- Trimatraধুমকেতু
- Posts : 23
স্বর্ণমুদ্রা : 1434
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-06-05
রুম নম্বরঃ ৯০৯
Sat Jun 05, 2021 8:33 pm
১ম পর্ব
"সমস্যাটা মূলত আমার মেয়েকে নিয়ে।"
"কী সমস্যা?"
"কখনও মাঝরাতে উঠে কোনো কারণ ছাড়াই গোসল করে। কখনও শরীরের সমস্ত কাপড়চোপড় খুলে রুমের এক কোণে জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকে।"
"বয়স কত তার?"
"প্রায় বারো বছর।"
সবেমাত্র ফজরের নামাজ সেরে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছিলেন আহমেদ সাবাজ। গায়ের উপর সাদা কম্বলটা উঠানোর আগেই কলিং বেলের শব্দ বাতাসে তার কান অব্দি ভেসে আসে। এই সময়টাতে ঘন্টা দুয়েক ঘুমানোর অভ্যাস হয়ে গেছে। খুব বিরক্তির সাথেই বিছানা ছাড়েন তিনি। ওপাশের মানুষটা বিরামহীনভাবে বেল চাপছে। সুইচটাই ভেঙ্গে ফেলবে এমন অবস্থা। আরে বাবা দরজা অব্দি যেতে সময়টুকু তো অন্তত দে, এমন অধৈর্য হওয়ার কী দরকার?
দরজা খুলতেই ওপাশে একজন মহিলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন। তাকে দেখেতে পেয়েই মহিলা প্রশ্ন করে বসেন, "আহমেদ সাবাজ?"
"জি।"
"ভিতরে আসতে পারি?"
তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে না সে উত্তরের অপেক্ষায় থাকবে। তাকে ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকতে পারলেও ঢুকবে এমন একটা ভাবসাব বিরাজ করছে। বাইরের আলো এখনও স্পষ্ট হয়নি। তাছাড়া এখনও শীত শীত আবহাওয়া রয়ে গেছে৷ এই সময়ে অপরিচিত এক মহিলা কোত্থেকে এলো চিন্তা হয় তার।
টেবিলের অপর পাশের চেয়ারে মহিলাটি বসা। আহমেদ সাবাজ কিছুটা বিরক্তি নিয়ে তার কথা শুনতে বসেছেন। বিরক্তির কারণটা স্পষ্ট, সকালের ঘুমটা নষ্ট হলো।
মহিলাটি তার সমস্যার ব্যাপারে বললেন। তার বলতে সমস্যাটা তার মেয়ের।
"স্যার আপনি কি কোনো কারণে চিন্তিত?"
"না।"
"কিন্তু আপনার চেহারা অন্য কিছু বলছে। ভাবছেন এতো ভোরবেলা এই মহিলা কোত্থেকে উদয় হলো। ভাবছেন না এমনটা?"
"হ্যাঁ ভাবছি।"
বিজয়ী একটা ভাব ফুটে ওঠে মহিলাটির মুখে। বিজয়ের ধারা ধরে রাখতে আবারে প্রশ্ন করে- "আপনাকে কেমন বিরক্তও দেখাচ্ছে। বিরক্ত থাকা মানুষের দুই ভ্রুর মাঝের চামড়া সামান্য ভাজ হয়ে যায়। আমি কি জানতে পারি আপনি কেন বিরক্ত? আচ্ছা আপনার আমার নাম জানতে ইচ্ছা করছে না? না করলেও বলি৷ আমার নাম রাফিয়া আনওয়ার।"
নামের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে সাবাজ বলেন, "এই সময়টাতে আমার ঘুমানোর অভ্যাস। না ঘুমালে সারাদিন মাথা চিনচিন করবে।"
"আচ্ছা তাহলে আপনি ঘুমিয়ে নিন আমি অপেক্ষা করছি।"
"যেভাবে কলিং বেল চাপছিলেন, অপেক্ষা করার ধৈর্য আপনার আছে বলে মনে হয় না।"
রাফিয়া মুখে হাত দিয়ে মৃদুস্বরে হেসে ফেললেন। তার চাপা হাসির আওয়াজ সাবাজের কান অব্দি পৌঁছায়। নারীকণ্ঠে মৃদু হাসি আকর্ষণীয় বটে। তবে এখন হাসিটা একদমই ভালো লাগছে না তার। বিরক্তির মাত্রা এখনও কমেনি।
কিন্তু মহিলাটি বুদ্ধিমান, সাবাজ ঠাহর করতে পারে।
"আমি জানি আমার ধৈর্য থাকলেও আপনি একজন অপরিচিত মহিলাকে ঘরে রেখে ঘুমাতে যেতেন না।"
সাবাজ কথা বলে না কোনো।
"ঘরে চা-পাতি আছে? থাকলে বানিয়ে নিয়ে আসি। চা খেতে খেতে কথা বলবো।"
তাকে বসিয়ে রেখে দু'কাপ চা বানিয়ে আনেন সাবাজ। ঘুম থেকে ঝেড়ে উঠতে চায়ের কাপে চুমুক দেওয়া ছাড়া আপাতত কোনো উপায় খুঁজে পান না তিনি।
রাফিয়া নামের এই মহিলাটির পরনে দামি জামদানী শাড়ি। বারো বছর বয়সী মেয়ে আছে মানে বয়স ত্রিশের এপার কিংবা ওপার হবে। মাথা হিজাব দিয়ে ঢাকা তবে মুখ খোলা। কিন্তু তাকে দেখে মনে হয় না তার বারো বছর বয়সী কোনো মেয়ে থাকতে পারে। মুখে ভারী মেকাপের কোনো ছাপ নেই। শুধুমাত্র চোখে কাজল দেওয়া আর ঠোঁটে হালকা গোলাপি রঙের লিপস্টিক। ব্যাস এটুকুই, এতেই তাকে প্রচণ্ড সুন্দরী লাগছে। এই বয়সের মহিলাদের এতো বেশি সৌন্দর্য খুব কম থাকে।
"আচ্ছা আমাকে প্রশ্ন করলেন না যে আমি এতো সকালে কেন আসলাম?"
চায়ের কাপটি টেবিলে রেখে সাবাজ উত্তর দেন, "আমার মনে হয় উত্তর পেয়ে গেছি।"
রাফিয়ার চোখজুড়ে কেমন একটা আনন্দের ছাপ। যেন চোখদুটো বলছে- আমি জানতাম বিখ্যাত আহমেদ সাবাজের ভাবনা শক্তির কোনো তুলনা নেই।
"আপনার বাসা যেখানেই হোক একেবারে কাছে কোথাও নয়। তাই সন্ধ্যা কিংবা তার একটু পরেই রওনা হয়েছেন যাতে আপনি সকাল সকাল এখানে এসে পোঁছাতে পারেন। কিন্তু এতো সকালে পৌঁছে যাবেন আপনি বুঝে উঠতে পারেননি। আমার অনুমান সঠিক হলে আপনার প্রাইভেট কার আর ড্রাইভার আশেপাশে কোথাও অপেক্ষা করছে।"- এতটুকু বলে আবার চায়ের কাপ হাতে নেন আহমেদ সাবাজ।
সামনে থাকা মহিলাটি কিছুটা চমকে উত্তর দেন, "আপনার অনুমান সঠিক। আমি আগেও আপনার ব্যাপারে শুনেছি কিন্তু এখন বাস্তব অভিজ্ঞতা হলো। কিন্তু কীভাবে বুঝলেন আমি ব্যক্তিগত গাড়িতে করে এসেছি?"
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সাবাজ উত্তর দেন, "বুঝতে না পারার কিছুই নেই। আমরা সকলে গভীরভাবে চিন্তা করি না এই যা।"
"আপনি গভীরভাবে ভাবতে পারেন বলেই আপনি আহমেদ সাবাজ। আশা করি আপনার অনুমানের ব্যাখ্যা পাব।"
"হাল্কা শীত এখনও বইছে। আমার এই বাড়ির সামনের গলিতে রিকশা, সাইকেল আর মোটরসাইকেল বাদে কোনো গাড়ি দেখা যায় না। আপনি বাইরে থেকে এসেছেন কিন্তু শিশিরের কোনো ফোঁটা আপনাকে ছোঁয়নি। মানে আপনি অবশ্যই হেঁটে আসেননি। মোটরসাইকেলে বা রিকশায় আসলে ঠাণ্ডা বাতাসে আপনার অবশ্যই কিছু্টা হলেও শীত লাগতো কিন্তু এখানে আসার পর থেকে আপনি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। তাহলে এসব যানে না আসলে আর হেঁটেও না আসলে এমন কিছুতে এসেছেন যার চারপাশে আটকানো থাকবে। তো সেক্ষেত্রে প্রাইভেট কার হতে পারে ভাবলাম।"
"কিন্তু আমি সকালে রওনা হয়ে সন্ধ্যার দিকেও তো এখানে পোঁছাতে পারতাম আর রাতে চলে যেতে পারতাম। তবে আমি সকালেই কেন আসলাম?"
"উত্তরটা পরে একসময় দেব। আরেকটা বিষয় হলো আপনি এখানে প্রথমবার নয়, আগেও এসেছেন।"
"আপনার এমনটা কেন মনে হচ্ছে?"
"এতো সকালে গলির পাশের দোকানগুলি খোলেনি যেখান থেকে আপনি আমার ঠিকানা জানতে পারেন। বলতে পারেন দু-একটা যে রিকশা চলছে ঐ রিকশাওয়ালার থেকে ঠিকানা জেনে নিতে পারেন৷ কিন্তু এই ঢাকা শহরে কোনো রিকশাওয়ালা কারো বাড়ি চেনে বলে আমার মনে হয় না। এই সকালে এসে একদমই ঠিক মানুষের দরজায় এসে দাঁড়ালেন এটা অবশ্যই অলৌকিক নয়। মানে আপনি আগে থেকেই আমার বাড়ি চিনতেন।"
এবার রাফিয়া হাসিমুখে বলে ফেললেন, "বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা শুনে মনে হয়- আরে এ তো একদমই সোজা।"
"এক্সাক্টলি এটাই। আমরা গভীরভাবে ভাবি না তাই উত্তর পাই না। তবে আমার অনুমানও সবসময় সঠিক হবে তেমনটা নয়। অনেক সময়ই যেটা ভাবি দেখা গেছে সেটা ভুল হয়ে দাঁড়ায়।"
"আচ্ছা সকালের খাবারের জন্য কিসের আয়োজন করেছেন?"
"কিছু ভেবে রাখিনি।"
"ঘরে চাল-ডাল নিশ্চয় আছে। না থাকলেও সমস্যা নেই। ড্রাইভারকে বাজারে পাঠাবো। আজকে আমার হাতের ভুনা খিচুড়ি খেয়ে দেখবেন।"
আহমেদ সাবাজ সম্ভবত অবাক হয়েছেন রাফিয়া আন্দাজ করে নেন। তার কিছু বলার আগেই রাফিয়া বলে ওঠেন, "দয়া করে অবাক হবেন না। আপনাকে আসল বিষয়টা বলা হয়নি।"
"কী বিষয়।"
"আমি আপনাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে চাই। আমার মেয়ের সমস্যা সমাধানের জন্য।"
"আপনার কেন মনে হচ্ছে আমি তার সমস্যার সমাধান করতে পারবো?"
"আমার স্বামী আপনাকে খুব শ্রদ্ধা করেন। তার একান্ত ইচ্ছা আপনি নিজেই আমাদের মেয়ের সমস্যা খুঁটিয়ে দেখবেন।"
রাজি হন আহমেদ সাবাজ। রাফিয়ার রান্না করা ভুনা খিচুড়ি খেয়েই বেরিয়ে পড়েন তারা। তার রান্নার হাতটাও চমৎকার, জাদু আছে বলতে হয়।
"আপনার দ্বৈত চরিত্রের ব্যাপারে জানার খুব আগ্রহ আমার। আপনি কীভাবে একইসাথে একজন সাইকোলজিস্ট আবার প্রাইভেট ডিটেকটিভ? বিষয়টা আরও জটিল লাগে এজন্য যে, আমি শুনেছি আপনার মধ্যে যখন এর কোনো একটি চরিত্র জাগ্রত হয় অন্য চরিত্রকে খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।"
সাবাজ মুচকি হেসে উত্তর দেন, "সময় নিয়ে বলবো সম্ভব হলে।"
রাফিয়া মনে মনে সাবাজের হাসির প্রশংসা করেন। লোকটি খুব বেশি হাসেন না। আর যারা কম হাসেন তাদের হঠাৎ করে হাসতে দেখলেই মুগ্ধ হতে হয়। তাদের হাসির মধ্যে যেন কোনো অদ্ভুত সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে।
"আচ্ছা কত সময় লাগবে আমাদের পৌঁছাতে?"- প্রশ্ন আহমেদ সাবাজের।
"সন্ধ্যা পার হয়ে যাবে।"
পাঁচিলঘেরা একটি বাড়ির সামনে এসে তাদের গাড়ি থামে। অন্ধকার ছেয়ে এসেছে অনেকটা। বাড়ির ভিতরে লাইট জ্বলছে তবে আশেপাশের পরিবেশ অন্ধকার। বুঝাই যাচ্ছে লোকালয় থেকে দূরে বাড়িটা। দারোয়ান গেট খুললে তারা ভিতরে প্রবেশ করেন। কলিং বেল চাপতে একটা মেয়ে এসে দরজা খুলে দিয়ে গেল। যতদূর বুঝা গেল সে কাজের মেয়ে হবে। বয়স সতেরো বা আঠারো হতে পারে। ফর্সা চেহারা। সবুজ-কালো কম্বিনেশনের একটা থ্রি-পিস পরে আছে। দরজা খুলেই সালাম দিল সে।
বাড়ির ভিতরটা বেশ সুন্দর। রাফিয়ার স্বামী অনেক পয়সাওয়ালা হবেন হয়তো। রাফিয়া বলেছিল তিনি নাকি বেশ সম্মান করেন তাকে। কিন্তু এ মূহুর্তে তাকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। সম্ভবত কোনো কাজে বাইরে আছেন।
"আপনার জন্য পানি গরম করা আছে। ট্যাপের পানি বেশ ঠাণ্ডা এখন।"- মেয়েটি সাবাজকে উদ্দেশ্য করে বলে, "হাত মুখ ধুয়ে নিবেন।"
সাধারণত বেশিরভাগ কাজের মেয়েদের কথায় কেমন আঞ্চলিক একটা টান থাকে, কিন্তু এর মাঝে তা লক্ষ্য করা গেল না। শব্দের উচ্চারণ সুস্পষ্ট, কণ্ঠটাও বেশ সুন্দর।
সাবাজকে লক্ষ্য করে রাফিয়া বলেন, "ফ্রেস হয়ে আসুন আমার স্বামীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিব।"
সাবাজ বুঝতে পারে যে তার স্বামী বাড়িতেই আছে। কিন্তু এখানে তার অনুপস্থিতির কারণ তিনি বুঝে উঠতে পারেন না।
_____
জানালার পাশে হুইল চেয়ারে বসে বাইরের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ভদ্রলোক। রাফিয়ার ডাকে পিছনে ফিরে তাকান তিনি। সাবাজের দিকে তাকিয়ে মুখে তার আনন্দের হাসি ফুটে ওঠে। সম্ভবত চিনতে পেরেছে তাকে। যদিও না চেনার কোনো কারণ স্পষ্ট নেই।
"আমার স্বামী মোস্তফা আনওয়ার। গত দুই বছর ধরেই তিনি এই অবস্থায়। দাঁড়াতে আর কথা বলতে পারেন না।"
সাবাজের মন কিছু মূহুর্তের জন্য বিষন্ন হয়ে যায়। লোকটিও তার সাথে কথা বলতে না পারার দুঃখ পাচ্ছে হয়তো।
তবে যার কারণেই এখানে আসা তাকেই দেখা হলো না এখনও। রাফিয়া তার মেয়ের রুমের দিকে আহমেদ সাবাজকে নিয়ে যান।
ঘুমাচ্ছে সে।
রাফিয়া বললো, "মেয়েটির চেহারায় কেমন অদ্ভুত মায়া জড়িয়ে আছে দেখছেন? কিন্তু যখনই তার ঘুম ভাঙবে এই মায়াভরা মুখে ভয় আর উদ্বেগ ছাড়া কিছুই দেখতে পাওয়া যাবে না।"
রাফিয়ার চোখ টলমল করছে। এক্ষুণি চোখের বাঁধ ভেঙ্গে লোনা পানির স্রোত বয়ে যেতে পারে। সাবাজ বুঝতে পেরে তাকে বলে, "আসুন, তাকে ঘুমাতে দিন।"
একসাথে সবাই রাতের খাবার সেরেছেন। শুধুমাত্র রাফিয়ার মায়াবী চেহারার মেয়েটা বাদে। সাবাজ তার রুমে একটা অদ্ভুত বিষয় লক্ষ্য করেছেন। বিছানায় বেডশিট নেই, স্রেফ ফোমের উপর শুয়ে আছে মেয়েটা। জানালায় কোনো পর্দা টাঙানো নেই। একটু খটকা লেগেছে বিষয়টা।
খাওয়া শেষে রাফিয়াকে প্রশ্ন করেন সাবাজ, "কতদিন ধরে তার এই সমস্যা?"
"প্রায় পনেরো-ষোল দিন।"
"মানে বলতে চাচ্ছেন হঠাৎ-ই সে এ সমস্যাতে ভুগছে?"
"হঠাৎ বলা যায়। আবার বললেও ভুল হয়।"
"কেন?"
"এই পনেরো বা ষোল দিন আগে একটা প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তি করানোর পর থেকেই তার এই সমস্যা।"
"আপনি নিশ্চিত?"
"শতভাগ।"
"তার রুম নম্বর কত ছিল মনে আছে?"
"হ্যাঁ, নয়শত নয়।"
"তাহলে ক্লিনিক থেকেই বিষয়টি খোলাসার যাত্রা শুরু করতে হবে। কিন্তু তার আগে আপনার মেয়ের সমস্যাটা ধরাও কম জরুরী নয়।"
কিছু সময় বাদেই চিৎকারের শব্দ ভেসে আসে। রাফিয়া দৌঁড়ে তার মেয়ের রুমের দিকে যান। মোস্তফা সাহেব কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে হুইল চেয়ারেই বসে আছেন। তার এই মূহুর্তে কিছুই করার সামর্থ্য বা শক্তি কোনোটাই নেই। সাবাজ রাফিয়ার পিছে মেয়েটির রুম পর্যন্ত যায়। দরজার কাছে যাওয়ার আগেই রাফিয়া আটকে দেয় সাবাজকে।
"প্লিজ ভিতরে আসবেন না। বা দরজার সামনেও আসবেন না। কিছু সময় কষ্ট করে ধৈর্য ধরুন।"
সাবাজ দাঁড়িয়ে পড়েন। নিষেধাজ্ঞার কারণ বুঝতে পারলেন না তিনি। তাকে তো ডাকা হয়েছে তার মেয়েকে দেখানোর জন্য তবে সে নিষেধ করছে কেন তার সাথে মেয়েটির রুমে যেতে?
মেয়েটি এখনও চিৎকার করছে। রাফিয়া রুমে যাওয়ার পর আরও জোরে চিৎকার করছে। রাফিয়া রুমের বাইরে চলে আসেন। তার চোখদুটো বেয়ে অল্প করে পানি পড়ছে। এসে সাবাজের পাশে দাঁড়ান তিনি। সাবাজের ইচ্ছা হচ্ছে ভিতরে গিয়ে দেখতে আসলে কী ঘটছে। কিন্তু রাফিয়া নিষেধ করেছে যেহেতু, তিনি আর পা বাড়াননি।
কয়েক সেকেন্ড বাদেই দরজার সামনে একে একে কিছু কাপড় জড়ো হলো। সম্ভবত ভিতর থেকে মেয়েটি তার গায়ের সব কাপড় এক এক করে খুলে ছুড়ে মেরেছে। যেমনটা রাফিয়া বলেছিল তাকে।
এই মুহূর্তে সম্ভবত মেয়েটির শরীরে সুতাটুকুও নেই। সাবাজ এটা বুঝতে পারেন যে রাফিয়া তাকে তার রুমে যেতে নিষেধ করেছিলেন কেন। মূর্তির মতো দু'জনেই দাঁড়িয়ে আছেন সেখানে।
চলবে...
Sayan
"সমস্যাটা মূলত আমার মেয়েকে নিয়ে।"
"কী সমস্যা?"
"কখনও মাঝরাতে উঠে কোনো কারণ ছাড়াই গোসল করে। কখনও শরীরের সমস্ত কাপড়চোপড় খুলে রুমের এক কোণে জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকে।"
"বয়স কত তার?"
"প্রায় বারো বছর।"
সবেমাত্র ফজরের নামাজ সেরে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছিলেন আহমেদ সাবাজ। গায়ের উপর সাদা কম্বলটা উঠানোর আগেই কলিং বেলের শব্দ বাতাসে তার কান অব্দি ভেসে আসে। এই সময়টাতে ঘন্টা দুয়েক ঘুমানোর অভ্যাস হয়ে গেছে। খুব বিরক্তির সাথেই বিছানা ছাড়েন তিনি। ওপাশের মানুষটা বিরামহীনভাবে বেল চাপছে। সুইচটাই ভেঙ্গে ফেলবে এমন অবস্থা। আরে বাবা দরজা অব্দি যেতে সময়টুকু তো অন্তত দে, এমন অধৈর্য হওয়ার কী দরকার?
দরজা খুলতেই ওপাশে একজন মহিলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন। তাকে দেখেতে পেয়েই মহিলা প্রশ্ন করে বসেন, "আহমেদ সাবাজ?"
"জি।"
"ভিতরে আসতে পারি?"
তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে না সে উত্তরের অপেক্ষায় থাকবে। তাকে ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকতে পারলেও ঢুকবে এমন একটা ভাবসাব বিরাজ করছে। বাইরের আলো এখনও স্পষ্ট হয়নি। তাছাড়া এখনও শীত শীত আবহাওয়া রয়ে গেছে৷ এই সময়ে অপরিচিত এক মহিলা কোত্থেকে এলো চিন্তা হয় তার।
টেবিলের অপর পাশের চেয়ারে মহিলাটি বসা। আহমেদ সাবাজ কিছুটা বিরক্তি নিয়ে তার কথা শুনতে বসেছেন। বিরক্তির কারণটা স্পষ্ট, সকালের ঘুমটা নষ্ট হলো।
মহিলাটি তার সমস্যার ব্যাপারে বললেন। তার বলতে সমস্যাটা তার মেয়ের।
"স্যার আপনি কি কোনো কারণে চিন্তিত?"
"না।"
"কিন্তু আপনার চেহারা অন্য কিছু বলছে। ভাবছেন এতো ভোরবেলা এই মহিলা কোত্থেকে উদয় হলো। ভাবছেন না এমনটা?"
"হ্যাঁ ভাবছি।"
বিজয়ী একটা ভাব ফুটে ওঠে মহিলাটির মুখে। বিজয়ের ধারা ধরে রাখতে আবারে প্রশ্ন করে- "আপনাকে কেমন বিরক্তও দেখাচ্ছে। বিরক্ত থাকা মানুষের দুই ভ্রুর মাঝের চামড়া সামান্য ভাজ হয়ে যায়। আমি কি জানতে পারি আপনি কেন বিরক্ত? আচ্ছা আপনার আমার নাম জানতে ইচ্ছা করছে না? না করলেও বলি৷ আমার নাম রাফিয়া আনওয়ার।"
নামের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে সাবাজ বলেন, "এই সময়টাতে আমার ঘুমানোর অভ্যাস। না ঘুমালে সারাদিন মাথা চিনচিন করবে।"
"আচ্ছা তাহলে আপনি ঘুমিয়ে নিন আমি অপেক্ষা করছি।"
"যেভাবে কলিং বেল চাপছিলেন, অপেক্ষা করার ধৈর্য আপনার আছে বলে মনে হয় না।"
রাফিয়া মুখে হাত দিয়ে মৃদুস্বরে হেসে ফেললেন। তার চাপা হাসির আওয়াজ সাবাজের কান অব্দি পৌঁছায়। নারীকণ্ঠে মৃদু হাসি আকর্ষণীয় বটে। তবে এখন হাসিটা একদমই ভালো লাগছে না তার। বিরক্তির মাত্রা এখনও কমেনি।
কিন্তু মহিলাটি বুদ্ধিমান, সাবাজ ঠাহর করতে পারে।
"আমি জানি আমার ধৈর্য থাকলেও আপনি একজন অপরিচিত মহিলাকে ঘরে রেখে ঘুমাতে যেতেন না।"
সাবাজ কথা বলে না কোনো।
"ঘরে চা-পাতি আছে? থাকলে বানিয়ে নিয়ে আসি। চা খেতে খেতে কথা বলবো।"
তাকে বসিয়ে রেখে দু'কাপ চা বানিয়ে আনেন সাবাজ। ঘুম থেকে ঝেড়ে উঠতে চায়ের কাপে চুমুক দেওয়া ছাড়া আপাতত কোনো উপায় খুঁজে পান না তিনি।
রাফিয়া নামের এই মহিলাটির পরনে দামি জামদানী শাড়ি। বারো বছর বয়সী মেয়ে আছে মানে বয়স ত্রিশের এপার কিংবা ওপার হবে। মাথা হিজাব দিয়ে ঢাকা তবে মুখ খোলা। কিন্তু তাকে দেখে মনে হয় না তার বারো বছর বয়সী কোনো মেয়ে থাকতে পারে। মুখে ভারী মেকাপের কোনো ছাপ নেই। শুধুমাত্র চোখে কাজল দেওয়া আর ঠোঁটে হালকা গোলাপি রঙের লিপস্টিক। ব্যাস এটুকুই, এতেই তাকে প্রচণ্ড সুন্দরী লাগছে। এই বয়সের মহিলাদের এতো বেশি সৌন্দর্য খুব কম থাকে।
"আচ্ছা আমাকে প্রশ্ন করলেন না যে আমি এতো সকালে কেন আসলাম?"
চায়ের কাপটি টেবিলে রেখে সাবাজ উত্তর দেন, "আমার মনে হয় উত্তর পেয়ে গেছি।"
রাফিয়ার চোখজুড়ে কেমন একটা আনন্দের ছাপ। যেন চোখদুটো বলছে- আমি জানতাম বিখ্যাত আহমেদ সাবাজের ভাবনা শক্তির কোনো তুলনা নেই।
"আপনার বাসা যেখানেই হোক একেবারে কাছে কোথাও নয়। তাই সন্ধ্যা কিংবা তার একটু পরেই রওনা হয়েছেন যাতে আপনি সকাল সকাল এখানে এসে পোঁছাতে পারেন। কিন্তু এতো সকালে পৌঁছে যাবেন আপনি বুঝে উঠতে পারেননি। আমার অনুমান সঠিক হলে আপনার প্রাইভেট কার আর ড্রাইভার আশেপাশে কোথাও অপেক্ষা করছে।"- এতটুকু বলে আবার চায়ের কাপ হাতে নেন আহমেদ সাবাজ।
সামনে থাকা মহিলাটি কিছুটা চমকে উত্তর দেন, "আপনার অনুমান সঠিক। আমি আগেও আপনার ব্যাপারে শুনেছি কিন্তু এখন বাস্তব অভিজ্ঞতা হলো। কিন্তু কীভাবে বুঝলেন আমি ব্যক্তিগত গাড়িতে করে এসেছি?"
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সাবাজ উত্তর দেন, "বুঝতে না পারার কিছুই নেই। আমরা সকলে গভীরভাবে চিন্তা করি না এই যা।"
"আপনি গভীরভাবে ভাবতে পারেন বলেই আপনি আহমেদ সাবাজ। আশা করি আপনার অনুমানের ব্যাখ্যা পাব।"
"হাল্কা শীত এখনও বইছে। আমার এই বাড়ির সামনের গলিতে রিকশা, সাইকেল আর মোটরসাইকেল বাদে কোনো গাড়ি দেখা যায় না। আপনি বাইরে থেকে এসেছেন কিন্তু শিশিরের কোনো ফোঁটা আপনাকে ছোঁয়নি। মানে আপনি অবশ্যই হেঁটে আসেননি। মোটরসাইকেলে বা রিকশায় আসলে ঠাণ্ডা বাতাসে আপনার অবশ্যই কিছু্টা হলেও শীত লাগতো কিন্তু এখানে আসার পর থেকে আপনি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। তাহলে এসব যানে না আসলে আর হেঁটেও না আসলে এমন কিছুতে এসেছেন যার চারপাশে আটকানো থাকবে। তো সেক্ষেত্রে প্রাইভেট কার হতে পারে ভাবলাম।"
"কিন্তু আমি সকালে রওনা হয়ে সন্ধ্যার দিকেও তো এখানে পোঁছাতে পারতাম আর রাতে চলে যেতে পারতাম। তবে আমি সকালেই কেন আসলাম?"
"উত্তরটা পরে একসময় দেব। আরেকটা বিষয় হলো আপনি এখানে প্রথমবার নয়, আগেও এসেছেন।"
"আপনার এমনটা কেন মনে হচ্ছে?"
"এতো সকালে গলির পাশের দোকানগুলি খোলেনি যেখান থেকে আপনি আমার ঠিকানা জানতে পারেন। বলতে পারেন দু-একটা যে রিকশা চলছে ঐ রিকশাওয়ালার থেকে ঠিকানা জেনে নিতে পারেন৷ কিন্তু এই ঢাকা শহরে কোনো রিকশাওয়ালা কারো বাড়ি চেনে বলে আমার মনে হয় না। এই সকালে এসে একদমই ঠিক মানুষের দরজায় এসে দাঁড়ালেন এটা অবশ্যই অলৌকিক নয়। মানে আপনি আগে থেকেই আমার বাড়ি চিনতেন।"
এবার রাফিয়া হাসিমুখে বলে ফেললেন, "বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা শুনে মনে হয়- আরে এ তো একদমই সোজা।"
"এক্সাক্টলি এটাই। আমরা গভীরভাবে ভাবি না তাই উত্তর পাই না। তবে আমার অনুমানও সবসময় সঠিক হবে তেমনটা নয়। অনেক সময়ই যেটা ভাবি দেখা গেছে সেটা ভুল হয়ে দাঁড়ায়।"
"আচ্ছা সকালের খাবারের জন্য কিসের আয়োজন করেছেন?"
"কিছু ভেবে রাখিনি।"
"ঘরে চাল-ডাল নিশ্চয় আছে। না থাকলেও সমস্যা নেই। ড্রাইভারকে বাজারে পাঠাবো। আজকে আমার হাতের ভুনা খিচুড়ি খেয়ে দেখবেন।"
আহমেদ সাবাজ সম্ভবত অবাক হয়েছেন রাফিয়া আন্দাজ করে নেন। তার কিছু বলার আগেই রাফিয়া বলে ওঠেন, "দয়া করে অবাক হবেন না। আপনাকে আসল বিষয়টা বলা হয়নি।"
"কী বিষয়।"
"আমি আপনাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে চাই। আমার মেয়ের সমস্যা সমাধানের জন্য।"
"আপনার কেন মনে হচ্ছে আমি তার সমস্যার সমাধান করতে পারবো?"
"আমার স্বামী আপনাকে খুব শ্রদ্ধা করেন। তার একান্ত ইচ্ছা আপনি নিজেই আমাদের মেয়ের সমস্যা খুঁটিয়ে দেখবেন।"
রাজি হন আহমেদ সাবাজ। রাফিয়ার রান্না করা ভুনা খিচুড়ি খেয়েই বেরিয়ে পড়েন তারা। তার রান্নার হাতটাও চমৎকার, জাদু আছে বলতে হয়।
"আপনার দ্বৈত চরিত্রের ব্যাপারে জানার খুব আগ্রহ আমার। আপনি কীভাবে একইসাথে একজন সাইকোলজিস্ট আবার প্রাইভেট ডিটেকটিভ? বিষয়টা আরও জটিল লাগে এজন্য যে, আমি শুনেছি আপনার মধ্যে যখন এর কোনো একটি চরিত্র জাগ্রত হয় অন্য চরিত্রকে খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।"
সাবাজ মুচকি হেসে উত্তর দেন, "সময় নিয়ে বলবো সম্ভব হলে।"
রাফিয়া মনে মনে সাবাজের হাসির প্রশংসা করেন। লোকটি খুব বেশি হাসেন না। আর যারা কম হাসেন তাদের হঠাৎ করে হাসতে দেখলেই মুগ্ধ হতে হয়। তাদের হাসির মধ্যে যেন কোনো অদ্ভুত সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে।
"আচ্ছা কত সময় লাগবে আমাদের পৌঁছাতে?"- প্রশ্ন আহমেদ সাবাজের।
"সন্ধ্যা পার হয়ে যাবে।"
পাঁচিলঘেরা একটি বাড়ির সামনে এসে তাদের গাড়ি থামে। অন্ধকার ছেয়ে এসেছে অনেকটা। বাড়ির ভিতরে লাইট জ্বলছে তবে আশেপাশের পরিবেশ অন্ধকার। বুঝাই যাচ্ছে লোকালয় থেকে দূরে বাড়িটা। দারোয়ান গেট খুললে তারা ভিতরে প্রবেশ করেন। কলিং বেল চাপতে একটা মেয়ে এসে দরজা খুলে দিয়ে গেল। যতদূর বুঝা গেল সে কাজের মেয়ে হবে। বয়স সতেরো বা আঠারো হতে পারে। ফর্সা চেহারা। সবুজ-কালো কম্বিনেশনের একটা থ্রি-পিস পরে আছে। দরজা খুলেই সালাম দিল সে।
বাড়ির ভিতরটা বেশ সুন্দর। রাফিয়ার স্বামী অনেক পয়সাওয়ালা হবেন হয়তো। রাফিয়া বলেছিল তিনি নাকি বেশ সম্মান করেন তাকে। কিন্তু এ মূহুর্তে তাকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। সম্ভবত কোনো কাজে বাইরে আছেন।
"আপনার জন্য পানি গরম করা আছে। ট্যাপের পানি বেশ ঠাণ্ডা এখন।"- মেয়েটি সাবাজকে উদ্দেশ্য করে বলে, "হাত মুখ ধুয়ে নিবেন।"
সাধারণত বেশিরভাগ কাজের মেয়েদের কথায় কেমন আঞ্চলিক একটা টান থাকে, কিন্তু এর মাঝে তা লক্ষ্য করা গেল না। শব্দের উচ্চারণ সুস্পষ্ট, কণ্ঠটাও বেশ সুন্দর।
সাবাজকে লক্ষ্য করে রাফিয়া বলেন, "ফ্রেস হয়ে আসুন আমার স্বামীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিব।"
সাবাজ বুঝতে পারে যে তার স্বামী বাড়িতেই আছে। কিন্তু এখানে তার অনুপস্থিতির কারণ তিনি বুঝে উঠতে পারেন না।
_____
জানালার পাশে হুইল চেয়ারে বসে বাইরের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ভদ্রলোক। রাফিয়ার ডাকে পিছনে ফিরে তাকান তিনি। সাবাজের দিকে তাকিয়ে মুখে তার আনন্দের হাসি ফুটে ওঠে। সম্ভবত চিনতে পেরেছে তাকে। যদিও না চেনার কোনো কারণ স্পষ্ট নেই।
"আমার স্বামী মোস্তফা আনওয়ার। গত দুই বছর ধরেই তিনি এই অবস্থায়। দাঁড়াতে আর কথা বলতে পারেন না।"
সাবাজের মন কিছু মূহুর্তের জন্য বিষন্ন হয়ে যায়। লোকটিও তার সাথে কথা বলতে না পারার দুঃখ পাচ্ছে হয়তো।
তবে যার কারণেই এখানে আসা তাকেই দেখা হলো না এখনও। রাফিয়া তার মেয়ের রুমের দিকে আহমেদ সাবাজকে নিয়ে যান।
ঘুমাচ্ছে সে।
রাফিয়া বললো, "মেয়েটির চেহারায় কেমন অদ্ভুত মায়া জড়িয়ে আছে দেখছেন? কিন্তু যখনই তার ঘুম ভাঙবে এই মায়াভরা মুখে ভয় আর উদ্বেগ ছাড়া কিছুই দেখতে পাওয়া যাবে না।"
রাফিয়ার চোখ টলমল করছে। এক্ষুণি চোখের বাঁধ ভেঙ্গে লোনা পানির স্রোত বয়ে যেতে পারে। সাবাজ বুঝতে পেরে তাকে বলে, "আসুন, তাকে ঘুমাতে দিন।"
একসাথে সবাই রাতের খাবার সেরেছেন। শুধুমাত্র রাফিয়ার মায়াবী চেহারার মেয়েটা বাদে। সাবাজ তার রুমে একটা অদ্ভুত বিষয় লক্ষ্য করেছেন। বিছানায় বেডশিট নেই, স্রেফ ফোমের উপর শুয়ে আছে মেয়েটা। জানালায় কোনো পর্দা টাঙানো নেই। একটু খটকা লেগেছে বিষয়টা।
খাওয়া শেষে রাফিয়াকে প্রশ্ন করেন সাবাজ, "কতদিন ধরে তার এই সমস্যা?"
"প্রায় পনেরো-ষোল দিন।"
"মানে বলতে চাচ্ছেন হঠাৎ-ই সে এ সমস্যাতে ভুগছে?"
"হঠাৎ বলা যায়। আবার বললেও ভুল হয়।"
"কেন?"
"এই পনেরো বা ষোল দিন আগে একটা প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তি করানোর পর থেকেই তার এই সমস্যা।"
"আপনি নিশ্চিত?"
"শতভাগ।"
"তার রুম নম্বর কত ছিল মনে আছে?"
"হ্যাঁ, নয়শত নয়।"
"তাহলে ক্লিনিক থেকেই বিষয়টি খোলাসার যাত্রা শুরু করতে হবে। কিন্তু তার আগে আপনার মেয়ের সমস্যাটা ধরাও কম জরুরী নয়।"
কিছু সময় বাদেই চিৎকারের শব্দ ভেসে আসে। রাফিয়া দৌঁড়ে তার মেয়ের রুমের দিকে যান। মোস্তফা সাহেব কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে হুইল চেয়ারেই বসে আছেন। তার এই মূহুর্তে কিছুই করার সামর্থ্য বা শক্তি কোনোটাই নেই। সাবাজ রাফিয়ার পিছে মেয়েটির রুম পর্যন্ত যায়। দরজার কাছে যাওয়ার আগেই রাফিয়া আটকে দেয় সাবাজকে।
"প্লিজ ভিতরে আসবেন না। বা দরজার সামনেও আসবেন না। কিছু সময় কষ্ট করে ধৈর্য ধরুন।"
সাবাজ দাঁড়িয়ে পড়েন। নিষেধাজ্ঞার কারণ বুঝতে পারলেন না তিনি। তাকে তো ডাকা হয়েছে তার মেয়েকে দেখানোর জন্য তবে সে নিষেধ করছে কেন তার সাথে মেয়েটির রুমে যেতে?
মেয়েটি এখনও চিৎকার করছে। রাফিয়া রুমে যাওয়ার পর আরও জোরে চিৎকার করছে। রাফিয়া রুমের বাইরে চলে আসেন। তার চোখদুটো বেয়ে অল্প করে পানি পড়ছে। এসে সাবাজের পাশে দাঁড়ান তিনি। সাবাজের ইচ্ছা হচ্ছে ভিতরে গিয়ে দেখতে আসলে কী ঘটছে। কিন্তু রাফিয়া নিষেধ করেছে যেহেতু, তিনি আর পা বাড়াননি।
কয়েক সেকেন্ড বাদেই দরজার সামনে একে একে কিছু কাপড় জড়ো হলো। সম্ভবত ভিতর থেকে মেয়েটি তার গায়ের সব কাপড় এক এক করে খুলে ছুড়ে মেরেছে। যেমনটা রাফিয়া বলেছিল তাকে।
এই মুহূর্তে সম্ভবত মেয়েটির শরীরে সুতাটুকুও নেই। সাবাজ এটা বুঝতে পারেন যে রাফিয়া তাকে তার রুমে যেতে নিষেধ করেছিলেন কেন। মূর্তির মতো দু'জনেই দাঁড়িয়ে আছেন সেখানে।
চলবে...
Sayan
Hasibul hasan santo, Santa akter, Sk sagor, Sk imran, Rasel islam, Mr faruk, Saiful Osman and লেখাটি পছন্দ করেছে
- Trimatraধুমকেতু
- Posts : 23
স্বর্ণমুদ্রা : 1434
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-06-05
Re: রুম নম্বরঃ ৯০৯
Sat Jun 05, 2021 8:34 pm
২য় পর্ব
মহিলাকণ্ঠের ডাকে পিছনে ঘুরে তাকান আহমেদ সাবাজ। আবছা আলোতে দূরে থাকা অবয়বটিকে চেনা সম্ভব হচ্ছে না। ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসছে মহিলাটি। কাছে আসতেই পরিচিত মুখ, ভীষণ পরিচিত- সাবাজের অর্ধাঙ্গিনী।
"তুমি এখানে কীভাবে এলে?"- সাবাজ প্রশ্ন করে।
"কেন? তোমার অসুবিধা হচ্ছে?"
"প্রশ্নবিদ্ধ করছো কেন আমাকে?"
কিছু না বলে সাবাজের পাশ কাটিয়ে জানালার দিকে মুখ করে তাকায় তার স্ত্রী। সাবাজ ঘাড় ঘুরিয়ে নেয় সেদিকে। জানালা বন্ধ, তাছাড়া অন্ধকার রাতে জানালার থাই গ্লাস ভেদ করেও বাইরের কিছু দেখার সম্ভাবনা নেই। তবে কী দেখছে সে? জানালার দুপাশে ঝুলানো পর্দা? নাকি জানালার উপরে থাকা ডিম লাইট যেখান থেকে আবছা আলো আসছে?
কোথাও এমনটা নয়তো এই সামান্য আলোও তাকে বিরক্ত করছে? কয়েক সেকেন্ড এভাবেই চললো, নীরব দু'জনেই।
সাবাজের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে পুনরায় প্রশ্ন করে তার স্ত্রী, "কখনও কি আমার কিংবা আমার বাচ্চার কথা মনে পড়ে না তোমার?"
সাবাজ উত্তর দেয় না। পেটের উপর থেকে শাড়ির অংশটুকু সরিয়ে নিয়ে তার স্ত্রী আবারও বলে, "দেখ, কেমন নির্দয়ভাবে আমার পেট চিরে তারা তোমার সন্তানকে বের করেছিল। এটাও কি কষ্ট দেয় না তোমাকে?"
সাবাজ তার স্ত্রীর পেটে ঊর্ধমুখীভাবে কাটার দাগ দেখতে পায় যেগুলোকে চৌদ্দটি সেলাই দ্বারা জোড়া লাগানো হয়েছে। তার স্ত্রী ফের প্রশ্ন করে, "বলো? কখনও কি মনে পড়ে না আমাদের? কষ্ট হয় না আমাদের জন্য?"
সাবাজের চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা হয়- হ্যাঁ প্রচণ্ড মনে পড়ে তোমাদের, খুব বেশি কষ্ট হয় তোমাদের অনুপস্থিতিতে। কিন্তু তার গলা দিয়ে একটি শব্দও বের হয় না।
"আমি জানি তুমি কোনো উত্তর দেবে না। এটাও জানি আমাদের অনেক বেশি মনে পড়ে তোমার। বেঁচে থেকে এতো কষ্ট ভোগ করে লাভ আছে বলো? তোমাকে নিয়ে যেতে চাই আমি। যাবে?"
সাবাজের উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে ডান হাতে থাকা ড্যাগারটি নিয়ে ক্ষীপ্র ষাঁড়ের মতো ঝাপিয়ে আসে তার স্ত্রী।
_____
বাথরুমে গিয়ে চোখে-মুখে পানি ছিটায় সাবাজ। রুমে ফিরে এসে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে চোখ বন্ধ করলেই দৃশ্যটি আবারও ভেসে ওঠে। স্বাভাবিকভাবেই তোয়ালেটা রেখে আবারও বিছানায় শুয়ে পড়েন। কিঞ্চিৎ ভয় পাওয়ার কথা তবে তিনি পাচ্ছেন না। স্বপ্নটি পরিচিত তার কাছে, আগেও দেখেছেন কয়েকবার। সেজন্যই ভয় নামক জিনিস টা সাড়া দিচ্ছে না।
একই স্বপ্ন বারবার দেখাকে প্রাথমিকভাবে "ড্রিম ল্যাগ" নাম দেওয়া হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ কিংবা আবেগতাড়িত ঘটনাকে মস্তিষ্ক সংরক্ষণ করে থাকে৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নেতিবাচক ঘটনাগুলো স্বপ্নে ফিরে আসে।
সাবাজের জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছিল তার স্ত্রী-বাচ্চার মৃত্যু। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে দু'জনেই মারা যান। একসাথে দু'টি জীবনের নিভে যাওয়া সাবাজের জীবনে কম শোকের সাড়া জাগায়নি। তাদের মৃত্যুর ঘটনাকে সাবাজ কখনওই ভুলে থাকতে পারেননি আর এটাকে তার মস্তিষ্ক তীব্রভাবে সংরক্ষণ করে রেখেছে যা বারবার স্বপ্নে ফিরে এসে ড্রিম ল্যাগ ঘটাচ্ছে।
তবে স্বপ্নের বিষয়গুলির ব্যাখ্যা সাবাজ দাঁড় করাতে পারেননি৷ স্বপ্নে তিনি তার স্ত্রীর পেটে চৌদ্দটি সেলাইয়ের দাগ লক্ষ্য করেন অথচ সিজারে এত বড় করে কাটা হয় না যে এতগুলো সেলাই-এর প্রয়োজন হবে। তাছাড়া সিজারের জন্য পেটে আড়াআড়িভাবে কাটা হয় কিন্তু তার পেটে কাটার দাগ নাভী থেকে ঊর্ধ্বগামী।
এবং সবথেকে বড় বিষয় হলো তার স্ত্রী-সন্তান দু'জনেরই মৃত্যু নরমাল ডেলিভারির সময়ে হয়েছিল, সিজারে নয়।
স্বপ্নে মানুষ অবাস্তব, অসম্ভব, অপ্রাসঙ্গিক কতকিছুই তো দেখে। এই যেমন, স্বপ্নে যখন তার স্ত্রী প্রথমে তার নিকটে আসে, তার দু'হাতে কিছুই ছিল না। অথচ খানিক বাদেই সে বড় এক ছুরি নিয়ে আক্রমণ করে বসে। এজন্য সাবাজ স্বপ্নটিকে সাধারণ ড্রিম ল্যাগ হিসেবেই মেনে নেন।
সকালের খাবারের টেবিলেও গতরাতের মতই যথারীতি চারজন। রাফিয়া আর তার স্বামী ও গতকালের সেই মেয়েটি। তবে রাফিয়ার মেয়েটি এখানে নেই। তার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে রাফিয়া উত্তর দেয়, "নওরিন তার ঘর থেকে কখনও বের হয় না। তাকে খাইয়ে দিয়ে এসেই খেতে বসি আমরা।"
"মানে শুধুমাত্র ঘুমানোর পরের সময় বাদে বাকি সবসময় সে স্বাভাবিক থাকে?"
"স্বাভাবিক থাকে তেমনটা নয়। চুপচাপ, মুখ মলিন করে রাখে সবসময়। কথা বলে না বললেই চলে। কিছু জিজ্ঞাসা করলেও ভালো করে উত্তর দেয় না।"
আহমেদ সাবাজ খাওয়া শেষ করে হাত ধোয়ার জন্য উঠেছেন। নিজের বাড়ি হলে অবশ্য প্লেটেই হাত ধুয়ে নিতেন।
রাফিয়া আর তার স্বামীর ব্যাপারে একটা বিষয় খুব ভালো লাগে তার। একই টেবিলে বসে খাবার খাওয়া মেয়েটি তাদের কেউ না। দত্তক নেওয়া সন্তানও না। সুশীল সমাজে যাকে "কাজের মেয়ে" নামে আখ্যা করা হয়। কিন্তু এই বাড়িতে তাকে একদমই কাজের মেয়ে লাগছে না। তারা দু'জনেই নিজের মেয়ের মতোই দেখভাল করেন ওর।
খাবার পর্ব সেরে ড্রয়িং রুমে বসে তারা। মোস্তফা আনওয়ারকে দেখে খুব দুঃখ হয় সাবাজের। হুইল চেয়ার যেন তার জগতকে সংকীর্ণ ঘরে আবদ্ধ করে রেখেছে। তাদের সাথে মেয়েটিও আছে।
"আপনি কিন্তু একটি বিষয়ের সমাধান এখনও দেননি।"- অভিযোগ রাফিয়ার।
"কোন বিষয়?"- সাবাজ প্রশ্ন করেন।
"আমি আপনার নিকট সকালে রওনা হয়ে সন্ধ্যার দিকে আপনার বাড়িতে পৌঁছাতে পারতাম আর রাতে রওনা করে সকালে ফের আমার বাড়িতে চলে আসতে পারতাম। তবে আমি সকালেই কেন গিয়েছিলাম?"
"আপনি সকালে আমার কাছে পৌঁছেছিলেন যাতে করে রাতে এখানে মানে আপনার বাড়িতে পৌঁছাতে পারেন। আপনার উদ্দেশ্য ছিল এমন কিছু দেখানো যা দিনের বেলায় আসলে পরবর্তী রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। কিন্তু আপনি বিষয়টি নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন ছিলেন বলে অপেক্ষা করতে চাচ্ছিলেন না। এজন্যই আমার কাছে সকালেই গিয়েছিলেন।"- একনাগাড়ে উত্তর দেন আহমেদ সাবাজ। বাকি সবাই দক্ষ শ্রোতার বেশে তার কথা শুনছে৷
"তবে বিষয়টি কী হতে পারে এ ব্যাপারে তখন আমার ধারণা ছিল না যে কারণে উত্তর দিয়েছিলাম না। কিন্তু গতরাতে বুঝতে পারলাম আপনার মেয়ে ঠিক কেমন আচরণ করে এটা আমাকে বুঝানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন।"
ডানে তাকাতেই সাবাজ লক্ষ্য করেন মেয়েটি কেমন উসখুস করছে। নাম জানা হয়নি তার। সাবাজ তার নাম জিজ্ঞাসা করলেন। মেয়েটি নিচুস্বরে উত্তর দিলো, "আয়েশা আফরিন।"
"তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে কিছু বলতে চাচ্ছো। বলবে কিছু?"- প্রশ্ন সাবাজের।
"আপনি কীভাবে সবকিছু ধরে ফেলেন আমার খুব জানতে ইচ্ছা হয়।"
আহমেদ সাবাজ মুচকি হাসলেন, "অনুমান করে।"
"অনুমান করে সবকিছুর ব্যাখ্যা দাঁড় করানো সম্ভব না।"
নড়েচড়ে বসলেন সাবাজ- "মনে করো আকাশে ভীষণ কালো মেঘ করেছে। এই মূহুর্তে তোমার অনুমান কী হবে?"
"বৃষ্টি আসতে পারে।"
"কেন? মেঘ কাটিয়ে উঠে রোদ বের হওয়ার সম্ভাবনা নেই?"
"আছে। কিন্তু বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।"- একজন সুতার্কিকের মতো উত্তর দেয় আয়েশা।
"এক্স্যাক্টলি এটাই। মেঘ করলে বৃষ্টি হওয়া না হওয়া দু'টোরই সম্ভাবনা থাকে তবে সবথেকে গ্রহণযোগ্য সম্ভাবনা হচ্ছে বৃষ্টি হওয়া। তেমনি কোনো বিষয় যদি আমার সামনে আসে আমি কয়েকটি সম্ভাবনা দাঁড় করাই আর সেখান থেকে সবথেকে বেশি গ্রহণযোগ্য যেটা, তা গ্রহণ করি। মেঘ কাটিয়ে যেমন রোদ উঠতে পারে তেমনি কোনো বিষয়ের সবথেকে গ্রহণযোগ্য সম্ভাবনাও ভুল হতে পারে।"
কথা শেষ করে সাবাজ আয়েশার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারেন তার উত্তরে মেয়েটা যথেষ্ট সন্তুষ্ট হয়েছে৷
ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত নওরিন অনেকটা স্বাভাবিক থাকে। সাবাজ এই সময়ে তার সাথে কথা বলার জন্য ঠিক করেন। সাথে রাফিয়াও আছে৷ মেয়েটির রুমে ঢুকতেই গরম আবহাওয়া অনুভব করেন সাবাজ। রুম হিটার ব্যবহার করা হয়েছে। এখন খুব বেশি শীত নেই। মাঝরাতের পর একটা পাতলা কম্বল কিংবা কাঁথা লাগে এই যা৷ কিন্তু নওরিনের রুমে কাঁথা কম্বল কিছুই নেই। তাছাড়া ঘুম থেকে উঠেই চিৎকার মেরে সব কাপড় খুলে বাইরে ছুড়ে আবার দরজা লাগিয়ে দেয়। যে কারণে তার রুমে হিটার ব্যবহার করা হচ্ছে এখনও।
নওরিনকে কথা বলানোর চেষ্টা করানো হচ্ছে। কিন্তু মেয়েটির কাছ থেকে আশানুরূপ কিছুই পাচ্ছেন না সাবাজ। মেয়েটি কোনো ঘোরে আছে মনে হচ্ছে, আশেপাশে কিছুর দিকেই কোনো খেয়াল নেই। গরমে সাবাজের কপাল ঘেমে উঠছে। পকেট থেকে সাদা রুমাল বের করলে তা হাত থেকে নিচে পড়ে যায়। ওটাকে উঠিয়ে দু'তিনবার ঝাড়া দিয়ে কপালের ঘাম মুছে নেন তিনি। নওরিন চোখ বড় বড় করে রুমালের দিকে তাকায়, পরবর্তী মূহুর্তেই চোখ বন্ধ করে চিৎকার শুরু করে। তার হঠাৎ এমন আচরণে রাফিয়া এবং সাবাজ দু'জনেই চমকে যান। রাফিয়া সাবাজকে অনুরোধ করে বাইরে নিয়ে আসেন। রুমাল দেখে এভাবে সে চমকে যাবে সাবাজ কল্পনাও করেননি। আর চমকানোর কারণটাও মাথায় আসছে না৷
"মিসেস রাফিয়া, আপনার মেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে আমায় জানাবেন।"
"কেন?"
"ঘুম ভাঙা পর্যন্ত আমি তার রুমে থাকবো।"
রাফিয়া কিছু বলার আগেই সাবাজ বলেন, "আর হ্যাঁ, আপনিও থাকবেন অবশ্যই।"
রাফিয়া হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ান।
_____
নওরিন ঘুমিয়ে পড়েছে৷ তাকে খাওয়ানোর পরেই সে ঘুমিয়ে পড়ে। অনেকসময় হলো সাবাজ আর রাফিয়া তার রুমে আছেন৷ সাবাজ নওরিনের বিছানার পাশ দিয়ে নিঃশব্দে পায়চারি করছে। কয়েক সেকেন্ড পরপর নওরিনের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। কিছু সময় বাদে পায়চারি থামিয়ে নওরিনের চোখের দিকে লক্ষ্য করে সাবাজ। রাফিয়াও এগিয়ে আসে। নওরিনের চোখের পাতা হাল্কা কাঁপছে; পাতার উপর দিয়ে চোখের মনির নড়াচড়া খেয়াল করা যাচ্ছে। সাবাজ রাফিয়াকে বলে ছোট আয়না কিংবা চশমা থাকলে দ্রুত নিয়ে আসতে। রাফিয়া কয়েক সেকেন্ডের মাথায় দৌঁড়ে তার স্বামীর চশমা নিয়ে আসেন।
চশমাটি নওরিনের নাকের সাথে প্রায় মিশিয়ে ধরেন সাবাজ। কোনোরকম ঘোলাটে হয়েছে চশমার কাঁচ। সম্ভবত শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে মেয়েটার। কিন্তু তার হাত-পা একবিন্দুও নড়ছে না।
ওগুলো যেন একেবারে অসাড় হয়ে আছে।
চলবে...
Sayan
মহিলাকণ্ঠের ডাকে পিছনে ঘুরে তাকান আহমেদ সাবাজ। আবছা আলোতে দূরে থাকা অবয়বটিকে চেনা সম্ভব হচ্ছে না। ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসছে মহিলাটি। কাছে আসতেই পরিচিত মুখ, ভীষণ পরিচিত- সাবাজের অর্ধাঙ্গিনী।
"তুমি এখানে কীভাবে এলে?"- সাবাজ প্রশ্ন করে।
"কেন? তোমার অসুবিধা হচ্ছে?"
"প্রশ্নবিদ্ধ করছো কেন আমাকে?"
কিছু না বলে সাবাজের পাশ কাটিয়ে জানালার দিকে মুখ করে তাকায় তার স্ত্রী। সাবাজ ঘাড় ঘুরিয়ে নেয় সেদিকে। জানালা বন্ধ, তাছাড়া অন্ধকার রাতে জানালার থাই গ্লাস ভেদ করেও বাইরের কিছু দেখার সম্ভাবনা নেই। তবে কী দেখছে সে? জানালার দুপাশে ঝুলানো পর্দা? নাকি জানালার উপরে থাকা ডিম লাইট যেখান থেকে আবছা আলো আসছে?
কোথাও এমনটা নয়তো এই সামান্য আলোও তাকে বিরক্ত করছে? কয়েক সেকেন্ড এভাবেই চললো, নীরব দু'জনেই।
সাবাজের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে পুনরায় প্রশ্ন করে তার স্ত্রী, "কখনও কি আমার কিংবা আমার বাচ্চার কথা মনে পড়ে না তোমার?"
সাবাজ উত্তর দেয় না। পেটের উপর থেকে শাড়ির অংশটুকু সরিয়ে নিয়ে তার স্ত্রী আবারও বলে, "দেখ, কেমন নির্দয়ভাবে আমার পেট চিরে তারা তোমার সন্তানকে বের করেছিল। এটাও কি কষ্ট দেয় না তোমাকে?"
সাবাজ তার স্ত্রীর পেটে ঊর্ধমুখীভাবে কাটার দাগ দেখতে পায় যেগুলোকে চৌদ্দটি সেলাই দ্বারা জোড়া লাগানো হয়েছে। তার স্ত্রী ফের প্রশ্ন করে, "বলো? কখনও কি মনে পড়ে না আমাদের? কষ্ট হয় না আমাদের জন্য?"
সাবাজের চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা হয়- হ্যাঁ প্রচণ্ড মনে পড়ে তোমাদের, খুব বেশি কষ্ট হয় তোমাদের অনুপস্থিতিতে। কিন্তু তার গলা দিয়ে একটি শব্দও বের হয় না।
"আমি জানি তুমি কোনো উত্তর দেবে না। এটাও জানি আমাদের অনেক বেশি মনে পড়ে তোমার। বেঁচে থেকে এতো কষ্ট ভোগ করে লাভ আছে বলো? তোমাকে নিয়ে যেতে চাই আমি। যাবে?"
সাবাজের উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে ডান হাতে থাকা ড্যাগারটি নিয়ে ক্ষীপ্র ষাঁড়ের মতো ঝাপিয়ে আসে তার স্ত্রী।
_____
বাথরুমে গিয়ে চোখে-মুখে পানি ছিটায় সাবাজ। রুমে ফিরে এসে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে চোখ বন্ধ করলেই দৃশ্যটি আবারও ভেসে ওঠে। স্বাভাবিকভাবেই তোয়ালেটা রেখে আবারও বিছানায় শুয়ে পড়েন। কিঞ্চিৎ ভয় পাওয়ার কথা তবে তিনি পাচ্ছেন না। স্বপ্নটি পরিচিত তার কাছে, আগেও দেখেছেন কয়েকবার। সেজন্যই ভয় নামক জিনিস টা সাড়া দিচ্ছে না।
একই স্বপ্ন বারবার দেখাকে প্রাথমিকভাবে "ড্রিম ল্যাগ" নাম দেওয়া হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ কিংবা আবেগতাড়িত ঘটনাকে মস্তিষ্ক সংরক্ষণ করে থাকে৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নেতিবাচক ঘটনাগুলো স্বপ্নে ফিরে আসে।
সাবাজের জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছিল তার স্ত্রী-বাচ্চার মৃত্যু। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে দু'জনেই মারা যান। একসাথে দু'টি জীবনের নিভে যাওয়া সাবাজের জীবনে কম শোকের সাড়া জাগায়নি। তাদের মৃত্যুর ঘটনাকে সাবাজ কখনওই ভুলে থাকতে পারেননি আর এটাকে তার মস্তিষ্ক তীব্রভাবে সংরক্ষণ করে রেখেছে যা বারবার স্বপ্নে ফিরে এসে ড্রিম ল্যাগ ঘটাচ্ছে।
তবে স্বপ্নের বিষয়গুলির ব্যাখ্যা সাবাজ দাঁড় করাতে পারেননি৷ স্বপ্নে তিনি তার স্ত্রীর পেটে চৌদ্দটি সেলাইয়ের দাগ লক্ষ্য করেন অথচ সিজারে এত বড় করে কাটা হয় না যে এতগুলো সেলাই-এর প্রয়োজন হবে। তাছাড়া সিজারের জন্য পেটে আড়াআড়িভাবে কাটা হয় কিন্তু তার পেটে কাটার দাগ নাভী থেকে ঊর্ধ্বগামী।
এবং সবথেকে বড় বিষয় হলো তার স্ত্রী-সন্তান দু'জনেরই মৃত্যু নরমাল ডেলিভারির সময়ে হয়েছিল, সিজারে নয়।
স্বপ্নে মানুষ অবাস্তব, অসম্ভব, অপ্রাসঙ্গিক কতকিছুই তো দেখে। এই যেমন, স্বপ্নে যখন তার স্ত্রী প্রথমে তার নিকটে আসে, তার দু'হাতে কিছুই ছিল না। অথচ খানিক বাদেই সে বড় এক ছুরি নিয়ে আক্রমণ করে বসে। এজন্য সাবাজ স্বপ্নটিকে সাধারণ ড্রিম ল্যাগ হিসেবেই মেনে নেন।
সকালের খাবারের টেবিলেও গতরাতের মতই যথারীতি চারজন। রাফিয়া আর তার স্বামী ও গতকালের সেই মেয়েটি। তবে রাফিয়ার মেয়েটি এখানে নেই। তার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে রাফিয়া উত্তর দেয়, "নওরিন তার ঘর থেকে কখনও বের হয় না। তাকে খাইয়ে দিয়ে এসেই খেতে বসি আমরা।"
"মানে শুধুমাত্র ঘুমানোর পরের সময় বাদে বাকি সবসময় সে স্বাভাবিক থাকে?"
"স্বাভাবিক থাকে তেমনটা নয়। চুপচাপ, মুখ মলিন করে রাখে সবসময়। কথা বলে না বললেই চলে। কিছু জিজ্ঞাসা করলেও ভালো করে উত্তর দেয় না।"
আহমেদ সাবাজ খাওয়া শেষ করে হাত ধোয়ার জন্য উঠেছেন। নিজের বাড়ি হলে অবশ্য প্লেটেই হাত ধুয়ে নিতেন।
রাফিয়া আর তার স্বামীর ব্যাপারে একটা বিষয় খুব ভালো লাগে তার। একই টেবিলে বসে খাবার খাওয়া মেয়েটি তাদের কেউ না। দত্তক নেওয়া সন্তানও না। সুশীল সমাজে যাকে "কাজের মেয়ে" নামে আখ্যা করা হয়। কিন্তু এই বাড়িতে তাকে একদমই কাজের মেয়ে লাগছে না। তারা দু'জনেই নিজের মেয়ের মতোই দেখভাল করেন ওর।
খাবার পর্ব সেরে ড্রয়িং রুমে বসে তারা। মোস্তফা আনওয়ারকে দেখে খুব দুঃখ হয় সাবাজের। হুইল চেয়ার যেন তার জগতকে সংকীর্ণ ঘরে আবদ্ধ করে রেখেছে। তাদের সাথে মেয়েটিও আছে।
"আপনি কিন্তু একটি বিষয়ের সমাধান এখনও দেননি।"- অভিযোগ রাফিয়ার।
"কোন বিষয়?"- সাবাজ প্রশ্ন করেন।
"আমি আপনার নিকট সকালে রওনা হয়ে সন্ধ্যার দিকে আপনার বাড়িতে পৌঁছাতে পারতাম আর রাতে রওনা করে সকালে ফের আমার বাড়িতে চলে আসতে পারতাম। তবে আমি সকালেই কেন গিয়েছিলাম?"
"আপনি সকালে আমার কাছে পৌঁছেছিলেন যাতে করে রাতে এখানে মানে আপনার বাড়িতে পৌঁছাতে পারেন। আপনার উদ্দেশ্য ছিল এমন কিছু দেখানো যা দিনের বেলায় আসলে পরবর্তী রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। কিন্তু আপনি বিষয়টি নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন ছিলেন বলে অপেক্ষা করতে চাচ্ছিলেন না। এজন্যই আমার কাছে সকালেই গিয়েছিলেন।"- একনাগাড়ে উত্তর দেন আহমেদ সাবাজ। বাকি সবাই দক্ষ শ্রোতার বেশে তার কথা শুনছে৷
"তবে বিষয়টি কী হতে পারে এ ব্যাপারে তখন আমার ধারণা ছিল না যে কারণে উত্তর দিয়েছিলাম না। কিন্তু গতরাতে বুঝতে পারলাম আপনার মেয়ে ঠিক কেমন আচরণ করে এটা আমাকে বুঝানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন।"
ডানে তাকাতেই সাবাজ লক্ষ্য করেন মেয়েটি কেমন উসখুস করছে। নাম জানা হয়নি তার। সাবাজ তার নাম জিজ্ঞাসা করলেন। মেয়েটি নিচুস্বরে উত্তর দিলো, "আয়েশা আফরিন।"
"তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে কিছু বলতে চাচ্ছো। বলবে কিছু?"- প্রশ্ন সাবাজের।
"আপনি কীভাবে সবকিছু ধরে ফেলেন আমার খুব জানতে ইচ্ছা হয়।"
আহমেদ সাবাজ মুচকি হাসলেন, "অনুমান করে।"
"অনুমান করে সবকিছুর ব্যাখ্যা দাঁড় করানো সম্ভব না।"
নড়েচড়ে বসলেন সাবাজ- "মনে করো আকাশে ভীষণ কালো মেঘ করেছে। এই মূহুর্তে তোমার অনুমান কী হবে?"
"বৃষ্টি আসতে পারে।"
"কেন? মেঘ কাটিয়ে উঠে রোদ বের হওয়ার সম্ভাবনা নেই?"
"আছে। কিন্তু বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।"- একজন সুতার্কিকের মতো উত্তর দেয় আয়েশা।
"এক্স্যাক্টলি এটাই। মেঘ করলে বৃষ্টি হওয়া না হওয়া দু'টোরই সম্ভাবনা থাকে তবে সবথেকে গ্রহণযোগ্য সম্ভাবনা হচ্ছে বৃষ্টি হওয়া। তেমনি কোনো বিষয় যদি আমার সামনে আসে আমি কয়েকটি সম্ভাবনা দাঁড় করাই আর সেখান থেকে সবথেকে বেশি গ্রহণযোগ্য যেটা, তা গ্রহণ করি। মেঘ কাটিয়ে যেমন রোদ উঠতে পারে তেমনি কোনো বিষয়ের সবথেকে গ্রহণযোগ্য সম্ভাবনাও ভুল হতে পারে।"
কথা শেষ করে সাবাজ আয়েশার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারেন তার উত্তরে মেয়েটা যথেষ্ট সন্তুষ্ট হয়েছে৷
ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত নওরিন অনেকটা স্বাভাবিক থাকে। সাবাজ এই সময়ে তার সাথে কথা বলার জন্য ঠিক করেন। সাথে রাফিয়াও আছে৷ মেয়েটির রুমে ঢুকতেই গরম আবহাওয়া অনুভব করেন সাবাজ। রুম হিটার ব্যবহার করা হয়েছে। এখন খুব বেশি শীত নেই। মাঝরাতের পর একটা পাতলা কম্বল কিংবা কাঁথা লাগে এই যা৷ কিন্তু নওরিনের রুমে কাঁথা কম্বল কিছুই নেই। তাছাড়া ঘুম থেকে উঠেই চিৎকার মেরে সব কাপড় খুলে বাইরে ছুড়ে আবার দরজা লাগিয়ে দেয়। যে কারণে তার রুমে হিটার ব্যবহার করা হচ্ছে এখনও।
নওরিনকে কথা বলানোর চেষ্টা করানো হচ্ছে। কিন্তু মেয়েটির কাছ থেকে আশানুরূপ কিছুই পাচ্ছেন না সাবাজ। মেয়েটি কোনো ঘোরে আছে মনে হচ্ছে, আশেপাশে কিছুর দিকেই কোনো খেয়াল নেই। গরমে সাবাজের কপাল ঘেমে উঠছে। পকেট থেকে সাদা রুমাল বের করলে তা হাত থেকে নিচে পড়ে যায়। ওটাকে উঠিয়ে দু'তিনবার ঝাড়া দিয়ে কপালের ঘাম মুছে নেন তিনি। নওরিন চোখ বড় বড় করে রুমালের দিকে তাকায়, পরবর্তী মূহুর্তেই চোখ বন্ধ করে চিৎকার শুরু করে। তার হঠাৎ এমন আচরণে রাফিয়া এবং সাবাজ দু'জনেই চমকে যান। রাফিয়া সাবাজকে অনুরোধ করে বাইরে নিয়ে আসেন। রুমাল দেখে এভাবে সে চমকে যাবে সাবাজ কল্পনাও করেননি। আর চমকানোর কারণটাও মাথায় আসছে না৷
"মিসেস রাফিয়া, আপনার মেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে আমায় জানাবেন।"
"কেন?"
"ঘুম ভাঙা পর্যন্ত আমি তার রুমে থাকবো।"
রাফিয়া কিছু বলার আগেই সাবাজ বলেন, "আর হ্যাঁ, আপনিও থাকবেন অবশ্যই।"
রাফিয়া হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ান।
_____
নওরিন ঘুমিয়ে পড়েছে৷ তাকে খাওয়ানোর পরেই সে ঘুমিয়ে পড়ে। অনেকসময় হলো সাবাজ আর রাফিয়া তার রুমে আছেন৷ সাবাজ নওরিনের বিছানার পাশ দিয়ে নিঃশব্দে পায়চারি করছে। কয়েক সেকেন্ড পরপর নওরিনের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। কিছু সময় বাদে পায়চারি থামিয়ে নওরিনের চোখের দিকে লক্ষ্য করে সাবাজ। রাফিয়াও এগিয়ে আসে। নওরিনের চোখের পাতা হাল্কা কাঁপছে; পাতার উপর দিয়ে চোখের মনির নড়াচড়া খেয়াল করা যাচ্ছে। সাবাজ রাফিয়াকে বলে ছোট আয়না কিংবা চশমা থাকলে দ্রুত নিয়ে আসতে। রাফিয়া কয়েক সেকেন্ডের মাথায় দৌঁড়ে তার স্বামীর চশমা নিয়ে আসেন।
চশমাটি নওরিনের নাকের সাথে প্রায় মিশিয়ে ধরেন সাবাজ। কোনোরকম ঘোলাটে হয়েছে চশমার কাঁচ। সম্ভবত শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে মেয়েটার। কিন্তু তার হাত-পা একবিন্দুও নড়ছে না।
ওগুলো যেন একেবারে অসাড় হয়ে আছে।
চলবে...
Sayan
Hasibul hasan santo, Santa akter, Sk sagor, Sk imran, Rasel islam, Mr faruk, Saiful Osman and লেখাটি পছন্দ করেছে
- Trimatraধুমকেতু
- Posts : 23
স্বর্ণমুদ্রা : 1434
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-06-05
Re: রুম নম্বরঃ ৯০৯
Sat Jun 05, 2021 8:35 pm
৩য় পর্ব
নওরিনের চাপা কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। তার হঠাৎ ঘুম ভাঙার সাথে সাথেই রাফিয়া সাবাজকে রুমের বাইরে নিয়ে আসেন। মিনিটখানেকের মতো চিৎকার মেরে এখন কান্না করছে মেয়েটা। সাবাজ তার এখনকার অবস্থা দেখতে যেতেও পারছেন না কারণ মেয়েটি এখন সম্পূর্ণ বিবস্ত্র।
"ঘুম থেকে উঠে সে কেমন আচরণ করে আপনি জানেন কি মিসেস রাফিয়া?"- সাবাজ প্রশ্ন করেন।
"না। ঘুম ভাঙার পর সে তার পাশে কাউকে দেখলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতো। তার রুম থেকে বাইরে বের করে দেওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতো।"- ক্ষীণস্বরে উত্তর দেন রাফিয়া, "তবে তার ঘুম ভাঙার দশ থেকে পনেরো মিনিট পর্যন্ত সে এভাবে কান্না করতে থাকে। এরপর থেমে যায়।"
আহমেদ সাবাজ কিছু না বলেই মাথা ঝাঁকান। তার এ মাথা ঝাঁকানোর ভঙ্গিমা বলে দেয় রাফিয়ার বলা কথাটি তাকে ভাবাচ্ছে খুব।
"তবে আপনাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানানো হয়নি।"-সাবাজের মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন রাফিয়া।
"কী বিষয়?"- ভাবনা ছেড়ে প্রশ্ন করেন সাবাজ।
"নওরিনের এমন অবস্থায় তার পাশে কাউকে দেখলেই সে চিৎকার করলেও আয়েশার বেলায় তার উল্টো।"
"উল্টো বলতে?"
"আয়েশাকে দেখে সে মোটেও চিৎকার করে না কিংবা ভয়ও পায় না।"
"তার মানে নওরিনের ঘুম থেকে ওঠার পরবর্তী অবস্থা সম্পর্কে আয়েশা জানে?"
"হ্যাঁ। আয়েশা এখন থেকে বাকি রাত তার সাথে থাকবে।"
"সে কোথায়?"
"চলে আসবে এখনই। আমাদের এখান থেকে যাওয়া উচিত। তার রুমে যাওয়ার আগে আয়েশাকেও বাইরে থেকে গায়ের সব কাপড় ছেড়ে যেতে হয়।"
তারা চলে আসে ওখান থেকে। রাত একটা তেরো বাজে। সাবাজের জন্য যে রুমটি দেওয়া হয়েছে বেশ চমৎকার বলতে হয়। পায়চারি করতে করতে কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা করা তার পছন্দ নয়। কারণ তা কোনো কিছুর সমাধান দেয় না বরং আরও উদ্বিগ্নতা বাড়িয়ে দেয়। কোনো বিষয়ের সমাধান পেতে হলে ভাবতে হয় ঠাণ্ডা মাথায়। তা হতে পারে বিছানায় শুয়ে, নির্জনে কোথাও বসে কিংবা রকিং চেয়ারে দোল খেতে খেতে। সাবাজ সবথেকে বেশি পছন্দ করেন রকিং চেয়ারে বসে ভাবতে। রাফিয়া এ ব্যাপারে জানে হয়তো। তার জন্য নতুন একটা রকিং চেয়ার জানালার পাশে পাতানো আছে।
চেয়ারে বসে ভাবতে থাকেন তিনি। কোনো একটা বিষয় নিয়ে নওরিন ভীষণ ভয় পাচ্ছে নিশ্চিত। তবে সেটা কী এমন বিষয় যার কারণে শরীরের সব কাপড়কেও ছুড়ে ফেলতে হচ্ছে? তাছাড়া তার কাছে থাকতে আয়েশাকেও বিবস্ত্র হয়েই তার রুমে যেতে হচ্ছে? প্রথম দিন এসেই তার রুমে জানালায় পর্দা, বিছানার বেডশিট সহ কাপড় জাতীয় কিছুই দেখতে পাননি সাবাজ। তাছাড়া ঘাম মুছার জন্য তিনি পকেট থেকে রুমাল বের করলে নওরিন ভয় পায় না কিন্তু হাত থেকে পড়ে যাওয়ার পর রুমাল ঝেড়ে নিতে যখন তার ভাঁজগুলো খুলে রুমাল মেলে যায় তখনই চিৎকার করে সে।
আচ্ছা কাপড়ের উপর ভয় পাওয়া কি কোনো ধরণের ফোবিয়া?- সাবাজ নিজেকে প্রশ্ন করেন। উত্তর জানেন না তিনি।
দিনের বেশিরভাগ সময় ঘুমিয়ে কাটায় নওরিন। দিনে অতিরিক্ত ঘুম স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ তো বটেই সাথে তা মানসিক চাপও বাড়িয়ে দেয়। মাঝরাতের পর ঘুম ভাঙার পর বাকি রাতটুকু নির্ঘুম কাটায় সে। তাকে এই অভ্যাস থেকে বের করে নিয়ে আসা জরুরী- ভাবেন আহমেদ সাবাজ। মানসিক রােগের চিকিৎসা একটি দলগত প্রচেষ্টা বা টিমওয়ার্ক। যাকে বলা হয় বায়ো-সাইকো-সােশ্যাল বা মনো-জৈব-সামাজিক পদ্ধতি। ওষুধ কাজ করে রাসায়নিক পদার্থ বা নিউরােট্রান্সমিটারের ওপর। সাইকোথেরাপি বা কাউন্সেলিং কাজ করে জ্ঞানীয় বিকাশ (Cognition), আচরণ ও মনের গড়নের ওপর। সেই সঙ্গে সামাজিক সহায়তা দেয় বাড়তি নিরাপত্তা আর বিশেষ প্রণােদনা। মানসিক রােগের চিকিৎসায় এই তিন প্রক্রিয়াই জরুরি। তবে রােগভেদে কোনাে কোনো প্রক্রিয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং অত্যাবশ্যকীয় হয়ে ওঠে।
নওরিনের ক্ষেত্রে স্পষ্টতই সামাজিক সহায়তা পদ্ধতি ব্যর্থ হয়েছে। তার পরিবারের কেউ বুঝে উঠতে পারেননি ঠিক কী করা উচিত। তবে বাকি দু'টো প্রক্রিয়ায় চিকিৎসা করতে তার রোগ ধরতে পারা আবশ্যক।
আয়েশার সাথে কথা বলাটা জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে তার জন্য সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। বাকি রাতটুকু রকিং চেয়ারে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেন আহমেদ সাবাজ।
_____
"রুমের এক কোণে বসে হাটুকে দু'হাতে জাপটে ধরে তার মধ্যে মাথা গুঁজে কাঁদে নওরিন।"
"এ সময়ে তার মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু লক্ষ্য করেছো?"- সাবাজ প্রশ্ন করেন।
"হ্যাঁ।"- উত্তর আয়েশার।
"কী সেটা?"
"খুব বেশি পরিমাণে ঘামতে থাকে সে। মনে হয় যেন সারা গায়ে পানি ঢেলে নিয়েছে। তাছাড়া তার পুরো শরীর কাঁপতে থাকে।"
"আচ্ছা তোমার কী মনে হয়? সে কেন এমন করবে?"
"কোনো বিষয় নিয়ে ভয় পাচ্ছে সে হয়তো, প্রচণ্ড ভয়। তবে কিছু সময় বাদে সে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে আর বাথটাবে গিয়ে ডুবে থাকে আধঘন্টার মতো।"
রাফিয়ার মুখের দিকে একবার তাকান আহমেদ সাবাজ- একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে।
"আচ্ছা আরেকটা প্রশ্ন- সে কি কখনও কিছু বলেছে তোমাকে? বা বলার চেষ্টা করেছে?"
"হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে আসার পর প্রথম যেদিন সে এমন আচরণ করছিল, আমি খুব ভয় পেয়ে যাই। খালাম্মা-খালুজান কাউকেই সে রুমে ঢুকতে দিচ্ছিলো না। ঢুকলেই গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে সে।"
"তারপর?"
"আমি খুব সাহস করে তার রুমে যাই। সে মুখ উঁচু করে আমাকে দেখে কিন্তু আগের মতো চিৎকার করেনি।"
"সে কিছু বলেছিল তোমাকে?"- অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন সাবাজ।
"বলেছিল- তোমাকেও মেরে ফেলবে তারা।"
"তারা মানে?"
"প্রশ্ন করেছিলাম, সে তীব্র আতঙ্ক নিয়ে রুমের চারপাশে তাকিয়েছিল। পরে আঙুল উঁচিয়ে আমার দিকে লক্ষ্য করলো।"
সাবাজের কাছে বিষয়টা কেমন জটিল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। রাফিয়া শুরু থেকেই চুপচাপ তাদের কথাগুলো শুনে যাচ্ছেন।
"সে তোমার দিকে ইশারা করলো কেন?"
সাবাজের প্রশ্নে মাথা নিচু করে ফেলে আয়েশা। সাবাজ এবং রাফিয়া দু'জনেই উদগ্রীব হয়ে তার উত্তরের অপেক্ষা করছে।
"সে মূলত আমার পোশাকের দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছিলো। বলেছিল সেগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিতে নয়তো নাকি তারা আমাকেও মেরে ফেলবে। কিন্তু এই 'তারা' বলতে নওরিন কাকে বুঝিয়েছিল তার উত্তর আমি পাইনি৷ বাধ্য হয়ে নওরিনের কথা মেনে নিতে হয়। এরপর থেকে প্রতিরাতেই ওর রুমের বাইরে পোশাক ছেড়ে তার সঙ্গ দিতে হয়। মেয়েটি ভীষণ ভয়কে সাথে নিয়ে আমাকে জড়িয়ে রেখে বাকি রাত হয়তো না ঘুমিয়েই পার করে দেয়।"
_____
রাফিয়াদের বাড়ির পিছে বড়সড় একটা বাগান করেছেন মোস্তফা আনওয়ার। পরিচর্যার জন্য তিনি বেশ কয়েকজন লোক রেখেছেন। এ মূহুর্তে সম্ভবত হুইল চেয়ারে বসে বাগানটিকে ঘুরে ঘুরে দেখছেন তিনি।
"চলুন আমরা আপনাদের বাগানটি ঘুরে দেখে আসি।"- রাফিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললেন আহমেদ সাবাজ। রাফিয়া সম্মতি জানালে তারা বাইরে বের হন। হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছেন তারা।
"আয়েশা আপনাদের সাথে কতদিন যাবৎ আছে?"
"চার বছরেরও বেশি৷"
"মেয়েটি খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারে।"
রাফিয়া মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি প্রকাশ করেন।
"আপনার ব্যাপারে একটা প্রশ্ন আছে আমার।"- দাঁড়িয়ে পড়েন সাবাজ।
"কী প্রশ্ন?"
"আপনি যখন আমার কাছে আপনার মেয়ের সমস্যা নিয়ে গিয়েছিলেন আপনাকে দেখে খুব স্বাভাবিক মনে হচ্ছিলো।"
"আমি যদি আপনার কাছে গিয়ে খুব বেশি উদ্বিগ্ন থাকতাম তবে হয়তো আমার মেয়ের সমস্যা নিয়ে আপনাকে বুঝাতে সক্ষম হতাম না। আর তাছাড়া আমি সেখানে গিয়েছি আমার মেয়ের সমস্যার কথা জানাতে, আমার কষ্ট বা দূর্বলতা দেখাতে নয়।"
তারা আবারও হাঁটতে শুরু করেন। একটু সামনে হুইলচেয়ারে মোস্তফা সাহেবকে বসে থাকতে দেখেন। বড় একটা আমগাছের গোঁড়ার আগাছা পরিষ্কার করে মাটি দেওয়া হচ্ছে- এটাকেই দেখছেন তিনি।
"আমার মেয়ের ব্যাপারে কী ভাবলেন?"
"এখন পর্যন্ত যতটুকু বুঝতে পেরেছি আপনার মেয়ে কোনো কিছু নিয়ে প্রচণ্ড আতঙ্কিত। ঘুমের মাঝে সম্ভবত ভয়ানক কিছু দেখে তার আতঙ্ক আরও বেড়ে যায়। ঘুম থেকে হঠাৎ উঠে দশ থেকে পনেরো মিনিটের মতো এই আতঙ্ক তার মধ্যে বিরাজ করে। এ সময়ে ঘেমে যায় সে খুব, কাঁপতে থাকে ভয়ে। এমন একটা আশঙ্কা তার মাঝে যে কেউ হয়তো তাকে মেরে ফেলবে।"
"কোনো রোগ এটা?"
"হুম, মানসিক রোগ। যাকে প্যানিক ডিসঅর্ডার বলা হয়। তবে ঘুমের মধ্যে তার অস্বাভাবিক আচরণকে আরও একটু খুঁটিয়ে দেখতে হবে। তাছাড়া সে বলেছিল কেউ তাকে মেরে ফেলতে চায় কিন্তু সে বা তারা আসলে কে হতে পারে এটা নওরিনই বলতে পারবে।"
দিনের বেলা আর রাতে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত নওরিনের অবস্থা কিছুটা স্বাভাবিক থাকে। গতকাল সাবাজ তার সাথে কথা বলার জন্য রাতের সময়টুকু বেছে নিয়েছিলেন যেখানে এক অপ্রত্যাশিত আচরণের সম্মুখীন হন তিনি। আজ দিনের বেলাতেই কথা বলবেন তার সাথে- সিদ্ধান্ত নেন সাবাজ।
বাড়িতে ফিরে এসে কলিং বেল চাপতে আয়েশা দরজা খুলে দেয়। রাফিয়া তার স্বামীর কাছেই আছেন। সাবাজ একাই ফিরেছে। ভিতরে ঢুকে নিজের কক্ষের দিকে পা বাড়াতে আয়েশা পিছন থেকে ডাক দেয়।
"কিছু বলবে আয়েশা?"
"হুম।"- মাথা ঝাঁকায় সে, "মিসির আলি থেকে ৯ অংক দিয়ে একটি মজার জিনিস পড়েছি। পড়ে ভাবলাম ৯ অংকটি আসলেই অন্য সব অংকগুলো থেকে আলাদা। এরপর ৯ কে নিয়ে নিজেও একটা বিষয় বের করেছি।"
"তোমার হঠাৎ ৯ অংকটির কথা মাথায় এলো যে?"
"নওরিনের কেবিন নম্বর ছিল ৯০৯। এখানেও ৯ অংকটি আছে। কেবিন নম্বর অর্থাৎ ৯০৯ এর সবগুলো অংক যোগ করলে ১৮ হয় (৯+০+৯=১৮)। আবার এই যোগফলের দু'টি অংক (১ ও ৮) যোগ করলে ফের আবার ৯ হয়। আবার ৯০৯ সংখ্যার সব অংক গুণ করলে হয় ৮১, এটিরও অংক দু'টি যোগ করলে ফের ৯ হয়৷ অদ্ভুত না?"
"হুম অদ্ভুত। কিন্তু তুমি একটু ভুল করে বসলে না?"
"কোথায়?"
"৯+০+৯=১৮ হয় এটা ঠিক কিন্তু ৯×০×৯=৮১ নয় বরং ০ হয়।"
মেয়েটি এবার চোখ বন্ধ করে জিহ্বা কামড়ে ধরে। কত সাধারণ একটা হিসাবে ভুল করে বসলো সে। সাবাজ মুখে সামান্য হাসির ছাপ এনে নিজ কক্ষের দিকে পা বাড়ান।
_____
"তুমি কি আমাকে চেন মামণি?"- নওরিনকে প্রশ্ন করেন সাবাজ।
নওরিন না-সূচক মাথা নাড়ায়।
"আমাকে ভয় পাচ্ছো?"
এবারও সে মাথা নাড়িয়ে বুঝায় সে তাকে ভয় পাচ্ছে না। মেয়েটি কথা বলতে চাচ্ছে না। বারবার তার বাবা-মায়ের দিকে তাকাচ্ছে চোখে আতঙ্কের ছাপ নিয়ে। সাবাজ তাদেরকে ইশারা করে নওরিনকে আবার প্রশ্ন করেন, "তুমি কি তাদের ভয় পাচ্ছো?"
মেয়েটি এবার হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ায়।
"একদমই ভয় পাবে না। আমার চোখের দিকে তাকাও মামণি।"
সাবাজের কথায় নওরিন তার চোখের দিকে তাকায়।
"দেখ, আমি আছি এখানে। মোটেও ভয় পাবে না।"
মেয়েটির চোখদু'টো সাবাজকে জানান দেয় সে তাকে ভরসা করেছে।
"কেন ভয় পাচ্ছো? আমাকে বলো।"
"আমায় মেরে ফেলবে।"- কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে প্রথমবারের মতো মুখ খোলে মেয়েটি।
"এতো বড় সাহস কার? কে মেরে ফেলবে আমার মিষ্টি মামণিকে?"- নওরিনকে সাহস যোগাচ্ছেন আহমেদ সাবাজ।
নওরিন তার দূর্বল কাঁপতে থাকা ডান হাত ধীরে ধীরে উঠায়। শাহাদাত আঙুলটিকে সামনে রেখে কাঁপা হাত দিয়ে ইশারা করে তার মা-বাবার দিকে।
চলবে...
Sayan
নওরিনের চাপা কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। তার হঠাৎ ঘুম ভাঙার সাথে সাথেই রাফিয়া সাবাজকে রুমের বাইরে নিয়ে আসেন। মিনিটখানেকের মতো চিৎকার মেরে এখন কান্না করছে মেয়েটা। সাবাজ তার এখনকার অবস্থা দেখতে যেতেও পারছেন না কারণ মেয়েটি এখন সম্পূর্ণ বিবস্ত্র।
"ঘুম থেকে উঠে সে কেমন আচরণ করে আপনি জানেন কি মিসেস রাফিয়া?"- সাবাজ প্রশ্ন করেন।
"না। ঘুম ভাঙার পর সে তার পাশে কাউকে দেখলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতো। তার রুম থেকে বাইরে বের করে দেওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতো।"- ক্ষীণস্বরে উত্তর দেন রাফিয়া, "তবে তার ঘুম ভাঙার দশ থেকে পনেরো মিনিট পর্যন্ত সে এভাবে কান্না করতে থাকে। এরপর থেমে যায়।"
আহমেদ সাবাজ কিছু না বলেই মাথা ঝাঁকান। তার এ মাথা ঝাঁকানোর ভঙ্গিমা বলে দেয় রাফিয়ার বলা কথাটি তাকে ভাবাচ্ছে খুব।
"তবে আপনাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানানো হয়নি।"-সাবাজের মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন রাফিয়া।
"কী বিষয়?"- ভাবনা ছেড়ে প্রশ্ন করেন সাবাজ।
"নওরিনের এমন অবস্থায় তার পাশে কাউকে দেখলেই সে চিৎকার করলেও আয়েশার বেলায় তার উল্টো।"
"উল্টো বলতে?"
"আয়েশাকে দেখে সে মোটেও চিৎকার করে না কিংবা ভয়ও পায় না।"
"তার মানে নওরিনের ঘুম থেকে ওঠার পরবর্তী অবস্থা সম্পর্কে আয়েশা জানে?"
"হ্যাঁ। আয়েশা এখন থেকে বাকি রাত তার সাথে থাকবে।"
"সে কোথায়?"
"চলে আসবে এখনই। আমাদের এখান থেকে যাওয়া উচিত। তার রুমে যাওয়ার আগে আয়েশাকেও বাইরে থেকে গায়ের সব কাপড় ছেড়ে যেতে হয়।"
তারা চলে আসে ওখান থেকে। রাত একটা তেরো বাজে। সাবাজের জন্য যে রুমটি দেওয়া হয়েছে বেশ চমৎকার বলতে হয়। পায়চারি করতে করতে কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা করা তার পছন্দ নয়। কারণ তা কোনো কিছুর সমাধান দেয় না বরং আরও উদ্বিগ্নতা বাড়িয়ে দেয়। কোনো বিষয়ের সমাধান পেতে হলে ভাবতে হয় ঠাণ্ডা মাথায়। তা হতে পারে বিছানায় শুয়ে, নির্জনে কোথাও বসে কিংবা রকিং চেয়ারে দোল খেতে খেতে। সাবাজ সবথেকে বেশি পছন্দ করেন রকিং চেয়ারে বসে ভাবতে। রাফিয়া এ ব্যাপারে জানে হয়তো। তার জন্য নতুন একটা রকিং চেয়ার জানালার পাশে পাতানো আছে।
চেয়ারে বসে ভাবতে থাকেন তিনি। কোনো একটা বিষয় নিয়ে নওরিন ভীষণ ভয় পাচ্ছে নিশ্চিত। তবে সেটা কী এমন বিষয় যার কারণে শরীরের সব কাপড়কেও ছুড়ে ফেলতে হচ্ছে? তাছাড়া তার কাছে থাকতে আয়েশাকেও বিবস্ত্র হয়েই তার রুমে যেতে হচ্ছে? প্রথম দিন এসেই তার রুমে জানালায় পর্দা, বিছানার বেডশিট সহ কাপড় জাতীয় কিছুই দেখতে পাননি সাবাজ। তাছাড়া ঘাম মুছার জন্য তিনি পকেট থেকে রুমাল বের করলে নওরিন ভয় পায় না কিন্তু হাত থেকে পড়ে যাওয়ার পর রুমাল ঝেড়ে নিতে যখন তার ভাঁজগুলো খুলে রুমাল মেলে যায় তখনই চিৎকার করে সে।
আচ্ছা কাপড়ের উপর ভয় পাওয়া কি কোনো ধরণের ফোবিয়া?- সাবাজ নিজেকে প্রশ্ন করেন। উত্তর জানেন না তিনি।
দিনের বেশিরভাগ সময় ঘুমিয়ে কাটায় নওরিন। দিনে অতিরিক্ত ঘুম স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ তো বটেই সাথে তা মানসিক চাপও বাড়িয়ে দেয়। মাঝরাতের পর ঘুম ভাঙার পর বাকি রাতটুকু নির্ঘুম কাটায় সে। তাকে এই অভ্যাস থেকে বের করে নিয়ে আসা জরুরী- ভাবেন আহমেদ সাবাজ। মানসিক রােগের চিকিৎসা একটি দলগত প্রচেষ্টা বা টিমওয়ার্ক। যাকে বলা হয় বায়ো-সাইকো-সােশ্যাল বা মনো-জৈব-সামাজিক পদ্ধতি। ওষুধ কাজ করে রাসায়নিক পদার্থ বা নিউরােট্রান্সমিটারের ওপর। সাইকোথেরাপি বা কাউন্সেলিং কাজ করে জ্ঞানীয় বিকাশ (Cognition), আচরণ ও মনের গড়নের ওপর। সেই সঙ্গে সামাজিক সহায়তা দেয় বাড়তি নিরাপত্তা আর বিশেষ প্রণােদনা। মানসিক রােগের চিকিৎসায় এই তিন প্রক্রিয়াই জরুরি। তবে রােগভেদে কোনাে কোনো প্রক্রিয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং অত্যাবশ্যকীয় হয়ে ওঠে।
নওরিনের ক্ষেত্রে স্পষ্টতই সামাজিক সহায়তা পদ্ধতি ব্যর্থ হয়েছে। তার পরিবারের কেউ বুঝে উঠতে পারেননি ঠিক কী করা উচিত। তবে বাকি দু'টো প্রক্রিয়ায় চিকিৎসা করতে তার রোগ ধরতে পারা আবশ্যক।
আয়েশার সাথে কথা বলাটা জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে তার জন্য সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। বাকি রাতটুকু রকিং চেয়ারে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেন আহমেদ সাবাজ।
_____
"রুমের এক কোণে বসে হাটুকে দু'হাতে জাপটে ধরে তার মধ্যে মাথা গুঁজে কাঁদে নওরিন।"
"এ সময়ে তার মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু লক্ষ্য করেছো?"- সাবাজ প্রশ্ন করেন।
"হ্যাঁ।"- উত্তর আয়েশার।
"কী সেটা?"
"খুব বেশি পরিমাণে ঘামতে থাকে সে। মনে হয় যেন সারা গায়ে পানি ঢেলে নিয়েছে। তাছাড়া তার পুরো শরীর কাঁপতে থাকে।"
"আচ্ছা তোমার কী মনে হয়? সে কেন এমন করবে?"
"কোনো বিষয় নিয়ে ভয় পাচ্ছে সে হয়তো, প্রচণ্ড ভয়। তবে কিছু সময় বাদে সে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে আর বাথটাবে গিয়ে ডুবে থাকে আধঘন্টার মতো।"
রাফিয়ার মুখের দিকে একবার তাকান আহমেদ সাবাজ- একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে।
"আচ্ছা আরেকটা প্রশ্ন- সে কি কখনও কিছু বলেছে তোমাকে? বা বলার চেষ্টা করেছে?"
"হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে আসার পর প্রথম যেদিন সে এমন আচরণ করছিল, আমি খুব ভয় পেয়ে যাই। খালাম্মা-খালুজান কাউকেই সে রুমে ঢুকতে দিচ্ছিলো না। ঢুকলেই গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে সে।"
"তারপর?"
"আমি খুব সাহস করে তার রুমে যাই। সে মুখ উঁচু করে আমাকে দেখে কিন্তু আগের মতো চিৎকার করেনি।"
"সে কিছু বলেছিল তোমাকে?"- অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন সাবাজ।
"বলেছিল- তোমাকেও মেরে ফেলবে তারা।"
"তারা মানে?"
"প্রশ্ন করেছিলাম, সে তীব্র আতঙ্ক নিয়ে রুমের চারপাশে তাকিয়েছিল। পরে আঙুল উঁচিয়ে আমার দিকে লক্ষ্য করলো।"
সাবাজের কাছে বিষয়টা কেমন জটিল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। রাফিয়া শুরু থেকেই চুপচাপ তাদের কথাগুলো শুনে যাচ্ছেন।
"সে তোমার দিকে ইশারা করলো কেন?"
সাবাজের প্রশ্নে মাথা নিচু করে ফেলে আয়েশা। সাবাজ এবং রাফিয়া দু'জনেই উদগ্রীব হয়ে তার উত্তরের অপেক্ষা করছে।
"সে মূলত আমার পোশাকের দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছিলো। বলেছিল সেগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিতে নয়তো নাকি তারা আমাকেও মেরে ফেলবে। কিন্তু এই 'তারা' বলতে নওরিন কাকে বুঝিয়েছিল তার উত্তর আমি পাইনি৷ বাধ্য হয়ে নওরিনের কথা মেনে নিতে হয়। এরপর থেকে প্রতিরাতেই ওর রুমের বাইরে পোশাক ছেড়ে তার সঙ্গ দিতে হয়। মেয়েটি ভীষণ ভয়কে সাথে নিয়ে আমাকে জড়িয়ে রেখে বাকি রাত হয়তো না ঘুমিয়েই পার করে দেয়।"
_____
রাফিয়াদের বাড়ির পিছে বড়সড় একটা বাগান করেছেন মোস্তফা আনওয়ার। পরিচর্যার জন্য তিনি বেশ কয়েকজন লোক রেখেছেন। এ মূহুর্তে সম্ভবত হুইল চেয়ারে বসে বাগানটিকে ঘুরে ঘুরে দেখছেন তিনি।
"চলুন আমরা আপনাদের বাগানটি ঘুরে দেখে আসি।"- রাফিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললেন আহমেদ সাবাজ। রাফিয়া সম্মতি জানালে তারা বাইরে বের হন। হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছেন তারা।
"আয়েশা আপনাদের সাথে কতদিন যাবৎ আছে?"
"চার বছরেরও বেশি৷"
"মেয়েটি খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারে।"
রাফিয়া মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি প্রকাশ করেন।
"আপনার ব্যাপারে একটা প্রশ্ন আছে আমার।"- দাঁড়িয়ে পড়েন সাবাজ।
"কী প্রশ্ন?"
"আপনি যখন আমার কাছে আপনার মেয়ের সমস্যা নিয়ে গিয়েছিলেন আপনাকে দেখে খুব স্বাভাবিক মনে হচ্ছিলো।"
"আমি যদি আপনার কাছে গিয়ে খুব বেশি উদ্বিগ্ন থাকতাম তবে হয়তো আমার মেয়ের সমস্যা নিয়ে আপনাকে বুঝাতে সক্ষম হতাম না। আর তাছাড়া আমি সেখানে গিয়েছি আমার মেয়ের সমস্যার কথা জানাতে, আমার কষ্ট বা দূর্বলতা দেখাতে নয়।"
তারা আবারও হাঁটতে শুরু করেন। একটু সামনে হুইলচেয়ারে মোস্তফা সাহেবকে বসে থাকতে দেখেন। বড় একটা আমগাছের গোঁড়ার আগাছা পরিষ্কার করে মাটি দেওয়া হচ্ছে- এটাকেই দেখছেন তিনি।
"আমার মেয়ের ব্যাপারে কী ভাবলেন?"
"এখন পর্যন্ত যতটুকু বুঝতে পেরেছি আপনার মেয়ে কোনো কিছু নিয়ে প্রচণ্ড আতঙ্কিত। ঘুমের মাঝে সম্ভবত ভয়ানক কিছু দেখে তার আতঙ্ক আরও বেড়ে যায়। ঘুম থেকে হঠাৎ উঠে দশ থেকে পনেরো মিনিটের মতো এই আতঙ্ক তার মধ্যে বিরাজ করে। এ সময়ে ঘেমে যায় সে খুব, কাঁপতে থাকে ভয়ে। এমন একটা আশঙ্কা তার মাঝে যে কেউ হয়তো তাকে মেরে ফেলবে।"
"কোনো রোগ এটা?"
"হুম, মানসিক রোগ। যাকে প্যানিক ডিসঅর্ডার বলা হয়। তবে ঘুমের মধ্যে তার অস্বাভাবিক আচরণকে আরও একটু খুঁটিয়ে দেখতে হবে। তাছাড়া সে বলেছিল কেউ তাকে মেরে ফেলতে চায় কিন্তু সে বা তারা আসলে কে হতে পারে এটা নওরিনই বলতে পারবে।"
দিনের বেলা আর রাতে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত নওরিনের অবস্থা কিছুটা স্বাভাবিক থাকে। গতকাল সাবাজ তার সাথে কথা বলার জন্য রাতের সময়টুকু বেছে নিয়েছিলেন যেখানে এক অপ্রত্যাশিত আচরণের সম্মুখীন হন তিনি। আজ দিনের বেলাতেই কথা বলবেন তার সাথে- সিদ্ধান্ত নেন সাবাজ।
বাড়িতে ফিরে এসে কলিং বেল চাপতে আয়েশা দরজা খুলে দেয়। রাফিয়া তার স্বামীর কাছেই আছেন। সাবাজ একাই ফিরেছে। ভিতরে ঢুকে নিজের কক্ষের দিকে পা বাড়াতে আয়েশা পিছন থেকে ডাক দেয়।
"কিছু বলবে আয়েশা?"
"হুম।"- মাথা ঝাঁকায় সে, "মিসির আলি থেকে ৯ অংক দিয়ে একটি মজার জিনিস পড়েছি। পড়ে ভাবলাম ৯ অংকটি আসলেই অন্য সব অংকগুলো থেকে আলাদা। এরপর ৯ কে নিয়ে নিজেও একটা বিষয় বের করেছি।"
"তোমার হঠাৎ ৯ অংকটির কথা মাথায় এলো যে?"
"নওরিনের কেবিন নম্বর ছিল ৯০৯। এখানেও ৯ অংকটি আছে। কেবিন নম্বর অর্থাৎ ৯০৯ এর সবগুলো অংক যোগ করলে ১৮ হয় (৯+০+৯=১৮)। আবার এই যোগফলের দু'টি অংক (১ ও ৮) যোগ করলে ফের আবার ৯ হয়। আবার ৯০৯ সংখ্যার সব অংক গুণ করলে হয় ৮১, এটিরও অংক দু'টি যোগ করলে ফের ৯ হয়৷ অদ্ভুত না?"
"হুম অদ্ভুত। কিন্তু তুমি একটু ভুল করে বসলে না?"
"কোথায়?"
"৯+০+৯=১৮ হয় এটা ঠিক কিন্তু ৯×০×৯=৮১ নয় বরং ০ হয়।"
মেয়েটি এবার চোখ বন্ধ করে জিহ্বা কামড়ে ধরে। কত সাধারণ একটা হিসাবে ভুল করে বসলো সে। সাবাজ মুখে সামান্য হাসির ছাপ এনে নিজ কক্ষের দিকে পা বাড়ান।
_____
"তুমি কি আমাকে চেন মামণি?"- নওরিনকে প্রশ্ন করেন সাবাজ।
নওরিন না-সূচক মাথা নাড়ায়।
"আমাকে ভয় পাচ্ছো?"
এবারও সে মাথা নাড়িয়ে বুঝায় সে তাকে ভয় পাচ্ছে না। মেয়েটি কথা বলতে চাচ্ছে না। বারবার তার বাবা-মায়ের দিকে তাকাচ্ছে চোখে আতঙ্কের ছাপ নিয়ে। সাবাজ তাদেরকে ইশারা করে নওরিনকে আবার প্রশ্ন করেন, "তুমি কি তাদের ভয় পাচ্ছো?"
মেয়েটি এবার হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ায়।
"একদমই ভয় পাবে না। আমার চোখের দিকে তাকাও মামণি।"
সাবাজের কথায় নওরিন তার চোখের দিকে তাকায়।
"দেখ, আমি আছি এখানে। মোটেও ভয় পাবে না।"
মেয়েটির চোখদু'টো সাবাজকে জানান দেয় সে তাকে ভরসা করেছে।
"কেন ভয় পাচ্ছো? আমাকে বলো।"
"আমায় মেরে ফেলবে।"- কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে প্রথমবারের মতো মুখ খোলে মেয়েটি।
"এতো বড় সাহস কার? কে মেরে ফেলবে আমার মিষ্টি মামণিকে?"- নওরিনকে সাহস যোগাচ্ছেন আহমেদ সাবাজ।
নওরিন তার দূর্বল কাঁপতে থাকা ডান হাত ধীরে ধীরে উঠায়। শাহাদাত আঙুলটিকে সামনে রেখে কাঁপা হাত দিয়ে ইশারা করে তার মা-বাবার দিকে।
চলবে...
Sayan
Hasibul hasan santo, Santa akter, Sk sagor, Sk imran, Rasel islam, Mr faruk, Saiful Osman and লেখাটি পছন্দ করেছে
- Trimatraধুমকেতু
- Posts : 23
স্বর্ণমুদ্রা : 1434
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-06-05
Re: রুম নম্বরঃ ৯০৯
Sat Jun 05, 2021 8:35 pm
৪র্থ ও শেষ পর্ব
রাফিয়া ও তার স্বামী দু'জনেই প্রচণ্ড বিস্ময় নিয়ে তাদের মেয়ের দিকে তাকায়। সাবাজ নিজেও বেশ চমকে গিয়েছেন। খুব ভাবছেন কয়েক মিনিট ধরে। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সবকিছু মেলানোর চেষ্টা করছেন। নওরিনের চেহারায় আতঙ্কের ছাপ আগের চেয়ে বেড়ে গিয়েছে। ভয়ার্ত চোখ নিয়ে কয়েক সেকেন্ড পরপর তার বাবা-মায়ের দিকে তাকাচ্ছে।
"মামণি!"
সাবাজের ডাকে কেঁপে ওঠে নওরিন।
"তুমি কি চাচ্ছো যে তারা এখান থেকে চলে যাক?"
আড়চোখে নওরিন আবার তার বাবা-মায়ের দিকে তাকায়। সাবাজ বুঝতে পারেন তাদের উপস্থিতি নওরিনের জন্য ত্রাসের সৃষ্টি করছে। সাবাজ তাদের দিকে তাকান। রাফিয়া বুঝতে পারে তাদের বাইরে যেতে বলা হচ্ছে। মোস্তফা সাহেবকে নিয়ে রুমের বাইরে অবস্থান নেন তারা।
"দেখ, তারা চলে গিয়েছে। এখন ভয় পাবার কিছু নেই।"
নওরিন এবার সাবাজের মুখের দিকে তাকায়। নওরিনের উদ্দেশ্যে আশ্বস্তের হাসি দেন সাবাজ।
"তুমি কেন বলছো যে তারা তোমার খুন করতে চায়?"- সাবাজ প্রশ্ন করেন।
"আমি শুনেছি। তারা ফিসফিসিয়ে আমাকে মারার ষড়যন্ত্র করছিলো।"- কাঁপা কণ্ঠে উত্তর দেয় নওরিন।
"কখন শুনেছো?"
নওরিনের অস্থিরতা বেড়ে গেছে। সম্ভবত সে মনে করার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। সাবাজ বিষয়টি বুঝতে পারেন।
"আচ্ছা তারা কি তোমাকে গলায় কিছু পেঁচিয়ে মারার চেষ্টা করছিলো?"
"হ্যাঁ, হ্যাঁ। খুব জোরে গলায় পেঁচিয়ে ধরেছিল।"- ঘন নিশ্বাসের সাথে নওরিন উত্তর দেয়।
"কী পেঁচিয়ে ধরেছিল দেখেছিলে?"
আবারও নিশ্চুপ হয়ে যায় সে। ভাবছে, মনে করার চেষ্টা করছে। তার উত্তরের আগে সাবাজ পুনরায় প্রশ্ন করেন, "কাপড়ের মতো কিছু?"
নওরিন চোখদু'টো বড় আকার নেয়। সাবাজের প্রশ্ন তাকে মনে করিয়ে দিয়েছে- হ্যাঁ কাপড়ের মতো কিছু।
"তোমার খুব কষ্ট হচ্ছিলো তাই না? দম বন্ধ হয়ে আসছিলো, তুমি চিৎকার করতে চাইছিলে কিন্তু পারছিলে না। বুক চিরে হৃদপিণ্ড বের হয়ে আসতে চাচ্ছিলো।"
বিস্মিত ও ভয়ার্ত কণ্ঠে নওরিন উত্তর দেয়, "হ্যাঁ!"
"এখন থেকে আর মোটেও ভয় পাবে না ওদের৷ ওরা তোমার কিছুই করতে পারবে না। আমি তোমার সাথে থাকবো কেমন?"
নওরিন সাবাজকে বিশ্বাস করে নেয়। নেওয়ার কারণ একটাই যে, তার ব্যাপারে সাবাজ যেগুলো বলছিলেন প্রতিটি কথা-ই সত্য। নওরিন তাকে না বলার পরেও সে সবকিছু জানে- এটা ভেবে সে বিশ্বাস করে নেয় আহমেদ সাবাজকে।
নওরিনকে আয়েশার কাছে রেখে রাফিয়ার সাথে কথা বলার জন্য সাবাজ বাইরে বেরিয়ে আসেন। তাকে দেখে রাফিয়া প্রায় ছুটে চলে আসে। এতক্ষণ হয়তো উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছিল সাবাজের থেকে তার মেয়ের ব্যাপারে জানার জন্য।
"কিছু জানতে পারলেন?"- রাফিয়া প্রশ্ন করেন।
"বেশ কিছু।"- উত্তর দেন সাবাজ।
রাফিয়ার অসহিষ্ণু চোখ সাবাজের ব্যাখ্যার অপেক্ষা করছে।
"তবে সেগুলো বলার আগে আরেকটা বিষয় সম্পর্কে বলি। নাহলে নওরিনের ব্যাপারটা আপনার কাছে ঘোলাটে লাগবে।"
"কী বিষয়?"
"আমাদের স্বপ্নের দু'টি ধাপ আছে। একটি Rapid Eye Movement (REM) অন্যটি Non Rapid Eye Movement (Non-REM)। ঘুমের প্রথম দিকে নন-রেম পর্যায়টি ঘটে। মানুষ স্বপ্ন দেখে মূলত রেম পর্যায়ে। এ সময়ে তার চোখের পাতা হালকা নড়তে থাকে। আর চোখের মনি খুব দ্রুত নড়াচড়া করে ও স্বপ্ন দেখে।"
"এ সম্পর্কে বলার কারণ ব্যাখ্যা করবেন নিশ্চয়ই।"
"গতকাল রাতে নওরিনের ঘুমের সময় তার চোখের মনির নড়াচড়া লক্ষ্য করেছিলেন অবশ্যই। মানে ঐ সময়টাতে সে স্বপ্ন দেখছিলো। কিন্তু তার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো আর শরীরের কোনো অঙ্গ নড়াতে পারছিলো না। নওরিনের সাথে এখন কথা বলে পুরো বিষয়টির ব্যাখ্যা এমন দাঁড়ায় যে, সে ঐ সময়টাতে স্বপ্নে দেখে যে কেউ তাকে মেরে ফেলতে আসছে। আর সে মার্ডারার হিসেবে আপনাকে ও আপনার স্বামীকে দেখেছে। তার গলায় কাপড় জাতীয় কিছু পেঁচিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে মারার চেষ্টা করা হচ্ছিলো এমনটা বলেছে সে। যে কারণে সে তার রুমে বেডশিট বা জানালার পর্দাও ভয়ে রাখেনি। সম্ভবত এরপর তার স্বপ্নের কল্পিত খুনি নওরিনের গায়ের কাপড় খুলে তাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করে যে কারণে ঘুম থেকে উঠে সারা শরীরের কাপড় খুলে রুমের বাইরে ছুড়ে ফেলে সে।"
রাফিয়ার মুখ চিন্তায় ভরে গেছে। চোখের পাতাগুলোও ভারী হয়ে যাচ্ছে, দু-চার ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়বে এমন অবস্থা। গম্ভীর কণ্ঠে তিনি প্রশ্ন করেন, "এমনটা কেন হচ্ছে? আর আমার মেয়ের সাথেই বা কেন?"
"স্লিপ প্যারালাইসিস।"- উত্তর দেন আহমেদ সাবাজ। "সহজ কথায় বলতে, যাকে বোবায় ধরা বলা হয়। নওরিনের এই স্বপ্নের মধ্যেই সে স্লিপ প্যারালাইসিস এর শিকার হয়। যে কারণে তার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, মনে হয় বুকের উপর চেপে বসে আছে কেউ। এই সময়টাতে শরীরের কোনো পেশি কাজ করে না বলে নওরিন হাত পা কিছুই নাড়াতে পারছিলো না। ঘুমের মধ্যে হওয়া এই স্লিপ প্যারালাইসিস কে হিপনাগোজিক (Hypnagogic) বা প্রিডরমিটাল (Predormital) স্লিপ প্যারালাইসিস বলা হয়।"
"কিন্তু তার এই স্লিপ প্যারালাইসিস হওয়ার কারণ কী?"
"যতদূর ব্যাখ্যা দাঁড়ায়, প্যানিক ডিসঅর্ডারের কারণে। যে কোনো একটা উপায়ে তার মাথায় কেউ এই ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে যে আপনি বা আপনার স্বামী তার খুন করবেন। এজন্য তার ঘুমের মধ্যে পক্ষাঘাত ঘটে আর ঘুম থেকে উঠেও কিছু সময় আতঙ্কে থাকে। এ সময়ে সে খুব ঘেমে যায়। আর এর রেশ কেটে উঠতে সে মাঝরাতে গোসল করে৷"
"কিন্তু তার মাথায় এমন ভয় কে ঢুকাবে?"
"আপনি বলেছিলেন যে, একটা প্রাইভেট ক্লিনিকে তাকে ভর্তি করানো হয়েছিল। আর তারপর থেকেই তার এই সমস্যা। হতে পারে আপনার প্রশ্নের উত্তর সেখানেই আছে৷"
"আর আমার মেয়ের সুস্থতার ব্যাপারে কী ভাবছেন?"
"মানসিক রোগের জন্য Biological Therapy তথা ওষুধ ও অন্যান্য জৈবিক চিকিৎসা এবং Psychotherapy তথা মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা দু'টোরই গুরুত্ব আছে। আমি একজন সাইকোলজিস্ট হিসেবে শুধুমাত্র তার কাউন্সিলিং বা সাইকোথেরাপিই করতে পারবো। কোনো ওষুধ প্রেসক্রাইব করার এখতিয়ার আমার নেই। সেক্ষেত্রে অবশ্যই একজন সাইকিয়াট্রিস্টের শরণাপন্ন হতে হবে। আপনার মেয়ের ব্যাপারে ভাববেন না। এই দু'টি পদ্ধতিতে চিকিৎসা করলে সে শীঘ্রই সুস্থ হয়ে উঠবে।"
"তাহলে এখন আপনার এক্স্যাক্ট উদ্দেশ্য টা কী?"
"নওরিনের মধ্যে প্যানিক ডিসঅর্ডার সৃষ্টির মূল হোতাকে বের করতে হবে।"
রাফিয়ার থেকে ক্লিনিকটির ঠিকানা নিয়ে বিকালেই বের হন আহমেদ সাবাজ। ফিরে আসেন প্রায় সন্ধ্যার দিকে। কলিং বেল চাপতেই দরজা খুলে দেন রাফিয়া। সম্ভবত তিনি সাবাজের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন এতক্ষণ।
"গোয়েন্দাগিরি করে আসলাম একটু।"- মুচকি হেসে রাফিয়ার দিকে তাকিয়ে বলেন সাবাজ।
"কোনো তথ্য.."- রাফিয়া প্রশ্ন শেষ করার আগেই সাবাজ উত্তর দেন, "হ্যাঁ, পেয়েছি কিছুটা। একটা প্রশ্ন- আপনার বা আপনার স্বামীর আইনি ক্ষমতা কেমন আছে?"
"হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?"
"ক্লিনিকটার ফ্লোরগুলোকে নিয়ে অন্যরকম নিয়ম করেছেন ড. আলতাফ হোসেন। তার নিজস্ব ক্লিনিকটিকে নিজের পছন্দমতো একটি প্যাটার্ন দিয়েছেন। যেমন নিচের ৪টি ফ্লোরকে ত্রিশ বছরের উপরের রোগীদের জন্য নির্ধারণ করেছেন৷ ওগুলো আবার পুরুষ ও মহিলাদের জন্য আলাদাভাবে ভাগ করা। ৫ম ফ্লোরে করেছেন খাবার ক্যান্টিন। আবার উপরের ৪টি ফ্লোরকে ত্রিশ বছরের নিচের রোগীদের জন্য নির্ধারণ করেছেন।"
"এটা তো গোপন কোনো বিষয় নয়।"
"আমার কথা শেষ করতে দিন। তো প্রথমে সেখানে গিয়ে সরাসরি জিজ্ঞাসা করলাম ৯০৯ নম্বর কক্ষটি খালি আছে কি না। প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলো রোগীর বয়স কত। উত্তর দিলাম- ২১ বছর; যদিও আমি কোনো রোগীকে ভর্তি করাতে যাইনি৷ এরপর বললো- না, ৯১২ এবং ৯১৫ নম্বর কেবিন খালি আছে৷ কিছু না বলেই সেখান থেকে বেরিয়ে এসে ছদ্মবেশ ছেড়ে এক মিনিটের মাথায় আবার ফিরে যাই। বলি- বাইরে এম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে, রোগীকে দ্রুত ভর্তি করতে হবে। এবার রোগীর বয়স বললাম বারো। রোগের বিবরণ লেখা শেষে আমার হাতে একটা ফর্ম ধরিয়ে দিলেন। লক্ষ্য করলাম- রুম নম্বর ৯০৯।"
"মানে? এক মিনিট আগেই না বললো ৯০৯ কেবিন খালি নেই?"
"গণ্ডগোল তো এখানেই। ৯০৯ নম্বর কেবিনে আজ অব্দি যত পেশেন্ট ভর্তি হয়েছে তাদের রেকর্ড দরকার আমার। এজন্যই জিজ্ঞাসা করলাম আইনি ক্ষমতার ব্যাপারে।"
"রাতটুকু অপেক্ষা করুন শুধু, সকাল হতেই পেয়ে যাবেন।"
কৃতজ্ঞতার হাসি দিয়ে নিজ কক্ষে ফিরে আসেন সাবাজ।
_____
"আপনার গুরুত্বপূর্ণ কোনো কথা থাকলে বলুন। আমার সময় অযথা নষ্ট করবেন না, ইমারজেন্সি পেশেন্ট আছে আমার।"
"গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কেই জানতে এসেছি ড. আলতাফ হোসেন।"
"কী বিষয়?"
"৯০৯ নম্বর রুমের ব্যাপারে জানতে চাই।"
ড. আলতাফ কিছু সময়ের জন্য রোবটের মত স্থির হয়ে যান। যেনো কোনো শক খেলেন। তার আচরণিক পরিবর্তন সাবাজের চোখ এড়ায়নি। সাবাজ আবারও প্রশ্ন করেন, "এ রুমের রেকর্ড ঘেটেছি আমি, আজ অব্দি যাদের এই কেবিনে ভর্তি করা হয়েছিল তাদের বয়স ১৩ এর আশেপাশে ছিল। মোট যে ছয়জন এখানে ভর্তি হয়েছিল তাদের চারজনই রিলিজের বেশ কয়েকদিন পর আত্মহত্যা করে, শেষ যাকে ভর্তি করা হয়েছিল তার মানসিক অবস্থাও ভালো নয়। আর সর্বপ্রথম যে মেয়েটিকে ভর্তি করা হয়েছিল, তার বাবা ছিলেন স্বয়ং আপনি, ড. আলতাফ হোসেন।"
"কোত্থেকে পেয়েছেন এসব? পরিচয় কী আপনার?"- একরকম চিৎকার মেরে ওঠেন ড. আলতাফ।
"আহমেদ সাবাজ, পেশায় সাইকোলজিস্ট।"- শান্ত গলায় উত্তর দেন তিনি।
আলতাফ কিছুটা শান্ত হয়ে বলেন, "আপনার ব্যাপারে শুনেছি। সম্মানীয় ব্যক্তি আপনি। তবে এসব ভিত্তিহীন প্রশ্ন করতে থাকলে আমার থেকে সম্মানটুকু হারাবেন।"
তার কথার কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে সাবাজ আবারও বলতে শুরু করেন, "আপনার মেয়ে মানসিক রোগী ছিল যে নিজে আপনার এই হাসপাতাল থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করে।"
"স্টপ টকিং এবাউট দিস শিট।"- কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে ড. আলতাফের।
সাবাজ তার কথা চালিয়ে যাচ্ছেন, "এরপর থেকে শুধুমাত্র ১৩ বছরের আশেপাশের মেয়েদের ভর্তি করা শুরু করেন। ফিজিক্যাল ট্রিটমেন্ট করেছিলেন বটে তবে মেন্টালি প্রত্যেককেই আক্রান্ত করে তোলেন৷ প্রত্যেকের মনে তার মা-বাবার সম্পর্কে তীব্র আতঙ্ক প্রবেশ করিয়েছিলেন।"
ড. আলতাফ কথা বলছেন না, ঘামছেন আর কাঁপছেনও। সাবাজ তার কথা শেষ করেননি, "শারীরিক সুস্থতা পেলেই আপনি রোগীদের রিলিজ দিয়ে দিতেন। মানসিক চিকিৎসার জন্য আপনার এই হাসপাতাল নয়। তাই মেয়েগুলোর বাবা-মা যখন চিন্তিত মুখ নিয়ে তাদের মেয়েদের বাড়িতে নিয়ে যেতেন তা দেখে আপনার মাঝে পৈশাচিক আনন্দ ফুঁটে উঠতো। দুঃখের বিষয় তাদের চারজনের কারোর-ই মানসিক চিকিৎসা হয়নি কিন্তু পঞ্চমবার এসে মোস্তফা আনওয়ার ও তার স্ত্রী রাফিয়া আনওয়ার এ ভুল করেননি।"- এতটুকু শেষ করে কিছু সময়ের জন্য থেমে যান সাবাজ। একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শেষবারের মতো বলেন, "তবে সবচেয়ে সত্য কথা এটা, আপনি না তো পেরেছেন একজন ভালো ডাক্তার হতে আর না তো পেরেছেন ভালো বাবা হতে।"
_____
নওরিনের চিকিৎসা চলছে; দ্রুতই সুস্থ হয়ে উঠবে। যত দ্রুত সুস্থ হবে সাবাজের জন্য ততই ভালো, নিজ ঠিকানায় ফিরতে হবে তাকে। হাতমুখ ধুয়ে রকিং চেয়ারটিতে গিয়ে বসলেন তিনি। ধীরে ধীরে দোল খাচ্ছেন।
আজ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি কেইসের মিমাংসা করেছেন সাবাজ। শুধুমাত্র নিজের ব্যাপারটিকে এতো কেইসের ভিড়ে পিছে ফেলে রেখেছেন। কয়েকবার মিমাংসা করতে গিয়ে মাঝপথে নিজ থেকেই থেমে গিয়েছেন। স্বপ্নে তার স্ত্রীর ভয়ার্ত চেহারাকে তো সে ভয় পায় না তবে সমাধানের কী দরকার?
কে জানে, হয়তো এ রহস্যের মিমাংসা করলে স্বপ্নেও তার স্ত্রীকে দেখার সৌভাগ্যটুকু হারাবেন তিনি!
সমাপ্ত
Sayan
রাফিয়া ও তার স্বামী দু'জনেই প্রচণ্ড বিস্ময় নিয়ে তাদের মেয়ের দিকে তাকায়। সাবাজ নিজেও বেশ চমকে গিয়েছেন। খুব ভাবছেন কয়েক মিনিট ধরে। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সবকিছু মেলানোর চেষ্টা করছেন। নওরিনের চেহারায় আতঙ্কের ছাপ আগের চেয়ে বেড়ে গিয়েছে। ভয়ার্ত চোখ নিয়ে কয়েক সেকেন্ড পরপর তার বাবা-মায়ের দিকে তাকাচ্ছে।
"মামণি!"
সাবাজের ডাকে কেঁপে ওঠে নওরিন।
"তুমি কি চাচ্ছো যে তারা এখান থেকে চলে যাক?"
আড়চোখে নওরিন আবার তার বাবা-মায়ের দিকে তাকায়। সাবাজ বুঝতে পারেন তাদের উপস্থিতি নওরিনের জন্য ত্রাসের সৃষ্টি করছে। সাবাজ তাদের দিকে তাকান। রাফিয়া বুঝতে পারে তাদের বাইরে যেতে বলা হচ্ছে। মোস্তফা সাহেবকে নিয়ে রুমের বাইরে অবস্থান নেন তারা।
"দেখ, তারা চলে গিয়েছে। এখন ভয় পাবার কিছু নেই।"
নওরিন এবার সাবাজের মুখের দিকে তাকায়। নওরিনের উদ্দেশ্যে আশ্বস্তের হাসি দেন সাবাজ।
"তুমি কেন বলছো যে তারা তোমার খুন করতে চায়?"- সাবাজ প্রশ্ন করেন।
"আমি শুনেছি। তারা ফিসফিসিয়ে আমাকে মারার ষড়যন্ত্র করছিলো।"- কাঁপা কণ্ঠে উত্তর দেয় নওরিন।
"কখন শুনেছো?"
নওরিনের অস্থিরতা বেড়ে গেছে। সম্ভবত সে মনে করার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। সাবাজ বিষয়টি বুঝতে পারেন।
"আচ্ছা তারা কি তোমাকে গলায় কিছু পেঁচিয়ে মারার চেষ্টা করছিলো?"
"হ্যাঁ, হ্যাঁ। খুব জোরে গলায় পেঁচিয়ে ধরেছিল।"- ঘন নিশ্বাসের সাথে নওরিন উত্তর দেয়।
"কী পেঁচিয়ে ধরেছিল দেখেছিলে?"
আবারও নিশ্চুপ হয়ে যায় সে। ভাবছে, মনে করার চেষ্টা করছে। তার উত্তরের আগে সাবাজ পুনরায় প্রশ্ন করেন, "কাপড়ের মতো কিছু?"
নওরিন চোখদু'টো বড় আকার নেয়। সাবাজের প্রশ্ন তাকে মনে করিয়ে দিয়েছে- হ্যাঁ কাপড়ের মতো কিছু।
"তোমার খুব কষ্ট হচ্ছিলো তাই না? দম বন্ধ হয়ে আসছিলো, তুমি চিৎকার করতে চাইছিলে কিন্তু পারছিলে না। বুক চিরে হৃদপিণ্ড বের হয়ে আসতে চাচ্ছিলো।"
বিস্মিত ও ভয়ার্ত কণ্ঠে নওরিন উত্তর দেয়, "হ্যাঁ!"
"এখন থেকে আর মোটেও ভয় পাবে না ওদের৷ ওরা তোমার কিছুই করতে পারবে না। আমি তোমার সাথে থাকবো কেমন?"
নওরিন সাবাজকে বিশ্বাস করে নেয়। নেওয়ার কারণ একটাই যে, তার ব্যাপারে সাবাজ যেগুলো বলছিলেন প্রতিটি কথা-ই সত্য। নওরিন তাকে না বলার পরেও সে সবকিছু জানে- এটা ভেবে সে বিশ্বাস করে নেয় আহমেদ সাবাজকে।
নওরিনকে আয়েশার কাছে রেখে রাফিয়ার সাথে কথা বলার জন্য সাবাজ বাইরে বেরিয়ে আসেন। তাকে দেখে রাফিয়া প্রায় ছুটে চলে আসে। এতক্ষণ হয়তো উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছিল সাবাজের থেকে তার মেয়ের ব্যাপারে জানার জন্য।
"কিছু জানতে পারলেন?"- রাফিয়া প্রশ্ন করেন।
"বেশ কিছু।"- উত্তর দেন সাবাজ।
রাফিয়ার অসহিষ্ণু চোখ সাবাজের ব্যাখ্যার অপেক্ষা করছে।
"তবে সেগুলো বলার আগে আরেকটা বিষয় সম্পর্কে বলি। নাহলে নওরিনের ব্যাপারটা আপনার কাছে ঘোলাটে লাগবে।"
"কী বিষয়?"
"আমাদের স্বপ্নের দু'টি ধাপ আছে। একটি Rapid Eye Movement (REM) অন্যটি Non Rapid Eye Movement (Non-REM)। ঘুমের প্রথম দিকে নন-রেম পর্যায়টি ঘটে। মানুষ স্বপ্ন দেখে মূলত রেম পর্যায়ে। এ সময়ে তার চোখের পাতা হালকা নড়তে থাকে। আর চোখের মনি খুব দ্রুত নড়াচড়া করে ও স্বপ্ন দেখে।"
"এ সম্পর্কে বলার কারণ ব্যাখ্যা করবেন নিশ্চয়ই।"
"গতকাল রাতে নওরিনের ঘুমের সময় তার চোখের মনির নড়াচড়া লক্ষ্য করেছিলেন অবশ্যই। মানে ঐ সময়টাতে সে স্বপ্ন দেখছিলো। কিন্তু তার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো আর শরীরের কোনো অঙ্গ নড়াতে পারছিলো না। নওরিনের সাথে এখন কথা বলে পুরো বিষয়টির ব্যাখ্যা এমন দাঁড়ায় যে, সে ঐ সময়টাতে স্বপ্নে দেখে যে কেউ তাকে মেরে ফেলতে আসছে। আর সে মার্ডারার হিসেবে আপনাকে ও আপনার স্বামীকে দেখেছে। তার গলায় কাপড় জাতীয় কিছু পেঁচিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে মারার চেষ্টা করা হচ্ছিলো এমনটা বলেছে সে। যে কারণে সে তার রুমে বেডশিট বা জানালার পর্দাও ভয়ে রাখেনি। সম্ভবত এরপর তার স্বপ্নের কল্পিত খুনি নওরিনের গায়ের কাপড় খুলে তাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করে যে কারণে ঘুম থেকে উঠে সারা শরীরের কাপড় খুলে রুমের বাইরে ছুড়ে ফেলে সে।"
রাফিয়ার মুখ চিন্তায় ভরে গেছে। চোখের পাতাগুলোও ভারী হয়ে যাচ্ছে, দু-চার ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়বে এমন অবস্থা। গম্ভীর কণ্ঠে তিনি প্রশ্ন করেন, "এমনটা কেন হচ্ছে? আর আমার মেয়ের সাথেই বা কেন?"
"স্লিপ প্যারালাইসিস।"- উত্তর দেন আহমেদ সাবাজ। "সহজ কথায় বলতে, যাকে বোবায় ধরা বলা হয়। নওরিনের এই স্বপ্নের মধ্যেই সে স্লিপ প্যারালাইসিস এর শিকার হয়। যে কারণে তার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, মনে হয় বুকের উপর চেপে বসে আছে কেউ। এই সময়টাতে শরীরের কোনো পেশি কাজ করে না বলে নওরিন হাত পা কিছুই নাড়াতে পারছিলো না। ঘুমের মধ্যে হওয়া এই স্লিপ প্যারালাইসিস কে হিপনাগোজিক (Hypnagogic) বা প্রিডরমিটাল (Predormital) স্লিপ প্যারালাইসিস বলা হয়।"
"কিন্তু তার এই স্লিপ প্যারালাইসিস হওয়ার কারণ কী?"
"যতদূর ব্যাখ্যা দাঁড়ায়, প্যানিক ডিসঅর্ডারের কারণে। যে কোনো একটা উপায়ে তার মাথায় কেউ এই ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে যে আপনি বা আপনার স্বামী তার খুন করবেন। এজন্য তার ঘুমের মধ্যে পক্ষাঘাত ঘটে আর ঘুম থেকে উঠেও কিছু সময় আতঙ্কে থাকে। এ সময়ে সে খুব ঘেমে যায়। আর এর রেশ কেটে উঠতে সে মাঝরাতে গোসল করে৷"
"কিন্তু তার মাথায় এমন ভয় কে ঢুকাবে?"
"আপনি বলেছিলেন যে, একটা প্রাইভেট ক্লিনিকে তাকে ভর্তি করানো হয়েছিল। আর তারপর থেকেই তার এই সমস্যা। হতে পারে আপনার প্রশ্নের উত্তর সেখানেই আছে৷"
"আর আমার মেয়ের সুস্থতার ব্যাপারে কী ভাবছেন?"
"মানসিক রোগের জন্য Biological Therapy তথা ওষুধ ও অন্যান্য জৈবিক চিকিৎসা এবং Psychotherapy তথা মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা দু'টোরই গুরুত্ব আছে। আমি একজন সাইকোলজিস্ট হিসেবে শুধুমাত্র তার কাউন্সিলিং বা সাইকোথেরাপিই করতে পারবো। কোনো ওষুধ প্রেসক্রাইব করার এখতিয়ার আমার নেই। সেক্ষেত্রে অবশ্যই একজন সাইকিয়াট্রিস্টের শরণাপন্ন হতে হবে। আপনার মেয়ের ব্যাপারে ভাববেন না। এই দু'টি পদ্ধতিতে চিকিৎসা করলে সে শীঘ্রই সুস্থ হয়ে উঠবে।"
"তাহলে এখন আপনার এক্স্যাক্ট উদ্দেশ্য টা কী?"
"নওরিনের মধ্যে প্যানিক ডিসঅর্ডার সৃষ্টির মূল হোতাকে বের করতে হবে।"
রাফিয়ার থেকে ক্লিনিকটির ঠিকানা নিয়ে বিকালেই বের হন আহমেদ সাবাজ। ফিরে আসেন প্রায় সন্ধ্যার দিকে। কলিং বেল চাপতেই দরজা খুলে দেন রাফিয়া। সম্ভবত তিনি সাবাজের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন এতক্ষণ।
"গোয়েন্দাগিরি করে আসলাম একটু।"- মুচকি হেসে রাফিয়ার দিকে তাকিয়ে বলেন সাবাজ।
"কোনো তথ্য.."- রাফিয়া প্রশ্ন শেষ করার আগেই সাবাজ উত্তর দেন, "হ্যাঁ, পেয়েছি কিছুটা। একটা প্রশ্ন- আপনার বা আপনার স্বামীর আইনি ক্ষমতা কেমন আছে?"
"হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?"
"ক্লিনিকটার ফ্লোরগুলোকে নিয়ে অন্যরকম নিয়ম করেছেন ড. আলতাফ হোসেন। তার নিজস্ব ক্লিনিকটিকে নিজের পছন্দমতো একটি প্যাটার্ন দিয়েছেন। যেমন নিচের ৪টি ফ্লোরকে ত্রিশ বছরের উপরের রোগীদের জন্য নির্ধারণ করেছেন৷ ওগুলো আবার পুরুষ ও মহিলাদের জন্য আলাদাভাবে ভাগ করা। ৫ম ফ্লোরে করেছেন খাবার ক্যান্টিন। আবার উপরের ৪টি ফ্লোরকে ত্রিশ বছরের নিচের রোগীদের জন্য নির্ধারণ করেছেন।"
"এটা তো গোপন কোনো বিষয় নয়।"
"আমার কথা শেষ করতে দিন। তো প্রথমে সেখানে গিয়ে সরাসরি জিজ্ঞাসা করলাম ৯০৯ নম্বর কক্ষটি খালি আছে কি না। প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলো রোগীর বয়স কত। উত্তর দিলাম- ২১ বছর; যদিও আমি কোনো রোগীকে ভর্তি করাতে যাইনি৷ এরপর বললো- না, ৯১২ এবং ৯১৫ নম্বর কেবিন খালি আছে৷ কিছু না বলেই সেখান থেকে বেরিয়ে এসে ছদ্মবেশ ছেড়ে এক মিনিটের মাথায় আবার ফিরে যাই। বলি- বাইরে এম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে, রোগীকে দ্রুত ভর্তি করতে হবে। এবার রোগীর বয়স বললাম বারো। রোগের বিবরণ লেখা শেষে আমার হাতে একটা ফর্ম ধরিয়ে দিলেন। লক্ষ্য করলাম- রুম নম্বর ৯০৯।"
"মানে? এক মিনিট আগেই না বললো ৯০৯ কেবিন খালি নেই?"
"গণ্ডগোল তো এখানেই। ৯০৯ নম্বর কেবিনে আজ অব্দি যত পেশেন্ট ভর্তি হয়েছে তাদের রেকর্ড দরকার আমার। এজন্যই জিজ্ঞাসা করলাম আইনি ক্ষমতার ব্যাপারে।"
"রাতটুকু অপেক্ষা করুন শুধু, সকাল হতেই পেয়ে যাবেন।"
কৃতজ্ঞতার হাসি দিয়ে নিজ কক্ষে ফিরে আসেন সাবাজ।
_____
"আপনার গুরুত্বপূর্ণ কোনো কথা থাকলে বলুন। আমার সময় অযথা নষ্ট করবেন না, ইমারজেন্সি পেশেন্ট আছে আমার।"
"গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কেই জানতে এসেছি ড. আলতাফ হোসেন।"
"কী বিষয়?"
"৯০৯ নম্বর রুমের ব্যাপারে জানতে চাই।"
ড. আলতাফ কিছু সময়ের জন্য রোবটের মত স্থির হয়ে যান। যেনো কোনো শক খেলেন। তার আচরণিক পরিবর্তন সাবাজের চোখ এড়ায়নি। সাবাজ আবারও প্রশ্ন করেন, "এ রুমের রেকর্ড ঘেটেছি আমি, আজ অব্দি যাদের এই কেবিনে ভর্তি করা হয়েছিল তাদের বয়স ১৩ এর আশেপাশে ছিল। মোট যে ছয়জন এখানে ভর্তি হয়েছিল তাদের চারজনই রিলিজের বেশ কয়েকদিন পর আত্মহত্যা করে, শেষ যাকে ভর্তি করা হয়েছিল তার মানসিক অবস্থাও ভালো নয়। আর সর্বপ্রথম যে মেয়েটিকে ভর্তি করা হয়েছিল, তার বাবা ছিলেন স্বয়ং আপনি, ড. আলতাফ হোসেন।"
"কোত্থেকে পেয়েছেন এসব? পরিচয় কী আপনার?"- একরকম চিৎকার মেরে ওঠেন ড. আলতাফ।
"আহমেদ সাবাজ, পেশায় সাইকোলজিস্ট।"- শান্ত গলায় উত্তর দেন তিনি।
আলতাফ কিছুটা শান্ত হয়ে বলেন, "আপনার ব্যাপারে শুনেছি। সম্মানীয় ব্যক্তি আপনি। তবে এসব ভিত্তিহীন প্রশ্ন করতে থাকলে আমার থেকে সম্মানটুকু হারাবেন।"
তার কথার কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে সাবাজ আবারও বলতে শুরু করেন, "আপনার মেয়ে মানসিক রোগী ছিল যে নিজে আপনার এই হাসপাতাল থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করে।"
"স্টপ টকিং এবাউট দিস শিট।"- কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে ড. আলতাফের।
সাবাজ তার কথা চালিয়ে যাচ্ছেন, "এরপর থেকে শুধুমাত্র ১৩ বছরের আশেপাশের মেয়েদের ভর্তি করা শুরু করেন। ফিজিক্যাল ট্রিটমেন্ট করেছিলেন বটে তবে মেন্টালি প্রত্যেককেই আক্রান্ত করে তোলেন৷ প্রত্যেকের মনে তার মা-বাবার সম্পর্কে তীব্র আতঙ্ক প্রবেশ করিয়েছিলেন।"
ড. আলতাফ কথা বলছেন না, ঘামছেন আর কাঁপছেনও। সাবাজ তার কথা শেষ করেননি, "শারীরিক সুস্থতা পেলেই আপনি রোগীদের রিলিজ দিয়ে দিতেন। মানসিক চিকিৎসার জন্য আপনার এই হাসপাতাল নয়। তাই মেয়েগুলোর বাবা-মা যখন চিন্তিত মুখ নিয়ে তাদের মেয়েদের বাড়িতে নিয়ে যেতেন তা দেখে আপনার মাঝে পৈশাচিক আনন্দ ফুঁটে উঠতো। দুঃখের বিষয় তাদের চারজনের কারোর-ই মানসিক চিকিৎসা হয়নি কিন্তু পঞ্চমবার এসে মোস্তফা আনওয়ার ও তার স্ত্রী রাফিয়া আনওয়ার এ ভুল করেননি।"- এতটুকু শেষ করে কিছু সময়ের জন্য থেমে যান সাবাজ। একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শেষবারের মতো বলেন, "তবে সবচেয়ে সত্য কথা এটা, আপনি না তো পেরেছেন একজন ভালো ডাক্তার হতে আর না তো পেরেছেন ভালো বাবা হতে।"
_____
নওরিনের চিকিৎসা চলছে; দ্রুতই সুস্থ হয়ে উঠবে। যত দ্রুত সুস্থ হবে সাবাজের জন্য ততই ভালো, নিজ ঠিকানায় ফিরতে হবে তাকে। হাতমুখ ধুয়ে রকিং চেয়ারটিতে গিয়ে বসলেন তিনি। ধীরে ধীরে দোল খাচ্ছেন।
আজ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি কেইসের মিমাংসা করেছেন সাবাজ। শুধুমাত্র নিজের ব্যাপারটিকে এতো কেইসের ভিড়ে পিছে ফেলে রেখেছেন। কয়েকবার মিমাংসা করতে গিয়ে মাঝপথে নিজ থেকেই থেমে গিয়েছেন। স্বপ্নে তার স্ত্রীর ভয়ার্ত চেহারাকে তো সে ভয় পায় না তবে সমাধানের কী দরকার?
কে জানে, হয়তো এ রহস্যের মিমাংসা করলে স্বপ্নেও তার স্ত্রীকে দেখার সৌভাগ্যটুকু হারাবেন তিনি!
সমাপ্ত
Sayan
Hasibul hasan santo, Santa akter, Sk sagor, Sk imran, Rasel islam, Mr faruk, Saiful Osman and লেখাটি পছন্দ করেছে
Permissions in this forum:
You cannot reply to topics in this forum