সাদা কাগজ
Would you like to react to this message? Create an account in a few clicks or log in to continue.

Go down
avatar
Ratul k.
নবাগত
নবাগত
Posts : 8
স্বর্ণমুদ্রা : 1279
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-06-05

শিকার Empty শিকার

Sat Jun 05, 2021 11:44 pm
এক.

"কিরে, এতক্ষণ ধরে কি করিস ? দেরী হয়ে যাচ্ছে তো ।"

মামার ডাকাডাকিতে ঘর থেকে বের হলাম । মামাকে দেখে আমি তো অবাক । শিকারীদের মত মাথায় হ্যাট পড়েছে, কাধেঁ ঝুলানো লম্বা নলওয়ালা বন্দুক,পরনে শিকারীদের পোষাক । অবাক হয়েই বললাম,"কি ব্যাপার মামা ? বনে কি ঘুরতে যাচ্ছো নাকি পশু শিকারে যাচ্ছো ?" মামা বন্দুকটা উচিঁয়ে বলল,"বনে আমি ত্রাস সৃষ্টি করতে যাচ্ছি ।" বুঝতে পারলাম শিকারে নেশা মাথায় ঢুকেছে মামার ।

জিনিসপত্র, খাবার-দাবার আর দরকারী সব মাল সামানা নিয়ে মামার ঝিকঝাক চার চাকার গাড়িতে চেপে বসলাম ।

আমি বরাবরই বন-জঙ্গল প্রেমী । আর আমার মামা ইমরান তো মাঝে মাঝে নিজেকে টারজান ভাবে । প্রায়ই বেরিয়ে পড়ে বন জঙ্গল ঘুরতে । এবারের যাত্রায় ওনার সঙ্গী আমি । ৫ কি.মি. দূরে একটা বড় আর ঘন জঙ্গল আছে । সেখানেই আমাদের গন্তব্য । আর চার চাকার ঝিকঝাক গাড়িটা মামার খুব প্রিয় গাড়ি । সেই ছোটবেলা থেকে দেখতেছি আমার মামা যেখানেই যাক না কেন এই গাড়িটা ব্যবহার করে । গাড়িটার ছাদ মনে হয় কোন এক ভয়াবহ দুর্ঘটনায় উড়ে গেছে । চারটা সিটের একটা সিট উধাও । আর একেবারে পিছনের দিকটা মোটামুটি ভালোই নড়বড়ে । আর ঝিকঝাক শব্দ না করলে গাড়িটা যেন চলতেই পারে না । মাঝে মাঝে মামাকে বলি,"মামা,তুমি একদিন গাড়িটা নিয়ে স্বর্গের পথে রওয়ানা দাও । আমার বিশ্বাস যতই ঝিকঝাক করুক ও একদিন ঠিকই তোমাকে স্বর্গে নিয়ে পৌছাবে ।" মামা তখন হেসে উত্তর দেয়,"দেখবি ঠিকই আমি একদিন এই গাড়িতে করে স্বর্গে যাবো ।" মামার কথা শুনে আমি মনে মনে খুব হাসি ।

একমনে গাড়ি চালাচ্ছে মামা । একটু কেশে বললাম,"মামা,হঠাৎ শিকারের ইচ্ছা তোমার মনে জাগলো কেন ?" মামা আমার দিকে না তাকিঁয়েই বলল,"আসলে অনেকদিন ধরে শিকার করি নি । আর হাতটাও কেমন যেন নিশপিশ করছে ।" আমি জিজ্ঞাসা করলাম,"তো কি কি শিকার করবে ?" মামা বলল,"এবার ৮-১০ প্রজাতির পশুপাখি শিকারের ইচ্ছে আছে । তবে তুই এটাকে শুধু শিকার না বলে জ্যান্ত শিকার বলতে পারিস । কারণ আমি কোন প্রাণীকেই মারবো না । জ্যান্ত ধরবো । বিশেষ করে বাঘের একটা ছোট বাচ্চা আমার জ্যান্ত চাই-ই ।" বোতলটা খুলে সবেমাত্র পানি মুখে নিয়েছি । মামার কথা শুনে পানি আটকে গেল গলায় । কোনরকমে কেশে পানিটা ফেলে দিয়ে মাথায় হাত চাপরাতে চাপরাতে প্রায় চেচিঁয়ে বললাম,"জ্যান্ত বাঘের বাচ্চা ! তুমি কি আমাকে বাঘের খাবার বানানোর জন্য বাড়ি থেকে নিয়ে আসছো ? আর এত জ্যান্ত পশু-পাখি দিয়ে তুমি কি করবে ?" মামা একটু হেসে বলল,"আমি ভাবতেছি ছোটখাটো একটা চিড়িয়াখানা বানাবো । আর তুই এত ভয় পাচ্ছিস কেন ? আমি আছি তো । আমি ভাবছি অন্য কথা ।" আমি জিজ্ঞাসা করলাম,"কি কথা ভাবতেছো ?" মামা গাড়িটাকে বাঁয়ের দিকে মোড় দিয়ে বলল,"বাঘের বাচ্চাটাকে নিয়ে আসলে একা থাকবে কি করে ওটা ? তাই ভাবতেছি একটা মা বাঘও সাথে নিয়ে আসবো ।" মামার কথা শুনে কি যে বলবো মাথায়ই আসলো না । অগ্যাত চুপ করে থাকাটাই শ্রেয় মনে করলাম । তবে মনে মনে মামাকে বকা দিতে ভুললাম না । মনে মনে বললাম,"গাধাটা কি বাঘকে গরু-ছাগল মনে করতেছে নাকি যে গলায় দড়ি বেধেঁ নিয়ে আসবে ? কি জানি বাঘ ধরতে গিয়ে নিজেই না বাঘের খাবার হয়ে যাই ।"

বন্য এলাকায় পৌঁছে গেলাম । বিকালের সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে । গ্রামের সরু রাস্তা দিয়ে আমাদের ঝিকঝাক গাড়ি চলছে । উৎসুক লোকজন আমাদের দিকে তাকিঁয়ে আছে । পনের মিনিট লাগলো গ্রামটা পাড় হতে । বনের ছোট আকাঁবাকাঁ রাস্তা দিয়ে ভিতরে ঢুকতে লাগলো আমাদের গাড়ি । একটু গভীর বনে পৌঁছাতে হবে আমাদের । তাহলে পশু-পাখি ধরতে সুবিধা হবে । তবে এটা আমার থিউরি না । আমার গ্রেট মামার থিউরি এটা । ওনার পছন্দসই একটা জায়গায় গাড়ি থামালো । মাল সামানা নিয়ে গাড়ি থেকে নামলাম । সূর্যের আলো সরলরেখার ন্যায় গাছের পাতার ফাকেঁ দিয়ে আসছিল । দুইজনে মিলে ছোটখাটো একটা তাবু বানিয়ে ফেললাম স্বল্পসময়ের মধ্যে ।
আগুন জ্বালানোর জন্য অনেক ডাল,লতা,পাতা জড়ো করলাম ।
আস্তে আস্তে সূর্যটা গভীর জঙ্গলের মাঝে হারিয়ে গেল । অন্ধকার নেমে আসলো চারদিকে । পাখিরা যার যার নীড়ে উড়ে যাচ্ছে ।

শুরু হল জঙ্গলে আমাদের প্রথমরাত ।

দুই.

পাখির কিচিরমিচির, শিয়ালের হুক্কা হুয়া, বানরের চেচাঁমিচিতে মোটামুটি মুখরিত জঙ্গলের এই দিকটা ।

তাবুর বাহিরে আগুন জ্বালিয়ে আমি আর মামা পাশাপাশি বসে আছি । শুকনো ডালপালাতে আগুন ভালোই জ্বলছে । মামার দিকে তাকিঁয়ে বললাম,"মামা, কি কি প্রাণী জ্যান্ত ধরতে চান ?" একটু ভেবে মামা বলল,"আপাতত ভাবতেছি হরিণ, খরগোশ, কাঠবিড়াল, বাঘ, ময়ূর এগুলো ধরবো । ছোট চিড়িয়াখানায় এর থেকে বেশি প্রানী লাগবে না । তবে যদি চোখের সামনে যদি সুন্দর কোন পশু বা পাখি পাই সেগুলো কিন্তু বাদ যাবে না । মোটকথা চিড়িয়াখানা সাজাতে আমার যেটা উপযোগী মনে হবে সেটাই ধরবো ।" আমি কাচুঁমাচুঁ হয়ে বললাম,"সব ঠিক আছে । কিন্তু বাঘ না ধরলে হয় না ?" মামা বলল,"বাঘ ছাড়া চিড়িয়াখানা হয় নাকি ? এখন চল শুয়ে পড়ি । সকাল সকাল উঠে আবার বেরোতে হবে ।"

গভীর রাত । চাঁদ উঠেছে । পশুপাখির চিৎকার চেচাঁমিচি কমেছে । মাঝে মাঝে শিয়ালের হুক্কা হুয়া ডাক আর নাম না জানা কোন এক পশুর হাঁক শুনা যাচ্ছে। ঘুম আসছে না আমার । উঠে বসলাম । মামা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন । সারাদিন মামার সাথে ছিলাম বলে একটা সিগারেটও খেতে পারি নাই । নিজের ব্যাগে লুকিয়ে রাখা সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট নিয়ে তাবুর বাইরে আসলাম । মৃদু বাতাস বইছে । চাঁদের আবছা আলোতে অন্যরকম একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে জঙ্গলে । একটা গাছের সাথে হেলান দিয়ে বসে সিগারেটটা ধরিয়ে আয়েশ করে টান দিলাম । অর্ধেক সিগারেট শেষ । হঠাৎ একটু দূরে ঝোপের আড়াল থেকে গড় গড় আওয়াজ শুনতে পেলাম । একটু ভয় পেলাম । তবে নিজের জায়গা থেকে নড়লাম না । বসেই নজর রাখলাম ঝোপটার উপর । মিনিট দুয়েক পর ঝোপের আড়াল থেকে কি যেন বের হল । ভালো করে তাকিঁয়ে চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখলাম একটা ডোরাকাটা বাঘ ঝোপ থেকে বেরিয়ে বনের ভিতরে চলে গেল । আমাকে দেখে নি বোধহয় । দ্রুত সিগারেটটা ফেলে দিয়ে তাবুর ভিতর ঢুকে গেলাম । বুক ধুকধুক করছে ভয়ে । পানি খেলাম । মামা ঘুমাচ্ছে । ডাকলাম না । ডাকলে হয়তো নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে । চুপচাপ মামার পাশে শুয়ে পড়লাম ।

মামার ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো । চোখ মেলতেই দেখি তাবুর ছোট ছিদ্র দিয়ে সূর্যের আলোর সরলরেখাটা আমার চোখে পড়ছে । আড়মোড়া দিয়ে ঘুম থেকে উঠলাম । তাবুর বাইরে আসলাম । জঙ্গলে এটাই আমার প্রথম দেখা সকাল । একটা সকাল এত সুন্দর হতে পারে আমি কখনও জানতামই না । ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিরা উড়ে যাচ্ছে আকাশে । নিশ্চয়ই খাবারের খোঁজে । নাম না জানা নানান রকম বন্যফুলের মিষ্টি সুবাস ভেসে আসছে বাতাসে । মনে হচ্ছে জীবনে এই প্রথম প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছি । তাবুর পাশের উঁচু একটা গাছ । তার ডালে একটা মা বানর তার বাচ্চাকে আদর করে ফল খাওয়াচ্ছে । একটু দূরে একটা শিয়াল ছানা ছুটোছুটি করছে । সকালের এত সুন্দর প্রকৃতি দেখে চোখ জুড়িয়ে গেলো আমার।
মামার একটা কথা ভীষণ মনে পড়লো তখন। প্রায়ই তিনি বলতেন,"ভাগ্নে ঘরে বসে থাকলে শুধু ঘরের পরিচিত সৌন্দর্য-ই দেখতে পারবে । ঘরের বাহিরে বেরিয়ে এসো দেখবে পৃথিবীর হাজারো অপরিচিত সৌন্দর্য তোমার সামনে এসে দাড়াঁবে । জীবনটাকে তখন আর একঘেঁয়ে মনে হবে না ।" মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম মামাকে ।

ফ্রেশ হয়ে নাশতা করে নিলাম । মামা আবার শিকারীর মত সেজেছে । আমি গাড়িতে কয়েকটা খাঁচা, জাল আর কিছু খাবার রাখলাম । যদি কোন প্রাণী জ্যান্ত ধরতে পারি তখন খাঁচা কাজে লাগবে ।জাল সেগুলো ধরতে সাহায্য করবে ।
মামা বলল,"আমরা প্রথমে জঙ্গলটা একটু ঘুরে দেখবো । তবে খুব সাবধানে থাকতে হবে । কখন কিসে আক্রমন করে বলা তো যায় না ।"
একটা ছুরি হাতে দিয়ে বলল,"এটা তোর কাছে রাখ । কাজে লাগতে পারে "

বাকি জিনিস পত্র সব তাবুতে গুছিয়ে রেখে আমরা ঝিকঝাক গাড়িতে করে আরো ঘন জঙ্গলের দিকে রওয়ানা দিলাম ।

চলবে

তুর্জয় শাকিল

Rasel islam, Sumaiya akter, Rokeya hoq, Asha islam, Soneya akter, Somrat, Liton vhos and লেখাটি পছন্দ করেছে

avatar
Ratul k.
নবাগত
নবাগত
Posts : 8
স্বর্ণমুদ্রা : 1279
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-06-05

শিকার Empty Re: শিকার

Sat Jun 05, 2021 11:45 pm
তিন.

এবড়ো থেবড়ো রাস্তা । কোথাও উঁচু, কোথাও নিচু । সাপের মত আকাঁবাকাঁ । কোথাও আবার রাস্তার উপর বন্য আগাছার ছোট ঝোপ । আমাদের ঝিকঝাক গাড়িটা সবকিছু সামলে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে । এখন বুঝতে পারছি মামা কেন তার ঝিকঝাক গাড়িটাকে এত পছন্দ করে ।

জঙ্গলের ভিতরের ছোট একটা বিলের পাশে এসে গাড়িটা থামলো । বন্দুকটা কাধেঁ করে বিলের পাশে এসে দাড়াঁলো ইমরান মামা । পাশে এসে দাড়াঁলাম আমি । বিলে অনেকগুলো বন্য হাঁস ভেসে বেড়াচ্ছে । মামা বলল,"দু’তিনটা মারতে পারলে একদিনের খাবার ঝুটে যেত ।" আমি বললাম,"তোমার কাধেঁ তো বন্দুক আছে । গুলি করেই তো মারতে পারো ।" মামা কাধেঁ হাত দিয়ে বলল,"ও আমার কাছে তো বন্দুক আছে । আমি তো ভূলেই গিয়েছিলাম ।" আমি অবাক হয়ে বললাম,"কি ?" মামা বলল,"অবাক হওয়ার কি আছে ? বয়স হয়েছে তো তাই না । ভূল তো হতেই পারে ।" আমি মামার ঘন কালো চুলের দিকে তাকিঁয়ে আর কিছু বললাম না । মামা কাধঁ থেকে বন্দুকটা নামিয়ে হাঁসগুলোর দিকে তাক করলো । প্রচন্ড শব্দে বন্দুক থেকে গুলি ছুড়লেন । দুইটা হাস কুপোকাত । বাকিগুলো উড়ে গেল । আমি সাতঁরে গিয়ে হাঁসগুলো নিয়ে আসলাম । গাড়িতে হাঁসগুলো রেখে আবার বিলের পাড়ে আসলাম ।

একটু দূরে একটা ঝোপের পাশে দুইটি ময়ূর পেখম মেলে খেলছে । আমি মামাকে দেখালাম । মামা দেখেই বন্দুক তাক করলো । আমি বললাম,"তুমি বন্দুক তাক করেছো কেন ? তুমি না এগুলোকে জ্যান্ত ধরতে চাও ।" মামা বন্দুক টা নামিয়ে চুপ করে রইলো । বুঝলাম একটু লজ্জা পেয়েছে । আমি বললাম,"মামা,তুমি ঝোপের ওদিকে যাও । ওগুলোর সামনে গিয়ে ভয় দেখাও । আর আমি এইদিকটাতে থাকবো জাল নিয়ে । ওরা ভয় পেয়ে এদিকটাতে আসবে । আর জালের ফাদেঁ পা দিবে ।" আমার পরিকল্পনা সফল হল । মামা ওগুলোকে ভয় দেখাতেই ওরা জালে এসে আটকা পড়লো । মাঝারী আকারের একটা খাচাঁয় ময়ূরদুটোকে ঢুকিয়ে গাড়িতে রেখে দিলাম ।

গাছের গোড়ায় বসে মামা-ভাগ্নে একটু জিরিয়ে নিলাম । হঠাৎ মনে হল ঝড় শুরু হয়েছে জঙ্গলে । আর গাছপালা সব লন্ডভন্ড করে ঝড়টা যেন এদিকেই ধেয়েঁ আসছে । একটু ভয় পেলাম । মামা চেচিঁয়ে বলল,"ঐ ঝোপটার আড়ালে লুকাতে হবে । তাড়াতাড়ি চল ।" আমি মামার নির্দেশ মত ঝোপের আড়ালে লুকালাম । কিছুক্ষণ পর দেখলাম এক পাল গন্ডার গাছপালা, ঝোপ, ঝাড় সব তছনছ করে আমাদের সামনে দিয়ে যাচ্ছে । প্রায় তিন মিনিট পর পালটা আমাদের অতিক্রম করলো । গন্ডারগুলো যাওয়ার পর আমরা ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে আসলাম । মামাকে বললাম,"ওদের যে এত শক্তি সেটা তো জানতাম না ।" মামা বলল,"এভাবে ওরা খুব শান্তশিষ্ট কিন্তু রেগে গেলে জঙ্গলের সবচেয়ে ভয়ানক প্রাণীতে রূপান্তরিত হয়।" আমি "ও আচ্ছা" বলে পিছনে তাকাঁতেই দেখলাম গন্ডারের একটা ছোট বাচ্চা হেলেদুলে এদিকেই আসছে । আমি মামাকে বাচ্চাটা দেখালাম । মামার চোখ চকচক করে উঠলো । বলল,"মনে হয় পালছুট হয়ে গেছে বাচ্চাটা । জালটা নিয়ে গাড়ি থেকে।" আমি দৌড়ে জালটা নিয়ে আসলাম । মামা বুঝিয়ে দিল কি করতে হবে ।
গন্ডারটা কাছে আসতেই জাল নিয়ে ওটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম । জাল দিয়ে পেচিঁয়ে বাচ্চাটাকে জড়িয়ে ধরলাম । কিন্তু ওইটুকু বাচ্চার যে এত শক্তি ভাবতে পারি নাই। এক ঝটকায় আমাকে ছুড়ে ফেলে দিল । জালসহই দৌড়াতে শুরু করলো বাচ্চাটা আর মুখে ঘোৎ ঘোৎ শব্দ করতে লাগলো । তবে জাল পায়ে আটকে যাওয়ায় বেশিদূর যেতে পারলো না ওটা । হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল । আবার ঝাঁপিয়ে পড়লাম ওটার উপর । মামা দৌড়ে এসে অবশ করার ইনজেকশনটা বাচ্চাটাকে দিয়ে দিল । দুই মিনিটের মধ্যে বাচ্চাটা নিস্তেজ হয়ে গেল । কোলে করে বাচ্চাটাকে নিয়ে খাচাঁয় পুড়লাম । অনেক ধকল গেছে শরীরের উপর । মামা বলল,"আজকের মত অভিযান এখানেই সমাপ্ত । চল তাবুতে ফিরে যাই । কাল আবার নতুন উদ্যমে অভিযান শুরু করবো ।" গন্ডারের বাচ্চার ধাক্কায় পড়ে গিয়ে হাত পা ছুলে গেছে ।ক্ষতস্থানে বুনো ঘাস লাগিয়ে ঝিকঝাকে চড়ে বসলাম ।

পড়ন্ত বিকাল । সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে । গাড়ি দিয়ে যাওয়ার সময় এই সোনালী বিকালের বন্য পরিবেশ দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল ।

সন্ধ্যা হওয়ার আগেই তাবুতে পৌঁছে গেলাম । সবকিছু গুছিয়ে ঠিকঠাক করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে গেল । গভীর অরণ্যে হারিয়ে গেল সূর্যটা ।

শুরু হলো জঙ্গলে আমাদের দ্বিতীয় রাত ।

চার.

শিকার করা হাঁসগুলো মামা আগুনে ঝলসিয়ে দুইভাগ করলো । একভাগ আমাকে দিল আর একভাগ মামা নিল । ঝলসানো মাংস এই প্রথম খেলাম আমি ।খেতে একটু কাচাঁ কাচাঁ লাগছিল কিন্তু খুব সুস্বাদু ছিল মাংসগুলো । খাবারের পর্ব চুকিয়ে ধরে আনা প্রাণীগুলোকে কিছু খাবার দিলাম । ওগুলোকে মামা আমাদের তাবুতেই রেখেছে । মাঝখানে পর্দা দিয়ে একপাশে আমি আর মামা অন্যপাশ ওগুলোকে রাখা হয়েছে ।

রাত গভীর হতে লাগলো । নিশাচর প্রাণীদের হাকঁডাক ভেসে আসতে লাগলো গভীর জঙ্গল থেকে । মামা ঘুমিয়ে আছে । আজ আর তাবুর বাহিরে গিয়ে সিগারেট খাওয়ার সাহস হলো না । অগ্যাত মনের ইচ্ছাটাকে জোর করে তাড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম ।

মামার ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো সকালবেলা । তাবুর বাহিরে এসে দেখি উঠানে নতুন এক অতিথি । খুব সুন্দর একটা কাঠবিড়াল খাচায় বসে কলার থোড় খাচ্ছে । অবাক হয়ে মামাকে বললাম,"কোথায় পেলে এটাকে ?" মামা একটা কলার খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে বলল,"কাল বিকালে ফিরার সময় খেয়াল করলাম পাশের কলাবাগানে বেশকিছু গাছে পাকা কলা রয়েছে । ভাবলাম কলা দিয়ে সকালের নাস্তাটা ভালোই জমবে । তাই ঘুম থেকে উঠে গিয়েছিলাম কলাবাগানে । গিয়ে দেখি থোড়ে বসে আছে এটা । ব্যস তখনই তাবু থেকে জাল নিয়ে গিয়ে ধরলাম এটাকে । এখন দ্রুত নাস্তা করে নে । বেরোতে হবে ।"

নাস্তা শেষ করে ঝিকঝাক গাড়িতে প্রয়োজনীয় জিনিসপাতি তুলে রওয়ানা দিলাম বনের অন্যদিকে । এইদিকটাতে সরু নদী আছে বেশকয়েকটা । বক, মাছরাঙ্গারা চুপটি করে বসে আছে নদীর তীরে শিকারের আশায় । নদীতে নেমে নাক দিয়ে ভুসভুস করে পানি ছেড়ে খেলা করছে জলহস্তীরা । চিড়িয়াখানায় দেখেছিলাম ওদেরকে । কিন্তু বন্য পরিবেশে ওরা যেন আরও স্বতঃস্ফূর্ত, আরও উৎফুল্ল । হঠাৎ গগণবিদারী আওয়াজে কানে তালা পড়ে গেল । মামা গাড়িটাকে থামিয়ে একটা গাছের আড়ালে নিয়ে রাখলো । আমাদের গাড়ির একটু সামনে দিয়ে একপাল হাতি দলবল নিয়ে যাচ্ছে । মামা বলল,"বন্য হাতিরা খুব ভয়ঙ্কর হয় । সামনে পড়লে আর রক্ষা নাই ।" হাতিগুলো সোজা গিয়ে নদীতে নামলো । শুড় দিয়ে পানি নিয়ে খেলা করতে লাগলো । আমাদের ঝিকঝাক আবার চলতে শুরু করলো । খোলা মাঠে এসে গাড়ি থামালো মামা । এখানে গাছপালা খুব একটা বেশি নেই । উচুঁ ঘাস আর লতাতে পরিপূর্ণ । গাড়ি থেকে নামলাম দু'জন । সুতা দিয়ে তৈরী একটা ফাঁদ ভাঁজ করতে করতে মামা বলল,"এই এলাকার লোকজন হরিণ ধরতে এই ফাঁদ ব্যবহার করে । আর এই তৃণভূমিটা হলো হরিণ ধরার সবচেয়ে শ্রেষ্ট জায়গা । ঘাস খেতে এসে ওদের পা আটকে যায় পেতে রাখা ফাঁদে ।" পুরো ফাঁদটা গুটিঁয়ে মামা বলল,"চল ঘাসের উপর ফাঁদটা পেতে দিয়ে আসি ।" মামা আর ভাগ্নে মিলে মাঠের অনেকটা জায়গা নিয়ে ঘাসের উপর ফাঁদটা পাতলাম । একটু দূরে পড়ে থাকা একটা গাছের গুড়িঁতে গিয়ে বসলাম দুইজন । কিছুক্ষণ পর অনেকগুলো হরিণ একসাথে ঘাস খেতে আসলো সেখানে । নীরবেই ফাঁদে পা আটকে গেল চারটা হরিণের । দ্রুত একটা একটা করে খাঁচায় ঢুকালাম হরিণগুলোকে । সহজাতিদের বন্দি হতে দেখে বাকি হরিণগুলো সব দৌড়ে পালালো ।

হরিণগুলোকে গাড়িতে উঠালাম । মামাকে বললাম,"খুব ক্ষুধা লেগেছে । মামা বলল."তাহলে চল তাবুতে ফিরে যাই । খাওয়া দাওয়া করে ভাববো পরের শিকারের কথা ।"

দুপুরের সূর্যটা মাথার উপর । তাবুতে এসে দুজনে মিলে খাবার তৈরী করলাম । সেগুলোকে গুছিয়ে রেখে গোসল করতে গেলাম নদীতে । সরু নদীটা একেঁবেকেঁ গিয়ে একটা উঁচু ঢিবির মধ্য দিয়ে ঢুকে গেছে । মামা বলল,"মনে হয় ওখানে কোন গুহা টুহা থাকতে পারে । পরে দেখবো এখন চল । অনেক ক্ষুধা লেগেছে ।" গোসল সেরে খেতে বসলাম দুইজন । খেতে খেতে বললাম,"মামা অনেক কিছুই তো ধরলেন । বাঘ ধরবেন না ?"
মামা বলল,"সেটাই তো ভাবছি । কিন্তু বাঘের দেখাই তো পাই না । ধরবো কীভাবে বল ?"

আমি খাবারের প্লেট থেকে একটুকরা মাংস তুলে চিবোতে চিবোতে বললাম,"আমি জানি বাঘ কোথায় থাকে ?"

শেষ পর্ব...

আমার দিকে ফিরে তাকালো ইমরান মামা ।
জিজ্ঞাসা করলো,"কোথায় দেখেছিস বাঘ ?" আমি বললাম,"আগে খেয়ে নেও তারপর বলছি ।" খাওয়া দাওয়া শেষ করে বন্দুকটা কাধেঁ নিয়ে মামা বলল,"এখন বল বাঘটা কোথায় ?" আমি হাতের ইশারায় দেখালাম,"ওই যে ঘন ঝোপটার আড়ালে আমি বাঘ দেখেছিলাম সেদিন রাতে । কিন্তু এই সামান্য বন্দুক দিয়ে তুমি এত বড় বাঘের সামনে যাবে কি করে ?" মামা বলল,"তুই এত ভীতু কেন ? খালি ভয় পাস । আমি আছি তো চল ।"

ঝোপের কাছে গিয়ে দেখি ঝোপের নিচে একটা বড়সড় গুহা । কিন্তু গুহার ভিতরটা খুব অন্ধকার । মামা বলল,"তাবু থেকে একটা টর্চ আর সবচেয়ে ছোট হরিণটা খাঁচা থেকে নিয়ে আয় ।" আমি মামার কথামত টর্চ আর ছোট হরিণটাকে কোলে করে নিয়ে আসলাম । মামা হরিণটার পায়ে একটা লম্বা দড়ি বেধেঁ হরিণটাকে গুহার ভিতরে ঢুকিয়ে দিল । কিছুক্ষণপর বের করে নিয়ে আসলো । আমাকে বলল,"টর্চটা দে । মনে হয় বাঘ নাই গুহাতে । থাকলে হরিণটাকে ধরতো । আমি গুহার ভিতর ঢুকবো ।" আমি মামাকে টর্চটা দিয়ে বললাম,"মামা,সাবধানে থেকো সাপ টাপ থাকতে পারে ।" মামা টর্চটা সাথে নিয়ে গুহাতে ঢুকলো । কিছুক্ষণপর পুরো শরীরে ধুলোবালি আর মাকরসার জালে জড়ানো অবস্থায় হাসিমুখে বেরিয়ে আসলো মামা । হাতে একটা ছোট বাঘের বাচ্চা । আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,"কিভাবে ধরলে এটাকে ?" বাচ্চাটাকে খাচাঁয় ঢুকিয়ে মামা বলল,"গুহার ভিতরে ঘুমাচ্ছিল । কোলে করে নিয়ে আসলাম । মা বাঘটা মনে হয় আশেপাশে আছে । তাড়াতাড়ি পালাতে হবে বুঝলি । তা না হলে কখন যে বাচ্চাটাকে খুজঁতে খুঁজতে এখানে এসে আক্রমন করে বসে কে জানে ।"

মামা আর আমি খাচাঁসমেত সব পশুগুলোকে গাড়িতে তুললাম । আরও যা যা জিনিসপাতি আছে মোটামুটি সবই গাড়িতে তুললাম । টুকটাক কিছু জিনিস গুচাচ্ছি । হঠাৎ গড় গড় শব্দ শুনে ঝোপের দিকে তাকিঁয়ে দেখি ডোরাকাটা বাঘটা একলাফে তাবুর উঠানে চলে আসলো । মামার দিকে তাকালাম ।তার হাতে একটা ছোট ব্যাগ । বাঘটাকে আসতে দেখে হাত-পা কাপঁতে লাগলো ওনার । চোখে মুখে স্পষ্ট ভয়ের ছাপ । আগে কখনো মামার এরকম অবস্থা দেখি নাই । বাঘটা ধীরপায়ে এগিয়ে আসছে । চোখে শিকারর নেশা । মুখটা একটু হা করতেই দেখলাম ধারালো আর ভয়ংকর দাঁতগুলো । ভয়ে আত্মা শুকিয়ে গেল আমার । ওদিকে মামার অবস্থাও বেগতিক । ভয়ে তো কথাই বলছেন না তিনি । কিছু একটা করতে হবে আমাকেই । কিন্তু কি করবো ভেবে পাচ্ছি না ? এদিকে বাঘটাও কাছাকাছি চলে আসছে । আমার হাতে ময়দার ছোট একটা ব্যাগ ছিল । শুনেছি বিড়াল প্রজাতির প্রাণীরা খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে পছন্দ করে । শরীরে কোন ময়লা সহ্য করতে পারে না। বাঘও তো সেই প্রজাতির । ব্যাগটা খুলে ময়দা গুলো ছুড়ে মারলাম বাঘটার উপর । ভড়কে গেলো বাঘটা । থেমে গেলো । অর্ধেকটা শরীর ময়দায় ভরে গেছে ।শরীর থেকে ময়দাগুলো পরিষ্কার করার জন্য মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খেতে লাগলো বাঘটা ।

আমি চেচিঁয়ে বললাম,"মাম্তা‌ড়াতাড়ি গাড়িতে উঠ ।" আমার ডাকে মামা যেন সম্মতি ফিরে পেল । এক দৌড়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো । পিছনে আমি । মামা গাড়ি স্টার্ট দিল । আমি পিছনে তাকিঁয়ে দেখলাম বাঘটা তখনও ময়দা পরিষ্কারে ব্যস্ত ।

পড়ন্ত বিকাল । আমরা জঙ্গল ছেড়ে অনেক দূরে চলে এসেছি । বাঘের ভয় এখানে আর নেই । কথা ফুটুছে মামার মুখে । আমার দিকে তাকিঁয়ে বলল,"বুঝলি ভাগ্নে সাহস ছাড়া কিন্তু জঙ্গলে শিকার করতে যাওয়া যায় না । আমার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখার আছে তোর ।"

আমি চুপ করেই থাকলাম । জঙ্গলের স্মৃতিগুলো ভেসে উঠলো চোখে ।

সমাপ্ত.........

Rasel islam, Mr faruk, Sumaiya akter, Rokeya hoq, Asha islam, Soneya akter, Somrat and লেখাটি পছন্দ করেছে

Back to top
Permissions in this forum:
You cannot reply to topics in this forum