সাদা কাগজ
Would you like to react to this message? Create an account in a few clicks or log in to continue.

Go down
avatar
Onu kotha
শুকতারা
শুকতারা
Posts : 56
স্বর্ণমুদ্রা : 1323
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-05-26

বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ Empty বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ

Fri Jun 04, 2021 1:36 am
১|

'দেখুন, আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না। আই এম প্রেগন্যান্ট।'

নিঃসংকোচে কথাগুলো বলার পর টিকলির বোধ হলো সে খুব বেহায়াপনা করে বলে ফেলেছে। তার উচিত ছিলো একটু থেমে থেমে, ইতস্ততবোধ করে, লজ্জায় কুকড়ে গিয়ে কথাটা বলা। 'অভিনয়ে সে যে বড্ড কাঁচা' এটা বুঝে এলেই তার ভেতরটা খানিক ক্ষুব্ধ অস্বস্তিতে জর্জরিত হয়ে উঠলো সাথে আরো একটু গুটিসুটি মেরে বসলো।

সম্মুখে বসে থাকা মাস্ক পরিহিতা এই মেয়ে আরেকটু হলেই তার হবু বউয়ের ট্যাগ লাভ করতো। আর সেই মেয়ে কিনা বলছে, সে প্রেগন্যান্ট। আদর রাজ্যের বিস্ময়তা নিয়ে তাকালো সাথে রাগ হলো নিজের আপন সম্মানিত ব্ল্যাকমেইলার পিতা-মাতার উপর। আদরকে তারা এক প্রকার ঠেলে ঠুলে অহেতুক জোরাজুরি করে পাঠিয়ে দিয়েছে মেয়ে দেখতে। আর এসে শুনে এই মেয়ে প্রেগন্যান্ট! গম্ভীর কন্ঠে আদর বলল,

'আপনি যে প্রেগন্যান্ট আপনার ফ্যামিলিকে জানিয়েছেন? না জানিয়েই এসে পরেছেন একটা ছেলেকে হেনস্তা করতে? আপনার কোনো আইডিয়া আছে আপনি আমার কতটুকু টাইম ওয়েস্ট করেছেন? চেম্বার রেখে আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি।'

টিকলির নিরব মন হঠাৎ একটু জ্বলে উঠলো। এতো ভাব! কড়া গলায় কিছু শুনিয়ে দিতে চেয়েও সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, 'দেখুন, আমার বাড়ির লোক কেউ কিছু জানে না। আমার বয়ফ্রেন্ড ছিলো। সে কথা দিয়েছিলো আমাকে বিয়ে করবে। কিন্তু এক মাস থেকে সে উদাও।'

আদর রেসটুরেন্টের দামী কাঠের চেয়ারটাতে হেলান দিয়ে বসলো। ধোঁয়া উঠা কফিটাতে চুমুক দিয়ে গরগরে কন্ঠে বলে উঠলো, 'কয় মাস প্রেগন্যান্সির?'

টিকলি চঞ্চল চোখে এদিক ওদিক তাকাতে থাকলো। যেনো সে কথাটা শুনেও শুনেনি এমন ভান। আদর আবার জিজ্ঞেস করলো। টিকলি দাঁত দিয়ে নখ খুটছে। শরীর মৃদু কাঁপছে। অপরিচিত একটা ছেলের সামনে এমন বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিতে পরে তার উপস্থিত বুদ্ধি যেনো লোপ পেয়েছে। সে নখ কামড়াচ্ছে অবলীলায়। এই কথা তো তাকে শিখিয়ে দেওয়া হয়নি। এখন কি বলবে সে? আদর ভ্রু কুচকে বলল,

'আশ্চর্য তো!'

মাস্ক পরা ওই শ্যামলা মুখশ্রীর ছোট ছোট চোখের কুচকুচে কালো চিকন ভ্রু জোড়া কুচকাতে দেখে টিকলির ভীতু মন ভয়ে থেমে গিয়ে আবারো তুমুল গতিতে লাফাতে লাগলো। সে আমতা আমতা গলায় বলল, '১৫ দিন।'

আদর চোখ কপালে তুলে তাকালো। টিকলি নিজেও হা হয়ে গেলো নিজের এহেন বোকামিঠাসা বুদ্ধিরসের ছটায়। আদর আপনমনে বলল, 'আনবিলিভেবল।'

টিকলি ঠিক ঠাক হয়ে বসলো। বার কয়েক জোরে শ্বাস টেনে নিজেকে এবনরমাল থেকে নরমাল মানুষে পরিণত করার প্রচেষ্টা চালানো হলো। কিন্তু বিশেষ কোনো লাভ হচ্ছে বলে মনে হলো না। মাস্কের আড়ালে টিকলির ভাবভঙ্গি ধরতে না পেরে আদরের মন বিরক্তিতে কাটা হয়ে রইল। টিকলি ঠকঠক করে কাঁপা দুটো হাতে এগিয়ে দিলো একটা ফাইল। একের পর এক ঢোক গিলে তুতলিয়ে বলল, 'এতে রিপোর্ট আছে চাইলে দেখে নিতে পারেন।'

আদর ফাইলটা নিতে গিয়েও নিলো না। নিজের মাস্কটাকে ঠিক করে চঞ্চুশ গলায় বলল, 'লাগবে না।'

আরেকটু হলেই উড়ে চলে যাচ্ছিলো টিকলির প্রাণপাখি। হৃদপিন্ডের প্রদীপ টা ধপ করে নিভে গিয়েও আবার ঝপাৎ করে জ্বলে উঠলো। আদর কিছু একটা বলছিলো। টিকলি ধুরুধুরু বুকে চোরা চোখে তাকিয়ে শুনলো।

সি ব্লু রঙের সানগ্লাসটা চোখে পরতে পরতে আদর ঠেস মারা গলায় বলল, 'ভাগ্যিস পনেরো দিনের প্রেগন্যান্সিতে এসেছেন। ডেলিভারি পেইন নিয়ে আসলে আমি কি করতাম বলুন তো?'

টিকলির ভিতু মনটা এবার বিক্ষোভে বিক্ষিপ্তভাবে চলতে শুরু করলো। ভোঁতা মস্তিষ্কে ধপ করে জ্বলে উঠলো আগুন। সেই আগুনের ছটা বেরিয়ে আসতে লাগলো চোখ থেকে। লোকটাকে সে নিতান্তই নম্র ভদ্র এবং সুশীল ভেবেছিলো। কিন্তু শেষ মুহুর্তে এসে ঠিক একটা গা জ্বালানি কথা বলে নিজের আসল পরিচয়টা দিয়েই দিলো। টিকলি আঙ্গুল উঁচিয়ে বলল, 'দেখুন, মিস্টার মজা করবেন না।'

আদর শার্টের হাতা ফোল্ড করায় ব্যস্ত ছিলো। টিকলির কথায় সে মাথা উঁচিয়ে তাকালো। এরপর সন্দিহান গলায় বলল, 'সরি?'

টিকলি আবারো ক্ষুব্ধ গলায় বলল, 'দেখুন, একদম ন্যাকা সাজবেন না। এখন কিচ্ছু বুঝেন না তাই না? একটু আগে কি বললেন?'

আদর চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো কিন্তু এই বুদ্ধিমানের রাগের ছটা দেখে সে টেবিলে ঠেস দিয়ে দাড়ালো। মজা লুফে নেওয়ার মতো করে বলল, 'বারবার বলছেন দেখুন দেখুন। কিন্তু কিছু দেখাচ্ছেন ই না।'

টিকলি চোখ দুটো বিস্ফোরিত করে তাকালো। ঠোঁট দুটো নিজ দায়িত্বে একটা থেকে আরেকটা আলাদা হয়ে কিঞ্চিৎ ফাঁক হয়ে গেলো। এতোক্ষণের মিনমিনে গলা চড়ে গেলো খানিক উঁচুতে।

'আপনি তো ভারী অসভ্য।'

আদর কিছুটা অবাক হওয়ার ভান করে বলল, 'আমি অসভ্য?'

'অবশ্যই।'

'আপনি তাহলে মহা অসভ্য। বিয়ে করতে এসে বলছেন আপনি প্রেগন্যান্ট। কেনো বাসায় জানাতে কি হয়েছিলো? এখন বিয়েটা তো ভাঙতে হবে আমার। সব দোষ তো এসে পরবে এবার আমার কাধে তাই না?' আদর বলল দাঁতে দাঁত কিড়িমিড়ি করে।

টিকলি আবারো ফুসে উঠে বলল, 'এই আপনি আমার সাথে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করছেন কেনো হ্যাঁ?'

বড় বড় দুটো চোখে চেয়ে নিজের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে আদর বলল, 'আমি ঝগড়া করছি?'

'অবশ্যই।'

'ওকে ফাইন। আমি বিয়েতে হ্যা বলছি। বাসায় গিয়ে বলবো মেয়ে পছন্দ হয়েছে।'

টিকলির অবাকতার চোখে তাকালো। রাগচটা আগুনটা ধপ করে নিভে গিয়ে ভস করে জ্বলে উঠলো।

'আপনি ভুলে যাচ্ছেন আমি প্রেগন্যান্ট।' দাঁত পিষে টিকলি বলল।

'পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট মেয়েকে বিয়ে করতে আমার কোনো আপত্তি নেই। ডেলিভারি পেইনের মেয়ে হলে না একটা কথা ছিলো।' আদরের নিরুক্তর ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসির বাণী।

পরিকল্পিত কর্মসূচি বাস্তবায়ন বিঘ্ন হওয়ার পথে আর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নিতান্তই অভদ্র একটা পুরুষের গা জ্বালানো এহেন কথায় টিকলি রাগী গলায় বলে উঠলো, 'আপনি কিন্তু বেশি বেশি করছেন। বারবার এক কথা বলছেন কেনো?'

'এবার যখন আমি বিয়েতে রাজি হবো তখন বুঝবেন বেশি বেশি কাকে বলে।'

চোখ বন্ধ করে রাগ নিয়ন্ত্রিত করলো টিকলি। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ মিস্টি গলায় বলল, 'দেখুন...সরি শুনুন ভাইয়া, আমি তো প্রেগন্যান্ট আর আমি আমার বয়ফ্রেন্ডকে প্রচুর ভালোবাসি। প্রচুর..'

'একি! একেবারে ভাইয়া? বলি, চোখ বন্ধ করলে বুঝি রাগ কন্ট্রোলে আসে?'

আদর যে ইচ্ছেকৃত ভাবে এমন মজা নিচ্ছে তা টিকলি ভালোই বুঝতে পারছে। অচেনা একটা ছেলের কাছে এরকমভাবে হেনস্তা হওয়ায় অপমানে ভেতরে কাটা হয়ে রইল তার। দাঁত কিড়িমিড়ি করে সে বলল,

'অসহ্য! আপনি কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত ফাজিল। এর জন্যেও আমি বিয়েটা বাতিল করতে পারি আপনি জানেন?'

আদর ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে কাধ ঝাকিয়ে বলল, 'তো বাতিল করুন। আপনি কি ভাবছেন আপনাকে বিয়ে করার জন্য আমিও ছ্যাকা পেইন নিয়ে পাগল হয়ে ঘুরছি?'

'করবোই তো। আজ ই গিয়ে বাসায় বলছি, আপনাকে আমি বিয়ে করবো না।'

'আপনার পরিবার মানবে?'

'কেনো মানবে না?' চোরা চোখে তাকিয়ে বলল টিকলি।

'না, তাহলে কষ্ট করে আপনার আর পনেরো দিনের প্রেগন্যান্সির ভর বয়ে বেড়াতে হতো না।' কেটে কেটে কথাগুলো বলল আদর।

টিকলি আড়ালে চোখ মুখ কুচকে জিহবা কাটলো। ছেলেটা কি বুঝে গেলো কোনোমতে যে টিকলি মিথ্যা বলছে? বুঝলেও কীভাবে বুঝলো? টিকলি কি পনেরো দিন অনেক বেশি বলে ফেলেছে? ধ্যাত, এসব কি বোকা বোকা ভাবনা ভাবছে সে। ভাবনার সুতো কাটলো আদরের আরো একটি ঠেস মারা কথায়।

'আফটার অল পনেরো দিনের প্রেগন্যান্সি! কত কষ্ট! একদম ডেলিভারি টাইমে ব্যথা উঠছে উঠছে কিন্তু উঠছে না তেমন আতংকিত এক কষ্ট! বেচারা আপনার জন্য আমার খারাপ লাগছে।' আদর বলল দুঃখে কেদে ভাসানোর মতো মুখ করে।

'ইউ আর জাস্ট ইম্পসিবল।' অসহযোগ গলায় বলল টিকলি। আদর হাসলো ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে।

'হোপার (Hoper)' বলেই খয়েরি রঙের ব্যাগটা কাধে নিয়ে টিকলি চটপট জায়গা ছাড়লো। টিকলি চলে যাওয়ার কিছুক্ষন পর ওয়ার্ড টা ধরতে পেরে আদর চোখ বড় বড় করে তাকালো সাথে বিরবির করে বলল,

'আমাকে ফালতু বলল?'

______________________

খাবার টেবিলে এখন টুংটাং শব্দ। ডাইনিং রুমের সাইডের বড় থাই গ্লাসটা খুলে দেওয়া হয়েছে অনেক্ক্ষণ আগে। হুরমুড় করে ডুকছে ঘরে ঠান্ডা বায়ু। বায়ুতে মিশে আছে পোড়া মাটির গন্ধ। আজিম খান বড় ছেলের মুখপানে একবার তাকালেন। ছেলে তার মাশাল্লাহ নম্র ভদ্র এবং সুপুরুষ একজন ডাক্তার। ছেলেকে আজ ধরে বেধে পাঠিয়েছিলেন মেয়ে দেখতে। কিন্তু কি হলো কে জানে?

আজিম খান মুখ উপরে তুলে স্ত্রী মনোয়ারা খানের দিকে তাকিয়ে ইশারা করলেন। মনোয়ারা খান তার পক্ষ থেকে উল্টে স্বামীকে আরো একটি ইশারা পাঠিয়ে দিলেন। আজিম খান রাগান্বিত চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন স্ত্রীর পানে। মনোয়ারা খান সেদিকে তোয়াক্কা না করে ছেলেদের খাতির যত্নে ব্যস্ত। প্লেটে আবারো টুংটাং চামচের শব্দ তুলে ব্যারিস্টার আজিম খান গমগমে গলায় বললেন,

'মেয়ে দেখতে গিয়েছিলে?'

আদর মুখ তুলে তাকালো। এরপর আবার চোখ নিচে নামিয়ে ছোট্ট করে বলল, 'হুম'

'কেমন লাগলো না লাগলো কিছুই তো বললে না?'

'বলার মতো কিছু নেই। পছন্দ হয়নি আমার।'

আজিম খান অবাক চোখে তাকালেন। ক্ষন সময় পর শক্ত কন্ঠে বললেন, 'কিহহ? মেয়ে তো মাশাল্লাহ ভালোই সুন্দর। কথাবার্তাও কি নম্র ভদ্র। তোমার পছন্দ কেনো হলোনা? '

খাবার শেষ করে টিস্যু দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে আদর বলল, 'মেয়ে সুন্দর হলেই তো আর হলো না। প্রেগন্যান্ট মেয়েকে তো আর আমি বিয়ে করতে পারিনা তাই না?'

গলায় ঝাল আটকে কাশি উঠে গেলো পাশে বসে থাকা ছোট ভাই আর্দ্র এর। সে ল' নিয়ে পড়াশোনা করছে। দু'ভাইয়ের মেধাই আল্লাহর রহমতে মারাত্মক ভালো। যদিও আর্দ্র বাড়াবাড়ি রকমের দুষ্ট। আজিম খানের মুখটা হয়ে গেছে হা। মনোয়ারা খান ছোট ছেলেকে পানি খাওয়াতে খাওয়াতে বললেন, 'কি বলছিস এসব? পাগল হলি নাকি?'

টেবিল ছেড়ে উঠে দাড়াতে দাড়াতে আদর বলল, 'মেয়েটা নিজের মুখেই বলেছে সে পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট।'

আজিম খান এবং মনোয়ারা খান বিস্ময়ের সাগরে হাবুডুবু খেতে লাগলেন। পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট?মনোয়ারা খান স্বামীর দিকে রাগী চোখে তাকালেন। যার অর্থ খোঁজ খবর না নিয়েই এতো আগ বাড়ানোর কি দরকার ছিলো? আদর নিজের ঘরে চলে গেলো। পরিবেশে এখন আগাম ঝড়ের পূর্বাভাস। তাই আস্তে করে কেটে পরলো আর্দ্রও।

'ক্লিনিক্যাল নিউরোলজি' বইটা নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখছে আদর। সে পেশায় একজন নিউরোলজিস্ট সাথে সরকারি হাসপাতালের লেকচারার।

ঘরের দক্ষিণা জানালাটা খোলা। হাওয়ায় হাওয়ায় ঘর এখন শীতল। আর্দ্র অনেক্ক্ষণ থেকে ভাইয়ের পাশে বসে ফোন গুতাচ্ছে। আদর একবার আড়চোখে ছোট ভাইয়ের দিকে তাকালো। ছেলেটা বড় হলেও তার মধ্যে নিতান্তই একটা বাচ্চা বাচ্চা ভাব এখনো রয়ে গেছে। ছোটোবেলার মতোই সবসময় ভাইয়ের পেছন পেছন ঘুরা শুধু তার। আদর গলা খাকারি দিয়ে বলল, 'এতো ফোনে কি করিস সারাদিন ?'

ফোনে মগ্ন আর্দ্র জবাব দিলো, 'গার্লফ্রেন্ডের সাথে চ্যাট করি।'

আদর চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলে, 'আমি তোর তিন বছরের বড়! লজ্জা করে না তোর? বড় ভাইকে এসব বলিস?'

টাউজারের পকেটে ফোন ঢুকিয়ে বিরক্তিতে আর্দ্র চু শব্দ করলো। এরপর বলল, 'আচ্ছা ভাইয়া আজকের মেয়েটা দেখতে কেমন ছিলো?'

বইয়ের পাতায় চোখ বুলাতে বুলাতে আদর উত্তর দিলো, 'মাস্ক পরা ছিলো।'

'ওওও...আচ্ছা মেয়েটার নাম কি?' চোখ ছোট ছোট করে গোয়েন্দার মতো প্রশ্ন আর্দ্রর।

'জানি না। বাবা শুধু রেস্টুরেন্টের নাম বলেছে আমি দেখা করতে গিয়েছি এর বেশি কিছুই জানি না।'

আর্দ্র বড় বড় চোখে চেয়ে রইল ভাইয়ের দ্বারপানে। আজকাল এমন মানুষও হয় বুঝি? যাকে বিয়ে করতে যাবে তার নামটাও জানে না?
আদর একবার আড়চোখে ছোট ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে উঠে চলে গেলো বেলকনিতে। বিছানায় পড়ে রইল বই। হিম শীতল বাতাসে উড়তে লাগলো বইয়ের একটার পর একটা পাতা। বাতাসে মিশে গেলো নতুন বইয়ের গন্ধ, ছন্দ, মন্দ আবেগ।

চলবে।

মুমুর্ষিরা শাহরীন

Masum, Tasmia haq, Sume akter, Hasibul hasan santo, Abul basar, Santa akter, Sk sagor and লেখাটি পছন্দ করেছে

avatar
Onu kotha
শুকতারা
শুকতারা
Posts : 56
স্বর্ণমুদ্রা : 1323
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-05-26

বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ Empty Re: বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ

Fri Jun 04, 2021 1:38 am
০২.

বাতাসে মৃদুমন্দ কাঁপন। ঝড়ো হাওয়ায় ঝাপটে আসছে বৃষ্টির ছন্দ সাথে দুজন তরুণীর মস্তিষ্কের উত্থাপিত চিন্তার দ্বন্ধ। শনশন বাতাসে উড়ছে অবিরাম টিকলির কোমড় ছাড়িয়ে লম্বা কালো ঘন রেশমির ন্যায় চুলগুলো। নখ কামড়াতে কামড়াতে নিজের বিশাল বড় ঘরটার এ মাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত সে পায়চারি করে চলেছে আধ ঘণ্টা যাবৎ। তার ওই এক দোষ, নখ কামড়ানো! চিন্তায় থাকলেই সে নখ কামড়ায়।
বৃষ্টির ছিটায় মেঝে হয়ে গেছে চিপচিপে। অসর্তকতাবশত কেউ সেখানে পা ফেললেই ধপাস করে পরে যাবে তা নিশ্চিত। টিকলি চোখের চশমাটা ঠিক করে কাচের জানালাটা বন্ধ করে দিলো। কপালে সূক্ষ্ম কিছু ভাঁজ ফেলে নখ কামড়াতে কামড়াতেই বলল,

'আচ্ছা টায়রা, ওই লোকটা কি বাবাকে সব বলে দিবে রে?'

টায়রা! টিকলির এক বছরের একটামাত্র ছোটো বোন। পিঠাপিঠি বোন হওয়ায় তারা একই ক্লাসে পড়ে এসেছে। একই সঙ্গে থেকে এসেছে সবসময়।

টায়রা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বিছানায় আরাম করে শুলো। ওর আবার চিন্তাভাবনা কম কাজ বেশি। কাজ মানে বাদরামো। বড় করে একটা হাই তুলে সে বলল,

'আমি জানি নাকি? আর এতো নখ খাস কেন? নখ খেলে জামাই ফকির হয়ে যায়।'

'বিয়েই করতে চাইতাছি না আর তুই জামাই ফকির হয়ে যায় নিয়াইছস?' টিকলি বলল বিরক্ত গলায়।

'প্ল্যান কি কাজে দিছে? রিপোর্ট দেখতে চাইছিলো? কি কি বলছোস?'

টিকলি চিন্তিত মুখে বলল, 'কাজে দিছে কিন্তু সমস্যা হলো আমি বলছি যে আমি পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট। '

টিকলির কথাটা শুনামাত্র টায়রা ঝট করে লাফিয়ে শুয়া থেকে উঠে বসলো। এরপর তার ফাটাবাঁশের মতোন গলায় চেঁচিয়ে বলে উঠলো, 'হোয়াট? মানে গর্দভেরও তো একটা লিমিট থাকে ভাই। তুই কোন লেভেলের গর্দভ?'

ফুসে উঠে টিকলি বলল, 'একটা চর খাবি। আমি তোর থেকে এক বছরের বড় মনে রাখিস।' টায়রা চুল হাওয়ায় উড়িয়ে দেওয়ার মতো কথাটাও উড়িয়ে দেয়। টিকলি এবার একটু অসহায় গলায় বলে, 'আমি কি করবো বল তো? আমি এতো নার্ভাস ছিলাম যে আমার হাত পা ঠকঠক করে কাঁপতাছিলো। যার কারনে ফট করে বলে দিছি আমি পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট। '

'ভালো করছো। উদ্ধার করছো। এবার ছেলেটা বাবাকে ফোন দিয়ে বলুক আপনার মেয়ে পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট। আর পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট মেয়েকে বিয়ে করে তো আমি জাতির অপমান করতে পারিনা। নো, নেভার, কাবি নেহি। এটলিস্ট দুই তিনমাস হলে মানা যেতো। জাতির সামনে অন্তত মুখটা দেখাতে পারতাম।'

'ফাইজলামি করবি তো কানের গোড়ায় খাবি।'

টায়রা রাগে গজগজ করে বলল, 'কোন কুক্ষণে যে আমার চেয়ে একটা বছর বড় হতে গেলি তুই টিকলি? মাঝে মাঝে মনে হয় আমি তোর বড় হইলে তোরে এক ঘন্টা রোদে দাড় করায়ে তেঁতুল গাছের ডাল দিয়ে অনবরত পিটাতাম।'

'টায়রার বাচ্চা....'

'বাচ্চা হয়নাই তো। বিয়েই হইলো না এখনো আর বাচ্চা? এ জীবনে আর আমার বাচ্চা কাচ্চা হবে বলে মনে হয় নারে। কিভাবে হবে বল? মেশিন সরবরাহ করছে না বাবা মা। তাই প্রডাকশনও প্রডাক্ট দিতে চায় না।' টায়রা বলল দুঃখী গলায়। টিকলি লজ্জায় চোখ মুখ কুচকে ফেলল। টায়রা টিকলির পাশে গিয়ে কাছে বসে আবার বলল, 'যাই হোক, আচ্ছা ছেলে কেমন দেখতে ছিলো রে?'

'আমি কি জানি?' টিকলির বিরক্তিকর উত্তর।

টায়রা ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে, 'তুই কি জানিস মানে?'

'মাস্ক পরা ছিলো। মুখ দেখি নাই। আর দেখার ইচ্ছাও হয় নাই। লোকটা সেই লেভেলের ফাজিলের ঘরে ফাজিল।'

'নাম কিরে?'

'আমি কীভাবে জানবো? আমি কি আর নামের ধান্দায় ছিলাম? বিয়ে ক্যানসেল কীভাবে করবো এই চিন্তায় বাঁচি না আর তো নাম্বার!'

'চিন্তা করে দুনিয়া উল্টায় ফেলছো একবারে। সেই তো আমারই মাথা খাটায়ে প্ল্যান বের করতে হইলো।'

'কিন্তু ভাগ্যিস রিপোর্ট দেখে নাই। কারন ওটা তো আর রিপোর্ট ছিলো না, ছিলো এক পেত্নীর আজেবাজে আর্ট। আই এম সিউর রিপোর্ট দেখার উদ্দেশ্যে ফাইলটা খুলে এসব পেত্নীমার্কা আর্ট দেখলে লোকটা সেখানেই অক্কা পেতো।'

'তুই আমাকে ইনসাল্ট করতাছোস? নিমকহারাম, বিশ্বাসঘাতক, প্রতারক, ছলানাময়ী।'

টায়রার এত্তো এত্তো অভিযোগের মাঝেই জামিলুর রেজার ভরাট গলায় ডাক পরলো। টিকলি টপাস করে দাঁড়িয়ে গেলো। বার দুয়েক হেচকি তুলে ঢোক গিলল। টায়রার হাত ধরে কাঁপতে কাঁপতে বলল, 'বাবা ডাকছে? '

'তো আমি কি করতে পারি?'

টিকলি কাদো কাদো হয়ে বলল, 'তুই আমার বোন না শত্রু?'
'ভিলেন।'
'তুই আসলেই একটা খারাপের বাচ্চা।'
'দাড়া আমি এখনি গিয়ে আব্বুরে বলতাছি তুই আব্বুরে খারাপ বলছোস।'

টায়রা উঠে যেতে ধরে বাবার কাছে নালিশ ঠুকার জন্য। টিকলি তার বিচ্ছু বোনকে পড়িমরি করে আটকিয়ে অসহায় গলায় বলল, 'বইন তুই এরম কেন?'

টায়রা দাঁত কেলিয়ে উত্তর দেয়, 'তোর বইন যে।'

জামিলুর রেজা ঘরে পা রাখতেই দুই বোন থেমে একদম চুপ করে যায়। এদিকে টিকলির হৃদস্পন্দন ও থেমে যায়। দমকা ঠান্ডা বাতাস যেনো মুহুর্তে উত্তাপ আর গরমে পরিনত হয়। কি শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি! টিকলি শ্বাস ফেলতেও ভয় পাচ্ছে। যেনো নিঃশ্বাসের সাথে আজকের সব গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে যাবে বাবা নামক ভয়ংকর মানুষটার সামনে। জামিলুর রেজার পেছন পেছন ঘরে ঢুকলেন শায়লা আক্তার। এতোক্ষনের আটকানো নিঃশ্বাস টা ছেড়ে দিয়ে টিকলি তোতলানো স্বরে বলে উঠলো,

'মা বাবা? তোমরা? বসো না বসো।'

জামিলুর রেজা আর শায়লা আক্তার গিয়ে বসলেন। জামিলুর রেজা কিছুক্ষন দুই মেয়ের দিকে সূক্ষ্মভাবে তাকিয়ে থাকলেন। পর্যবেক্ষণ করলেন। তার দুই মেয়ে। আজই প্রথম বড় মেয়েকে পাঠিয়েছিলেন একটা ছেলের সাথে দেখা করতে। ইচ্ছে ছিলো বড় মেয়ের পরপর ই ছোট মেয়ের জন্যেও পাত্র খুঁজবেন। কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেলো!

টিকলি টায়রা দুজন দুজনের হাত খামচে ধরে তখন টেনশনে মুচড়া-মুচড়ি করছিলো। জামিলুর রেজার থমথমে মুখ দেখে টায়রা ঢোক গিলে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো, 'কি হয়েছে বাবা?'

টিকলি সরে বসলো খাটের একদম কর্ণারে। তার নিঃশ্বাসের গতি স্থবির। আঙ্গুলে লাল উড়না অনবরত ঘুরে চলেছে চিন্তায়। পরিবেশে দমবন্ধের ছোঁয়া। জামিলুর রেজা টিকলির মাথায় হাত রাখলেন। এরপর তেজি গলায় বলা শুরু করলেন। তখনি যেনো আটকে গেলো টিকলির নিঃশ্বাস। রুদ্ধশ্বাসে সে শুনলো বাবার কথা।

'কোথাও বিয়ে দিবো না আমার মেয়েকে। আমার এতো সুন্দর লক্ষী একটা মেয়ে।'

টিকলি চোখ বড় বড় করে তাকালো ঝট করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। আর একটু হলে সে মারা পরতো। কিন্তু একি শুনলো সে? কাহিনীর মধ্যে ভেজাল গল্প? জামিলুর রেজা আবার বললেন, 'মারে ওই বাড়িতে তোকে বিয়ে দিবো না। বলি আমার মেয়ে কি আমার বাড়িতে বেশি হয়েছে নাকি হ্যাঁ?'

বাবাকে উত্তেজিত দেখে টায়রা বাবার পেছন থেকে আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো, 'কি হয়েছে বাবা?'

'আরে কি হয়নি সেটাই বল। বলে কিনা আমার মেয়ে প্রেগন্যান্ট। কত্ত বড় কথা! পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট মেয়েকে নাকি আমরা ঘুঁচিয়ে দিচ্ছিলাম তার বাড়িতে। মেয়ে কি আমার ঘরে বেশি হবে নাকি হ্যাঁ? ওমন বাড়িতে বিয়ে না দিলে কি আমরা না খেয়ে মরবো নাকি মেয়েকে আর বিয়ে দিতে পারবো না ?' শায়লা আক্তার বললেন উঁচু গলায় হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে।

টায়রা উল্টো দিকে ঘুরে শব্দবিহীন ফিক করে হেসে দিলো। অন্যদিকে ঘুরে মুচকি হাসলো টিকলিও। টায়রা হাসি চেপে হায়হায় করে আগুনে ঘি ঢালার মতো বলল, 'হায়হায় বলো কি! কি সাংঘাতিক কথা! আমার বোনকে পনেরো দিনের প্রেগন্যান্সির অপবাদ দেয়? এত্তো....বড় অপবাদ।' টায়রা নেকামো ভঙ্গিতে হাত টাকে প্রসারিত করে দেখালো।

জামিলুর রেজা এবার জ্বলে উঠলেন, 'ওদেরকে তো আমি দেখে নিবো। আমার মেয়ের নামে এতো বড় অপবাদ। পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট কেউ হয় নাকি? কেউ বুঝে নাকি?'

টায়রা বাবার কথায় সায় দিয়ে বলল, 'ঠিক বলেছো বাবা। ডাক্তার দেখানো ছাড়া প্রেগন্যান্সি বুঝতে মিনিমাম এক মাস তো লাগবেই তাই না?'

টায়রা এমনি। লাগামহীন মেয়ে। কোথায় কি বলতে হয় তা জানে না। চঞ্চল, বেপরোয়া। সবার সাথেই এমন। টিকলিও চঞ্চল কিন্তু বিনয়ী। সে সবার সাথে চঞ্চলতা দেখায় না। ক্ষেত্রবিশেষে তার রূপ ধারন করে। এই মুহুর্তে টিকলি চিমটি কাটলো টায়রার হাতে। জামিলুর রেজা ভঙ্গি কাশি দিয়ে উঠে চলে গেলেন মেয়ের ঘর থেকে। শায়লা আক্তার যাওয়ার আগে চোখ পাঁকিয়ে বলে গেলেন, 'টিকলির আগে তোর ই বিয়ে দিতে হবে দেখছি। পাকনা মেয়ে একটা।'

'দেও না মা দেও। আর কতদিন জামাইয়ের মুখ দেখা ছাড়া থাকবো বলো তো? পরাণ যে জ্বলিয়া যায়। পরাণ যায় জ্বলিয়া রে...পরাণ যায় জ্বলিয়া রে।' শেষের দু লাইন গান গেয়ে শুনিয়ে দিলো টায়রা। শায়লা আক্তার মেয়েকে বকতে বকতে চলে গেলেন।

সবশেষে টিকলি শব্দ করে হেসে দিলো। টায়রা উঠে ঝটপট জড়িয়ে ধরলো বোনকে। টুপ করে গালে একটা চুমু দিলো৷ টিকলি বোনের ফিরতি চুমু দিয়েও দিলো৷ এরপর একসাথে দুজনা হাসিতে মত্ত হলো।

এই হলো ওদের বোন-কেমিস্ট্রি! ঝগড়া, মারামারি, খোঁচাখোঁচি কিন্তু দুজন দুজনকে ছাড়া নো চলাচলি।

চলবে।

Masum, Tasmia haq, Hasibul hasan santo, Abul basar, Santa akter, Sk sagor, Sk imran and লেখাটি পছন্দ করেছে

avatar
Onu kotha
শুকতারা
শুকতারা
Posts : 56
স্বর্ণমুদ্রা : 1323
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-05-26

বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ Empty Re: বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ

Fri Jun 04, 2021 1:38 am
০৩.

শেষ বিকালে বৃষ্টির আনাগোনা। লুকোচুরি খেলছে আবহাওয়া। হঠাৎ আকাশের ঘন কালো মেঘে ঢেকে যাচ্ছে সূর্য তো আবার আধার সরিয়ে হয়ে যাচ্ছে শুভ্র নির্মল গোধূলি বিকাল। লুকোচুরি খেলতে খেলতেই এই বুঝি ঝপঝপ করে বৃষ্টি নামলো! ঠান্ডা বাতাসের সাথে গা ভাসিয়ে আদর দাঁড়িয়ে ছিলো ঘরের বারান্দাটাতে। মিনিট দশেক হলো সে চেম্বার থেকে ফিরেছে। এক দেড় ঘন্টা পর আবার ছুটতে হবে তাকে মানবসেবায়।

হাতে ধোঁয়া উঠা কফির মগ...বাতাসে বৃষ্টির ছন্দ... প্রেম প্রেম ভাব...চারিপাশে সব ঠিকঠাক। শুধু যথার্থ মানুষের অভাবে এই প্রেমময় সময়টাকে ভাগাভাগি করে নেওয়া যাচ্ছে না। ইশশ দুঃখ!
পেছন থেকে ডেকে উঠলো মনোয়ারা খান, 'আদর....'

মোলায়েম বৃষ্টি বৃষ্টি আবহাওয়া থেকে চোখ সরিয়ে আদর মায়ের পানে তাকালো। মনোয়ারা খান বললেন,

'তোর বাবা তোর জন্য আরেকটা মেয়ে দেখেছে। কাল বা পরসু গিয়ে দেখা করে আসিস।'

বিরক্তিতে চোখ মুখ কুচকে উঠলো আদরের। সেই পনেরো দিনের সো কল্ড প্রেগন্যান্ট মেয়েকে দেখার পর আজ প্রায় পনেরো দিন পার হয়ে গেছে।
পনেরো দিন! হ্যাঁ পনেরো দিন। ইশশ...সব এতো পনেরো পনেরো কেনো? জীবনের গল্পের নামটা বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ না দিয়ে পনেরো দিন দিলেই বোধ হয় বেশি ভালো হতো। এই পনেরো দিন টা যেনো আষ্ঠেপৃষ্ঠে প্রেমিকার মতো জড়িয়ে ধরে আছে আদরকে। আদর বিরক্তিতে আরক্তনয়নে বলল,

'মা, কেনো আমার জন্য মেয়ে দেখছো? এই মুহুর্তে আমার বিয়ে করার ইচ্ছা নেই। সময় হলে আমি তোমাদের জানাবো। আমারো তো পছন্দ অপছন্দ আছে নাকি?'

মনোয়ারা খান গমগম করে বললেন, 'সেটা তোর বাবাকে কে বুঝাবে? এমনিতেই কত কান্ড হয়েগেছে তুই তো কিছু জানিস না। ওই বাড়িতে ফোন দিয়ে তোর বাবা অনেক খারাপ কথা শুনিয়েছিলো।'

আদর অবাক গলায় বলল, 'কোন বাড়িতে? যেই মেয়েকে দেখতে গিয়েছিলাম?'

'হ্যাঁ'

আদর বিরক্তের চরম সীমায় পৌঁছে গেলো যেনো, 'মা তোমরা এতো বোকা কেনো হ্যাঁ? পনেরো দিনের কেউ প্রেগন্যান্ট হয়? মেয়েটা বিয়ে করতে চাইছিলো না বোধ হয় এর জন্য এমন একটা লেইম এক্সকিউজ বের করেছে।'

মনোয়ারা খান খুব যে একটা বিশ্বাস করলেন তা মনে হলো না। কপালে ভাঁজ ফেলে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'তুই সব জানিস? আজকাল কার ছেলেমেয়েরা ভালো হয়না রে। তুই তো ডাক্তার মানুষ ব্যস্ত থাকিস তাই অতশত বুঝিস না।'

মায়ের কথায় যথারীতি সবসময়কার মতো মুখে বিরক্ত ফুটিয়ে তুলে আদর আবারো বৃষ্টি আবেগ পরিবেশে মগ্ন হলো। ধোঁয়া উঠা কফির মগ টা থেকে এখন আর ধোঁয়া উঠছে না। কফিতে মুখ দিলেই দেখা গেলো কফি ঠান্ডা পানি হয়ে গেছে। তিক্ততায় আদর বলল, 'কফিটা ঠান্ডা হয়ে গেছে মা নিয়ে চলে যাও।'

মনোয়ারা খান ছেলেকে একবার ঠিকঠাক পরখ করে চলে গেলেন। মা চলে যেতেই আদর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বারান্দার রেলিং ধরে ওই প্রেম প্রেম ভাব পরিবেশটার দিকে তাকিয়ে রইল বিষন্ন মুখে। কেউ কেনো বুঝে না লাইফে একটা প্রপার টাইম থাকে আর সেই টাইমে পারফেক্ট মানুষের এন্ট্রি ঘটে। প্রপার টাইম টা পাওয়ার জন্য লাইফকে এনাফ সময় দিতে হয়। কিন্তু এই বাবা-মা রা না সবসময় তারাহুরো করে। আদরের বিরক্ত লাগে।
এই যে বৃষ্টিশেষে আবারো বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব। আকাশে ঘোমট মেঘে ছাই রঙা রং এ সজ্জিত হওয়ার আভাস। বাতাসে প্রেম প্রেম ছন্দ। ইশশ কি দারুন অনুভূতির গন্ধ! এই সময়টার পার্ফেক্ট একটা নাম দেওয়া উচিত। যে নামে থাকবে বৃষ্টি, প্রেম, ছন্দ এবং তার শুরু ও শেষ। আদর তার হালকা গোলাপি ঠোঁট দুটো নাড়িয়ে মোহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আওড়ালো, "বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ।"

____________________________

বিশেষ কোনো কাজে বাইরে বের হয়েছিল টায়রা। রিক্সা দিয়ে বাসায় ফেরার সময় নিজের নামের মাত্র বয়ফ্রেন্ড কে অন্য কোনো এক সুন্দরী রমনীর হাত ধরে থাকতে দেখে নাকের পাটাতন ফুলে গেলো তার। রিক্সাওয়ালা মামাকে দাড় করিয়ে নিজের ডায়নী রূপ ধারন করে সে গেলো রাফি নামক সেই ছেলেটার কাছে।

'এই তুমি এখানে কি করছো?' কোমড়ে হাত দিয়ে ভ্রু কুটি করে বলল টায়রা।

আচমকা টায়রাকে অসময়ে এখানে দেখে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পরলো রাফি। মুখ ছোট হয়ে এতোটুকুনি হয়ে গেলো। দেখেই বুঝা যাচ্ছে সে ভিষন ভয়ে আছে। ঢোক গিলে সে তার নিউ গার্লফ্রেন্ড রাফিয়ার হাতটা শক্ত করে ধরলো। টায়রা আড়চোখে তা দেখে ফুসে উঠে বলল,

'কু* বাচ্চা....তুই আমাকে ধোকা দিছস? আমি থাকতে অন্য মেয়ের লগে চিপকায় থাকস?' হাতের ভেনিটি ব্যাগ দিয়ে সজোরে দিলো এক বাড়ি।

রাফিয়া নিজের বাবুকে এই শাকচুন্নির হাত থেকে বাঁচাতে ন্যাকা স্বরে চেঁচিয়ে উঠলো, 'এই তুমি আমার বাবুকে মারছো কেনো?'

রাফিকে মারা থামিয়ে টায়রা রাফিয়ার দিকে তাকালো। এরপর রাফিয়ার থুতনি ধরে টান দিয়ে ওর মতোই ন্যাকা গলায় বলল, 'ওওও...তোমার বাবু...? তুমি ওর মা লাগো বুঝি? ইশশ...বেচারাকে শুধু শুধু এতোক্ষন মারলাম। থাক জান, আই এম সো সরি।' রাফির গালে হাত বুলিয়ে চুমু দেওয়ার ভঙ্গিতে ঠোঁট চোখা করল টায়রা।

রাফিয়া চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে ফুসতে লাগলো। রাফি চোখ মুখ কুচকে বলল, 'দেখো টায়রা, তোমার মতো তারছিড়া মেয়ের সাথে রিলেশন রাখা আমার পক্ষে সম্ভব না। প্লিজ আমার জীবন থেকে চলে যাও। আমি রাফিয়া কে নিয়েই ভালো থাকবো। ওর মাঝেই আমার সুখ।'

টায়রা একবার চোখ বন্ধ করে আবার টপাস করে খুলল। রণচণ্ডী রূপ ধারন করে বলল, 'বাংলা সিনেমার ডায়লগ মারস? ওর মাঝেই আমার সুখ। আহারে! আর আমি তারছিড়া? ওই শালা আমি তারছিড়া? তোর মতো রাফির বাচ্চা আমার পেছনে প্রতিদিন বিশ বাইশ টা ঘুরে। আর তুই আসছোস আমাকে তারছিড়া বলতে হ্যাঁ?

'তাহলে যাও তাদের সাথে গিয়ে প্রেম করো আমাদের কেনো ডিস্টার্ব করছো?'

'তোরে আমি ডিস্টার্ব করতাছি? গত একটা বছর তুই আমার পেছনে লালু কুত্তার মতোন ঘুরছস। এখন দুই মাস যাইতে না যাইতেই ফুস..'

'শুনো, আমি এতোকিছু বুঝি না। মোট কথা হলো তোমার সাথে আমার মিলে না কোনোকিছু। তুমি শুধু পেইন দেও। কিন্তু রাফিয়ার সাথে দেখো সবকিছুই মিলে আমার। ইভেন আমাদের নামটাও কি সুন্দর মিল দেখছো?'

কেনো কে জানে এই পর্যায়ে টায়রার চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরে গেলো নির্লজ্জ ভাবে। চোখ মুছে নাক টেনে ইমোশনাল মুড থেকে বেরিয়ে এসে টায়রা আঙ্গুল উঁচিয়ে শাসানো গলায় বলল, 'প্রেম করতাছোস না? কর। আমার বিয়াত তোরে আমি আমার উকিল বাপ বানামু দেখিস তুই। মাইন্ড ইট।'

টায়রা হনহন করে চলে গেলো। রাফি বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকলো। পাশ থেকে রাফিয়া ন্যাকি গলায় আবারো বলল, 'বাবু? উকিল বাপ কি?'

রাফি বিরক্তিতে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে তেজি গলায় বলল, 'আমারে উকিল বানায়ে পরে ওর বাপ বানাবো। যত্তসব।'

,

ঘরে ঢুকেই গোলাপি রঙের ব্যাগ টাকে ছুড়ে মারলো একদিকে। টিকলি যথারীতি চোখে চশমা পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বই পড়ছিলো। 'শেষের কবিতা'! কোমড়ে হাত দিয়ে টায়রাকে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে দেখে টিকলি উঠে টায়রার কাধে হাত রাখলো। মেয়েটার মুখ হয়ে আছে লাল। বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে তার ঘনঘন নিঃশ্বাস পরছে। চোখে পানিরা উপচে গেছে। বারবার মুছেও সামাল দেওয়া যাচ্ছে না আবার ভিজিয়ে দিচ্ছে। এমতাবস্থায় কাধে বোনের হাতের ছোঁয়া পেয়ে টায়রা নিজেকে আটকাতে পারলো না। জড়িয়ে ধরলো বোনকে। এরপর শব্দ করে কেদে দিলো।

বোনকে শেষ কবে কান্না করতে দেখেছে তা মনে নেই টিকলির। এতোদিন বাদে মেয়েটাকে কাদতে দেখে টিকলি ভিষন রকমের অবাক হয়েছে। টায়রার মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে স্বরে টিকলি বলল, 'কি হয়েছে আমার সোনা বোনটার? কাদছে কেনো সে? কে বকেছে হুম?'

ব্যস, কান্নার বেগের মাত্রা বাড়লো। হেচকি দিয়ে কেদে উঠে টায়রা বলল, 'রাফি আমাকে ভালোবাসে না। ও এই দুই মাস আমার সাথে শুধু এডজাস্টমেন্টে ছিলো। আমার সাথে এডজাস্ট করতে না পেরে ও এখন রাফিয়া নামের আরেকটা মেয়ের কাছে গেছে।'

'এই ছেলে না তোর পেছনে এক বছর ঘুরেছিলো?' টিকলি বলল সন্দিহান গলায়।

চোখ মুছে টায়রা বলল, 'হুম'

'তুই ভালোবাসতিস ছেলেটাকে?'

কান্না থামিয়ে চুপ করে বিছানায় বসে নাক টেনে টায়রা বলল, 'না।'

টিকলি অবাক গলায় বলে, 'না? তাহলে কাদছিস কেনো?'

'ও আমাকে রিফিউজ কেনো করলো? ব্রেকাপ আমি করতাম। আমি অন্য একটা ছেলের সাথে রিলেশনে জড়াতাম। রাফি কেনো জড়াইলো? ও সম্পর্ক ভাঙ্গলো কেনো? ইটস হার্ট মাই ইগো।'

বোনের কথা শুনে জোরালো এক দীর্ঘশ্বাস ফেলল টিকলি। টায়রা এমনি কারোর রিফিউজ সহ্য করতে পারে না। বোনের মাথায় হাত রেখে টিকলি শান্ত কণ্ঠে বলল,

'সবসময় নিজের ইগোকে নিয়ে ভাবলে আমাদের চলবে না টায়রা। অন্যদের টাও বুঝতে হবে। তুই যদি আজ রাফিকে বুঝার চেষ্টা করতি তাহলে সম্পর্ক টা ভাঙ্গতো না। ও অন্য মেয়ের কাছে চলে যেতো না। তোকে রিফিউজ করতো না।'

টিকলির কথা শুনে টায়রা টিকলির দিকে তাকালো। এরপর নিরব মনে বলল, 'আমি আর রিলেশন ই করবো না। এটাই লাস্ট।'

'প্রত্যেকবার ব্রেকাপ করে এসে এটাই বলিস। নাথিং নিউ। যদিও প্রতিবার ব্রেকাপ তুই করিস আর এবার তো.....'

বোনের দেওয়া খোঁচা বুঝতে পেরে হনহন করে ওয়াশরুমে চলে গেলো টায়রা। টিকলি জোরে হেসে দিলো।

__________________________

চেম্বার থেকে মাত্র ফিরলো আদর। একান্ত ব্যক্তিগত নিজের ঘরটাতে এসেই আর্দ্রর দেখা পেয়ে সে ভ্রু কুচকালো। আর্দ্র ফোন টিপছিলো। ঘড়িতে চোখ রাখতেই আদর দেখলো রাত এগারোটা বাজে। সে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল,

'কিরে তোর রুম নাই? আমার রুমে এসে ফোন টিপার লাগে?'

ফোন থেকে মাথা তুলে আদরের কথার উত্তর না দিয়ে দিয়ে আর্দ্র উল্টে বলল,

'ওহ এসে পরেছো। যাও ফ্রেশ হয়ে আসো। অনেক ইম্পোর্টেন্ড কথা আছে।'

কুচকানো ভ্রুতেই ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এলো আদর। বিছানায় এক কোণায় বসার সাথে সাথে তার হাতে কিছু মেয়ের ছবি ধরিয়ে দিলো আর্দ্র। বলল,

'আম্মু বলেছিলো ছবিগুলো তোমাকে দিতে। মেয়েগুলো হেব্বি সুন্দর। আমি দেখেছি তুমি দেখো ভাইয়া। অনেক পছন্দ হবে।'

রাগে ভ্রু কুচকে আদর বলল, 'এটা তোর ইম্পোর্টেন্ড কথা?'

ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে আর্দ্র বলে, 'হ্যাঁ। আর তুমি সবসময় এতো ভ্রু কুচকাও কেনো? মনে হয় রাজ্যের বিরক্তি এসে তোমার ঘাড়ে চেপেছে।'

'বাজে কথা বন্ধ কর। তোরা সবাই আমার বিয়ের পেছনে হাত ধুয়ে লেগেছিস কেনো বল তো? আমি যে বিয়ে করতে চাইছি না এটা কি বাবা মা বুঝতে পারছে না?'

ভাইয়ের মুখোমুখি বসে আর্দ্র গোয়েন্দা গলায় বলল,

'আমি জানি না ভাইয়া। কিন্তু বাবা একদম হাত ধুয়েই নেমেছে। যে করেই হোক তোমাকে বিয়ে দিতেই হবে। এটাই এখন তার জীবনের এক এবং একমাত্র মিশন। তার ধারণা তুমি প্রেম করো। আর তুমি তো জানো প্রেমে বাবার এলার্জি আছে। অথচ নিজেই প্রেম করে বিয়ে করেছে। যদিও এর জন্য তাকে আমি সারাজীবন পস্তাতে দেখেছি।'

আর্দ্রকে থামিয়ে দিয়ে আদর বলল, 'হইছে হইছে। চুপ কর ভাই। তোকে প্রশ্ন করলাম একটা আর তুই হিস্টোরি শোনাইতাছস? আমি কি জানিনা এসব?'

'তাহলে আর কি বলবো? তুমি সুন্দর হ্যান্ডসাম মেয়েরা তোমার পেছন সারাক্ষণ ঘুরঘুর করে। প্রেম করতেই পারো বলে বাবার ধারণা। '

'উপায় বল। এই বিয়ে করানোর পোকা বাবার মাথা থেকে নামবে কীভাবে?'

আর্দ্র ঠিকঠাক হয়ে বসলো। এরপর আয়েশী ভঙ্গিতে বলল, 'ভাইয়া অনেকদিন না ঘুরতে যাই না। চলো আমরা পাঁচ সাতদিনের ট্যুরে যাই। কিন্তু বাসার কাউকে জানাবো না। তারা জানবে তারা তোমাকে জোর করে বিয়ে দিতে চাইছে বলে তুমি ভেগে গেছো। ছেলে ভেগে গেছে এই দুঃখে বাবার ঘাড় থেকে ভূত ও নামবে।'

আদর ভ্রু কুটি করে বলল, 'আমি কি মেয়ে নাকি যে ভেগে যাবো? কিসব মেয়েলী বুদ্ধি তোর মাথায়। আর আমার ছুটি নাই।'

'ছুটি নিবা। এইটুকু করতে না পারলে বিয়ে করে ফেলো।'

আদর কিছুক্ষন ভেবে বলল, 'কোথায় যাবি?'

খুশিতে আটখানা হয়ে আর্দ্র বলল, 'নিঝুম দ্বীপ। একদম নিরব জায়গা। তোমার জন্য পার্ফেক্ট।'

____________________________

টিকলির ছোট্ট কুটিরে যখন মনখারাপের বৃষ্টি নামে টিকলি তখন বই পড়ে। বইয়ের মাঝে মন ভালো করার ওষুধ আছে বলে সে বিশ্বাস করে। আজও মন খারাপ তাই সে বই পড়ছে।
টায়রা এবার সন্দিষ্ট গলায় বলল, 'তোর কি মন খারাপ?'
'হুম।' দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল টিকলি।
'কিন্তু কেনো খারাপ? মন খারাপ হওয়ার কথা তো আমার।' চিন্তিন গলায় বলল টায়রা।
বইটাকে বন্ধ করে টিকলি অসহায় গলায় বলল, 'বাবা আবার ছেলে দেখছে। আমি বিয়ে করতে চাইনা। কেনো বুঝে না তারা? মেয়ে বড় হলেই বিয়ে দিতে হবে নাকি? তোকে ছাড়া থাকতে পারবো না আমি।'

টায়রা চোখ বড় বড় করে বলল, 'কি?? এর জন্যই বলেছিলাম, চল বাড়ি থেকে পালিয়ে যাই। কিছুদিন উদাও হয়ে গেলেই মেয়েদের মর্ম বুঝবে।'

'কিন্তু পালিয়ে যাবোটা কই?' টিকলি চিন্তিত মুখে বলল। টায়রাও গালে হাত দিয়ে বসলো। কিছুক্ষণ ভাবার পর টিকলি আমোদিত গলায় বলল, 'এই টায়রা ঘুরতে যাবি? চল ঘুরতে যাই। বাড়ি থেকে পালানো ও হবে। ঘুরাও হবে।'

' ব্রিলিয়ান্ট আইডিয়া। কিন্তু কোন জায়গায় যাবো?'

'নিঝুম দ্বীপ।'

টিকলি বলল কিছুটা ঘোর লাগানো গলায়। কেনো জানি না এই জায়গাটায় যাওয়ার তার খুব ইচ্ছা। চার-পাঁচ বছর আগে এই জায়গা সম্পর্কে একটা ভিডিও দেখেছিলো সে। সেখান থেকেই তার খুব ইচ্ছা এই জায়গাটাতে যাওয়ার। তার আবার খুব ইউনিক ইউনিক ইচ্ছা জাগে। লোকজন যা কিছুতে আকৃষ্ট সে তাতে আকৃষ্ট না। যেমন, বান্দরবান, সিলেট, কক্সবাজার এসব টুরিস্ট প্লেস তাকে টানে না। অন্যদিকে নিঝুম দ্বীপে লোকজন ঘুরতে যায়না বললেই চলে সেখানে যাওয়ার তার খুব ইচ্ছা।

টায়রা অসহযোগ গলায় বলল, 'এ্যাহ...নোয়াখালী?'
'হ্যাঁ নোয়াখালী তো কি হয়েছে? চল না যাই প্লিজ বোন। আমার কতোদিনের শখ।'
'আচ্ছা চল। লঞ্চে করে যাবো।'
'ওকে ডান।'

চলবে।

Masum, Tasmia haq, Sume akter, Hasibul hasan santo, Abul basar, Santa akter, Sk sagor and লেখাটি পছন্দ করেছে

avatar
Onu kotha
শুকতারা
শুকতারা
Posts : 56
স্বর্ণমুদ্রা : 1323
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-05-26

বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ Empty Re: বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ

Fri Jun 04, 2021 1:39 am
০৪.

আকাশে মুক্ত পাখিদের আনাগোনা। কিচিরমিচির শব্দে বাড়ি ফিরে যাওয়ার তাড়না আর একটুপরেই ডুববে সূর্য। ডুববে এই ধরণীতল আধার রাজ্যে। টিকলি রেডি হয়ে গেছে। মাথায় সাদা স্কাপ পরে গায়ে গোলাপি কামিজ জড়িয়ে হাতে একটা হলুদ কালারের ব্যাগ নিয়ে সে একবার ঘরের দরজার সামনে গিয়ে উঁকিঝুঁকি মারলো। তখন হুরমুড় করে দরজা ঠেলে ঘরে প্রবেশ করলো টায়রা। ক্ষনিকের জন্য ভয়ে টিকলির প্রাণ পাখি উড়ে গেলো। টায়রাকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। টায়রা গলার মুখের ঘাম মুছে হাঁপ ধরা গলায় বলল,

'সব রেডি টিকলি?'

'ইয়েস ডান। কিন্তু আমাদের ব্যাগ?'

নিজের কালো রঙের হ্যান্ড ব্যাগটা হাতে নিতে নিতে টায়রা নিচু গলায় বলল, 'ব্যাগপত্র সব রাতুলের বাসায়। কাল রাতে ওকে দিয়ে ওর বাসায় রেখেছি। লঞ্চ ছাড়ার ঠিক আধ ঘন্টা আগে এসে দিয়ে যাবে।'

রাতুল ওদের ব্যাচমেট। ছেলেটাকে বোকাসোকা পেয়ে টায়রা ওকে বাদর নাচন নাচায়। টিকলি প্রশ্ন করলো, 'কয়টায় লঞ্চ?'

টায়রা তখন নিজের আর টিকলির আর কিছু বাবা মায়ের ঘর থেকে চুরি করা টাকা গুনছিলো। টিকলির কথা শুনে ঠাস করে টাকা গুলোকে বিছানার উপর রেখে তেজি গলায় বলল,

'তোর জন্য আমরা পালাইতাছি। আর তুই জানোস না লঞ্চ কয়টায়? ভাই তুই কই থাকোস? দিন দুনিয়ার আছোস নাকি নাই?'

টিকলি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল, 'যাই হোক। আমরা তো এখনি বের হবো নাকি? বাবা মা কোথায়?'

'হুম এখনি বের হবো। সাড়ে পাঁচটায় লঞ্চ। লঞ্চের নাম এম ভি.তাসরিফ-১। ডাবল কেবিন নিয়েছি। ভাড়া ২২০০ টাকা।' টায়রা ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে বলল,

'আর এখন বাজে চারটা। বাবা মা বিকাল বেলা ঘুমোয় তা নিশ্চয়ই তুমি জানো? আমরা এখন বের হবো। সদরঘাট পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেজে যাবে পাঁচটা। তারপর রাতুল আসবে। আমরা ব্যাগ নিবো। লঞ্চে উঠবো। কেবিন খুঁজবো। তারপর কেবিনে ঢুকে পায়ের উপর পা তুলে নোয়াখালীর হাতিয়া চলে যাবো। সেখান থেকে নিঝুম দ্বীপ। আর কিছু জানার আছে?'

টিকলি চোখ ঘুরিয়ে বলল, 'না।'

'তাহলে চলো এবার।' টায়রা ব্যাগপত্র নিতে নিতেই বলল, 'টাকা গুলো তোর কাছে রাখ। আমি কেয়ারলেস। হারিয়ে ফেলবো।'

টিকলি টাকা গুনে নিয়ে বলল, 'আচ্ছা চল।'

দরজার মুখে এসেই দাঁড়িয়ে পরলো টায়রা। টিকলির মতো নখ কামড়াতে কামড়াতে বলল, 'ওই, কাজের লোকগুলো আছে তো।'

টিকলি তার চশমার নিচে বাম চোখ টিপে দিয়ে বলল, 'টেনশন নিস না। দুপুরে খাওয়ার সময় ঘুমের ওষুধ খাওয়ায় দিছি।'

বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে টায়রা ফিক করে হেসে দিলো। একটা হাই ফাই দিয়ে বলল, 'তুই মামা বহুত সেয়ানা। চশমার আড়ালে দেখাস ভদ্র বাচ্চা।'

'চল তো দেরি হয়ে যাচ্ছে। আব্বু আম্মু উঠে পরবে।'

____________________________

কাল রাত থেকেই উদাও খান বাড়ির দুই ছেলে। আজিম খান মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন এবং মনোয়ারা খান বিলাপ পেরে বৃথা চোখের পানি ভাসাচ্ছেন। আজিম খান কপালে হাত রেখে হাতের মুঠোয় ধরে থাকা চিঠিটাতে আরেকবার চোখ বুলালেন। চিঠিতে লেখা,

আমার সম্মানিত পিতা,

আমি আপনার একান্ত বাধ্যগত সন্তান। আপনার সকল সিদ্ধান্তকে আমি বরাবরই সমর্থন করে এসেছি। কিন্তু আমাকে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার মতো আপনার এই বিদগুটে অবান্তর সিদ্ধান্তকে আমি অসমর্থন করেছি প্রথম দিন থেকে। কিন্তু আপনি কথা শুনলেন না। আজ আপনার দেখা আরো একটি পাত্রীর সাথে আমাকে সাক্ষাৎ করিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা থাকলেও আপনার সেই ইচ্ছা পূরণ করতে পারছি না বলে আমি দুঃখিত। তাই যথারীতি আমি আমার আদরের ছোট ভাইকে নিয়ে বাড়ি থেকে ভেগে যাচ্ছি। যেদিন আপনার মাথা থেকে ভূত নামবে সেইদিন ফিরে আসবো। বিদায় আমার আব্বাজান।

ইতি,
আপনার ভদ্র ছোট বাচ্চার বড় ভাই।

মনোয়ারা খান বিলাপ পেরে হাত পা ছুড়ে কাদতে কাদতে বললেন, 'ওরে আমরা কি অপরাধ করেছিলাম রে বাবা? ফিরে আয়। মায়ের কোলে দুই ভাই ফিরে আয়। এই জন্নমে আর বিয়ে করার কথা বলবো না। তোর বাপ বললে তার মুখ আমি সেলাই করে দিবো।'

আজিম খান বিরক্তিতে কপাল কুচকালেন। আজ সারাদিন স্ত্রীর এই আহাজারি শুনতে শুনতে তিনি ক্লান্ত। চিঠিতে আরেকবার চোখ রাখলেন। তিনি জানেন এ চিঠি তার বড় পুত্রের লেখা নয়। এ চিঠি তার একমাত্র ধড়িবাজ ছোট ছেলে আর্দ্রর লেখা। কারন আদর কখনো এসব মেয়েলী কথাবার্তা বলবে না বা এতো অতিভক্তি চোরের লক্ষণ টাইপ কথার চিঠিও লিখবে না। সে লিখলে অতিসংক্ষেপে আসল কথাটি ই লিখতো। কিন্তু যেই লিখুক, ছেলে দুটো যে ভেগে যায়নি বরং কিছুদিনের জন্য গা ঢাকা দেওয়ার জন্য বাইরে গেছে এটা বেশ বুঝতে পারছে আজিম খান। একটা হতাশ শ্বাস ফেলে তিনি সোফা ছেড়ে উঠে নিজের ঘরে চলে গেলেন।

,

কাল সারারাত নিজের চেম্বারেই ছিলো আদর। লঞ্চটা সাড়ে পাঁচটায় হওয়ায় একদিন আগেই বাড়ি থেকে চলে যেতে হলো। কারন দিনের বেলা বাড়ি থেকে বের হওয়া ছিলো ভীষণ দুষ্কর। আর ভাইয়ের লেজ ধরে হাটিহাটি পা পা করে চলে এসেছে আর্দ্রও। এই চেম্বারেই দুই ভাই সারারাত হাসি ঠাট্টা, নাটক-মুভি দেখে পার করেছে।
পরের দিন সকাল হতেই রোগী দেখতে বসে গেছে আদর। বিকাল সাড়ে চারটা পর্যন্ত রোগী দেখে সে বের হয়েছে সদরঘাটের উদ্দেশ্যে।

আর্দ্র এলএলবি কমপ্লিট করে এখন ল' প্র‍্যাকটিস করছে এক নামিদামী উকিলের সাথে পাশাপাশি BJS (Bangladesh Judicial Service) এর প্রিপারেশন নিচ্ছে। BJS অনেকটা BCS এর মতো। এই পরীক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে মাজিস্ট্রেট বা জজ হওয়া যায়।

আর্দ্র আজ সারাদিন ছিলো তার এক বন্ধুর বাসায়। সদরঘাট থেকে বন্ধুর বাসা একটু দূরে হওয়ায় সে সাড়ে তিনটা সময় বেরিয়ে পরে লঞ্চের উদ্দেশ্যে।

_____________________________

মাথায় স্কাপ বেধে মুখে মাস্ক পরে দুইবোন দাঁড়িয়ে আছে। মিনিট দশেক হলো মাত্র রাতুল ব্যাগ দিয়ে গেছে। দুই বোনের হাতে মাঝারি সাইজের দুটো ট্রলি। দেখে মনে হচ্ছে তারা দিন পনেরোর ট্যুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা আরম্ভ করবে। মেয়ে মানুষ তো! সবকিছুতে বেশি বেশি। একদিনের জন্য কোনো জায়গায় বেড়াতে গেলে পাঁচ দিনের জামা-কাপড় নিবে।

ঘড়িতে পাচঁটা দশ বাজে। বৃষ্টির দিন হওয়ায় আশেপাশে কাদা কাদা মাটি। এমতাবস্থায় ঘাটে চলাফেরা করা একটু দুষ্কর্ম। একটু দূরেই দেখা যাচ্ছে হাওয়াই মিঠাই। মেঘলা আকাশ...বাতাসে ঠান্ডা আমেজ...আমোদিত সন্ধ্যা-বিকেল এর মাঝে হাওয়াই মিঠাই। টিকলি টায়রাকে বলল, 'শোন, তুই উঠ। আমি একটু আসছি।'

'মানে? কোথায় যাবি? লঞ্চ ছেড়ে দিবে। এমনিতেই আমরা আসতে দেরি করেছি।' টায়রার গলায় হালকা তেজ।

টিকলি ইশারায় সামনে দেখিয়ে বলল, 'তুই উঠ না, আমি হাওয়াই মিঠাই কিনেই আসছি।'

টায়রা বিরক্তি ভঙ্গিতে বলল, 'হইছে তোর যাওয়া লাগবো না। আমি যাইতাছি। তুমি লঞ্চে উইঠে আমারে উদ্ধার করো।'

'আচ্ছা তোর ব্যাগ রেখে যা। আমি উঠাচ্ছি। পরে ব্যাগ উঠাতে দেরি হয়ে যাবে।'
'পারবি? শিউর?'
'হান্ড্রেড পার্সেন্ট।'
'ওকে।'

টায়রা চলে যেতেই দুই ট্রলির দুই হাতল ধরে টিকলি নিজের শরীরের সমস্ত শক্তি ব্যয় করে হালকা একটু উপরে তুলতে পারলো। বলাই বাহুল্য, ট্রলি দুটো ভীষণ ভারী যা টিকলির এই ছোটোছোটো হাত দুটো তার ভর সইতে পারছে না। কাদা মাড়িয়ে যেতেই শ্যাতশ্যাতে একটা স্থানে বৃষ্টির পানি জমে যাওয়ায় পিছলে উল্টে পরে যেতে নিলো টিকলি। চোখ মুখ কুচকে চিল্লানোর আগেই একটা শক্ত পোক্ত হাত এসে জড়িয়ে ধরলো তার সূক্ষ্ম, মিহি, কোমল কোমড়টা।

বৃষ্টির দিনগুলোতে বিকাল হলেই মনে হয় রাত নেমে এসেছে। সে ক্ষেত্রে এই বৃষ্টির দিনে বেলা পাঁচটা পনেরোকে মনে হচ্ছে যেনো সন্ধ্যা সাতটা বেজে গেছে। আশেপাশে ট্রলার, লঞ্চ,জাহাজ গুলোতে অজস্র বাতি জ্বলে উঠেছে। কিছু লঞ্চ জাহাজ সাইরেন বাজিয়ে তাদের নির্দিষ্ট গন্তব্যে যাত্রা শুরু করেছে তো কিছু যানবাহন যাত্রা আরম্ভ করবে।

এই শ্যাতশ্যাতে কর্দমাক্ত জমিনের উপর নিয়ন্ত্রণ না রাখতে পেরে উল্টে পরে না গিয়ে কারোর উপর হেলে যাওয়ায় অবাক হলো টিকলি। ভয়ে কুচকানো চোখ জোড়ার পাটাতন আস্তে করে খুলল। সূর্য তখন ডুবি ডুবি। সেই ডুবন্ত সূর্যের হলুদ-লাল বৃষ্টিভেজা আলোয় মুখের ঠিক উপর হেলে পরে থাকা মাস্ক পরিহিতা এই ছেলের চোখ দুটো যেনো ভিষণ চেনা টিকলির। সাথে কপালটাও ভিষন রকমের চেনা। টিকলি উঠতে চাইলো কিন্তু কর্দমাক্ত এই জমিনে পা পিছলে আবারো পরে যেতে নিলো। প্রাণ বাঁচানো সেই ব্যাক্তি আবারো শক্ত করে ধরলো টিকলিকে। এরপর আস্তে করে উঠালো। কাদা-ছিট মাটিতে দাড় হবার পর ছেলেটার দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পরই বিস্ময় ঘেরা উঁচু গলায় তর্জনী আঙ্গুল দেখিয়ে টিকলি বলল,

'আপনি?'

কাদার কবল থেকে এই মেয়েটাকে পরতে পরতে বাঁচানোর পরও তার এহেন ভাবভঙ্গিতে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো আদর। সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার পর আদর খেয়াল করলো এই সেই মেয়ে। যার সাথে তার বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো। পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট মেয়ে। আদর নিজের বিস্ময় চেপে গিয়ে আমোদপূর্ণ খোঁচা দেওয়ার গলায় বলল,

'ওহ আপনি! পনেরো দিনের প্রেগন্যান্সির পেইন নিয়ে এই সদরঘাটেও চলে এসেছেন? মানতে হবে আপনার স্পিরিট আছে। হাটস অফ টু ইউ।'

নাকের পাটাতন ফুলিয়ে আঙ্গুল উঁচিয়ে যেই কিছু বলতে যাবে টিকলি ওমনি তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে আদর বলল, 'ওহ সরি। এখন তো আর পনেরো দিন না এখন তো আপনি এক মাস এক দিনের প্রেগন্যান্ট। বাহ! ভালোই ডেভেলপ হয়েছে দেখি! তা পেটের বাচ্চা কেমন আছে? লাথি টাথি দেয় এখনি?'

'দেখুন..।' টিকলির মুখের কথা কেড়ে নিয়ে আদর আবারো বলল,

'আবার দেখবো? এই দেখানোর অভ্যাস টা আপনার এখনো গেলো না? যাই হোক, আপনি যেমন সুপার ফাস্ট। বিয়ে করার জন্য ছেলে দেখতে গিয়ে বলেন, আপনি পনে..রো দিনের প্রেগন্যান্ট। ভাবা যায়? তার বাচ্চার পক্ষে এই একমাস একদিনে পেটের মাঝে ফুটবল খেলাও সম্ভব। নাথিং ইজ ইম্পসিবল। যাই হোক, আপনার বয়ফ্রেন্ড ফিরে এসেছে? ওই যে বলেছিলেন যে, একমাস আগে বয়ফ্রেন্ড উদাও আর আপনি পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট হলেন। এনিওয়ে, বাবা মাকে বলেছেন তো? আর আপনি না বললেও শুনেছি আমার বাবা নাকি বলে দিয়েছে..'

আদরের কথার মাঝেই টিকলি চেঁচিয়ে উঠে বলল,

'সাট আপ। আপনি তো মহা ফালতুবাজ ছেলে। আপনার মতো অসভ্য, অভদ্র, ইতর আমি আর একটাও দেখি নাই। আপনার বাবা আমার বাবাকে অপমান করেছে। আপনি আমাকে অপমান করছেন। পেয়েছেন টা কি হ্যা? যত্তসব। ভালোই হয়েছে আপনার ফ্যামিলির সাথে সম্পর্ক না হয়ে। এখনি যা রূপ ভবিষ্যতে কি করতেন আল্লাহ জানে।'

'কপাল ভালো তো আমার। সো কল্ড পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট মহিলাকে বিয়ে করতে হয়নি।' চোখ উল্টিয়ে আদর বলল।

'উউফফ...আপনি..আপনি একটা অসহ্য।' টিকলি ধপ ধপ শব্দ করে পা এগোলো লঞ্চের দিকে।

চলব।

Masum, Tasmia haq, Sume akter, Hasibul hasan santo, Abul basar, Santa akter, Sk sagor and লেখাটি পছন্দ করেছে

avatar
Onu kotha
শুকতারা
শুকতারা
Posts : 56
স্বর্ণমুদ্রা : 1323
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-05-26

বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ Empty Re: বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ

Fri Jun 04, 2021 1:40 am

০৫.
আকাশ ডেকে উঠছে বারংবার। কালো আকাশটা থেকে টিপটিপ বৃষ্টির ফোঁটা গুলো ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে শরীর। ছুয়ে দিচ্ছে হালকা করে গায়ের লোমকূপ। টায়রা দৌড়ে গেলো হাওয়াই মিঠাইওয়ালার কাছে। বৃষ্টি থেকে খানিকটা রেহাই পেতে মাথার উপর এক হাত দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,

'মামা দুটো হাওয়াই মিঠাই দেন তাড়াতাড়ি। '

সাথে সাথেই পাশ থেকে কেউ ভরাট জেদি গলায় বলল,

'মামা আমারটা আগে দেন।'

টায়রা অবহেলায় সূক্ষ্ম চোখে তাকালো পাশের সেই অজানা মানুষটার দিকে। এরপর আবার তাকালো হাওয়াই মিঠাইওয়ালার দিকে। তেজি গলায় বলল, 'আমি আগে চেয়েছি।'

আর্দ্র হচ্ছে পরিবেশবান্ধব। পরিবেশের সবকিছু তাকে সহজে আকৃষ্ট করে। অন্যদিকে আদর সবসময় নিজেকে গুটিয়ে রাখে। সে আকৃষ্ট হয় কম। কোনোকিছুতেই সে ভয়ানক রকম খুশি বা চমকায় না। সেদিক থেকে আর্দ্র ব্যাতিক্রম। এই রাস্তার ধারের মেয়েদের মতো ফুচকা, হাওয়াই মিঠাই, আইসক্রিম খেতে আর্দ্রর ভালো লাগে বৈ কি! অন্যদিকে আদর এসব দেখলেই নাক ছিটকায়। এখন হাওয়াই মিঠাই কিনতে এসেও আর্দ্র পরেছে আরেক বিপাকে। কোথা থেকে এক মেয়ে উড়ে এসে জুড়ে বসে তার সাথে পাল্লাপাল্লি করছে৷ হল্লা শুরু করে দিয়েছে। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আঙ্গুল উঁচিয়ে আর্দ্র নবাবি চালে বলল,

'এই যে ম্যাডাম আপনার আগে আমি এসেছি।'

টায়রা এবার পুরোদস্তুর ছেলেটার দিকে তাকালো। হলুদ ফর্সা তার গায়ের রং, থুতনিতে মাস্ক আটকে রেখেছে। উঁচু দাম্ভিক নাক, খয়েরি বর্ণের ঠোঁট, অতলান্ত গহীন এক জোড়া শক্ত চোখগুলো বিদ্যমান। বলিষ্ঠ স্পন্দমান তার দেহ, চওড়া বুক পিঠ। সাদা শার্ট টা খুব সুন্দর করে আটসাট ভাবে গেঁথে গেছে তার বলিষ্ঠ বুকটাতে। লোকটা দেখতে সুন্দর হলেও মুখের বুলি ক্যারক্যারা। টায়রা ফুসে উঠে বলল,

'আমি আগে চেয়েছি।'

পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে এই টিপটিপ বৃষ্টির মাঝে হালকা ভিজতে ভিজতে আর্দ্র বলল, 'জি না। আমি আগে এসেছি। আমি বলতে যাবো ওমনি আপনি হনহন করে হাওয়াই মিঠাই চেয়ে বসলেন।'

'সো আলটিমেটলি আমি ই আগে এসেছি।' টায়রা মুখ বাকিয়ে বলল। কিন্তু মাস্কের আড়ালে আর্দ্রর চোখে তা পরলো না।

আর্দ্র বিরক্ত চোখে চেয়ে বলল, 'আপনি তো ভারী চাপাবাজ মেয়ে।'

ফুসে উঠে টায়রা একটানে মুখ থেকে সাদার উপর নীল সুতোর নকশা করা মাস্কটা টান দিয়ে থুতনি পর্যন্ত নামিয়ে আনলো। দৃশ্যমান হলো তার ঠোঁট, নাক, গাল। টায়রার মনে হয়, মাস্ক পরে থাকলে মন মতো ঝগড়া করা যায় না। অপর মানুষটা তো তার রিয়েকশন ই বুঝবে না মুখ না দেখলে।

আর্দ্র দেখলো তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে রজনীগন্ধার ফুলের ন্যায় দস্যি এক মেয়ে। যেখানে সেখানে দস্যিপনা করাই যার একমাত্র প্রধান কাজ। বৃষ্টির ঠান্ডা জোরালো বাতাসে তখন ঘাটের এক পাশের কৃষ্ণচূড়া গাছ থেকে ঝড়ে পরছিলো লাল ফুল। বিছিয়ে দিচ্ছিলো রাস্তায় লাল গালিচা। রাগে লাল হয়ে যাওয়া টায়রার গাল, জিদে ফুলিয়ে রাখা ঠোঁট, ট্যাপা নাক, বড় কপাল, তেজে ছোট ছোট হয়ে আসা ভাসমান দুটি নয়ন... ইশশ কি সুন্দর সব! তার আকাশি স্কাপে মাথার অর্ধেক চুল ঢাকা। বৃষ্টির ফোটায় সম্মুখ ভাগের কালো চুলগুলো ঢেকে গেছে সাদা সাদা চিকচিকে মুক্তোর ন্যায় জ্বলজ্বল করা পানিতে। মেয়েটাকে দেখে আর্দ্র কথা হারিয়ে ফেলল গহীন জঙ্গলে। সেই জঙ্গলে কথা খুঁজতে গেলে অনেকটা সময় পার হয়ে যাবে এখন। এর মাঝে হাওয়াই মিঠাই নিয়ে হাওয়ায় উড়াল দিলো টায়রা।

এখন বাজে পাঁচটা বিশ। আদর ভাইয়ের ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করছে। নিচু গলায় একটু বিরবির করে সে বলল, 'এই ছেলেটা বড্ড কেয়ারলেস। মেয়েদের মতো শুধু তার ছুকছুক স্বভাব। কোনো দরকার ছিলো এখন হাওয়াই মিঠাই কিনতে যাওয়ার? গেলো তো গেলোই এখন আসছেও না।'

আদর এগিয়ে গেলো একটু। কিছু কদম যেতেই দেখা পেলো তার অতি বুদ্ধু ভাইটির। যে কিনা হাওয়াই মিঠাইওয়ালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক দৃষ্টিতে সম্মুখে চেয়ে। আদর এগিয়ে গিয়ে কাধে এক চাপড় মারলো। আর্দ্র লাফিয়ে উঠলো। এরপর ভাইকে দেখেই মাথা চুলকে হেসে দিলো। আদর বলল,

'থাপ্পড় দেওয়া দরকার। হা করে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো এখানে? চল।'

_____________________________

গোলাপি পায়জামা টার নিচের দিকটায় কাদায় মাখামাখি। টিকলির নাকে সাদার উপর গোলাপি কারুকাজ করা মাস্ক। ঠিক টায়রার মতো। ওরা দুই বোন একই জিনিস পরতে এবং একভাবে সাজতে ভালোবাসে।
নাক ছিটকে টিকলি দুই ব্যাগের হাতল ধরে অনেক কষ্টে টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো হঠাৎ কেউ ছু মেরে তার বাম হাত থেকে একটা ট্রলি নিয়ে হাটা শুরু করলো। টিকলি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। অবাক হয়ে দেখলো অগ্নিশর্মা টায়রা ঠক ঠক শব্দ তুলে জোরেসোরে ট্রলি টা নিয়ে যাচ্ছে।

কেবিনের দরজার সামনে এসে টিকলি জিজ্ঞেস করলো, 'কি হয়েছে?'

ওদের মধ্যে আবার কোনো আড়াল টাড়াল চলে না। দুজনের কাছে সবসময় সত্যি কথা বলার ওয়াদা বদ্ধ তারা। টায়রা ফুসে উঠে টিকলির হাতে ঠাস করে একটা হাওয়াই মিঠাই ধরিয়ে দিয়ে বলল, 'তোমার এই হাওয়াই মিঠাইয়ের জন্য আজকে আমাকে অপমানিত হতে হলো।'

টিকলি অবাকপ্রসন্ন গলায় বলে, 'অপমান করেছে? তোকে? এ বুকের পাটা কারোর হয়েছে বুঝি? কেউ একটা বললে তো তুই দশটা শুনিয়ে দিস।'

টায়রা গরম চোখে তাকালো টিকলির দিকে। কেবিনের ভেতর ঢুকে টিকলি মাস্ক খুলে জোরালো এক শ্বাস নিলো। টায়রা এতোক্ষন বাদে টিকলির দিকে ভালো ভাবে নজর দিতেই উঁচু গলায় বলল, 'হায়হায়! তোর পায়জামার কাদা কেনো? কার সাথে কুস্তি লড়ছস?'

বিরক্তিতে তেঁতো হয়ে গেলো টিকলির মুখ। চোখে মুখে আরক্তিম ভাব ফুটিয়ে সে বলল, 'লঞ্চে উঠার সময় পা পিছলে কাদার মধ্যে পরে যেতে ধরেছিলাম। তখন একটা ছেলে এসে আমাকে বাঁচায়। তখনি বোধ হয় কাদা লেগেছে?'

টায়রা একটু ভেবে ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করলো, 'কোন ছেলে?'

'যার সাথে আমার বিয়ের হওয়ার কথা ছিলো।' চোখে মুখে তিক্ত ভাব ফুটিয়ে টিকলি আবারো বলল, 'ছেলেটা মারাত্মক ফাজিল, ফালতু এবং অসভ্য, অভদ্র। আমাকে আজ আবারো খোঁচা দিয়ে অপমান করেছে।'

বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে টায়রা বলল, 'হাইরে! তোকে চিনে ফেলছে? এখন যদি বাবাকে ফোন দিয়ে বলে আমরা সদরঘাটে?'

কপালে ভাঁজ ফেলে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে টিকলি বলল, 'পাগল নাকি তুই? সে কেনো বাবাকে বলতে যাবে? সে জানবে কিভাবে আমরা পালাচ্ছি? তাছাড়া আমাদের সাথে কি তার কোনো সম্পর্ক আছে? সে আমাদের কেউ হয়? সে বলার কে? আশ্চর্য!'

টায়রা গালে হাত দিয়ে বসলো। টিকলি পাওয়ার লেন্সটা খুলে চোখে তার মোটা ফ্রেমের চশমা লাগালো। মাস্ক পরা অবস্থায় টিকলি চশমা পরে না তখন সে চোখে লেন্স লাগায়। কারন মাস্কের জ্বালায় কিছুক্ষন পরপর চশমা ঘোলা হয়ে যায়। তখন চলতে ফিরতে অসুবিধা হয়।

পোশাক চেঞ্জ করে চোখে চশমা লাগিয়ে টিকলি বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে বলল, 'উফফ..ফাইনালি টেনশন ফ্রি।'

টায়রাও হাপ ছেড়ে বাঁচা গলায় বলল, 'হুম।'
'যা চেঞ্জ করে আয়। বৃষ্টিতে তো ভিজে গিয়েছিস। ঠান্ডা লাগবে।'

টায়রা চলে গেলো ওয়াশরুমে। লঞ্চ সাইরেন বাজালো। বোধ হয় এখনি যাত্রা আরম্ভ করবে। লঞ্চ ছাড়তে ছাড়তে বেজে গেলো প্রায় ছয়টা। ঘন কালো ধূসর রঙের আকাশটাতে পরিবেশ কালো হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। টায়রা ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় বসলো। একটু পর মাগরিবের আজান দিলো। টিকলি নামাজ পড়ে উঠে ফোন হাতে নিতেই দেখলো ফোনটা সাইলেন্ট এবং মায়ের নাম্বার থেকে তিনটে মিসড কল। টিকলির হাতে ফোন থাকা অবস্থাতেই মায়ের নাম্বার থেকে আবারো কল আসলো। শ্বাসরুদ্ধ গলায় সে বলল,

'টায়রা, মা ফোন দিয়েছে।'

টায়রা তখন বোতলে মুখ লাগিয়ে পানি খাচ্ছিলো। টিকলির কথা শুনে তার মুখ থেকে ছিটকে পানি পরে গেলো। চোখ মুখ লাল করে সে কাশতে লাগলো। টিকলি টায়রার পিঠে হাত বুলালো কিছুক্ষন। এদিকে শায়লা আক্তার ফোন দিয়েই যাচ্ছেন। টায়রা এবার তেজি গলায় বলল,

'তুই ফোন অফ করস নাই?'

'মনে ছিলো না। আর মনে থাকবে কেমনে আমি তো সারাদিনে দুইবারও ফোন হাত দিয়ে ধরি না।'

টায়রা আদেশরূপে বলল, 'তাড়াতাড়ি অফ কর যা।'

ফোনের স্কিনে ভেসে উঠেছে মায়ের হাস্যোদ্দীপক মুখখানা। গেঁজ দাঁত তার ঝিলিক দিচ্ছে। শ্যামলা মুখখানাটাতে ভারী মায়া। টিকলি হয়েছে একদম মায়ের মতো শুধু তার গায়ের রং টা ফর্সা। বাবার রং পেয়েছে সে। অন্যদিকে টায়রা দেখতে একদম বাবার মতো কিন্তু তার গায়ের রং টাকে শ্যামলাও বলা যায় না আবার ফর্সাও বলা যায় না। মাঝখানে একটা। ফোন অফ করতে গিয়েও মায়ের মায়াভরা মুখখানা দেখে ফোন অফ করতে পারলো না টিকলি। অসহায় মুখে বলল,

'আম্মু চিন্তা করবে। আমি একটা মেসেজ পাঠিয়ে তারপর ফোন অফ করে দিচ্ছি।'

টায়রা মুখ বাকিয়ে বলল, 'মায়ের বাধ্য সন্তান রে..।'

আগেই বলেছিলাম, টায়রা একটু বেপরোয়া। কোনো দিকে তার হুশ নেই। চিন্তামুক্ত থাকতেই পছন্দ করে সে সবসময়। তার জীবনটা উচ্ছোন্নে গেলেও সে হাসিমুখে ঠাট্টার সুরে বলবে, 'এখন উচ্ছোন্নে যাচ্ছো যাও। কিন্তু ঠিক সময় আবার যথাস্থানে ভদ্রভাবে ফিরে এসো।'

অন্যদিকে টিকলি বিনয়ী, তেজি, মারাত্মক ঠান্ডা মেজাজের রাগী। চারিপাশে মানুষজনদের নিয়ে তার ভাবনার একশেষ। নিজের প্রতি সে কেয়ারলেস। চিন্তারা সারাক্ষন তার মাথায় কিলবিল করতে থাকে। এক মিনিটের জন্যেও শান্তি দেয় না। সবার প্রশান্তিতেই তার সন্তুষ্টি। বাড়ির বড় মেয়েগুলো বুঝি টিকলির মতোই হয়। আর ছোট গুলো টায়রার মতো।

টিকলি মেসেজ পাঠালো, 'আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে কেনো লেগেছো মা? আমি চলে যাচ্ছি। যেইদিন তোমাদের ঘাড় থেকে এই ভূত নামবে এবং মেয়ের মর্ম বুঝতে পারবে সেইদিন ফিরবো। আর টায়রা আমার সাথে আছে। চিন্তা করো না। ভালো মতো থেকো। লাভ ইউ মা।'

টায়রা এবার একটু চিন্তিন মুখে বলল, 'আচ্ছা ওই ছেলে এই ঘাটে কি করছিলো?'

'কোন ছেলে?' টিকলির প্রশ্ন।

'ওই যে যার সাথে তোর বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো। ধুর ছাই নামটাও জানি না। তুই এমন কেনো বল তো? যার সাথে বিয়ে করতে যাবি তার নামটাও জানিসনি। এমনকি মুখটাও দেখিসনি। আমি হলে চোদ্দগুষ্টির নাম মুখস্ত করে যেতাম। আর ছেলের মুখ দেখা ছাড়া তো নরতামই না। যতই বিয়ে না করি।'

'আমি তো তুই না। আমি তো আমিই।' চশমাটা ঠিক করে চোখে লাগিয়ে বলল টিকলি।

'হুম বুদ্ধিহীন, নির্বোধ, সহজ-সরল বালিকা। যাই হোক, কি করছিলো সে?'

'আমি কি তার বিয়ে করা বউ? আমি সবকিছু জেনে বসে আছি?' টিকলির তেরছা উত্তর।

'তাও ঠিক। কিন্তু তুই জাতির বউ। বিয়ের আগে সব ছেলেমেয়ের একে অপরের উপর পঁচিশ পার্সেন্ট অধিকার থাকে। আমার উপরেও আছে ডোন্ট ওয়ারি। চাপ নিও না ময়না।' টায়রা বাম চোখ টিপে বলল। টিকলি হেসে টায়রার পিঠে দুম করে একটা কিল বসিয়ে দিলো।

টায়রা ছোট ছোট চোখ করে বলল, 'হাসতে হাসতে মারো? ভালোই তো টেকনিক শিখছো বনু।'

চলবে

Masum, Tasmia haq, Hasibul hasan santo, Abul basar, Santa akter, Sk sagor, Sk imran and লেখাটি পছন্দ করেছে

avatar
Onu kotha
শুকতারা
শুকতারা
Posts : 56
স্বর্ণমুদ্রা : 1323
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-05-26

বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ Empty Re: বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ

Fri Jun 04, 2021 1:41 am

০৬.

কেবিনের মুখে ঢুকতেই ভাইয়ের জুতো আর প্যান্টে নজর পরলো আর্দ্রর। আহত গলায় সে বলল, 'ভাইয়া, শরীরে কাদা লাগলো কীভাবে? তোমার নতুন জুতো!'

তরজমাকারী গলায় আদর বলল,

'তুই হাওয়াই মিঠাই আনতে গেলি আমি তখন ঘাটে দাঁড়িয়ে তোর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তখন দেখলাম একটা মেয়ে! কাধে ভেনিটি ব্যাগ। দু'হাতে আবার দুটো মাঝারি সাইজের ট্রলি ব্যাগ। মেয়েটা ব্যাগের ভার সইতে না পেরে কাদার মাঝে পরে যাচ্ছিলো প্রায়। আমি গিয়ে তড়িঘড়ি করে তাকে বাঁচালাম। পরে দেখি...

'পরে দেখো?' আর্দ্র ভ্রু কুচকালো।

হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে আদর বলল, 'পরে দেখি এই সেই পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট মেয়ে।'

আর্দ্র কিছুক্ষন থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে শব্দ করে হেসে দিলো। 'পনেরো দিনের প্রেগন্যান্সি' এই কথাটা শুনলেই তার ভীষণ হাসি পায়। আর্দ্র জিজ্ঞেস করলো, 'চিনলে কীভাবে? মানে তুমি তো আর মুখ দেখোনি মেয়েটার।'

আড়চোখে তাকিয়ে আদর উত্তর দিলো, 'আজও মাস্ক পরা ছিলো। একদম কাছ থেকে দেখেছি বলেই চিনেছি।মেয়েটার ডাকিনী ভয়েস শুনে পুরোপুরি শিউর হয়েছি। মেয়েটাই আগে আমাকে চিনতে পেরেছে।'

আর্দ্র হাসলো কতক্ষন। আদর তার শখের নতুন কালো সু জোড়া খুলল। ট্রলি থেকে প্যান্ট আর শার্ট বের করতে করতে জিজ্ঞেস করলো,

'হাওয়াই মিঠাইয়ের সামনে ওমন হা করে দাঁড়িয়ে ছিলি কেনো?'

আদরের প্রশ্নে আর্দ্র একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। শুকনো কাশি দিলো। আসলেই তো সে ওই চাপাবাজ মেয়েটার দিকে ওমন হা করে তাকিয়ে ছিলো কেনো? বলতেই হবে মেয়েটা মারাত্মক লেভেলের বেয়াদব। মানে চূড়ান্ত লেভেলের বেয়াদবের চেয়েও এক ধাপ উপরে। বিরক্ত গলায় আর্দ্র বলল,

'আর বলো না, একটা মেয়ে ঝগড়া শুরু করেছিলো। গিয়েছি আমি আগে বলে কিনা মেয়েটা আগে গিয়েছে এবং হাওয়াই মিঠাই তাকেই আগে দিতে হবে। এ তার একমাত্র দাবী। আমিও কম না। আমি আগে গিয়েছি সে আগে কেনো নিবে? ব্যস, ঝগড়া লেগে গেলো। এক পর্যায়ে ঝগড়া করার মাঝে মেয়েটা তার মাস্ক খুলে ফেলল। মেয়েটাকে দেখেই আমি মিনিট খানিকের জন্য অতল সমুদ্রে ডুবে গেলাম। সেই ডুবন্ত আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম না কারোর হদিস, শুনিছিলাম না কারোর বাচ্য। শুধু চোখের সামনে দেখছিলাম অপরূপ সেই নারী।'

আর্দ্র একবার বলা শুরু করলে বেশি বলে ফেলে। নিজের অজান্তেই কখন কি বলে তাও সে জানেনা। এই যেমন এখন, এই কথাগুলো কিন্তু সে একদমই বলতে চায়নি। একদমই না মানে একদমই না। কিন্তু ওই যে কথা শুরু করলে মুখ দিয়ে আপনা আপনি বেরিয়ে আসে তার। তাই বলে ফেলে। কথাগুলো বলে আর্দ্র গোপনে জিহবা কাটলো। আদর ভাইয়ের কাধ চাপড়ে বলল,

'তোর এখন যেই রিলেশনটা আছে এটা যেনো কত নাম্বার?'

চোখ মুখ খিচে আর্দ্র জানান দিলো, 'পনেরো নাম্বার।'

আদর অবাক হলো। মুখশ্রী হয়ে উঠলো আগুনের গোলার ন্যায় লাল। মুখের ভেতর তিক্ত অনুভূতি হলো। আবার? আবার সেই পনেরো? ইশশ..এই পনেরো কেনো ছাড়ছে না আদরের পিছু? বারবার ভুলতে চায় সেই পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট মেয়েকে। কিন্তু কোনো না কোনো উপায়ে সেই বোকা মেয়ের কথা তার মনে আসছেই। কি করবে আদর? কীভাবে সুরাহা হবে এই সমস্যা? আর্দ্রর মুখপানে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় আদর বলল,

'আর তোর থেকে তিনবছর বড় হওয়া সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত একটাও প্রেম না করা আমি। তারউপর প্রেম চলাকালীন তুই অন্য মেয়েকে এক দেখায় অতল সমুদ্রে ডুবে যাস!'

আদর ঢুকে পরলো ওয়াশরুমে। আর্দ্র পেছন থেকে জোরে জোরে চেঁচিয়ে বলল,

'ভাইয়া, তুমি যেমন ভাবছো তেমন না। ওই ঝগড়ুটে চাপাবাজ মেয়েকে আমি মোটেও পছন্দ করিনা। শুধু ক্ষনিকের জন্য কি যে হলো ঠিক ঠাহর করতে পারলাম না।'

শেষের কথাগুলো আর্দ্র আস্তে আস্তে কাদো কাদো গলায় বলল। এরপর নিজের সিদ্ধান্তে অটল এমন জেদী গলায় বলল, 'ওই চাপাবাজ মেয়েকে তো আমি দেখে নিবো। ও সুযোগ বুঝে আমার আগে হাওয়াই মিঠাই নিয়ে পালিয়েছে। বেয়াদব মহিলা একটা।'

____________________________

লঞ্চের বারান্দার মতো সাইডে রেলিং ঘেঁষে দাড়িয়ে ছিলো আদর। আকাশে মস্ত বড় এক রূপালী চাঁদ। রূপোর আলোয় চারিদিকের অথৈ নির্জনতার পানিতে চিকচিক করে চাঁদের প্রতিবিম্ব ফুটে উঠেছে। আদরের এই উনত্রিশ বছরের জীবনে কখনো প্রেম আসেনি। ভালোবাসা হয়নি। বাতাসে সে প্রেম প্রেম ভাব পায় কিন্তু গন্ধ পায়না। কিন্তু আজ এই লঞ্চের সাথে চলমান সন্ধ্যার বাতাসটা যেনো ভারী স্নিগ্ধ এবং মোলায়েম! বলতে নেই, আজ হঠাৎ এই প্রথম আদর বাতাসে প্রেম প্রেম গন্ধ পাচ্ছে। সত্যি কি পাচ্ছে? নাকি মনের ভুল?

,

টিকলি দাঁড়িয়ে ছিলো রেলিং ঘেঁষে একমনে আকাশটার দিকে তাকিয়ে। আবহাওয়া ভালো নয়। বাতাস বইছে খুব জোরে। ঢেউ উঠছে অনেক বড় বড়। লঞ্চ চলছে আস্তে আস্তে। এবং একটু পরপর একবার এদিক তো আরেকবার ওদিক হেলছে প্রবল ঢেউয়ের কবলে পরে।

টিকলিকে এক দেখায় কেউ চিনে উঠতে পারবে না। মেয়েটার নিখুঁত সুন্দর মুখখানা মনে রাখতে কারোর বার কয়েক তার দিকে গভীর নয়নে তাকাতে হবে। তার উপর যদি মাস্ক পরা থাকে তাহলে তো কথাই নেই। মাস্ক পরা টিকলি এবং শুধু টিকলির মাঝে তফাৎ আছে। সহজে কেউ ধরতে পারবে না মাস্ক পরা মেয়েটি টিকলি ছিলো। আদরের সাথে যে দুইদিন টিকলির দেখা হয়েছে দু'দিন ই তারা দুজন মাস্ক পরা ছিলো। মাস্ক পরা অবস্থায় টিকলি সবসময় মাথায় স্কাপ দেয়। চোখে লেন্স পরে। আর এমনিতে সে স্বাভাবিক এবং চশমা পরে থাকে। তবে কেউ যদি অতি সূক্ষ্ণ ভাবে তাকে পর্যবেক্ষণ করে তাহলে এক দেখায় তার হাটাচলা দেখে বুঝে ফেলতে পারবে।

বড় এক ঢেউয়ের কবলে পরে লঞ্চটা আবার একটু বাম সাইডের দিকে হেলে পরলো। ব্যালেন্স না রাখতে পেরে টিকলি আছড়ে পরলো কোনো মানুষের উপর। মানুষটা তড়িঘড়ি করে প্রায় অবচেতনায় ধরে ফেলল অসর্তক সেই মেয়েটিকে।

,

রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে লঞ্চটা একটু হেলে পরলো। আদর অনেক কষ্টে ব্যালেন্স রাখতে পারলেও নিজের উপর হঠাৎ কোনো ভারী বস্তু পরে যাওয়ায় সে কয়েক কদম পিছিয়ে গেলো। তাড়াতাড়ি করে ধরলো সেই আগুন্তক নারীকে। মেয়েটা আস্তে করে তার মাথা উঠালো। লঞ্চের নীল-সাদা আলোয় মেয়েটার মুখ আলোড়িত ঝিলিক দিয়ে উঠলো। আদর দেখলো, সদ্য ফুটে উঠা ভোরের শিশিরে ভেজা গোলাপের ন্যায় মেয়েটার শ্রীময়ী মুখখানা। চোখে তার কালো রঙের চশমা মানিয়ে গেছে ফর্সা গায়ের রঙে। টিকলো নাকটা যেনো খুব সুন্দর করে বানিয়েছেন সৃষ্টিকর্তা। নিখুঁত সুন্দর লাল ঠোঁট দুটোর ভাঁজে ভয়ের ছাপ। ফোলা গাল দুটো আলুর মতোন। যেনো আলাদা করে এই ছিপছিপে মুখটার গালের অংশে মাংস লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু মেয়েটার চোখ আবিষ্কার করা গেলো না। চশমার আড়ালে মেয়েটার সূক্ষ্ম ব্যাক্তিত্ববান আঁখি দুটো ঢেকে গেছে খুব সন্তর্পণে । কিন্তু এই কপাল! এই কপাল এবং কপালের দু পাশ থেকে শুরু হওয়া গোছানো একগাছি চুল গুলো যেনো তার চেনা। খুব চেনা! কিন্তু এই মুহুর্তে মস্তিষ্ক ঠিক ঠাওর করতে পারছে না। আদর আরেকবার তাকালো। তখনি এক গভীর মনপ্রাণ বলে উঠলো স্রোতশূন্যে গা ভাসিয়ে,

"সে নয় তো কোনো সাধারণ নারী,
সে ছিলো যে এক ব্যক্তিত্ববান রানী।"

টিকলি আস্তে আস্তে মেঝেতে পা ফেলে সোজা হয়ে দাড়ালো। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই শ্যামল ছেলেটার পানে সে চোখ তুলে তাকিয়ে ছিলো অনেক্ক্ষণ। কপালের উপর দু একটা চুল অযত্নের সহীত পরে আছে তার। ভ্রুর নিচে এক জোড়া বুদ্ধিদীপ্ত, তীক্ষ্ণ, সতর্কমূলক চোখ। এই চক্ষু যখন চাহিয়া মেলিলো টিকলিরো পানে, টিকলির প্রাণভোমরা তখন টপাস করিয়া লুটিয়া পরিলো প্রায় মৃত হইয়ে। তার উঁচু এক নাক। যেনো হেলিকপ্টার গেলে নাকের সাথে ঘর্ষণ লাগবে। পুরু এক জোড়া ঠোঁট। যেই ঠোঁটের ভাঁজে রয়েছে গোলাপের সুগন্ধি। চাপা গাল দুটোর ভাঁজে না বলার অভিমানী কথা সাঁজে। চেহারায় দাম্ভিকতা এবং গম্ভীরতার ছাপ। কিন্তু কেনো জানিনা টিকলির মনে হলো এই অপরূপ সুন্দর পুরুষটিকে সে কোথাও দেখেছে। কোথাও! এই চোখ, কপাল এবং কপালের সাথে মিশে থাকা চুলগুলো তার বড্ড চেনা। বলিষ্ঠ মসৃণ ছেলের বুক, চওড়া প্রশস্ত কাধ। টিকলি কপালে ভাঁজ ফেলে চেনার চেষ্টা করলো। কিন্তু নাহ..পারলো না। অতঃপর সে নিচু মোলায়েম গলায় বলল,

'সরি।'

আদর একটু অবাক হলো। এই মেয়ের মিস্টি গলার স্বরটাও তার কিছুটা চেনা চেনা লাগছে। অনেকটা সেই পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট মেয়েটার মতো। কিন্তু তা কীভাবে সম্ভব? কোথায় সেই মেয়ে আর কোথায় এই মিস্টি দেখতে মেয়েটা! আদর বলল খুবই নরম সুরে,

'ইটস ওকে। নো প্রবলেম।'

টিকলি চকিতেই তাকালো। এই কণ্ঠধ্বনি তার চেনা! অনেকটা সেই অভদ্র ছেলের মতোন। আদর আবারো বলল ভদ্র সুরে,

'আপনার লাগেনি তো কোথাও?'

টিকলির মনের ভাবটা কেটে গেলো। কর্পূরের মতো উবে গেলো অচীন কোনো রাজ্যে। নাহ, আর যাই হোক এই ছেলে সেই অভদ্র লোকটা হতে পারেনা। দুনিয়ায় তো একই রকম দেখতে মানুষ আছে। আর কিছুটা ভয়েস মিল মানুষ হতে পারে না? সেই ছেলে কেমন কর্কশ গলায় কথা বলে আর এই ছেলে কি মিস্টি সুরে কথা বলছে! ওই লোকের মধ্যে সবসময় কাঠিন্যতা, গাম্ভীর্য, অহংকার ভাব। সবসময় মানুষকে হেয় করে খোঁচা দিয়ে অপমান করে কথা বলা। আর এই লোকের কথার সুরের মাঝে স্নিগ্ধতা, মোলায়েম, আবেশ! আস্তে করে টিকলি উত্তর দিলো,

'নাহ লাগেনি। আপনার?'

আদর এবার নিশ্চিত, এই মেয়ে কিছুতেই সেই বোকা, অভদ্র, মেনারলেস মেয়ে হতে পারেনা। সেই মেয়ের গলা দিয়ে তো যেনো আগুনের ফুলকি ঝরে। আর এই মেয়ের গলার সুরে কোমলতা। ভেজা গন্ধরাজের ন্যায় মসৃণ। যেনো এক সূর্যমুখী ফুল। আর ওই মেয়ে তো একটা গাঁদা ফুল। আদরের মনও যেনো ওই মেয়েটার কথা কর্কশভাবে ভাবে। আদর মাথা নাড়িয়ে বলল,

'নাহ।'

তখনি ওদের দুজনকে ডাকতে এলো আর্দ্র ও টায়রা। মুখোমুখি হতেই আর্দ্র ও টায়রা বিপন্ন-বিস্ময়ের গলায় তর্জনী আঙ্গুল উঁচিয়ে দুজন একসাথে বলে উঠলো,

'আপনি?'

মাঝখান থেকে এতো সুন্দর পরিবেশটায় এমন কর্কশতার গলায় ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো আদর ও টিকলি।

চলবে

Masum, Tasmia haq, Sume akter, Hasibul hasan santo, Abul basar, Santa akter, Sk sagor and লেখাটি পছন্দ করেছে

avatar
Onu kotha
শুকতারা
শুকতারা
Posts : 56
স্বর্ণমুদ্রা : 1323
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-05-26

বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ Empty Re: বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ

Fri Jun 04, 2021 1:42 am

০৭.

লঞ্চের এই পেছনের দিকটায় মানুষের আনাগোনা কম। ভারী বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলেছে আর্দ্র ও টায়রার তীব্র নিঃশ্বাস। প্রকান্ড তেজি শ্বাস প্রশ্বাসেই যেনো দুজনা দুজনকে জ্বলসে দিবে। টিকলি এগিয়ে এসে বলল,

'কি হয়েছে?'

টায়রা সাথে সাথে ফুসে উঠে বলল, 'কি হয়নি সেটা বল। এটাই সেই বেয়াদব ছেলে। হাওয়াই মিঠাই নিতে গিয়ে আমার সাথে ঝগড়া করেছে।'

আর্দ্র বড় বড় চোখ করে লাফিয়ে উঠলো। আদর ভ্রু কুচকে তাকাতেই আর্দ্র কপট স্বরে বলল, 'মিথ্যা কথা ভাইয়া। এই চাপাবাজ মেয়ে আগে আমার সাথে ঝগড়া করেছে। আপনি তো দেখা যায় চাপাবাজের সাথে মিথ্যাবাদীও।'

টায়রা বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে নালিশ ঠুকার মতো টিকলির কাছে বলল, 'দেখলি? এই বেয়াদব ছেলে আমাকে চাপাবাজ সাথে মিথ্যাবাদীও বলছে। ওকে তো আমি....'

টায়রা ছুট লাগায় আর্দ্রর দিকে। উদ্দেশ্য আজ মারামারি, কাটাকাটি, রক্তারক্তির গাঙ ভাসিয়ে দেওয়া। টিকলি ঝাপটে কোমড় জড়িয়ে ধরে টায়রাকে আটকালো। কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তির পর ধমকের সুরে বলল,

'কি হচ্ছে টা কি? সব জায়গায় পাগলামি করিস কেনো?'

আর্দ্র বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। আদর গরম চোখে তাকালো। সাথে সাথে চুপসে গেলো সে।

টিকলির দিকে এক পলক রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে টায়রা হনহন করে চলে গেলো। অসহায় মুখে টিকলি তাকিয়ে থাকলো বোনের যাওয়ার পানে। আদর ইশারায় আর্দ্রকে যেতে বলে। আর্দ্র বাধ্য ছেলের মতো থমথমে মুখে অন্যপাশে চলে যায়।

গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এসে আদর টিকলির পেছনে দাঁড়ালো। টিকলি তখন মন খারাপ করে উঁকিঝুঁকি করে দেখছিলো টায়রা কোথায় গেলো? আদর মাথাকে একটু নিচে নামিয়ে আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো, 'মন খারাপ হলো?'

টিকলি চমকে তাকালো। উড়ে আসা ছোট ছোট চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে দিয়ে জোরপূর্বক মিস্টি হেসে বলল, 'নাহ।'
'কিন্তু দেখে তো মনে হচ্ছে ভীষন বিষন্ন আপনি।'
'নাহ আমি আসলেই এমনি। সবসময় এরকমই থাকি।'
'ওহ।'

আদর আর কোনো কথা খুঁজে পেলো না এই মুহুর্তে। অস্বস্থিতে জর্জরিত হয়ে উঠলো টিকলির মন-প্রাণ। সে একটু এলোমেলো গলায় বলল, 'এখন আসি তবে। আসলে টায়রা কোথায় গেলো দেখতে হবে। মেয়েটা আবার প্রচন্ড বদমেজাজি।'

আদর হালকা হেসে বলল, 'টায়রা কি ওই মেয়েটার নাম? সে কি আপনার বোন হয়?'

'জি।'

'আপনারা কি টুইন? কিন্তু চেহারার তো তেমন মিল নেই।'

হেসে দিয়ে টিকলি বলে, 'নাহ। ও আমার চেয়ে এক বছরের ছোট। কিন্তু আমরা একসাথেই থাকি এবং একইসাথে পড়ি। আমাদের আবার গলায় গলায় ভাব।'

আদর হাসলো। অবাক বিষয়! হাসির কোনো কারণই ছিলো না তবুও অযথা হাসছে সে। ভারি আশ্চর্য তো! বলতে নেই, এই মুহুর্তে আদরের চোখে চারিপাশ রঙিন লাগছে। এই রাতের বেলায়ও দিনের লালচে-সোনালির আলো খুঁজে পাচ্ছে। মনে হচ্ছে, গাছে শত ফুল ফুটেছে। নতুন পাতা এসেছে। বসন্তের কোকিল ডাকছে। কিন্তু এখন তো গ্রীষ্মকাল। কালবৈশাখী ঝড়ের দিন। তাহলে?

টিকলি বলল, 'আসি তবে।'

টিকলি চলে যেতে নেয়। সে বুঝতে পারলো না ক্ষনিকের জন্য তার অন্তরের ভেতর কি হয়েছিলো? কেনো এই লোকটাকে এতো কৈফিয়ত দিলো এবং হাসিমুখে এতো কথা বলল? লোকটা তো নিতান্তই একদম অপরিচিত তাই না? টিকলি চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে আরেক পা বাড়ালেই আদর তড়িঘড়ি করে উত্তেজিত কন্ঠে বলল,

'বলছিলাম যে, বোনের নামটা তো বললেন কিন্তু নিজের নাম?'

বেহায়াপনা করা আদরের ধাতে নেই। কিন্তু আশ্চর্য ভাবে সে আজ তাই করছে। তার সব নিয়ম নিমিষেই উল্টেপাল্টে যাচ্ছে। ভেঙে যাচ্ছে তার আত্মসম্মানের গন্ডি। টিকলি পেছন ফিরে তাকিয়ে একটু অবাক করা গলায় বলল, 'আমার নাম?'

'জি।'
'আমার নাম টিকলি। টিকলি রেজা।'
আদর হেসে একটু দুষ্টুমির স্বরে বলল, 'কি? টিকটিকি?'

চট করে আদরের দিকে তাকালো টিকলি। আজ পর্যন্ত কেউ কক্ষনো তার নামের বিকৃত রূপ বের করেনি। আর এই ছেলে কিনা মিনিট দশেকের মতো কথা বলার মধ্যে নাম বিকৃতি করে ফেলল। টিকলির ভারী রাগ হলো। থমথমে গলায় সে প্রশ্ন করলো,

'আপনার নাম কী?'

আদর গর্বের সহীত বলল, 'আদর খান।'

টিকলি একটু ভাবলো। আদর! কিন্তু নাহ...আদরের কোনো বিকৃতি নাম সে খুঁজে পেলো না। আর একটু ভাবার পর সে এক দারুন নাম উদঘাটন করলো। এরপর আদরের মতোই রসিকতার সুরে বলল,

'কিহ..বাদর? বাদর খান? বাদরদের আবার খান বংশও আছে বুঝি?'

ঠিক জায়গায় গোল দিয়ে দিয়েছে। মেয়েটা নিতান্তই ভীষণ চালাক। আদরের হাসিহাসি মুখটা মিলিয়ে গেলো। গম্ভীর মুখে সে বলল, 'ডোন্ট কল মি বাদর, মাই নেম ইজ আদর।'

টিকলি ফিক করে হেসে দিয়ে আদরের মতো করেই গম্ভীর স্বরে বলল, 'দেন ইউ অলসো ডোন্ট কল মি টিকটিকি, মাই নেম ইজ টিকলি।'

আদর মাথা চুলকে হাসলো। বলল, 'ছাদে যাবেন?
'ছাদে?'
'হুম।'
টিকলি একটু চিন্তা করে বলল, 'যাওয়া যায়। কিন্তু টায়রাকে ছাড়া...। দাড়ান, আমি টায়রাকে ডেকে আনছি।'

_____________________________

লঞ্চের ছাদে দাঁড়িয়েছিল টায়রা। অপ্রত্যাশিত ভাবে সেই ছাদেই উপস্থিত হলো আর্দ্র। ঠান্ডা বাতাসে খোলা আকাশের নিচে মন ভালো করার জন্য এসেছিলো সে। কিন্তু এসে দেখলো এই চাপাবাজ মেয়ে এখানেও উপস্থিত। তেজে আর্দ্রর মুখখানা লাল রঙা হয়ে উঠলো। উল্টো পা বাড়ালো চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। এক কদম হেটেই ভাবলো, 'থাক একটু জ্বালাই। আফটার অল আমার আগে হাওয়াই মিঠাই নিয়ে চলে এসেছিলো। তার শোধ তুলতে হবেনা?'

,

টায়রার মনটাতে তখন বিষন্নতার সুর। এখন বুঝি বিষাদ সময়। তাই উজ্জ্বল সারাদিন প্যাক প্যাক করা বাঁচাল টায়রার মনে উদাসীনতা। হঠাৎই এই বিষাক্ত বাতাসকে ছাপিয়ে কানের কাছে কেউ টেনে টেনে বলে উঠলো,

'মিস. চাপাবাজ।'

টায়রা একটু চমকে উঠলো কিন্তু বুঝতে পারলো আগুন্তকের কণ্ঠধ্বনি। উল্টো ঘুরে গরম গলায় শুধু বলল,

'বেয়াদব!'

আর্দ্র মুখটাকে একটু পাংশুটে বানালো। এরপর হাসিহাসি মুখ করে আবারো বলল, 'নাম কী?'

'নাম দিয়ে কাম কী?' টায়রার অকপট উত্তর।

নদীর জলরাশির দিকে তাকিয়ে আর্দ্র বলে, 'নাহ তেমন কোনো কাজ নেই। নাম না বললেও সমস্যা নেই। আমি মিস.চাপাবাজ বলেই নাহয় ডাকবো।'

পরাজিত গলায় তেজ টেনে টায়রা বলল, 'টায়রা রেজা।'

শুনতে পায়নি এমন ভান করে আর্দ্র বলে,

'কি কি কি? টায়ার রেজা? কোন টায়ার? বাসের না ট্রাকের? ছে ছে ছে! আপনার বাবা মা আর নাম পায়নি শেষে কিনা টায়ার? আমাকে বললেও তো আমি আপনার একটা সুন্দর নাম রেখে দিতে পারতাম। সমস্যা নেই মিস. চাপাবাজ এই টায়ার নামের থেকে ঢের বেশি ভালো এবং সুন্দর। আপনি মনে দুঃখ রাখবেন না মিস. চাপাবাজ। ' আর্দ্র বলল অনেকটা দুঃখের সাগরের দুঃখীরাজ হয়ে।

'আপনি কিন্তু....। আপনাকে আজ আমি মেরেই ফেলবো।' ফুসে উঠে কথাটা বলেই টায়রা এক অবাক কাজ করে বসলো। আর্দ্রর গলা চেপে ধরলো। আর্দ্র ভঙ্গি করে জিহবা বের করে বলল, 'আহ! মরে গেলাম আমি।' কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তার একদম ই ব্যথা লাগছিলো না।

টায়রার হাত দুটো নিজ গলা থেকে সরিয়ে চেপে ধরলো আর্দ্র। তারপর টায়রার মুখে ফু দিলো। মুখের বাতাসে টায়রার বড় কপালে পরে থাকা কিছু ছোট ছোট চুল উড়ন্ত পাখির ন্যায় উড়ে গেলো। খানিক বেসামাল অস্বস্থিকর পরিস্থিতিতে পরে টায়রা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ঘুরে দাড়ালো। আর্দ্রও একটু সংকীর্ণতা বোধ করলো। বেশ কিছুক্ষণ বাদে টায়রা প্রশ্ন করলো,

'আপনার নাম কী?'

আর্দ্র বুক ফুলিয়ে বলল, 'আর্দ্র খান। সুন্দর না নামটা?'

টায়রা আর্দ্রর মতোই দুষ্টুমির ছলে দাঁত কপাটি বের করে বলল,

'কিহ.. ভাদ্র? কোন ভাদ্র? বাংলা মাসের ভাদ্র? ভাদ্রও বুঝি কারোর নাম হয়? আপনার বাবা-মা এই পৃথিবীতে আর নাম খুঁজে পায়নি? শেষে কিনা বাংলা মাসের নাম রেখে দিয়েছে? কি লজ্জা কি লজ্জা! বাইরে মুখ দেখান কীভাবে আপনি? আপনার জায়গায় আমি হলে গলায় কলসি বেধে মরে যেতাম। যাই হোক, দুঃখ করবেন না। বেয়াদব নামটা এই ভাদ্রর নামের থেকে ঢের বেশি ভালো এবং সুন্দর। ইশশ...আপনার জন্য কষ্টে আমার বুকটা পেখম তুলে নাচছে।'

নাক ফুলিয়ে আর্দ্র বলল, 'আমার নামটা কীভাবে ভাদ্র হয়? ভাদ্র তে তো রেফ নেই। আর গলায় কলসি বাধলেই মানুষ মরে যায় বুঝি? আর আপনি কি আমার কথা আমাকেই ফিরিয়ে দিচ্ছেন?'

টায়রা অবাক গলায় বলল, 'ওমা! কোথায় আপনার কথা আপনাকে ফিরিয়ে দিলাম? একে বলে টিট ফর ট্যাট। কিছুই তো জানেন না দেখছি।'

আর্দ্র অপমানিত বোধ করলো। হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, 'আপনার সাথে তর্ক করা আমার কর্ম নয়। আপনি সত্যি চাপাবাজ। দি গ্রেট চাপাবাজ টায়ার। আর এতো বড় একজন গুণী মানুষের কাছে আমি তো ক্ষুদ্র এক বালুকণা। এতোবড় চাপাবাজ নারীর কাছে আমি অবলা, নগন্য।'

টায়রা আড়চোখে তাকিয়ে বলল,

'অবলা মেয়েদের বলে। আর আপনি আমাকে কি বললেন? আমি দি গ্রেট চাপাবাজ টায়ার? বলি আপনার কি কানের সমস্যা আছে? হাওয়াই মিঠাইওয়ালার কাছে গিয়েও আমি আগে হাওয়াই মিঠাই চাইলাম। কিন্তু আপনি শুনলেন না। উল্টে বললেন আপনি আগে এসেছেন। এখন আবার আমার সুন্দর টায়রা নামটাকে বারবার টায়ার টায়ার বলছেন।'

টায়রার কথায় পাত্তা না দিয়ে চিন্তিত মুখে আর্দ্র বলল, 'আচ্ছা তাহলে ছেলেদের কি বলে? অবলা থেকে অবল?'

তখনি ছাদে প্রবেশ ঘটলো টিকলির। সারা লঞ্চ খুঁজেও যখন সে টায়রাকে পেলো না তখন খুঁজতে খুঁজতে চলে এলো এই লঞ্চের ছাদে। টায়রা আর আর্দ্রকে দেখে টিকলি হাঁপ ছাড়া গলায় বলল,

'থ্যাঙ্ক গড, তোমরা এখানে আছো। তোমাদের খুঁজতে খুঁজতে আমার পা ব্যথা হয়ে গেছে।'

টায়রা টিকলির কাছে এগিয়ে গিয়ে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঠেস মারা গলায় বলল,

'বাতাসে আর্দ্রতা কী কম তাই নারে টিকলি! শীত শীত লাগছে। কি করে আবার এই আর্দ্র ফিরিয়ে আনা যায়রে?'

টিকলি টায়রার কপালে চাপড় দিয়ে বলল, 'গাধা, শীতকালে বাতাসে আর্দ্রতা কম থাকে আর তুই এই জৈষ্ঠ্য মাসে বলছিস বাতাসে আর্দ্রতা কম? তোর শীত লাগছে? যদিও এখন ঝড়ের সময়। কাল বৌশাখী ঝড়! আর আজও বৃষ্টি হয়েছে। তাই বোধ হয় শীত লাগছে। নচেৎ গ্রীষ্মকাল কী শীত লাগার সময়?'

টায়রা একবার আর্দ্রকে দেখে নিলো। আর্দ্র নাক গাল ফুলিয়ে তাকিয়ে ছিলো ওদের দিকে। টায়রা বিদ্রুপাত্মক হাসি দিয়ে বলল, 'হ্যাঁ রে তাই তো। ইশশ..কত্তো ব্রিলিয়ান্ট রে তুই! যাই হোক, বেশি জ্ঞান দিস।'

টিকলি চোখ পাকিয়ে তাকালো, 'আমি তোর চেয়ে এক বছরের বড়।'

সঙ্গে সঙ্গে হাত জোর করে মেকি গলায় টায়রা বলল, 'মাফ কর ভাই। এই কথা শুনতে শুনতে কান আমার ঝালাপালা।'

চলবে।

Masum, Tasmia haq, Hasibul hasan santo, Abul basar, Santa akter, Sk sagor, Sk imran and লেখাটি পছন্দ করেছে

avatar
Onu kotha
শুকতারা
শুকতারা
Posts : 56
স্বর্ণমুদ্রা : 1323
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-05-26

বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ Empty Re: বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ

Fri Jun 04, 2021 1:42 am

০৮.

'শুনুন'
আদর পেছন ফিরে তাকালো, 'জি বলুন।'
'চলুন।'
'কোথায়?'
'ওমা! ছাদে।'
'ওহ...আসছি।'
টিকলি চলে গেলো। আদর খানিকক্ষণ হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকলো। টিকলি যখন এসে বলল 'শুনুন'। মিনিট খানিকের জন্য তখন আদরের হৃদপিন্ডের পিঞ্জরাস্থিতে ধুকপুক শব্দগুলো বন্ধ হয়ে গেলো। নিঃশ্বাস আটকে গেলো। হারিয়ে ফেলল নদীর কূল। দিশেহারা মন বারবার চাইলো আর একবার...একবার ওইভাবে ডাকুক। একবার না বহুবার...বহুবার ডাকুক।

,

ছাদে একটা উড়না বিছিয়ে দিয়েছে টিকলি। বলেছিলাম, টিকলি বিনয়ী, নম্র-ভদ্র অকারণে কোনো মানুষের সাথে হাঙ্গামা, খারাপ ব্যবহার কিংবা অবহেলা করা তার ধাঁচে নেই। সে খুব সহজে বিনয়ী হয়ে মিশতে পারে মানুষের সাথে। সবার কাছে নম্র, ভদ্র, নরম, সুশীল হলেও একজনের সামনে গেলেই তার মাথা কেনো জানিনা আওলিয়ে যায়। সেই অভদ্র ছেলেটা, যে কিনা কথায় কথায় সুযোগ পেলেই টিকলিকে খোঁচা মেরে শুধু পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট প্রেগন্যান্ট করে। আর তখন টিকলির মাথাও গরম হয়ে যায়।

উড়নার চার মাথায় বসে আছে ওরা চারজন। ফুরফুরে মেজাজি বাতাস। পানির গন্ধ। চাঁদের আলো। সুন্দর সাবলীল পরিবেশটায় যখন সবাই চুপচাপ টায়রা তখন বিরক্ত হয়ে বলল,

'ধ্যাত, এভাবে ভালো লাগে নাকি? বরিং...। সবাই চুপ করে আছে।'

আর্দ্র মুখ ভেঙিয়ে বলল, 'অপরিচিত আমরা সবাই। চুপ করে থাকবো নাতো কি ধেই ধেই করে নাচবো?'

টায়রা নাক ফুলিয়ে বলল, 'আমি আপনাকে কিছু বলেছি? আপনি এতো কথা বলছেন কেনো? আর অপরিচিত কিন্তু পরিচিত হতে কতক্ষন? এই যে আমি আমার পরিচয় দিচ্ছি। আমি হলাম টায়রা রেজা...।

টায়রার কথা আটকিয়ে দিয়ে আর্দ্র বলল, 'সরি, আপনার ভুল হয়েছে ওটা হবে টায়ার রেজা।'

টায়রা আঙ্গুল তুলে বলল, 'আপনি আর একটা কথা বললে আপনাকে মেরে আমি এই পানিতে ভাসিয়ে দেবো।'

'ও মাগো, ভয় পাইছি।' মুখে হাত দিয়ে ভঙ্গি করে বলল আর্দ্র।

আদর গম্ভীর মুখে একটা মেকি ধমক দিলো আর্দ্রকে। এরপর বলল, 'আপনি বলুন টিকলি।'

আদর তাকিয়ে ছিলো টায়রার দিকে কিন্তু নাম বলল টিকলির। সবাই একটু হকচকিয়ে গেলো। টায়রা মুখ ভেটকিয়ে বলে, 'টিকলি? না ভাইয়া টিকলি তো আমার বোনের নাম। আমার নাম তো টায়রা।'

এমন লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পরে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো আদর। ওর মাথায় যে শুধু টিকলি ছাড়া আর কারোর নাম ঘুরতেই চাইছে না। আদরের ভারী রাগ হলো নিজের প্রতি। এই প্রথম সে তার মনের মনিকোঠায় কি চলছে তা ঠাওর করতে পারছে না। টায়রার দিকে তাকিয়ে তোতলানো স্বরে সে বলল,

'হ্যাঁ, ওই আসলে...এমনি। আমি উনাকেই বলতে চেয়েছি।'

টায়রা বলল, 'তাহলে তুই আগে বল টিকলি।'

টিকলি নিচু গলায় বলল, 'কি বলবো?' এরপর এক মুহুর্ত চুপ থেকে টিকলি সংক্ষেপে বলল, 'আমার নাম টিকলি রেজা। বাবা মার বড় মেয়ে। অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ি। থাকি ঢাকার উত্তরায়।'

এরপর টায়রা অনেক আগ্রহ নিয়ে নিজের পরিচয় দিতে চাইলো। যেনো এই পরিচয় দেওয়ার মাঝে খুব মজা। কিন্তু ব্যাঘাত ঘটালো আর্দ্র। সে মুখ দিয়ে 'চু' শব্দ করে বলে উঠলো,

'হইছে, চুপ থাকেন। আরে এগুলো কি পরিচিত হওয়া হলো? এবার গভীর সম্পর্কের দিকে যাওয়া যাক। লেটস গো ইন্টু টু দ্য ডিপ রিলেশনশিপ।'

টিকলি বেসামাল স্থিকর গলায় বলল, 'সরি? মানে বুঝলাম না ভাইয়া।'

আর্দ্র বলল, 'ডিপ রিলেশন। মানে ধরো আজকের পর থেকে তোমাদের সাথে আমাদের অনেক ভালো একটা সম্পর্ক হয়ে উঠবে। বন্ধুর মতোন।'

টায়রা অবহেলার গলায় বলল, 'ওও..এই কথা।'

আর্দ্র টায়রাকে ভেঙচিয়ে বলল, 'ওও..এই কথা এটা বললে চলবে না। নাম্বার দেও। ঠিকানা দেও। আমি তোমাদের বাসায় যাবো। তোমার সাথে কথা বলবো। সারাদিন আপু আপু করে পেছনে ঘুরবো। তোমাকে ভারসিটি পৌছে দিবো। মানে, যতরকম সেফটি দেওয়া যায় তোমাকে। এজ লাইক এজ ব্রাদার এন্ড সিস্টার।'

কথাগুলো আর্দ্র টিকলিকে উদ্দেশ্য করে বলল। টিকলি আদর টায়রা কিছুক্ষণ আর্দ্রর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। তাকিয়ে থাকার অর্থ, অপরিচিত মানুষকে এতো দরদ দেখানোর মানে কি? সবার তীক্ষ্ণ চাহনির সামনে পরে আর্দ্র বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পরে গেলো। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে টিকলি মিস্টি হেসে বলল, 'ওহ এই কথা। আচ্ছা।'

টিকলি নাম্বার বলতে ধরলো। ওমনি টায়রা গালে হাত দিয়ে ভাবুক গলায় বলল, 'বুঝলাম না কাহিনিটা। একটু আগে বললেন বন্ধুর মতো হতে চান। এখন আবার ভাই বোন? একচুয়েলি আপনি কোন ডিপ রিলেশনে যেতে চান? বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড?' টায়রা ভ্রু কুচকে গোয়েন্দা গলায় জিজ্ঞেস করলো।

আর্দ্র মাথায় হাত দিয়ে জোরেসোরে বলল, 'আস্তাগফিরুল্লাহ! এতো বড় অপমান?' এরপর টিকলির দিকে তাকিয়ে ইমোশনাল গলায় বলে,

'আপু। ওহ না, তুমি তো আমার ছোট। এর আগেও আপু ডেকেছিলাম। হোয়াট এভার, তবুও আপুই ডাকলাম। দেখো, তোমার বোন কিন্তু আমার মান সম্মান নিয়ে টানাটানি করছে। আমি তোমাকে নিজের বোনের আসনে বসাচ্ছি। আর সে তোমাকে টেনে আমার বউয়ের আসন দিচ্ছে। ছি ছি ছি!'

আর্দ্র লাগামছাড়া। বলেছিলাম, সে একবার বলা শুরু করলে বেশি বলে ফেলে। টিকলি লজ্জায় মাথা নিচু করে বিরবির করলো, 'দুইটার ক্যারাক্টারই সেম।'

টিকলি মাথা উঁচিয়ে হাসি হাসি মুখ করে আবার বলল, 'ওর কথায় কান দিবেন না ভাইয়া। আমি নাম্বার আর ঠিকানা দিচ্ছি। আপনি লিখুন।'

আর্দ্র পকেটে হাত দিয়ে কিছু খুঁজলো। অবশেষে খুঁজে না পেয়ে কপাল চাপড়ালো, 'হায় হায়, ভাইয়া। আমার ফোন তো কেবিনে ফেলে এসেছি। তোমার ফোনটা একটু দেও তো। নাম্বারটা তুলি। পরে আবার আমার ফোনে নিয়ে নিবো।'

আদর ভ্রু কুচকে চেয়ে কিছুক্ষন বুঝার চেষ্টা করলো ভাইয়ের মতলব। আর্দ্র তাড়া দিলো। আদর পকেট থেকে ফোন বের করে লক খুলে আর্দ্রর হাতে দিয়ে ফিসফিস করে বলল, 'অভিনয়ে তুই বড্ড কাঁচা। তুই যা ভাবছিস তেমন কিছুই না। এতো কাহিনী করে মেয়েটার নাম্বার নেওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিলো না।'

'নিবো না বলছো?' আর্দ্র ভ্রু নাচিয়ে ফিসফিস করেই বলল।
'নাহ, যেহেতু এখন বলে ফেলেছিস। না নিলে খারাপ দেখাবে।'
'সেটাই।' ভ্রু নাচিয়ে দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল আর্দ্র।

টিকলি নাম্বার আর ঠিকানা বলল। আর্দ্র আদরের ফোনে সেভ করে রাখলো। ঠিকানাটা শুনে নিলো।সবশেষে টায়রা আছন্নহারা অমাবশ্যার ন্যায় মুখ করে বলল,

'আপনি কি সত্যি আমাদের বাসায় আসবেন?'
আর্দ্র কাধ নাচিয়ে বলল, 'অবশ্যই, বোনকে দেখতে আসবো না?'
টায়রা চোখ মুখ খিচে বলল, 'না, একদম আসবেন না।'

আর্দ্র টায়রার কথা পাত্তা না দিয়ে বলল, 'আমি আমার বোনকে দেখতে যাবো আপনার তাতে কি? আপনি আপনার কাজ করুন। চুপচাপ যেভাবে বসে ছিলেন সেভাবে বসে থাকুন।'

আর্দ্র এবার টিকলির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো, 'তোমরা দুজন দুজনের কত বছরের ছোট বড়?'
টিকলি উত্তর দিলো, 'এক বছর। আমি বড় আর টায়রা ছোট।'
'ওহ তার মানে উনি সেকেন্ড ইয়ারে পড়েন?'
'নাহ, আমরা একই সাথে পড়ি।'
'ওওও..তাই বুঝি সে তোমার নাম ধরে ডাকে?'

টিকলি টায়রার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে হেসে মাথা নাড়ালো। টায়রা টিকলির দিকে গোল গোল চোখ করে তার রাগ জানান দিলো। এরপর কিছু মুহুর্ত কেটে গেলো নিস্তব্ধে। আদর ফোনের স্কিনে একবার দেখে নিলো টিকলির নাম্বার। সবার আড়ালে নাম্বারটা সেভ করে রাখলো 'টিকটিকি' দিয়ে। আনমনে একটু হাসলো সে। টায়রার বাঁজ পাখির মতো তীক্ষ্ণ নজরে তা খুব সুন্দর ভাবে ধরা পরলো। সে ভ্রু কুচকে বলল,

'আপনি হাসছেন কেনো ভাইয়া?'

আদর ফোনের স্কিনের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে মৃদু হাসি নিয়ে অবচেতনায় বলল, 'মিস. টিকটিকি।'

টায়রার ভ্রু জোড়া আরো কুচকিয়ে গেলো। স্বগোতক্তি করলো সে, 'মিস.টিকটিকি? একটা টিকটিকি কে এতো সম্মান? বাব্বাহ!'

এদিকে আর্দ্র অবাক চোখে তাকিয়েছে। আর টিকলি তার বড় বড় দুটো চোখ নিয়ে তাকিয়ে ছিলো আদরের পানে। চোখে তার তেজের ছিটা। আদর উপরে মুখ তুলল। সবার এই রিয়েকশন দেখে সে থতমত খেয়ে গেলো,

'আসলে....তেমন কিছুই না। ওই আরকি...আমি আদর করে একজনকে টিকটিকি বলে ডাকি।'

কথাটা শুনে টিকলির গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো। লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেলো। ক্ষনিকের জন্য পরে গেলো সে উত্থাল সমুদ্রে। পলকবিহীন চোখে তাকিয়ে রইল ওই শ্যামল মুখপানে। আদর টিকলির দিকে তাকালো এক বিপুল আচ্ছাদন দৃষ্টিতে। কিছুক্ষণ পর টিকলি স্বাভাবিক ভাবে চোখ সরিয়ে নিলো। টায়রা কিছুটা বাচ্চামো গলায় বলল,

'বাহ! আদর আবার আদরও করতে জানে।'

দুজনের ঘোর ভাঙলো। আর্দ্র আবারো টায়রার উত্তরের পরীপেক্ষিতে বাঁকা উত্তর দিলো, 'কেনো জানবে না? যার নামই আদর সেই তো আরো বেশি বেশি আদর করতে জানবে নাকি? আমার ভাইয়াও বেশি বেশি আদর করতে পারে। তার বউ অনেক হ্যাপি। আদর ভাইয়ার কাছ থেকে শুধু আদরই পাবে।'

কেশে উঠলো আদর। মুখে হাত দিয়ে সে যে কাশছে থামার নামই নেই। এই সময়ে যে এমন একটা বেক্কল কথা আর্দ্র বলবে তা আদরের ধারণাতেও ছিলো না। আদর দাঁত কটমট করলো। সত্যি ছেলেটা বলতে শুরু করলে আর ব্রেক কষে না। টিকলি সন্তপর্ণে লুকিয়ে চুরিয়ে হাসলো। টায়রা ফুসে উঠে বলল, 'আপনার সমস্যা কি? আমি কিছু বললেই আপনার উত্তর দিতে হবে, যত্তসব।'

আর্দ্র আবারো একটা ত্যাড়া কথা বলার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলো। কিন্তু ভাইয়ের চোখ রাঙানি দেখে সে থেমে গিয়ে মেয়েদের মতো গাল ফুলিয়ে বসে থাকলো। এরপর আবারো কিছুক্ষণ নিরবতা। একটুপর টায়রা হাসি হাসি গলায় আদরকে বলল,

'জানেন ভাইয়া টিকলি না অনেক সুন্দর গান পারে।'

টিকলি চোখ বড় বড় করে চিমটি কাটলো টায়রার হাতে। আদর বলল, 'তাই? তাহলে তো তোমার বোনের কাছ থেকে একটা গান আমদের পাওনা।'

টিকলি জোরপূর্বক হেসে টায়রার হাতে দ্বিতীয় চিমটিটা কেটে দিলো। টায়রা 'উহ' শব্দ করে উঠলো। আর্দ্র রিকুয়েষ্ট করলো অনেক, 'প্লিজ আপু। না করোনা। একটা গান গাও। জাস্ট একটা। যা খুশি গাও।'

টিকলি অসহায় চোখে একবার সবার দিকে তাকালো। আর্দ্র টায়রা হাসি মুখে বসে ছিলো। টিকলি তাকাতেই আদর মৃদুমন্দ হাসলো। টিকলি চোখ বন্ধ করলো। বন্ধ চোখের পাতায় সব গানের প্রতিচ্ছবি হাওয়া। শুধু একটা গানেরই কিছু সুর গলা দিয়ে তখন বেরিয়ে এলো। কিন্নর কণ্ঠে বন্ধ চোখের পাতার এক অপরূপা সুন্দরী গেয়ে উঠলো,

"তোর সাথে সারা নিশি ভিজবো জোসনায়,
চাঁদের আলো পরবে ঝরে তোর মুখটায় (ii)

মিলেমিশে দুজনে চল, এক হয়ে...যাই।
আদরে আদরে, অন্তরে অন্তরে...
মিশে রব দুজনায় (ii)"

মুগ্ধ হয়ে টিকলির সুরেলা কণ্ঠময় গান শুনছিলো সবাই। টিকলির সাথে তাল মিলিয়ে সবাই চোখ বন্ধ করে গান শুনছিলো। কিন্তু এ পর্যায়ে এসে আদরের চোখজোড়া টপাস করে খুলে গেলো। চোখে তার একরাশ অবাকতা। আদর! তার নাম গানে? টিকলি এই গানই কেনো গাইলো? খুঁজে খুজেঁ এই গানই কেনো? টিকলি কি ইচ্ছাকৃত ভাবে গাইলো নাকি হয়ে গেছে?

টিকলি জানেনা কেনো সে এই গানটাই গাইলো। সে শুধু জানে এই মুহুর্তে তার মস্তিষ্কে অন্যকোনো গান ধরা দিচ্ছে না। টিকলি গাইতে থাকলো,

"তোর সাথে ভিজবো অঝোর বৃষ্টিতে,
রংধনু খুঁজবো তোর অবুঝ দৃষ্টিতে,
মিলেমিশে দুজনে চল, এক হয়ে যাই,
আদরে আদরে অন্তরে অন্তরে
মিশে রব দুজনায়(ii)

চলবে

Masum, Tasmia haq, Hasibul hasan santo, Abul basar, Santa akter, Sk sagor, Sk imran and লেখাটি পছন্দ করেছে

avatar
Onu kotha
শুকতারা
শুকতারা
Posts : 56
স্বর্ণমুদ্রা : 1323
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-05-26

বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ Empty Re: বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ

Fri Jun 04, 2021 1:43 am

০৯.

রাত যত গভীর হচ্ছিলো টায়রা আর্দ্রর ঝগড়ার তোড়জোড়ও বাড়ছিলো তত। শেষে না পেরে রাতের প্রথম প্রহরে দুজন অগ্নিশর্মা রাগ নিয়ে উঠে চলে গেলো নিজেদের জন্য বরাদ্দকৃত কেবিনগুলোতে। ওরা চলে যাওয়ার পর টিকলি একটু অস্বস্থি নিয়ে আদরের দিকে তাকালো সাথে জোরপূর্বক একটা হাসি দিলো। আদর চোখ সরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, 'ঘুরতে যাচ্ছেন?'
কানের পাশে চুল গুজে দিয়ে টিকলি আড়ষ্ট ভঙ্গিতে জবাব দিলো, 'জি। আপনিও নিশ্চয়ই? '
'হুম। কোথায় যাচ্ছেন?'
'হাতিয়া। নিঝুম দ্বীপ।'
'শুধু নিঝুম দ্বীপ ই ঘুরবেন?'
'দেখি, হুট করে চলে এসেছি তো। প্ল্যানিং নেই। আপনি?'
'আমিও নিঝুম দ্বীপ যাচ্ছি।'
'ওহ।' টিকলি আবার অস্বস্থিতে পরে গেলো কেনো যেনো। অথচ এতো আড়ষ্ট ভঙ্গিমা করার মতো কিছু হয়নি। আদর বলল, 'রাত হয়ে যাচ্ছে। ঘুমোবেন না?'

টিকলির ছোট উত্তর, 'জি। গুড নাইট। ভালো থাকবেন।' একনজর আদরের দিকে তাকিয়ে চলে গেলো সে। তার চলে যাওয়ার পর আদর ভাবতে বসলো।
এতো ভয়ে ভয়ে আরক্তনয়নে টিকলি কেনো কথা বলল কে জানে? হয়তো অপরিচিত ব্যক্তি তারউপর একটু আগেই একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার কবলে পরে এই মানুষটার সান্নিপাতিক হয়েছিলো সে; তার বুকে আচড়ে পরেছিলো তাই বোধ হয় এই অস্থির মনস্তাপ।

,

ফজরের নামাজ পড়ে নিয়ে টিকলি তার ব্যাগভর্তি বয়ে নিয়ে আসা উপন্যাসের স্তূপ থেকে একটা বই নিয়ে পড়ছিলো টায়রা বিরক্ত হয়ে কেবিন থেকে বের হয়ে গিয়ে লঞ্চের শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে সূয্যিমামার সূর্যোদয়ের রঞ্জনরশ্মি দেখতে বসলো। হঠাৎ পাশ থেকে কেউ গলা উঁচিয়ে চেঁচালো,

'ওহ মাই গড। আপনার মুখ থেকে তো তেল বেরোচ্ছে।'

ঘুম থেকে উঠলে মুখ স্বাভাবিক ভাবেই একটু তেলতেলে থাকবে। যদিও ওজু করা হয়েছে কিন্তু মুখে কোনো ক্রিম, পাউডার বা অন্যকোনো প্রসাধনী মাখা হয়নি বলে টায়রার মুখের তেলতেলে ভাবটা রয়ে গেছে।

টায়রা একটু ঘাবড়ে গিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন দিকে তাকিয়ে দেখলো আবার সেই বেয়াদব ছেলেটা। রোষাগ্নি হয়ে টায়রা উত্তর দিলো ত্যাড়া ভাবে, 'হ্যাঁ তো? সেই তেল দিয়ে আপনাকে রেধে খাওয়াবো।'

আর্দ্র নাক ছিটকিয়ে সরে গেলো সাথে টায়রাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, 'উফফ এই লঞ্চ যে কখন থামবে আর কখন এই তৈলাক্ত মানুষজনদের কাছ থেকে রেহাই পাবো!'

টায়রা নাকের পাটাতন ফুলিয়ে রাখলো। কথার উত্তর দিলো না কিন্তু সেও শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, 'বোকারা কথা বলে বেশি রাগে বেশি। বুদ্ধিমানেরা কথা বলে কম রাগেও কম।'

'হুহ...আসছে বুদ্ধিমান! যে বুদ্ধির ছটা জীবন হয়ে যাবে আমার দফা-রফা।'

__________________________________

নোয়াখালী জেলার মধ্যে একটি উপজেলা হলো হাতিয়া। এটি মূলত একটি দ্বীপ। বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত মেঘনা নদীর মহোনায় জাগরিত সেই দ্বীপ। এর চারদিকে রয়েছে বিশাল জলরাশি। একসময় নোয়াখালীর মূল ভূমির সাথে সংযুক্ত থাকলেও ক্রমেই নদী ভাঙনের দাপটে এটি প্রায় বিচ্যুত। আস্তে আস্তে হয়তো এই হাতিয়া বিলীন হয়ে যাবে বিশাল জলরাশির কবলে। ভোলা এবং মনপুরা হাতিয়া উপজেলার দুটি উল্লেখিত দ্বীপাঞ্চল। ভোলা যা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় একটি দ্বীপ। এমনকি ২০১৫ সালে, বাংলাদেশ সরকার হাতিয়া দ্বীপের ভাসানচরে রোহিঙ্গা শরনার্থীদের পুর্নবাসনের সিদ্ধান্ত নেন।

বেলা প্রায় সাড়ে দশটার দিকে লঞ্চ গিয়ে পৌছায় হাতিয়ার লঞ্চঘাটে। সম্ভবত এইঘাটকে তমরুদ্দি ঘাট ও বলা হয়। টিকলি টায়রা ব্যাগপত্র নিয়ে লঞ্চ থেকে নেমে বাজারের একটা দোকানের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো। টিকলির আগে টায়রার তীক্ষ্ণ দুটি চোখ আটকে গেলো একটা জায়গায়।

বাজারের এক কোণায় আম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে ব্যস্ত আর্দ্র। রোদ উঠেছে তবে এদিকে হয়তো বৃষ্টি হয়েছিলো কাল রাতে অথবা আজ সকালে যার কারনে বাজারের আশপাশের মেঠোপথে কাদার ছড়াছড়ি এবং জমাট বাধা পানি। হঠাৎ দমকা বাতাসে পট করে ঝুলন্ত এক মাঝারি সাইজের কাঁচা আম গিয়ে পরলো ঠিক আর্দ্রর মাথার উপর। তা দেখে টায়রা হেসেই খুন। কোমড়ে এক হাত রেখে আরেক হাত কপালে রেখে সে হাসছে।

এদিকে টিকলির মনটা খারাপ কারন কিছুক্ষন আগে ঘটে গেছে একটি মন্দ ঘটনা। লঞ্চ থেকে নামার সময় টিকলি কাদায় আবারো পা পিছলে পরে যেতে নেয়। টায়রা ছিলো খানিকটা পেছনে। সে দেখেনি। কিন্তু এ যাত্রায় টিকলিকে বাঁচিয়ে নেয় আদর। এই ঘটনা যেনো পূর্বপরিচিত। টিকলির বন্ধ দুয়ারের অসহায় চোখ দুটো আস্তে করে তার দ্বার খুলল। সামনে তাকিয়ে দেখলো আদর তাকে শক্ত করে ধরে আছে। বলতে নেই, এক মিনিটের জন্য টিকলির মনে হলো এই সেই অসভ্য ছেলেটা।

যারপরনাই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আবার ঘটায় আদরের মস্তিষ্কে খেলে গেলো কালকের বিকাল পাঁচটা পনেরোর ঘটনা। সেই নির্বোধ বোকা কিন্তু নিজেই নিজেকে ভাবা বুদ্ধিমান পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট মেয়েকে মনে পরতেই আদরের ভেতরটা রাগ হয়ে গেলো। সেই রাগ প্রকাশ পেলো কাদার কবল থেকে মাত্র বেঁচে ফেরা বেচারা টিকলির উপর। টিকলি খানিকক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল আদরের মুখপানে। এক মুহুর্তের জন্য সে আদরের উপর সেই অসভ্য ছেলের ছায়া দেখতে পেলো। নাকের পাটাতন তখন অজান্তেই ফুলে গেলো। সে বলল,

'আমি তো ইচ্ছে করে পরে যাইনি কাদা ছিলো তাইতো পরে যাচ্ছিলাম।'

'কেনো পরবেন? আল্লাহ হাত পা চোখ সব দিয়েছে তাও যখন তখন পরে যাবেন? এখন নাহয় আমি বাঁচিয়েছি পরে কে বাঁচাবে? চিৎপটাং হয়ে তো তখন কাদায় গড়াগড়ি খেতে হবে।' আদরের ঝাঁঝালো গলা।

টিকলির খারাপ লাগলো খুব। সে সরি বলে চলে এলো সেই জায়গা থেকে। বলতে গেলে, লোকটা তো আর মিথ্যা বলেনি। টায়রার জোরালো হাসির শব্দ আবারো কানে বাড়ি খেলো। ভাবনার সুতো কেটে টিকলি এবার বিরক্তচোখে তাকিয়ে বলল, 'পাগলের মতোন এতো জোরে জোরে হাসছিস কেনো?'

টায়রা সামনের দিকে হাত দিয়ে ইশারায় দেখিয়ে দিলো। টিকলি দেখলো আর্দ্র মুখ ফুলিয়ে মাথায় বাম হাত ঘষছে এবং তার ডান হাতে এক টসটসে কাঁচা আম ধরে রাখা। টায়রা হাসতে হাসতে এগিয়ে গেলো সেইদিকে। টিকলি চোখ সরিয়ে বিরক্তির শ্বাস ফেলল। সূর্যের প্রকটন আলোতে ধাতস্থ হয়ে এদিক সেদিক তাকালো। দেখলো তার পাশের দোকান থেকে আদর মিরিন্ডা কিনছে। টিকলি তার ধনুকের মতো বেঁকে যাওয়া ভ্রু জোড়া সোজা করে তাকালো। মনটা আরো খানিক খারাপ হয়ে গেলো। তাকে লক্ষ্য করে ততক্ষনে এগিয়ে এসেছে আদর। হাতে থাকা একটা ত্রিশ টাকার মিরিন্ডার বোতল এগিয়ে দিয়ে বলল,

'সূর্যের তাপে আপনার চোখ মুখ তো লাল হয়ে গিয়েছে। নিন এটা খান।'

আদরের এহেন মিস্টি বাক্যে টিকলির শত রাগ, কোটি মন খারাপ পরে গেলো। মিনিট খানিকের জন্য যে ভেবেছিলো, এই ছেলে বুঝি সেই অসভ্য ছেলে তা ভেবে টিকলি নিজেকেই ধিক জানালো। আসলে এই লোকটা তো টিকলির ভালো চায় তাই বকা-ঝকা করেছে। কিন্তু ওই লোকটা তো কারনে অকারণে অপমান করে। অভদ্র লোক একটা! টিকলি সৌজন্যে একটা হাসি উপহার দিয়ে কোল্ড ড্রিংকস টা নিয়ে সহাস্যে বলল, 'আচ্ছা আপনি কি করেন?'

' নিউরোলজিস্ট।' আরেকটা বোতলে মুখ লাগালো আদর। এরপর প্রশ্ন করলো, 'তো দাঁড়িয়ে আছেন কেনো এখনো?'

টিকলি কপালে ভাঁজ ফেলে ভাবতে বসলো। পুরো সমস্যার বীজটা তো এখানেই? দাঁড়িয়ে আছে কেনো? আর এই দাঁড়িয়ে থাকার পেছনে রয়েছে পুরো ইতিহাস। আর এই ইতিহাসের ব্যখ্যা হলো, হাতিয়ার এই ঘাট থেকে মোটরসাইকেলে করে যেতে হবে হাতিয়ার একদম শেষ মাথা মোক্তারিয়া ঘাটে। এখন সমস্যার মূল শেকড় টা হলো মোটরসাইকেলে যাবে কীভাবে? এক মোটরসাইকেলে দুজন মেয়ে বসা সম্ভব না। সুতরাং, টিকলি এবং টায়রাকে দুটো মোটরসাইকেলে যেতে হবে। তারউপর তারা কেউ ঠিকমতো জায়গাগুলো চেনে না। একা দুজন মেয়ে। স্থানীয় এলাকায় এসব ড্রাইভাররা হয় প্রচন্ড লেভেলের বেয়াদব। তাছাড়া মোটরসাইকেলে উঠলে লোকগুলোর কাধে হাত রাখতে হবে। টিকলি যদিও পেছনের হ্যান্ডেল ধরে যেতে পারবে কিন্তু টায়রা তো পারবে না। আর এই মোটরসাইকেলের ভেজাল শুনলে টায়রা যেতেই রাজি হবেনা। এখন কি করা যায়?

টিকলিকে চিন্তিত দেখে আদর তুড়ি বাজালো। চমকে টিকলি বলল, 'হ্যাঁ?হ্যাঁ? কী?'

কপালে ভাঁজ ফেলে আদর বলল, 'আচ্ছা মোটরসাইকেলে আপনারা যাবেন কীভাবে?'

তাদেরকে নিয়ে ভাবতে দেখে টিকলি বিস্ময় বোধ করলো। সাথে টিকলির মনটা প্রশান্ত মহাসাগরীয় এর মতো উত্থাপন করলো। সে বলেই ফেলল, 'আমাদের নিয়ে ভাবছেন যে?'

আদর একটুও বিব্রত বা বিভ্রান্তবোধ করলো না। সে হেসে খেলে বলল,

'ডাক্তার মানুষ তো সবাইকে নিয়ে ভাবা একটা অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওই যে দেখুন না দূরে দাঁড়িয়ে আছে ওই মহিলা। একপাশে একটা বাচ্চা, কোলে আরেকটা ছোট বাচ্চা এবং আরেক হাতে একটা মস্ত বড় ব্যাগ। তাকে দেখেও আমি ভেবেছিলাম, শীঘ্রই মহিলাটি অসুস্থ হয়ে পরবে। এতো ধকল আর শরীরে সইবে না। খুব সম্ভবত আজ রাতে মহিলাটির গা ব্যাথা করবে নয়তো পা ব্যাথা। জ্বরও হতে পারে। সেইক্ষেত্রে আপনি অল্পমাত্রার হলেও পরিচিত। আপনাকে নিয়ে ভাবা স্বাভাবিক।'

টিকলি অবাকপ্রসন্ন গলায় বলে, 'বাব্বাহ! এতো ভাবনা?'

'ভাবতে হয়। সবসময় ভাবনা চিন্তার উপরই থাকতে হয়। শুধু ডাক্তারদের না এভরিবডি শুড থিংক। এন্ড দে মাস্ট টু বি ট্রাই। এখন সেই প্রশ্নের উত্তরটা বলুন।'

টিকলি একটু ভাবলো কোন প্রশ্ন। পেছনের কিছু কথোপকথন ঘাটতেই বেরিয়ে এলো প্রশ্নটা। টিকলি নিচু গলায় উত্তর দিলো, 'আসলে অপরিচিত জায়গা তারউপর আমরা দুজনেই মেয়ে। আবার মোটরসাইকেল করে নাকি যেতে হবে। এক মোটরসাইকেলে দু'বোন মিলে ড্রাইভার সহ গাদাগাদি করে বসা অসম্ভব। আর এসব ড্রাইভারগুলো তো হয় সুযোগসন্ধানী। সুযোগ পেলেই তাদের হাত নিশপিশ নিশপিশ করে।'

টিকলিকে থামিয়ে আদর বলল, 'বুঝেছি। আর ব্যাখ্যা দিতে হবে না। কিন্তু আপনি চাইলে এক কাজ করা যেতে পারে। এক মোটরসাইকেলে তিনজন করে যাওয়া যাবে। আমি আপনি আর ড্রাইভার এবং আর্দ্র টায়রা আর ড্রাইভার।'

আদরের কথা শুনে টিকলি বড় বড় চোখ করে এক বাক্যে না করে দিলো। আদর একটু অবাক হলো। টিকলি নখ কামড়িয়ে আবারো ভাবতে বসলো, লাভটা কি হলো? সেই তো ঘুরেফিরে একই কথা। এক মোটরসাইকেলে ছেলেদের সাথে গাদাগাদি করে বসতে হবে। যা কখনোই সম্ভব না। বুকের সাথে পিঠ লেগেই থাকবে। আর টিকলির পক্ষে তা অসম্ভব। টিকলি বিচক্ষণ। সব দিক ভেবে যেই দিক সুশীল এবং সুশৃঙ্খল সেই দিকেই পা বাড়াবে সে। কিন্তু এখানে তো কোনোটাই সুশীল নয় সব অশ্লীল। এখন উপায়?

আদর বোধ হয় ধরতে পারলো টিকলির চিন্তাধারা। সে বুঝে বলল, 'আপনি যা চিন্তা করছেন সেটাও ঠিক আছে। মেয়ে হিসেবে আপনার এই চিন্তাকে আমি সমর্থন জানাচ্ছি। '

লজ্জায় টিকলি মাথা নোয়ালো। এই ফাঁকে আদর গেলো মোটরসাইকেলের ড্রাইভারদের সাথে কথা বলতে। মিনিট দশেক পরে ফিরেও এলো।

চলবে

Masum, Tasmia haq, Hasibul hasan santo, Abul basar, Santa akter, Sk sagor, Sk imran and লেখাটি পছন্দ করেছে

avatar
Onu kotha
শুকতারা
শুকতারা
Posts : 56
স্বর্ণমুদ্রা : 1323
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-05-26

বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ Empty Re: বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ

Fri Jun 04, 2021 1:43 am
১০.

আদর প্রায় দৌড়ে এলো। প্রচন্ড গরমে কানের পাশ দিয়ে চিপচিপে ঘাম জড়ছে। মুখশ্রী হয়ে উঠেছে করুণ লাল। তেজি রশ্মিতে চোখ গেছে কুচকে। হাটুতে ভর দিয়ে হাঁপ ধরা গলায় আদর প্রশ্ন করলো, 'আমার সাথে যেতে সমস্যা আছে?'

টিকলি অবাক থেকে মাথা নাড়ালো। আদর আবার জিজ্ঞেস করলো হাঁপাতে হাঁপাতেই, 'সত্যি? একা যেতে সমস্যা নেই তো?'

টিকলি এবার নড়েচড়ে উঠলো। যেনো ঘোর থেকে বেরিয়ে এলো। আদরের প্রশ্নে সে সরাসরি বলল, 'অবশ্যই আছে। আমি আমার বোনকে ফেলে আপনার সাথে একা যাবো? ভাবলেন কীভাবে?' টিকলি বলল তেজি গলায়।

আদর অবাক হলো। বিস্ময় সূচক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সোজা হয়ে দাড়ালো। শূন্যে ছেড়ে দিলো মুখ ভর্তি রাগী শ্বাস। খানিক গম্ভীরমুখে বলল,

'আপনি আমি এক মোটরসাইকেলে যেতাম এবং আর্দ্র টিকলি আরেক মোটরসাইকেলে যেতো। এতে আপনার চিপকে বসে থাকতে হতো না। অনেক দূরত্ব রেখে বসে যেতে পারতেন। কাধে হাত চাইলে রাখতে পারতেন আবার নাও পারতেন। যেহেতু আপনার সমস্যা হচ্ছিলো তাই দুটো মোটরসাইকেল ড্রাইভারকে আমি রিকুয়েষ্ট করেছি যাতে আমরা নিজেরাই চালিয়ে যেতে পারি। এবং তারা অন্য আরেকটা মোটরসাইকেল করে আমাদের পথ দেখাবে এবং নজর রাখবে। এতে ভারতি টাকাও নিয়েছে তারা।'

টিকলি খুব গোপনে জিব কাটলো। ইশশ..আগে কথা শুনে তারপর রিয়েক্ট করার উচিত ছিলো। লোকটা বোধ হয় রাগ করলো। কেমন গম্ভীর হয়ে গেলো। টিকলি কানের পাশে চুল গুজে দিয়ে ছোট করে বলল, 'ওহ।'

আদর খুব ঠান্ডা গলায় বলল, 'যাবেন নাকি ওদের না করে দিবো?'

'না না যাবো না কেনো? আসলে আমি দুঃখিত।'

'ইটস ওকে।' বলেই গটগট করে হেটে মোটরসাইকেলের ওইদিকে চলে গেলো আদর। টিকলির বুকে আবারো মন খারাপের বরফের ন্যায় ঠান্ডা বাতাস বইলো। ধ্যাত, দিন দিন না সে টায়রার মতো হয়ে যাচ্ছে, কারণে অকারণে উদ্ভট আচরণ করা। কি ভাবলো লোকটা?

,

টায়রা আর্দ্রর সামনে দাঁড়িয়ে হাসি বন্ধ করে আর্দ্রর হাত থেকে আমটা নিয়ে উড়নায় ঘষলো। কামড় দিতে দিতে আর্দ্রর রাগে ফুলে ফেঁপে উঠা মুখখানা দেখে আবারো হুহা করে হেসে উঠলো।
কাঁচা আমটা ছিলো ভীষণ টক। ছাল সুদ্ধ খেতে গিয়ে টায়রার মাড়িতে জোরালো ভাবে কামড় পরলো। অমনি থু থু করে ফেলে দিয়ে সে ডান পাশের চাপা ধরে 'উউউ' শব্দ করে উঠলো। টায়রাকে দেখে এবার আর্দ্র হেহে করে হেসে দিলো। টায়রার হাত থেকে আমটা নিয়ে কামড় দিয়ে অংশটুকু হাতে নিলো। ছাল ছাড়িয়ে খেতে খেতে টক খাওয়ার যে শব্দ হয় 'চ কারান্ত' সেই শব্দ করতে করতে বলল,

'বেশি চাপা করলে চাপায় এমনি হওয়া উচিত। আই উইশ এই চাপা আর ভালো না হতো। আল্লাহ!'

টায়রা সাথে সাথে আর্দ্রর বাহুতে একটা থাপ্পড় দিয়ে আবারো চাপা ধরে উউ শব্দ করতে লাগলো। আর্দ্র গরম চোখে তাকিয়ে বলল, 'এটা কি হলো?'

আস্তে আস্তে টায়রা চাপা নাড়িয়ে বলে, 'মাইর হলো।'

আর্দ্র টায়রার চুল ধরে আস্তে করে টান দিলো। টায়রা চিল্লিয়ে উঠলো। দূর থেকে টিকলি ওদের ডাকছিলো। আর্দ্র এগিয়ে গেলো সেইদিকে এবং বলল, 'আসেন নাকি কোলে নিতে হবে?'
'বেয়াদব।'
'আপনি।'

________________________________

বিদ্বান, বিচক্ষণ, বহুদর্শী, পারদর্শী আদর খেয়াল করলো হাতিয়া জেলায় মোটরসাইকেল গুলোতে কোনো লাইসেন্স নেই এবং ড্রাইভাররা কোনোরকম সেফটি গার্ড ইউস করে না। মাথায় হেলমেট ড্রাইভারদের ড্রাইভিং লাইসেন্স কিছুই নেই তাদের। এখানে মোটরসাইকেল রয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার। পার মান্থ মোটরসাইকেল ড্রাইভারদের দু'শো টাকা ঘুষ দিতে হয়। এছাড়াও খুব সম্ভবত পার ডে দশ টাকা করে দিতে হয়। সুতরাং দেখা যায়, পার মান্থ মোটরসাইকেল থেকে উঠে আসে {(২০০×৫০০০)=১০০০০০০} প্রায় দশ লক্ষ টাকা। (এটি নিশ্চিত নাও হতে পারে)

ভাবনা-চিন্তার যন্ত্র মেশিন অফ করে আদর মোটরসাইকেল স্টার্ট দিলো। টিকলি খুব সন্তর্পণে পেছনে উঠে বসলো। মাঝখানে তার ভেনিটি ব্যাগ রাখলো। তখনের রাগ আদরের এখনো কমেনি। মেয়েটা তখন না জেনেশুনে আদরকে অযথা কথা শুনিয়ে দিয়েছিলো। টিকলি বসেছিলো একদম গুটিসুটি হয়ে। সামনে কোনো বাঁকা ত্যাড়া রাস্তা এলে যে সে ধপাস করে পরে যাবে তা নিশ্চিত। আদর বলল একদম সাপের মতো ঠান্ডা গলায়,

'আমাকে ধরে বসুন। পরিস্থিতির চাপে পরেই আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি এবং আপনিও এই অপরিচিত আমার সাথে যাচ্ছেন। নচেৎ, কোথায় হারিয়ে যেতাম আমরা। তাই এতো আড়ষ্টতার বা লজ্জিত হওয়ার কিছু হয় নি। ট্রাই টু বি ইজি। আমাকে ধরে বসলে আপনি কলংকিত হয়ে যাবেন এমন তো না?'

টিকলি মাথা নিচু করলো। লোকটার কথাগুলো একদম তীরের ফলার মতো। চ্যাটাংচ্যাটাং করে বলা কথাগুলো যেনো একদম বুকে বিঁধে। একটা ঠান্ডা স্বাভাবিক অতি বুদ্ধিমান মানুষও এর কথার জ্বালায় বিব্রত হয়ে পরবে। যে মানুষ কোনোদিন রাগ করেনা সেই মানুষটাও আদরের কথায় ভয়ানক রাগ করবে বলে টিকলির ধারণা। টিকলি চোখ বন্ধ করে আস্তে আস্তে আদরের কাধে হাত রাখলো।

লুকিং গ্লাস মুখ দেখার জন্য নয়। পেছন থেকে কোনো গাড়ি আসছে নাকি আসছে না তা দেখার জন্য। লুকিং গ্লাস ঠিকমতো তুমি দেখতে পারো তার মানে ৩০℅ গাড়ি চালানো তুমি শিখে গেছো। কিন্তু এই প্রথম আদর নিয়মের খেলাপ করলো। লুকিং গ্লাসে টিকলির মুখটাই দেখলো প্রথম। তার মৃদু কাঁপা রক্তলাল ঠোঁট, ফুলে উঠা কপোল, ঘর্মাক্ত ললাট, বন্ধ দুটি অক্ষিপট। সবচেয়ে সুন্দর যেনো সেই নয়নগুলোই। মোটা ফ্রেমের চশমার নিচের সেই বন্ধ আঁখি দুটো ভারী নিখুঁত সুন্দর এবং মিষ্টি। হঠাৎ টিকলি চোখ খুলল। আদর পড়িমরি করে চোখ সরালো এবং আস্তে ধীরে বলল,

'মাস্ক পরেননি?'

টিকলি মাথা নাড়িয়ে বলল, 'না। ভুলে গেছি।'

মাস্কের কথা মনে পরতেই মনে পরে গেলো সেই মাস্ক পরিহিতা পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট মেয়েটার কথা। আদরের আবারো রাগ হলো। আদর ইচ্ছে করেই মাস্ক পরেনি। কিন্তু এই করোনাকালে মাস্ক না পরে ঘুরা খুব ই ঝুকিপূর্ণ। কিন্তু তাতে কি? এই এতো সুন্দর সময়গুলোতে মাস্ক পরে সেই মেয়ের কথা চিন্তা করে আদর সময়গুলো নষ্ট করতে চায় না। সে শক্ত গলায় বলল, 'আর পরবেনও না মাস্ক। আমার সাথে যতক্ষণ আছেন ততক্ষণ পরবেন না।'

টিকলি হা করে চেয়ে থেকে শুধু ঘাড় কাৎ করলো। চোখে চশমাটা ঠিক মতো এঁটে দিয়ে তাকালো ফেলে চলে আসা একের পর এক গাছ-গাছালি, বাড়ি-ঘর, দোকান-পাট, মানুষ-জন, রাস্তা-ঘাট, রাস্তার পাশে বুনোফুল, প্রকৃতির দিকে। এসব মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখতে দেখতেই টিকলি একটা অসংগতিপূর্ণ কথা ভাবলো,

'মাস্ক পরলে প্রকৃতি অনুভব করা যায় না। মাস্ক ছাড়াই ঠিকঠাক।'

'আঙুর ফল টক' টিকলির বলা কথাটা একদম এই প্রবাদ বাক্যের সাথে না মিলে গেলেও ধাঁচটা প্রায় এরকমই।

,

আদর আর্দ্র যেই মোটরসাইকেল গুলো দিয়ে যাচ্ছে সেই মোটরসাইকেলের ড্রাইভার দুটো যাচ্ছে আরেক মোটরসাইকেল দিয়ে। ভাড়া সম্পূর্ণই আদর বহন করবে। ড্রাইভার গুলো মোটরসাইকেল নিয়ে আগে আগে যাচ্ছে তাদের পেছনে যাচ্ছে আদর ও আর্দ্রর মোটরসাইকেল। কারন তারা রাস্তা চেনে না। ড্রাইভার দুটোর মধ্যে একটা ড্রাইভার ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন দিক তাকিয়ে আছে। কারন মানুষগুলো তো চোর ও হতে পারে। হুটহাট মোটরসাইকেল নিয়ে ভেগে চলে যেতে পারে। একমাত্র টাকার নেশায় পরেই মোটরসাইকেল দিয়েছে তাই বলে কি নজর রাখবে না? পেছনে বসা সেই ড্রাইভার লোকটা এক মিনিটের জন্যেও ঘাড় সোজা করেনি। আর্দ্র নিশ্চিত এই ড্রাইভার তার ঘাড় আর জীবনেও সোজা করতে পারবে না। ইশশ....বেচারা তাদের নজরে রাখতে গিয়ে নিজের ঘাড়টাকে খোয়াচ্ছে। কষ্টে আর্দ্রর বুকটা ভেঙে গুড়গুড় হয়ে যাচ্ছে।

আর্দ্রর বুকটা যখন ড্রাইভারের কষ্টে পুড়ে প্রায় খা খা ঠিক তখন তার চোখ গেলো লুকিং গ্লাসে একটা রজোশর্মারী ক্ষেপা রাগিবুন্ড মেয়ের দিকে। যার গাল ফুলা রাগে, জিদে ফুলা ট্যাপা নাক, কপালে কুঞ্চন, ঠোঁট বিকৃত।

আর্দ্র দুষ্টুমি করে জোরে একটা ব্রেক কষলো। টায়রা গিয়ে আছড়ে পরলো আর্দ্রর পিঠে। রোষানলে জ্বলে উঠে টায়রা বলল, 'আমার বোন এই ভয়ের জন্য মোটরসাইকেলওয়ালা দের বাদ দিয়ে আপনার সাথে নিয়ে যাচ্ছে। আর আপনি সেই ইচ্ছাকৃতভাবে ব্রেক ই কষলেন? ড্রাইভারদের থেকেও অধিক বেয়াদব আপনি।'

মোটরসাইকেল চালাতে চালাতেই আর্দ্র ঘাড় ঘুরিয়ে টায়রার দিকে তাকালো। চোখ লাল করে বলল,

'আপনি কি সামহাও আমাকে লাউসি (Lousy=লুচ্চা) বলতে চাইছেন?'

টায়রা হাত দিয়ে আর্দ্রর মুখ সামনে ঘুরিয়ে দিলো। কাটকাট গলায় বলল,

'বলতে চাইছি না, আমি এটাই বলছি। এখন তো এটা বলেছি। একটুপর খুনীর তকমা গায়ে লাগাতে না চাইলে সামনে দেখে বাইক চালান।'

আর্দ্র উচ্চস্বরে বলল, 'হোয়াট? আমি খুনী? আমি লাউসি? আচ্ছা এখন যে আপনি হাতে দিয়ে আমার গাল ধরে সামনে ঘুরিয়ে দিলেন তাহলে আপনি কি হলেন? লিউড(Lewd),অসচরিত্র, অশ্লিল, নোংরা?'

টায়রা চোখ বড় বড় করে তাকালো। পানিতে ভাসমান চোখ দুটো নিয়ে তাকিয়ে বলল, 'আপনি আমাকে এসব বলতে পারলেন?'

আর্দ্র আরো তেজি গলায় বলল, 'তো বলবো না? আমি কি আপনাকে স্বাদে নিয়ে যাচ্ছি? আমরা দু' ভাই কি পারতাম না একা চলে যেতে? আপনাদের কথা ভেবেই তো হেল্প করা। আর তাছাড়া আপনার বোন তো ভরসা করে আপনাকে আমার সাথে যেতে দিয়েছে আর আপনি আমার সম্পর্কে কত খারাপ মনোভাব পোষণ করলেন!'

টায়রা আবারো কিছু বলতে চাইলো। আর্দ্র আটকে দিয়ে বলল, 'আর একটা কথা বললে ধাক্কা দিয়ে গাড়ি থেকে ফেলে দিয়ে খুনীর তকমা গায়ে লাগিয়েই ঘুরবো। তাছাড়া আমার গার্লফ্রেন্ড আছে। আপনার প্রতি কোনোরকম এট্রাকশন কাজ করার চান্সই নেই। তাই আজেবাজে চিন্তা গুলো মাঠের বাইরে ফেলে দেন।'

আর্দ্র বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলল। টায়রা ধীর কণ্ঠে স্বগোতক্তি করলো, 'গার্লফ্রেন্ড আছে? সত্যি?'

আর্দ্র বাঁকা হেসে বলল, 'এমনভাবে বলছেন যেনো ইউ ক্রাশড অন মি।'

টায়রা মুখ ঘুরিয়ে তাকালো। লুকিং গ্লাসে তা দেখে আর্দ্র হেসে দিলো। সেই হাসি যেনো ধনুকের মতো অপমান সূচক হয়ে বিধলো টায়রার হৃদয়ে।

চলবে

Masum, Tasmia haq, Sume akter, Hasibul hasan santo, Abul basar, Santa akter, Sk sagor and লেখাটি পছন্দ করেছে

Sponsored content

বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ Empty Re: বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ

Back to top
Permissions in this forum:
You cannot reply to topics in this forum