার বাড়িই উপযুক্ত জায়গা।"- টেবিলটাতে হেলান দিয়ে বুকের উপর হাত বেঁধে দাঁড়ায় সাব্বির।
"মাঝে মাঝে আপনার উদ্দেশ্য আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না স্যার।"
"বুঝবে, খুব দ্রুতই বুঝবে।"- সাব্বির মুচকি হেসে উত্তর দেয়। কিছু সময় চুপ থেকে আবার বলে ওঠে,
"আচ্ছা আনোয়ার ভাই, কয়েকদিন আগে যে বেওয়ারিশ লাশটা পাওয়া গিয়েছিল, পরিচয় পাওয়া যায়নি ওটা কে ছিল?"
"না স্যার, এখনও পর্যন্ত ওটার ব্যাপারে কোনো কমপ্লেইনও আসেনি। তোরো-চৌদ্দ দিন হয়ে গেল, অথচ পাত্তাই নেই কারো।"
সাব্বির আবারও নিজের চেয়ারে বসে পড়ে। ও লাশটিকে নিজের চোখে দেখেছিল। এত জঘন্যতমভাবে আর এত কষ্ট দিয়ে তাকে খুন করা হয়েছিল ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। মহিলার বয়স আনুমানিক ত্রিশ থেকে বত্রিশ, বিবাহিতা। মাথা থেকে পা অব্দি শরীরের প্রতিটা অঙ্গে আঘাতের চিহ্ন। দুই হাত এবং পায়ে একাধিক ছিদ্র, পেরেক দিয়ে পিটিয়ে করা হয়েছে। বুক থেকে নাভি পর্যন্ত চিরে ফেলা হয়েছে ধারালো কিছু দিয়ে। এমনটা নয় যে শরীর থেকে কেউ কিডনি বা লিভার চুরি করার জন্য এ খুন করেছে। শুধুমাত্র প্রচণ্ড কষ্ট দিয়ে খুন করা হয়েছে, এই ছাড়া শরীর থেকে কোনো অঙ্গ বিচ্ছেদ করেনি খুনি।
পোস্টমর্টেম করে জানা যায় প্রতিটা আঘাত তার মৃত্যুর আগে। অর্থাৎ খুন করে আঘাত নয়, বরং আঘাত করতে করতে খুন করা হয়েছিল৷ মানুষ এতো নৃশংস হতে পারে ভাবতেই গায়ে কাটা দেয়।
লাশটিকে বস্তাভর্তি অবস্থায় পাওয়া যায় শহরের কোনো এক ডাস্টবিনে। আর লাশের সাথে একটা ছবি ছিল, একটা পেইন্টিং। খুব নিঁখুতভাবে অঙ্কন করেছে কেউ।
চেয়ারে তারকাটা দিয়ে বাঁধা, হাতে পায়ে পেরেক দিয়ে চেয়ারের সাথে আটকানো ও উন্মুক্ত দেহের বুক থেকে নাভি অব্দি চিরে ফেলার ক্ষত আর মুখে তীব্র আর্তনাদ খুব সুক্ষ্মভাবে ফুটে উঠেছে এই পেইন্টিং এ।
মাথায়ও কম আঘাত নেই। তবে পেইন্টিং এর প্রতিটি আঘাতের সাথে লাশটিরও প্রতিটি আঘাতের কাকতালীয় মিল রয়েছে। ব্যাপারটা রহস্যজনক।
"আনোয়ার ভাই, দু'কাপ চায়ের অর্ডার দিন তো।"
"দু'কাপ কেন স্যার?"
"কেন? আমি একাই খাব আর তুমি চেয়ে চেয়ে দেখবে?"
"স্যার, এভাবে কোনো ইনস্পেক্টর সাধারণ কনস্টেবলের সাথে বসে চা খায় এমনটা আগে কোথাও দেখিনি।"
সাব্বির আবারও মুচকি হাসে, "এরকম অনেকেই আছে আনোয়ার ভাই, আমি একা নই।"
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কথা বলছে তারা। সাব্বির গল্পপ্রিয় মানুষ। মানুষের সাথে মিশতে, তাদের সুখ-দুঃখের অনুভূতির সঙ্গী হতে অনেক আগ্রহী সে৷ মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয় তার সারা দেশ ঘুরে বেড়াতে, নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হয়ে তাদের আবেগের ভাগীদার হতে।
বেওয়ারিশ লাশটি সম্পর্কে ভাবতেই মাথা ঝিম ধরে ওর। না চাইতেও বারবার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এখন ও বিশ্রাম নিতে চায়।
মাথাটা চেয়ারের সাথে দুলিয়ে চোখ বোজে কয়েক মিনিটের জন্য। কিছুক্ষণ পর টেবিলে থাকা টেলিফোনটি ক্রিংক্রিং করে বাজতে থাকে। চোখ বুজেই সে বলে, "আনোয়ার ভাই, দেখেন তো কে ফোন করলো।"
আনোয়ার ফোনটি রিসিভ করে৷ সর্বোচ্চ দশ সেকেন্ড কথা বলেই ফোন রেখে দেয় ও। কাঁপা গলায় বলে ওঠে, "স্যার! আরেকটা লাশ!"
ধড়ফড়িয়ে উঠে পড়ে সাব্বির- "লাশ? কোথায়?"
গাড়ি নিয়ে দু'জনেই বেরিয়ে পড়ে৷ অনেক মানুষের জটলা হয়ে আছে নদীতে ময়লা জমে সৃষ্ট চরটিতে। মানুষ এতোটাই সচেতন(!) যে ময়লা ফেলতে ফেলতে নদীতেই চর বানিয়ে মৃতপ্রায় করে ফেলেছে। বস্তাটির চারপাশে হাজারো মাছির মেলা বসেছে৷ দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে খুব। এম্বুলেন্সে করে মর্গে নিয়ে যাওয়া হয় লাশটিকে।
ঠিক একইভাবে লাশের সাথে একটা পেইন্টিং, সুক্ষ্ম শিল্পীর পোক্ত হস্তে আঁকা। পেইন্টিংটাও সম্পূর্ণ এক, সাথে লাশটির শরীরে থাকা প্রত্যেকটি আঘাতের চিহ্ন।
লাশটির মুখ থেতলে দেওয়া হয়েছে আগেরবারের মতোই। পেইন্টিং এ আঁকা মহিলার চেহারা পরিচিত মনে হচ্ছে সাব্বিরের, যেন দেখেছে কোথাও।
হ্যাঁ, মনে পড়েছে- কিছুক্ষণ আগে ওর টেবিলের উপরেই দেখেছে। শফিক সাহেবের স্ত্রী। নিখোঁজ হয়েছিল তিনদিন আগে। কেইসের তদন্ত শুরু করার আগেই পেয়ে গেল তার লাশ।
"একইভাবে খুন, দু'জনের বয়সও কাছাকাছি। একই নিশান- পেইন্টিং, যাতে ফুটে উঠেছে মৃত্যু-পথযাত্রীর তীব্র কষ্ট, মৃত্যুকষ্ট। ঠিক একই জায়গায় আঘাতের চিহ্ন দু'টো লাশের।"- পেইন্টিং টা হাতে নিয়ে পায়চারি করতে করতে বিড়বিড় করছে সাব্বির।
"স্যার, এতো নৃশংসভাবে মানুষ কীভাবে পারে কারো খুন করতে?"- ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে আনোয়ার।
"মানুষ নয় সে!"- সাব্বিরের চোখে তীব্রতার ছাপ।
"তাহলে?"
"সাইকো, হি মাস্ট বি আ সাইকো!"
চলবে..
Sayhan Ahmed
Hasibul hasan santo, Abul basar, Santa akter, Sk sagor, Raihan khan, Tanusri roi, Mr faruk and লেখাটি পছন্দ করেছে
- Trimatraধুমকেতু
- Posts : 23
স্বর্ণমুদ্রা : 1434
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-06-05
Re: সাইকোপ্যাথ কিলার
Sat Jun 05, 2021 8:28 pm
২য় পর্ব
সাব্বিরের বুকের উপর মাথা রেখে আনমনে গুনগুন করে গান গেয়ে চলেছে ওর স্ত্রী। হঠাৎ গান থামিয়ে জিজ্ঞাসা করে, "আচ্ছা সাব্বির, তুমি কখনও টিউবওয়েল থেকে কারো সাহায্য ছাড়াই পানি পড়তে দেখেছ?..."- সাব্বিরের উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে নিজেই বলে ওঠে, "আমি দেখেছি।"
মাঝে মাঝে অদ্ভুত প্রশ্ন করতে পটু ওর স্ত্রী, লিজা। ভালোবেসে বিয়ে করলে নাকি সংসারে শান্তি আসে না- প্রচলিত কথাটিকে নাকানিচুবানি খাইয়ে প্রায় দু'বছর পার করে এসেছে ওরা। যদিও বিবাহিত জীবনের সবে শুরু বলা চলে, তবুও ওদের একে অন্যের প্রতি ভালোবাসার কমতি কখনও হয়ে উঠবে- সবসময় এটার ঘোর বিরোধিতা করে দু'জনেই।
"আচ্ছা? কোথায় দেখলে এমন ভৌতিক কাণ্ড?"- লিজার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে সাব্বির জিজ্ঞাসা করে।
"অনেক আগে দেখেছি, তখন ক্লাস সেভেনে আমি। জানো ওটা দেখে ভয় পেয়ে জ্বরে ভুগেছিলাম অনেকদিন!"
সাব্বির হেসে ওঠে, খুব জোরে নয়। তবে লিজার কান অব্দি স্পষ্টভাবে পৌঁছায়। বুকের উপর বাম হাত দিয়ে আস্তে করে একটা থাপ্পড় মেরে লিজা বলে, "যাও! আর কিছুই বলবো না। সবকিছু নিয়েই মজা করো তুমি।"
অন্য সময় হলে সাব্বির ওকে দু'হাতে বুকের উপর জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমু খেত একটা। লিজা জানে, ও এমনটাই করবে। কিন্তু না, সাব্বির চুপচাপ। উঠে বসে লিজা।
"কী গো? কমে গিয়েছে ভালোবাসা? অন্য কাউকে ভালো লেগেছে? সতীন বানাবে তাকে?"- বলেই নিজে নিজে মিটমিট করে হাসতে থাকে। সাব্বিরের কোনোরকম প্রতিক্রিয়া না দেখে লিজা বুঝতে পারে কোনো একটা সমস্যা হয়েছে অবশ্যই।
ওর কাঁধের উপর মাথা রাখে লিজা, জিজ্ঞাসা করে কী হয়েছে।
সাব্বিরের চোখের সামনে এখনও দু'টো লাশের প্রতিচ্ছবি ভাসছে। কী নৃশংস, বর্বর খুনিটা! লিজাকে আগের লাশটির ব্যাপারে বলেনি। মেয়েটি ভীতু খুব। কিন্তু এবার না বলে পারছে না সাব্বির।
এমন জঘন্যতম খুনের ব্যাপারে শুনে লিজার মুখ চুপসে যায়। সদাহাস্যময় চেহারা যেন মুহূর্তেই ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে।
"যতক্ষণ না আমি ফোন করে বাসায় ফিরবো ততক্ষণ পর্যন্ত বাসার দরজায় কেউ হাজার ধাক্কালেও খুলবে না।"- অজানা আশংকাকে ঘিরে ধরে লিজাকে বুকে জড়িয়ে ধরে সাব্বির। ভয় হচ্ছে ওর, তীব্র ভয়। উষ্ণ বাহুদ্বয়ে আগলে থাকা লিজা সাব্বিরের হৃদপিণ্ডের আওয়াজ শুনছে কান পেতে।
_____
"লাশ দু'টির পোস্টমর্টেম রিপোর্ট সম্পূর্ণ এক।"- রিপোর্টের কাগজদু'টি হাতে নিয়ে মিলিয়ে দেখেন ডক্টর আলফাজ।
সাব্বির ডান হাতটি রানের উপর রেখে হাতের মুষ্টির উপরে মুখের ভর দিয়ে চুপচাপ বসে আছে চেয়ারের উপর। ধ্যান থেকে উঠে জিজ্ঞাসা করে, "আচ্ছা ডক্টর, লাশটিকে ধর্ষণ...." বলতে বলতেই আটকে যায় ও।
"দু'জনেই বিবাহিতা, বুঝে ওঠা সম্ভব হয়নি। কিন্তু যৌনাঙ্গকেও আঘাত থেকে মুক্তি দেয়নি কিলার।"
সাব্বির বুঝতে পারে না- ধর্ষণ করার জন্য খুন নাকি খুন করে ধর্ষণ? নাকি কোনোটিই নয়? আচ্ছা নেক্রোফিলিয়াকরা কি সাইকো হয়? কিংবা সাইকোরা নেক্রোফিলিয়াক?
সাব্বির উত্তরটা জানে না।
"তবে তুমি যেটা সন্দেহ করেছিলে সাব্বির। খুনি অবশ্যই সাইকোপ্যাথ কিলার।"- রিপোর্ট দু'টি টেবিলে রেখে দেন ড. আলফাজ।
"খুব জোরগলায় বলার কারণটা অবশ্যই ব্যাখ্যা করবেন ডক্টর!"
"কেন নয়? দেখ, লাশদু'টি ভালো করে লক্ষ্য করো। প্রত্যেকের দেহে একই জায়গায় একই রকম ক্ষতের চিহ্ন। আর সাইকোদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য এটা, একইভাবে প্রতিটা খুন করা।"
"অনেক আগেই দেখেছি ডক্টর। প্লিজ নতুন কিছু বলুন।"- ঘেমে যাওয়া মুখটি হাত দিয়ে মুছে নেয় সাব্বির।
"সাইকোপ্যাথ কিলাররা কখনও সম্মান বা গৌরবের জন্য কিছু করে না। সে ভয়ের সৃষ্টি করতে চায় মানুষের মধ্যে, শাসন করার প্রচণ্ড আকাঙ্ক্ষা তাকে সর্বদা বেষ্টিত রাখে..."
ডক্টরের কথা শুনে মুখে হাত দিয়ে কয়েকবার মাথা ঝাকায় সাব্বির।
"...সাইকো সম্পর্কে পাওয়া যত তথ্য আছে তার মধ্যে এমন কিছু পাওয়া গিয়েছে যারা খুনের পর কোনো না কোনো নিশান রেখে যায়, যেটা দেখে মানুষ ভয় পায় আর তা দেখে মজা নিতে থাকে ও। যেমনটা এই কেইসের ক্ষেত্রে, এই পেইন্টিংটা।"
"মানে কেইসটা ধর্ষণের নয়। কোনো এক মানসিক রোগীর বীভৎস হত্যাকান্ড।"
"এমনটাই।"- বলেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন ডক্টর আলফাজ।
_____
এখনও অব্দি কোনো সূত্র পায়নি সাব্বির, শুধুমাত্র পেইন্টিং টা ছাড়া। তবে ওটাকে কোনো সূত্র হিসেবেও ধরতে পারছে না সে। পেইন্টিং দেখে তো আর খুনির মুখ চেনা যাবে না। এই মুহূর্তে অনেক তথ্যের প্রয়োজন ওর।
শফিক সাহেব, হ্যাঁ তার থেকে সামান্য কিছু জানতে পারলেও কাজে দেবে- ভেবেই আনোয়ারকে নিয়ে দ্রুত তার বাসার দিকে রওনা হয় সাব্বির।
শফিক সাহেব এখনও জানেন না তার স্ত্রীর ব্যাপারে। সাব্বির প্রথমে জানাতে চায় না। একবার ভেঙ্গে পড়লে কোনো তথ্য জেনে নেওয়া সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
"শফিক সাহেব..."- বলেই সামান্য গলা ঝাড়ে সাব্বির, "...কিছু জানার ছিল আপনার থেকে।"
"বসুন, আমি কফি নিয়ে আসি।"
"ধন্যবাদ, কফির প্রয়োজন নেই। সামান্য কথা বলেই চলে যাব..."
মাথা ঝাকিয়ে হ্যাঁ ইঙ্গিত দেন শফিক সাহেব।
"...বাসায় শুধুমাত্র স্ত্রীকে নিয়েই থাকতেন?"
"হ্যাঁ, তবে দুপুরে ও বিকালে বুয়া আসে একজন।"
"ছেলেমেয়ে কেউ..."- কথাটি বলে একটু ইতস্তত করে সাব্বির।
"হ্যাঁ ছেলে আছে একজন, লন্ডনে পড়াশোনা করছে।"
সাব্বির জানে ও অপ্রাসঙ্গিক কথা বলছে। ও ভাবছে যদি শফিক সাহেব জানতে পারেন তার স্ত্রীর মার্ডার হয়েছে তখন তার অবস্থা কেমন হবে।
"আচ্ছা শফিক সাহেব.."- দ্বিতীয় বারের মতো গলা ঝেড়ে একটু নড়েচড়ে বসে, "...আপনার স্ত্রী সেদিন বাসা থেকে ক'টা নাগাদ বের হয়েছিল?"
"সন্ধ্যার সামান্য আগে। কেন?"
"না তেমন কিছু নয়। আচ্ছা আমি কি জানতে পারি সেদিন কী নিয়ে ঝগড়া হয়েছিল আপনাদের?"
"দেখুন স্যার, স্বামী-স্ত্রীর মাঝে পারিবারিক কোনো বিষয় নিয়ে ঝগড়া হতেই পারে। সে ব্যাপারে বাইরের কাউকে বলার প্রয়োজন মনে করছি না আমি।"
ঝগড়া হতেই পারে?- কথাটি সাব্বির কেন জানি মেনে নিতে পারে না। কারণ ওর আর লিজার মধ্যে খুনসুটির অভাব না হলেও কখনও সিরিয়াস ভাবে ঝগড়া করেনি ওরা। কিন্তু ওরা করে না বলে অন্য কেউ করবে না তেমনটা নয়। পরক্ষণে মেনে নেয় সাব্বির।
"উনি বেরিয়ে যাওয়ার সময় আপনি তার সাথে গিয়েছিলেন কি?"
"না, ও জামাকাপড় গুছিয়ে একটা ব্যাগ নিয়েই বেরিয়ে পড়েছিল। যাওয়ার সময় বলেনি কিছুই, শুধু বিকট শব্দে দরজাটা লাগিয়ে আমায় জানান দিয়েছিল যে ও বেরুচ্ছে। কিন্তু মুখ ফুটে বলেনি।"
"আপনি কী করে জানলেন ও বাবার বাড়িতেই যাচ্ছে?"
"কাপড় গোছানো দেখে জিজ্ঞাসা করেছিলাম একবার। আটকাইনি পরে।"
"আচ্ছা আপনাদের বিয়ে হয়েছে আনুমানিক কত বছর হবে?"
"আনুমানিক...আট-নয় বছর।"
"আচ্ছা আমরা আসি এখন। পরবর্তীতে কিছু জানতে হলে আবারও আসবো।"- মুখে সামান্য হাসি রেখে উঠে দাঁড়ায় সাব্বির।
_____
"আনোয়ার ভাই!"
"স্যার!"
"শফিক সাহেবকে কেমন মনে হলো আপনার?"- বলতে বলতে চেয়ারে বসে পড়ে সাব্বির।
"আগেও যেমনটা বলেছিলাম স্যার। রাগী স্বভাবের।"
"শুধু রাগী?"
"আর কিছু তো মনে হয়নি স্যার।"
"মিথ্যাবাদী মনে হয় না?"
"মিথ্যাবাদী? কিন্তু কেন?"
"আনোয়ার ভাই..."- টেবিলের উপর থেকে একটা কলম নিয়ে কান খোঁচাতে খোঁচাতে বলে, "...ধরেন আপনি আট-নয় বছর হলো বিয়ে করেছেন, আপনার সন্তানের বয়স সর্বোচ্চ কত হবে?"
"এই.. আনুমানিক সাত বছরের মতো।"- একটু ভেবে বলে আনোয়ার।
"আর একটি সাত কিংবা আট বছরের ছেলেকে কেউ লন্ডনে পড়াশোনা করতে পাঠাবে বলে আপনার মনে হলো?"- কলমটা পূর্বের জায়গায় রেখে টেবিলের উপর দু'হাত রেখে সাব্বির জিজ্ঞাসা করে।
আনোয়ার ভাবছে, সত্যিই তো! এটা কী অদৌ সম্ভব? শফিক সাহেব তবে মিথ্যা বলেছেন? কিন্তু কেন?
"আচ্ছা স্যার, শফিক সাহেবকে জানালেন না কেন তার স্ত্রী খুন হয়েছে?"
চেয়ারের সাথে হেলান দিয়ে কিছুক্ষণ ভাবে সাব্বির। আনোয়ার উত্তরের অপেক্ষায় চেয়ে আছে তার দিকে।
নীরবতা ছেড়ে সাব্বির উত্তর না দিয়েই জিজ্ঞাসা করে, "আপনি লাশটিকে দেখেছেন আনোয়ার ভাই?"
"হ্যাঁ স্যার।"
"ওটা যে শফিক সাহেবের স্ত্রীর-ই লাশ এটা কীভাবে বুঝলেন?"
খটকা খায় আনোয়ার। লাশের মুখ জঘন্যরকম থিতলে দিয়েছে খুনি, চেনার প্রশ্নই আসে না। শুধুমাত্র লাশের পাশে থাকা পেইন্টিং-এ অঙ্কিত চেহারার সাথে মিল আছে শফিক সাহাবের স্ত্রীর চেহারা। কিন্তু লাশটি যে তারই, এটা শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলা অসম্ভব।
দু'জনেই চুপ করে আছে। মাথায় হয়তো তাদের একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। এরই মাঝে টেবিলে থাকা টেলিফোনটা ক্রিংক্রিং শব্দে সচল হয়ে ওঠে। হঠাৎ হৃদপিণ্ড কেঁপে ওঠে সাব্বিরের৷ টেলিফোনে আসা প্রতিটা কল ভয় পাচ্ছে এখন সে, কে জানে আবারও কারো খুনের সংবাদ কানে আসে৷ সাইকোপ্যাথ কিলারেরা একটা দু'টো খুন করেই ক্ষান্ত হয় না। একের পর এক খুন করে হয়ে ওঠে সিরিয়াল কিলার। যতক্ষণ না তাকে থামানো যায় ততক্ষণ খুনের দামামা বাজিয়ে চলে এরা।
ফোন রিসিভ করতেই আরেকটা খুনের সংবাদ পায় সাব্বির, ঠিক যেমনটার আশংকা করছিল।
টেলিফোন রেখে ধড়ফড়িয়ে উঠে দাঁড়ায় সে। দ্রুত পকেট থেকে সেলফোন বের করে ফোন দেয় লিজাকে। তীব্র আতঙ্ক ঘীরে ধরে আছে তাকে।
যতক্ষণ না ওপাশ থেকে কেউ ফোন ওঠায় ততক্ষণ বাম হাত দিয়ে ঘর্মাক্ত মুখ বারবার মুছতে থাকে সাব্বির। ফোন রিসিভ হতেই সাব্বির প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে, "হ্যালো...হ্যালো লিজা।"- কথা টেনে উঠাতে পারছে না সে।
"কী হলো এতো ঘাবড়ে আছো কেন? কী হয়েছে?"
"কোথায় আছো তুমি? আর ঠিক আছো তো?"- কাঁপা গলায় বলে চলেছে সাব্বির।
"বাসায় তো আছি। আর ঠিক থাকবো না কেন?"
জমে থাকা আতঙ্ক নিশ্বাসের সাহায্যে বেরিয়ে সাব্বির ধপাস করে বসে পড়ে চেয়ারে। সামলে নিয়ে আবারও বলে, "না কিছু না, সাবধানে থেক।"
সাব্বির ফোন কেটে দেয়।
আনোয়ার ভাইয়ের গলাও টানটান হয়ে আছে। মনে হচ্ছে যেন তার গলাতেও অধীরতা আটকে রয়েছে। সাব্বির চেয়ারের সাথে পুনরায় হেলান দিয়ে জোরে নিশ্বাস ছাড়ে।
কয়েক মুহূর্ত পর আবারও উঠে দাঁড়ায়। প্রথম খুনের নয়-দশদিনের মাথায় দ্বিতীয় খুন আর তার তিনদিনের মাথায় তৃতীয় খুন। তাদের আবারও যেতে হবে নতুন কোনো লাশের কাছে।
আবারও একইরকম খুন, একই নিশান। একটি ক্ষতবিক্ষত মহিলার লাশ আর তার সাথে পড়ে থাকা একটা পেইন্টিং, যাতে আছে অন্য কারও ভয়ানক যন্ত্রণা মিশ্রিত চেহারা।
চলবে...
Sayhan Ahmed
সাব্বিরের বুকের উপর মাথা রেখে আনমনে গুনগুন করে গান গেয়ে চলেছে ওর স্ত্রী। হঠাৎ গান থামিয়ে জিজ্ঞাসা করে, "আচ্ছা সাব্বির, তুমি কখনও টিউবওয়েল থেকে কারো সাহায্য ছাড়াই পানি পড়তে দেখেছ?..."- সাব্বিরের উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে নিজেই বলে ওঠে, "আমি দেখেছি।"
মাঝে মাঝে অদ্ভুত প্রশ্ন করতে পটু ওর স্ত্রী, লিজা। ভালোবেসে বিয়ে করলে নাকি সংসারে শান্তি আসে না- প্রচলিত কথাটিকে নাকানিচুবানি খাইয়ে প্রায় দু'বছর পার করে এসেছে ওরা। যদিও বিবাহিত জীবনের সবে শুরু বলা চলে, তবুও ওদের একে অন্যের প্রতি ভালোবাসার কমতি কখনও হয়ে উঠবে- সবসময় এটার ঘোর বিরোধিতা করে দু'জনেই।
"আচ্ছা? কোথায় দেখলে এমন ভৌতিক কাণ্ড?"- লিজার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে সাব্বির জিজ্ঞাসা করে।
"অনেক আগে দেখেছি, তখন ক্লাস সেভেনে আমি। জানো ওটা দেখে ভয় পেয়ে জ্বরে ভুগেছিলাম অনেকদিন!"
সাব্বির হেসে ওঠে, খুব জোরে নয়। তবে লিজার কান অব্দি স্পষ্টভাবে পৌঁছায়। বুকের উপর বাম হাত দিয়ে আস্তে করে একটা থাপ্পড় মেরে লিজা বলে, "যাও! আর কিছুই বলবো না। সবকিছু নিয়েই মজা করো তুমি।"
অন্য সময় হলে সাব্বির ওকে দু'হাতে বুকের উপর জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমু খেত একটা। লিজা জানে, ও এমনটাই করবে। কিন্তু না, সাব্বির চুপচাপ। উঠে বসে লিজা।
"কী গো? কমে গিয়েছে ভালোবাসা? অন্য কাউকে ভালো লেগেছে? সতীন বানাবে তাকে?"- বলেই নিজে নিজে মিটমিট করে হাসতে থাকে। সাব্বিরের কোনোরকম প্রতিক্রিয়া না দেখে লিজা বুঝতে পারে কোনো একটা সমস্যা হয়েছে অবশ্যই।
ওর কাঁধের উপর মাথা রাখে লিজা, জিজ্ঞাসা করে কী হয়েছে।
সাব্বিরের চোখের সামনে এখনও দু'টো লাশের প্রতিচ্ছবি ভাসছে। কী নৃশংস, বর্বর খুনিটা! লিজাকে আগের লাশটির ব্যাপারে বলেনি। মেয়েটি ভীতু খুব। কিন্তু এবার না বলে পারছে না সাব্বির।
এমন জঘন্যতম খুনের ব্যাপারে শুনে লিজার মুখ চুপসে যায়। সদাহাস্যময় চেহারা যেন মুহূর্তেই ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে।
"যতক্ষণ না আমি ফোন করে বাসায় ফিরবো ততক্ষণ পর্যন্ত বাসার দরজায় কেউ হাজার ধাক্কালেও খুলবে না।"- অজানা আশংকাকে ঘিরে ধরে লিজাকে বুকে জড়িয়ে ধরে সাব্বির। ভয় হচ্ছে ওর, তীব্র ভয়। উষ্ণ বাহুদ্বয়ে আগলে থাকা লিজা সাব্বিরের হৃদপিণ্ডের আওয়াজ শুনছে কান পেতে।
_____
"লাশ দু'টির পোস্টমর্টেম রিপোর্ট সম্পূর্ণ এক।"- রিপোর্টের কাগজদু'টি হাতে নিয়ে মিলিয়ে দেখেন ডক্টর আলফাজ।
সাব্বির ডান হাতটি রানের উপর রেখে হাতের মুষ্টির উপরে মুখের ভর দিয়ে চুপচাপ বসে আছে চেয়ারের উপর। ধ্যান থেকে উঠে জিজ্ঞাসা করে, "আচ্ছা ডক্টর, লাশটিকে ধর্ষণ...." বলতে বলতেই আটকে যায় ও।
"দু'জনেই বিবাহিতা, বুঝে ওঠা সম্ভব হয়নি। কিন্তু যৌনাঙ্গকেও আঘাত থেকে মুক্তি দেয়নি কিলার।"
সাব্বির বুঝতে পারে না- ধর্ষণ করার জন্য খুন নাকি খুন করে ধর্ষণ? নাকি কোনোটিই নয়? আচ্ছা নেক্রোফিলিয়াকরা কি সাইকো হয়? কিংবা সাইকোরা নেক্রোফিলিয়াক?
সাব্বির উত্তরটা জানে না।
"তবে তুমি যেটা সন্দেহ করেছিলে সাব্বির। খুনি অবশ্যই সাইকোপ্যাথ কিলার।"- রিপোর্ট দু'টি টেবিলে রেখে দেন ড. আলফাজ।
"খুব জোরগলায় বলার কারণটা অবশ্যই ব্যাখ্যা করবেন ডক্টর!"
"কেন নয়? দেখ, লাশদু'টি ভালো করে লক্ষ্য করো। প্রত্যেকের দেহে একই জায়গায় একই রকম ক্ষতের চিহ্ন। আর সাইকোদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য এটা, একইভাবে প্রতিটা খুন করা।"
"অনেক আগেই দেখেছি ডক্টর। প্লিজ নতুন কিছু বলুন।"- ঘেমে যাওয়া মুখটি হাত দিয়ে মুছে নেয় সাব্বির।
"সাইকোপ্যাথ কিলাররা কখনও সম্মান বা গৌরবের জন্য কিছু করে না। সে ভয়ের সৃষ্টি করতে চায় মানুষের মধ্যে, শাসন করার প্রচণ্ড আকাঙ্ক্ষা তাকে সর্বদা বেষ্টিত রাখে..."
ডক্টরের কথা শুনে মুখে হাত দিয়ে কয়েকবার মাথা ঝাকায় সাব্বির।
"...সাইকো সম্পর্কে পাওয়া যত তথ্য আছে তার মধ্যে এমন কিছু পাওয়া গিয়েছে যারা খুনের পর কোনো না কোনো নিশান রেখে যায়, যেটা দেখে মানুষ ভয় পায় আর তা দেখে মজা নিতে থাকে ও। যেমনটা এই কেইসের ক্ষেত্রে, এই পেইন্টিংটা।"
"মানে কেইসটা ধর্ষণের নয়। কোনো এক মানসিক রোগীর বীভৎস হত্যাকান্ড।"
"এমনটাই।"- বলেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন ডক্টর আলফাজ।
_____
এখনও অব্দি কোনো সূত্র পায়নি সাব্বির, শুধুমাত্র পেইন্টিং টা ছাড়া। তবে ওটাকে কোনো সূত্র হিসেবেও ধরতে পারছে না সে। পেইন্টিং দেখে তো আর খুনির মুখ চেনা যাবে না। এই মুহূর্তে অনেক তথ্যের প্রয়োজন ওর।
শফিক সাহেব, হ্যাঁ তার থেকে সামান্য কিছু জানতে পারলেও কাজে দেবে- ভেবেই আনোয়ারকে নিয়ে দ্রুত তার বাসার দিকে রওনা হয় সাব্বির।
শফিক সাহেব এখনও জানেন না তার স্ত্রীর ব্যাপারে। সাব্বির প্রথমে জানাতে চায় না। একবার ভেঙ্গে পড়লে কোনো তথ্য জেনে নেওয়া সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
"শফিক সাহেব..."- বলেই সামান্য গলা ঝাড়ে সাব্বির, "...কিছু জানার ছিল আপনার থেকে।"
"বসুন, আমি কফি নিয়ে আসি।"
"ধন্যবাদ, কফির প্রয়োজন নেই। সামান্য কথা বলেই চলে যাব..."
মাথা ঝাকিয়ে হ্যাঁ ইঙ্গিত দেন শফিক সাহেব।
"...বাসায় শুধুমাত্র স্ত্রীকে নিয়েই থাকতেন?"
"হ্যাঁ, তবে দুপুরে ও বিকালে বুয়া আসে একজন।"
"ছেলেমেয়ে কেউ..."- কথাটি বলে একটু ইতস্তত করে সাব্বির।
"হ্যাঁ ছেলে আছে একজন, লন্ডনে পড়াশোনা করছে।"
সাব্বির জানে ও অপ্রাসঙ্গিক কথা বলছে। ও ভাবছে যদি শফিক সাহেব জানতে পারেন তার স্ত্রীর মার্ডার হয়েছে তখন তার অবস্থা কেমন হবে।
"আচ্ছা শফিক সাহেব.."- দ্বিতীয় বারের মতো গলা ঝেড়ে একটু নড়েচড়ে বসে, "...আপনার স্ত্রী সেদিন বাসা থেকে ক'টা নাগাদ বের হয়েছিল?"
"সন্ধ্যার সামান্য আগে। কেন?"
"না তেমন কিছু নয়। আচ্ছা আমি কি জানতে পারি সেদিন কী নিয়ে ঝগড়া হয়েছিল আপনাদের?"
"দেখুন স্যার, স্বামী-স্ত্রীর মাঝে পারিবারিক কোনো বিষয় নিয়ে ঝগড়া হতেই পারে। সে ব্যাপারে বাইরের কাউকে বলার প্রয়োজন মনে করছি না আমি।"
ঝগড়া হতেই পারে?- কথাটি সাব্বির কেন জানি মেনে নিতে পারে না। কারণ ওর আর লিজার মধ্যে খুনসুটির অভাব না হলেও কখনও সিরিয়াস ভাবে ঝগড়া করেনি ওরা। কিন্তু ওরা করে না বলে অন্য কেউ করবে না তেমনটা নয়। পরক্ষণে মেনে নেয় সাব্বির।
"উনি বেরিয়ে যাওয়ার সময় আপনি তার সাথে গিয়েছিলেন কি?"
"না, ও জামাকাপড় গুছিয়ে একটা ব্যাগ নিয়েই বেরিয়ে পড়েছিল। যাওয়ার সময় বলেনি কিছুই, শুধু বিকট শব্দে দরজাটা লাগিয়ে আমায় জানান দিয়েছিল যে ও বেরুচ্ছে। কিন্তু মুখ ফুটে বলেনি।"
"আপনি কী করে জানলেন ও বাবার বাড়িতেই যাচ্ছে?"
"কাপড় গোছানো দেখে জিজ্ঞাসা করেছিলাম একবার। আটকাইনি পরে।"
"আচ্ছা আপনাদের বিয়ে হয়েছে আনুমানিক কত বছর হবে?"
"আনুমানিক...আট-নয় বছর।"
"আচ্ছা আমরা আসি এখন। পরবর্তীতে কিছু জানতে হলে আবারও আসবো।"- মুখে সামান্য হাসি রেখে উঠে দাঁড়ায় সাব্বির।
_____
"আনোয়ার ভাই!"
"স্যার!"
"শফিক সাহেবকে কেমন মনে হলো আপনার?"- বলতে বলতে চেয়ারে বসে পড়ে সাব্বির।
"আগেও যেমনটা বলেছিলাম স্যার। রাগী স্বভাবের।"
"শুধু রাগী?"
"আর কিছু তো মনে হয়নি স্যার।"
"মিথ্যাবাদী মনে হয় না?"
"মিথ্যাবাদী? কিন্তু কেন?"
"আনোয়ার ভাই..."- টেবিলের উপর থেকে একটা কলম নিয়ে কান খোঁচাতে খোঁচাতে বলে, "...ধরেন আপনি আট-নয় বছর হলো বিয়ে করেছেন, আপনার সন্তানের বয়স সর্বোচ্চ কত হবে?"
"এই.. আনুমানিক সাত বছরের মতো।"- একটু ভেবে বলে আনোয়ার।
"আর একটি সাত কিংবা আট বছরের ছেলেকে কেউ লন্ডনে পড়াশোনা করতে পাঠাবে বলে আপনার মনে হলো?"- কলমটা পূর্বের জায়গায় রেখে টেবিলের উপর দু'হাত রেখে সাব্বির জিজ্ঞাসা করে।
আনোয়ার ভাবছে, সত্যিই তো! এটা কী অদৌ সম্ভব? শফিক সাহেব তবে মিথ্যা বলেছেন? কিন্তু কেন?
"আচ্ছা স্যার, শফিক সাহেবকে জানালেন না কেন তার স্ত্রী খুন হয়েছে?"
চেয়ারের সাথে হেলান দিয়ে কিছুক্ষণ ভাবে সাব্বির। আনোয়ার উত্তরের অপেক্ষায় চেয়ে আছে তার দিকে।
নীরবতা ছেড়ে সাব্বির উত্তর না দিয়েই জিজ্ঞাসা করে, "আপনি লাশটিকে দেখেছেন আনোয়ার ভাই?"
"হ্যাঁ স্যার।"
"ওটা যে শফিক সাহেবের স্ত্রীর-ই লাশ এটা কীভাবে বুঝলেন?"
খটকা খায় আনোয়ার। লাশের মুখ জঘন্যরকম থিতলে দিয়েছে খুনি, চেনার প্রশ্নই আসে না। শুধুমাত্র লাশের পাশে থাকা পেইন্টিং-এ অঙ্কিত চেহারার সাথে মিল আছে শফিক সাহাবের স্ত্রীর চেহারা। কিন্তু লাশটি যে তারই, এটা শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলা অসম্ভব।
দু'জনেই চুপ করে আছে। মাথায় হয়তো তাদের একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। এরই মাঝে টেবিলে থাকা টেলিফোনটা ক্রিংক্রিং শব্দে সচল হয়ে ওঠে। হঠাৎ হৃদপিণ্ড কেঁপে ওঠে সাব্বিরের৷ টেলিফোনে আসা প্রতিটা কল ভয় পাচ্ছে এখন সে, কে জানে আবারও কারো খুনের সংবাদ কানে আসে৷ সাইকোপ্যাথ কিলারেরা একটা দু'টো খুন করেই ক্ষান্ত হয় না। একের পর এক খুন করে হয়ে ওঠে সিরিয়াল কিলার। যতক্ষণ না তাকে থামানো যায় ততক্ষণ খুনের দামামা বাজিয়ে চলে এরা।
ফোন রিসিভ করতেই আরেকটা খুনের সংবাদ পায় সাব্বির, ঠিক যেমনটার আশংকা করছিল।
টেলিফোন রেখে ধড়ফড়িয়ে উঠে দাঁড়ায় সে। দ্রুত পকেট থেকে সেলফোন বের করে ফোন দেয় লিজাকে। তীব্র আতঙ্ক ঘীরে ধরে আছে তাকে।
যতক্ষণ না ওপাশ থেকে কেউ ফোন ওঠায় ততক্ষণ বাম হাত দিয়ে ঘর্মাক্ত মুখ বারবার মুছতে থাকে সাব্বির। ফোন রিসিভ হতেই সাব্বির প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে, "হ্যালো...হ্যালো লিজা।"- কথা টেনে উঠাতে পারছে না সে।
"কী হলো এতো ঘাবড়ে আছো কেন? কী হয়েছে?"
"কোথায় আছো তুমি? আর ঠিক আছো তো?"- কাঁপা গলায় বলে চলেছে সাব্বির।
"বাসায় তো আছি। আর ঠিক থাকবো না কেন?"
জমে থাকা আতঙ্ক নিশ্বাসের সাহায্যে বেরিয়ে সাব্বির ধপাস করে বসে পড়ে চেয়ারে। সামলে নিয়ে আবারও বলে, "না কিছু না, সাবধানে থেক।"
সাব্বির ফোন কেটে দেয়।
আনোয়ার ভাইয়ের গলাও টানটান হয়ে আছে। মনে হচ্ছে যেন তার গলাতেও অধীরতা আটকে রয়েছে। সাব্বির চেয়ারের সাথে পুনরায় হেলান দিয়ে জোরে নিশ্বাস ছাড়ে।
কয়েক মুহূর্ত পর আবারও উঠে দাঁড়ায়। প্রথম খুনের নয়-দশদিনের মাথায় দ্বিতীয় খুন আর তার তিনদিনের মাথায় তৃতীয় খুন। তাদের আবারও যেতে হবে নতুন কোনো লাশের কাছে।
আবারও একইরকম খুন, একই নিশান। একটি ক্ষতবিক্ষত মহিলার লাশ আর তার সাথে পড়ে থাকা একটা পেইন্টিং, যাতে আছে অন্য কারও ভয়ানক যন্ত্রণা মিশ্রিত চেহারা।
চলবে...
Sayhan Ahmed
Hasibul hasan santo, Abul basar, Santa akter, Sk sagor, Sk imran, Raihan khan, Tanusri roi and লেখাটি পছন্দ করেছে
- Trimatraধুমকেতু
- Posts : 23
স্বর্ণমুদ্রা : 1434
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-06-05
Re: সাইকোপ্যাথ কিলার
Sat Jun 05, 2021 8:29 pm
৩য় পর্ব
"মেয়েদের সন্ধ্যার পর কিংবা রাতে একা একা বাসা থেকে বের হওয়াকে আপনি কেমন মনে করেন আনোয়ার ভাই।"
"ঠিক নয়, একদমই নয়।"
"হুম! আগে ইজ্জত হারানোর ভয় থাকলেও এখন সাথে যুক্ত হয়েছে জান হারানোর ভয়।"
"কিন্তু স্যার খুনি তার উদ্দেশ্য বা মতিগতি কিছুই বুঝে উঠতে দিচ্ছে না। মাঝে মাঝে তো আমার এমনটাও মনে হচ্ছে যে খুনি ধর্ষণের পর এমন জঘন্যতম ভাবে খুনগুলো করেছে।"
"কিংবা খুনের পর ধর্ষণ..."- বলেই নিজের রানের উপর পরপর দু'বার থাবা মারে সে। আনোয়ার অবাক হয়, খুনের পর ধর্ষণ কথাটা সে ভালোভাবে হজম করতে পারেনি। ব্যাপারটি নাক সিটকানো কিংবা ভ্রু কুঁচকানোর মতো হলেও সাব্বির একনাগাড়ে বলে যেতে থাকে।
"...নেক্রোফিলিয়া সম্পর্কে জানেন কিছু?"
"খুবই কম, জানি না বললেই চলে। লাশের প্রতি ভালোবাসা বা আসক্তি এ টাইপের কিছু। তাই না?"
"আসক্তি তো বটে, যৌন-আসক্তি!"- কাঁধ ঝাকায় সাব্বির। আনোয়ার অবাক হয়ে তাকায় ওর দিকে।
"নেক্রোফিলিয়া, দু'টো গ্রীক শব্দের থেকে উঠে এসেছে। নেক্রোস অর্থ মৃত আর ফিলিয়া অর্থ ফ্রেন্ডশিপ কিংবা লাভ। মানে এটা দাঁড়ায়, মৃতব্যক্তির সাথে ভালোবাসা অনুভব করা। তবে মূল বিষয়টা ভিন্ন। মৃতদেহের প্রতি শারীরিক চাহিদাকেই মূলত নেক্রোফিলিয়া বলা হয়ে থাকে।"
এতক্ষণ বিমূঢ় হয়ে থাকা আনোয়ার চিন্তিত স্বরে না জিজ্ঞাসা করে পারে না, "নেক্রোফিলিয়া কি বেশ ছড়িয়ে গেছে নাকি এই সমাজে? বাংলাদেশেও চলে এসেছে এর প্র্যাক্টিস?"
"কিভাবে বলি?..."- গা মুচড়ে বলে সাব্বির "...ঘটনা তো আজকে শুরু না। হেরোডোটাসকে চেনেন তো?"
অবাক হয় আনোয়ার, "বিখ্যাত গ্রীক ইতিহাসবিদ তো? ও ব্যাটাও লাশ নিয়ে এসব করত নাকি?"
"পুরোটা শুনুন আগে। হেরোডোটাস নেক্রোফিলিয়াক ছিলেন না। উনি বলেছেন যে, ফারাওদের আমল থেকে চলে আসছে এটা। বা তারও আগে থেকে। তবে নির্ঘাত মিশরীয় সভ্যতার সময় রেগুলার নেক্রোফিলিয়াকের অভাব ছিল না।"
"ওটা আবার কী?"- ভ্রু কুঁচকায় এবার আনোয়ার।
"যারা রেগুলার লাশের সাথে মিলিত হতো। দৈনিক লাশ লাগবে তাদের। কোথায় বিয়ে-শাদি করে শান্তিতে থাকবে তা নয়, আছে লাশেদের সাথে মিলিত হওয়ার ধান্দায়।"
"যাই হোক, যেটা বলছিলাম- ফারাওদের ক্ষেত্রে যেটা করা হত- সম্ভ্রান্ত মহিলাদের মৃত্যুর পর তিন চারদিন লাশটাকে পঁচিয়ে মমি বানাতে পাঠানো হত। এটা তো জানেনই বটে ওই সময় মমি করাটা ছিল প্রথা..."
সাব্বিরের কথায় চোখ নিচে রেখে মাথা নাড়ায় আনোয়ার।
"...যদি টাটকা মৃতদেহ এলবামাদের কাছে দেওয়া হত তারা আগে সেই মহিলার মৃতদেহের ওপর চড়াও হত; পরে মমি বানানো। বোঝা যায় এরা রীতিমত নেক্রোফিলিয়ার প্র্যাকটিস করত তখন। হেরোডটাস শুধু এলবামাদের দোষ দেন নি; গ্রেকোরোমান সম্রাটদের প্রতিও রেখে গেছেন একই অভিযোগ। তারাও শবদেহের সাথে মিলিত হওয়ার চর্চা করতেন।"
আনোয়ারের শরীর কুঁচকে ওঠে, "সম্রাটরাও?"
চেয়ারে হেলান দিয়েই সাব্বির উত্তর দেয়, "সম্রাটরাও।"
আনোয়ারের চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে এখনই গালি ছুড়ে মারে কয়েকটা। কিন্তু সে এখন নীরব শ্রোতা, মনোযোগ দিয়ে শুনছে সাব্বিরের প্রতিটা কথা। "বাইজেন্টাইন সম্রাটরা তো আরও এক ধাপ এগিয়ে। ডাউন দ্য উইকেটে এসে ছক্কা মারা পাবলিক এরা। অন্য রাজ্যে হামলা করার পর তারা সেসব রাজ্যের রাজাদের হেরেম দখন করত নিঃসংকোচে। সেখানে থাকা মেয়েগুলোর রক্ত দিয়ে চৌবাচ্চা ভর্তি করে তা নিয়ে খেলত সম্রাট। তবে স্বীকার করতেই হবে, নেক্রোফিলিয়াকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে প্রাচীন মিশরীয়রা। এদের সম্ভ্রান্ত মহিলা আর সুন্দরী মেয়েদের মৃত্যুর পর ঘর থেকে লাশ বের করতেই কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হত। নাহলে পাপাচারী পুরোহিত থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত লাশের সাথে দৈহিক সম্পর্ক করে যেত।"
"মিশর থেকেই কি এসেছে নাকি এটা, স্যার?" জানতে চায় আনোয়ার।
"তা ঠিক জানি না আনোয়ার ভাই। পরে রোমেও দেখা যায় এর প্রচলন। রোমান সম্রাট হেরড ছিল আরেক চিজ। হাসমোনিয়ান রাজ্য দখল করে ধ্বংসযজ্ঞ তো এই লোক চালিয়েছিলই। তারওপর ধরে এনেছিল রাজকুমারী মারিআন্নিকে। জোর করে বিয়ে করেছিল মেয়েটাকে এই পিশাচ সম্রাট। বিয়ে তো নাম মাত্র, শয্যা সঙ্গিনী বানানো আর কি! তবে মারিআন্নি রাজি হয় নি তাতে। প্রচন্ড ঘৃণা ছিল তার এই অত্যাচারী সম্রাটের প্রতি। রাজকুমারীর রাজ্য ভেঙ্গে এই লোকই তো তছনছ করেছিল। ঘৃণা থাকা তো অস্বাভাবিক না। ফলাফলটা ভালো হয় নি।"
"ফলাফল?"- উৎসুক চোখে জিজ্ঞাসা করে আনোয়ার।
"হেরড হত্যা করে মারিআন্নিকে। তবে ওটা কিছুই না। হেরডের এই অপকর্মের সবচেয়ে ট্রিকি পার্ট ছিল- রাসায়ানিকভাবে সে সাত বছর সংরক্ষণ করে মারিআন্নিকে। এই দীর্ঘ সাত বছর নিয়মিত হেরড যৌনকর্ম চালায় মৃত মারিআন্নির শরীরে ওপর।"
"অদ্ভুত রকমের পাগলামী। কিন্তু স্যার, তাদের কী উদ্দেশ্য ছিল এই রকম অপকর্মের পেছনে?"
"উদ্দেশ্য তো অনেক আছে। তবে এই কেইসের ব্যাপারে যেটা মাথায় এসেছিল- পূর্বের শত্রুতা বা বিদ্বেষ থেকে বিপরীত লিঙ্গের কাওকে খুন করে ফেলার পর খুনীর মনে পরিপূর্ণ বিজয়ের তৃপ্তি আসে না। চরমভাবে লাশটিকে পরাস্ত প্রমাণ করার জন্য শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হয়ে থাকে কিছু কিছু খুনী।"
"মানে এ খুনির সাথে এই তিনজন মহিলারই পূর্বশত্রুতা ছিল? যে কারণে খুন করে এরপর আবার লিপ্ত হয় দৈহিকভাবে?"
"এমনটা হতে পারে আনোয়ার ভাই। কিন্তু ডক্টরের ভাষ্যমতে লাশগুলোর সাথে এমন কিছু হয়েছিল কি না সেটা বলা অসম্ভব।"
"তবে স্যার, আপনার এসব কথাকে আমরা মেনে নেব কীভাবে?"
"শুধুমাত্র একটা সন্দেহ আনোয়ার ভাই, দ্বিতীয় কিছুই নয়। খুনির ব্যাপারে আমরা এখনও কোনো হদিস পাইনি। সাইকো পুরুষ কিংবা মহিলা উভয়ই হতে পারে। তাই এসব আমার সন্দেহ ছাড়া দ্বিতীয় কিছু নয়।"
আনোয়ার মাথা ঝাকায় কয়েকবার। সাব্বিরও চুপ থাকে কয়েক মুহূর্ত। আবার বলে ওঠে, "তবে খুনি নেক্রোফিলিয়াক হোক বা না হোক, অবশ্যই একজন সাইকো- এটা শতভাগ সত্য।"
দু'জনের নীরবতা ভেঙ্গে টেবিলে থাকা টেলিফোনটি আবারও বেজে ওঠে। দু'জনেই ফ্যালফ্যাল করে একে অন্যের দিকে তাকায়। কাঁপা হাতে ফোন উঠায় আনোয়ার। রিসিভ করেই যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে।ডক্টর আলফাজের ফোন, অন্য আরেকটা খুনের নিউজ নয়। কাল যে মহিলার খুন হলো তার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট জানাতে কল করেছেন।
সাব্বির অবাক হয় না মোটেই।
তিনটি খুন, তিনজনই মহিলা, তিনজনের বয়সই ত্রিশের কাছাকাছি। খুনি যে-ই হোক, এই বয়সের মহিলাদের উপর তার প্রচণ্ড ক্ষোভ ও ঘৃণা আছে এটা বুঝতে পারে সাব্বির। তাকে থামানো না গেলে হয়তো ধীরে ধীরে সুস্থ্য শহরটাকে মৃত্যুপুরী বানিয়ে ফেলবে সে।
প্রথম ভিক্টিমের কোনোরকম পরিচয় মেলেনি এখনও। তৃতীয়জনের স্বামী পেশায় ডাক্তার, তবে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। দু'মাস হলো তাদের ডিভোর্স হয়েছে।
মার্ডার কেইসের ব্যাপারে প্রত্যেককে সন্দেহের ভেতরে রাখা ঠিক বটে তবে সাব্বির শফিক সাহেব কিংবা গতরাতে খুন হওয়া মহিলার প্রাক্তন স্বামী ড. রাশেদের উপর সন্দেহ করতে পারছে না।
রাগারাগি করে শফিক সাহেব তার স্ত্রীকে যদিও খুন করে তবে রাশেদের স্ত্রীকে কেন খুন করবে? কিংবা ডিভোর্সের কারণে রাশেদ তার স্ত্রীকে খুন করলে শফিক সাহেবের স্ত্রীকে খুন কেন করবে?
এমনটা নয় যে খুনি অনেকজন, খুনি একজনই- একজন সাইকো।
ড. রাশেদের কাছে যাওয়ার পূর্বে সাব্বির শফিক সাহেবের বাসায় হাজির হয়। প্রশ্নের জালে ফাসাতে থাকে তাকে। গতকাল সে ছেলের ব্যাপারে মিথ্যা কেন বলেছিল এটাই বারবার জিজ্ঞাসা করে চলেছে সাব্বির। প্রথমে অস্বীকার করলেও যুক্তির কাছে হেরে যান শফিক সাহেব। রাগী মুখটা যেন মুহূর্তেই বদলে যায়। চুপ করে থাকেন তিনি। তার নিস্তব্ধতা ভাঙ্গাতে সাব্বির বলে ওঠে, "শফিক সাহেব, আপনি সত্য না বললে আমরা কখনওই পারবো না আপনার স্ত্রীর খুনিকে বের করতে।"
চোখ বড় হয়ে ওঠে শফিক সাহেবের। তিনি এখনও জানেন না তার স্ত্রী খুন হয়েছে। সাব্বির বুঝতে পারে সে মুখ ফসকে কী বলে ফেলেছে। নিস্তব্ধতা কাটিয়ে ওঠার পরিবর্তে আরও বেড়ে যায়। গলার রগগুলো টানটান হয়ে উঠেছে, দাঁতে দাঁত চেপে ধরেছেন শফিক সাহেব। চোখের পাতাদুটোও অবিরামহীনভাবে স্থীর হয়ে আছে। অধিক শোকে পাথর হয়ে যাওয়া যেটাকে বলে।
প্রেয়সীকে হারানোর কষ্ট সাব্বির অনুভব করতে পারে। কিছু সময়ের জন্য লিজার হাস্যজ্বল চেহারা ভেসে ওঠে তার সামনে। শফিক সাহেবের ভিতরে কী চলছে তা বুঝতে না পারলেও অনুভব করে ও।
এখানে বসে থাকবে, নাকি তার পাশে গিয়ে ঘাড়ে হাত রেখে শান্তনা দিবে, নাকি উঠে চলে যাবে ড. রাশেদের বাসায়- দ্বিধায় ভুগতে থাকে সাব্বির। কিন্তু পরক্ষণে তার দ্বিধা কাটিয়ে শফিক সাহেব নিজেই বলতে শুরু করেন, "আসলে আমাদের কোনো ছেলে নেই। ছেলে বলতে কোনো সন্তানও নেই..."- কণ্ঠে আর আগের মতো দৃঢ়তা নেই তার। নিশ্বাসের সাথে আটকে যাচ্ছে প্রতিটা কথা, "...বিয়ের এতগুলো বছর পার হয়ে গেল, না তো পারলাম বাবা ডাক শুনতে আর না তো আমার স্ত্রীকে পারলাম মা ডাক শোনাতে। ডক্টর বলেছে সমস্যা আমার মধ্যেই। আর এই নিয়েই প্রায় ঝগড়া হতো। তাকে বুঝানোর চেষ্টা করতাম যে এতে আমার কোনো হাত নেই। কিন্তু এতদিনেও মা ডাক শুনতে না পারার কষ্টে ও আমাকেই দোষারোপ করে যেত বারবার..." ঝাপসা চোখদুটো মুছে নেন একবার তিনি, "...সেদিনও এই নিয়েই ঝগড়া হয়েছিল। খুব বাজেভাবেই বকাঝকা করেছিলাম। এরপর সে রেগে বের হয়ে যায় বাসা থেকে। আর এরপর..."
আর বলতে পারছেন না তিনি, কণ্ঠে আটকে যাচ্ছে প্রতিটা কথা। সাব্বিরও জানে এরপর কী হয়েছিল। কিন্তু কীভাবে হয়েছিল এটা জানার অপেক্ষায় তারা প্রত্যেকেই।
শফিক সাহেব কিছুটা শান্ত হলে বিদায় নেয় সাব্বির, ড. রাশেদ সাহেবের সাথেও দেখা করতে হবে ওকে। প্রায় সন্ধ্যার দিকে থানায় ফিরে আসে। তাকে ফিরতে দেখেই ধড়ফড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে আনোয়ার, এতক্ষণ মনে হয় ওর জন্যই অপেক্ষা করছিল। এগিয়ে আসে সাব্বিরের দিকে। হাটতে হাটতেই সাব্বির জিজ্ঞাসা করে, "কী হয়েছে আনোয়ার ভাই? উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে খুব?"
"স্যার একটু আগে কেউ ফোন করে জানান যে শফিক সাহেবের লাশ পড়ে আছে ওনার বাসার সামনে! আমাদের এখনই যেতে হবে, আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।"
চেয়ারে প্রায় বসতে গিয়েও থেমে যায় সাব্বির। মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে কয়েক সেকেন্ড৷ ভাবতে থাকে এটা চতুর্থ নয় তো! কিন্তু খুনি যদি সাইকো হয় তবে তার শিকার তো মহিলা হওয়ার কথা, কোনো পুরুষ নয়।
চলবে...
Sayhan Ahmed
"মেয়েদের সন্ধ্যার পর কিংবা রাতে একা একা বাসা থেকে বের হওয়াকে আপনি কেমন মনে করেন আনোয়ার ভাই।"
"ঠিক নয়, একদমই নয়।"
"হুম! আগে ইজ্জত হারানোর ভয় থাকলেও এখন সাথে যুক্ত হয়েছে জান হারানোর ভয়।"
"কিন্তু স্যার খুনি তার উদ্দেশ্য বা মতিগতি কিছুই বুঝে উঠতে দিচ্ছে না। মাঝে মাঝে তো আমার এমনটাও মনে হচ্ছে যে খুনি ধর্ষণের পর এমন জঘন্যতম ভাবে খুনগুলো করেছে।"
"কিংবা খুনের পর ধর্ষণ..."- বলেই নিজের রানের উপর পরপর দু'বার থাবা মারে সে। আনোয়ার অবাক হয়, খুনের পর ধর্ষণ কথাটা সে ভালোভাবে হজম করতে পারেনি। ব্যাপারটি নাক সিটকানো কিংবা ভ্রু কুঁচকানোর মতো হলেও সাব্বির একনাগাড়ে বলে যেতে থাকে।
"...নেক্রোফিলিয়া সম্পর্কে জানেন কিছু?"
"খুবই কম, জানি না বললেই চলে। লাশের প্রতি ভালোবাসা বা আসক্তি এ টাইপের কিছু। তাই না?"
"আসক্তি তো বটে, যৌন-আসক্তি!"- কাঁধ ঝাকায় সাব্বির। আনোয়ার অবাক হয়ে তাকায় ওর দিকে।
"নেক্রোফিলিয়া, দু'টো গ্রীক শব্দের থেকে উঠে এসেছে। নেক্রোস অর্থ মৃত আর ফিলিয়া অর্থ ফ্রেন্ডশিপ কিংবা লাভ। মানে এটা দাঁড়ায়, মৃতব্যক্তির সাথে ভালোবাসা অনুভব করা। তবে মূল বিষয়টা ভিন্ন। মৃতদেহের প্রতি শারীরিক চাহিদাকেই মূলত নেক্রোফিলিয়া বলা হয়ে থাকে।"
এতক্ষণ বিমূঢ় হয়ে থাকা আনোয়ার চিন্তিত স্বরে না জিজ্ঞাসা করে পারে না, "নেক্রোফিলিয়া কি বেশ ছড়িয়ে গেছে নাকি এই সমাজে? বাংলাদেশেও চলে এসেছে এর প্র্যাক্টিস?"
"কিভাবে বলি?..."- গা মুচড়ে বলে সাব্বির "...ঘটনা তো আজকে শুরু না। হেরোডোটাসকে চেনেন তো?"
অবাক হয় আনোয়ার, "বিখ্যাত গ্রীক ইতিহাসবিদ তো? ও ব্যাটাও লাশ নিয়ে এসব করত নাকি?"
"পুরোটা শুনুন আগে। হেরোডোটাস নেক্রোফিলিয়াক ছিলেন না। উনি বলেছেন যে, ফারাওদের আমল থেকে চলে আসছে এটা। বা তারও আগে থেকে। তবে নির্ঘাত মিশরীয় সভ্যতার সময় রেগুলার নেক্রোফিলিয়াকের অভাব ছিল না।"
"ওটা আবার কী?"- ভ্রু কুঁচকায় এবার আনোয়ার।
"যারা রেগুলার লাশের সাথে মিলিত হতো। দৈনিক লাশ লাগবে তাদের। কোথায় বিয়ে-শাদি করে শান্তিতে থাকবে তা নয়, আছে লাশেদের সাথে মিলিত হওয়ার ধান্দায়।"
"যাই হোক, যেটা বলছিলাম- ফারাওদের ক্ষেত্রে যেটা করা হত- সম্ভ্রান্ত মহিলাদের মৃত্যুর পর তিন চারদিন লাশটাকে পঁচিয়ে মমি বানাতে পাঠানো হত। এটা তো জানেনই বটে ওই সময় মমি করাটা ছিল প্রথা..."
সাব্বিরের কথায় চোখ নিচে রেখে মাথা নাড়ায় আনোয়ার।
"...যদি টাটকা মৃতদেহ এলবামাদের কাছে দেওয়া হত তারা আগে সেই মহিলার মৃতদেহের ওপর চড়াও হত; পরে মমি বানানো। বোঝা যায় এরা রীতিমত নেক্রোফিলিয়ার প্র্যাকটিস করত তখন। হেরোডটাস শুধু এলবামাদের দোষ দেন নি; গ্রেকোরোমান সম্রাটদের প্রতিও রেখে গেছেন একই অভিযোগ। তারাও শবদেহের সাথে মিলিত হওয়ার চর্চা করতেন।"
আনোয়ারের শরীর কুঁচকে ওঠে, "সম্রাটরাও?"
চেয়ারে হেলান দিয়েই সাব্বির উত্তর দেয়, "সম্রাটরাও।"
আনোয়ারের চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে এখনই গালি ছুড়ে মারে কয়েকটা। কিন্তু সে এখন নীরব শ্রোতা, মনোযোগ দিয়ে শুনছে সাব্বিরের প্রতিটা কথা। "বাইজেন্টাইন সম্রাটরা তো আরও এক ধাপ এগিয়ে। ডাউন দ্য উইকেটে এসে ছক্কা মারা পাবলিক এরা। অন্য রাজ্যে হামলা করার পর তারা সেসব রাজ্যের রাজাদের হেরেম দখন করত নিঃসংকোচে। সেখানে থাকা মেয়েগুলোর রক্ত দিয়ে চৌবাচ্চা ভর্তি করে তা নিয়ে খেলত সম্রাট। তবে স্বীকার করতেই হবে, নেক্রোফিলিয়াকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে প্রাচীন মিশরীয়রা। এদের সম্ভ্রান্ত মহিলা আর সুন্দরী মেয়েদের মৃত্যুর পর ঘর থেকে লাশ বের করতেই কয়েকদিন অপেক্ষা করতে হত। নাহলে পাপাচারী পুরোহিত থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত লাশের সাথে দৈহিক সম্পর্ক করে যেত।"
"মিশর থেকেই কি এসেছে নাকি এটা, স্যার?" জানতে চায় আনোয়ার।
"তা ঠিক জানি না আনোয়ার ভাই। পরে রোমেও দেখা যায় এর প্রচলন। রোমান সম্রাট হেরড ছিল আরেক চিজ। হাসমোনিয়ান রাজ্য দখল করে ধ্বংসযজ্ঞ তো এই লোক চালিয়েছিলই। তারওপর ধরে এনেছিল রাজকুমারী মারিআন্নিকে। জোর করে বিয়ে করেছিল মেয়েটাকে এই পিশাচ সম্রাট। বিয়ে তো নাম মাত্র, শয্যা সঙ্গিনী বানানো আর কি! তবে মারিআন্নি রাজি হয় নি তাতে। প্রচন্ড ঘৃণা ছিল তার এই অত্যাচারী সম্রাটের প্রতি। রাজকুমারীর রাজ্য ভেঙ্গে এই লোকই তো তছনছ করেছিল। ঘৃণা থাকা তো অস্বাভাবিক না। ফলাফলটা ভালো হয় নি।"
"ফলাফল?"- উৎসুক চোখে জিজ্ঞাসা করে আনোয়ার।
"হেরড হত্যা করে মারিআন্নিকে। তবে ওটা কিছুই না। হেরডের এই অপকর্মের সবচেয়ে ট্রিকি পার্ট ছিল- রাসায়ানিকভাবে সে সাত বছর সংরক্ষণ করে মারিআন্নিকে। এই দীর্ঘ সাত বছর নিয়মিত হেরড যৌনকর্ম চালায় মৃত মারিআন্নির শরীরে ওপর।"
"অদ্ভুত রকমের পাগলামী। কিন্তু স্যার, তাদের কী উদ্দেশ্য ছিল এই রকম অপকর্মের পেছনে?"
"উদ্দেশ্য তো অনেক আছে। তবে এই কেইসের ব্যাপারে যেটা মাথায় এসেছিল- পূর্বের শত্রুতা বা বিদ্বেষ থেকে বিপরীত লিঙ্গের কাওকে খুন করে ফেলার পর খুনীর মনে পরিপূর্ণ বিজয়ের তৃপ্তি আসে না। চরমভাবে লাশটিকে পরাস্ত প্রমাণ করার জন্য শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হয়ে থাকে কিছু কিছু খুনী।"
"মানে এ খুনির সাথে এই তিনজন মহিলারই পূর্বশত্রুতা ছিল? যে কারণে খুন করে এরপর আবার লিপ্ত হয় দৈহিকভাবে?"
"এমনটা হতে পারে আনোয়ার ভাই। কিন্তু ডক্টরের ভাষ্যমতে লাশগুলোর সাথে এমন কিছু হয়েছিল কি না সেটা বলা অসম্ভব।"
"তবে স্যার, আপনার এসব কথাকে আমরা মেনে নেব কীভাবে?"
"শুধুমাত্র একটা সন্দেহ আনোয়ার ভাই, দ্বিতীয় কিছুই নয়। খুনির ব্যাপারে আমরা এখনও কোনো হদিস পাইনি। সাইকো পুরুষ কিংবা মহিলা উভয়ই হতে পারে। তাই এসব আমার সন্দেহ ছাড়া দ্বিতীয় কিছু নয়।"
আনোয়ার মাথা ঝাকায় কয়েকবার। সাব্বিরও চুপ থাকে কয়েক মুহূর্ত। আবার বলে ওঠে, "তবে খুনি নেক্রোফিলিয়াক হোক বা না হোক, অবশ্যই একজন সাইকো- এটা শতভাগ সত্য।"
দু'জনের নীরবতা ভেঙ্গে টেবিলে থাকা টেলিফোনটি আবারও বেজে ওঠে। দু'জনেই ফ্যালফ্যাল করে একে অন্যের দিকে তাকায়। কাঁপা হাতে ফোন উঠায় আনোয়ার। রিসিভ করেই যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে।ডক্টর আলফাজের ফোন, অন্য আরেকটা খুনের নিউজ নয়। কাল যে মহিলার খুন হলো তার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট জানাতে কল করেছেন।
সাব্বির অবাক হয় না মোটেই।
তিনটি খুন, তিনজনই মহিলা, তিনজনের বয়সই ত্রিশের কাছাকাছি। খুনি যে-ই হোক, এই বয়সের মহিলাদের উপর তার প্রচণ্ড ক্ষোভ ও ঘৃণা আছে এটা বুঝতে পারে সাব্বির। তাকে থামানো না গেলে হয়তো ধীরে ধীরে সুস্থ্য শহরটাকে মৃত্যুপুরী বানিয়ে ফেলবে সে।
প্রথম ভিক্টিমের কোনোরকম পরিচয় মেলেনি এখনও। তৃতীয়জনের স্বামী পেশায় ডাক্তার, তবে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। দু'মাস হলো তাদের ডিভোর্স হয়েছে।
মার্ডার কেইসের ব্যাপারে প্রত্যেককে সন্দেহের ভেতরে রাখা ঠিক বটে তবে সাব্বির শফিক সাহেব কিংবা গতরাতে খুন হওয়া মহিলার প্রাক্তন স্বামী ড. রাশেদের উপর সন্দেহ করতে পারছে না।
রাগারাগি করে শফিক সাহেব তার স্ত্রীকে যদিও খুন করে তবে রাশেদের স্ত্রীকে কেন খুন করবে? কিংবা ডিভোর্সের কারণে রাশেদ তার স্ত্রীকে খুন করলে শফিক সাহেবের স্ত্রীকে খুন কেন করবে?
এমনটা নয় যে খুনি অনেকজন, খুনি একজনই- একজন সাইকো।
ড. রাশেদের কাছে যাওয়ার পূর্বে সাব্বির শফিক সাহেবের বাসায় হাজির হয়। প্রশ্নের জালে ফাসাতে থাকে তাকে। গতকাল সে ছেলের ব্যাপারে মিথ্যা কেন বলেছিল এটাই বারবার জিজ্ঞাসা করে চলেছে সাব্বির। প্রথমে অস্বীকার করলেও যুক্তির কাছে হেরে যান শফিক সাহেব। রাগী মুখটা যেন মুহূর্তেই বদলে যায়। চুপ করে থাকেন তিনি। তার নিস্তব্ধতা ভাঙ্গাতে সাব্বির বলে ওঠে, "শফিক সাহেব, আপনি সত্য না বললে আমরা কখনওই পারবো না আপনার স্ত্রীর খুনিকে বের করতে।"
চোখ বড় হয়ে ওঠে শফিক সাহেবের। তিনি এখনও জানেন না তার স্ত্রী খুন হয়েছে। সাব্বির বুঝতে পারে সে মুখ ফসকে কী বলে ফেলেছে। নিস্তব্ধতা কাটিয়ে ওঠার পরিবর্তে আরও বেড়ে যায়। গলার রগগুলো টানটান হয়ে উঠেছে, দাঁতে দাঁত চেপে ধরেছেন শফিক সাহেব। চোখের পাতাদুটোও অবিরামহীনভাবে স্থীর হয়ে আছে। অধিক শোকে পাথর হয়ে যাওয়া যেটাকে বলে।
প্রেয়সীকে হারানোর কষ্ট সাব্বির অনুভব করতে পারে। কিছু সময়ের জন্য লিজার হাস্যজ্বল চেহারা ভেসে ওঠে তার সামনে। শফিক সাহেবের ভিতরে কী চলছে তা বুঝতে না পারলেও অনুভব করে ও।
এখানে বসে থাকবে, নাকি তার পাশে গিয়ে ঘাড়ে হাত রেখে শান্তনা দিবে, নাকি উঠে চলে যাবে ড. রাশেদের বাসায়- দ্বিধায় ভুগতে থাকে সাব্বির। কিন্তু পরক্ষণে তার দ্বিধা কাটিয়ে শফিক সাহেব নিজেই বলতে শুরু করেন, "আসলে আমাদের কোনো ছেলে নেই। ছেলে বলতে কোনো সন্তানও নেই..."- কণ্ঠে আর আগের মতো দৃঢ়তা নেই তার। নিশ্বাসের সাথে আটকে যাচ্ছে প্রতিটা কথা, "...বিয়ের এতগুলো বছর পার হয়ে গেল, না তো পারলাম বাবা ডাক শুনতে আর না তো আমার স্ত্রীকে পারলাম মা ডাক শোনাতে। ডক্টর বলেছে সমস্যা আমার মধ্যেই। আর এই নিয়েই প্রায় ঝগড়া হতো। তাকে বুঝানোর চেষ্টা করতাম যে এতে আমার কোনো হাত নেই। কিন্তু এতদিনেও মা ডাক শুনতে না পারার কষ্টে ও আমাকেই দোষারোপ করে যেত বারবার..." ঝাপসা চোখদুটো মুছে নেন একবার তিনি, "...সেদিনও এই নিয়েই ঝগড়া হয়েছিল। খুব বাজেভাবেই বকাঝকা করেছিলাম। এরপর সে রেগে বের হয়ে যায় বাসা থেকে। আর এরপর..."
আর বলতে পারছেন না তিনি, কণ্ঠে আটকে যাচ্ছে প্রতিটা কথা। সাব্বিরও জানে এরপর কী হয়েছিল। কিন্তু কীভাবে হয়েছিল এটা জানার অপেক্ষায় তারা প্রত্যেকেই।
শফিক সাহেব কিছুটা শান্ত হলে বিদায় নেয় সাব্বির, ড. রাশেদ সাহেবের সাথেও দেখা করতে হবে ওকে। প্রায় সন্ধ্যার দিকে থানায় ফিরে আসে। তাকে ফিরতে দেখেই ধড়ফড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে আনোয়ার, এতক্ষণ মনে হয় ওর জন্যই অপেক্ষা করছিল। এগিয়ে আসে সাব্বিরের দিকে। হাটতে হাটতেই সাব্বির জিজ্ঞাসা করে, "কী হয়েছে আনোয়ার ভাই? উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে খুব?"
"স্যার একটু আগে কেউ ফোন করে জানান যে শফিক সাহেবের লাশ পড়ে আছে ওনার বাসার সামনে! আমাদের এখনই যেতে হবে, আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।"
চেয়ারে প্রায় বসতে গিয়েও থেমে যায় সাব্বির। মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে কয়েক সেকেন্ড৷ ভাবতে থাকে এটা চতুর্থ নয় তো! কিন্তু খুনি যদি সাইকো হয় তবে তার শিকার তো মহিলা হওয়ার কথা, কোনো পুরুষ নয়।
চলবে...
Sayhan Ahmed
Hasibul hasan santo, Abul basar, Santa akter, Sk sagor, Sk imran, Raihan khan, Tanusri roi and লেখাটি পছন্দ করেছে
- Trimatraধুমকেতু
- Posts : 23
স্বর্ণমুদ্রা : 1434
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-06-05
Re: সাইকোপ্যাথ কিলার
Sat Jun 05, 2021 8:29 pm
৪র্থ ও শেষ পর্ব
"ভালোবেসে প্রেয়সীকে না পেলে আত্মহত্যা, নাকি পাওয়ার পর আবারও হারালে আত্মহত্যা- কোনটা বেশি কষ্টের হতে পারে আনোয়ার ভাই?"
"সম্ভবত দু'টোই।"
"না..."- গভীর এক দীর্ঘশ্বাস নিয়ে সাব্বির বলে, "...দ্বিতীয়টা। তবে কোনোটাই উচিত নয়। কিন্তু অত্যাধিক শক খেলে মস্তিষ্ক বিচারবুদ্ধি হারিয়ে ফেলে। এরপর হুট করেই করে ফেলে কোনো না কোনো ভুল।"- সামনে থাকা লাশটির দিকে তাকিয়ে বলে সাব্বির। আত্মহত্যা করেছেন শফিক সাহেব, ছাদ থেকে লাফিয়ে। লাশের পাশ থেকে রক্ত গড়িয়ে চলেছে এখনও।
_____
"স্যার, রাশেদ সাহেবের সাথে দেখা করে কী জানতে পারেন?"
"খুব বেশি কিছু নয়। তারা বিচ্ছিন্ন দু'মাস ধরেই। রাশেদ সাহেব তেমন কিছু না জানার পক্ষে অধিকার রাখে। শুধুমাত্র এটুকুই বলেছে, ডিভোর্সের পর ব্যক্তিগতভাবে একটা ফ্লাট ভাড়া নিয়েছে।"
"এখনও পর্যন্ত কোনো সূত্রই মিললো না! যদি আবারও কারো খুন করে বসে ঐ সাইকো?"
"সেটারই ভয় হচ্ছে আনোয়ার ভাই। সাইকোরা থেমে যাওয়ার পাত্র নয়, মানুষের মাঝে ভয়ের সৃষ্টি করে মজা নেওয়া পাবলিক এরা। আর এই খুনি তা সফলভাবেই করে চলেছে।"- টেবিলের উপর এক হাত রেখে আঙুলের আঘাত করতে করতে বলে সাব্বির।
"আচ্ছা স্যার, এমনটা তো নয় যে খুনি সন্ধ্যার পর এ বয়সী যাকে রাস্তায় পাচ্ছে তাকেই তুলে নিয়ে যাচ্ছে?"
"সন্ধ্যার পর এই শহরে এই বয়সী একজন মানুষ রাস্তায় থাকবে বলে আপনার মনে হয়?"
"তাহলে?"
"মনে হচ্ছে প্রত্যেক ভিক্টিমই তার পরিচিত কেউ, যে-কোনোভাবেই।"
কিছুক্ষণ চুপ থেকে সাব্বির উঠে দাঁড়ায়৷ টেবিলের উপর থেকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে বলে, "আমাদের আবারও যেতে হবে ড. রাশেদের কাছে। হতে পারে এর উত্তর তার থেকে পেয়ে যাব আমরা।"
শফিক সাহেবের দেওয়া তার স্ত্রীর ছবিটি সাথে নিতে ভুলে যায়নি ও। প্রথম যে মহিলা খুন হয় তার পরিচয় না মেলায় কোনো ছবিও নেই। তার লাশের পাশে থাকা পেইন্টিং এর একটা ছবি তুলেই রওনা হয় ওরা। ড. রাশেদের বাড়ি অনেকটা বাংলোর মতো। বেশ কামিয়েছেন বলতে হয়। তবে একা এত বড় একটা বাড়িতে কীভাবে সময় কাটে তা মাথায় আসে না সাব্বিরের।
"আবারও বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত রাশেদ সাহেব।"
"ব্যাপার না স্যার, বলুন কী সাহায্য করতে পারি?"
বেশি কথা বাড়াতে চায় না সাব্বির, হাতে একদমই সময় নেই। চতুর্থ কারো খুন করার আগেই খুনিকে ধরতে হবে তার। পকেট থেকে শফিক সাহেবের স্ত্রীর ছবিটা বের করে রাশেদকে দেখায়। কয়েক সেকেন্ড খুব মনোযোগ দিয়ে ছবিটা দেখে জানান যে তাকে এই সর্বপ্রথম দেখছেন তিনি।
সাব্বির আশাহত হয়ে চুপ করে থাকে কয়েক মুহূর্ত। পুনরায় মোবাইলটা বের করে প্রথম ভিক্টিমের পেইন্টিংটা দেখায় সে। এটাও ভালো করে লক্ষ করেও চিনতে পারে না বলে জানান ড. রাশেদ।
চলে যাওয়ার জন্য দরজার দিকে পা বাড়িয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ায় সাব্বির। জিজ্ঞাসা করে যে তার স্ত্রী পরবর্তীতে কোথায় ফ্লাট ভাড়া নেয় এটা সে জানে কি না। ঠিকানা দেন ড. রাশেদ। সাব্বিরের মুখে একটু হাসির ছাপ দেখা যায়।
দারোয়ানের থেকে জানতে সে জানতে পারে ড. রাশেদের স্ত্রী, অবন্তী- কততম ফ্লোরে থাকে। দরজা লক করা, চাবিও নেই তার কাছে। বাধ্য হয়ে তালা ভেঙ্গে ভেতরে ঢোকে সাব্বির। ঢুকতেই ড্রয়িং রুম, অনেক সুন্দরভাবে সাজানো। ড্রয়িং রুম থেকে শুরু করে সারা বাড়ির দেওয়ালে পেইন্টিং ভর্তি। সম্ভবত শখ ছিল তার পেইন্টিং এর।
পেইন্টিংগুলো খুটিয়ে দেখছে সাব্বির। প্রতিটা পেইন্টিং এর নিচে ইনিশিয়াল সাইন করা, অবন্তীরই হবে হয়তো। এটা স্বাভাবিক যে, প্রতিটা শিল্পী তার চিত্রের নিচে, সাধারণত ডান পাশে ইনিশিয়াল সাইন ব্যবহার করে থাকে। তবে একটা পেইন্টিং সে লক্ষ্য করে ভিন্ন সাইনের, আর তা বাম পাশে। মনে হচ্ছে সাইনটা সে দেখেছে আগে কোথাও৷
মস্তিষ্কের উপর চাপ ফেলে সাব্বির৷ মনে পড়েছে তার, খুন হওয়া তিনটি মহিলার লাশের সাথে পাওয়া পেইন্টিং এ। নিজেকে শতভাগ সত্য প্রমাণ করতে মোবাইলে প্রথম খুন হওয়া মহিলার সাথে পাওয়া যে পেইন্টিং এর ছবিটা তুলে এনেছিল সেটা বের করে- মিলে যাচ্ছে হুবহু। একই সাইন, ছবির বাম পাশে।
সাইনটি খুব মনোযোগ সহকারে লক্ষ্য করে সে বুঝতে পারে ওখানে DaD লেখা।
সাব্বির জানে না এর মানে কী হতে পারে। বেডরুম খুটিয়ে দেখার সময় বিছানার পাশে থাকা ছোট টেবিলটির উপরে থাকা একটি ছবির উপর তার চোখ আটকে যায়। দেখে মনে হচ্ছে স্বামী-স্ত্রী। কিন্তু ছবিতে অবন্তী পিছন থেকে যার গলা জড়িয়ে আছে তিনি মোটেও ড. রাশেদ নন। বিষয়টা অদ্ভুত, অন্য কোনো পুরুষের সাথে এভাবে ছবি তোলার কথা নয়। উপরের ফ্লোরে যায় সাব্বির, একটা দরজায় কলিং বেল বাজানোর কয়েক মিনিট পর একজন মহিলা এসে দরজাটি খোলেন। চোখ কচলাতে কচলাতে জিজ্ঞাসা করেন, "কে আপনারা?" মহিলার হাই তোলা আর চোখ কচলানো দেখে মনে হচ্ছে ঘুম থেকে উঠে এসেছে।
"বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত ম্যাম..."-ইতস্ততবোধ করে সাব্বির। "... আসলে একটা জরুরী বিষয় নিয়ে কথা বলার ছিল।"
"জ্বি?"
"আপনার নিচের ফ্লোরে যে মহিলা থাকেন উনি কি আপনার পরিচিত?"
"কে? সাহারা?"
"সাহারা নয় ম্যাম, অবন্তী।"
"কিন্তু নিচের ফ্লোরে তো সাহারা থাকে।"
অবাক হয় সাব্বির৷ কিন্তু ড. রাশেদ যে বলেছিলেন তার স্ত্রীর নাম অবন্তী? কয়েক সেকেন্ড নীরব থেকে অবন্তীর বেডরুমে পাওয়া ছবিটা দেখায় তাকে। মহিলা আবারও বলে, "এ তো সাহারা-ই। অবন্তী কেন হবে?"
সাব্বির আবারও অবাক হয়। তবে রাশেদ সাহেব মিথ্যা কেন বলেছিলেন তাকে এ বিষয়টা মাথায় আসে না ওর।
"আচ্ছা উনি কতদিন হলো এখানে আছেন?"
"প্রায় পাঁচ-ছয় মাসের মতো হলো। স্বামীর সাথে ডিভোর্সের পর সে এখানটা ভাড়া নেয়।"
পাঁচ-ছয় মাস? সাব্বির বারবার শক খেয়ে চলেছে। রাশেদ সাহেব বলেছিলেন দু'মাসের মতো হলো ডিভোর্স হয়েছে। এখন কার কথা বিশ্বাস করবে সে বুঝতে পারে না। এরপর আবারও ছবিটা দেখিয়ে পাশে থাকা লোকটির কথা জিজ্ঞাসা করতেই মহিলাটি বলেন, "ইনি সাহারার স্বামী, ড. মাহিন।"
মানে কী, এ মহিলার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে নাকি? সাহারা বা অবন্তী যে নামই হোক, ইনি তার স্বামী হলে ড. রাশেদ কে? সাব্বির আর কিছু জানতে চায় না। তবে সেখান থেকে প্রস্থান নেওয়ার আগে তাকে শফিক সাহেবের স্ত্রীর ছবি বের করে দেখায়। মহিলাটি চিনতে পারে, বলে যে, "ইনি তো একদিন পরপরই আসতেন। সাহারা আপার সাথেই কোনো এক ড্রয়িং একাডেমিতে যেতেন।"
চলে আসে সাব্বির, সোজা শফিক সাহেবের বাসায়। ঠিক যেটার প্রত্যাশা করেছিল সে, তার ঘরের দেওয়ালেও পেইন্টিং ঝুলানো। এর আগে এসব অতোটা লক্ষ্য করেনি ও। এমনটাও হতে পারে এই পেইন্টিং গুলো শফিক সাহেবের স্ত্রীর নিজ হাতে করা।
অঙ্ক মেলাতে থাকে সাব্বির, খুন হওয়া প্রতিটা মহিলা পরিচিত হবে অবশ্যই। আর যদি তারা পরিচিত-ই হয়, এবং তারা যদি একই সাথে একই একাডেমিতে ড্রয়িং শিখতে যায় তবে পরবর্তী যে মহিলা খুন হতে চলেছে সেও ঐ একাডেমিরই হবে৷ কিন্তু এ শহরে এই বয়সীর মহিলাদের ড্রয়িং শেখানোর মতো কোনো একাডেমি আছে বলে সাব্বিরের জানা নেই। আগে খুঁজে বের করতে হবে কোথায় এটা; আর এই DaD এর মানেই বা কী!
_____
"আনোয়ার ভাই, প্রতিটা নিউজ চ্যানেলে এই একাডেমি কিংবা এই DaD সম্পর্কে ব্রেকিং নিউজে দেখালে কি খুনি সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যাবে?"
"হয়তো পাওয়া যাবে স্যার, কিন্তু নিউজ তো খুনির চোখেও পড়তে পারে। এরপর সে নিজেকে গুটিয়ে নিলে তো আর খুঁজেই পাওয়া যাবে না তাকে।"
সাব্বির মাথা নাড়ায়। এ ব্যাপারে খুনিকে কোনোমতেই জানতে দেওয়া যাবে না। চেয়ারে হেলান দিয়ে কয়েক মিনিট ভাবতে থাকে সে।
একটু পরেই ধড়ফড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে সে৷
"আনোয়ার ভাই, প্রতিটা জেলার পুলিশ হেডকোয়ার্টারে জানান। পেইন্টিং টা মেইল করে যেন প্রতিটা থানায় পোঁছায়। তবে তা যেন শুধু পুলিশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।"
সারাদিন টেলিফোনের সামনে বসে অপেক্ষা করে সাব্বির। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ার পরেও এ ব্যাপারে কোনো খবর পায় না সে। সন্ধ্যার প্রায় এক ঘণ্টা বাদে আরেকটি কল আসে টেলিফোনে।
ওপাশ থেকে কেউ নিজের পরিচয় দিচ্ছে। ইনস্পেক্টর আফতাব, বলেন যে এই ইনিশিয়াল সাইনের পেইন্টিং এর সাথে পরিচিত তিনি।
সাব্বির উত্তেজিত হয়ে ওঠে বিষয়টা জানার জন্য।
"পাঁচ বছর আগে এমনই একটা কেইসের দায়িত্ব আমার কাঁধে পড়ে। এনায়েত কবির, আর্টিস্ট- খুব বেশি রাগী স্বভাবের ও গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। সারাদিনই প্রায় আঁকিবুঁকি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। তার স্ত্রী প্রচণ্ড বিরক্ত ছিল তার উপরে। কবিরের আচরণে তার মাঝে মাঝে মনে হতো ওর বিয়েই হয়নি। স্বামীর থেকে নূন্যতম অনুরাগ না পেয়ে জড়িয়ে পড়ে পরকীয়া প্রেমে। ফলাফল মোটেও ভালো হয়নি, কবির জেনে যায় এ ব্যাপারে। নিজের হাতেই খুন করার সিদ্ধান্ত নেয় তার স্ত্রীকে। চেয়ারের সাথে তারকাটা দিয়ে বেঁধে রেখে জীবন্ত অবস্থায় হাতে পায়ে একের পর এক পেরেক মারতে থাকে। তার স্ত্রী বুঝেছিল যন্ত্রণা কতো কঠিন হতে পারে। এখানেই ক্ষান্ত হয়নি কবির। তার স্ত্রীকে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র করে গলা থেকে নাভি পর্যন্ত চিরে ফেলে ও। না জানি আরও কতো যন্ত্রণা পোহাতে হয়েছিল তার! আর তার এই যন্ত্রণা মিশ্রিত চিৎকারের ছাপ সে নির্দয়তার সাথে পেইন্ট করতে থাকে। একের পর এক হৃদয় বিদারক চিৎকার যেন তার পেইন্টিং-কে আরও জীবন্ত করে তোলে।
ধরা পড়ে যায় কবির। পরবর্তীতে লাশের সাথে পেইন্টিংটিও উদ্ধার করে পুলিশ। যাতে এই ইনিশিয়াল সাইন, DaD লেখা ছিল। তবে সেটা বামপাশে নয়, ছিল ছবির ডানপাশে। আর এই DaD মানে সে বুঝিয়েছিল 'Death Apostle of the Deceiver' যার বাংলা মানে দাঁড়ায়, 'প্রতারকের মৃত্যুদূত'।"
একনাগাড়ে অপর পাশ থেকে বলে চলেন ইনস্পেক্টর আফতাব। সাব্বির এর পরবর্তীতে কী হয়েছিল জিজ্ঞাসা করে।
"রিমান্ডে নিয়ে তার ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল কেটে ফেলা হয়েছিল, তার এই নির্মমতার উপর প্রচণ্ড ঘৃণার থেকে। তারপর কোর্টে নেওয়ার আগে পুলিশ ভ্যান থেকে পালিয়ে যায় ও। এরপর থেকে আজ অব্দি তার কোনো খোঁজ পায়নি আমরা।"
এই শহরে এসে সে নতুনকরে আস্তানা করে নিয়েছে। ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল কেটে ফেলায় সে নতুন করে নিজেকে বা হাতি হিসেবে প্রস্তুত করে নিয়েছে এতদিনে। বিবাহিতা মহিলাদের প্রতি তার ক্ষোভের কারণের সূত্রপাত তার নিজের স্ত্রী। একে একে সকল বিষয়-ই বুঝতে পারে সাব্বির।
কিন্তু ও ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল কেটে ফেলা হাতটি দেখেছে কোথাও। খুব শক্তভাবে মনে করার চেষ্টা করে ও- করতে পারে, ড. রাশেদের হাত। তৎক্ষনাৎ বেরিয়ে পড়ে ওরা। এই রাতে বোধহয় সে অন্য কারোর খুন করতে ব্যস্ত।
ভেতর থেকে লক করা, মানে ও ভেতরেই আছে। বারবার কলিংবেল দেওয়ার পরেও দরজা খুলছে না দেখে ভেঙ্গে ঢোকে ওরা। সম্পূর্ণ বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেও কারো নিশানা পায় না কেউ। এতো বড় বাড়ি, একদম ফাঁকা। স্টোররুমে তিনটা রক্তমাখা ভাঙ্গা চেয়ার খুঁজে পায়, এগুলোর সাথে বেঁধেই হয়তো সে খুন করেছিল ঐ তিনজনের।
জীবিত অবস্থায় আঘাতগুলো করলে তো আর ভিক্টিম চুপ থাকবে না, অতএব এমন কোনো কক্ষে খুনগুলো করা হয়েছে যেখান থেকে বাইরে কোনো শব্দ আসে না আর ভিতরেও শব্দ পৌঁছায় না।
সাব্বির একবার বাইরে বেরিয়ে আসে। ঘরটির অন্য প্রান্ত পর্যন্ত হেঁটে প্রস্থ ঠাহর করে নেয়। আবারও ফিরে এসে দরজা থেকে শুরু করে শেষ প্রান্ত অব্দি মেপে নেয়। যেমনটা আন্দাজ করেছিল, ঘরের ভেতরের প্রস্থ কম৷ মানে এটাই, দেওয়ালের ওপাশে কম পড়ে যাওয়া প্রস্থটুকুর কক্ষের অবস্থান।
ছোট একটা বুকশেলফ সরিয়ে দরজা দেখতে পায় সাব্বির।
ভিতরে ঢুকেই অবাক হয় ও, চারপাশটা মোটা কাচ দিয়ে বেষ্টিত যাতে চিৎকারের সামান্য শব্দও বাইরে না বের হয়। বেচারা সবে হাত-পা বেঁধেছে চতুর্থ শিকারের। ওয়েলকাম জানায় সে এনায়েত কবিরকে।
_____
"বুঝলে আনোয়ার ভাই, এই কবির সাহেব অনেক বেশি বোকা।"
"কেন স্যার?"
"নিজের পরিচয় লুকিয়ে, নিজের চেহারাটাও বদলিয়ে ড. রাশেদ সেজেছিল বটে, তবে সাহারার মিথ্যা স্বামীর পরিচয় দিয়ে বেচারা সবথেকে বড় বোকামি করে।"- চেয়ারে বসে পা দুলাতে দুলাতে বলে সাব্বির।
"আমি এখনও বুঝলাম না স্যার, ও সাহারাকে নিজের স্ত্রী বলে কেন দাবি করেছিল।"
"ও ভেবেছিল এতে ওর দিকে সন্দেহের আঙুলটা যাবে না৷ সাহারা ম্যাডাম কবির সাহেবের কাছে অবন্তী কেন ছিল জানি না। হয়তো সাহারা নিজেই নাম গোপন রেখেছিল তার কাছে। তার স্বামী ডাক্তার ছিলেন ও তাদের ডিভোর্স হয়েছিল এ ব্যাপারটাকে মাথায় রেখে বৃথা সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করেন আমাদের কবির সাহেব। নিজেকে ডাক্তার পরিচয় দিয়ে ডিভোর্সের বিষয়টা ঠিক রেখে তার স্বামী বলে পরিচয় দেন আমাদের কাছে। আর এটাই তার সবথেকে বড় বোকামি..."- মৃদু হেসে নেয় সাব্বির। টেবিলের উপর হাতদুটো রেখে বলে, "...মিথ্যা পরিচয় দিয়েই ও নিজেকে সামনে নিয়ে আসে। অথচ সে নিজেকে গোপন রাখলে আমরা এখনও হয়তো তাকে খুঁজে পেতাম না।"
"বোকা"- আরেকবার তাচ্ছিল্যের হাসি দেয় সাব্বির।
সমাপ্ত
Sayhan Ahmed
"ভালোবেসে প্রেয়সীকে না পেলে আত্মহত্যা, নাকি পাওয়ার পর আবারও হারালে আত্মহত্যা- কোনটা বেশি কষ্টের হতে পারে আনোয়ার ভাই?"
"সম্ভবত দু'টোই।"
"না..."- গভীর এক দীর্ঘশ্বাস নিয়ে সাব্বির বলে, "...দ্বিতীয়টা। তবে কোনোটাই উচিত নয়। কিন্তু অত্যাধিক শক খেলে মস্তিষ্ক বিচারবুদ্ধি হারিয়ে ফেলে। এরপর হুট করেই করে ফেলে কোনো না কোনো ভুল।"- সামনে থাকা লাশটির দিকে তাকিয়ে বলে সাব্বির। আত্মহত্যা করেছেন শফিক সাহেব, ছাদ থেকে লাফিয়ে। লাশের পাশ থেকে রক্ত গড়িয়ে চলেছে এখনও।
_____
"স্যার, রাশেদ সাহেবের সাথে দেখা করে কী জানতে পারেন?"
"খুব বেশি কিছু নয়। তারা বিচ্ছিন্ন দু'মাস ধরেই। রাশেদ সাহেব তেমন কিছু না জানার পক্ষে অধিকার রাখে। শুধুমাত্র এটুকুই বলেছে, ডিভোর্সের পর ব্যক্তিগতভাবে একটা ফ্লাট ভাড়া নিয়েছে।"
"এখনও পর্যন্ত কোনো সূত্রই মিললো না! যদি আবারও কারো খুন করে বসে ঐ সাইকো?"
"সেটারই ভয় হচ্ছে আনোয়ার ভাই। সাইকোরা থেমে যাওয়ার পাত্র নয়, মানুষের মাঝে ভয়ের সৃষ্টি করে মজা নেওয়া পাবলিক এরা। আর এই খুনি তা সফলভাবেই করে চলেছে।"- টেবিলের উপর এক হাত রেখে আঙুলের আঘাত করতে করতে বলে সাব্বির।
"আচ্ছা স্যার, এমনটা তো নয় যে খুনি সন্ধ্যার পর এ বয়সী যাকে রাস্তায় পাচ্ছে তাকেই তুলে নিয়ে যাচ্ছে?"
"সন্ধ্যার পর এই শহরে এই বয়সী একজন মানুষ রাস্তায় থাকবে বলে আপনার মনে হয়?"
"তাহলে?"
"মনে হচ্ছে প্রত্যেক ভিক্টিমই তার পরিচিত কেউ, যে-কোনোভাবেই।"
কিছুক্ষণ চুপ থেকে সাব্বির উঠে দাঁড়ায়৷ টেবিলের উপর থেকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে বলে, "আমাদের আবারও যেতে হবে ড. রাশেদের কাছে। হতে পারে এর উত্তর তার থেকে পেয়ে যাব আমরা।"
শফিক সাহেবের দেওয়া তার স্ত্রীর ছবিটি সাথে নিতে ভুলে যায়নি ও। প্রথম যে মহিলা খুন হয় তার পরিচয় না মেলায় কোনো ছবিও নেই। তার লাশের পাশে থাকা পেইন্টিং এর একটা ছবি তুলেই রওনা হয় ওরা। ড. রাশেদের বাড়ি অনেকটা বাংলোর মতো। বেশ কামিয়েছেন বলতে হয়। তবে একা এত বড় একটা বাড়িতে কীভাবে সময় কাটে তা মাথায় আসে না সাব্বিরের।
"আবারও বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত রাশেদ সাহেব।"
"ব্যাপার না স্যার, বলুন কী সাহায্য করতে পারি?"
বেশি কথা বাড়াতে চায় না সাব্বির, হাতে একদমই সময় নেই। চতুর্থ কারো খুন করার আগেই খুনিকে ধরতে হবে তার। পকেট থেকে শফিক সাহেবের স্ত্রীর ছবিটা বের করে রাশেদকে দেখায়। কয়েক সেকেন্ড খুব মনোযোগ দিয়ে ছবিটা দেখে জানান যে তাকে এই সর্বপ্রথম দেখছেন তিনি।
সাব্বির আশাহত হয়ে চুপ করে থাকে কয়েক মুহূর্ত। পুনরায় মোবাইলটা বের করে প্রথম ভিক্টিমের পেইন্টিংটা দেখায় সে। এটাও ভালো করে লক্ষ করেও চিনতে পারে না বলে জানান ড. রাশেদ।
চলে যাওয়ার জন্য দরজার দিকে পা বাড়িয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ায় সাব্বির। জিজ্ঞাসা করে যে তার স্ত্রী পরবর্তীতে কোথায় ফ্লাট ভাড়া নেয় এটা সে জানে কি না। ঠিকানা দেন ড. রাশেদ। সাব্বিরের মুখে একটু হাসির ছাপ দেখা যায়।
দারোয়ানের থেকে জানতে সে জানতে পারে ড. রাশেদের স্ত্রী, অবন্তী- কততম ফ্লোরে থাকে। দরজা লক করা, চাবিও নেই তার কাছে। বাধ্য হয়ে তালা ভেঙ্গে ভেতরে ঢোকে সাব্বির। ঢুকতেই ড্রয়িং রুম, অনেক সুন্দরভাবে সাজানো। ড্রয়িং রুম থেকে শুরু করে সারা বাড়ির দেওয়ালে পেইন্টিং ভর্তি। সম্ভবত শখ ছিল তার পেইন্টিং এর।
পেইন্টিংগুলো খুটিয়ে দেখছে সাব্বির। প্রতিটা পেইন্টিং এর নিচে ইনিশিয়াল সাইন করা, অবন্তীরই হবে হয়তো। এটা স্বাভাবিক যে, প্রতিটা শিল্পী তার চিত্রের নিচে, সাধারণত ডান পাশে ইনিশিয়াল সাইন ব্যবহার করে থাকে। তবে একটা পেইন্টিং সে লক্ষ্য করে ভিন্ন সাইনের, আর তা বাম পাশে। মনে হচ্ছে সাইনটা সে দেখেছে আগে কোথাও৷
মস্তিষ্কের উপর চাপ ফেলে সাব্বির৷ মনে পড়েছে তার, খুন হওয়া তিনটি মহিলার লাশের সাথে পাওয়া পেইন্টিং এ। নিজেকে শতভাগ সত্য প্রমাণ করতে মোবাইলে প্রথম খুন হওয়া মহিলার সাথে পাওয়া যে পেইন্টিং এর ছবিটা তুলে এনেছিল সেটা বের করে- মিলে যাচ্ছে হুবহু। একই সাইন, ছবির বাম পাশে।
সাইনটি খুব মনোযোগ সহকারে লক্ষ্য করে সে বুঝতে পারে ওখানে DaD লেখা।
সাব্বির জানে না এর মানে কী হতে পারে। বেডরুম খুটিয়ে দেখার সময় বিছানার পাশে থাকা ছোট টেবিলটির উপরে থাকা একটি ছবির উপর তার চোখ আটকে যায়। দেখে মনে হচ্ছে স্বামী-স্ত্রী। কিন্তু ছবিতে অবন্তী পিছন থেকে যার গলা জড়িয়ে আছে তিনি মোটেও ড. রাশেদ নন। বিষয়টা অদ্ভুত, অন্য কোনো পুরুষের সাথে এভাবে ছবি তোলার কথা নয়। উপরের ফ্লোরে যায় সাব্বির, একটা দরজায় কলিং বেল বাজানোর কয়েক মিনিট পর একজন মহিলা এসে দরজাটি খোলেন। চোখ কচলাতে কচলাতে জিজ্ঞাসা করেন, "কে আপনারা?" মহিলার হাই তোলা আর চোখ কচলানো দেখে মনে হচ্ছে ঘুম থেকে উঠে এসেছে।
"বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত ম্যাম..."-ইতস্ততবোধ করে সাব্বির। "... আসলে একটা জরুরী বিষয় নিয়ে কথা বলার ছিল।"
"জ্বি?"
"আপনার নিচের ফ্লোরে যে মহিলা থাকেন উনি কি আপনার পরিচিত?"
"কে? সাহারা?"
"সাহারা নয় ম্যাম, অবন্তী।"
"কিন্তু নিচের ফ্লোরে তো সাহারা থাকে।"
অবাক হয় সাব্বির৷ কিন্তু ড. রাশেদ যে বলেছিলেন তার স্ত্রীর নাম অবন্তী? কয়েক সেকেন্ড নীরব থেকে অবন্তীর বেডরুমে পাওয়া ছবিটা দেখায় তাকে। মহিলা আবারও বলে, "এ তো সাহারা-ই। অবন্তী কেন হবে?"
সাব্বির আবারও অবাক হয়। তবে রাশেদ সাহেব মিথ্যা কেন বলেছিলেন তাকে এ বিষয়টা মাথায় আসে না ওর।
"আচ্ছা উনি কতদিন হলো এখানে আছেন?"
"প্রায় পাঁচ-ছয় মাসের মতো হলো। স্বামীর সাথে ডিভোর্সের পর সে এখানটা ভাড়া নেয়।"
পাঁচ-ছয় মাস? সাব্বির বারবার শক খেয়ে চলেছে। রাশেদ সাহেব বলেছিলেন দু'মাসের মতো হলো ডিভোর্স হয়েছে। এখন কার কথা বিশ্বাস করবে সে বুঝতে পারে না। এরপর আবারও ছবিটা দেখিয়ে পাশে থাকা লোকটির কথা জিজ্ঞাসা করতেই মহিলাটি বলেন, "ইনি সাহারার স্বামী, ড. মাহিন।"
মানে কী, এ মহিলার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে নাকি? সাহারা বা অবন্তী যে নামই হোক, ইনি তার স্বামী হলে ড. রাশেদ কে? সাব্বির আর কিছু জানতে চায় না। তবে সেখান থেকে প্রস্থান নেওয়ার আগে তাকে শফিক সাহেবের স্ত্রীর ছবি বের করে দেখায়। মহিলাটি চিনতে পারে, বলে যে, "ইনি তো একদিন পরপরই আসতেন। সাহারা আপার সাথেই কোনো এক ড্রয়িং একাডেমিতে যেতেন।"
চলে আসে সাব্বির, সোজা শফিক সাহেবের বাসায়। ঠিক যেটার প্রত্যাশা করেছিল সে, তার ঘরের দেওয়ালেও পেইন্টিং ঝুলানো। এর আগে এসব অতোটা লক্ষ্য করেনি ও। এমনটাও হতে পারে এই পেইন্টিং গুলো শফিক সাহেবের স্ত্রীর নিজ হাতে করা।
অঙ্ক মেলাতে থাকে সাব্বির, খুন হওয়া প্রতিটা মহিলা পরিচিত হবে অবশ্যই। আর যদি তারা পরিচিত-ই হয়, এবং তারা যদি একই সাথে একই একাডেমিতে ড্রয়িং শিখতে যায় তবে পরবর্তী যে মহিলা খুন হতে চলেছে সেও ঐ একাডেমিরই হবে৷ কিন্তু এ শহরে এই বয়সীর মহিলাদের ড্রয়িং শেখানোর মতো কোনো একাডেমি আছে বলে সাব্বিরের জানা নেই। আগে খুঁজে বের করতে হবে কোথায় এটা; আর এই DaD এর মানেই বা কী!
_____
"আনোয়ার ভাই, প্রতিটা নিউজ চ্যানেলে এই একাডেমি কিংবা এই DaD সম্পর্কে ব্রেকিং নিউজে দেখালে কি খুনি সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যাবে?"
"হয়তো পাওয়া যাবে স্যার, কিন্তু নিউজ তো খুনির চোখেও পড়তে পারে। এরপর সে নিজেকে গুটিয়ে নিলে তো আর খুঁজেই পাওয়া যাবে না তাকে।"
সাব্বির মাথা নাড়ায়। এ ব্যাপারে খুনিকে কোনোমতেই জানতে দেওয়া যাবে না। চেয়ারে হেলান দিয়ে কয়েক মিনিট ভাবতে থাকে সে।
একটু পরেই ধড়ফড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে সে৷
"আনোয়ার ভাই, প্রতিটা জেলার পুলিশ হেডকোয়ার্টারে জানান। পেইন্টিং টা মেইল করে যেন প্রতিটা থানায় পোঁছায়। তবে তা যেন শুধু পুলিশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।"
সারাদিন টেলিফোনের সামনে বসে অপেক্ষা করে সাব্বির। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ার পরেও এ ব্যাপারে কোনো খবর পায় না সে। সন্ধ্যার প্রায় এক ঘণ্টা বাদে আরেকটি কল আসে টেলিফোনে।
ওপাশ থেকে কেউ নিজের পরিচয় দিচ্ছে। ইনস্পেক্টর আফতাব, বলেন যে এই ইনিশিয়াল সাইনের পেইন্টিং এর সাথে পরিচিত তিনি।
সাব্বির উত্তেজিত হয়ে ওঠে বিষয়টা জানার জন্য।
"পাঁচ বছর আগে এমনই একটা কেইসের দায়িত্ব আমার কাঁধে পড়ে। এনায়েত কবির, আর্টিস্ট- খুব বেশি রাগী স্বভাবের ও গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। সারাদিনই প্রায় আঁকিবুঁকি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। তার স্ত্রী প্রচণ্ড বিরক্ত ছিল তার উপরে। কবিরের আচরণে তার মাঝে মাঝে মনে হতো ওর বিয়েই হয়নি। স্বামীর থেকে নূন্যতম অনুরাগ না পেয়ে জড়িয়ে পড়ে পরকীয়া প্রেমে। ফলাফল মোটেও ভালো হয়নি, কবির জেনে যায় এ ব্যাপারে। নিজের হাতেই খুন করার সিদ্ধান্ত নেয় তার স্ত্রীকে। চেয়ারের সাথে তারকাটা দিয়ে বেঁধে রেখে জীবন্ত অবস্থায় হাতে পায়ে একের পর এক পেরেক মারতে থাকে। তার স্ত্রী বুঝেছিল যন্ত্রণা কতো কঠিন হতে পারে। এখানেই ক্ষান্ত হয়নি কবির। তার স্ত্রীকে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র করে গলা থেকে নাভি পর্যন্ত চিরে ফেলে ও। না জানি আরও কতো যন্ত্রণা পোহাতে হয়েছিল তার! আর তার এই যন্ত্রণা মিশ্রিত চিৎকারের ছাপ সে নির্দয়তার সাথে পেইন্ট করতে থাকে। একের পর এক হৃদয় বিদারক চিৎকার যেন তার পেইন্টিং-কে আরও জীবন্ত করে তোলে।
ধরা পড়ে যায় কবির। পরবর্তীতে লাশের সাথে পেইন্টিংটিও উদ্ধার করে পুলিশ। যাতে এই ইনিশিয়াল সাইন, DaD লেখা ছিল। তবে সেটা বামপাশে নয়, ছিল ছবির ডানপাশে। আর এই DaD মানে সে বুঝিয়েছিল 'Death Apostle of the Deceiver' যার বাংলা মানে দাঁড়ায়, 'প্রতারকের মৃত্যুদূত'।"
একনাগাড়ে অপর পাশ থেকে বলে চলেন ইনস্পেক্টর আফতাব। সাব্বির এর পরবর্তীতে কী হয়েছিল জিজ্ঞাসা করে।
"রিমান্ডে নিয়ে তার ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল কেটে ফেলা হয়েছিল, তার এই নির্মমতার উপর প্রচণ্ড ঘৃণার থেকে। তারপর কোর্টে নেওয়ার আগে পুলিশ ভ্যান থেকে পালিয়ে যায় ও। এরপর থেকে আজ অব্দি তার কোনো খোঁজ পায়নি আমরা।"
এই শহরে এসে সে নতুনকরে আস্তানা করে নিয়েছে। ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল কেটে ফেলায় সে নতুন করে নিজেকে বা হাতি হিসেবে প্রস্তুত করে নিয়েছে এতদিনে। বিবাহিতা মহিলাদের প্রতি তার ক্ষোভের কারণের সূত্রপাত তার নিজের স্ত্রী। একে একে সকল বিষয়-ই বুঝতে পারে সাব্বির।
কিন্তু ও ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল কেটে ফেলা হাতটি দেখেছে কোথাও। খুব শক্তভাবে মনে করার চেষ্টা করে ও- করতে পারে, ড. রাশেদের হাত। তৎক্ষনাৎ বেরিয়ে পড়ে ওরা। এই রাতে বোধহয় সে অন্য কারোর খুন করতে ব্যস্ত।
ভেতর থেকে লক করা, মানে ও ভেতরেই আছে। বারবার কলিংবেল দেওয়ার পরেও দরজা খুলছে না দেখে ভেঙ্গে ঢোকে ওরা। সম্পূর্ণ বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেও কারো নিশানা পায় না কেউ। এতো বড় বাড়ি, একদম ফাঁকা। স্টোররুমে তিনটা রক্তমাখা ভাঙ্গা চেয়ার খুঁজে পায়, এগুলোর সাথে বেঁধেই হয়তো সে খুন করেছিল ঐ তিনজনের।
জীবিত অবস্থায় আঘাতগুলো করলে তো আর ভিক্টিম চুপ থাকবে না, অতএব এমন কোনো কক্ষে খুনগুলো করা হয়েছে যেখান থেকে বাইরে কোনো শব্দ আসে না আর ভিতরেও শব্দ পৌঁছায় না।
সাব্বির একবার বাইরে বেরিয়ে আসে। ঘরটির অন্য প্রান্ত পর্যন্ত হেঁটে প্রস্থ ঠাহর করে নেয়। আবারও ফিরে এসে দরজা থেকে শুরু করে শেষ প্রান্ত অব্দি মেপে নেয়। যেমনটা আন্দাজ করেছিল, ঘরের ভেতরের প্রস্থ কম৷ মানে এটাই, দেওয়ালের ওপাশে কম পড়ে যাওয়া প্রস্থটুকুর কক্ষের অবস্থান।
ছোট একটা বুকশেলফ সরিয়ে দরজা দেখতে পায় সাব্বির।
ভিতরে ঢুকেই অবাক হয় ও, চারপাশটা মোটা কাচ দিয়ে বেষ্টিত যাতে চিৎকারের সামান্য শব্দও বাইরে না বের হয়। বেচারা সবে হাত-পা বেঁধেছে চতুর্থ শিকারের। ওয়েলকাম জানায় সে এনায়েত কবিরকে।
_____
"বুঝলে আনোয়ার ভাই, এই কবির সাহেব অনেক বেশি বোকা।"
"কেন স্যার?"
"নিজের পরিচয় লুকিয়ে, নিজের চেহারাটাও বদলিয়ে ড. রাশেদ সেজেছিল বটে, তবে সাহারার মিথ্যা স্বামীর পরিচয় দিয়ে বেচারা সবথেকে বড় বোকামি করে।"- চেয়ারে বসে পা দুলাতে দুলাতে বলে সাব্বির।
"আমি এখনও বুঝলাম না স্যার, ও সাহারাকে নিজের স্ত্রী বলে কেন দাবি করেছিল।"
"ও ভেবেছিল এতে ওর দিকে সন্দেহের আঙুলটা যাবে না৷ সাহারা ম্যাডাম কবির সাহেবের কাছে অবন্তী কেন ছিল জানি না। হয়তো সাহারা নিজেই নাম গোপন রেখেছিল তার কাছে। তার স্বামী ডাক্তার ছিলেন ও তাদের ডিভোর্স হয়েছিল এ ব্যাপারটাকে মাথায় রেখে বৃথা সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করেন আমাদের কবির সাহেব। নিজেকে ডাক্তার পরিচয় দিয়ে ডিভোর্সের বিষয়টা ঠিক রেখে তার স্বামী বলে পরিচয় দেন আমাদের কাছে। আর এটাই তার সবথেকে বড় বোকামি..."- মৃদু হেসে নেয় সাব্বির। টেবিলের উপর হাতদুটো রেখে বলে, "...মিথ্যা পরিচয় দিয়েই ও নিজেকে সামনে নিয়ে আসে। অথচ সে নিজেকে গোপন রাখলে আমরা এখনও হয়তো তাকে খুঁজে পেতাম না।"
"বোকা"- আরেকবার তাচ্ছিল্যের হাসি দেয় সাব্বির।
সমাপ্ত
Sayhan Ahmed
Hasibul hasan santo, Abul basar, Santa akter, Sk sagor, Sk imran, Raihan khan, Tanusri roi and লেখাটি পছন্দ করেছে
Permissions in this forum:
You cannot reply to topics in this forum