সাদা কাগজ
Would you like to react to this message? Create an account in a few clicks or log in to continue.

Go down
avatar
Onu kotha
শুকতারা
শুকতারা
Posts : 56
স্বর্ণমুদ্রা : 1339
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-05-26

বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ - Page 4 Empty Re: বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ

Wed Jun 30, 2021 9:42 pm
মুমুর্ষিরা শাহরীন

৩১.
'এক্ষুনি আমার সাথে দেখা করুন।' সাপের ন্যায় ঠান্ডা গলায় বলল টিকলি।

ঘড়িতে তখন বাজে রাত এগারোটা। আদর রাউন্ডে ছিলো। টিকলির কথা শুনে ফিসফিস করে বলল,

'টিকলি, আমি এখনো হসপিটালে।'

তখনি আকস্মিক এক কাজ করে বসলো টিকলি। ছাদ কাঁপিয়ে চিল্লিয়ে বলল,

'চুলোয় যাক সব। এক্ষুনি মানে এক্ষুনি। দেখা করুন।'

আদর অবাক হলো। মাত্রই রণচণ্ডী অন্য আরেক টিকলিকে আবিষ্কার করলো। বিস্ময়ের সাগরে হাবুডুবু খেতে খেতে মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলল। শান্তশিষ্ট টিকলিরও যে এমন একটা রূপ আছে তা আজ প্রথম দর্শন পেলো। সারাদিন মাত্রাতিরিক্ত ব্যাস্ত থাকায় আদরের মেজাজটাও বিগড়ে যাওয়ার পথে। ব্যস্ততার কবলে পরে আদর আজ টিকলিকে ফোন দিতে পারেনি। টিকলি অনেকবার ফোন করলেও ধরতে পারেনি। তাই বলেই কি এতো রাগ দেখাতে হবে? আদরের বিষয়টা বুঝবে না?

'একটু বুঝার চেষ্টা করুন...'

আদরের কথা শেষ হওয়ার আগেই টিকলি আবারো চেঁচিয়ে উঠলো, 'আমি কিচ্ছু বুঝতে চাই না...কিচ্ছু না। এক্ষুনি দেখা করুন।'

আদর অসহায় সাথে একটু শক্ত গলায় বলল,

'আপনার বুঝতে হবে টিকলি আই এম আ ডক্টর। এতো অবুঝপনা আপনাকে মানায় না। প্লিজ ট্রাই টু বি আন্ডারস্ট্যান্ড।'

টিকলি অবাক গলায় বলল,

'অহংকার দেখাচ্ছেন, ডাক্তার? আপনার কাছে যদি আপনার ডাক্তারি পেশাটাই এতো বড় হয়ে থাকে তাহলে আমি কোথায়? না একটা ফোনকল, না একটা মেসেজ, নো নাথিং। দিজ ইজ কলড রিলেশন? যদি এটাকেই সম্পর্ক বলে তাহলে চাই না আমার এমন সম্পর্ক।'

টিকলির কথায় আদর হতবাক হয়ে গেলো। বুদ্ধিমান আদর উত্তর দেওয়ার মতো কিচ্ছু খুঁজে পেলো না। অকূলপাথারে পড়লো যেনো। টিকলি আবার বলল,

'আমার নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। আপনি কালকেও আমার সাথে কথা বলেননি। কি করছেন টা কি আপনি? পাঁচদিন হয়ে গেলো কোনো দেখা-সাক্ষাৎ কিচ্ছু নেই আমাদের। আপনার কাছে আমি ব্যতীত বাকি সব ইম্পোর্টেন্ড। তাহলে আমি কে? আমাকে এভাবে জীবনে রাখার মানে কি? বাদ দিয়ে দিন। তবুও এতো কষ্ট কেনো দিচ্ছেন? কথা বলছেন না কেনো ডাক্তার?'

টিকলি আবারো চিল্লিয়ে উঠলেই ওপাশ থেকে ফোন কাটা হলো। বারংবার হ্যালো বলেও কোনো রেসপন্স না পেয়ে টিকলি ছাদের রেলিং ধরে বসে পরলো। ডুকরে কেদে উঠতেই আবারো ফোন লাগালো। অপাশ থেকে ফোন ব্যস্ত পাওয়া গেলো। 'কেটে দিলো?' বিরবির করে টিকলি আরো বার দুয়েক ফোন দেওয়ার পর ওপাশ থেকে ফোন ধরে আদর দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

'আমি এখন ব্যস্ত। সম্পর্ক টায় আমি প্রথম কনফেস করে বোধ হয় ভুল করে ফেলেছি।'

কথাটা বলেই খট করে ফোন কাটা হলে টিকলি স্তব্ধ হৃদয়ে বসে রইল। বুকের মাঝে উথলে উঠলো কান্নার দিল। এতোটা নিষ্ঠুর হতে পারলেন উনি?

খানিক বাদেই পেছনে এসে পরম যত্নে টিকলির কাধে হাত রাখলেন জামিলুর রেজা। চমকে ভেজা চোখে পেছনে ফিরে তাকিয়ে বাবাকে দেখতেই জামা ঝাড় দিয়ে তড়িঘড়ি করে উঠে দাড়ালো টিকলি। জামিলুর রেজা মেয়ের চোখ মুছে মেয়েকে ধরে দোলনায় বসালেন। টিকলি আত্মা ঢিপঢিপ করছে বাবা কিছু শুনে ফেলার ভয়ে। জামিলুর রেজা মেয়ের মাথা নিজের কাধে রাখলেন। এরপর খুব আদুরে স্বরে বললেন,

'কাদছিলি মা?'

টিকলি দীর্ঘ স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে বাবাকে ঝাপটে ধরতেই অবাধ্য অবুঝ নয়ন বেয়ে নীর পরতে লাগলো বিরামহীন। জামিলুর রেজা হতাশ শ্বাস ফেলে হঠাৎই বললেন,

'আমাকে মাফ করে দে মা।'

টিকলি অবাক চোখে তাকালো। বাবা আবার বললেন,

'আমি ভুল করেছি। তুই এতো কষ্ট পাবি জানলে এসব করতাম না। আমি আর কখনো তোকে বিয়ের কথা বলবো না। বিয়ের প্রেসার দিবো না। তবুও কাদিস না মা।'

বাবার এ কথায় টিকলি বিস্ময় নিয়ে তাকালো। খানিক বাদে বুঝে আসলেই টিকলির বুক ফাটিয়ে কাদতে ইচ্ছে করলো। এক বিপদের উপর আরেক মুসিবত। একি হলো? উল্টো বুঝলো কেনো বাবা? টিকলি তো এখন বিয়ে করতে চায়। মুখ ফুটে তো এখন বলতেও পারবে না বাবা আমি একজনকে ভালোবাসি তার সাথে আমার বিয়ে দাও। এমনি ওদের পরিবারের সাথে সম্পর্ক খারাপ তারউপর বাবা উল্টো বুঝলো এরসাথে আদরের সাথে ঝগড়া ফ্রি। টিকলির চিতকার করে বলতে ইচ্ছে করলো,

'যখন বিয়ে করবো না বলেছি তখন বিয়ে বিয়ে করে লাফিয়েছো। এখন বিয়ে করতে চাই কিন্তু তার আগেই তোমরা বলে দিলে আমাকে আর বিয়ে নিয়ে প্রেসার দিবে না। এখন নিজের বিয়ের কথা কি নিজে মুখ ফুটে বলে বেহায়া পদবি লাভ করবো?'

_________________________________

ভোর সাড়ে পাঁচটা। সকালের প্রথম রোদ-আলোটা পর্দার ফাঁকফোঁকর গলিয়ে সাদা ঝকঝকে মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছিলো। মিষ্টি সরু রশ্মির বিচরণ সারা ঘরময়। আবহাওয়া দেখে বোধ করা যায় আজ বৃষ্টি নাও হতে পারে। তবে আষাঢ় মাস, এখান বৃষ্টি নিয়ে কোনো গ্যারান্টি দেওয়া যায়না। ফজরের নামাজ পড়ে চোখ লেগে আসতে না আসতেই টিকলির ফোনটা বিকট আওয়াজে চেঁচিয়ে উঠলো। আধো চোখ খুলে ফোনের দিকে তাকাতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো 'বাদর ডাক্তার' নাম। টিকলি ফোন কেটে দিয়ে উল্টো করে রাখলো। একটুপর আবারো বাজা শুরু করলো। নিজের মতোই কেটে গেলো। আবারো বিকট শব্দে বাজতেই ঘুমুঘুমু অবস্থায় বিরক্তি নিয়ে টায়রা মাথার পাশ থেকে কুশন ছুড়ে মারলো ফোনের উপর। যারপরনাই গলায় বলল,

'ফোন এক আছাড় মাইরে ভাইঙ্গে ফেলমু এখন। ধরস না কে? তোর আশিক ফোন দিতে দিতে মইরে গেলো তো।'

টিকলি ততক্ষণে উঠে বসেছে। টায়রার দিকে তাকিয়ে রাগীস্বরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

'আশিক আবার কি? ভাষা ঠিক হবো না তোর? বেয়াদব।'

ফোনটা আবার বাজতে শুরু করলো। আরো দু তিনবার বেজে বেজে কেটে যাওয়ার পরও ধরা হলোনা। তবুও ফোনের কোনো ক্লান্তি নেই। আবারো বেজে উঠলো। টিকলি অসহায় টলমলে চোখে তাকিয়ে ফোন রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে ব্যস্ত গলায় কেউ বলল,

'আধ ঘন্টার মধ্যে নিচে নামুন উইথ ব্ল্যাক শাড়ি।'

টিকলি অবাক হলো। অতিমাত্রায় রাগ নিয়ে বলল,

'ফোন কেনো দিয়েছেন?'

আদর ক্লান্ত গলা ঠেলে দিয়ে বলল, 'প্লিজ টিকলি নামুন। আমি ভীষণ ক্লান্ত। সারারাত ঘুমাইনি।'

আদরের অসহায় গলা শুনে টিকলি থেমে গেলো। চোখের পাতা জোড়া ছলছল করে উঠলো। চোখ বন্ধ করে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে রুদ্ধশ্বাসে বলল,

'শাড়ি পড়তে পারবো না। আমি শাড়ি পড়তে জানিনা।'

ওপাশ থেকে আর শোনা হলোনা। ফোন কেটে দিলো। টিকলি হতাশ নিষ্প্রাণ চোখে তাকিয়ে বারান্দার সামনে থেকে রাস্তায় উঁকি দিলো। কিছুক্ষণ উঁকি ঝুঁকি দেওয়ার পরই কালো পাঞ্জাবিতে শ্যামলা রাগী মুখশ্রীতে দাড়িয়ে থাকা দেখা গেলো আদরকে। টিকলি নিষ্চ্ছল পায়ে হেটে টায়রার সামনে এসে টায়রাকে টেনে তুললো। টায়রা বিরক্তি নিয়ে উঠে বলল,

'তোদের সমস্যা কি একটু বলবি? সবাই প্ল্যান করছোস যে আমাকে আজকে ঘুমাতে দিবিনা? একটু আগে তোর জামাই ফোন করে করে কানের বারোটা বাজালো সাথে ঘুমেরও। এখন আবার তুই শুরু করলি?'

আলমারি থেকে কালো রঙের একটা জামদানি বের করে টায়রার হাতে ধরিয়ে দিয়ে গুরুগম্ভীর মুখে টিকলি বলল,

'তাড়াতাড়ি পড়ায় দে। দশ মিনিট সময়।'

শাড়িটা হাতে নিয়ে উল্টে-পাল্টে বিস্ফোরিত চোখে দেখতে লাগলো টায়রা। এরপর খুব আহত গলায় বলল,

'শেষমেষ কি তোদের পাবনায় এডমিট করতে হবো? এন্ড দ্যা ক্যাপশন ইজ, প্রেমে পাগল।'

টিকলি ভ্রু কুচকে তাকালো। টায়রা খানিক উচ্চস্বরে বলল,

'এতো সকালে কালো শাড়ি পইড়ে কই যাবি?'

'শোক পালন করতে। এখন তাড়াতাড়ি পড়ায় দে।'

'আজকে কি? কোনো দিবস? বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু দিন কি? নাকি গনহত্যার দিন নাকি একুশে মার্চ?'

'তুই কি পড়াবি?'

'পড়াইতাছি। কিন্তু বুঝলাম তোরা মানসিক প্রতিবন্ধী তাই এই ভোর বেলা শাড়ি টাড়ি পড়ে ঘুরতে যাইতাছোস কিন্তু আব্বু আম্মু জিগাইলে কি কমু?'

'বলবি বান্ধবীরা মিলে আজকে প্ল্যান করছিলাম কালো শাড়ি পরে পিকনিক করতে যামু।'

'কিন্তু আমি গেলাম না কে?'

'তোর পেট খারাপ।'

'আস্তাগফিরুল্লাহ! এখন যদি সত্যি সত্যি পেট খারাপ হয়ে আমার বাথরুমে দৌড়াইতে হয় তাইলে দেখিস তোরে কি করি?'

,

কড়া রোদ উঠে গিয়েছে। আকাশে সাদা আলোর ঝলকানি। তবুও বিরক্তহীন ক্লান্ত দেহে আদর গাড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কালো পাঞ্জাবির সাথে হাতে পড়া কালো ঘড়িটা এক ঝলক দেখতেই আবিষ্কার করলো ঘড়িতে ছটা বিশ বাজে। প্রায় এক ঘন্টা যাবত আদর এভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। শ্রান্ত নিরব নিধ্র চোখ দুটো নিয়ে এদিক-ওদিক তাকাতেই দূরে আবিষ্কার করলো নির্জন রাস্তা পেরিয়ে কালো শাড়ির কুচি ধরে ব্যস্ত পায়ে হেটে আসছেন মহারানী। মহারানীর মাথায় বড় করে ঘোমটা দেওয়া। যার দু'পাশে দু'আঙ্গুল দিয়ে রাজকীয় ভাবে ধরে হেটে আসছেন তিনি। আদর তাকিয়ে থাকলো অন্তকাল পরিশ্রান্তের ন্যায় চোখের পলক না ফেলে। আস্তে আস্তে মহারানী কাছে চলে আসলো। আদরের অবচেতন হাত মহারানীর জন্য গাড়ির দরজা খুলে দিলো। টিকলি ভ্রু কুচকে বলল,

'গাড়ি কার?'

আদরের ঘোর কাটলো। বিপন্ন গলায় বলল,

'অবশ্যই আমার।'

টিকলি আর উত্তর দিলো না। গাড়িতে না উঠেই বলল,

'কি বলতে চান বলুন?'

'কি বলতে চাই মানে? গাড়িতে উঠুন।' আদর রাগী গলায় বলে।

'কেনো উঠবো?' চট করে মাথার আচঁল ফেলে দিয়ে চোখ কুচকে টিকলি বলল।

'দেখুন টিকলি আমি প্রচন্ড টায়ার্ড। হসপিটাল থেকে ভোরে বাসায় গিয়ে ফ্রেস হয়ে পাঞ্জাবিটা পরে ওমনি বের হয়েছি। জেদ ধরবেন না প্লিজ।'

টিকলি জ্বলজ্বল চোখে চেয়ে নির্বাকে গাড়িয়ে উঠে বসলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আদর গাড়িতে উঠে বসতেই টিকলি বলল,

'এসেছেন কেনো? কাল রাতে যখন আসতে বললাম তখন তো আসেন নি।'

'আমি ব্যস্ত ছিলাম টিকলি। আপনার বুঝতে হবে। আমার সমস্যাটা আপনি না বুঝলে আর কে বুঝবে?'

'আমার বেলায় কেনো আপনার এতো সমস্যা, ডাক্তার?'

'আপনি এতো অবুঝের মতো কথা বলছেন কেনো টিকলি?'

'ঠিক আমি অবুঝ। তো, এই অবুঝের সাথে তো থাকা যায়না। আপনি বরং এক কাজ করুন। খুব বুঝমান কাউকে খুঁজে নিন।'

এই বলেই টিকলি দরজা খুলে নামতে ধরলো আদর তাড়াতাড়ি হাত চেপে ধরে টিকলিকে টেনে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

'সমস্যা কি হ্যাঁ? আপনার জন্য এই ভোরবেলা আমি না ঘুমিয়ে ছুটে এসেছি। আর আপনি তেজ দেখিয়েই যাচ্ছেন। ব্যস্ততা থাকলে কি আমার দোষ? ব্যস্ত থাকতে কি আমার খুব ভালো লাগে? আর অন্যকাউকে খুঁজে নিবো মানে কি? কালকেও এ কথা বলেছেন। এ কথা শুনেই তো আমি ফোন কেটে দিয়েছি। জানেন সারারাত একটা কাজেও আমার মন বসেনি। শুধু নিজের দিকটা ভাবেন। আমার উপর যে কতটা প্রেসার যায় তা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা ব্যাথা নেই আপনার।'

আদর হাত ঝাড়া মেরে ছেড়ে দিয়ে নিজের সিটে বসে চোখ বন্ধ করলো। নিজের হাত ধরে টিকলি বসে থাকলো। খুব আড়ালে কাজল রাঙা চোখ দুটো থেকে কয়েক ফোটা পানি পরে গেলো। চুড়ি গেথে ফর্সা হাত লাল হয়েও যাওয়া হলো। নিঃশব্দে থেকেই হঠাৎ ডুকরে কেদে উঠলো টিকলি। আদর চোখ খুলে আহত দৃষ্টিতে তাকালো। এই মেয়েটার হয়েছে টা কি? আদর মেয়েটার মনের হাব-ভাব কিছুতেই ধরতেই পারছে না। এই একটু আগে তেজ দেখালো এখন আবার কান্না! কি মুশকিল! আদর ক্লান্ত গলায় বলল,

'আপনি নাকি কাদেন না টিকলি তবে এখন কেনো কাদছেন? একটু বকাও কি সহ্য করা যায় না?'

টিকলি ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর বৃথা চেষ্টা করে অন্যদিকে ফিরে তাকালো। আদরকে মন দিয়ে দেওয়ার পর থেকেই তার সব নিয়ম উলোটপালোট হয়েছে। এখন অকারণেই সে বড্ড কাদে। তবে খুব গোপনে। সবার অগ্রচরে।

আদর হাত বাড়িয়ে টিকলির মাথাটা নিজের বুকের একপাশে রাখলো। টিকলির কান্নার বেগ বাড়লো। মানুষটার এই প্রথম এতো কাছের ছোঁয়া পেয়ে আবেগে অতিমাত্রায় আপ্লুত হয়ে গেলো। বোধ হলো, একটু বেশি করে ফেলেছে সে। বারকয়েক টিকলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে টিকলিকে শান্ত করতেই খুব নরম সুরে আদর বলল,

'এবার বলুন তো, এতো হামকি-ধামকির কারন কি? কাল রাতে এতো জোরে চিতকারই বা করা হচ্ছিলো কেনো?'

টিকলি নাক টেনে টেনে বলল, 'কাল রাতে আমাদের এক দূরের ফ্রেন্ড সুইসাইড করেছে।'

আদর ভ্রু কুচকে বলল, 'তার সাথে এসবের সংযোগ কি?'

'ও সুইসাইড করেছে ওর বয়ফ্রেন্ডের জন্য। ওর বয়ফ্রেন্ডও একজন ডাক্তার। প্রথম কিছুদিন খুব ভালোভাবে রিলেশন টা চললেও একসময় ওর বয়ফ্রেন্ড ওকে এড়িয়ে যেতে শুরু করলো। দেখা করতো না, ফোন দিতো না, ফোন রিসিভও করতো না। পরে জানা গেলো হসপিটালের কোনো এক নার্স এর সাথে ডাক্তারের প্রেম চলছে। খুব ভালোবেসেছিলো ছেলেটাকে। শোকে সুইসাইড করলো।'

আদর অবাক গলায় বলল, 'মানে সিরিয়াসলি? তার মানে এরজন্যই আপনি কাল অজস্র বার আমাকে ফোন দিয়েছেন। ফোনে আমাকে না পেয়ে ভেবেছেন আমিও কোনো নার্স নিয়ে বিজি। এজন্যই এতো রাগারাগি?'

টিকলি কোনো উত্তর না দিয়ে আদরের বুক থেকে সরে এলো। মাথা নিচু করে বলল,

'এখন আমি কি করবো?'

'ওহ মাই গড। ভেবেছিলাম ম্যাচিউর মেয়ের প্রেমে পরেছি। বিন্দাস লাইফ। কোনো প্যারা নাই। কিন্তু আপনি তো দেখি...'

আদরের কথা শেষ হওয়ার আগেই গাল ফুলিয়ে টিকলি বলল, 'তো যান, ম্যাচিউর মেয়ে খুঁজে নেন আমার কাছে কি?'

টিকলি আবারো নেমে যেতে ধরলেই আদর হাত চেপে ধরে রাগী গলায় বলল,

'আপনি কি নতুন কাউকে পেয়েছেন? সত্যি করে বলুন? বারবার অন্যকাউকে খুঁজে নিতে বলছেন কেনো? আমার কিন্তু রাগ হচ্ছে প্রচন্ড। '

টিকলি চোখ মুখ বিকৃত করে হাত মোচড়াতে মোচড়াতে বলল, 'উফফ...ডাক্তার ব্যথা পাচ্ছি তো। একটু আগেও এখানেই ধরেছিলেন। চুড়ি গেথে গেছে।'

আদর হাত ছেড়ে দিয়ে গম্ভীর ভারিক্কি মুখে বসে রইল। আড়চোখে তাকিয়ে টিকলি বলল,

'কোথায় যাবো আমরা?'

গম্ভীর মুখেই উত্তর দিলো আদর, 'যেখানে যেতে চাইবেন। সারাদিনের জন্য ছুটি নিয়েছি। তবে রাতে ব্যস্ত থাকবো তখন আবার এইসব উল্টাপাল্টা ভেবে বসবেন না।'

'সত্যি? চলুন তবে। আজ মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়াল দিবো আকাশে। তবে গাড়ি না নিয়ে রিক্সা নিলে ভালো হতো।'

'এখানে রিক্সা নিলে কেউ দেখে চিনে ফেলার চান্স থাকতে পারে। পরে আপনার সমস্যা হবে যেহেতু এলাকা আপনার। সামনে কোথাও থেকে রিক্সা নিয়ে ড্রাইভারকে ফোন করে গাড়ি পাঠিয়ে দিবোনি।'

'ইশশ...এত্তো ভালো কেনো আপনি ডাক্তার?'

আদর হেসে দিয়ে বলল,

'হুম। কাল রাতে এক মুহুর্তের জন্য এ কথাটা ভুলে গিয়েছিলাম আমি।'

চলবে

Ohi islam, Hasan molla, Taniya akter, Md jahid, Tanjid khan, Alon adnan, Angel riya and লেখাটি পছন্দ করেছে

avatar
Onu kotha
শুকতারা
শুকতারা
Posts : 56
স্বর্ণমুদ্রা : 1339
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-05-26

বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ - Page 4 Empty Re: বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ

Wed Jun 30, 2021 9:42 pm
মুমুর্ষিরা শাহরীন

৩২.
সূর্য তখন আকাশের মাঝ বরাবর। দ্বিপ্রহরের কড়া উত্তাপ সাথে মনের কোলাহল। প্রসন্ন চোখ দুটি মাঝেমধ্যে চেয়ে দেখে আদরকে পরমুহূর্তেই মজার কোনো কথা শুনে খিলখিল করে হেসে উঠে অবিচ্ছেদ ঠোঁটে। তৃষ্ণায় ধুঁকছে গলা তবুও অন্যরকম প্রশান্তি শরীর জুড়ে। অল্প একটু চাওয়ার থেকে অধিক পাওয়ার সুখ অন্তরে। কালো রঙ মোড়ানো দেহ ভরপুর। শাড়িতে পা বেজে পড়ে প্রায় যেতে যেতেই রোদে ভিজে ক্লান্ত শরীরে প্রিয় মানুষটি ধরে ফেলার বারংবার অনুভূতির কাঁপন ধরানো। হাতের ভাঁজে হাত রেখে রিক্সা দিয়ে সারা ঢাকা শহর চষে বেড়ানো। প্রেম প্রেম ভাব ছড়িয়ে দেওয়া যে প্রেম করে নাই কবুও। এমনি কড়া উত্তাপের মধ্যাহ্নে টিকলি তৃষ্ণার্ত গলায় বলল,

'পিপাসা পেয়েছে। খিদেও পেয়েছে। আপনি এমন কেনো ডাক্তার? এতো কিপ্টা! সেই ভোরে বেরিয়েছি অথচ এখনো খাওয়ার নাম নিলেন না।'

আদর স্মিত হেসে বলল,

'এই যে এতো জায়গায় টাকা দিয়ে ঘুরালাম তবুও পেট ভরলো না? এখন এক্সট্রা টাকা খরচ করে আবার আলাদা খাওয়াতেও হবে?'

টিকলি অবাক হয়ে ভ্রু কুচকে বলল,

'হোয়াট আ বিশাল কিপ্টা ইউ আর!'

আদর ঠোঁট প্রসারিত করে মাথা দুলিয়ে হেসে দিলো। টিকলি আদরের চুল ঠিক করে দিতেই টিকলির হাতের ভাঁজে হাত রাখলো আদর। পরমুহূর্তেই রিক্সার হুট উঠিয়ে দিয়ে বলল,

'চলুন তবে, কিপ্টার আরেকটু কিপ্টামি দেখাই।'

টিকলি ফিসফিস করে বলল,

'মানে? আর হুট উঠালেন কেনো ডাক্তার?'

'রোদের তাপ দেখেন না? ভীষণ গরম! মাথা গরম হয়ে যাচ্ছিলো।'

আদরও ফিসফিস করে টিকলির মতো করে বলল। ফিসফিস শব্দ বাধা পেয়ে বারংবার কানে এসে লাগতে থাকলো। বাতাসের দাপটে অস্ফুটে ফসফস ধ্বনি শুনা গেলো। শরীর শিহরিত হলো। সচেতন দৃষ্টিতে আদরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে টিকলি বলল,

'আপনার মতলব কি ডাক্তার? আর খিদে পেয়েছে বললাম না। কিপ্টামি বাদ দিয়ে কোনো রেসটুরেন্টের সামনে রিক্সা দাড় করান। ডাক্তার রা আসলেই কিপ্টা হয় টায়রা ঠিক বলে।'

আদর মাথা দুলিয়ে আবার হেসে বলল,

'আপনাকে একটা রয়েল রেসটুরেন্টে নিয়ে যাই চলেন। আমার রয়েল রেসটুরেন্ট। আমার পকেটও বাঁচবে আপনার খাওয়াও হবে।'

,

দুপুরে খেতে বসেই জামিলুর রেজা প্রশ্ন ছুড়লেন টায়রার দিকে,

'টিকলি কোথায় টায়রা?'

টায়রা কিছুক্ষণ তুতলিয়ে বলল, 'পিকনিকে গেছে। কেনো মাকে বলেছিলাম তো।'

শায়লা আক্তার চোখ বড় বড় করে বললেন,

'মিথ্যাবাদী। তুই কখন আমাকে বললি? দরজায় তো এ বেলা অবধি খিল দিয়ে বসেছিলি। ডাকলেও সাড়া দিসনি। সকালের খাবারটাও খাসনি। আর এখন শুনছি টিকলি পিকনিকে গেছে।'

ঢোক গিলে জোরপূর্বক হেসে টায়রা বলল, 'ওহ বলেনি? ভুলে গিয়েছিলাম বোধহয়। '

জামিলুর রেজা চিন্তিত মুখে ভরাট গলায় বললেন,

'পিকনিকে গেছে? কাদের সাথে? কখন গেছে?'

'বান্ধবীদের সাথে। সকালে গেছে।'

'এখনো ফিরলো না যে?'

'একটা বান্ধবীর বাসায় পিকনিক করছে তো। ওদের সুন্দর বাগান বাড়ি আছে। সারাদিন ওখানেই থাকবে।'

'তুমি যাওনি কেনো তাহলে?'

টায়রা ইতস্তত করে বলল, 'ইয়ে মানে, আমার সকাল থেকে পেট খারাপ ছিলো। এর জন্যই তো সকাল থেকে দরজায় খিল দিয়ে বসেছিলাম।'

শেষের কথাটা খুব উৎফুল্লের সুরে বলল টায়রা।জামিলুর রেজা টায়রার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

'কি বলো? এখন ভালো আছো? খাবার-দাবার একটু মেইনটেইন করতে পারো না? ফাস্টফুড কমিয়ে খাও।'

'আচ্ছা বাবা।'

'এখন শরীর সুস্থ আছে তো? কয়বার বাথরুমে গিয়েছো? বেশি খারাপ শরীর?'

টায়রা বিরবির করলো, 'খাওয়ার সময় এসব কি শুরু করলো আব্বু? বারবার এই কথা কেনো তুলতাছে? আল্লাহ জানে সত্যি সত্যি না আমার পেট খারাপ হয়ে যায়।' চোখ মুখ কুচকে টায়রা উত্তর দিলো,

'হুম। একদম সুস্থ আছি।'

'তাহলে এখন যেহেতু সুস্থ আছো তাহলে তুমিও পিকনিকে চলে যাও। ঘুরে ফিরে বিকালেই এসে পরো দুই বোন মিলে।'

টায়রা অবাক হয়ে তারস্বরে চেঁচিয়ে বলল, 'অ্যা...???'

জামিলুর রেজা খাওয়া থামিয়ে অবাক গলায় বললেন,

'হ্যাঁ, তুমি তো বললে তোমার কোনো এক বান্ধবীর বাসায় পিকনিক হচ্ছে তো যেহেতু সুস্থ আছো তাহলে বাসায় বসে থেকে শুধু শুধু ইঞ্জয় থেকে বঞ্চিত থাকবে কেনো? গো এন্ড ইঞ্জয় ইউর সেল্ফ।'

'কিন্তু বাবা...'

শায়লা আক্তার টায়রাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে ফুস করে বলে উঠলেন,

'ঠিক ই তো বলেছে তোর বাবা। তোরা দু বোন তো দুজন দুজনকে ছাড়া থাকতে পারিস না। ওদিকে টিকলিরও বোধ হয় খারাপ লাগছে তোকে ছাড়া। এদিকে তোরও বরিং লাগবে সারাদিন ঘরে একা একা। তার চেয়ে দু বোন একসাথে থাকলে আমরাও একটু নিশ্চিন্ত থাকবো আর তোদেরও ভালো লাগবে। আর এসব পিকনিক টিকনিক তো এখনি করবি কিছুদিন পর যখন বিয়ে হয়ে যাবে তখন তো এসবের জন্য হা-হুতাশ করে মরে গেলোও আর পাবিনা।'

টায়রা আবারো কিছু বলতে গেলে জামিলুর রেজা থামিয়ে দিয়ে সন্দেহপ্রবন দৃষ্টিতে বললেন,

'কি ব্যাপার বলো তো? তুমি কি কিছু লুকাচ্ছো? এমনিতে দু বোন দুজনকে ছাড়া এক মিনিট থাকতে পারো না আর এখন জোর করে পাঠানো যাচ্ছে না। তোমার বান্ধবীর বাসা চিনো নিশ্চয়ই? না চিনলে টিকলিকে ফোন করে ঠিকানা নিয়ে নাও। আমি গিয়ে তোমাকে দিয়ে আসি।'

'না। না। না বাবা আমি একাই যেতে পারবো। আমি...আমি রেডি হয়ে নিচ্ছি।'

,

খয়েরী রঙের গেটের সামনে রিক্সাটা থামতেই নেইম-প্লেট এ দেখা গেলো বাড়ির নাম 'খান ভিলা'। টিকলি অবাক দৃষ্টি নিয়ে তাকালো। ভ্রু কুচকে পুরো তিন তলা বাড়ির এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যবেক্ষণ করে বলল,

'এটা কার বাড়ি, ডাক্তার?'

রিক্সার ভাড়া মিটিয়ে আদর ছোট করে জবাব দিলো,

'আমার।'

চোখ কপালে তুলে টিকলি উচ্চস্বরে বলল,

'কি??'

গেট দিয়ে প্রবেশ করতে করতে আদর জবাব দিলো,

'হুম। আসুন।'

গেটের ভেতর প্রবেশ করেও টিকলিকে আসতে না দেখে আদর আবার পেছন ফিরলো।

'কি হলো আসুন।'

ভীতি গলায় টিকল বলল, 'আপনি কি পাগল হয়ে গেলেন ডাক্তার? আপনার বাড়িতে যাবো মানে? আপনার বাড়িতে গেলেই তো আপনার বাবা-মা আমাকে চিনে ফেলবে।'

'কিভাবে চিনবে?'

'আপনি পাগল হয়ে গেলেন নাকি? আমাদের বিয়ের কথাবার্তা যখন চলছিলো তখন দু পক্ষের ছবি দেওয়া নেওয়া হয়েছিলো না? আমরাই না মূর্খের মতো কেউ কারোর ছবি দেখিনি।'

'আরে কিচ্ছু হবে না আসুন।'

টিকলির হাত ধরে জোরে টেনে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলো।

দরজা খুলাই ছিলো। ভেতরে প্রবেশ করতেই প্রথমে চোখে পড়লো বসার ঘর। বসার ঘরে দেখা গেলো, এক বাটি ভর্তি পপকর্ন হাতে টিভি দেখছে আর্দ্র তার পাশেই বসে আছে নিভা। আদর চমকে তাকালো। টিকলি বিস্ময়, অবাকতার সাথে ভয়ে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে এমন দশা। চোখগুলো হয়ে উঠেছে রসোগোল্লার ন্যায় বড় বড়। এদিকে আর্দ্ররও হাত থেকে পপকর্নের বাটি পরে যাওয়ার জোগাড়। মুখটাকে কিঞ্চিৎ হা করে সে সম্মুখে চেয়ে রইল। নিভা টিভির চ্যানেল পাল্টাতে পাল্টাতে মাথা ঘুরিয়ে টিকলিকে দেখেই থতমত খেয়ে গেলো। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল চোখ বড় বড় করে।

ঘরে চারটি মানুষ একেক জনকে দেখে চাররকম চমকিত নয়নে তাকিয়ে আছে। চমকিত হৃদয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই হিসাব মেলানোর চেষ্টা করলে বারংবার গড়মিল বেধে যাচ্ছে। এদিকে টিকলি দুরুদুরু ভীতু মন সাথে অবাক প্রসন্ন চোখে তাকিয়েই দেখলো সামনের সুদূর ভবিষ্যত। যে ভবিষ্যতে বাধন ছিড়ে যাচ্ছে ওর আর আদরের। টিকলির আত্মা লাফিয়ে উঠলো। আদর স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে নিভার উদ্দেশ্যে বলল,

'তুমি??'

নিভাও একই সুরে প্রশ্ন করলো, 'তুই?'

সাথে আর্দ্রও বলল, 'টিকলি?'

এদের মাঝে থতমত খেয়ে অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে রইল টিকলি। এসব কি হচ্ছে? টিকলি ফিসফিস করে বলল,

'নিভা এখানে কেনো ডাক্তার?'

আদর ফিসফিস করে জবাব দিলো, 'নিভা আমার খালাতো বোন।'

'আপনার বাবা-মা?'

'টেনশন করবেন না বাড়িতে বাবা-মা নেই।'

টিকলি জোরপূর্বক হাসি দিয়ে তাকালো। নিভা চিতকার করে বলল,

'এই তোরা ফিসফিস করস কেন? কাহিনী কি?'

আদর তিনগুন অবাক গলায় বলল, 'নিভা? আমাকে তুই বললা?'

'তোমাকে বলি নাই ভাইয়া। টিকলিকে বলছি।'

'তুমি উনাকে চিনো কীভাবে?'

'আমার বেস্টফ্রেন্ড আর আমি চিনবো না?'

আদর প্রশ্নবিদ্ধ চোখে টিকলির দিকে তাকালো। টিকলি মাথা নাড়ালো। আর্দ্র বাহবা দিয়ে বলল, 'বাহ! ভাইয়া ইউ আর ভেরি ফাস্ট। তো, কেমন আছো টিকলি?'

টিকলি মাথা নাড়িয়ে অনেক কষ্টে গলা দিয়ে আওয়াজ বের করে বলল, 'ভালো। আপনি কেমন আছেন ভাইয়া?'

'আহ দিলে বড় ব্যথা লাগে গো। ভাবী হবা। আপনি ডেকো না প্লিজ। ভাইয়া ডাকো তাতেই বুক খানখান হয়ে যায়।'

টিকলি লজ্জায় রাঙা হলো। আদর শুকনো কাশি দিয়ে উপরে যেতে যেতে বলল, 'ফ্রেশ হয়ে আসছি।'

টিকলি গিয়ে নিভার পাশে বসতেই দেখলো নিভা তার দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে আছে যেনো এখনি গিলে খাবে। টিকলি কিছুই হয়নি এমন গলায় বলল,

'হোয়াট? গরুর মতোন তাকায় আছোস কেন?'

'তুই যে আমার ভাইয়ের সাথে প্রেম করতাছোস এটা আমারে বলছিলি?'

'এটা যে তোর ভাই তুই আমারে বলছিলি?'

নিভা গালে হাত দিয়ে বসে বলল, 'কেমনে মামা? আমার এই ভাইরে তুই পটাইলি কেমনে?'

টিকলি ভাব ধরা গলায় বলল, 'তোমার ভাই ই আমারে পটায়ছে বুঝছো?'

'বিশ্বাসযোগ্য না।'

'না করলি বিশ্বাস। যাই হোক, আন্টি আংকেল কই গেছে?'

'খালামনি, খালু, আমার আব্বু আম্মু সবাই মিলে নানুবাড়ি গেছে। নানার কি জানি জমি সংক্রান্ত ঝামেলা হইছে। বুঝোস না মামা না থাকলে যা হয়। আর তাই আমি এইখানে।'

'কখন আসছোস?'

'দু-তিন ঘন্টা তো হলোই।'

'ওহ।'

টিকলিকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে নিভা বলল,

'বাব্বাহ! শাড়িও পড়ছোস আবার? জীবনেও তো শাড়ি পড়তে দেখলাম না।'

'আজকেই ফার্স্ট পড়ছি। ছয়বার উষ্ঠাও খাওয়া হইছে।'

টিকলি নিভার কথোপকথনের মাঝেই ফোনটা বাজখাঁই শব্দে মেতে উঠলো। কালো রঙের ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে টায়রার নাম্বার দেখেই ভ্রু কুচকালো। কল রিসিভ করে উদ্ধিগ্ন গলায় বলল,

'কি রে কিছু হয়েছে? কোনো সমস্যা? আব্বু আম্মুকে সবকিছু ঠিক মতো বুঝায় বলছিলি?'

আর্দ্র টিভি দেখায় মগ্ন ছিলো এতোক্ষন। টিকলির কথার ধরন দেখেই বুঝে ফেলেছে মিস. চাপাবাজ ফোন দিয়েছে। কান খাড়া করে আর্দ্র শুনতে লাগলো। এর মাঝেই নিভা হাত বাড়িয়ে ফোনের লাউডস্পিকার অন করে দিলো। ওপাশ থেকে টায়রা তখন বলল,

'রাখ তোর বালের ঢং। আমার মেজাজ হাই লেভেলে গরম আছে।'

আর্দ্রর গলায় পপকর্ন আটকে কাশি উঠে গেলো। টিকলি লাউডস্পিকার অফ করতেই নিভা আবার অন করে দিলো। টিকলি মিনমিন করে বলল, 'কি হয়েছে?'

টায়রা কাদো কাদো গলায় বলল,

'সকাল থেকে খাই নাই। দরজা বন্ধ করে বসেছিলাম। কাউকে জানাই নাই তুই বাসায় নাই। কিন্তু দুপুর একটা বাজতেই পেটে ইঁদূর দৌড়াদৌড়ি শুরু করলো। কোনোমতে আধঘন্টা নিজেকে কন্ট্রোল করার পর ঘর থেকে বের হয়ে দেখি বাবা খাবার নিয়ে টেবিলে বসে আছে। আমি যেতেই তোর কথা জিজ্ঞেস করলো। আমি বললাম তুই পিকনিকে গেছিস সারাদিন থাকবি। সবকিছু বলা শেষ হতেই বাবা বলল তাহলে তুমিও যাও। টিকলি হয়তো বোর ফিল করছে আর তোমারও নিশ্চয়ই খারাপ লাগছে বান্ধবীরা সবাই মজা করবে আর তুমি এখানে বসে থাকবে?'

'কেনো? তুই বলস নাই তোর পেট খারাপ?'

'বলছি তো। এটাও বলছি পেট খারাপ ভালো হয়ে গেছে।'

এ পর্যায়ে আর্দ্র নিভা ফিক করে হেসে দিলো। টিকলি নিভার দিকে কটমট করে তাকিয়ে ফোনের লাউডস্পিকার অফ করে দিয়ে বিরবির করে বলল, 'মাথামোটা।'

তখনি টায়রা চেঁচিয়ে বলল, 'ওই তুই আমারে কি বললি? আর হাসলো কেরা? নিশ্চয়ই তোর জামাই? একবার হাতের কাছে পাই। ওই শালার লাইগে আজকে আমার এই দূর্দশা। এ্যাহ..রাত পোহাতে না পোহাতেই বউয়ের রাগ ভাঙাতে চলে আসছে সাথে আমার কপালে শনি লিখে নিয়ে আসছে।'

টিকলি কড়া কণ্ঠে বলল,

'থাপ্পড় লাগাবো একটা।'

'হ তুমি তো লাগাবাই। এখন আমি কি করবো সেটা বলো। এই ভর দুপুরে কই যাবো?'

টিকলিও অসহায় কণ্ঠে বলল,

'আমি তো জানি না। কি করবি এখন?'

টায়রা কেদে দিবে এমন গলায় বলল, 'আল্লাহ আমার মরণ নেয় না কেন? এতো বেকুব বোন আল্লাহ আমার কপালেই জুটায়ছিলো। সলিউশন বের করার বদলে উলটে আমাকে জিজ্ঞেস করে।'

সিড়ি দিয়ে নামছিলো আদর। বাড়িটা তিনতলা হলেও এই বাড়িতে দুটো সিড়ি। একতলা দুতলা মিলে ড্রইংরুমের মাঝখান দিয়ে সিড়ি। আর গেট থেকে তিনতলা পর্যন্ত আরেকটা সিড়ি। আদর সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে প্রশ্ন করলো,

'কি হয়েছে টিকলি?'

টিকলি ফোন হাতে নিয়ে সংক্ষিপ্ত করে যতটুকু বলা যায় বলল। এরপর ফোন কানে নিয়ে টায়রাকে বলল,

'এক কাজ কর পার্কে চলে যা।'

টায়রা ফুসে বলল, 'আমার ছোট হইলে ঠাডায়ে একটা চর মারতাম। ভর দুপুরে পার্কে যায়ে রোদ্রের মধ্যে মুড়ি খামু?'

'ওহ তাও তো কথা। তাইলে রেসটুরেন্টে যা। আর তা নাহলে ওয়েট কর আমি আসতাছি।'

আদর ভরাট কণ্ঠে বলল, 'কোথাও যেতে হবে না। আপনি টায়রাকে এখানে আসতে বলুন। আর্দ্র গিয়ে নিয়ে আসবে। চিন্তা করবেন না। বাবা-মা রাত ছাড়া আসবে না।'

টিকলি মাথা নাড়িয়ে বলল, 'আমি চলে যাই না ডাক্তার?'

'না। বিকেলে আমি দিয়ে আসবো।'

টিকলি মিনমিন করে বলল,

'টায়রা তুই এ বাড়িতে আয়।'

'কোন বাড়ি?'

'উনার বাড়ি।'

'কেনো?'

'কারন আমি এখন ওখানেই।'

'ওহ। কিন্তু আমি যাবো না।'

'কেনো?'

'কারন ওই ভাদ্র আছে।'

'কিচ্ছু হবে না লক্ষী বোন আয়। কিছু হলে আমি আজ ভাইয়াকে বকা দিয়ে দিবো।'

টায়রা ভ্রু কুচকে বলল, 'সত্যি?'

'হুম। আয় নিভাও আছে।'

'আচ্ছা।'

ফোন রাখতে গেলেই টায়রার মনে পরলো বাড়ির ঠিকানা ভুলে গেছে ও। যেদিন আর্দ্র এক্সিডেন্ট করলো সেদিন আর্দ্রকে ড্রপ করেছিলো। কিন্তু এখন খেয়াল নেই।

'আমি তো বাড়ি চিনি না।'

টিকলি বলল, 'আর্দ্র ভাইয়া গিয়ে নিয়ে আসবে।'

আর্দ্র বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে এক বাক্যে চিল্লিয়ে বলল, 'না। কোনোদিন না।'

চলবে

Hasan molla, Md ovi, Mahfuj hasan, Jhuma akter, Tahia Tabassum, Sohana islam, Shafayet rakib and লেখাটি পছন্দ করেছে

avatar
Onu kotha
শুকতারা
শুকতারা
Posts : 56
স্বর্ণমুদ্রা : 1339
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-05-26

বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ - Page 4 Empty Re: বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ

Wed Jun 30, 2021 9:43 pm
মুমুর্ষিরা শাহরীন

৩৩.
হিম পবনে শরীর মৃদু কেঁপে উঠছে। সকাল থেকে কড়া রোদ থাকায় আঁচ করা গিয়েছিলো আজ বোধ হয় বৃষ্টি হবে না। কিন্তু আবহাওয়া দেখে মনে হচ্ছে একটু পরই ঝুমঝুম করে বর্ষন পরবে। আর্দ্র বিরক্তি দৃষ্টিতে তাকিয়ে এগিয়ে যেতেই দেখলো টায়রা এসে রিক্সা থেকে নামলো। ভাইয়ের বকা ঝকা শুনে শেষ পর্যন্ত আর্দ্র টায়রাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এসেছে। ব্যাস্ত পায়ে আর্দ্র এগিয়ে গেলো। টায়রা রিক্সা ভাড়া দিয়ে ঘুরে দাড়াতেই আর্দ্র উচ্চস্বরে বলল,

'আপনি আমাদের বাড়ি চিনেন না?'

'কেনো? চেনার কথা ছিলো বুঝি?' টায়রা ভ্রু কুচকে পার্সের চেন লাগাতে লাগাতে বলল।

'মশকরা করছেন? আমি যেইদিন বাইক এক্সিডেন্ট করলাম সেদিন তো আপনি পৌঁছে দিলেন।'

'শুনুন, মিস্টার ভাদ্র, নিজেকে এতোটা ইম্পোর্টেন্ড ভাববেন না। আমি আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলাম বলেই কি আপনার বাড়ির রাস্তা মুখস্থ করে রেখেছি? আর তাছাড়া আমি আপনাদের বাড়িতে প্রথম যাচ্ছি সো আপনার উচিত আমাকে প্রপার ভাবে ট্রিট করা। আপনার তো উচিত ছিলো আমার বাড়ি গিয়ে আমাকে নিয়ে আসা। সেই জায়গায় আমি এতোটা পথ একা এসেছি।'

টায়রা মুখ ভেঙিয়ে কথাগুলো বলতেই আর্দ্র পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে বিদ্রুপাত্মক হাসি হেসে বলল,

'আচ্ছা, এবার এসেছেন আসল কথায়। রাস্তা চেনাটা আসল কথা না একচুয়েলি আমি যাতে নিজে এসে আপনাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাই এটা হলো মূল কথা।'

হাওয়ায় চুল উড়িয়ে দিয়ে টায়রা ভাব নিয়ে বলল,

''এ্যাহ...যেই না তার বদন
ঠিকঠাক নাম হলো মদন।"

আর্দ্র ফুসে উঠে বলল,

'এই...আপনি আমাকে মদন বললেন?'

'তা নয়তো কি? বলেছি না নিজেকে এতো ইম্পোর্টেন্ড ভাববেন না? আপনি কখন এসে আমাকে নিয়ে যাবেন তার আশায় আমি বসেছিলাম নাকি? যেকেউ আসলেই হতো।'

'কেনো আপনি কি কচি খুকি? আপনাকে রাস্তা চিনিয়ে নিয়ে যেতে হবে।'

টায়রা মুখ বাকিয়ে বলে,

'নাহ আমি কচি খুকি না। কিন্তু অপরিচিত কারোর বাড়িতে তো আমি একা একা ঢ্যাং ঢ্যাং করে চলে যেতে পারিনা? আমার একটা প্রেস্টিজ আছে না?'

'ওহ আচ্ছা? তাই নাকি? প্রেস্টিজ? তা শুনছিলাম আপনার নাকি পেট খারাপ? সকাল থেকে এ পর্যন্ত বারো-তেরোবার বাথরুমে যাওয়া-আসাও হয়ে গেছে?'

আর্দ্র ভ্রু নাচিয়ে দুষ্ট মুখচ্ছবিতে বলল। টায়রা বড় বড় চোখ মেলে তাকালো। বিরবির করে বলল, 'এই কথা এই লোক কেমনে জানলো?' আর্দ্র টায়রার চোখের সামনে হাত নাড়ালো। সম্ভিত ফিরে আঙ্গুল তুলে চোখ মুখ কুচকে টায়রা বলল,

'দেখুন, একদম অসভ্যের মতো কথা বলবেন না। ওটা বাবাকে কাটানোর জন্য মিথ্যা বলেছিলাম।'

আর্দ্র হাটা দিলো। হাটতে হাটতেই সুর করে গাইলো দু লাইন,

'বুক চিনচিন করছে হায়,
বাথরুম তোমায় কাছে চায়।'

টায়রা পেছন থেকে চিল্লিয়ে বলল,

'আপনি এতো খারাপ কেনো?'

'যেই একটা সুন্দর গান বললাম ওমনি খারাপ হয়ে গেলাম?'

'এটা সুন্দর গান?'

'অবশ্যই। আপনি জানেন এই গান গেয়ে আমি ছোটোবেলায় ক্লাস টু তে থাকতে প্রাইজ পেয়েছিলাম। তিনজন প্রতিযোগিতা দিয়েছিলো আমি থার্ড হয়েছিলাম। ইয়া বড় একটা পানি খাওয়ার মগও পেয়েছিলাম।'

আর্দ্র দাঁত কেলিয়ে বলল। টায়রা মুখটাকে কিঞ্চিৎ হা করে কিছুক্ষণ আহাম্মক এর মতো তাকিয়ে থেকে রাস্তার মাঝেই হু হা করে হেসে উঠলো। আর্দ্র বিরক্ত চোখে তাকিয়ে চলে যেতে যেতেই অনেক দূরে চলে গেলো। টায়রা পেছন থেকে চেচিঁয়ে বলল,

'এই আমাকে নিয়ে যান।'

'আসেন তাড়াতাড়ি। কোলে নিয়ে যাবো।'

ভ্রু কুচকে রেগে জোর আওয়াজে বলল টায়রা,

'আস্ত একটা বেয়াদব। আমি বলেছি কোলে নিতে?'

______________________________

গালে হাত দিয়ে চিন্তিত মনে সোফায় বসে ছিলো টিকলি। ঠিক তার বরাবর আরেকটা সোফায় বসে ফোন সামনে নিয়ে আড়চোখে টিকলিকেই পর্যবেক্ষণ করা চলছিলো অন্য দুটি অক্ষিপটে। নিভা টিকলির পাশ থেকে বলে উঠলো,

'কি চিন্তা করস?'

বুক ফুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে টিকলি কপাল কুচকে উত্তর দিলো,

'আর্দ্র ভাইয়া গেছে টায়রাকে আনতে এটাই সবচেয়ে বড় চিন্তা।'

আদর ফোন থেকে চোখ সরালো। টিকলির দিকে পুরোদস্তুর তাকাতেই দেখলো নিভা ওর দিকে তাকিয়েছে। আদর আবারো ফোনে ডুব দিলো। নিভা বলল,

'তোরা থাক। আমি ছাদে যাই। এ বাসার ছাদ টা অনেক সুন্দর।'

টিকলি উৎফুল্লতার সুরে বলল, 'তাহলে আমিও যাই, চল। একা একা বসে থেকে কি করবো?'

আদর কোণাচোখে এক ঝলক তাকালো। নিভা খেয়াল করে বলল,

'নাহ তুই থাক। আমি একাই যাই।'

কথাটা বলা মাত্র নিভা দৌড়ে চলে গেলো বাইরে। নিভা চলে যেতেও আদর ভালোভাবে তাকালো টিকলির দিকে। বাইরে তখন ঝড়ো হাওয়া। আষাঢ়ে বর্ষার আগামবার্তা। জানালা দরজার পর্দারা উড়ছে মুক্ত হয়ে। হু হু করে বাতাস ঢুকে ঘরময় হয়ে গেছে অত্যন্ত শীতল। টিকলি উঠে দাঁড়িয়ে জানালার থাই আটকে দিতে দিতে বলল,

'একটু আগেও কি সুন্দর রোদ ছিলো! অথচ এখনি আকাশ মেঘ করেছে।'

আদর গিয়ে দাড়ালো টিকলির পেছনে। খুব সন্নিকটে। সকালে বকুল ফুলের মালা কিনে দিয়েছিলো আদর।টিকলির খোলা চুলের ভাঁজে গাথা বকুল ফুলের মালা, কাজল কালো দুটি চোখ রাঙা, হালকা গোলাপি রং ছোয়ানো দু'ঠোঁট জুড়ে, কানে বড় বড় কালো ঝুমকো, হাতভর্তি কালো লাল মিশ্রণের চুড়ি। নৌকা গলার ব্লাউজে লাল সুতোর কাজ করা। কালো জামদানি শাড়ির লাল আঁচল। আদর হাত বাড়িয়ে থাই খুলে দিলো। হু হু করে আবারো বাতাস ভেতরে ঢুকতেই টিকলি ঘুরে তাকালো। আদরকে এতোটা কাছে দেখে শিরদাঁড়া কেঁপে উঠলো। ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো শরীর জুড়ে। উন্মাদ অনুভূতির চোখদুটো দিশেহারা হয়ে তাকিয়ে রইল ওই শ্যামলা মুখের যুবকটির দিকে। যেই যুবকের চোখ নেশাক্ত। গভীর পাতাল চোখদুটো ভীষণ মাতাল। টিকলির কোমড় ছাড়ানো ঘন কালো রেশমি কেশ আর কালো শাড়ির লাল আঁচল উড়ে এসে পড়লো তার মুখচ্ছলে। টিকলি আস্তে করে সরিয়ে নিলো। আবারো ঘুরে দাড়ালো জানালার দিক। চোখবন্ধ করে আদরে মত্ততা গলায় বলল,

'বাতাসের সাথে বালি আসছে তো ঘরে।'

টিকলির কথা জবাব না দিয়ে দ্বিগুণ মাতালজনিত গলায় আদর বলল,

'এই সুন্দর চুলের ভাঁজে যে একটা টিকলির অভাব আছে তা কি আপনি জানেন, শুকতাঁরার মনতাঁরা?'

টিকলি কোমলতার যোগে চাইলো জানালা গলিয়ে বাইরের পানে। খুব অসহায় চোখ দুটোতে খেলে গেলো নিদারুন প্রেম! প্রেম প্রেম অনুভূতি নিয়ে দুঃখ বিলাশ করে চোখ দুটো বলল, 'এভাবে বলবেন না! আমার দেহের প্রাণ চলে যায়!'

আদর সেদিকে তাকিয়ে আবারো মুগ্ধ গলায় বলল,

'আপনার ইচ্ছা কি টিকলি? যেকোনো ইচ্ছা? এই মেঘলা দিনে ঘরে একলা আমার সাথে কি করতে আপনার বেশি ভালো লাগবে?'

টিকলি চমকে ঘুরে তাকালো। অবাকপ্রসন্ন চোখে তাকিয়ে আদরের চোখে কিছু একটা খুঁজলো। কিন্তু নেই...সেসব অবেদন, অভেদ্য চাওয়া পাওয়া কিছুই আদরের চোখে নেই। আছে শুধু বিশুদ্ধ নিরাপদ ভালোবাসা। ভালোবাসা আর ভালোবাসা। আছে প্রেম, অনুরক্তি, টিকলির প্রতি প্রবল অনুরাগ, মমতা, স্নেহ আর একরাশ মুগ্ধতা। টিকলি আশ্বস্ত হলো। মনে আশ্বাস নিয়ে বলে উঠলো,

'এই বৃষ্টিস্নিগ্ধ দিনে একা আমরা দুজন বারান্দার কিনারে বসে আমি গিটার বাজানো শিখতে চাই, ডাক্তার। আপনার কাছে। আপনি থাকবেন আমার পেছনে বসে আমি থাকবো আপনার সামনে বসে। হাতের উপর হাত রেখে শিখাবেন আমায় গিটার বাজানো?'

আদর মোহবিষ্ট চোখে টিকলির দিকে তাকিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে বলল, 'আসুন।'

,

তখনও বৃষ্টি পড়েনি। মেঘলা সময়ে বারান্দার দ্বারপানে টিকলি বসে ছিলো গ্রাস কার্পেটে গিটার হাতে। একটা কালো রঙের টুল নিয়ে টিকলির পেছনে বসেছে আদর। বাদামী রঙের গিটারে আদর টিকলির হাত বাজিয়ে দিলো। হাতের উপর হাত রাখতেই শিউরে উঠলো দুটি মন। দুজন দুজনার খুব কাছে। অনুভব করা যাচ্ছে হৃদয়ের শব্দ। প্রেয়সীর চুলের ঘ্রাণে মাতোয়ারা অন্তর। আদর বলল,

'আমি গিটার বাজাতে পারি এটা আপনি জানেন কীভাবে টিকলি?'

হালকা ঘাড় ঘুরিয়ে আদরের দিকে তাকিয়ে টিকলি মিষ্টি হেসে ফিসফিস করে বলল, 'সিক্রেট। বলা যাবে না। বলা বারন।'

আদর ভ্রু কুচকে বলল, 'আর্দ্র বলেছে?'

টিকলি মাথা নাড়িয়ে বলল, 'হুম। নিঝুম দ্বীপে একদিন বলেছিলো। সাথে এও বলেছে আপনি খুব সুন্দর গান পারেন।'

'ডাহা মিথ্যা।'

'ডাহা সত্যি। এবার শিখান।'

আদর ধরলো গিটার শক্ত করে। টিকলির হাত তারে লাগিয়ে দেখিয়ে দিতে দিতে সময় পার হলো কিছুক্ষণ। টিকলির হাতে গিটার পেছন থেকে ধরে ছিলো আদর। বাতাসে খোলা চুল এলোমেলো হয়ে বারংবার উড়ে পড়ছে আদরের মুখে আর টিকলি মগ্ন গিটার শিখতে। এদিকে আদর তাকিয়ে ছিলো প্রণয় নয়নে আসক্ত দৃষ্টিতে। হঠাৎ কেউ বলে উঠলো,

'পার্ফেক্ট।'

এরপর আবারো দুই নারী-পুরুষ কন্ঠ সমস্বরে বলল, 'আমরা কিন্তু কিচ্ছু দেখিনি।'

আদর টিকলি চমকে তাকালো। ঘরের দরজার সামনেই দেখা গেলো দুজন দুজনের ফোন হাতে দাঁড়িয়ে আছে। টিকলি ঝটপট উঠে দাড়ালো। উঠে দাড়াতেই টান খেলো আঁচলে। আদরের হাতের নিচে চাপা পড়েছে শাড়ির আঁচল। আদর ছাড়িয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পকেটে হাত দিয়ে অন্যদিক ঘুরে তাকিয়ে শুকনো কাশি কাশলো। টায়রা এগিয়ে এসে প্রফুল্লচিত্তে বলল,

'ভাইয়া, দেখুন তো ছবিটা জবরদস্ত হয়েছে না?'

আদর আড়চোখে তাকালো। আর্দ্র টায়রাকে মাড়িয়ে বলল,

'ভাইয়া, আমারটা দেখো। উনার টা দুই টাকা দামের ফোন। ছবি ভালো আসে না।'

টায়রা চোখ বড় বড় করে কোমড়ে হাত রেখে বলল,

'এই আপনি কোনটাকে দু টাকা দামের ফোন বললেন? ইটস আইফোন।'

'তাই বুঝি? সেকেন্ড হ্যান্ড নাকি থার্ড হ্যান্ড?'

'ফার্স্ট হ্যান্ড। আরে আপনি চিনবেন নাকি? জীবনে আইফোন দেখছেন?'

'তো আমার হাতে এটা কি? নোকিয়া?' আর্দ্র ভ্রু কুচকে হাতের আইফোন দেখিয়ে বলল।

ওদের ঝগড়ার মাঝে টিকলি আদরের দিকে অসহায় চোখে তাকালো। আশ্চর্য ভাবে আদর ঠোঁট চেপে মুচকি হাসলো।

_______________________________

ছাদের কাছাকাছি সিড়িতে আসতেই নিভা শুনতে পেলো কেউ একজন গুনগুন করে মনের সব কষ্ট আবেগ ঢেলে গাইছে,

"ব্যাচেলার আমি ব্যাচেলার
বিন্দাস লাইফে কোনো পেইন নেই আমার
ব্যাচেলার আমি ব্যাচেলার
বিন্দাস লাইফে কোনো পেইন নেই আমার।
ব্যাচেলার হয়ে যখন বাড়ি ভাড়া নিতে যাই
বাড়িওয়ালা বলে ব্যাচেলার এর জায়গা নাই
আংকেল,
আমি আপনার মেয়ের জামাই হতে আসি নাই
থাকার মতো ছোটোখাটো একটা জায়গা চাই
ব্যাচেলার আমি ব্যাচেলার
বিন্দাস লাইফে কোনো পেইন নেই আমার।"

নিভা গোয়েন্দাদের মতো সূক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলো কে গাইছে গান। কিন্তু দেখা গেলো না।গুটিগুটি পায়ে ছাদে উঠলো সে। আন্দাজ করলো যেই চারজনকে ব্যাচেলার ভাড়া দেওয়া হয়েছে হয়তো তাদের মধ্যেই কেউ একজন। বৃষ্টিমুখর দিনে মেঘলা আকাশের দিকে মুখ করে গাইছে কোনো অজানা যুবক। নিভা উল্টো ঘুরে চলে যেতে নিলেই ছেলেটি ঘুরে তাকালো। নিভা অবহেলায় তাকাতে গেলেই থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। অবাকতার চরম সীমানায় পৌঁছে গিয়ে মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলল। ঠোঁট দুটো আপনা আপনি নিজ শক্তিতে আলাদা হয়ে চোখের পলক না ফেলে চেয়ে রইল। রাহুল বিস্ময় নিয়ে বলল,

'আপনি? আপনি টিকলি টায়রার ফ্রেন্ড না? সেদিন না আমাকে রিক্সায়.....'

রাহুলকে মাঝপথে আটকে নিভা স্বগতোক্তি করলো,

'আপনি তো টিকলি টায়রার মামাতো ভাই। আপনি এখানে কি করছেন?'

শেষবাক্য খুব দ্রুত বলল নিভা। রাহুল স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,

'এখানে তো আমি ভাড়া থাকি। কিন্তু আপনি??'

'আদর আর্দ্র ভাইয়াকে চিনেন না? আমি ওদের খালাতো বোন।'

রাহুল হেসে বলল, 'ওহ আচ্ছা। তো কেমন আছেন?'

'ভালো আপনি?'

'যাচ্ছে কোনোরকম।'

নিভা তাকালো সম্পূর্ণ দৃষ্টিতে। রাহুলও তাকালো। চোখে চোখ মিল হলো। নিষিক্ত বাধাহীন অক্ষি। কিছুক্ষণ অস্বস্থিকর মুহুর্ত পার হলো আশেপাশে মাতাল হাওয়ায় ভেসে ভেসে। নীল আকাশ ঢাকা কালো মেঘের চত্ত্বরে। উপরে উড়ে বহুদূর চলে যাওয়া কোনো এক চিলের সান্নিধ্যে।

চলবে

Ohi islam, Taniya akter, Md jahid, Tanjid khan, Alon adnan, Angel riya, Md ovi and লেখাটি পছন্দ করেছে

avatar
Onu kotha
শুকতারা
শুকতারা
Posts : 56
স্বর্ণমুদ্রা : 1339
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-05-26

বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ - Page 4 Empty Re: বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ

Tue Jul 13, 2021 11:21 pm

৩৪.
উড়ন্ত চুলগুলোকে হাত খোপায় বন্দী করতে করতে নিভা প্রশ্ন করলো,

'আপনি এ বাসায় কতদিন থেকে আছেন?'

'এইতো বেশ কিছু মাস।'

'চারজন থাকেন তাই না? আমি শুনেছিলাম দুজন বিবাহিত। আরেকজন কি আপনার সমবয়সী?'

রাহুল হেসে জবাব দিলো, 'আমার বন্ধু। নাম নয়ন।'

'ওহ। আচ্ছা আপনার নিজের বাসা কোথায়?'

রাহুলের চোখে মুখে আকাশের মতোই তখন ঘন কালো মেঘ নেমে এলো। হাসি হাসি মুখ বালুচরে বিলীন হয়ে চোখে মুখে ফুটলো চাপা আর্তনাদ। রাহুল জোরপূর্বক হাসলো শুধু আর কোনো কথা বলল না। নিভা প্রশ্নটা ব্যক্তিগত ভেবে এড়িয়ে গেলেও কৌতুহল লুকাতে না পেরে আবারো প্রশ্ন করলো,

'নিজের ফুফির বাসা রেখে আপনি ভাড়া থাকেন কেনো?'

রাহুল স্মিত হেসে উত্তর দিলো, 'তেমন কোনো কারণ নেই। ওই... কারোর ঘাড়ে চেপে বসে থাকতে ইচ্ছে করেনা। নিজের পায়ে দাড়াতে চাই নিজের পরিশ্রমে।'

নিভা মৃদু হাসলো। এলোমেলো চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে দিতেই খেয়াল করলো তার ভীষণ রকম অস্বস্থি হচ্ছে। এরপর আর কোনো কথা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সাথে এও খেয়াল করলো এতোক্ষণ পর্যন্ত সে নিজেই শুধু বকবক করে গেছে। প্রশ্ন করেছে। আর রাহুল শুধু উত্তর দিয়েছে। এর বাইরে কোনো প্রশ্ন করেনি। নিভার চিন্তা ভাবনায় ভাটা দিয়ে তখনি রাহুল বলে উঠলো,

'আপনি খুব মিশুক কিন্তু আমি একটু ইন্ট্রোভার্ট। লাজুক নই তবে মানুষের সাথে মিশতে একটু সময় লাগে। অপরিচিতদের সাথে একটু কম কথা বলা হয়। আসলে আমার পরিচিত দুনিয়া খুবই সীমিত। সেখানে বলা চলে, এখন আপনিও আমার সেই সীমিত দুনিয়ায় একজন। অল্প হলেও তো পরিচিত।'

পকেটে হাত রেখে ঠোঁটের কোণায় সৌজন্যমূলক হাসি ঝুলিয়ে বলছিলো রাহুল। নিভার মন খারাপ ভাব গুলো কেটে যেতে লাগলো আস্তেধীরে। সে একবার টিকলি আর টায়রার কথা বলতে চাইলো। মনে হলো, টিকলি আর টায়রাকে দেখিয়ে এ মুহুর্তে লোকটাকে দারুন এক সারপ্রাইজ দেওয়া যাক। কিন্তু পরমুহূর্তেই মত পালটানো হলো। মন বলল, নাহ... এখন যদি টিকলি টায়রার সাথে রাহুলকে দেখা করায় তাহলে তো রাহুল বিভিন্ন প্রশ্ন করবে, কেনো এসেছে? কতক্ষন হলো এসেছে? কি করছে এখানে? কার সাথে এসেছে? যদিও নিভার খালার বাসায় এসেছে বলে কাটিয়ে দেওয়া যাবে তবুও টিকলিরা তো বাসায় বলে এসেছে পিকনিকে যাচ্ছে। এখন রাহুল যদি আবার টিকলির বাসায় ফোন করে বলে দেয়। তখন তো আরেক কেলেঙ্কারি। সব ভেবেচিন্তে নিভা আর কিছু বলল না। মানবিকতার খাতিরে সেও হাসি ফিরিয়ে দিলো। রাহুল পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে হাসিমুখে মাথা ঝাকিয়ে বলল,

'এখন আমার ঘুমানোর সময়। এই সময় না ঘুমালে প্রচন্ড মাথা ব্যথা করে বাকিদিন। সরি আপনাকে সময় দিতে পারলাম না। অন্য একদিন জবরদস্ত আড্ডা চলবে।'

,

ঘরে ঢুকতেই নিভা দেখতে পেলো এক পাশের সোফায় বসে আছে টিকলি টায়রা অপরপাশে বসে আছে আদর আর্দ্র। আর্দ্র আর টায়রার মাঝে কিছুক্ষণ আগেই এক দফা তুমুল ঝগড়ার ইতি ঘটেছে। এখন দুজন গাল ফুলিয়ে দু সাইডে বসে আছে। নিভা গিয়ে আর্দ্রর পাশে বসতে না বসতেই টায়রা পিশাচিনীর মতো খেঁক করে বলে উঠলো,

'ওই, ওইপাশে বসছোস কেন? এইপাশে আয়। আমরা এইপাশে চোখে দেখোস না?'

নিভা উঠতে নিলেই আর্দ্র হাত চেপে ধরে বলল,

'নাহ তুই এপাশেই বসবি। আমার সাথে।'

টায়রা ভেঙিয়ে বলল, 'মেয়ে দেখলেই ময়না ছলাৎ ছলাৎ করে! ও আমার বেস্টফ্রেন্ড। আমার পাশে বসবে ও।'

'এক্সকিউজ মি। আপনার বেস্টফ্রেন্ডের আগে ও আমার বোন।'

'তো? বোন তো কি হইছে? বোন বলেই চিপকায় বসতে হবে?'

'কেনো আপনার জ্বলে?' আর্দ্র ভ্রু নাচিয়ে এমন এক ভাবভঙ্গি নিয়ে বলল যে টায়রা ফুসে উঠে টিকলির উপর চেঁচালো এবার,

'এই তুই উঠবি? তোর শ্বশুড় বাড়ি ঘুরা শেষ হয়নাই?'

টিকলি গরম চোখে তাকিয়ে বলল, 'আমি আবার কি করলাম?'

'উঠোস না কেন? বাসায় যাবি না?'

'আপনি যাবেন যান। আমার ভাবীকে নিয়ে টানাটানি করেন কেনো?' আর্দ্র সোফা ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে আবার বলল, 'ভাবী চলে গেলে বেচারা আমার ভাইটা একা হয়ে যাবে না?'

আদর চোখ পাকিয়ে বলল, 'আমি বিয়ে করলাম কবে?'

আদরের কথা কেউ তেমন পাত্তা দিলো না। টায়রা আর্দ্রকে তখনের মতো ভেঙিয়ে বলল,

'এক্সকিউজ মি। আপনার ভাবীর আগে ও আমার বোন। তাও মায়ের পেটের।'

নিভা গালে হাত দিয়ে ঝগড়া দেখতে দেখতে টিকলিকে বলল,

'হোয়াট আ ঝগড়া! ফিলিংস লাইক সিনেমা হলে বসে ঝগড়া শো দেখছি। আমি মুগ্ধ, আপ্লুত, মোহিত!'

কপাল কুচকিয়ে টিকলি বিরক্ত কণ্ঠ ঠেলে বলে উঠলো,

'বাদ দে, এরা সবসময় এমন করে। এতোক্ষণ ছাদে কি করছিলি?'

নিভা যেনো একটা কথার মতো কথা পেলো। খুব উৎসাহ নিয়ে সোফার উপর দু পা তুলে বসে বলল,

'এই তোর একটা মামাতো ভাই আছে না?'

অবহেলার গলায় টিকলি বলল, 'ছিলো একটা।'

'রাহুল নাম না?'

'হ্যাঁ।'

'তুই জানিস সে কোথায় থাকে?'

'এই মিরপুরেই একটা ব্যাচেলর বাসায় থাকে শুনেছিলাম। কিন্তু কোথায় থাকে সেটা জানি না।'

নিভা সোফায় হেলান দিয়ে হেহে করে হেসে বলল, 'এ বাসার উপর তলায়।'

টিকলি নড়েচড়ে বসলো। ভ্রু কুচকে বলল, 'মানে?'

'মানে তোমার একমাত্র মামাতো ভাইটা এ বাসার তিনতলায় ভাড়া থাকে। ব্যাচেলর।'

বিশাল বড় এক হা করে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে টিকলির মনে হলো সে ডুবে যাচ্ছে অকূল পাথারে। নির্জন দ্বীপে সে হারিয়ে গেছে। একা একদম একা টিকলি খুঁজে পাচ্ছে না কোনো দিশা। শুধু মনে হচ্ছে, 'হায় আল্লাহ! এ মেয়ে বলে কি! রাহুল ভাইয়া এ বাসায় ভাড়া থাকে মানে? এবার? এবার কি হবে?'

'ভাইয়া কি আমাকে দেখেছে?'

নিভা হাত নাড়িয়ে মাছি তাড়াবার ন্যায় উত্তর দিলো, 'আরে নাহ।'

'তুই কিছু বলছিস?'

'আরে নাহ। বলতে চাইছিলাম পরে ভাবলাম, অন্তত একটা বাঁশ থেকে তো বান্ধবীকে রক্ষা করি। তাহলে এতো জনমে তোদের সাথে মিলে যে পাপগুলো করছি দয়া করে হলেও আল্লাহ একটা পাপ অন্তত মাফ করলেও করতে পারে।'

'ফাইজলামি করস এই মুহুর্তে আইসে? আমার চিন্তা লাগতাছে। ভাই আমরা এই বাসা থেকে বের হবো কেমনে?'

'কেন বাইরে কি বাঘ দাঁড়ায় আছে অর শিয়াল, কুত্তা, গরু, হাতি, মহিষ এনিথিং?' নিভা ভ্রু কুচকে বলল। টিকলি নিভার বাহুতে পরপর দুটো থাপ্পড় দিয়ে বলল,

'রাহুল ভাইয়া যদি দেখে ফেলে সেটার কথা বলেছি।'

'আরে দেখবে না। প্যারা নিস না। ইউ নো লাইফ ইজ প্যারাহীন। তোর ভাই এখন ঘুমাবে। এ সময় না ঘুমালে নাকি বাকিদিন তোর ভাইয়ের মাথা ব্যথা করে। হুহ...ঢং...।'

নিভা মুখ ভেঙিয়ে বিদ্রুপ করে কথাগুলো বলতেই টিকলি আবার নিভার হাতে থাপ্পড় দিয়ে বলল,

'আমার ভাইকে নিয়ে কিচ্ছু বলবি না। আমার ভাই অনেক ভালো। ওর মতো ভালো মানুষ আর একটাও হয় না।'

টিকলির কথার মাঝপথেই আদর তড়িঘড়ি করে ওর সামনে এলো। টিকলি ভালোভাবে তাকাতেই দেখলো ফর্মাল পোশাকে আদর দাঁড়িয়ে আছে। সোফা ছেড়ে উঠে দাড়ালো টিকলি। মুহুর্তেই বিষন্নতার বৃষ্টি নেমে গেলো মুখে। আদর প্রচন্ড মন খারাপ নিয়ে মুখ ভাড় করে কিছু বলতে চাইলেই টিকলি ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে নরম গলায় বলল,

'কি কাজ পরে গেছে?'

আদর কোনো কথা বলল না। টিকলি চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ চুপ থেকে ঢোক গিলল। অনেক বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,

'সাবধানে যাবেন। আমরাও চলে যাচ্ছি।'

আদর থমথমে মুখে বলল, 'আর কিছুক্ষণ থেকে যান। আমার খুব আর্জেন্ট কাজ পরে গেছে তা নাহলে আমি যেতাম না।'

টিকলির চোখ তৎক্ষণাৎ টলমল করে উঠলো। ভাঙা গলায় বলল, 'থেকে কি করবো ডাক্তার?'

তখনি আর্দ্র হুশিয়ারি দিয়ে বলল, 'আমরা কেউ নই? ভাইয়াই সব? ভাইয়া চলে যাচ্ছে বলেই চলে যেতে হবে? তোমরা পরে যাবে। দরকার পরলে আমি তোমাদের বাসায় দিয়ে আসবো।'

টিকলি জোরপূর্বক মুচকি হাসলো। উপরের দিকে তাকিয়ে চশমার আড়ালে কাজল কালো চোখদুটোর নিচে আঙ্গুল দিয়ে চেপে মুছে নিলো। আদর এক পলক তাকালো টিকলির দিকে। টিকলিও তাকালো। চোখে চোখ মিল হলো। কিছু না বলা ব্যথা অনুভব হলো। কিছু অসহায় কথা বলা হলো। আদর চলে গেলো। টিকলি ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকতেই টায়রা বলল,

'বাব্বাহ! জামাইয়ের জন্য কতো দরদ! জীবনে আমার জন্য কাদছোস এমনে?'

টিকলি উত্তর দিলো না। বিষন্ন মনে সোফায় বসতেই সিড়ির সামনে থেকে আদরের কন্ঠস্বর ভেসে এলো। ভিড়ানো দরজাটা খুলে আদর টিকলিকে ডাকলো। স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে টিকলি ছুট লাগালো। সিড়ির সামনে আসতেই আদর দরজা চাপিয়ে দিয়ে বলল,

'এতো জোরে কেউ দৌড় দেয়? এক্ষুনি তো পড়ে যেতেন?'

'আপনি এখনো যাননি?'

'এইতো চলে যাবো।'

টিকলি আশায় ছিলো হয়তো আদর যাবে না। মাথা নিচু করে ছোট করে সে বলল,

'ওহ।'

আদর টিকলির চুলগুলো কানের একপাশে গুঁজে দিয়ে বলল, 'আর কিছুক্ষণ থেকে যান।'

টিকলির চোখ দুটো আবার ছলছল করে উঠলো। ঠোঁট চেপে বলল, 'যার জন্য থাকবো সে তো চলে যাচ্ছে, ডাক্তার। তবে থাকবো কার জন্য?'

আদর টিকলির গালে এক হাত রাখলো। এরপর খুব নিঃসহায় গলায় বলল, 'আমি তো থেকে যেতে পারছি না, টিকলি।'

আদরের স্পর্শ পেতেই অবাধ্য জলেরা গাল বেয়ে আদরের হাতের উপর দিয়ে গড়িয়ে গেলো। ব্যস্ত হাতে আদর টিকলির চোখ মুছে দিয়ে বলল, 'আহা! কাদছেন কেনো? আপনি এমন করলে আমি যাবো কীভাবে?'

'আপনি বলেছিলেন আজ সারাদিন আমার সাথে থাকবেন। আর এখন মাত্র বিকেল সাড়ে চারটা বাজে।'

টিকলির কথায় আদর হেসে দিলো। এরপর খুব তৃপ্তি নিয়ে বলল, 'কি বাচ্চামো! এই বাচ্চাটাকে কবে যে বউ করে আমার রাজ্যে নিয়ে আসবো!'

আদর হেসে টিকলির গাল টিপে দিলো। এই মুহুর্তে দাঁড়িয়ে থেকে টিকলির মনে হলো, এই বাক্যের মতো এতো সুন্দর কথা আর হতে পারেনা। এতো সুন্দর অনুভূতি এতো সুন্দর মুহুর্ত আর হতে পারেনা কিন্তু সব তো হারিয়ে যাবে। ইশশ...সময়কে ধরে রাখার মতো কোনো মেশিন কেনো নেই টিকলির কাছে? তবে কিছু সময়কে কক্ষনো যেতে দিতো না। আটকে রাখতো সুখময় সময়গুলোকে আর নদীর স্রোতে ভাসিয়ে দিতো দুঃখগুলোকে। তখনি আদর বলল,

'আপনি কি বলতে পারবেন টিকলি? আমার এই আটাশবছর জীবনে কেনো আপনার পা পরলো? আঠারো বছর বয়সে কেনো আপনার পদার্পণ হলো না, আমার বুকে? কিংবা তারও আগে! কতগুলো বছর আপনি হীনা কেটে গেছে ভাবলেই মন বলে, চল আদর। মিশনে নামি। জীবনের আগের অধ্যায়গুলোকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে এসে তোর টিকলির নাম গুলোকে আঠা মেরে বসিয়ে দি। এমন আঠা! যে আঠা জীবনে কেউ লাগায়নি তুই হীনা!'

তখনি যেনো নিরন্তর প্রবল প্রণয়ে ছেয়ে উঠলো টিকলির অন্তঃস্থলে থাকা অন্তঃকরণ। অবিরত ভালোবাসার বুলি বলে ক্রমেই অপস্রিয়মাণ হয়ে যেতে লাগলো আদর। এক পা এক পা করে সিড়ি দিয়ে নেমে চলে গেলো সাথে টিকলিকে দিয়ে গেলো এক আকাশ ভালোবাসা। এক সমুদ্র প্রেম। এক পাহাড় উত্তাল অশান্ত মনের বাণী।

______________________________

টিকলিরা যখন খান বাড়ি থেকে বের হলো তখন বাজে সাড়ে পাঁচটা। নিভাও এসেছে ওদের সাথে। টায়রা টিকলি জোর করেই নিয়ে এসেছে। আজ রাতটা টিকলিদের বাসায়ই কাটানোর বায়না। আর্দ্র আসতে চেয়েছিলো কিন্তু টায়রার বেড়াজালে পড়ে টিকলি বারন করেছে। গেট দিয়ে বের হতেই দেখা গেলো ওই সময় ওই গেট দিয়ে আরেকটি যুবক ভেতরে ডুকলো। ছেলেটা এমন ভাবে তাকালো যে কার দিকে তাকালো ঠিক ঠাওর করা গেলো না। টিকলি টায়রা নিভা একে অপরের দিকে তাকাতেই টায়রা চোখ কুচকে বলল,

'এই লোক কার দিকে তাকালো?'

টায়রার মাথায় চাপড় দিয়ে টিকলি বলে, 'যার দিকে তাকাক। তোর তাতে কি?'

'আরে বুঝস না মাম্মা। আমার দিকে তাকালে তো কিছু একটা হিল্লে হয়ে যেতো। তুমি তো বইন প্রেম ট্রেম কইরে বিন্দাস লাইফ পার করতাছো। আমার তো আর একা একা সিংগেল লাইফ ভালো লাগে না। বোনের কষ্ট তো বুঝবা না!'

'চুপ থাক, বেয়াদব।' বলেই নিভা রিক্সা ডাকতে গেলো।

,

'মামা, আজকে যা দেখছি না!'

রাহুল ভ্রু কুচকে বলল, 'কি দেখছস?'

নয়ন এক লাফ দিয়ে রাহুলের কাছে আসলো। মুখোমুখি বসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাবে ফিসফিস করে বলল,

'আজকে দেখি কি জানোছ? আমাদের বাসা থেকে তিনটা মেয়ে বাইর হয়ে গেলো। তিনটাই যা সুন্দর না রে! ডানপাশের টা তো একবারে আমার দিল কাইরে নিছে।'

রাহুল বিরক্ত হয়ে নয়নের কাছ থেকে সরে গিয়ে বলল,

'তোর এই রোগ কবে যাবো বলতো? মেয়ে দেখলেই ছুক ছুক স্বভাব। যারেই দেখোস তার উপরেই তুমি ফিদা। ঠাস ঠুস করে ক্রাস খাও।'

'তুমি যদি দেখতা তাইলে তুমিও তোমার দিলের যতো পেয়ার আছে সব ঢাইলে দিতা।'

'হ। তোর মতো তো সবাই প্রতিবন্ধী। অটিজম শিশু।'

চলবে

Muna hasan, Md zeesahi, Priya halder, Zidan hamid, Afifa Mahmud, Arjju khan, Sohag hasan abir and লেখাটি পছন্দ করেছে

avatar
Onu kotha
শুকতারা
শুকতারা
Posts : 56
স্বর্ণমুদ্রা : 1339
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-05-26

বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ - Page 4 Empty Re: বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ

Tue Jul 13, 2021 11:22 pm

৩৫.
রোদ্দুরে সকাল। ঝকমকে এক ফালি নরম রোদ এসে গড়াগড়ি খাচ্ছিলো বিছানা জুড়ে। সুন্দর সকালটাকে পাড় করেই দুপুর গড়ালো। সাথে বাড়লো তাপ। গরমের উত্তাপ। গায়ে জড়লো ঘাম। রোদ্রে ক্লান্ত দেহ চলতে চায়না।তবুও চলাতে হয়। কাল রাতে নিভা টিকলিদের বাসায় ছিলো। সকালে টিকলিদের সাথেই ভারসিটি এসেছে। দুপুরে ক্লাস শেষ করে ওরা যখন ভারসিটি থেকে বের হলো তখন নিভা বলল,

'তোরা তাহলে চলে যা।'

টায়রা ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করে, 'তুই এখন কোথায় যাবি?'

'খালামনির বাসায়।'

'কেন যাবি? তোর নিজের বাসা নাই?'

'আরে আম্মু কিছুদিন থাকবে নানুবাড়ি। খালামনি তো কাল রাতেই এসে পরছে। আম্মু আসার আগ পর্যন্ত খালামনির বাসায় ই থাকতে হবে।'

নিভার কথা মাঝেই আচমকা কোথা থেকে যেনো সামনে রিক্সায় করে রাহুল এসে থামলো। টিকলি ভীষণ রকম অবাকতার সাথে চোখ কুচকে তাকাতেই দেখলো পাশে আরেকটা ছেলে। চেনা চেনা লাগছে কিন্তু চেনা যাচ্ছে না।

ভর দুপুরে কড়া উত্তাপে রাহুল তার শার্টের কলার পেছন দিকে ঠেলে দিতেই পাশ থেকে নয়ন খুব উৎফুল্লতার স্বরে ফিসফিস করে বলল,

'আরেব্বাস, ভাই এই তিনটাই তো সেই মাইয়া। যার কথা কালকে তোরে বললাম। ওই যে দেখ, মাঝখানে যেই মেয়েটা দাঁড়ায় আছে না ওই মেয়েই আমার দিল কাইড়ে নিছে।'

রাহুল ভ্রু কুচকে নয়নের দিকে তাকিয়ে আবার সামনে তাকালো। সামনে তাকাতেই দেখলো মাঝখানের মেয়েটা টায়রা। রাহুল চোখ পাকিয়ে নয়নের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

'আমার বোন।'

নয়ন মিনিট পাঁচেকের জন্য হা হয়ে গেলো। বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে বলল, 'এতো সুন্দর মাইয়া তোর বইন?'

রাহুলের কপালে কিছু সূক্ষ্ম চিন্তার ভাঁজ। কিন্তু পরমুহূর্তেই নয়নের কথা শুনে কটমট করে বলল,

'একদম নজর দিবি না। চোখ তুইলে ফেলামু একবারে। যেখানে মন চায় সেখানে ফ্লার্ট কর কিন্তু আমার বোনদের ধারের কাছেও যাতে না দেখি।'

রাহুল এগিয়ে গেলো। নয়নও মুখ গোমড়া করে রাহুলের পেছন পেছন গেলো। সাথে বিরবির করে বলল, 'শালার ভাগ্যটাই আমার খারাপ। পোড়া কপাল।' নয়ন এগিয়ে যেতেই টিকলি টায়রাকে ইশারা করলো। ফিসফিস করে বলল,

'সর্বনাশ! এই লোক রাহুল ভাইয়ার সাথে কি করে?'

টায়রাও ফিসফিস করে জবাব দিলো, 'আমি কীভাবে জানবো? তুই যেখানে আমিও তো সেখানেই।'

রাহুল সামনে যেতেই নিভা হাসিমুখে বলল, 'আপনি? ভালো আছেন?'

রাহুল স্বভাবসুলত মাথা ঝাকিয়ে হেসে বলল, 'জি। কাল বিকালেই আমাদের দেখা হয়েছিলো। এই সময়টুকুতেই খারাপ থাকি কি করে?'

'হুম। তাও তো কথাই।' নিভা হেসে ফেলল। রোদের আলোতে ঝিলিক দিয়ে উঠলো সুন্দর মুখখানা।

টায়রা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে টিকলিকে বলল, 'কাহিনী কি রে? কাল বিকালে দেখা হইছে মানে?'

'তেমন কিছু না। পরে বলবোনি।'

তখনি নয়ন টায়রার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে হেসে বলল,

'হাই, আই এম নয়ন। হোয়াটস ইউর নেম?'

টায়রা বত্রিশটা দাঁত বের করে বলল, 'মাই নেইম ইজ চোখ।'

থতমত খেয়ে নয়ন বলল, 'সরি?'

রাহুল এসে দাঁড়িয়ে চোখ পাকিয়ে নয়নের দিকে তাকালো। নয়ন অন্যদিকে ঘুরে বিরবির করে বলল,

'ভাই হচ্ছে একটা আইটেম বোম। বোন হচ্ছে ধানি লঙ্কা।'

টিকলি মিনমিনে গলায় বলল, 'ভাইয়া তুমি এখানে?'

'হুম চল। ফুফা ফোন করে বলল তোদের ভারসিটি থেকে নিয়ে আসতে।'

টায়রা ভ্রু কুচকে বলল, 'বাবা বলেছে? হঠাৎ কেনো? আমরা তো প্রতিদিন একা একাই যাই।'

'জানি না। আসতে বলেছে তাই এসেছি৷' কপালে ভাঁজ ফেলে রাহুল সন্দেহজনক চোখে তাকিয়ে আবার বলল, 'আচ্ছা কাল তোরা কোথাও গিয়েছিলি?'

টিকলি তুতলিয়ে বলল, 'কে কেনো ভাইয়া?'

'যেটা জিজ্ঞেস করলাম সেটা বল।'

'ওইতো ভাইয়া পিকনিকে গিয়েছিলাম। বান্ধবীরা সবাই মিলে পিকনিক করছিলাম। তো নিভা ছিলো ওর খালার বাসায়। পিকনিকে এটেন্ড করেনি। তাই আমরা বাসায় ফেরার সময় ওকে ওর খালার বাসার সামনে থেকে পিক করে নিয়েছিলাম। কাল রাতে ও আমাদের সাথেই ছিলো।' কথাগুলো বলার পর টিকলি নিজেই হতবাক হয়ে গেলো। কি সুন্দর! অনর্গল মিথ্যে কথা বলে দিলো। একটুও বাজলো না। টিকলি কবে এতো মিথ্যা বলা শিখলো? প্রেমে পরলে কি সবাই মিথ্যে বলা শিখে?

'কিন্তু কেনো রাহুল ভাইয়া? কি হয়েছে?' টায়রার প্রশ্ন।

রাহুল এবার হেসে উত্তর দিলো, 'তেমন কিছু না। ওই আমার বন্ধু নয়ন তোদের আমাদের বাসার সামনে দেখেছে তো তাই।'

কিছু মনে পরেছে এমন ভান ধরে নিভা বলল, 'ও হ্যাঁ, আমরাও তো দেখেছি। আমরা যখন চলে যাচ্ছিলাম তখন সে বাসার ভেতর ঢুকছিলো তাই না নয়ন ভাই?'

নয়ন মাথা নাড়ালো। রাহুল টিকলির দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বলল,

'বাসার ভেতরে ঢুকেছিলি নাকি বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিলি?'

টিকলি বিরবির করে বলল, 'এতো প্রশ্ন করে ক্যা?' চোখ মুখ কুচকে টিকলি আরো একটা মিথ্যা বলল, 'বাইরে দাড়িয়েছিলাম।'

টায়রা সন্দেহ চোখে তাকিয়ে বলল, 'কিন্তু ভাইয়া? তুমি...'

টায়রাকে মাঝপথে আটকিয়ে রাহুল বলল, 'আমি ওই বাসায়ই ব্যাচেলর হিসেবে ভাড়া থাকি।'

টায়রা অবাক হয়ে টিকলির দিকে তাকালো। টিকলি অসহায় চোখে তাকিয়ে বুঝিয়ে দিলো ঘটনা সত্যি। টায়রা ফিসফিস করে বলল, 'কি বলে! আল্লাহ যে কালকে কি জোর বাঁচায় দিছে! বেঁচে থাকতে আর ওই বাড়িতে পা রাখবো না।'

________________________________

তখন বিকেল। টিকলি টায়রাকে বাড়ি পৌছে দিয়েই রাহুল মিরপুরের নিজের ছোট্ট এই ব্যাচেলর বাসায় এসে পড়েছিলো। এসেই ঘুম দিয়েছে। ঘুম থেকে উঠে বিকেলে ছাদে যেতেই আবিষ্কার করলো ছাদের এক কিনারে দাঁড়িয়ে রয়েছে নিভা। রাহুল পেছন থেকে বলল,

'হাই।'

নিভা ঘুরে সবসময়কার মতো হাসি দিয়ে বলল, 'ওহ, হ্যালো।'

'কি খবর?'

'এইতো চলছে।'

রাহুল কৌতুহল থেকে প্রশ্ন করলো, 'আপনি কি এখানে বেড়াতে এসেছেন? না মানে আগে তো কখনো দেখি নি।'

এলো চুলগুলোকে ঠিক করতে করতে নিভা জবাব দিলো, 'সেরকমই। আসলে এ বাড়িতে আসা হয়। কিন্তু তেমন থাকা হয়না। আম্মু গেছে নানুবাড়ি। কিছুদিন থাকবে। তাই আমিও কয়েকটা দিন আছি এখানে।'

'ওহ আচ্ছা। আপনারা কয় ভাই-বোন?'

'আমি একাই।' নিভা হেসে আবার বলল, 'এর জন্যই আমার এখানে আসতে ভালো লাগে। সারাদিন বাসায় একা একা ভালো লাগে না। এখানে আসলে আদর আর্দ্র ভাইয়ার সাথে মজা করা হয়। মাঝে মাঝে টিকলি টায়রার কাছে থাকি। দিন কেটে যায়। বাই দা ওয়ে, আপনারা কয় ভাই-বোন? '

রাহুলের মুখ থমথমে হয়ে গেলো। একদম কালকের মতোন। নিভা ভ্রু কুচকে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকালো। আশ্চর্য! লোকটাকে যখনি নিজের ফ্যামিলির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হয় তখনি লোকটা কেমন চুপ হয়ে যায়। নিভার ভাবনার মাঝেই রাহুল খুব আস্তে করে বলল,

'দুই ভাই-বোন।'

'ওহ তাই। আপনার বোন আছে বুঝি? নাম কি? কোন ক্লাসে পড়ে?'

'নাম রুমকি। ক্লাস থ্রি তে পড়ে।'

'অনেক ছোট।'

রাহুল হেসে মাথা ঝাকিয়ে বলল, 'হ্যাঁ সাথে খুব আদুরে। আমার বাধ্য।'

'তাই? একদিন দেখা করাবেন আমার সাথে?'

নিভা খুব উৎসাহ নিয়ে কথাটা বলল। নিভার কথায় রাহুলের মুখটা আবারো থমথমে হয়ে গেলো। নিভার হাসি-হাসি মুখ মিলিয়ে গেলো। বিভ্রান্তিকর অস্থিরতাগুলো লুকিয়ে জানতে চাইলো, 'আপনি কি রাগ করলেন আমার উপর? আপনি যদি না চান তবে দেখা করবো না।'

রাহুল হেসে ব্যস্ত কণ্ঠে বলল, 'আরে নাহ। তেমন কিছু না। আমার সাথেই তেমন দেখা হয় না।'

'কেনো?'

'হুম?'

'বললাম কেনো দেখা হয়না?'

'এমনি। আমি দূরে থাকি তো তাই।'

'কেনো আপনি আপনার নিজের বাড়িতে যান না?'

রাহুল এর পরিপেক্ষিতে আর কোনো কথা খুঁজে পেলো না। খুব অস্বস্থি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল আকাশের দিকে মুখ করে। অপরিচিত মানুষের এতোটা গভীর প্রশ্ন রাহুলের পছন্দ না। কিন্তু এই প্রশ্নগুলো তো খুবই ন্যাচারাল। স্বভাবসুলত মানুষ করবেই। কিন্তু ন্যাচারাল মানুষগুলোর জন্যই তো ন্যাচারাল প্রশ্ন। রাহুল তো ন্যাচারাল না। তার জীবন যে টিকলি, টায়রা, নিভা, আদর, আর্দ্রের মতো এতোটা স্বাভাবিক না। নিভা তুড়ি বাজালো। সম্ভিত ফিরে রাহুল কিছু বলতে যাবে তার আগেই শুনতে পেলো নয়নের গলা। নয়ন ছাদে উঠতে উঠতে বলছে,

'এই তুই কি করিস এতোক্ষন ছা...দে...।'

নিভাকে দেখে নয়ন থেমে গেলো। চোখগুলোকে একটু কচলিয়ে বলল,

'আপনি?'

নিভা কাধ নাড়িয়ে বলল, 'হ্যাঁ আমি।'

রাহুল নয়নের কাধ ধরে আস্তে করে বলল, 'উনি আদর আর্দ্রের খালাতো বোন হয়।'

'ওহ তাই বুঝি দুপুরে ওভাবে কথা বলছিলি? আমি তখন কিছুই বুঝতে পারিনি।'

'হুম।'

নয়ন এবার ফিসফিস করে বলল, 'তা তুমি আদর ভাইয়ের বোনের সাথে এতো কি কথা বলো? প্রেম পড়ছো নাকি মাম্মা?'

রাহুল নয়নের পেটে কনুই দিয়ে গুতা দিলো। নয়ন পেট ধরে মুখ ফুলিয়ে আউ করে সরে দাড়ালো।

_____________________________

রাতে জামিলুর রেজা টিকলিদের ঘরে এলো। টিকলি কপালে হাত রেখে আধশোয়া হয়েছিলো আর পাশেই টায়রা চুল আচড়াচ্ছিলো। জামিলুর রেজাকে দেখে টায়রা নড়েচড়ে বসে বলল,

'কিছু বলবে বাবা?'

টিকলি কপাল থেকে হাত সরালো। বাবাকে দেখে শোয়া থেকে সুন্দর করে উঠে বসে বলল,

'কখন ফিরেছো বাবা?'

'এইতো কিছুক্ষণ আগেই।'

'খেয়েছো?'

'হুম।'

ঘরে শায়লা আক্তার ঢুকলো। টিকলি এক পলক তাকিয়ে আবার বাবার দিকে ভ্রু কুচকে চেয়ে প্রশ্ন করলো,

'আজ আমাদের ভারসিটি থেকে আনতে রাহুল ভাইয়া কেনো গিয়েছিলো?'

'আমি বলেছিলাম তাই।'

'কেনো?'

জামিলুর রেজা কোনো প্যাঁচে গেলেন না সরাসরি প্রশ্ন করলেন, 'তুমি কি কাউকে পছন্দ করো টিকলি?'

কথাটা কানে যাওয়া মাত্র টিকলির বুক কেঁপে উঠলো। আকস্মিক প্রশ্নে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। মুখে ফুটে উঠলো অজানা তীব্র ভয়। হাত কচলাতে কচলাতে এদিক ওদিক তাকিয়ে টায়রার দিকে তাকালো। টায়রা নিজেও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে বাবার মুখের দিকে। সেও যে এই প্রশ্নে বেশ শক খেয়েছে তা একদম ঝকঝক করে মুখে ভেসে উঠেছে। টিকলি যেনো বোবা হয়ে বসে আছে। কথা বলার জন্য ঠোঁট দুটো খুলতে পারছে না। জামিলুর রেজা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আবারো বললেন,

'বাদর ডাক্তার কে?'

টিকলি যেনো এই প্রশ্ন শুনে আরো অবাক হয়ে গেলো। ভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলো। গহীন অন্ধকারে এক ফুটা আলোর দিশা খুঁজে পেলো না। শায়লা আক্তার তখন পেছন থেকে ঝাঝাঁলো গলায় বললেন,

'উত্তর দিচ্ছিস না কেনো? কাল রাতে খাবার টেবিলেই ফোন রেখে এসেছিলি মনে আছে? তখন এই নামে সেভ করা একটা নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছিলো। লকস্ক্রিনে মেসেজটা ভেসে উঠেছিলো। আর মেসেজ টা ছিলো, 'আমি আজ রাতে ব্যস্ত থাকবো।' তুই নিশ্চয়ই পরে দেখেছিস?'

টিকলি ঢোক গিলল। চোখ বন্ধ করে নিজের এই অপকর্মের জন্য নিজেকে কিছু গালাগালও দেওয়া হলো। পাশ থেকে তখন টায়রা থেমে থেমে বানিয়ে বানিয়ে বলে উঠলো,

'আরে না মা। তেমন কেউ না। সে তো একটা মজা ছিলো। এক বন্ধুর নাম মজা করে সেভ করা হয়েছিলো।'

'বন্ধুটা তো আর ডাক্তার নয়? ডাক্তার হলে তো আর তোমাদের বন্ধু হতে পারে না। আর ধরেই নিলাম বন্ধু কিন্তু এই মেসেজ কেনো পাঠাবে?' জামিলুর রেজা প্রশ্ন করলেন।

টায়রা আবার কিছু বলতে ধরলেই টিকলি টায়রাকে থামিয়ে দিলো। জিহবা দিয়ে শুকনো ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে বলল, 'থাক আর মিথ্যা বলিস না।'

টায়রা থেমে গেলো। শায়লা আক্তার উচ্চস্বরে বললেন,

'তার মানে তুই প্রেম করিস?'

টিকলি কোনো উত্তর দিলো না। মাথা নিচু করে বসে থাকলো। টায়রা নখ কামড়িয়ে ভাবতে থাকলো কি করে ব্যাপারটাকে সামাল দেওয়া যায়। জামিলুর রেজা টিকলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।বললেন,

'তোমার যদি কোনো পছন্দ থাকে তাহলে আমার আপত্তি নেই। আমরা চেয়েছিলাম তোমাকে বিয়ে দিতে। কিন্তু আমরা জানতে চাই ছেলেটা কে? তোমার যোগ্য কি না?'

বাবার কথায় খানিকটা ভরসা পেলেও টিকলি জানে ছেলেটা কে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার পর সব উলোট পালোট হয়ে যাবে। আর হলোও তাই। টিকলি বাবার হাত ধরে বলল,

'বাবা, উনার নাম আদর। আদর খান।'

জামিলুর রেজার স্বাভাবিক ভ্রু জোড়া কুচকে এলো। সন্দেহ কন্ঠ নিয়ে প্রশ্ন করলো, 'কোন আদর?'

টিকলি ঢোক গিলে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে সময় নিয়ে বলল, 'আজিম খানের ছেলে। নিউরোলজিস্ট।'

জামিলুর রেজা বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। ভীষণ অবাকতার সুরে বললেন, 'হোয়াট? এটা কি সেই ছেলে যার সাথে আমি প্রথমে তোমার বিয়ে ঠিক করেছিলাম?'

টিকলি কিছুক্ষণ চুপ থেকে আস্তে করে মাথা নাড়ালো। জামিলুর রেজা অবাকের উপর বিস্ময় হলেন। শতগুণ অবাকতা কন্ঠে ঢেলে বললেন,

'কিভাবে এটা করতে পারো তুমি? তোমার কি মনে নেই তারা কি কি করেছিলো? কিভাবে আমাদের অপমান করেছিলো? এমনকি তোমাকে পনেরো দিনের....ছি ছি ছি!'

জামিলুর রেজা হাইপার হয়ে গেলেন। টিকলি দাঁড়িয়ে বাবার মুখোমুখি হয়ে ব্যস্ত গলায় বলল, 'বাবা দোষ টা আমার ছিলো। আমার কথাটা একবার শুনো।'

জামিলুর রেজা এক কথায় বললেন, 'আর একটা কথাও হবে না। ভুলে যাও সেই ছেলেকে। একসময় আমি সেই ছেলেকে পছন্দ করে তোমার জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিলেও এখন আর মানতে পারবো না। সেই পরিবার খুবই বেয়াদব এবং অসভ্য।'

জামিলুর রেজা চটপট পায়ে চলে গেলেন ঘর থেকে। টিকলি থম মেরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বসে পড়লো খাটে। কানে অনবরত বাজতে থাকলো বাবার বলা কথাগুলো। একসময়ের ছোট্ট একটা মিথ্যে বলায় আজ কত বড় কান্ড ঘটে গেলো! টিকলি কি আদেও কখনো পাবে আদরকে? দু'নয়ন বেয়ে জলেরা পড়তে থাকলো অফুরন্ত। টায়রা টিকলির কাধে হাত রেখে চোখ মুছিয়ে দিলো। ফোন এগিয়ে দিয়ে বলল,

'আদর ভাইয়াকে ফোন কর।'

টিকলি তৎক্ষণাৎ ফোন লাগালো। পাগলের মতো একটার পর একটা ফোন দেওয়ার পরও ওপাশ থেকে ধরা হলো না। টিকলি শব্দ করে কেদে উঠলো কিছুক্ষণ পর মেসেজ এলো, 'আমি খুব ব্যস্ত। জাস্ট দশ মিনিট ওয়েট করুন। আমি ব্যাক করছি।'

টিকলি আরো জোরে শব্দ করে কেদে উঠতেই টায়রা ওকে জড়িয়ে ধরলো। হেচকি দিয়ে কাদতে কাদতে টিকলি বলল,

'দেখেছিস, তুই তো কাল বারবার বলছিলি, আমি এতো কাদছি কেনো? এখন দেখেছিস সেই যে কাল দেখা হলো এরপর আর তার সাথে কথা হয়নি। সে এতোটাই ব্যস্ত। তার এই ব্যস্ত জীবনে আমি আমাকে খুঁজে পাইনা। অথচ ব্যস্ততা শেষ হলে পাগল সে। সেই পাগলামির কি মানে! কি দাম!'

চলবে

Md zeesahi, Zidan hamid, Arjju khan, Anik hossain, Sikdar rahat, Sk rahul ali, Jannat islam and লেখাটি পছন্দ করেছে

avatar
Onu kotha
শুকতারা
শুকতারা
Posts : 56
স্বর্ণমুদ্রা : 1339
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-05-26

বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ - Page 4 Empty Re: বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ

Tue Jul 13, 2021 11:23 pm

৩৬.
আট মিনিটের মাথায়ই ফোন দিয়েছিলো আদর। টিকলি ফোন কানে ধরেই রুদ্ধশ্বাসে বলল, 'এতোটা ব্যস্ত আপনি!'

টিকলির কণ্ঠশুনে আদর ভয়ার্ত গলায় বলল, 'কুল ডাউন। কি হয়েছে? আপনি তো জানতেন আমি ব্যস্ত থাকবো।'

টিকলি ঠোঁট ভেঙে কেদে দিলো। আদর দিশেহারা হয়ে পরলো। হতাশ কন্ঠে বলল, 'এতোটা পাগলামি করলে কি করে চলবে? আমি ব্যস্ত ছিলাম।'

টিকলি তৎক্ষণাৎ জ্বলে উঠলো, 'সবসময় বেশি বুঝেন কেনো? আমি একবারো বলেছি আপনার জন্য কাদছি? আমি তো জানি আপনার ব্যস্ততম জীবনে আমার কোনো ভূমিকা নেই।'

আদর বিস্মিত হয়ে পরলো। কিছুক্ষণ অবাক থেকে বলল, 'আপনার ঘুম দরকার টিকলি। ঘুমান। বেশি উল্টাপাল্টা বকছেন।'

টিকলি বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে চিতকার করে বলল, 'আপনি কি আমার কথাটা শুনবেন? তা নাহলে আমি বিয়ে করে ফেললাম।'

আদর যেনো বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে রইল। শতগুণ অবাকতার স্বরে বলে উঠলো, 'রাত ভিড়েতে কি শুরু করলেন? এখানে বিয়ের প্রসঙ্গ আসছে কোথা থেকে?'

'ডাক্তার..'

'ওকে ওকে...আপনি বলুন। আমি শুনছি। তবুও এতো হাইপার হবেন না। ওহ মাই গড! পুরাই হট।'

'আপনি কি আমার সাথে মজা করছেন?'

'মজা করবো? তাও আবার আমি? তাও এই সময়ে? আপনার সাথে? এখন মজা করলে আপনি এক চিৎকারে আপনাদের দু'তলা বাসাটা ভেঙে ফেলবেন। প্রেমের পর নতুন নতুন চিৎকার শিখেছেন বলে কথা!'

টিকলি চোখ বন্ধ করে শান্ত হলো। নিজেকে যথাযথ গাম্ভীর্য করার চেষ্টা চালালেও পারা গেলো না। অন্যথাকারী মনটা আবার কেদে উঠে আদরকে বলল,

'আমি বাবাকে সব বলে দিয়েছি।'

এতোক্ষণ টিকলির রাগ কমানোর প্রচেষ্টায় ঠাট্টার ছলে কথা বললেও এ মুহুর্তে ভ্রু জোড়া বেঁকে গেলো আদরের। অসম্ভব কৌতূহল নিয়ে ভ্রু কুটি করে বলল, 'কি বলেছেন?'

'আপনার কথা। আপনার মেসেজ কাল বাবা দেখে ফেলেছে। আমি আজকে সব স্বীকার করেছি। কিন্তু বাবা মানছে না। আপনাকে ভুলে যেতে বলেছে।' কথা বলতেই টিকলি কেদে দিলো। জীবনের এতোগুলো বছরে যা কাদেনি। প্রেম করার পর তার চেয়ে বেশি কাদছে। প্রেম করলে বোধ হয় মানুষের সাহস বাড়ে, মিথ্যে কথা বলাও শিখে, কথা গোপন করতে জানে, নিজেকে আড়াল করতে শিখে, সাথে খুব করে কাদতে পারে।

আদর অবিশ্বাস্য চোখে কিছুক্ষণ শূন্যে তাকিয়ে থাকলো। কিছুক্ষণ পর খুবই হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে দীর্ঘ কন্ঠে বলল,

'কিচ্ছু বলার নেই।'

টিকলি ঠোঁট চেপে কান্না আটকিয়ে প্রশ্ন করলো, 'কিচ্ছু বলার নেই?'

'নাহ। শুধু এটুকুই বলবো এতোটা বাড়াবাড়ি আপনি না করলেও পারতেন। আমাকে না জানিয়েই এতো বড় ডিসিশন না নিলেও পারতেন। আপনার বাবাকে জানানোর এখনি কোনো দরকার ছিলো না। কথাটা কাটিয়ে দিতেন। আমি চেয়েছিলাম আগে আমি আমার পরিবারকে বুঝাবো। এরপর আমার পরিবার ভুল স্বীকার করে আপনার পরিবারের সাথে কথা বললেই ব্যাপারটা মিটমাট হয়ে যেতো। কিন্তু আপনি কি করে ফেললেন! নাথিং টু ছে।'

কথাগুলো বলেই ফোন কাটা হলো। টিকলি দাড়ানো থেকে ধপ করে বসে পড়লো। চোখের সামনে ফোনটা ধরে বিরবির করে বারবার বলল, 'কেটে দিলো? কেটে দিলো সে ফোনটা? আমার দিকটা একটুও বুঝার চেষ্টা করলো না?'

________________________________

এর মাঝে কেটে গেলো দুদিন,,,

"কি দরকার, মিছে আবদার
ভুলের পাল্লা ভারী
জানি নয়ছয়, সবই অভিনয়
তাই তো দুজনের আড়ি"

শুভ্র প্রভাতটা মেঘে ভরপুর। জারুল গাছ থেকে চুইয়ে টুপটাপ করে পড়ছে বৃষ্টির পানি। হিজল গাছে ফুটেছে লাল ফুল। টিকলি ঊষর বেলায় বসে গেছে গিটার হাতে। সারারাত নির্ঘুম টিকলির চোখ ভারী, ক্লান্ত। তবুও ঘুমের ছিটাফোঁটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আদরের কাছ থেকে সেদিন একটু আকটু গিটার বাজানো শিখে নেওয়া হয়েছিলো। সেই শেখা গিটার বাজানো বাজিয়েই অশ্রু জড়িয়ে দু লাইন গাওয়া হলো।

নির্ঘুম কালো রাত্রি কেটে যেতেই ভোরবেলায় কফি হাতে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে আদর। দেয়াল ঘেঁষে জেগে উঠা বাগানবিলাস। চারিপাশের বাতাসে সাদা শিমুল তুলোর উড়াউড়ি। গম্ভীর মনের মন খারাপ সাথে হালকা তেজ তবুও ভালোবাসার কাছে একবার পরোয়ানাবিহীন তো আরেকবার পরাজিত। পাতার ন্যায় বেগুনি রঙের ফুলগুলো মুঠো ভরে ছিড়ে নিয়ে বৃষ্টিপ্রহর প্রত্যুষে অনেকদিন বাদে বহু বছর বাদে গেয়ে উঠা হলো,

"তোমার হাসির জন্য আমি সব করে যাই
ভালোবেসে দিয়েছি তোমায় আমার পুরোটাই।"

টায়রা উঠে এসে টিকলির কাধে হাত রাখলো। বন্ধ চোখে টিকলি গেয়ে উঠলো,

"চাইনি আমি হারাও তুমি
বাড়াও মনের দূরত্ব....."

সকাল সকাল উঠা আর্দ্রের অভ্যাস নয়। তবুও আজ কীভাবে যেনো সকালে উঠে পড়েছে। ভাইয়ের ঘর থেকে গানের আওয়াজ এলে চমকে উঠাও হয়েছে। ব্যস্ত পায়ে হেটে ভাইয়ের ঘরের বাইরে দাড়াতেই শুনতে পেলো,

"তবুও দুজন দূরে হারাই
জিতেও দুজন হেরে যাই।"

ধীর আঙ্গুল গুলো গিটারের তারে চালিয়ে টিকলিরও গাওয়া হলো,

"তবুও দুজন দূরে হারাই
জিতেও দুজন হেরে যাই।"

আর্দ্র গিয়ে ভাইয়ের পেছনে দাড়ালো। আদর ভোরের উঁকি দেওয়া সূর্যটার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধীর কণ্ঠে গাইলো,

'তবুও দুজন দূরে হারাই...'

শূন্যে দৃষ্টি স্থির রেখে টিকলি গান সমাপ্ত করলো,

'জিতেও দুজন হেরে যাই....।'

অভিমানের পাল্লা ভীষণ ভারী। তবুও দু'প্রান্ত থেকে নিজেদের খুব অজানায় গোপনে গাওয়া হয়ে গেলো একই গান। কেউ জানলো না। আড়ালেই হয়ে গেলো অভিমানের গান। এই অভিমানের কবলে পরে দেওয়া হচ্ছে না ফোন। করা হচ্ছে না কোনো যোগাযোগ দুদিন ধরে। টায়রা টিকলির পাশের কালো বিনব্যাগে বসলো। টিকলির হাত থেকে গিটারটা নিয়ে টুংটাং সুর তুলে বলল,

'বাব্বাহ! আদর ভাইয়া তো তোকে গিটার বাজানোও শিখিয়ে দিয়েছে। আই এম ইমপ্রেসড।'

টিকলির কোনো হেলদোল দেখা গেলো না। সে যেমন একদিকে তাকিয়ে বসেছিলো তেমনই বসে আছে। টায়রা এবার গলা খাকারি দিয়ে গিটারের পানে চোখ রেখে বলল,

'তোর কি মনে হয়না তোর ইগো বেশি?'

টিকলি ঘুরে তাকালো। ভ্রু কুচকে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকাতেই টায়রা আবারো সুর তুলল। কিছুক্ষণ পর আবার বলল,

'দোষটা কি তোর নয়?'

টিকলি আবার তাকালো। ভ্রু কুচকে চোখ দুটো ছোট করে বলল, 'মানে? সব আমার দোষ?'

টায়রা হাত থেকে গিটার নামিয়ে পাশে রাখলো। টিকলির মুখোমুখি বসে বোঝানোর চেষ্টা করে বলল,

'তুই পুরো বিষয়টা অবজারভেশন কর একবার।'

'যেমন?'

'যেমন তুই দেখ, সবকিছু কিন্তু তোর জন্যই হয়েছে। ঘটনা ঘাটতে গেলে কিন্তু দেখা যাবে ভুলগুলো তোরই। তুই বিয়ে করতে চাসনি প্রথমে। হ্যাঁ, আমারও দোষ আছে। আমিও চাই নি তুই বিয়ে কর। কিন্তু যাই হোক আদর ভাইয়ার তো দোষ নেই। তুই বলেছিলি, তুই নিজে পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট। ব্যস, বাড়িতে গিয়ে নিজের বাবা মাকে আদর ভাইয়াও সেটাই বলেছে। তাই কি স্বাভাবিক নয়? অপরিচিত কারোর জন্য সে নিজে কেনো বাবা মার কাছে মিথ্যে বলবে? আফটার অল সেও ওই টাইমে বিয়ে করতে চাইনি। এখন, সেদিন রাতে বিষয়টা আমি কাটিয়ে দিতে চাইলাম কিন্তু তুই বলে দিলি আব্বুকে সবটা। এটা তো আগে থেকেই জানা ছিলো যে বাবা মা মানবে না। তাই আদর ভাইয়ের পারমিশন না নিয়ে এতো বড় কথাটা আগেই বলে দেওয়া তোর উচিত হয়নি। তাই আদর ভাইয়া রেগে আছে। তার উপর তুই ফোন দিচ্ছিস না দু'দিন ধরে। সে আরো রেগে আছে। আল্টিমেটলি সব ঘটনার পেছনের মূল কারণ কিন্তু তুই।'

টায়রা চোখ মুখ কুচকে কথাগুলো বলে এক চোখ খুলে বোনের রিয়েকশন দেখার চেষ্টা করলো। কিন্তু টিকলির মুখে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া খুঁজে পাওয়া গেলো না। কপালে কিছু সূক্ষ্ম ভাঁজ ফেলে সে বাইরে তাকিয়ে ছিলো। কিছুক্ষণ পর উঠে নিজের ঘরে চলে গেলো। টায়রা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রভাতের অপার্থিব মেঘের গর্জন শুনতে শুনতে গিটার হাতে নিয়ে পুনরায় টুংটাং শব্দ তুলল।

,

স্নিগ্ধ বিকেল। টিকলি সাদা জামা পড়লো। গায়ে জড়ালো নীল রঙের উড়না আর পায়জামা। নীল আকাশের মাঝে এক টুকরো সাদা মেঘের ন্যায় ফুটে উঠলো মোমের পুতুলের মতো মুখখানা। কানে নীল রঙা ঝুমকা। হাতে নীল-সাদা চুড়ি। আজ চশমা পড়লো না। কিন্তু টিকলির ক্ষেত্রে চশমা না পরে চলাফেরা করা বিশাল বড় এক যুদ্ধ। তাই চোখে পাওয়ার লেন্স লাগানোটা আবশ্যক। টিকলিকে রেডি হতে দেখে টায়রা ভ্রু কুটি করে বলল,

'এই বৃষ্টি-বাদলের দিনে একলা যাস কই তুই?'

কোমড় ছাড়ানো ঘন কালো রেশমি চুলগুলোকে ঠিক করতে করতে মুচকি হেসে টিকলি জবাব দিলো,

'জামাইয়ের কাছে।'

টায়রা চোখ বড় বড় করে তাকালো। টায়রা কিছু বলতে চাইলো টিকলি না শুনেই সাদা পার্স নিয়ে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। পেছন থেকে টায়রা চেঁচিয়ে বলল,

'যাচ্ছো যাও। কিন্তু সাবধান নিচে ভাল্লুক মামা নাহ... মামী এসে বসেছে।'

নিচে যেতেই টিকলি আশ্চর্য হয়ে পড়লো। বসার ঘরে বসে আছে বাবা-মা। আর তার সামনের সোফায় বসে আছে রুহুল হক আকিদা হক আর ছোট্ট রুমকি। জামিলুর রেজা ভ্রু কুচকে টিকলির দিকে তাকালেন। টিকলি স্বাভাবিক হয়ে মামা মামীকে সালাম জানালো। রুমকিকে কোলে নিয়ে কিছুক্ষণ আদর করে বেরিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে এক পা বাড়াতেই আকিদা হক কেমন যেনো উপহাসের গলায় বললেন,

'কোথাও যাচ্ছো নাকি টিকলি?'

টিকলি আস্তে করে উত্তর দিলো, 'ওই তো মামী একটু কাজ ছিলো।'

জামিলুর রেজা গম্ভীর গলায় বললেন, 'কি কাজ পরলো?'

শায়লা আক্তারও বললেন, 'এই বৃষ্টি কাদার দিনে কি কাজ পরলো শুনি?'

টিকলি কারোর কথার উত্তর খুঁজে পেলো না। বসার ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে টায়রা। আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে টিকলির পাশে এসে দাঁড়ালো। আকিদা হক ভ্রু কুটি করে ন্যাকা গলায় বললেন,

'ইশশ...আজই কাজ পরে গেলো? আমরা এসেছি কোথায় একটু গল্প গুজব করবে তা না..'

টায়রা ফট করে বলে ফেলল, 'গল্প তো সমানে সমানে আই মিন বয়সে বয়সে হয়। আপনার সাথে তো আমাদের বয়স যায় না। যেই বয়সের মেয়ে সেই বয়সের মেয়ের সাথেই তো গল্প করবো মামীজান।'

টায়রা দাঁত কেলিয়ে টেনে টেনে বলল। টিকলি টায়রাকে কনুই দিয়ে গুতা দিলো। শায়লা আক্তার চোখ পাঁকিয়ে তাকিয়ে ছিলেন মেয়ের দিকে। আকিদা হক একটু চুপসে গেলেন তবুও দমলেন না। জামিলুর রেজার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

'তা ভাই মেয়ের বিয়ে দিবেন না? দু মেয়েই আপনার বড় হয়েছে। একজনের অন্তত বিয়ে এবার দেওয়া উচিত।'

টায়রা দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে আকিদা হকের দিকে তাকিয়ে থাকলো। জামিলুর রেজা চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন,

'ছেলে খুঁজছি।'

চায়ে চুমুক দিয়ে ডাইনির মতো হেসে আকিদা হক কুটনির গলায় বলেন, 'আহা! ওতো খুঁজা খুঁজির কি দরকার? আপনাদের ঘরেই তো পাত্র আছে?'

টায়রা বিরবির করে বলল, 'এখানে আসছেই কুটনিগিরি করতে বেয়াদ্দব মহিলা।'

শায়লা আক্তার ভ্রু কুচকে বললেন, 'মানে?'

'মানে বুঝেন না আপা? আপনার নিজের ভাতিজা থাকতে ওতো দূরে কেনো যেতে হবে?'

আকিদা হক কথাটা বলতেই টিকলি বিস্ফোরণ চোখে তাকালো। শায়লা আক্তারের যেনো কথাটা মনে ধরেছে। টিকলি শক্ত গলায় ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,

'বাবা আমাকে বেরুতে হবে এন্ড ইটস আর্জেন্ট।'

'বৃষ্টির দিনে বের হতে হবে না। ঘরে যাও।'

আকিদা হক কেমন যেনো চোখে তাকিয়ে ছিলো। মনটা ভরপুর তার কুটনৈতিক চালে। টায়রা বিরবির করে বলল, 'এই আকিদা, ওইদিকে তাকা। তাকা। তাকা বলতাছি। দাড়া....।'

টায়রা টিকলিকে ফিসফিস করে বলল, 'এক দৌড়ে গেটের বাইরে চলে যাবি।'

'হু?'

টিকলি কিছু বুঝে উঠার আগেই টায়রা গগনবিহারী চিৎকার দিয়ে হাত দিয়ে সামনের এক জায়গায় ইশারা করে বলল, 'আল্লাহ গো! ভাল্লুক..... মামী!'

সবাই ভ্যাবাচেকা খেয়ে আকস্মিক এই চিৎকারে ভয় পেয়ে টায়রার হাত যেদিকে তাক করা সেদিকে তাকিয়ে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল, 'কই কই? কি? কি?'

আকিদা হক ভয় পেয়ে চমকে দাঁড়িয়েছেন। টায়রার দেখাদেখি সেও চিৎকার করে সেইদিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু কিছু দেখতে না পেয়ে ভ্রু কুচকে বিরবির করে বললেন, 'এক মিনিট। কি বলল? ভাল্লুক মামী?'

এই সুযোগে টিকলি দৌড়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেছে। আকিদা হক টায়রার দিকে গরম চোখে তাকাতেই দেখলেন টায়রার পাশে টিকলি নেই। তিনি ভাল্লুক মামী কথাটা ভুলে গিয়ে অবাক কন্ঠে বললেন,

'টিকলি কই গেলো?'

রুহুল হক ধমকে বললেন, 'তাতে তোমার কি? এতো বেশি কথা বলছো কেনো? তোমাকে কি এখানে ঘটকালি করতে এনেছি?'

সবার সামনে স্বামীর মুখ থেকে এহেন ধারার কথা শুনে আকিদা হক অপমানিত বোধ করলেন। সোফায় বসে পুনরায় চা খেতে লাগলেন। টায়রা দাঁত বের করে হাসছিলো। বাবা-মার দিকে চোখ পড়তেই দেখলো তারা চোখ পাঁকিয়ে তাকিয়ে আছে। টায়রা আলগোছে সেখান থেকে এক পা এক পা করে সরে নিজের ঘরে চলে এলো।

চলবে

Muna hasan, Md zeesahi, Disha moni, Priya halder, Afifa Mahmud, Sabbir hosen sumon, Sohag hasan abir and লেখাটি পছন্দ করেছে

avatar
Onu kotha
শুকতারা
শুকতারা
Posts : 56
স্বর্ণমুদ্রা : 1339
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-05-26

বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ - Page 4 Empty Re: বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ

Tue Jul 13, 2021 11:23 pm

৩৭.
ক্লান্ত দেহখানি চেয়ারে এলিয়ে দিতেই চেম্বারের দরজা ঠেলে হুড়মুড় করে কেউ ডুকলো। গর্জনাধিকারী আকাশটা ধীরে ধীরে কালো রঙা মেঘে ছেয়ে যাচ্ছে। ঘরময় জুড়ে ঠান্ডা বাতাসের বিচরণ। আদর ভ্রু কুচকে অস্বাভাবিক অবাকতা নিয়ে তাকিয়ে থাকার কালেই জামা ঝেড়ে বিরক্ত মুখে টিকলি এসে বসলো চেয়ারে। বাইরে একদম হালকা ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। টিকলির বদ্ধ কালো চুলের উপর বিন্দু বিন্দু সাদা উজ্জ্বল পানির আলোড়ন। চুল ঝাড় দিয়ে চোখের চশমাটা ঠিক করে টিকলি অত্যন্ত বিরক্ত কন্ঠে বলল,

'ওমন হা করে তাকিয়ে রয়েছেন কেনো? এক গ্লাস পানি খাওয়ান। নাকি আপনাদের এখানে পানিও পাওয়া যায়না? থাক, এসব ডাক্তার ফাক্তারের পানিও রোগী রোগী গন্ধ করবে। খাবো না।'

আদর ছোট ছোট চোখে তাকালো। হঠাৎ মনে হলো, চশমা পড়ুয়া টিকলি বেশি সুন্দর। ওই ফোলা রক্তিম ফর্সা গাল দুটোর সাথে কালো চশমায় টিকলিকে মনে হয় অধিক চিন্তাশীল, বিচক্ষণ, মেধাবী, বুদ্ধিসম্পন্ন নারী এবং ভীষণ চতুর। অন্যরকম আলাদা আদুরী টিকলি। আদর নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক করে তুলে গম্ভীর মুখে বলল,

'আপমি এখানে কেনো?'

'উফফ ডাক্তার...সবসময় গম্ভীর মুখে কথা বলবেন না তো।'

আদর নড়েচড়ে বসলো। এরপর বলল, 'আমরা বাইরে দেখা করতাম...'

আদরের কথা শেষ হওয়ার আগেই টিকলি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলল,

'বাইরে দেখা করতাম মানে? আমি এখানে চিকিৎসা নিতে এসেছি। আপনি কি বাইরে রেস্টুরেন্ট কিংবা পার্কে বসে আমার চিকিৎসা করতেন?'

আদর থতমত খেলো। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই উদ্ধিগ্ন গলায় বলল, 'চিকিৎসা নিতে এসেছেন মানে? মাথা ব্যথা আবার বেড়েছে নাকি? ঠিকমতো ওষুধ খান না ?'

টিকলি গালে হাত দিয়ে ঠোঁট উল্টে বলল, 'ওসব কিছু না ডাক্তার।'

আদর ভ্রু কুচকে বলে, 'তবে?'

টিকলি ভিষণ হতাশ কন্ঠে বলে উঠলো, 'আমি স্বপ্ন দেখি না বাদর সাহেব।'

আদর ভ্রুর কোণা উঠিয়ে তাকালো। টিকলি আবারো দুঃখে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বলে উঠলো,

'আমি স্বপ্ন দেখি না। রাজপুত্র রাগ করে রাজকন্যার স্বপ্নে ধরা দেয় না।'

আদর চেয়ারে হেলান দিলো। মাথাটা এলিয়ে দিয়ে চেয়ারটাকে দুলাতে দুলাতে গোপনে বাকাঁ হেসে বলল,

'স্বপ্ন দেখার জন্য ঘুমাতে হয় মিস টিকলি। আমি আপনাকে ঘুমের ওষুধ লিখে দিচ্ছি। খেয়ে ঘুমাবেন। ভালো ঘুম হবে। আর হ্যা হুড়মুড় করে ঢুকে পরেছেন। নিশ্চয়ই ভিজিট দেননি। এখন ভিজিট সহ ৬০০ টাকা জরিমানা দিবেন আমার টাইম ওয়েস্ট এর জন্য।'

'ডাক্তারগুলো সত্যি কিপটা হয় সাথে আবেগহীন।'

আদর হাসলো। হাতের কলম নাড়াতে নাড়াতে বলল, 'তো? আপনার বুঝি খুব আবেগ?'

'অবশ্যই। তা নাহলে এমনি এমনি এসেছি?'

'নিজে ভুল করেছেন আবার দুদিন ফোন দেননি। তারউপর আবার বড় বড় কথা?'

'আপনিও তো ফোন দেননি ডাক্তার।'

টিকলির চোখ টলমল করলো। আদর উঠে এসে টিকলির পাশে দাঁড়িয়ে বলল, 'ফ্যাচফ্যাচ করে কাদবেন তো চশমা ভেঙে চোখ উঠিয়ে আনবো।'

টিকলি চোখ কুচকে বলল, 'আপনি আমার ডক্টর আমি আপনার পেসেন্ট। একজন পেসেন্টের সাথে প্রেমিকার মতো বিহেভিয়ার মানায় না।'

'সারারাত বাসর করে সকালে উষ্ঠা দিয়ে কয়, এই তুমি কে? এই হচ্ছে আপনার দশা।'

আদর গিয়ে আবার নিজের জায়গায় বসলো। টিকলির গাল দুটো লাল হয়ে উঠলো। ঠোঁট টিপে হেসে দিলো। আদর যে এতোটা বাজে কথা বলতে পারে তা কখনো কল্পনাও করেনি টিকলি। সংকোচ নিয়ে চোখ ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, 'চলুন।'

'কোথায় যাবো?'

'দেখছেন না? বাইরে মেঘ করেছে। আজ আমরা বৃষ্টিতে ভিজবো।'

'আমার কাজ আছে টিকলি।'

'কোনো কাজ নেই। দুই ঘন্টা ম্যানেজ করাই যায়।'

'আর আপনি? বাসায় গিয়ে কি বলবেন?'

'বলে দিবো কিছু একটা।'

'বৃষ্টিতে ভিজবেন ভালোকথা। যদি ঠান্ডা জ্বর লেগে ঘ্যানঘ্যানানি শুনি তবে আজন্মের বৃষ্টিতে ভেজার স্বাদ মিটিয়ে দিবো।'

'চলুন তো।'

'আচ্ছা আপনি ডুকলেন কীভাবে? বাইরে তমাল দাঁড়িয়ে ছিলোনা?'

'হ্যাঁ তো আপনার এসিস্ট্যান্ট দাঁড়িয়ে ছিলো। আমাকে জিজ্ঞেস করলে আমি বলেছি আমি আপনার স্যারের হবু বউ। এক্ষুনি ডুকতে দেন তা নাহলে আপনার স্যার আপনার জান ধোলাই করবে।'

আদর ঠোঁট কামড়ে হাসলো। বলল, 'মারাত্মক পাজি হয়ে গেছেন।'

'প্রেমের প্রভাব।'

________________________________

দিন গড়িয়েছিলো তিনদিন। নিভা আদরদের বাসায়ই ছিলো একয়দিন। প্রতিদিনের রুটিনমাফিক কাজকর্মের সাথে জুড়ে নেওয়া হয়েছিলো নিয়মমাফিক বিকালে ছাদে যাওয়াও। সারাদিন ঘরে বসে থাকতে থাকতে ত্যক্তবিরক্ত নিভা ছাদে গেলেই চনমনা হয়ে উঠে। ছলচ্ছল কিশোরীর মতোন সারাদিন মন ছুটাছুটি করে কখন ছাদে যাওয়ার সময় আসবে। অকারণে বুকটা আনচান আনচান করে রাহুলের সাথে সময় কাটাতে। আজও ব্যতিক্রম হলো না। সিড়ি বেয়ে ছাদে উঠতে দেখলো রাহুল আগে থেকে দাঁড়িয়ে আছে। নিভা হেসে পেছন থেকেই বলল,

'বাহ! আজ আগে?'

রাহুল ঘুরে দাঁড়িয়ে মিষ্টি করে হাসলো। এই কয়েকদিনে নিভার সাথে তার ভালো সখ্যতা হয়েছে। না চাইতেও নিজের মনের অনেক কথাই বলা হয়েছে সাথে এও বুঝেছে এই মেয়েটাকে বিশ্বাস করা যায়। নিজের মনের সব কথা ঢেলে দিয়ে একটু হালকা হওয়া যায়। বয়সের গ্যাপ থাকলেও খুব বন্ধুসুলভ আচরণ ফুটে উঠেছে ওদের মাঝে। বিকেলের অনেকটা সময় ছাদে একসাথে বসে আড্ডা দিতে দিতে খুব গোপনেই ভীষণ পরিচিত হয়ে উঠেছে দুজন। একেক দিন একেকরকম খেজুরে আলাপে মত্ত তারা। হাসিতে মাতোয়ারা দুটি প্রাণ। খোশমেজাজে খোশগল্পে মজে উঠতে না উঠতেই দেখা যায় দু তিন ঘন্টা পার হয়ে গেছে। নিভা কানের পেছনে চুল গুঁজে দিয়ে ছাদের ছোট দেয়ালের উপর চড়ে বসলো। রাহুল একটু আতংকিত গলায় বলল,

'এই, পড়ে যাবেন। আস্তে।'

নিভা একবার পেছনে দেখে নিয়ে মিষ্টি করে হেসে বলল, 'পড়বো না। আজকে কি টপিক? কি টপিকে গল্প করবো? দুদিনে এতো গল্প করেছি দুজন যে আমার চৌদ্দগুষ্ঠির সব খবর আপনি জানেন।'

রাহুল মাথা দুলিয়ে হাসলো। খানিক বাদেই মুখটা মলিন করে নিভা বলল, 'কিন্তু আপনার ফ্যামিলি সম্পর্কে তেমন কিছুই বলেন না? শুধু এড়িয়ে যান। এটা কি ঠিক?'

রাহুলের মুখটা গম্ভীর হয়ে এলো। কালো মেঘের কোলে ভাসতে ভাসতে হারিয়ে গেলো সূর্য। চারিদিকে বৃষ্টি আসার আগামবার্তা। ঠান্ডা বাতাস গায়ে লাগতেই লোমকূপ দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। রাহুল নিভার পাশে দূরত্ব বজায় রেখে দেয়ালে চড়ে বসলো। নিজের পরিচয়, আপন পরিবারের কথা ভাবলেই নিজেকে খুব নিষ্প্রয়োজনীয় মনে হয় রাহুলের। পরিবার নামক শক্ত দেয়ালটা যেভাবে আকড়ে ধরে সেভাবে রাহুলকে আঁকড়ে ধরেনি উল্টে সরিয়ে দিয়েছে নিজ স্থান থেকে। মেঘেরডাক শুনতে শুনতে রাহুল আকাশের দিকে ইশারা করে বলল,

'ওই যে দেখছেন, কালো মেঘ। আমার জীবনটা ওই মেঘের মতোই।'

নিভা আকাশের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে রাহুলের দিকে তাকিয়ে বলল, 'প্রকৃতি দেখে মনে হয়না একটুপর ঝুমঝুম করে বৃষ্টি নামবে? হয়তো আপনার জীবনেও কেউ বর্ষা নামাতে আসবে।'

রাহুল হেসে বলল, 'আমি যা চাই তা কোনোদিনও পাই না নিভা।'

নিভা কৌতূহল চোখে তাকালো রাহুলের দিকে। রাহুল উপহাসের ন্যায় হেসে মুখ আকাশের দিক তাক করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠলো,

'ছোটবেলা থেকেই ভীষণ মা নেউটা ছিলাম বুঝলেন? আমার জীবনে আমার মাই সব। বাবা ব্যবসার কাজে এদিক ওদিক থাকতেন তেমন কাছে পাইনি। আমার মা ছিলেন প্রচন্ড ভালো মানুষ। তার মতো নীতিবাদী নারী খুব কম রয়েছে। টিকলি অনেকটা আম্মুর মতোন। ভীষণ আবেগি। আবার টায়রাও খানিকটা আম্মুর মতোন প্রতিবাদী। সবকিছু বেশ ভালোই চলছিলো। সুখময় স্বস্তিতে দিন পার করছিলাম। কিন্তু সুখময় সময়গুলো সবসময় সুখের হয়না। আমার সুখের সময়টাতেও দুঃখ ঘনিয়ে এলো। ওই যে বললাম আমি জীবনে যা চাই তা কখনোই পাইনি। ছোটবেলায় চাইতাম বাবা কেনো সময় দেয়না। সপ্তাহে দুই থেকে তিনদিন আমরা একসাথে থাকতাম। সেই দিনগুলো বাবা-মায়ের মাঝখানে শুয়ে ঘুমাতাম নিজেকে ভীষণ ভাগ্যবান মনে করতাম।'

রাহুল ফিচেল হাসলো। নিভা উদ্বেগ নিয়ে বলল, 'তারপর? তারপর কি হলো?'

'তারপর? হঠাৎ একদিন শুনি আমার মায়ের ব্রেন টিউমার ধরা পড়েছে। আমি তখন সবে নাইনে উঠেছি। মায়ের একদম লাস্ট স্টেজ। এক দু মাসের মধ্যেই আমি কিছু বুঝে না উঠতেই আমাকে অন্ধকার জগতে ফেলে দিয়ে মা চলে গেলো। আমি সেদিন প্রথম বাবাকে কাদতে দেখলাম। নিঃশব্দে কাঁদতে কাঁদতে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলো। আমার বাবা অনেক চেষ্টা করেছিলো মাকে বাচাঁনোর। কিন্তু পারেনি। আল্লাহর হুকুম কি কেউ ফেরাতে পারে? বিশ্বাস করবেন না কিন্তু আমার মায়ের মৃত্যুর চল্লিশ দিন পার না হতেই আমার বাবা গ্রাম থেকে বিয়ে করে নিয়ে আসে আরেক মহিলাকে। আমার পুরো দুনিয়া যেনো থমকে গেলো। আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। ওই দিনটাই যেনো হয়ে উঠলো আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অভাগা কালোদিন। এরপর থেকেই আমার জীবন হয়ে উঠলো নরকের মতো। হতভাগ্য মানুষ আমি!'

রাহুল বিদ্রুপের মতো হাসি হাসলো নিজের উপর। নিভা অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলল, 'সব শুনে মনে হয়েছিল আপনার বাবা আপনার মাকে ভালোবাসতেন। কিন্তু চল্লিশ দিন না যেতেই বিয়ে করেছেন। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।'

রাহুল মেকি হাসি দিয়ে বলল, 'আমিও পারিনি। প্রথম কিছুদিন মহিলার সাথে আমি কোনোরকম কথা বলিনি। কিন্তু দিন গড়াতে গড়াতে একসময় দেখলাম, মহিলাটি বাবার সামনে আমাকে খুব আদর করেন। কিন্তু আড়ালে ভীষণ রকম শাসায়। তার চোখে মুখে ফুটতো হিংসের আগুন। এক বছরের মাথায়ই তাদের আরেকটা মেয়ে হলো রুমকি। আমি তখন ক্লাস টেন। মহিলাটি আমাকে দিয়ে সকল কাজ করাতো। বাচ্চার কাঁথা ধোয়া থেকে শুরু করে যাবতীয় সকল কাজ। বাচ্চাকে ফিডারে দুধ পর্যন্ত আমি খাইয়ে দিতাম। একটু উনিশ থেকে বিশ হলেই মহিলাটি আমাকে ধরে মারতেন। কেনো মারতেন জানিনা। অকারণেই ভিষণ মারতেন। এরমধ্যে আমার এসএসসি পরীক্ষা ঘনিয়ে এলো। রুমকির তখন প্রায় এক বছর। আমার খুব ভক্ত ছিলো। আমিও ওকে প্রচন্ড আদর করতাম। কিন্তু অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েই আলাদা ম্যাচে থাকা শুরু করলাম। তাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে গেলাম। মাঝে মাঝে ওই বাড়িতে যেতাম রুমকিকে দেখতে। ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত খরচ বাবাই চালিয়েছেন। কিন্তু তারপর থেকে কষ্ট করে না খেয়েদেয়ে থাকলেও তার থেকে এক টাকা নেই না আমি। '

নিভার ওই বড় বড় পাপড়ি বিশিষ্ট চোখে পানি জমেছে। রাহুল হেসে দিয়ে বলল বলল, 'আরে আপনি কাদছেন কেনো?'

নিভা জানে না কেনো কাদছে। কিন্তু একটা ছেলের এতো করুন জীবনকাহিনী শুনলে পাথরও কাদবে। নিভা চোখ মুছে বলল, 'তো এখন কি প্ল্যান? কি করছেন?'

'জব খুঁজছি।'

'বিয়ে করবেন না?'

'দেখি। ভাবিনি এখনো।'

হালকা হেসে কথাগুলো বলে রাহুল ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে খুব ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,

'আমাকে একটু ফুফির বাসায় যেতে হবে। এমনিতেও অনেক দেরি হয়ে গেছে।'

'কেনো?'

রুমকি এসেছে। ওকে একটু দেখতে যাবো। মেয়েটা ভাইয়া বলতেই অজ্ঞান।'

______________________________

ঝুম বৃষ্টি মাথায় নিয়ে হুট খোলা রিক্সায় ঘোরা হলো ঢাকা শহর। কর্দমাক্ত রাস্তাতে পাশাপাশি হাটাও হলো। ভিজে জুবুথুবু হয়ে একে অপরকে লুকিয়ে ক্যামেরাবন্দী করাও হলো। খোলা আকাশের নিচে ফাঁকা রাস্তায় ইচ্ছেমতোন দু পাশে দু হাত মেলে দিয়ে ভিজা হলো। ঠোঁট মেলে হাসিতে হাসিতে আত্মহারা হয়ে উঠলো দুই মানব মানবী। তৃপ্তি করে ভিজা হলো প্রাণোচ্ছল কিশোর-কিশোরীর ন্যায়। বৃষ্টিভেজা প্রেমছন্দে মাতোয়ারা শহরজুড়ে ওরা যেনো মুক্ত প্রেমপাখি। আদর টিকলিকে এগিয়ে দিলো। বাড়ির খানিকটা দূরে থেকেই টিকলি রিক্সা থেকে নেমে গেলো। আদর পেছন ডেকে বলল,

'স্বাদ আহ্লাদ মিটেছে?'

টিকলি ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে দিয়ে বলল, 'ইশশ ডাক্তার এমন স্বাদ আহ্লাদ প্রতিদিন মিটালেই আপনি হয়ে যাবেন পৃথিবীর সেরা প্রেমিক।'

'তাই না? ঠান্ডা লাগলে পরে দেখাবো মজা। এবার তাড়াতাড়ি বাসায় যান। গিয়েই আমাকে কল করবেন।'

,

কাক ভেজা হয়ে বাসায় ডুকতেই দেখা গেলো বসার ঘরে সেইভাবেই সবাই বসে আছে সাথে শুধু রাহুল যোগ হয়েছে। রুমকিকে কোলে নিয়ে বসে আছে সে। জামিলুর রেজা ঘাড় ঘুরিয়ে টিকলিকে দেখে বললেন,

'ঘরে গিয়ে তাড়াতাড়ি জামা পাল্টাও।'

শায়লা আক্তার তোয়ালে নিয়ে সেখানেই হাজির হয়ে গেছেন। মেয়ের মাথা মুছে দিয়ে বললেন, 'জ্বর আসলে হাড্ডি এক জায়গায় করবো মাংস এক জায়গায় করবো।'

টিকলি মাথা নিচু করে চলে যেতে নিলেই আকিদা হক চুড়েল গলায় বললেন, 'তা এই বৃষ্টির মধ্যে ওতো জরুরি ভাবে বের হওয়ারই কি দরকার ছিলো? আর এতো বৃষ্টিতে ভিজে আসারই বা কি দরকার ছিলো? বৃষ্টি কমলে আসতে পারলে না?'

আকিদা হকের কথা তেমন পাত্তা দিলো না টিকলি। রাহুল ব্যস্ত কণ্ঠে বলল, 'যা যা। তাড়াতাড়ি ঘরে যা। এমনভাবে ভিজেছিস যেনো মনে হচ্ছে ইচ্ছা করে ভিজেছিস।'

টিকলি ভীত চোখে তাকিয়ে বিরবির করে বলল, 'তুমি এতো চালাক না হলেও পারতা রাহুল ভাই।'

সকলের কথা শুনে ঘর থেকে নিচে নেমে এসেছে টায়রা। টিকলিকে দেখে বলল, 'হায়হায় এমন ভাবে ভিজেছিস কেনো? এমনি তোর ঠান্ডার সমস্যা।'

আকিদা হক বললেন, 'বাইরে গিয়েছিলে বুঝি বৃষ্টিতে ভিজতেই?'

টায়রা মুখ টানা মেরে বলল, 'এতো সুন্দর জামা পড়ে সাজুগুজু করে কেউ নিশ্চয়ই ইচ্ছে করে কাদায় গড়াগড়ি খেয়ে ভিজতে যাবে না? এটা আপনার থেকে ভালো আর কে জানে মামীজান। আমি তো শুনেছি আপনার ওই বয়স্ক স্কিন নষ্ট হয়ে যাবে বলে আপনি রান্নার ঘরে উঁকিও দেন না।'

রাহুল ঠোঁট টিপে হেসে দিলো। আকিদা হক রুহুল হকের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চাপলেন। নিশ্চয়ই এসব রুহুল হকই বলেছেন। তাছাড়া আর কে বলবে? পরমুহূর্তেই আকিদা হক টায়রার দিকে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে বললেন,

'এই এক মিনিট টায়রা, তুমি কি বললে? বয়স্ক স্কিন? আমার স্কিন বয়স্ক? আপা আপনার মেয়ের কথা শুনেছেন? টিকলির আগে এরই বিয়ে দিতে হবে আপা।'

'আমার মনে হয় আমার আগে আপনাকে বিয়ে দিতে হবে। যেভাবে বিয়ে বিয়ে করছেন। মনে হচ্ছে, নতুন করে কবুল বলার স্বাদ জেগেছে।'

কথাগুলো বলেই টায়রা দৌড়ে টিকলিকে নিয়ে উপরে চলে গেলো। ঘরের দরজাও আটকিয়ে দিলো।

চলবে

Muna hasan, Md zeesahi, Zidan hamid, Sk rahul ali, Akash islam, Said ahmed, Nisha khan and লেখাটি পছন্দ করেছে

avatar
Onu kotha
শুকতারা
শুকতারা
Posts : 56
স্বর্ণমুদ্রা : 1339
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-05-26

বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ - Page 4 Empty Re: বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ

Tue Jul 13, 2021 11:24 pm

৩৮.
ভেজা জপজপে শরীর নিয়ে আদর আর হাসপাতালে গেলো না। বাসায় গিয়ে গোসল করে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই দেখলো আর্দ্র বিছানায় পায়ের উপর পা তুলে শুয়ে ফোনে কারোর সাথে কথা বলছে। আদর ভ্রু কুচকে টাওয়াল দিয়ে মাথা মুছে বারান্দায় নেড়ে দিলো। ততক্ষণে আর্দ্র ফোন রেখে দিয়েছে। আদর তর্জন গর্জন করে বলল,

'তোর সমস্যা কি? ফোনে কথাটা পর্যন্ত আমার রুমে এসে বলস। তোর রুম কি ভাইঙ্গে গেছে?'

আর্দ্র হাই তুলে সারা বিছানায় গড়াগড়ি করলো। এরপর খুব আয়েশী ভঙ্গিতে বলল,

'তোমাকে দেখেই এলাম। যাই হোক দারুন একটা গুড নিউজ আছে জানো।'

তুচ্ছতাচ্ছিল্য রূপে হেসে আদর ভ্রু নাচিয়ে বলল,'কি? নতুন প্রেম?'

আর্দ্র হেসে মাথা ঝাকিয়ে, হাত নাড়িয়ে বলল, 'আরে এখনো প্রেম হয়নাই ভাইয়া। ফিলিংস আসতাছে না। আই লাভ ইউ কথাটা মুখ দিয়ে বেরই হতে চায় না। তবে মেয়েটা বাকিদের মতোই আমার জন্য পাগলা। বোরিং লাগে আমার। কেউ একটু অন্যরকম হলে কি হয়?'

আদর গায়ে শার্ট জড়াতে জড়াতে বলল, 'এটা ষোলো নাম্বার তাই না?'

'আরে ভাইয়া প্রেম হয়নাই তো এখনো।'

আদর আর কথা বাড়ালো না। চুলগুলো আচড়ে হাতে ঘড়ি পড়তেই আর্দ্র ভাবুক মুখে প্রশ্ন করলো,

'আচ্ছা ভাইয়া? এমন কোনো কথা আছে যা তুমি এখনো টিকলিকে বলতে পারোনি।'

'হুম আছে তো। দুটো না বলা কথা রয়ে গেছে।'

আর্দ্র কৌতূহল স্বরে বলল, 'তাই? কি কি?'

গায়ে পারফিউম লাগাতে লাগাতে আদর বলল, 'সরি আর ভালোবাসি বলা হয়নি।'

আর্দ্র কিছুক্ষণ বড় বড় করে চোখ মেলে চেয়ে থেকে বলল, 'কি বলো? এখনো সেই সরি বলোনি? ভালোবাসিও বলো নি?'

'যে কথা চেষ্টা করেও বলা হয়ে উঠে না তা আর বলার কি দরকার? থাকুক আড়ালে গোপনে। সরিটা খুব করে বলতে চেয়েও বলতে পারিনি। তাই এখন আর চেষ্টা করিনা।'

'আর ভালোবাসা?'

'যে কথা মুখে না বলেও কাজকর্মে অনুভূতিতে ব্যক্ত হয়ে অপরিসীম প্রেম জোগায় সে কথা না বলাই উত্তম।'

,

রাত নয়টা। রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ হলো এই কেবলই। আকিদা হক রুহুল হক আজ এ বাড়িতে থাকবেন। রাহুল খাওয়া দাওয়ার পাট চুকানো মাত্র চলে গিয়েছে। রুমকি বসে ছিলো টিকলি টায়রার মাঝে। টিকলির সামনে বসে আছে জামিলুর রেজা আর শায়লা আক্তার। মাথা নিচু করে টিকলি বসে ছিলো। ক্রমাগত হাত মোচড়াতে মোচড়াতে হাত এখন ব্যথা ধরে গেছে। ক্ষণে ক্ষণে আকাশ গর্জন করছে। বড় বড় বজ্রপাতের ঝলকানিতে মাঝে মাঝেই প্রকৃতি দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে উঠছে। শায়লা আক্তার রুমকির দিকে ঘুরে বললেন,

'আম্মু, তুমি তোমার আব্বু আম্মুর কাছে যাবে একটু?'

রুমকি নিঃশব্দে মাথা নাড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। টিকলি এবার নড়েচড়ে বসলো। জামিলুর রেজা গম্ভীর গলায় বললেন,

'বিকালে কোথায় গিয়েছিলে?'

মিনমিন করে টিকলি বলল, 'একটু কাজ ছিলো বাবা।'

'কিসের কাজ?'

এই প্রশ্নের পরিপেক্ষিতে টিকলি উত্তর খুঁজে পেলো না। ব্যস্ত চোখে এদিক ওদিক তাকাতেই শায়লা আক্তার নিচু গলায় হুঙ্কার ছেড়ে বললেন,

'কার সাথে বৃষ্টিতে ভিজে এসেছিলি?'

টিকলি চোখ মুখ খিচে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকলো। টায়রা আড়চোখে তাকিয়ে আস্তে করে বলল,

'আম্মু একটু আস্তে করে কথা বলো। তোমার বাঘিনী ভাইয়ের বউ শুনে ফেললে তো আবার শুরু হয়ে যাবে।'

জামিলুর রেজা চোখ পাকিয়ে টায়রার দিকে তাকাতেই টায়রা মুখে আঙ্গুল দিলো। টিকলির কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে জামিলুর রেজা কড়া আদেশে বললেন,

'আজ থেকে তোমার বাইরে যাওয়া বন্ধ৷ ভারসিটি যাওয়ার প্রয়োজন হলে আমি নিয়ে যাবো নিয়ে আসবো। আমি না পারলে তোমার মা। তোমার মা না পারলে রাহুল যাবে।'

জামিলুর রেজা থমথম পায়ে হেটে চলে গেলেন। টিকলি মাথা তুলে বাবার যাওয়ার পানে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকলো। চোখের কোণায় বিন্দু বিন্দু পানি জমতেই শায়লা আক্তার অবাক গলায় বললেন,

'একটা ছেলের জন্য তুই...'

কথা শেষ করার আগেই টিকলি মাথা তুলে তাকালো। অত্যন্ত আহত গলায় বলল,

'তুমি বদলে গেলে কেনো মা? তুমি তো এমন ছিলে না। ছোটোবেলায় আমি দুষ্টুমি করলে বলতে আমি নাকি তোমার মেয়ে না। তোমার মেয়ে এতো দুষ্ট হতেই পারে না। হাসপাতালে নিশ্চয়ই অদলবদল হয়ে গেছে। তবে এখন আমার কেনো মনে হচ্ছে? হাসপাতালে আমার মা অদলবদল হয়ে গেছে?'

শায়লা আক্তার নরম মনের মানুষ। অত্যন্ত দুঃখী হয়ে সে মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন। চোখের কোণায় উপচানো জল গুলোকে ধরে রেখেই ভাঙা গলায় বললেন,

'আমার মেয়ের নামে এতো বড় অপবাদ যারা দিয়েছিলো সেই পরিবারে আমি কিছুতেই মেয়ে বিয়ে দিবো না। ওই পরিবারে তুই কখনো ভালো থাকবি না। সামান্য কিছু হলেই তারা 'পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট' এই ভুয়া কথার মতোই তোকে কথা শুনাবে। ওই পরিবার ভালো নয়। তুই তো জানিস না তারা ফোন দিয়ে সেদিন কতো বাজে কথা বলেছিলো। পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট কি কেউ হয়? তবুও তারা এতো বাজে কথা কীভাবে বলতে পারে? হ্যাঁ রে ওই ছেলের সাথে তো তোর সব ভেঙেই গিয়েছিলো আবার জোড়া লাগলি কি করে তোরা?'

শায়লা আক্তার নিজ মনে কথা গুলো বলে চলে যেতেই নিস্তব্ধ টিকলি জানালা গলিয়ে দৃষ্টি বাইরে রাখলো। মনের কোঠায় তেজি মেঘগুলো গর্জন করতে করতে বৃষ্টি হয়ে ঝড়ে পড়লো। টিকলি কাদতে পারছে না। এদিকে তার বুক ছিড়ে যাচ্ছে। গলায় অসহনীয় ব্যথা হচ্ছে। ক্ষণে ক্ষণে শরীর কেঁপে উঠছে। নিঃশ্বাস চলছে না। মুখটাকে কিঞ্চিৎ হা করে নিঃশ্বাস ফেলতে হচ্ছে। একটুপরেই বাইরে তুমুল আষাঢ়ে বর্ষন শুরু হলো। বৃষ্টির ছাচে টিকলির গলার অংশ ভিজে উঠলো। টায়রা হাত বাড়িয়ে জানালা আটকে টিকলিকে কাছে টানলো। টায়রাকে জড়িয়ে ধরেই অনুভূতি শূন্য কৌঠার ঘরে পৌছিয়ে টিকলি বলল,

'আমার বাইরে যাওয়া বন্ধ। আমার কি আর কক্ষনো উনার সাথে দেখা হবে না? বাবা-মা কি মানবে না কোনোদিনও? আমি এ কথাগুলো তাকে বললে সে কিভাবে রিয়েক্ট করবে টায়রা?'

টায়রা উত্তর খুঁজে পেলো না। টিকলির মাথা হাত বুলিয়ে বড়দের মতো করে বলল,

'দুই তিনদিন থেকে ঘুমোস না। তুই একটু ঘুমা তো। আমি দেখছি ব্যাপারটা।'

,

রাত তখন দশটা। ঘড়ির কাটা ছুটছে যেনো তুমুল গতিতে। চিন্তায় ক্লান্ত হয়ে আসছে শরীর। বৃষ্টি শীতল পরিবেশেও জড়ে পড়ছে ঘাম। টিকলি ঘুমিয়ে গেছে। টায়রার ফোনে আদরের নাম্বার নেই। টিকলির ফোন থেকে ফোন করা হলে ওপাশে বেজে বেজে কেটে গেলো কিন্তু ধরা হলো না। টায়রা যারপরনাই বিরক্ত হয়ে বারান্দার দোলনায় বসলো। একটু পর আবার ফোন দিতেই ওপাশ থেকে ফোন ধরা হলো। টায়রা হ্যালো বলতেই অবাকতার সুরে কেউ উচ্চকণ্ঠে বলল,

'আপনি কেনো?'

টায়রার ভ্রু দুটো কুচকে এলো। ফোন সামনে এনে নাম্বারটা চেক করেই ক্রোধান্ধ হয়ে বলল,

'অন্যের ঘাড়ে বন্দুক রেখে আর কয়দিন ফুটাবেন?'

আর্দ্র অবাক হলো। কাবার্ডের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,

'যদি নিশানা ঠিক থাকে তাহলে গুলি ছুড়তে ক্ষতি কি?'

আর্দ্র সন্দিহান গলায় আবার বলল, 'কি ব্যাপার বলুন তো? যেদিন আমি ফোন ধরি সেদিন আপনিও ফোন করেন। ব্যাপারটা কি কাকতালীয় নাকি ইচ্ছাকৃত?'

টায়রা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, 'সেটা তো আর আমি জানি না। আমি তো আর আপনার নাম্বারে ফোন দেইনি। উলটে আপনি এসে ফোন ধরেছেন। সুতরাং বলা যায়, ব্যাপারটা আপনার দিক থেকে ইচ্ছাকৃত।'

'ঝগড়া করার তাল তুলবেন না একদম।'

টায়রা চেচিঁয়ে বলল,

'এই, আপনার সাথে ঝগড়া করতে আমার বয়ে গেছে বুঝছেন? ফোন আপনি কেনো ধরছেন? আপনাকে ফোন দিছি?'

'ভাইয়া মাত্র হাসপাতাল থেকে আসলো। ফ্রেশ হতে গেছে। ফোন বাজার শব্দ পেয়ে আমি এসেছি পরে দেখি...। এই ওয়েট, আপনাকে এতো কৈফিয়ত কেনো দিবো? আপনি নিজেই তো নিজের বোনের ফোন থেকে ফোন করেছেন।'

'আমার কাছে ভাইয়ার নাম্বার ছিলো না।'

'তো? তাই বোনের ফোন চুরি করে ফোন দিতে হবে?'

'আপনি যে আপনার ভাইয়ের ফোন চুরি করে ধরছেন তার বেলায়?'

'আপনার সাথে ঝগড়া করার মুড নাই আমার। টিকলি কোথায়?'

'ঘুমোচ্ছে।'

'এতো তাড়াতাড়ি?'

'শুনেন আপনার সাথে খেজুরে আলাপ পারার জন্য আমি ফোন দেই নাই। তাড়াতাড়ি ভাইয়াকে ডেকে ফোন দেন।'

আর্দ্র রাগে ফুসতে ফুসতে বলল, 'ডাইনি।'

'আপনি ডায়েন। এবার ভাইয়াকে দেন।'

আর্দ্র ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াতে গিয়েও ফিরে এলো। ভ্রু কুচকে বলল, 'ব্যপার কি? আমার ভাইয়ের জন্য এতো উতলা কেনো? বোনের জামাইয়ের দিকে নজর দেন? আস্তাগফিরুল্লাহ! ছি ছি! নজর হেফাজতে রাখুন। '

টায়রা খুব অসহায় হয়ে পড়লো, 'দেখুন ভাদ্র সাহেব। প্লিজ..ইটস ইমার্জেন্সি। দিন।'

তখনি ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দ হলো। আর্দ্র কথা না বাড়িয়ে আদরের হাত ফোন ধরিয়ে দিতেই আদর ভ্রু কুচকে বলল,

'কে? আর তুই আমার ফোন ধরস কেন?'

আর্দ্র উত্তর না দিয়ে চলে গেলো। ফোনের স্কিনে নাম্বার দেখে নিয়ে আদর বলল,

'হ্যাঁ টিকলি বলুন। কি করছেন?'

'ভাইয়া আমি টায়রা।'

আদর কাধে ফোন রেখে মাথা দিয়ে চেপে কথা বলছিলো। টায়রার নাম শুনে ভ্রু কুচকে ফোন হাতে নিয়ে ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,

'টায়রা? কেমন আছো? কিছু হয়েছে? টিকলি কোথায়?'

'ঘুমোচ্ছে।'

আদর আবার ভ্রু কুচকে বলল, 'ঘুমোচ্ছে? এতো তাড়াতাড়ি?'

'হুম। ভাইয়া শুনুন।'

'জি বলো।'

লম্বা এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে টায়রা কথা শুরু করলো। সম্পূর্ণ কথা বলা শেষ হতেই আদর হতাশ শ্বাস ফেলে বলে উঠলো,

'উনাকে কান্নাকাটি করতে বারণ করো। আর একটু ডেকে দাও।'

টায়রা টিকলিকে ঘুম থেকে উঠালো। টিকলি ক্লান্ত আধখোলা চোখে তাকাতেই টায়রা হাতে ফোন ধরিয়ে দিলো। ফোন কানে নিয়ে টিকলি বলল,

'বলুন।'

'এক দুইদিনের কাপড় নিয়ে ব্যাগ গুছান। আর রেডি হয়ে মোড়ে আসেন। আমি আসছি। টায়রাকেও রেডি থাকতে বলেন।'

টিকলি বিস্ফোরিত চোখে তাকালো। চোখের ঘুম উবে গেলো। ফোন সামনে এনে নাম্বারটা চেক করে নিয়ে বলল,

'বেশি কাজের প্রেসারে বোধহয় পাগল হয়ে গেছেন ডাক্তার। আমি এখন কীভাবে বের হবো? বাবা মা বোধ হয় ঘুমিয়ে গেছেন। আর আমার বাইরে বের হওয়া বন্ধ। তারউপর বাসায় মামা মামী আছে।'

'লুকিয়ে আসুন। দেড় ঘণ্টার ভেতরেই আমি এসে পরবো। পারবেন না আসতে? না পারলেও আসতে হবে।'

নিজ মতে কথাগুলো বলেই ফোন কাটা হলো। টায়রা টিকলির ফোনের সাথে কান পেতে ছিলো। আদরের কথা শুনে সে নাচতে নাচতে ব্যাগ গুছিয়ে বলল,

'আই এম সিউর, আদর ভাইয়া আমাদের নিয়ে কোনো ট্যুরে যাবে। উফফ....বন্ধ দুনিয়া থেকে একটু শান্তিু পাবো। নে নে তাড়াতাড়ি রেডি হ। চুপিচুপি বাসা থেকে বের করার দায়িত্ব আমার।'

,

আদর গিয়ে আর্দ্রকে ডেকে নিয়ে আসলো। এরপর খুব নিচু গলায় বলল, 'রেডি হ।'

আর্দ্রও ফিসফিস করে বলল, 'কেনো ভাইয়া?'

আর্দ্রের মাথায় একটা চাটি মেরে আদর ধমকে বলল, 'এতো প্রশ্ন করিস কেনো? যা রেডি হ। বাবা মা যাতে না জানে। শুধু নিভাকে জানিয়ে যাবি। নিভা কোথায়?'

'ছাদে।'

'ও দিন রাত ছাদে কি করে?'

'একটু আগেই বৃষ্টি থামলো না? তাই ভেজা পরিবেশ দেখতে গেছে।' আর্দ্র দাঁত বের করে বলল। আদর কটমট করে বলল,

'তাড়াতাড়ি বলে তাড়াতাড়ি রেডি হ যা। টিকলিকে পিক করতে যেতে হবে।'

______________________________

তুমুল বৃষ্টি থেমেছে একটু আগেই। ভেজা ছাদ। পুরো ছাদে ছড়িয়ে ছিটিয়ে উড়ন্ত শিমুল তুলোগুলো ভেজা ভারী হয়ে নেতিয়ে আছে। নিভা খালি পায়ে হেটে বেড়াচ্ছে। ছাদের একপাশে হরেক রকমের ফলের গাছ। আরেকপাশে ফুলের গাছ। প্রতিটা গাছের পাতায় পাতায় পানি। ভেজা পাতায় ছুয়ে দিতেই টুপ টুপ করে পানি বর্ষিত হচ্ছে। নিভা খিলখিল করে হাসলো। মধ্যরাতে খোলা চুলে খালি পায়ে এক রমণী ভেজা ছাদ চষে বেড়াচ্ছে। ছাদের এক পাশে টিমটিম করে জ্বলছে হলুদ বাতি। হরেক ফুলের গন্ধে ম ম চারিপাশ। এক কোণায় হাসনাহেনা গাছ ফুল ঝড়িয়ে সাদা গালিচা বিছিয়ে দিয়েছে। নিভা সেদিকে যেতেই খেয়াল করলো উল্টো ঘুরে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। মুখের সামনে জ্বলছে নিভু নিভু লাল বাতি। আকস্মিক নিভা ভয় পেলেও পরক্ষণেই সতর্ক দৃষ্টিতে তাকালো। সন্দিহান চোখে গলা উঁচু করে বলল,

'কে ওখানে?'

রাহুল ফিরে তাকালো। নিভাকে দেখেই চমকে উঠে হাতের সিগারেট টা দূরে ফেলে দিলো। ফেলে দিতেই মনে হলো ভুল করে ফেলল। সিগারেটটা নিভিয়ে ফেলার দরকার ছিলো। নিভা এক পা এগিয়ে ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালালো। সাদা আলোতে রাহুলকে আবিষ্কার করতেই খুব অবাক হয়ে বলল,

'আরে আপনি?'

রাহুল স্মিত হেসে বলল, 'আমিও আপনাকে দেখে অবাক হয়েছি। আমি তো প্রতিদিন এসময় ছাদে আসি।'

নিভা ভ্রু কুচকে বলল, 'সিগারেট খেতে?'

রাহুল মাথা চুলকিয়ে আবার হেসে দিয়ে বলল, 'আপনি এসময়ে?'

নিভা দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আয়েশী ভঙ্গিতে বলল, 'বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগের দৃশ্য আর শেষ হওয়ার পরের দৃশ্য কিন্তু চমৎকার।'

'তা ঠিক। তাই বুঝি এসময় ছাদে এসেছেন?'

নিভা মাথা নাড়ালো। এরপর কিছুক্ষণ আর কোনো কথা হলো না। নিভা উদাস চোখে আকাশের দিক তাকিয়ে থাকলো ক্ষণকাল। হঠাৎ আকস্মিক কিংবা দৈবাৎ বলা যায় কিন্তু নিভা প্রশ্ন করলো,

'আপনি কাউকে ভালোবাসেন না?'

রাহুল থতমত খেলো। শুকনো কাশিও কাশা হলো। তবুও মুখে সত্য হাসি ফুটিয়ে অত্যন্ত নরম কণ্ঠে বলল, 'বাসি তো।'

নিভা আকাশ থেকে চোখ সরিয়ে রাহুলের দিকে চোখ নামিয়ে আনলো। খুব কৌতুহল কণ্ঠে বলে উঠলো, 'কাকে?'

মাথা ঝাকিয়ে রাহুল উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে কৌতুক স্বরে প্রশ্ন করলো, 'বলবো?'

নিচু স্বরে নিভা বলল, 'হুম।'

'সত্যি বলবো?'

'হুম বলুন।'

'কাউকে বলে দিবেন না তো?'

নিভার বুক ঢিপঢিপ করে উঠলো। মাত্রাতিরিক্ত বুক কাঁপানো নিয়ে বলে উঠলো, 'নাহ। এ জীবন থাকতে কক্ষনো কাউকে বলবো না।'

'কথা দিলেন?'

'হুম। এবার বলুন।'

দূরের ওই মেঘে ভাসানো চাঁদ-তাঁরাবিহীন কালো আকাশের দিকে তাকিয়ে রাহুল হাসিহাসি মুখ করে বলল, 'টিকলিকে।'

প্রায় সাথেসাথে আশেপাশে যেনো বজ্রপাতের মেলা বসলো। মনে হলো এই তিন তলা শক্তপোক্ত বাড়িটা এক নিমিষেই দুমড়ে মুচড়ে গেলো। নিভা স্তব্ধ হয়ে শুনলো। কানে যেনো বারংবার বাজলো শব্দটা। মাথায় বলের মতো ঢপ খেতে লাগলেই নিভা দিশেহারা হয়ে গেলো। বোধ হলো, আশেপাশে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় বয়ে যাচ্ছে। উড়ে যাচ্ছে সব। ধ্বংস হচ্ছে। চূর্ণবিচূর্ণ হচ্ছে। দগ্ধ হচ্ছে। সে সাথে কথা ফুরিয়ে যাচ্ছে নিভার। শরীর ক্রমেই অসাড় হয়ে আসছে। ভর ছেড়ে দিচ্ছে। রাহুল মুচকি হেসে তখনি আবার বলল,

'অনেক ছোটোবেলা থেকেই ওকে আমি ভালোবাসি। কিন্তু কখনো বলা হয়নি। আপনি যেনো আবার ওকে বলে দিবেন না।'

নিভা স্থির নিশ্চল চোখে তাকিয়ে ছিলো। নিষ্প্রাণ দুটি চোখ বন্ধ করে আবার মেলে ধরতেই চোখের কোণায় অজান্তেই চিকচিক করে জানান দিয়ে উঠলো অশ্রুকণা। মনেতে বারংবার বেজে উঠলো প্রশ্নের দল, 'টিকলি? কীভাবে? কীভাবে সম্ভব? টিকলি কেনো?' তখনি ছাদে এসে দাড়ালো আর্দ্র। রাহুলকে দেখে হাসিমুখে কথা বলে নিভাকে টেনে আড়ালে নিয়ে এলো।

'এতো রাতে কি করস এখানে? যা ঘরে যা। আর শোন, আমরা এক দুই দিনের জন্য বাইরে যাচ্ছি। টিকলিও যাবে। বুঝলি? বাসার কেউ কিন্তু জানে না তুই কাউকে বলবি না। শুধু বলবি তুই এ ব্যপারে কিচ্ছু জানিস না।'

নিভা রোবটের মতো আর্দ্রের সব কথা শুনলো। কিন্তু উত্তর দেওয়ার জন্য গলা থেকে শব্দ বের করতে পারলো না। হঠাৎ করেই নিজ হাতে সাজানো গোছানো দুনিয়াটা কেমন এলোমেলো হয়ে যেতে লাগলো। একদিকে টিকলির প্রতি রাহুলের বছরের পর বছর একতরফা গভীর ভালোবাসা অন্যদিকে আদর টিকলির মরণপ্রাণ ভালোবাসা, প্রেম। তারউপর তারা যাচ্ছে ঘুরতে। রাহুল আছে কষ্টে। দুই পরিবারে বিবাদ। আর্দ্র টায়রার ঝগড়া। এই এতোকিছুর মধ্যে নিভার অস্তিত্বটা ঠিক কোথায়! সবকিছুর মাঝে যেনো নিভা শুধুই সাক্ষীপক্ষ। সবার জীবনের আড়ালের গোপনের খবরের সাক্ষী হয়ে রইল। কিসের টানে এতোদিন ছুটলো সে? কিসের পেছনে ছুটলো? তার জীবনটা কি শুধুই মরিচীকা?

চলবে

Disha moni, Priya halder, Arjju khan, Sabbir hosen sumon, Sohag hasan abir, Anik hossain, Nishad jaman and লেখাটি পছন্দ করেছে

avatar
Onu kotha
শুকতারা
শুকতারা
Posts : 56
স্বর্ণমুদ্রা : 1339
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-05-26

বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ - Page 4 Empty Re: বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ

Tue Jul 13, 2021 11:24 pm

৩৯.
নিশুতি রাতে নেই কোনো কোলাহল। রাস্তায় নেই কোনো যানবাহন। দূর দূরান্তেও নেই মানুষের পদচ্ছাপ। নেই অযথা মানুষের গিজগিজ। দম আটকানো ফাঁকা চারিপাশে। সোডিয়ামের টিমটিমে এক প্রকার আলোয় মুখচ্ছবি অস্পষ্ট। রাত তখন বাজে বারোটা। গলির মুখের মোড়ে দাড়াতেই দেখতে পেলো আদর আর্দ্র গাড়িতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ব্যস্ত পায়ে ঢিপঢিপ বুকে এগিয়ে যেতেই আদর বিরক্ত মুখে বলল,

'আধ ঘন্টা লেট।'

টিকলি মাথার স্কাপ টাকে আরেকটু টেনে নিলো। মুখের মাস্ক ঠিক করে এদিক ওদিক চঞ্চল চোখে তাকিয়ে বলল, 'গাড়িতে উঠুন। এখানে থাকা সেফ না। কে কোথা থেকে দেখে ফেলে।'

আদর ভাবলেশহীন ভাবে ক্লান্ত হয়ে গাড়ির সাথে শরীর এলিয়ে দিয়ে টিকলির সারা মুখে চোখ বুলালো। সেই প্রথমদিনের মতো মুখে মাস্ক চোখে লেন্স মাথায় স্কাপ কাধে ঝুলানো ব্যাগ। একদম সেই প্রথম দিনের টিকলি। আদর হঠাৎ বলল,

'মিস. পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট মহিলা আপনার বেবির এখন কত মাস চলে? আমার হিসেব নেই।'

টিকলি বড় বড় চোখ করে আদরের দিকে তাকিয়ে নিজের পেটের উপর হাত রাখলো। একবার পেটের দিকে তাকিয়ে আরেকবার আদরের দিকে তাকালো। আদরের বাহুতে একটা শক্ত থাপ্পড় মেরে বলল,

'ফাইযলামি করেন?'

আদর বোকা বোকা চেহারায় বলল, 'ফাইযলামি করলাম? আরে আপনি তো বলেছিলেন আপনার বয়ফ্রেন্ড এক মাস আগে আপনাকে ছেড়ে চলে গেছে আর আপনি পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট।'

আদর হেসে দিয়ে আবার বলল, 'সিরিয়াসলি মানুষ কতটা বোকা গাধা হলে এই কথা বলতে পারে।'

'বাদর সাহেব, খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।'

আদর ঠোঁট কামড়ে হাসলো। টিকলি ফুসে উঠে বলল, 'আপনি যান। আমি আপনার সাথে কোত্থাও যাবো না। অসভ্য লোক একটা।'

আদর আবার হাসলো মাথা নাড়িয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আর্দ্রর চিৎকার শোনা গেলো, 'ভাইয়া....'

আদর চমকে উঠলো। আকস্মিক চিৎকারে টিকলি আদরের হাত খামচে ধরলো। দাঁত কিড়িমিড়ি করে আদর বলল, 'ঠাটিয়ে দিবো এক চড়।'

আর্দ্রর কোনো হেলদোল হলো না। ও টায়রার দিক তাক করে আঙ্গুল তুলে বলল, 'এই শাকচুন্নিও আমাদের সাথে যাবে? তুমি তো বলোনি।'

টায়রা গরম চোখে তাকালো। তেজি গলায় বলল, 'কে শাকচুন্নি? আপনার বউ শাকচুন্নি। ফালতু লোক একটা।'

আদর বিরক্ত হয়ে গাড়িতে উঠতে উঠতে বলল, 'সারাটাদিন শুধু ঝগড়া ঝগড়া ঝগড়া। তুই ভাবলি কি করে তোকে আনলে টায়রাকে আনবো না?'

আর্দ্র কাদো কাদো চোখে তাকিয়ে বলল, 'বিয়ে না করতেই পর হয়ে যাচ্ছো? ভাইয়ের থেকে শালী আপন?'

আদর ধমকে বলল, ' তুই উঠবি?'

আর্দ্র সামনের সিটে বসতে গেলে আদর আবারো খেকিয়ে উঠলো, 'এখানে বসছিস কেনো? এখানে টিকলি বসবে।'

'তো আমি কোথায় বসবো?'

'পেছনে যা।'

তৎক্ষণাৎ টায়রা আন্দোলনের স্বরে বলে উঠলো, 'ইম্পসিবল। আমি মরে গেলেও এই মদনের সাথে বসবো না।'

আর্দ্র গলা উঁচিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই টিকলি সামনের সিটে বসে পরলো। রেগে বলল, 'এই গাড়ি স্টার্ট দেন তো। দুটোকেই রেখে যাই।'

টায়রা ফুস ফুস করতে করতে পেছনের সিটে বসে বলল, 'তোরে আমি আর কোনোদিন হেল্প করমু না। বোন নামের কলংক তুই।'

টিকলি টায়রার কথা পাত্তা না দিয়ে আর্দ্রকে জিজ্ঞেস করলো, 'ভাইয়া, বাসায় কি কাউকে বলে আসছেন?'

'হুম নিভাকে বলছি।'

'ওকে নিয়ে আসলেই তো পারতেন।'

আদর উত্তর দিলো, 'এখানে সবাই কাপল কাপল ঘুরবে। মাঝখানে ও একা এসে কি করবে?'

অনতিবিলম্বে তক্ষুণি আর্দ্র টায়রা ক্ষিপ্ততা সহকারে সমস্বরে বলল, 'কিসের কাপল? শুধু তোমরা দুজন কাপল।'

টায়রা আর্দ্রের দিকে তাকিয়ে নাক ছিটকে বলল, 'এই ডেমরা হবে আমার কাপল? ছি!'

টায়রার রিয়েকশন দেখে আর্দ্র থতমত খেয়ে বলল, 'এই ঢেড়ি হবে আমার কাপল? থু!'

'অসহ্য, আমি।'

'অতিষ্ট, আমি।'

টিকলি কানে হাত রেখে আদরকে বলল, 'গাড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে দুটোকে ফেলে দিন তো।'

______________________________

সকাল সকাল মনোয়ারা খান বিরবির করতে করতে গেলেন আদরের ঘরে। ছেলের তো এবার বিয়ে করা ফরজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর কতদিন এভাবে বসে থাকবে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে কি ভালো মেয়ে পাবে? এদিকে আজিম খান প্রত্যেক দিন এ বিষয় নিয়ে তার সাথে রাগারাগি করে। মনোয়ারা খানের শরীর জ্বলে যায়। সে বুঝে না, ছেলের বিয়ে নিয়ে বাপের এতো তড়জড় কিসের?

আদরের ঘরে গিয়ে আদরকে না পেয়ে মনোয়ারা খান ভাবলেন হয়তো ছেলে তার হাসপাতালে চলে গেছে। তবুও বড় ছেলের খোঁজে ছোট ছেলের ঘরে গেলেন। গিয়ে দেখলেন ছোট ছেলেও ঘরে নেই। মনোয়ারা খানের ভ্রু জোড়া স্বাভাবিক ভাবে কুচকে গেলো। এতো সকালে দু ভাই ঘরে নেই। ব্যাপারটা তো সহজ কথা নয়। ভিষণ রকম শরীর কাঁপা নিয়ে তিনি ঘর ছাড়লেন। মা মনটা অকারণেই ভাবতে বসলো, 'দু ভাই মিলে কি আবার গণ্ডগোল পাকালো? হায় খোদা! এবার যদি কিছু হয় আমি ওর বাপকে সামাল দিবো কীভাবে?'

মনোয়ারা খান নিভার ঘরে গেলো। নিভার কাচা ঘুম ভাঙিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, 'মা, আদর আর্দ্র কোথায় জানিস?'

নিভার ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে বলে ফেলল, 'ঘুরতে গেছে।'

মনোয়ারা খানের কপাল কুচকে গেলো। ঘুরতে গেছে তার মানে কি দুটো মিলে আবার পালালো? ঘুরতে গেলো তো বলে যেতো। কিন্তু পালিয়ে যাবার মতো তো এবার কিছু হয়নি। মনোয়ারা খান কপাল কুচকে প্রশ্ন করলেন, 'কোথায় গেছে?'

নিভা বলতে যাবে তার আগেই মস্তিষ্কে ঢপ খেলো। ঘুম ছুটে পালালো। বিরাট বড় যে একটা ঝামেলা পাকিয়ে ফেলল তা বুঝে আসতেই ঢোক গিলল। ব্যস্ত কণ্ঠে তোতলানো স্বরে বলল, 'আমি জানি না। জানি না তো ওরা কোথায়। ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখছিলাম তো তাই উল্টো পালটা বলে ফেলছি।'

মনোয়ারা খান জহুরি নজরে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ এরপর আর কোনো কথা বললেন না। কপালে চিন্তিত কয়েকটি ভাঁজ ফেলে উঠে চলে গেলেন। নিভা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। জানালা গলিয়ে বাইরে তাকাতেই মনের মেঘগুলো হঠাৎ ডুকরে উঠলো। কাল সারারাত ঘুমানো হয়নি। ফজরের নামাজ পড়ে একবারে ঘুমোতে গেছে। এখন হুড়মুড় করে ঘুম থেকে উঠার ফলস্বরূপে মাথায় এক ধরনের চিনচিনে ব্যথা অনুভব হচ্ছে। নিভা আবার শুয়ে পড়লো।

,

শায়লা আক্তার হাত খোপা করতে করতে মেয়েদের ঘরের দরজার সামনে গেলেন। দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতেই বেশ ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেন। পুরো রুমে চোখ বুলিয়েও কোথাও মেয়েদের অস্তিত্ব পাওয়া গেলো না। তার শরীর ধরধর করে ঘামা শুরু করলো। হাত দিয়ে মুখ হাপড়ে মুছলেন। সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেও মেয়েদের পেলেন না। নিজ ঘরে গিয়ে তিনি স্বামীকে খবর লাগালেন। জামিলুর রেজা ব্যস্ত পায়ে মেয়েদের ঘরে গেলেন। ঘরে মেয়েদের না পেয়ে বললেন,

'সারা বাড়ি খুঁজেছো?'

শায়লা আক্তার মুখে আচঁল দিয়ে কেদে উঠলেন। মাথা ঝাকিয়ে বললেন, 'হুম'

জামিলুর রেজা চতুর চোখে এদিক ওদিক তাকাতেই দেখতে পেলেন আলমারি কিঞ্চিৎ খোলা। আলমারির
হাতল ধরে টেনে পুরোপুরি খুলতেই দেখলেন মেয়েদের ব্যাগ নেই। সাথে বেশকিছু জামাকাপড়ও নেই। জামিলুর রেজা চোখ পাকিয়ে শায়লা আক্তারকে দেখে দাঁত কিড়িমিড়ি করে বললেন,

'কেমন মা তুমি? মেয়েদের খেয়াল রাখতে পারো না? দু'বার মেয়েরা পালিয়ে গেলো।'

গম্ভীর লাল মুখে চটপট পায়ে ঘর ছাড়লেন জামিলুর রেজা। নিচে গিয়ে বিষন্ন মুখে সকালের নাস্তা তৈরি করলেন শায়লা আক্তার। একটু পর জমকালো শাড়ি পড়ে নিচে নেমে এলেন আকিদা হক। মাথায় ভেজা তোয়ালে বাধা। শায়লা আক্তার একবার দেখেই চোখ ফিরিয়ে নিলেন। আকিদা হক টেবিলে বসতে বসতে বললেন,

'টিকলি টায়রা ঘুম থেকে উঠে নি আপা?'

শায়লা আক্তার জবাব দিলেন না। আকিদা হক ভ্রু কুচকে তাকাতেই শায়লা আক্তার নড়েচড়ে উঠলেন। এই মহিলা তিল কে তালের রস বানিয়ে ছাড়ে। মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন,

'ওই তো....ঘুরতে গেছে ওরা। বান্ধবীদের সাথে ঘুরতে গেছে।'

'কখন গেলো? এই এতো সকালে ঘুরতে গেলো? কোথায় গেছে আপা?'

শায়লা আক্তার বিরক্ত হলেন। এতো প্রশ্নের কি দরকার? গমগমে মুখে শায়লা আক্তার উত্তর দিলেন,

'এইতো আশেপাশেই গেছে।'

নিচে নেমে এলেন রুহুল হক। টেবিলের কাছাকাছি আসতেই স্ত্রীর বেশভূষা দেখে ভ্রু কুচকালেন। মুখটাকে ভীষণ রকম তিক্ততায় ভরিয়ে তুলে চাপা গলায় বললেন,

'তোমাকে তো আমি গোসল করতে দেখলাম না।'

আকিদা হক জবাব দিলেন না। টেবিল থেকে একটা পেয়ারা নিয়ে খেতে লাগলেন মনের সুখে। রুহুল হক চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,

'একটু তো লজ্জা সরম করো। সাতসকালে তোয়ালে ভিজিয়ে মাথায় প্যাচিয়ে নিচে নেমে এসেছো নাটক দেখাতে? তুমি কি নতুন বউ? বুইড়া বয়সে ভীমরতি। এসব ক্রিমিনালগিরি ভাব ছাড়ো। তা না হলে লাত্থি মেরে ওই ফুটা টিনের চালের বাপের বাড়ি দিয়ে আসবো।'

আকিদা হক রুহুল হকের কথা শুনে সাপের ন্যায় ফুসে উঠলেন। ক্যাট ক্যাট করে বললেন, 'বোনের বাড়ি এসে কথা ফুটেছে না?'

'তোমার কথা বন্ধ করার ব্যবস্থা করো না। জিহবায় আগুন লাগিয়ে দিবো।'

আকিদা হক বড় বড় পা ফেলে নিজের জন্য বরাদ্দকৃত ঘরটায় চলে গেলেন। রুমকিকে ঘুম থেকে টেনে তুললেন। উঠতে না চাইলে দু চারটা চর থাপ্পড়ও লাগালেন।

____________________________

ওরা এসেছে গাজীপুর ফাউগান ইকো রিসোর্টে। শুনশান জনমানবহীন রাস্তা পেয়ে গাড়ি একটানে দেড় ঘণ্টার মাঝেই এসে পড়েছে এই রিসোর্টে। আদর আগে থেকেই রুম বুক করে রেখেছিলো। রিসোর্টে পৌঁছেই টিকলি টায়রা এক রুমে চলে গেলো। আদর আর্দ্র আরেক রুমে গেলো। খুব সকালে আদর টিকলিকে ফোন করে জাগালো। ফোনের শব্দে টায়রাও উঠে পড়েছে। ঘুমু ঘুমু চোখে টিকলি কান থেকে ফোন রাখতেই টায়রা বলল,

'কে ফোন করেছিলো?'

'উনি।'

'কি বলল?'

'ফ্রেশ হয়ে বাইরে যেতে বলল দুজনকেই।'

ঘড়িতে দেখলো সাতটা বাজে। টায়রা ক্লান্ত গলায় বলল, 'এতো সকালে?'

'হুম।' টিকলি চোখ কচলিয়ে ফোন সামনে ধরলো। ধরতেই অবাক হয়ে দেখলো মায়ের আট টা কল। টিকলি ভয়ার্ত গলায় বলল,

'আম্মু ফোন দিছিলো।'

টায়রা ঘাড়ে হাত রেখে হাই তুলছিল। টিকলির কথা শুনে হাই তুলা মুখটা হা হয়েই রইল। বিস্ফোরিত নয়ন দুটো মেলে দিয়ে বলল,

'তুই এইবারেও ফোন খোলা রাখছস?'

টায়রা বিরক্তে চোখ মুখ কুচকে আবার বলল, 'মানে, মানুষ এতো বলদও হয়? এক ভুল বারবার করস।'

,

ফাউগান ইকো রিসোর্টটা গাজীপুরের বেশ একটু গভীরে। বন জঙ্গলের মাঝে। দু'পাশে গজারি গাছের বন। মাঝখান দিয়ে চলে গেছে পাকা রাস্তা। রিসোর্টের এক পাশে আছে মাছ ধরার জন্য পুকুর। একপাশে সুইমিংপুল। একপাশে টিনের ঘর। কেউ যদি চায় তবে টিনের ঘরেও থাকতে পারে গ্রামীণ পরিবেশ উপভোগের উদ্দেশ্যে। রিসোর্টে ভেতরে বাইরে হরেকরকম ফলের গাছ। এক পাশে খোলা সবুজ মাঠ। আদর আর টিকলি পাশাপাশি হাটছিলো। হালকা এক ফোটা দু ফোটা বৃষ্টি। আদর প্যান্টের পকেটে হাত ডুকিয়ে হাটতে হাটতে বলল,

'মাথায় উড়না দিন।'

টিকলি বিনাবাক্যে মাথায় উড়না টেনে নিলো। আদর হাটতে হাটতেই প্রশ্ন করলো, 'বাসা থেকে কেউ ফোন দিয়েছিলো?'

'হুম মা দিয়েছিলো। আপনার?'

'হুম। মা ফোন দিয়েছিলো।'

'ধরেছিলেন?'

'হুম। বলেছি, ঢাকার আশেপাশে দুদিনের জন্য এসেছি।'

টিকলি কথা বাড়ালো না। নির্বাকে মন খারাপে হেটে যেতেই আদর বলল, 'বিষয়টা কি আপনার বাবা বেশি বেশি করছে না?'

টিকলি ভ্রু কুচকে তাকালো। আদর বলল, 'না আমার বাবারও দোষ আছে। কিন্তু আপনার বাবা তো ব্যাপারটা শুনতেই চাইছে না। আমাকে ভুলে যেতে বলছে আবার বাড়ি থেকে বের হওয়াও বন্ধ করে দিচ্ছে।'

টিকলি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, 'নাথিং টু ছে।'

'বাস্তব কথার কোনো উত্তর থাকে না।'

টিকল ভ্রু কুটি করে তাকিয়ে বলল, 'আপনার কাছে যেমন আপনার ফ্যামিলির দোষ নেই। তেমনি আমার কাছেও আমার ফ্যামিলির দোষ নেই। আমার বাবার রিয়েক্ট করা স্বাভাবিক। কেউ নিশ্চয়ই তার মেয়ে সম্পর্কে খারাপ কথা শুনতে চাইবে না।'

আদর আর কথা বাড়ালো না। নিশ্চুপ কদম ফেলতে ফেলতে খুব দীর্ঘ একটি শ্বাস ফেলল। টিকলি বলল,

' আমরা হঠাৎ এখানে কেনো এলাম?'

গম্ভীর মুখে আদর জবাব দিলো, 'আপনি তো বলেন আমি আপনাকে সময় দেই না। তাই কালকে সুযোগ পেয়ে দুদিনের ছুটি নিয়েছিলাম। পরে রাতে টায়রার কাছ থেকে সব শুনে মাথায় জেদ উঠে গেলো।'

টিকলি আবারো ভ্রু কুচকে তাকালো। হাটা থামিয়ে দিলো। আদরও থেমে দাঁড়িয়ে খুব নিঃসহায় গলায় বলল, 'আপনার থেকে আমি আলাদা থাকতে পারবো না।'

টিকলি স্তম্ভিত হয়ে শুনলো। কানে যেনো তালা লেগে গেলো। আদর আবারো হাটা ধরলো। মুচকি হেসে টিকলি দৌড়ে গিয়ে আদরের হাত ধরলো।

,

জামিলুর রেজা রাগে থরথর করে কাঁপছেন। আকিদা হক আর রুহুল হক চলে গেছেন ঘন্টা খানেক হলো। এখন বাজে সকাল দশটা। ঘরের মেঝেতে রাগের সাইনবোর্ড হিসেবে কিছু ফুলদানি ভেঙে পরে আছে। জামিলুর রেজা কাউকে ফোন লাগালেন। ওপাশে ব্যক্তি ফোন ধরতেই তিনি হুঙ্কার ছেড়ে বললেন,

'নিজের ছেলেকে সামলে রাখতে পারেন না? কেমন কুলাঙ্গার ছেলের জন্ম দিয়েছেন মশাই?'

আজিম খান খেপে গেলেন। অনেক দিন বাদে জামিলুর রেজার কল পেয়ে তার ভ্রু জোড়া নিতান্তই বিরক্তিতে কুচকে উঠেছিলো। তারউপর স্নেহের ছেলের সম্পর্কে এমন কথা শুনে মাথায় রক্ত চড়ে গেলো।

'মুখ সামলে কথা বলুন।'

'কিসের মুখ সামলে কথা বলবো? আমার মেয়েকে নিয়ে আপনার ছেলে পালিয়েছে। এই আপনার ডাক্তার ছেলে? ডাক্তারের চরিত্র এমন হয়?'

আজিম খান অবাক হলেন। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা স্ত্রীর দিকে কটমট দৃষ্টিতে তাকালেন। তবুও ছেলের পক্ষ হয়ে বললেন,

'আপনার মেয়ে যেতে না চাইলে তো আর আমার ছেলে ধরে বেধে নিয়ে যায়নি। নিজের মেয়ের চরিত্র আগে ঠিক করুন।'

জামিলুর রেজা গলা ফাটানো চিৎকার দিলেন,

'আজিম খান... আপনার মুখ আমি বটি দিয়ে কেটে ফেলবো সাথে আপনার ছেলেকে রামদা দিয়ে কুপিয়ে কুত্তাকে খাওয়াবো।'

'আগে নিজের মেয়ের চরিত্র ঠিক করুন। তারপর কোপাতে আসবেন। প্রেগন্যান্ট মেয়েকে তো গছিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।'

জামিলুর রেজা হাত মুঠো করে রাগ সংবরনের চেষ্টা করলেন। দাঁত কিড়িমিড়ি করে বললেন, 'বানোয়াট কথা বলবেন না।'

'কিসের বানোয়াট? আপনার মেয়ে নিজে আমার ছেলেকে বলেছিলো, সে পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট। এখন আবার আমার ছেলের সাথেই ফষ্টিনষ্টি করছে।'

জামিলুর রেজা হতবাক হয়ে গেলেন। টিকলি বলেছিলো? তবে কি বিয়ে করতে চায়নি দেখেই এই মিথ্যে পথের অবলম্বন? জামিলুর রেজা হুঙ্কার ছেড়ে আবার বললেন,

'আপনি মূর্খ নাকি? পনেরো দিনের কেউ প্রেগন্যান্ট হয়? পড়ালেখা করেন নাই? বাপ-দাদা স্কুলে পাঠায় নাই? যত্তসব অশিক্ষিত। আপনার মতো বাড়িতে আমি মেয়ে বিয়ে দেইনি বলে নিজেকে সৌভাগ্য মনে হচ্ছে। আল্লাহ চোখ খুলে দিয়েছে। খুব শীঘ্রই আমার মেয়ের বিয়ে দিবো আমি।'

জামিলুর রেজা ফোন কাটলেন। আজিম খান জোরে জোরে শ্বাস ফেলে মনোয়ারা খানের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'তোমার ছেলেরা আমার মান সম্মান কিচ্ছু রাখলো না।'

জামিলুর রেজা শায়লা আক্তারের দিকে তাকিয়ে উচ্চস্বরে বললেন, 'পনেরো দিনের মধ্যে আমার মেয়ের বিয়ে দিবো।'

চলবে

Muna hasan, Md zeesahi, Disha moni, Priya halder, Zidan hamid, Afifa Mahmud, Jannat islam and লেখাটি পছন্দ করেছে

avatar
Onu kotha
শুকতারা
শুকতারা
Posts : 56
স্বর্ণমুদ্রা : 1339
মর্যাদা : 10
Join date : 2021-05-26

বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ - Page 4 Empty Re: বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ

Tue Jul 13, 2021 11:25 pm

৪০.
শ্যাতশ্যাতে ভেজা পরিবেশ। পিচ্ছিল উর্বর মাটি। শোনা যায়, গাজীপুরের ভূমি বেশ উর্বর এবং এখানের ফল-ফলান্তির গাছ হয় বিন্যস্ত ভাবে। খেতেও নাকি দারুন মজা! ফাউগান ইকো রিসোর্ট টা বেশ বিলাশবহুল। একেকটা ঘর জাকজমকপূর্ণভাবে সাজানো। চোখ ধাধানো সুন্দর। আর্দ্র টায়রা গেছে রিসোর্টের পাশের পুকুরটাতে মাছ ধরতে। তখন প্রায় বিকেল। আকাশ পরিষ্কার। বৃষ্টি নেই। টায়রা খুব উৎসাহ নিয়ে বড়শি ফেলল। সাথে সাথে আর্দ্রও ফেলল। টায়রা মুখ টানা মেরে বলল,

' দেখাদেখি মুসলমান।'

আর্দ্র ফুসে উঠলো। পরক্ষণেই কাধ ঝাকিয়ে তৃপ্তিকর ভঙ্গিতে বলল, 'আমার বড়শিতেই আগে মাছ উঠবে।'

টায়রা কৌতুক হাসি হাসলো। আদর টিকলি ওদের পেছনেই টেবিলে বসে ছিলো। হাসতে হাসতে টায়রা বলল, 'ওই তোর পেবা দেবর এ কয় কি? নাইছ জোকস।'

আর্দ্রর গা পিত্তি জ্বলে উঠলো। রোষাগ্নি গলায় বলল,

'আমি পেবা? নিজে কি? পেবি! এসব ঠেলাগাড়ি মার্কা শরীর নিয়ে নাকি তিনি মাছ ধরবে। হুহ..সাত মন তেলও পুড়বে না আর রাধাও নাচবে না।'

টায়রা নাক ফুলিয়ে তর্জনী আঙ্গুল তাক করে বলল, 'বাজি?'

টায়রার তর্জনী আঙ্গুল বেকিয়ে দিয়ে আর্দ্র বলল, 'বাজি। যে হারবে সে তিন ঘণ্টা সুইমিংপুলের ঠান্ডা পানিতে থাকবে।'

টায়রা তর্জনী আঙ্গুল ধরে ঝাকিয়ে চোখ মুখ কুকরিয়ে বলে উঠলো, 'শালার হাত নাকি লোহা?'

তৎক্ষণাৎ আর্দ্র চেঁচিয়ে আদরের উদ্দেশ্যে বলল,

'ভাইয়া আমাকে শালা ডাকছে। এখন আমি শালী ডাকলেই তো তুমি বকা দিবা।'

আদর ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ পাকিয়ে তাকাতেই আর্দ্র মিনমিনে কণ্ঠে বলল, 'শালী ডাকলেই কি টিকলি আমার বউ হয়ে গেলো?'

আর্দ্রর মিনমিনে গলায় বলা কথাগুলো টায়রার কানে স্পষ্ট হয়ে লাগলো। সে ছি ছি করতে করতে বলল,

'ভাইয়ের বউয়ের দিকে নজর দেন? শরম লাগে না? চোখের উপর পর্দা লাগান মিয়া।'

'এই, আপনি আর একটা কথা বলবেন আমি ধাক্কা দিয়ে পুকুরে ফেলে দিবো।'

টায়রা হাতের কবজি থেকে হাতা উঠিয়ে এমন এক ভাব নিয়ে বলল, 'দেখি কে ফেলে? কার কত দম? এমন এক সিরিয়াস জায়গায় ল্যাং মারবো না বাপ বাপ করে নিজেই পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে বলবেন, ছেড়ে দে মা কেদে বাঁচি।'

আর্দ্র নাক ছিটকে টিকলি দিকে ঘুরে বলল, 'ইহার মতোন আজব বস্তুকে কি খাওয়ায় মানুষ করছো?'

টিকলি ঠোঁট ভাসিয়ে হেসে বলল, 'আমি মানুষ করতে পারি নাই ভাই। বহুত দুঃখ এই মনে। আপনি মানুষ করেন এবার।'

টায়রা জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস ফেলে টিকলির দিকে রক্তিম চোখে তাকিয়ে থাকতেই হঠাৎ খেয়াল করলো তার বড়শিতে জোড়ালো টান পরেছে। টায়রা সচেতন দৃষ্টিতে বড়শিটাকে হালকা নাড়ালো। বড়শির টান শক্ত হয়ে এলো। টায়রা জোরে বড়শি ধরে টেনে উঠিয়ে নিয়ে আসতেই লাফিয়ে উঠলো। মুখে হাত দিয়ে চিৎকার করে বলল,

'মাই গড! আমি মাছ পাইছি? অবিশ্বাস্য!'

আর্দ্র হতবুদ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল মিনিট খানিক। টায়রা বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসতে হাসতে আর্দ্রর সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলল,

'বাজি কমপ্লিট করেন। তিনঘণ্টা সুইমিংপুলে থাকবেন।'

আর্দ্র করুণ চোখে আদরের দিকে তাকাতেই আদর বলল, 'দাড়ায় আছোস কেন যা। বাজি তো তুই ই দিছিলি।'

আর্দ্র বিরবির করে বলল, 'এমন ভাই থাকার চেয়ে এই ঠেলাগাড়ির মতো শত্রুও ভালো।'

_______________________________

সোফায় বসে পাকোড়া হাতে গোয়েন্দা সিরিজ দেখছিলো নিভা। কলিংবেলের শব্দে রান্নাঘর থেকে মনোয়ারা খান তার বিষন্ন গলা উঁচিয়ে বললেন,

'কে এসেছে মা দেখ তো।'

'দেখছি খালামনি।'

টিভিতে চোখ রেখেই অন্ধের মতো সামনে এগিয়ে গেলো নিভা। দরজা খুলে ঘাড় ফেরাতেই দেখলো নয়ন দাঁত কেলিয়ে তাকিয়ে আছে। নিভা ঘাবড়ে দু'পা পিছিয়ে গেলো। বুকে থু থু দিয়েই ধমক দিলো,

'আপনি কি বারো মাসই হাসেন? হাসি কি আপনার রোগ?'

নয়নের হাসিহাসি মুখটা মিলিয়ে গেলো। নিভা অসম্ভব রেগে পেছনে তাকাতেই দেখলো রাহুল দাঁড়িয়ে আছে মুচকি হেসে। নিভার পরান টা ছলকে উঠলো। অকারণে ভেতর থেকে হাহাকার বেড়িয়ে এলো। এই মুচকি হাসির অসম্ভব সুন্দর গোপন দুঃখে ভরা মুখটা যখন জানবে, তার ছেলেবেলার ভালোবাসা তাকে নয় অনেক আগেই অন্যকাউকে মন দিয়ে বসেছে। তখন সে কি করবে! রাগ করবে? পাগলামি করবে? ভাঙচুর করবে? নাকি মনের গহীনে সমস্ত লুকায়িত কষ্টের সাথে এই কষ্টও পুষে রেখে কষ্টের পাল্লা ভারী করে নিস্তব্ধ একা রাতে নিঃশব্দে কাদবে?

'ভেতরে আসতে পারি?'

রাহুলের কথায় নিভা চমকে উঠলো। অবচেতন মনেই দরজা থেকে সরে দাড়ালো। সম্ভিত ফিরতেই দেখা গেলো তার চোখ ছলছল করে উঠেছে। চারিপাশ ঝাপসা, অস্পষ্ট, মেঘাচ্ছন্ন। ঈষদন্ধকার এই মন বুঝে উঠতে পারে না, নিভা কার জন্য কষ্ট পায়? নিজের জন্য নাকি রাহুলের জন্য? কিন্তু নিজের জন্য কষ্ট পাওয়ার কারণ কি? কোনোকিছুই কি কারণ ছাড়া হয়?

মনোয়ারা খান রান্নাঘর থেকে এসে সোফায় রাহুলকে বসে থাকতে দেখেই ব্যস্ত হয়ে গেলেন। প্রফুল্লচিত্তে বললেন,

'বাবা তুমি? অবশেষে এলে? পায়ের ধুলি পড়লো তাহলে আমার ঘরে?'

রাহুল সৌজন্যে হাসি দিয়ে বলল, 'এসব কি বলে লজ্জা দিচ্ছেন আন্টি? আমি তো আপনাদের ঘরেই থাকি।'

'কি খাবে বলো?'

'কিছু খাবো না আন্টি। ওই বাড়ি ভাড়াটা দিতে এসেছি।'

নয়ন বাড়ি ভাড়া দিতেই মনোয়ারা খান বললেন,

'আরে রাখো পরে দিও। কি খাবে সেটাই বলো। নিভা পাকোড়া বানিয়েছে। তোমাদেরও দেই।'

রাহুল কিছু বলার আগেই নয়ন বলল, 'আন্টি সাথে এক কাপ চা দিলে মোড়ের টং দোকানে গিয়ে চা খাওয়ার সময়টা বেঁচে যেতো।'

মনোয়ারা খান মাথা দুলিয়ে হেসে রান্নাঘরে গেলেন। যেতে যেতে বললেন, 'প্রতিদিন বিকালে আন্টির কাছে এক কাপ চা খাওয়ার আবদারে এসে পরো নয়ন।'

নয়ন মাথা নাড়িয়ে নিভার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসলো। নিভাও উলটে হাসি ফেরত দিলো। কথা বলতে চাইলে দেখা গেলো কোনো কথা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শেষে কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে এক অবাঞ্ছিত কথা বলল নয়ন,

'জানো, প্রতিবার ভাড়া দিতে আমি একাই আসি কিন্তু এবার তোমাকে দেখতে রাহুল এসেছে।'

রাহুল কেশে উঠলো। নিভা অবাক চোখে পানি আনতে চলে যেতেই রাহুল লাত্থি লাগালো নয়নের পায়ে। দাঁত কিড়িমিড়ি করে বলল, 'তুই কি পাগল?'

'পাগল হবো কেনো? তুই নিভাকে দেখতে আসোস নাই?'

'না।'

'তাহলে কেন আসছোস? তোর পায়ে পড়লেও তো জিন্দেগীতে আসোস নাই।'

'আমি উনার সাথে কথা বলতে আসছি।'

নয়ন চোখ ঘুরিয়ে বলল, 'আলটিমেটলি ওই একই কথা হলো।'

'আর একটা কথা বললে তুই মাইর খাবি। চুপ থাক।'

নিভা পানি এনে রাহুলের সামনে ধরতেই রাহুল উঠে দাঁড়ালো। নিভার দিকে তাকিয়ে মৃদুমন্দ হেসে বলল,

'আজ ছাদে গেলেন না যে? অসুস্থ?'

নিভা হালকা হেসে মাথা নাড়ালো। রাহুল আবার জিজ্ঞেস করলো, 'তবে?'

'ওই বাসায় চলে যাবো তো। ব্যাগ গোছাচ্ছিলাম।'

রাহুল চরম অবাক গলায় বলল, 'আপনি চলে যাবেন?'

'জি। কাল সকালে।'

'আবার কবে আসবেন?'

নিভা এক ঝলক তাকালো। অতৃপ্ত চোখদুটো ঘুরতে লাগলো রাহুলের চোখে মুখে। লোকে বলে, চোখ নাকি কখনো মিথ্যে বলে না। রাহুলের চোখ দুটোকে গাঢ় ভাবে পর্যবেক্ষণ করে নিভা দেখতে পেলো, সেই চোখে তার জন্য মায়া, স্নেহ, বন্ধুত্বপূর্ণ আবেগ ছাড়া আর কিছুই নেই। কিছুই না! দীর্ঘশ্বাস বুকের মাঝে টেনে নিয়ে নিভা উত্তর দিলো,

'জানি না। দেখি কবে আসা যায়।'

রান্নাঘর থেকে মনোয়ারা খানের ডাক পরলো। নিভা সেদিকে স্বাভাবিক ব্যস্ত পায়ে হেটে চলে গেলো। তবুও রাহুলের মনে হলো, অস্বাভাবিক! কোথাও কিছু আড়াল হয়ে গেলো। নিভার আজ বিকালে ছাদে যাওয়ার পেছনে ব্যাগ গোছানোর কারণটা নিছকই এক অযুহাত। সে ইচ্ছে করেই যায়নি কেননা ব্যাগ সে রাতেও গুছাতে পারতো। নিজেকে গোপন রাখার চেষ্টা বুঝা গেলো নিভার সকল কার্যকলাপে। কথা বলার ধরণও কেমন যেনো খাপছাড়া ঠেকলো রাহুলের কাছে। 'কি হয়েছে উনার? খারাপ কিছু হয়েছে কি? নাকি চলে যাবেন এজন্য মন খারাপ?' বুকের মাঝে অজস্র ভাবনা-প্রশ্ন নিয়ে রাহুল ম্লান মুখে সোফায় বসলো।

,

দু'ঘণ্টা হয়েছে আর্দ্র সুইমিংপুলে বসে আছে। সুইমিংপুলটা দেখতে দারুন! গিটার শেপ। টায়রা তা দেখেই আপসোস করে বলেছিলো, 'ইশশ..আমার গিটারটা যে কেনো আনলাম না!'

তখন শেষ বিকালের আকাশে কালো মেঘের দল হানা দিয়েছিলো। একটু পরেই নামবে ঝুমঝুম বৃষ্টির সন্ধ্যা। টায়রা সুইমিংপুলের পাশে স্লিপিং চেয়ারে বসে আর্দ্রের দিকে তাকিয়ে দুঃখী দুঃখী গলায় বলল, 'আহারে...কষ্ট হচ্ছে?'

আর্দ্র উত্তর দিলো না। গাল নাক ফুলিয়ে পানির মাঝে ভাসতেই টায়রা এগিয়ে এলো। সুইমিংপুলের সিড়িতে এক পা রেখে চু চু করে আবারো অসহায় গলায় ঠাট্টার ছল বজায় রেখে বলল,

'থাক রাগ করবেন না। যাওয়ার সময় পাঁচটা লজেন্স কিনে দিবো।'

টায়রার কথার মাঝেই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামলো। এই বৃষ্টির মাঝে সুইমিংপুলের ঠান্ডা পানিতে আরো এক ঘণ্টা থাকতে হবে ভেবে আর্দ্রের শরীরে এখনি জ্বর উঠে যাচ্ছে। টায়রা উঠে দাড়িয়ে ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,

'যাক ষোলো আনা পূর্ণ হলো। এবার বৃষ্টিতেও ভিজতে থাকুন।'

ভারী বৃষ্টির প্রকটে টায়রা ভিজে গেছে অনেকটাই। সে তাড়াহুড়ো করে চলে যেতে নিলেই আর্দ্র ওর পায়ে এক টান মেরে ওকে ফেলে দিলো সুইমিংপুলে। টায়রা নাকানিচুবানি খেয়ে রোষানলে জ্বলে উঠলো। আকস্মিক পড়ে যাওয়ায় কিছু পানিও খেয়ে ফেলা হলো। ভিষণ মাত্রায় রেগে সে বলল,

'কি হলো এটা?'

টায়রার মেদ বিহীন কোমড় জড়িয়ে ছিলো আর্দ্রের হাত। টায়রার ভেজা সিক্ত চেহারার দিকে বেশ কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেই আর্দ্র তলিয়ে গেলো। টায়রার কোমড় ছেড়ে ডুব দিয়ে আবার উঠে আসলো। মুখ থেকে হাতরে পানি মুছলো। চুলগুলো পেছনে এলিয়ে দিয়ে চোখ মেলে সম্মুখে তাকালো আবারো। স্নিগ্ধ, কোমল, পানিতে ভেজা অকঠিন, মৃদু তেজি যুক্ত টায়রাকে দেখে হঠাৎ আর্দ্র দিশেহারা হয়ে গেলো। আকাশ ফেটে পড়ছিলো অবিরাম ধারায় জলরাশি তার মাঝে পানিতে ভাসমান একই সাথে তারা দুইজন। আর্দ্রের ঘোর ভাঙলো টিকলির চিৎকারে।

'তুই আবার সুইমিংপুলে কি করিস?'

টায়রা কাদো কাদো গলায় বলল, 'তোর বদমাইশ খাসি দেবর ফেলে দিয়েছে।'

'উঠে আয় আমি তোয়ালে নিয়ে আসছি। বৃষ্টিও পড়ছে। ঠান্ডা লেগে যাবে তো।'

টায়রার কথায় আর্দ্র ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে রইল। কোনো তর্কে বির্তকে না জড়িয়ে চোখ দুটো এক ধ্যানে দেখে গেলো সামনের অপরিসীম সুন্দর শ্যামলা মুখশ্রীর রমণীকে। টায়রা সাতরে পাড়ের কাছাকাছি যেতেই আর্দ্র হাত ধরে টান দিলো। আকস্মিক টানে টায়রা থতমত খেয়ে গেলো। আর্দ্র শক্ত করে টায়রার হাত ধরে বলল,

'এই সুইমিংপুলেই বাকি এক ঘন্টা থাকতে হবে আপনাকে।'

টায়রা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করেও পারলো না। অসহায় দৃষ্টিতে আর্দ্রের দিকে তাকাতেই আর্দ্র চোখ টিপে দিলো। অতঃপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে টায়রা থেমে থেমে প্রশ্ন করলো,

'কিছু কি করছেন?'

আর্দ্র ভ্রু উঁচিয়ে সিরিয়াস মুডে বলল, 'মানে?'

'পানি কি নষ্ট করছেন?'

'পানি নষ্ট করবো মানে?'

'গর্দভ নাকি?'

আর্দ্র একটু ভাবতেই বিস্ফোরিত চোখে টায়রার দিকে তাকিয়ে বলল, 'এতো ফালতু কেন আপনি?'

টায়রা উচ্চস্বরে বলল, 'এখন আমি ফালতু?'

'অবশ্যই।'

'আপনি ফালতু। অসভ্য, ইতর, বেয়াদব দুনিয়ার সমস্ত খারাপ আপনি।'

আর্দ্র টায়রার হাত আরো শক্ত করে ধরে বলল, 'ভেবেছিলাম মাফ করবো কিন্তু না। এবার থাকুন আমার সাথে আর তা নয়তো বাজি বাতিল করুন।'

টায়রার শরীর হিম হয়ে যাচ্ছে। আর কিছুক্ষন থাকলে যেখানে সে পাক্কা অক্কা পাবে সেখানে আরো এক ঘণ্টা থাকা তো বিলাসিতা ভাই! টায়রা নাক ফুলিয়ে বলল,

'ছাড়ুন। মাফ করে দিলাম।'

,

সুইমিংপুল থেকে দৌড়ে ঘর অবধি যেতেই টিকলি আধভেজা হয়ে গেলো। তোয়ালে নিয়ে উল্টো ঘুরতেই দেখলো আদর ভয়ার্ত চোখে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে। টিকলি চোখ দুটোকে কুঞ্চিত করে বলল,

'কিছু হয়েছে ডাক্তার?'

আদর ভয়ার্ত ভাব বজায় রেখেই বলল, 'এভাবে দৌড়ে এলেন কেনো? কোনো সমস্যা?'

টিকলি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আদরের ভয়ার্ত দৃষ্টি দেখে ভীষনরকম ভয় পেয়ে গিয়েছিলো সে। হাতের তোয়ালে টা দেখিয়ে বলল, 'আর্দ্র ভাইয়া টায়রাকে টেনে পানিতে ফেলে দিয়েছে। ওর জন্যই তোয়ালে নিয়ে যাচ্ছিলাম।'

'তাই বলে এতো দৌড় দিয়ে কেউ আসে? পড়ে টড়ে গেলে তখন? পা ভেঙে ফেলে দিতাম।'

আদর খানিকটা রাগী গলায় বলল। টিকলি ভীষণ বড় এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে আদরের মুখোমুখি দাড়ালো। চোখে চোখ স্থির হতেই অভিলাষী চোখ দুটো দ্বারা অতলস্পর্শী হৃদয়ে নিবিড় গলায় প্রশ্ন করলো,

'আপনি কি আমার থেকেও বেশি দূর্বল হয়ে যাচ্ছেন ডাক্তার? দূর্বল হয়ে পড়লেও এই দূর্বলতার কারণ কি?'

আদর স্থিরতাচিত্রে টিকলির ওই গহন চোখে তাকিয়ে থাকলো। টিকলি হীনবল গলায় বলল,

'আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ছি ডাক্তার। আশেপাশের সবকিছু কেমন যেনো বিশৃঙ্খলায় ভরপুর। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই বাবা সব জেনে গেলো। আবার বুঝে উঠার আগেই আমার উপর কড়া রেস্ট্রিকশন আসলো। এরপর হঠাৎ কিছু না ভেবে আপনার সাথে এসে পরলাম। কেনো এলাম কিছুই বুঝতে পারছি না? কিন্তু এখন চিন্তায় আমার মাথা দুলছে। আপনি বুঝতে পারছেন বাসায় গেলে কি হবে?'

আদরের মুখ থেকে তবুও কথা আসলো না। টিকলি তার অগাধ ধৈর্য্য নিয়ে আদরের কলার চেপে ধরলো। নীল শার্টের ভাঁজ করা কলারটা দুমড়ে মুচড়ে গেলো। টিকলির চোখে বিন্দু বিন্দু পানি জমলো। কিছুক্ষণ প্রগাঢ় নিস্তব্ধতা চলার পর গাঢ় গলায় টিকলি বলল,

'কথা বলুন। আমি কেনো একবাক্যে আপনার সাথে এলাম? আমাদের সম্পর্কের নাম কি ডাক্তার? শুধুই প্রেম? ভালোবাসা নয়? কেনো আপনার এতো ইগো? আর পাঁচটা প্রেমিক পুরুষদের মতো আপনি কেনো ভালোবাসি ভালোবাসি বলে মুখে ফেনা তুলতে পারেন না? তবে কি আপনি আমায় ভালোবাসেন না?'

টিকলির কলার চেপে ধরা হাত দুটোর উপর আদর হাত রাখলো। মনোহর চঞ্চল প্রেমময় চোখদুটো ভীষণ টিকলি আসক্ত। পরম যত্ন করা গলায় বলে উঠা হলো,

'আমি আপনাকে এতোটা ভালোবাসি যে ভালোবাসা ভালোবাসি বলে প্রকাশ করা যায় না।'

বাতাস থমকে গেলো। বাইরের তুমুল বর্ষণও স্তব্ধ হয়ে গেলো। নিশ্চল হয়ে এলো পরিবেশ। নিস্তব্ধ হয়ে গেলো টিকলির শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। কষ্টের মতো অলৌকিক অভিনব সুখে ভেসে গেলো টিকলির হৃদয়ছন্দ।

চলবে

Muna hasan, Md zeesahi, Priya halder, Zidan hamid, Arjju khan, Sabbir hosen sumon, Sohag hasan abir and লেখাটি পছন্দ করেছে

Sponsored content

বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ - Page 4 Empty Re: বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ

Back to top
Permissions in this forum:
You cannot reply to topics in this forum