- Asifধুমকেতু
- Posts : 16
স্বর্ণমুদ্রা : 698
মর্যাদা : 20
Join date : 2021-05-19
ক্রোনল্যাব
Sun Jun 06, 2021 12:11 am
ঠিক ৯’টা বেজে ২১ মিনিটে আমি ক্রোনল্যাবের ১২ল গেটের সামনে পৌঁছে গেলাম। আমাকে বলা হয়েছে ন’টা পয়ত্রিশে গেটের নিরাপত্তা রোবটের কাছে রিপোর্ট করতে। তার মানে আমার হাতে আছে আরো চৌদ্দ মিনিট। এতটা সময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা বিরক্তিকর হবে, তার উপর হকার রোবটগুলোর উৎপাত তো আছেই। আমি কাছাকাছি একটা নিরিবিলি যোগাযোগ বুথ খুঁজে নিয়ে তাতে ঢুকে পড়লাম।
এই বুথগুলো সময় কাটানোর জন্য বেশ ভাল। বিনা খরচে উষ্ণ পানীয় আর ম্যাসাজ উপভোগ করা যায়। আমি খেয়াল করলাম বুথের কম্পিউটার আমার ডাটাবেসের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে। এই অত্যুৎসাহী নতুন সিস্টেমগুলো আমার খুবই অপছন্দের। একবার ডাটাবেসের সাথে যুক্ত হলেই আজেবাজে হাজারটা অফার দিয়ে মাথা ধরিয়ে দেয়। সবচেয়ে বাজে ব্যাপার হচ্ছে প্রায় সময়েই দেখা যায়, সেশন শেষে আমি দু’একটা অফারে হ্যাঁ-ও বলে দিয়েছি। ফলাফল মাসের শেষে ছয় অঙ্কের বিল।
কিন্তু আজকে আমার কারো সাথে কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছে। কারণ আজ একটা বিশেষ দিন। আমার ক্রোনল্যাবে যোগ দেবার দিন। বাবাকে খবরটা জানাতে পারলে ভাল লাগত। কিন্তু বাবা নেটওয়ার্কের বাইরে, সিরাস গ্রহপুঞ্জে অবসরজীবন কাটাচ্ছেন। আমার এই ক্রোনল্যাব প্রীতির (পড়ুন ভক্তি) কারণ কিন্তু আমার বাবা।
বাবা ক্রোনল্যাবে কাজ করতেন। এবং কাজটা যেনতেন কিছু ছিল না। বাবা ছিলেন ক্রোনল্যাবের নিরাপত্তা প্রধান। অন্য ছেলেমেয়েরা যে বয়সে বাবা-মা’র কাছে বুরাতিনো আর প্লিখাশা রোবটের গল্প শোনে, আমি শুনতাম ক্রোনল্যাবের গল্প। বাবা আমাকে বলতেন কিভাবে বিজ্ঞানীরা অবপৃথিবীর দরজা খুললেন, কিভাবে খারাপ লোকদের সেখানে নামিয়ে দেওয়া হলো, আর সেখানে তাদের কী ভয়ঙ্কর এক নতুন জীবন শুরু করতে হয়। ক্রোনল্যাবের বাইরের পৃথিবীতে এই গল্পগুলো নিষিদ্ধ, সন্দেহ নেই। বাবা হয়তো তার শিশুসন্তানকে এগুলো বলে মনের ভার লাঘব করতেন।
স্কুলে আমাদের অবপৃথিবী সম্পর্কে ইচ্ছাকৃতভাবে একটা ভয়ঙ্কর ধারণা দেওয়া হয়। হিংস্র জন্তু, অণুজীব, খারাপ আবহাওয়া – এগুলো আমাদের যত না ভীত করে তার চেয়ে বেশি আতঙ্ক ছড়ায় মানবিক নেটওয়ার্ক না থাকার ব্যাপারটা। সেখানে নাকি যোগাযোগ করতে হয় শব্দ তৈরি করে! অকল্পনীয়!
কিন্তু বাবার কল্যাণে আমি জানতাম যে এই সব কিছু বাদ দিলে অবপৃথিবী একটা সাদামাটা গ্রহ ছাড়া আর কিছু না। পার্থক্যটা শুধু সময়ে। অবপৃথিবী অতীতের এক গ্রহ। ঠিক করে বলতে গেলে একটা অনুজ্জ্বল নক্ষত্রের তৃতীয় গ্রহ, যেটা চলে গেছে ওই নক্ষত্রের পেটেই। সেও মিলিয়ন বছর আগের কথা। বিজ্ঞানীরা সেই হারানো গ্রহটাকে খুঁজে বের করেছেন অতীত মহাবিশ্বে। আর এটাকে পরিণত করেছেন নিশ্ছিদ্র এক কারাগারে। দুনিয়ার যত ভয়ংকর অপরাধীদের ধরে এনে নামিয়ে দেওয়া হয় অবপৃথিবীতে। জেনেটিক এঞ্জিনিয়ারিং করে কেড়ে নেওয়া হয় তাদের নেটওয়ার্ক, কমিয়ে দেওয়া হয় শারীরিক আর মানসিক সক্ষমতা। এই হতভাগ্য কয়েদিদের বেঁচে থাকার জন্য নির্ভর করতে হয় কয়েক ধরণের গ্যাসের উপর, যা কয়েক লক্ষ আলোকবর্ষের মধ্যে শুধু অবপৃথিবীর বায়ুমন্ডলেই ঠিক অনুপাতে আছে।
পালাবার প্রশ্নই ওঠে না।
এই পুরো ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রিত হয় ক্রোনল্যাবের সেক্টর-৮ থেকে, যেখানে আমি, সুহান মিহাজ, আজ যোগ দিতে যাচ্ছি। আমার মানবিক নেটওয়ার্ক জানাচ্ছিল, আমার হাতে সময় আছে আর তিন মিনিট। আমি যোগাযোগ বুথ থেকে বেরিয়ে ১২ল গেটের দিকে এগুলাম।
আমি বুঝতে পারছিলাম না, আমার জেটটা নিয়েই ঢুকে পড়ব কিনা, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখি ক্রোনল্যাবের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আমার জেটের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিল। মাথার বামদিকে একটা ভোঁতা ব্যাথার অনুভূতিতে বুঝলাম যে আমার নেটওয়ার্ক ক্রোনল্যাবের কোন একটা ডাটাবেসের সাথে যুক্ত হল। আমি দেখতে চাচ্ছিলাম ওতে কি আছে, কিন্তু দেখলাম ওগুলো গোপন করে রাখা আছে। আমি শুধু একটা ইন্টারফেসের সাথেই যুক্ত যেখানে আমার পরিচয়বাহী সংখ্যাগুলো জানতে চাওয়া হচ্ছে। বুঝলাম এটাই সেই নিরাপত্তা রোবট যার কাছে আমাকে আসতে বলা হয়েছে।
আমি একটা দীর্ঘ সনাক্তকরণ পর্বের জন্য প্রস্তুত ছিলাম, কিন্তু পুরো ব্যাপারটা শেষ হতে লাগলো কয়েক মাইক্রোসেকেন্ড। ওদের কাছে সব রকম তথ্যই আছে বলে মনে হল। কয়েক লেভেলের কোয়ারেন্টাইন পার করে আমি বেরিয়ে এসে দেখি, আমার জন্য দাঁড়িয়ে আছে ক্রোনল্যাবের ছাপ মারা নতুন একটা স্ব্য়ংক্রিয় জেট। ডাটাবেসের তথ্যগুলোতে চোখ বুলাতেই একটা আনন্দের শিহরণ বয়ে গেল আমার শরীরে।
এখন থেকে আমি ক্রোনল্যাবের অংশ!
আমার ডাটাবেসে অনেক নির্দেশনা ভরে দয়া হয়েছে টের পেলাম। অধিকাংশই নিরাপত্তা-সংক্রান্ত, কিছু পথ-নির্দেশ, কর্মপরিকল্পনা।আমার কাজটা চতুর্থ স্তরে, একটা এটমাইজার যন্ত্রের রক্ষণাবেক্ষণ সঙ্ক্রান্ত। আমি চতুর্থ স্তরে যাওয়ার জন্য জেটটাকে তৈরি করছিলাম, তখনি আরেকটা জেট এসে ডকিং বে তে থামলো। আমি দেখলাম চালক কাঁচাপাকা চুলের একজন মধ্যবয়স্ক অফিসার। আমার কাছে এসে সে সরাসরি আমার নাম ধরে সম্বোধন করলো, “এয় সুহান। আশা করি নিরাপত্তাজনিত সব যন্ত্রণা মিটে গেছে?”
আমি মাথা নাড়লাম। আমার নাম ধরে সম্বোধন করায় আমি কিছুটা অবাক হয়েছি। কাজের জায়গায় এসব অর্থহীন জন্মনাম ব্যবহার হয় না বলেই জানতাম।
“আমি যার্কি, তোমার সুপারভাইজার। ক্রোনল্যাব দোযখে স্বাগতম হাহাহা…“
আমি লোকটার দাঁতে একটা হালকা গোলাপি আভা দেখে নিঃসন্দেহ হলাম যে লোকটা বিতানিন টেনে এসেছে। মানুষের বাহ্যিক আচরণ বা চেহারার উপর বিতানিনের প্রভাব খুবই সূক্ষ্ম। কিন্তু একজন বিতানিনাসক্তের সাথে দশ বছর বসবাস করার পর আমি এখন খুব সহজেই দশজন মানুষের মধ্য থেকে একজন বিতানিনখোরকে আলাদা করতে পারি। আমি জানতাম ক্রোনল্যাবের কর্মচারীদের মাঝে এই হালকা মাদকের চল আছে।
বিতানিন মানসিক চাপমুক্তির মহৌষধ।
যার্কি নিজের জেটের সাথে আমার জেটটাকে সিংক্রোনাইজ করে নিল, “এখন আমরা যাবো সেক্টর ট্যুরে। সতেরটা আলাদা আলাদা স্তর আছে এখানে। আমাদের প্রবেশাধিকার আছে আটটাতে। সবশেষে আমরা চলে যাব চতুর্থ স্তরে। তোমার কাজ ওখানেই।“
আমাদের জেট একটা দ্রুতগতিসম্পন্ন টানেলে ঢুকে পড়ল। নির্দেশক চিহ্নগুলো দেখে বুঝলাম আমরা যাচ্ছি একাদশ স্তরের দিকে। জায়গাটা খুব সম্ভবত মাটির নিচে। আমি ডাটাবেস থেকে যার্কির প্রোফাইলটাতে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলাম। এরকম উচ্চপদস্থ একজন কর্মচারি আমাকে ট্যুরে নিয়ে যাচ্ছেন দেখে অবাক হলাম।
“আমি তোমার বাবাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম। সে ছিল আমার বিতানিন-সঙ্গী”, যার্কি চোখ মটকালো।
এবার পুরো ব্যাপারটা খোলাসা হল। যদিও বাবাকে কখনো এই দোস্তটির কথা বলতে শুনিনি। সম্ভবত তিনি বিতানিনের প্রসংগটা তুলতে চাননি। আর তার ক্রোনল্যাবের শেষ দিনগুলো খুব একটা সুখপ্রদও ছিল না। যার্কি হয়তো সে ব্যাপারে অনেক কিছুই জানে।
“আমি মনে করি তোমার বাবার সাথে অন্যায় করা হয়েছিল।“
আমি চমকে উঠলাম। যার্কি কি আমার মনের কথা বুঝতে পারে নাকি? আমি আস্তে আস্তে বললাম, “বাবা এব্যাপারে কথা বলতে চান না।“
“ওর লজ্জিত হবার কোন কারণ নেই। ওর কোন দোষ ছিল না।“ যার্কির গলা অসহিষ্ণু শোনায়, “একরাষ্ট্রবিরোধীরা অনেক চিন্তাভাবনা করেই কাজটা করেছিল। আমি জানি, ওরা কাদের, কিভাবে কিনে নিয়েছিল। গ্লাতুনের বাচ্চারা সেটাকে ধামাচাপা দিয়েছে তোমার বাবাকে ফাঁসিয়ে। আর এমন তো না যে ক্রোনল্যাবে আর কোন নিরাপত্তা লঙ্ঘন ঘটেনি…“
“আরো নিরাপত্তা লঙ্ঘন?” পৃথিবীর সবচাইতে সুরক্ষিত ল্যাবে? এটা আমার কাছে নতুন খবর।
“হাহাহা সেটাই তো মজা। তোমাদের সংবাদ বুলেটিনে কয়টা সত্যিকারের খবর থাকে? বড় খবর তো সব ধামাচাপা। আর আমি কোনটাকে বড় খবর বলছি? একরাষ্ট্রবিরোধীদের পর আরো শ’খানেক লোক লুকিয়ে-চুরিয়ে অবপৃথিবীতে প্রযুক্তি পাচার করতে গেছে। তাদের আবার ধরেবেঁধে ফেরতও আনা হয়েছে। এটা এখন নিরাপত্তা বাহিনীর রুটিন কাজ।”
“কিন্তু, কিন্তু…”, আমার মাথার ভিতর সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল।
“বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে শোন, গত সপ্তাহেও এরকম একজনকে ধরে আনা হয়েছে।“, যার্কি চোখ মটকালো।
আমি তো অবাক, আমতা আমতা করে বললাম “কিন্তু আমি তো জানতাম অবপৃথিবীতে সুস্পষ্ট জেনেটিক ধারা বজায় রাখা হয়।“
“সেটা কিভাবে করা হয় কোন ধারণা আছে?”
“হ্যাঁ, প্রথমে অবপৃথিবীর দু’জন বিপরীত লিঙ্গের মানুষ বেছে নেওয়া হয়। আর তাদের জিনের সংমিশ্রনে একটা নতুন জেনেটিক পরিচয় তৈরি করা হয়। তারপর নতুন কয়েদিদের সেই অনন্য জেনেটিক প্রোফাইলগুলোর কোন একটি দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। মানে ব্যাপারটা অনেকটা আবার জন্ম নেওয়ার মত।“
“আমরা মানুষেরা যেভাবে জন্ম নিই, ঠিক সেভাবে না, তবে হ্যাঁ ব্যাপারটা কাছাকাছি।“
“কিন্তু এটা লঙ্ঘন করতে তো মূল কম্পিউটারের কোন একটা সুরক্ষিত অংশে প্রবেশাধিকার থাকা প্রয়োজন।“
“ঠিক তাই”, যার্কিকে উৎফুল্ল দেখায়, “সেজন্য ক্রোনল্যাবের নিরাপত্তা লঙ্ঘিত হয় ক্রোনল্যাবের কর্মচারিদের হাতেই! গত সপ্তাহে এক পাগলাটে জেনেটিক এঞ্জিনিয়ারকে ধরে আনা হয়েছে অবপৃথিবী থেকে। সে করেছে আরো ভয়ংকর এক কাজ। পুরো জেনেটিক ধারা ধ্বসে যাওয়ার উপক্রম।“
যার্কি একাদশ স্তরের ডকিং বে-তে জেট থামায়। বে’র হালকা হলুদ আলোতে তাকে অদ্ভূত দেখাচ্ছিল। আর ও যা বলছিল তা-ও রূপকথার মত শোনাচ্ছিল। ক্রোনল্যাবে নিরাপত্তা লঙ্ঘন! যার্কি রসিকতা করছে নাতো!
“লোকটা ছিল হিসাস-৪২১ গ্রুপের ছাত্র। খুবই উঁচুমানের মানসিক ক্ষমতা। নিজের জেনেটিক পরিচয় লুকানোর জন্যে শুধুমাত্র একজন অবমানবীর জিন ব্যবহার করে সে অবপৃথিবীতে নেমে গেছে। কল্পনা করতে পারো, কী ভীষণ বিশৃংখলা! কোন জিন মিশ্রণ না করে, মূল কম্পিউটারে নতুন কোন ভুক্তি তৈরি না করেই সে নেমে গেল অবপৃথিবীতে! আমরা তো ভয়ে ছিলাম, অবমানবেরা কেমন প্রতিক্রিয়া দেখায় তা নিয়ে। ওরা যদি বুঝে ফেলে যে ওরা একটা কৃত্রিম জগতে বাস করছে, তাহলে অবপৃথিবীর পুরো ধারণাটাই মার খেয়ে যাবে।“
“হ্যাঁ এটা আসলেই বিপজ্জনক ছিল। তা কি করল অবমানবেরা?“, আমি মাথা নাড়লাম।
“ওদের আচরণ ছিল হাস্যকর। জেনেটিক সক্ষমতা হ্রাস ওদের কোন পর্যায়ে নামিয়ে দিয়েছে ভাবা যায় না। ওদের এক দল লোকটাকে আমাদের হাতে তুলে দিয়েছে। আবার ওদেরই আরেক দল লোকটাকে মহাপুরুষ বানিয়ে ছেড়েছে। ওরা বলে, সে নাকি ঈশ্বরের পুত্র! হাহাহা…”
ঈশ্বরের পুত্র? আমিও হাসি থামিয়ে রাখতে পারলাম না।
(সমাপ্ত)
এই বুথগুলো সময় কাটানোর জন্য বেশ ভাল। বিনা খরচে উষ্ণ পানীয় আর ম্যাসাজ উপভোগ করা যায়। আমি খেয়াল করলাম বুথের কম্পিউটার আমার ডাটাবেসের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে। এই অত্যুৎসাহী নতুন সিস্টেমগুলো আমার খুবই অপছন্দের। একবার ডাটাবেসের সাথে যুক্ত হলেই আজেবাজে হাজারটা অফার দিয়ে মাথা ধরিয়ে দেয়। সবচেয়ে বাজে ব্যাপার হচ্ছে প্রায় সময়েই দেখা যায়, সেশন শেষে আমি দু’একটা অফারে হ্যাঁ-ও বলে দিয়েছি। ফলাফল মাসের শেষে ছয় অঙ্কের বিল।
কিন্তু আজকে আমার কারো সাথে কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছে। কারণ আজ একটা বিশেষ দিন। আমার ক্রোনল্যাবে যোগ দেবার দিন। বাবাকে খবরটা জানাতে পারলে ভাল লাগত। কিন্তু বাবা নেটওয়ার্কের বাইরে, সিরাস গ্রহপুঞ্জে অবসরজীবন কাটাচ্ছেন। আমার এই ক্রোনল্যাব প্রীতির (পড়ুন ভক্তি) কারণ কিন্তু আমার বাবা।
বাবা ক্রোনল্যাবে কাজ করতেন। এবং কাজটা যেনতেন কিছু ছিল না। বাবা ছিলেন ক্রোনল্যাবের নিরাপত্তা প্রধান। অন্য ছেলেমেয়েরা যে বয়সে বাবা-মা’র কাছে বুরাতিনো আর প্লিখাশা রোবটের গল্প শোনে, আমি শুনতাম ক্রোনল্যাবের গল্প। বাবা আমাকে বলতেন কিভাবে বিজ্ঞানীরা অবপৃথিবীর দরজা খুললেন, কিভাবে খারাপ লোকদের সেখানে নামিয়ে দেওয়া হলো, আর সেখানে তাদের কী ভয়ঙ্কর এক নতুন জীবন শুরু করতে হয়। ক্রোনল্যাবের বাইরের পৃথিবীতে এই গল্পগুলো নিষিদ্ধ, সন্দেহ নেই। বাবা হয়তো তার শিশুসন্তানকে এগুলো বলে মনের ভার লাঘব করতেন।
স্কুলে আমাদের অবপৃথিবী সম্পর্কে ইচ্ছাকৃতভাবে একটা ভয়ঙ্কর ধারণা দেওয়া হয়। হিংস্র জন্তু, অণুজীব, খারাপ আবহাওয়া – এগুলো আমাদের যত না ভীত করে তার চেয়ে বেশি আতঙ্ক ছড়ায় মানবিক নেটওয়ার্ক না থাকার ব্যাপারটা। সেখানে নাকি যোগাযোগ করতে হয় শব্দ তৈরি করে! অকল্পনীয়!
কিন্তু বাবার কল্যাণে আমি জানতাম যে এই সব কিছু বাদ দিলে অবপৃথিবী একটা সাদামাটা গ্রহ ছাড়া আর কিছু না। পার্থক্যটা শুধু সময়ে। অবপৃথিবী অতীতের এক গ্রহ। ঠিক করে বলতে গেলে একটা অনুজ্জ্বল নক্ষত্রের তৃতীয় গ্রহ, যেটা চলে গেছে ওই নক্ষত্রের পেটেই। সেও মিলিয়ন বছর আগের কথা। বিজ্ঞানীরা সেই হারানো গ্রহটাকে খুঁজে বের করেছেন অতীত মহাবিশ্বে। আর এটাকে পরিণত করেছেন নিশ্ছিদ্র এক কারাগারে। দুনিয়ার যত ভয়ংকর অপরাধীদের ধরে এনে নামিয়ে দেওয়া হয় অবপৃথিবীতে। জেনেটিক এঞ্জিনিয়ারিং করে কেড়ে নেওয়া হয় তাদের নেটওয়ার্ক, কমিয়ে দেওয়া হয় শারীরিক আর মানসিক সক্ষমতা। এই হতভাগ্য কয়েদিদের বেঁচে থাকার জন্য নির্ভর করতে হয় কয়েক ধরণের গ্যাসের উপর, যা কয়েক লক্ষ আলোকবর্ষের মধ্যে শুধু অবপৃথিবীর বায়ুমন্ডলেই ঠিক অনুপাতে আছে।
পালাবার প্রশ্নই ওঠে না।
এই পুরো ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রিত হয় ক্রোনল্যাবের সেক্টর-৮ থেকে, যেখানে আমি, সুহান মিহাজ, আজ যোগ দিতে যাচ্ছি। আমার মানবিক নেটওয়ার্ক জানাচ্ছিল, আমার হাতে সময় আছে আর তিন মিনিট। আমি যোগাযোগ বুথ থেকে বেরিয়ে ১২ল গেটের দিকে এগুলাম।
আমি বুঝতে পারছিলাম না, আমার জেটটা নিয়েই ঢুকে পড়ব কিনা, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখি ক্রোনল্যাবের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আমার জেটের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিল। মাথার বামদিকে একটা ভোঁতা ব্যাথার অনুভূতিতে বুঝলাম যে আমার নেটওয়ার্ক ক্রোনল্যাবের কোন একটা ডাটাবেসের সাথে যুক্ত হল। আমি দেখতে চাচ্ছিলাম ওতে কি আছে, কিন্তু দেখলাম ওগুলো গোপন করে রাখা আছে। আমি শুধু একটা ইন্টারফেসের সাথেই যুক্ত যেখানে আমার পরিচয়বাহী সংখ্যাগুলো জানতে চাওয়া হচ্ছে। বুঝলাম এটাই সেই নিরাপত্তা রোবট যার কাছে আমাকে আসতে বলা হয়েছে।
আমি একটা দীর্ঘ সনাক্তকরণ পর্বের জন্য প্রস্তুত ছিলাম, কিন্তু পুরো ব্যাপারটা শেষ হতে লাগলো কয়েক মাইক্রোসেকেন্ড। ওদের কাছে সব রকম তথ্যই আছে বলে মনে হল। কয়েক লেভেলের কোয়ারেন্টাইন পার করে আমি বেরিয়ে এসে দেখি, আমার জন্য দাঁড়িয়ে আছে ক্রোনল্যাবের ছাপ মারা নতুন একটা স্ব্য়ংক্রিয় জেট। ডাটাবেসের তথ্যগুলোতে চোখ বুলাতেই একটা আনন্দের শিহরণ বয়ে গেল আমার শরীরে।
এখন থেকে আমি ক্রোনল্যাবের অংশ!
আমার ডাটাবেসে অনেক নির্দেশনা ভরে দয়া হয়েছে টের পেলাম। অধিকাংশই নিরাপত্তা-সংক্রান্ত, কিছু পথ-নির্দেশ, কর্মপরিকল্পনা।আমার কাজটা চতুর্থ স্তরে, একটা এটমাইজার যন্ত্রের রক্ষণাবেক্ষণ সঙ্ক্রান্ত। আমি চতুর্থ স্তরে যাওয়ার জন্য জেটটাকে তৈরি করছিলাম, তখনি আরেকটা জেট এসে ডকিং বে তে থামলো। আমি দেখলাম চালক কাঁচাপাকা চুলের একজন মধ্যবয়স্ক অফিসার। আমার কাছে এসে সে সরাসরি আমার নাম ধরে সম্বোধন করলো, “এয় সুহান। আশা করি নিরাপত্তাজনিত সব যন্ত্রণা মিটে গেছে?”
আমি মাথা নাড়লাম। আমার নাম ধরে সম্বোধন করায় আমি কিছুটা অবাক হয়েছি। কাজের জায়গায় এসব অর্থহীন জন্মনাম ব্যবহার হয় না বলেই জানতাম।
“আমি যার্কি, তোমার সুপারভাইজার। ক্রোনল্যাব দোযখে স্বাগতম হাহাহা…“
আমি লোকটার দাঁতে একটা হালকা গোলাপি আভা দেখে নিঃসন্দেহ হলাম যে লোকটা বিতানিন টেনে এসেছে। মানুষের বাহ্যিক আচরণ বা চেহারার উপর বিতানিনের প্রভাব খুবই সূক্ষ্ম। কিন্তু একজন বিতানিনাসক্তের সাথে দশ বছর বসবাস করার পর আমি এখন খুব সহজেই দশজন মানুষের মধ্য থেকে একজন বিতানিনখোরকে আলাদা করতে পারি। আমি জানতাম ক্রোনল্যাবের কর্মচারীদের মাঝে এই হালকা মাদকের চল আছে।
বিতানিন মানসিক চাপমুক্তির মহৌষধ।
যার্কি নিজের জেটের সাথে আমার জেটটাকে সিংক্রোনাইজ করে নিল, “এখন আমরা যাবো সেক্টর ট্যুরে। সতেরটা আলাদা আলাদা স্তর আছে এখানে। আমাদের প্রবেশাধিকার আছে আটটাতে। সবশেষে আমরা চলে যাব চতুর্থ স্তরে। তোমার কাজ ওখানেই।“
আমাদের জেট একটা দ্রুতগতিসম্পন্ন টানেলে ঢুকে পড়ল। নির্দেশক চিহ্নগুলো দেখে বুঝলাম আমরা যাচ্ছি একাদশ স্তরের দিকে। জায়গাটা খুব সম্ভবত মাটির নিচে। আমি ডাটাবেস থেকে যার্কির প্রোফাইলটাতে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলাম। এরকম উচ্চপদস্থ একজন কর্মচারি আমাকে ট্যুরে নিয়ে যাচ্ছেন দেখে অবাক হলাম।
“আমি তোমার বাবাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম। সে ছিল আমার বিতানিন-সঙ্গী”, যার্কি চোখ মটকালো।
এবার পুরো ব্যাপারটা খোলাসা হল। যদিও বাবাকে কখনো এই দোস্তটির কথা বলতে শুনিনি। সম্ভবত তিনি বিতানিনের প্রসংগটা তুলতে চাননি। আর তার ক্রোনল্যাবের শেষ দিনগুলো খুব একটা সুখপ্রদও ছিল না। যার্কি হয়তো সে ব্যাপারে অনেক কিছুই জানে।
“আমি মনে করি তোমার বাবার সাথে অন্যায় করা হয়েছিল।“
আমি চমকে উঠলাম। যার্কি কি আমার মনের কথা বুঝতে পারে নাকি? আমি আস্তে আস্তে বললাম, “বাবা এব্যাপারে কথা বলতে চান না।“
“ওর লজ্জিত হবার কোন কারণ নেই। ওর কোন দোষ ছিল না।“ যার্কির গলা অসহিষ্ণু শোনায়, “একরাষ্ট্রবিরোধীরা অনেক চিন্তাভাবনা করেই কাজটা করেছিল। আমি জানি, ওরা কাদের, কিভাবে কিনে নিয়েছিল। গ্লাতুনের বাচ্চারা সেটাকে ধামাচাপা দিয়েছে তোমার বাবাকে ফাঁসিয়ে। আর এমন তো না যে ক্রোনল্যাবে আর কোন নিরাপত্তা লঙ্ঘন ঘটেনি…“
“আরো নিরাপত্তা লঙ্ঘন?” পৃথিবীর সবচাইতে সুরক্ষিত ল্যাবে? এটা আমার কাছে নতুন খবর।
“হাহাহা সেটাই তো মজা। তোমাদের সংবাদ বুলেটিনে কয়টা সত্যিকারের খবর থাকে? বড় খবর তো সব ধামাচাপা। আর আমি কোনটাকে বড় খবর বলছি? একরাষ্ট্রবিরোধীদের পর আরো শ’খানেক লোক লুকিয়ে-চুরিয়ে অবপৃথিবীতে প্রযুক্তি পাচার করতে গেছে। তাদের আবার ধরেবেঁধে ফেরতও আনা হয়েছে। এটা এখন নিরাপত্তা বাহিনীর রুটিন কাজ।”
“কিন্তু, কিন্তু…”, আমার মাথার ভিতর সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল।
“বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে শোন, গত সপ্তাহেও এরকম একজনকে ধরে আনা হয়েছে।“, যার্কি চোখ মটকালো।
আমি তো অবাক, আমতা আমতা করে বললাম “কিন্তু আমি তো জানতাম অবপৃথিবীতে সুস্পষ্ট জেনেটিক ধারা বজায় রাখা হয়।“
“সেটা কিভাবে করা হয় কোন ধারণা আছে?”
“হ্যাঁ, প্রথমে অবপৃথিবীর দু’জন বিপরীত লিঙ্গের মানুষ বেছে নেওয়া হয়। আর তাদের জিনের সংমিশ্রনে একটা নতুন জেনেটিক পরিচয় তৈরি করা হয়। তারপর নতুন কয়েদিদের সেই অনন্য জেনেটিক প্রোফাইলগুলোর কোন একটি দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। মানে ব্যাপারটা অনেকটা আবার জন্ম নেওয়ার মত।“
“আমরা মানুষেরা যেভাবে জন্ম নিই, ঠিক সেভাবে না, তবে হ্যাঁ ব্যাপারটা কাছাকাছি।“
“কিন্তু এটা লঙ্ঘন করতে তো মূল কম্পিউটারের কোন একটা সুরক্ষিত অংশে প্রবেশাধিকার থাকা প্রয়োজন।“
“ঠিক তাই”, যার্কিকে উৎফুল্ল দেখায়, “সেজন্য ক্রোনল্যাবের নিরাপত্তা লঙ্ঘিত হয় ক্রোনল্যাবের কর্মচারিদের হাতেই! গত সপ্তাহে এক পাগলাটে জেনেটিক এঞ্জিনিয়ারকে ধরে আনা হয়েছে অবপৃথিবী থেকে। সে করেছে আরো ভয়ংকর এক কাজ। পুরো জেনেটিক ধারা ধ্বসে যাওয়ার উপক্রম।“
যার্কি একাদশ স্তরের ডকিং বে-তে জেট থামায়। বে’র হালকা হলুদ আলোতে তাকে অদ্ভূত দেখাচ্ছিল। আর ও যা বলছিল তা-ও রূপকথার মত শোনাচ্ছিল। ক্রোনল্যাবে নিরাপত্তা লঙ্ঘন! যার্কি রসিকতা করছে নাতো!
“লোকটা ছিল হিসাস-৪২১ গ্রুপের ছাত্র। খুবই উঁচুমানের মানসিক ক্ষমতা। নিজের জেনেটিক পরিচয় লুকানোর জন্যে শুধুমাত্র একজন অবমানবীর জিন ব্যবহার করে সে অবপৃথিবীতে নেমে গেছে। কল্পনা করতে পারো, কী ভীষণ বিশৃংখলা! কোন জিন মিশ্রণ না করে, মূল কম্পিউটারে নতুন কোন ভুক্তি তৈরি না করেই সে নেমে গেল অবপৃথিবীতে! আমরা তো ভয়ে ছিলাম, অবমানবেরা কেমন প্রতিক্রিয়া দেখায় তা নিয়ে। ওরা যদি বুঝে ফেলে যে ওরা একটা কৃত্রিম জগতে বাস করছে, তাহলে অবপৃথিবীর পুরো ধারণাটাই মার খেয়ে যাবে।“
“হ্যাঁ এটা আসলেই বিপজ্জনক ছিল। তা কি করল অবমানবেরা?“, আমি মাথা নাড়লাম।
“ওদের আচরণ ছিল হাস্যকর। জেনেটিক সক্ষমতা হ্রাস ওদের কোন পর্যায়ে নামিয়ে দিয়েছে ভাবা যায় না। ওদের এক দল লোকটাকে আমাদের হাতে তুলে দিয়েছে। আবার ওদেরই আরেক দল লোকটাকে মহাপুরুষ বানিয়ে ছেড়েছে। ওরা বলে, সে নাকি ঈশ্বরের পুত্র! হাহাহা…”
ঈশ্বরের পুত্র? আমিও হাসি থামিয়ে রাখতে পারলাম না।
(সমাপ্ত)
Rasel islam, Tanusri roi, Badol hasan, Sumon khan, Rohan Ahmed, Somrat, Liton vhos and লেখাটি পছন্দ করেছে
Permissions in this forum:
You cannot reply to topics in this forum