- Trimatraধুমকেতু
- Posts : 23
স্বর্ণমুদ্রা : 1434
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-06-05
ডেথ লেটার
Sat Jun 05, 2021 8:30 pm
১ম পর্ব
তোয়ালে দিয়ে মাথার কোঁকড়ানো চুলগুলো মুছতে মুছতে বাথরুম থেকে বেরুতেই কলিং বেলের টুং টাং শব্দ। সবেমাত্র গোসল শেষ হয়েছে। পরনে শুধুমাত্র একটি থ্রি-কোয়ার্টার। এ অবস্থায় দরজা খুলতে যাওয়াটা বোকামি। কী জানে কে এসেছে এই অবেলায়। হলুদ টি-শার্টটি গায়ে চড়িয়ে দরজার লুকিং গ্লাস দিয়ে উঁকি মারে। শাড়ি পরিহিতা একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে। বয়স পঁচিশ কি ছাব্বিশের মতো। মুখটা নতুন আয়ানের কাছে। দরজা খুললেই মেয়েটি জিজ্ঞাসা করে, "জনাব আয়ান রাফিদ?"
মাথা নেড়ে হ্যাঁ-সূচক জবাব দেয় আয়ান। ভেতরে আসার অনুমতি নেয় মেয়েটা।
তাকে সোফায় বসিয়ে বেডরুম থেকে ঘড়ি আর চশমাটা নিয়ে আসে আয়ান। যদিও চশমা ছাড়াই সে স্পষ্ট দেখতে পায়, মাথাব্যাথার জন্য ব্যবহার করতে হয়।
"আমি নেহা আনজুম আর আমার বোন ফাবিহা আনজুম। বোনের কথা এজন্য বলছি কারণ সমস্যাটি তাকে নিয়েই।"
আয়ান কিছু বলার আগেই নেহা তার হাতে থাকা থামটি থেকে একটা কাগজ বের করে আয়ানের দিকে বাড়িয়ে দেয়।
"আজ সকালেই পেয়েছি এটা। ফাবিহার রুমে।"
"চলে এসো প্রিয়, একা থাকতে ভয় করছে আমার।"- কাগজটিতে থাকা বাক্যটি জোরে জোরে পড়ে আয়ান।
"বুঝতে পারছি না যে এটা কে ফেলে গিয়েছে।"
"মিস নেহা!..."- চশমাটি খুলে টি-শার্ট দিয়ে মুছে আবারও চোখে দেয় আয়ান, "... আপনি অবশ্যই এটা জানেন যে আমি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট, কোনো গোয়েন্দা নই। আমার মনে হয় আপনি ভুল জায়গায় এসেছেন।"
"ও তাই?"- মাথা কিঞ্চিৎ বাকিয়ে প্রশ্ন করে নেহা।
"আলবাত!"
"কিন্তু আমার একদমই তা মনে হচ্ছে না।"
"আশা করি 'কেন?' এর উত্তরটা দিবেন।"
"অবশ্যই! আমি এখানে এই উড়োচিঠির পিছে গোয়েন্দা লাগানোর জন্য আসিনি। প্রথমেই বলেছি সমস্যাটা আমার বোনকে ঘিরে..."- একটু নড়েচড়ে বসে নেহা, "...ও একটা মানসিক রোগী।"
"মানসিক রোগী? আপনি এতটা শক্ত করে কীভাবে বলতে পারেন?"
"আবোলতাবোল বকে সবসময়, কথা বলে একা একা। মাঝেমধ্যে আঙুলের ইশারায় কাউকে দেখাতে চায় অথচ আমি দেখতে পাই না কিছুই।"
সোফার হাতলে ডান হাতটির কনুই রেখে মুঠের উপর চোয়ালের ভর রাখে আয়ান। কয়েক সেকেন্ড বাদে আবার সোজা হয়ে বসে। জিজ্ঞাসা করে, "কতদিন ধরে এ সমস্যা?"
"তিন চারদিন হবে।"
আয়ান দ্বিতীয় প্রশ্ন করার আগে নেহা আবারও বলে ওঠে, "আমি চাচ্ছি আপনি একবার আমার সাথে এসে তাকে দেখে যান- যদি আপনার হাতে এখন সময় থাকে তো।"
আয়ান রাজি হয়। কোনরকমে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ে তারা। রাস্তায় থাকা একটি প্রাইভেট কারের দিকে এগিয়ে যায় নেহা। আয়ান বুঝতে পারে এটা তারই গাড়ি। বেশ বড়লোক ঘরের মনে হচ্ছে।
পৌঁছেই বাড়ির মেইন গেইট খোলা পায় নেহা। খানিক দ্রুততার সাথে ভেতরে ঢুকে উপরের তলার একটি কক্ষের দিকে এগিয়ে যায় সে, আয়ান তার সাথে সাথে এগোচ্ছে। ভেতরে ঢুকেই হতভম্ব হয়ে যায় দু'জনেই। ফ্যানের সাথে ঝুলছে ফাবিহার লাশ। আত্মহত্যা মনে হচ্ছে। নেহা ধপাস করেই বসে পড়ে ফ্লোরে। আয়ান পুলিশে ফোন দেয়।
দশ থেকে পনেরো মিনিটের মাথায় পুলিশ পোঁছে যায় সেখানে। লাশের চারপাশে একবার ঘুরে দেখার পর নিচে নামাতে বলেন একজন পুলিশ। আয়ান তার পোশাকে থাকা নামটি পড়ে নেয়- 'ইশতিয়াক'।
আয়ান দুপুরে তার বাড়িতে নেহার যাওয়া থেকে শুরু করে এখানে পোঁছানো পর্যন্ত বলে তাকে। নেহা পুরপুরি স্তব্ধ হয়ে আছে।
টেবিলে থাকা একটি ছবিতে চোখ পড়ে ইশতিয়াকের। ফাবিহার সাথে কোনো ছেলের ছবি। নেহাকে জিজ্ঞাসা করলে বলে যে, "ওর নাম সাদাত, ফাবিহার সাথে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল ওর। কিন্তু সাদাতের মানসিক সমস্যা থাকায় বিয়েটি আটকে দেয় ফাবিহা।"
"মানসিক সমস্যা?"- আয়ান প্রশ্ন করে।
"হ্যাঁ, ও সিজোফ্রেনিয়ার রোগী। আমার তো সন্দেহ হচ্ছে ওর থেকে ফাবিহারও এই রোগ সংক্রমণ হলো কি না!"
"সিজোফ্রেনিয়া সংক্রামক রোগ না।"- আয়ানের বক্তব্য।
"জানি আমি। তবুও।..."- একটু থেমে আবারও নেহা বলা শুরু করে, "...সাদাতকে না জানানোই ঠিক হবে, ফাবিহার সুইসাইডের ব্যাপারে। নাহলে ওর অবস্থা আরও বেগতিক হয়ে উঠবে।"
নেহার কথা শেষ হতে না হতেই ছবিতে থাকা লোকটি সশরীরে রুমে প্রবেশ করে৷ চোখেমুখে উৎকণ্ঠার ছাপ। সম্ভবত জেনে গিয়েছে এ ব্যাপারে।
নেহা কান্না করছে না, তবে তার মুখটা ফ্যাকাশে- লক্ষ্য করে আয়ান।
ফাবিহার লাশের দিকে একনজরে চেয়ে আছে সাদাত। এখন পর্যন্ত মুখ দিয়ে কোনো শব্দই উচ্চারণ করেনি। মনে হচ্ছে যেন গলা ভারি হয়ে উঠেছে তার, কণ্ঠ পর্যন্ত এসেও শব্দ যেন আটকে আছে।
লাশটিকে পোস্টমর্টেমের জন্য পাঠানো হয়। প্রস্থান নেন ইশতিয়াকসহ অন্য পুলিশেরা। আয়ানও বেরিয়ে পড়ে।
_____
মাঝপথে খারাপ করেছে সাদাতের গাড়িটি। সিএনজি নিতে চাচ্ছিল সে। না পেয়ে বাধ্য হয়েই সে লোকাল বাসে ওঠে। বাসের মাঝামাঝিতে জানালার পাশে ফাঁকা সিট পেয়েই বসে পড়ে। তার পাশের সিটটাও ফাঁকা। বাসে অনেকগুলো সিটই শূন্য হয়ে পড়ে আছে। জানালা দিয়ে সোডিয়ামের আলোয় ভর্তি ব্যস্ত রাস্তার দৃশ্য অবলোকন করছে সাদাত। কিছু সময় বাদ তার মনে হলো পাশে কেউ বসেছে। একবার ঘুরে দেখে আবারও জানালার বাইরে তাকায়। হঠাৎ অবাক হয়ে ওঠে সে, মনে হচ্ছে যেন তাকেই দেখেছে। আবারও পাশের সিটে তাকায়। ফাবিহা! চোখ কপালে উঠে যায় সাদাতের। ভয়ে চিৎকারের উদ্বেগ তৈরি হতেই তার মুখ চেপে ধরে ফাবিহা। আবারও শান্ত হয়ে যায় সাদাত। বিচলিত কন্ঠে প্রশ্ন করে, "ফাবিহা তুমি এখানে কীভাবে? তুমি না বিগত তিন দিন পূর্বেই আত্মহত্যা করলে?"
"কে বললো আত্মহত্যা করেছি? করলে কি আমাকে এখানে দেখতে পেতে তোমার পাশে?"- মুচকি হাসে ফাবিহা।
বাসের অন্য যাত্রীরা সাদাতকে অবাক চোখে দেখছে। এখানে এভাবে ড্যাবড্যাব করে দেখার কী হলো বুঝতে পারে না সে।
তাদের দৃষ্টিকে তোয়াক্কা না করে আবার প্রশ্ন তোলে, "তাহলে সেদিন ওটা কে ছিল?"
"আহা! বাদ দাও না। আমাকে তো পেয়েছ-ই। তাহলে আবার অতো প্রশ্ন করছো কেন?"
সাদাত মাথা নাড়ায়। চোখেমুখে উজ্জ্বলতা ভেসে উঠেছে। ফাবিহা তার সাথে যেতে চায়। সাদাত না করে না।
বাস থেকে নেমে বাসার দিকে হাঁটতে শুরু করে দু'জনে। পৌঁছে হাতমুখ ধুয়ে নেয়। সাদাত কফি করে নিয়ে আসে।
ড্রয়িং রুমে বসেই কথা বলছে ওরা। মগের মধ্যে থাকা গরম কফির ধোঁয়া পেয়ে সাদাতের চশমাটা সাদা হয়ে যাচ্ছে। ফাবিহা আগেই শেষ করে ফেলে, মগটা রেখে দেয় সামনের টি-টেবিলে। সাদাতের শেষ হওয়ার অপেক্ষা করছে। কফির মগে শেষ চুমুক দিয়ে টেবিলে রাখতেই উঠে দাঁড়ায় ফাবিহা। বলে যে কাল দেখা করবে আবার। সাদাত এগিয়ে যায় ওর সাথে। দরজার ওপাশে গিয়ে হাসিমুখে বিদায় জানিয়ে চলে যায় ফাবিহা।
ফিরে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় সাদাত। ঘুম পেয়ে যায় মুহূর্তেই। স্বপ্নে আসে ফাবিহা, একসাথে গাড়িতে করে ঘুরছে ওরা। আকস্মিকভাবে অন্য একটা গাড়ি এসে ধাক্কা দেয় তাদেরকে। সাদাত পাশে তাকায়, ফাবিহা নেই। সামনের গাড়ির দিকে তাকাতেই দেখে ঐ গাড়ির ড্রাইভিং সিটে ফাবিহা বসে। অথচ ধাক্কার আগেও ঠিক তার সাথেই তার গাড়িতেই ছিল সে।
"তুই সেদিন চাইলে বাঁচাতে পারতি আমাকে।"- বলেই সে আবারও সজোরে ধাক্কা মারে সাদাতের গাড়িটিকে।
এক ঝটকায় ঘুম থেকে উঠে যায় সাদাত। বুকের উপর কেউ চেপে আছে মনে হয় তার। তাকিয়ে দেখে গলা চেপে ধরে আছে ফাবিহা। সাদাত ঘাবড়ে যায় প্রচণ্ড। টেবিল ল্যাম্পের সুইচটা অন করতেই রুমে নিজেকে একা আবিষ্কার করে।
ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন ছিল। বেসিনের দিকে এগিয়ে যায় সাদাত। চোখেমুখে পানি ছেটায় সামান্য। আয়নায় নিজের গলাটা ঘুরিয়ে দেখে। বুঝতে পারছে না কিছুই। ফাবিহা কি সত্যিই গলা চেপে ধরেছিল?
রুমের দিকে আবার পা বাড়াতেই জান্তব শব্দ শুনতে পায় সে। দ্রুত রুমে ঢুকেই দরজা আটকে দেয়। টেবিল-ল্যাম্পের আলোয় স্পষ্ট কাউকে দেখতে পায় রুমে, ফাবিহা! মেয়েটি এখানে কীভাবে?
আবারও তীব্র আতঙ্ক অনুভব করে সাদাত। দরজা খুলেই দৌঁড়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যায়। ফাবিহা জান্তব শব্দ করতে করতে পিছে এগিয়ে আসছে। হাতের কাছে গ্লাস, প্লেট যা পায় একের পর এক ছুড়তে থাকে সাদাত। বাতাসে ভেসে প্রতিটা আঘাত এড়িয়ে যায় মেয়েটা।
দ্রুত অন্যরুমে থাকা ড্রেসিং টেবিলের নিচের ড্রয়ারের ভেতরে গোপন বক্সে থাকা পিস্তলটি বের করে সে। ফাবিহা এ রুমের দিকেও এগিয়ে আসছে।
পরের সেকেন্ডেই উদভ্রান্তের মত সাদাতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সে। চোখ বুজে পাগলের মতো একে একে তিনটা গুলি চালায় সাদাত। চোখ খুলে দেখে মেঝেতে তার দেহ নিথর হয়ে পড়ে আছে। রক্তের ক্ষীণ একটা স্রোত বয়ে যায় রুমের মেঝেতে- তরলের নিম্নগামীতার সূত্র মেনে নিয়ে ।
কিছু সময়ের জন্য বিষন্নতায় ঘিরে ধরে তাকে। প্রেয়সীকে নিজ হাতে খুন করে শান্ত থাকা মোটেও সহজ নয়।
তবে এ মুহূর্তে তাকে নিজেকে বাঁচাতে হবে, সরিয়ে ফেলতে হবে লাশটিকে।
গ্যারেজে থাকা তার দ্বিতীয় প্রাইভেট কারের পিছনের বনেটের মধ্যে ফাবিহার লাশটিকে রাখে সাদাত। রক্তাক্ত দেহ হাতে নিতেই তার অদ্ভুত এক অনুভূতি সৃষ্টি হয়, মোচড় দিয়ে ওঠে পেটের মধ্যে। বমি করে দিতে পারে এমন অবস্থা।
কিন্তু পেটে তার কিছুই নেই এখন। শুধুমাত্র আছে প্রচণ্ড ভয়, গায়ের লোম খাড়া করার মতো ভয়।
গাড়ির ইঞ্জিন চালু করে সে। শহরের এক প্রান্তে পঁচা ডোবা আছে, ময়লা আবর্জনায় ভর্তি। সেখানে লাশটকে ফেলে দিলে ডোবার কাঁদায় তলিয়ে যাবে। মানুষেরা এখানে ময়লা ফেলে যায় শুধু। সে জানে যে এই ডোবা খুঁড়ে কেউ লাশ বের করতে যাবে না।
কাজ শেষ করে বাসার দিকে ক্লান্ত গতিতে ফিরে চলে ও। রক্তের দাগ পরিষ্কার করতে হবে।
_____
পরদিন সকালে অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হয় সাদাত। গত রাতে যেখানে তার গাড়িটা নষ্ট হয়েছিল সেখানে পৌঁছে হঠাৎই কী মনে করে গাড়ির ব্রেক কষে দেয়। হয়তো রাতের ঘটনা আবারও মাথায় ভর করেছে। আশেপাশে তাকায় সে। হঠাৎ মনে হলো সে রাস্তার ওপাশে কাউকে দেখেছে। তার দিকে তাকিয়ে হাসি দিয়েই চলে যায় ও। সাদাত দু'হাতে মাথা চেপে ধরে। চারদিকে ঝলমলে দিনের আলো। এর মাঝে এসব ব্যাখ্যাহীন কিছু দেখার জন্য প্রস্তুত ছিল না ও মোটেও।
পরে নিজেকে বোঝায়- ওটা ফাবিহা নয়, তার মত দেখতে কেউ হবে হয়তো।
গাড়ি থেকে নেমে মেয়েটি যেদিকে গিয়েছিল সেদিকে তাকায়। রাস্তার ঐ প্রান্তে স্পষ্ট ফাবিহাকে দেখতে পায়। বেপরোয়া হয়ে ছুটে যায় এবার সাদাত। কিন্তু তার পৌঁছানোর পূর্বেই উধাও হয়ে যায় মেয়েটা।
_____
কাল রাত থেকে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো একে একে বলতে থাকে সাদাত। আয়ান অনেক মনযোগের সাথে শোনে সবটুকু। এরপর বলে, "আপনার বাসায় যাওয়া যাবে এখন, সাদাত সাহেব?"
মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয় সাদাত।
কোন রুমে ফাবিহার উপর সে গুলি চালিয়েছিল জিজ্ঞাসা করে আয়ান। সাদাত নিয়ে যায় সেখানে। রুমের চারপাশে ভালো করে খেয়াল করে আয়ান বলে, "সাদাত সাহেব, আমি জানি যে আপনি আগে থেকেই সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত। আর ফাবিহার হঠাৎ মৃত্যুতে আপনি আরও বেশি আঘাত পান। যার ফলে হঠাৎ এই ভিজুয়াল হ্যালুসিনেশন হচ্ছে আপনার।"
"কিন্তু আপনি কীভাবে এতটা নিশ্চিত হয়ে বলতে পারেন যে এটা আমার হ্যালুসিনেশন ছিল?"
"কাল রাতে বাসে আপনার পাশের সিটে কেউ ছিল না। একা কথা বলছিলেন আপনি। যার কারণে অন্য যাত্রীরা অবাক হয়ে দেখছিল আপনাকে..."- পূর্ব পাশের দেয়ালটার দিকে এগিয়ে গিয়ে আবার বলতে শুরু করে, "...এখানে দেখুন। আপনি বলছেন যে আপনি ফাবিহার উপর তিনটি গুলি চালিয়েছেন। অথচ এই দেয়ালে তিনটি গুলি আটকে রয়েছে যাদের একটির সাথেও কোনো রক্ত লেগে নেই। মানে একটাই, আপনি হাওয়াতে গুলি ছুড়েছিলেন।"
এবার ড্রয়িং রুমের দিকে এগিয়ে যায় আয়ান। টি-টেবিলে কফির মগদু'টো এখনও পড়ে আছে। একটা উঠিয়ে সাদাতের দিকে লক্ষ্য করে বলেন, "এই মগের কফি এখনও পরিপূর্ণ। মানে কাল রাতে ফাবিহা কেন, কেউই এ মগের কফি খায়নি।"
"কিন্তু আমি তার লাশ নিজে ডোবায় ফেলে এসেছি।"- ভ্রু কুঁচকে যায় সাদাতের।
"আচ্ছা আপনি মেঝেতে থাকা রক্ত নিশ্চয় পরিষ্কার করেছিলেন?"
"হ্যাঁ, ফাবিহার লাশ ফেলে আসার পর। কাপড়টা ময়লার ঝুড়িতেই আছে।"
"রক্তমাখা কাপড় ময়লার ঝুড়িতে ফেলে রেখেছেন যে?"
"আমি জানি না। খুনের কলঙ্ক মাথায় চেপে অন্য কিছুতে খেয়াল ছিল না আমার।"
ঝুড়ি থেকে কাপড়টা বের করে সাদাতকে দেখায় আয়ান। রক্তের বিন্দু পরিমাণ দাগ নেই। আয়ান আবারও বলে যে এর সবকিছুই হ্যালুসিনেশন, তার সিজোফ্রেনিয়া রোগের প্রভাব।
"কিন্তু ঐ লাশ..."
সাদাতের কথা শেষ হওয়ার আগেই আয়ান বলে ওঠে, "চলুন গিয়ে দেখা যাক। আমি পুলিশে ফোন দিচ্ছি, উদ্ধারকর্মী নিয়ে আসতে।"
মাত্র একরাতে খুব বেশি তলিয়ে যায়নি লাশটি।ডোবার ভেতরে প্রায় আধা ঘন্টা খোঁজাখুঁজির পর একজন উদ্ধারকর্মী চিৎকার করে ওঠে কিছু একটা পেয়েছে সে। উপরে টেনে তোলে অন্যজনের সহযোগিতায়। অসম্ভবনীয় ও অবিশ্বাস্যভাবে সেটা লাশ ছিল, কোনো মেয়ের; ফাবিহার নয়তো?
"আমি বলেছিলাম যে আমি এখানে ফেলেছি ওকে। এটা মোটেই হ্যালুসিনেশন নয়।"- চিৎকার করে ওঠে সাদাত। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ার উপক্রম।
কিন্তু আয়ান নিজেই একটু আগে সবকিছু মিলিয়ে দেখেছে। এই লাশ এখানে আসবে কীভাবে?
আর সবথেকে বড় কথা এটা যে, ফাবিহার লাশ এখনও মর্গে থাকার কথা। সুইসাইডের পর তাকে ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, এই ডোবায় ফেলা হয়নি।
লাশের হাতে বেঁধে দেওয়া একটি পলিথিনের প্যাকেটে নজর পড়ে আয়ানের। ওটা পরিষ্কার করা হলে খুলে দেখে আয়ান। ভিতরে চিঠির খাম, এরকম খাম সে আগেও দেখেছে। নেহা নিয়ে এসেছিল তার বাসায়। ভেতরে থাকা কাগজটি বের করে আয়ান। সেই লেখা, সেই শব্দগুলো, "চলে এসো প্রিয়, একা থাকতে ভয় করছে আমার।"
চলবে..
Sayhan Ahmed
তোয়ালে দিয়ে মাথার কোঁকড়ানো চুলগুলো মুছতে মুছতে বাথরুম থেকে বেরুতেই কলিং বেলের টুং টাং শব্দ। সবেমাত্র গোসল শেষ হয়েছে। পরনে শুধুমাত্র একটি থ্রি-কোয়ার্টার। এ অবস্থায় দরজা খুলতে যাওয়াটা বোকামি। কী জানে কে এসেছে এই অবেলায়। হলুদ টি-শার্টটি গায়ে চড়িয়ে দরজার লুকিং গ্লাস দিয়ে উঁকি মারে। শাড়ি পরিহিতা একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে। বয়স পঁচিশ কি ছাব্বিশের মতো। মুখটা নতুন আয়ানের কাছে। দরজা খুললেই মেয়েটি জিজ্ঞাসা করে, "জনাব আয়ান রাফিদ?"
মাথা নেড়ে হ্যাঁ-সূচক জবাব দেয় আয়ান। ভেতরে আসার অনুমতি নেয় মেয়েটা।
তাকে সোফায় বসিয়ে বেডরুম থেকে ঘড়ি আর চশমাটা নিয়ে আসে আয়ান। যদিও চশমা ছাড়াই সে স্পষ্ট দেখতে পায়, মাথাব্যাথার জন্য ব্যবহার করতে হয়।
"আমি নেহা আনজুম আর আমার বোন ফাবিহা আনজুম। বোনের কথা এজন্য বলছি কারণ সমস্যাটি তাকে নিয়েই।"
আয়ান কিছু বলার আগেই নেহা তার হাতে থাকা থামটি থেকে একটা কাগজ বের করে আয়ানের দিকে বাড়িয়ে দেয়।
"আজ সকালেই পেয়েছি এটা। ফাবিহার রুমে।"
"চলে এসো প্রিয়, একা থাকতে ভয় করছে আমার।"- কাগজটিতে থাকা বাক্যটি জোরে জোরে পড়ে আয়ান।
"বুঝতে পারছি না যে এটা কে ফেলে গিয়েছে।"
"মিস নেহা!..."- চশমাটি খুলে টি-শার্ট দিয়ে মুছে আবারও চোখে দেয় আয়ান, "... আপনি অবশ্যই এটা জানেন যে আমি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট, কোনো গোয়েন্দা নই। আমার মনে হয় আপনি ভুল জায়গায় এসেছেন।"
"ও তাই?"- মাথা কিঞ্চিৎ বাকিয়ে প্রশ্ন করে নেহা।
"আলবাত!"
"কিন্তু আমার একদমই তা মনে হচ্ছে না।"
"আশা করি 'কেন?' এর উত্তরটা দিবেন।"
"অবশ্যই! আমি এখানে এই উড়োচিঠির পিছে গোয়েন্দা লাগানোর জন্য আসিনি। প্রথমেই বলেছি সমস্যাটা আমার বোনকে ঘিরে..."- একটু নড়েচড়ে বসে নেহা, "...ও একটা মানসিক রোগী।"
"মানসিক রোগী? আপনি এতটা শক্ত করে কীভাবে বলতে পারেন?"
"আবোলতাবোল বকে সবসময়, কথা বলে একা একা। মাঝেমধ্যে আঙুলের ইশারায় কাউকে দেখাতে চায় অথচ আমি দেখতে পাই না কিছুই।"
সোফার হাতলে ডান হাতটির কনুই রেখে মুঠের উপর চোয়ালের ভর রাখে আয়ান। কয়েক সেকেন্ড বাদে আবার সোজা হয়ে বসে। জিজ্ঞাসা করে, "কতদিন ধরে এ সমস্যা?"
"তিন চারদিন হবে।"
আয়ান দ্বিতীয় প্রশ্ন করার আগে নেহা আবারও বলে ওঠে, "আমি চাচ্ছি আপনি একবার আমার সাথে এসে তাকে দেখে যান- যদি আপনার হাতে এখন সময় থাকে তো।"
আয়ান রাজি হয়। কোনরকমে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ে তারা। রাস্তায় থাকা একটি প্রাইভেট কারের দিকে এগিয়ে যায় নেহা। আয়ান বুঝতে পারে এটা তারই গাড়ি। বেশ বড়লোক ঘরের মনে হচ্ছে।
পৌঁছেই বাড়ির মেইন গেইট খোলা পায় নেহা। খানিক দ্রুততার সাথে ভেতরে ঢুকে উপরের তলার একটি কক্ষের দিকে এগিয়ে যায় সে, আয়ান তার সাথে সাথে এগোচ্ছে। ভেতরে ঢুকেই হতভম্ব হয়ে যায় দু'জনেই। ফ্যানের সাথে ঝুলছে ফাবিহার লাশ। আত্মহত্যা মনে হচ্ছে। নেহা ধপাস করেই বসে পড়ে ফ্লোরে। আয়ান পুলিশে ফোন দেয়।
দশ থেকে পনেরো মিনিটের মাথায় পুলিশ পোঁছে যায় সেখানে। লাশের চারপাশে একবার ঘুরে দেখার পর নিচে নামাতে বলেন একজন পুলিশ। আয়ান তার পোশাকে থাকা নামটি পড়ে নেয়- 'ইশতিয়াক'।
আয়ান দুপুরে তার বাড়িতে নেহার যাওয়া থেকে শুরু করে এখানে পোঁছানো পর্যন্ত বলে তাকে। নেহা পুরপুরি স্তব্ধ হয়ে আছে।
টেবিলে থাকা একটি ছবিতে চোখ পড়ে ইশতিয়াকের। ফাবিহার সাথে কোনো ছেলের ছবি। নেহাকে জিজ্ঞাসা করলে বলে যে, "ওর নাম সাদাত, ফাবিহার সাথে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল ওর। কিন্তু সাদাতের মানসিক সমস্যা থাকায় বিয়েটি আটকে দেয় ফাবিহা।"
"মানসিক সমস্যা?"- আয়ান প্রশ্ন করে।
"হ্যাঁ, ও সিজোফ্রেনিয়ার রোগী। আমার তো সন্দেহ হচ্ছে ওর থেকে ফাবিহারও এই রোগ সংক্রমণ হলো কি না!"
"সিজোফ্রেনিয়া সংক্রামক রোগ না।"- আয়ানের বক্তব্য।
"জানি আমি। তবুও।..."- একটু থেমে আবারও নেহা বলা শুরু করে, "...সাদাতকে না জানানোই ঠিক হবে, ফাবিহার সুইসাইডের ব্যাপারে। নাহলে ওর অবস্থা আরও বেগতিক হয়ে উঠবে।"
নেহার কথা শেষ হতে না হতেই ছবিতে থাকা লোকটি সশরীরে রুমে প্রবেশ করে৷ চোখেমুখে উৎকণ্ঠার ছাপ। সম্ভবত জেনে গিয়েছে এ ব্যাপারে।
নেহা কান্না করছে না, তবে তার মুখটা ফ্যাকাশে- লক্ষ্য করে আয়ান।
ফাবিহার লাশের দিকে একনজরে চেয়ে আছে সাদাত। এখন পর্যন্ত মুখ দিয়ে কোনো শব্দই উচ্চারণ করেনি। মনে হচ্ছে যেন গলা ভারি হয়ে উঠেছে তার, কণ্ঠ পর্যন্ত এসেও শব্দ যেন আটকে আছে।
লাশটিকে পোস্টমর্টেমের জন্য পাঠানো হয়। প্রস্থান নেন ইশতিয়াকসহ অন্য পুলিশেরা। আয়ানও বেরিয়ে পড়ে।
_____
মাঝপথে খারাপ করেছে সাদাতের গাড়িটি। সিএনজি নিতে চাচ্ছিল সে। না পেয়ে বাধ্য হয়েই সে লোকাল বাসে ওঠে। বাসের মাঝামাঝিতে জানালার পাশে ফাঁকা সিট পেয়েই বসে পড়ে। তার পাশের সিটটাও ফাঁকা। বাসে অনেকগুলো সিটই শূন্য হয়ে পড়ে আছে। জানালা দিয়ে সোডিয়ামের আলোয় ভর্তি ব্যস্ত রাস্তার দৃশ্য অবলোকন করছে সাদাত। কিছু সময় বাদ তার মনে হলো পাশে কেউ বসেছে। একবার ঘুরে দেখে আবারও জানালার বাইরে তাকায়। হঠাৎ অবাক হয়ে ওঠে সে, মনে হচ্ছে যেন তাকেই দেখেছে। আবারও পাশের সিটে তাকায়। ফাবিহা! চোখ কপালে উঠে যায় সাদাতের। ভয়ে চিৎকারের উদ্বেগ তৈরি হতেই তার মুখ চেপে ধরে ফাবিহা। আবারও শান্ত হয়ে যায় সাদাত। বিচলিত কন্ঠে প্রশ্ন করে, "ফাবিহা তুমি এখানে কীভাবে? তুমি না বিগত তিন দিন পূর্বেই আত্মহত্যা করলে?"
"কে বললো আত্মহত্যা করেছি? করলে কি আমাকে এখানে দেখতে পেতে তোমার পাশে?"- মুচকি হাসে ফাবিহা।
বাসের অন্য যাত্রীরা সাদাতকে অবাক চোখে দেখছে। এখানে এভাবে ড্যাবড্যাব করে দেখার কী হলো বুঝতে পারে না সে।
তাদের দৃষ্টিকে তোয়াক্কা না করে আবার প্রশ্ন তোলে, "তাহলে সেদিন ওটা কে ছিল?"
"আহা! বাদ দাও না। আমাকে তো পেয়েছ-ই। তাহলে আবার অতো প্রশ্ন করছো কেন?"
সাদাত মাথা নাড়ায়। চোখেমুখে উজ্জ্বলতা ভেসে উঠেছে। ফাবিহা তার সাথে যেতে চায়। সাদাত না করে না।
বাস থেকে নেমে বাসার দিকে হাঁটতে শুরু করে দু'জনে। পৌঁছে হাতমুখ ধুয়ে নেয়। সাদাত কফি করে নিয়ে আসে।
ড্রয়িং রুমে বসেই কথা বলছে ওরা। মগের মধ্যে থাকা গরম কফির ধোঁয়া পেয়ে সাদাতের চশমাটা সাদা হয়ে যাচ্ছে। ফাবিহা আগেই শেষ করে ফেলে, মগটা রেখে দেয় সামনের টি-টেবিলে। সাদাতের শেষ হওয়ার অপেক্ষা করছে। কফির মগে শেষ চুমুক দিয়ে টেবিলে রাখতেই উঠে দাঁড়ায় ফাবিহা। বলে যে কাল দেখা করবে আবার। সাদাত এগিয়ে যায় ওর সাথে। দরজার ওপাশে গিয়ে হাসিমুখে বিদায় জানিয়ে চলে যায় ফাবিহা।
ফিরে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় সাদাত। ঘুম পেয়ে যায় মুহূর্তেই। স্বপ্নে আসে ফাবিহা, একসাথে গাড়িতে করে ঘুরছে ওরা। আকস্মিকভাবে অন্য একটা গাড়ি এসে ধাক্কা দেয় তাদেরকে। সাদাত পাশে তাকায়, ফাবিহা নেই। সামনের গাড়ির দিকে তাকাতেই দেখে ঐ গাড়ির ড্রাইভিং সিটে ফাবিহা বসে। অথচ ধাক্কার আগেও ঠিক তার সাথেই তার গাড়িতেই ছিল সে।
"তুই সেদিন চাইলে বাঁচাতে পারতি আমাকে।"- বলেই সে আবারও সজোরে ধাক্কা মারে সাদাতের গাড়িটিকে।
এক ঝটকায় ঘুম থেকে উঠে যায় সাদাত। বুকের উপর কেউ চেপে আছে মনে হয় তার। তাকিয়ে দেখে গলা চেপে ধরে আছে ফাবিহা। সাদাত ঘাবড়ে যায় প্রচণ্ড। টেবিল ল্যাম্পের সুইচটা অন করতেই রুমে নিজেকে একা আবিষ্কার করে।
ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন ছিল। বেসিনের দিকে এগিয়ে যায় সাদাত। চোখেমুখে পানি ছেটায় সামান্য। আয়নায় নিজের গলাটা ঘুরিয়ে দেখে। বুঝতে পারছে না কিছুই। ফাবিহা কি সত্যিই গলা চেপে ধরেছিল?
রুমের দিকে আবার পা বাড়াতেই জান্তব শব্দ শুনতে পায় সে। দ্রুত রুমে ঢুকেই দরজা আটকে দেয়। টেবিল-ল্যাম্পের আলোয় স্পষ্ট কাউকে দেখতে পায় রুমে, ফাবিহা! মেয়েটি এখানে কীভাবে?
আবারও তীব্র আতঙ্ক অনুভব করে সাদাত। দরজা খুলেই দৌঁড়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যায়। ফাবিহা জান্তব শব্দ করতে করতে পিছে এগিয়ে আসছে। হাতের কাছে গ্লাস, প্লেট যা পায় একের পর এক ছুড়তে থাকে সাদাত। বাতাসে ভেসে প্রতিটা আঘাত এড়িয়ে যায় মেয়েটা।
দ্রুত অন্যরুমে থাকা ড্রেসিং টেবিলের নিচের ড্রয়ারের ভেতরে গোপন বক্সে থাকা পিস্তলটি বের করে সে। ফাবিহা এ রুমের দিকেও এগিয়ে আসছে।
পরের সেকেন্ডেই উদভ্রান্তের মত সাদাতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সে। চোখ বুজে পাগলের মতো একে একে তিনটা গুলি চালায় সাদাত। চোখ খুলে দেখে মেঝেতে তার দেহ নিথর হয়ে পড়ে আছে। রক্তের ক্ষীণ একটা স্রোত বয়ে যায় রুমের মেঝেতে- তরলের নিম্নগামীতার সূত্র মেনে নিয়ে ।
কিছু সময়ের জন্য বিষন্নতায় ঘিরে ধরে তাকে। প্রেয়সীকে নিজ হাতে খুন করে শান্ত থাকা মোটেও সহজ নয়।
তবে এ মুহূর্তে তাকে নিজেকে বাঁচাতে হবে, সরিয়ে ফেলতে হবে লাশটিকে।
গ্যারেজে থাকা তার দ্বিতীয় প্রাইভেট কারের পিছনের বনেটের মধ্যে ফাবিহার লাশটিকে রাখে সাদাত। রক্তাক্ত দেহ হাতে নিতেই তার অদ্ভুত এক অনুভূতি সৃষ্টি হয়, মোচড় দিয়ে ওঠে পেটের মধ্যে। বমি করে দিতে পারে এমন অবস্থা।
কিন্তু পেটে তার কিছুই নেই এখন। শুধুমাত্র আছে প্রচণ্ড ভয়, গায়ের লোম খাড়া করার মতো ভয়।
গাড়ির ইঞ্জিন চালু করে সে। শহরের এক প্রান্তে পঁচা ডোবা আছে, ময়লা আবর্জনায় ভর্তি। সেখানে লাশটকে ফেলে দিলে ডোবার কাঁদায় তলিয়ে যাবে। মানুষেরা এখানে ময়লা ফেলে যায় শুধু। সে জানে যে এই ডোবা খুঁড়ে কেউ লাশ বের করতে যাবে না।
কাজ শেষ করে বাসার দিকে ক্লান্ত গতিতে ফিরে চলে ও। রক্তের দাগ পরিষ্কার করতে হবে।
_____
পরদিন সকালে অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হয় সাদাত। গত রাতে যেখানে তার গাড়িটা নষ্ট হয়েছিল সেখানে পৌঁছে হঠাৎই কী মনে করে গাড়ির ব্রেক কষে দেয়। হয়তো রাতের ঘটনা আবারও মাথায় ভর করেছে। আশেপাশে তাকায় সে। হঠাৎ মনে হলো সে রাস্তার ওপাশে কাউকে দেখেছে। তার দিকে তাকিয়ে হাসি দিয়েই চলে যায় ও। সাদাত দু'হাতে মাথা চেপে ধরে। চারদিকে ঝলমলে দিনের আলো। এর মাঝে এসব ব্যাখ্যাহীন কিছু দেখার জন্য প্রস্তুত ছিল না ও মোটেও।
পরে নিজেকে বোঝায়- ওটা ফাবিহা নয়, তার মত দেখতে কেউ হবে হয়তো।
গাড়ি থেকে নেমে মেয়েটি যেদিকে গিয়েছিল সেদিকে তাকায়। রাস্তার ঐ প্রান্তে স্পষ্ট ফাবিহাকে দেখতে পায়। বেপরোয়া হয়ে ছুটে যায় এবার সাদাত। কিন্তু তার পৌঁছানোর পূর্বেই উধাও হয়ে যায় মেয়েটা।
_____
কাল রাত থেকে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো একে একে বলতে থাকে সাদাত। আয়ান অনেক মনযোগের সাথে শোনে সবটুকু। এরপর বলে, "আপনার বাসায় যাওয়া যাবে এখন, সাদাত সাহেব?"
মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয় সাদাত।
কোন রুমে ফাবিহার উপর সে গুলি চালিয়েছিল জিজ্ঞাসা করে আয়ান। সাদাত নিয়ে যায় সেখানে। রুমের চারপাশে ভালো করে খেয়াল করে আয়ান বলে, "সাদাত সাহেব, আমি জানি যে আপনি আগে থেকেই সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত। আর ফাবিহার হঠাৎ মৃত্যুতে আপনি আরও বেশি আঘাত পান। যার ফলে হঠাৎ এই ভিজুয়াল হ্যালুসিনেশন হচ্ছে আপনার।"
"কিন্তু আপনি কীভাবে এতটা নিশ্চিত হয়ে বলতে পারেন যে এটা আমার হ্যালুসিনেশন ছিল?"
"কাল রাতে বাসে আপনার পাশের সিটে কেউ ছিল না। একা কথা বলছিলেন আপনি। যার কারণে অন্য যাত্রীরা অবাক হয়ে দেখছিল আপনাকে..."- পূর্ব পাশের দেয়ালটার দিকে এগিয়ে গিয়ে আবার বলতে শুরু করে, "...এখানে দেখুন। আপনি বলছেন যে আপনি ফাবিহার উপর তিনটি গুলি চালিয়েছেন। অথচ এই দেয়ালে তিনটি গুলি আটকে রয়েছে যাদের একটির সাথেও কোনো রক্ত লেগে নেই। মানে একটাই, আপনি হাওয়াতে গুলি ছুড়েছিলেন।"
এবার ড্রয়িং রুমের দিকে এগিয়ে যায় আয়ান। টি-টেবিলে কফির মগদু'টো এখনও পড়ে আছে। একটা উঠিয়ে সাদাতের দিকে লক্ষ্য করে বলেন, "এই মগের কফি এখনও পরিপূর্ণ। মানে কাল রাতে ফাবিহা কেন, কেউই এ মগের কফি খায়নি।"
"কিন্তু আমি তার লাশ নিজে ডোবায় ফেলে এসেছি।"- ভ্রু কুঁচকে যায় সাদাতের।
"আচ্ছা আপনি মেঝেতে থাকা রক্ত নিশ্চয় পরিষ্কার করেছিলেন?"
"হ্যাঁ, ফাবিহার লাশ ফেলে আসার পর। কাপড়টা ময়লার ঝুড়িতেই আছে।"
"রক্তমাখা কাপড় ময়লার ঝুড়িতে ফেলে রেখেছেন যে?"
"আমি জানি না। খুনের কলঙ্ক মাথায় চেপে অন্য কিছুতে খেয়াল ছিল না আমার।"
ঝুড়ি থেকে কাপড়টা বের করে সাদাতকে দেখায় আয়ান। রক্তের বিন্দু পরিমাণ দাগ নেই। আয়ান আবারও বলে যে এর সবকিছুই হ্যালুসিনেশন, তার সিজোফ্রেনিয়া রোগের প্রভাব।
"কিন্তু ঐ লাশ..."
সাদাতের কথা শেষ হওয়ার আগেই আয়ান বলে ওঠে, "চলুন গিয়ে দেখা যাক। আমি পুলিশে ফোন দিচ্ছি, উদ্ধারকর্মী নিয়ে আসতে।"
মাত্র একরাতে খুব বেশি তলিয়ে যায়নি লাশটি।ডোবার ভেতরে প্রায় আধা ঘন্টা খোঁজাখুঁজির পর একজন উদ্ধারকর্মী চিৎকার করে ওঠে কিছু একটা পেয়েছে সে। উপরে টেনে তোলে অন্যজনের সহযোগিতায়। অসম্ভবনীয় ও অবিশ্বাস্যভাবে সেটা লাশ ছিল, কোনো মেয়ের; ফাবিহার নয়তো?
"আমি বলেছিলাম যে আমি এখানে ফেলেছি ওকে। এটা মোটেই হ্যালুসিনেশন নয়।"- চিৎকার করে ওঠে সাদাত। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ার উপক্রম।
কিন্তু আয়ান নিজেই একটু আগে সবকিছু মিলিয়ে দেখেছে। এই লাশ এখানে আসবে কীভাবে?
আর সবথেকে বড় কথা এটা যে, ফাবিহার লাশ এখনও মর্গে থাকার কথা। সুইসাইডের পর তাকে ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, এই ডোবায় ফেলা হয়নি।
লাশের হাতে বেঁধে দেওয়া একটি পলিথিনের প্যাকেটে নজর পড়ে আয়ানের। ওটা পরিষ্কার করা হলে খুলে দেখে আয়ান। ভিতরে চিঠির খাম, এরকম খাম সে আগেও দেখেছে। নেহা নিয়ে এসেছিল তার বাসায়। ভেতরে থাকা কাগজটি বের করে আয়ান। সেই লেখা, সেই শব্দগুলো, "চলে এসো প্রিয়, একা থাকতে ভয় করছে আমার।"
চলবে..
Sayhan Ahmed
Hasibul hasan santo, Abul basar, Badol hasan, Mr faruk, Asha islam, Soneya akter, Sakib sikdar and লেখাটি পছন্দ করেছে
Permissions in this forum:
You cannot reply to topics in this forum